দ্বাদশ অধ্যায় : স্পেনে উমাইয়া খিলাফতের পতন

স্পেনে উমাইয়া খিলাফতের পতন
(১০০২-১০৩১)
দ্বাদশ অধ্যায়

আরব, বার্বার, খ্রীস্টান ও নও-মুসলিম প্রভৃতি জনসমষ্টিকে লইয়া গঠিত রাষ্ট্রকে শাসন করা খুবই কঠিন ছিল। দেশে কৃত্রিম সংহতি বিরাজ করায় খলিফা এই পরস্পর বিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করিতে চেষ্টা করেন। কর্ডোভা নগরীতে খলিফা অবিরত বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন। খলিফা আবদুর রহমান ও হাজীব আল-মনসুর পুরাতন সুরক্ষিত নগরী কর্ডোভা হইতে নিরাপদ দূরত্বে জাহরা ও জাহিরা প্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং দেহরক্ষী হিসাবে স্লাভদিগকে নিয়োগ করেন। স্নাভগণ রাজপ্রাসাদ ও হেরেম পাহারা দিত। বেতনভুক বিদেশী সৈন্যদের উপর নির্ভরশীলতা তৃতীয় আবদুর রহমান ও মনসুরকে সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। কিন্তু ইহার ফলে আরব, বার্বার ও স্পেনীয়দের মধ্যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। মনসুর বার্বারদের তুলনায় আরব ও স্পেনীয়দের প্রতি অধিক সহানুভূতি প্রদর্শন করিতেন। দীর্ঘদিন যাবৎ তাহারা বার্বারদিগকে স্পেন হইতে বিতাড়িত করিবার আশা অন্তরে পোষণ করিয়া আসিতেছিল। বার্বার ও আরবদের গোত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবেশকে আরও মারাত্মক করিয়া তোলে।

প্রধান মন্ত্রী মুজাফফর

স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মাধ্যমে মনসুর তাঁহার প্রজাকুলকে দমন রাখিতে সক্ষম হইলেও তাহাদের প্রকৃত আনুগত্য লাভে ব্যর্থ হন। ফলে তাঁহার পুত্রগণ অবিরত এই অসন্তুষ্টির সম্মুখীন হন। মনসুরের মৃত্যুর পর প্রজাগণ দ্বিতীয় হিশামকে ক্ষমতায় বসাইতে আগ্রহ প্রকাশ করিয়া বানু আমীরের বিরোধিতা করে। তৃতীয় আবদুর রহমানের অপর পৌত্র যুবরাজ হিশাম মনসুরের পুত্র আবদুল মালিককে হত্যার পরিকল্পনা করে কিন্তু ইহা ব্যর্থ হয় এবং যুবরাজ নিহত হন। বিদ্রোহ দমন করিয়া আবদুল মালিক যিনি চারি বৎসর পূর্বে উত্তর আফ্রিকার ভাইসরয় হিসেবে নিজেকে বিশেষভাবে পরিচিত করিয়া তোলেন। তিনি ১০০২ খ্রীঃ পিতার স্থলে হাজীবের পদ গ্রহণ করেন এবং খলিফা দ্বিতীয় হিশাম সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাহার সাত বৎসরের শাসন আমলে মুসলিম স্পেন সমৃদ্ধ হইয়া ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্য কলকারখানা ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। উত্তর আফ্রিকা হইতে নতুন সেনা সংগ্রহ করিয়া তিনি খলিফার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করিয়া গড়িয়া তোলেন এবং একাধিক অভিযান পরিচালনা করেন ৩৯৩ হিঃ/১০০৩ খ্রীঃ দেশের উত্তরে অবস্থিত ক্যাটালোনিয়ার বিরুদ্ধে ৩৯৫ হিঃ/১০০৫ খ্রীস্টাব্দে পাম্পলোনার বিরুদ্ধে এবং ৩৯৭ হিঃ/১০০৭ খ্রীস্টাব্দে ক্যাস্টিলিয়ানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান। শেষ অভিযানের পর তিনি “আল মুজাফফর বিল্লাহ” উপাধি ধারণ করেন। দেশের উত্তরাংশে অবস্থিত খ্রীস্টান

রাজ্যগুলির সহিত মুসলমানদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি পূর্বাবস্থা বহাল রাখেন। আবদুল মালিক আল মুজাফফরের জীবদ্দশায়ই আমীরী (বানু আমীর) পরিচালিত সরকার ক্রমান্বয়ে শক্তি সঞ্চয় করিতে শুরু করে। তিনি সফলতার সহিত বিদ্রোহ দমন করেন। এবং যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন দৃঢ়ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তিনি নিজেকে একজন দক্ষ প্রশাসক এবং মহান সেনাপতি প্রমাণিত করেন।

ইতিমধ্যে মুসলিম স্পেনে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। সাম্প্রদায়িক বিবাদ ও শ্ৰেণী বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়া ওঠে এবং নতুন এক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় যাহারা ধর্ম ও রাজনীতি সম্পর্কে এক নতুন মতবাদ প্রচার করে। আরবগণ ভিক্ষুকে পরিণত হয় কিন্তু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সীমাহীন বিত্তের অধিকারী হইয়া ওঠে এবং বার্বার ও স্লাভগণ সামরিক ক্ষমতা লাভ করে। বাবার স্লাভ ও স্পেনীয়গণ দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত করিয়া তোলে। স্লাভ গার্ডগণ কর্ডোভাতে প্রাচীন রোমের প্রিটোরিয়ান ও মধ্য যুগের বাগদাদে তুর্কীদের ভূমিকা পালন করে। জনগণ আন্তরিকভাবে উমাইয়া খিলাফতের প্রতি অনুগত ছিল এবং সর্বান্তকরণে আল-মনসুরের আমীরি শাসনের অবসান কামনা করিত।

চতুর্থ আবদুর রহমান সাঞ্চোল

মুজাফফরের মৃত্যুর পর আমীরী শাসনের অবক্ষয় শুরু হয়। তাঁহার ভ্রাতা আবদুর রহমানের ডাক নাম শানজুলের (Sanchuelo বা Sanchol (i.e.) little Sancho) প্ররোচনায় বিষ প্রয়োগের কারণে তিনি ৩৯৯ হিঃ/ মহরম মাসে/১০০৮ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যু বরণ করেন। আবদুর রহমান জোর পূর্বক ক্ষমতা দখল করেন। তাঁহার হাজীবের পদ গ্রহণে দুর্বল খলিফা দ্বিতীয় হিশাম অনুমোদন করেন। এই সময় হইতে স্পেনের ইতিহাসে অরাজকতা বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। আবদুর রহমান ফুকাহাদের নিকট অপ্রিয় ছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন মাশক্ত ও ইসলামের পবিত্র আচার অনুষ্ঠান বিরোধী। পিতা ও ভ্রাতার গুণ হইতে তিনি ছিলেন বঞ্চিত। তিনি হিশামের নিকট হইতে উমাইয়া খেলাফতের ভাবী উত্তরাধিকারী রূপে অনুমোদন লাভ করিতে সক্ষম হন। খোতবায় তাহার নাম পাঠ করা হইত। ইহাতে কোরায়েশ ও অপরাপর আরবগণের মধ্যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। কারণ খলিফার প্রতি তাহাদের আনুগত্য ছিল খুবই দৃঢ়। এই অসন্তুষ্টি আরও মারাত্মকরূপ ধারণ করে সৈনিকদিগকে শিরস্ত্রাণের পরিবর্তে ধর্মীয় নেতাদের পাগড়ি ব্যবহারে বাধ্য করিবার ফলে, এই সমস্ত কার্যকলাপ শেষ পর্যন্ত তাহার ও তাহার পরিবারের জন্য বিপদজনক বলিয়া প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয় মুহাম্মদ আল মাহদী ও চতুর্থ আবদুর রহমান ৯০০৯ খ্রীঃ ইবনে আসকালিজাকে কর্ডোভায় তাহার প্রতিনিধি নিয়োগ করিয়া লিওনের পঞ্চম আলফন্সের বিরুদ্ধে আরিয়ার অভিযান পরিচালনা করেন। সেই সময় কর্ডোভাবাসী দ্বিতীয়

হিশামকে জোরপূর্বক ক্ষমতা ত্যাগ করিতে বাধ্য করেন এবং দ্বিতীয় মুহাম্মদ বিন হিশাম বিন আবদুল জব্বার বিন তৃতীয় আবদুর রহমানকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। ৩৯৯হিঃ/১০০৮ খ্রীঃ সম্মানসূচক উপাধিসহ তাঁহাকে খলিফা ঘোষণা করা হয়। নতুন খলিফা আমীরী প্রাসাদ আল-মাদিনা তুল জাহিরাকে ধূলিস্মাৎ করিয়া দেয় এবং চার দিন ধরিয়া শহরটি লুণ্ঠিত হয়। বিশ লক্ষ দশ হাজার রৌপ্য খণ্ড ও পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণ খণ্ড গানিমত হিসাবে পাওয়া যায়। নিজের অবস্থা নিরাপদ নহে ভাবিয়া তিনি শান্তি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেন কিন্তু কর্ডোভাতে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাহার বিশ্বস্ত মিত্র কারিওন নিহত হন। এইভাবে আমীরী স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটে। খলিফা নির্বাচনে তিনটি উপজাতীয় দল কর্ডোভার পপুলাসে বার্বার ও স্লাভ বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে। এই সময় হইতে উমাইয়া শাসনের পতন কাল (১০০৯-১০০৩১ খ্রীঃ) পর্যন্ত কর্ডোভা গৃহযুদ্ধের ফলে খণ্ডবিখণ্ড হইয়া যায়। বার্বারগণ উত্তর আফ্রিকা হইতে সংগৃহীত সানহাজাহ সেনাদলের সহিত মিলিত হইয়া বিশৃঙ্খলায় ইন্ধন যোগায়। রক্তপিপাসু মাহদী দ্বিতীয় হিশামকে আনয়ন করিয়া পুতুল হিসাবে সিংহাসনে বসান। বেতনভুক বিদেশী সৈন্যদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য মাহদী স্লাভ ও বার্বারদের অধিক সংখ্যায় সমরবিভাগ হইতে অপসারণ করেন। অমিতাচারী ও লম্পট মাহদী ধর্ম বেত্তাগণেরও কোপানলে পতিত হন।

সুলায়মান

মাহদী ছিলেন একজন দুশ্চরিত্র ব্যক্তি, সেইহেতু বার্বারগণ সুলায়মান বিন তৃতীয় আবদুর রহমানের পুত্র অপর হিশামকে স্পেনের খলিফা হিসাবে দাবী করেন। কিন্তু তাহাকে হত্যা করা হয় এবং তাহার সমর্থকগণকে দেশ হইতে বিতাড়িত করা হয়। বার্বারগণ অনতিবিলম্বে তাহাদের নেতা জাওবির পিছনে একতাবদ্ধ হয় এবং তাহাদের সহিত কর্ডোভার অসন্তুষ্ট জনগণ একত্রিত হইয়া দেশের ক্ষমতা হস্তগত করে এবং ১০১০ খ্রীস্টাব্দে অপর উমাইয়া যুবরাজ সুলায়মান বিন আল হাকাম বিন তৃতীয় আবদুর রহমান সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি “আল মুস্তাইন বিল্লাহ” উপাধি গ্রহণ করেন। নতুন খলিফার নেতৃত্বাধীনে বার্বারগণ কালাতারাভা ও গোয়াদালাজারা এবং ক্যাস্টিলিয়ানদের সহযোগিতায় কর্ডোভার দিকে অগ্রসর হন। আল মাহদী কান্তিচে পরাজিত হন এবং তাহাদের অগ্রাভিযানে বাধা প্রদান করিতে ব্যর্থ হন। সুলায়মান বিন মুস্তাইন বিল্লাহ সানহাজাহ নেতা জাওবী কর্তৃক রাজা হিসাবে রাজ প্রসাদে অভিষিক্ত হন। বাবার এবং ক্যাস্টিলিয়ানগণ রাজধানীতে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নৃশংস অত্যাচার চালায়।

আল মাহদীর রাজধানী পুনরুদ্ধার

মাহদী বার্সিলোনার কাউন্ট রাইমুন্ড উরগেলের (লেরিদার) এরমেনেগিল্ড এবং তোরতোসার শাসক ওয়াদিহর সহিত সন্ধি স্থাপন দ্বারা শক্তি সঞ্চয় করিয়া সুলায়মান আল মুস্তাইন বিল্লাহকে ও তাহার বাবার

সমর্থকদেরকে কর্ডোভার উত্তরে অবস্থিত আকাবা আল-বাকারের (Castillo del Bacar) সন্নিকটে আক্রমণ করেন। বিশেষ করিয়া যুদ্ধকৌশলের অজ্ঞতা বশতঃ সুলায়মান পরাজিত হন। আফ্রিকার অধিবাসী তাঁহার অগ্রগামী দেহরক্ষী দল প্রচণ্ড শক্তিতে আক্রমণের উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে পশ্চাৎ অপসারণ করে। সুলায়মান তাহাদের পরিকল্পনা অনুধাবন করিতে না পারিয়া যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেন এই ভাবিয়া যে তাহারা যুদ্ধ ক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিয়াছে। কিন্তু বার্বারগণ প্রত্যাবর্তন করে কাটালানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ পরিচালনা করে। কাউন্ট এরমেনেগিল্ডসহ তাহাদের ষাট জন নেতা নিহত হন। কিন্তু বার্বারগণ যখন দেখিতে পায় তাহাদের নেতা সুলায়মান যুদ্ধক্ষেত্র হইতে নিরুদ্দেশ হইয়াছেন তখন তাহারা নিরাশ হইয়া পশ্চাৎ অপসারণ করে। মাহদী এইভাবে যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া কর্ডোভা পুনর্দখল করেন। মাহদী ছিলেন একজন অক্ষম রাজা। তিনি রাজধানীতে পর্যন্ত শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ হন। বার্বারগণ পুনরায় একত্রিত হইয়া স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ হঠাৎ আক্রমণ করে এবং কর্ডোভা ও দেশের বিভিন্ন অধিবাসীদের লাঞ্ছিত করে। এইভাবে দেশের জনগণ মাহদীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া ওঠে।

অভিভাবকত্ব হইতে দ্বিতীয় হিশামের মুক্তি

ওয়াদিহর নেতৃত্বে স্লভগণ মাহদীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় ও মাহদীকে হত্যা করে এবং খলিফা দ্বিতীয় হিশামকে তাহার হাজীবের অভিভাবকত্ব হইতে মুক্ত করে। ৪০০ হিঃ জুলহাস/১০১০ খ্রীঃ জুন মাসে দ্বিতীয় হিশাম দ্বিতীয় বারের মত খলিফা ঘোষিত হন। হিশামের প্রথম কাজ ছিল তাহার প্রধান মন্ত্রী রূপে ওয়াদিহকে নিয়োগ ও বার্বারদের সহিত শান্তি চুক্তি সম্পাদন করা। বার্বারগণ ওয়াদিহর সহিত একমত হইতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে এবং জনগণকে হত্যা করা ও লুণ্ঠন কার্য অব্যাহত রাখে। খাজাঞ্চীখানা শূন্য হইয়া যায়। সেনাবাহিনীর মাহিনার জন্য ওয়াদিহকে হাকামের লাইব্রেরির মূল্যবান গ্রন্থসমূহ বিক্রয় করিতে হয়।

দ্বিতীয় দফা সুলায়মান শাসক নিযুক্ত

১০১২ খ্রীঃ বার্বারগণ কর্ডোভা লুণ্ঠন করে এবং কর্ডোভাবাসীদিগকে দ্বিতীয় বারের মত সুলায়মানকে খলিফা হিসাবে গ্রহণ করিতে বাধ্য করে। স্লাভগণ বার্বারদের অনুসরণ করিয়া কর্ডোভায় প্রবেশ করে এবং ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়। এমন কি তাহারা পৃথিবী বিখ্যাত পণ্ডিতগণকেও হত্যা করিতে দ্বিধা করে না। উমাইয়া শাসনের স্বর্ণ যুগে এই সব পণ্ডিত ব্যক্তি বিদেশীদিগকে স্পেনে আকর্ষণ করিত। তাহারা দ্বিতীয় হিশামের কর্মকাণ্ডে নিরাশ হয়। হিশাম এশিয়ায় পলাইয়া যায় এবং অজ্ঞাত জীবনযাপন করে অথবা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আহত হইবার পর মৃত্যুবরণ করে। তাহার জীবন অবসানের সঙ্গে সঙ্গে উমাইয়া শাসনের শেষ গৌরবের পরিসমাপ্তি ঘটে। ২৩শে শাওয়াল ৪০৩ হিঃ/৯ই মে ১০১৩ খ্রীঃ কর্ডোভার

কাজি ইবনে জাকওয়ান কর্ডোভার অধিবাসীদের পক্ষে বিনা শর্তে বার্বারদের নিকট শহর সমর্পণ করেন। সুলায়মান তাহার দ্বিতীয় দফার শাসনকে স্মরণীয় করিয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে নতুন মুদ্রার প্রচলন করেন। সুলায়মান আল মুস্তাইন তাহার শাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার উদ্দেশ্যে এলভিরাতে আন হাজাকে, জায়েনে বানু বিরজাল ও বানু ইফরানকে এবং হামদুবিদ ভাতৃদ্বয় আলী ও কাসিমকে যথাক্রমে সিউটা এবং তাঞ্জিয়ারের শাসনভার অর্পণ করে।

আলী বিন হাম্মুদ

সুলায়মান বার্বারদিগকে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপদে নিয়োগ করেন। কর্ডোভাবাসিরা তাহার শাসনে অতিষ্ঠ হইয়া সিউটাতে গভর্নর আলী বিন হাম্মুদকে আহবান করে সিংহাসন দখল করিবার উদ্দেশ্যে। আলী বিন হাম্মুদ ৪০৫ হিঃ/১০১৫ খ্রীঃ সুলায়মানকে হত্যা করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের অল্পদিনের মধ্যে তিনি নিহত হন এবং রাষ্ট্রের অবস্থা আরও বিশৃঙ্খল হইয়া পড়ে। তাঁহার ভ্রাতার মৃত্যুর অল্প দিন পর কাসিম সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন খুবই দুর্বল প্রকৃতির ফলে অবস্থার সহিত নিজেকে খাপ খাওয়াইতে ব্যর্থ হন। ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যে তাহাকে ১০১৮ খ্রীঃ কর্ডোভা হইতে বিতাড়িত করা হয়।

তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম আবদুর রহমান

এই বিশৃঙ্খলার সময়ে কর্ডোভা সর্বপ্রকার বর্বরতা ও অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয় এবং দেশের প্রত্যন্ত সীমায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াইয়া পড়ে। ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসকের উদ্ভব ঘটে। ইহাদের মধ্যে মুলুক আল তাওয়াইফের (Sp. Reyes de Taifas) নাম উল্লেখযোগ্য। ৩রা এপ্রিল ১০১৮ খ্রীঃ ১০ই জিলহজ্জ/ ৪০৮ হিঃ আলমিবার শাসক খায়রান, সারাগোসার গভর্নর মুনজির এবং কর্ডোভা নগরীর সুধীবৃন্দ আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ বিন আবদুল মালিক বিন তৃতীয় আবদুর রহমানকে খলিফা নির্বাচিত করেন। তিনি “আল মুর্তজা উপাধি ধারণ করেন। গ্রানাডার শাসক জাবি বিন জিরির সহিত যুদ্ধ চলাকালে তাহার সমর্থকগণ বিশ্বাস ঘাতকতা করে এবং তিনি নিহত হন। কাসিম বিন হাম্মুদ কর্ডোভা অধিকার করেন কিন্তু পরে বিতাড়িত হন।

তৃতীয় আবদুর রহমানের পৌত্র চতুর্থ আবদুর রহমানকে খলিফা হিসাবে নির্বাচন করা হয় ৪১৪ হিঃ/ ১০২৩ খ্রীস্টাব্দে। তিনি “আল মুস্তাজহির” উপাধি গ্রহণ করেন এবং আলী বিন হাজমকে তাঁহার প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ করেন। আলী ইবনে হাজম ছাড়াও তিনি আবদুল ওয়াহাব ইবনে হাজম (আলীর পিতব্য পুত্র) ও আবু আমীর ইবনে শুহাইদের ন্যায় উপদেষ্টা পাইয়াছিলেন। তাহারা যোগ্যতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপারে তাহাদের অনীহা ও বিরূপ মনভাব গোড়া মুসলমানগণকে মর্মাহত করে।

পঞ্চম আবদুর রহমানকে বিরোধীতা করার দরুন বহু প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোককে কারাবরণ করিতে হয়। গৃহযুদ্ধের ফলে শহরের জনজীবন ও অর্থনৈতিক

অবস্থার চরম ক্ষতি সাধিত হয়। অগণিত লোক বেকার হইয়া পড়ে। তাহারা সমাজের অবশিষ্ট ঔজ্জ্বল্যকে ধ্বংস করিতে উদ্যত ছিল। তাহাদের নেতা মুহাম্মদ বিন আবদুর রহমান বিন উবায়েদ আল্লাহ ছিলেন আল নাসিরের জনৈক পৌত্র। তিনি তাহাদিগকে শহরের ধ্বংস সাধন ও লুণ্ঠন করিবার জন্য উত্তেজিত করেন। প্রাচীন সম্ভ্রান্ত লোকেরা পপুলেছদের সহিত যোগদান করেন। ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দের শেষভাগে বার্বারদের একটি ব্যাটেলিয়ান কর্ডোভায় প্রবেশ করে। সৈন্যের বিশেষ প্রয়োজন থাকায় পঞ্চম আবদুর রহমান তাহাদিগকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিয়া নেন। রাজকীয় দেহরক্ষী বাহিনী যাহারা বার্বারদের ঘৃণা করিত তাহারা বিদ্রোহীদের সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। শহরের ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও উজিরগণ খলিফাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়। তাহারা বার্বারদের খুঁজিয়া বাহির করিয়া যেখানে পায় সেখানেই হত্যা করেন। পঞ্চম আবদুর রহমান ১০২৪ খ্রীস্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি নিহত হন।

 তৃতীয় মুহাম্মদ আল-মুস্তাকফী

তৃতীয় মুহাম্মদ সিংহাসন অধিকার করিয়া “আল মুস্তাকফী” উপাধি গ্রহণ করেন। যখন তিনি জনৈক তাঁতীকে তাহার প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ করেন ও ইবনে হাজমকে গ্রেফতার করেন তখন জনগণ হিংস্র হইয়া ওঠে। তাহারা ১০২৫ খ্রীঃ মালাগার নেতা হামুদী ইয়াহিয়াকে আমন্ত্রণ করেন। জনতা তাহার প্রধান। মন্ত্রীকে হত্যা করেন এবং তৃতীয় মুহাম্মদ নারীর ছদ্মবেশে কোন অখ্যাত গ্রামে আত্মগোপন করেন। কিন্তু সেখানে তাঁহার এক অফিসারের দ্বারা তিনি নিহত হন।

মালাগার ইয়াহিয়া

ইয়াহিয়া কর্ডোভায় আগমন করিতে ছয় মাস বিলম্ব করেন। এই অন্তর্বর্তীকালে এক উপদেষ্টা পরিষদ কর্ডোভার শাসন পরিচালনা করে। সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ইয়াহিয়া ও শান্তি স্থাপনে জনগণকে সন্তুষ্ট করিতে ব্যর্থ হন। কর্ডোভাবাসীরা হামুদী ও আফ্রিকাবাসীদের উপর অসন্তুষ্ট হইয়া ওঠে। তাহাদের উপর শাসন কার্য পরিচালনার জন্য আলমেরিয়া ও দেনিয়া হইতে যথাক্রমে দুইজন স্লাভনেতা খায়রান ও মুজাহিদকে আহ্বান করেন। তাহারাও অপদার্থ বলিয়া প্রমাণিত হন এবং উভয়ের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয় এবং একের পর এক দুইজনই কর্ডোভা ত্যাগ করেন।

তৃতীয় হিশাম আল-মুতাদ

জাওহারের পুত্র আবুল হাজমের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন উমাইয়া রাজবংশের কাহাকেও সিংহাসনে বসাইতে। অতঃপর মুহাম্মদের (মৃঃ ৯৭৫ খ্রীঃ) পুত্র, পঞ্চম আবদুর রহমানের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিশামকে ১০২৭ খ্রীঃ জুন মাসে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হিশাম ১০২৯ খ্রীঃ ডিসেম্বর মাসে আলপুয়েন্তে হইতে কর্ডোভা আগমন করেন। তাহার ভ্রাতার হত্যার পর তিনি সেখানে পলাইয়া যান। আরামপ্রিয় ও অস্থিরচিত্ত হিশাম তাঁহার পরামর্শদাতা ও অভিজাত শ্রেণীর আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করিতে ব্যর্থ হন। তাহারা হিশামের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তদুপরি হিশাম জনৈক অযোগ্য ও অপদার্থ হাকামকে তাঁহার হাজীব

নিযুক্ত করেন যিনি তাহার প্রভকে লাম্পট্য ও অমিতাচারে উৎসাহিত করেন, ফলে কোষাগার শূন্য হইয়া যায় ও সৈনিকদের বেতন বকেয়া পড়ে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর উপর কর ধার্য করিয়া এবং রাজপ্রাসাদের আসবাবপত্র বিক্রয় করিয়া যে অর্থ পান রাষ্ট্রের খরচ বহনের জন্য তাহা যথেষ্ট ছিল না। তিনি বিভিন্ন পন্থায় অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেন। ধর্মনেতাদিগকে তিনি অতি সহজে ব্যবহার করিতে পারিতেন কিন্তু তিনি তাহাদিগকে অসন্তুষ্ট করিয়া তোলেন। তিনি অভিজাত শ্রেণীর বিদ্রোহী নেতা ইবনে জাওহারকেও দমন করিতে ব্যর্থ হন। তিনি তাহাকে পরিষদের কার্যালয় হইতেও বহিষ্কার করিতে ব্যর্থ হন। সমস্ত স্পেনবাসী সরকারের স্থিতিহীনতায় খেলাফতের অবসানের জন্য আগ্রহী হইয়া ওঠে। ততীয় হিশামের স্থলে অপর কাহাকেও খলিফার আসনে বসাইবার জন্য উপদেষ্টা পরিষদ চিন্তা ভাবনা করিতে আরম্ভ করে। তৃতীয় হিশামের আত্মীয় জনৈক উমাইয়ার সহিত যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। ১০৩১ খ্রীস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে ষড়যন্ত্রকারীগণ প্রধান মন্ত্রী হাকামকে হত্যা করে এবং উপদেষ্টা পরিষদের প্রেসিডেন্ট ইবনে জাওহারের পক্ষে হিশামকে সিংহাসন ত্যাগ করিতে বাধ্য করে। তৃতীয় হিশামকে কারারুদ্ধ করা হয়। সেখান হইতে তিনি মেরিদাতে পলায়ন করেন ও ১০৩৬ খ্রীঃ মৃত্যু বরণ করেন। দেশ হইতে উমাইয়াদেরকে উৎখাত করা হয়। ইবনে জাওহারের নেতৃত্বে পৌরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাসন কর্ডোভার শহরতলী এবং শহরের বাহিরের জনগণ মানিয়া লইতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে।

উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতন

এগারো শত খ্রীস্টাব্দে স্পেনের উমাইয়া সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হইয়া যায় এবং প্রত্যেক প্রদেশ স্বাধীনতা দাবী করে। আরব, স্পেনীয় স্লাভ অথবা বার্বার নেতাদের নেতৃত্বে মুলুকুল তাওয়াইয়া নামে বহু সংখ্যক ছোট ছোট রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০৩১ খ্রীস্টাব্দে সীমান্তবর্তী তিনটি প্রদেশ ব্যতীত আল আন্দালুসের তেরোটি শহর কমবেশি স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

প্রাচ্যে উমাইয়া রাজবংশের পতনের পর স্পেনে উহার পুনঃপ্রতিষ্ঠা মধ্যযুগের আরবের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। উমাইয়া রাজবংশ সর্বপ্রথম মুসলিম বিশ্ব হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া স্পেনে প্রকৃত রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। যোগ্য ও সাহসী শাসকদের শাসনাধীনে মুসলিম স্পেন আব্বাসী ও ফাতেমী আক্রমণকে প্রতিহত করে। তাঁহারা ফ্রাঙ্ক এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে সফলতার সহিত যুদ্ধ করেন। শান্তিয়াগো ডি কম্পোস্টিলা অধিকার করিয়া খ্রীস্টানদিগকে সেখান হইতে বিতাড়িত করার ফলে তাহারা ভীষণভাবে অবমাননা বোধ করে। স্পেনের প্রথম খলিফা যখন উমাইয়া রাজবংশের পতাকা বোবাস্ট্রো ও টলেডোতে উড্ডয়ন করেন সেই সময় হইতে স্পেনে উমাইয়াদের শাসন সুদৃঢ় হয়। মধ্যযুগীয় বার্বারদের রাজনৈতিক সংবিধান আলোচনাকালে ই, এফ, গান্টিয়ার (E. F. Gantier) বর্ণনা করেন যে,

উমাইয়া রাষ্ট্র ভূইফোর রাষ্ট্র ছিল না। যাহা রাত্রিতে জন্মলাভ করিয়া ভোরবেলা বিলুপ্ত হয়। কিন্তু ইহা পরিপূর্ণরূপ পরিগ্রহ করিতে মাত্র পঁচিশ বৎসর সময় লাগে। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক যে সমস্ত কারণে রাজ্যের স্থিতিশীলতা ও সংহতি বিনষ্ট হয় তাহা অবোধগম্য নহে।

অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ

দ্বিতীয় হিশাম ও আবদুর রহমান সাঞ্চোলের দুর্বলতা আমীর ও পরবর্তী উমাইয়া রাজ প্রতিনিধিদের অত্যাচার ও স্বৈরাচার, জনসাধারণের ব্যাপারে বার্বার ও স্লাভদের হস্তক্ষেপ, কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা, নব মুসলিমদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সম্প্রদায় ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন প্রভৃতি উমাইয়া সামাজ্যের পতনের কারণ। সেনাবাহিনীর নৈতিক অধঃপতন এবং অভিজাত শ্রেণীর বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গিও উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। প্রায় প্রত্যেক শাসকই তাহার নিজের কল্যাণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। শাসিতের কল্যাণের প্রতি অধিকাংশ ছিলেন উদাসীন। কোন স্বেচ্ছাচারী শাসক কেবলমাত্র শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই জনগণের আনুগত্য আদায় করিয়া থাকে। আমীর অথবা খলিফারদের শাসনকালে সাধারণত রাষ্ট্রে অনৈক্য দেখা দেয়। প্রাচ্যের ন্যায় ইসলামী সংস্কৃতি স্পেনে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে না সত্য তথাপিও তৃতীয় আবদুর রহমান হাজীব আল-মনসুরের ন্যায় অত্যাচারী এবং স্বৈরাচারী শাসকও ইসলামী ধর্মবেত্তাগণকে অবজ্ঞা করিতে সাহস করেন না। পরবর্তীকালের উমাইয়া শাসকগণ ক্রমবর্ধমান হারে পার্থিব সুখ শান্তি ও বিলাস ব্যাসনে লিপ্ত হন। তাহারা ধর্মনেতা ও বিচারকদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করিতে শুরু করেন।

পূর্ববর্তী শাসকগণ তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাহারা উমাইয়া নেতৃত্বের উপর অসন্তুষ্ট হইয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাহারা প্রকৃতই পার্থিব ও আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপ ও ক্ষমতাকে তাহাদের মধ্যে একত্রিত করিতে চাহিয়াছিলেন। শাসকদের অনীহার ফলে তাঁহারা তাহাদের মঞ্চ হইতে রাজাদের বিরুদ্ধে খোতবা প্রদান করিতে শুরু করেন এবং এইরূপে জনগণের মধ্যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় হাকামের উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় হিশাম ছিলেন অপ্রাপ্ত বয়স্ক। ফলে মনসুর রাষ্ট্রের উপর তাহার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হন। ইহাতে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে পুনরায় অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। ফলে পুরাতন শত্রুতা মাথা চাড়া দিয়া ওঠে। মনসুর তাহার জীবিতকালে তাহার বুদ্ধিমত্তা, চাতুর্য ও শক্তি দ্বারা রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষা করেন।

মনসুরের ন্যায় বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা না থাকায় তাঁহার উত্তরাধিকারীগণ উমাইয়া সিংহাসনের অবশিষ্ট সময়ে মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখিতে ব্যর্থ হন। তাঁহাদের গৃহীত কার্যক্রম। জনগণ ও সৈনিকগণকে অভ্যন্তরীণ গোলযোগে অংশ গ্রহণ করিবার সুযোগ প্রদান করে।

খেলাফতের সব চাইতে বড় দুর্বলতা ছিল রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন গোত্র ও বিভিন্ন ধর্মের লোকদের উপস্থিতি। দুর্বল শাসকদের আমলে বিশেষ করিয়া উমাইয়া শাসনের শেষ চব্বিশ বৎসরে দশজন অপদার্থ শাসক বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ক্ষমতার সমতা বিধানে ব্যর্থ হন। রাজ্য পরিচালন ভার খলিফার আওতার বাহিরে চলিয়া যায় এবং বিভিন্ন দল নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পুনঃপুনঃ পুরাতন এই গৃহবিবাদ সংঘটিত হওয়ায় ও স্বাধীন ইমারত প্রতিষ্ঠা আবদুল্লাহর সময়ে গৃহ যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে। এই বিদ্রোহকে দমন করিবার জন্য প্রথম আবদুর রহমান ও তৃতীয় আবদুর রহমানের ন্যায় কোন শক্তিশালী ব্যক্তি তখন ছিল না। জাতিগত পার্থক্য ও শত্রুতা বার্বার ও নব মুসলিমদের সহানুভূতি লাভ করে। তাহারা আরবদের পরম শত্রুতে পরিণত হয় এবং গোত্রগত পার্থক্য দেশের মধ্যে বিরোধ ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। আমীর আলী বলেন, “প্রাচীন আরব সমাজ তাহার নৈতিকতাবোধ ও দোষত্রুটিসহ অবলুপ্ত হয়।”৬ জাতীয় ঐক্য তৃতীয় আবদুর রহমান ও মহান হাজীব ইবনে আবি আমীর মুহাম্মদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। দুর্বল শাসকদের সময়ে তাহা অন্তর্হিত হয়।

ইবনে আবি আমীর রাজ্যকে সুসংহত করিবার প্রচেষ্টায় এবং অন্যদের প্রতি বিশ্বাসের দরুন প্রশাসনের সমস্ত বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে নিজে দেখাশোনা করিতেন। এই অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের ফলে সরকারি কর্মচারীবৃন্দ ও দূরবর্তী জেলাসমূহের শাসকগণ বিদ্রোহী হইয়া ওঠে। তাহারা মনে করে যে তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালনের অধিকার হইতে বঞ্চিত হইতেছেন। মন্ত্রীগণ ক্ষমতাহীন হইয়া হাজীবের আদেশ নীরবে পালন করিতেন। তাহারা তাঁহার উত্তরাধিকারীদিগকে সংহতি বিরোধী কার্যকলাপে উৎসাহিত করে।

মুজারাবগণ তাহাদের গীর্জাকে, পৌরহিত্যকে এবং তাহাদের উপদেষ্টা পরিষদের অধিকারকে অক্ষুন্ন রাখেন। তাহাদের উৎসব ও পৰ্বাদি খ্রীস্টান ও মুসলমানগণ পালন করিতেন। মুজারাবদের অনেকেই আরবদের প্রথাসমূহ অবলম্বন করা সত্ত্বেও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত ছিল না। তাহারা সর্বদা দেশের উত্তরাঞ্চলের খ্রীস্টান অনু প্রবেশকারীদিগকে সাহায্য করিত এবং দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করিত। মুজারাবদের বিশ্বাসঘাতকতা ও শত্রুতার এইরূপ উদাহরণ বিরল ছিলনা। আরবদের গোত্রীয় কোন্দল ও বিদ্বেষ সাধারণ স্পেনীয়দের মধ্যে তাহাদের প্রতি অশ্রদ্ধার মনোভাব সৃষ্টি করে। ইসলামের আদর্শে সঠিকভাবে শিক্ষিত না হওয়ায় এবং আরব ও বার্বারদের মধ্যে সহজাত ঘৃণা ও বিদ্বেষের ফলে নব মুসলিমগণ উমাইয়া সিংহাসনের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয় এবং তাহাদের প্রতিবেশি খ্রীস্টানদের প্ররোচনায় মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী কার্যে লিপ্ত হয়। ইবনে মারওয়ান ও উমর বিন হাফসুন ছিলেন ইহার প্রকৃষ্ট ও জ্বলন্ত প্রমাণ। বার্বারগণ বলেন যে, তাহাদিগকে বিজিত হিসাবে বিবেচনা করা চলিবে তাহারা আরবদের সমান অধিকার দাবী করে এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যাহাতে তাহাদের দাবী আদায় করা সহজ হয়। তদুপরি আরবগণ নিজেরা ঐক্যবদ্ধ ছিলনা। রাজদরবারে স্লাভদের প্রাধান্যের ফলে আরবগণ তাহাদের বিরুদ্ধে ও খলিফাদের বিরুদ্ধে যাহারা স্লভদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন তাহাদের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ হইয়া ওঠে। তৃতীয় আবদুর রহমানের রাজত্বকালে খন্দক যুদ্ধের দুঃখজনক পরিণতি ইহার জ্বলন্ত প্রমাণ। এই যুদ্ধের সময় আরব নেতাগণ যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে নাজদা ত্যাগ করেন ফলে মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।

মুসলমান অভিজাতদের শ্রেণীবিভাগ ছিল—স্বাধীন, মুক্ত ও স্লাভ। তৃতীয় আবদুর রহমানের রাজত্বকালে বার্বার ও আরব অভিজাত শ্রেণীর ধ্বংস স্তুপের উপর বণিক, শিল্পপতি ও সৈনিকদের এক নতুন অভিজাত শ্রেণী জন্ম লাভ করে। আরব ও বার্বার জমিদারগণ গ্রামে বসবাস করিয়া বিরাট জমিদারী লাভ করে, অন্য দিকে শহরসমূহ নব মুসলিম ও মুজারাবদের হস্তে ন্যস্ত হয় শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নতি বিধানের জন্য, গুরুতর পরিণতি সত্ত্বেও উমাইয়াগণ দেশের মধ্যে সামন্ত প্রথার প্রবর্তন করেন। অভিজাত সম্প্রদায় ও আরব রাজকুমারদের মধ্যে সম্পদ ও সম্পত্তি বিতরণ করেন। তাহারা ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করেন। ফলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সময় সময় অভিজাত শ্রেণীর কতিপয় ব্যক্তিও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পতাকা উত্তোলন করে। নব মুসলিম, মধ্যবিত্ত শ্রেণী, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ যাহারা দেশের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করিতেন তাহাদের বৈষয়িক উন্নতি চরমে পৌছে কিন্তু কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকার বলিতে তেমন কিছু ছিল না।

সম্পদের প্রাচুর্য ও নতুন সামাজিক ব্যবস্থা শ্রেণীসংঘর্ষ সৃষ্টি করে। ভূত্য ও প্রভু অভিজাত শ্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। রাজধানীর সামাজিক অবস্থা এমন ছিল যে ক্ষুদ্র দুর্ঘটনা ধনী দরিদ্রের মধ্যে বিরাট উত্তেজনার জন্ম দিত। হাজার হাজার শ্রমিক বিদ্রোহ ও দাঙ্গাহাঙ্গামায় অংশ গ্রহণ করিত। ইহাতে বাড়ি ঘর পর্যন্ত লুণ্ঠিত হইত।

জনগণের বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গি বিত্তবানদের মধ্যে একে অপরকে ঠকাইয়া নিজের ভাগ্য উন্নয়নের প্রচেষ্টা তীব্রতর করিয়া তোলে। আত্মস্বার্থের উপর নির্ভর করিয়া গড়িয়া উঠিত খলিফা ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেকার সম্পর্ক। আমীরী শাসকগণের অনুসৃত নীতিকে উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা সমর্থন করিত না। সামাজিক কাঠামোতে এমন কোন আদর্শ ছিল

যাহার মাধ্যমে উচ্চশ্রেণীর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্যের স্পৃহা জাগান সম্ভব ছিল। দশম শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে আন্দালুসিয়াতে ধর্মহীনতার মনোভাব তীব্র আকার ধারণ করে।

দশম শব্দীর মধ্যভাগ হইতে শ্রেণীমিশ্রণের ফলে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায়। স্লাভদিগকে সামরিক ও বেসামরিক চাকুরীতে নিয়োগ করা হয়। হাজীব আল-মনসুর কর্তৃক আনীত বার্বারগণ পূর্ব হইতে বসবাসকারী বার্বার ও নিগ্রোদের হইতে দৃষ্টি ভঙ্গিতে ভিন্নতর ছিল। একাদশ শতাব্দীতে একই প্রকৃতির সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও শ্রেণী মিশ্রণ বিরল হইয়া ওঠে। অধিকাংশ স্লাভগণ পরিশেষে স্বাধীন হইয়া যায় এবং শহরে বসতি স্থাপন করে এবং নাগরিক জীবনে উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসাবে নিজদিগকে প্রতিষ্ঠা করে।

আব্বাসী ও ফাতেমী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হইবার পর উমাইয়াগণ প্রাচ্য হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। ফলে উত্তর আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের স্লাভ অধ্যুষিত দেশসমূহ হইতে সৈন্য সংগ্রহ করিতে হয়। রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড সৈনিকদিগকে সাধারণত বার্বার ও খ্রীস্টানদের মধ্য হইতে সংগ্রহ করা হইত। মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষে তাহারা যুদ্ধ করিত শুধু টাকার জন্য, রাষ্ট্র ও জাতীয় কল্যাণের জন্য নয়। উমাইয়া শাসনের শেষ প্রান্তে দুর্বল শাসন ও ভঙ্গুর অর্থনীতির যুগে এই সৈনিকগণ রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির সহিত যোগদানে দ্বিধা করিত না। উমাইয়া ও খ্রীস্টানদের লুণ্ঠন কার্যের দরুন স্পেনের খ্রীস্টান ও মূরজাতির মধ্যে সম্পূর্ণ এক মুক্ত ও স্বাধীন ভূখণ্ডের সৃষ্টি হয়। মানুষ ও অর্থের অভাবে এবং যাযাবর জাতীয় যুদ্ধনীতির ফলে যুদ্ধ কখনও সঠিকভাবে সমাপ্ত হয় না। অভিজাত সম্প্রদায় ও খলিফার নিকট-আত্মীয়গণ রাষ্ট্রবিরোধী হইয়া ওঠে এবং বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে। তাহারা দেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের জন্য দেশের উত্তরাংশের খ্রীস্টান নেতাদিগকে আহবান জানায়। বহু গভর্নর ও সেনাপতিগণ এই বিশৃংখলার সুযোগ গ্রহণ করিয়া নিজেদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কেহ কেহ যেমন—সিউটার গভর্নর আলী ইবনে হাম্মুদ ও মালাগার গভর্নর ইয়াহিয়া অল্পদিনের জন্য কর্ডোভার সিংহাসন দখল করে।

বানু আমীরকে সাধারণ জনগণ ও বিশেষ করিয়া ধর্মনেতাগণ পছন্দ করিতেন না। আবু আমীরের বংশধরগণ যদি খলিফা দ্বিতীয় হিশাম ও তাহার উত্তরাধিকারীদের নামে শাসনে সন্তুষ্ট থাকিত, তাহা হইলে তাহাদের স্বৈরাচারী শাসন হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হইত। কিন্তু তাহারা সিংহাসন লাভের আশা পোষণ করিত। আবদুর রহমান সাঞ্চোল কর্তৃক সিংহাসন অধিকার, জনগণের মধ্যে বানু আমীরের বংশের প্রতি এতই ঘৃণা ও অবজ্ঞার সৃষ্টি করে যে উমাইয়াদের সহিত তাহারা শেষ সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া ফেলে। ফলে বার্বার ও স্লাভগণ জনসাধারণকে বংশীয় এবং জাতীয় ভিত্তিক বিভিন্ন দলে বিভক্ত করিবার কার্যে সমানভাবে অংশ গ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর চরিত্র ও শৃংখলার উপর ইহার বিরাট প্রভাব পড়ে। এইরূপে তাহারা রাজরক্তের অধিকারী ও সমগ্র উমাইয়া বংশকে তাহাদের শত্রুতে পরিণত করে। তাহারা ফুকাহা ও সাধারণ জনগণের সহিত যোগদান করেন।

মুজাফফরের মৃত্যুর পর বানু আমীরের পতন ঘটে এবং সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের কাঠামো ভাঙ্গিয়া পড়ে।

বাহ্যিক কারণসমূহ

উমাইয়া সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার পিছনে স্পেনের ভৌগলিক অবস্থান বিশেষ ভাবে দায়ী। ভৌগলিক অবস্থানের দরুনই দেশের উত্তরাংশে খ্রীস্টান রাজ্যের জন্ম হয়। এমন কি শক্তিশালী মুসলিম শাসকগণও এই বিপদকে অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হন এবং আস্তুরিয়ান ও ক্যাস্টিলিয়ানদের শক্তি বৃদ্ধি অনুমোদন করেন। মুসলমান কর্তৃক ফ্রান্স আক্রমণে খ্রীস্টান ইউরোপ জাগিয়া ওঠে এবং প্রতিক্রিয়া হিসাবে পীরেনীজ অতিক্রম করিয়া উহার দক্ষিণে গথিক মার্চ প্রতিষ্ঠা করে। স্পেনের উত্তরাংশের খ্রীস্টান শাসিত অঞ্চলের এমন কি মুসলিম এলাকার খ্রীস্টানদিগকে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতে অনুপ্রাণিত করে। টলেডো ও সারাগোসার বিরামহীন বিদ্রোহ ইহার জ্বলন্ত প্রমাণ। উমাইয়াদিগকে অভ্যন্তরীণ গোলযোগে তাহারা ব্যাপৃত রাখিয়াছিল যাহাতে উমাইয়ারা তাহাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টি নিবদ্ধ না করিতে পারে। তাহাদের নিজেদের নিরাপত্তা ও সংহতির জন্য কোন কোন মুসলিম শাসক আকস্মিক আক্রমণ পরিচালনা করিয়া খ্রীস্টানদের দুর্গ ও প্রাসাদসমূহ ধ্বংস করিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান ও শীতকালে বরফ পতনের জন্য এবং দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিবাদের ফলে খ্রীস্টানগণ মুসলমানদের হস্তে সম্পূর্ণ রূপে পরাভূত হয় না।

দেশের দক্ষিণাংশে বসবাসকারী আফ্রিকার বার্বারগণ যাহারা প্রথম দিকে অবহেলিত ছিল তাহারা স্পেনে উমাইয়া শাসনের অবসানের জন্য ইন্ধন যোগাইতে ছিল। উত্তর আফ্রিকার তরফ হইতে এই বিপদ আরও মারাত্মক ছিল। স্পেনের শাসকগণ বহুল পরিমাণে বার্বারদিগকে তাহাদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিয়া ভুল করে। অবশেষে তাহারা তাহাদের বিরুদ্ধাচারণ করে ও তাহাদিগকে ক্ষমতাচ্যুত করে। স্বৈরাচার বিশৃঙ্খলার যুগে স্পেনে বহু সংখ্যক বাবার অনুপ্রবেশ করে।

আব্বাসী ও ফাতেমীদের সহিত উমাইয়াদের সম্পর্ক বিছিন্ন হওয়ায় প্রাচ্য হইতে সেনা সংগ্ৰহতেই শুধু তাহারা বঞ্চিত হয় না প্রয়োজনের সময় সামরিক সাহায্য লাভেও ব্যর্থ হয়। আব্বাসী ও ফাতেমীদের প্রতিরোধ করিবার জন্য তাহারা বাইজান্টাইন ও জার্মানদের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। প্রয়োজনের সময় এই বন্ধুত্ব অকেজো বলিয়া প্রমাণিত হয়। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতাও তাহাদের ধ্বংসের অন্যতম কারণ।

আন্দালুসিয়ার খলিফা এমনই দুর্দশাগ্রস্ত ও নিঃসহায় অবস্থায় পতিত হয় যে মাহদী কাটালানগণের সাহায্য ও সহযোগিতা এবং তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী সুলায়মান ক্যাস্টাল ও লিওনের খ্রীস্টানদের নিকট হইতে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। এইরূপে মুসলমানগণ গ্যালেসিয়ান ও খ্রীস্টানদিগকে মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করিবার জন্য

আহবান করেন। লিওন ও ক্যাস্টিলিয়ান প্রধানদের দাবী ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাইতে থাকে। ফলে তৃতীয় আবদুর রহমান ও মহামতি হাজীব আল-মনসুর খ্রীস্টান নেতাদের আক্রমণ প্রতিহত করিবার উদ্দেশ্যে দেশের উত্তরাংশে যে সমস্ত শহর ও দুর্গ নির্মিত হইয়াছিল তাহা সমর্পণ করিতে হয়। ছিন্নমূল খ্রীস্টানদিগকে চাকুরী দেওয়ায় দেশের সমস্ত জনগণ কর্ডোভার শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হইয়া ওঠে। অগণিত সমৃদ্ধশালী গ্রাম জনশূন্য ও শস্যক্ষেত্র ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। দেশের উত্তরাংশের শক্তিশালী ঘাটির পতন ঘটে এবং দেশের পূর্ব পশ্চিমের গভর্নর নিজদিগকে স্বাধীন বলিয়া দাবী করে। এইরূপে স্পেনের বিশাল উমাইয়া সাম্রাজ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হইয়া যায়। যাহা পুনরায় আর কখনও একত্রিত হয় নাই।

তথ্য নির্দেশ

এন্টনিও প্রিটো ওয়াই ভাইভস, লস রিইয়েচ ডি তাইফাস, মাদ্রিদ, ১৯২৬. পৃঃ ১৪। এন্টনিও প্রিটো ওয়াই ভাইভস্, ঐ, পৃঃ ১৫-১৬। ঐ, পৃঃ ১৬। এমিলিও গার্সিয়া গমেজ, হিট্রোরিয়া ডি ইস্পনা, ৪র্থ খণ্ড, মাদ্রিদ, ১৯৫০, পৃঃ ৪৮৭, টীকা-৩৬। ঐ, পৃঃ ৪৫৬। আমীর আলী, হিস্ট্রি অব দি স্যারাসিনস, লন্ডন, ১৯৫১, পৃঃ ৩২৫। আমীর আলী, ঐ, পৃঃ ৫২৫। ডজি, পৃঃ ৫৩৫; আমীর আলী, পৃঃ ৫২৫-২৬।

সকল অধ্যায়

১. উপক্রমণিকা (মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাস)
২. প্রথম অধ্যায় : মুসলমানদের স্পেন বিজয়
৩. দ্বিতীয় অধ্যায় : দামেস্ক-খেলাফতের অধীন উমাইয়া আমীরদের শাসন
৪. তৃতীয় অধ্যায় : স্বাধীন উমাইয়া আমীরদের রাজত্ব
৫. চতুর্থ অধ্যায় : প্রথম হিশাম
৬. পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম হাকাম
৭. ষষ্ঠ অধ্যায় : দ্বিতীয় আবদুর রহমান
৮. সপ্তম অধ্যায় : প্রথম মুহাম্মদ
৯. অষ্টম অধ্যায় : মুনজির ও আবদুল্লাহ
১০. নবম অধ্যায় : উমাইয়া খিলাফত
১১. দশম অধ্যায় : দ্বিতীয় হাকাম
১২. একাদশ অধ্যায় : হাজীব আল-মনসুর
১৩. দ্বাদশ অধ্যায় : স্পেনে উমাইয়া খিলাফতের পতন
১৪. ত্রয়োদশ অধ্যায় : স্পেনের উত্তরাঞ্চলে খ্রীস্টান রাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয়
১৫. চতুর্দশ অধ্যায় : প্রথম পর্যায় ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহ
১৬. পঞ্চদশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পর্যায় – উত্তর আফ্রিকার শাসন
১৭. ষষ্ঠদশ অধ্যায় : তৃতীয় পর্যায়ঃ নাসরী রাজবংশ
১৮. সপ্তদশ অধ্যায় : মরিস্ক জাতি
১৯. অষ্টাদশ অধ্যায় : স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের কারণসমূহ
২০. উনবিংশ অধ্যায় : শাসনকার্য ও প্রশাসন
২১. পরিশিষ্ট-ক : ইক্রিতিশে কর্ডোভান মুসলমানদের শাসন
২২. পরিশিষ্ট-খ : স্পেনে মুসলিম শাসকদের বংশানুক্রমিক তালিকা
২৩. পরিশিষ্ট-গ : উত্তর-স্পেনে খ্রিষ্টান শাসকদের কালানুক্রমিক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন