দশম অধ্যায় : দ্বিতীয় হাকাম

দ্বিতীয় হাকাম
(৯৬১-৭৬ খ্রীঃ)
দশম অধ্যায়

সিংহাসনে আরোহণ

তৃতীয় আবদুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় হাকাম আল মুসতানসির বিল্লাহ উপাধি ধারণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় হাকাম আবদুর রহমানের প্রধান সহকারী ছিলেন। তিনি তাঁহার পিতা কর্তৃক নিযুক্ত সমস্ত মন্ত্রীকে বহাল রাখেন। জাফর আল-আসকালাবী নামে জনৈক স্লাভকে প্রধানমন্ত্রী (হাজীব) নিয়োগ করেন। সিংহাসনে আরোহণ কালে দ্বিতীয় হাকামের বয়স ছিল প্রায় ছয়চল্লিশ বৎসর। তাঁহার পিতার মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে রাষ্ট্রের প্রশাসন ও পরিচালনকার্যে তিনি বিশেষভাবে অংশ গ্রহণ করেন। মাসুদীর মতে, হাকামের তেমন কোন সামরিক দক্ষতা ছিল না। কিন্তু সুবিচারক হিসাবে রাজ্যের সর্বত্র তাঁহার সুখ্যাতি ছিল।’ তাহার সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই দেশের উত্তরাঞ্চলে খ্রীস্টান শক্তি মাথা চাড়া দিয়া ওঠে ও বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

খ্রীস্টান বিদ্রোহ দমন

সাঞ্চো ও গার্সিয়া যথাক্রমে লিওন ও নাভাররের রাজদ্বয় তৃতীয় আবদুর রহমানের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। কিন্তু আবদুর রহমানের মৃত্যুর পর তাহারা চুক্তি ভঙ্গ করেন। সাঞ্চো দুর্গ হস্তান্তর করিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। গার্সিয়া তাহার বন্দী ফার্ডিনান্দকে (ফারনান গঞ্জালেজ) হাকামের নিকট সমর্পণ করিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। কর্ডোভার উমাইয়াদের মিত্র চতুর্থ অর্ডোনীওর সহিত বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাইবার জন্য ফার্ডিনান্দ তাহার কন্যাকে প্রভাবিত ও বাধ্য করেন। সাঞ্চো ও গার্সিয়ার ধারণা ছিল সামরিক কার্যকলাপে বিমুখ ও সাহিত্যের প্রতি অতিশয় অনুরাগী হাকাম সন্ধির শর্তসমূহ পালনের জন্য চাপ-প্রয়োগ করিবেন না। আর একান্তই যদি তিনি সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও যুদ্ধ ঘোষণা করেন তবে তাঁহার পিতার ন্যায় সামরিক সফলতা অর্জন করিতে সক্ষম হইবেন না। ঠিক একই সময়ে ক্যাস্টাইলের কাউন্ট ফারনান গঞ্জালেজও তাহার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করিতে শুরু করেন। কিন্তু হাকাম প্রমাণ করেন যে একজন বিদ্বান ও সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তি সামরিক ক্ষেত্রেও সমভাবে পারদর্শী হইতে পারেন তাহার পূর্বসূরীর ন্যায় তিনিও দেশের উত্তরাংশের ঘটনাবলীর নীরব দর্শক ছিলেন না। ৯৭২ খ্রীস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি গঞ্জালেজের বিরুদ্ধে নিজে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং সীমান্তের অপর পার্শ্বে খ্রস্টানদিগকে বিতাড়িত করেন।

খ্রীস্টান শাসকদের আত্মসমর্পণ

অভিযান হইতে প্রত্যাবর্তনের পর চতুর্থ অর্ডোনীও তাহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। অর্ডোনীও আবদুর রহমানের সহায়তায়

সাঞ্চোকে বিতাড়িত করিয়াছিলেন। মদিনাতুস সালিমের গভর্নরের মাধ্যমে তিনি নতুন খলিফার সহিত সাক্ষাৎ করেন। ওবায়দুল্লাহ (আবদুল্লাহ) ইবনে কাসিম পাহারা দিয়া তাহাকে সেভিলের রাজধানী আল জাহরাতে আনয়ন করেন। সেখানে তাঁহাকে অতি সম্মানের সহিত গ্রহণ করা হয়। তিনি নাউরা প্রাসাদে অবস্থান করেন। খলিফার সহিত আলজাহরা প্রাসাদে তাহাকে পরিচয় করাইয়া দেওয়া হয়। তিনি তাঁহার পিতৃব্য পুত্র সাঞ্চোর বিরুদ্ধে খলিফার সাহায্য প্রার্থনা করেন। খলিফা তাহাকে সাহায্যের আশ্বাস প্রদান করেন। তিনি তাঁহার সেনাপতি গালিবকে লিওনের সিংহাসনে অর্ডোনীওকে অধিষ্ঠিত করিতে সাহায্য দেওয়ার আদেশ প্রদান করেন। মুসলমানদের সহিত শান্তিতে বসবাস করিবার জন্য অর্ডোনীও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। তিনি তাঁহার পুত্র গার্সিয়াকে জিম্মী হিসাবে প্রেরণ করিয়া প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি কখনও গঞ্জালেজের বিদ্রোহীদিগকে সাহায্য করিবেন না।

সাঞ্চোকে তাঁহার প্রজাকুল পছন্দ করিত না। এই মারাত্মক পরিস্থিতি দেখিয়া তিনি আত্মসমর্পণ করেন এবং পূর্ববর্তী চুক্তি মোতাবেক দুর্গসমূহ সমর্পণ করেন। হাকাম সাঞ্চোর উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করিয়া অর্ডোনীওর সহিত সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করেন। সাঞ্চো পুনরায় বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন। তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী অড্রোনীওর মৃত্যুর পর সাঞ্চো চুক্তির শর্তসমূহ পালন করিতে অস্বীকৃতি জানান। কথিত আছে ৯৬২ খ্রীঃ অর্ডোনীও হতাশ হৃদয়ে কর্ডোভায় দেহত্যাগ করেন। ইহার পর খ্রীস্টান নেতাদের সহিত পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। মেদিনাসিলের গভর্নর গালিবের নেতৃত্বে এক বিরাট সৈন্য বাহিনী ক্যাস্টিলে প্রেরিত হয়। তিনি গ্যালেসীয়দের বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করিয়া সান এষ্টেভান দে-গরমাজের গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ অধিকার করেন। মুহাম্মদ তাজিবীর পুত্র ইয়াহিয়া সারাগোসার গভর্নর গালিবের সহিত যোগদান করেন। গালিব ও ইয়াহিয়ার সম্মিলিত বাহিনী বাস্কদের দেশে অনুপ্রবেশ করে। নাভাররের নেতা গার্সিয়াকে পরাজিত ও কালাহোররাকে বন্দী করেন। সীমান্ত শহর ক্যাটালোনীয়া আক্রান্ত ও ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। অধিকৃত গুরুত্বপূর্ণ শহরসমূহ বহির-আক্রমণ হইতে সুরক্ষিত করিবার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়। তৎপর সাঞ্চোর (৯৬৬ খ্রঃ) পরাজয়ের পর নাভাররের গার্সিয়া ও ক্যাস্টিলের গঞ্জালেজও একের পর এক আত্মসমর্পণ করেন। তাহাদের মিত্র কাউন্ট, বরেল ও মিরন তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ক্যাটালোনীয়ার খ্রীস্টান নেতাগণ, বার্সিলোনার কাউন্ট ও ক্যাটালোন লর্ডগণ হাকামের সহিত চুক্তিবদ্ধ হন। তাহারা মুসলিম সীমান্ত সংলগ্ন সমস্ত দুর্গ ও পাহারা স্তম্ভের ধ্বংস সাধন করিতে সক্ষম হন এবং মুসলমানদের সহিত যুদ্ধে খ্রীস্টানদিগকে কোন প্রকার সাহায্য না করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সাঞ্চো যখন হাকামের সহিত শান্তি আলোচনায় লিপ্ত সেই মুহূর্তে গ্যালেসিয়া আক্রান্ত হয়। ৯৬৬ খ্রীঃ শেষের দিকে ডুরো নদীর তীরে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি তাহার শত্রু কাউন্ট গোনঝালভো কর্তৃক বিষ পরিবেশিত

হইয়া মৃত্যুবরণ করেন। তাঁহার পাঁচ বৎসর বয়স্ক পুত্র রামিরো ও তাহার চাচী এলভিরা রাষ্ট্রকে ডানদের ধ্বংস লীলার কবল হইতে রক্ষা করিতে ব্যর্থ হন। হীনবল লিওনগণও দ্বিতীয় হাকামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে সাহস পায় না। বারর্সিলোনার কাউন্ট বরেল ৯৭১ খ্রীস্টাব্দে দ্বিতীয় হাকামের নিকট ত্রিশজন স্লাভকে উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেন। পরবর্তী বৎসর ক্যাস্টিলিয়ান শাসক সীমান্তচুক্তি মানিতে অস্বীকৃতি জানাইলে তাহার প্রতিনিধি দলকে হাকাম বন্দী করেন। ৯৭৫ খ্রীঃ লিওন, ক্যাস্টাইল ও নাভারের রাজাগণ তাহাদের স্বাধীনতা দাবী করিলে গালিব তাহাদিগকে কঠোর হস্তে দমন করেন।

ফাতেমী ও সানহাজাহদের সহিত যুদ্ধ

সমান দক্ষতার সহিত তিনি উত্তর আফ্রিকার তরফ হইতে বিপদের হুমকিকেও প্রতিহত করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতেমী খলিফাগণ সমগ্র মুসলিম জাহানকে তাহাদের শাসনাধীনে আনিবার চেষ্টা করেন। তাঁহারা স্পেনের শহরসমূহে ধর্মোন্মত্ত নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা পাঠান। ফাতেমী গোয়েন্দাগণ সেনাবিভাগ, এমন কি আল হাকামের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করে। ৯৭২ খ্রীঃ ফাতেমী রাজধানী কায়রোতে স্থানান্তরের পর অবশ্য এই ফাতেমী আতঙ্ক অন্তর্হিত হয়। তিউনিসিয়া হইতে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ফাতেমী প্রভাব হ্রাস পাইতে থাকে। সেনাপতি গালিবের নেতৃত্বে ৯৭২ ও ৯৭৪ খ্রীঃ উমাইয়া অভিযানের ফলে ইফ্রিকার কিছু এলাকা পুনরুদ্ধার করা হয়। ফাতেমী খলিফাদের অনুগত সানহাজাহগণ উত্তর আফ্রিকায় উমাইয়া সমর্থকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ক্ষুদ্র ইদ্রিসী রাজবংশ তাঞ্জিয়ার ও আরজিলায় উমাইয়াদের নামমাত্র প্রজা ছিল।

ফাতেমী প্রতিনিধি আবুল ফাতাহ শেষ ইদ্রিসী শাসক হাসান ইবনে পাননুনের শাসিত এলাকায় প্রবেশ করিয়া তাহাকে কর্ডোভার খলিফার আনুগত্য প্রত্যাহার এবং কায়রোর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিতে বাধ্য করেন। উমাইয়া নৌ ও পদাতিক বাহিনী, ইবনে তুমলুসের নেতৃত্বে ফাতেমী ভাইসরয় হাসান ইবনে গানের সহিত দুই দফা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রথম আক্রমণে ইবনে গান পরাজিত হন কিন্তু দ্বিতীয় দফায় উমাইয়াগণ পরাজয় বরণ করে। উমাইয়া সেনাপতি ইবনে তুমলুস যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। ফলে মৌরিতানিয়ার উমাইয়া সমর্থকগণ তাহাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করিয়া হাসান ইবনে গানের সহিত যোগদান করে। দ্বিতীয় হাকামের অধিকারে শুধু সিউটার ন্যায় কয়েকটি সুরক্ষিত শহর অবশিষ্ট থাকে।

গালিবের নেতৃত্বে ৯৭২ খ্রীঃ মৌরিতানিয়ায় এক অভিযান পরিচালিত হয়। ফাতেমী অগ্রাভিযানকে প্রতিহত করিবার উদ্দেশ্যে গালিব সিউটা ও তাঞ্জিয়ারের মধ্যবর্তী কাসরে-মাসমুদাতে অবতরণ করেন। গালিব সুকৌশলে সৈন্য পরিচালনা করিয়া ভূমধ্যসাগরের তীরে বার্বার সৈন্যদের সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করেন। ইবনে গানের সমর্থক ও অফিসারদিগকে উপহার ও উপঢৌকন দেওয়া বাবদ গালিব প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। ইফ্রিকিয়ায় আর্থিক ব্যবস্থাপনার পুনর্বিন্যাস ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে

আলহাকাম কর্ডোভা টাকশালের পরিচালক ইবনে আবি আমিরকে সেখানে প্রেরণ করেন। আবি আমির সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যাইবে মৌরিতানিয়ার সেনাপতি ইয়াহিয়া ইবনে মুহাম্মদ সম্পর্কে আলোচনাকালে। তাহারা দীর্ঘদিন হাসান বিন গানুনকে প্রতিরোধ করেন। অবশেষে ৯৭৪ খ্রীঃ ফেব্রুয়ারি মাসে ইবনে গানুন আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হন। হাজরাতুন নাশরের দুর্গ হইতে তাহাকে বন্দী করিয়া কর্ডোভার কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীকালে তিনি তিউনিসিয়াতে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন এবং সেখান হইতে তিনি আলেকজান্দ্রিয়াতে গমন করেন। জানাতা মাগরাওয়া ও মিনাশার বার্বার উপজাতিগণ কায়রোর খলিফার সমর্থন প্রত্যাহার করিয়া কর্ডোভার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। আন্দালুসিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর আল হাকাম তাঁহার প্রিয় বিষয় সাহিত্য ও বিজ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। মৃত্যুঃ সত্যনিষ্ঠ ও ধার্মিক খলিফা আল হাকাম মাত্র ১৬ বৎসর রাজ্য শাসন করিবার পর ৩রা সফর ৩৩৬হিঃ/৩০শে সেপ্টেম্বর ৯৭৬ খ্রীঃ পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হইয়া ৬১ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাহার ১২ বৎসর বয়স্ক একমাত্র পুত্র হিশামকে তাহার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। মুশাফী এবং ইবনে আবি আমির মুহাম্মদকে তাহার অভিভাবক নিযুক্ত করেন।

কৃতিত্ব

তাহার কৃতিত্ব ছিল ব্যাপক। তাহার শাসনকালে আইবেরিয়ার উপদ্বীপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান চর্চায় বিরাট সাফল্য অর্জন করে। তিনি তাহার রাজ্যের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা অক্ষুন্ন রাখেন এবং খ্রীস্টান ও ফাতেমী আক্রমণ প্রতিহত করেন। হাকাম তাঁহার পিতা কর্তৃক বিলুপ্ত হাজীবের পদ পুনর্জীবিত করেন। তিনি শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসার সাধন ও উন্নতি বিধানের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। পরিচ্ছন্নতা পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা, সাবানের ব্যবহার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা ও রুমালের ব্যবহার প্রভৃতি মুসলমানদের নিকট হইতে পাশ্চাত্য জগত গ্রহণ করিয়াছে। দ্বিতীয় আবদুর রহমান ও দ্বিতীয় হাকামের ন্যায় উমাইয়া শাসকগণ এই সমস্ত জিনিসের প্রবর্তন করেন। দ্বিতীয় হাকামের হেরেমে তখন যে সাবান ও প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহার হইত সমসাময়িক ইউরোপবাসীগণ কয়েক মাসেও উহা একবার ব্যবহার করিত না। আচার ব্যবহার,শালীনতা ও সৌজন্যবোধ এবং মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থায় ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করে। তাঁহার রাজত্বকালে ইউরোপীয় নাইটগণ আরব অশ্বারোহী সৈনিকদের নিকট শিক্ষার্থী হিসাবে আগমন করিত। হাকামের সাফল্য ও কৃতিত্ব নিম্ন শিরোনামগুলির মাধ্যমে আলোচনা করা যাইতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহঃ দ্বিতীয় আল হাকাম ছিলেন বিদ্যানুরাগী ও শিক্ষা সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সেবক ও পৃষ্ঠপোষক। তাঁহার ভ্রাতা মুনজিরকে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। তাহার সময়ে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় চরম উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে। পরবর্তীকালে কায়রোর আল আজহার ও বাগদাদের নিজামীয়া ইহার

প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া ওঠে। খ্রীস্টান, ইহুদী ও মুসলিম ছাত্রগণ বিদ্যা শিক্ষার্থে এখানে আগমন করিত। এখানে শুধু স্পেনের ছাত্রগণই শিক্ষা লাভ করিত না, ইউরোপের বিভিন্ন অংশ আফ্রিকা ও এশিয়ার বিদ্যার্থীগণও ভীড় জমাইত। রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত সাতাইশটি অবৈতনিক স্কুলে গরীব ছাত্র-ছাত্রীগণ শিক্ষা গ্রহণ করিত। প্রথম মসজিদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় তিনটি ও কর্ডোভার শহরতলীতে অবৈতনিক শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে চব্বিশটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার ব্যয় নির্বাহ হইত কর্ডোভা বাজারের জিন নির্মাতাদের নিকট হইতে সংগৃহীত শুল্কের দ্বারা। ধনীদের জন্য নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া ওঠে। অতি ক্ষুদ্র শহরেও বিদ্যালয় ছিল। প্রতিটি বড় শহরে উচ্চ শিক্ষার্থে পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া ওঠে। সেভিল, মালাগা, সারাগোসা, ও জায়েনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কর্ডোভার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যতালিকা অনুসরণ করিত। পরবর্তীকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নিজস্ব পাঠ্যতালিকা প্রবর্তন করে। কর্ডোভায় সর্ববৃহৎ এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এইরূপ বহু প্রতিষ্ঠান অন্যান্য শহরেও গড়িয়া ওঠে। স্পেনের অধিকাংশ জনগণ লিখিতে ও পড়িতে জানিত। কর্ডোভার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উচ্চ পারিতোষিক দেশ বিদেশের পণ্ডিতদিগকে আকৃষ্ট করিত। দ্বিতীয় হাকামের শাসনকাল শিক্ষা-সংস্কৃতি ও পাণ্ডিত্যের স্বর্ণযুগ। কর্ডোভা ছিল ইহার জ্যোর্তিকেন্দ্র।

কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বৃহৎ লাইব্রেরিতে বহু দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি ও মূল্যবান গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল। দ্বিতীয় হাকামের রাজত্বকালে আন্দালুসিয়ার সাংস্কৃতিক জীবন ছিল খুবই উচ্চাঙ্গের ও পরিশীলিত।“প্রত্যেকে লিখিতে ও পড়িতে জানিত। অপরদিকে খ্রীস্টান ইউরোপের যে সামান্য কয়েকজন লিখিতে পড়িতে পারিত তাহারা ছিল যাজক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।”৪ কাজবিনির উদ্ধৃতি দিয়া নিকলসন বলেন, যদি কেউ একজন কৃষককেও কিছু কবিতার পংক্তি রচনা করিতে বলিত তবে সে “ফরমায়েশ মোতাবেক যে কোন বিষয়ের উপর কবিতার পংক্তি রচনা করিয়া দিতে পারিত”। কথিত আছে ইউরোপে কর্ডোভার স্থান ছিল মানবদেহের মস্তকের ন্যায়। ইউরোপবাসী কর্ডোভা হইতেই অধিকাংশ জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করে। হাকাম স্পেনীয় সভ্যতাকে এমন উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেন যে তকালীন অন্ধকারময় ইউরোপে কর্ডোভা আলোর দিশারী হিসাবে কাজ করে। দশম শতাব্দীর জার্মান নারী কবি গ্যান্ডার শেইমের হরৎসভিথা (১০০২ খ্রীঃ) কর্ডোভাকে বিশ্বের আভরণ হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন।

কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ : খলিফা হাকাম কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য হইতে অধ্যাপকদের আমন্ত্রণ জানান এবং তাহাদের বেতনের বিনিময়ে জায়গীর প্রদান করেন। এই সমস্ত শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বাগদাদের বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ ও ঐতিহাসিক আবু বকর ইবনে কুতিয়াহ যিনি কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাকরণ ও ইতিহাস শিক্ষা দান করিতেন। বাগদাদের ভাষাতত্ত্ববিদ পণ্ডিত আবু আলী আলকালী (মৃঃ ৯৬৭)

শিক্ষা দিতেন প্রবাদবাক্য, ভাষা, কাব্য-সাহিত্য ও প্রাচীন আরবদের কৌতুহলোদ্দীপক জীবন-কাহিনী। তাহার রচিত ‘আমালী’ গ্রন্থখানি এখনও আরবী সাহিত্যের ছাত্রগণ শ্ৰতিলিখন গ্রন্থহিসাবে পাঠ করিয়া থাকে। আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল উজরী ছিলেন হাকামের প্রাসাদ-চিকিৎসক। ‘কিতাবুল আইন’ নামে একখানা উত্তম আরবী অভিধানের প্রসিদ্ধ লেখক ও বিখ্যাত পণ্ডিত মুহাম্মদ আবু বকর আল জুবাইদী হাকামের পুত্র হিশামের গৃহশিক্ষক ছিলেন। ফিকাহ শাস্ত্রবিদ আবু ইব্রাহিম কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করিয়া ইহাকে ধন্য করিয়াছিলেন। আবু বকর ইবনে মুয়াবিয়াহ হাদীস, ধর্মতত্ত্ব, কুরআনী আইন, শিষ্টাচার ও প্রাচ্য বিজ্ঞানের উপর বক্তৃতা দান করিতেন। অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষকগণও বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। গ্রন্থাগারসমূহ : দ্বিতীয় হাকাম ও তাঁহার ভ্রাতা আবদুল্লাহ তাঁহাদের পিতার জীবদ্দশায়ই নিজস্ব গ্রন্থাগার গড়িয়া তোলেন। হাকাম এই গ্রন্থাগারগুলিকে তাঁহার পিতার গ্রন্থাগারের সহিত একত্রিত করিয়া দুষ্প্রাপ্য ও অমূল্য গ্রন্থ সংগ্রহে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত গ্রন্থ সংগ্রাহক। তাঁহার প্রতিনিধি ফাতিমাহ পুরাতন ও নতুন পাণ্ডুলিপি ক্রয় ও অনুলিপি সংগ্রহের জন্য কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, দামেস্ক ও বাগদাদের বিভিন্ন গ্রন্থাগার এবং পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্রগুলি তন্ন তন্ন করিয়া খোঁজ করেন। দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি খলিফার নিকট সবচেয়ে মূল্যবান উপঢৌকন বলিয়া বিবেচিত হইত। ফলে মধ্যযুগের রাজকীয় লাইব্রেরির মধ্যে খলিফা হাকামের লাইব্রেরি ছিল দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি ও অমূল্য গ্রন্থের সর্ববৃহৎ সংগ্রহশালা। কোন কোন ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ৬,০০,০০০ লক্ষ উল্লেখ করিয়াছেন। তবে কোন ইতিহাস লেখকই ৪,০০,০০০৭ লক্ষের কম উল্লেখ করেন নাই। সমকালীন আরব পণ্ডিতগণ দ্বিতীয় হাকামের গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান পুস্তক সংগ্রহের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন।

ইবনে হাজমের সূত্র উল্লেখ করিয়া ইবনে খালদুন বলেন যে, তিনি হাকাম কর্তৃক মুক্ত, তাহার লাইব্রেরি দেখাশোনায় নিযুক্ত খোজা তালিদের নিকট হইতে অবগত হইয়াছেন যে, লাইব্রেরির অসমাপ্ত গ্রন্থ তালিকা চুয়াল্লিশ খণ্ডে পরিব্যাপ্ত ছিল। প্রতি খণ্ডে বিশ হইতে পঁচিশ সিট কাগজ ছিল—ইহাতে শুধু পুস্তক ও লেখকের নাম লিপিবদ্ধ ছিল।

হাকাম তাঁহার ভ্রাতা আবদুল আজিজকে রাজকীয় গ্রন্থাগারের তত্ত্বাবধায়ক ও অপর ভ্রাতা মুনজিরকে শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বে নিয়োগ করেন। কখন কখন তিনি তাঁহার সাম্রাজ্যের শিক্ষিত জ্ঞানীগুণিদের সভায় সভাপতিত্ব করিতেন। তালিদ নামক জনৈক খোজা ছিলেন প্রধান গ্রন্থাগারিক। পুস্তক রাখিবার আলমারীগুলি তৈয়ার করা হইত সুগন্ধিযুক্ত পালিশ করা কাঠ দ্বারা। আলমারীর উপরে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত বাক্য, তাকে রক্ষিত পুস্তকগুলির বিষয়বস্তু নির্দেশ করিত। রাজ প্রাসাদের কিছু কক্ষ অনুলিপি তৈয়ারি ও পুস্তক দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। পুস্তকসমূহের বাঁধাই ও অঙ্গসজ্জার জন্য সুদক্ষ নারী ও

১৭৩ পুরুষ কর্মচারী নিয়োগ করা হইত। দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয় ও রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে সেগুলি পরিচালিত হইত। বালেসট্রসের মতে, একমাত্র কর্ডোভা শহরে সত্তরটি পাবলিক লাইব্রেরি ছিল।১০ গ্রন্থ সংগ্রহ ও হাকাম কর্ডোভাকে বিশ্বগ্রন্থ বাজারে পরিণত করেন। এখানে সারা বিশ্বের প্রকাশিত পুস্তক ক্রয় বিক্রয় হইত। কখন কখন প্রতিলিপির দোকানগুলি নারী কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত হইত। গহনা ও সিল্ক কাপড়ের দোকানগুলির ন্যায় পুস্তক বিক্রয়ের দোকানগুলিতেও ক্রেতার ভীড় জমিত। একটি শহরে বিশ হাজার পুস্তক বিক্রয়ের দোকান ছিল। তাহা হইলে সেই শহরের দেশে নিশ্চয়ই কয়েক লক্ষ টন কাগজ তৈয়ার হইত। রোমানদের পাপিরাস ও চামড়ার কাগজের পরিবর্তে আরবরা তাহাদের নিজস্ব তৈয়ারি কাগজ ব্যবহার করিত। ইহার ফলে পুস্তক প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এবং পুস্তকের মূল্য হ্রাস পাইবার ফলে সাহিত্য ও বিজ্ঞান সাধকগণ উপকৃত হন।

কর্ডোভার সাহিত্যিক ও অভিধান সংকলক মুহাম্মদ বিন আবি আল হুসাইন আল ফিহরী এবং জায়েনের অপর আরব পণ্ডিত মুহাম্মদ বিন মার্মার ছিলেন দ্বিতীয় হাকাম কর্তৃক নিযুক্ত বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের অন্যতম, যাহারা তাঁহার গ্রন্থাগারের জন্য দুষ্প্রাপ্য পুস্তক সংগ্রহে নিযুক্ত ছিলেন। নকল নবিশদের মধ্যে ছিলেন ইউসুফ আল বালুতি ও সিসিলির আবুল ফজল বিন হারুন (মৃঃ ৩৭৯হিঃ/৯৮৯-৯০) ও আব্বাস বিন আমর এবং বাগদাদের জাফর অন্যতম। ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রাহকদের মধ্যে কর্ডোভার ইবনে ফুতাইসের লাইব্রেরির স্থান ছিল সর্বোচ্চ। এগারো শতাব্দীর প্রথমভাগে এই লাইব্রেরিটি ৪০,০০০ দিনারের বিনিময়ে নিলামে বিক্রি হয়। বিদেশী পণ্ডিতগণও খলিফার জন্য পুস্তক সংগ্রহে নিযুক্ত ছিলেন। ইহাদের মধ্যে মিশরের ইবনে শাবান, বাগদাদের ইবনে ইয়াকুব আলকিন্দী ও মুহাম্মদ ইবনে ফারজানের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। লাব্বানাহ (মৃঃ ৩৯৪হিঃ/১০০৪ খ্রীঃ) গ্রন্থাগারিক তালিদের প্রধান সেক্রেটারী পরবর্তীকালে হাকামের ব্যক্তিগত সচিব নিযুক্ত হন। শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির লেখক ফাতিমাহ ও লাব্বানা দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপির অনুসন্ধানে বহুদেশ ভ্রমণ করেন এবং মূল্যবান গ্রন্থে রাজকীয় গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ করিয়া তোলেন।

প্রতিটি বিখ্যাত লেখককে পুরস্কৃত করা হইত। নতুন নতুন প্রকাশনাকে উৎসাহিত করিবার জন্য উদারভাবে দান করা হইত। এবং বাজারে প্রকাশের পূর্বেই লেখকের নিকট হইতে প্রথম কপি সংগ্রহের জন্য বিশেষ ভাবে চেষ্টা করা হইত। মিশর, গ্রীস, সিরিয়া ও ইরান প্রভৃতি দূরদেশ হইতে বিখ্যাত লেখকদের গ্রন্থ কর্ডোভায় প্রেরণ করা হইত। কোন বিষয়ে কৃতিত্বপূর্ণ রচনার জন্য এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা পর্যন্ত উপঢৌকন দেওয়া হইত। উমাইয়া ঐতিহাসিক ও কবি আবুল ফারাজ ইসফাহানী যখন ইরাকে

বসিয়া আরব ঐতিহাসিক কবি ও চারণ গীতিকারদের উপর কিতাবুল আগানী’ নামক গ্রন্থ রচনা করিতেছিলেন ইহার প্রথম প্রতিলিপি সংগ্রহের জন্য আল হাকাম এক হাজার দীনার প্রেরণ করেন। আবুল ফারাজ উমাইয়াদের বংশতালিকার উপর লিখিত অন্য একটি পুস্তকসহ কিতাবুল আগানী’ গ্রন্থটি হাকামের নিকট প্রেরণ করেন। প্রসিদ্ধ লেখকগণ তাঁহাদের রচিত বহু গ্রন্থ দ্বিতীয় আল হাকামের নামে উৎসর্গ করিতেন। ইহাদের মধ্যে ৯৬১ খ্রীঃ পঞ্জিকার উপর রচিত আবুল হাসান আরিব বিন সাইদ (মৃঃ ৯৮০-১ খ্রীঃ) কিতাবুল আওকাতিস সনাত’ গ্রন্থখানি ও স্পেনে বসবাসকারী কায়রোওয়ানের মুহাম্মদ বিন হারিস বিন আসাদ আল খুশানী (মৃঃ ৬৬১হিঃ/৯৭১খ্রীঃ) কর্তৃক রচিত তারিক কুজাতিল কুরতবা’ উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল কুতিয়াহ (মৃঃ ৯৭৭ খ্রীঃ) স্পেনের উমাইয়া শাসকদের বংশ-ইতিহাস রচনা করেন। ইবনে জামামিন (১০০৭-৯ খ্রীঃ) হাকামের লাইব্রেরির জন্য ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে বহু পুস্তক রচনা করেন। অন্যান্য লেখকগণ যাহারা খলিফার নামে তাহাদের রচিত গ্রন্থ উৎসর্গ করেন তাঁহারা হইলেন ফনতি আওরিয়ার (কর্ডোভা) ইবনে মুফাররাজ, এলভিরার মুতাররিফ বিন ইসা (মৃঃ ৩৭৭ হিঃ/ ৯৮৭ খ্রঃ) ও গোয়াদালাজারার মুহাম্মদ ইউসুফ। জায়েনের আহমদ বিন ফারাজ লিখিত ‘আলহাদায়েক’ নামক কবিতার সংকলনটি তাঁহার নামে উৎসর্গীত হয়। হাকামের পুত্র হিশামের গৃহ শিক্ষক আল জুবাইদি (মৃঃ ৯৮৯) কবি হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন। সিরিয়া স্পেনের উমাইয়া খলিফাদের উপর রচিত কাব্যগ্রন্থসমূহ সংগ্রহের জন্য ইবনুস সফরকে নিয়োগ করেন।১২ সরকারি দফতরে সেক্রেটারীদের দ্বারা বহুল ব্যবহৃত উন্নতমানের গদ্যরীতিতে লিখিত বহু পুস্তক ছিল যাহা এখন আর অবশিষ্ট নাই।

বিদ্বান ও বিদ্যানুরাগী আল হাকাম

দ্বিতীয় আল হাকাম শুধু গ্রন্থের সংগ্রাহকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন জ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক। ইবনে আল ফারাজী ও ইবনে বাশকোয়ালের প্রকাশিত মতে, বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন ইবনুল আব্বার। তাহারা হাকামের সময়ের পণ্ডিতদের নাম উল্লেখ করিয়াছেন বটে কিন্তু খলিফার সম্পর্কে কিছুই বলেন নাই। খলিফা এবং অভিজাত শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় আকৃষ্ট হইয়া বহু। চিকিৎসাবিদ, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, ভূগোল বিশারদ, জ্যোতির্বিদ ও অঙ্কশাস্ত্রের পৃণ্ডিতগণ কর্ডোভায় বসবাস করিবার জন্য আগমন করেন। অভিজাত সম্প্রদায় ও সুধীগণ দ্বিতীয় হাকামের অনুকরণে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা ও বাগান তৈরি করিতেন। শিক্ষা সংস্কৃতি ও আমলাদের নগর ছিল কর্ডোভা। অন্য কোন সম্রাটকেই ঐতিহাসিকগণ তাঁহার পাণ্ডিত্যের সমকক্ষ বলিয়া অবিহিত করেন নাই। বিভিন্ন বিষয়ে তাহার শিক্ষক ছিলেন কাসিম ইবনে আসবাগ, আহমদ ইবনে দাহিম, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুস সালাম আল-খুশানী, যাকারিয়া ইবনে আল-খাত্তাব ও ছাবিত ইবনে কাসিম। অন্যান্য আমোদ

দ্বিতীয় হাকাম (৯৬১-৭৬ খ্রীঃ) প্রমোদের জিনিসের তুলনায় তিনি পুস্তক পাঠকে অধিকতর পছন্দ করিতেন। তিনি শুধু তাঁহার লাইব্রেরিতে পুস্তক পাঠ করিতেন না বরং সমস্ত পঠিত পুস্তকে সংযোজিত সাদা পাতায় গ্রন্থের বিষয়বস্তু ও লেখকের পূর্ণ পরিচয় লিখিয়া রাখিতেন। হাকামের লাইব্রেরির জন্য লিখিত একটি পাণ্ডুলিপি ৩৫৯ হিঃ/ ৯৭০ খ্রীঃ ফেজে আবিষ্কৃত হয়। ইবনে আল আব্বারের মতে, খলিফা তাহার নিজের লাইব্রেরির প্রায় সমস্ত গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সহিত পরিচিত ছিলেন। এইরূপে তিনি তাহার জ্ঞানকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করিয়া তোলেন এবং ইতিহাস, জীবনী ও বংশ পরিচয়ে তাহার সময়কার পণ্ডিত ব্যক্তিদের অতিক্রম করেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞ ঐতিহাসিক ও নিরপেক্ষ সমালোচক।১৪ তাহার ঐতিহাসিক জ্ঞান ছিল খুবই নির্ভুল এবং তর্কাতীত। তাঁহার সুগভীর বিচারবুদ্ধি ও পাণ্ডিত্য সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বের পণ্ডিতগণ গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করিতেন। তিনি স্পেন সম্পর্কে সুন্দর একখানা ইতিহাস রচনা করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ গ্রন্থখানি বিনষ্ট হইয়া যায়।

স্পেনীয়দের ন্যায় বিদেশী পণ্ডিত, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের প্রতিও তাহার সীমাহীন উদারতা এবং শ্রদ্ধা ছিল। তিনি দার্শনিকদের উৎসাহিত করিতেন ও ধর্মান্ধদের অত্যাচারের কবল হইতে তাহাদিগকে রক্ষা করিতেন। হাকাম বিদ্বান, পণ্ডিত ও ধর্মবেত্তাদের শ্রদ্ধা ও সাহায্য করিতেন। একবার আবু ইব্রাহিম কর্ডোভার প্রধান মসজিদে ধর্মতত্ত্বের ওপর বক্তৃতা করিতেছিলেন, সেই সময় খলিফা তাহাকে ডাকিয়া পাঠান। কোন উত্তম কাজে নিয়োজিত আছেন বলিয়া ইব্রাহিম খলিফাকে অবহিত করেন। খলিফা তাহার গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং বক্তৃতা শেষে খলিফার দরবারে হাজির হইতে বলেন। উত্তরে ফকিহ ইব্রাহিম বলেন যে তিনি খুবই দুর্বল এবং বৃদ্ধ, ঘোড়ায় আরোহণ করিতে অক্ষম ও পায়ে হাঁটিয়া দীর্ঘপথ অতিক্রম করিতে অপারগ। তিনি সংবাদ দাতাকে মসজিদ ও প্রাসাদের মাঝখানে সংযোগ রক্ষাকারী দরজা “বাবুল-সানা”কে খুলিয়া দিতে বলিলেন। বক্তৃতা সমাপ্তির পর ইব্রাহিম প্রাসাদে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পান যে খলিফা মন্ত্রীগণসহ তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। ইহাতে তিনি ভীষণভাবে অভিভূত হইয়া পড়েন। খলিফা তাহাকে আন্তরিক অভিবাদন ও অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন এবং মূল্যবান উপহার ও উপঢৌকনে সম্মানিত করেন।

মৌলিক গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদের কাজ খলিফা হাকামের রাজত্বকালে সমভাবে চলিতে থাকে। গ্রীকভাষায় লিখিত দর্শনের পুস্তকসমূহ অনুবাদ করানো হয়। সক্রেটিস ও প্লেটোর গ্রন্থাবলীর প্রতিও যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করা হইত। ইউক্লিড ও এরিস্টটলের গ্রন্থাবলী অনুবাদের জন্য অনুবাদসংস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন। ভূতত্ত্বের উপর কতিপয় গ্রন্থ রচিত হয়। কৃষি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদ্ভিদ বিজ্ঞান সম্পর্কে পুস্তক রচিত হয় এবং বৃক্ষের রোগ ও পুষ্টির উপর নানা প্রকারের পরীক্ষা নিরীক্ষা পরিচালিত হয়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা এবং ঔষধের উপর গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক রচিত হয়। আবুল কাসেম অস্ত্রোপচার সম্পর্কে লিখিত পুস্তক আল-তাসরিফের জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেন। শতশত বৎসর পূর্বের গ্রীক চিকিৎসা বিজ্ঞান আশাতীত উন্নতি লাভ করে। মানচিত্র অংকন ও ভূগোলশাস্ত্র সম্পর্কে গবেষণা করা হয়। নক্ষত্রের গতিবিধি লক্ষ্য করিবার জন্য মানমন্দির হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কিছু মিনার নির্মিত হয়। ইবনে ফিরনাস নামক জনৈক বৈজ্ঞানিক পশুর লোম (ফারসের) দ্বারা আকাশে উড্ডয়ন যোগ্য পোশাক তৈয়ার করেন। তিনি নিজে ইহার সাহায্যে আকাশে উড্ডয়ন করেন কিন্তু ভারসাম্য রক্ষা করিতে ব্যর্থ হইয়া ভূমিতে পতিত হওয়ার দরুন মারাত্মকভাবে আহত হন। আবিতার নামক জনৈক ব্যক্তি স্বয়ংক্রীয় ঘড়ি আবিষ্কার করেন।১৫ আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের জ্ঞানভাণ্ডার কর্ডোভায় কেন্দ্রীভূত হয়। এই সময় আন্দালুসিয়ায় গণশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। প্রায় প্রত্যেকটি নাগরিকই লিখিতে পড়িতে জানিত।

জনহিতকর কার্যাবলী

খলিফা জনহিতকর কার্যের প্রতি আগ্রহশীল ছিলেন। তিনি রাজপথের সংস্কার সাধন ও পথের পার্শ্বে কূপ খনন করান। একদিনের যাত্রাপথের দূরত্বে (প্রায় পঁচিশ মাইল) পথিকদের জন্য বিরাট বিরাট সরাইখানা নির্মাণ করা হয়। গরীব ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাস, রুগ্নদের জন্য হাসপাতাল এবং গণশিক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলেন। কেন্দ্রীয় রাজধানীসহ প্রাদেশিক রাজধানীতেও সাধারণ জনগণের জন্য গোসলখানা (হাম্মাম), সরাইখানা, বাজার, পুষ্করিণী ও হাসপাতাল নির্মিত হয় ১৬ খলিফা জনসাধারণকে তাহাদের গৃহপ্রাঙ্গণে ও গৃহের আশেপাশে খালি জায়গায় বাগান তৈরী করিয়া উহার রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন লইতে অনুরোধ করেন। তিনি নিজে রাজকীয় বাগানের পরিচর্যায় অংশ গ্রহণ করিতেন।

কর্ডোভা মসজিদের সংস্কার সাধন

স্থাপত্য বিদ্যা ও শিল্পের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন খলিফা আল হাকাম। কর্ডোভা মসজিদের সংস্কার সাধন করিয়া উহা আকারে বড় করেন। প্রথম আবদুর রহমান কর্তৃক নির্মিত দক্ষিণ পার্শ্বের প্রাচীর ভাঙ্গিয়া মূল এগার সারির (চক্র) সহিত আরও কিছু সারি সংযোগ করিয়া দৈর্ঘ্যে বর্ধিত করেন। সুন্দর একটি কামরা (মাকসুরা) নির্মাণ করা হয়। নির্জনে একাকী ধ্যানমগ্ন থাকিবার জন্য একটি খিলানের মধ্যে অপর একটি খিলান নির্মাণ করিয়া চীনা বাটির ন্যায় একটি গম্বুজ নির্মিত হয়। ইহার সম্মুখে আট গম্বুজের মিহরাব ছিল। এই মিহরাবের উভয়দিক মূল্যবান পাথর দ্বারা মোজাইক করা হইয়াছিল। মিহরাবের উপর দিক নির্মিত হয় মিনা করা টাইল (টালী) দ্বারা। তাঁহার সময়ে মসজিদের বর্ধিত অংশে বাগদাদের স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অলঙ্কৃত খিলান ও সুসজ্জিত মিহরাবের জন্য কর্ডোভা মসজিদ স্থাপত্যশিল্পের বিকাশে চরমে পৌঁছে। কর্ডোভা মসজিদের বর্ধিত অংশকে সুশোভিত ও সুসজ্জিত করিয়া গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে গ্রীস হইতে মোজাইক

কুশলীদের প্রেরণ করিবার জন্য খলিফা নিচেফরো ফোকাসকে অনুরোধ জানান। খলিফা কনস্টান্টিনোপল (কুস্তুনতুনিয়া) হইতে ৩২৫ কিউব মোজাইক সামগ্রী উপঢৌকন পান। ইহা কর্ডোভা ও মদিনাত আল-জাহরার স্থাপত্য শিল্পী ভাস্কর এবং মোজাইক কুশলীদের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। দশম শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে নির্মিত কতিপয় অট্টালিকার কারুকার্যে বাইজান্টাইন প্রভাব প্রতিভাত হয়।১৭ কর্ডোভা মসজিদের মিম্বার কাষ্ঠ নির্মিত। ইহা কারুকার্যখচিত শিল্পকর্মের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই মিম্বার নির্মাণ করিতে ৩৬০০০ খণ্ড আইভরি, আবলুস, সেগুন ও অন্যান্য সুগন্ধিযুক্ত কাষ্ঠ, মূল্যবান পাথর ও স্বর্ণের ব্যবহার করা হয়। মসজিদের নির্মাণ কার্য সমাপ্ত করিতে সময় লাগে সাত বৎসর এবং ৩৫,৭০৭ দিনার খরচ হয়। কর্ডোভা মসজিদ নির্মাণ করিতে সর্বমোট ২,৬১,০০০ দিনার ব্যয় হয়। কর্ডোভার প্রস্তরখনি হইতে কর্তনকৃত আস্ত পাথরের তৈরি দুইটি বিরাট ঝরণা খলিফা প্রধান মসজিদের জন্য তৈয়ার করান। সিয়েরার ঝরণা হইতে সীসার পাইপ ও নলের সাহায্যে কর্ডোভায় পানি সরবরাহ করা হইত। খলিফার সময়ের পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ আজও দেখিতে পাওয়া যায়।

চরিত্র

আল হাকাম ছিলেন সুশিক্ষিত ও ন্যায়বিচারক শাসক। যিনি প্রদেশগুলির উপর ধার্যকৃত কর লাঘব করেন। তিনি প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে শরিক হইতেন এবং দরিদ্রদের মধ্যে দান-খয়রাত করিতেন। তিনি কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মানিয়া চলিতেন এবং রসূলুল্লাহর জীবন আদর্শ (সুন্না) সাম্রাজ্যের সর্বত্র চালু করিয়াছিলেন। বিবাহ এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় হাকামের বিরোধিতা সত্ত্বেও দেশের সর্বত্র প্রচুর পরিমাণে আঙ্গুরের মদ প্রচলিত ছিল। আরিব বিন সাঈদের মতে, গোলাপ ফুল শাহতারাজ ও অন্যান্য ফুল হইতে এপ্রিল মাসে; আপেল, আলশাবী ও খাসখাস হইতে মে মাসে; আপেল ও নাশপাতি হইতে জুলাই মাসে; খাসখাস ও দাড়িম ফল হইতে আগস্ট মাসে শরবত (পানীয়) সংগৃহীত হইত। খলিফা অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যা পাঠে উৎসাহী ছিলেন। গোড়া মুসলমানদের অপছন্দ সত্ত্বেও খলিফা দর্শন শাস্ত্র পাঠে অনুপ্রেরণা দিতেন।১৮ তাহার দরবারে গোড়া ও উদার পন্থীরা উভয়ে সমভাবে সমাদ্রিত ছিলেন। তাঁহার সাম্রাজ্যে সকল ধর্মাবলম্বীই তাহাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান স্বাধীনভাবে পালন করিতে পারিত। তিনি ছিলেন পরধর্মে সহিষ্ণ।

জাহিরী মাতবাদের আল মুনজির ইবনে সাঈদ আল বালুতি নামে জনৈক বিখ্যাত ব্যক্তি এই সময়ে প্রসিদ্ধী লাভ করেন। বালুতী ছিলেন ৯৫০-৯৬৬ খ্রীঃ পর্যন্ত কর্ডোভার কাজি। খলিফা মালিকী মতবাদের আধিপত্য সমর্থন করিতেন না। তিনি সাধারণ বিষয়ে কাজিকে জাহিরী মতবাদ মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে অনুমতি প্রদান করেন। কোরান শরীফের মূলপাঠে বিশেষজ্ঞ ও শাফী মতবাদের প্রচারক আবুল হাসান

আল-আনতাকী ৯৬৩ খ্রীঃ কর্ডোভায় বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু তিনি মালেকীদের বিরোধীতার কারণে শাফী মতবাদ প্রচারে বিশেষ সুবিধা করিতে পারেন না। কায়রোওয়ান ও অন্যান্য স্থান হইতে শাফী মতবাদে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ আগমন করিতে থাকেন। ধর্মতত্ত্বে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন শাখায় বৃত্তি প্রদানের নীতি অব্যাহত থাকে এবং প্রাচ্যের সুন্নী মতবাদ কর্ডোভায় প্রতিষ্ঠিত হয়। খলিফা আল হাকাম ছিলেন নম্র দয়ালু ধর্মপরায়ণ ও সরল প্রাণ। তিনি শত্রুকে পর্যন্ত ক্ষমা প্রদর্শন করিতেন। তিনি যেমন তাঁহার পিতার ন্যায় রাজনীতিবিদ ছিলেন, তেমনি তিনি তাঁহার পিতার জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপনও পছন্দ করিতেন না। কূট রাজনীতিবিদ না হইলেও তিনি ছিলেন সাহসী ও কর্মঠ। তিনি কোন কোন সময় যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনা করিতেন। অধিকাংশ সময় জ্ঞান সাধনা ও সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করিবার ফলে রাজকার্য পরিচালনায় উজির ও হেরেমের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় হাকাম তাঁহার সামরিক শক্তি হ্রাস করেন এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্র বর্ধিত করের ছয় ভাগের একভাগ লাঘব করেন।২০ রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করেন খলিফা আল হাকাম। দেশ কৃষি সম্পদে সমৃদ্ধশালী হইয়া ওঠে। হাকামের সচিব আরিব বিন সাঈদের বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, দেশের নদীতীরবর্তী এলাকায় ধানের চাষাবাদ হইত। কলকারখানার উন্নতি সাধিত হয়। পিতার ন্যায় খলিফা দ্বিতীয় হাকামও বস্ত্রশিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিরাজের প্রধান প্রস্তুতকারক হিসাবে স্লভ ফাইক আল-নিজামীকে ও অপর স্লভ জাওজারকে সুন্দর সূচীকর্মের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। এই দুই প্রিয় অনুচরের বাহুর উপরেই দ্বিতীয় হাকামের ইন্তেকাল হয়।

গচ্ছিত মূল্যবান খনিজ পদার্থকে দেশের শিল্পকারখানার উন্নয়নে ব্যবহার করা হয়। ফলে স্পেন উন্নত ও ঐশ্বর্যশালী হইয়া ওঠে। সংক্ষেপে বলা যায় দ্বিতীয় হাকামের রাজত্বকাল ছিল মুসলিম স্পেনের স্বর্ণযুগ।

তথ্য নির্দেশ

ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ৪৫৩; মুসলিম কলোনিস, পৃঃ ১৫৮-১৫৯। ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ৪৫৪; রিচার্সাস (১৮৮১) পৃঃ ২৯৪। হিট্টি, হিস্ট্রি অব দি আরবস, পৃঃ ৫৩০। সাম অ্যাসপেক্টস, পৃঃ ১৮৪। গুরুনেবাউম, মেডিয়াভ্যাল ইসলাম, পৃঃ ৫৭। লেভি প্রভেঙ্কাল, ল্যা-সিভিলাইজেশন, আরব এন ইস্পনা, পৃঃ ১০১। ম্যাককেব, স্পেলান্ডার অব মুরিশ স্পেন, পৃঃ ৮০; মাক্কারী, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪০৮; এস, এম. ইমামউদ্দিন, হিস্পনো আরব লাইব্রেরিয়া, বুক্‌স এ্যান্ড ম্যানাসক্রিপ্টস (J. P. H. S. VII) করাচি, ১৯৫৯, পৃঃ ১০৬; হোল, আন্দালুস, টীকা-৩৮।

দ্বিতীয় হাকাম (৯৬১-৭৬ খ্রীঃ)

১৭৯ ৮। মাক্কারী, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩০২। ৯। জে, ম্যাককেব, স্পেলাডার অব মুরিশ স্পেন, পৃঃ ৮১; রিবেরা, ডিজারটেরনস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৯৩। ১০। ম্যাককেব, পৃঃ ৮১; এস, এম, ইমামউদ্দিন, হিস্পনো আরব, করাচি, ১৯৫৯, পৃঃ ১০৮। ১১। এস, এম, ইমামউদ্দিন, হিস্পনো আরব, করাচি, ১৯৬১, পৃঃ ৪-৫। ১২। ঐ পূঃ ৫। ১৩। হিস্পানিস, ১৮শ খণ্ড, ১৯৩৪, পৃঃ ১৯৮-২০০; লেডি প্রভেঙ্কাল, ল্যা-সিভিলাইজেশন; পৃঃ ৮৭,

টীকা নং-২১। ১৪। গায়ানগোস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৭০। ১৫। ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ৪৫৫; ম্যাককেব, পৃঃ ৮১, ১৮৫; স্কট, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৬৫৬-৫৭। ১৬। এস. এম. ইমামউদ্দিন, সাম অ্যাসপেক্টস, অব দ্যা সোশিও-ইকনোমিক এ্যান্ড কালচারাল হিস্ট্রি

অব মুসলিম স্পেন, লেডেন, ১৯৬৫, পৃঃ ১৭৩। ১৭। ১ দিনার = ১৩ শিলিং (১৯৬৯ খ্রীঃ)। ১৮। সাম অ্যাসপেক্টস, লেডেন, ১৯৬৫, পৃঃ ১০৬। ১৯। ইবনুল ফারাজী, নং ১৩২। ২০। লেভি প্রভেঙ্কাল, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৬৮, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩৮।

সকল অধ্যায়

১. উপক্রমণিকা (মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাস)
২. প্রথম অধ্যায় : মুসলমানদের স্পেন বিজয়
৩. দ্বিতীয় অধ্যায় : দামেস্ক-খেলাফতের অধীন উমাইয়া আমীরদের শাসন
৪. তৃতীয় অধ্যায় : স্বাধীন উমাইয়া আমীরদের রাজত্ব
৫. চতুর্থ অধ্যায় : প্রথম হিশাম
৬. পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম হাকাম
৭. ষষ্ঠ অধ্যায় : দ্বিতীয় আবদুর রহমান
৮. সপ্তম অধ্যায় : প্রথম মুহাম্মদ
৯. অষ্টম অধ্যায় : মুনজির ও আবদুল্লাহ
১০. নবম অধ্যায় : উমাইয়া খিলাফত
১১. দশম অধ্যায় : দ্বিতীয় হাকাম
১২. একাদশ অধ্যায় : হাজীব আল-মনসুর
১৩. দ্বাদশ অধ্যায় : স্পেনে উমাইয়া খিলাফতের পতন
১৪. ত্রয়োদশ অধ্যায় : স্পেনের উত্তরাঞ্চলে খ্রীস্টান রাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয়
১৫. চতুর্দশ অধ্যায় : প্রথম পর্যায় ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহ
১৬. পঞ্চদশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পর্যায় – উত্তর আফ্রিকার শাসন
১৭. ষষ্ঠদশ অধ্যায় : তৃতীয় পর্যায়ঃ নাসরী রাজবংশ
১৮. সপ্তদশ অধ্যায় : মরিস্ক জাতি
১৯. অষ্টাদশ অধ্যায় : স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের কারণসমূহ
২০. উনবিংশ অধ্যায় : শাসনকার্য ও প্রশাসন
২১. পরিশিষ্ট-ক : ইক্রিতিশে কর্ডোভান মুসলমানদের শাসন
২২. পরিশিষ্ট-খ : স্পেনে মুসলিম শাসকদের বংশানুক্রমিক তালিকা
২৩. পরিশিষ্ট-গ : উত্তর-স্পেনে খ্রিষ্টান শাসকদের কালানুক্রমিক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন