শিকারি রাজপুত্র

রতনতনু ঘাটী

দম্ভীনগর রাজ্যের রাজামশাইদের দু-ভাই। বড়ো মিতদ্রুনারায়ণ। রাজ্যের নিয়ম মেনে রাজা হয়েছেন তিনি। কিন্তু রাজ্য চালনার চেয়ে শিকার করতে তাঁর বেশি পছন্দ। শিকারের কথা মনে হলে তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। রাজ্যের ভার কিছু দিনের জন্য ছোটো ভাই শতদ্রুনারায়ণের হাতে দিয়ে তিনি লোকলশকর নিয়ে বেরিয়ে পড়েন জঙ্গলে শিকার করতে।

রাজা মিতদ্রুনারায়ণের রাজদরবারে সার দিয়ে সাজানো আছে হাতির লম্বা লম্বা সাদা দাঁত। কত-না হরিণের বড়ো বড়ো শিং। বাইসনের মস্ত মুন্ডু। বাঘের চামড়ার গালিচা পাতা মেঝেতে। বাঘ আর সিংহের মাথাও তুলে রাখা আছে সার দিয়ে। যে বন্দুক দিয়ে সবচেয়ে বেশি বাঘ মেরেছেন রাজামশাই, সেটিও দেওয়ালে ঝোলানো আছে সযত্নে। কোনো বনে খুব হিংস্র বাঘের খবর রাজামশাইয়ের কানে এসে পৌঁছোলে তিনি তখন সেই বন্দুকটা নামিয়ে আনেন। রাজা মিতদ্রুনারায়ণের শিকার করার খবর আশপাশের কোনো রাজ্যের রাজার কানে পৌঁছোতে আর বাকি নেই।

একদিন মন্ত্রী সকালে রাজদরবারে এসে বললেন, ‘‘রাজামশাই, গুরুতর খবর এসেছে। চম্পকগড়ের রাজা আমাদের রাজ্যের সীমান্তে সৈন্য সাজাচ্ছেন। মনে হয়, শিগগির যুদ্ধের দামামা বাজবে।’’

রাজামশাই মন দিয়ে শুনলেন মন্ত্রীর কথা। ঘাড়ও নাড়লেন। কিন্তু দুপুর গড়াতে-না-গড়াতে শুরু হয়ে গেল সাজসাজ কান্ড। কী, না কাল সকালেই রাজামশাই শিকারে যাবেন। সাজানো হল ঘোড়া, সাজানো হল হাতি। সাজানো হল শিকারবাহিনী। সঙ্গে নেওয়া হল অনেক খাবারদাবার। সঙ্গে নেওয়া হল বিশ্বস্ত লোকজন।

‘‘যুদ্ধ হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু রাজামশাই, আপনি শিকারে যাবেন, তার জন্যে বিশ্বস্ত লোক চাই কেন?’’

মন্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে রাজামশাই বললেন, ‘‘না হে মন্ত্রী, শিকারও যুদ্ধের মতোই। যুদ্ধ হয় মানুষে মানুষে। আর শিকারে গেলে যুদ্ধ চলে বন্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের। ভেবো না, বন্য প্রাণীদের বুদ্ধি মানুষের চেয়ে কম। তাই শিকারের জন্যে বিশ্বস্ত লোক দরকার। কখন কোন দিক থেকে বন্যেরা আক্রমণ করবে, তার ঠিক কী? তারা সতর্ক নজর রাখবে। শিকারের জন্যে আর চাই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। তাই যে-সেলোক শিকারের সঙ্গী হতে পারে না।’’

মন্ত্রী চিন্তিত মুখে বললেন, ‘‘তা না হয় ঠিক কথা। কিন্তু যুদ্ধের কী হবে রাজামশাই? কাল যদি সত্যিই চম্পকগড় আমাদের রাজ্য আক্রমণ করে বসে? আপনি না থাকলে…?’’

রাজামশাই নিশ্চিন্ত মুখে বললেন, ‘‘অমন হলে আমি শতদ্রুনারায়ণকে দম্ভীনগরের ভার দিয়ে যাব। ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না!’’

সেবার চম্পকগড় আক্রমণ করল না বলে রক্ষা পাওয়া গেল। দিন যায়, মাস যায়। রাজামশাইয়ের রাজ্য নিয়ে এমন উদাসীনতার খবর বাতাসে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেল রাজ্যবাসীর কাছেও। রাজ্যবাসীর চিন্তায় যেন আর চোখে ঘুম আসে না।

যে রাজ্যের রাজা রাজ্য চালনার ব্যাপারে এত উদাসীন, একদিন সেই রাজ্যের রাজার এক ছেলে হল। রাজামশাই তার নাম রাখলেন নবনীকিশোর। রাজ্য জুড়ে সাড়া পড়ে গেল। যাক, এবার রাজপুত্র বড়ো হয়ে রাজ্যের ভার হাতে নিলে রাজ্যবাসীর আর কোনো চিন্তা থাকবে না।

রাজপুত্র নবনীকিশোর বড়ো হয়ে উঠতে লাগল। রাজা তাকে ছেলেবেলা থেকেই রাজ্য চালনায় পারদর্শী করে তুলতে লাগলেন। সারা রাজ্য ঢুঁড়ে খুঁজে আনা হল কূটনীতি জানা দক্ষ লোক। তাঁরা পালা করে রাজপুত্রকে রাজ্য চালনার নানা খুঁটিনাটি শেখাতে লাগলেন। সেইসঙ্গে চলতে লাগল অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা। চলতে লাগল রাজপুত্রকে তীর-ধনুক ছোড়া শেখানো। কিন্তু দেখা গেল, রাজপুত্রর বেশি পছন্দ বন্দুক ছোড়া। সেবন্দুক নিয়ে ঘুরতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। পাখি শিকার করে মনের আনন্দে। সেই দেখে রানিমা চিন্তায় পড়লেন খুব। একদিন রাজামশাইকে বললেন, ‘‘আমি দেখছি, নবনীকিশোর আপনার মতো শিকারিই হবে।’’

রাজামশাই অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কেন, তোমার এমন কথা মনে হল কেন?’’

রানিমা বললেন, ‘‘ও তো দেখি সারাদিন বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। এমনকী, রাতে ঘুমোনোর সময়ও পালঙ্কের পাশে বন্দুকটা রেখে ঘুমোতে যায়। নবনীকিশোর আমাদের শিকারি রাজপুত্র! বিশ্বাস না হয়, চলুন, দেখবেন চলুন!’’

রাজামশাই রানিমার সঙ্গে পাশে রাজুপত্রের ঘরে গেলেন সত্যি-মিথ্যে দেখার জন্যে। ঘরে ঢুকে দেখলেন, রাজপুত্র বন্দুকটা পালঙ্কে শুইয়ে রেখে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। এই দেখে রাজামশাইয়ের মনে চিন্তার মেঘ দানা বঁাধতে শরু করল।

পরদিন সকালেই মন্ত্রীর ডাক পড়ল রাজদরবারে। মন্ত্রী সকাল বেলার ব্যায়াম ফেলে ছুটলেন দরবারে। এত সকালে কেন রাজামশাইয়ের ডাক পড়ল?

রাজামশাই বললেন, ‘‘নবনীকিশোরও তো আমার মতো শিকারি হতে চায় মন্ত্রীমশাই? কী উপায় হবে? আমি ভেবেছিলাম, রাজুপত্র আর একটু বড়ো হলে অভিষেক অনুষ্ঠান করে রাজ্যের ভার তুলে দেব নবনীকিশোরের হাতে। কিন্তু এখন তো দেখি, বেজায় চিন্তার কথা!’’

রাজামশাইয়ের কথা শুনে মন্ত্রীও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মাথা চুলকে তিনি উপায় খুঁজতে লাগলেন।

নবনীকিশোর একদিন রাজদরবারে এসে রাজামশাইয়ের কাছে বায়না করল, ‘‘বাবা, আমি শিকার করতে জঙ্গলে যাব। আপনি অনুমতি দিন।’’

রাজামশাই হেসে বললেন, ‘‘তুমি আর একটু বড়ো হও, তখন আমি সঙ্গে করে তোমাকে শিকারে নিয়ে যাব। আগে তোমার বয়স ষোলো পূর্ণ হোক!’’

নবনীকিশোর মাথা নীচু করে রাজদরবার থেকে চলে গেল। ষোলো বছর পূর্ণ হতে এখনও দু-বছর বাকি। সেতো অনেক দিন! অতদিন শিকার করতে পারব না? ভেবে আকুল হল রাজপুত্র।

সময় তো নদীর মতো। আপন মনে বয়ে যায়। রাজপুত্রও দিন গুনতে থাকে।

তেমন সময় একদিন মন্ত্রী এলেন রাজদরবারে। তখন বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধের দিকে। রাজামশাই আনমনা হয়ে একা বসে আছেন। এই সময়টুকুই তাঁর একদম একার। এ সময় তিনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না। একটিও কথা বলেন না কারো সঙ্গে। তখন রাজদরবার যেন এক নিঝুম পুরী হয়ে যায়।

মন্ত্রী গলার স্বর নামিয়ে বললেন, ‘‘মহারাজ, নবনীকিশোরের বয়স ষোলো পূর্ণ হতে আর একুশ দিন বাকি। আপনি এবার অভিষেকের আয়োজন করুন। না হলে রাজপুত্রকে শিকারযাত্রা থেকে ফেরানো যাবে না। রাজপুত্রের মতো অমন নির্ভুল নিশানা আমি কখনো দেখিনি মহারাজ। নবনীকিশোরের হাতের টিপ লক্ষ করছিলাম সেদিন রাজউদ্যানে পুত্রঞ্জীব গাছের ছায়ায় বসে।’’

রাজামশাই অবাক হয়ে মন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘‘কী গাছ বললেন মন্ত্রীমশাই?’’

‘‘সেই যে আপনার মনে নেই? পুত্রের দীর্ঘজীবন কামনার আকাঙ্ক্ষায় এমন গাছ লাগায় মানুষ? আপনিও তো নবনীকিশোরের দীর্ঘজীবন কামনা করে এই গাছ লাগিয়ে ছিলেন? মনে নেই?’’

রাজা মিতদ্রুনারায়ণ চোখ বুজে ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘‘মনে পড়েছে। খুব ছোটো ছোটো হলুদ ফুল ফোটে গাছটায়, তাই না? তা হলে মন্ত্রীমশাই, এই একুশ দিনের মধ্যে নবনীকিশোরের অভিষেকের সমস্ত আয়োজন করুন।’’

মন্ত্রী মাথা নীচু করে বললেন, ‘‘রাজামশাই, অনুমতি দিলে একটা কথা নিবেদন করি?’’

রাজামশাই মুখ তুললেন। তাঁর চোখে প্রশ্ন।

মন্ত্রী বললেন, ‘‘রাজপন্ডিতদের দিয়ে এমন একটা কথা ঘোষণা করুন, অভিষেকের প্রথম দশ বছর রাজপুত্র নবনীকিশোর শিকারে গেলে অমঙ্গল হবে। তা হলে দশ বছর রাজপুত্র শিকারে যেতে পারবে না। একবার রাজকার্যে মন বসে গেলে, দেখবেন, রাজপুত্রের মন থেকে শিকারের ইচ্ছে চিরতরে বিদায় নিয়েছে।’’

মাথা নাড়লেন রাজা মিতদ্রুনারায়ণ। তারপর বললেন, ‘‘মন্দ পরামর্শ নয়! আমি আজই রাজপন্ডিতদের ডেকে আদেশ দিচ্ছি। আপনি অভিষেকের আয়োজন সম্পূর্ণ করুন।’’

অভিষেকের আগের দিন রাজপন্ডিতরা একসঙ্গে কুশের আসনে এসে বসলেন সকলে। তারপর অনেক শাস্ত্র বিচার করে বিধান ঘোষণা করলেন, ‘‘মহারাজ, অভিষেকের প্রথম দশ বছর রাজপুত্রের শিকারযাত্রায় অমঙ্গলের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।’’

সেইমতো ঘোষণা করলেন রাজা মিতদ্রুনারায়ণ। কথাটা কানে গেল রাজপুত্র নবনীকিশোরেরও। মন খারাপ করে রাজকুমার বসে রইল বাতায়নে। রানিমা পিছন দিক থেকে এসে বললেন, ‘‘বাবা, এতে মন খারাপের কী আছে? দেখতে দেখতে দশ বছর সময় কখন কেটে যাবে হুশ করে। তুমি তখন শিকারে যাবে। আমি তখন তোমাকে নিজের হাতে শিকারির বেশে সাজিয়ে দেব।’’

রাজপন্ডিতদের কথা শিরোধার্য করল রাজপুত্র।

তার পরের দিন মহা ধুমধাম করে অভিষেক হল রাজপুত্র নবনীকিশোরের। আলোকমালায় সাজানো হল রাজপ্রাসাদ। রাজপুত্রের অভিষেক দেখতে কত লোকজন এল পাঁচ-সাতখানা রাজ্য উড়াড় করে। কতক্ষণ ধরে শাঁখ বাজাল পুরনারীরা। কত পুষ্পবৃষ্টি করল রাজ্যের বালক-বালিকারা। সারাদিন ধরে বেদগান গাইলেন কত কত ঋষি। আজ থেকে দম্ভীনগরের নতুন রাজা হলেন নবনীকুমার। রাজ্যবাসী পরম নিশ্চিন্তে হাঁফ ছেড়ে যে যার কাজে মন দিল।

এবার হাঁফ ছাড়লেন মিতদ্রুনারায়ণও। তিনি আজ থেকে আর দম্ভীনগরের রাজা নন। আর রাজকার্যের ভার থাকল না তাঁর কাঁধে। প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বাজানোর আদেশ আর দিতে হবে না তাঁকে। এবার তিনি শিকার নিয়ে মেতে থাকবেন। যেদিন, যখন মন চাইবে, সেদিন তখনই বেরিয়ে পড়বেন শিকার করতে।

রাজা নবনীকিশোরের অভিষেকের পর পঞ্চম দিনে মিতদ্রুনারায়ণ রাজা নবনীকিশোরকে ডেকে বললেন, ‘‘আমার মনটা আজ দু-দিন ধরে বড়ো শিকার শিকার করছে। আমি আজ শিকারে যাব।’’

রাজা নবনীকিশোর ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাজসাজ রব পড়ে গেল গোটা রাজপ্রাসাদে। সেই অহংকারী বন্দুকটা নামানো হল রাজদরবারের দেওয়াল থেকে। নিজের হাতে ঘষে-মেজে পরিষ্কার করলেন বন্দুকটা। তারপর মিতদ্রুনারায়ণ শিকারযাত্রা করলেন।

এই ক-দিনে রাজা নবনীকিশোরের মন শিকারের জন্যে একবারও উতলা হয়নি। বরং রাজ্যবাসীর সুখের কথা ভাবতে ভাবতে সকাল কখন যে দুপুর হল, দুপুর কখন যে বিকেলের গায়ে গড়িয়ে পড়ল, বিকেল কখন গোধূলির রং মাখল, কিছুই মনে পড়ল না রাজামশাইয়ের। মানুষের সুখের আয়োজন করতে করতেই তাঁর দম ফেলার সময় জুটল না একটুও।

মিতদ্রুনারায়ণের শিকারযাত্রার ষষ্ঠদিনে রাজা নবনীকিশোরের কাছে খবর এল, মিতদ্রুনারায়ণ একটা বড়ো বাঘিনি শিকার করেছেন। এর আগে মিতদ্রুনারায়ণ এত বড়ো বাঘিনি কখনো শিকার করেননি। এবার তিনি সদলবলে ফিরে আসছেন রাজপ্রাসাদে।

জঙ্গলের অনেক গভীরে পৌঁছে গিয়েছিলেন মিতদ্রুনারায়ণ। ফিরে আসতে আসতে সময়ও লাগল তিনদিন। বীরদর্পে ঢুকলেন রাজপ্রাসাদে। বাঘিনির চামড়া পাঠিয়ে দিলেন শোধন করতে। এত বড়ো বাঘিনির দেখা পাওয়া খুব কম শিকাররই ভাগ্যে জোটে। তাই তিনি গর্বিত ভঙ্গিতে গিয়ে দাঁড়ালেন রাজদরবারে। রাজা নবনীকিশোরের সিংহাসনের সামনে। নবনীকিশোর সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মণিমাণিক্য খচিত রাজপোশাক। তখনই একটা পুঁচকে বাঘের বাচ্চা পুটুস করে গিয়ে ঢুকে পড়ল সিংহাসনের নীচে। রাজা নবনীকিশোর ভয়ে সিংহাসনের উপর পা তুলে বসলেন। মুখে তাঁর আতংক। প্রশ্ন করলেন মিতদ্রুনারায়ণকে, ‘‘বাবা, একে আবার কোথায় পেলেন?’’

মিতদ্রুনারায়ণ হাসি মুখে বললেন, ‘‘গভীর জঙ্গলে ও খেলা করছিল মায়ের সঙ্গে। একটা বড়ো গাছের ঝুঁকেপড়া ডালের নীচে। আর ওর মা ওর সঙ্গে খুনসুটি করছিল। এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে ওর মায়ের মুখে। আমাকে দেখতে পায়নি বাঘিনিটা। ওর সঙ্গে খেলায় মগ্ন ছিল। তখন আমার বন্দুক ছুটল অব্যর্থ নিশানায়।’’ তারপর সিংহাসনের নীচের দিকে আঙুল দেখিয়ে মিতদ্রুনারায়ণ বললেন, ‘‘ও থাকবে রাজপ্রাসাদের একপাশে। ওর জন্যে তুমি বানিয়ে দাও গাছগাছালিতে ভরা একটা ছোটো বন। সেটাই হবে ওর বাড়ি।’’

রাজা নবনীকিশোর চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লেন কয়েকবার। তারপর রাজসিংহাসন ছেড়ে চলে গেলেন শয়নকক্ষে।

সেদিন সারাদিন কারো সঙ্গে দেখা করলেন না রাজা নবনীকিশোর। অনেক ডাকাডাকি করলেন রানিমা। নি:শব্দে রানিমার ডাকও উপেক্ষা করলেন। কিছুই মুখে তুললেন না সারাদিন। একবার শুধু দুপুরের দিকে রাজপেয়াদাকে আদেশ দেওয়ার জন্যে দরজা ফাঁক করলেন। আদেশ দিলেন, ‘‘বাচ্চা বাঘটির জন্যে পর্যাপ্ত দুধ যেন এখনই পাঠিয়ে দেওয়া হয়!’’ একথার পর ফের বন্ধ হল রাজা নবনীকিশোরের শয়নকক্ষের দরজা।

এ খবর পেয়ে মিতদ্রুনারায়ণের মুখ চিন্তায় ঘনঘোর হয়ে উঠল। রানিমার মুখে ঘন কালো মেঘের ছায়া দোল খেতে লাগল তিরতির করে।

গোটা রাজপ্রাসাদ থমথম করতে লাগল নিঝুম রাতের মতো। যেন এক নির্বাক পুরী।

পরের দিন ভোরের পাখি ডাকল। সূর্য উঠে আলো ফেলল রাজপ্রাসাদের মাথায়। তখন রাজা নবনীকিশোর শয়নকক্ষের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। বাঘের বাচ্চাটিকে প্রাসাদের পাশে যে খাঁচায় রাখা হয়েছিল, থমথমে মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন নবনীকিশোর। কত আর বয়স হবে বাঘের বাচ্চাটার? মাস খানেক। গরাদের ফাঁক দিয়ে আদর করতে থাকলেন বাঘের বাচ্চাটির মাথায়।

এমন সময় খবর পেয়ে মিতদ্রুনারায়ণও এসে হাজির হলেন খাঁচার সামনে। রানিমা, মন্ত্রী, সেনাপতি, এমনকী, পন্ডিত, পুরোহিত, সৈন্যসামন্ত, দাসদাসী, কেউ বাকি থাকল না।

মিতদ্রুনারায়ণ মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বললেন, ‘‘ও আজ সকালে অনেকটা দুধ খেয়েছে!’’

রাজা নবনীকিশোর বাবার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘এই মা-হারা বাঘের শিশুটি মাকে হারিয়ে না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে। মন্ত্রীমশাই, ওর জন্যে জঙ্গল থেকে বড়ো বড়ো গাছ তুলে এনে এখানে একটা সুন্দর বন তৈরি করে দিন, যত তাড়াতাড়ি পারেন। এই বনে ও থাকুক। যতদিন না নিজে শিকার ধরতে পারছে, ততদিন ও এখানেই থাকবে। এই বনে শিকার ছেড়ে দিয়ে মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখবেন। ও শিকারে পটু হয়ে উঠলে তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে আসবেন গভীর জঙ্গলে। ওর নিজের জন্মভূমিতে।’’

মন্ত্রী মাথা নীচু করে ঘাড় নেড়ে রাজার আদেশে সায় দিলেন।

মিতদ্রুনারায়ণ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। একটু থেমে বললেন, ‘‘আমি যে বাঘের বাচ্চাটাকে পুষব বলে এনেছি। তোমার রাজপ্রাসাদে একটা পোষা বাঘ আছে, এটা কি কম গর্বের কথা হবে? এও তো তোমার রাজ্যের একটা অহংকার!’’

রাজা নবনীকিশোর ধীর কন্ঠে বললেন, ‘‘বাবা, যে অহংকার অন্যের দুঃখের বিনিময়ে পাওয়া যায়, অমন অহংকার আমি চাই না বাবা। বনের প্রাণী নির্ভয়ে মনের আনন্দে বনে থাকুক, এই তো আমার আনন্দ! আর একটা কথা…’’ একটু থামলেন রাজা নবনীকিশোর। তারপর মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘মন্ত্রীমশাই, ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করে দিন, আমার রাজ্যে আজ থেকে বনের পশু শিকার বন্ধ হল!’’ বলে রাজা নবনীকিশোর রাজদরবারের দিকে হেঁটে চললেন।

তারপর মিতদ্রুনারায়ণ মনে মনে বললেন, ‘ছোটোবেলা থেকে শিকারি হতে চাওয়া আমার ছেলে আজ দম্ভীনগরের যথার্থ রাজা!’ তারপর রাজসেনাপতিকে ডেকে বললেন, ‘‘শিকার করার বন্দুকগুলো তুলে রাখুন সেনাপতি। এগুলোর আর প্রয়োজন হবে না!’’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন