রতনতনু ঘাটী
সেএমন এক রাজ্য, সেই রাজ্যের রাজা কখনো যুদ্ধে হারেন না। অন্য রাজ্যের রাজসিংহাসনের পায়ের কাছে কখনো মাথার রাজমুকুট খুলে রাখতে হয়নি কোনো দিন। সেরাজ্যের নাম বিজয়মন্ডল। সেরাজ্যের দু-জন রাজা। দু-জনেই রাজ্য শাসন করেন। বড়ো রাজার নাম জগজ্জয়ী। আর ছোটো রাজার নাম দিগ্বিজয়ী। এক রাজ্যে দু’জন রাজা? এ তো অবাক কান্ড। এক রাজ্যের দু’জন রাজা থাকলে কোনো সমস্যা হয় না কি? না, হয় না।
ওঁদের বাবা রাজা ভুবনজয়ীর বয়স যখন এক-শো ছুঁইছুঁই, তখন একদিন অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘আমার মৃত্যুর পর দুই ছেলেই আমার রাজ্যের রাজা হবে।’’
মন্ত্রী-অমাত্য-পারিষদ অবাক হয়ে রাজা ভুবনজয়ীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘সেকেমন করে হবে রাজামশাই? এ-রকম তো কখনো কোনো রাজ্যে ঘটেনি?’’
রাজা ভুবনজয়ী হেসে বলেছিলেন, ‘‘অন্য রাজ্যে যা ঘটেনি, তা আমার রাজ্যে ঘটবে না এমন কোনো কথা আছে কি? সব রাজ্যই তো যুদ্ধে পরাজিত হয় আমার কাছে? বিজয়মন্ডল রাজ্যের ইতিহাসে পরাজয়ের কথা একবারের জন্যেও লেখা হয়নি। বিজয়মন্ডল রাজ্যে যা ঘটবে, সেটাই হবে নিয়ম। আমি চাই, আমার দুই রাজপুত্রের একসঙ্গেই একই দিনে অভিষেক হোক।’’
হয়েছিলও তাই। রাজা ভুবনজয়ী মৃত্যুর আগে নিজের হাতে দুই রাজপুত্রের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন অভিষেকের দিন। তারপর থেকে বিজয়মন্ডল রাজ্যে দু-জন রাজা। বড়ো রাজা জগজ্জয়ী। তিনি যুদ্ধবিদ্যায় পটু। ছোটো রাজা দিগ্বিজয়ী। তিনি রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ।
একদিন মহা ধুমধাম করে দুই রাজার একই দিনে বিয়েও হয়ে গেল। তখন রাজা ভুবনজয়ী আর বেঁচে নেই। কয়েক বছর আগে তিনি পরলোকগমন করেছেন। তবু বিয়ের অনুষ্ঠান আর অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়নে সমারোহের কোনো ঘাটতি চোখে পড়ল না রাজ্যবাসীর। ভিন রাজ্যের মানুষেরও চোখ ধাঁধিয়ে গেল অভিষেকের আড়ম্বর দেখে।
এখন বিজয়মন্ডল রাজ্যের দুই রানি। রাজা জগজ্জয়ীর রানিই হলেন বড়ো রানি। তাঁর নাম গুঞ্জামালা। তিনি সাজতে ভালোবাসেন। রোজ বিকেলবেলা ন-জন দাসী মিলে চারদিকে গোল হয়ে তাঁকে সাজাতে বসে। কোনো দাসী সামনে উবু হয়ে বসে নাকে পরিয়ে দেয় সোনার বেশর, তো কোনো দাসী গলায় পরিয়ে দেয় অর্ধচন্দ্রাকার সোনার হাঁসুলি। কেউ গলায় পরিয়ে দেয় একাবলী, তো কেউ পরিয়ে দেয় সোনার মাঝে হিরে বসানো সাতনরি। কেউ রানি গুঞ্জামালার পাশে বসে তাঁর হাতে পরিয়ে দেয় রতনচূড়, তো কেউ পরিয়ে দেয় হিরে দিয়ে গাঁথা চোখ জুড়নো বাজুবন্ধ। কোনো দাসী পিছনে বসে খোঁপায় পরিয়ে দেয় মুক্তো বসানো সোনার কবরীভূষণ। কেউ হাতে পরিয়ে দেয় সোনার অঙ্গদ, তো কেউ পরিয়ে দেয় কোমরে মণি-মুক্তোর কিঙ্কিণী।
রানি গুঞ্জামালা একটু নড়েনও না, চড়েনও না। পুতুলের মতো স্থির হয়ে বসে থাকেন। গয়নার ভারে নড়তে- চড়তেও পারেন না। তবু সাজতে সাজতে তাঁর মন কানায় কানায় ভরে ওঠে আনন্দে। তৃপ্তি চলকে পড়ে তাঁর মুখশ্রী থেকে। কখন বিকেল গড়িয়ে পুব আকাশ আলো করে সূর্য ডুবে যায় অস্তাচলে। ক্ষীরের মতো পূর্ণিমা চাঁদ মুখ তোলে মহানিম গাছের মাথায়, সে-দিকে তাঁর খেয়ালই থাকে না।
আর রাজা দিগ্বিজয়ীর রানি হলেন ছোটো রানি। তাঁর নাম লাজবন্তী। তিনি ভোরবেলা থেকেই রাগরাগিণী নিয়ে বিভোর হয়ে থাকেন। একটা বড়ো ঘরের সারা মেঝেতে পলাশ ফুলের রঙের মলমলের গদি বিছোনো থাকে। ঘরের মাঝের নকশা-করা স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো থাকে বল্লকী, তো আর-এক দিকে দাঁড়া করানো থাকে রুদ্রবীণা। এক দিকে মলমলের উপর পাখোয়াজ শোয়ানো থাকে, তো আর-এক দিকে শোয়ানো থাকে ত্রিতন্ত্রী। এক দিকে কঙ্কমালা, তো আর-এক দিকে মঞ্জিরা। ওদিকে খত্তাল, তো এদিকে বিষাণ। সামনে ঘণ্টিকা থাকে, তো পিছনে মহাশঙ্খ। তিনি সারাদিন গানে আর সুরের তরঙ্গে বিভোর হয়ে থাকেন। নাওয়া-খাওয়ার কথা তাঁর মনেই থাকে না।
এবছর বড়ো রানি গুঞ্জামালা সাধ করে রূপ-হলুদ ব্রত পালন করবেন বলে ঠিক করেছেন। তাঁর ইচ্ছে, তিনি যেন আরও রূপবতী হয়ে ওঠেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, গোটা রাজ্যবাসী তাঁর রূপের প্রশংসা করুক। সেইমতো চড়ক সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু হয়েছে তাঁর এই ব্রত পালন। চলবে বৈশাখ সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত। এ সময় তাঁর নাওয়া-খাওয়ার কথা কিছুই মনে থাকছে না। এ-রকম চার বছর ধরে বড়ো রানি রূপ-হলুদ ব্রত পালন করবেন বলে স্থির করেছেন। এটাই নিয়ম।
দু-জন রানির এমন আত্মহারা ভাব দেখে মহা চিন্তায় পড়েছেন দুই রাজা। ক-দিন আগে রাজপুরোহিত রাজসভায় এসে বলে গেছেন, ‘‘মহারাজদ্বয়গণ, এখনও আপনাদের কারো সন্তানাদি হল না। কে গ্রহণ করবে এই বিপুল রাজ্যভার, ভেবে দেখেছেন কি?’’
বড়ো রাজা জগজ্জয়ী রাজপুরোহিতের কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে তাকালেন রাজসভার দিকে। যুদ্ধবিদ্যা নিয়ে এতদিন এমনই মেতে ছিলেন যে, এমন কথা আগে কখনো মনে পড়েনি তাঁর।
ছোটো রাজা দিগ্বিজয়ী রাজ্য পরিচালনা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন, এত বড়ো একটা কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলেন! তিনি এখন ধীরভাবে মাথা নাড়লেন তিনবার।
বড়ো রাজা জগজ্জয়ী অন্তঃপুরে গিয়ে রানি গুঞ্জামালাকে বললেন রাজপুরোহিতের কথা। রানি মন দিয়ে শুনলেন বটে। তবে তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘‘না মহারাজ, এখন ওসব নিয়ে আমার ভাবার মতো সময় নেই। আমি এবছর রূপ-হলুদ ব্রতপালন করতে শুরু করেছি। চার বছর ধরে চলবে আমার এই ব্রতপালন। তারপর হয়তো ভেবে দেখার সময় পাব!’’
বড়ো রাজা মনমরা হয়ে বসে রইলেন কারুকার্যময় বুরুজের দিকে তাকিয়ে।
ছোটো রাজা দিগ্বিজয়ী সেদিনই সন্ধ্যায় রাজঅন্তঃপুরে গিয়ে রানি লাজবন্তীকে বললেন রাজপুরোহিতের কথা। ছোটো রানি সব কথা শুনে হেসে বললেন, ‘‘আপনারা দুই রাজা পরে কার হাতে তুলে দেবেন এই বিরাট রাজ্যভার, সেও তো খুব দরকারি কথা!’’
দেখতে দেখতে দশ মাস এগিয়ে এল। রাজসরোবরের জল আলো করে ফুটল কত ইন্দিবর ফুল। নীল রঙে ভেসে গেল চারদিক। তারপর কোজাগরী পুর্ণিমার দিন ছোটো রানি লাজবন্তীর কোলজুড়ে এল এক পুত্রসন্তান। হাসি ফুটল রাজা দিগ্বিজয়ীর মুখে। আনন্দের বান ডাকল যেন রাজপ্রাসাদ জুড়ে। সে-সংবাদ পৌঁছে গেল প্রজাদের বাড়িতে বাড়িতে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সকলে। রাজ্য জুড়ে রাজ্যের প্রজারা গান গাইতে গাইতে ফুল ছড়াতে লাগল রাজপথে রাজপথে। রাজপুরোহিত সেই রাজপুত্রের নাম রাখলেন ‘কোজাগরকিরণ’।
কেউ বলল, ‘‘এ যে বড্ড কঠিন নাম হল রাজপুত্রের!’’
কেউ বলল, ‘‘আর একটু সহজ নাম কিছু পাওয়া গেল না পুরোহিতমশাই? দেখুন না পুঁথিপত্র ঘেঁটে!’’
রাজপুরোহিত গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘রাজপুত্রের নাম তো এমনই হওয়া উচিত।’’
কেউ আর রাজপুরোহিতের কথার উত্তর খন্ডন করতে এগিয়ে এল না। রাজপুত্রের নাম প্রজাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল।
যথাসময়ে একদিন অন্নপ্রাশনও হয়ে গেল রাজপুত্র কোজাগরকিরণের। কত লোক এল রাজপুত্রের মুখেভাতের অনুষ্ঠান দেখতে। কত মানুষ পেটপুরে খেল চৌষট্টি ব্যঞ্জন দিয়ে সেই জাঁকজমকপূর্ণ মধ্যাহ্নভোজ। সাধুসন্ন্যাসী, ফকির-দরবেশ, সকলের মুখ পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠল।
এর পর তিন বছর বয়স পেরোনোর পরই শুরু হয়ে গেল রাজপুত্র কোজাগরকিরণের শিক্ষা। কখনো লেখাপড়া, কখনো শাস্ত্রপাঠ, কখনো মল্লযুদ্ধের মহড়া, কখনো তরবারিচালনা, কখনো ঘোড়ায় চড়া। কিন্তু সকলেই দেখলেন, রাজপুত্রের কোনো কিছুতেই যেন মন বসছে না। দেখতে দেখতে সমস্ত গুরুদেব অভিযোগ নিয়ে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়ালেন মহারাজা দিগ্বিজয়ীর দরবারে।
রাজা দিগ্বিজয়ী সকলের অভিযোগ মন দিয়ে শুনলেন। মুখ ভার হয়ে গেল তাঁর। চোখে চিন্তার কালো মেঘ। সেদিনের মতো রাজদরবার বন্ধ বলে ঘোষণা করলেন। তারপর চিন্তিত মুখে ফিরে গেলেন অন্তঃপুরে।
রানি লাজবন্তীর কানেও কথাটা পৌঁছে গিয়েছিল বিকেল বিকেল। তিনি রাজা দিগ্বিজয়ীর সামনে কাতর কন্ঠে জানতে চাইলেন, ‘‘মহারাজ, এর বিহিত কী?’’
রাজা দিগ্বিজয়ী রানির কথার উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘‘কাল সকালে আমি সভাপন্ডিতদের দরবারে ডেকেছি। তাঁদের খুঁজে বের করতে বলেছি কী এর বিধান? কী করলে এবার থেকে মন বসবে কোজাগরকিরণের শাস্ত্রপাঠে, লেখাপড়ায়? কী করলে কৌতূহলী হয়ে উঠবে অসিচালনায়? কী করলে মল্লযুদ্ধে আর শিহরিত হয়ে উঠবে না রাজকুমার? কী করলে ঘোড়ার পিঠে চড়তে গিয়ে আর দু-চোখ ভিজে উঠবে না রাজপুত্রের? দেখি তাঁরা আগামীকাল কী বিধান দেন!’’
ঘুম আসি আসি করেও আসতে দেরি করল রানি লাজবন্তীর দু-চোখে। পালঙ্ক থেকে নেমে পাশের কক্ষে গিয়ে দেখে এলেন কোজাগরকিরণকে। রাজপুত্র ঘুমিয়ে পড়েছে! রাজা দিগ্বিজয়ী একবার পায়চারি করলেন অন্তঃপুরে, ফের এসে পালঙ্কে আধশোয়া হয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। ফের পায়চারি করলেন। দেখতে দেখতে সকালবেলার কুঁড়ি মুখ তুলল বেঁাটার উপর ফুল হয়ে ফোটার জন্যে। ভোরের পাখি ডেকে উঠল রাজপ্রাসাদের বনবিতানে। আজ সূর্যদেব সব কাজ ফেলে নিজের হাতে আলো মাখালেন শ্বেতপাথরের রাজপ্রাসাদের চূড়ার সোনার কলসের পায়ে।
২
পরদিন সকালেই রাজদরবারে পন্ডিতরা আসতে শুরু করলেন। প্রথমে এলেন সমস্ত বিষয়ের শিক্ষাগুরু, যাঁরা রাজপুত্র কোজাগরকিরণকে ভবিষ্যতের রাজা হিসেবে গড়ে তোলার মহাদায়িত্ব পেয়েছেন। তারপর একে একে আসতে শুরু করলেন রাজপন্ডিতরা। কোনো রাজপন্ডিতের হাতে মুড়মুড়ে হয়ে যাওয়া প্রাচীন পুঁথির পাতা। কোনো রাজপন্ডিতের পিছন পিছন ভারী ভারী পুরাণ-উপনিষদ বয়ে আনল কত লোকলশকর। কোনো রাজপন্ডিতের কাঁধের দীর্ঘ ঝোলা থেকে উঁকি দিতে লাগল হলুদ রঙের পুরোনো লিপির অংশ-বিশেষ। শেষে রাজপুরোহিত রাজপুত্র কোজাগরকিরণের জন্মপত্রিকা হাতে নিয়ে ঢুকলেন রাজদরবারে।
এর পর রাজা দিগ্বিজয়ীর আগে আগে ঢুকলেন রাজা জগজ্জয়ী। তিনি এসে সিংহাসনে বসলেন। তারপর রাজা দিগ্বিজয়ী এসে বসলেন তাঁর সিংহাসনে। রাজদরবারে তখন কোনো গাছের হলুদ পাতা খসে পড়ারও শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
রাজা জগজ্জয়ী ধীর কন্ঠে বললেন, ‘‘আমার তো কোনো সন্তান নেই। তাই হে মহাপন্ডিতগণ, রাজপুত্র কোজাগরকিরণই এই রাজবংশের আগামী দিনের রাজা। তাকে কী উপায়ে ভবিষ্যতের রাজা হিসেবে গড়ে তোলা যায়, আপনারা তার সুপরামর্শ দিন। শুনেছি, সেনাকি সব কিছুতে বড়ো উদাসীন, অন্যমনা?’’
রাজা দিগ্বিজয়ী দাদার কথায় ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
তখন একজন রাজপন্ডিত পরামর্শ দিলেন, ‘‘মহারাজ, অনেকদিন আগে আপনার বাবা রাজা ভুবনজয়ী আমাদের রাজ্যের একেবারে শেষ প্রান্তে যে জঙ্গল রচনা করেছিলেন, সেই জঙ্গলে কন্বমুনির আশ্রমের মতো একটা তপোবন তৈরি করুন। সেখানে মালিনীর মতো একটা নদীও থাকবে। সরোবর থাকবে, তাতে থাকবে কাকচক্ষু জল। জোড়ায় জোড়ায় রাজহংস ভেসে বেড়াবে। গাছে গাছে পাখিরা গান গাইবে। ময়ূর পেখম মেলবে মেঘ করে এলে আকাশে। অনেক ফলের আর ফুলের গাছ থাকবে সেখানে। রাজ্য থেকে খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিমান বালকদের সেখানে রাখার ব্যবস্থা করুন। তারাই হবে সেই তপোবনের আশ্রম বালক। আর রাজপুত্র তাদের সঙ্গে থেকে সেখানে শাস্ত্রপাঠ করবেন। দেখবেন রাজপুত্রের মন বসবে সেই তপোবনে।’’
আর-একজন রাজপন্ডিত বললেন, ‘‘মহারাজ, আমরা যেখানে থাকি, রাজপুত্রকে আমাদের কাছে গুরুগৃহে রাখার ব্যবস্থা করুন। সেখানে রাজপুত্র ব্যাঘ্রচর্মে শয়ন করবেন, মৃগচর্মের আসনে বসে পাঠাভ্যাস করবেন সকাল-সন্ধে। দেখবেন, পুরাণ-উপনিষদে রাজপুত্রের মন না বসে কি পারে? কৃচ্ছ্র সাধনই হল রাজকুমারের শিক্ষার সঠিক পন্থা মহারাজ!’’
অস্ত্রগুরু তরবারিতে ঝনঝনাৎ শব্দ করে বললেন, ‘‘রাজকুমারকে যদি অস্ত্রবিদ্যা শিখতেই হয়, তবে অস্ত্রাগারে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করুন মহারাজ। তিনি ঘুমে-জাগরণে যেন অস্ত্র ছাড়া আর কিছু না দেখতে পান। রাজপুত্র যখন জেগে থাকবেন, তখন যেমন হুকুমবরদাররা অস্ত্রে অস্ত্রে ঠোকাঠুকি করে অস্ত্রের ঝনঝনি তুলবে, রাজপুত্র ঘুমিয়ে পড়লেও তারা সমানে অস্ত্রের ঝনৎকার তুলে চলবে অস্ত্রাগারে সারারাত। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি প্রহরে প্রহরে অস্ত্রশিক্ষা দেব রাজপুত্রকে। দেখবেন, অল্পদিনেই রাজপুত্র অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠবেন। তাঁর মনে হবে, অস্ত্রবিদ্যাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান, অস্ত্রশিক্ষাই জীবনের চরম শিক্ষা!’’
মল্লগুরু পেশি ফুলিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে এলেন রাজাদের সিংহাসনের সামনে। তারপর বললেন, ‘‘মহারাজ, রাজপুত্রকে পাঠিয়ে দিন আমার কুস্তির আখড়ায়। বিলাস-বৈভব নয়, সেখানে প্রতিদিন খড়ের বিছানায় শয়ন করবেন রাজপুত্র। খড়ের গদির উপর সারাদিন ধরে চলবে কুস্তিশিক্ষা। খড়ের গায়ে ধানের মিষ্টি গন্ধ লেগে থাকে তো! সেই মনোহারী গন্ধে সারাক্ষণ বিভোর হয়ে থাকবেন রাজপুত্র। মনে হবে, কুস্তিশিক্ষাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, রাজ্যচালনার জন্যে সবচেয়ে দরকারি। একবার পরখ করে দেখুন মহারাজা!’’
অশ্বগুরু বললেন, ‘‘মহারাজ, ঘোড়ায় চড়া শিখতে হলে এবং ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা শিখতে হলে রাজপুত্রকে আস্তাবলে থাকতে হবে। ভাব করতে হবে, পরিচিত হয়ে উঠতে হবে অশ্বের সঙ্গে। দেখতে দেখতে রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতে আর পিছপা হবেন না। দেখবেন, বিরাট অশ্ববাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলে রাজপুত্রের তখন গর্বে বুক ফুলে উঠছে। বরং এই সঙ্গে আপনি বিরাট একটা অশ্ববাহিনীও তৈরির কথা ভাবুন!’’
দুই রাজা মন দিয়ে শুনলেন সকলের পরামর্শ। তারপর সেদিনের মতো রাজদরবার মূলতুবি ঘোষণা করা হল।
৩
সেদিন রাতে চাঁদ নেমে এসে কোজাগরকিরণের বারান্দায় চুপ করে বসে থাকল অনেকক্ষণ। একজোড়া লক্ষ্মীপ্যাঁচা সাঁইসাঁই করে উড়ে এসে বসল কারুকাজ-করা রাজপুত্রের শয়নকক্ষের গবাক্ষপথে। শয়নকক্ষে রানি লাজবন্তী উসখুস করছিলেন অনেকক্ষণ। তারপর তিনি কাতর কন্ঠে রাজা দিগ্বিজয়ীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘মহারাজ, কোজাগরকিরণের রাজকার্য শেখায় আগ্রহের কিছু উপায় কি খুঁজে পেলেন?’’
রাজা দিগ্বিজয়ী ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়লেন, ‘‘না। কাল রাজা জগজ্জয়ীর কাছে জানতে চাইব, তিনি কিছু বিহিত ভেবে পেলেন কিনা!’’
রাতের প্রহর কাটতে চাইল না ঘুমহীন রানির। তবু একসময় ভোররাতে লাজবন্তীর চোখের পাতায় একটুখানি ঘুম নেমেছিল। বাতায়নে পাখির ডাকে সেঘুম ভেঙে গেল।
রাজা দিগ্বিজয়ী তড়িঘড়ি রাজদরবারে চললেন। দাসদাসীরা সকলে অবাক হয়ে দেখল, এত সকালে তাঁর দরবারে যাওয়ার দরকার পড়ল কেন? তা হলে কি কোথাও কোনো অশুভ কিছু ঘটল?
বড়োরাজা জগজ্জয়ী তখন ফুলের বাগানে তন্ময় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আজ সকাল থেকে তিনিও চিন্তার ভারে বিচলিত। এমন সময় পাইক এসে নিবেদন করল, ‘‘মহারাজ, ছোটো রাজা দরবারে আপনার অপেক্ষায় আছেন!’’
একথা শুনে তড়িঘড়ি রাজা জগজ্জয়ী রাজদরবারে চলে এলেন। তখনও আর কেউ দরবারে আসেননি। না, মন্ত্রী-অমাত্য, না সেনাপতি-দ্বাররক্ষী, না পাইক-বরকন্দাজ। তিনি দেখলেন, নত মুখে বসে আছেন দিগ্বিজয়ী। বড়ো রাজা ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি এত সকালে কীসের চিন্তায় মগ্ন?’’
দিগ্বিজয়ী মুখ তুলে তাকালেন জগজ্জয়ীর চোখের দিকে। বললেন, ‘‘রাজপুত্র কোজাগরকিরণের জন্যে উপায় কিছু খুঁজে পাওয়া গেল? রাজপুত্র যুদ্ধ শিখবে না, অস্ত্রবিদ্যায় অনভিজ্ঞ হবে, ঘোড়ায় চড়তে তার মন চাইবে না, হাতির পিঠে চড়ে শিকার করতে সেভয় পাবে, এ কি কখনো কোনো রাজ্যে হয়েছে?’’
রাজা জগজ্জয়ীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ‘‘বিজয়মন্ডল রাজ্যের ধারাহিক বিজয়ের ইতিহাসের সঙ্গে লেখা আছে রাজাদের শৌর্যের কথা। বীরত্বের কথা লেখা আছে ঠিকই। তবু আমার মনে হয়, দিন একদিন বদলায়, নতুন করে রাজ্যের ইতিহাস লেখা হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। হয়তো এমন দিন আসবে, যখন আর যুদ্ধের প্রয়োজন পড়বে না পৃথিবীতে? তখন এটাই তো রাজপুত্রের সঙ্গে মানানসই হবে? তোমার মনে নেই, মহারাজা ভুবনজয়ী বলতেন, ‘বিজয়মন্ডল রাজ্যে যা ঘটবে, সেটাই নিয়ম!’ তাই আমি জেনেছি রাজপুত্র কোজাগরকিরণ নিজের মতো করে বড়ো হয়ে উঠুক। ওর যদি যুদ্ধ ভালো না লাগে না-ই শিখল যুদ্ধবিদ্যা?’’
‘‘যদি অন্য রাজ্য আক্রমণ করে বিজয়মন্ডল?’’
রাজা জগজ্জয়ী কখনো দাদার কথা অমান্য করেননি। আজও মাথা নীচু করে মেনে নিলেন তাঁর নির্দেশ। তারপর গোটা রাজ্যে কথাটা ছড়িয়ে পড়ল, ‘এবার বুঝি ঘনিয়ে আসবে বিজয়মন্ডল রাজ্যের বিপদ। এত দিনের গৌরবের ইতিহাস বুঝি এবার মুছে যাবে!’
দেখতে দেখতে রাজপুত্র বড়ো হয়ে উঠতে লাগলেন নিজের মতো মনের আনন্দে। রাজপন্ডিতরা সকলেই প্রায় অবসরের জীবনযাপন করতে লাগলেন। কতদিন আর খোলাই হয় না পুঁথিপত্রের পাতা। স্মৃতি ঝাপসা আসতে লাগল। অস্ত্রের ঝনঝনি না শুনতে পেয়ে আর দু-চোখে ঘুম এল না অস্ত্রগুরুর। কর্মহীন মল্লগুরুর এখন আর ভালো করে হজম হয় না। শিথিল হয়ে পড়ল তাঁর অমন টানটান পেশি। এখন অশ্বগুরু ও হাত-পায়ের শিরায় টান অনুভব করতে শুরু করেছেন।
আর রাজপুত্র কোজাগরকিরণ এই দ্বাররক্ষীর ছেলের সঙ্গে খেলাধুলো করে, তো এই দাসীর মেয়ের সঙ্গে বাগানে সাজি ভরে পুজোর ফুল তুলতে যায়। আজ কোটালের ছেলের সঙ্গে সরোবরে সাঁতার কাটতে যায় তো, কাল চলে যায় সেনাপতির ছেলের সঙ্গে বনে-বনান্তরে পাখির বাসা বানিয়ে দিতে। পরশু রাজপুত্র চলে যায় রাজপ্রাসাদের ঘণ্টিবাদকের ছেলের সঙ্গে তাদের পাঠশালায়, তো তার পরদিন চলে যায় অস্ত্রগুরুর ছেলের সঙ্গে পদ্মদিঘিতে পদ্মফুল তুলতে। কোনোদিন মন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে রাজপুত্র চলে যায় রাজ্যের গরিব প্রজাদের বাড়ি বাড়ি, তাদের সুখের চেয়ে দুঃখের খোঁজ নেয় বেশি করে।
দ্বাররক্ষী তার ছেলেকে নিষেধ করতে গিয়েও থেমে যায়। দাসী ঘোমটার আড়াল থেকে মেয়েকে চোখ দেখিয়ে বারণ করে। সেবারণ দাসীর মেয়ে দেখতে পায় না। কোটাল ছেলেকে আটকাতে গিয়েও পিছিয়ে আসে আর ভয়ে ভয়ে দিন কাটে তার। কবে বলতে কবে তার চাকরিটাই না চলে যায়। সেনাপতি নিজের মনে মনে ছেলেকে কতবার যে রাজপুত্রের সঙ্গে যেতে আটকায়। কতদিন ঘণ্টিবাদক ছেলের শরীর ভালো নেই বলে রাজপুত্রের সঙ্গে তাকে যেতে দেয়নি। ছেলে যে রাজপুত্রের সঙ্গে পদ্মফুল তুলতে যায় সেনিয়ে অস্ত্রগুরুর মন ভালো নেই কতদিন। মন্ত্রী অবশ্য মনে মনে ভাবে, রাজপুত্রের সঙ্গে যদি কারো যাওয়া মানায়, তবে সেতো তাঁর ছেলেকেই মানায়।
কেমন করে যেন রাজ্যপুত্রের সুনামের কথা পৌঁছে যায় এক রাজ্য থেকে আর-এক রাজ্যে। যার একটুও অহংকার নেই মনে, যে সকলকে আপন করে নিতে পারে, এমন রাজপুত্র দশ-বিশটা রাজ্যেও খুঁজে পাওয়া ভার। সকলেই তার বন্ধু।
এ খবর বিজয়মন্ডল রাজ্যেও পৌঁছে যায় একদিন। অবাক হয়ে সেগল্প শোনে বিজয়মন্ডল রাজ্যের মানুষ। রাজা জগজ্জয়ী, রাজা দিগ্বিজয়ীর কানেও অমন আনন্দের খবর পৌঁছোতে সময় লাগে না।
এমন একদিন রাজা জগজ্জয়ী মন্ত্রীকে আদেশ দিলেন, ‘‘মন্ত্রীমশাই, আপনি কাল রাজদরবার ডাকুন!’’
মন্ত্রী ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।
রাজা জগজ্জয়ী বললেন, ‘‘কিন্তু মন্ত্রীমশাই, এবার রাজদরবার বসবে রাজপ্রাসাদের সামনে, খোলা আকাশের নীচে।’’
একথা শুনে রাজা দিগ্বিজয়ী চিন্তিত মুখে বললেন, ‘‘কিন্ত দাদা, এ যে বিজয়মন্ডল রাজ্যের ইতিহাসে ঘটেনি? রাজপ্রাসাদের বাইরে বসবে রাজদরবার? না না, তা হয় না দাদা!’’
রাজা জগজ্জয়ীর মুখে ছড়িয়ে পড়ল হাসি। তিনি তাই দিগ্বিজয়ীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আবার নতুন করে ইতিহাস লেখা হবে এ রাজ্যের। কাল আমাদের নতুন রাজার অভিষেক হবে!’’
অবাক গলায় রাজা দিগ্বিজয়ী প্রশ্ন করলেন, ‘‘কে হবে এ রাজ্যের রাজা?’’
ফের হাসি ছড়িয়ে পড়ল রাজা জগজ্জয়ীর মুখে। বললেন, ‘‘কাল থেকে এ রাজ্যের রাজা হবে কোজাগরকিরণ! আমাদের উদাসীন রাজপুত্র। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এত মানুষের ভালোবাসা মাখা সমর্থন এই রাজ্যে কেন আর কোনো রাজ্যের কোনো রাজার কপালে জোটেনি!’’
এক পাশে বসেছিলেন রাজপুত্র কোজাগরকিরণ। সেবলল, ‘‘কিন্তু আমি কি এই রাজ্যের রাজা হওয়ার উপযুক্ত? না না, এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন মহারাজা।’’
রাজা দিগ্বিজয়ীর মুখে তখনও চিন্তার রেখা। দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘‘কিন্তু একদিনে অভিষেকের আয়োজন হবে কী করে?’’
রাজা জগজ্জয়ী হেসে সায় দিলেন কোজাগরকিরণকে, ‘‘তুমিই রাজার উপযুক্ত!’’ তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘কোনো আয়োজন লাগবে না! কাল থেকে ভেঙে যাবে রাজপ্রাসাদের গন্ডী। রাজায়-প্রজায় আর কোনো ভেদ থাকবে না। সাধারণ প্রজার মাঝখানে অভিষেক হবে আমাদের নতুন রাজার।’’
পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ভেঁপু বেজে উঠল রাজ-দেউড়ির সামনে। আর অপরূপ সাজ নয়। সাধারণ সাজে সাধারণের মাঝখানে এসে বসলেন বড়োরানি গুঞ্জামালা। সুরের মূর্চ্ছনা সরিয়ে তাঁর পাশে এসে বসলেন রানি লাজবন্তী! দুই রাজা জগজ্জয়ী আর দিগ্বিজয়ী সাধারণ বেশে এলেন মুক্ত রাজদরবারে।
তখন রাজপুত্র কোজাগরকিরণকে ঘিরে আনন্দ করছে কোটালের ছেলে আর দাসীর মেয়ে। দ্বাররক্ষী, কোটাল, ঘণ্টিবাদক, অস্ত্রগুরু, সেনাপতি, মন্ত্রীর ছেলে কেউ আসতে দেরি করেনি। আকাশে উড়ে বেড়োচ্ছে নীল আর সাদা মেঘের ভেলা। পাখিরা গান গাইছে গাছের ডালে বসে। ফুল ফুটেছে গাছের শাখায় শাখায়। সূর্য রং মাখাচ্ছে বিজয়মন্ডল রাজ্যের নদী-পাহাড়ে।
এসবের মাঝখানে বিজয়মন্ডল রাজ্যের নতুন রাজার অভিষেক হল। রাজা হলেন উদাসীন রাজপুত্র কোজাগরকিরণ!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন