রতনতনু ঘাটী
বনবীথি নামে একটা গ্রাম আছে। গ্রামটা একেবারে দুর ছাই করার মতো ছোটোও নয়। আবার গালভারী করে বলার মতো অমন বড়োও নয়। শহর থেকে বেশ অনেকটা দূরে গ্রামটা। সেই গ্রাম থেকে শহর যেমন অনেক দূর, পাহাড় বলো, নদী বা সমুদ্র বলো, নয়তো জঙ্গলই বা বলো না কেন, অনেক অনেক দূর। তাই সেগ্রামে চাষ-আবাদ হয় না বললেই চলে। শাক-সবজি, ফল-ফুল, সেও তেমন গলা উঁচু করে বলার মতো হয় না।
সেগ্রামে কি বৃষ্টিও হয় না?
হয় না যে তাও নয়। আবার খুব যে ঘনঘোর বর্ষা নামে সেগ্রামে, মাঠঘাঠ, গোরু-বাছুর ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনও বলা যাবে না। মন খারাপ করা মানুষের কখনো কখনো হঠাৎ করে কোনো গাছে পলাশ ফুটতে দেখলে ক্ষণেকের জন্যে যেমন মন ভালো হয়ে যায়, কোনো কোনো বছর অমন করে সেগ্রামে এক-আধ পশলা বৃষ্টি হয়। তবে তাতে ধুলো-মাখা পথের মুখভার খানিকটা কমে হয়তো, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। না চাষ-আবাদ, না ফুল-কুসুম।
সেখানে মানুষের দিন কাটে কেমন করে?
দিন এমন একটা জিনিস, না কাটলেও কাটে, আবার কাটলেও কাটে না। ও হো, বলাই হয়নি, সেগ্রামেই তো থাকে ফাল্গুনি নামের মেয়েটা। এবছর বারোয় পা দিয়েছে। ফরসা, সাদা পরির মতো দেখতে ফুটফুটে মেয়েটাকে। মাথায় তার একমাথা ঝাঁকড়া চুল।
ওর অমন নাম কেন? ওর কি ফাল্গুন মাসে জন্ম?
হ্যাঁ, তাই তো! এবারও ফাল্গুন মাসে শ্বেতচন্দন গাছে হালকা হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে। দুধেল গোরুর পিঠে এসে বসেছে একটা বঁাশপাতি পাখি। দুটো ঝুঁটি শালিখ বাসা বেঁধেছে ফাল্গুনিদের কুঁড়েঘরের থেকে অনেকটা দূরে একটা ভাঙা বাড়ির দেওয়ালে। এসব দেখেই ঘুরে ঘুরে দিন কাটে ফাল্গুনির। একবার বায়না ধরেছিল, অনেকটা হেঁটে দূরে শহরের স্কুলে পড়তে যাবে। ছোটোদের সব বায়না কি মেটানো যায়? তবু ফাল্গুনির ঠাকুরমা অনেক চেষ্টা করে শেষমেশ ফাল্গুনিকে শহরের একটা স্কুলে ভরতি করেছেন।
ফাল্গুনির মা-বাবা নেই?
এখন নেই। ওর মা মারা গেছে খরার বছর। আর ওর বাবা মহামারির বছর মারা গেছে। সেঘটনা আজ ক-বছর পার হয়ে গেল। সংসারে ঠাকুরমা আর ফাল্গুনি থাকে।
ওদের দুটো দুধেল গোরু আছে। আর আছে হরিণের মতো দুটো ফুটফুটে বাছুর। একটার গায়ে কালো ছোপ, আর একটা ছাই ছাই রঙের। ফাল্গুনি কালো ছোপ বাছুরটার নাম রেখেছে ‘আনি’। আর ছাই রঙের বাছুরটার নাম ‘মানি’। কেন যে সেএমন নাম রেখেছে নিজেও জানে না। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, ‘‘ওদের ওরকমই নাম!’’
সকালে সূর্য গাছের মাথা ছাড়িয়ে আকাশে উঠলে ফাল্গুনি আনি-মানিকে মাঠে চরাতে নিয়ে যেত। এখন স্কুলে যেতে হয় বলে সকালে সময় কুলোয় না। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে মাঠে নিয়ে যায় আনি-মানিকে। তখন আবার আনি-মানির মাঠে থাকতে মন একদম বসে না। শুধু মা-র কাছে যাই যাই করে। বড্ড মা-মুখো বাছুর দুটো! গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ওদের সন্ধের আগে পর্যন্ত মাঠে আটকে রাখে ফাল্গুনি।
তারপর আকাশের গায়ে যখন বালতি বালতি আবির রং ঢেলে দেয় কেউ, তখন আনি-মানিকে নিয়ে বাড়ি ফেরে ফাল্গুনি।
শহর থেকে রোজ দুধওয়ালা আসে। বঁাশের লাঠির দু-দিকে দুটো টিন বঁাধা। গ্রামে গ্রামে দুধ কুড়োতে কুড়োতে টিন ভরতি দুধ নিয়ে শহরে চলে যায়। গিয়ে সব দুধ বিক্রি করে মিষ্টি তৈরির দোকানে। সেই দুধওয়ালাকে ফাল্গুনির ঠাকুরমা প্রতিদিন দু-লিটার করে দুধ বিক্রি করে। সেই পয়সায় সংসার চলে ওদের।
সেবার ঘটল এক কান্ড। ফাল্গুনির শরীরে কী একটা অসুখ এসে বাসা বাধল। কোনো পোড়োবাড়িতে বনটিয়া এসে যেমন উটকো লোকের মতো বাসা বাধে, ওরকম। সারাদিন মনমরা হয়ে ঘোরে, কিছু খেতেও চায় না। রাতে ভালো করে ঘুমও হয় না ফাল্গুনির। ঠাকুরমা এক-এক রাতে ঘুম ভাঙলে নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। দ্যাখে, কত রাত হয়েছে। তখনও পিটপিট করে চোখের পাতা মেলে তাকিয়ে আছে ফাল্গুনি।
কিছু উপায় খুঁজতে গ্রামের একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগল ঠাকুরমা। কেউ বলল, গুনিন ডাকো। কেউ বলল জলপড়া খাওয়াও, সব সেরে যাবে। সবই করতে লাগল ঠাকুরমা। কিন্তু কিছুতেই ফাল্গুনির শরীর আর সারে না।
আর স্কুলেও যেতে পারল না নিশ্চয়ই?
না, স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হল। বইয়ের পড়া-টড়া কিচ্ছু তার মনেও পড়ে না। এখন আনি-মানিকে নিয়েও মাঠে যেতে পারে না। গায়ের শক্তিতে কুলোয় না তার। সারাদিন কাঁথামুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে।
গ্রামের এক প্রান্তে থাকে অবনীকবিরাজ। গাছগাছড়ায় অনেক রোগ সারিয়ে দেয়, সকলে বলে। তার কাছেও এক সকালে গিয়ে হাজির হল ঠাকুরমা। কীসব গাছের শিকড়ে দিল বাগান থেকে তুলে এনে। বলল, ‘‘এই শিকড়ের রস বের করে দিনে তিনবার খাওয়াও, তোমার নাতনি সেরে যাবে!’’
এবার ফাল্গুনির অসুখ সারল কি?
কই আর সারল! তখন একজন দরবেশ আসছিল ভিন গ্রামের দিক থেকে। কমলা রঙের আলখাল্লার মতো পা পর্যন্ত জামা পরা। কাঁধে কালো রঙের একটা কাপড়ের ঝোলা। মাথায় বেগনি রঙের ওড়না পাগড়ির মতো আলতো করে বঁাধা। চোখে চাঁদির চশমাও আছে। খালি পায়ে হেঁটে আসছিল বনবীথি গ্রামের দিকে।
ও মা! লোকটা আবার ছেলেধরা নয়তো?
না না। দরবেশরা কেমন করে যেন মানুষের বিপদের খোঁজ পেয়ে যায়। তারপর উপকার করতে এগিয়ে আসে। বিনিময়ে কিছু দিতে পারলে দাও, নয়তো কিছু দিও না। কখনো মুখ তুলে কিছু চাইবে না।
দরবেশ ফাল্গুনিদের কুটিরের সামনে এসে হাঁক পাড়ল, ‘‘ও বুড়িমা, তোমার নাতনির নাকি কী এক কঠিন অসুখ হয়েছে?’’
বুড়ি ঘাড় নাড়ল।
তখন দরবেশ ঠাকুরমাকে ডেকে বলল, ‘‘অনেকটা দূরে যে নয়না নদী আছে, নাম শুনেছ তো? তুমি নাতনিকে সূর্য ওঠার আগে সেই নদীর জলে স্নান করিয়ে আনো। একদিনেই ওর সব অসুখ ভালো হয়ে যাবে!’’
নয়না নদী? বনবীথি গ্রাম থেকে সেতো একটা দিন আর একটা গোটা রাতের পথ। অত দূর হাঁটতে পারবে না ফাল্গুনি। বুড়ি বলল, ‘‘বাবা, আমার নাতনি তো অতটা পথ হাঁটতে পারবে না। তুমি অন্য কিছু উপায় বলো না!’’
দরবেশ একটুক্ষণ কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘‘তাহলে এক কাজ করো! এখান থেকে তিনটে তেপান্তর পেরোবে। তারপর একটা বঁাশপাতার মতো নদী পেরোবে। ভয় পাবে না। সেনদীতে কখনো হাঁটুজলের বেশি জল থাকে না। তারপর সেনদীর ওপারে একটা বেশ পাতলা বন পাবে। সেবনে গাছপালা তেমন কিছু ঘন নয়। তাই জীবজন্তুর ভয় নেই। এই পাতলা বনটা একটা বেশ উঁচু পাহাড়ের পায়ের কাছে। সেই পাহাড়ের উপরে একটা পাতার কুটিরে এক মায়াবিনী বুড়ি থাকেন।’’
তিনি কি মায়ামন্ত্র জানেন নাকি?
‘‘না। তবু কেন যে লোকে তাঁকে ‘মায়াবিনী বুড়ি’ বলে কে জানে? তিনি কোনো তুকতাকে বিশ্বাস করেন না। তিনি ঝরনায় গিয়ে আঁজলা ডুবিয়ে জল খান। খিদে পেলে গাছপালার ফলপাকুড় খেয়ে তাঁর দিন কাটে। তাঁর কাছে গেলে নাকি সকলের অসুখ সেরে যায়। সকলে তাঁকে ডাকে ‘পাহাড়-মা’ বলে। তুমি কালই সেই পাহাড়-মা-র কাছে চলে যাও। তারপর পাহাড়-মা যে-কথা যেমন করে বলবেন, সেই মতো কাজ কোরো।’’
চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে ঠাকুরমা মুখ ঘুরিয়ে দেখে, দরবেশ কোত্থাও নেই!
ও মা! কোথায় গেল লোকটা?
ওরা অমন করেই আসে মানুষকে সুখবর দিতে। তারপর চলে যায়। ঠাকুরমা চিঁড়ে-মুড়ি সংসারে যেটুকু যা ছিল পোঁটলায় বেঁধে নাতনিকে নিয়ে এক সকালে বেরিয়ে পড়ল পাহাড়-মা-র উদ্দেশে। যে সামান্য ক-টা টাকা দুধওয়ালা কাল দিয়ে গিয়েছিলেন সেটুকুও সঙ্গে নিতে ভুলল না। পথে কখন কী দরকার পড়ে। পাশের বাড়ির ময়নাবউকে গোরু-বাছুরগুলোর দেখভালের ভার দিয়ে গেল।
ফাল্গুনি কিছু পথ হাঁটে, তারপর বসে পড়ে পথের ধুলোয়। বুকে হাঁফ ধরে। দম নিতে কষ্ট হয়। ফের উঠে হাঁটতে শুরু করে। পথের যেখানটায় সন্ধে নামে, চিঁড়ে-মুড়ি খেয়ে সেখানে গাছের তলায় ছেঁড়া কাপড়ের আঁচল বিছিয়ে নাতনিকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সকাল হলে ফের হাঁটার শুরু।
দেখতে দেখতে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, পক্ষকালও ঘুরতে গেল। একদিন ফাল্গুনি ঠাকুরমাকে বলল, ‘‘ঠাকুরমা, আমরা যত এগোই, পাহাড়টা তো তত পিছিয়ে পিছিয়ে যায়। আমার মন বলে, এই পাহাড়টাই আসলে মায়াবিনী। চলো বরং বাড়ি ফিরে যাই!’’
নাতনির কথা শুনে ঠাকুরমা বলল, ‘‘বাড়ি ফিরে যাওয়াও তো আবারও পনেরো দিনের পথ। সেকি আর কম হল বাছা? বরং চল, আর একটু এগিয়ে যাই। দরবেশ যখন বলেছে, পাহাড়-মা-র দেখা নিশ্চয়ই পাব। চল, আর খানিকটা কষ্ট করি।’’
ঠাকুরমার কথা ফেলতে পারে না ফাল্গুনি। ফের পথ চলার শুরু হয়। হঠাৎ একদিন একটা গাছের তলায় বসে বিশ্রাম করছে ঠাকুরমা আর নাতনি। বুড়ি নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, অসুখের সেই কালো ছায়া আর ফাল্গুনির মুখে দেখা যাচ্ছে না তো! তখনই ফাল্গুনি বলল, ‘‘ঠাকুরমা চলো! এমন করে বসে সময় কাটালে হবে? আমার কিন্তু এখন আর বুকে হাঁফ ধরছে না, পাহাড়ে উঠতেও কষ্ট হচ্ছে না আগের মতো! চলো পাহাড়-মাকে খুঁজি!’’
পাহাড়ে উঠতে উঠতে ওরা একটা সরু ঝরনার কাছে এসে থামল। ফাল্গুনি বলল, ‘‘ঠাকুরমা, আমরা তো এখনও পাহাড়-মা-র দেখা পেলাম না। কিন্তু আমার অসুখটা তো একদম সেরে গেছে। এখন আর একটুও কষ্ট নেই। এমন অবাক কান্ড কেমন করে হল?’’
‘‘আমরা পাহাড়-মা-র দেখা পাইনি বটে। তিনি কিন্তু আমাদের জন্যে আড়াল থেকে আকাশের নির্মল বাতাস, ঝরনার সুন্দর জল, সবুজ গাছগাছালি ভরা ফলপাকুড় দিয়েছেন। তাই তো তুই সেরে উঠেছিস! আমরা আর এখান থেকে বাড়ি ফিরে যাব না রে ফাল্গুনি!’’
‘‘চলো ঠাকুরমা, এই ঝরনার ধারে আমরা গাছের ডালপাতা দিয়ে একটা কুটির বানাই। আর আমরা দু-জন পালা করে পাহাড়-মাকে খুঁজে বেড়াই।’’
এখন ওদের সেই পাতার কুটির বঁাধা হয়ে গেছে। ওরা আর বনবীথি গ্রামে ফিরে আসেনি। আজ কতদিন হল সেই কুটিরে ফাল্গুনি আর তার ঠাকুরমা থাকে। সঙ্গের চিঁড়ে-মুড়ি কবেই ফুরিয়ে গেছে। তাতে কী? ঝরনার জল আছে। গাছ ভরা ফলমূল আছে। পাহাড়-মা নিশ্চয়ই আছেন। আর তিনি আড়াল থেকে ওদের ভালো করে চলেছেন। কোনোদিন পাহাড়-মা-র সঙ্গে দেখা হলে ওরা দু-জনে তাকে প্রণাম করবে।
কেউ যদি সেই পাহাড়ে যায়, একটা সরু ঝরনার পাশে ফাল্গুনিদের ছোট্ট পাতার কুটিরটা এখনও দেখতে পাবে!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন