আঁকাবাঁকা জলরেখা

রতনতনু ঘাটী

অনেক অনেক দূরে একটা বালির দেশ ছিল। সেই কাঁটা গাছপালাময় মরুর দেশে থাকত এক ছেলে। তারা ছিল বেদুইন। আরব সাগরের কোলের ছোট্ট সেই দেশে ছিল তার বাবা-মা। তাদের একটা উটও ছিল। এক-এক সময় সেবাবার সঙ্গে উটের পিঠে চেপে যেত অন্য এক বালির দেশে। পথে পড়ত এক-একটা মরূদ্যান। বাবা ওকে নিয়ে বসত সেখানে। একটু জিরিয়ে নিত ওরা। তারপর আবার শুরু হত পথচলা। বাবা যে কী কাজ নিয়ে যেত, তার কিছুই বুঝে উঠতে পারত না ছেলেটি। তবু যাওয়ার জন্যে সেবাবার পিছু ছাড়ত না মোটে। আসলে তার আনন্দ ছিল দেশ দেখার আনন্দ।

এক-একবার ওদের ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যেত। এসে দেখত, মা কথাই বলছে না কারুর সঙ্গে। ও বুঝতে পারত মার খুব রাগ হয়েছে। ও গিয়ে মার গলা জড়িয়ে ধরত। মা বলত, ‘‘তুই আমাকে ছেড়ে থাকিস কী করে? তোর কষ্ট হয় না?’’

ও বলত, ‘‘হ্যাঁ গো মা, খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কত যে দেশ দেখতে পাই।’’

মা বলত, ‘‘আমার মধ্যেও কত দেশ আছে, তুই তো দেখতেই শিখলি না। আমার মধ্যে যে দেশ আছে, তুই আর বাবা কোনোদিন সেই দেশে যাসনি।’’

ছেলেটি অবাক চোখে তাকাত মার দিকে। বলত, ‘‘কীরকম সেই দেশ মা?’’

মা শুরু করত, ‘‘সেই দেশ হল এক সমতলভূমির দেশ। সেখানে কত কত সবুজ গাছপালা। কত লতা, ফুল, পাখি। সেখানে নাম-না জানা পাখি এসে গান শুনিয়ে যায়।’’

ও বলত, ‘‘সেদেশে আর কী আছে মা?’’

মা বলত, ‘‘সেদেশে আছে নীল জলের হ্রদ, কত আঁকাবঁাকা নদী।’’

অমনি ছেলেটি বলত, ‘‘নদী কী মা?’’

তখন মা একটু ঢোক গিলে বলত, ‘‘না, নদী নেই। তবে নদী হতে কতক্ষণ? নদী হল এক আঁকাবঁাকা জলধারা।’’

ছেলেটি ছুটত বাবার কাছে। বাবা তখন উটের খাবার নিয়ে ব্যস্ত। বলত ছেলেটি, ‘‘বাবা, নদী কী?’’

বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকত ওর দিকে। তারপর আবার উটকে খাওয়াতে লেগে যেত।

আসলে বাবা তো জানেই না, নদী কী। কেননা, তখনও তো পৃথিবীতে নদী বলে কিছু তৈরিই হয়নি। পৃথিবীজুড়ে ছিল বড়ো বড়ো সাগর। একটাও নদী ছিল না। তবে তার বাবা বুঝত, এই নদী-টদি ওর মায়ের সব কল্পনার জিনিস। আমরা ফিরতে দেরি করেছি তো, তাই ওর মায়ের বুক জুড়ে এত কান্না। নদী আসলে কান্নারই স্রোত।

দিন যায়, মাস যায়, আবার ছেলেটির বাবার সময় হয় উঠের পিঠে চেপে দূর দেশে যাওয়ার। বাবা একদিন তাকে ডেকে বলল, ‘‘তুই আর তোর মা, তোরা এবার বাড়িতেই থাক। তুই মার কাছে না থাকলে তোর মার কষ্ট হয় রে!’’

ছেলেটি বলল, ‘‘কিন্তু আমার যে দেশ দেখা হবে না? কাঁটাগাছের ছায়ায় বসে তোমার সঙ্গে খেজুর ভাগ করে খাওয়া হবে না? আমি তোমার সঙ্গে যাব।’’

বাবা অনেক করে বোঝালো ছেলেকে। বলল, ‘‘এবারটা তো থাক। এর পরের বার যখন যাব, তখন তুই যাবি।’’

সাত-আট বছরের ভ্যাবলা ছেলের চোখ দিয়ে জল গড়াল। ঠোঁটও ফুলে ফুলে উঠল বর্ষার মেঘের মতো। সারা সকাল বাবার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল সে। বালি দিয়ে পাহাড় বানালো, উট বানালো।

দুপুর গড়িয়ে যাই যাই। মা এসে কোলে করে নিয়ে গেল ছেলেকে। চোখের জল মুছিয়ে দিল। মা বলল, ‘‘তোর মধ্যেও একটা নদী আছে!’’

নদী-টদির কথা তার কানে ঢুকলই না। বাবার সঙ্গে দূর দেশে যাওয়াই হয়নি, তার কাছে এর চেয়ে বড়ো দুঃখ আর কী হতে পারে?

প্রায় একমাস কেটে গেল। বাবা তখনও এল না। মা একদিন বিকেল বেলা পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘তোর বাবা এখনও এল না। এত দেরি তো হয় না কোনোবার।’’

ছেলেটি হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘‘ঠিক হয়েছে। যেমন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যায়নি। সেজন্যেই তো বাবার ফিরতে দেরি হয়ে গেল।’’

এ-রকম একদিন সঙ্গের উটের গন্ধ পেল ছেলেটি। হ্যাঁ, এ তো তাদেরই উটের গায়ের গন্ধ। সন্ধে আসি আসি করছে। বাইরে গিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে দেখল সে, বাবা আসছে।

বাবা অনেক খেজুর এনেছে। একটিন বার্লি, প্রায় এক বস্তা গম। ছেলেটার খুব আনন্দ হল। মারও আনন্দ হল খুব। সেদিন আকাশ জুড়ে অনেক বড়ো একটা চাঁদও উঠল।

আবার দিন কাটতে লাগল তাদের। ছেলেটা উটের গায়ে হাত বোলায়। কী ভালো যে তাদের উটটা ছেলেটা ভাবে, সেও একদিন বাবার মতো বড়ো হবে। এই উটের পিঠে চড়ে চলে যাবে দূর দেশে। কত দেশ দেখবে। কত মানুষ। ভাবল, যদি কোনোদিন বড়ো হয়ে সেসুযোগ পেয়ে যায়, তাহলে মার ভেতরের দেশটাও দেখে আসবে। বাবা বলে, ‘‘তোর মা ওসব দেশের কথা, নদীর কথা—সব বানিয়ে বানিয়ে বলে।’’ বাবার কথাটা বিশ্বাস হয় না তার। সত্যিই যদি কিছু না থাকে, সবই কি বানিয়ে বানিয়ে বলা সম্ভব?

ছেলেটা ভাবে, এক চাঁদ-ওঠা সন্ধ্যায় উটের পিঠে চেপে সেও একদিন অনেক খেজুর আর ফল নিয়ে বাড়ি ফিরে মাকে বলবে, ‘‘মা ধরো, দ্যাখো কত জিনিস এনেছি। আমাদের অনেক দিন চলে যাবে এতে। অনেকদিন আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না!’’

ভাবতে ভাবতেই দিন কাটে। আবার বাবার বাইরে যাওয়ার দিন আসে। বালি ভেঙে ভেঙে দূর দেশে যেতে কষ্ট হয় বাবার। কিন্তু কত কিছু দেখা হয়ে যায়। এবার সেবাবার সঙ্গে যাবে, যাবেই।

বাবা এবারও অনেক বোঝালো। অনেক আদর করল মা। কিন্তু ভ্যাবলা ছেলে কিছুতেই ভুলল না। উটের পিঠে বাবার সামনে বসল গ্যাঁট হয়ে।

বেশ ক-টা মরূদ্যান পেরিয়ে এবার গেল অন্য এক বালির দেশে। ফিরতে ফিরতে এবারও দেরি হয়ে গেল তাদের। বাবা উটের পিঠে চেপে আসতে আসতে বলল, ‘‘দেখিস, এবারেও তোর মা খুব রাগ করবে।’’

দেখতে দেখতে উটের পিটে বসেই পেরিয়ে এল কত পথ। বড়ো চাঁদ উঠে মিলিয়েও গেল আকাশে। এক আঁধার নেমে আসা সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে এসে বাবা আর ছেলে দেখল, ঘরে আলো জ্বলেনি। ওরা উটের পিঠ থেকে নামল। কেউ এগিয়ে এল না খেজুরের ঝোলা নিতে। ঘরে ঢুকে দেখল কেউ নেই। সেদিন সারা সন্ধে আর সারারাত ধরে বাবা মাকে খুঁজে বেড়ালো। ছেলেও বাবার পিছু পিছু অনেক খুঁজল মাকে। কোথাও পাওয়া গেল না মাকে!

দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীরা ছেলেটাকে আড়াল করে তার বাবাকে কীসব বলল। সব শুনে বাবার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল কি না, অত দেখার সময় হল না ছেলেটার। সেচোখ মুছল হাতের উলটো পিঠে। বাবা ছেলের হাত ধরল।

বাড়ি ফিরে ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘মা কোথায় গেছে বাবা?’’

ছেলেটা বলল, ‘‘চলো না বাবা, আমরা উটের পিঠে চেপে সেদেশে যাই। গিয়ে মাকে ফিরিয়ে আনি।’’

বাবা একটু সময় চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘‘তোর মা সবাইকে বলে গেছে, তুই যদি কোনোদিন আঁকাবঁাকা জলধারার এক নদী তৈরি করতে পারিস, আর সেই নদীর জলে ফুল ভাসিয়ে দিস, তাহলে তোর মাকে ফিরে পাবি।’’

ছেলে বলল, ‘‘তুমি তো বলতে, সেসব মা-র মনের কথা। আমি তাকে সত্যি করব কী করে?’’

বাবার গলা গম্ভীর শোনালো, ‘‘তোকে পারতেই হবে খোকা।’’

তারপর দু-চারটে মাস কাটতে-না-কাটতেই ছেলেটার বাবা মারা গেল কী এক অসুখে। সেনাকি এক মরুভূমির অসুখ। সেঅসুখ হলে আর কেউ বঁাচে না। একা হয়ে গেল ছেলেটা।

তার পরদিন উটের পিঠে চেপে এক সাগরের পারে গেল সে। এক কাঁটাগাছের ছায়ায় উটকে বেঁধে রেখে বসল সে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিধারার মতো কাঁদতে লাগল সে। নির্জন, কেউ কোথাও নেই। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে এক-একটা করে দিন ফুরোতে লাগল। একদিন সাগরের একটা উঁচু ঢেউ এসে বলল, ‘‘এই ছেলে, কাঁদছ কেন?’’

ছেলেটি বলল, ‘‘আমার একটা আঁকাবঁাকা জলের নদী চাই, তুমি একটা নদী দেবে?’’

ঢেউটা বলল, ‘‘তোমার বায়না তো ভারি অদ্ভুত। যে জিনিস পৃথিবীতে নেই, সেই জিনিসই তোমার চাই?’’

ছেলেটি বলল, ‘‘হ্যাঁ, আমার নদীই চাই।’’

ঢেউটা অনেকটা পিছিয়ে গেল। আবার পলকে ছেলেটির কাছে এসে বলল, ‘‘নদী দিয়ে কী করবে তুমি?’’

ছেলেটি বলল, ‘‘আমার মা রাগ করে চলে গেছে। বলে গেছে, আমি যদি কোনোদিন একটা নদী তৈরি করতে পারি, এবং নদীর জলে ফুল ভাসাই, তা হলে আমার মা ফিরে আসবে।’’

ছেলেটার কথায় বুঝি মন ভরল ঢেউয়ের। বলল, ‘‘ঠিক আছে। আমার একার কথায় তো কিছু হবে না। যাই, গিয়ে ঢেউদের ডেকে বলি। তুমি বরং ততক্ষণ মরূদ্যানে গিয়ে ফুল পাড়ো।’’

চোখের জল মুছে উটের পিঠে চেপে ছেলেটি চলল মরূদ্যানের দিকে। ফুল পাড়া হতেই ছেলেটা পেছন দিকে শুনল, কলকল শব্দ। পেছন ফিরে দেখল, সমুদ্রের বড়ো ঢেউগুলো ছোটো হয়ে জলধারার মতো এগিয়ে এসেছে মরূদ্যানের কাছে।

ছোটো ঢেউগুলো ছেলেটাকে বলল, ‘‘এই নাও। আমরা হলাম তোমার নদী।’’

আনন্দে চকচক করে উঠল ছেলেটার দুটো চোখ। হাতের ফুল ভাসিয়ে দিল নদীতে।

সেই শুরু পৃথিবীতে সাগর ভেঙে ভেঙে নদী তৈরি হওয়া।

এখন ভূগোল বইয়ে তোমরা যে হাজার হাজার নদীর কথা পড়ো, আর মাঝে মাঝে সেই নদীতে যখন ফুলপাতা ভেসে আসতে দ্যাখো, তখন জেনো, সেই ভ্যাবলা ছেলেটা এখনও তার মাকে খুঁজে চলেছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন