রতনতনু ঘাটী
টিকলি এবার দশে পা দিয়েছে। এবার ক্লাস ফাইভ। ফাইভে উঠেছে বলে মা সেদিন বাবাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘এবার আমাদের মুনুর জন্মদিনটা একটু বড়ো করে করব!’’
মার কথাই ফাইনাল। এবার সরস্বতী পুজোর দিন খুব ঘটা করে টিকলির জন্মদিন পালন করা হল। কালই তো ছিল সরস্বতী পুজো। ওই দিন টিকলি জন্মেছিল বলে ওই সরস্বতী পুজোর দিনটাই টিকলির জন্মদিন।
মাঘ মাস। শীতটা এখনও যাই যাই করে যাচ্ছে না। চারদিকে বাগান ভরতি কত রঙের যে গাঁদা ফুটেছে। হরেক রঙের দোপাটি। শিউলির ডালে এখনও কয়েকটা হলুদ বেঁাটার সাদা ফুল ভোর বেলার কুয়াশা মেখে তাকিয়ে আছে।
ইস, কী বাজে! সরস্বতী পুজোর দিন কারো জন্মদিন পড়ে নাকি?
না না, খারাপ কেন হবে? বাড়িতে প্রতিমা এনে পুজো হয়েছিল এবার। প্রতিবার এমন প্রতিমা এনে পুজো হয় না। এবার টিকলি ফাইভে উঠেছে তো তাই! খুব মন দিয়ে টিকলি ঠাকুরের কাছ পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে মনে মনে বলেছে, ‘ঠাকুর, আমার লিখতে গিয়ে খুব বানান ভুল হয়। বাড়িতে মার কাছে আর স্কুলে আন্টিদের কাছে এই নিয়ে কম বকুনি শুনতে হয় না! তুমি তো সবই জানো। তুমি এবার আমার যাতে বানান ভুল কম হয়, অমন একটা বর দাও!’
ছোটোবেলায় অনেক ছোটোদেরই অমন বানান ভুল হয়। মন দিয়ে শিখে নিলেই তো হল!
ঠিক কথা! তা, সব বারের মতো জন্মদিনের সকালে বাবা-মা মিলে যখন জন্মদিনের আগের দিন সন্ধেবেলা জন্মদিনের মেনু ঠিক করতে বসেন, তখন পাশ থেকে সেমেনু শুনতে শুনতে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। টিকলির মন খারাপের একটাই কারণ, সবই নিরামিষ মেনু ঠিক হয় কিনা। সরস্বতী পুজো বলে ওইদিন মাছ-মাংসের কোনো মেনু রাখা হয় না। এবারও হয়েছিল তাই। তেইশজন বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছিল টিকলি। সঙ্গে কাকু-কাকিমাদেরও। সকলেই এসেছিলেন। খুব হইহই হয়েছিল অনেকটা রাত পর্যন্ত।
বা:, কী মজাই না হয়েছিল টিকলির!
দারুণ মজা! তারপর সকালে উঠে টিকলির মনে পড়ল, এই যা:! এবার তো ‘ম্যাজিকদাদু’কে ডাকা হয়নি। বাবা-মা, এমনকী টিকলি, কারুরই নেমন্তন্ন করার সময় ম্যাজিকদাদুর নামটা এবার মনেই পড়ল না! অবাক হয়ে গেল টিকলি।
এবার কতরকম বই উপহার পেয়েছে টিকলি। সকলেই নানারকম বই দিয়েছেন।
টিকলির বাড়ির একটা না-লেখা নিয়ম আছে। সেনিয়মটা বাবা চালু করেছেন। টিকলির জন্মদিনে বই ছাড়া অন্য কোনোরকম উপহার আনা চলবে না। সকলে তাই বই আনেন। এবারও সকলে কত রকমের যে বই এনেছেন!
ও মা! এ-রকম নিয়মের কথা কই আগে শুনিনি তো? নিয়মটা খুব ভালো আর বেশ মজার!
কাল সরস্বতী পুজোর ছুটি ছিল স্কুলে। আজ রবিবার। কী মজা! আজও স্কুল ছুটি। আলমারির তাকে কাল উপহারগুলো র্যাপার-বঁাধা অবস্থায় মা তুলে রেখেছিলেন। অত রাত হয়ে গেছে বলে একটাও খুলে দেখা হয়নি। টিকলি সব উপহারগুলো নামিয়ে আনল। এক-একটা মোড়ক খুলছে আর আনন্দে মন ভরে উঠছে।
দেবত্রী দিয়েছে ‘বুড়ো আংলা’। আরুণি দিয়েছে ‘ভোঁদড়বাহাদুর’। দেবোপম দিয়েছে ‘যখের ধন’। অনন্যা দিয়েছে ওর প্রিয় কমিকসের বই ‘টিনটিন অন দ্য মুন’।
একটাও হ্যারি পটার পায়নি?
হ্যাঁ, তাও পেয়েছে টিকলি। অনীক দিয়েছে হ্যারি পটারের বই।
আরও কত বই। মোড়কগুলো খুলতে খুলতে হঠাৎ ঘটল এক অবাক কান্ড!
একটা মোড়কের উপর লেখা আছে ‘টিকলির জন্মদিনের উপহার…ম্যাজিকদাদু’। টিকলি তো হাঁ! কী করে এমনটা হল? কাল তো ম্যাজিকদাদু আসেনইনি। আসবেনই বা কেন? তাঁকে তো ডাকাই হয়নি। না নেমন্তন্ন করলে কি কেউ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আসে নাকি?
না, আসে না তো কেউ!
টিকলি মনে করার চেষ্টা করল চোখ বুজে। না, কাল ম্যাজিকদাদু সত্যিই আসেননি! একবার ভাবল, মাকে গিয়ে কথাটা বলে? তারপর কী ভেবে টান মেরে মোড়কটা ছিঁড়েই ফেলল টিকলি। দেখল, খুব সুন্দর একটা নোটবই। কী সুন্দর তার মলাট! টিকলি ভাবল, ম্যাজিকদাদু বই না দিয়ে এবার তবে নোটবই দিয়েছেন? কিন্তু কাল টিকলির বাড়িতে না এসে জন্মদিনের উপহারটা দিয়ে গেলেনই বা কেমন করে? এসব কি ম্যাজিকেই হয়?
ঠিক তাই! তারপর নোটবইটার প্রথম পাতা খুলতেই টিকলি দেখল, লেখা আছে ‘টিকলিকে নবম জন্মদিনের উপহার…ম্যাজিকদাদু’। নীচে যে তারিখ লেখা, সেটা গত বছরের।
এবার টিকলির স্পষ্ট মনে পড়ল, হ্যাঁ, গত বছরই তো তার নবম জন্মদিন ছিল। এখন ঠিক মনে পড়ছে, গত বছর ম্যাজিকদাদুকে নিজে ফোন করে নেমন্তন্ন করেছিল টিকলি। ম্যাজিকদাদু এসেও ছিলেন।
এবার পরিষ্কার বুঝতে পারল টিকলি, এটা তার গত বছরের জন্মদিনেরই উপহার। আজ এক বছর হয়ে গেল, তালেগোলে বইয়ের তাকের একটা কোনায় পড়ে ছিল। খোলাই হয়নি। নোটবইটা খুলে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল টিকলি। কী নরম আর সুন্দর নোটবইয়ের পাতাগুলো। ফাঁকা ফাঁকা করে আবছা নীল কালিতে রুল-টানা। এবারের পাওয়া উপহারের মধ্যেই সাজিয়ে রাখল নোটবইটা। আর মনে মনে ঠিক করল, পরের বার মনে করে অবশ্যই তার জন্মদিনে ম্যাজিকদাদুকে নেমন্তন্ন করবে। পারলে সকলের প্রথমেই নেমন্তন্ন করবে।
উপহারগুলো আলমারিতে তুলে রেখে মাকে বলে টিকলি খেলতে গেল পাশের আমনদের ফ্ল্যাটে। ফিরে এসে খেয়ে-দেয়ে টানা ঘুম দিল টিকলি। তারপর সন্ধেবেলা পড়তে বসে মাকে বলল, ‘‘মা, একটা কথা তোমাকে বলি! এই সুন্দর নোটবইটা গত বছরের জন্মদিনে ম্যাজিকদাদু আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। জানো মা, এতদিন উপহারটা খোলাই হয়নি।’’
মা নোটবইটা নিয়ে উলটে-পালটে দেখে বললেন, ‘‘বা:, খুব সুন্দর নোটবইটা! তুমি ইচ্ছে করলে এই নোটবইতে সময় পেলে তোমার স্কুলের হ্যাণ্ডরাইটিং প্র্যাকটিস করতে পার।’’ বলে মা উঠে কাজে চলে গেলেন।
মার এই কথাটা খুব মনে ধরল টিকলির। কাল স্কুলের হ্যাণ্ডরাইটিংটা এই নোটবইটার পাতায় একবার প্র্যাকটিস করে নিলেই তো হয়! এই ভেবে পেনসিল নিয়ে হাতের লেখা লিখতে বসল টিকলি।
ও মা, সঙ্গে সঙ্গে ঘটল এক অবাক কান্ড!
সবে নোটবইয়ে একটা লাইন লিখেছিল টিকলি; ‘মালিনি নদীর তীরে তপোবনে কণ্যমুনির আশ্রম।’ সঙ্গে সঙ্গে ‘মালিনি’ আর ‘কণ্যমুনির’ বানান দুটো ক্রস চিহ্ন দিয়ে কাটা হয়ে গেল। তার পাশে সঠিক বানান লেখা হয়ে গেল ‘মালিনী’ আর ‘কন্বমুনির’ বানান দুটো। আর তক্ষুনি নোটবইটা কথা বলে উঠল, ‘‘টিকলি, তুমি দুটো বানান ভুল লিখেছ! আমি পাশে লিখে দিয়েছি। তুমি শুধরে নাও।’’
এ-রকম করে এক পাতায় আজ টিকলি সাতটা বানান ভুল লিখেছিল। নোটবইটা সব বানানই লিখে দিয়েছে।
ও মা! নোটবই আবার বানান ঠিক করে দিতে পারে নাকি?
পারেই তো! যদি সেটা ম্যাজিকদাদুর দেওয়া নোটবই হয়।
সেইসব ভুল বানান ঠিক করতে করতে টিকলি স্কুলের হ্যাণ্ডরাইটিং খাতায় পুরো এক পাতা লিখে ফেলল। কথাটা কাউকে বললই না টিকলি।
কথাটা কাউকেই বলল না? এমনকী, মাকেও না?
না। পরদিন স্কুলের আন্টি ‘ভেরি গুড’ দিলেন খাতা দেখে। এই প্রথম স্কুলের খাতায় সব ঠিক বানান লিখে ‘ভেরি গুড’ পেল টিকলি। বানানগুলো টিকলি মন দিয়ে শিখেও রাখল, পরে যাতে বানানগুলো আর কখনো ভুল না হয়।
কিন্তু বানান শেখার কী আর শেষ আছে? পড়ার বইয়ে কত শত বানান টিকলির চারপাশে উড়ে বেড়ায়। তার ক-টাই বা মনে ধরে রাখতে পারে ওইটুকুনি টিকলি!
এরকম বেশ চলছিল। স্কুলে প্রায়দিনই নির্ভুল বানানে হ্যাণ্ডরাইটিং লিখে ‘ভেরি গুড’ পাচ্ছিল টিকলি। একদিন সকালবেলা টিকলি ঘুম থেকে উঠে ভাবছিল, যদি কোনোদিন ম্যাজিকদাদুর বানান শিখিয়ে দেওয়া নোটবইটা হারিয়ে যায়, তখন কী হবে? খুব মনখারাপ হয়ে গেল টিকলির। আর স্কুলে হ্যাণ্ডরাইটিং লেখার খাতায় নির্ভুল বানান লিখে ‘ভেরি গুড’ পাবে না কোনোদিন! সকলে তাকে ফের দুচ্ছাই করতে শুরু করবে?
না, এবার থেকে সেঠিক করল, আর নোটবইয়ের সাহায্য নেবে না। যত কষ্টই হোক, বানান শেখা শুরু করবে এবার থেকে। সন্ধেবেলা পড়তে বসে মনে মনে ঠিক করল, কারো সাহায্য না নিয়েই এবার থেকে সব বানান শিখে ফেলবে টিকলি।
ও মা! টিকলির লেখাপড়ায় খুব সাহস আছে বলতে হবে!
তবে কেমন করে যেন টিকলির মনের এই কথাটা সেদিন টের পেয়ে গেল নোটবইটা। নোটবইটা তো টিকলির মনের কথা পড়তে পারে।
ও মা! মনের কথা আবার কেউ পড়তে পারে নাকি?
সেদিন সন্ধেবেলা পড়তে বসে খুব ঘুম পাচ্ছিল টিকলির। জানলার ওপাশে বাতাবি লেবুর গাছটার গায়ে জড়িয়ে ছিল একটা গোল চাঁদ। সে-দিকেও চোখ গেল না টিকলির। অন্য দিন হলে অঙ্ক ভুলে গিয়ে তাকিয়ে থাকত চাঁদটার দিকে। আর মায়ের বকুনি জুটত কপালে।
তারপর কী ঘটল?
এমন সময় ঘটল এক অবাক কান্ড! স্কুল ব্যাগের পাশে শুয়ে থাকা নোটবইটা ফিসফিস করে বলল, ‘‘টিকলি, আমি নিজে নিজে হারিয়ে যাওয়ার ম্যাজিক জানি। আমাকে এই ম্যাজিকটা শিখিয়ে দিয়েছেন তোমার ম্যাজিকদাদু।’’
টিকলি ঘুম জড়ানো গলায় বলল, ‘‘কী ম্যাজিক? নিজে নিজে হারিয়ে যাওয়ার ম্যাজিক? ও ম্যাজিক আমি শিখতে চাই না। আমি তো মা-বাবা আর দিদুনকে ছেড়ে কোত্থাও যেতে চাই না। তুমি তো নির্ভুল বানান লেখার ম্যাজিকটা জানো! পারলে ওই ম্যাজিকটা শিখিয়ে দাও!’’
নোটবইটা বলল, ‘‘তুমি একটু আগে পড়তে বসে যখন মনে মনে ঠিক করলে, আমার সাহায্য ছাড়াই যত কষ্ট হোক বানান শিখবে, তখনই তোমার ওই ম্যাজিকটা শেখা হয়ে গেছে। এখন তুমি চেষ্টা করো। তোমার আর বানান ভুল হবে না। এবার তোমার কাছ থেকে আমার হারিয়ে যাওয়ার সময় হল।’’
টিকলি জিজ্ঞেস করল, ‘‘তুমি এখন কোথায় যাবে? চারদিকে যে অন্ধকার নেমে এসেছে?’’
নোটবইটা বলল, ‘‘আমার দু-হাতজোড়া অনেক কাজ! যেসব ছেলে-মেয়েরা বানান শিখতে পারেনি, তোমার মতো তাদেরও যে বানান শেখানোর কাজ আমার! আজ তবে আসি!’’
তারপর নোটবইটা উধাও হয়ে গেল অন্ধকারে?
না না। নোটবইটা পড়ে রইল টিকলির স্কুলব্যাগের পাশে। তার ভিতর থেকে শুধু উধাও হয়ে গেল বানান শিখিয়ে দেওয়ার ম্যাজিকটা।
এখন লিখতে গিয়ে টিকলির আর একটাও বানান ভুল হয় না!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন