দ্বিতীয় পর্যায়
(১০৯১-১২৪৮ খ্রীঃ)
পঞ্চদশ অধ্যায়
১। মুরাবিতুন রাজবংশ (১০৯১-১১৪৬ খ্রীঃ)
মুরাবিতুন রাজবংশের উৎপত্তি ও মুরাবিতুন রাজবংশের পাঁচজন রাজা (তাফিন, আমীরুল মুসলিমীন ইউসুফ বিন তাশফিন, আমীরুল মুসলিমীন আলী বিন ইউসুফ, তাফিন ও আবু ইসহাক) প্রায় নব্বই বৎসর রাজ্য শাসন করেন। স্পেনীয় শব্দ আল মুরাভিদ আরবী আল মুরাবিত শব্দ হইতে উৎপন্ন। ইহার অর্থ রিবাতে (সরাইখানা ও সুরক্ষিত খানকাতে) বসবাসকারী সন্ন্যাসী। আন্দালুসিয়ানদের দ্বারা আফ্রিকা দখল হওয়ার পর হাজীব আল-মনসুরের সময় উহা দুর্বল হইয়া পড়ে। বার্বারগণ মুরাবিত (পবিত্র) নামক তাদের ধর্মীয় নেতার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসেন এবং আলজিরিয়া হইতে নাইজার অথবা সেনেগাল নদী পর্যন্ত সমস্ত আফ্রিকায় তাহাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সিনহাজাহ গোত্রের লামতুনাহ শাখা মুসা ইবনে নুসায়েরের পতাকাতলে ইফ্রিকিয়া-স্পেনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তাহারা সাহারা মরুভূমির তপ্তবালির উত্তাপ হইতে রক্ষার জন্য লিসাম ( বোরকা) ব্যবহার করিতেন। তাহার পর মুরাবিতুনগণ মুলাস সামুন নামে পরিচয় লাভ করে। মুরাবিতুন অথবা মুলাস সামুন শব্দ দ্বয়ের মূল সম্পর্কে মতভেদ আছে। কাহারো কাহারো মতে তাহারা হিমারীয় গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। ইহারা হযরত আবু বকরের সময় ইয়ামান হইতে সিরিয়া (শাম) এবং তৎপর আলমাগরিবে বসতি স্থাপন করে।
অন্যদের মতে, তাহারা বার্বারদের সিনহাজাহ গোত্র হইতে উদ্ভূত। সিনহাজাহ গোত্রের জনৈক জাদ্দালাহ নেতা ইয়াহিয়া বিন ইব্রাহিম ১০৩৯ খ্রীঃ হজ্জ সমাপনান্তে মক্কা হইতে ফিরিবার পথে জনৈক মালেকী বিচারক ও সুফী আবু ইমরান আল-ফাসির সহিত কায়রোওয়ানে, মিলিত হইয়া তাহারা গোত্রের লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য জনৈক ধর্ম প্রচারককে প্রেরণের অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। সেই অনুসারে নাফিসের (মরক্কোর নিকটবর্তী) অধিবাসী আবদুল্লাহ বিন ইয়াসিন আল জাযুলী সেখানে প্রেরিত হন। তিনি একটি রিবাত (সুরক্ষিত মঠ) নির্মাণ করেন। নাইজারের (সেনেগাল) এলবার্ট দ্বীপে তাহারা শিষ্যদের মধ্যে লামতুনা গোত্রের দুই ভ্রাতা ইয়াহিয়া বিন ওমর ও আবু বকর বিন ওমর ছিলেন। লামতুনা, মাসমুদা ও অপরাপর গোত্রের বার্বার যোদ্ধাগণের ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতা হিসাবে আবদুল্লাহ বিন ইয়াসিন আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি দ্বিধাবিভক্ত বার্বার গোত্রগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তাহার শিষ্যদিগকে লইয়া সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং তাহার প্রধান শিষ্য ইয়াহিয়া
বিন ওমরের নেতৃত্বে অর্পণ করেন। তিনি ওয়াদী দারা পর্যন্ত অগ্রসর হন ও সিজিলমাশা অধিকার করেন। যাহা মুসা ইবনে নুসায়ের দখল করিতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন। আল মুরাভিদ অতঃপর ১০৫৯ খ্রীঃ বারগাওয়াতাহর বার্বারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে নিহত হন। এই সব বাবার ধর্মীয় নেতা সালিহর অনুসারী ছিল। রাজ্য বিস্তারের প্রথম পর্যায়ে তাহাদের রাজধানী সিজিলমাশাহ হইতে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়।
ইয়াহিয়ার পর তাহার ভ্রাতা আবু বকর তাহার স্থলাভিষিক্ত হন। যিনি বারগাওয়াহকে পরাজিত করেন। তিনি ইদ্রিসী রাজ্যকে তাহার রাজ্যের সহিত একিভূত করেন এবং নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। আলমুরাভিদ রাজা সমস্ত মরক্কো ও মৌরিতানিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইহার দক্ষিণে সেনেগাল নদীর অববাহিকা ও উত্তরে আলজিরিয়ার পশ্চিম অংশ অবস্থিত ছিল। ১০৬২ খ্রীঃ মারাকুশে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সামঞ্জস্য থাকার দরুন আলমুরাভিদগণ সিনহাজাহ গোত্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ দূর করিয়া ঐক্য স্থাপনে সফল হন। তাহার পিতৃব্য পুত্র ইউসুফ বিন তাশুফিনের উপর সাম্রাজ্যের শাসনভার অর্পণ করিয়া তিনি মরু অঞ্চলে মুরাবিতুনদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গমন করেন। সেখান হইতে ফিরিয়া তিনি তাহার রাজ্য পুনরুদ্ধার করিতে ব্যর্থ হইয়া নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য হন এবং শেষ পর্যন্ত ১০৮৭/৮ খ্রীঃ মৃত্যুবরণ করেন।
সংক্ষেপে এই হইল মুরাবিতুনদের প্রাথমিক ইতিহাস। তাহাদের নিকট হইতে আন্দালুসিয়ান মুসলিম শাসকগণ বিপদের সময় সাহায্য কামনা করিতেন। মুরাবিতুন শাসক ইউসুফ বিন তাশুফিন আব্বাসীয় খলিফাদের নিকট হইতে ‘আমিরুল মুসলিমীন’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন এবং ধর্মীয় মতের জন্য এরূপ সুখ্যাতি অর্জন করেন যে, ইমাম গাজ্জালী তাহার দর্শন লাভের অভিপ্রায় জ্ঞাপন করেন। (১০৮৬ খ্রীঃ ইউসুফ বিন তাশুফিন স্পেনে আগমন করেন) তাহার সহিত কর্মঠ বার্বার সেনার বিরাট বাহিনী আলজেসিরাসে পদার্পণ করে। আলজেসিরাস তাহার সৈন্যের ঘাটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সেভিলের নিকটে মুতামিদসহ মুসলিম নেতা ও রাজা তাহার সহিত যোগদান করেন। প্রায় বিশ হাজার সৈন্যের সম্মিলিত বাহিনী বাদাজোজের দিকে অগ্রসর হইয়া ১০৮৬ খ্রীঃ জাল্লাকায় শত্রুদের সম্মুখীন হন। এক রক্তাক্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং খ্রীস্টানগণ এই যুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত হয়। ষষ্ঠ আলফন্সে শুধু তিনশত সৈন্য লইয়া পলায়ন করিতে সমর্থ হয়। ইউসুফ বিন তাশুফিন আন্দালুসীয় মুসলমানদের ত্রাণকর্তা হিসাবে বিবেচিত হইতে থাকেন। অঙ্গীকার মোতাবেক ইউসুফ তাহার নবনির্মিত রাজধানী মারাকুশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু তিনি তিন হাজার সুদক্ষ সেনাকে মুতামিদের অধীনে রাখিয়া আসেন।
ইউসুফের স্পেন ত্যাগের অব্যবহিত পর খ্রীস্টানগণ মুসলমানদের সহিত পুনরায় সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়। খ্রীস্টানগণ যদিও ভ্যালেন্সিয়া রাজ্য ত্যাগ করিয়াছিল এবং সারাগোসার অবরোধ তুলিয়া লইয়াছিল তথাপিও মুসলিম রাজ্য মুরসিয়া, লোরকা ও আলমেরিয়ায় তাহাদের বিরাট প্রভাব ছিল। মুরসিয়া ও লোরকার মধ্যে অবস্থিত আলেডো খ্রীস্টানদের শক্তিশালী ঘাটিতে পরিণত হয়। অনৈক্যের ফলে মুসলমানগণ ক্রমে ক্রমে দুর্বল হইয়া খ্রীস্টানদের আক্রমণ প্রতিহত করিতে অক্ষম হইয়া পড়ে। মুসলমানগণ জাল্লাকার যুদ্ধে বিজয় লাভে উৎসাহিত হইয়া মুরসিয়াসহ পূর্বাঞ্চল হইতে খ্রীস্টানগণকে উৎখাত করিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু মাত্র সাতশত খ্রীস্টানযোদ্ধার হাতে তিন হাজার মুসলিম সৈন্য পরাজিত হয়। এই পরাজয়ের ফলে মালেকী ফকিহগণ, বিশিষ্ট মুসলিমনেতা মুতামিদ এবং ইউসুফ ইবনে তাশফিনকে পুনরায় স্পেনে আমন্ত্রণ জানান। ইউসুফ ১০৯০ খ্রীস্টাব্দে বসন্তকালে পুনরায় আলজেসিরাসে পদার্পণ করেন। ইউসুফের আগমনে সেভিলের মুতামিদ, মালাগার তামিম, গ্রানাডার আবদুল্লাহ, আলমেরিয়ার মুতাসিম, ও মুরসিয়ার ইবনে রাশিক তাঁহার সহিত যোগদান করেন। আলেডোর শক্তিশালী ঘাঁটি, যেখান হইতে মুসলিম অধ্যুসিত এলাকায় খ্রীস্টানগণ অভিযান পরিচালনা করিত। মুসলিম সেনাবাহিনী সেই দুর্গের দিকে অগ্রসর হয়। ১৩,০০০ হাজার খ্রীস্টান এই দুর্গ রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। দীর্ঘ চার মাস এই দুর্গ আবরুদ্ধ থাকে। মুসলমানদের মধ্যে পুনরায় ব্যক্তিস্বার্থ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়া ওঠে।
আলমেরিয়ার রাজা সেভিলের শাসককে উৎখাত করিতে উদ্যত হয়। শেষোক্ত ব্যক্তি ইবনে রাশিককে ক্ষমতাচ্যুত করিতে চেষ্টা করেন যিনি তাহার রাজ্যের অন্তর্গত মুরসিয়া দখল করেন এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে আলেডোর খ্রীস্টানদের সাহায্য ও সহযোগিতা করেন। তাহারা ছিল অদূরদর্শী। ফলে ইউসুফের নিকটে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করেন। ইবনে রাশিক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং মুরসিয়াগণ ক্যাম্প ত্যাগ করে ও সেনাবাহিনীতে লোক, টাকাপয়সা ও রসদ সরবরাহে অসম্মতি জানায়। খাদ্য সরবরাহের স্বল্পতা এবং মুসলমান নেতাদের মধ্যে বিদ্বেষ ইউসুফকে অবরোধ অপসারণে বাধ্য করে এবং তিনি লোরকাতে গমন করেন। গোত্রীয় নেতাগণের একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসের ফলে তাহারা আলফলোকে প্রতিহত করিতে ব্যর্থ হন। ইউসুফ মুসলমানদের সার্বিক স্বার্থের কথা ভাবিয়া তাহার অধীনে আন্দালুসকে ঐক্যবদ্ধ করিবার চেষ্টা করেন। মালিকী ফুকাহগণের প্ররোচনায় ইউসুফ গ্রানাডা অবরোধ করেন এবং কাজী আবু জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার দরুন ইহা অতি সহজে ইউসুফের হস্তগত হয়। তিনি তাহার প্রতিনিধি সির বিন আবু বকর মুহাম্মদ বিন তাফিনকে স্পেনে রাখিয়া মরক্কো প্রত্যাবর্তন করেন।
মালাগা, কর্ডোভা, সেভিল ও অন্যান্য স্থানের মুসলিম নেতাগণ ইউসুফের প্রতিনিধির বিরুদ্ধে খ্রীস্টানদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ইমাম গাজ্জালীসহ স্পেন উত্তর
আফ্রিকা ও এশিয়ার উলেমাদের নিকট হইতে জিহাদের ফতোয়া লইয়া সির বিন আবু বকর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং কর্ডোভা অধিকার ও সেভিল অবরোধ করেন। অলিভার ফানেজের অধীনে ক্যাস্টিলের সেনাবাহিনী মুতামিদের সাহায্যার্থে দ্রুত অগ্রসর হন এবং সির বিন আবু বকরের সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্ন অংশ কর্তৃক আলমোদোভার নিকটে পরাজিত হন।
দীর্ঘ প্রতিরোধের পর ৭ই সেপ্টেম্বর ১০৯০ খ্রীস্টাব্দে সেভিলের পতন ঘটে এবং মুতামিদ তাহার পরিবারের লোকজনসহ আগমাতের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। মুতামিদের দুই পুত্র মুদাত ও রাজী কর্তৃক রক্ষিত মেরটোলা ও রোভাও অবশেষে আল মুরাভিদের হস্তগত হয়। খ্রীস্টাননেতা রোডরিগো দিয়াজ ডে বিভার সাধারণত সিদ (আরঃ সাইয়েদ) নামে পরিচিত, অধীন পূর্বাঞ্চলের ভ্যালেন্সিয়া ব্যতীত আলমেরিয়া, মুরসিয়া ডেনিয়া, জাতিভা, বাদাজোজ ও অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা একের পর এক ১২৯৪ খ্রীঃ সির বিন আবু বকরের হস্তগত হয়। সিদের মৃত্যুর (১১০২ খ্রীঃ) পর তাহার বিধবা পত্নী জিমেনার অধীনে ভ্যালেন্সিয়ার পতন ঘটে। ষষ্ঠ আলফন্সের বিরুদ্ধে মুরাবিতুনদের বিজয় লাভ আলমুরাভিদ সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয়। বানুহুদ নেতা মুস্তাইন শাসিত সারাগোসা ও বানু রাজিনের অধীন লা সাহলা ব্যতীত সম্পূর্ণ আন্দালুসিয়া তিন বৎসরের মধ্যে মুরাবিতুনদের অধিকারে আসে এবং স্পেনের ১৩ জন মুসলিম শাসক ইউসুফ বিন তাশফিনকে করদানে বাধ্য হয়। নতুন অর্থনৈতিক পদ্ধতির অধীনে স্পেনের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়। কর আদায়ের ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি সত্ত্বেও ইউসুফ তাহার উত্তরাধিকারীর জন্য কোষাগারের ৬০,০০০ সের (১২০,০০০ পাউন্ড) স্বর্ণ গচ্ছিত রাখিয়া যান। তাহার শাসনামলে জীবিকা নির্বাহের সামগ্ৰীসমূহ খুবই সস্তা ছিল এবং জনসাধারণ মুরাবিতুনদের শাসনাধীনে খুবই সুখ-শান্তিতে জীবন যাপন করিত।
ইসলাম ধর্মের উপরে গুরুত্ব প্রদানের ফলে এবং বিচারকদের প্রভাবের দরুন আলমুরাবিদ শাসন আমলে খ্রীস্টান ও ইহুদীদের জীবন কিছুটা বিপন্ন হইয়া ওঠে। মুজারাবগণ বরাবরই মুসলিম শাসকদের অনুগত ছিল না। বিশেষ করিয়া গোত্রীয় প্রধানগণ সর্বদা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকিয়া মুসলিম শাসিত এলাকায় আকস্মিক আক্রমণ করার জন্য খ্রীস্টান শাসকদিগকে সাহায্য করিত। মুসলিম এলাকার মধ্যে মুরাবিতুনদের মোকাবিলা করিবার জন্য তাহারা খ্রীস্টানদিগকে সাহায্য করে। পশ্চাদপসারণের সময় হাজার হাজার সৈন্য তাহাদিগকে অনুসরণ করে। আলী বিন ইউসুফ তাহাদেরকে সাফী ও মেকনেস শহরে পুনর্বাসন করেন। খ্রীস্টান ও ইহুদীগণ তাহাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করিতেন কিন্তু নতুন কোন গীর্জা ও ইহুদীদের উপাসনালয় নির্মাণ করিবার অনুমতি ছিল না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম শাসকগণ যে সকল স্বাধীন মতাবলম্বীদের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন মুরাবিতুন শাসক তাহাদিগকে নিরুৎসাহিত করেন। যদিও
ধর্মনিরপেক্ষ কবিগণ সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তথাপিও মুরাবিতুন শাসন আমলে চারুশিল্প এবং জনপ্রিয় কবিতা ও গানের উন্নতি সাধিত হয়।
আলী ডাকনাম। আবুল হাসান, ইউসুফ বিন আশুফিনের পুত্র ও উত্তরাধিকারী। ১১০৭ খ্রীস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ কালে তাহার বয়স ছিল তেইশ বৎসর। তিনি আন্দালুসিয়ার শহর ও বিভিন্ন প্রদেশে অভিজ্ঞ ও অনুগত গভর্নরদিগকে নিয়োগ করেন। ইউসুফের পুত্র তামিম বানু হুদদের বিরুদ্ধে সারাগোসার জনসাধারণ ও ভ্যালেন্সিয়ার গভর্নরের সাহায্যে এবরো উপত্যকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সারাগোসা ১১১০ খ্রীস্টাব্দে অতি সহজে অধিকার করেন। সারাগোসার শাসক ইমাদুদ দৌলা রোয়েদা পলাইয়া যান এবং ১১৩০ খ্রীস্টাব্দে সেখানে দেহ ত্যাগ করেন। তামিম ষষ্ঠ আলফন্সের রাজ্য আক্রমণ করিয়া পরাজিত হন। মুতামিদের কন্যা আলফন্সের মুসলিম পত্নী জুবাইদাহর পুত্র যুদ্ধে নিহত হন। ইহার কয়েক মাস পর আলফন্সে মারা যান।
তামিম আফ্রিকা হইতে এক লক্ষ সৈন্য লাভ করেন। তাহাদের সাহায্যে তিনি ক্যাস্টিলের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করেন এবং আলফন্সের মৃত্যুর পর অসংখ্য দুর্গের ধ্বংস সাধন করেন। মুরাবিতুন জেনারেল সির বিন আবুবকর পশ্চিম স্পেন আক্রমণ করিয়া লিসবন ও সানতারেন অধিকার করেন। আলীর ভ্রাতা আমিরের মৃত্যুর পর খ্রীস্টানগণ আরাগণের বিখ্যাত যোদ্ধা (এল বাতাল্লাডোর) প্রথম আলফলো সারাগোসা, কালাতাইউদ এবং তাগুসের অদূরে অবস্থিত বহু প্রসিদ্ধ জায়গা ফ্রান্সবাসীদের সাহায্যে পুনরোধিকার করেন। পশ্চিম স্পেনের বিস্তীর্ণ এলাকা বর্তমানের পর্তুগাল ও ডুরো উপত্যকা আলী বিন ইউসুফের অধিকারে আসে। আলী নিজে বিরাট সেনাবাহিনী লইয়া খ্রীস্টান শক্তিকে ধ্বংস করিতে অগ্রসর হন। তিনি কর্ডোভা পৌছিয়া ইফ্রিকিয়ায় বিদ্রোহ সম্পর্কে অবহিত হন এবং ১১৪৫ খ্রীস্টাব্দে প্রত্যাবর্তন করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন।
আলী তাহার পিতার ন্যায় যোগ্য ছিলেন না। তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক কার্যে উদাসীন ছিলেন। এবং অধিকাংশ সময় ধর্মকর্মে ধ্যানমগ্ন থাকিতেন। তিনি তাহার পত্নী কামারের নির্দেশে পরিচালিত হইতেন। প্রকৃত পক্ষে রাজ্য পরিচালিত হইত হারেম হইতে। জনগণ সুখে শান্তিতে ছিল না এবং অভিজাত শ্রেণী ক্ষমতা গ্রহণের চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। গভর্নরগণ, সেনাপতি ও সৈনিকগণ কর্তব্যে অবহেলা করিতেন। বার্বারগণ তাহাদের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতায় আসীন থাকিয়া ইসলাম বিরোধী আদেশ প্রদান ও অসংয জীবন যাপনে লিপ্ত হয়। এই সময়ে সমরশিল্প অপেক্ষা বুদ্ধিজীবীদের আনন্দদায়ক ক্রীয়াকলাপ বেশী গুরুত্ব লাভ করে।
(১১৪৬-১২৪৮ খ্রীঃ)
আল মুয়াহিদুনের উত্থান ও মুয়াহিদুন ছিলেন আটলাস পর্বতে বসবাসকারী জাতি মাসমুদাহ উপজাতির অন্তর্গত। ১২শ শতাব্দীর প্রারম্ভে মাসমুদা গোত্রের ধর্ম সংস্কারক
ইফ্রিকিয়ায় আগমন করেন। তিনি ছিলেন আব্দুলাহ বিন তুমারাতের পুত্র আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মদ (সিঃ ১০৭৮-১১৩০)। তিনি আটলাসের হিন্তাতা গোত্রে ১০৮২ খ্রীঃ জন্মগ্রহণ করেন। তাহার পিতা ছিলেন সুস পল্লীর মসজিদের বাতি দাতা (মসজিদের খাদেম) এইজন্য তাহাকে সাররাজ বলা হইত। যৌবনকালে তিনি ছাত্র হিসাবে কর্ডোভা, কায়রো ও বাগদাদ মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য চর্চার জন্য বিখ্যাত এই তিন কেন্দ্র পরিদর্শনে যান এবং আল গাজ্জালী ও তোরতোসার আবু বকর নামে বিখ্যাত পণ্ডিতদের নিকট দর্শন ও আইন বিজ্ঞানের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি আশারী বিষয়ে নিজামীয়া কলেজে লেখা পড়া করেন। কর্ডোভাতে ইমাম গাজ্জালীর গ্রন্থসমূহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ইহা জনসাধারণের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। যুবক পর্যটক তাহার জন্মভূমি নিজ গ্রাম সুসে ফিরিয়া আসেন। মৌরিতানিয়াকে বিচ্ছিন্নকারী বিস্তীর্ণ পর্বত শ্রেণীতে বসবাসকারী বার্বারদের চারিত্রিক অবনতিতে বিরক্ত হইয়া তিনি নিজ গ্রামের মসজিদকে কেন্দ্র করিয়া তাহাদের চরিত্র উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন।
তিনি ছিলেন তাকালিদ বিরোধী, কোরআন সুন্না ও ইজমায়ে সাহাবাতে (কোন বিষয়ে রসূলের (দঃ) সাহাবাদের ঐক্যমতে দৃঢ় বিশ্বাসী। মুসলিম মসিহর ন্যায় পরবর্তী কালে তিনি নিজেকে মাহদী। (খোদার একত্ববাদ) মতবাদ প্রচার করিতেন। এই কারণেই তাহার অনুসারীদের মুয়াহিদুন বলা হইত। নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি ইসলামী আদর্শের প্রচার করিতে শুরু করেন। আলেকজান্দ্রিয়া হইতে যাত্রা শুরুকারী জাহাজের যাত্রী ও নাবিকদের মধ্যে এবং যখন যে শহরে যাইতেন সেখানকার জনসাধারণের মধ্যে তিনি তাহার মত প্রচার করিতেন। আল-মুয়াহিদুন (একত্ববাদীগণ) নামে পরিচিত অসংখ্য শিষ্য মরক্কো যাত্রা কালে তাহার অনুসরণ করে।
মাহদীর প্রথম ও প্রধান শিষ্য ছিলেন আবদুল মুমিন। তিনি ছিলেন নেদরোনার কুমিয়া গোত্রের ধনী বার্বার কুম্ভকার আলীর পুত্র। আবদুল মুমিন বুজাইয়াহর সন্নিকটে তাহার গুরুর সহিত মিলিত হন, যেখান হইতে ১১১৭/১৮ খ্রীঃ মাহদী মরক্কোর ফেজে গমন করিতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি মুহূর্তের জন্যও অবস্থান করিতে পারেন না। ঘোমটা খোলা অবস্থায় ফেজের রাস্তা দিয়া যাইবার সময়ে আলী বিন ইউসুফ-আল মুরাবিতের এক ভগ্নিকে তিনি চপেটাঘাৎ করেন। গভীর শ্রদ্ধার অধিকারী হওয়াতে তাহাকে হত্যা করা হয় না সত্য কিন্তু তাহার উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয় এবং তিনি শহর হইতে বহিস্কৃত হন। তিনি শহরের বাহিরে এক সমাধিক্ষেত্রে বসবাস করিতে শুরু করেন। মৃত্যু ভয়ে সেখান হইতে তিনি (ফেজ হইতে) একদিনের দূরত্বে অবস্থিত পার্বত্য অঞ্চলের এক সুরক্ষিত দুর্গ তিনমালে গমন করেন। তিনি সেখানে বসতি স্থাপন করেন এবং নাফিস নদীর উৎপত্তি স্থলে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন শুরু করেন এবং যাজকতন্ত্রের গোড়াপত্তন করেন। ১১২১ খ্রীঃ নিজেকে মাহদী বলিয়া দাবী করেন। আবদুল মুমিন ছিলেন এগারোজন
উপদেষ্টা সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মুয়াহিদিন সম্প্রদায়ভুক্ত বার্বার গোত্রের। পঞ্চাশ সদস্যবিশিষ্ট গঠিত অপর একটি উপদেষ্টা পরিষদ লইয়া ধর্মের নামে তিনি মুরাবিতুনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তাহাদের শাসনের বিভিন্ন দোষত্রুটি প্রকাশ ও প্রচার করিতে শুরু করেন। ফলে পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন বার্বার গোত্র মুরাবিতুনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং কর ও খাজনা দেওয়া বন্ধ করে। সুসের গভর্নর পরাজিত ও নির্বাসিত হন। প্রথম যুদ্ধেই মাহদীর বিচক্ষণতা প্রমাণিত হওয়ায় তাহার অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মুয়াহিদুন ও মুরাবিতুনদের মধ্যে সংঘঠিত তিনটি যুদ্ধে শেষোক্তদল পরাজয় বরণ করে। সীমাহীন শক্তির অধিকারী হইয়া মাহদী তাহার ৪০,০০০ হাজার অনুসারী লইয়া মরক্কো আক্রমণ করেন কিন্তু পরাজিত হন। সুদক্ষ সেনাপতি হিসাবে আবদুল মুমিনের নিকট যদিও তাহার সুনাম ও সুখ্যাতি কিছুটা ক্ষুন্ন হয় তথাপিও তিনি তাহার হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। আবদুল মুমিনকে তাহার উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করিয়া ১১২৮-৩০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে মাহদী ইন্তেকাল করেন। তাহার মৃত্যু দিবস সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রহিয়াছে। প্রধান সঙ্গী আবদুল মমিন কিছুদিনের জন্য তাহার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করিতে বিরত থাকেন এবং ইবনে তুমারতের মৃত্যুর তিন বৎসর পর পর্যন্ত তিনি উত্তরাধিকারী হিসাবে নিজেকে বহাল রাখিতে সক্ষম হন। তিনি দুইটি পরিষদকে—প্রতিনিধি পরিষদ (House of Lord), সাধারণ পরিষদ (House of Commons)-কে একত্রিত করেন।
আলী বিন ইউসুফ আলমুরাবিত তাহার প্রথম জীবন শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে অতিবাহিত করেন কিন্তু তাহার শাসনের শেষ দিনগুলি অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বৈদেশিক হস্তক্ষেপের শিকারে পরিণত হয়। ইফ্রিকিয়ার মুয়াহিদিনদের উদীয়মান শক্তিকে মোকাবিলা করিবার জন্য তিনি তাহার পুত্র তাশফিনকে স্পেন হইতে প্রত্যাবর্তনের আহবান জানান। আলী বিন ইউসুফ জীবিত থাকা কালীন আবদুল মুমিন (১১৩০-১১৪৬ খ্রীঃ) উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হন। তাশফিন স্পেন হইতে ৪০০০ মুজারাবকে আনয়ন করিয়া তাহাদের সহযোগে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়িয়া তোলেন কিন্তু মুয়াহিদিনদের মোকাবিলা করিতে ব্যর্থ হন। মুয়াহিদিন অধিকৃত তিলিমসানের (Tlemcen) নিকটবর্তী এলাকায় তাহার সেনাবাহিনী পরাজিত হয়। ফেজ, সিউটা, তাঞ্জিয়ার, আগমাত আত্মসমর্পণ করে। তাশফিন অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করিতে অক্ষম হইয়া এগার মাসের অবরোধের পর ১১৪৬ খ্রীঃ মরক্কো আব্দুল মুমিনের নিকট সমর্পণ করেন। প্রায় সত্তর হাজার ক্ষুধার্ত ও দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মারিনি কর্তৃক অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত মরক্কো আব্দুল মুমিন ও তাহার এগারজন উত্তরাধিকারী দ্বারা ১২৬৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত শাসিত হয়। আব্দুল মুমিন তাহার তেত্রিশ বৎসরের রাজত্বকালে রাজ্যের সীমানা ১২৬০
খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ত্রিপলী সীমান্তের অভ্যন্তরে সম্প্রসারিত করেন। ইহাই ছিল সর্বপ্রথম বৃহৎ মুসলিম সাম্রাজ্য যাহা গেডেস উপসাগর হইতে আটলান্টিক মহাসাগর এলাকা পর্যন্ত ও মুসলিম স্পেনের সম্মিলিত অঞ্চল লইয়া গঠিত হইয়াছিল।
যে সমস্ত বিবাদমান শক্তিসমূহের কারণে স্পেনে মুসলিম রাজ্যের ধ্বংস সাধিত হয়, মুরাবিতুনগণ সেই সমস্ত শক্তিকে স্বল্পদিনের জন্য ঐক্যবদ্ধ করেন। মুয়াহিদুনগণ ইফ্রিকিয়ায় মুরাবিতুনদের আরো সম্প্রসারণে উত্তর স্পেনের অগ্রাভিযানে বাধা প্রদান করেন। মুরাবিতুন শাসনের শুরুতে বিনা বাধায় কৃষি উন্নয়ন, কারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে কিন্তু কাব্য চর্চা ও দশর্নে জ্ঞান লাভকে উৎসাহিত করা হয় না। আন্দালুসিয়ার শ্রেষ্ঠ কবি ইবনে বাকী শহর হইতে শহরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুরিয়া বেড়ান। সেভিলের মালিক ইবনে ওয়াহাব দর্শন শাস্ত্রে জ্ঞান লাভের ইচ্ছা প্রকাশ করেন কিন্তু নিজের জীবন বিপদাপন্ন বিধায় এই ইচ্ছা ত্যাগ করেন এবং ধর্মতত্ত্বের লেখাপড়ায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কর্ডোভার কাজি ইবনে হামদুন ধর্মতত্ত্ব ও গাজ্জালীর দার্শনিক গ্রন্থসমূহ পাঠের তীব্র নিন্দা করেন। আলী বিন ইউসুফের অনুমতি লইয়া তিনি গাজ্জালীর সমস্ত গ্রন্থের ধ্বংস সাধন করেন। মুরাবিতুনগণের শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ কম ছিলো।
তাহারা ধর্ম প্রচার ও দেশ বিজয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। স্পেনে মুসলিম বিজয়ের পরে মুসা বিন নুসায়েরের সহিত সম্পাদিত চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করিয়া যে সমস্ত গীর্জা নির্মিত হইয়াছিল আলেমদের প্রভাবে সেগুলির ধ্বংস সাধন করা হয়। জনৈক গথিক মহৎ ব্যক্তি গুদিলা কর্তৃক ৬০০ খ্রীস্টাব্দে গ্রানাডাতে নির্মিত একটি গীর্জাও ধ্বংস করা হয়। বিশেষ করিয়া স্পেনের খ্রীস্টান ও ইহুদীগণ সন্তুষ্ট ছিল না। মুরাবিতুনদিগকে অত্যাচারী শাসক বলিয়া মনে করা হইত। ১১০৯ খ্রীঃ ষষ্ঠ আলফন্সের মৃত্যুর পর খ্রীস্টানগণ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয় কিন্তু মুরাবিতুনগণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতে ব্যর্থ হন। তাহারা টলেডো অধিকার করেন না। ১১১৮ খ্রীস্টাব্দে আরাগণ যোদ্ধা (el Batallador) উত্তর মার্চের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সারাগোসা প্রথম আলফন্সের নিকট ছাড়িয়া দেন। তাশুফিনের মৃত্যুর সাথে সাথে স্পেনের মুসলমানগণ তাহার প্রতিনিধি ইবনে জামীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইবনে জামী বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে পলাইয়া যান। শহর, বন্দর ও দুর্গসমূহ বিদ্রোহীগণ অধিকার করে। মুরাবিতুনদের গ্রানাডার জেলখানায় বন্দী করা হয়। ক্যাস্টিলিয়াবাসী জামীর সহিত যোগদান করিয়া প্রচণ্ডবেগে কর্ডোভা আক্রমণ করে। প্রথম আবদুর রহমান কর্তৃক নির্মিত কর্ডোভার জামে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করে এবং হযরত ওছমানের কোরান শরীফ যে কারুকার্য খচিত বাক্সে রক্ষিত ছিল উহা অশ্রদ্ধা ও বিদ্রুপ সহকারে অনাবৃত করা হয়। আফ্রিকায় মুরাবিতুনের সহিত মুয়াহিদিনদের বিরোধ খ্রীস্টানদিগকে স্পেনের মুসলিম অধ্যুসিত এলাকা ধ্বংস সাধন ও মুসলমানদের উপর চরম অত্যাচার করার
সুযোগ করিয়া দেয়। হোলের মতে, উত্তরাঞ্চলের খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের রক্ষার্থে ইউসুফের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত স্পেনে দুই পুরুষের মুসলিম শাসন ছিল সর্বাপেক্ষা দুর্বল। স্পেনের রাজনৈতিক অবস্থা বিশেষ করিয়া আলমেরিয়ার বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে অবগত হইয়া ভেনিস, জেনোয়া ও ক্যাস্টিলের নৌ-শক্তি একত্রিত হইয়া খ্রীস্টান শাসকের সাহায্যে আলমেরিয়া আক্রমণ ও অধিকার করে। ষষ্ঠ আলফন্সের পৌত্র সপ্তম আলফন্সে মুসলমানদের ক্ষতি হওয়াতে পরিতুষ্ট হয়।
বার্সিলোনার রাজা ইটালির নৌবহরের সাহায্যে তোরতোসা ও এবরো উপত্যকা অধিকার করেন। ১১৩৩ খ্রীঃ ক্যাস্টিলের সপ্তম আলফন্সে কর্ডোভা, সেভিল, কারমোনা ও কাডিজের ধ্বংস সাধন করেন। জেরেজ দগ্ধিভূত হয় এবং জায়েন, বায়েজা, উবেদা ও আন্দুজার ১১৩৮ খ্রীঃ খ্রীস্টান কর্তৃক অধিকৃত হয়। ১১৪৪ খ্রীঃ কালাতারাভা হইতে আলমেরিয়া পর্যন্ত সারা আন্দালুসিয়া খ্রীস্টানদের করায়ত্ত হয়। পুনরায় আন্দালুসের মুসলমানগণ জিব্রাল্টার প্রণালীর অপর প্রান্তে বার্বার ভাইদের সাহায্য কামনা করে। ১১৪৫ খ্রঃ মুরাবিতুন শাসনের পতনের পর হইতে শুরু করিয়া মুয়াহিদিনদের (১১৭০ খ্রীঃ) ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত স্পেনে অশান্তুি ও বিশৃঙ্খলা বাড়িতেছিল। এই পঁচিশ বৎসরকে দলীয়নেতাদের শাসনের দ্বিতীয় পর্যায় বলিয়া উল্লেখ করা হয়। এই সময়ে মুসলিম যুবরাজগণ কখনও আল মুহাদ এবং কখনও খ্রীস্টানদের প্রতি সমর্থন জানায়।
আবদুল মুমিন ১১৪৭ খ্রীঃ যখন আবু আমর মুসাকে ত্রিশ হাজার সৈন্য ও নৌবহরসহ স্পেন অধিকারের জন্য প্রেরণ করেন তখনও সম্পূর্ণ উত্তর আফ্রিকা মুয়াহিদিন শাসনাধীনে আসে নাই। স্পেনের শহরের পর শহর মুসার আগমনে অভিনন্দন জানায় এবং স্পেনের মুসলমানগণ তাহার সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। বাদাজোজের সেনাবাহিনীও তাহার সহিত যোগদান করে। সেভিলের মুরাবিতুনগণও আত্মসমর্পণ করে। সেখানকার বিশপ যিনি সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করিতেন, টলেডোতে পলায়ন করেন। মালগা বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করে। মুরাবিতুন নেতা ইবনে জামী যিনি বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত হন ইয়াহিয়া বিন গানিয়ার (মৃত্যুঃ ৫৪৩ হিঃ/ ১১৪৮-৯ খ্রীঃ) নিকট কর্ডোভার শাসনভার অর্পণ করিয়া পলাইয়া যান। ইয়াহিয়াও সবশেষে আত্মসমর্পণ করেন মুয়াহিদিনদের নিকট। এই রূপে বিভিন্ন জেলার পরিচালনায় নিযুক্ত স্বাধীন শাসকগণ, আত্মসমর্পণ করেন এবং খ্রীস্টানগণ পলাইয়া যায়।
পূর্ব আলমেরিয়া, ভ্যালেন্সিয়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গাসমূহ অধিকার করা বাকী থাকে। কিন্তু মুয়াহিদিনগণ নিজেরাই অসুবিধার সম্মুখীন হন। তাহাদের ত্রিশ হাজার সৈন্য বিস্তীর্ণ এলাকায় বিক্ষিপ্ত ছিল। আফ্রিকা হইতে কোন অতিরিক্ত সামরিক সাহায্যের আশা ছিলনা। কারণ আবদুল মুমিনের ভয় ছিল অপর একজন মাহদী উত্থানের। এই মাহদী ছিল জনৈক নগণ্য ধোপা যিনি সালা শহরে অসংখ্য শিষ্য সংগ্রহ করেন। জনগণ
তাহার পক্ষ সমর্থন করে ও আবদুল মুমিনের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। ফেজ ও মরক্কো ব্যতীত তাহারা অন্যান্য স্থানের ক্ষতি সাধন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাহদী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিহত হন এবং তাহার শিষ্যগণ আবদুল মুমিনের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। আফ্রিকাতে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পর আবদুল মুমিন তাহার পুত্র আবু সাঈদকে প্রায় বিশ হাজার সৈন্যসহ আলমেরিয়া অধিকারের জন্য প্রেরণ করেন। আলমেরিয়া আত্মসমর্পণ করে।
সেভিলের করদরাজ্য নিয়েবলা আবু জাকারিয়ার নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুয়াহিদিনদের হস্তগত হয়। আবু সাঈদ গ্রানাডা অধিকার করেন এবং ভ্যালেন্সিয়ায় শহর রক্ষীদলকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। ভ্যালেন্সিয়ার মুহাম্মদ বিন সাদ টলেডোর খ্রীস্টানদের সাহায্যে কর্ডোভা ও গ্রানাডার সন্নিকটে দুই দফা যুদ্ধের পর শোচনীয়ভাবে পরাজিত হইয়া মুরাসিয়া অভিমুখে পলাইয়া যায়। তাহার অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করিয়া বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিতে পারে এই ভয়ে আবদুল মুমিন প্রথম দিকে ইফ্রিকিয়া ত্যাগ করিতে পারেন না। পরে তিনি জিব্রাল্টার পর্যন্ত অগ্রসর হন, ইহাকে সুরক্ষিত করেন এবং তাহার নতুন বিজিত এলাকায় সেনাধ্যক্ষ নিয়োগ করেন। ১১৬০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে আবদুল মুমিন আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, ত্রিপলী ও মাহদীয়া পর্যন্ত তাহার রাজ্যের সীমা সম্প্রসারণ করেন। এই বিজয়ের পর তিনি আমীরুল মুমিনীন’ খেতাব ধারণ করেন। এইভাবে আন্দালুসিয়াসহ মিশর সীমান্ত হইতে আটলান্টিকের উপকূলে অবস্থিত উত্তর-আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা আবদুল মুমিনের অধীনে একই পতাকাতলে সমবেত হয়।
আবদুল মুমিন তাহার বিরাট সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করিয়া প্রত্যেক প্রদেশকে শাসন করিবার জন্য তাহার এক এক পুত্রকে নিয়োগ করেন। আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বুজাইয়াহ (Bougie) ও ইহার অঙ্গ রাজ্যসমূহ শাসন করেন। আবুল হাসান আলী ফেজ, আবু সাঈদ সিউটা, আলজিরিয়া ও মালাগা শাসন করেন। তাহার শাসনের শেষ দিকে তিনি সম্পূর্ণ স্পেন বিজয়ের পরিকল্পনা করেন। তিনি তাঞ্জিয়ার আল জেসিরাস ও জিব্রাল্টায় পাঁচ লক্ষ সৈন্য ও প্রচুর পরিমাণ রসদ জমা করেন। তাহার এই সামরিক অভিযানের পূর্বেই তিনি ১১৬৩ খ্রীস্টাব্দে তেত্রিশ বৎসরের সফল ও সুযোগ্য শাসনের পর দেহত্যাগ করেন।
আবদুল মুমিন শুধু একজন বিখ্যাত যুদ্ধবিশারদ বিজয়ী বীরই ছিলেন না তিনি ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসকও। তিনি প্রতিনিধি পরিষদ ও সাধারণ পরিষদকে (Councils of Lord and Commons) একত্রিত করেন। পুরাতন বন্দরসমূহ পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেন এবং নতুন নতুন বন্দর নির্মাণ করেন। গোটা ভূমধ্যসাগর তাহার পতাকা তলে ছিল। মুসলিম বিশ্বের পণ্ডিতগণ তাহার প্রাসাদে
সমবেত হন। তাহার সাম্রাজ্যের সর্বত্র শিল্প ও সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ ও উন্নতি সাধিত হয়। প্রতিটি শহর ও নগরে স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মরক্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন হাজার ছাত্র অধ্যয়ন করিত। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কেবল কিতাবী বিদ্যাই শিক্ষা দেওয়া হইত না বরঞ্চ শিল্প, হস্তশিল্প ও সামরিক বিদ্যাও শিক্ষা দেওয়া হইত। স্পেনের অবস্থা সন্তোষজনক ছিলনা। কারণ ইহার শাসনভার অর্পিত ছিল তাহার প্রতিনিধির উপর, তাহার নিজের উপর নয়। গৃহযুদ্ধ ও খ্রীস্টানদের আক্রমণ স্পেনের বৈষয়িক উন্নতির পথে বাধার সৃষ্টি করে।
মুমিনের মৃত্যুর পর তাহার পুত্র আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন কিন্তু অযোগ্যতার জন্য তাহার সভাসদগণ তাহাকে অপসারণ করিয়া আবদুল মুমিনের তৃতীয় পুত্র আবু ইউসুফকে সিংহাসনে বসান। নতুন রাজা ছিলেন একজন বিখ্যাত সৈনিক ও খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ। আবু ইয়াকুব ইউসুফ তাহার শাসনের প্রথম দিকে আটলাস পর্বতের উপজাতিগণ কর্তৃক কঠিন বাধার সম্মুখীন হন। কিন্তু তাহারা আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। তিনি বিশ হাজার সুদক্ষ সৈনিককে স্পেনে প্রেরণ করেন এবং নিজেও তাহাদের পিছনে পিছনে অগ্রসর হইয়া সেভিলে অবস্থান করেন। মিনোরকার যুদ্ধে ভ্যালেন্সিয়ার রাজা ইবনে সাদ নিহত হন। তাহার পুত্রগণ তাহার সাম্রাজ্যকে (ভ্যালেন্সিয়া, মুরসিয়া, লোরকা ও অন্যান্য অঞ্চল) মুয়াহিদিনদের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিতে ব্যর্থ হন। তাহাদের ভগ্নিকে ইউসুফের সহিত বিবাহ দিয়া আত্মসমর্পণ করেন এবং উত্তর আফ্রিকার জমিদারীর সহিত তাহাদের জমিদারীর বিনিময় করেন। তিনি টলেডো পর্যন্ত বিস্তৃত তাস উপত্যকা ও আলকানতারার সীমান্ত ঘাটি অধিকার করেন। সেভিলে এক বৎসর অবস্থান কালে তিনি সুরম্য প্রাসাদ, মিনারযুক্ত মসজিদ, সরকারি হাম্মাম ও অসংখ্য সেতু নির্মাণ করিয়া ইহাকে সুশোভিত করিতে চেষ্টা করেন। ওয়াদী আল কাবির (গোয়াদালকুইভির) নদীর উপর নৌকা-সেতু (ভাসমান সেতু) নির্মাণ করেন ও জনহিতকর কার্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। শহরের মধ্যবর্তী স্থানে একটি সুশোভিত মসজিদ নির্মাণ করেন। ইহার অপর পার্শ্বে দণ্ডায়মান তাহার উত্তরাধিকারী কর্তৃক সমাপ্ত বর্তমানের বিখ্যাত জিরাল্ডা মিনার। বিশিষ্ট ধরনে নির্মিত এই মিনারটি আন্দালুসীয় মুসলমানদের স্থাপত্য শিল্পের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১১৭৬ খ্রীস্টাব্দে আফ্রিকায় দারুণ মহামারী দেখা দেয়, এই সংকটময় মুহূর্তে আবু ইয়াকুব স্পেনের বাহিরে আফ্রিকাতে আট বৎসর অবস্থান করেন। তাহার অনুপস্থিতির সুযোগে স্পেনের গভর্নরগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইউসুফও তাহার পিতার ন্যায় এই সমস্ত অবাধ্য গভর্নরকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং এই উদ্দেশ্যে সত্তর হাজার পদাতিক ও ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীকে সিউটাতে সমবেত করেন। প্রতিটি উপজাতি তাহাদের দলীয় প্রধানের অধীনে
নিজস্ব পতাকাতলে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। স্পেনের বার্বার সেনাগণ সেভিলে সুলতানের সেনাবাহিনীর সহিত যোগদান করেন। ১১৮৪ খ্রীস্টাব্দে তাহারা সামতারেন অবরোধ করেন। ইউসুফ সেখানে গুরুতর রূপে আহত হন। এবং মুসলমানগণ খ্রীস্টানদের হস্তে চরমভাবে পরাজিত হন।
স্লভ পত্নীর গর্ভজাত আবু ইউসুফ ইয়াকুব ১১৮৪ খ্রীস্টাব্দে তাহার পিতা ইউসুফের স্থলাভিষিক্ত হন।১০ ইয়াকুব আল মনসুর বিল্লাহ’ উপাধি ধারণ করেন। তিনি তাহার রাজপরিবারের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন দয়ালু সুবিচারক ও ধর্মপরায়ণ রাজা। তিনি কর হ্রাস করেন এবং সরকারি কর্মচারীদের জন্য ঘুস ও উপঢৌকন গ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সুদক্ষ ও শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী শহর রাজপথ পাহারায় নিয়োজিত থাকিত। চুরি, ডাকাতি ও রাহাজানী বলিতে দেশে কোন কিছু ছিলনা। দুর্গসমূহ পুনর্নির্মিত হয়। কিছু নতুন দুর্গও নির্মিত হয়। রাজপথের পার্শ্বে কূপ খনন ও সরাইখানা নির্মাণ করা হয়।
কর্ডোভার পতনের পর সেভিল গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। আফ্রিকার আলমুরাবিদ ও আলমুহাদ শাসকদের মধ্যে, আলমুহাদ খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফের রাজত্বকাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাজির সাহায্যে সাহিব আল-মদিনা বিচার কার্য পরিচালনা করিতেন এবং মুহতাসিব কর্তৃক পৌরশাসন পরিচালিত হইত। রাজ্যের বন্দরসমূহ সমুদ্রগামী জাহাজের গমনাগমনে ব্যস্ত থাকিত। সাধারণ যাত্রী ও দেশের অভ্যন্তরে মালামাল পারাপারে নদীসমূহে ফেরীনৌকা ব্যবহৃত হইত। রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পয়ঃ নিষ্কাষণের জন্য শাসক আল-মুহাদ পয়ঃ প্রণালী নির্মাণ করেন। আলমুহাদের শাসনকালে শিল্প ও স্থাপত্য কর্মে সেভিল বিশেষ ভাবে উন্নতি লাভ করে। কিন্তু খ্রীস্টানদের পুনরাধিকারের ফলে ইহার অতি সমান্যই তাহার আসল রূপে অবশিষ্ট থাকে। মসজিদগুলিকে গীর্জায় ও মিনারগুলিকে টাওয়ারে (প্রহরীস্তম্ভ) রূপান্তরিত করা হয়।
আল মুহাদ কর্তৃক নির্মিত দালানগুলি ছিল বহত ও স্মৃতিস্তম্ভের ধরনে গঠিত। ইহার শিল্পশৈলী ছিল কারুকার্যের তুলনায় দৃঢ়ভাবে গঠিত। দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্মিত সেভিলের জিরান্ডা স্মৃতিস্তম্ভ ইহার উৎকষ্ট প্রমাণ। যদিও ইহা স্থানীয় প্রভাবের ফলে অতিরিক্ত কারুকার্যময় করিয়া নির্মাণ করা হইয়াছে। উত্তর আফ্রিকায় আল মুহাদ নির্মিত দালানসমূহ হইতে ইহা এক ব্যতিক্রম। মূলত সেভিলের জামে মসজিদের মিনার হিসাবে নির্মিত বর্তমানে ক্যাথিড্রাল সংলগ্ন জিরাল্ডা স্মৃতিস্তম্ভ, স্পেনীয় স্মৃতি স্তম্ভগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশী পরিচিত। মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ১১৭২ খ্রীঃ আলারকোসের যুদ্ধে আল মুহাদের বিজয় উৎসব উপলক্ষে ইহার নির্মাণ কার্য শুরু হয় এবং স্থপতি আহমদ ইবনে আবু লাইসের তত্ত্বাবধানে ইহা ১১৯৫ খ্রীঃ সমাপ্ত হয়। ইহার মূল ছোট স্মৃতি স্তম্ভটিতে স্বর্ণের চারিটি গোলক স্থাপন করা হইয়াছিল ১৫৬৮ খ্রীঃ
ইহার পরিবর্তে বায়ুর গতি নির্দেশিকা যন্ত্র স্থাপন করা হয় এবং সেই হইতে ইহা জিরান্ডা নামে পরিচিত। ইহার নির্মাণ কার্যে মারাকুশের জামী আল কুব্বাহ এবং রাবাতের হাসান স্মৃতি-স্তম্ভের অনুকরণ করা হয়। পরবর্তীতে পরিত্যাজ্য অংশটি সংযোজন করা হয় যাহার উচ্চতা ২৩০ ফুটা। ও বর্গাকৃতি চৌকো ছিল ৪৪ ফুট। এই স্মৃতিস্তম্ভের নিম্নাংশ ৮৭ ফুট যাহা কোন এক সময় মানমন্দিরের কাজ করিত। এই অংশ ছিল পাথরের অবশিষ্ট অংশ ছিল ইটের। ইহা ব্যতীত ঊর্ধ্বে উঠিবার সিড়ির স্থলে সমান্তরাল পথ ছিল। এই সময়কার অপর ইমারত আল কাজার পুনঃ পুনঃ সংঘঠিত অগ্নিসংযোগে এবং ভূমিকম্পের ফলে ও পরবর্তী পরিবর্তনের দরুন তাহার পূর্ব সৌন্দর্য হারাইয়া ফেলিয়াছে।
বাগদাদের হারুন আল-রশিদ ও কর্ডোবার তৃতীয় আবদুর রহমানের ন্যায় তিনি সেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। তাহার সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল নির্মিত হয়। মারাকুশীর মতে, ইয়াকুব কর্তৃক নির্মিত মরক্কোর হাসপাতাল ছিল পৃথিবীর অদ্বিতীয়।১২ ইয়াকুব ছিলেন শিল্পকলা ও সাহিত্যের অনুরাগী পৃষ্ঠপোষক। তাহার সময়কার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত চিকিত্সক এ্যাভেজোয়ার (ইবনে জুহর) ও এভেস্পেস (ইবনে বাজ্জাহ) এবং দার্শনিক এ্যাভেররস (ইবনে রুশদ) যিনি কর্ডোভার কাজির পদ অলঙ্কত করিয়াছিলেন। স্পেনীয় মুসলিম বিদ্যালয়, স্কুলসমূহে রসায়ন শাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান, অংক শাস্ত্র, গণিত ও জ্যোতিষ এবং ফলিত জ্যোতিষ শাস্ত্র প্রভৃতি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। খ্রীস্টান-ইউরোপ হইতে অগণিত বিদ্যার্থী অধ্যয়নের জন্য এখানে ভীড় জমাইত। ইউরোপীয়গণ স্পেনীয় মুসলমানদের নিকট দর্শনে গভীর জ্ঞানলাভ করে। এরিস্টটলের দার্শনিক মতবাদের বিচার বিশ্লেষণ ও উন্নতি ঘটে ইবনে রুশদের হস্তে। সালাহ আল-দিন (সালাদিন) উসমাহ ইবনে মুনকিজের ভ্রাতুস্পুত্রের নেতৃত্বে ইয়াকুবের রাজ দরবারে দূত প্রেরণ করেন। শেষোক্ত ব্যক্তি ১৮০টি নৌযান ক্রসেডারদের বিরুদ্ধে মুসলমানদিগকে সাহায্য করিবার জন্য প্রেরণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই ইয়াকুবকে তাহার পূর্ববর্তীদের ন্যায় বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করিতে হয়। বেলেয়ারিক দ্বীপসমূহের নেতাগণ তখনও মুরাবিতিনদের অনুগত ছিল এবং ইয়াকুবের নিজের ভাইগণও তাহাদের সহিত যোগদান করিয়াছিল। এইসব বিদ্রোহী ভ্রাতাগণ নিহিত হয় ও বিদ্রোহী নেতাগণকে শাস্তি প্রদান করা হয়। ইহা ছিল তৃতীয় ক্রসেডের (১১৮৯- ১১৯২ খ্রীঃ) সময়কার ঘটনা। কিছু সংখ্যক ইংরেজ নাইট এই সময়ে জেরুযালেম অভিমুখে অগ্রসর হইতেছিলেন। তাহারা এই বিশৃংখলার সুযোগ গ্রহণ করিয়া ইভোরা, বেজা ও সালবিস ধূলিসাৎ ও নিরোপরাধ মুসলিম জনসাধারণকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ক্যাস্টিলিয়ান সৈন্যরা ফ্রান্সের স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত মুসলিম স্পেনে অনুপ্রবেশ করে। ইয়াকুব ৩,০০০,০০ লক্ষ বার্বার সৈন্য লইয়া আফ্রিকা হইয়া স্পেনে আগমন করেন এবং অষ্টম আলফন্সের নেতৃত্বাধীনে খ্রীস্টানদের সহিত বাদাজোজ ও কালাতারাভার পার্শ্ববর্তী এলাকা
আলারকোসে (আলআর্ক) মিলিত হয়। মুসলিম সেনাগণ সানায়ানী ও ইয়াকুবের নেতৃত্বাধীনে শত্রুকে হঠাৎ আক্রমণ করিবার জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। যুদ্ধের প্রথমদিকে, খ্রীস্টানগণ সুবিধাজনক অবস্থায় থাকিলেও শেষ পর্যন্ত সানায়ানীর সুযোগ্য সেনাপতিত্বে অবস্থা মুসলমানদের অনুকূল হয়। খ্রীস্টানগণ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং এক লক্ষ ছেচল্লিশ হাজার লোক নিহিত হয় এবং ত্রিশ হাজার বন্দী হয়। এই সংখ্যা অবশ্য অতিরঞ্জিত বলিয়া মনে হয়। খ্রীস্টানগণ কালাতারাভা ও আলফন্সে টলেডোতে পলাইয়া যায়। কালাতারাভা বিধ্বস্ত ও গুয়াদালাজারা, এসসেলোনা, সালামানকার ন্যায় শহরগুলি যাহা খ্রীস্টানদের অধীনে ছিল পুনরুদ্ধার করা হয়। নাভারের ও লিওনের রাজাগণ আত্মসমর্পণ করেন। ১১৯৬ খ্রীস্টাব্দে টলেডো অবরুদ্ধ হয় ও আত্মসমর্পণে উদ্যত হয়। কিন্তু অষ্টম আলফন্সের মাতা ও স্ত্রীর অনুরোধে অবরোধ অপসারিত হয়। আরাগণদের পরাজয়ের পর মুসলমানগণ সেভিলে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে প্রশাসনিক কার্যাবলী বিন্যস্ত করার জন্যে ইয়াকুব এক বৎসর অবস্থান করেন। অতঃপর ১১৯৭ খ্রীস্টাব্দে তিনি মরক্কোতে গমন করেন। ইহার দুই বৎসর পর তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
১১৯৯ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব তাঁহার পিতার স্থলাভিষিক্ত হন ও আল নাসির লিদিনিল্লাহ’ উপাধি ধারণ করেন। তাহার পিতার জীবিত কালে তিনি সুযোগ্য প্রশাসক হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কিন্তু পরে শাসক হিসাবে তিনি ব্যর্থতার প্রমাণ দেন। তিনি রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করিতে ব্যর্থ হন। তাহার বংশের পতনের জন্য তাহার দুর্বলতাই বিশেষ ভাবে দায়ী ছিল। ইয়াকুব আল-মনসুরের মৃত্যুতে ফেজ ও বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের জনসাধারণ পুনরায় বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে। ফেজের বিদ্রোহীদিগকে অতি সহজে দমন করা হয়। বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী ইউসুফ বিন তাণ্ডফিনের পরবর্তী বংশধর বিদ্রোহী ইয়াহিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি উপকূলীয় শহর ও মাহদীয়া অধিকার করেন। তিনি কায়রোওয়ান অবরোধ করেন কিন্তু সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইয়া সাহারার দিকে পলায়ন করিতে বাধ্য হন। ক্যাষ্টিলের নবম আলফলোর নেতৃত্বাধীনে পুনরায় আন্দালুসিয়াতে লুটতরাজ করিতে শুরু করেন এবং কর্ডোভা ও সেভিল পর্যন্ত রাজ্যের ক্ষতি সাধন করেন। মুহাম্মদ আলারকোস যুদ্ধের ন্যায় অতি সহজে সাফল্য লাভের আশা পোষণ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা হইবার ছিল না। কারণ আলফন্সে ইতিমধ্যে তাহার সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করিয়াছিল। মুহাম্মদ সিউটা হইতে ৩,০০০,০০ লক্ষ সৈন্য লইয়া স্পেনের দিকে অগ্রসর হন। সেভিলে পদার্পণের অল্পদিনের মধ্যে মুহাম্মদ কালাতারাভার গভর্নর ইউসুফ ইবনে কাদিসকে আলফলোর হস্তে কালাতারা দুর্গ হস্তান্তরের জন্য ও অন্যান্যকে সীমান্তের দুর্গসমূহ সমর্পণের জন্য শাস্তি দান করেন।
ইউসুফের প্রতি অনুগত জনগণ মুহাম্মদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া ওঠে। শেষোক্ত ব্যক্তি ভারতবর্ষের হুমায়ুনের ন্যায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতে ব্যর্থ হন। ক্যাস্টাইলে যাইবার পথে সিলভাতিয়েরার ন্যায় একটি ক্ষুদ্র দুর্গ অধিকার এবং তাহার হৃত সাম্রাজ্য পুনরাধিকার এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেন। লিওন, নাভারের আরাগণ ও পর্তুগালের অধিবাসী যাহারা ১১৪৩ খ্রীস্টাব্দ হইতে স্বাধীনতা ভোগ করিয়া আসিতেছিল তাহারা ইউরোপ হইতে আগত ক্রসেডারদের সহিত যোগদান করে এবং ১২১২ খ্রীঃ আল আকাবে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। আল আকাব স্পেনীয়দের নিকট লাস নাভাস ডে তোলোসা নামে পরিচিত। লাস নাভাস ডে তোলোসার যুদ্ধের পূর্বে আল মুহাদগণ কখনও পরাজয় বরণ করেন নাই। এখানেই সর্বপ্রথম তাহারা বিভিন্ন খ্রীস্টান রাজার সম্মিলিত আক্রমণে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া পলায়ন করেন। যুদ্ধের চরম পর্যায়ে আন্দালুসিয়ান ষাট হাজার সৈন্য মুহাম্মদের গৃহাধ্যক্ষ কর্তৃক তাহারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। বার্বারগণ সাহসিকতার সহিত যুদ্ধ করা সত্ত্বেও খ্রীস্টান ও নাভাররীয়দের হাতে শশাচনীয়ভাবে পরাজিত হন। যুদ্ধের ময়দান হইতে সৈন্যগণ যাহাতে পলায়ন করিতে না পারে সেই জন্য মুহাম্মদ সৈন্যদের পায়ে জিঞ্জির পরাইয়া বাঁধিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু সৈন্যগণ জিঞ্জির ছিড়িয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করে। মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক হত্যা কান্ড সংঘটিত হয়। কথিত আছে এই যুদ্ধে কমপক্ষে ১০,০০০,০০ লক্ষ মুসলমান জীবন হারান। মুহাম্মদ মাত্র চারি হাজার। সৈন্য লইয়া অতিকষ্টে সেভিলে পলাইয়া যাইতে সক্ষম হন। ভগ্ন হৃদয়ে মুহাম্মদ মরক্কোতে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন। কতিপয় ঐতিহাসিকের মতে, তিনি ১২১৪ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে অসন্তুষ্ট সভাসদ কর্তৃক বিষ পরিবেশিত হইয়া মৃত্যুবরণ করেন। লাস নাভাস ডে তোলোসার যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের ফলে প্রায় পাঁচ লক্ষ মুসলমান আফ্রিকায় নির্বাসিত হয়।
পনের বৎসরের ব্যবধানে মুহাম্মদের চারিজন উত্তরাধিকারী নামমাত্র স্পেন শাসন করেন। ইউসুফ আবু ইয়াকুব আলমুস্তানসির বিল্লাহ, আবদুল ওয়াহিদ আল-মাকলু ও আবু মুহাম্মদ আল-আদিল এই তিনজন শাসক ছিলেন চরম অপদার্থ ও অযোগ্য। চতুর্থ শাসক আবু আলী ইদ্রিস আল মামুন ছিলেন সেভিলের গভর্নর। ১২২৭ খ্রীঃ তাহার ভ্রাতা আবু মুহাম্মদ নিহিত হইবার পর তিনি উত্তরাধিকার নিযুক্ত হন। তাহার বিরুদ্ধে প্রেরিত আফ্রিকান সেনাবাহিনী ক্যাস্টিলের তৃতীয় ফার্ডিনাণ্ডের সাহায্যে দেশের অভ্যন্তরে লুটতরাজ এবং সীমান্তে অবস্থিত দুর্গ পিরিয়েগো ও লোজা অধিকার করিলে তিনি তাহাদের দমন করেন। বায়জার মুসলিম আমীরের সহযোগিতায় তিনি জায়েন অধিকার করেন। মামুন অবরুদ্ধদের সাহায্যে আগমন করেন এবং অবরোধকারীদের পরাজিত করতঃ অন্যান্য শহর পুনরাধিকার করেন। স্পেনে তাহার শাসন প্রতিষ্ঠার পর তিনি ১২২৮ খ্রীস্টাব্দে
প্রথমার্ধে স্পেনের উত্তরাংশে খ্রীস্টানগণ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ক্যাস্টিল ও আরাগণের মধ্যেকার বিরোধ গ্রানাডার মুসলমানদেরকে সাময়িকভাবে সাহায্য করে। ফলে খ্রস্টানদের স্পেন পুনর্দখলে বিলম্ব ঘটে।
অসংখ্য মুসলমান খ্রীস্টান এলাকা ত্যাগ করিয়া দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। খ্রীস্টান অধিকৃত এলাকায় বসবাসকারী ইহুদীগণকে প্রতাপশালীদের স্বার্থে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাখিয়া শোষণ করিবার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ঋণ গ্রহীতা প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজণ্যবর্গ তাহাদের সহায়তা করিতেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের খ্রীস্টানগণ ইহুদী রমণীদের অর্থ ও বুদ্ধিমত্তা এবং সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়। খ্রীস্টান অধিকৃত এলাকা হইতে মুসলমানদের অপসারণের পর সৃষ্ট শূন্যস্থান মুসলিম এলাকা হইতে নবাগত ইহুদীদের দ্বারা পূর্ণ করা হয়। তাহাদিগকে কর আদায় করিতে দেয়া হয় এবং মুরসিয়া, টলেডো ও লা-মাঞ্চাতে ১২৭২-১২৭৪ খ্রীস্টাব্দে কৃষি কর্মেনিয়োগ করা হয়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ৪০,০০০ ইহুদী খ্রীস্টানদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করিবার জন্য এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাহাদের সাহায্য সহযোগিতা অপরিহার্য হওয়ায় একাদশ আলফন্সে চতুর্দশ খ্রীস্টাব্দে ষষ্ঠ পোপ ক্লেমেন্টকে ইহুদীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপনের অধিকার প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান। তাহারা যাজক সম্প্রদায়ের ক্রীতদাস হিসাবে বিবেচিত হইত। যাজক সম্প্রদায়। অর্থের বিনিময়ে তাহাদিগকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত ছিল।
আল মুরাবিদ ও আল মুহাদের শাসনের সুস্পষ্ট ফলশ্রুতি হিসাবে দক্ষিণ স্পেনেও আফ্রিকার সভ্যতার বিকাশ ঘটে। কালের চক্রে ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির ফলে সে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি সাধিত হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা হ্রাসের সাথে সাথে সংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হইতে থাকে। ফলে সৌন্দর্য বিকাশ চর্চা শুরু হয়। স্পেনীয় মুসলমানদের রচিত উচ্চাংগের গীতি কবিতা স্পেনে ও ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের দেশসমূহে বিভিন্নমুখী সাহিত্য সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা যোগায়। তাহাদের সৌন্দর্য প্রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাহাদের স্থাপত্য কর্মে। ধর্মীয় বাঁধা থাকা সত্ত্বেও চিত্র কর্ম ও ভাস্কর্যশিল্প বাহ্যিক সজ্জা হিসাবে অনুশীলিত হইত। এই সমস্ত শিল্পচর্চায় আফ্রিকানদের বিশেষ প্রভাব ও অবদান ছিল।
মুয়াহিদিনদের পতনের পর সমস্ত স্পেনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুয়াহিদিন শাসকগণ মরক্কো হইতে স্পেন শাসন করিতেন। ফলে স্পেনে তাহাদের শাসন দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। স্পেনের বিশৃঙ্খলাপূর্ণ প্রদেশগুলি যুবরাজগণ সহজে আয়ত্তে আনিতে ব্যর্থ হন। তাহারা মরক্কো হইতে প্রতিনিধি প্রেরণ করিয়াই সন্তুষ্ট থাকিতেন। কোন কোন সময় খ্রীস্টান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নামেমাত্র অভিযান পরিচালনা করিতেন। মুয়াহিদিন সাম্রাজ্যের ধ্বংস স্তুপের উপর মুসলমানদের তিনটি বিখ্যাত ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র গড়িয়া ওঠে। ভেনিয়া, জাতিভা ও আন্দালুসিয়ার বিভিন্ন শহর লইয়া মুরসিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় বানু-হুদ রাষ্ট্র। বানু মারদানিশ (জাইয়ান) বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ভ্যালেন্সিয়াতে। প্রথমে আরজোনা ও পরবর্তীকালে গ্রানাডাতে ইবনুল আহমার নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। আরব নেতা ইবনে হুদ দক্ষিণ-স্পেন ও সিউটার ভাগ্যবিধাতা ছিলেন। তিনি ১২৩৮ খ্রীঃ ইন্তেকাল করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর মুসলিম স্পেনের নেতৃত্ব অর্পিত হয় গ্রানাডার বানু নাসরের উপর। ইহাই একমাত্র রাজ্য যাহা আরাগণ ও ক্যাস্টিলের খ্রীস্টানদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আড়াই শত বৎসর টিকিয়া ছিল।
লাস নাভাস ডে তোলোসার যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ক্যাস্টিলের অষ্টম আলফন্সে সাম্রাজ্য বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। কতিপয় অভিযানের পর তিনি দেশের উত্তরাঞ্চলে অগ্রসর হন। তাহার উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় খ্রীস্টান শক্তি অতি দ্রুত তাহাদের হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করে। ১২৩৬ খ্রীঃ কর্ডোভা, ১২৪১ খ্রীস্টাব্দে মালাগা, ১২৪৬ খ্রীঃ জিয়েন ও মুরসিয়া এবং ১২৪৮ খ্রীঃ ডিসেম্বর মাসে সেভিল প্রভৃতি দক্ষিণাঞ্চলীয় মুসলিম এলাকাসমূহ একের পর এক অষ্টম আলফন্সের পৌত্র তৃতীয় ফার্নান্ডোর করতলগত হয়।
বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের ভ্যালেন্সিয়া, এলচে, আলীকান্তে ও নিয়েবলাও তাহার শাসনাধীনে আসে। ক্ষুদ্র রাজ্য গ্রানাডাসহ দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের কয়েকটি বন্দর মাত্র মুসলমানদের অধিকারে থাকে। চৌদ্দশত শতাব্দীর শেষার্ধে ও পনের শত শতাব্দীর
তথ্য নির্দেশ
১। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম, ১ম খণ্ড, ৩১৮-২০; পারেজা, ইসলামোলোজিয়া, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৭৪-৭৫। ওয়াট, পৃঃ ৯৪। কোডেরা, ফ্যামিলিয়া রিয়েল ডি লস বেনিটেকসুফিন ইন রাভিস্তা ডি এ্যারাগণ, ১৯০৩; প্রিটো ওয়াই ভাইভস্, পৃঃ ৪৩, টীকা-১।
২।উত্তর আফ্রিকাতে এক বিদ্রোহ দমন করিবার জন্য গমন করেন। তাহার অনুপস্থিতির সুযোগে স্পেনে মারাত্মক বিদ্রোহ দেখা দেয়। ফলে স্পেনে চিরদিনের জন্য মুয়াহিদিনদের ক্ষমতা লোপ পায়, তাহারা ১২৬০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসর কাল মরক্কো শাসন করেন। ১২৩২ খ্রীঃ মামুন মরক্কোতে দেহ ত্যাগ করেন। আল রশিদ আল সাইদ, উমর আল মুর্তোজা ও আবুল উলা আবু দাবলুস একের পর এক তাহার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হন। শেষ শাসক ১২৬৯ খ্রীস্টাব্দে বানু মারিন বার্বার গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় নিহত হন। বানু মারিন উপজাতীয় বার্বারগণ পরবর্তীকালে সমগ্র মৌরিতানিয়াতে তাহাদের শাসন কায়েম করেন।
৪। আর, মেনেন্দেজ পাইভাস, এল ইম্পানা ডি মিওসিড, ১৯২৯ (ইংরেজী অনুবাদ The Cid and his Spain, লন্ডন, ১৯৩৪)। ৫। মারকুশী, দ্যা কিতাব আল-মুজিব, পৃঃ ১২৮; ইবনে খাল্লিকান, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪২৬; হিট্টি, হিষ্ট্রি অব দ্যা আরবস পৃঃ ৫৪৬। আন্দালুস, পৃঃ ২৬।
ডজি, রিচারচেস, ২য় খণ্ড, ১৮১৮, পৃঃ ৩১২; স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ৭২৬। ৮। হোল, আন্দালুস, পৃঃ ৫০। ৯। এই মসজিদটি চার্চের পার্শ্বে নির্মিত হয়। মসজিদ নির্মাণের বহু পূর্বে চার্চটি নৰ্যান কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। খ্রীস্টানদের সেভিল বিজয়ের পর মসজিদটি ক্যাথেড্রালে পরিবর্তিত হয়। ১০। মাররাকুশী, দ্যা কিতাব আল মুজিব, পৃঃ ১৮৯। ১১। হোল, আন্দালুস, পৃঃ ২৭। ১২। ইবনে আবিজার, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১৪৩, ১৫১-৫২; হিট্টি উদ্ধৃত করেন, হিস্ট্রি অব দ্যা আরবস-এর পৃঃ ৫৪৮, নোট ৬ এবং ৭। ১৩। হোল, আন্দালুস, পৃঃ ৫৩, ৫৫।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন