অষ্টাদশ অধ্যায় : স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের কারণসমূহ

অষ্টাদশ অধ্যায়

সহজাত দুর্বলতা

জাতীয়তা বোধ ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণা প্রথম যুগের মুসলমানদের দেশ বিজয়ের মূলে বিশেষ অবদান রাখে। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা দেশ হইতে দেশান্তরে ধর্ম প্রচারে উদ্বুদ্ধ করে। অপরদিকে জাতীয়তাবোধ দেশ বিজয়ে উৎসাহ যোগায়। সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে মুসলমানগণ বিলাসিতা ও সুখে জীবন উপভোগ করিতে অভ্যস্ত হইয়া ওঠে। বিলাসিতা ও উপভোগের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীতার ফলে রাজনৈতিক দলাদলি মাথা চাড়া দিয়া ওঠে এবং বিরাট সাম্রাজ্যের পতন তরান্বিত করে।

স্পেনের মুসলিম শাসনের স্থায়িত্ব ততদিন পর্যন্তই নিরাপদ ছিল যতদিন দক্ষ প্রশাসন যন্ত্র, রাজানুগত শক্তিশালী পুলিশ ও সেনাবাহিনী এবং নিরপেক্ষ ও যোগ্য শাসক দ্বারা দেশের শাসন কার্য পরিচালিত ছিল।

জন কল্যাণধর্মী সুদক্ষ প্রসাশনযন্ত্র রাজানুগত শক্তিশালী পুলিশ ও সেনাবাহিনী এবং নিরপেক্ষ ও সুযোগ্য শাসক দ্বারা শাসন কার্য পরিচালিত হইলে স্পেন মুসলিম শাসনাধীনে থাকিতে পারিত। গভীরভাবে পর্যালোচনা করিলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে স্পেনে মুসলমানদের অব্যাহত পতন ও সর্বশেষে ধ্বংসের মূলে ছিল সামাজিক রাজনৈতিক ও প্রশাসন কাঠামোতে কতিপয় সহজাত দুর্বলতা।

অনৈক্য ও গোত্রীয় বিদ্বেষ ও স্পেনে মুসলিম সম্রাজ্যের ধ্বংসের মুলে বহিঃশত্রু অপেক্ষা অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও বিশৃঙ্খলাই বেশি দায়ী। মুসলমানগণ যে সময়ে স্পেনে পদার্পণ করে সেই সময়ে অনৈক্যের বীজ উপস্থিত ছিল। আরব, (হিমারিটস, ইয়ামানী) কায়সী ও কালবী, সিরীয় (মুজারী), বার্বার (মিকলাসাহ), সানহাজাহ ও জানাতাহ, নব মুসলিম, খ্রীস্টান ও ইহুদী প্রভৃতি জাতীয় ও ধর্মের অনুসারীগণ স্পেনে বসবাস করিতে শুরু করে। আরব ও বার্বারগণ তাহাদের পূর্ব পুরুষের গোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বীতার মানসিকতা স্পেনের মাটিতেও অতিযত্নে লালন করিয়া চলে। তাহাদের প্রধান শত্রু খ্রীস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিবর্তে তাহারা নিজেদের মধ্যে বিবাদ ও বিরোধে লিপ্ত হয়। প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা যায় চার্লস মার্টেলের নেতৃত্বাধীনে পরিশ্রান্ত সেনাবাহিনী তুরস্কের যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন কিন্তু গোত্রীয় কলহে লিপ্ত মুসলিম সেনাবাহিনী আবদুর রহমান আল গাফিকীর স্থলে একজন নতুন সেনাপতি নির্বাচন করিয়া খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানিতে ব্যর্থ হয়। এই গোত্রীয় বোধ বা কওম চেতনার (আসাবিয়াহ) অভাবের ফলেই আলহামদিনা ও জামাছার যুদ্ধের ন্যায় কতিপয় যুদ্ধ বিজয় লাভের পরও মুসলমানদিগকে পরাজয়ের গ্লানি বহন করিতে হয়।

বার্বার সেনাদের সাহায্যে মনসুর স্বেচ্ছাচারমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করিতে উদ্যোগী হইলে জনপ্রিয়তা হারাইয়া ফেলে। স্পেনে উমাইয়া শাসনকালে আমরা দেখিতে পাই গৃহযুদ্ধ গোত্রীয় ও উপদলীয় কোন্দল এবং দেশী বিদেশীর দ্বন্দ্ব। একমাত্র শক্তিশালী শাসকই উহাদিগকে বসে রাখিতে পারিতেন। উমাইয়া শাসনের শেষ পর্যায়ে বহু প্রদেশ কেন্দ্রের হাতছাড়া হইয়া যায়। প্রদেশগুলি কেন্দ্রীয় সরকার হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার পর কর্ডোভার খেলাফতের ধ্বংস স্কুপের উপর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বার্বার, পূর্বাঞ্চলে স্লাভ, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আরব, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নবমুসলিম ও খ্রীস্টানগণ নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করে।

উমাইয়াদের পতনের পর ক্ষণস্থায়ী বহু রাজবংশের আবির্ভাব ঘটে। এই সমস্ত ক্ষুদ্র শাসকগণ সামাজিক বিদ্বেষ ও উপজাতীয় কোন্দলের শিকারে পরিণত হয়। সেভিলের মুতামিদ, টলেডোের মামুন একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। স্পেনের আরব নেতাদের বিরুদ্ধে মালাগার ইয়াহিয়া বার্বার নেতাদের এক যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ইয়াহিয়া বার্বার ঐক্য ফ্রন্টের মাধ্যমে কার্ডোভা ও সেভিলের অস্তিত্বকে বিপন্ন করিয়া তোলেন। এই ঐক্যফ্রন্ট দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। বাবার সর্দারগণ একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। সেভিলের ইসমাইল কর্তৃক ইয়াহিয়া পরাজিত ও নিহত হন। ইসমাইলও পরবর্তীকালে আলমেরিয়ার স্লাভনেতা জুহায়ের কর্তৃক নিহত হয়। গ্রানাডার বাদিস ও জুহায়েরের মধ্যে ছিল চরম শত্রুতা। জিরি শাসক বাদিস ছিলেন বার্বারদের একমাত্র নেতা যিনি আরবদের নেতা মুতামিদের মোকাবিলা করেন। বানু হামুদ ঐক্যবদ্ধ ছিল না। মালাগা ও আলজেসিরাস তাহাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজধানী গড়িয়া ওঠে। কিছু ক্ষুদ্র দেশের শাসক গৃহযুদ্ধে পরাজিত হইয়া ক্ষান্ত হয় না, তাহারা মুসলিম স্পেনের ধ্বংস ত্বরান্বিত করিবার উদ্দেশ্যে খ্রীস্টানদিগকে আহ্বান জানায়।

টলেডোর বানু জুনুনদের শ্রেষ্ঠ শাসক মামুন কর্ডোভাকে আবদুল মালিক বিন জওহারের কবল হইতে উদ্ধার করিতে ব্যর্থ হইয়া ক্যাস্টিল ও লিওনের খ্রীস্টানদের সহিত চুক্তি সম্পাদন করেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে তিনি ষষ্ঠ আলফন্সেকে তাহার রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। মুসলিম স্পেনের শেষ পর্বে শ্রেষ্ঠ নসরীরাজবংশ স্পেনে মুসলিম সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের উপর গড়িয়া ওঠে। খ্রীস্টানদের সাহায্য ও সহযোগিতায় পূর্ববর্তীদের ন্যায় এই রাজবংশেরও অবসান ঘটে। দেশের প্রশাসন কার্যকলাপে ন্যায্য অংশ হইতে বঞ্চিত, আরব শাসনের প্রতি অসন্তুষ্ট ও বৈরীভাবাপন্ন বার্বারগণ তাহাদের মূল আবাসভূমির সহিত বরাবর যোগাযোগ রক্ষা করিত। উত্তর আফ্রিকার বার্বারদের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দিলে স্পেনের আরবদের বিরুদ্ধেও তাহারা বিদ্রোহ করিত। তাহারা ইহা করিত প্রশাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া। ইহাতে মুসলিম সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হইয়া পড়ে। বার্বারগণ স্পেনে আরব শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটাইবার ইন্ধন যোগায়। আরব শাসন অবসানের পর তাহারা স্পেনকে

নিজস্ব সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। স্পেনের সামরিক শক্তি হ্রাস পাইবার পর মুরাবিতুন ও মুয়াহিদীনগণ স্পেনে আগমন করে। তাহারা মরক্কো হইতে স্পেনকে শাসন করিত। ফলে তাহারা কার্যকরীভাবে তাহাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করিতে ব্যর্থ হয়। নব মুসলিম ও আরবদিগকে খ্রীস্টানদের হস্তে সমৰ্পণ করিয়া বহু বার্বার তাহাদের আবাসভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে। দেশ ত্যাগ করিয়া নব মুসলিমদের কোথাও যাইবার জায়গা ছিল না। এবং আরবগণ দেশ ত্যাগের চিন্তাও করিত না। আরব ও বার্বারদের উপদলীয় কোন্দলের সুযোেগ লইয়া বিদেশী শক্তিগুলি স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান না হওয়া পর্যন্ত তাহাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে। দুর্বল প্রশাসন ও দুর্বল কেন্দ্রীয়-সরকার, চরিত্রবান শাসক, কর্তব্যনিষ্ঠ সরকারি কর্মচারী এবং শক্তিশালী ও সুশৃংখল সেনাবাহিনীর উপর মুসলিম সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল। উমাইয়া সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অপদার্থ শাসকদের আগমনে প্রশাসনযন্ত্রের অবনতি ঘটে এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগতা এমন কি পুলিশ বিভাগের লোকেরাও তাহাদের কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করিতে ব্যর্থ হয়।

আত্মকেন্দ্রিক ও দেশপ্রেম-বর্জিত মুসলিম অভিজাত শ্রেণী, সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও অনৈক্যের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল। এমনকি তৃতীয় আবদুর রহমানের সময়েও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মারাত্মক অসন্তুষ্টি পরিলক্ষিত হয়। দ্বিতীয় হাকাম ও তাঁহার বংশধরদের রাজত্বকালে ইহা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। আরব অভিজাত শ্ৰেণীর শক্তিকে খর্ব করিবার উদ্দেশ্যে তৃতীয় আবদুর রহমান বহু সংখ্যক স্লাভকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করেন। হাজীব আল-মনসুর বার্বারদিগকে সেনাবিভাগের চাকুরীতে নিয়োগ করেন। ইহাতে সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে শাসক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রথম হাকামের রাজত্ব কাল হইতেই ক্রীতদাস ও খোজাগণ রাজপ্রাসাদে তাহাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করিতে শুরু করে। এবং খেলাফত আমলেই স্লাভগণ পৃথক দল গঠন করিয়া প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাহারা সরকারি উচ্চপদ ও উপঢৌকনের মাধ্যমে প্রশাসন যন্ত্রকে কুক্ষিগত ও কলুষিত করে। রাজার সিংহাসনে আরোহণ ও অপসারণ তাহাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করিত। আবদুর রহমানের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও জাতীয় ঐক্য গড়িয়া ওঠে না। তাহার আমলে কৃত্রিম জাতীয়ঐক্য অদূর ভবিষ্যতে বিনষ্ট হইয়া যায়।

স্পেন শাসনের ব্যাপারে মুসলিম শাসকগণ কঠোর চরিত্রের আরব সিরীয় ও বার্বারদের উপর নির্ভর করিনা। বরং বহু সংখ্যক বিদেশী স্লাভ ও নিগ্রোকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করায় সেনাবাহিনী অনির্ভরযোগ্য হইয়া ওঠে। বিদেশীগণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হইয়া শুধু টাকার লোভে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিত। তাহারা কদাচিৎ বিদ্রোহ দমন ও নিয়োগ কর্তার শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিত। বিদেশী বেতনভুক

সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত দ্বিতীয় হাকামের সেনাবাহিনী আফ্রিকার বার্বারদের তুলনায় খুবই নিম্নমানের ছিল। আবু আমীর মুহাম্মদ কর্তৃক দেশের উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী ও আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে রাজকীয় বাহিনীর উপর যে প্রবল চাপের (Strain) সৃষ্টি হয় তাহার ফলে রাজকীয় বাহিনী আরও ক্ষীণবল হইয়া পড়ে।

দ্বিতীয় আল হাকাম ও আবু আমীর মুহাম্মদের পরবর্তী শাসকগণ তেমন প্রতিভাবান ও অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাঁহারা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিরাট সাম্রাজ্যের বিদ্রোহ দমন করিয়া দেশকে পরিচালিত করিতে পারেন নাই। এই সময় হইতেই প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যের অবনতি ও অধঃপতন শুরু হয়। দ্বিতীয় হিশামের সিংহাসনে আরোহণ কালে তিনি ছিলেন নাবালক। এই সুযোেগে তাহার প্রধানমন্ত্রী তাঁহাকে প্রভাবিত করিয়া রাজ্যের প্রশাসন ক্ষমতা নিজে কুক্ষিগত করেন। ইহা অবনতি ও অধঃপতনে ইন্ধন যোগায়।

শৈথিল্য সৃষ্টিকারী আবহাওয়া, খাদ্যদ্রব্যের সহজ লভ্যতা, আন্দালুসীয়দের সহিত অসবর্ণ বিবাহ, বিলাসীতার প্রশ্রয় দান, আমোদ প্রমোদ ও অপরাপর আনুষঙ্গিক কারণে যুবরাজগণ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গভর্নর ও সৈন্য পরিচালনার জন্য সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত হইত না। কেউ কেউ গভর্নর ও সেনাপতি নিযুক্ত হইলেও তাহারা অশান্তি সৃষ্টি করিত ও গণঅসন্তোষে ইন্ধন যোগাইত। ভোগ বিলাসপূর্ণ ঘৃণিত জীবন যাপন করিত এবং হেরেমের আরাম আয়াশে লিপ্ত হইত। পরবর্তীকালের ক্ষুদ্র শাসক ও যুবরাজদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক ভালো ছিল না ফলে যুবরাজগণ রাজপরিবার ও অভিজাত শ্রেণীর সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়। ক্ষুদ্র শাসকদের মধ্যে গ্রানাডার বানু জিরি রাজবংশের হাব্দুস ও কাদীস, সেভিলের আবু আমর আব্বাস রাজবংশের মুতাদিদ ও তাহার পুত্র মুতামিদ, টলেডোর বানু জুনুন রাজবংশের ইয়াহিয়া আল মামুন, গ্রানাডার বানু নাসর রাজবংশের আবুল হাসান আলী ও তাহার পুত্র আবু আব্দুল্লাহ (বুয়াব দিল) এর ন্যায় সুযোগ্য শাসকগণও আয়াসের জীবন যাপন করিতেন।

এই সব যুবরাজ তাহাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ও শৌর্যবীর্যকে হারাইয়া ফেলিয়া ভোগ বিলাসে লিপ্ত হইয়া অধপতিত জীবন যাপন করে। সেভিলের আবু আমর আব্বাস আল মুতাদিদ সমসাময়িক কালের মুসলিম স্পেনের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। তাহার হেরেমে ৮০০ নির্বাচিত সুন্দরী ক্রীতদাসী ছিল, তাহার উত্তরাধিকারী মুতামিদ ছিলেন গান বাদ্য ও আমোদ প্রমোদের প্রতি অতিরিক্ত আকৃষ্ট। উজির ইবনে আম্মার ও রানী রুমাইকিয়াহ তাহার সীমাহীন লোভ-লালসা চরিতার্থে উৎসাহ দান করেন। মুতাদিদের ন্যায় গ্রানাডার বিখ্যাত আলকাজরের প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল নামক জনৈক ইহুদীর হস্তে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করিয়া নিজে ভোগ বিলাসে উন্মত্ত হইয়া ওঠেন। আলমেরিয়ার উজির ইবনে আব্বাসও মদ্যপান এবং লম্পট্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাহার হেরেমে ৫০০ গায়িকা ও নর্তকী ছিল। এই ধরনের উচ্চাভিলাসী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রভাবে রাজ্যের

প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। গানবাদ্য ও আনন্দ উৎসব উপভোগ এবং লাম্পট্য ও মদ্যপানের প্রশ্রয়দানের ফলে রাজা এবং প্রজা উভয়েই দুনীতিপরায়ণ হইয়া পড়ে। ভ্যালেন্সীয়গণ সিদের নিকট আত্মসমর্পণ করিতে আসিলে তিনি রূঢ় ভাষায় বলেন, কোন জরুরী কাজ থাকিলে তোমরা আমার নিকটে আসিও। আমি তোমাদের কথা শ্রবণ করিব। আমি তোমাদের রাজার মতো তোমাদিগকে আমার দর্শন হইতে বঞ্চিত করিব

কারণ আমি তোমাদের রাজার মতো নারী ও মদের ভিতরে নিজেকে বিলীন করিয়া দেই নাই। মুসলিম শাসকদের অধঃপতনের যুগের ইহা প্রকৃতি চিত্র। আন্দালুসিয়ার ক্ষুদ্র শাসকগণ তাহাদের চরিত্রহীনতা ও লম্পট্যপনার জন্য ইউসুফ বিন তাশফিন কর্তৃক তিরস্কৃত হন। আন্দালুসীয় আবহাওয়ার প্রভাবে মুসলমানগণ তাহাদের উৎসাহ উদ্দীপনা এবং চরিত্রের যাযাবরীয় বৈশিষ্ট্য এবং সাহস হারাইয়া ফেলে এবং ভোগ বিলাসিতা মদ্যপান গায়ক ও নর্তকী পরিবৃত্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হইয়া পড়ে। রাজা এবং অভিজাত শ্রেণীর পরিবর্তে ভোগবিলাস ও অসঞ্জীবন যাপনের জন্য খ্রীস্টান সন্ন্যাসী এবং ধর্মযাজকগণ সাধারণ মুসলমানদিগকে সমালোচনা করেন। ফলে তাহাদিগকে স্পেন হইতে বিতাড়িত হইতে হয়। খলিফা ও আমীরদের বল্গাহীন খেয়াল খুশিকে বাধা প্রদানের মত কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। প্রথম আবদুর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদ স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের বাধা দানে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। তৃতীয় আবদুর রহমানেরও একটি উপদেষ্টা পরিষদ ছিল। তিনি তাহাদের পরামর্শ কদাচিৎ গ্রহণ করিতেন। শাসকদের স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে বাধা প্রদানের মত কোন শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকিলে হয়ত দুর্বল শাসকদের সময়ে দেশের অভ্যন্তরে যে সীমাহীন অশান্তি ও বিশৃংখলা বিরাজ করিত তাহা দমন করা সম্ভব হইত। উত্তরাধিকার আইনের কড়াকড়ি না থাকায় রাষ্ট্রের শক্তি ও সম্মান হ্রাস পায়। রাজার পুত্র, ভ্রাতা অথবা নিকট আত্মীয়গণের প্রত্যেকই শূন্য সিংহাসনের যোগ্য প্রার্থী বলিয়া দাবী করিত এবং শক্তি পরীক্ষা ব্যতীত এই দাবী তাহারা পরিত্যাগ করিত না। নতুন শাসক নির্বাচনে কোন নিয়মতান্ত্রিক প্রথা অথবা নির্ধারিত উত্তরাধিকার আইন থাকিলে রাষ্ট্রের কল্যাণে অহেতুক রক্তপাত এবং গোলযোগকে পরিহার করা যাইত। উমাইয়াদের অধঃপতনের যুগে খায়রানুল সাকা পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি শক্তিশালী ও স্থায়ী হইলে প্রচুর রক্তপাতের ঘটনা হয়তো ঘটিত

দূরবর্তী প্রদেশসমূহের শাসনের জন্য সরকারের কোন উপযুক্ত (প্রতিষ্ঠান) ব্যবস্থা ছিল না। সীমাহীন সম্পদের মালিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী গভর্নরগণ প্রায়ই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিত। শাসকগণ কল্যাণজনক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়া গভর্নরদিগকে বাধা দিতে এবং প্রদেশগুলিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করিয়া কেন্দ্রীয় শাসনের আওতাভুক্ত করিতে ব্যর্থ হন।

সুদীর্ঘ অঞ্চলের প্রতি সরকারের অবহেলার দরুন কোন কোন সময় জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিত। দুর্বল রাজাদের শাসন আমলে দূরবর্তী অঞ্চল ও পল্লীসমূহের নিরাপত্তা এবং শান্তি শৃংখলার জন্য প্রকৃতপক্ষে কোন কার্যকরী ব্যবস্থাই অবলম্বিত হইত না। গ্রাম্য টাউটগণ প্রশ্রয় পায়। জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ছিল শুধু খাজনা আদায়ে সীমাবদ্ধ। ফলে কেন্দ্রে পরিবর্তন হইলেও গ্রামবাসীদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দিত না। সম্রাটদের বড়জোর গভর্নরদের সহিত সম্পর্ক ছিল প্রজাদের সহিত তাহাদের কোন রকম যোগাযোগ ছিল না। খলিফা অথবা মন্ত্রীর হত্যা কিম্বা সরকারের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহে জনগণ কোন প্রতিবাদ জানাইত না। সরকারের প্রতি তাহাদের অনীহার সুযোগ পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করিত বিদ্রোহী ও খ্রীস্টান অনুপ্রবেশকারীগণ ! সরকারের সামরিক বৈশিষ্ট্য অব্যাহত থাকে। বিজয়ী ও বিজিতের ব্যবধান দূরীভূত করিয়া জাতীয় সরকার গঠিত হয় নাই। ফলে দেশের সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা দেয়। এবং বিদ্রোহীগণ কোন কোন সম্প্রদায়ের সমর্থন অবশ্যই লাভ করিত। প্রথম আবদুর রহমানের রাজত্বকালে স্পেনের স্থানীয় জনগণকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা হয়। সর্বোপরি আরব ও বার্বারদের পুরাতন উপজাতীয় শক্রতা, দেশী-বিদেশী বিরোধ, প্রথম হাকাম ও আবদুল্লাহর রাজত্বকালে এমনকি হাজীব আল-মনসুরের পরেও সাংঘাতিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করে।

অর্থনৈতিক দূরাবস্থা : একাধারে খ্রীস্টানদের সহিত যুদ্ধে ও মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেকার গৃহবিবাদের ফলে আবদুল মালিক আল মুজাফফরের (মৃত্যুঃ ১০০৭ খ্রীঃ) মৃত্যুর পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হইয়া পড়ে। দুর্গসমূহের মেরামত ও সেনাবাহিনীর বেতনের টাকা সরকারী তহবিলে ছিল না। সরকারি কর বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকগণ তাহাদের কৃষিকর্ম পরিত্যাগ করিয়া অন্যবিধ জীবিকা গ্রহণ করে। তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ দস্যুতে পরিণত হয়। সাম্রাজ্যের আর্থিক কাঠামো প্রায় ধ্বংস হইয়া যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের জন্মের ফলে আমদানী-রপ্তানীর শুল্ক ও টোল বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ ক্ষুদ্র রাজার একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাহা হইল জনগণের অর্থে নিজ নিজ রাজ্যভাণ্ডার স্ফীত করা। রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে শিল্পজাত বস্তুর রপ্তানীর উপর বর্ধিত কর আরোপিত হয়। ইহাতে জীবিকার ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি সৃষ্টিতে সহায়ক ব্যবসায়-বাণিজ্যে বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। দেশের তথাকথিত শিল্পী সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অঢেল সাহায্য এবং ক্যাস্ট্রিলীয় নাভাররীয়দিগকে কর দেওয়ার ফলে রাজকোষ শূন্য হইয়া পড়ে। টলেডোর মামুনের পুত্র, দুর্বল ও অযোগ্য শাসক ইয়াহিয়া আল কাদির খ্রীস্টানদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। তিনি তাঁহার গরীব প্রজাদের নিকট হইতে যতদূর সম্ভব বেশী রাজস্ব আদায় করিতেন, তাহার প্রভুকে অধিক কর দেওয়ার জন্য। অসন্তুষ্ট জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া তাহকে রাজধানী হইতে বিতাড়িত করে

এবং বাদাজোজের শাসক আল মুতাওয়াক্কিলকে আহবান জানায়। অসহায় কাদির ষষ্ঠ আলফন্সের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১০৮৫ খ্রীঃ তিনি নিজে টলেডো অধিকার করেন। এবং কাদির তাহার জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি ভ্যালেন্সিয়াতে অতিবাহিত করেন। চতুর্থ হেনরীকে বাৎসরিক ১২০০০ দিনার কর প্রদানে সম্মত হইয়া গ্রানাডার সাদ বিন আলী শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। তাহার পুত্র ও উত্তরাধিকারী আবুল হাসান আলী। (১৪৬৫-৮২ খ্রীঃ) এই মোটা কর দানে ব্যর্থ হইবার ফলে খ্রীস্টানগণ নতুন করিয়া আক্রমণ করে। বার্ট্রান্ড বলেন,“ খ্রীস্টান যুবরাজগণ মুসলিম রাজ্যকে অধিকার করিয়া এবং তাহাদিগকে দেশ হইতে বিতাড়িত অথবা উৎখাত না করিয়া তাহাদের রাজ্যগুলিকে আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করিবার দীর্ঘস্থায়ী নীতি গ্রহণ করিয়াছিলেন।

মুসলিম নীতির দুর্বলতা ও ভৌগোলিক প্রতিকূলতা : আদিম যোগাযোগ ব্যবস্থা এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও রাজনৈতিক ঐক্যবিধানে অন্তরায় সৃষ্টি করে। স্পেনে পরিপূর্ণ ঐক্যবিধানের পরিবেশ অনুপস্থিত ছিল উপরন্তু কতিপয় প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে আঁকা বাঁকা পথে সেনাবাহিনী দ্রুত গমনাগমন করিতে পারিত না। ফলে দুর্বল শাসকদের সময়ে দেশের অভ্যন্তরে যাতায়াত নিরাপদ ছিল না।

মুসলমানগণ ফ্রান্সে তাহাদের উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী করিতে ব্যর্থ হন। স্পেনের অভ্যন্তরে ফ্রান্সের উপনিবেশ থাকিয়া যায়। ফ্রান্স অভিযান পরিচালনা করিয়া স্পেনে তাহার শক্তি বৃদ্ধি করিতে থাকে। ফলে মুসলিম-স্পেন দ্রুত ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়। মুসলমানগণ তাহাদের শক্তিকে সুসংহত করিয়া স্পেনের অভ্যন্তরে ফ্রাঙ্কের সিটমহল সমূহের ধ্বংস সাধন এবং নিজেদের উপনিবেশ বহাল রাখিতে চেষ্টা করিতে পারিত। তাহাদের অঁধিকৃত এলাকাকে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে ফ্রান্সে মুসলমানদের সেনানিবাস নির্মাণ করা উচিৎ ছিল। ইহার ফলে ইউরোপে আরো অগ্রসর না হইতে পারিলেও নিজেদের দখলকৃত এলাকা অধিকারে রাখিতে পারিত। মুসলমানদের শাসনের প্রথম যুগে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নারবোনে তাহাদের নামমাত্র একটি ঘাঁটি ছিল। ফ্রান্সের অভ্যন্তরে যুদ্ধ চলাকালে শক্রর বিরুদ্ধে নারবোন হইতে তেমন কোন সাহায্যের আশা করা যাইত না। তাহারা সব সময় কর্ডোভার নিকট হইতে সাহায্যের প্রত্যাশা করিত। দূরত্ব, সড়ক পথের অসুবিধা এবং নৌশক্তির দুর্বলতার কারণে অতিদ্রুত সামরিক সাহায্য প্রেরণের সম্ভাবনা ছিল সুদূর পরাহত। তুষারাবৃত পীরেনীজের মধ্য দিয়া কয়েকটি মাত্র গিরিপথ ছিল। ইহাও বৎসরে প্রায় ছয়মাস বরফে আচ্ছাদিত থাকিত। উত্তর-আফ্রিকা মুসলিম দেশগুলি হইতে নিয়মিত সাহায্য পাওয়ার আশায় তাহারা রাজধানী হিসাবে কর্ডোভাকে নির্বাচন করেন। কিন্তু সারা দেশ তাহাদের অধিকারে রাখিবার জন্য রাজধানী হিসাবে টলেডো অপেক্ষা মেদিনাসেলী ছিল অধিক উপযুক্ত। এখান হইতে দেশের সর্বত্র অতিদ্রুত ও অতি সহজে সেনা প্রেরণ করা যাইত,

যাহা কর্ডোভা হইতে সম্ভব ছিলনা। অবশ্য কর্ডোভা হইতে উত্তর-আফ্রিকাতে অতি সহজে প্রবেশ করা যাইত।

আবহাওয়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে দক্ষিণে বসবাসকারী মুসলমান ও উত্তরে বসবাসকারী খ্রীস্টানগণ অষ্টম খ্রীস্টাব্দে ডুরোর পরিত্যক্ত মেসেত অঞ্চল সেনাসীমানা হিসাবে ব্যবহার করে। দশম খ্রীস্টাব্দে এই সীমারেখা বরাবর তৃতীয় আবদুর রহমান ও হাজীব আল-মনসুর দুর্গ নির্মাণ করেন। কিন্তু একাদশ শতাব্দীতে এইগুলি উত্তরের খ্রীস্টানগণ কর্তৃক অধিকৃত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১০৮৫ খ্রীঃ টলেডোর পতনের সাথে সাথে সারা আন্দালুসিয়া উত্তরাঞ্চলের অগ্রসরমান খ্রীস্টান সৈনিকদের সহজ আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। বার্ট্রান্ডের মতে, “কয়েক শতাব্দী ধরিয়া মূরগণ যেমন খ্রীস্টানদের সহিত ব্যবহার করে, ঠিক একইভাবে খ্রীস্টানগণ শক্তিশালী হইবার পর তাহাদের শত্রু মুসলমানদের সঙ্গেও অনুরূপ ব্যবহার করে।”

বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী স্পেনীয় জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া দেশের নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা রক্ষা করা ও তাহাদের সমর্থন লাভ করা মুসলিম শাসকদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। মুসলিম শাসকগণ বুঝিতে পারে যে,জনগণের সমর্থন ব্যতীত রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা কল্পনা করা আকাশ কুসুম মাত্র। তৃতীয় আবদুর রহমান তাহার প্রজাকুলকে ঐক্যবদ্ধ করিতে সফলকাম হন বটে কিন্তু ইহা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। আবদুর রহমানের অনুসৃত নীতির ফলে আরব অভিজাত সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় ও শাসকগণ বেতনভুক সৈনিকদের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়ে।

মুসলমানগণ যখন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের সম্মুখীন সেই সময় খ্রীস্টান অভিজাত সম্প্রদায় এবং পাদ্রীগণ তাহাদের উপর চরম আঘাত হানিবার সুযোগ গ্রহণ করে। দ্বিতীয় আবদুর রহমানের রাজত্বের শেষদিকে তাহার সহনশীলতা, দয়া ও উদারতার সুযোগ গ্রহণ করিয়া ধর্মোন্মত্ত খ্রীস্টানগণ মারাত্মক ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। ফলে কিছু সংখ্যক খ্রীস্টানকে বন্দী ও হত্যা করা হয়। প্রথম মুহাম্মদ কঠোর হস্তে তাহাদিগকে দমন করেন। কিন্তু খ্রীস্টান উগ্রপন্থীদের মানসিক পরিবর্তন হয় না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাহাদের ঘৃণা ও শক্রতা পূর্বের মতই থাকে। এ সমস্ত উগ্রপন্থী খ্রীস্টানগণ ইবনে হাফসুনের সহিত যোগদান করে। হাফসুন ঘোষণা করেন যে, অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ ও আরবদের গোলামী হইতে স্থানীয় জনগণকে তিনি মুক্তি দিতে আগ্রহী। কর্ডোভার সিংহাসনে শক্তিশালী শাসকবৃন্দ অধিষ্ঠিত থাকাকালে তাহারা শাসকদের অনুগত ছিল ও মাথা নত করিয়া থাকিত। টলেডো তাহার সুবিধাজনক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে মুসলিম শাসককে অগ্রাহ্য করিবার চেষ্টা করে।

মুসলমানদের অদূরদর্শী নীতি অনুসরণের ফলে খ্রীস্টানগণ শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাসের সুযোগ লাভ করে। তাহারা মুসলিম সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধনের অভিপ্রায়ে

মুসলমানদিগকে দেশ হইতে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করিবার উদ্দেশ্যে উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী তাহাদের স্বজাতিদের সহিত গভীর ষড়যন্ত্রে অংশ গ্রহণ করে। মুসলমানগণ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার শিকারে পরিণত হইয়া অধিকৃত খ্রীস্টান এলাকা হইতে বিতাড়িত হয়।

উপরে উল্লিখিত অভ্যন্তরীণ অসুবিধাসমূহ সত্ত্বেও মুসলমানগণ যদি তাহাদের দলীয় ও গোত্রীয় কলহ বিদ্বেষকে দূরীভূত করিয়া নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করিতে পারিতেন তাহা হইলে স্পেনে তাহাদের শাসন কায়েম রাখিতে সক্ষম হইতেন। তাহাদের ব্যক্তিগত বিরোধ ও দলীয় স্বার্থের সংঘাত স্পেনে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে বরাবরই আমরা দেখিতে পাই। তাঁহাদের শত্রুদের উগ্রতা, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ ব্যতীত ইহাই ছিল তাঁহাদের পতনের মূল কারণ। মুসলমানদের ধ্বংস ও পতনের জন্য প্রধানতঃ তাঁহারা নিজেরাই দায়ী ছিল। কিন্তু দেশ হইতে উৎখাতের মূলে খ্রীস্টান ধর্মোন্মত্তগণ সক্রীয় ভাবে অংশ গ্রহণ করে। শাসক অথবা শাসিত রূপে স্পেনে মুসলমানদের থাকিবার অধিকার অবশ্যই ছিল। খ্রীস্টানদের ন্যায় তাঁহাদের পূর্বপুরুষগণও সেখানে যুগ যুগ ধরিয়া বসবাস করিয়া আসিতেছিল এবং দেশের উন্নয়নে তাঁহাদের বিরাট অবদান ছিল। তাহারা স্পেনেরই সন্তান এবং স্পেনীয় খ্রীস্টানদের মতই সমান অধিকার ভোগ করিত। একমাত্র খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ না করার অপরাধে পূর্বপুরুষের ভিটামাটি হইতে তাহাদিগকে বিতাড়িত ও উৎখাত হইতে হয়।

খ্রীস্টান শাসক ও বিশপগণ সালাউদ্দীন ও অন্যান্য মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে শৈশবকাল হইতেই বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ছিল। খ্রীস্টান শাসকগণ গ্রানাডার পতনের পর মুসলমানদিগকে স্পেনে বসবাস করিতে দেওয়ার কুফল সম্পর্কে অবহিত ছিল বলিয়া তাহারা মুসলমানদিগকে স্পেন হইতে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত ও উৎখাত করিবার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন।

তথ্য নির্দেশ

বারট্রান্ড, দ্যা হিস্ট্রি অব স্পেন, পৃঃ ৬২। ঐ, পৃঃ ১৪৮। ঐ, পৃঃ ১৪৮।

সকল অধ্যায়

১. উপক্রমণিকা (মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাস)
২. প্রথম অধ্যায় : মুসলমানদের স্পেন বিজয়
৩. দ্বিতীয় অধ্যায় : দামেস্ক-খেলাফতের অধীন উমাইয়া আমীরদের শাসন
৪. তৃতীয় অধ্যায় : স্বাধীন উমাইয়া আমীরদের রাজত্ব
৫. চতুর্থ অধ্যায় : প্রথম হিশাম
৬. পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম হাকাম
৭. ষষ্ঠ অধ্যায় : দ্বিতীয় আবদুর রহমান
৮. সপ্তম অধ্যায় : প্রথম মুহাম্মদ
৯. অষ্টম অধ্যায় : মুনজির ও আবদুল্লাহ
১০. নবম অধ্যায় : উমাইয়া খিলাফত
১১. দশম অধ্যায় : দ্বিতীয় হাকাম
১২. একাদশ অধ্যায় : হাজীব আল-মনসুর
১৩. দ্বাদশ অধ্যায় : স্পেনে উমাইয়া খিলাফতের পতন
১৪. ত্রয়োদশ অধ্যায় : স্পেনের উত্তরাঞ্চলে খ্রীস্টান রাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয়
১৫. চতুর্দশ অধ্যায় : প্রথম পর্যায় ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহ
১৬. পঞ্চদশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পর্যায় – উত্তর আফ্রিকার শাসন
১৭. ষষ্ঠদশ অধ্যায় : তৃতীয় পর্যায়ঃ নাসরী রাজবংশ
১৮. সপ্তদশ অধ্যায় : মরিস্ক জাতি
১৯. অষ্টাদশ অধ্যায় : স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের কারণসমূহ
২০. উনবিংশ অধ্যায় : শাসনকার্য ও প্রশাসন
২১. পরিশিষ্ট-ক : ইক্রিতিশে কর্ডোভান মুসলমানদের শাসন
২২. পরিশিষ্ট-খ : স্পেনে মুসলিম শাসকদের বংশানুক্রমিক তালিকা
২৩. পরিশিষ্ট-গ : উত্তর-স্পেনে খ্রিষ্টান শাসকদের কালানুক্রমিক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন