উপক্রমণিকা (মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাস)

উপক্রমণিকা

স্পেনের ভৌগোলিক অবস্থান

আইবেরিয়ান উপদ্বীপের তের ভাগের এগার ভাগ স্থান জুড়িয়া স্পেন অবস্থিত। ইহার আয়তন বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। চতুর্দিকে প্রাকৃতিক সীমানা দ্বারা পরিবেষ্টিত। চৌদ্দ মাইল প্রশস্ত জিব্রাল্টার প্রণালী উত্তর আফ্রিকা এবং তিনশত মাইল দীর্ঘ পীরেনীজ ফ্রান্স ও ইউরোপের অবশিষ্ট ভূ-খণ্ড হইতে ইহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে। ইহার পূর্বদিকে ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগর। ইহা আফ্রিকার সহিত ইউরোপ মহাদেশের যোগসূত্র রচনা করে এবং ভূমধ্যসাগরে নৌ-চলাচলের মাধ্যমে এশিয়া মহাদেশের সহিত সম্পর্ক বজায় রাখে। এইরূপে স্পেন তিনদিকের মহাদেশের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রচনার এক অনন্য ভূমিকা পালন করে।

আইবেরিয়ান উপদ্বীপের আটভাগের সাতভাগ ব্যাপিয়া আড়াই হাজার মাইল বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমা থাকা সত্ত্বেও মাত্র কয়েকটি পোতাশ্রয় রহিয়াছে। কারণ ইহার সুউচ্চ এবং খাজবিহীন উপকূল ভূমি পোতাশ্রয় উপযোগী নহে। ইহার উত্তর-পূর্ব উপকূলে যে সমস্ত বন্দর রহিয়াছে তাহা—তারাগোনা, ক্যাস্টেলোন ও ভ্যালেন্সিয়া এবং দক্ষিণ উপকূলবর্তী বন্দরসমূহের মধ্যে—আলমেরিয়া, মালাগা, আলজেসিরাস, তারিফা ও কেডিজ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। ইহার পশ্চিমে ডুরো ও তাস নদীর অববাহিকায় লিসবন এবং অপোর্টোর ন্যায় মনোরম পোতাশ্রয় রহিয়াছে। উত্তর-পশ্চিম গ্যালিসিয়ার অস্থায়ী উপকূল রেখা কোরুন্নার মত প্রসিদ্ধ বন্দর সৃষ্টিতে সহায়তা করিয়াছে।

মেসেতা বলিয়া খ্যাত মধ্য মালভূমি উপকূল হইতে বিচ্ছিন্ন উপদ্বীপের অর্ধেকের বেশি জায়গা জুড়িয়া অবস্থিত এবং উত্তর হইতে দক্ষিণে ও পূর্ব হইতে পশ্চিমে ইহা ক্রমশঃ ঢালু। পশ্চিমে ক্রমশঃ ঢালু হইয়া বহুদূর পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে এবং পূর্বদিকে সামান্য কিছুদূর অগ্রসর হইয়াই শেষ হইয়াছে। এমন কি পীরেনীজ (পর্বতমালা) হইতে গোয়াদালকুইভিরের যে ঢালু অঞ্চল রহিয়াছে তাহাও ক্রমানুগতিতে শেষ হইয়াছে। এই মালভূমির উত্তরে ক্যান্টা গিরিমালার ক্যান্টাব্র-আস্তুরীয়ান এলাকা হইতে দক্ষিণে সিয়েরা-মরেনা (মারিয়ানিকা রেঞ্জ) পর্যন্ত এবং পুনরায় পূর্বে আইবেরিয়ান পর্বতমালা ও ভ্যালেন্সিয়া উপসাগর হইতে পশ্চিমে ক্যান্টা-গ্যালেসীয়ান পর্বতমালা ডুরো নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ হইতে মেসেতা মালভূমির এই বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগে উচ্চতার গড় দু’ হাজার ফুট। এই মালভূমিকে মন্টেস দে-টলেডো উত্তর ও দক্ষিণ উপ-মেসেতায় বিভক্ত করিয়াছে। ইহা তাগুস নদীর অববাহিকা হইতে ডুরো নদীর অববাহিকাকেও বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে। মেসেতা মালভূমির শৈলশ্রেণী উত্তরে অবস্থিত

পীরেনীজ এবং দক্ষিণে সিরেরা-নেভেদা (পেনিবেথিকা রেঞ্জ) পর্বত হইতে নীচু। সিয়েরা-নেভেদার দক্ষিণে, জিব্রাল্টার ও আটলান্টিক উপকূলীয় অঞ্চল অবস্থিত। পীরেনীজে অতিঅল্প সংখ্যক গিরিপথ রহিয়াছে যেমন—রইসেস ভ্যালী, পেরতুস (সুইনামো-পিরেনো), ভ্যালী দে-আরান এবং সমপোর্ট। এই গিরিপথগুলি ফ্রান্স ও স্পেনকে সংযুক্ত করিয়াছে। কিন্তু এই সমস্ত গিরিপথ বৎসরের ছয় মাস প্রায় তুষারাবৃত থাকে। মেসেতা সীমান্তের গিরিপথ এবং সমুদ্রোপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত নদীপথ ও উপত্যকাসমূহ অর্থাৎ ইবরো, গোয়াদালকুইভির এবং ইহার উপনদী মাগানা ও জালোনের জলপ্রবাহ গোটাদেশের ইতিহাসকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করিয়াছে। সিয়েরা দেওয়াদারমা-র গিরিসঙ্কট সমূহ (কার্পেটো-ভেতমিকা) উপ-মেসেতার (প্রাচীন ক্যাস্টাইল ও নতুন ক্যাস্টাইল) মধ্যে সহজ গমনাগমনের সুযোগ সৃষ্টি করিয়াছে। পর্বত শব্দুল হওয়া সত্ত্বেও রোমান এবং আরব শাসনাধীনে যোগাযোগ ব্যবস্থায় খুবই উন্নতি সাধিত হইয়াছিল। ফলে দেশের প্রধান প্রধান শহর ও বন্দরের সহিত আইবেরিয়ান উপদ্বীপের সংযোগ সাধিত হইয়াছিল। রোমানদের তৈয়ারী ৩৪টি রাস্তা ৩৭২টি শহরের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করিয়াছিল। এই ৩৪টি রাস্তার সর্বমোট দৈর্ঘ্য ছিল ৬৯৫৫ রোমান লীগ।

পর্বত-সঙ্কুল হওয়ার জন্য স্পেনে অসংখ্য নদ-নদী থাকা সত্ত্বেও উহা নৌ পরিবহন ও সেচকার্যে কোন প্রকার সহায়তা করিতে পারে নাই। কারণ কঙ্করময় উপত্যকার মধ্যদিয়া নদীগুলি প্রবাহিত। এই সমস্ত নদ-নদী-যথেষ্ট পরিমাণে বৃষ্টির পানি ধারণ করিতে পারে বলিয়া দ্রুতগতিতে নীচে নামিয়া যায়। ফলে ভয়াবহ প্লাবনের সৃষ্টি হয়। তাগুস, ডুরো, গোয়াদিয়ানা এবং গোয়াদালকুইভির—এই চারিটি বৃহত্তর নদীর পানি উপদ্বীপের পশ্চিমাঞ্চল পেনিন সুলার বৃহত্তর অংশ ও ইবরো নদীর জল প্রবাহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশের সেচ প্রয়োজন মিটাইত। মেসেতা মালভূমির পর্বতমালা হইতে যে সমস্ত নদী প্রবাহিত হইয়া ভূমধ্যসাগরে পতিত হইয়াছে উহা আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত নদীগুলির তুলনায় আকারে ছোট। এই সমস্ত নদীর মধ্যে তাগুসই সর্ববৃহৎ (৫৬৫ মিটার)। অন্যান্য নদীর মধ্যে দৈর্ঘ্যের ক্রমানুসারে উল্লেখযোগ্য হইতেছে গোয়াদিয়ানা, ডুরো, ইবরো, গোয়াদালকুইভির এবং মিনহো। এই সব নদীর নিম্নভাগই কেবল মাত্র নৌ-চলালের উপযোগী। লিসবন হইতে আরাম জুয়েজ পর্যন্ত ১১৯ মাইল দীর্ঘ তাগুস এবং সেভিল পর্যন্ত বিস্তৃত গোয়াদালকুইভির নদীর জলপথে নৌযান চলাচল করিয়া থাকে। মধ্যযুগেও গোয়াদালকুইভির হইতে কর্ডোভা পর্যন্ত নৌ চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। মেসেতা মালভূমির পূর্বপ্রান্তের নদী-বাহিত পলিমাটি উপকূলীয় অঞ্চলকে উর্বরা শক্তি দান করিত এবং গ্রীষ্মকালে পূর্ব স্পেনকে প্রাবিত করিয়া উহার উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি করিত। ইহার ফলে প্রচুর ফলমূল ও শস্যাদি উৎপাদনে স্পেন সমৃদ্ধশালী হইয়া উঠিত।

আন্দালুসীয়ার সমৃদ্ধশালী উপত্যকা স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলের মেসেতা মালভূমি হইতে গোয়াদালকুইভির নদী-বাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত। ইহার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নদী ইবরো নৌচলাচল উপযোগী না হইলেও পূর্ব-পীরেনীজ এবং সিয়েরা দেলমোনকাইও-র মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভূভাগ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাকে প্লাবিত করিত।

স্পেনের আবহাওয়া

স্পেনের আবহাওয়া শীতকালে মৃদু ও আর্দ্র এবং গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও শুষ্ক থাকে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আবাহওয়া মোটামুটি নাতিশীতোষ্ণ বলা যাইতে পারে। উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া অত্যধিক ঠাণ্ডা। গ্যালেসিয়া ও ক্যান্টাব্রিয়া অঞ্চলে অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হইয়া থাকে। অথচ বৃষ্টিহীনতার দরুন মেসেতা শীতকালে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। ক্যাস্টাইল এবং লা মাঞ্চার উচ্চ মালভূমি অঞ্চল অতিশয় শুষ্ক ও চাষাবাদের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। এই উপদ্বীপের প্রায় অর্ধাংশ অনুর্বর পর্বত ও গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ এবং সমগ্র এলাকার দুই পঞ্চমাংশের কিছু কম জায়গা কৃষি কার্যের উপযোগী। জলবায়ু-সৃষ্ট প্রতিকূল অসুবিধাগুলির মোকাবেলা করিবার জন্য উপদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান কতকগুলি বিশেষ সুবিধাও সৃষ্টি করিয়াছে। উপদ্বীপের সমগ্র পার্বত্য এলাকা বনজ ও খনিজসম্পদ যথা—স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ, এবং শিল্পে ব্যবহৃত অন্যান্য ধাতব সম্পদে পরিপূর্ণ। পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূলের সমতল ভূমি খুবই উর্বর। এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গম, ধান, জলপাই, আঙ্গুর, কমলালেবু, ইক্ষু এবং বিভিন্ন ধরনের ফল, খাদ্যশস্য ও শাকসজী উৎপন্ন হইয়া থাকে। দেশের উত্তর উপকূলীয় ভূ-ভাগ কৃষি সম্পদে সম্পদশালী না হইলেও গোচারণ ভূমি রূপে ইহা অতিশয় সমৃদ্ধ।

উপদ্বীপের বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক অবস্থান উত্তর-আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনায় সাহায্য করিয়াছে। ইহা হইতেই স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কিভাবে আদিম আঞ্চলিক অধিবাসীরা রাজনৈতিক সংহতি সত্ত্বেও তাহাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে বজায় রাখিতে সক্ষম হইয়াছিল। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের ফলশ্রুতি হিসাবেই উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চল পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল এবং ইহার অধিবাসীরা নিজ নিজ বর্ণবৈশিষ্ট্য, রক্ষণশীল আচার আচরণ বজায় রাখিতে সক্ষম হইয়াছিল। তাহাদের এই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসমূহ সমগ্র স্পেনীয় সভ্যতায় প্রাণ সঞ্চারক শক্তি হিসাবে কাজ করে। অপরদিকে উপদ্বীপ হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিবার ফলে রাইল ক্যাস্টাইল বহু শতাব্দী ধরিয়া সকল বিষয়েই পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত থাকে। উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল বহিরাক্রমণের ভূমিতে পরিণত হইবার ফলে বিদেশী প্রভাবে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।

উপদ্বীপের অধিবাসীগণ রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সহজ শিকারে পরিণত হয়। রোমানদের শাসন আমলে উপদ্বীপটি বেশ ঘনবসতিপূর্ণ ছিল। কিন্তু ভ্যাণ্ডাল বার্বারীয়ান এবং গথদের শাসনকালে এই অঞ্চলের লোকসংখ্যা বিশেষভাবে হ্রাস পায়। ইহার

অধিবাসীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী, ধনী শ্রেণী, ইহুদী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক নৃশংসভাবে নিহত ও দেশ হইতে বহিষ্কৃত হয়। সীমান্তের দুইটি অঞ্চল ব্যতীত মুসলমানদের আগমনের ফলে সারা দেশে পুনরায় লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সুখ-শান্তি ও ঐশ্বর্য ফিরিয়া আসে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশ ছিল মুসলমান এবং উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল খ্রীস্টান। খ্রীস্টানদের পুনরাধিকারের ফলে মুসলমান ও ইহুদীগণ দেশ হইতে বিতাড়িত হয়। মুসলমান ও ইহুদী বিতাড়নের ফলে দেশের অধিকাংশ জনপদ বসতিশূন্য এবং বহু শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। দশম শতাব্দীর কর্ডোভা বর্তমান কর্ডোভা হইতে আকারে বহুলাংশে বৃহৎ ছিল। দশম শতাব্দীতে কর্ডোভার জনসংখ্যা ছিল দশ লক্ষের মত কিন্তু বর্তমানে উহা কমিয়া এক লক্ষেরও নীচে নামিয়া আসিয়াছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে গ্রানাডার লোকসংখ্যা ছিল চারি লক্ষের মত, বর্তমানে উহা হ্রাস পাইয়া মাত্র একলক্ষ সতের হাজারে দাঁড়াইয়াছে।

আন্দালুসীয়ার ভৌগোলিক অবস্থান দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করিয়াছে। ইহার ভৌগোলিক অবস্থিতি আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে পূর্ব-পশ্চিম এবং আটলান্টিক ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে। ইহা এই অঞ্চলের জল ও স্থলপথের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। স্পেনের মত অপর কোন দেশের আবহাওয়া এত বৈচিত্র্যপূর্ণ নয় এবং ভূমিও এত উর্বরা শক্তিসম্পন্ন নয়। ফলে দেশের এক অঞ্চলের অধিবাসী হইতে অন্য অঞ্চলের অধিবাসী আচার আচরণ ও চরিত্রে ভিন্নতর। মেসেতার উচ্চ মালভূমি এবং ভূমির অসমতা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে জটিল করিয়া তুলিয়াছে। স্পেনের এই ভৌগোলিক অবস্থিতির দরুন বিশেষ করিয়া মধ্যযুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতার কারণে এলাকার অধিবাসীদের মধ্যে কেন্দ্রবিমুখতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার সৃষ্টি হয়। শক্তিশালী শাসক ও প্রবল সামরিক শক্তি ব্যতীত সমগ্র দেশের উপর একাধিপত্য বজায় রাখা খুবই দুরূহ ছিল। কারণ দেখা গিয়াছে যখনই কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে তখনই উচ্চাভিলাসী আঞ্চলিক শাসক ও গোত্রপ্রধানগণ ভৌগোলিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার জটিলতার সুযোগ লইয়া আপন আপন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছে এবং স্বাধীন শাসকরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করিবার প্রয়াস পাইয়াছে। দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যে আকৃষ্ট হইয়া বিদেশীরা বারবার এই দেশ আক্রমণ করিয়াছে। বিভিন্ন এলাকার শাসকদের কেন্দ্রবিমুখতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা বিদেশী শক্তিকে এদেশ সহজে জয় করিতে সাহায্য করিয়াছে।

ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ

স্পেনীয় আরবরা ইতিহাস, ভূগোল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর মূল্যবান গ্রন্থ রচনার জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। মুসলিম শাসকদের অনেকে বিখ্যাত ও দুর্লভ রচনাবলী সংগ্রহের জন্য পণ্ডিত ব্যক্তিদিগকে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত এবং বিদ্যোৎসাহী পণ্ডিতদিগকে পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন। স্বাধীন নর-নারী, ও ক্রীতদাস সকলেরই জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান ছিল। গ্রন্থাবলী সংগ্রহ করিয়া নিজস্ব গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার প্রতি স্পেনীয় মুসলমানদের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, তাহাদের সংগৃহীত অধিকাংশ মূল্যবান গ্রন্থই কালের করাল গ্রাসে বিলীন হইয়া গিয়াছে। গ্রানাডা পতনের মাত্র সাত বৎসর পর ১৪৯৯ খ্রীস্টাব্দে কার্ডিনাল জিমেনেজ প্রায় আট হাজার আরবী গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির ধ্বংস সাধন করে। ফলে স্পেনের মুসলিম মনীষীদের লিখিত গ্রন্থের দুষ্প্রাপ্যতা একান্ত প্রকট হইয়া ওঠে। প্রফেসর নিকলসন মন্তব্য করেন যে, কার্ডিনাল জিমেনেজ মাত্র একদিনে সাত/আট শত বৎসরে গড়িয়া ওঠা মুসলিম সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করিবার জন্য ইচ্ছা পোষণ করিয়াছিলেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত মূল্যবান গ্রন্থগুলির মধ্যে আল-রাজী ও ইবনে হাইয়ানের গ্রন্থগুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দীতে কার্ডোভার অধিবাসী আহমদ বিন মুহম্মদ আল-রাজী আখবারুল মুলুকুল উন্দুলুস’ নামে স্পেনে মুসলিম শাসনের উপর একখানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থখানি পরবর্তীকালের ইতিহাসবেত্তাদের জন্য গবেষণার উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছিল। অল্প সংখ্যক আরবী গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি যাহা এই ধ্বংসলীলার কবল হইতে রক্ষা পায় তাহা হয় পাদ্রীদের অধিকারে যায় অথবা কোন গ্রন্থাগারে অরক্ষিত অবস্থায় থাকে। এই সমস্ত আরবী গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পরবর্তীকালে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৬-৯৮খ্রীঃ) ও তৃতীয় ফিলিপ সংগ্রহ করিয়া মাদ্রিদের সন্নিকটে এস্কোরিয়ালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর তৃতীয়াংশ পর্যন্ত এই গ্রন্থগুলি অযত্নে ও অবহেলিত অবস্থায় থাকে। ১৬৭১ খ্রীস্টাব্দে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এস্কোরিয়াল গ্রন্থাগারে রক্ষিত মূল্যবান পাণ্ডুলিপিগুলির তিন চতুর্থাংশ ভস্মীভূত হয়। এই অপূরণীয় ক্ষতির ফলে স্পেন সরকার মহা মূল্যবান গ্রন্থ সম্পদের গুরুত্ব মর্মে মর্মে অনুধাবন করেন। ফলে সরকার দেশবাসীকে আরবী সাহিত্য ও বিজ্ঞান-চর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন। ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষাপ্রাপ্ত ১৮৫০ খানা পাণ্ডুলিপির একটা বর্ণনামূলক ক্যাটালগ (বিবলিওথিকা এরাবিকো হিস্পানা এস্কোরিয়া লেনসিস) কাসিরী প্রণয়ন করেন। ফরাসী ভাষায় ইহার বিশেষ বিশেষ অংশের অনুবাদ ১৭৬০-৭০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। অনেক আরবী গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি মাদ্রিদের জাতীয় গ্রন্থাগারে, রাজকীয় একাডেমীর ইতিহাস গ্রন্থাগারে, মাদ্রিদ ও গ্রানাডার আরবী প্রতিষ্ঠান সমূহের গ্রন্থাগারে এবং জেনারেল ফ্রাঙ্ক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তিতুয়ানের (মরক্কো) গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে। এই সমস্ত গ্রন্থাগারে রক্ষিত বহু পাণ্ডুলিপি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। কিন্তু ধর্ম সংক্রান্ত আরবী পাণ্ডুলিপিগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের কোন ব্যবস্থাই করা হয় নাই।

আরবদের লিখিত গ্রন্থসমূহে প্রচুর ঐতিহাসিক বিবরণী বিদ্যমান। কিন্তু সমসাময়িক কালে ইউরোপীয় ভাষায় রচিত গ্রন্থে স্পেনে মুসলিম শাসন আমলে যে সমস্ত ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন সাধিত হইয়াছিল তাহার কোন উল্লেখ পাওয়া যায়।

পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া লিখিত ইউরোপীয় গ্রন্থকারদের রচনায় মুসলিম মনীষীদের মূল্যবান সাহিত্য অবদান সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সেই সময়কার স্পেনীয় লেখকদের মধ্যে ইসিডোরাস-প্যাসেন্সিস, মুংক সেবাস্তিয়ান, মুংক ভিজিলা ও স্যাম্পিরোর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

নিম্নে ধ্বংসের কবল হইতে রক্ষাপ্রাপ্ত মূল্যবান আরবী গ্রন্থসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল।

‘তারিখ-ই-ফতেতাহুল আন্দালুস’—ইবনুল কুতীয়া (মৃঃ ৩৬৭/৯৭৭) নামক স্পেনের একজন নওমুসলিম পণ্ডিত কর্তৃক গ্রন্থখানি রচিত। তিনি খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দীতে কর্ডোভাতে বসবাস করিতেন এবং সেখানেই জ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত থাকেন। এই গ্রন্থে তৃতীয় আবদুর রহমানের শাসনামলের প্রথম ভাগ পর্যন্ত স্পেনে মুসলিম শাসনের ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে মাদ্রিদে ‘হিস্টরীয়া দে-লা কংকয়েস্তা দে- এম্পানীয়া’ নামে ডন জুলিয়ান রিবেরা গ্রন্থখানিকে সম্পাদনা ও স্পেনীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। গ্রন্থকার তাঁহার রচনায় আগাগোড়াই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দান করিয়াছেন। মধ্য যুগের স্পেনের মুসলমান ও খ্রীস্টান লেখকদের মধ্যে তিনিই সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। তিনি পিতার দিক দিয়া আরব ও মাতার দিক দিয়া ছিলেন গথ। ফলে তিনি সব সময়েই উভয় সম্প্রদায়ের মতবাদের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করিয়াছেন। তাঁহার পিতা ইসা বিন মুজাহিম ছিলেন খলিফা আবদুল আজিজ কর্তৃক মুক্ত উমাইয়া বংশের একজন স্বাধীন মানুষ। তাহার মাতা সাবাহ ছিলেন গথরাজ উইতিজার পৌত্রী।

ইবন আবদুল হাকাম বিরচিত ‘তারিখ ফাতহুল মিসর’ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ের সমাপ্তি পর্বে স্পেন বিজয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে। ১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দে ডঃ জন হারেস জনস্ গোটিনজেনে ইংরেজী অনুবাদসহ গ্রন্থখানি প্রকাশ করেন। ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে ভারতের হায়দারাবাদে জামিলুর রহমান কর্তৃক এই আরবী গ্রন্থখানির উর্দু অনুবাদ ‘যিকরে ফাতহে উন্দুলুস’ নামে প্রকাশিত হয়।

ইবনুল আহমার (মৃঃ ৩৫৮/৯৬০ খৃঃ) তাঁহার রচিত “উনান্দিকা এ্যাননিমা দে আবদুর রহমান (তৃতীয়) আল নাসির’ গ্রন্থে খলীফা নাসিরের জীবনী এবং তাঁহার অবদান ও কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করিয়াছেন। ইহা লেভি প্রভেঙ্কাল ও ই, গার্সিয়া গোমেজ কর্তৃক সম্পাদিত ও স্পেনীয় ভাষায় অনূদিত হইয়া ১৯৫০ খ্রীঃ মাদ্রিদ-গ্রানাডা হইতে প্রকাশিত হয়। নাম পরিচয়হীন লেখক কর্তৃক রচিত আখবার মাজমুয়া’ গ্রন্থখানি ই-লা ফুরেন্তা ই-আলকান্তারার সম্পাদনায় স্পেনীয় ভাষায় অনূদিত হইয়া ১৮৬৭ খ্রীঃ মাদ্রিদে প্রকাশিত

হয়। মধ্যযুগের উপকথার প্রভাব মুক্ত এই গ্রন্থখানিতে তৃতীয় আবদুর রহমানের রাজত্বকাল পর্যন্ত স্পেনে মুসলিম শাসনের বাস্তব বর্ণনা বিস্তারিত ভাবে প্রদত্ত হইয়াছে।

প্রখ্যাত স্পেনীয় ঐতিহাসিক আবু মারওয়ান হাইয়ান ইবনে খালাফ ইবনে হাইয়ান (৯৮৮-১০৭৬ খ্রীঃ) আল মুকতাবিস ফি তারিখে রিজালুল আন্দালুস’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। তাহার রচিত প্রায় পঞ্চাশখানি মূল্যবান গ্রন্থের অতি অল্পসংখ্যক গ্রন্থই সংরক্ষিত হইয়াছে এবং উল্লিখিত ঐতিহাসিক গ্রন্থখানিরও অতি সামান্য অংশই আমাদের গোচরীভূত হইয়াছে। দশ খণ্ডে সমাপ্ত এই বিরাট গ্রন্থখানির তৃতীয় খণ্ডে আমীর আবদুল্লাহ বিন মুহম্মদের শাসনকাল আলোচিত হইয়াছে। ইহা বিখ্যাত বড়লিয়ান গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রহিয়াছে। ১৯৩২-৩৭ খ্রীস্টাব্দে প্যারিসে ম্যাচিওর এম. আন্তনা ‘টেক্সটেজ এরাবেস রিলেটিকস আল হিস্তোয়ায়ের ডেল অক্সিডেন্ট’ নামে ইহার সম্পাদনা করেন। কনস্টান্টিনোপলে প্রাপ্ত ইহার অপর এক খণ্ডে দ্বিতীয় আল হাকামের শাসনকালের আংশিক আলোচনা রহিয়াছে। মাদ্রিদের রয়েল একাডেমী গ্রন্থাগারে এই উভয় খণ্ডেরই পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গৃহীত হইয়াছে। মুহম্মদ ইবনে আবি নাসরে ফতুহ যাজুয়াতুল মুকতাবিস’ নামে আল মুকতাবিস গ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার রচনা করেন। উহা বড়লিয়ান গ্রন্থাগারে (পাণ্ডুলিপি নং হান্ট ৪৬৪) সংরক্ষিত রহিয়াছে। দশ খণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থে স্পেনের বিখ্যাত মুসলিম মনীষীদের জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে।

১২২৪ খ্রীস্টাব্দে আবদুল ওয়াহাব ইবনে আলী আল-তামিমী আল-মারাকুশী মুযাহিদ শাসনের উপর একখানি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থখানির নাম আল মুজিব ফি তালখিসে আখবার আল মাগরিব’। ই. ফাপ্পান ফরাসী ভাষায় ‘হিস্তোয়ায়ের দেস আল মুহাদেস’ (আলজিয়ার্স ১৮৯৩) নামে গ্রন্থখানি অনুবাদ করেন এবং আর, ডজি ইহা সম্পাদনা করেন। ১৮৪৭ খ্রীস্টাব্দে আবদুল ওয়াহিদ আল মারাকুশী ‘হিস্টরী অব আলমোহেদস’ নামে লন্ডন হইতে ইহার ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেন। ইহাতে মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের সময় হইতে মুরাবিতিন শাসক ইউসুফ ইবনে তাশফিনের শাসনকাল পর্যন্ত স্পেনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে মুহম্মদ নইমুর রহমান মাদ্রাজ হইতে ইহার উর্দু অনুবাদ প্রকাশ করেন।

খ্রস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মারাকুশের ইবনে ইজারী তাঁহার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-বায়ানুল মাগরিব ফি আখবারিল আন্দালুস ওয়াল মাগরিব’ রচনা করেন। গ্রন্থকার ঘটনাবলীর বিস্তারিত পর্যালোচনা না করিয়া জায়গা বিশেষে অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করিতে যাইয়া অতিশয়োক্তির অবতারণা করিয়াছেন। এই গ্রন্থের তিন খণ্ড সংরক্ষিত আছে বলিয়া জানা যায়। ইহার দুই খণ্ডে স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। প্রথম খণ্ডে স্পেনের মুসলিম বিজয়ের পর হইতে হাজিব আল-মনসুরের রাজত্বকাল এবং দ্বিতীয় খণ্ডে উমাইয়া শাসকদের পতন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসকদের

ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। ১৮৪৮ খ্রীস্টাব্দ হইতে ১৮৫১ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে লিডেন ‘হিস্তোয়ের দেল-আফরিক এট দেল এস্পগ্ন ইনটিটুলি আল বায়ানুল মাগরিব’ প্রথম নামে ডজি প্রথম খণ্ডের সম্পাদনা করেন। এবং ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে প্যারিসে টেক্সটেস এরাবেস রিলেটিকস আল হিস্তোয়ের দেল-অক্সিডেন্ট মুসলমান’ দ্বিতীয় নামে ই লেভি প্রভেঙ্কাল ইহার দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদনা করেন। খ্রীস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রগতিশীল লেখক ইবনে সাহেব আল সালাত মুরাবিতিন ও মুয়াহিদিন শাসনের উপর অপর একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। ইহার দ্বিতীয় খণ্ডে ৫৫৪-৫৬৮ হিঃ/ ১১৫৯-৭৩ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে স্পেনে সংঘটিত ঘটনাবলীর বিস্তারিত আলোচনা রহিয়াছে। ইহা বড়লিয়ান গ্রন্থাগারে (পাণ্ডুলিপি নং মার্স ৪৩৩) রক্ষিত আছে। গ্রন্থটির অন্যান্য খণ্ডের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইয়াছে। মুয়াহিদুন (মাহদী-খলিফা আবদুল মুমিন) আন্দোলনের উপর রচিত তিন খণ্ডে বিভক্ত গ্রন্থখানি কাসিরি তালিকাভুক্ত করেন নাই। ডকুমেন্টস ইন এডিটস্ দ্য হিস্তোয়ের আলমুহেদ’ নামে প্যারিসে ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে লেভি প্রভেঙ্কালের সম্পাদনায় ইহার ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ইহা সমসাময়িক কালের একখানি তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ। ইহার তৃতীয় খণ্ডে খলিফা আবদুল মুমিনের শাসনামলের পর হইতে মুয়াহিদিন রাজত্বকালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। গ্রন্থকার ব্যতীত অন্য কেহ ইহার সমাপ্তিপর্ব রচনা করেন। ১৩১৩-১৩৭৪ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবু আবদুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে সাইদ আল-সালমানী লিসানুদ্দীন ইবনুল খাতিব” এই ছদ্ম নামে গ্রানাডার প্রখ্যাত মনীষীদের জীবন কথা এবং গ্রানাডার শাসকদের বিস্তারিত ইতিহাস সম্বলিত গ্রন্থ আল ইহাতা ফি তারিখে গারনাতা’ রচনা করেন। নাসরীয় শাসক ইউসুফ আল হাজ্জাজ ও পঞ্চম মুহম্মদের শাসনকালে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁহার সংরক্ষিত বিশটি গ্রন্থের মধ্যে ইহা অন্যতম। এই গ্রন্থের একটি দুম্পাপ্য ও মূল্যবান অংশ মারকাজুল ইহাতা বি-উদাবা গারনাতা’ নামে প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে (পা: নং ৮৬৭) সংরক্ষিত রহিয়াছে। ১৩১৯ হিঃ/১৯০১ খ্রীস্টাব্দে কায়রোতে ইহার দুইটি খণ্ড প্রকাশিত হয়। তিউনিসিয়ার সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্র নীতিবিদ—আবদুর রহমান ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রী): ‘কিতাবুল ইবার ওয়া দিওয়ানুল মুবতাদা ওয়াল খাবার ফি আইয়ামিল আরব ওয়াল আজম ওয়াল বারবারা’ গ্রন্থটি রচনা করেন। স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকার ইতিহাসে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং গ্রানাডার নাসরীয় শাসক ষষ্ঠ মুহম্মদের অধীনে দুই বৎসর চাকুরী করেন। একটি মুখবন্ধসহ গ্রন্থখানি তিনটি অংশে বিভক্ত। ১২৮৪ খ্রীস্টাব্দে কায়রোতে ইহা সাত খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এই মূল্যবান গ্রন্থের চল্লিশ পৃষ্ঠা ব্যাপী স্পেনে মুসলিম শাসনের ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। ইবনুল খাতিব ও ইবনে

খালদুন রচিত দুইখানি গ্রন্থই নাসরীয় শাসন কালের ইতিহাস। নাসরীয় শাসনের শেষ শতাব্দীর কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। ইবনুল আছির ও আল-নুয়াইরীর মত ঐতিহাসিক ও বিশ্বকোষ রচয়িতারা তাঁহাদের রচিত গ্রন্থ আল কামিল’ ও ‘নিহায়েতুল আরবে’ স্পেনের প্রাচীন ইতিহাসের প্রতি আলোকপাত করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন।

স্পেনে মুসলিম শাসনের সম্পূর্ণ ইতিহাস সম্বলিত গ্রন্থ নাফহুত্তিব মিন গুসনুল আন্দালুস আল-রাতিব ওয়া যিকর ওয়াজির লিসানুদ্দীন ইবনুস খাতিবের ইতিহাস সংকলক, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত লেখক তিলিসমানের (আলজিয়ার্স) অধিবাসী আহমদ ইবনে মুহম্মদ আল মাক্বারী আলমাগরিবী ‘আজহারুর রিয়াদ ফি আখবারে জিয়াদ’ গ্রন্থখানি রচনা করেন। মাক্কারী কর্তৃক ১৬২৮-১৬৩০ খ্রীঃ মধ্যে দামেস্কে নাফহুত্তিব’ গ্রন্থটি সংকলিত হয়। ইহাতে সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিষয়সমূহের বিস্তারিত বর্ণনা রহিয়াছে। মাক্কারী তাঁহার রচনায় বিজ্ঞান ভিত্তিক ইতিহাস রচনা অপেক্ষা সাহিত্যককুশলতার অধিক পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। তিনি তাহার রচনায় আপন অভিমত ব্যক্ত না করিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁহার পূর্বসূরিদের রচনার উদ্ধৃতি দান করিয়াছেন। এই সমস্ত দীর্ঘ ও অপ্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি ও কবিতার ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে রচনার মূল বিষয়বস্তুকে দুর্বোধ্য করিয়া তুলিয়াছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল উদ্ধৃতি এবং মূল গ্রন্থে যাহা নাই তাহারও উল্লেখ করিয়াছেন। ইহার কারণ হয়ত এই যে, তিনি তিলিসমানে বসিয়া মূল গ্রন্থখানি পাঠ করিয়াছিলেন এবং সিরিয়ায় যখন প্রবাস জীবন যাপন করেন সেই সময় তিনি ইহা সংকলন করেন। অথবা তিলিসমানে গ্রন্থটির জন্য তিনি যে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেন সিরিয়ায় যাইবার সময় তাহা তিনি সঙ্গে লইতে পারেন নাই। এইসব ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও গ্রন্থখানির বিশেষ গুরুত্ব রহিয়াছে। ইহাতে স্পেনের মুসলিম শাসনের রাজনৈতিক ইতিহাস ও প্রশাসনিক পদ্ধতির পরিপূর্ণ চিত্র রহিয়াছে এবং এমন সমস্ত মূল্যবান ও দুর্লভ গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃতি রহিয়াছে বর্তমানে যাহার সন্ধান পাওয়া যায় না। গ্রন্থটির কোন কোন অধ্যায়ে স্পেনের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক বিবরণ এমনভাবে প্রদান করা হইয়াছে যাহা হইতে মধ্যযুগের স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থার নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। ইহা ব্যতীত গ্রন্থটির কোন কোন অধ্যায়ে স্পেনের মুসলিম শাসনের যে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় তাহা অন্য কোন মৌলিক গ্রন্থে পাওয়া যায় না। ১৮৪০ হইতে ১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে লন্ডনে ডন পাস্কল ও গাইয়ানগস ইহা ইংরাজী ভাষায় অনুবাদ করেন। অনূদিত গ্রন্থটির নামকরণ করা হয় ‘দি হিস্ট্রি অব দি মোহামেডান ডাইনাস্টিস ইন স্পেন।’ ইহাতে যে ভূমিকা ও টীকা-টিপ্পনী দেওয়া হইয়াছে তাহা খুবই মূল্যবান। উইলিয়াম রাইট গাইয়ানগসের ইংরাজী অনুবাদের তীব্র সমালোচনা করেন এবং নিজে ১৮৫৫ হইতে ১৮৬১ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ডজি ও গুস্তাভে ডুকাটের সহযোগিতায় লেডেনে ‘এনালেকটেস সুর লা ছিস্তোয়ের এট-লা-লিটারেচার দেস এরাবেস দ্য এসিগ্ন’ নামে নাফহুত্তিবের মূল আরবী গ্রন্থটি সম্পাদনা করেন।

১২৭৯ হিজরীতে বুলাকে (কায়রো) সপ্ত খণ্ডে ইহা প্রকাশিত হয়। ডজি এবং উইলিয়াম রাইট ইহার ত্রুটিবিচ্যুতির কঠোর সমালোচনা করেন কিন্তু লেনপুল তাহাকে জোর সমর্থন জানান। কারণ তিনি ছিলেন এ বিষয়ের পথিকৃৎ এবং এই বিরাট গ্রন্থ অনুবাদের একমাত্র দাবীদার। একথা সত্য যে, ইংরেজী অনুবাদটি সর্বক্ষেত্রেই নির্ভুল ও ত্রুটিমুক্ত হয় নাই এবং কোন কোন বিষয় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত হইয়াছে। তথাপি তিনি তথ্যাদির যে বিবরণ দান করিয়াছেন আরবী ভাষায় অনভিজ্ঞ পাঠকের জন্য তাহা খুবই সহায়ক হইয়াছে। কিতাব নাফহুত্তিব’ নামে খলিলুর রহমান ইহার উর্দু অনুবাদ করিয়াছেন।

ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থ ছাড়াও সমসাময়িক কালের আত্মচরিত পাঠেও স্পেনের মুসলিম শাসনের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। আবি আব্দুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে হারিসুল-খুশানী (মৃঃ ৩৬১ হিঃ/৯৭১ খ্রীঃ) রচিত কিতাবুল কুযাত বি-কুরতুবাহ’ এই পর্যায়ের অপর একখানি গ্রন্থ। ইহা ব্যতীত এই প্রসঙ্গে আরও যে সমস্ত গ্রন্থের নাম করা যায় তাহা হইল আবি আল হাসান আলী বিন বাসাম (মৃঃ ৫৪২ হিঃ/১১৪৭-৮ খ্রীঃ) রচিত ‘আলজাখিরা ফি মাহাসিনিল জাহিরা’, ইবনুল ফারাজী নামে পরিচিত আবি আল ওয়ালিদ আব্দুল্লাহ ইবনে মুহম্মদ বিন ইউসুফ আল আজদি (মৃঃ ১০১৩ খ্রীঃ) রচিত ‘তারিখ উলামাইল আন্দালুস,’ আবিল কাসিম খালাফ বিন আবদুল মালিক বিন বাসকুয়াল (মৃঃ ৫৭৮হিঃ/১১৮৩ খ্রীঃ) রচিত ‘কিতাবুস সিলাহ ফি তারিখে আইমনাতিল আন্দালুস’, আবু জাফর আহমদ বিন ইয়াহিয়া আল জাব্বী (মৃঃ ১২০৩ খ্রীঃ) রচিত বুগিয়াতুল মুলতামিস ফি তারিখে রিজাল-আহলুল আন্দালুস’ এবং ইবনুল আকবর (মৃঃ ১২৬০ খ্রীঃ) বলিয়া পরিচিত আবু আব্দুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে আবি বকর আল কুজা রচিত তাকমিলাহ লি কিতাবুস সিলা’।

ইউরোপীয় উৎস

ইউরোপীয় ভাষায় রচিত সমসাময়িক কালের যে সমস্ত গ্রন্থ পাওয়া যায়, তাহাতে মুসলিম শাসনকালে স্পেনের যে ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন হইয়াছিল তাহার কোন তথ্যই পাওয়া যায় না। স্পেনের ঘটনাপঞ্জী লেখকদের মধ্যে যাঁহাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, তাহারা হইতেছেন—ইসিডোরাস প্যাচেসিস, মুংক সেবাসতিয়ান, মুংক ভিজিলা, সাম্পিয়রা, পিলাগিয়স। টলেডোর আর্চবিশপ ডন রুই জেমেনেজ কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় রচিত গ্রন্থ ‘আরব জাতির ইতিহাস’ সমসাময়িককালের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। প্রচুর আরবীগ্রন্থ ও ঘটনাপঞ্জী আলোচনা করার পর তিনি এই গ্রন্থখানি রচনা করেন। ভুল তথ্য সম্বলিত এই গ্রন্থখানিতে ১১৪০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জীর আলোচনা করা হইয়াছে। দশম আলফন্সের আদেশে ইহুদী ও মুসলমান লেখকগণ ক্যাস্টিলিয়ান ভাষায় স্পেনের সাধারণ ইতিহাস রচনা করেন। ইহাকে স্পেনীয় খ্রীস্টানদের সামাজিক ইতিহাস না বলিয়া সাহিত্য বলা যাইতে পারে। ফলে জাতীয়তা ও ধর্মীয় গোড়ামীর প্রভাবে প্রভাবিত হইয়া পরবর্তীকালের ইতিহাস বেত্তাগণ মুসলিম কীর্তিকলাপকে সম্পূর্ণ অবহেলা ও অগ্রাহ্য করিয়াছেন। আরবী ও হিব্রু ভাষায় রচিত গ্রন্থ ‘লজ লস মোসারাবেস দে-টলেডো অন লস সিগলোস’ (১২-১৩ শতাব্দী) মোজারেবদের (যে সমস্ত স্পেনীয় খ্রীস্টান মুসলমানদের সামাজিক নিয়ম কানুন মানিয়া চলিত) সম্পর্কে একটি মূল্যবান সংগ্রহ। মাদ্রিদের জাতীয় মহাফেজ খানা, টলেডোর বিভিন্ন উপাসনালয় ও অপরাপর গীর্জায় ইহা সংরক্ষিত হয়। এঞ্জেল গঞ্জালেস প্যালেন্সিয়া চারি খণ্ডে ইহার সম্পাদনা করেন। ১৯২৬-৩০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ইহা মাদ্রিদে প্রকাশিত হয়।

১০৮৩ হইতে ১২৯৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলীর বিস্তারিত ও সুষ্ঠু ইতিহাস রহিয়াছে। কিন্তু সমগ্র চতুর্দশ শতাব্দীর ঘটনাবলীর বিক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ বর্ণনা বহুল কিছু কিছু রচনা পাওয়া যায়। মুসলিম রাজত্বকালে মুজারেবদের অবস্থার কথা পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করা হইয়াছে এই সমস্ত গ্রন্থে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফ্লোরেজ কর্তৃক একান্ন খণ্ডে বিরচিত ‘এম্পানীয়া সাগারদা’ গ্রন্থে স্পেনে মুসলিম শাসনামলের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু কিছু আলোচনা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। সাগরদা একখানি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। সমসাময়িক কালের এবং তৎপূর্ববর্তী সময়ের ঘটনাপঞ্জির কিছু কিছু অংশ এই গ্রন্থে আলোচিত হইয়াছে। মাদ্রিদের রয়েল একাডেমী অব হিস্ট্রি কালেকশন দে ডকুমেন্টস ইন এডিতোস প্যারা লা হিস্তোরিয়া দে এস্পানিয়া’ নামে ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ একখানি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করে।

আধুনিক উপাদান

জে, এ. কোন্দে রচিত ‘হিস্তোরীয়া দে-লস দোমিনাসীয়ন দে-লস এরাবেস এন এম্পানীয়’ গ্রন্থখানি ১৩৪৪ খ্রীস্টাব্দে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হইলে তখন ইহা উচ্চমানের গ্রন্থ বলিয়া পরিগণিত হয়। এই বিষয়ে পথিকৃৎ হওয়ার দরুন কোন্দে তাহার গ্রন্থে অসংখ্য ভুল তথ্য পরিবেশন করেন। রেইনহার্ট ডজির শিক্ষক প্রফেসর ওয়েজার্স গ্রন্থখানির প্রতি ডজির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গ্রন্থখানির ভুলভ্রান্তি ডজিকে হতাশ করিলেও ইহা তাহাকে স্পেনের মুসলমানদের সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার কাজ করে। তিনি আরবী গ্রন্থগুলির সমালোচনামূলক সংস্করণ ও মুসলিম স্পেনের রাজনীতি ও সাহিত্যের ইতিহাস ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করার ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। তেলেমসেনের বনু সাইয়ান, সেভিলের আব্বাদী এবং ইবনে আবদুনের কবিতার উপর গ্রন্থ রচনা ছাড়াও ডজি ১৮৪৭ খ্রীস্টাব্দে আবদুল ওয়াহিদ আল-মারাকুশী রচিত আলমুয়াহেদুন (মুয়াহেদদের ইতিহাস) এবং ১৮৪৮ হইতে ১৮৫১ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ইবনুল ইজারী রচিত আলবায়ানুল মাগরিব ফি আখবারিল মাগরিব’ গ্রন্থ দুইটি সম্পাদনা করেন। ডজি ক্যাম্বুিজের উইলিয়াম রাইট, ফ্রান্সের গুস্তাভে ডুগাত ও জার্মানের লুডলফ

ক্রেলের সহযোগিতায় ১৮৬১ খ্রীস্টাব্দে আল-মাক্কারীর সুবিখ্যাত গ্রন্থ নাফহুত্তিব’ সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ডজির সুনাম সাধারণতঃ চার খণ্ডে প্রকাশিত তাঁহার রচিত গ্রন্থ ‘হিস্তোয়ের দেস মুসলমান দে এস্পগ্ন’র উপর নির্ভর করে। ১৮৬১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি আলমুরাবিও অভিযান হইতে শুরু করিয়া সেভিলের আব্বাসী শাসক মুতামিদের (১০৯৫ খ্রীঃ) শাসন কাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক বর্ণনায় পরিপূর্ণ। ডজির লেখায় গভীর পাণ্ডিত্য এবং ঘটনা বিশ্লেষণে ভাষার সাবলীলতা খুবই হৃদয়গ্রাহী। ইহা এই বিষয়ের উপর একখানি উত্তম গ্রন্থ হিসাবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করিয়াছে। ফ্রান্সিস গ্রীফিন স্টকস গ্রন্থখানি ‘স্পেনিস ইসলাম নামে ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ইহা ১৯১৩ খ্রীস্টাব্দে লণ্ডনে প্রকাশিত হয়। ইহা উর্দুতে অনুবাদ করেন মৌঃ জাকাউল্লার পুত্র মুহম্মদ ইনায়েত উল্লাহ। ইব্বত নামায়ে আন্দালুস’ নামে গ্রন্থখানি ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে দিল্লীতে প্রকাশিত হয়। ডজির রচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও ইহার অসম্পূর্ণতা দৃষ্টিগোচর হয়। ১১১০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত স্পেনের মুসলিম শাসনের ইতিহাস পর্যালোচনা করা হইলেও বার্বার, আল মুরাবিতুন, আল মুয়াহিদুন ও বনু নাসর শাসনের পরবর্তী চার শতাব্দীর ইতিহাস ইহাতে বর্ণিত হয় নাই। স্পেনের মুসলিম শাসনের ইহা একটি অসম্পূর্ণ ইতিহাস। ডজি এই গ্রন্থে সমকালীন সাংস্কৃতিক ও তথ্যবহুল সাহিত্য কর্মকে অবহেলা করিয়া শুধু ঐ সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের বর্ণনা প্রদান করিয়াছেন। ডজি ১৮৮১ খ্রীস্টাব্দে তাঁহার শব্দকোষ সাপ্লিমেন্ট আত ডিকশনারীস আরাবেস’ নামে দুইটি বিরাট খণ্ডে প্রকাশ করেন। শব্দকোষ প্রকাশের দুই বৎসর পর তিনি পরলোক গমন করেন। মজার ব্যাপার এই যে, তিনি তাহার সাহিত্যিক জীবন শুরু করিয়াছিলেন, ‘এ ডিকশনারী অব আরাবিক কস্টিউম সম্পাদনার মাধ্যমে এবং তাহার জীবনের পরিসমাপ্তিও ঘটে উক্ত কর্মের পরিপূরক শব্দকোষ প্রকাশনার মধ্য দিয়া। এই শব্দকোষই ডজিকে ভাষাতত্ত্ববিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করে।

এই মূল্যবান গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ডজি তাহার পূর্ববর্তী লেখকদের অতিক্রম করিয়া ইতিহাস রচনার এক অনির্ধারিত পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। এভারেস্ট লেভি প্রভেঙ্কাল তাহার পথ অনুসরণ করিয়াছেন। লেভি প্রভেঙ্কালও ডজির ন্যায় বহু লেখার মাধ্যমে মূল আরবী গ্রন্থের উৎসকে সহজলভ্য করিয়াছেন। ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দে তিনি ডজির ‘হিস্তোয়ের মুসলমানস দে এস্পগ্ন’ (৭১১-১১১০খ্রীঃ) গ্রন্থটির সংশোধিত সংখ্যা প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে সন্তুষ্ট না হইয়া তিনি স্পেনের মুসলিম ইতিহাসকে নতুন ভাবে লিপিবদ্ধ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁহার গুরুত্ত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলির মধ্যে ইন্সক্রীপশন এরাবেস দে এগ্ন’ দুই খণ্ডে ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ১৯৫০-৫৩ খ্রীস্টাব্দে প্যারিসে ‘লে এস্পগ্ন মুসলমানস আত জেমে সিয়েক্রী ইনস্টিটিউশন এট ভিয়ে সোসিয়াল’ তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থগুলিতে তিনি ১০৩৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম শাসনের পূর্ণ ইতিহাস পর্যালোচনা করিয়াছেন। এই গ্রন্থগুলি ঐতিহাসিক ডজির রচনাকে সম্পূর্ণরূপে

অতিক্রম করিয়াছে। দুঃখের বিষয়, এই ঐতিহাসিক পণ্ডিত তাঁহার পরিকল্পিত চতুর্থ খণ্ড স্পেনের বার্বার শাসনের উপর লিখিত গ্রন্থ বার্বার এম্পায়ার্স আলমুরাবিত ও আল মুয়াহিদ প্রকাশের পূর্বেই ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁহার মৃত্যু আধুনিক ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে ১০৩১ খ্রীস্টাব্দের পর এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করে। ডজির ন্যায় ইতিহাস বিশ্লেষণে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী না হইলেও লেভি প্রভেঙ্কাল ছিলেন তাহার যোগ্য উত্তরাধিকারী। এমিলিও গার্সিয়া গোমেজ স্পেনীয় ভাষায় লেভি প্রভেঙ্কালের ‘হিস্তোয়ের’ গ্রন্থটি ‘হিস্তোরিয়া দে এম্পানীয়া’ (৪র্থ খণ্ড) নামে অনুবাদ করেন এবং ১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে ইহা মাদ্রিদে প্রকাশিত হয়।

দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাংশ ও আলমুহাদ যুগের ইতিহাস জানিতে হইলে আমাদিগকে ডজি লিখিত ইতিহাসের সংশোধিত সংখ্যা ও আসব্রোসীয় হুইসী মিরান্দা লিখিত হিস্তোরীয়া পলিটিকা দেল এম্পোরীয় আলমুহেদ’ নামক গ্রন্থটির উপর নির্ভর করিতে হয়। গ্রন্থটি ১৯৫৬-৫৭ খ্রীস্টাব্দে তিতুয়ানে প্রকাশিত হয়। মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের উপরে লিখিত এস. পি. স্কটের ‘হিস্ট্রি অব দি মূরিশ এম্পায়ার’ নামক গ্রন্থটি তিন খণ্ডে সমাপ্ত। ইহা ১৯০৪ খ্রীস্টাব্দে ফিলাডেলফিয়াতে প্রকাশিত হয়। ইহা ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ। কিন্তু লেখক তাঁহার এই গ্রন্থে মুসলিম রাজত্বকালে স্পেনের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ আলোকপাত করেন নাই। তিনি কদাচিৎ তাহার মূল গ্রন্থে বা পাদটীকায় তাঁহার বক্তব্যের সমর্থনে প্রামাণিক সূত্রের উল্লেখ করিয়াছেন। এই গ্রন্থে কিছু কিছু গরমিল পরিলক্ষিত হয়।

স্টেনলী লেনপুল লিখিত ‘হিস্ট্রি অব দি মূরস ইন স্পেন’ গ্রন্থটি ১৮৮৮ খ্রীস্টাব্দে লণ্ডনে প্রকাশিত হয়। এই ক্ষুদ্র গ্রন্থে লেখক স্পেনের মুসলিম শাসনের পূর্ণ ইতিহাস আলোচনা করিয়া আরব সংস্কৃতির ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন। ১৮৩২ খ্রীস্টাব্দে ওয়াশিংটন আরভিং কর্তৃক প্রকাশিত ‘টেলস অব দি আলহামরা’র অনুকরণে লিখিত লেনপুলের গ্রন্থ সম্পর্কে মন্টোগোমারী বলেন যে, “স্টেনলী লেনপুল আরবদের প্রশংসা করিয়াছেন অপরদিকে সমকালীন স্পেনীয়দের পছন্দ করেন নাই। তাঁহার ধারণা আরবদের জন্যই স্পেনের সুনাম ও প্রাধান্য ছিল। আরবদের বিতাড়িত করার ফলেই স্পেনের অধঃপতন হয়।” আরব দর্শন স্পেনের এবং মধ্যযুগীয় ইউরোপের অপরাপরাংশে যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল ১৯২৯ খ্রীস্টাব্দে লন্ডনে প্রকাশিত ইসলাম ইন স্পেন’ গ্রন্থে লেখক ক্যানন শেল সে সম্পর্কে কম গুরুত্ব প্রদান করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হিস্তোয়ের দ্য এস্পাগ্ন’ নামক গ্রন্থে লেখক লুই বার্ট্রান্ড স্পেনের বার্বার ও আরব সংস্কৃতি এবং সভ্যতার গুরুত্বকে খাটো করিয়া দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন এবং ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মতবাদকে সমর্থন করিয়া বলিয়াছেন যে, স্পেনীয় সভ্যতায় মুসলমানদের দান খুবই সামান্য।

১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দে লণ্ডনে প্রকাশিত ‘দি এসৃপ্লেন্ডার অব মূরিশ স্পেন’ গ্রন্থে গ্রন্থকার জসেফ ম্যাক্কার দৃঢ়তার সহিত কতিপয় ইউরোপীয় লেখকের যথা—চার্লস প্লেটরিক ও লুইস বাট্র্যান্ডের পক্ষপাতিত্ব মূলক মতামতকে খণ্ডন করিয়াছেন। ব্যাপক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লিখিত এই গ্রন্থটিতে তিনি বলিয়াছেন যে, আরবরা শুধু প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতার মধ্যে যোগসূত্রই রচনা করেন নাই বরং এক নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি করিয়া উহা ইউরোপকে উপহার দিয়াছেন। ১৯১০ খ্রীস্টাব্দে লন্ডনে প্রকাশিত ‘দি হিস্ট্রি অব ইন্টেলেকচিউয়্যাল ডেভেলপমেন্ট অব মুসলিম স্পেন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের এক শত পৃষ্ঠায় লেখক জন উইলিয়াম ড্রাম্পার তাঁহার নিরপেক্ষ লেখনীর মাধ্যমে মুসলমানদের নিকট ইউরোপবাসীদের ঝণ সম্পর্কে আলোচনা করিয়াছেন। ১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দে বার্সিলোনায় প্রকাশিত এ গঞ্জালেজ প্যালেন্সিয়া কর্তৃক লিখিত হিস্তোরিয়া দেলা এম্পানীয়া মুসলমানা’ একখানি জনপ্রিয় সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ। হেনরী তেরেসা লিখিত ও ১৯৫৮ খ্রীস্টাব্দে প্যারিসে প্রকাশিত ইসলাম দ্য এস্পগ্নে উনে রিকন্ত্রে দেল ওরিয়েন্ট এট দে-লা অক্সিডেন্ট’ গ্রন্থটিতে সাধারণতঃ প্রত্নতত্ত্ব ও শিল্পকলার ইতিহাস বিবৃত হইয়াছে। আমেরিকো ক্যাস্ট্রো লিখিত স্ট্রাকচার অব স্পেনীশ হিস্ট্রি’ গ্রন্থে ইসলামিক স্পেন সম্পর্কে লেখক যে মতামত প্রকাশ করিয়াছেন হেনরী তেরেসা উহাকে সমর্থন জানান। গ্রন্থটি ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দে প্রিন্সটনে ই. এল. কিং অনুবাদ করেন। সি. সাঞ্চেজ আল বার্নোজের লেখা ‘এম্পানীয়া এন সু হিস্তোরীয়া, ক্রিস্টিয়ানোস, মূরোস ই খুদিওস’ ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দে বুয়েনেস আয়ারসে আমেরিকো ক্যাস্ট্রো কর্তৃক সংশোধিত ও প্রকাশিত। উল্লিখিত গ্রন্থে ক্যাথলিক মতের বিরুদ্ধে ভিজিগথ যুগ হইতে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ান স্পেনের মধ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়াস পাইয়াছেন। লেখক মতামত প্রকাশ করেন যে, পরবর্তীকালের ক্রিশ্চিয়ান স্পেনের ধারাবাহিকতা ভিজিগথ স্পেনের সহিত স্থাপিত হয় অষ্টম শতাব্দীর মুসলিম শাসনের ফলে। আরবদের নিকট হইতে ব্যাপক ভাবে গৃহীত মিশ্র সংস্কৃতি এই শূন্যতা পূরণ করে।

১৯৫১ খ্রীস্টাব্দে লণ্ডনে প্রকাশিত হিস্ট্রি অব দি আরবস’ গ্রন্থে গ্রন্থকার ফিলিপ কে, হিট্টি ইহার চতুর্থ খণ্ডের ১০০ পৃষ্ঠা ব্যাপী লেখায় স্পেনীয় আরব বুদ্ধিজীবীদের অবদান সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন। স্পেনের মুসলমান শাসনের একখানি পূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থ উর্দু ভাষায় রচনার জন্য পাটনার মৌলানা সাইয়েদ রিয়াসত আলী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তারিখে উন্দুলুস’ নামে ইহার প্রথম খন্ড ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে আজমগড়ে প্রকাশিত হয়। ইহাতে দ্বিতীয় আবদুর রহমানের (৮৫২ খ্রীঃ) রাজত্বকাল পর্যন্ত স্পেনের ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। উর্দু ভাষায় রচিত ইতিহাস গ্রন্থের মধ্যে ইহা একটি তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ। ১৯৬৭ খ্রীস্টাব্দে এডেনবার্গে প্রকাশিত এ হিস্ট্রি অব ইসলামিক স্পেন’ গ্রন্থে ডব্লিউ মন্টগোমারী অতি সংক্ষেপে মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক

ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস এক নতুন প্রেক্ষাপটে রচনা করেন। এই গ্রন্থে মুসলিম স্পেনের স্থাপত্য ও প্রশাসন সম্পর্কিত ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ হইয়াছে।

মুসলমানদের আগমনের পূর্বে স্পেন

হিজরী প্রথম শতাব্দীর মধ্যে মুসলিম সাম্রাজ্য পূর্বে হিন্দুকুশ হইতে পশ্চিমে আটলান্টিকের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। স্থায়ীভাবে বসবাসরত ও যাযাবর জাতীয় বার্বারদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ লইয়া মুসলমানগণ শেষ পর্যন্ত তিউনিসিয়াতে নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ৬৯৮ খ্রীস্টাব্দে বাইজান্টাইনের অধিবাসীগণ তাহাদের উত্তর আফ্রিকার রাজধানী কার্থেজ হইতে বিতাড়িত হয়। অষ্টম শতাব্দীর প্রথম হইতেই মুসলমানগণ আলজিরিয়ার মধ্য দিয়া মরক্কোতে প্রবেশ করিতে শুরু করে। এই এলাকায় স্থায়ী বসবাসকারী বার্বারগণ মুসলমানদের অগ্রাভিযানে বাধা প্রদান করিলে তিউনিসিয়ার নবনিযুক্ত গভর্নর মুসা বিন নুসাইর তাহাদিগকে সমূলে ধ্বংস করেন। মুসা বিন নুসাইর উমাইয়া খলিফাদের অধীন ছিলেন। পূর্বে তিনি মিসরের গভর্নরের অধীনে কায়রোওয়ানের শাসনকর্তা হিসাবে কার্য পরিচালনা করেন। পরবর্তীকালে ৬৭০ খ্রীস্টাব্দে কায়রোওয়ানে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়। আমীর আলী বলেন, “ইফ্রিকিয়া যখন মুসলিম শাসনাধীনে সহিষ্ণুতা ও সুবিচারের আশীর্বাদপুষ্ট হইয়া পার্থিব উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত তখন · আইবেরিয়ান উপদ্বীপ ভিজিগথ শাসনের কঠোর ও কঠিন যাতাকলে নিষ্পেষিত হইতেছিল।”৩। ভিজিগথ শাসকগণ তাহাদের পূর্ববর্তী সুয়েভী ও ভ্যান্ডাল শাসকদের অপেক্ষা নিজদিগকে উত্তম বলিয়া প্রমাণ করিতে ব্যর্থ হন। স্পেন প্রায় তিনশত বৎসর (৪০৯-৭১২ খ্রীঃ) ভিজিগথ শাসনাধীনে ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁহারা পূর্ববর্তী শাসক সিজারদের (কায়সার) দুঃশাসন ও অন্যায় অত্যাচারের কালিমা দূরীভূত করিতে ব্যর্থ হন। বরং তাহাদের দুঃশাসনে জনগণের দুঃখকষ্ট আরও বৃদ্ধি পায়। গথিক শাসন “ধ্বংসলীলা, গণহত্যা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্দয়ভাবে দমন এবং আক্রমণকারী বার্বারদের (অসভ্য জাতি) অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পরিপূর্ণ।”? রিকার্ডের ক্ষমতা গ্রহণ ও রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত স্পেনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল। উত্তরাধিকারী নির্বাচনে বুদ্ধিজীবীদের গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সংক্ষেপে বলা যায় যে, ভিজিগথ রাজতন্ত্র রোমান ইতিহাসের ব্যর্থতার প্রতীক। উঁচু নীচুর ব্যবধান; উত্তরাধিকারী নির্বাচনে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্রতি নিম্নশ্রেণীর অসন্তুষ্টি সেনাদের মধ্যে আস্থাহীনতা, অর্থনৈতিক দূরবস্থা ও ইহুদীদের দুর্ভোগের ইতিহাস ভিজিগথ শাসনের ব্যর্থতার স্বাক্ষর বহন করে।

সামাজিক পরিবেশ

মুসলিম শাসনাধীনে আসিবার পূর্বে স্পেনের অধিবাসীগণ রাজা, ক্ষুদ্ররাজ্যের শাসক, অমাত্যবর্গ, যাজক, সামন্তরাজ, অভিজাত শ্রেণী, বর্গাদার,

ভূমিদাস (সাফ) ও ক্রীতদাস ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। ইহাদিগকে মোটামুটিভাবে শাসক ও শাসিত এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যাইতে পারে। শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন রাজা, ধর্মযাজক ও অভিজাত শ্রেণী। অপরদিকে বর্গাদার, ভূমিদাস (সার্ফ), ক্রীতদাস ও ইহুদীগণ ছিল শাসিত শ্রেণীভুক্ত।

অষ্টম শতাব্দীর প্রারম্ভে স্পেনীয় রোমান ও ভিজিগথ অভিজাত সম্প্রদায় সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। প্রশাসনে ইহাদের বিশেষ প্রভাব ছিল। বিশপ ও রাজার মধ্যে গভীর সান্নিধ্যের কারণে বহু প্রশাসনিক বিষয় চার্চপরিষদ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হইত। জনসাধারণের সহিত বিশপদের সরাসরি যোগাযোগ থাকার দরুন তাহারা রাজা উয়াম্বা ও উইতিজার বিরুদ্ধে জনগণকে বিদ্রোহ করিতে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেন। বিশপগণ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেন।

যাজকগণ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়া পড়েন। তাহারা অগাধ ধনসম্পদের অধিকারী ছিলেন। তাঁহারাই যাজকদের পরিষদ পরিচালনা করিতেন। যাজক পরিষদের সীমাহীন প্রভাব ছিল জনসাধারণের উপর। যাজকদের কুকর্ম ও অপকর্মের অন্ত ছিল না। তাহারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী রাজা নির্বাচন করিতেন এবং প্রশাসনের মর্যাদাপূর্ণ পদগুলি তাহাদের অধিকারে ছিল। চার্চের অধীনস্থ কর্মচারীগণ যাজকের পরিবর্তে কার্য সম্পাদন করিতেন।

যুবরাজ ও সামন্ত প্রভুদের সমন্বয়ে স্পেনের অভিজাত শ্রেণী গড়িয়া ওঠে। জুয়া, মদ, ঘোড়দৌড়, বনভোজন ও বিলাসিতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকিয়া তাহারা দিনাতিপাত করিতেন। তাঁহারা বাস করিতেন সুরম্য ও সুশোভিত রাজপ্রাসাদে। প্রজাকুলের কল্যাণের প্রতি তাঁহাদের কোন দৃষ্টি ছিলনা। শাসকগণ ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে, প্রজাদের আনুগত্য, সহযোগিতা ও সমর্থনের উপরই তাহাদের অস্তিত্ব নির্ভর করে।

প্রজাগণকেও আবার দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যাইতে পারে। পৌরকার্যক্রম পরিচালনায় নিযুক্ত যাজক ও বর্গাদার সমন্বয়ে গঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণী অনধিক পঁচিশ একর ভূমির মালিক ছিলেন। এই ভূমি হস্তান্তরের অধিকার তাহাদের ছিল না। তাহারা এই জমিগুলি ফসল উৎপাদনের জন্য চাষীদিগকে বর্গা দিতেন। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির ফলে ফসল উৎপন্ন না হইলে বর্গাদারদের নিজের পকেট হইতে জমিদারের খাজনা পরিশোধ করিতে হইত।৭.ইহার ফলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাহাদের ভূসম্পত্তি ত্যাগ করিয়া হয় সেনাবাহিনীর চাকুরী গ্রহণ করিতেন অথবা জীবন ধারণের জন্য নীচু পেশা গ্রহণ করিতেন। স্পেনের সর্বনিম্ন শ্রেণী গড়িয়া উঠিয়াছিল ভূমিদাস (সাফ) ও ক্রীতদাসদের সমন্বয়ে। এইসব হিস্পানীয়-রোমান ভূমিদাসগণ ছিল স্বাধীনচেতা ও রোমান

উপনিবেশের উত্তরাধিকারী। বর্গাদার ও ভূমিদাসদের মধ্যবর্তী স্থানে ছিল ইহাদের অবস্থান। কৃষি-শ্রমিক ও সেনা বিভাগের লোক সরবরাহের কঠিন দায়িত্ব অর্পিত ছিল তাহাদের উপর। ক্রীতদাসদের ভাগ্য বিজড়িত ছিল ভূমির সহিত। জমি বিক্রি বলিতে জমির সহিত সংশ্লিষ্ট ক্রীতদাসকেও বুঝাইত। ভূমিরাজস্ব ব্যতীত তাহাদিগকে ব্যক্তিগত করও প্রদান করিতে হইত। সামান্য ভুল-ত্রুটির জন্য তাহাদের উপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চলিত। রোমান শাসনের শেষ অধ্যায়ে তাহাদের অবস্থা প্রায় ক্রীতদাসদের সমপর্যায়ে ছিল। ভিজিগথ শাসনকালে ক্রীতদাস ও ভূমিদাসদের মানবীয় অধিকার সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়। ব্যক্তিস্বাধীনতা বলিতে কোন কিছু ছিল না। দূর-দূরান্ত হইতে পানি বহন ও জঙ্গল হইতে কাষ্ঠ সংগ্রহ করাই ছিল তাহাদের একমাত্র কাজ। ভূমিদাস ও ক্রীতদাস তাহাদের প্রভুর বিনা অনুমতিতে বিবাহ করতে পারিত না। প্রভুর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত বিবাহ করিলে উহা বাতিল বলিয়া গণ্য হইত। এবং স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছিন্ন অবস্থায় জীবন-যাপন করিতে বাধ্য হইত। প্রতিবেশী দুই জমিদারের ক্রীতদাসদের মধ্যে বিবাহ-শাদী হইলে উভয় জমিদারই তাহাদের সন্তান-সন্তুতি ভাগ বাটোয়ারা করিয়া লইত। পণ্যসামগ্রীর ন্যায় ক্রীতদাস সর্বদা বাজারে ক্রয়-বিক্রয় হইত। সমাজে ক্রীতদাস প্রথা ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল। ৪০০০ হইতে ৮০০০ ক্রীতদাস এক এক ব্যক্তির অধীনে থাকিত। ভিজিগথ শাসকগণ ক্রীতদাসদের কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছিলেন। কৃষিজীবী, মেষপালক, মৎস্যজীবী ও কর্মচারী ইত্যাদি। সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণী কোন কোন সময় বনে জঙ্গলে আত্মগোপন করিত এবং দস্যু ও লুণ্ঠনকারীতে পরিণত হইত। রোমান শাসনকাল হইতে ভিজিগথ শাসন পর্যন্ত নাগরিক সুযোগ সুবিধা হইতে বঞ্চিত শহরগুলি তাহারা সময় সময় লুণ্ঠন করিত। নির্মম অত্যাচারের শিকার এই সব জনগণের চারিত্রিক অবনতির সাথে সাথে তাহাদের অর্থনৈতিক দুর্দশাও চরমে পৌছে।

অর্থনৈতিক অবস্থা

মুসলমানদের আগমনের পূর্বে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। স্পেনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ইহুদীদের প্রভাব ছিল সীমাহীন। তাহারা ছিল স্পেনের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার দরুন তাহারা মিল কারখানা, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ করিয়া দেশত্যাগ করে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। একদিকে বিত্তবানদের কর হইতে অব্যাহতি প্রদান অপরদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর সীমাহীন করধার্য করার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নামিয়া আসে আর্থিক বিপর্যয় ও দুর্ভোগ। আমীর আলী বলেন, “শিল্প কারখানাগুলিতে অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে সারাদেশ অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্বের কবলে পতিত হয়।”১১ ভূমিদাস ও ক্রীতদাসগণ জমির মালিক ছিলনা। জমিদার ও

সরকারের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হইলে তাহাদের উপর নামিয়া আসিত কঠোর অত্যাচার ও নির্যাতন। এই নির্মম অত্যাচার হইতে বাঁচিবার জন্য তাহারা বনে জঙ্গলে পলাইয়া যাইত ও দস্যুদের দলে যোগদান করিত। ফলে মিল কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হইত ও সেচকার্যের অভাবে জমি অনাবাদী অবস্থায় পড়িয়া থাকিত। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার দরুন সমগ্র রাজ্য দস্যুদের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফলে যাতায়াত ও ব্যবসা বাণিজ্যে অচল অবস্থা দেখা দেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত এই অর্থনীতি অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানদের প্রচেষ্টায় পুনর্জীবন লাভ করে।

ধর্মীয় অবস্থা

স্পেনে ধর্মীয় সহনশীলতা ছিল অনুপস্থিত।১২ ভিজিগথগণ নিজদিগকে আর্য খ্রীস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত বলিয়া দাবী করিত। ৫৮৭ খ্রীস্টাব্দে তাহাদের রাজা রিকার্ড (৫৮৬-৬০১ খ্রঃ) ক্যাথলিক ধর্মমত গ্রহণ করেন এবং ইহা রোমানগণ পছন্দ করিত না।১৩ ক্যাথলিক ধর্মমতকে রাষ্ট্রীয়ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিয়া স্পেনের ইতিহাসে তিনি সুখ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। এই সময় হইতেই স্পেন গোঁড়া ধর্মমতে বিশ্বাসী হয় এবং অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণ বলিয়া খ্যাতি লাভ করে। ইহুদীগণ খ্রীস্টানদের কোপানলে পতিত হয়। নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখিবার জন্য সংঘবদ্ধ হইবার চেষ্টা করিলেও বিশপের অকথ্য নির্যাতন ভোগ করিতে হইত। তাহাদিগকে খ্রীস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করিবার বিরামহীন প্রচেষ্টা চলিত। ৬১১ খ্রীস্টাব্দে গথিকরাজ সিসেবুত, খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিলে ইহুদীদের ধনসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও তাহাদেরকে নির্বাসনে পাঠাইবার অধিকার আইনসিদ্ধ করেন। ফলে বেশ কিছু সংখ্যক ইহুদী নামমাত্র খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। ইহুদীদের উপর অত্যাচার ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের আইন পাশ করিবার জন্য তৎকালীন স্পেনের রাজধানী টলেডোতে সময় সময় গথিকরাজের পরামর্শ পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হইত। ৬১২ খ্রীস্টাব্দ হইতে ৬২০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে ৯০,০০০ ইহুদীকে জোরপূর্বক খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। এডউইন হোলের মতে, “ফুয়েরো খুজগো, ইহুদীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বার্ষিক উৎসব ও বিবাহ অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কোন ইহুদী তাহার সন্তানকে খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত করিতে অসম্মতি জানাইলে শাস্তিস্বরূপ তাহাকে একশত বেত্রাঘাত, ধনসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও মস্তকমণ্ডন প্রভৃতি শাস্তি ভোগ করিতে হইত।১৪ ৬৮১ খ্রীস্টাব্দে দ্বাদশতম অধিবেশনে গথিকরাজের পরামর্শ পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে হয় ইহুদীগণ খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করিবে অন্যথায় তাহাদিগকে দেশত্যাগ করিতে হইবে। ৬৯৩ খ্রীঃ অনুষ্ঠিত পরামর্শ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাহাদিগকে ব্যবসা-বাণিজ্য হইতে বঞ্চিত করা হয়। অতঃপর উত্তর আফ্রিকার ইহুদীদের সহিত একত্রিত হইয়া স্পেনের ইহুদীগণ ভিজিগথ। শাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ৬৯৪ খ্রীস্টাব্দে উপদেষ্টা পরিষদ ইহুদীদিগকে তাহাদের সাত বৎসরের পুত্র-কন্যাসহ ক্রীতদাসরূপে বিক্রয় এবং খ্রীস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত

করিবার ফরমান জারী করে। অত্যাচারে জর্জরিত, মর্মাহত ও বিক্ষুদ্ধ ইহুদীগণ জিব্রাল্টার প্রণালীর অপর পারে উত্তর-আফ্রিকায় বসবাসরত সমগোত্রীয় ও সমধর্মীয় বার্বারদের সহযোগিতায় গথিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা ফাঁস হইয়া যাইবার ফলে তাহাদিগকে কঠোর শাস্তি ভোগ করিতে হয়। তাহাদের স্থাবর অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘঘাষিত হয়।১৫ এই অত্যাচার হইতে রক্ষাপ্রাপ্ত ইহুদী যুবা, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে ক্রীতদাস হিসাবে খ্রীস্টানদের হস্তে সমর্পিত হয়। বৃদ্ধগণ যদিও তাহাদের পূর্বধর্মে থাকিবার অনুমতি লাভ করে কিন্তু যুব সম্প্রদায় খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়। ইহুদীদের সহিত ইহুদীদের বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং খ্রীস্টান ক্রীতদাসদের সহিত ইহুদীদের বিবাহের রেওয়াজ প্রচলিত হয়। এই রূপে গথিক শাসকগণ একটি উন্নত মানব সমাজকে মানবীয় অধিকার হইতে বঞ্চিত করেন। ইহুদীগণ স্বাধীন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় প্রতীক্ষা করিতে থাকে।”

রাজনৈতিক অবস্থা

স্পেনে বসবাসরত পশ্চিমী রোমানদের উত্তরাধিকারী ভিজিগথ শাসকদের মধ্যে উয়াম্বা এবং উইতিজা সুশাসন ও জনহিতকর কার্যের জন্য সুবিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছিলেন। উয়াম্বার শাসনকালে স্পেন শান্তি শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি লাভ করিলেও পরবর্তীকালে উয়াম্বা উচ্চাভিলাষী হইয়া উঠিলে অভিজাত সম্প্রদায় ও যাজকদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়। ফলে স্পেনে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসা ইবনে নুসাইর১৬ যখন তিউনিসিয়ার ভাইসরয় ছিলেন সেই সময়ে বায়েটিকার ডিউক ৮২ বৎসর বয়স্ক রডারিক (লুজরিক) রাজা উইতিজাকে১৭ হত্যা করিয়া আইবেরিয়ার সিংহাসন অধিকার করেন। উইতিজা ৭০২ খ্রীস্টাব্দে তাঁহার পিতা এজিকার উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হন এবং তিনি তাঁহার পুত্র আচিলাকে (আখিলা) ৪১৪ খ্রীস্টাব্দের প্রারম্ভে ভিজিগথগণ কর্তৃক দখলকৃত উত্তর-পূর্ব স্পেনের রোমান প্রদেশ তারাকোনেন্সিস-এ গভর্নর নিযুক্ত করেন। আচিলা রডারিক কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হইয়া গ্যালিসিয়ায় পলায়ন করেন।

রাজতন্ত্র তাহার পূর্ব জৌলুস হারাইয়া ফেলে। সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তুষ্টির ফলে, উত্তরাধিকারীদের জীবনের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়। শাসকগণ বিশপদের দ্বারা নির্বাচিত হইতেন। সমাজে বিশপদের প্রভাব ছিল অপরিসীম। কোন কোন রাজা স্বীয় উত্তরাধিকারীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য বিশপদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাহাদের সহিত অংশীদার রাখিতেন। ইহাতে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় অসন্তুষ্ট হইয়া ওঠেন, কেন না উত্তরাধিকারী নির্বাচনে তাহারাও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইতেন। ৬৮০ খ্রীস্টাব্দে উয়াকে সিংহাসনচ্যুত করিবার পর স্পেনে ভিজিগথ শাসনের শেষ একত্রিশ বৎসর দারুণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে অতিবাহিত হয়। অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে টলেডোর সিংহাসন

অধিকারের প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। ইহার ফলে দূরবর্তী প্রদেশের গভর্নর ও বিদ্রোহী নেতাগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করে। কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা ও সৈনিকদের নিয়মিত মাহিনা প্রদান করিতে না পারার দরুন বিদ্রোহ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যর্থ হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষের কারণে রাজার প্রয়োজনীয় সংখ্যক সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল না। রাজার আদেশে সকল সক্ষম ব্যক্তি সেনাবাহিনীতে যোগদান করিলেও মনে মনে অসন্তুষ্ট থাকিত। পরবর্তীকালে পশ্চিম ইউরোপের জায়গীর প্রথার ন্যায় তাহাদের মধ্যে জায়গীর প্রথার প্রচলন করা হয়। সার্বক্ষণিক ও নিয়মিত কোন সেনাবাহিনী ছিল না। ভূমিদাস ও ক্রীতদাসকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করিতে হইত। কিন্তু তাহারা নিয়মিত বেতন পাইত না। এইরূপ অনিয়মিত ও প্রশিক্ষণ বিহীন সেনাবাহিনী গড়িয়া ওঠায় সপ্তম শতাব্দীর শেষাংশে গথিক শাসকগণ প্রয়োজনীয় সেনা সংগ্রহে অসুবিধার সম্মুখীন হন। জার্মান দলপতি-শাসন পদ্ধতির সংগে তৎকালীন ভিজিগথ শাসকগণ স্পেনের পারিপার্শ্বিকতার কারণে খাপ খাওয়াইতে ব্যর্থ হন।

মুসলিম আক্রমণের সাথে সাথে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে উত্তরাধিকার প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দেয়। ৬৮৭ খ্রীস্টাব্দে পিতা এবং পুত্র মিলিতভাবে রাজ্য শাসন করেন। উইতিজার প্রতি দেশের জনগণের সীমাহীন ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল। উইতিজা ইহুদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন। তিনি আশা করিয়াছিলেন, তাঁহার পুত্র উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হইবে। পুত্রকে উত্তর-পূর্ব তারাকোনেন্সিস প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত করিয়া প্রশাসন কার্য পরিচালনায় দক্ষতা অর্জনের জন্য নিজের পাশে পাশে রাখিবেন। অভিজাত শ্রেণীর এক অংশ উইতিজার শাসনের বিরোধিতা করেন এবং শেষ পর্যন্ত রডারিককে রাজা নির্বাচন করেন। আচিলা নিজ শাসনাধীন প্রদেশ স্বাধীন বলিয়া ঘোষণা করেন এবং স্বীয় নামে মুদ্রার প্রচলন করেন। সিউটার গভর্নর ও উইতিজার জামাতা কাউন্ট জুলিয়ান (ইলিয়ান) তৎকালীন প্রথানুযায়ী স্বীয় কন্যা ফ্লোরিডাকে১৮ রাজকীয় আদবকায়দা ও শিষ্টাচার রপ্ত করিবার জন্য রডারিকের রাজপ্রাসাদে প্রেরণ করেন। ফ্লোরিণ্ডা রডারিক কর্তৃক প্রলুব্ধ হইয়া বিপথগামিনী হন। রডারিকের আচরণে জুলিয়ান গভীরভাবে মর্মাহত হন। জুলিয়ান অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ও আফ্রিকায় বসবাসরত দেশত্যাগীদের অনুরোধে দেশকে বে-আইনী দখল হইতে মুক্ত করিবার জন্য সংকল্প করেন এবং স্পেনের অবস্থা সম্পর্কে মুসাকে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান গোপন তথ্য সরবরাহ করেন। হিট্টি১৯ এবং হোলের২০ ন্যায় বিখ্যাত পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ এই ঘটনার প্রতি অতি সামান্য গুরুত্ব প্রদান করিয়াছেন। যে জুলিয়ান দীর্ঘদিন মুসলিম অধিকার হইতে সিউটাকে রক্ষা করেন পরবর্তীকালে সেই জুলিয়ানই সিউটাকে শুধু মুসলমানদের নিকট হস্তান্তরই করেন নাই উপরন্তু স্পেন অধিকার করিতে তারিক ও মুসাকে সর্বপ্রকার

সাহায্য ও সহযোগিতা সক্রীয় ভাবে দান করেন। ইহারও কোন ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকগণ দেন নাই। কিন্তু জুলিয়ানের ব্যবহার এই ইঙ্গিতই প্রদান করে যে, রডারিক নিশ্চয়ই অশালীন এবং অন্যায় ব্যবহার করিয়াছিলেন। অপরদিকে সমকালীন আরব ও স্পেনীয় ঐতিহাসিকগণ এ ব্যাপারে ফ্লোরিণ্ডার উপাখ্যান ব্যতীত অন্য কোন দুর্ঘটনার উল্লেখ করেন নাই। ফলে রডারিক মৃত রাজার পুত্র ও ভ্রাতাদের আত্মীয় স্বজনের নেতৃত্বে গঠিত এক শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরোধিতার সম্মুখীন হন এবং অবিশ্বাসী সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করিতে বাধ্য হন। উইতিজার ভ্রাতাদের মধ্যে বিশপ অপ্লাস ও সিসবার্ট এবং পুত্রদের মধ্যে আচিলা ছিলেন বিশেষ প্রভাবশালী। ভিজিগথ অভিজাত সম্প্রদায় ও রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধের ফলে রাজ্যে বিবাদ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

দারিদ্রক্লিষ্ট জনসাধারণ, দুঃখী ক্রীতদাস, দুর্ভাগা ভূমিদাস এবং উৎপীড়িত ইহুদীগণ সকলে সমবেতভাবে একজন ত্রাণকর্তার অপেক্ষা করিতেছিলেন। স্পেনের মোহাজেরগণ যেখানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন শেষপর্যন্ত সেই মুসলিম আফ্রিকা হইতেই তাঁহার আগমন ঘটিল। সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ধনী জমিদারগণ রাষ্ট্রের শাসন কার্য পরিচালনা করিতেন। তাঁহারা বিলাসপ্রিয় হইয়া উঠিবার ফলে শৌর্যবীর্য ও কর্মক্ষমতা হারাইয়া ফেলেন। দুঃশাসন, যাজকদের অতিরিক্ত প্রভাব, অভ্যন্তরীণ অনৈক্য, শত্রুতা, ষড়যন্ত্র এবং প্রজাদের অসন্তুষ্টিই ভিজিগথ শাসন অবসানের প্রকৃত কারণ। খণ্ড বিখণ্ড ও ধ্বংসপ্রাপ্ত গথিক সাম্রাজ্য প্রতিরক্ষার দায়িত্ব অর্পিত ছিল অনিয়মিত বেতন প্রাপ্ত সেনাবাহিনীর উপর, যাহারা প্রভুর পক্ষে যুদ্ধ না করিয়া নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সুযোেগ বুঝিয়া শত্রুপক্ষে যোগদান করিত। এই অসন্তোষ ভিজিগথ সেনাবাহিনীর মধ্যে ভীষণ বিশৃঙ্খলা ও দুর্বলতার সৃষ্টি করে এবং ১২,০০০ সৈনিকের এক ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী ভিজিগথ শাসনকে প্রথম আঘাতেই সমূলে উৎখাত করে।

তথ্য নির্দেশ

১। এস. এম. ইমামউদ্দিন, সাম অ্যাসপেক্টস্ অব দ্যা সোশিও-ইকোনোমিক এ্যান্ড কালচারাল হিস্ট্রি অব

মুসলিম স্পেন (৭১১-১৪৯২), লেডেন, ১৯৬৫, পৃঃ ১-৯; চপম্যান, চার্লস ই, এ হিস্ট্রি অব স্পেন, নিউইয়র্ক, ১৯৫৪, পৃঃ ১-৫।

দ্রষ্টব্যঃ ডাবলার, ইউবার ডাস উইন্সক্যাফটসলিবেন, সুইজারল্যান্ড, ১৯৪৩, পৃঃ ৮। ৩। ক) আমীর আলী, হিস্ট্রি অব দ্যা স্যারাসিস, লন্ডন, ১৯৫১, পৃঃ ১০৬।

খ) ইমামউদ্দিন, সোশিও-ইকোনোমিক এ্যান্ড কালচারাল হিস্ট্রি অব মুসলিম স্পেন, লেডেন, ১৯৬৫, পৃঃ ১৫

গ) জার্নাল অব পাকিস্তান হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি, করাচি, ১৯৫৮, পৃঃ ১১৭ ৪। ক) ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, লন্ডন, ১৯১৩. পৃঃ ২১৫।

খ) উইলকিনসন, লিটেরেরি হিস্ট্রি অব দ্যা আরবস, পৃঃ ৪৩৫। ৫। ক) লুইস বারট্রান্ড, দ্যা হিস্ট্রি অব স্পেন, লন্ডন, ১৯৫৬, পৃঃ ১৮।

খ) জার্নাল অব পাকিস্তান হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি, ১৯৫৮, পৃঃ ১১৭। ৬। লুইস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯; এম, এম, ইমামউদ্দিন, আল-আন্দালুস, মাদ্রিদ, গ্রানাডা, পৃঃ ২১০-১১। ৭। ক) ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ২১৬।

খ) ইবনে খালিক্যান (অনুবাদ দ্য স্নেভ), ১১, পৃঃ ১৪, ৫৫৮। ৮। ডজি, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৯। ৯। ঐ পৃ. ২১৭-২১৮। ১০। আমীর আলী, হিস্ট্রি অব দ্যা স্যারাসিস, পৃঃ ১০৭; ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ২২৮। ১১। আমীর আলী, হিস্ট্রি অব দ্যা স্যারাসিস, পৃঃ ১০৬। ১২। দ্রষ্টব্যঃ এমিলিও গার্সিয়া গমেজ, হিস্টোরিয়া ডি ইস্পনা, ভল্ম ৪, মাদ্রিদ, ১৯৫০, পৃঃ ৪-৫। ১৩। ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ২২৩ ও টীকা ২; দ্রষ্টব্য দ্যা স্ট্রাকচার অব স্পেনিশ হিস্ট্রি, ১৯৫৪, পৃঃ ৬৩। ১৪। আন্দালুস, স্পেন আন্ডার দ্যা মুসলিমস, লন্ডন, ১৯৫৮, পৃ. ৫, ১০। ১৫। আমীর আলী, হিস্ট্রি অব দ্যা স্যারাসিন, পৃঃ ১০৭। ১৬। মুসার পিতা নুসাইরকে বন্দি হিসেবে আইন তামার থেকে আনা হয়। ১৭। ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ২৩১; দ্রষ্টব্য, স্পেন আন্ডার দ্যা ভিজিগথস, কেমব্রীজ মেডিয়াভ্যাল

হিস্ট্রি, ২য় খণ্ড, ১৯১৩, পৃঃ ১৮২। ১৮। ইবনুল আছির, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৪৪৩; স্পেন আন্ডার দ্যা ভিজিগথস, কেব্রীজ মেডিয়াভ্যাল হিস্ট্রি, ২য়

খণ্ড, কেমব্রীজ, ১৯১৩, পৃঃ ৮৪। ১৯। পি. কে. হিট্টি, হিস্ট্রি অব দ্যা আরবস, লন্ডন, ১৯৫১, পৃঃ ৪৯৪, টীকা-১। ২০। আন্দালুস, পৃঃ ২১। ২১। দ্রষ্টব্যঃ ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ২৩০।

অধ্যায় ১ / ২৩

সকল অধ্যায়

১. উপক্রমণিকা (মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাস)
২. প্রথম অধ্যায় : মুসলমানদের স্পেন বিজয়
৩. দ্বিতীয় অধ্যায় : দামেস্ক-খেলাফতের অধীন উমাইয়া আমীরদের শাসন
৪. তৃতীয় অধ্যায় : স্বাধীন উমাইয়া আমীরদের রাজত্ব
৫. চতুর্থ অধ্যায় : প্রথম হিশাম
৬. পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম হাকাম
৭. ষষ্ঠ অধ্যায় : দ্বিতীয় আবদুর রহমান
৮. সপ্তম অধ্যায় : প্রথম মুহাম্মদ
৯. অষ্টম অধ্যায় : মুনজির ও আবদুল্লাহ
১০. নবম অধ্যায় : উমাইয়া খিলাফত
১১. দশম অধ্যায় : দ্বিতীয় হাকাম
১২. একাদশ অধ্যায় : হাজীব আল-মনসুর
১৩. দ্বাদশ অধ্যায় : স্পেনে উমাইয়া খিলাফতের পতন
১৪. ত্রয়োদশ অধ্যায় : স্পেনের উত্তরাঞ্চলে খ্রীস্টান রাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয়
১৫. চতুর্দশ অধ্যায় : প্রথম পর্যায় ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহ
১৬. পঞ্চদশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পর্যায় – উত্তর আফ্রিকার শাসন
১৭. ষষ্ঠদশ অধ্যায় : তৃতীয় পর্যায়ঃ নাসরী রাজবংশ
১৮. সপ্তদশ অধ্যায় : মরিস্ক জাতি
১৯. অষ্টাদশ অধ্যায় : স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের কারণসমূহ
২০. উনবিংশ অধ্যায় : শাসনকার্য ও প্রশাসন
২১. পরিশিষ্ট-ক : ইক্রিতিশে কর্ডোভান মুসলমানদের শাসন
২২. পরিশিষ্ট-খ : স্পেনে মুসলিম শাসকদের বংশানুক্রমিক তালিকা
২৩. পরিশিষ্ট-গ : উত্তর-স্পেনে খ্রিষ্টান শাসকদের কালানুক্রমিক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন