সেদিন দৈত্যের গুহায়

রতনতনু ঘাটী

সেদিন দৈত্যের গুহায়

তেপান্তর নামে একটা মস্ত বড়ো দেশ আছে। অন্য অনেক দেশের মতো সেদেশেও অনেক নদী, পাহাড়-পর্বত, ছোটো-বড়ো জঙ্গল আছে। তার মধ্যে একটা আছে গাছপালায় ভরা গভীর জঙ্গল। সেজঙ্গলে অনেকরকম হিংস্র জীবজন্তু যে থাকে না তা নয়। জঙ্গল থাকলে জীবজন্তু তো থাকবেই। সেই জঙ্গলের মধ্যে আছে মিসমিসে কালো পাথরের একটা মস্ত বড়ো গুহা। সেই গুহার মধ্যে থাকে এক বিরাট দৈত্য। দৈত্যদের তো আর মানুষের মতো ঘরবাড়ি থাকে না। ওটাই তার বাড়ি কিনা।

ও বাবা, দৈত্যের ভয় করে না? একলা থাকতে তার ভালো লাগে?

ভালো লাগে বইকী। সেটাই তো তার দেশ! এখন বৈশাখ মাস বলে গাছে গাছে নতুন পাতা ধরেছে। পলাশ ফুটেছে জঙ্গলের গায়ে রং মাখিয়ে। খুব গরম পড়েছে বটে! কিন্তু তাতে কী? বাতাসও তো বইছে ঝড়ের বেগে। মনে হয় একটু পরে কালবৈশাখী নামবে। মেঘের গায়েও কালচে রঙের নৌকো ভেসে বেড়াচ্ছে, এদিকে দুটো তো সেদিকে চারটে। কোনোটা ডিঙিনৌকো, তো কোনোটা পানসি, কোনোটা আবার গাধাবোট।

দৈত্যের গুহাটার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝিমলি নামে একটা আঁকাবঁাকা পাহাড়ি ছোট্ট নদী। ঝিমলি নদীটা ছোট্ট হলে কী হবে, বর্ষাকালে সেজলে সবসময় টইটই করে। আর আছে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো তার খুব স্রোত। কিন্তু এই গরমের দিন এলে সূর্যের আলো গনগন করে গাছপালার মাথার উপর। সেআলো কোনো মতেই জঙ্গলের মাটি ছুঁতে পারে না। তখন সেই ঝিমলি নদী মন খারাপ-করা গরিব মানুষের মতো শুকিয়ে ঠা ঠা করে। সেক-দিন কিন্তু ঝিমলি নদীতে এক ফোঁটাও জল থাকে না। কেয়াপাতার নৌকোও ভাসতে পারে না ঝিমলির ওইটুকুনি জলে।

দৈত্যটা দেখতে কেমন? বইয়ে পড়া দৈত্যের মতোই?

দৈত্যটা দেখতে যেমনই লম্বা, তেমনই আছে তার মুখের দু-পাশে বড়ো বড়ো মুলোর মতো দুটো লালচে দাঁত। আর তার মাথা ভরতি লম্বা লম্বা ঝাঁকড়া চুল। মাথার দু-পাশে ছোটো ছোটো উঁচু দুটো কী যেন চুলের মধ্যে মাথা তুলে আছে। শিং-টিং হবে হয়তো, কে জানে!

তার দাঁত অমন লালচে কেন?

ও মা! দাঁত দুটো লালচে হবে না? সেতো রোজ সকালবেলা উঠে টিকলি-মামনদের মতো দাঁত ব্রাশ করে না। তার না আছে টুথব্রাশ, আর না আছে টুথপেস্ট। দাঁত ব্রাশ না করার জন্যে স্কুলের মিসের কাছ থেকে বকুনিও শুনতে হয় না তাকে। বকুনি শুনবে কেন, সেতো আর স্কুলে পড়তে যায় না। জঙ্গলের মধ্যে আবার স্কুল থাকে নাকি, যে সেপড়তে যাবে?

দৈত্যটা জঙ্গলে গুহার মধ্যে যে থাকে, তার একটুও ভয় করে না?

না, দৈত্যটার গুহার মধ্যে ভয় করবে কেন? দৈত্যদের মনে থাকে খুব সাহস। ওরা কশ্যপের বংশধর কিনা! আর দৈত্যটা কি একা থাকে নাকি?

তবে আর কে কে থাকে তার সঙ্গে?

তার সঙ্গে থাকে তার একটা দৈত্য-বউ। দৈত্য তাকে ডাকে, ‘দৈত্যুনি’ বলে। আর তাদের আছে একটা দৈত্য-ছেলে।

দৈত্যের ছেলেকেও কি দৈত্যের মতোই দেখতে?

দৈত্যের ছেলেকে দৈত্যের মতো দেখতে হবে না তো কি মানুষের মতো হবে? দৈত্যের মতোই দেখতে তাকে।

দৈত্যের ছেলের কি কোনো নাম নেই?

নাম থাকবে না কেন? দৈত্য তাকে আদর করে ডাকে ‘দত্যু’ বলে! দত্যুর বয়স এখন আর কত হবে? গুনেগেঁথে দেখলে সবে মাত্র দশে-টসে পা দিয়েছে বলেই মনে হয়!

এই তো মাত্র আজকেরই কথা! তখন সবে ভোর হব হব করছে। তখনও সকালের রোদ এসে গাছের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়নি। পাখিদের দুটো চোখে তখনও ঘুমের আঠা ঘন হয়ে দুধের সরের মতো জড়িয়ে আছে। সকাল হতে দেরি দেখে গুহার মুখের সামনের আঁধারে সাহস করে দু-একটা জোনাকিও যে উড়ছিল না, তা নয়! অমন সময় একটা ভোরের পাখির ক্র্যাকাও-ক্র্যা ক্র্যাকাও-ক্র্যা ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল দৈত্যুর।

দৈত্যটা কাল সন্ধ্যেবেলা মানুষকে ভয় দেখাতে বেরিয়েছিল। অনেকটা জঙ্গল পেরিয়ে সেগিয়েছিল দূরের একটা গ্রামে। ফিরতে ফিরতে তার রাত গড়িয়ে গিয়েছিল। কতদিন যে দৈত্যটা একজনও মানুষকে ভয় দেখাতে যায়নি! তাই বেশ ক-দিন ধরে তার মনটা ‘কী যেন করা হয়নি’, ‘কী যেন করা হয়নি’ করছিল।

হঠাৎ কাল দুপুরবেলা দৈত্যটার মনে পড়ে গিয়েছিল, আরে কতদিন ধরে তো মানুষকে ভয়ই দেখানো হয়নি!

দৈত্যরা খামোখা মানুষকে ভয় দেখাতে যায় কেন? চুপ করে বসে থাকতে পারে না গুহায়?

মানুষকে ভয় দেখানোও তো তার একটা জরুরি কাজের মধ্যেই পড়ে কিনা। তা, সন্ধেবেলা গ্রামে যাওয়ার সময় সেদত্যুনিকেও ডেকেছিল। বলেছিল, ‘‘চলো না গো! আমরা দু-জনে মিলে গ্রামে গিয়ে আজ কয়েকজন মানুষকে বেদম ভয় দেখিয়ে আসি!’’

দত্যুনি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল, ‘‘আমি-তুমি দু-জনেই চলে গেলে আমাদের দত্যুটার একলা গুহায় থাকতে ভয় করবে না? তুমি কী যে বলো! কালই তো দত্যু বলছিল, ক-দিন ধরে নাকি একটা লোক তীর-ধনুক নিয়ে ঘুরঘুর করছে আমাদের গুহার চারপাশে। কী মতলবে আছে কে জানে! আমার বড়ো ভয় করছে বাপু! মানুষকে একদম বিশ্বাস নেই। কখন যে কী মতলবে ঘোরে!’’

দৈত্য হেসে বলল, ‘‘হ্যাঁ গো দত্যুনি, দেবতা আর মানুষ দৈত্যকে ভয় পাবে, এমন কথাই তো শাস্ত্রে-পুরাণে লেখা আছে গো। এ তো মিথ্য নয়! আমরা হলাম গিয়ে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বংশধর। মহর্ষি কশ্যপ আর দিতির ছেলে হিরণ্যকশিপু। এ কী কম গর্বের কথা! আগেকার দিনে দৈত্যদের কাজই ছিল দেবতাদের যজ্ঞ এবং পুজোর আয়োজন নষ্ট করা। রামায়ণ, মহাভারত আর পুরাণে অমন কত গল্পই না লেখা আছে। আর তুমি মরছ কিনা মানুষের ভয়ে? এ যে দেখি উলটো কথা!’’

দত্যুনিটা মোটেও ভালো না! বড়ো ভিতু টাইপের।

তবে অনেক সময় দত্যুনির কথা ফেলনা বলে মনে করে না দৈত্য। তাই তার কথা শুনে দৈত্যটা একলাই যাবে ঠিক করেছিল। গিয়েও ছিল একলা। খুব রাত করে গুহায় ফিরে এসে দৈত্যটা ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই আজ ভোরবেলা তার আর ঘুম ভাঙেনি।

তার পরই সেদিন দৈত্যের বাড়িতে ঘটল এক কান্ড!

দৈত্যুটা বাবার কাছে গিয়ে গায়ে ঠেলা দিল। ওইটুকুনি দত্যুর পক্ষে অত বিশাল চেহারার দৈত্যকে ঠেলা দিয়ে নড়ানো কি মুখের কথা? দৈত্যর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে দৈত্যু বলল, ‘‘বাবা, পরশু তো আমার জন্মদিন! আর মাত্র একদিন বাকি। আমার মাথার চুলগুলো খুব বড়ো হয়ে গেছে। জন্মদিনের আগে সেলুন-কাকুর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে আমার মাথার চুলগুলো কাটিয়ে আনো না বাবা! তা হলে বেশ দেখতে হয় আমাকে! এ-রকম দৈত্য দৈত্য দেখতে ভালো লাগে না! আমি আমার জন্মদিনে আর কিচ্ছু চাই না বাবা!’’

দৈত্যুর আবদারে ভোরের ঘুমটা এক চটকায় ভেঙে গেল দৈত্যর। তারপর কিছুক্ষণ দু-চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবল। সত্যিই তো, দত্যুর এবারের জন্মদিনের কথাটা তো একদম মনেই ছিল না। দত্যুনিও তো কই দত্যুর জন্মদিনের কথাটা মনে করিয়েও দেয়নি। সেও নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। কী কান্ড!

ছেলের জন্মদিনের কথা সারাবছর ধরেই তো মনে থাকে মায়েদের। দত্যুনি অমনি ভুলে গেল কথাটা?

ধড়ফড় করে ঘুমচোখে উঠে বসল দৈত্য। তারপর কিছুক্ষণ ঠায় হয়ে বসে রইল চুপটি করে। মনে মনে একটা কিছু আইডিয়া খোঁজার চেষ্টা করল। তারপর দৈত্যুনিকে ডেকে কথাটা খুলে বলল দৈত্য। দৈত্য বলল, ‘‘দ্যাখো দত্যুনি, আমাদের একটাই মাত্র ছেলে! কী আবদার করেছে তার জন্মদিনে জানো কি?’’

দত্যুনি চোখ মটকে বলল, ‘‘ও মা! তাই তো! দত্যুর জন্মদিনের কথাটা তো আমার মনেই ছিল। আজই তুমি ঘুম থেকে উঠলে বলব বলে মনে করে রেখেছিলাম! তারপর কখন ভুলেই গেছি!’’ দত্যুনি জানতে চাইল, ‘‘তা দত্যুটা এবার জন্মদিনে কী আবদার করেছে শুনি?’’

দৈত্য আগের মতোই হেসে বলল, ‘‘খুব সামান্যই আবদার! আমরা সেই আবদারটা রাখতে পারব না তা কি হয়?’’

দৈত্যুনি রাগ দেখিয়ে বলল, ‘‘আহা, তুমি বললেই না তো খোকার আবদারটা কী?’’

দৈত্য বলল, ‘‘আমাদের দত্যু সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতে চায়।’’

দত্যুনি গালে হাত দিয়ে অবাক গলায় বলল, ‘‘ও মা, এ কী অলক্ষুনে কথা! আমরা তো মাত্র একগুহা দৈত্য থাকি এ জঙ্গলে। দৈত্যদের জন্যে আলাদা সেলুনের কথা তো কই জন্মেও শুনিনি। তা ছাড়া দৈত্যর ছেলের মাথায় যদি অমন ঝাঁকড়া চুল না থাকে, তবে সেআবার কেমন দৈত্য? হুঁ, দৈত্যর ছেলে যাবে মানুষের সেলুনে চুল কাটাতে? তুমিও যেমন!’’

দৈত্য বলল, ‘‘ছেলে বায়না করেছে যখন, আমি বরং এদিক-ওদিক খানিক ঘুরে দেখে আসি, আশপাশের জঙ্গলে কোথাও দৈত্যদের সেলুন খুঁজে পাই কিনা! না হলে মানুষের চুল কাটার সেলুন একটা-না-একটা খুঁজে তো পাবই!’’

তারপর দৈত্যটা কি জঙ্গলে সেলুন খুঁজতে বেরোলো?

দৈত্যুনি চোখে রাগ এনে বলল, ‘‘ছেলে যা আবদার করবে, সবসময় তা-ই বা দিতে হবে, তা কেন? তুমি ছেলেকে আদর দিয়ে দিনদিন বঁাদর করে তুলছ!’’

দৈত্যটা যেন কানেই তুলল না দৈত্যুনির কথাটা। এমন ভান করল, যেন সেদৈত্যুনির কথা শুনতেই পায়নি। দত্যুকে কাছে ডেকে আদর করে জিজ্ঞেস করল, ‘‘হ্যাঁ রে, দেখি তোর জন্যে কোথাও সেলুন খুঁজে পাই কিনা!’’ বলেই দৈত্য হনহন করে গুহা থেকে বেরিয়ে সোজা গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গেল।

কখন ফিরল দৈত্যটা?

দৈত্য সারাদিন হন্যে হয়ে ঘুরে ঘুরে সন্ধেবেলা ফিরে আসছিল গুহায়। আজ পুর্ণিমা-টুর্নিমা হবে বোধ হয়। জঙ্গলের মাথায় মস্ত বড়ো গোল চাঁদ উঠেছে। গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে আবছা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে গুহার মুখে। দৈত্যুনি আর দত্যু গুহার সামনে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল দৈত্যের জন্যে। দূর থেকে দৈত্যকে আসতে দেখে ছুটে গেল দত্যু। বাবাকে জড়িয়ে ধরিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘‘বাবা, সেলুন-কাকুর দোকানের খোঁজ পেলে?’’

দৈত্যুনিও কাছে এসে জিজ্ঞাসু মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। দৈত্য মুখের উপর ঝেঁপে পড়া চুলগুলো দু-হাতে সরিয়ে হতাশ গলায় বলল, ‘‘কোথাও দৈত্যদের একটাও সেলুন খুঁজে পেলাম না। জঙ্গল পেরিয়ে গ্রামের দিকে যদিও-বা একটা সেলুন পেলাম, সেলুনের লোকেরা আমাকে দেখে দৌড়ে পালাচ্ছিল। অনেক বুঝিয়েবাঝিয়ে দত্যুর আবদারের কথা বললাম। সব শুনে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘এখানে চুল কাটার সঙ্গে চুলে নানা রকমের রংও করা হয়। মানুষ এখন এসবই খুব পছন্দ করে। তা আপনার ছেলে তো এখনকার ছেলেদের মতোই হবে। চুলে কী রং করাবে? লাল, সোনালি, কালো, বাদামি? কী ডিজাইন হবে? কোন রং তার পছন্দ? এসব জেনে আসুন গিয়ে। তারপর না হয় ছেলেকে নিয়ে আসবেন! আর একটা কথা। আপনারা হলেন গিয়ে দৈত্যকুলের লোক। মাথাও তেমনি বড়ো। বড়ো মাথার চুল কাটাতে খরচা বেশি পড়বে কিন্তু, এই আমি আগেভাগে বলে রাখলাম।’’

সব শুনে দৈত্যুনি তার দত্যুর পিঠে আদরে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘‘আমি বলি কী, মানুষ যা সব করে করুক গে। আমরা হলাম গিয়ে দৈত্যকুল। আমাদের দৈত্যের মতোই থাকা ভালো। দৈত্যরা আবার খামোখা মানুষের মতো হতে যাবে কেন?’’

কথাটা তেমন ভুল কিছু কথা নয়।

দৈত্যুনির কথা শুনে সায় দিয়ে ঝাঁকড়া মাথাটা কয়েকবার নাড়ল দৈত্য। তক্ষুনি কী ভেবে দত্যু বলল, ‘‘মা, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি আর কক্ষনো চুল কাটার বায়না করব না। কাল তো আমার জন্মদিন। তুমি বরং রং-কালি মাখিয়ে আমাকে সাজিয়ে দিও মা! আমাকে ঠিক যেন বড়ো দৈত্যের মতো দেখায়!’’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন