হাজীব আল-মনসুর
(৯৭৬-১০০২ খ্রীঃ)
একাদশ অধ্যায়
দ্বিতীয় আল হাকামের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় হিশাম আল-মুয়াইয়াদ ২রা অক্টোবর ৯৭৬ খ্রীঃ সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণ কালে তাহার বয়স ছিল ১২ বৎসর। ফাইক ও সাত্তজার নেতৃত্বাধীন স্লাভগণ তাহার সিংহাসনে আরোহণের বিরোধিতা করে এবং তাঁহার পিতৃব্য আল মুগিরাহ সিংহাসন আরোহণ সমর্থন করে কিন্তু তাহাদের এই প্রয়াস ব্যর্থ হয়। আবুল হাসান জাফর বিন উসমান আল মুশাফী মুগিরাকে হত্যা করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রী। আবু আমীর মুহাম্মদকে প্ররোচিত করেন। খলিফা অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তাহার মাতা সুলতানা সুবহ রাজপ্রতিনিধি হিসাবে রাজ্যের সমস্ত কার্য পরিচালনা করিতেন। সুলতানা সুবহ ছিল বাস্ক জাতির অন্তর্গত। খ্রীস্টানগণ তাহাকে অরোরা (উষা) বলিয়া সম্বোধন করিত।
দ্বিতীয় হিশামের রাজত্বকালে আমীরদের স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত হয়। খালিফাকে তাঁহার প্রাসাদে বন্দী করিয়া তাহাকে সকল প্রকার রাজনৈতিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হয়। দ্বিতীয় হাকামের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের মধ্যে যে বিশৃংখলা দেখা দেয় তাহার কারণ সর্বজন বিদিত। এই আমীরী স্বেচ্ছাচারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবু আমীর মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ ইবনে আবু আমীর। তিনি সামান্য অবস্থা হইতে নিজ চেষ্টার দ্বারা প্রধান মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। তাহার মাতা বুরাইয়াহা ছিলেন শহর ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াহিয়া ইবনে জাকারিয়া ইবনে বারতাল আল তামিমীর কন্যা। তাহার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন রাজপ্রাসাদের শিক্ষিত ও সম্মানিত ব্যক্তি। ইবনুল আব্বাস ও মাক্কারীর মতে, তাহার মহান প্রপিতামহ আবদুল মালিক আল মাফিরী ছিলেন ইয়ামানের অধিবাসী। তিনি তারিক ইবনে জিয়াদের সহিত স্পেনে আগমন করেন এবং আল-জাসিরা প্রদেশের অন্তর্গত টোররোক্স-এ বসতি স্থাপন করেন। আমীর মুহাম্মদের সভাসদদের মধ্যে আবু আমীর ছিলেন অন্যতম। আবু আমীর মুহাম্মদের পিতামহ মুহাম্মদ সেভিলের কাজি হিসাবে আট বৎসর চাকরী করেন। তাহার পিতা বিচারক আবু হাফস আবদুল্লাহ ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তৃতীয় আবদুর রহমানের শাসনের শেষ পর্যায়ে হজ্ব হইতে প্রত্যাবর্তনের পথে আফ্রিকার আরকাদা অথবা ত্রিপলীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আবু আমীর মুহাম্মদ ৯৪২ খ্রীঃ জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি কর্ডোভা আগমন করিয়া সেখানে বসতি স্থাপন করেন। প্রথম জীবন হইতেই তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা
লাভের আশা পোষণ করিতেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি তাহার বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক দূরদর্শীতা সম্পর্কে আস্থাবান ছিলেন এবং ভবিষ্যতবাণী করিয়াছিলেন যে, তিনি একদিন আন্দালুসিয়ার ভাগ্যবিধাতা হইবেন। কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে তিনি আইন শিক্ষা লাভ করেন। তারপর কর্ডোভার কাজি মুহাম্মদ আল সলিমের বিচারালয়ে মুহরীর কাজ করিয়া জীবিকা অর্জন করিতে শুরু করেন। দ্বিতীয় আল হাকামের প্রসাদের বাহির দরজার নিকট তিনি তাহার অফিস স্থাপন করিয়াছিলেন। আবু আমীর মুহাম্মদের সহিত জনৈক খোজার ঘনিষ্ঠতা হয়। সেই খোজা তাহাকে সুলতানা সুবহের সহিত পরিচয় করাইয়া দেয়। রাণী তাহাকে মাসে পুনরো দিনার মাস মাহিনায় তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুর রহমানের জমিদারীর নায়েব নিযুক্ত করেন। ৯৬৭ খ্রীঃ ফেব্রুয়ারি ঐ সময় তাহার বয়স ছিল মাত্র ছাব্বিশ বৎসর। কিছুকাল পর রাণী তাহাকে নিজের ব্যক্তিগত জমিদারীর তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেন। সাতমাস পর সেভিলে রাণী তাঁহাকে উত্তরাধিকার কর ও অকটর আদায়ের কালেকটর পদে উন্নীত করেন। পরবর্তী কালে তাঁহাকে কর্ডোভা টাকশালের সুপারিনটেন্টডেন্ট নিয়োগ করা হয়।
তাহার পৃষ্ঠপোষক সুলতানা সুবহের জন্য প্রাসাদের রৌপ্য নির্মিত নমুনা (Model) পেশ করেন এবং আল হাকামের প্রিয়ভাজন আবু আফলাহসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির হৃদয় মূল্যবান উপঢৌকন ও প্রচুর ঘুষ দ্বারা জয় করিতে সমর্থ হন। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হইলে উজির ইবনে হুদায়ের তহবিল পূরণের জন্য তাহাকে গোপনে সাহায্য করেন। ফলে যাহারা তাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করিয়াছিল তাহারা লজ্জিত ও লাঞ্ছিত হয়। ৯৬৮ খ্রীঃ তিনি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক এবং উহার এগার মাস পর সেভিল ও হুয়েলভার কাজি নিযুক্ত হন। যুবরাজ আবদুর রহমানের মৃত্যুর পর ৯৭০ খ্রীঃ তিনি হিশাম আল মুয়াইয়াসের গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত হন। ৩৬১ হিঃ/ ৯৭২ খ্রীঃ তিনি কর্ডোভার সাহিবুল শুরতাই (পুলিশ অফিসার) নিযুক্ত হন। কর্ডোভা নগরীর ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে তিনি নিরপেক্ষভাবে আগ্রহ ও উৎসাহের সহিত নিজ দায়িত্ব পালন করেন। যোগ্যতা ও তোষামদের দ্বারা তিনি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন এবং একত্রিশ বৎসর বয়সে তিনি পাঁচ হইতে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন করেন।
সুদূর পশ্চিম ইফ্রিকিয়াতে বার্বার সরদারদের বিদ্রোহ দমনে গালিব প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। ইহা দ্বিতীয় হাকাম অর্থের অপচয় বলিয়া সন্দেহ করেন এবং আবু আমীর মুহাম্মদকে অর্থ দফতরের কন্ট্রোলার জেনারেল এবং মৌরিতানিয়ার প্রধান বিচারক নিযুক্ত করেন। তিনি আফ্রিকায় গমন করিয়া প্রাদেশিক প্রশাসন ও সামরিক বিভাগের সহিত প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হন। জনৈক ফাতেমী সমর্থক হাসান বিন গানের বিরুদ্ধে মরক্কোতে যুদ্ধরত জেনারেল গালিবের সহিত পরামর্শ করিয়া মোটা সামরিক ব্যয় হ্রাস করেন। তাহার উপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি সফলতার সহিত সম্পাদন করেন। গালিব পরবর্তীকালে নিজ কন্যা আসমাকে তাহার সহিত বিবাহ দেন। ইফ্রিকিয়ায় অর্জিত অভিজ্ঞতা ও এই বৈবাহিক সম্পর্ক পরবর্তীকালে তাহাকে ক্ষমতা লাভে সাহায্য করে।
দ্বিতীয় আল-হাকামের মৃত্যুর সময় আবু আমীরের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। বালক রাজার সিংহাসন আরোহণে পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলির খ্রীস্টানদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে, তাহারা এইবার সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করিবার সুযোগ পাইবে। খ্রীস্টানদের এই ধারণাই তাহার উন্নতির পথ পরিষ্কার করিয়া দেয়। রজব ৩৬৬ হিঃ/ ফেব্রুয়ারি ৯৭৭ খ্রীঃ আবু আমীর খ্রীস্টানদের দমন করিবার উদ্দেশ্যে কর্ডোভা হইতে যাত্রা করেন এবং তাহাদিগকে দমন করিয়া প্রচুর গানিমত লইয়া রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। ইহার ফলে কর্ডোভায় তাহার সুখ্যাতি বৃদ্ধি পায়।
আবু আমীর মুহাম্মদ তাঁহার শ্বশুর গালিবের সহায়তায় হাজীব জাফর ইবনে উসমান আল মুশাফী যিনি হাকামের পুত্রের গৃহশিক্ষক হইবার সুযোগে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন তাহাকে ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ যাহারা তাহার ক্ষমতা গ্রহণে বিরোধীতা করিয়াছিলেন তাহাদিগকে অপসারণ করেন। তিনি শেষ আঘাত হানেন রাজকীয় দেহরক্ষী স্নাভদের উপর, যাহারা গালিবের প্রতি বিশেষ অনুগত ছিল। তিনি এই দেহরক্ষী দলের পরিবর্তে উত্তর আফ্রিকার বার্বার ও উত্তর স্পেনের খ্রীস্টান বেতনভোগী ইউনিট গড়িয়া তোলেন। ইহারা রাষ্ট্রের তুলনায় আবু আমীরের প্রতি অধিক অনুগত ছিল। মঞ্চে একমাত্র বিরোধী (যুল ও জারাতাইন) জেনারেল গালিব অবশিষ্ট থাকেন। আবু আমীরের সৌভাগ্য গালিব খ্রীস্টানদের সহিত যুদ্ধকালে নিহত হন। তিনি খলিফাকে প্রাসাদের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করেন এবং উৎসব অনুষ্ঠান ব্যতীত সরকারি কর্মচারীদের সহিত দেখা সাক্ষাত করিতে নিষেধ করেন। কর্ডোভাতে উমাইয়াদের দ্বারা নির্মিত প্রাসাদ আল কাজার হইতে নতুন নগরী মদিনাতুল জাহিরাতে প্রশাসনিক সদর দফতর স্থানান্তর করিয়া বাহিরের জগত হইতে ইহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলেন।
এই সময় সুলতানা সুবহ আবু আমীরের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট হইয়া ওঠেন। দ্বিতীয় হিশামকেও তিনি তাহার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পরায়ণ করিয়া তোলেন। সুলতানা বাহিরের সাহায্যের জন্য মরক্কোর শাসক জিরি ইবনে আতিয়ারের স্মরণাপন্ন হন। আবু আমীর রাজ্যের সমস্ত পরিচালনার ভার তাহার উপর ন্যস্ত করিয়া একটি ডিক্রি জারি করিতে খলিফাকে সম্মত করিতে সক্ষম হন। রাণী আবু আমীরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ হইয়া রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করেন। ক্ষমতা লাভের পথে সমস্ত প্রতিবন্ধক বিরোধী শক্তিকে পরাভূত করিয়া আবু আমীর স্পেনের একচ্ছত্র অধিপতি হইয়া ওঠেন। মুদ্রার উপর হিশামের নাম ছিল সত্য কিন্তু সমস্ত রাজাজ্ঞা ও আদেশ নিষেধ আবু আমীরের অনুমোদনে প্রচারিত হইত। খলিফার নামের সহিত তাহার নামও খুতবায় পাঠ করা হইত। তিনি অতিরিক্ত চতুর ছিলেন বলিয়া খলিফা টাইটেল গ্রহণ হইতে বিরত
থাকেন। সংক্ষেপে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করিতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে লিওন ও নাভাররের শাসকদ্বয়কে পরাজিত করিয়া তিনি ‘আল মনসুর বিল্লাহ’ উপাধী গ্রহণ করেন। আবু আমীর ছিলেন সাহসী ও কর্মঠ। তিনি পূর্বেকার শাসকের ন্যায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। একজন আরব হওয়া সত্ত্বেও তিনি অন্যায়ভাবে গৃহীত ক্ষমতাকে রক্ষা করিবার জন্য বার্বার ও স্লাভদিগকে সেনাপতিরূপে নিয়োগ করেন।
সুলতানা সুবহর সহিত তাহাদের পূর্ব সম্পর্ক লইয়া কর্ডোভায় বিরূপ সমালোচনা হয়। পূর্বে যাহারা হাজীবের অনুগত ছিল পরবর্তীকালে তাহারাই তাহার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হইয়া ওঠে। তাহার চরম শত্রু ফকিহগণ তাঁহাকে ধর্মবিরোধী বলিয়া আখ্যা দেন। খলিফার সহিত তাহাকেও হত্যা করিতে ফকিহগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং তৃতীয় আবদুর রহমানের অপর পৌত্রকে সিংহাসনে বসাইতে চেষ্টা করেন। এই ষড়যন্ত্র প্রকাশ হইয়া যায় এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁসী অথবা নির্বাসন দেওয়া হয়। বিচারক ও আলেমদের সন্তুষ্ট করিবার জন্য আল-মনসুর আল হাকামের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত দর্শনের গ্রন্থসমূহ জ্বালাইয়া দেন এবং বহু দার্শনিককে নির্বাসিত করেন। ইহার পরও তাহাদের সমর্থন লাভের জন্য তিনি স্বহস্তে কোরআন শরীফ নকল করেন।
প্রধানমন্ত্রী মুশাফীকে উৎখাত করিবার পর আল-মনসুর প্রধান সেনাপতির প্রভাব হইতে নিজেকে মুক্ত করিতে চেষ্টা করেন। তিনি প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সেনাবাহিনীকে তাহার আয়ত্তে আনিবার জন্য। আরব বাবার এবং স্পেনীয়দের লইয়া সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। তৃতীয় আবদুর রহমানের শাসন আমলে বিদেশীদের সেনাবিভাগে ভর্তির যে রেওয়াজ প্রচলিত ছিল দ্বিতীয় হাকামের রাজত্বকালে উহার পরিবর্তে দেশী লোকদিগকে সেনাবিভাগে ভর্তি করা শুরু হয়। গালিবের পক্ষপাতিত্ব ও অবহেলার দরুন সেনাবাহিনী পূর্বের শৃঙ্খলাবোধ হারাইয়া ফেলে। উত্তর আফ্রিকায় অবস্থানকালে আবু আমীর মাগরিব সেনাদের দক্ষতায় মুগ্ধ হন এবং তাহাদিগকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মৌরিতানিয়ার যুদ্ধে বিপর্যস্ত বহু বার্বার সিউটাতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সিউটার গভর্নরের হস্তক্ষেপে এই সমস্ত বার্বার তাহার সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। আল মনসুর তাহাদিগকে কর্ডোভায় সাদরে গ্রহণ করেন এবং উন্নতমানের যুদ্ধাস্ত্র ও অশ্ব দ্বারা তাহাদিগকে সুসজ্জিত করেন। এই খবর শুনিবার পর বহু বার্বার ও সুদানী স্বেচ্ছাসেবক নতুন হাজীবের সেনাদলে যোগ দিতে শুরু করে। বার্বারদিগকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিবার পর নগরীর লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে আল-মনসুর কর্ডোভার জামে মসজিদকে বর্ধিত করেন। বার্বার সৈন্যগণ দুই শ্রেণীর ছিল। প্রথম শ্রেণী বেতনভোগ। নিয়মিত সেনা, তাহাদিগকে মুবতাজিকা’ বলা হইত। দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল স্বেচ্ছাসেবক
বাহিনী। তাহারা পুরস্কার এবং এক কালীন ভাতা পাইত। তাহাদিগকে মুতাবিয়া’ বলা হইত। দেশের উত্তরাংশে খ্রীস্টান নেতাদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের ফলে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। লিওন, নাভাররে ও কাটালোনিয়ার অধিবাসীগণ দরিদ্র হইয়া পড়ে। বহুলোক তাহাদের পূর্ব প্রভু ত্যাগ করিয়া কর্ডোভায় আগমন করে। দেশের উত্তরাঞ্চলের খ্রীস্টানগণ বার্বারদের ন্যায় অধিক সংখ্যায় কর্ডোভার সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। গোত্রীয় আদর্শে গঠিত মুসলিম সেনাবাহিনী উহাদের বৈশিষ্ট্য হারাইয়া ফেলে। তৃতীয় আবদুর রহমানের অনুকরণে আল-মনসুর আরবগোত্রীয় সেনাবাহিনীর পরিবর্তে নিয়মিত সেনাবাহিনী গড়িয়া তোলেন। দ্বিতীয় হাকামের শাসনকালে এই পদ্ধতির তেমন কোন উন্নতি সাধিত হয় না। গোত্রীয় কলহ-কোন্দলকে দূর করিবার উদ্দেশ্যে আল-মনসুর আরব সৈন্যদিগকে বার্বার ও খ্রীস্টান বেতনভোগী সৈন্যদের মধ্যে ভাগাভাগী করিয়া দেন। গালিবের ভক্ত ও অনুগত সেনাবাহিনীকে এইভাবে বিভক্ত করা হয়। অতঃপর সেনাবাহিনীতে শৃংখলাবোধ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দক্ষ ও অনুগত সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। বিদেশী বেতনভুক সৈনিকের আনুগত্য সম্পর্কে তাঁহার পূর্ণ আস্থা ছিল। উহাদের সমন্বয়ে তিনি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়িয়া তোলেন দেশের উত্তরাঞ্চলে এক অভিযানকালে তাঁহার মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ৬,০০,০০০ লক্ষ। শক্তিশালী শাসকদের অধীনে বিদেশী বেতনভুক সৈনিকগণ ছিল সুশৃঙ্খল। কিন্তু উমাইয়া শাসনের পতনকালে শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিয়া তাহারা দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি এবং সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধনে অংশ গ্রহণ করে। মনসুরের সেনাবাহিনী ছিল খুবই সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী।
কারণ শৃঙ্খলা ভংগের জন্য সমুচিত শাস্তি বিধানে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর।
বেসামরিক প্রশাসনের মত সামরিক ক্ষেত্রেও আবু আমীর মুহাম্মদ কৃতিত্বের পরিচয় দান করেন। হিট্টির ন্যায় বিশ্ব বিশ্রুত ঐতিহাসিক বলিয়াছেন যে, “৯৭৩ খ্রীস্টাব্দে ফাতেমীদের রাজধানী কায়রোতে স্থানান্তর ও দেশের উত্তরাংশে অবস্থিত খ্রীস্টান রাষ্ট্রসমূহে গণ-অসন্তোষ তাহার জন্য আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ও আইবেরিয় উপদ্বীপের উত্তরাংশে সামরিক অভিযান পরিচালনার সুবর্ণ সুযোগ করিয়া দেয়।”১০
দ্বিতীয় হাকামের মৃত্যুর অব্যবহিত পর গ্যালেসিয়ার অধিবাসী ও বাস্কগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং স্পেনীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করে। ৩৭১ হিঃ/ ৯৮১ খ্রীঃ লিওনের রাজা তৃতীয় রামিরো জামোরা অধিকার করিয়া ক্যাষ্টিলের কাউন্ট গার্সিয়া ফার্নান্ডেজ ও পাম্পলোনার নাভাররে) রাজা সাঞ্চো আবারকার সহিত সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন। কিন্তু এই তিন জনই আবু আমীর মুহাম্মদের সেনাপতির হস্তে সিমানকাসের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত রোয়েদাতে পরাজিত হয়। খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে মনসুরের এক যুদ্ধ সম্পর্কে তারতুশি উল্লেখ করিয়াছেন যে, প্রথমবারের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের
পরপরই উভয় পক্ষের সেরা সৈনিকদের মধ্যে প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হইয়া যায়। কয়েকটি সফল অভিযানের পর মনসুর লিওন ও নাভাররেকে করদরাজ্যে পরিণত করেন এবং উহাদের রাজধানীতে নগররক্ষী বাহিনী মোতায়েন করেন। খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় লাভের পর তিনি ৯৮১ খ্রীঃ মনসুর বিল্লাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। দেশের উত্তরাংশে গমনের উদ্দেশ্যে ৯৮৫ খ্রীঃ এলভিরা, বাজা ও মুরসিয়ার মধ্য দিয়া পুনরায় তিনি কর্ডোভা ত্যাগ করেন এবং সেখানকার নেতা ইবনে খাত্তাব ১৩ দিন ব্যাপী উৎসবের মধ্য দিয়া তাঁহাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ক্যাটালোনিয়া পৌছিবার পর তিনি ৯৮৫ খ্রীঃ ৬ই জুলাই দ্রুত বার্সিলোনা অধিকার ও লুণ্ঠন করেন এবং কাউন্ট বরেলকে বিতাড়িত করেন। ইবনে আব্বারের মতে ইহা ছিল তাহার তেইশতম অভিযান। তৃতীয় রামিরোর উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় বেরমুডের অধীনে লিওনবাসীগণ ৯৮৭ খ্রীঃ পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ৯৮৮ খ্রীঃ তাহারা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমা পুনরায় পীরেনীজ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
মৌরিতানিয়াতেও তাহার সেনাবাহিনী সফলতা অর্জন করে এবং উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার বিরাট অঞ্চল তাঁহার পিতৃব্যপুত্র সেনাপতি আসকালাজাহর নেতৃত্বে তাঁহার অধিকারে আসে। ইবনে গানুন পরাজিত ও পরাভূত হইয়া কর্ডোভাতে প্রেরিত হন কিন্তু আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গ করিয়া তাহাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় আসকালাজাহও নিহত হন। জিরি বিন অতিয়াহ আবু আমীরের বিরুদ্ধে সুলতানা সুবহের সহিত যোগদান করেন। জিরিকে শাস্তি প্রদানের জন্য মনসুর তাহার পুত্র আবদুল মালিককে প্রেরণ করেন। ফেজ অধিকার করিয়া সিজিলমাসের সহিত একত্রিত করা হয়। জিরি তাহিরাতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে ৩ বৎসর পর ১০০১ খ্রীঃ মৃত্যু বরণ করেন। আবদুল মালিক তাহার আজাদকৃত ক্রীতদাস ওয়াদীকে মৌরিতানিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করিয়া ৯৮৮ খ্রীঃ স্পেনে প্রত্যাবর্তন করেন। সেই সময় মরক্কোর ইদ্রিসী শাসক হাসান বিন গানুন বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি উত্তর আফ্রিকার জিরি বিন আতিয়ার নিকট হইতে “মিহরিয়াহ” নামক উৎকৃষ্ট জাতের পঞ্চাশটি উট উপঢৌকন হিসাবে গ্রহণ করেন।
দেশের উত্তরাংশে খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে প্রতি বৎসর অভিযান পরিচালনার ফলে তাহাদের মনে মনসুর সম্পর্কে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। একবার মনসুরের সেনাবাহিনী কোন এক খ্রীস্টান নগরীর ছোট পাহাড়ে উপস্থিত হইয়া সেখানে পতাকা উত্তোলন করে। পতাকাটি রাখিয়া সেনাবাহিনী স্থান ত্যাগ করে কিন্তু কোন খ্রীস্টান সেনা উহাকে নামাইতে সাহস পায় নাই। মনসুরের নাম শুনিলে শত্রুর হৃদয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হইত। ৯৯৭ খ্রীঃ কাসরে আবি দানিশে রক্ষিত যুদ্ধোপযোগী বেশ কিছু সংখ্যক যুদ্ধ জাহাজকে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী নাবিক দ্বারা সুসজ্জিত করিয়া গ্যালেসিয়া অভিযানে প্রেরণ করা হয়। সমুদ্রপথের এই দুঃসাহসিক অভিযানে মনসুর বিরাট সফলতা অর্জন করেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল এবং সুদূর উত্তরে লিওন, সান্তিয়াগো, দি কম্পোস্টিলা ও কান্টাব্রিয়ান সমুদ্র পর্যন্ত তাহার সাম্রাজ্যের সীমা সম্প্রসারিত হয়। উত্তরাঞ্চলের খ্রীস্টান শাসকদের মত উমাইয়া শাসকগণও আধা সামন্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। আল-মনসুর প্রতি বৎসর ৮০০০ হাজার ঘোড়া খরিদ করিতেন। একবার তিনি শুধু উত্তর আফ্রিকা হইতে ১,০০০ হাজার ঘোড়া আমদানী করেন। সেভিলের নদী-দ্বীপ মাদাইনে তাহার ৩,০০০ হাজার ঘোটকী ও ১০০ ঘোড়া ছিল। প্রতিবার অভিযান হইতে প্রত্যাবর্তনের পর আস্তাবল রক্ষক মুনিয়াতুল আমিরীয়াতে মনসুরকে ঘোড়ার উৎপাদন ও উন্নয়ন সম্পর্কে অবহিত করিত।১২ ইবনুল খাতিব বলেন, মন্টে মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রাক্কালে মনসুর সাতদিনে ৩,০০০ হাজারের অধিক খচ্চর খরিদ করেন।১৩ ইহাতেই প্রমাণিত হয় যে, ঐ এলাকায় সামরিক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য প্রচুর পশু পাওয়া যাইত।১৪
মৃত্যুঃ রিওজার বিরুদ্ধে পরিচালিত শেষ অভিযানে সান মিলান দে-লা কগোল্লার আশ্রম ধ্বংস করিয়া প্রত্যাবর্তন কালে ২৭ শে রমজান ৩৯২ হিঃ/ ১০ই আগস্ট ১০০২ খ্রীস্টাব্দে সাফল্যের সহিত ২৭ বৎসর রাজত্ব করিবার পর এই বিখ্যাত বীর একষট্টি বৎসর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মদিনাতুস সালিমে (মেদিনা সেলী) তাঁহাকে দাফন করা হয়।
আল-মনসুর তাহার সময়কার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তৃতীয় আবদুর রহমানের পর তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং দশম শতাব্দীর ইউরোপে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। সাধারণ অবস্থা হইতে নিজ চেষ্টা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, যোগ্যতা ও কূটনীতির মাধ্যমে তিনি রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ছাত্র জীবনেই তিনি নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন এবং বলিতেন তিনি ভবিষ্যতে আন্দালুসিয়ার ভাগ্যবিধাতা হইবেন। স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্যকে তিনি ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করেন। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হিশামের সিংহাসন আরোহণ ও অলস মুশাফির অকর্মণ্যতার দরুন খ্রীস্টানদের অনুপ্রবেশ ও আফ্রিকার বিদ্রোহ স্পেনকে খণ্ডবিখণ্ড করিবার উপক্রম করে কিন্তু মনসুর কূটকৌশল অবলম্বন করিয়া স্লাভদের বিরুদ্ধে মুশাফীকে, মুশাফীর বিরুদ্ধে গালিবকে, গালিবের বিরুদ্ধে জাফর মালিক আল জাবকে, জাফরের বিরুদ্ধে আবদুর রহমান আল মুতাররীদকে একের পর এক ব্যবহার করিয়া নিজ শক্রদিগকে উৎখাত করিয়া দেশকে ধ্বংসের কবল হইতে রক্ষা করেন। রাজ্য শাসনে তিনি অসহায় ও নাবালেগ খলিফাকে দাবার ঘুটি হিসাবে ব্যবহার করেন। আল-মনসুর অনুগত সুদক্ষ সেনাবাহিনী গডিয়া তোলেন। তিনি মোট সাতানুটি অভিযান পরিচালনা করেন এবং লিওন, নাভাররে ও বার্সিলোনার খ্রীস্টান শক্তিকে দমন
করেন। খ্রীস্টানগণ তাহার নামে আতঙ্কিত হইত এবং চুক্তিভঙ্গকারিরা সমুচিত শিক্ষা লাভ করিত। তিনি শত্রুর সহিত শান্তি আলোচনার পরিবর্তে তাহাদিগকে কঠিন ও কঠোর হস্তে দমন করিতেন। সন্দেহাতীত ভাবে তিনি ছিলেন তাঁহার সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব।
মনসুর ছিলেন তাঁহার সৈনিকদের নিকট অনুপ্রেরণার উৎস। সৈনিকদের শৃঙ্খলাবোধের প্রতি তিনি ভীষণ গুরুত্ব আরোপ করিতেন। তাঁহার শাসন খুবই কঠোর ছিল। ফলে তাহার শাসনকালে কোন প্রকারের বিদ্রোহ রাজ্যের শান্তি বিঘ্নিত করিতে পারে নাই। তাঁহার রাজত্বকালে স্পেন যে গৌরবের অধিকারী হইয়াছিল পরবর্তীকালে আর সেরূপ হয় নাই। তাহার সময়ে মুসলিম স্পেন গৌরব ও প্রাচুর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে। তৃতীয় আবদুর রহমান ব্যতীত স্পেনের রাজনৈতিক গগনে তাহার ন্যায় আর কোন নক্ষত্রের উদয় হয় নাই। মনসুর দেশের বৈষয়িক উন্নতির প্রতি অতি মাত্রায় আগ্রহী ছিলেন।১৫ ফলে মুসলিম স্পেনের জনসংখ্যা বৃদ্ধিপায়। তিনি যাতায়াতের সুবিধার জন্য পুরাতন রাস্তাসমূহকে সংস্কার ও প্রশস্ত এবং নতুন নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ও সেনা পরিচালনায় সুবিধার জন্য কতিপয় সেতু নির্মাণ করেন। এচিজার নিকট জেনিল ও কর্ডোভার সন্নিকটে গোয়াদালকুইভির নদীর উপর সেতু নির্মিত হয়। কর্ডোভা সেতু নির্মাণে ১,৪০,০০০ দিনার ব্যয় হয়। কর্ডোভা মসজিদকে আল-মনসুর সংস্কার ও সম্প্রসারিত করেন। ইহার নির্মাণ কার্যে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। কর্ডোভা মসজিদ তাঁহার সময়েই শেষবারের মত সম্প্রসারিত হয়। ইহার পূর্ব অংশ ভাঙ্গিয়া আরো আটটি সারি (চক্র) যোগ করা হয়। দ্বিতীয় আবদুর রহমান ও দ্বিতীয় হাকামের সময় কর্ডোভা মসজিদে পরিবর্তন ও সংযোজন এবং মনসুরের সময় ইহার সিলিংকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হয়। সমসাময়িক কালের হিসাব অনুযায়ী কর্ডোভা নগরী ও উহার শহরতলীতে জনগণের ব্যবহারের জন্য ২,১৩,০৭৭টি গৃহ খলিফা, অভিজাত সম্প্রদায়ের বসবাসের জন্য এবং মসজিদ হাসপাতাল ও সেনানিবাসসহ ৬০,৩০০টি অট্টালিকা ও ৮০,৪৫৫টি দোকানঘর ছিল। কর্ডোভা নগরীতে বসবাসকারী নাগরিকের সংখ্যা ছিল দশ লক্ষাধিক। কর্ডোভার অধিবাসীদের মধ্যে ছিল আরব, বার্বার নব মুসলিম, খ্রীস্টান ও ইহুদী।
জাহরার দূরত্বের জন্য এবং কর্ডোভার নিরাপত্তা হীনতার দরুন আবু আমীর ৩৬৮হিঃ/৯৭৮ খ্রীঃ মদিনাতুল জাহিরা নামে কর্ডোভার পূর্বপ্রান্তে জাকজমকপূর্ণ ও সুরক্ষিত এক নতুন নগরী গড়িয়া তোলেন। টাকশাল স্থানান্তরিত হয় হিশামের রাজপ্রাসাদ হইতে মদিনাতুল জাহিরাতে। রাষ্ট্রদূতদের অভ্যর্থনা জ্ঞাপন ও রাজ সভাসদদের অধিবেশনও সেখানে অনুষ্ঠিত হইত।
আল-মনসুরের রাজত্বকালে স্পেন উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। আন্তর্জাতিক শক্তিরূপে কর্ডোভা সারা খ্রীস্টান জগতে ঈর্ষার বস্তুতে পরিণত হয়। গ্যান্ডার
শেইমের জার্মান সন্ন্যাসিনী হরৎসভিথা (মৃঃ ১০০২ খ্রীঃ) খ্রীস্টান ধর্মান্ধ জনৈক নিলাগিয়াসের সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেন। দ্বিতীয় আবদুর রহমানের রাজত্বকালে এই খ্রস্টান ধর্মান্ধ নিহত হন। এই গ্রন্থে লেখক কর্ডোভার প্রশংসায় বলেন যে, পশ্চিম গোলার্ধে কর্ডোভা এক উজ্জ্বল নগরী, যুদ্ধে অপরাজেয়, সুমার্জিত সংস্কৃতির ধারক, স্পেনীয়রা যাহার উত্তরাধিকারী, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ও সম্পদের জন্য বিখ্যাত।১৬
হাজীব আল-মনসুর স্পেনৈ আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধন করেন। বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার উন্নতিকল্পে তিনি সাহায্য করেন। বিদেশ হইতে বহু খ্যাতনামা পণ্ডিতব্যক্তি তাঁহার রাজধানীতে আগমন করেন এবং মনসুর স্বয়ং তাহাদের আলোচনায় শরিক হইতেন ও তাহাদিগকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন। অভিযান পরিচালনার সময় দেশের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও কবিগণ তাহার সহিত গমন করিতেন। প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, ক্যাটালোনিয়া অভিযানকালে একচল্লিশ জন সুশিক্ষিত কবি ও ঐতিহাসিক তাঁহার সহিত ছিলেন। বাগদাদের সুপ্রসিদ্ধ ও বিশিষ্ট কবি আবুল আলা সাঈদ বিন আল হাসান ছিলেন তাহাদের অন্যতম। তিনি ভাষাতত্ত্বের সমালোচনা ও টীকা, পৌরাণিক কাহিনী, কবিতা এবং প্রবাদবাক্য প্রভৃতি বিষয়ে আরবী সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেন।
জ্যোতির্বিদ্যা ও অংকশাস্ত্রকে মনসুর জনপ্রিয় করিয়া তোলেন। তিনি ফলিত জ্যোতিষ শাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ফলিত জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্কে শিক্ষাদান করিতেন আবুল কাসিম মাসলামাহ আল মাজরিতি (মৃত্যু : ১০০৪-৭)। খাওয়ারাজিমের ৭ জিজের তিনি সংস্কার ও সংশোধন করেন। উস্তৃরলাব (এস্ট্রোল্যাব-astrolab) এবং খাওয়ারাজিমের ট্যাবলের (নকশা) সংক্ষিপ্তসার প্রণয়ন ও বাণিজ্যিক অঙ্ক সম্পর্কে পুস্তক রচনা করেন। তিনি পেটের রোগ ও জোলাপ (Omitive ও Laxative) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত সার ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর অপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। মনসুরের প্রাসাদের চিকিৎসকদের খ্যাতি সারা ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়াইয়া পড়ে। তাঁহার রাজত্বকালে স্নাভরাও রাজ্যের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় অংশ গ্রহণ করে। তাহাদের মধ্যে ফাতিন, হাবিব ও ইবনে জলজল পাণ্ডিত্যের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিলেন। পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে মনসুর দ্বিতীয় হাকামের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাঁহার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইল বাগদাদের সাঈদ কর্তৃক বিরচিত আলফুসুস’। মনসুরের নিকট হইতে এই গ্রন্থের পারিতোষিক হিসাবে তিনি ১০০০ দিনার গ্রহণ করেন। অপর একখানি বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন হাসান ইবনে আবি আবদুল্লাহ। আবুল ওয়ালিদ ইবনে মামার নামক বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদ (Paleaographist) কে পাণ্ডুলিপি মিলাইবার জন্য (Collate) মনসুর ও তাহার উত্তরাধিকারীদের লাইবেরিতে সংরক্ষণের জন্য নিয়োগ করেন। আমীরের
পারিবারিক ইতিহাস রচনার দায়িত্ব তাহার উপর অর্পণ করেন। হুসাইন ইবনে আসিম ১১শত শতাব্দীর বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবি আমীর সম্পর্কে কিতাবুল মাসিরিল আমীরিয়া’ নামে একখানা ইতিহাস রচনা করেন। হাজীব আল-মনসুর আলেমদের দ্বারা প্রভাবিত হইয়া দর্শন সম্পর্কে লিখিত আলহাকামের লাইব্রেরির অসংখ্য গ্রন্থ জ্বালাইয়া দেন। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা টলেডোর সাঈদ কর্তৃক বিবৃত হইয়াছে।
ধর্ম শাস্ত্রের পণ্ডিতদিগকে সন্তুষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে আল-মনসুর তাঁহার শাসনের প্রথম দিকে মুক্তচিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করিতেন কিন্তু শেষের দিকে তাহাদিগকে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। মনসুর দার্শনিক মতবাদের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কাসিম বিন মুহাম্মদ যাম্বুসির মৃত্যুদণ্ড রহিত করেন। তিনি ছিলেন উদার মনোভাবাপন্ন। খ্রীস্টান ও মুসলমানদের বিবাহে তিনি উৎসাহ প্রদান করিতেন এবং নিজে নাভাররের রাজা তৃতীয় সাঞ্চোর কন্যাকে বিবাহ করিয়া দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁহার সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য খ্রীস্টান হওয়ায় তিনি রবিবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করেন।
এই মহান শাসকের প্রতিভার ছাপ তাহার ছোট বড় সমস্ত কাজ-কর্মে প্রতিফলিত হয়। তিনি সাধারণত তাহার পরামর্শ পরিষদের মতামত জানিতে চাহিতেন। কিন্তু নির্বিচারে উহা গ্রহণ করিতেন না। তিনি যে পন্থায় ক্ষমতায় আসেন উহা সমর্থনযোগ্য নহে বটে। কিন্তু ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, এই ক্ষমতা লাভের পর তিনি ইহা সততা ও সফলতার সহিত ব্যবহার করিয়াছিলেন। মনসুর ছিলেন উদারচেতা, দানশীল ও সুবিচারক। তিনি গরীব ও দুঃখীদের জন্য মুক্ত হস্তে দান করিতেন এবং অত্যাচারীকে ভৎসনা ও কঠোর হস্তে দমন করিতেন। সাধারণ প্রজার প্রতি অবিচার ও জনৈক ব্যবসায়ীর সহিত দুর্ব্যবহারের জন্য বর্মধারী বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ মেজর ডেমোকে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। সুবিচার করিতে ব্যর্থ বিচারকদের অপসারণ ও প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মচারীকে তিনি বিতাড়িত করেন। সুবিচারের প্রতি তাঁহার একনিষ্ঠতা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়। মনসুর নিজে জনগণের সেবা ও ত্রাণমূলক কার্যে অংশ গ্রহণ করিতেন। মনসুরের রাজকীয় খাদ্য গুদামে ৩৭৪হিঃ/৮৮৪-৫ খ্রীঃ ২,০০,০০০ মুদ্দস গম মওজুদ ছিল যাহার জন্য তিনি গর্ব অনুভব করিতেন। ৩৭৮ হিঃ/৯৮৮-৯ খ্রীস্টাব্দের দুর্ভিক্ষে জনগণকে রিলিফ হিসাবে প্রদান করিয়া উক্ত খাদ্য গুদাম শূন্য করিয়া ফেলেন। তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও কর্তব্য কর্মের প্রতি একনিষ্ঠ, বন্ধুত্বে বিশ্বাসী ও ঘৃণাবিদ্বেষে অনাগ্রহী। রাজনীতিজ্ঞ হিসাবে তিনি পথ প্রদর্শক ও সৈনিক হিসাবে তিনি ছিলেন তাঁহার যুগের অদ্বিতীয়। তিনি ক্ষমতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করেন। ক্ষমতার এই পর্যায়ে পৌঁছিতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, আবু মুসলিম খোরাসানী ও খালিদ বারমাকীর ন্যায় ব্যক্তিগণ সমর্থ হন নাই। ইহার কারণ হয়তো
তাঁহারা যে সমস্ত খলিফা ও শাসকের অধীনে কার্য সম্পাদন করিতেন তাহারা ছিলেন যোগ্য ও শক্তিশালী শাসক। রাজার পুত্র রাজা হইবে, রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে উঠিলে আমরা দেখিতে পাই যে, আল-মনসুর রাজপুত্র হিসাবে জন্ম গ্রহণ না করিলেও স্পেনের বহু মুসলিম রাজা হইতে অধিক যোগ্য শাসক ও কূটনীতিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে সক্ষম হন।
তথ্য নির্দেশ
১। ডজি, পৃঃ ৪৬৭. স্কট, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৬৬৭।
ডজি, ঐ পৃঃ ৪৬৭।
হাসিব আল-মনসুরের বংশধরেরা হিশামকে বন্দী করিয়া তাহার নামে রাজ্য শাসন করেন। ৪। মাক্কারী, (গায়ানগোস) ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৭৮। ৫। আল-মনসুর ছিলেন আব্দুল মালেকের অষ্টম অধঃস্তন বংশধর। ৬। ১০ম শতাব্দীতে ২০ দিনারে একটি পরিবার মণ্ডলে ১ বৎসর ভদ্রোচিতভাবে চলিতে পারিত।
৯৬০ খৃঃ এক পাউন্ড গমের মূল্য ছিল ২৪ দিরহাম (হোল, আন্দালুস, পৃঃ ৭১; আল-ডুরি, পৃঃ ২৪৬)। এই সময়ে মণ্ডল-এর চেয়ে স্পেনে খাওয়া-পড়ার জিনিস সস্তা ছিল, (von Kramar, ইবনে হাওকল, পৃঃ ১১৪)।
ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ৪৬১।
৮। ধ্বংসের এই বিভীষিকাময় চিত্র টলেডোর সাঈদ কর্তৃক আমাদের নিকট পৌঁছিয়াছে। লেভি প্রভেঙ্কাল, ল্যা সিভিলাইজেশন, পৃঃ ৮৮। ৯। লা ইস্পনা, পৃঃ ১৩৭-৩৮। ১০। হিস্ট্রি অব দ্যা আরবস, পৃঃ ৫৩২। ১১। লা ইস্পনা, পৃঃ ১৪৭-৪৮। ১২। গায়ানগোস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২১৮। ১৩। আ’মাল, পৃঃ ১১৯। ১৪। ম্যাককেব, মুরিশ স্পেন, পৃঃ ৬৩। ১৫। গুরুনেবাউম, মেডিয়াভ্যাল ইসলাম, পৃঃ ৫৭। ১৬। মেলিস-ভ্যালিচরোসা, হিট্রোরিয়া ডি লা সায়েন্সিয়া ইস্পানোলা, বার্সেলোনা, ১৯৪৯, পৃঃ ২৭-২৮। ১৭। প্যালেন্সিয়া, লিটারেচার, পৃঃ ২৮৯।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন