রতনতনু ঘাটী
এক ছিল ছোট্ট দ্বীপ। একটা বড়ো সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে। সেই নির্জন দ্বীপে থাকত একটা ছোট্ট মেয়ে। সেই দ্বীপটায় আর কোনো মানুষজন থাকত না। চারদিকে ছোটো-বড়ো বন, গাছপালা। বেশি ছিল ফুলের গাছ। একলা থাকতে তার একদম ভয় করত না। কেননা, সেই দ্বীপে একটাও জীবজন্তু ছিল না। ছিল শুধু রং-বেরঙের পাখি।
মানুষজন ছিল না বলে মেয়েটা কারো সঙ্গে কথা বলতে পারত না। বনে বনে, সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াত। কখনো ফুল তুলত, মালা গাঁথত, কখনো কখনো বা ঝিনুক কুড়োতো। বালি দিয়ে খেলাঘর বানাতো।
দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেক দিন। গাছের ফলপাকুড় পেড়ে খায় খিদে পেলে। সেই দ্বীপে ছিল একটা ছোট্ট পাহাড়। তার মাথা থেকে ঝরে পড়ত একটা ছোট্ট ঝরনা। তেষ্টা পেলে জল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত গাছের নীচে।
একদিন সমুদ্রের সৈকতে বালির ওপর একটা ছোট্ট লাঠি দিয়ে হিজিবিজি দাগ কাটতে কাটতে এঁকে ফেলল একটা মানুষের ছবি। তখনই তার মনে পড়ে গেল বাবা-মার কথা। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না নিজের নামটা। অনেক অনেক দিন কেউ তার নাম ধরে ডাকেনি। কারো সঙ্গে কথাও বলতে পারেনি। কথা বলার চেষ্টা করে দেখল, কথা সব কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবল মেয়েটি, তাহলে কি সেকথা বলাও একদম ভুলে যাবে? তার নামটাও যে আর একদম মনে পড়ছে না!
কী করবে তাহলে সে! গালে হাত দিয়ে বসে গেল ভাবতে। ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে গেল হারিয়ে যাওয়া দিনটির কথা। তাও মনে পড়ল খুব আবছা আবছা। একটা বড়ো পালতোলা জাহাজ। ওর বাবা-মার মতো অনেকেই ছিল সেই জাহাজে। এক জাহাজ ভরতি লোক। ওদের দেশটা ছিল খুব সুন্দর। কিন্তু ওদের দেশটাকে শাসন করত অন্য একটা দেশের লোক। তাই ওদের দেশের মানুষের মনে একটুও সুখ ছিল না। এসব কথা বাবার মুখ থেকে শোনা। সব কথার মানে বুঝতে পারেনি সেদিন। মানে বোঝার মতো বয়সও তো ছিল না তার। তখন কতই বা বয়স! আড়াই বা তিন বছর। এখন মনে পড়ছে, সেবাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল সেদিন, ‘‘আমরা জাহাজে চড়ে কোথায় যাচ্ছি?’’
বাবা বেশ জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘স্বাধীনতা আনতে।’’
তারপর সেই জাহাজ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ ভেঙে এগিয়ে চলল সমুদ্রে। হঠাৎ গভীর রাতে উঠল এক মরণ ঝড়। উলটে গেল জাহাজ। ডুবে গেল সবাই। মেয়েটি কেমন করে বেঁচে গেল সে-কথা ওর এখন মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে একটা কাঠের পাটাতনের ওপর ভাসতে ভাসতে এই দ্বীপে এসেছিল ও।
এসব ভাবতে ভাবতে খুব মন খারাপ হয়ে গেল মেয়েটির। যেমন মন খারাপ হয়েছিল এই দ্বীপে আসার পর প্রথম প্রথম। অতল দিঘির মতো কালো টলটলে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জলের ধারা।
সারাদিন কিছুই খেল না। তার পরের দিনও না। তার পরের দিনও না। মেয়েটি ফুল তুলল না বলে মন ভার করে ফুল ফোটালো না ফুলগাছ। পাখিদের সঙ্গে মেয়েটি খেলল না, নাচল না বলে মন খারাপ করে গাছের ডালে ডালে মুখভার বসে থাকল সব পাখি। ঘাসে ঘাসে লাফালো না ফড়িং, প্রজাপতি উড়ল না ফুলে ফুলে, মৌচাকে গুনগুন করল না মৌমাছি। ছোট্ট ঝরনাটাও শুকিয়ে এল দেখতে দেখতে।
এ-রকম সময় একদিন সকালবেলা চুপচাপ সমুদ্রের ধারে বসেছিল মেয়েটি। আজ কতদিন এই দ্বীপে আছে সে। তা হয়তো গুনলে দশ বছর হয়ে যাবে। কোনোদিনও এত মন খারাপ করেনি তার। হঠাৎ সমুদ্রের দিক থেকে উড়তে উড়তে এল এক পাখি। ঠিক তার সামনে এসে বসল পাখিটা। বা:, পাখিটা তো দেখতে বেশ সুন্দর। একটা বাজপাখির মতো চেহারা। গলায় টিয়াপাখির মতো সাদা ঝুঁটি, ঠোঁটটা অনেকটা যেন ডোডো পাখির মতো, ময়না পাখির মতো চোখ। বলা যায় বেশ বড়ো হলদে শালিক পাখির মতো পালক তার সারা গায়ে। এ তো নতুন পাখি!
পাখিটা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘তোমার নাম কী মেয়ে?’’
মেয়েটি বলল, ‘‘ও মা, তুমি অবিকল মানুষের মতো কথা বলতে পার? আমার কী নাম আমি ভুলে গেছি পাখি।’’
পাখিটা বলল, ‘‘এই দ্বীপে তুমি তো একা থাকো, তাহলে তোমার নাম হোক দ্বীপ-কুমারী।’’
মেয়েটি বললল, ‘‘বা: তোমার দেওয়া নামটা তো খুব সুন্দর। এ-রকমই একটা কিছু নাম ছিল আমার।’’
‘‘দ্বীপ-কুমারী, তুমি বসে বসে কাঁদছিলে কেন?’’
মেয়েটি বলল, ‘‘বাবা-মাকে হারিয়ে এই দ্বীপে আছি আজ কতদিন। কথা বলার মতো কেউ নেই। দেখতে দেখতে নাম ভুলে গেছি। অনেক কথাও ভুলে গেছি। আর এই দ্বীপে থাকতে ভালো লাগছে না।’’
দ্বীপ-কুমারী পাখিটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘তোমার নাম কী? এই দ্বীপে তো অনেক রকমের পাখি আছে। কিন্তু তোমার মতো পাখি তো একটাও নেই!’’
পাখিটা হাসল মানুষের মতো খিলখিল করে। তারপর বলল, ‘‘আমার নাম ‘কথা-বলা পাখি’। আমাকে তুমি দেখবে কোথায়? সারা পৃথিবীতে তো আমি একাই। আমিই একমাত্র পাখি যে মানুষের মতো কথা বলতে পারি। আসলে আমি স্বর্গের এক নর্তকী। দেবতাদের সভায় খুব ভালো নাচতাম। একদিন নন্দনকাননে বসে এক ঋষি তপস্যা করছিলেন। আমি আপনমনে নেচে বেড়াচ্ছিলাম। তাঁর তপস্যায় বাধা পড়ছিল আমার নাচের জন্য। তিনি দু-বার নিষেধও করেছিলেন আমাকে। তবুও আমি নেচে বেড়াচ্ছি দেখে তিনি আমাকে অভিশাপ দিয়ে পাখি করে দিয়েছেন।
দ্বীপ-কুমারী বলল, ‘‘বেশ হয়েছে। তুমি আমার কাছে থাকো। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব, গান গাইব, ঘুরে বেড়াব। তাহলে আমার আর কোনো দুঃখ থাকবে না।’’
পাখি বলল, ‘‘তোমার দুঃখ দূর করতে পারলেই তো আমার মুক্তি। ঋষি বলেছিলেন, একটা ছোট্ট দ্বীপে একটি মেয়ে একা থাকে। তার দুঃখ দূর করতে পারলে আমি আবার নর্তকী হতে পারব। কতদিন ধরে কত কত দ্বীপে ঘুরেছি। উড়ে গেছি এক সমুদ্র থেকে আর এক সমুদ্রে। এতদিন পরে তোমার দেখা পেলাম। কিন্তু তুমি যে আমাকে তোমার কাছে থেকে যেতে বলছ। তুমি কি চাও না আমি মুক্তি পাই?’’
দ্বীপ-কুমারী বলল, ‘‘তাহলে আমি কথা বলব কার সঙ্গে?’’
পাখি বলল, ‘‘আমি যদি দ্বীপের কিছু পাখিকে কথা বলা শিখিয়ে দিই? তারা কথা বলা শিখে তোমার সঙ্গে কথা বলবে, গান গাইবে, খেলা করবে। তাহলে তো তোমার মনে কোনো দুঃখ থাকবে না?’’
দ্বীপ-কুমারী দু-বেণী দুলিয়ে বলল, ‘‘হ্যাঁ, তাই করো।’’
পাখিটা প্রথমে উড়ে গেল আকাশের অনেকটা ওপরে। তারপর নেমে এসে সারা দ্বীপে চক্কর দিয়ে উড়তে লাগল আনন্দে।
পরদিন সাকলে দ্বীপ-কুমারী এসে বসল সমুদ্রের ধারে একটা বড়ো বট গাছের নীচে। একটু পরেই উড়ে এল সেই পাখিটা। সঙ্গে এল একঝাঁক ময়না, কাকাতুয়া, টিয়া পাখি। পাখিগুলো গোল হয়ে দ্বীপ-কুমারীকে ঘিরে বসল। আর দ্বীপ-কুমারীর একদম পাশে গিয়ে বসল সেই পাখিটা।
পাখিটা দ্বীপ-কুমারীকে বলল, ‘‘এই পাখিদের সঙ্গে তুমি কথা বলবে। এরা তোমার কথা শুনে কথা বলতে পারবে। তুমি কথা বলো।’’
দ্বীপ-কুমারী কাকাতুয়ার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার বলল, ‘‘তুই আমার বন্ধু।’’
কাকাতুয়া একটু পরে বলল, ‘‘তুই আমার সই।’’
দ্বীপ-কুমারীর মনে আর আনন্দ ধরে না। তাই দেখে সেই পাখিটা বলল, ‘‘দ্বীপ-কুমারী, তোমার মনে আর কোনো দুঃখ নেই তো? এবার আমি যাই?’’
দ্বীপ-কুমারী ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পলক পড়তে-না-পড়তেই উড়ে চলল সেই পাখি। একটু ওপরে উঠেই পাখিটা হয়ে গেল অপরূপা এক নর্তকী। উড়ে গেল স্বর্গের দিকে।
সেই থেকে ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া হয়ে গেল কথা-বলা পাখি। তারা দ্বীপ-কুমারীর মুখ থেকে শুনে কথা বলা শেখে। দ্বীপ-কুমারীর মনে আর কোনো দুঃখ নেই। দ্বীপ-কুমারী এখনও সেই দ্বীপে আছে কি না সেখবর কেউ বলতে পারে না। তবে ময়না, টিয়া, কাকাতুয়াদের কিছু পাখি দলছুট হয়ে উড়ে এসেছে আমাদের পৃথিবীর নানা দেশে। কথা বলা শেখালে তারাও এখন কথা বলতে পারে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন