রতনতনু ঘাটী
সেরাজ্যের নাম বান্ধবদুয়ারি। সকলেই সেরাজ্যের বন্ধু। সকলের জন্যে বান্ধবদুয়ারি রাজ্যের দরজা খোলা। অতিথি হলে অতিথি, সন্ন্যাসী হলে সন্ন্যাসী, মুসাফির হলে মুসাফির, ভিক্ষুক হলে ভিক্ষুক। একবার এ রাজ্যে কেউ এলে তার ফিরে যাওয়ার নিয়ম নেই। তাই অনেক অনেক দিন থেকে ওই বান্ধবদুয়ারি নামটাই চলে আসছে। আর সেই রাজ্যের রাজার নাম রুদ্রশঙ্কর। তিনি প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে কখনো যুদ্ধ করেন না। মিলমিশ করে থাকতে ভালোবাসেন। সাহায্যের জন্যে দরাজ হাত তাঁর। দশ-বিশটা রাজ্যের মানুষ সকাল-বিকেল রাজা রুদ্রশঙ্করের প্রসংশায় পঞ্চমুখ।
সেই রাজার আছে এক রাজপুত্র। তার নাম নির্ভয়কুমার। ছোটোবেলা থেকে তার সাহসের তুলনাই হয় না। তাই রাজপুরোহিত অনেক ভেবে রাজপুত্রের অমন নাম রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাজা রুদ্রশঙ্করকে। রাজামশাই হাসিমুখে সেনামই রেখেছেন রাজপুত্রের।
রাজপুত্র নির্ভয়কুমারের সাহসের গল্প শুনলে সত্যিই অবাক হতে হয়। এবছর সবে মাত্র বারোয় পা দিয়েছে রাজপুত্র। কিন্তু তার চোখে-মুখে টইটই করছে সাহস।
রাজা রুদ্রশঙ্করের পশুপাখিদের নিয়ে একটা বড়ো জঙ্গল আছে। রাজপ্রাসাদ থেকে খানিক দূরে। ঘন গাছপালায় ভরা। শক্ত তারের জাল দিয়ে ঘেরা জঙ্গলটা। জঙ্গলের একটা দিক গিয়ে মিশেছে এ রাজ্যের সবচেয়ে বড়ো জঙ্গলে। কিন্তু জাল দিয়ে ঘেরা বলে এই জঙ্গলের বন্দি পশুরা সেই বড়ো জঙ্গলে যেতে পারে না। রাজপন্ডিতদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজামশাই সেজঙ্গলের নাম রেখেছেন ‘কানন-কুলায়িকা’। সেখানে বাঘ বলো বাঘ, সিংহ বলো সিংহ, হাতি বলো হাতি, কী নেই? সেরাজামশাই রুদ্রশঙ্করের বড়ো আদরের জঙ্গল।
সেখানে রাজপুত্র নির্ভয়কুমার রাজপ্রাসাদের দিকের শক্ত জালের দরজা খুলে একা-একাই কানন-কুলায়িকার ভিতরে চলে যায়। খালি হাতে বাঘের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একবার বাঘটা রাজকুমারকে দেখে হালুম করে তেড়ে এসেছিল। রাজপুত্র নির্ভয়কুমার সপাটে একটা ঘুসি মেরেছিল বাঘটার নাকে। মাথা নেড়ে বাঘকে ভয় দেখিয়েছিল। বাঘটা অমনি পালিয়েছিল গভীর জঙ্গলের দিকে।
একদিন হাত দিয়ে সিংহের কেশরে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়েছিল। অমনি সিংহ থাবা উঁচিয়ে আঁচড়ে দিয়েছিল রাজপুত্রের হাতে। সেনিয়ে গোটা রাজপ্রাসাদে তুমুল হইচই!
আর-একবার একটা দাঁতাল হাতি শুঁড় দুলিয়ে এসে শুঁড়ে তুলে আছাড় মারতে গিয়েছিল রাজকুমারকে। হাতিটার শুঁড় ধরে জোরসে এমন ঝাঁকিয়েছিল, সে-কথা হাতিটা এখনও ভোলেনি। রাজকুমারকে দেখতে পেলেই ঘন ঝোপের আড়াল থেকে হাতিটার বৃংহণ শোনা যায়। রাজকুমার বুঝতে পারে, কানন-কুলায়িকায় থাকার ফলে ওদের মনে এত হিংসন!
একদিন একটা গন্ডার মাথা নীচু করে হুম হুম শব্দে তেড়ে আসছিল। তার উঁচু খড়্গটা ধরে আচ্ছাসে নাড়িয়ে দিয়েছিল রাজকুমার। তখন গন্ডারটার মাথা বনবন করে ঘুরছিল তাল পাতার ঘুরন চরকির মতো। তারপর থেকে সেই গন্ডারটা আর কোনোদিন রাজুপুত্র নির্ভয়কুমারের সামনাসামনি আসেনি। কিন্তু দূরের জঙ্গলে পালাতেও তো পারেনি। পালাবে কোথায়? জাল দিয়ে গভীর জঙ্গলে যাওয়ার পথ যে বন্ধ!
আর একবার হয়েছিল কী, একটা চিতাবাঘ আর নির্ভয়কুমার একটা মাঝারি লম্বা নাগেশ্বর গাছে উঠে দুটো ডালে দু-জনে ঘুমিয়েছিল পুরো একটা দুপুর। পরে রাজকুমারের ঘুম ভাঙতে নেমে এসে লজ্জা লজ্জা মুখ করে সকলকে বলেছিল, ‘‘দুধসাদা নাগেশ্বরের ফুলের গন্ধে ঘুম এসে গিয়েছিল। তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’’
আর একদিন সেএক কান্ড করে প্রাসাদে ফিরল রাজকুমার। কানন-কুলায়িকা থেকে আরও খানিক দূরে একটা অগভীর দিঘি কাটিয়েছেন রাজা রুদ্রশঙ্কর। সেই দিঘির নাম রেখেছেন ‘মকর-দিঘিকা’। সেই দিঘির সঙ্গে নদীর যোগাযোগও আছে জলপথে। তবে তা একটা লোহার জালের দরজা ফেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। নদীর জোয়ার-ভাটা আসে-যায়। তাতে রাজা ছেড়ে রেখেছেন অনেক কুমির। তারা বন্দি থেকে থেকে আরও যেন হিংসুক হয়েছে। ছোটো কুমিরকে বড়ো কুমিরগুলো আর ভালোবাসে না একটুও। দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে রাজপুত্র নির্ভয়কুমার দেখছিল কুমিরদের। এমন সময় দেখল, বড়ো কুমিরটা সব মাছ একাই টপাটপ করে গিলে নিচ্ছে। ছোটো কুমিরদের একটাও মাছ খেতে দিচ্ছে না। তা দেখে সেদিন রাজকুমার তরতর করে দিঘিতে নেমে গিয়েছিল। তারপর সেই বড়ো কুমিরটার চোয়াল ধরে হিড়হিড় করে টেনে তুলে এনেছিল ডাঙায়। রাজকুমার ল্যাজের ঝাপট সহ্য করেছিল মুখ বুজে। তবু কুমিরটার চোয়াল ছাড়েনি। তারপর শক্ত লতা দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে ফিরে এসেছিল রাজপ্রাসাদে। তখন রাজপুত্রের গা-হাত-পা কেটে রক্ত ঝরছে। রাজপুত্রের পোশাক রক্তে লাল। রাজপুত্রের সাহস দেখে কারো মুখে আর রা ফোটেনি সেদিন।
কানন-কুলায়িকার পাশে আকাশ-ছোঁওয়া একটা মস্ত খাঁচা আছে। পন্ডিতদের প্রস্তাব মেনে নিয়ে রাজামশাই তার নাম রেখেছেন ‘গগনগতি-পিঞ্জর’। সেখানে বনের সব পাখিই ছেড়ে রাখা আছে। অনেক দিন খাঁচায় থেকে-থেকে গান গাইতে ভুলে গেছে সব গান-গাওয়া পাখি। কথা বলতে পারে না আর কথা-বলা পাখিও। গাছের ডালের দোলনায় দোল খায় না আর ফিঙে পাখি। রাজপুত্র ভোরবেলা গিয়ে দাঁড়ায় খাঁচাটার সামনে। তখন খুব উদাস-উদাস লাগে রাজপুত্রকে।
২
রাজামশাই রাজসিংহাসনে হেলান দিয়ে হাঁ করে শোনেন রাজপুত্রের সাহসের কথা। শোনেন আর অবাক হয়ে যান। সন্ধেবেলা যখন গোল চাঁদটা দেবমন্দিরের চূড়ার সোনার কলস ছুঁয়ে মুখ তুলে তাকায় রাজপ্রাসাদের দিকে। তখন রাজপুত্র মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রানিমাকে ওইসব গল্প বলে। আর রানিমা গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে শোনেন। তাঁর বুক ভরে যায় গর্বে। রাজ্যবাসী রাজপ্রাসাদ থেকে দূরে বসে সেইসব সাহসের কথা লোকমুখে শোনে। তারপর বলতে বলতে সে-কথা তারা রাষ্ট্র করে দেয় সকলকে। ইতিমধ্যে রাজপুত্র অস্ত্রচালনা শিখেছে। তীর-ধনুক ছোড়া শিখেছে। কুস্তি শিখেছে। যুদ্ধবিদ্যাও শিখেছে। বয়স ষোলো বছর পূর্ণ হলে রাজকুমারের অভিষেক হবে, এরকমই ভেবে রেখেছেন রাজা রুদ্রশঙ্কর। রাজপুত্রের এত যখন সাহস, তখন তার হাতে রাজ্যের ভার তুলে দিতে বাধা কোথায়?
কিন্তু কিছুদিন ধরে সকলে লক্ষ করেছে, রাজপুত্র নির্ভয়কুমার বড়ো উদাসীন। মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। অমন যে সাহসী রাজপুত্র, সেএখন একবারও বাঘের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় না। সিংহের সামনেও না। গন্ডারের সামনে? তাও না। আজ কতদিন হয়ে গেল, নির্ভয়কুমার একবারও কানন-কুলায়িকার সামনে যায়নি। গগনগতি-পিঞ্জরকে চোখেও দ্যাখেনি কতদিন হয়ে গেল। মকর-দিঘিকার পথটাই যেন ভুলে গেছে রাজপুত্র।
হঠাৎ একদিন রাজপুত্র এক কান্ড করল। সেদিন রাজপুত্র নির্ভয়কুমার রাজদরবারে এসে রাজা রুদ্রশঙ্করকে বললেন, ‘‘বাবা, আমার কয়েকটি নিবেদন আছে আপনার কাছে।’’
রাজামশাই আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘‘বলো বাবা, কী তোমার নিবেদন? আমি তা রাখার চেষ্টা করব।’’
রাজপুত্র নির্ভয়কুমার একবার দরবারের চারদিকে তাকাল। মন্ত্রী, রাজপন্ডিত, পঞ্চরত্নসভার পাঁচজন রত্ন, রাজপুরোহিত, সেনাপতি, অমাত্য, নগরপাল, কে নেই? গমগম করছে রাজদরবার।
বিষণ্ণ মুখে রাজপুত্র বলল, ‘‘বাবা, আমাদের কানন-কুলায়িকা থেকে সব বনের প্রাণীকে মুক্ত করে বনে চলে যেতে দিন! অরণ্যে থাকুক অরণ্যচারী প্রাণী। গগনগতি-পিঞ্জর থেকে আকাশে উড়ে যেতে দিন সমস্ত বন্দি পাখিকে। ওদের দিন মুক্তির আনন্দ! মকর-দিঘিকার সঙ্গে নদীর যে জলপথ আছে, তার লোহার দরজা উন্মুক্ত করে দিন বাবা। ওদের সকলকে ফিরিয়ে দিন সমুদ্র-জীবনের আনন্দ!’’
রাজা অবাক হয়ে তাকালেন রাজপুত্রের মুখের দিকে। রাজদরবার একেবারে নিশ্চুপ। কারো মুখ থেকে একটিও কথা সরছে না। গাছের একটি পাতা খসে পড়লেও শব্দ শোনা যাবে।
রাজামশাই বললেন, ‘‘কিন্তু, এসবই তো আমার রাজ্যের গৌরব। এ আমার রাজবংশের অহংকার। এ আমি কেমন করে মুছে ফেলব? তা হলে আমার রাজদম্ভ যে ধুলোয় লুটোবে বাবা?’’
রাজপুত্র নির্ভয়কুমার মাথা নত করে বলল, ‘‘বাবা, এ অহংকার বড়োই ঠুনকো। কাচের প্রাসাদের মতো! মুক্তির আনন্দই জীবনের শ্রেষ্ঠ অহংকার! আপনি পন্ডিতদের, পঞ্চরত্নদের জিজ্ঞেস করুন।’’
তখনও কারো মুখ থেকে একটিও কথা সরল না। না পন্ডিতদের মুখে, না পঞ্চরত্নের মুখে।
রাজকুমার বলল, ‘‘বাবা, আপনার রাজ্যের নাম বান্ধবদুয়ারি! এখানে তো বন্ধন থাকা সমীচীন নয়। আপনি আজ থেকে ঘোষণা করুন, আপনার রাজ্যে মুক্তিই হবে শেষ কথা।’’
রাজামশাই ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘‘তা হয় না রাজপুত্র! আমি রাজবংশের মর্যাদা এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি না!’’
সেদিনের মতো রাজদরবার মুলতুবি হয়ে গেল।
অমন যে সাহসী রাজপুত্র, তার এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় পড়লেন রাজা রুদ্রশঙ্কর। আর তিন বছর পরেই রাজপুত্রের অভিষেক হওয়ার কথা। অনেক ভেবে একদিন রাজজ্যোতিষীকে ডেকে পাঠালেন রাজামশাই।
রাজজ্যোতিষী এসে দাঁড়ালেন মহারাজের সামনে। রাজা রুদ্রশঙ্কর মুখ তুলে তাকালেন। ধীর কন্ঠে বললেন, ‘‘আপনি আমাকে চিন্তামুক্ত করুন জ্যোতিষীমশাই। রাজপুত্র অমন আনমনা হয়ে থাকে কেন? কোনো কিছুতেই যেন মন নেই। অত সাহসী যে রাজপুত্র, সেএখন একবারও কানন-কুলায়িকার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় না পর্যন্ত?’’
রাজজ্যোতিষী কাগজে কীসব আঁক কষলেন। অনেক সময় লাগল তাঁর। তারপর বললেন, ‘‘রাজপুত্রকে উচাটন অসুখে পেয়েছে।’’
রাজামশাই রেগে উঠে বললেন, ‘‘না না, উচাটন নয়, আনমনা অসুখে পেয়েছে বলুন!’’
রাজজ্যোতিষী হেসে বললেন, ‘‘যা উচাটন, তাইই আনমনা রাজামশাই!’’
কথাটা পছন্দ হল না মহারাজা রুদ্রশঙ্করের। হাত নেড়ে চলে যাওয়ার ভঙ্গি করলেন। রাজজ্যোতিষী চলে যেতেই রাজামশাই ডেকে পাঠালেন প্রধান রাজপন্ডিতকে। তিনি এসে অভিবাদন করতে রাজামশাই তাঁকে বললেন রাজপুত্রের সংকটের কথা। উপায় বাতলে দিতে বললেন।
রাজপন্ডিত একটু থমকে থেকে বললেন, ‘‘মহারাজ, রাজপুত্রকে শাস্ত্র পড়াতে বসে আমি দেখেছি, রাজপুত্র আনমনা হয়ে থাকে। রাজপুত্র বারেবারে আমার কাছে বুদ্ধদেবের কাহিনি শুনতে চায়। বুদ্ধদেব ছিলেন ভগবানের দশ অবতারের নবম অবতার। রাজপুত্র বুদ্ধদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের কাহিনি শুনতে চায় আমার কাছে। মনে হয় সংসারের মায়া শুকিয়ে আসছে রাজপুত্রের মধ্যে!’’
রাজামশাই চিন্তিত মুখে জানতে চাইলেন, ‘‘এর বিহিত কী পন্ডিতমশাই?’’
রাজপন্ডিত মাথা নেড়ে চিন্তিতভাবে বললেন, ‘‘এ-রকম অবস্থায় রাজপুত্রের বিবাহবিধানই নিয়ম রাজামশাই! সংসার দিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে রাজপুত্রকে।’’
রাজামশাই মনে মনে বললেন, ‘রাজপুত্রের বয়স এখনও তেরো পূর্ণ হয়নি। এ কী বিধান পন্ডিতমশাই? এখনই বিয়ে দেওয়া কি কাজের কথা হবে?’ রাজপন্ডিতের দিকে তাকিয়ে শুধু বার কয়েক মাথা নাড়লেন।
রাজামশাই রাজপন্ডিতের কথায় আবার ক্ষণিকের জন্যে মনে ভরসাও পেলেন যেন। নিরুপায় রাজামশাই মনে মনে সায় দিলেন রাজপন্ডিতের কথায়। তবে সেকথা মুখে কাউকে বললেন না।
তাই রাজপন্ডিতের পরামর্শ রাজামশাইয়ের মুখ হয়ে রানিমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছোলো না। রাজ্য পরিচালনার সব কথা রানিমাকে বলা নিয়ম নয়। রাজদরবার থেকে ফিরে রাজামশাই বারান্দায় গিয়ে দক্ষিণের বাতায়নের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে রানিমা কাছে গেলেন। খুব নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘রাজামশাই খুব চিন্তার কি কিছু কারণ ঘটেছে? আপনাকে এত বিষণ্ণ দেখাচ্ছে?’’
রাজামশাই রানিমার মুখের দিকে তাকালেন। মনে হয় কালই পূর্ণিমা। ক্ষীরের মতো জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। অমন জ্যোৎস্নায় মানুষের মনের সব বিষাদ মুছে যায়। কিন্তু অমন স্বর্গের মতো জ্যোৎস্নায়ও রাজামশাইয়ের মুখের চিন্তার রেখা সরল না। দূরে কোনো গাছের আড়াল থেকে একটা রাতপাখি ক্র্যা-ক্র্যা করে ডেকে উঠল। যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন রাজামশাই। রানিমার হাত ধরে চললেন শয়নকক্ষের দিকে।
আজ যেন বান্ধবদুয়ারি রাজ্য কোনো বড়ো খবরের জন্যে উন্মুখ। দক্ষিণের বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে তিরতির করে। লতাবিতানে পিটপিট করে ফুল ফুটছে আপন মনে। দিঘি পদ্মে পদ্মে ভরে উঠছে রাতারাতি। মাটি থেকে একরকম মধুর গন্ধ উঠছে, খর গ্রীষ্মে প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধের মতো সেই গন্ধ। নাকি গাছের প্রথম ফোটা চাঁপা ফুলের গন্ধ! কে জানে!
যার ফুলের পাপড়িতে পরাগ রাখার কথা ছিল, সেভুলে গেছে পরাগ রাখতে। এমন নিবিড় নীশিথে তিলতিল করে যার বসুন্ধরাকে সুফলা করে তোলার কথা, সেআজ কাজে আসতে ভুলে গেছে। পাখির চোখে যার ঘুম মাখিয়ে দেওয়ার কথা, সেও আজ কোথায় উধাও। দিঘির জলে জলপিপির চক্কর কাটার কথা মনে পড়ছে না। গাছের কোটর থেকে প্যাঁচা বেরোয়নি তার বাচ্চার জন্যে খাবার খুঁজতে। প্যাঁচানি ঘাড় গোঁজ করে বসে আছে গাছের কোটরে, বাচ্চাদের পালকে জড়িয়ে।
গোটা বান্ধবদুয়ারি রাজ্যের চোখে তেমন করে যেন ঘুম নেই। প্রহরের পর প্রহর রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। রাজদেউলের ঘণ্টা প্রতি প্রহরে বেজে বেজে রাজ্যবাসীকে জানিয়ে দিচ্ছে রাত ক-প্রহর হল। বইতে বইতে মাঝে মাঝে থির হয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোত। এমন সময় একটা লক্ষ্মীপ্যাঁচা রাজপ্রাসাদের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা বড়ো বট গাছটার কোটর থেকে খাবার খুঁজতে বেরিয়ে এল। তার মুখটা চাকার মতো গোল। ধবধবে সাদা রং। দেখতে বেশ লম্বা। গায়ে আবার সাদা রঙের ডোরা। গায়ের রং লালচে। সেএকটা এলিয়েপড়া দক্ষিণী বাবুল গাছের পাতার আড়ালে এসে বসল চুপটি করে। বাবুল গাছের সাদাটে ছোটো ছোটো ফুলগুলো তাকে একরকম মন খারাপ করা বিষণ্ণতায় গ্রাস করে ফেলল। আনমনে বার কয়েক ‘ফোঁস ফোঁস’ করে শব্দ করল। তারপর ঠিক করল, আজ সেকোথাও খাবার খুঁজতে যাবে না। চুপ করে বসে থাকবে সারা রাত।
অমন সময় সেদেখল, একটা জ্যোৎস্না রঙের কিশোর ছায়ামূর্তি রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বাতায়নে পা রাখল। খালি পা। তার পরনে কীরকম পোশাক, তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না এত দূর থেকে। এমন সময় জ্যোৎস্নাও যেন অনেকটা ম্লান। স্পষ্ট হয় না কিছুই। তারপর দেখল, সেই জ্যোৎস্নামূর্তি গিয়ে দাঁড়াল কানন-কুলায়িকার সামনে। তরতর করে ঢুকে গেল জঙ্গলের মধ্যে। পশুদের তখন ঘুমের সময়। কানন-কুলায়িকায় থেকে থেকে পশুদের আর শিকার ধরার গরজ নেই। রাজপ্রাসাদ থেকে রোজ খাবার আসে তাদের জন্যে। তাই রাত জাগার দরকার হয় না। জ্যোৎস্নামূর্তি কানন-কুলায়িকার শেষ প্রান্তে গিয়ে খুলে দিল জঙ্গলে যাওয়ার লোহার দরজাটা।
লক্ষ্মীপ্যাঁচা ভাবল, এই যা:! রাজামশাইয়ের সব পশু যে পালিয়ে যাবে গভীর জঙ্গলে? সেতড়িঘড়ি করে উড়ে গেল রাজপ্রহরীর দরজায়। তাঁকে ডেকে দিতে হবে তো! এ যে বান্ধবদুয়ারি রাজ্যের মহা বিপদ!
লক্ষ্মীপ্যাঁচা গিয়ে বসল রাজপ্রহরীর ঘরের কারনিসে। না, সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না রাজপ্রহরীর। তিনি হয়তো প্রাসাদের অন্য কোনো দিকে প্রহরা তদারকির কাজে গেছেন।
তখনই একদম পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে লক্ষ্মীপ্যাঁচা দেখল, সেই জ্যোৎস্নামূর্তি বাতাসের বেগে ধেয়ে চলেছে মকর-দিঘিকার দিকে। জ্যোৎস্নায় ডানা মেলল লক্ষ্মীপ্যাঁচা। কী হয় দেখার জন্যে সেউড়াল দিল দিঘিকার পাড়ের দিকে। ও মা, গিয়ে তার দু-চোখ স্থির হয়ে গেল। সেই জ্যোৎস্নামূর্তিটা মকর-দিঘিকার নদীর দিকের লোহার জালটা তুলে দিল উপরে। বন্দি যত কুমির আর মাছ ছিল, দিঘিকার জলে আলোড়ন তুলে ছুটে চলল নদীর দিকে, মুক্তির আনন্দে।
কী করবে ভেবে পেল না লক্ষ্মীপ্যাঁচা। তক্ষুনি উড়ল রাজপ্রাসাদে মহারাজার শয়ন কক্ষের দিকে। প্যাঁচা উড়লে তার ডানায় কোনো শব্দ হয় না। নি:শব্দে বারান্দায় বসে ‘ক্র্যাও’ করে একবার ডাকল লক্ষ্মীপ্যাঁচাটা। রাজামশাইয়ের ঘর থেকে কোনো সাড়া ভেসে এল না। দু-বার অমন করে ডাকা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না লক্ষ্মীপ্যাঁচা। যত হোক, রাজামশাইয়ের ব্যাপার! আবার কী থেকে না কী হয়ে যায়! রাজামশাইয়েরও তো ঘুম দরকার চোখে। তাই সাত-পাঁচ ভেবে উড়ল সেই জ্যোৎস্নামূর্তিকে খুঁজতে।
গিয়ে লক্ষ্মীপ্যাঁচা দ্যাখে কী, গগনগতি-পিঞ্জরের দরজা হাট করে খুলে দিচ্ছে সেই জ্যোৎস্নামূর্তি। আর যত বন্দি পাখি উড়ে চলল আকাশের দিকে। লক্ষ্মীপ্যাঁচা এই দৃশ্য দেখে তো থ’! হঠাৎ জ্যোৎস্নায় বড়ো বড়ো করে চোখ মেলে সেদেখল, সেই জ্যোৎস্নামূর্তিটা আর কোত্থাও নেই। না কানন-কুলায়িকায়, না মকর-দিঘিকার পাড়ে, না গগনগতি-পিঞ্জরের পাশে। কখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে মূর্তিটা! ওই জ্যোৎস্নামূর্তিটা কোনো সন্ন্যাসী নাকি? সারাদিন বট গাছের কোটরে বসে অমন অনেক সন্ন্যাসীকে রাজপ্রাসাদে যাওয়া-আসা করতে দেখেছে লক্ষ্মীপ্যাঁচা।
কেমন গা ছমছম করে উঠল লক্ষ্মীপ্যাঁচার। আনমনে বার কয়েক ‘ফোঁস ফোঁস’ করে শব্দ করল! এ যে কী ঘটে গেল তার চোখের সামনে! তারপর তার মনে হল, রাজপ্রাসাদের ব্যাপার! অত সাতে-পাঁচে থেকে কাজ কী? ওদিকে ভোরের পাখি চোখ মেলছে নিজের বাসায়। রাতের ফুল মুখ তুলবে বলে জেগে আছে সকালের অপেক্ষায়। প্যাঁচা ভাবল, রাজপ্রাসাদের ব্যাপারে তার মতো সামান্য একটা পাখির থাকার দরকার নেই। সেতো আর রাজপ্রাসাদের কেউকেটা নয়? তাই বট গাছের কোটরের দিকে ডানা মেলল লক্ষ্মীপ্যাঁচা।
রাজপন্ডিতদের আশ্রম কক্ষের দিক থেকে ভেসে আসছে ভোরের বেদগান। আশ্চর্য দেখতে একটা লাল-হলুদে মেশানো পাখি চুপচাপ মন খারাপ করে বসে আছে অশোক গাছের শুকনো ডালে। রানিমা উঠে পড়েছেন ঘুম থেকে। রাজামশাই তখন শরীরচর্চায় ব্যস্ত। ধীরে ধীরে জেগে উঠছে বান্ধবদুয়ারি রাজ্যটা। এমন সময় রানিমা রাজপুত্র নির্ভয়কুমারের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে লক্ষ করলেন, রাজপুত্রের শয়নকক্ষের দরজাটা হাট করে খোলা। রাজপুত্র পালঙ্কে নেই। এত সকালে রাজপুত্র কোথায় গেল?
আজ কি রাজপুত্র নির্ভয়কুমারের পুরাণ-উপনিষদ পাঠের দিন? নাকি এখন যুদ্ধবিদ্যার মহড়া নেওয়ার সময় হয়েছে? রানিমা মন্ত্রীর কাছ থেকে খবর আনতে তাড়াতাড়ি দাসীকে পাঠালেন।
দাসী এসে জানালো, না, আজ রাজপুত্র নির্ভয়কুমারের বিশ্রামের দিন। রানিমা চিন্তায় পড়লেন। কোথায় গেল রাজপুত্র? খবর পাঠালেন রাজামশাইয়ের কাছে। তারপর রাজকুমারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এই খবরটা মুহূর্তে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল।
এর পর রাজামশাই রুদ্রশঙ্করের কাছে একের পর এক খবর আসতে লাগল। প্রথমে খবর এল, কেউ কানন-কুলায়িকার লোহার জাল খুলে দিয়েছিল রাতে। সব বন্দি বাঘ, সিংহ, হাতি, ঘোড়া, গন্ডার, হরিণ বেরিয়ে জঙ্গলে চলে গেছে। যে লোকটা ছিল কানন-কুলায়িকার দেখভালের দায়িত্বে, তক্ষুনি রাজদরবারে ডাক পড়ল তার।
সেভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়াল রাজামশাইয়ের সামনে। এক্ষুনি হয়তো তার মাথা কেটে নেওয়ার জন্যে কোটালকে আদেশ করবেন রাজামশাই।
তখনই খবর এল, মকর-দিঘিকার নদীর দিকের লোহার দরজাটা কেউ হাট করে খুলে দিয়েছে গভীর রাতে। সব মাছ আর কুমির বেরিয়ে নদীতে চলে গিয়েছে। শুনে রাজামশাই রাগে কাঁপতে লাগলেন। রাজদরবারে ধরে আনতে বললেন মকর-দিঘিকার প্রহরীকে।
সেএসে দাঁড়ানো মাত্রই রাজামশাই কোটালকে রাজদরবারে আসতে আদেশ পাঠালেন। সে-কথা শুনে মকর-দিঘিকার প্রহরী প্রাণভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। মনে ভাবল, আর বুঝি তার প্রাণে বঁাচার কোনো উপায় নেই। তখনই হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নীচু করে রাজদরবারে এসে দাঁড়াল কোটাল।
তার পরই খবর এল রাজদরবারে, গগনগতি-পিঞ্জরের দরজাও কেউ খুলে দিয়েছিল রাতে। সব পাখি উড়ে চলে গিয়েছে নীল আকাশে।
মহারাজ মাথায় হাত দিয়ে এক পলক চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর আদেশ করলেন, ‘‘কে আছ, যাও, গগনগতি-পিঞ্জরের প্রহরীকে বেঁধে আনো এক্ষুনি!’’
একজন প্রহরী গিয়ে তক্ষুনি বেঁধে আনল গগনগতি-পিঞ্জরের প্রহরীকে। সেও ভয়ে হিম হয়ে রাজামশাইয়ের সামনে এসে দাঁড়াল।
রানিমা রাজামশাইয়ের সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদছেন। সকলে ভয়ে কাঁপছে, এই বুঝি রাজামশাই আদেশ দেবেন, মশানে নিয়ে গিয়ে এই তিন প্রহরীর মাথা কেটে ফেলার। কিছুটা সময় চুপ করে থাকলেন রাজামশাই। রাজদরবার নিশ্চুপ। একটু পরে মুখ খুললেন রাজা রুদ্রশঙ্কর, ‘‘আমার রাজ্যে আজ থেকে কোনো পশুপাখি-প্রাণীকে কেউ খাঁচায় বন্দি করে রাখতে পারবে না। মুক্তিই হবে এ রাজ্যের মূল মন্ত্র। রাজপুত্র নির্ভয়কুমার হয়তো সেই মুক্তির খোঁজেই নিরুদ্দেশ হয়েছে।’’
কথা বলতে বলতে গলা বুজে এল রাজামশাইয়ের। জোরে কেঁদে উঠলেন রানিমা।
অমন সময় রাজজ্যোতিষী এসে রাজদরবারের মেঝেতে খড়ি পাতলেন। তারপর নানা হিসেব কষে বললেন, ‘‘রাজপুত্র নির্ভয়কুমার রাত তিন প্রহর শুরুর মুহূর্তে মুক্তির বাণী নিয়ে হিমালয়ের পথে সন্ন্যাসযাত্রা করেছেন।’’
রাজা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘‘কেউ রাজপুত্র নির্ভয়কুমারকে তার নিরুদ্দেশযাত্রা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কোরো না। তার যাত্রা শুভ হোক!’’
সেই থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনো পশুপাখিকে বন্দি করে রাখার নিয়ম নেই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন