রতনতনু ঘাটী
রাজপুত্রের বড়ো একটা মন খারাপ হয় না। কখনো মন খারাপের ভাব এলে, রাজপুত্র মন থেকে তাড়িয়ে দেয়। রাজযোগাচার্য মন খারাপ না হওয়ার জন্যে একটা উপায় শিখিয়ে দিয়েছেন। দিবারাত্রির সন্ধিক্ষণে হরিণ চর্মের আসনে বসে যতক্ষণ পারা যায়, শ্বাস বন্ধ করে ধ্যান করতে হয়।
একদিন রাজপন্ডিত বলে দিয়েছেন, ‘‘মন খারাপ ভীষণ ছোঁয়াচে লক্ষণ। রাজারাজড়াদের মন খারাপ হতে নেই। মন শক্ত করতে হয়।’’
মন খারাপ যাতে না হয়, রাজবৈদ্য তার জন্যে পাঁচন তৈরি করে দিয়েছেন। রাজপুত্রকে সকালে খালি পেটে সেই পাঁচন খেতে হয়। ঘুম থেকে উঠলেই রানি পাঁচন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
অত বড়ো প্রাসাদ। প্রাসাদের চারপাশে নীল জলের পরিখা। বেশ চওড়া। নদী বললেই হয়। অনেকটা কন্ব মুনির আশ্রমের তপোবনের পাশের সেই মালিনী নদীর মতো দেখতে। তাতে রাজহাঁস ভেসে বেড়ায় সারাদিন। তিরতির করে ছোট ছোটো ঢেউ ওঠে জলে। পদ্ম ফুটে থাকে। নীল আর সাদা। শালুক? হ্যাঁ, তাও ফোটে।
রাজপ্রহরীর মেয়েটা। তার ভালো নাম অগ্নিকা। রাজামশাই তার এ নাম রেখেছেন। তার কত আর বয়স? রাজপুত্রেরই মতো। আট কী দশ। সকালে জুঁই ফুটে ঝরে পড়লে সেকুড়িয়ে আনে ফ্রকের কোঁচড় ভরে। রাজপ্রাসাদের চাতালে বসে মালা গাঁথে। নিজের মনে কীসব কথা বলে। রাজপুত্র পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কান পেতে শুনেছে। সেসব হল রূপকথার গল্প। রাজপুত্র ভাবে, মেয়েটা অত রূপকথা শিখল কোথা থেকে? একটু বেলা হলে অগ্নিকা নিজে পরিখা সাঁতরে শালুক তুলে আনে। তারপর পরিখার পাড়ে এসে বসে। ভেজা জামায়। ওর তো কই জ্বর হয় না? তারপর পুটুস পুটুস করে শালুক ডাঁটা ভেঙে ভেঙে মালা গাঁথে। মালা গেঁথে কী করে? গোপালজিউর মন্দিরে গিয়ে পুরুতমশাইকে দেয়। শালুক ফুলে কি গোপালজিউর পুজো হয় নাকি? তবু দেয়।
সকাল বেলা। ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজপুত্র রাজময়দানে যুদ্ধবিদ্যা শিখে প্রাসাদে ফিরে আসে। তখন অগ্নিকা সিংহদরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সেহাত তুলে রাজপুত্রের ঘোড়াটা থামায়। নাকি ঘোড়াটা এমনি এমনি থামে? কে জানে! অগ্নিকা তখন একটা জুঁই ফুলের মালা রাজপুত্রকে ছুড়ে দেয়। রাজপুত্র ঘোড়ার উপরে থাকে বলে ওর হাত কুলোয় না। মালাটা হাতে নিয়ে রাজপুত্র হাসে। কিন্তু অগ্নিকা মালাটা দেয় কেন? গোটা রাজপ্রাসাদে তার বয়সি যে আর কেউ নেই। তাই!
রাজপুত্রের তখনই পলকের জন্যে মন খারাপ হয়। কেন মন খারাপ হয়? অগ্নিকাকে কোনো কাজ করতে হয় না বলে। সেকেমন আপন মনে থাকে। কিন্তু রাজপুত্রের সেউপায় কই? তবু মন খারাপ তাড়িয়ে দেয় রাজপুত্র।
অগ্নিকাকে রাজপন্ডিতের কাছে গিয়ে পড়তে বসতে হয় না। পুরাণ-উপনিষদ ওলটাতে হয় না। শাস্ত্র শিখতে হয় না। অর্জুনের ক-টা নাম, তা মনে রাখতে হয় না। স্বর্গে ক-টা ফুলের গাছ আছে, তাও মনে রাখতে হয় না। অস্ত্র ধরা শিখতে হয়? না। যুদ্ধবিদ্যা? তাও না। ঘোড়ায় চড়া? তাও না। সেসারাদিন রাজপ্রাসাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।
একটু বেলা হলে সেপাখি নিয়ে মেতে ওঠে। একটা হেলে-পড়া ডুমুর গাছ আছে রাজপ্রাসাদের নৈঋত কোণে। সেই ডুমুর গাছের ডালে গর্ত বানিয়েছে একটা বেনেবউ পাখি। সকাল থেকে টুকটুক টুকটুক করে শব্দ করে। অগ্নিকা বেনেবউয়ের বাসার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দ্যাখে। সাদা রঙের তিনটে ডিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। দু-সপ্তাহ পরে ডিম ফুটে পাখি হয়ে উড়ে যাওয়া পর্যন্ত। কেউ তাকে কিছুই বলে না। বলবে কেন? রাজামশাই যে তাকে ভালোবাসেন। রাজামশাই তাকে ভালোবাসেন কেন? রাজামশাইয়ের একটিও যে মেয়ে নেই।
আর-একবার রাজপুত্রের মন খারাপ হয়। যখন রাঙা হয়ে সূর্য অস্তাচলে যায়। কত যে রং ছড়িয়ে পড়ে! আর কী তার চোখ জুড়োনো রূপ! রাজপুত্রের মন খারাপ হয় সূর্য ডুবে যায় বলে, তা নয়। সন্ধের পরে মন্ত্রী-অমাত্যদের নিয়ে রাজসিংহাসন আলো করে বসেন রাজামশাই। চারদিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ঝাড়লণ্ঠন। যে লোকটা ঝাড়লণ্ঠন জ্বালানোর কাজ করে, তার সারাদিনে ওটুকুই কাজ। বাকি দিনটা বসে বসে ঘুমে ঢুলে পড়ে। পাশ দিয়ে কেউ গেলে ধড়ফড় করে চোখ মেলে তাকায়। ভাবে, বুঝি রাজামশাই যাচ্ছেন। রাজামশাইয়ের নগরা জুতোর মসমস শব্দ নেই। রাজপোশাকের জরির ছমছম নেই। কৃপাণের ঝনঝনাৎ নেই। তা হলেও কি রাজা আসেন? লোকটা কী ভাবে কে জানে? তারপর আবার যে কে সেই। ঘুমে ঢুলুঢুলু!
ঝাড়লণ্ঠন জ্বলে ওঠার পর ঝলমল করে ওঠে রাজদরবার। তখন ডাক পড়ে রাজপুত্রের। রাজপুত্রের জন্যে একটা ছোটো রাজবেশ বানিয়ে আনা হয়েছে। রাজ-দরজির কাছ থেকে। কত রঙের জরির কাজ তাতে। তাতে হিরে-মানিকও কম বসানো নেই। সেগুনে শেষও করা যাবে না। মাথার মুকুটটাও দেখবার মতো! রাজপুত্রের আসন রাজামশাইয়ের সিংহাসনের ঠিক পাশে। সন্ধেবেলায় রাজপুত্রকে আসতে হয় কেন রাজদরবারে? রাজ্যপরিচালনা শেখার জন্যে।
তখনই তো মন্ত্রীমশাই নতুন রাজ্যজয়ের পরামর্শ দেন রাজামশাইকে। রাজ্যের সীমান্ত রক্ষার ফিকির বাতলান। অমাত্যরা বসে বসে মাথা নাড়েন। সৈন্যবাহিনী বাড়ানো হবে কিনা সে-কথা রাজামশাইয়ের কানে তোলেন রাজসেনাপতি। তখনও রাজামশাই মাথা নাড়তে থাকেন। রাজপুত্র বসে বসে শোনে সব কথা। চোখ মেলে দ্যাখে।
তারপর রাজামশাই তাঁর সিদ্ধান্ত জানান। এসব শিখতে হয় রাজপুত্রকে। বড়ো হয়ে রাজ্য পরিচালনা করতে হবে তো! রাজপুত্রের মনে হয়, এ কাজটা যুদ্ধবিদ্যা শেখার চেয়ে বেশ কঠিন। মনে হয়, এর চেয়ে দু-একটা রূপকথার গল্প শুনতে পেলে দারুণ হত। ওই কথাটা তার মনে গেঁথে থাকে। রাজারাজড়াদের মন খারাপ হতে নেই।
সিংহদরজার পাশে রাজপ্রহরীর থাকার ঘর। সন্ধেবেলা অগ্নিকা ঘরের নিভু নিভু আলোয় তার ঠাকুরমার মুখ থেকে রূপকথার গল্প শোনে। নিভু নিভু আলো কেন? দূরে যখন ভিন রাজ্যের সৈন্য এসে পড়বে, তারা ঠাহর করতে পারবে না, কোন ঘরটা রাজপ্রহরীর। আক্রমণ করতে গিয়ে দিগভ্রান্ত হবে। মাঝে মাঝে অগ্নিকা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে রাজপুত্রের। কিন্তু উপায় কী?
রাতে সোনার পালঙ্কে শোয় রাজপুত্র। মাথার উপর ময়ূরের পালকের রাজপঙ্খা। ঘরের বাইরে অনেক দূরে বসে একজন পঙ্খাবারি দড়িতে টান দিতে থাকে। সারারাত। সেকিন্তু ঝাড়লণ্ঠন-জ্বালিয়ের মতো ঘুমে ঢোলে না। তখন রাজপুত্র রানিমাকে বলে, ‘‘মা, আমাকে একটা রূপকথার গল্প বলো না!’’
রানিমা রাজপুত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘‘এখন রাজামশাইয়ের ঘুমের সময় যে! তিনি সারাদিন রাজকার্য সেরে এখন ক্লান্ত! এখন একটিও কথা বলতে নেই বাবা!’’
দেখতে দেখতে গোটা রাজপ্রাসাদ নিঝুম হয়ে যায়। শুধু সিংহদরজার মাথার উপরের ক্ষীণ আলোটা টিমটিম করে জ্বলতে থাকে। তার চোখে আর ঘুম আসে না। ঝুপ ঝুপ করে চাঁদ ওঠে ছোটো ছোটো সাদা ফুলে ভরা তেলশুর গাছের মাথায়। সেই ফুলের মায়াময় গন্ধে রাজামশাইয়ের নাক ডাকতে শুরু করে। তখন রানিমার চোখেও তেরো নদী পারের ঘুম! কিন্তু তখনও ঘুম আসে না রাজপুত্রের।
প্রতি প্রহরে প্রহরে রাজপ্রাসাদের চার কোণ থেকে ‘হে-হে-হে হুই-হুই’ করে ডাক ভেসে আসে। প্রহরীরা যে জেগে আছে, রাজ্যবাসীকে জানান দেয়। আর রাজামশাইকে জানান দেয়, রাজপ্রাসাদ সুরক্ষিত। তখন সিংহদরজা থেকে প্রহরীর দল সাড়া দেয়, ‘উ-ই-ই-ই হা:!’ জানান দেয়, তারাও জেগে আছে!
রাজপুত্রের আর রূপকথা শোনা হয় না। মন খারাপ হতে শুরু করে তখন। রাজপুত্র মন খারাপকে তাড়াতে তাড়াতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে সোনার পালঙ্কে।
মন খারাপ হয় কিনা তারও পরীক্ষা দিতে হয় রাজপুত্রকে। এ বছরের পরীক্ষা তখনও হয়নি। রাজামশাই রাজগণৎকারকে ডেকে পাঠালেন। রাজগণৎকার আসতে রাজা বললেন, ‘‘রাজপুত্রের এখনও মন খারাপের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি কেন? কালই ব্যবস্থা করুন!’’
সেই মতো পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রাজপুত্রের শুধু পাঁচনটুকু খাওয়া হল। তারপর না হল যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা। না হল ঘোড়ায় চড়া। সে-দিন রাজপ্রাসাদের একদম কোণের একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল রাজপুত্রকে। তারপর এসে হাজির হলেন রাজযোগাচার্য। প্রথমে তিনি রাজপুত্রের মাথায় হাত রেখে পরীক্ষা করলেন। তারপর দু-একটা ছোটোখাটো প্রশ্ন করলেন। সেই পরীক্ষায় রাজপুত্র পাশ করতে হাসি মুখে চলে গেলেন রাজযোগাচার্য।
এর পর এলেন রাজপন্ডিত। তাঁর হাতে মস্ত উপনিষদ। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বের বর্ণনা করতে করতে লক্ষ করলেন রাজপুত্রকে। কী লক্ষ করলেন তিনিই জানেন। এক-আধটা প্রশ্নও করলেন। রাজপুত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে তিনি বিদায় নিলেন।
এর পর এলেন রাজবৈদ্য। তাঁর ঝোলা থেকে অচেনা গাছগাছড়ার গন্ধে ম-ম করতে থাকল ঘরটি। তিনি ঝিনুকে করে কী একটা গাছের পাতার রস খাইয়ে দিলেন রাজপুত্রকে। পাঁচ মিনিট চুপ করে বসে থাকতে বললেন। তারপর খুশি মনে রাজবৈদ্য চলে গেলেন। এর পর ছুটি হয়ে গেল রাজপুত্রের।
মন খারাপের পরীক্ষার পরে পরেই রাজপুত্র শুনল, অগ্নিকারা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেছে। কেন, চলে গেছে কেন? হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে! কাল যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার পর রাজপুত্র ফিরে আসছিল প্রাসাদে। অমন সময় সিংহদরজার কাছে অগ্নিকা জুঁই ফুলের মালাটা তার দিকে ছুড়ে দিয়েছিল, যেমন করে প্রতিদিন দেয়। তারপর বলেছিল, ‘‘কাল থেকে আর পাবে না!’’
তখন অত মন দেয়নি অগ্নিকার কথায়। রাজপ্রহরীর চলে যাওয়ার কথা শুনে মনে পড়ে গেল রাজপুত্রের। রাজপুত্র শুনল, কাল গভীর রাতে রাজপ্রহরী তার ঘর-সংসার নিয়ে চলে গেছে। কেন, চলে গেছে কেন? কোথায় গেছে? অনেকটা পথ পেরিয়ে, কয়েকটা পাহাড় ডিঙিয়ে দুটো নদী পেরিয়ে আর একটা যে রাজ্য আছে, সেখানে। সেরাজ্যের রাজা মাইনে হিসেবে অনেক বেশি মোহর দেবেন। রাজপ্রহরীকে সেই রাজা বলেছেন, ‘‘আমি তোমার মেয়েকে বিদ্যাপাঠ শেখাব। যুদ্ধবিদ্যাও শেখাব। রাজপ্রহরীর মেয়ে যুদ্ধবিদ্যা শিখবে না কেন?’’
একথা শুনে ছোটো ছোটো অনেকগুলো মন খারাপ এসে ভিড় করল রাজপুত্রের মনে। একটা মন খারাপ, রাজপ্রহরীর মেয়ে অগ্নিকার সঙ্গে তার আর দেখা হবে না। দুটো মন খারাপ, যুদ্ধবিদ্যা শিখে ফিরে আসার সময় অগ্নিকা আর জুঁই ফুলের মালা দেবে না। তিনটে মন খারাপ, অগ্নিকা আর বেনেবউ পাখির ডিম দেখতে যাবে না। চারটে মন খারাপ, অগ্নিকা আর পরিখা সাঁতরে শালুক তুলে এনে মালা গাঁথবে না। পাঁচটা মন খারাপ, সন্ধেবেলা অগ্নিকার আর রূপকথা শোনার সময় হবে না।
এই এতগুলো টুকরো টুকরো মন খারাপ হঠাৎ মেঘ হয়ে গেল। তারপর সেগুলো একসঙ্গে জুড়ে জুড়ে হয়ে গেল একটা বড়ো মন খারাপ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন