তৃতীয় পর্যায়
(১২৩২-১৪৯২ খ্রীঃ)
ষষ্ঠদশ অধ্যায়
(৬২৯-৮৯৮ হিঃ/ ১২৩২-১৪৯২ খ্রীঃ)
১। বানু নাসর রাজবংশের পরিচয় ও উথান
মুসলিম স্পেনের সর্বশেষ দুর্গ ছিল গ্রানাডা রাজ্য। ৭০০ বর্গমাইল ব্যাপী এই রাজ্য সিয়েরা দ্য এলভিরা ও সিরানিয়া দ্য রোন্ডাকে পরিবেষ্টন করিয়া আলমেরিয়ার উপকূল হইতে জিব্রাল্টার প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যদিও বাউজুল মিতারের’ লেখকের মতে, গ্রানাডা প্রতিষ্ঠিত হয় মুলুকুল তাওয়াইফের রাজত্বকালে। আলরাজী, ইবনুল খাতিব, ইয়াকুত ও কাজবিনী মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, এলভিরা জোস্টার একটি প্রাচীন নগর। এবং ইহা ইহুদিদের নগর অথবা ইহুদিদের গ্রানাডা’ বলিয়া পরিচিত ছিল। আলমেরিয়ার স্লভ শাসক খায়রানের সম্ভাব্য আন্দোলনে ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া এলভিরার অধিবাসীগণ জাবী বিন জিরির নেতৃত্বে তাহাদের নগরী পরিত্যাগ করে এবং বিধ্বস্ত নগরী গ্রানাডাকে সুরক্ষিত ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর সেখানে বসতি স্থাপন করে। গ্রানাডার চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত পর্বতমালা জিরিদের জন্য প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাজ করে। গ্রানাডার উর্বর কৃষি ভূমিতে জেনিল নদী হইতে পানি সেচের ব্যবস্থা ছিল। জিরিদের বসতি স্থাপনের একশত একচল্লিশ বৎসর পর গ্রানাডায় বানু নাসর গোত্রের একুশজন শাসক একের পর এক রাজত্ব করেন। মদীনার খাজরাজ গোত্রের প্রধান এবং হযরত মুহাম্মদের ছাহাবা সাদ বিন উবাদার বংশধর বলিয়া তাহারা দাবী করিতেন। তাহারা মুসলিম শাসনের প্রথম যুগে স্পেনে আসেন এবং উমাইয়া সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ও সেনাধ্যক্ষ হিসাবে বহাল ছিলেন।
স্পেনে মুয়াহিদিন শাসকদের ক্ষমতা হ্রাস পাইবার পর ভ্যালেন্সিয়ার বানু মারদানিশ ও মুরসিয়ার বানু হুদ নামে দুইটি প্রভাবশালী পরিবার জনগণের আত্মকলহের সুযোগ লইয়া স্পেনের পূর্বাঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। মদীনা হইতে আগত বানু নাসের নামে অপর একটি পরিবারও এই সুযোগ গ্রহণ করে। তাহাদের প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ বিন ইউসুফ বিন আহম্মদ বিন নাসর। তিনি সাধারণতঃ এবনে আল আহমার নামে পরিচিত ছিলেন। স্পেনের বিশ মাইল উত্তরে কার্ডোভা অঞ্চলের অন্তর্গত আরজোনা বন্দরের প্রধান ছিলেন তিনি। বানু নাসর ও বানু আশকাবিলাহ গোত্রের মধ্যে তাহার সমর্থক দেখিতে পাইয়া ১২৩১ খ্রীঃ তিনি নিজেকে আরজোনার স্বাধীন শাসক বলিয়া ঘোষণা করেন। জায়েন, গোয়াদিকস ও বায়েজার অধিবাসীগণ পরবর্তীকালে তাহার পতাকা তলে সমবেত হয়। বানু হুদের
বিরুদ্ধে মুহাম্মদ ক্যাস্টিলের রাজার সহিত মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি প্রথম ফার্ডিনান্ডকে সেভিল অবরোধে (১২৪৮ খ্রীঃ) এবং কারমোনা ও অন্যান্য স্থানসমূহের শক্তি হ্রাসে সহযোগিতা করেন। তাহাদের সাহায্যে তিনি ১২৩৫ খ্রীস্টাব্দে গ্রানাডা এবং ১২৩৮ খ্রীস্টাব্দে মালাগা ও আলমেরিয়া দখল করেন। ১২৬৪ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত লোরকা শহর অধিকারে আসে নাই।
গ্রানাডা অধিকারের পর মুহাম্মদ আল আহমার (১২৩১১২৭২ খ্রীঃ) তাহার প্রশাসনিক দপ্তর সেখানে স্থাপন করেন এবং আল-গালিব বিল্লাহ খেতাব ধারণ করেন। গ্রানাডা ক্রমশঃ দুইটি সমান্তরাল পাহাড় হইতে উত্তরে দারো-জেনিল সমতল ভূমি, আলবাছিন ও আল-হামরা এবং দক্ষিণে দারোর উভয় পার্শ্ব লইয়া জেনিল পর্যন্ত সম্প্রসারিত। দামেস্কের গুতাহর ন্যায় বহু নদী বিধৌত গ্রানাডার সমতল ভূমি অতি অল্পদিনের মধ্যে মুসলিম স্পেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। খ্রীস্টানদের অমানুষিক অত্যাচারের কবল হইতে বহু পণ্ডিত ব্যক্তি, বৈজ্ঞানিক ও শিল্পী এবং অন্যূন ১০০,০০০ লোক গ্রানাডায় আশ্রয় গ্রহণ করে ও এই নগরীকে সমৃদ্ধশালী করিয়া গড়িয়া তোলে। গ্রানাডা নগরীর দক্ষিণ-পূর্বে অবিস্থত পাহাড়ের উপরে মুহাম্মদ এবনে আল-আহমার নিজের জন্য বিখ্যাত দুর্গ ও আল-হামরা (স্পেনে : আলহাম্রা) প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তাহার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে দ্বিতীয় মুহাম্মদ, প্রথম ইউসুফ ও পঞ্চম মুহাম্মদ এই প্রাসাদকে আরও সম্প্রসারিত ও সুসসাভিত করেন। আল-গালিব বিল্লাহ গ্রানাডা রাজ্যে তাহার শক্তিকে সুসংহত করেন। ইহা ছিল মুসলমানদের শক্তিশালী দুর্গ। এখান হইতেই মুসলমানগণ উদীয়মান খ্রীস্টান শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘ দুইশত বৎসর ধরিয়া আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ পরিচালনা করে।
আলগালিব শুধু একজন সুদক্ষ সেনাপতিই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিবিদও। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে তিনি খ্রীস্টানদিগকে সাহায্য করেন। সেই সাথে তিনি ভবিষ্যতে খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিও গ্রহণ করেন। মুসলমানগণ নাসরী শাসনাধীনে কিছু দিনের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। স্পেনের উত্তর অঞ্চলের উদীয়মান খ্রীস্টান শক্তি শহরের পর শহর জয় করিয়া খোদ গ্রানাডা শহর অধিকার না করা পর্যন্ত তাহারা শান্তিতে জীবন যাপন করে। আরাগণের প্রথম জায়মে ভ্যালেন্সিয়া অধিকার করেন এবং ক্যাস্টিলের ধর্মপ্রাণ শাসক তৃতীয় ফার্ডিনান্ড জায়েন অবরোধ করিয়া দক্ষিণ অঞ্চলের বহু এলাকা দখল করেন। এবনুল আহমার নিজের দুর্বলতা অনুভব করিতে পারিয়া আত্মসমর্পণ করেন। বাৎসরিক কর প্রদান ও খ্রীস্টানগণের ন্যায় ক্যাস্টিলের দরবারে যোগানদার ও যুদ্ধের সময় সেনা সরবরাহের শর্তে উভয়ের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। সেই সময় হইতেই মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা চিরতরে অবলুপ্ত হয়। বাহ্যিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক হইতে গ্রানাডার অধিবাসীগণ খ্রীস্টানদের অধীন হইয়া পড়ে। এবং ক্যাস্ট্রিলীয় আচার আচরণ গ্রহণ করে।
নাসিরীর শাসকগণও তাহাদের প্রজাকুল খ্রীস্টানদের পোষাক পরিধান করিতে শুরু করে এবং নিজদিগকে খ্রীস্টান রীতিপদ্ধতিতে চিহ্নিত করিতে থাকে এ সম্পর্কে সমসাময়িক কালের মুসলিম লেখক এবনুল খাতিব এবনে খালদুন ও এবনে সাদ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন যে, আসবিয়াহর অনুপ্রেরণা আরব ও বার্বারদের ঐক্যের শক্তির যে উৎস ছিল, তাহা চিরতরে বিলুপ্ত হয় এবং তদস্থলে ব্যক্তি ও পরিবারিক অনুভূতির জন্ম নেয়।
শান্তিচুক্তি সম্পাদনে তৃতীয় ফার্ডিনান্ডের উদারতার অন্তরালে অপরাপর মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বানু নাসরদের কূটষড়যন্ত্র নিহিত ছিল। তৃতীয় ফার্ডিনান্ড সেভিল অবরোধ করিলে এবনুল আহমার ৫০০ সুদক্ষ সেনা লইয়া তাহাকে নীতিগতভাবে সাহায্য করিতে অগ্রসর হন। এইভাবে গ্রানাডার মুসলিম সেনাগণ তাহাদের একই ধর্মে বিশ্বাসী সেভিলবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। সন্ধি শর্তে ১২৪৮ খ্রীস্টাব্দে সেভিল আত্মসমর্পণ করে। বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জন্য খ্রীস্টানদের মধ্যে ইবনে আল-আহমারের সুনাম হইলেও তিনি নিজে ইহার জন্য অনুতপ্ত হন। কারণ গ্রানাডা পতনের ইহা ছিল পূর্ব সংকেত। তিনি ভগ্ন হৃদয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। পরবর্তী সময়ে খ্রীস্টান সামরিক অস্ত্র এই রাজধানীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। ইহা সত্ত্বেও গ্রানাডায় তাহাকে অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়। বানু নাসরদের দ্বারা বহু আকাক্ষিত ক্ষণস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইলে জনগণ তাহাকে গালীব (বিজয়ী) উপাধি প্রদান করেন। যদিও এই শান্তি চুক্তি ছিল তাহাদের রাজনৈতিক অধিকারের পরিবর্তে। নাসরী শাসক বিপদ আশঙ্কা করিয়া তাহার রাজ্যকে সুরক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত করেন।
মুহাম্মদ বিন ইউসুফ মুসলমানদের শত্রু ক্যাস্টিলের রাজাকে বিশ্বাস করিতেন না। তিনি সেনাবাহিনীকে সুসংগঠিত বিশেষ করিয়া সীমান্তে জিব্রাল্টারে নতুন দুর্গ নির্মাণ, পুরাতন দুর্গ সংস্কার এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনা নিয়োগ করেন। মৌরিতানিয়ার মারিনী শাসকদের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং খুতবাতে নিজের নামের সহিত তাহাদের নামও যুক্ত করেন।
সামরিক প্রস্তুতি সমাপনান্তে এবনুল আহমার খ্রীস্টানদিগকে বিতাড়িত করিবার উদ্দেশ্যে অতি গোপনে মেদিনা, সিদোনিয়া, মুরসিয়া ও আরকোসের জনগণকে খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে সাহায্য করেন। খ্রীস্টানগণ এই সকল এলাকা দখল করিয়াছিল এবং গ্রানাডাও অধিকার করিবার পরিকল্পনা লইয়াছিল। খ্রীস্টানদিগকে কর্ডোভা হইতেও বিতাড়িত করিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইয়াছিল কিন্তু ইহা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। খ্রীস্টানগণ ১২৩৬ খ্রীঃ কর্ডোভা পুনর্দখল করে। ১২৬১ খ্রীঃ লাড়াইয়াল দুর্গের সন্নিকটে তীব্ৰযুদ্ধে খ্রীস্টানগণ শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু
মালাগা ও ওয়াদী আশ (গোয়াদি) এর মুসলিম গভর্নরদ্বয় উলামাদের উৎসাহে খ্রস্টানদের সহিত মিলিত হন। উলামাগণ মৌরিতানীয়দের তুলনায় খ্রীস্টানদিগকে পছন্দ করিতেন। খ্রীস্টানগণ এখন দশম আলফলোর নেতৃত্বাধীনে গালিবকে হুমকি প্রদান করিতে শুরু করেন। গালিব ২৫০,০০০ দিনার কর প্রদানের পরিবর্তে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করিতে বাধ্য হন। চুক্তি সম্পাদনের অল্পদিন পরে দশম আলফন্সে বানু আশ কাবিলাহ, মালাগা ও গোয়াদিক্সের গভর্নরদ্বয়কে তাঁহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতে প্ররোচিত করেন। ডন নুনিও দ্য লারা ও আলফলোর বিদ্রোহী ভ্রাতা ডন ফিলিপের অধীনে বহু সংখ্যক খ্রীস্টান আল-গালিবের পক্ষ অবলম্বন করে। আল-গালিব বিরাট সেনাবাহিনী সংগ্রহ করিয়া বিদ্রোহী গভর্নরদ্বয় ও তাহাদের সমর্থকদের শাস্তি দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু ১২৭২ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর ৭৯ বৎসর বয়সে তাহার অসমাপ্ত দায়িত্বকে পরবর্তী বংশধরদের হস্তে অৰ্পণ করিয়া দেহ ত্যাগ করেন।
নাসরী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আল-গালিব ছিলেন স্পেনের একজন সফল শাসক ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। সুশিক্ষিত ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবনুল আহমার অতি অল্প বয়সেই আরজোনা ও জায়েনের গভর্নর পদ অলংকৃত করেন। তাহার সদয় নীতির জন্য তিনি রাজ্যের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বানু হুদের পতনের পর তাইফাদের মধ্যে অনৈক্য মাথা চাড়া দিয়া ওঠে। এবনুল আহমার এই সুযোেগ যথাযথভাবে ব্যবহার করেন এবং জনগণ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে প্রদত্ত সিংহাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি গ্রানাডাতে জিরি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাহার দক্ষতার জন্য সঙ্কটাপন্ন দুর্দিনে মুসলমানদের সম্মান রক্ষা পায় এবং তাহার শাসন সফল বলিয়া প্রমাণিত হয়। তিনি বিভিন্ন শহরের শাসন কার্যে যোগ্য ও বিশ্বাসী লোক নিয়োগ করেন। তিনি পুলিশ বিভাগকে সুবিন্যস্ত ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ছিলেন সুবিচারক, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকে সপ্তাহে একবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিত। তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি, ধর্মবেত্তা ও বিচারকদের সহিতও সপ্তাহে দুইবার মিলিত হইতেন। দরিদ্র ও নিঃস্বদের মধ্যে প্রতি শুক্রবার অর্থ সামগ্রী বিতরণ করিতেন। জনকল্যাণমূলক কার্যে তাহার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে তিনি সড়ক ও সেতু নির্মাণ করেন। দরিদ্র অন্ধ ও বৃদ্ধদের জন্য আশ্রয়স্থল এবং রুগ্ন ব্যক্তিদের জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করেন। হাসপাতালগুলি অভিজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ চিকিৎসক দ্বারা পরিচালিত হইত। তাহার সময় হাম্মাম ও ঝর্ণা নির্মিত হয়। পানি বিতরণের সর্বোত্তম পন্থা প্রয়োগ করিয়া পানি বহনের জন্য এসেকুইয়া রিয়াল (Acequia Real) নির্মাণের মাধ্যমে ডায়রা নদী হইতে প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত প্রাসাদে, বাগানের ঝর্ণা ও স্নানাগারে পানি সরবরাহ করা হইত। এই এসেকুইয়া রিয়াল এখনো বিদ্যমান। ইহা এবনুল আহমারের সময়কার গ্রানাডার প্রকৌশলীদের পানি-প্রযুক্তির কথা আমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেয়। তিনি ছিলেন শিল্প সাহিত্যের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্প্রসারণের জন্য তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত করেন, সেখানে কর্ডোভার উমাইয়া লাইব্রেরির বিখ্যাত ও দুষ্প্রাপ্য পুস্তকসমূহ সংরক্ষিত হয়। ন্যায্যমূল্যে দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, গোস্ত ও রুটির জন্য সরবরাহ কেন্দ্রের প্রচলন। করেন। তিনি কৃষি শিল্প ও স্থাপত্যের সীমাহীন উন্নতি সাধন করেন। তিনি অশ্ব ও অন্যান্য পশু পালন ও প্রজননে জনগণকে উৎসাহিত করিতেন। তাহার সময়ে রেশম শিল্পের উন্নয়ন সাধিত হয়। খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে স্বর্ণ ও রৌপ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সংক্ষেপে বলা যায় মুসলমান-স্পেনের সাংস্কৃতিক জীবনে পুনর্জীবন ঘটে। গ্রানাডাতে ভয়াবহ রূপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সে সময় শহরের পাহাড়ে ও সমতল ভূমিতে প্রায় ১৫০,০০০ লোক বসবাস করিত।
নাসরীয় শাসনের শেষদিকে স্পেনীয় মুসলমানগণ দেওয়াল চিত্র অংকনে বিশেষ আগ্রহ ও উৎসাহ দেখান। এইসব চিত্রের খুব সামান্যই আজ অবশিষ্ট আছে। এই দেওয়াল চিত্রের কিছু নিদর্শন আলহামরা প্রাসাদের তোরণে দেলাস দামানা নামক কক্ষে দেখিতে পাওয়া যায়। এইসব চিত্রে সোনালী রঙসহ এক ডজনেরও অধিক রঙ ব্যবহৃত হইয়াছে। কতিপয় চিত্রে নারীমূর্তিসহ ঘরোয়া উৎসব ও শিকারের দৃশ্য দেখান হইয়াছে। শিকারীসহ শিকারীকুকুর ও পশুর বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে। এই চিত্রশিল্পে সমসাময়িক কালের ইরানী চিত্রাংকন রীতি, মিশরীয় পদ্ধতির অলঙ্করণ ও খ্রীস্টানদের ক্ষুদ্রাকৃতি শিল্পের প্রভাব দৃষ্টিগোচর হয়। আলহামরার অন্যান্য অংশ যেমন—পাতিও দেলস লিওনেস ও পাতিও দেলা আল-ফোরকাতে সিংহ ও অন্যান্য জীব-জন্তুর চিত্র দেখিতে পাওয়া যায়।
(১২৭২-১৩০২ খ্রীষ্টাব্দ)
দ্বিতীয় আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাঁহার পিতা আল-গালিবের স্থলাভিষিক্ত হন। দ্বিতীয় মুহাম্মদ ছিলেন একজন বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন। তিনি ছিলেন বহু ভাষায় বিজ্ঞ ও পন্ডিত। রাজকার্য সম্পাদনের পর তিনি দার্শনিক ও বিচারকদের সহিত আলোচনা বৈঠকে বসিতেন। বিচারক হিসাবে তিনি আল-ফকিহ উপাধি ধারণ করেন। তাঁহার পিতা কর্তৃক নিযুক্ত সরকারি কর্মচারীগণকে তিনি বহাল রাখেন এবং বিদ্রোহী গভর্নরগণকে আন্তেকুয়েরায় আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য করেন। দশম আলফন্সে ও দ্বিতীয় মুহাম্মদের মধ্যে এই শর্তে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয় যে, আলফন্সে তাঁহার বিদ্রোহী ভ্রাতা ডেল ফিলিপকে তাহার জায়গীরে পুনর্বহাল করিবেন।
রাজ্যকে পূর্ণ গোলযোগের মধ্যে নিক্ষেপ করিয়া দশম আলফন্সে গ্রানাডা ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় মুহাম্মদ তাহার অনুসৃত নীতি সঠিকভাবে বুঝিতে পারেন। তিনি মরক্কোর মারিনী রাজা আবু ইয়াকুব বিন আবদুল হককে ৫০,০০০ সৈন্যসহ খ্রীস্টান-স্পেনকে আক্রমণ করিবার আহ্বান জানান। ১০৭৪ খ্রীঃ গ্রানাডা আক্রমণকারী লারা নুনিও
গঞ্জালেজের নেতৃত্বে খ্রীস্টানদের সহিত এক মরাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে সেনাপতিসহ প্রায় ৮,০০০ খ্রীস্টান নিহত হয়। আরাগোনের প্রথম জেমসের পুত্র সাঞ্চোর সেনাপতিত্বে অপর এক খ্রীস্টান বাহিনী জায়েনের সন্নিকটে পরাজয় বরণ করে। অসংখ্য সৈন্যসহ সাঞ্চো নিহত হন। এই বিরাট সাফল্যের প্রতিদান স্বরূপ দ্বিতীয় মুহাম্মদ মরক্কোর রাজাকে আল-জাজিরাহ (আলজেসিরাস) ও তায়িফা অর্পণ করেন। আফ্রিকার সৈন্যদের স্পেন ত্যাগের অব্যবহিতপর খ্রীস্টানগণ আল-জাজিরাহ অবরোধ ও গ্রানাডা আক্রমণ করে এবং ভেগার উদ্যানসমূহকে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করে। শেষ পর্যন্ত খ্রীস্টানগণ পরাজিত ও বিতাড়িত হয়। ইহার পর খ্রীস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে জয়-পরাজয় নির্ধারণহীন যুদ্ধ চলে। নাসরী শাসক তাঁহার রাজ্যকে শক্তিশালী করিবার উদ্দেশ্যে ১০০০,০০০ স্বর্ণ মিথকালের (প্রায় ৪৬৯ সের) বিনিময়ে মরক্কোর রাজার নিকট হইতে আল-জাজিরা ক্রয় করিয়া নেন। বিশ বৎসর দক্ষতার সহিত রাজকার্য পরিচালনার পর দ্বিতীয় মুহাম্মদ ১৩০২ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে নামাজ আদায়রত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
(১৩০২-১৩০৯ খ্রীস্টাব্দ)
দ্বিতীয় মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তাহার পুত্র তৃতীয় মুহাম্মদ যিনি পরবর্তীকালে ‘আল মাখলু’ (সিংহাসন চত) নামে পরিচিতি লাভ করিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। যদিও তাহার অধিকাংশ সময় বিদ্রোহ দমন ও শত্রুর সহিত যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। তথাপিও তিনি রাজ্যের বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি বিধানে সক্ষম হন। তাহার স্থাপত্য কর্মের মধ্যে বিখ্যাত জামে মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গ্রানাডার পতনের পর খ্রীস্টানগণ উহাকে গীর্জায় পরিণত করে।
১৩০৫ খ্রীস্টাব্দে আলমেরিয়ার গভর্নর সুলায়মান আরাগণদের প্ররোচনায় নিজেকে স্বাধীন বলিয়া ঘোষণা করিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ধৃত হইয়া কারারুদ্ধ হন। তিনি গোয়াদিক্সের গভর্নরের বিদ্রোহ সফলতার সহিত দমন করেন। খ্রীস্টানগণ জিব্রাল্টার অধিকার ও আল জাজিরাহ অবরোধ করেন। কুয়েসাদা বেদমার ও কুয়াদা রস প্রভৃতি সীমান্ত শহর সমর্পণ করিলে তাহারা অবরোধ প্রত্যাহার করে। ১৩০৯ খ্রীস্টাব্দে মুহাম্মদের চাচা আবুল জইয়ুশ নসর বিন মুহাম্মদ বিদ্রোহ ঘোষণা করিলে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করেন। তৃতীয় মুহাম্মদ আলমুনেকার দুর্গে পাঁচ বৎসর বন্দী জীবন যাপন করেন।
আল নসর বিন মুহাম্মদ বিদ্যাশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। তাহার সময়ে দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয় এবং সেগুলির পাণ্ডুলিপি নকল করাইয়া প্রকাশ করেন। নতুন প্রযুক্তির ঘড়ি আবিষ্কৃত হয় ও জনগণের ব্যবহারের জন্য দালান কোঠা নির্মিত হয়।
কিন্তু আল-নসর ছিলেন একজন ভাগ্যহীন রাজা। পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাহার শাসন শান্তিপূর্ণ ও নিরুপদ্রব ছিলোনা। সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই ক্যাস্টিলের রাজা চতুর্থ ফার্ডিনান্ড আলজেসিরাস আবরোধ করেন। বাৎসরিক কর দানের প্রতিশ্রুতিতে ফার্ডিনান্ড ইহা ত্যাগ করেন। তাহার ভ্রাতুস্পুত্র সিংহাসন অধিকার করিবার জন্য চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হন। এবং তাহার পিতা মালাগার গভর্নরের নিকট পলাইয়া যান। এক সময়ে নসর অসুস্থ হইয়া পড়িলে তৃতীয় মুহাম্মদ সিংহাসন দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া কারারুদ্ধ হন। এই সময়ে চতুর্থ ফার্ডিনান্ডের মৃত্যু ঘটিলে তের মাসের পুত্র একাদশ আলফন্সে তাহার স্থলাভিষিক্ত হন। ক্যাস্টিল রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পারিষদবর্গ ও গভর্নরদের মধ্যে আত্মকলহ শুরু হয়। এই সময় মুসলমানগণ ক্যাস্টিল ব্যতীত স্পেনের অন্যান্য অংশ পুনর্দখল করিতে পারিত কিন্তু গ্রানাডায় মুসলিম সম্ভ্রান্ত সন্তানদের মধ্যে তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান ছিল। ১৩১৪ খ্রীস্টাব্দে আল নসর তাহার ভ্রাতুস্পুত্র ইসমাইল নামে সুপরিচিত আবুল ওয়ালিদের পক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। পরে গুয়াদিক্সের গভর্নর পদ গ্রহণ করেন এবং সেখানে ১৩২২ খ্রীস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন।
আবুল ওয়ালিদ ইসমাইল বিন ফারাজ ছিলেন নাসরী রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ভ্রাতা ইসমাইলের পৌত্র প্রথম ইসমাইল ১৩১৯ খ্রীঃ শক্তিশালী দুর্গ বায়েজা অবরোধ করেন। তিনি শায়খুল গোজাত আবু সাইদ উসমানের সাহায্যে আলীকুম ও সিয়েরা দে এলভিরাতে ক্যাস্টিলীয়দের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। শেষ যুদ্ধে রাজা একাদশ আলফন্সের অভিভাবক ডন জোয়ান ও ডন পেডরো নিহত হয়। হুয়েস্কার গালেরা ও বায়েজার পতন ঘটে। পরবর্তী বৎসর জায়েনের ১৬ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মারতোসা অধিকারে আসে। নাসরী রাজের নিকট আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী জনগণকে হত্যা করা হয়। তিনি তারিফা ও রোন্ডা যাহা দীর্ঘদিন পূর্বে মারিনীদের অধিকারে চলিয়া গিয়াছিল উহা পুনরুদ্ধার করেন। এই বিজয়ের পর ইসমাইল আনন্দ উৎসব মুখর পরিবেশে গ্রানাডায় প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু তিনদিন পর ১৩২৫ খ্রীস্টাব্দে আলজেসিরাসের শাসক তাহার পিতৃব্যপুত্র মুহাম্মদ বিন ইসমাইল কর্তৃক তিনি নিজ প্রাসাদে নিহত হন। ইসমাইল পুলিশ বিভাগ ও প্রশাসন দফতরের পুনর্বিন্যাস এবং সীমান্তকে সংরক্ষিত করেন। জনগণ তাহার সদয় শাসনাধীনে খুব সুখে শান্তিতে ছিল।
(১৩২৫-৩৩ খ্রীস্টাব্দ)
প্রথম ইসমাইল চার পুত্র রাখিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন। জ্যেষ্ঠ পুত্র আবু আব্দুল্লাহ চতুর্থ মুহাম্মদ ১২ বৎসর বয়সে ১৩২৫ খ্রীঃ জুলাই মাসে গ্রানাডার সিংহাসনে আরোহণ করেন। ধূর্ত ও স্বার্থপর প্রধানমন্ত্রী আলমাহরুক ছিলেন তাহার অভিভাবক। তিনি বিজ্ঞ পারিষদবর্গ ও চতুর্থ মুহাম্মদের
ভ্রাতাদিগকে রাজধানী হইতে অপসারণ করেন। পূর্ণ বয়সে রাজা নিজেকে কর্মঠ উৎসাহী ও সৎ শাসক বলিয়া নিজেকে প্রমাণিত করেন। তিনি আল মাহরুককে কারারুদ্ধ করিয়া প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন এবং এবনে ইয়াহিয়াকে তাহার প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। রাজকীয় দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান উসমান আন্দ্রাক্সে পলায়ন করে এবং ক্যাস্টিলিয়ন ও ইফ্রিকিয়ার বানু মারিন শাসক সুলতান আবুল হাসান আলীকে গ্রানাডা আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। আফ্রিকার জনগণ আলজেসিরাস অধিকার করে। আলজেসিরাসের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ইবনে ইয়াহিয়া নিহত হন। তাহারা রোন্ডা ও মারবেল্লা (মন্টে মেয়র) অধিকার করে এবং গ্রানাডা অভিমুখে অগ্রসর হয়। রাজা স্বল্প সংখ্যক অনুগত বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ সেনা বাহিনীর সাহায্যে তাহার আক্রমণই শুধু প্রতিহত করেন না বরং আফ্রিকার অনেক অঞ্চল একের পর এক অধিকার করেন। তিনি খ্রীস্টানদিগকে কাসারেসে পরাজিত করেন। এইরূপে কয়েক মাসের মধ্যেই তাহার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিয়া অতি অল্প বয়সে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন। ক্যাস্টিলীয়দের অধিকৃত জিব্রাল্টার তিনি ১৩৩৩ খ্রীস্টাব্দে পুনরুদ্ধার করেন। খ্রীস্টানদের সহিত শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পর দুর্গ পরিদর্শন করিয়া প্রত্যাবর্তনের পথে চতুর্থ মুহাম্মদ খ্রীস্টান গুপ্তঘাতক কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া নিহন হন।
মৃত আমীরের ভ্রাতা প্রথম আবু হাজ্জাজ ইউসুফকে মন্ত্রী রিজওয়ান গ্রানাডার সিংহাসনে বসান। তাহার বংশের মধ্যে তিনিই ছিলেন অত্যন্ত সুশিক্ষিত ও সার্বভৌম শাসক। ফেজের (মরক্কো) বিখ্যাত রাজা আবুল হাসান ১৩৩৯ খ্রীস্টাব্দে আবুল মালিককে স্পেন অধিকার করিবার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি আলজেসিরাস ও জিব্রাল্টার অধিকার করিতে সক্ষম হন। কিন্তু পাগানায় খ্রীস্টানদের হস্তে পরাজিত হইয়া দশ হাজার সৈন্যসহ আবুল মালিক নিহত হন। পরবর্তী বৎসর আবুল হাসান বিরাট বাহিনী লইয়া খ্রীস্টানদিগকে আক্রমণ করিয়া ক্যাস্টিলীয় শক্তিকে ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম উপকূল হইতে উত্থাত করেন। তিনি গ্রানাডার আমীর প্রথম ইউসুফের সহযোগিতায় তারিফাহর সুদৃঢ় দুর্গ অবরোধ করেন। আরাগণ পতুর্গাল ও ক্যাস্টিলের সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া তারিফাহ রক্ষার্থে অগ্রসর হয়। ১৩৪০ খ্রীস্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর সালাদো নদীর মোহনার নিকটে যুদ্ধ হয়। হটকারী করিয়া মুসলিম সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং তাহাদের অনেকেই নিহত হয়। প্রথম ইউসুফ ও আবুল হাসান সমুদ্র পথে তাহাদের রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিতে সক্ষম হন। যুদ্ধের সময় আক্রান্ত হইয়া একাদশ আলফলো মৃত্যু মুখে পতিত হন। খ্রীস্টানগণ নারী শিশু নির্বিশেষে মুসলমানদিগকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সালাদোর যুদ্ধের পর আফ্রিকার জনগণ চিরদিনের জন্য স্পেন অভিযানের ইচ্ছা ত্যাগ করেন। গ্রানাডার শাসকগণ ইহার পরবর্তী সময়ে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন।
তারিফাহ ও আল-জাজিরাহ বিজয়ের পর ক্যাস্টিলীয়গণ নাসরীয়দের সহিত দশ বৎসরের জন্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। এই সময়ে খ্রীস্টানগণ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত থাকায় প্রথম ইউসুফ জনকল্যাণমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি শিল্পকলা, স্থাপত্য, সাহিত্য চর্চা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের একজন অতি উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাহার সময়ে আলহামরার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে ও সম্প্রসারিত হয়। এবং আলহামরার বাবুল সারী (বৃহৎ ফটক তোরণ) নির্মিত হয়। তাঁহার সময়ে নির্মিত আলহামরার মধ্যে বানো রেজিও, পুয়ের দেলা জাষ্টিসিয়া, ও কাসারিয়েল আজও বিদ্যমান। ইউসুফ কর্তৃক নির্মিত কামরাসমূহের গাত্রে তাহার নাম খোদিত ছিল। বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত আলকাজার তিনি নির্মাণ করেন। সীসার পাইপের সাহায্যে সিয়েরা নেভাদা নদী হইতে গ্রানাডা নগরীতে পানি আনিয়া মার্বেল পাথরে প্রস্তুত চৌবাচ্চাতে সংরক্ষণ করা হইত। বারটি মুসলিম পরিবারের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিটি মহল্লায় একটি করিয়া মসজিদ এবং তদসংলগ্নে এতিম খানা ও অনাথ আশ্রম ছিল। প্রতি গ্রামে মসজিদ ও স্কুল নির্মাণ করা হয়। গ্রানাডার বিখ্যাত মাদ্রাসাটি ১৩৪৯ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত হয়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও পদার্থ বিদ্যার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ ইবনে বইতার সেই সময়ের প্রসিদ্ধ উদ্ভিদবিদ ছিলেন। ইউসুফের স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। তিনি ছিলেন কাব্যে সুপণ্ডিত। তিনি শহর গড়িয়া তোলেন এবং রাত্রিকালে প্রহরী নিয়োজিত করেন। পুলিশ বিভাগের উন্নয়ন সাধন করেন। প্রতিটি বাজারে একজন করিয়া অফিসার নিয়োগ করেন। তাহারা জনগণের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি রাখিতেন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করিতেন। তিনি নির্ভীক ছিলেন বলিয়া আক্রান্ত হওয়া সত্তেও রক্তপাতের পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি শক্তিশালী দেহের ও মানসিক দিক হইতে মহৎ চিন্তার অধিকারী ছিলেন। ইউসুফ এতই উদারচেতা শাসক ছিলেন যে, জিব্রাল্টার অবরোধকালে একাদশ আলফন্সে স্পেনে আক্রান্ত হইয়া নিহত হইলে তিনি আনন্দিত না হইয়া দুঃখ প্রকাশ করেন। এবং জিব্রাল্টার হইতে সেভিল পর্যন্ত শোক মিছিল অতিক্রমের অনুমতি দান করেন। তাঁহার ন্যায় ও সদয় প্রশাসনে জনগণ সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন যাপন করে। স্পেনীয় মুসলমানদের দুর্ভাগ্য যে, ইউসুফের ন্যায় সুশাসক দেশ ও জাতির খেদমতের জন্য অধিক দিন জীবিত ছিলেন
মসজিদে নামাজ পড়ার সময় ১৩৫৪ খ্রীস্টাব্দে ১৯ শে অক্টোবর তিনি জনৈক মাতাল কর্তৃক ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
(১৩৫৪-৫৯ খ্রীস্টাব্দ)
ইউসুফের মৃত্যুর পর তাহার সুযোগ্য পুত্র পাণ্ডিত্য ও সুরুচিসম্পন্ন পঞ্চম মুহাম্মদ আল-গনি বিল্লাহ’ উপাধি ধারণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি দেশ হইতে দুষ্কৃতকারীদের বিতাড়িত করেন। কিন্তু ১৩৫৯ খ্রীস্টাব্দে তাহারা পঞ্চম মুহাম্মদকে হত্যা করিয়া তাহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ইসমাইলকে সিংহাসনে বসাইবার জন্য তাহার বিমাতার সহিত যোগসাজশে ষড়যন্ত্রে
লিপ্ত হয়। পঞ্চম মুহাম্মদ কোন রকমে জীবন রক্ষা করিয়া গোয়াক্সি-এ পলায়ন করেন এবং সেখান হইতে ১৩৫৯ খ্রীস্টাব্দে ফেজে গমন করেন।
ইসমাইল বিন ইউসুফ ছিলেন একজন অযোগ্য শাসক। তাহার ভগ্নীপতি ও প্রধান উপদেষ্টা আবু সাঈদ প্রজাদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন করিত, ফলে বিদ্রোহ দেখা দেয় ১৩৬০ খ্রীঃ বিদ্রোহীদের হস্তে অযোগ্য ও অকর্মণ্য দ্বিতীয় ইসমাইল নিহিত হইলে আবু সাঈদ সিংহাসন অধিকার করেন। তাহার সৈন্যদল গোয়াদিক্সের সন্নিকটে খ্রীস্টানদের হস্তে শশাচনীয়রূপে পরাজিত হয়। জনগণ আবু সাঈদের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হইয়া তাহাকে ত্যাগ করিতে শুরু করে। আল-গনি বিল্লাহ আফ্রিকার সেনাদলের সাহায্যে তাহার হারানো সাম্রাজ্য পুনর্দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু ফেজের আবু সালিমের উত্তরাধিকারী সেনাদলকে প্রত্যাহার করেন। তথাপিও জনগণ সিংহাসনচ্যুত রাজাকে নেতৃত্ব প্রদান করিতে আহ্বান জানায়। এবং আবু সাঈদকে ক্যাস্টিলের রাজার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য করে। তাহার ধন ঐশ্বর্যের জন্য ১৩৬২ খ্রীস্টাব্দে তিনি নিহত হন।
পঞ্চম মুহাম্মদ আল-গনি বিল্লাহ জনগণের আনন্দ উৎসবের মধ্যে দ্বিতীয়বার সিংহাসনে আরোহণ করেন। মাঝে মাঝে পারিবারিক গৃহবিবাদ ব্যতীত তাহার দ্বিতীয় বারের শাসনকাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়। তিনি ক্যাস্টিলের নিষ্ঠুর পেড্রোর সহিত সদ্ভাব বজায় রাখেন এবং নাজেরা ও মন্টিলের যুদ্ধে তাহাকে সাহায্য করেন। তিনি আলজেসিরা দখল করেন কিন্তু ইহা দীর্ঘদিন অধিকারে রাখিতে ব্যর্থ হন। মুহাম্মদ ছিলেন একজন সুশাসক। তিনি শিক্ষাদীক্ষা প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। লিসানুদ্দীন’ উপাধি প্রাপ্ত বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবনুল খাতিব ছিলেন তাহার প্রধানমন্ত্রী। তাহার সময়ে ব্যবসা বাণিজ্যে ও শিল্পক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। উন্নত সেচ ব্যবস্থার দরুন কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ১৩৯১ খ্রীঃ তিনি পরলোক গমন করেন।
পঞ্চম মুহাম্মদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রানাডার উজ্জ্বলতা নিষ্প্রেভ হইয়া পড়ে। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তাহার পুত্র আবুল হাজ্জাজ ইউসুফ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ক্যাস্টিলের শাসকের সহিত সদ্ভাব বজায় রাখেন। আল কানতারার ভাগ্য বিধাতা ডন মার্টিন ইয়ানেজ দে বারবুডো ক্যাস্টিলের শাসকের ঘোড়তর শত্রু ছিলেন। তিনি ১৮০০ সৈন্য লইয়া গ্রানাডার বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করেন। ফেজের রাজার নিকট হইতে যৌতুক হিসাবে প্রাপ্ত বিষাক্ত কম্বল ব্যবহারের দরুন ১৩৯২ খ্রীঃ দ্বিতীয় ইউসুফের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে।
ইউসুফের মৃত্যুর পর তাহার দ্বিতীয় পুত্র মুহাম্মদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইউসুফকে সালোৱেনা
দুর্গে কারারুদ্ধ করেন। গ্রানাডা শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য তৃতীয় হেনরী যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্দেশ্যে পরামর্শ পরিষদ আহ্বান করেন। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই তাহার মৃত্যু ঘটে। ১৪০৬ খ্রীঃ ক্যাস্টিলীয়গণ গ্রানাডা আক্রমণ করে এবং এক বৎসর পর বর্তমানে কাদিজ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত জাহরা দুর্গ অধিকার করে।
মুসলমানগণ বেদার আক্রমণ করেন এবং বিশ হাজার সৈন্য লইয়া খ্রীস্টান কর্তৃক সুদৃঢ়ভাবে রক্ষিত আলকাদেত আবরোধ করেন। যুদ্ধে উভয় পক্ষই সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিমধ্যে সপ্তম মুহাম্মদ গুরুতর রূপে অসুস্থ হইয়া পড়েন। তাহার চিকিৎসক অবধারিত মৃত্যুর কথা তাহাকে জানান। অতঃপর পুত্রের সিংহাসন নিরাপদ করিবার উদ্দেশ্যে তিনি তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা ইউসুফকে হত্যার আদেশ জারি করেন। আদেশ কার্যকরী হইবার পূর্বেই ১৪০৮ খ্রীস্টাব্দে তাহার মৃত্যু ঘটে। জনগণ আবু আব্দুল্লাহ তৃতীয় ইউসুফকে সিংহাসনে বসান।
(১৪০৮-১৭ খ্রীঃ)
ততীয় ইউসূফ দুই বৎসরের জন্য ক্যাস্টিলীয়দের সহিত একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। ১৪১০ খ্রীস্টাব্দে এই চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। তিনি ইহার মেয়াদ বৃদ্ধি করিতে চাহিলে ক্যাস্টিলীয়গণ অস্বীকৃতি জানায়। ক্যাস্টিলের যুবক রাজার অভিভাবক ও চাচা ফার্ডিনান্ড মুসলমানদের নিকট হইতে আন্তেকুয়েরা জবর দখল করে। সমস্ত খ্রীস্টানদের মুক্তির শর্তে তাহাদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। জিব্রাল্টারের মুসলমানগণ গভর্নরদের অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া আফ্রিকানদিগকে জিব্রাল্টার আক্রমণে আহবান জানান। জিব্রাল্টার অধিকারের জন্য ফেজের সুলতান ফায়েজ তাঁহার ভ্রাতা আবু সাঈদকে প্রেরণ করেন। কিন্তু আমীর তৃতীয় ইউসুফের পুত্র আহম্মদ অধিক সংখ্যক সেনাবাহিনী লইয়া আফ্রিকানদের পরাজিত ও আবু সাঈদকে। বন্দী করেন। ভাইয়ের নিকট হইতে সিংহাসন নিরাপদে রাখিবার উদ্দেশ্যে ফেজের সুলতান তাহার ভ্রাতার সহিত যথেচ্ছা ব্যবহার করিবার জন্য ইউসুফকে আহ্বান জানান। কিন্তু গ্রানাডার রাজা সাঈদকে মুক্তি দিয়া সেনাবাহিনীসহ সুলতানকে যথাযোগ্য শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রেরণ করেন। সুলতান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং সাঈদ সিংহাসন দখল করেন। গ্রানাডা ও ফেজের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
তৃতীয় ইউসুফ অবশিষ্ট জীবন শান্তিতে অতিবাহিত করেন। এবং প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে আত্মনিয়োগ করেন। সুবিচার, দানশীলতা ও অন্যান্য সৎ কাজের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। বিরোধ মীমাংসার জন্য বহু খ্রীস্টান গ্রানাডায় ইউসুফের নিকট আগমন করে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তিনি সৈনিকদের খেলা ধুলায় উৎসাহিত করিতেন। সীমান্ত প্রদেশসমূহে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি যুদ্ধকালীন সময়েও খ্রস্টানদের মুক্তি দান করেন। কিন্তু খ্রীস্টানগণ উহার বিপরীত করিত। শান্তি প্রতিষ্ঠিত
হওয়ায় দেশের অর্থ প্রাচুর্য ফিরিয়া আসে। জনসাধারণ আরাম আয়েশে জীবন কাটাইতে শুরু করে। ফলে তাহারা উদীয়মান খ্রীস্টান শক্তির মোকাবিলা করিতে ব্যর্থ হয়। প্রজাকুলকে শোক সাগরে ভাসাইয়া ১৪১৭ খ্রীস্টাব্দে ইউসুফ ইহলোক ত্যাগ করেন।
অষ্টম মুহাম্মদ “আল-আয়তাহার” (বাম হস্ত) উপাধি ধারণ করিয়া তাহার পিতা তৃতীয় ইউসুফের স্থলাভিষিক্ত হন। কর্মবিমুখতার দরুন তিনি জনগণের অপ্রিয় হইয়া ওঠেন। পারিষদবর্গের তুলনায় খোজা ও ক্রীতদাসদের তিনি অধিক গুরুত্ব প্রদান করিতেন। তিনি খেলাধুলা ও গণ-উৎসবাদি বন্ধ করিয়া দেন। আবেন ছেরাগেছ (বানু আল সাররাজ) ও জেগরিস (ছাগরী, সীমান্তের অধিবাসী) সম্প্রদায় তাহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া তিউনিসিয়া হইতে তাহাকে বিতাড়িত করে।
অষ্টম মুহাম্মদ সিংহাসন চ্যুত হইবার পর নবম মুহাম্মদ ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি বিখ্যাত বানু সাররাজ পরিবারকে বিতাড়িত করেন। বানু সাররাজের কিছু লোক ক্যাস্টিলের রাজা ও তিউনিসীয় আমীরের সহিত যোগদান করিয়া নবম মুহাম্মদকে সিংহাসন দ্রুত ও হত্যা করে এবং অষ্টম মুহাম্মদকে সিংহাসনে পুনরায় বসান। কিন্তু এই হতভাগ্য রাজা ক্যাস্টিলের দ্বিতীয় জন-এর সার্বভৌমত্ব মানিয়া লইতে অস্বীকৃতি জানাইলে ক্যাস্টিলীয়গণ তাহাকে আক্রমণ করে। ১৪৩১ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে গ্রানাডার সন্নিকটে হিগুয়েরুয়েলাতে উভয় পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুসলমানগণ শশাচনীয় রূপে পরাজয় বরণ করেন। অষ্টম মুহাম্মদ আল-আয়তার মালাগাতে পলায়ন করেন।
ষষ্ঠ মুহাম্মদের পৌত্র চতুর্থ ইউসুফ বিন আল-আহমার দ্বিতীয় জন-এর সাহায্যে ১৪৩১ খ্রীঃ জুলাই মাসে জোরপূর্বক সিংহাসন দখল করেন। ইহার কয়েক মাসের মধ্যে তাহার মৃত্যু ঘটে এবং অষ্টম মুহাম্মদ তৃতীয় বার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাহার সাম্রাজ্যের সীমা সঙ্কুচিত হইতে থাকে। তাঁহার শাসনের সমগ্র সময় গণঅসন্তোষের মধ্যে অতিবাহিত হয়। জিমেনা হুয়েস্কা (গ্রানাডা) ও হুয়েলমা (জায়েন) শহরগুলি একের পর এক খ্রীস্টানদের হস্তে চলিয়া যায়। ১৪৪৫ খ্রীস্টাব্দে তাঁহার ভ্রাতুস্পুত্র দশম মুহাম্মদ বিন উসমান কর্তৃক কারারুদ্ধ হন। মুহাম্মদ বিন উসমান আল হামরা প্রাসাদ অধিকার করেন।
(১৪৪৫-৬৫)
দশম মুহাম্মদের শাসনকাল শান্তিপূর্ণ ছিল না। তিনি তাঁহার পিতার ভ্রাতুস্পুত্র সাদ বিন আলী কর্তৃক ১৪৫৪ খ্রীঃ সিংহাসনচ্যুত হন। গৃহযুদ্ধে দেশ ধ্বংশ তূপে পরিণত হয়। কোষাগার শূন্য হইয়া পড়ে।
জনপদশূন্য সীমান্ত দুর্গসমূহ অরক্ষিত অবস্থায় খ্রীস্টানদের হস্তগত হয়। সাদ শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু ক্যাস্টিলের রাজা চতুর্থ হেনরী (এনরিক) ইহাতে অস্বীকৃত হন এবং গ্রানাডা আক্রমণ করেন। মুসলমানগণ অসমর্থ হওয়ায় আক্রমণ প্রতিহত করিতে পারেন না। ফলে শত্রুগণ বল্গাহীনভাবে ধ্বংসকার্য চালায়। রডরিগো পন্সে দ্য লিওন এবং মেদিনা সিদনীয়ার ডিউকের হস্তে ১৪৩২ খ্রীঃ বিখ্যাত দুর্গ আর্কিডোনা ও জিব্রাল্টার পতন ঘটে। হতভাগ্য সাদ হেনরীর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করিয়া বাৎসরিক বার হাজার দিনার কর দিতে রাজী হইয়া শান্তি স্থাপনের চুক্তি সম্পাদন করেন। ১৪৬৫ খ্রীস্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু পর্যন্ত শান্তি বহাল থাকে।
সাদের পুত্র আবুল হাসান (স্পেন ও আল বুয়াসেন) আলি’ উপাধি গ্রহণ করিয়া তাহার পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন ধূর্ত ও সাহসী কিন্তু রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বলিতে তাঁহার কিছু ছিল না। তাঁহার পিতা কর্তৃক স্বীকৃত বাৎসরিক কর দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানাইলে খ্রীস্টানগণ গ্রানাডা রাজ্যের ধ্বংস সাধন করে।
ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত আরাগণের ফার্ডিনান্ড ও ক্যাস্টিলের ইসাবেলার ক্ষমতা লাভের পর খ্রীস্টান আক্রমণ চরম আকার ধারণ করে। ফার্ডিনান্ড ১৪৬৯ খ্রীস্টাব্দে ইসাবেলাকে বিবাহ করিয়া তাহার ক্ষমতাকে সুসংহত করেন। উভয়েই ছিলেন চরম মুসলিম বিদ্বেষী। তাহারা মুসলমানদিগকে আক্রমণ করার সমস্ত সুযোগ গ্রহণ করেন। ১৪৮২ খ্রীঃ খ্রীস্টানগণ গ্রানাডার দক্ষিণ-পশ্চিমে সিয়েরা দে আল-হামাহ তীরে অবস্থিত আলহামাহ-এর শক্তিশালী দুর্গ দখল করে। হাতাহাতি যুদ্ধের পর মুসলিম নারী ও শিশুরা নগরের মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে। খ্রীস্টানগণ মসজিদে অগ্নি সংযোগ করিয়া তাহাদিগকে হত্যা করে। আবুল হাসান পর পর দুইবার আলহামাহ দুর্গ পুনর্দখলের প্রচেষ্টা চালাইয়া ব্যর্থ হন।
সে সময় রাজ্যের স্বার্থের উপরে ব্যক্তিস্বার্থ স্থান পাওয়ায় খ্রীস্টানগণ একের পর এক দুর্গ ও শহর দখল করে। তখন গ্রানাডা গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। মুহাম্মদ আবু আবদুল্লাহ (স্পেন ও বো আবদিল) যিনি তাহার পিতা আবুল হাসানের অনুকূলে বেদমারের ক্যাস্ট্রিলীয় আল কাইদের কন্যা ইসাবেলা দে সলিস (জাহরা) নামে জনৈক স্পেনীয় রক্ষিতাকে রাখিয়াছিলেন। তিনি তাহার আরব মাতা আয়শার প্ররোচনায় পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন। শহর রক্ষীদের সাহায্যে তিনি ১৪৮২ খ্রীস্টাব্দে আলহামরা অবরোধ করেন এবং গ্রানাডা তাহার অধিকারে আসে। তিনি তাহার পিতাকে মালাগায় আশ্রয় লইতে বাধ্য করেন। সেই সময় মালাগার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন আবুল হাসানের ভ্রাতা, আল-জাগাল নামে পরিচিত আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ। ১৪৮৩ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসে আল-জাগাল ও তাহার সহকারী রেজওয়ান প্রচুর
ক্ষতি সাধন করিয়া ক্যাস্ট্রিলীয়দের মালাগা আক্রমণ প্রতিহত করেন। এই বৎসর আবু আব্দুল্লাহ খ্রীস্টান শহর লুছেনা আক্রমণ করিয়া পরাজিত ও বন্দী হন। এইরূপে আবুল হাসান গ্রানাডার শূন্য সিংহাসন পুনরায় দখল করেন। কিন্তু পরে তাহার সুযোগ্য ভ্রাতা। মুহাম্মদ আল জাগালের পক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করেন। তিনি তাহার পরিবার ও সঞ্চিত। ধনসহ ইল্লোরা (ইল্লিরিস), সেখান হইতে আল মুনকার-এ গমন করেন এবং সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফার্ডিনান্ড গ্রানাডাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করিবার জন্য আবু আব্দুল্লাহকে (বোআবদিল) পুতুল হিসাবে ব্যবহার করিয়া বিরাট সৈন্য বাহিনীসহ তাহার চাচা আল-জাগালের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। আল-জাগাল তৃতীয় আবদুর রহমান কর্তৃক টলেডোর নিকটে নির্মিত আল ফাতাহ এবং তেলেমেছেনের সন্নিকটে হাজীব আল-মনসুর কর্তৃক নির্মিত সুরক্ষিত শহরের পাথর নির্মিত প্রাচীর পরিবেষ্টিত একটি শিবির তাহার নিজের জন্য তৈয়ারী করেন। ইহা পরবর্তীকালে গ্রানাডার দক্ষিণে শান্তা ফে (পবিত্র বিশ্বাস) শহরে পরিণত হয়। তখন হইতে মুসলমানগণ তাহাদের শেষ সম্বল লইয়া অবরোধ প্রতিহত করে। এই অবরোধ দশ বৎসর স্থায়ী হইয়াছিল। আবু আবদুল্লাহ খ্রীস্টানদের চক্রান্ত বুঝিতে না পারিয়া ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলার দাবার খুঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তিনি পুরাতন গ্রানাডার অংশ আল-বায়েছিন ১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে অধিকার করেন। আল-জাগাল সম্মিলিত ভাবে ক্যাস্টিলীয়দের বাধা প্রদানের প্রস্তাব করেন কিন্তু তাহার ভ্রাতুস্পুত্র আবু আব্দুল্লাহ ইহাতে। সম্মত হন না।
উপরন্তু গ্রানাডা রাজ্যের পতন ঘটানোর জন্য আবু আব্দুল্লাহ ক্যাস্ট্রিলীয়দের ও আরাগোনদের সাহায্য করেন। আবু আবদুল্লাহ তাহার চাচার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া গ্রানাডায় পুনর্বাসিত তাহার দক্ষিণ হস্ত দেশ প্রেমিক আফ্রিকার বানু সাররাজকে সমূলে ধ্বংস করেন। গৃহযুদ্ধের সুযোগ গ্রহণ করিয়া ক্যাস্টিলীয়গণ আলোরা, কাসর বনিলা, রোন্ডা ও অন্যান্য শহরগুলি একের পর এক অধিকার করেন। ১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে লোজা এবং পরবর্তী বৎসর আলমেরিয়া ও মালাগা পদানত হয়। শহরসমূহের অধিবাসীদের উপর অত্যাচার করা হইবেনা এই শর্তে শহরগুলি আত্মসমর্পণ করে। ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলা চুক্তি ভঙ্গ করিয়া মুসলমানদিগকে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে অথবা নগর হইতে তাহাদিগকে তাড়াইয়া দেয়। আল-জাগাল ক্যাস্ট্রিলীয়দের বাধাপ্রদান করিয়া ব্যর্থ হন। ফার্ডিনান্ড সমস্ত শক্তি লইয়া বায়েজা আক্রমণ করেন। নিরাশ হইয়া আল-জাগাল রাজধানী রক্ষা করিবার জন্য আফ্রিকায় বসবাসরত তাহার স্বজাতীয়দের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাহাকে হতাশ হইতে হয়। কারণ তাহারাই তখন আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। খাদ্য সামগ্রীর অভাবে নগরবাসী শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণ করে। আল-জাগাল ১৪৮৭ খ্রীস্টাব্দে আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হন। তিনি মরক্কোর
তিলিমসানে গমন করেন এবং সেখানেই অবশিষ্ট জীবন দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়া অতিবাহিত করেন।
এবারের পালা আবু আব্দুল্লার। ১৪৯০ খ্রীস্টাব্দে তাঁহার মিত্র ফার্ডিনান্ড কর্তৃক গ্রানাডা সমর্পণে আদিষ্ট হন। ইহাতে অস্বীকৃতি জানাইলে চল্লিশ হাজার পদাতিক ও দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য ১৪৯১ খ্রীস্টাব্দের বসন্তকালে গ্রানাডা শহর ও গ্রানাডার শস্য-শ্যামল ভূমিকে ধ্বংস স্কুপে পরিণত করে। প্রধান সেনাপতি মুসা বিন গাজানের নেতৃত্বে মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনী প্রচন্ড আক্রমণে প্রথমে বহু সংখ্যক অবরোধকারীকে হত্যা করে। ফার্ডিনান্ড অবরোধকারীদের শক্তি বৃদ্ধি করিলে জনগণ আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। ভেগার ধ্বংসলীলা অবলোকন করিয়া এবং মুসলিম দেশগুলি হইতে সাহায্য না পাইয়া (৮৯৭ হিজরী ২রা রবিউল আওয়াল/১৪৯২ খ্রীঃ ২রা জুন) বেআবদিল আত্মসমর্পণ করেন। সন্ধির শর্তসমূহ : সুদীর্ঘ দুই মাস সমুদ্র অথবা স্থল পথে কোনরূপ সাহায্য না পাইয়া পঞ্চাশটি শর্তে মুসলমানগণ স্পেনে তাহাদের শেষ শক্তিশালী দুর্গ হস্তান্তর করিতে সম্মত হয়। নিম্নে উহার কয়েকটি উল্লেখ করা হইল।
(১) আবু আব্দুল্লাহ বোআবদিল, তাহার অফিসার এবং নাগরিকবৃন্দ ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিবেন।
(২) আবু আব্দুল্লাহ আল বুশারাতে (আল পুজার) একটি জাইগীর পাইবেন।
(৩) মুসলমানগণ তাহাদের জানমালের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করিবে।
(৪) তাহাদের পুরা আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, ভাষা ও পোশাক বহাল থাকবে।
(৫) মুসলমান ও খ্রীস্টানদের মধ্যকার বিরোধ উভয় পক্ষের লোকদের লইয়া গঠিত ট্রাইবুনাল মীমাংসা করিবে।
(৬) মুসলমানগণ মুসলিম শাসকদের আমলে যে সমস্ত কর প্রদান করিত উহাই প্রদান করিবে।
(৭) সমস্ত বন্দী মুসলিম মুক্তি পাইবে।
(৮) স্বর্ণ ও হাতিয়ারসহ সঙ্গে বহনযোগ্য মালামাল লইয়া মুসলমানগণ স্বাধীনভাবে স্পেন ত্যাগ করিতে পারিবে। ইচ্ছা করিলে তিন বৎসর সময়সীমার মধ্যে তাহারা স্পেনে ফিরিয়া আসিতে পারিবে। তিন বৎসর পর ফিরিয়া আসিলে তাহাদের সম্পদের এক দশমাংশ প্রত্যার্পণ করিতে হইবে। (৯) নব মুসলিমদিগকে তাহাদের পূর্ব ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হইবে না এবং খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণে আগ্রহী মুসলমানদিগকে তাহাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে চিন্তা করিবার সুযোগ
দিতে হইবে। এবং তাহাদের শেষ সিদ্ধান্তকে একজন মুসলমান ও ফ্রস্টান বিচারকের সম্মুখে ঘোষণা করিতে হইবে।
(১০) মুসলিম ব্যবসায়ীদিগকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দিতে হইবে এবং খ্রীস্টানদের ন্যায় শুল্ক প্রদান করিয়া মুসলমানরাও দেশের ভিতরে ও বাহিরে ব্যবসা করিতে পারিবে।
(১১) চুক্তির শর্তসমূহ অক্ষরে অক্ষরে পালনের জন্য দায়িত্বশীল গভর্নর ও পরিচালক নিয়োগ করিতে হইবে।
মুসলিম সেনাপতি মুসা ইহুদীদের ভাগ্যের অনিশ্চয়তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করিয়া শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণে চুক্তির বিরোধিতা করেন। ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলার অঙ্গীকারে তাহার বিশ্বাস ছিল না। মুসলমানদের তরফ হইতে কোন প্রকার সমর্থন না পাইয়া, তিনি চিরদিনের জন্য নগরের এলভিরা গেটের বাহিরে চলিয়া যান। দুইমাস অতিবাহিত হইবার পরও মিশরের সুলতান, তুরস্ক ও অপরাপর মুসলিমদেশসমূহ গ্রানাডার মুসলমানদের সাহায্যে সৈন্য প্রেরণ না করার দরুন ক্যাস্টিলীয়গণ শহর অধিকার করে। আবু আব্দুল্লাহ আন্দ্রাক্সে গমন করেন। এবং সেখান হইতে ফেজে নির্বাসিত হন। ১৫৩৮ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানে তিনি অতি দুঃখ-কষ্টে জীবন যাপন করেন। টেন্ডিল্লার কাউন্ট আল হামরার গভর্নর এবং গ্রানাডা রাজ্যের ক্যাপ্টেন জেনারেল নিযুক্ত হন। কূটিল রাজনীতি ও অস্ত্রবলে স্পেন পুনরায় খ্রীস্টান শক্তির হস্তগত হয়। লুই বার্ট্রান্ড বলেন, “স্পেনীয়রা মনে করেন এই চুক্তির ফলে মুসলমান যুবরাজদের কঠিন শাসন হইতে তুলনামূলকভাবে কম অত্যাচারী শাসনাধীনে গমন করেন। লেখক আরও বলেন, আমরা (ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলা) আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাজ বাক্যের মাধ্যমে নিশ্চয়তা দিতেছি, অঙ্গীকার ও শপথ করিতেছি যে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত সমস্ত বিষয় এবং প্রত্যেকটি অংশ এখন ও ইহার পরবর্তীকালে এবং এখন হইতে চিরদিনের জন্য আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিব এবং পালন করিতে বাধ্য করিব”। অস্থায়ীভাবে খ্রীস্টান শাসকগণ সামন্তরাজদের সুযোগ সুবিধা দান করেন। দেশে পরিপূর্ণরূপে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাহাদিগকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করিবার উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়। সহঅবস্থান ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহের ফলে দীর্ঘ আটশত বৎসরে বহু মুসলমান ক্যাস্টিলীয়তে ও বহু খ্রীস্টান আরবে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের গণ্ডিতে মুসলমানদিগকে একত্রিত করা সম্ভব হয় নাই। সর্বোপরি খ্রীস্টান প্রভু চাহিতেন যে, কৃষিকার্যে অভিজ্ঞ মূরগণ কৃষিকার্যে নিয়োজিত থাকুক। ফলে ক্যান্টিলিয়ান শাসকদের পক্ষে তাহাদিগকে বিতাড়িত করা সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়।
পুনর্বিজয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রথম যুগের (১১৪০) সিদ-এর কাব্যে আলোচিত হয়। নিদর্শন স্বরূপ উহার কয়েকটি পংক্তি উল্লেখিত হইল ?
শোন, আলবার্ট ফানেজ ও নাইটগণ! আমরা এই দুর্গে মহামূল্যবান সম্পদ বন্দী করিয়াছি: এই দুর্গের মূরগণ এখন জীবন্ত-মৃত। মূর নারী ও পুরুষকে আমরা বিক্রয় করিতে পারি না, তাহাদের হত্যা করিয়াও আমাদের কোন লাভ হইবে না; তাহাদিগকে অন্দর মহলে থাকিতে দিন, আমরা এখন সম্মানিত! আমরা তাহাদের বাড়িগুলিতে বাস করিব এবং
তাহাদেরকে ব্যবহার করিব (৬১৬-৬২২)। এই পংক্তিগুলির অর্থ হইতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, দারিদ্র হইতে মুক্ত খ্রীস্টানগণ মুসলমানদের উপর অধিকার বিস্তার করেন এবং তাহাদিগকে নানা কাজে ব্যবহার করেন। কিন্তু কার্যসিদ্ধির পর দেখা যায় ধর্মীয়ঐক্য সাধনের পরিবর্তে দেশের বৈষয়িক উন্নতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হইয়াছে এবং চুক্তির শর্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য মুসলমানদিগকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা হইয়াছে।
তথ্য নির্দেশ
পঞ্চম মুহাম্মদের শাসনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইবনে আলখাতিব মরক্কোতে পলায়ন করেন এবং সেখানে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন এবং এখানেই ইবনে খাতিব এবং ইবনে খালদুন নাসিরীয় বংশের পরিসমাপ্তি ঘটায়। আল-মাক্কারীর নাফলুল-তিব’ এবং মূলার কর্তৃক প্রকাশিত নাম বিহীন ঘটনা পুঞ্জের (১৮৬৩ খ্রীঃ) কিছু পৃষ্ঠায় পরবর্তী শাসকদের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়। আমীর আলী, হিস্ট্রি অব দ্যা স্যারাসিনস, পৃঃ ৫৫৫। দ্যা হিস্ট্রি অব স্পেন, প্রথম খণ্ড, লন্ডন, ১৯৫৬, পৃঃ ১৫০, ১৫২। ৪। ক্যাস্ট্রো কর্তৃক উদ্ধৃত, পৃঃ ৪৩।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন