দ্বিতীয় অধ্যায় : দামেস্ক-খেলাফতের অধীন উমাইয়া আমীরদের শাসন

দামেস্ক খেলাফতের অধীন উমাইয়া আমীরদের শাসন
(৭১৪-৭৫৬ খ্রীঃ)
দ্বিতীয় অধ্যায়

গভর্নরদের ক্ষমতা

রডারিকের পরাজয়ের পর স্পেন দামেস্কের খিলাফতের অধীন একটি প্রদেশে পরিণত হয়। সুদূর স্পেন হইতে কায়রোওয়ান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এই এলাকার সহিত দামেস্কের কেন্দ্রীয় শাসনের বন্ধন ছিল খুবই শিথিল। স্বেচ্ছাচার ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী এবং প্রজাদের সহিত সাম্যের নীতি অনুসরণকারী বিশাল ও বিস্তৃত সাম্রাজ্যের মধ্যে উমাইয়া খলিফার অবস্থা দুর্বল হইয়া পড়ে। পরবর্তীকালে কিছু উমাইয়া খলিফা রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারী ইরাণী শাসকদের ঐতিহ্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিস্তীর্ণ এলাকা বিজয়ের পর সেনাপতিগণ প্রাদেশিক গভর্নরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রায় একচল্লিশ বৎসর আমীর হিসাবে পরিচিত গভর্নর দ্বারা স্পেনের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। আমীর প্রায় স্বাধীনভাবে স্পেনের শাসন কার্য পরিচালনা করিতেন। তিনি নামমাত্র কায়রোওয়ানে অবস্থানরত আল মাগরীবের (স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা) গভর্নর জেনারেলের অধীন ছিলেন। আমীর কোন কোন সময় দামেস্কের খলিফার নিকট হইতে তাঁহার নিয়োগপত্র পাইতেন আবার কোন কোন সময় কায়রোওয়ানের ভাইসরয়ের তরফ হইতে নিয়োগপত্র আসিত। এই দ্বৈত অধীনতার ফলে তাঁহার পক্ষে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা ছিল অসম্ভব। আমীরগণ গভর্নর জেনারেল ও খলিফার খামখেয়ালীর শিকারে পরিণত হইত।

দামেস্ক হইতে স্পেনের দূরত্ব ছিল ২,৫০০ মাইল। ফলে খলিফার প্রতি সীমাহীন আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন করা আমীরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। স্পেনের আরব মুসলমানগণ ইচ্ছামত এক আমীরকে অপসারণ করিয়া অপর আমীরকে ক্ষমতায় বসাইয়া গভর্নর জেনারেল অথবা খলিফার অনুমোদন প্রার্থনা করিতেন। আমীর খলিফার ন্যায় স্বেচ্ছাচারী হইতে পরিতেন না। তাঁহাকে নেতৃস্থানীয় আরবদের অভিমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকিয়া শাসনকার্য পরিচালনা করিতে হইত। ক্ষমতায় টিকিয়া থাকিবার জন্য আরব ও সিরীয় অথবা শক্তিশালী যে কোন একটি দলের সমর্থন ছিল বিশেষ প্রয়োজনীয়। সামান্য উত্তেজনার ফলে স্পেনে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। স্পেনে খলিফা ও গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতার এই ছিল নমুনা। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত হয় বিশজন আমীর। একের পর এক তাহারা স্পেন শাসন করেন। কয়েকজন একাধিকবার এবং তিনজন পাঁচ বৎসর। অথবা ইহার অধিক কাল এই পদে বহাল ছিলেন। ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ সেনাপতিদের স্থলে অস্থায়ী গভর্নর হিসাবে দেশ শাসন করেন।

আবদুল আজিজ

মুসা ইবনে নুসাইয়েরের পুত্র আবদুল আজিজ ছিলেন স্পেনের প্রথম আমীর। তিনি সেভিলে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করিয়া শাসন কার্য পরিচালনা করেন। সুদক্ষ প্রশাসক হিসাবে পরিচিত আবদুল আজিজ প্রশাসন কার্যের সুবিধার্থে বিজিত অঞ্চলকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। শান্তির খাতিরে তিনি থিওডোমিরের সহিত তারিকের সম্পাদিত চুক্তি বহাল রাখেন। প্রজাহিতৈষী এই আমীর জনগণের কর্মসংস্থানের জন্য মিল কারখানা স্থাপন করেন এবং কৃষি উৎপাদনে সহায়ক সেচকার্যের জন্য গথ-প্রণালী খনন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কল্পে দীর্ঘ সড়ক ও সেতু নির্মাণ করেন। ব্যবসা বাণিজ্যে নিযুক্ত বণিক ও পথিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সড়ক পথে সশস্ত্র প্রহরী নিয়োগ করেন। সমৃদ্ধি ও শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে দেশের সর্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করে। মুঘল সম্রাট আকবরের ন্যায় তিনি অসবর্ণ বিবাহকে উৎসাহিত করেন এবং স্বয়ং রডারিকের বিধবা পত্নী এগিলোনাকে (উম্মে আসিম) বিবাহ করেন। মুসলমান ও স্থানীয় জনগণের এই অসর্বণ বিবাহের মাধ্যমে তিনি স্পেনে মুসলিম শাসনের ভিত্তি মজবুত করিতে চাহিয়াছিলেন। এগিলোনার উৎসাহে তিনি ভিজিগথদের ন্যায় বহুমূল্যবান মণিমুক্তা খচিত মুকুট পরিধান করিতেন এবং দর্শন প্রার্থীদের কক্ষের প্রবেশদ্বার এমনভাবে নির্মাণ করিতেন যে মাথানত না করিয়া কেহ প্রবেশ করিতে পারিত না।

ইহাতে খলিফা সুলায়মান মর্মাহত হন। স্পেনবিজয়ী বীর মুসা বিন নুসাইয়েরের পুত্র ও স্পেনবাসীর প্রাণপ্রিয় শাসক আবদুল আজিজকে খলিফা মোটেই বরদাস্ত করিতে পারিতেছিলেন না। খ্রীস্টান রাজা রডারিকের বিধবা পত্নীকে বিবাহ করিয়া আবদুল আজিজ খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করিলে ইসলামের মর্যাদাহানী হইতে পারে সন্দেহে খলীফা তাঁহার বিরুদ্ধে মুসলমানদিগকে ক্ষিপ্ত করিয়া তোলেন। তাঁহাকে হত্যা করিবার জন্য খলিফা পাচজন আরব নেতাকে নিয়োগ করেন। হাবিব বিন আবি উবায়দা আল-ফিহরী ও যাইয়াদ বিন নালিগবাহ আল তামিমী এই ষড়যন্ত্রে অংশ গ্রহণ করেন। রজব ৯৭ হিঃ/ ৯ই মার্চ ৭১৬ খ্রীঃ খলিফার নির্দেশে আবদুল আজিজকে ফজরের নামাজ আদায়রত অবস্থায় নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। খলিফার ইচ্ছানুসারে নিহত আবদুল আজিজের ছিন্ন মস্তক দামেস্কে প্রেরিত হয়। খলিফা নিহত পুত্রের ছিন্ন মস্তক ভাগ্যাহত পিতা মুসাকে দেখান। মুসা বিন নুসাইর এই দৃশ্য দেখিয়া অতি দুঃখে ও ক্ষোভে খলিফার প্রতি অভিশম্পাত করিতে করিতে দরবারকক্ষ ত্যাগ করিয়া মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন। অসহায় ও অজ্ঞাত অবস্থায় দীনহীন বেশে ওয়াদী-উল-কোরা নামক স্থানে স্পেনবিজয়ী বীর মুসা বিন নুসাইর মৃত্যুমুখে পতিত হন। স্পেনের প্রথম আমীর সুযোগ্য শাসক আবদুল আজিজকে হত্যা করিয়া খলিফা সুলায়মান স্পেনের ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়ের সূচনা করেন।

আইউব ও আল-হুর

আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর সেনাবাহিনী মুসার ভগ্নির পুত্র আইউব বিন হাবিবকে তাহাদের নেতা ও গভর্নর নির্বাচন করেন। তিনি সেভিল হইতে কর্ডোভাতে রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রয়াস চালান। তাঁহার নির্বাচনকে আফ্রিকার গভর্নর জেনারেল অনুমোদন না করায় ছয় মাসের মধ্যে আল-হুর ইবনে আবদুর রহমান আল-থাকাফী (৭১৬-৭১৮ খ্রীঃ) তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি সেনাপতি মুসার আত্মীয় হওয়ায় গভর্নর জেনারেল ও খলিফার অনুমোদন লাভে বঞ্চিত হন।

আল-হুর নবীন রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা আনয়নে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ বলিয়া প্রমাণ করেন। ৯৮ হিঃ/ ৭১৮ খ্রঃ তাঁহার লেফটেন্যান্ট গভর্নর আল কামাহ কোভাডোংগাতে পিলাইওর নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। রডারিক সেনাবাহিনীর এই গথিক নেতা আস্তুরীয়ার কোভাডোংগাতে একটি খ্রীস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। আল-হুরের নির্যাতনমূলক শাসনে জনগণ অতিষ্ঠ হইয়া ওঠে। লোভী ও অত্যাচারী হুর অতি অল্পদিনে জনগণের বিরাগভাজন হন। তাহার কুশাসনের প্রতি জনগণ খলিফার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। খলিফা আবদুল আজিজ আল-হুরের কার্য কলাপের বিরুদ্ধে জনগণের আবেদনে গুরুত্ব দেন এবং জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আল সামাহ ইবনে মালিক আল-খাওলানীকে (৭১৯-৭২১ খ্রীঃ) আল-হুরের স্থলে গভর্নর নিযুক্ত করেন।

সামাহ বিন মালিক আল-খাওলানী

খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজ, স্পেনের বিভিন্ন এলাকা কোন পরিস্থিতিতে ও পরিবেশে বিজিত হয়, তাহা জানাইতে সামাহকে নির্দেশ প্রদান করেন। সামাহ স্পেনে আসিয়াই সরেজমিনে তদন্ত করিয়া সমস্ত বিষয় সবিস্তারে খলিফাকে অবহিত করেন। সামাহ স্পেনে আগমন করেন ১০০ হিঃ/ রমজান মাসে (এপ্রিল ৭১৮ খ্রীঃ)। তিনি ইসলামী আদর্শ মোতাবেক আদায়কৃত করের এক পঞ্চমাংশ জাবির নামক জনৈক ব্যক্তির মাধ্যমে দামেস্কে প্রেরণ করেন। ইহার অল্পদিন পর ১০১ হিঃ/ ৭১৯ খ্রীস্টাব্দে ওমর বিন আবদুল আজিজের মৃত্যু ঘটে। তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হন দুর্বল উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদ। সামাহ ইহার পর দামেস্কে কর প্রদান বন্ধ করিয়া দেন। এবং সংগৃহীত কর স্পেনের জনকল্যাণমূলক কার্যে ব্যয় করেন।

৭১৭ খ্রীস্টাব্দে আইউব-বিন হাবিব (সামাহ) শাসন কার্যের সুবিধার্থে সেভিল হইতে রাজধানী দেশের মধ্যস্থলে অবস্থিত কর্ডোভাতে স্থানান্তর করেন। কর্ডোভা স্পেনে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। সামাহ সারাগোসায় একটি জামে মসজিদ নির্মাণ ও গোয়াদালকুইভির নদীর উপর রোমানদের নির্মিত পুরাতন পুলটি পুনর্নির্মাণ করেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার

সমাধান কল্পে তিনি সারাদেশ ব্যাপী বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের লোকের আদম শুমারী করেন এবং নতুন কর প্রথা চালু করিবার উদ্দেশ্যে ভূমি ও শহরগুলিকে নতুন করিয়া জরিপ করেন। দেশের বসতিহীন এলাকায় বার্বারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।

তুলুসের যুদ্ধ

সামাহ শুধু একজন উত্তম প্রশাসকই ছিলেন না, তিনি সুদক্ষ সেনাপতি হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করেন। শাসনভার গ্রহণ করিবার পরই তিনি শুনিতে পাইলেন যে, সেপ্টিমানিয়ার খ্রীস্টানগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছে। পীরেনীজের অপর প্রান্তে অবস্থিত এই সেপ্টিমানিয়া সপ্তনগরী নমে খ্যাত। নারবোন, আগদে, বেজিয়ার লোভে, কারকাসূসোন, নিমেস ও মাগলোন নামে, সাতটি শহর সমন্বয়ে সেপ্টিমানিয়া গঠিত। রাজধানী নারবোনে সমুদ্র হইতে অতি সহজে প্রবেশের পথ ছিল। ফলে ইহা। মুসলিম সেনাদের সামরিক তৎপরতার লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়। তিনি অতঃপর আকিতেনের রাজধানী তুলুস অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন এবং ৭২১ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে উহা অবরোধ করেন। আকিতেনের ডিউক ইউডেস শহর সেনাদলের সাহায্যার্থে বিরাট সেনাবাহিনী লইয়া আগমন করেন। সেনা সংখ্যার স্বল্পতা ও উভয় দিক হইতে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সামাহ আরব সুলভ ক্ষিপ্রতার সহিত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু অপর্যাপ্ত সৈন্য সংখ্যার কারণে বীরত্ব নিষ্ফল পর্যবসিত হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর সামাহ নিহত হন। তাহার মৃত্যুতে সেনাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ আল গাফিকীর নেতৃত্বে সামাহর সেনাদল যুদ্ধক্ষেত্র প্রভেন্স হইতে প্রত্যাবর্তন করে।

আনসাহ

(৭২১-২৫)

সামাহর মৃত্যুর পর আবদুর রহমান কয়েকমাস গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আফ্রিকার গভর্নর জেনারেল বিশর বিন সাফওয়ান আনবাসাহ বিন সাহিম আল কালবিকে স্পেনের গভর্নর নিযুক্ত করেন। নতুন গভর্নর আবদুর রহমানকে পূর্ব স্পেনের লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে পুনর্বহাল করেন।

তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি সহকারে অভিযান পরিচালনা করিয়া কারকাসসোন, নিমেস ও অন্যান্য স্থান পুনর্দখল করেন। মুসলিম সেনারা উত্তর দিকে রোন উপত্যকা অতিক্রম করিয়া আউতুনে উপস্থিত হয়। মুসলিম বাহিনী ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বারগুইণ্ডি প্রদেশ এবং পূর্বে সাউনে অধিকার করে। আনবাসাহ কারকাসসোনের খ্রীস্টানদের মিত্রতা ও সহযোগিতায় আত্মরক্ষা মূলক ও আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করেন। জামিন ও বন্দীদের প্রতি তাঁহার মহানুভবতা এবং বিচক্ষণতাপূর্ণ ব্যবহার দক্ষিণ ফ্রান্সে মুসলমানদের অবস্থানকে শক্তিশালী করিতে সাহায্য করে। ৭২৫ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে আউতুন হইতে গানিমত সহ ফিরিবার পথে বাঙ্ক বিদ্রোহীদের হস্তে তিনি নিহত হন।

আনবাসাহর মৃত্যুর পর গভর্নর পদটি স্পেনে নতুন বসতি স্থাপনকারী বিভিন্ন আরব গোত্রের মধ্যে বিতর্কের বস্তুতে পরিণত হয় এবং পরবর্তী পাঁচ বৎসরে পরপর একাধিক

গভর্নর নিযুক্ত হন। তাঁহার সময়ে দেশের শাসন ব্যবস্থায় কোন উন্নতি পরিলক্ষিত হয় নাই এবং কোন নতুন অভিযান পরিচালিত হয় নাই। হিসাম বিন উবায়েদ কিলাবীর সময় (৭২৯-৭৩০) পীরেনীজের অপর পার্শ্বে অবস্থিত লিওন, মাসসান এবং অন্যান্য স্থান মুসলমানদের হস্তগত হয়। কিন্তু আরব এবং বার্বারদের কোন্দল ও আত্মকলহের ফলে এই সব অঞ্চল হাতছাড়া হইয়া যায়।

আবদুর রহমান আল গাফিকী

(৭৩০-৩২)

খলিফা হিশাম বিন আবদুল মালিক স্বয়ং স্পেনের প্রশাসনিক ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ আল-গাফিকীকে স্পেনের গভর্নর নিযুক্ত করেন। আল গাফিকী ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসক ও মহান সেনাপতি। দক্ষিণ আরব ও উত্তর আরবের হিমাইয়ার এবং মুদার নামক পরস্পর বিরোধী উভয় গোত্রের নিকটেই তিনি ছিলেন প্রিয়। তিনি রাজ্যের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে ভ্রমণ করিয়া দেশের ভগ্ন প্রশাসন যন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করেন। তিনি জনগণের অভিযোগের সুবিচার করেন। ইউরোপে তারিক এবং মুসার সাহসিকতাপূর্ণ কার্যকে পুনরায় আরম্ভ করিয়ার উদ্দেশ্যে তিনি সীমান্তকে সুরক্ষিত করেন। আল গাফিকী ইটালী, জার্মানী ও গ্রীক সাম্রাজ্যকে ইউরোপের মুসলিম দখলকৃত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সহিত একত্রিত করিবার অসম্পূর্ণ কার্যকে সম্পূর্ণ করিবার উপযুক্ত ব্যক্তি বলিয়া নিজেকে মনে করিতেন। তিনি দক্ষিণ ফ্রান্সের উসমান বিন আবু নিসা নামক বার্বার নেতাকে শায়েস্তা করেন। উসমান বিন আবু নিসা আর্কিটেনের ডিউক ইউডেস-এর সহিত পারস্পরিক স্বার্থে একত্রিত হইয়া ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। (এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হইবে) আল গাফিকী গিরি পীরেনীজের পশ্চিমে অবস্থিত অপর একটি গমনাগমনের পথ আবিষ্কার করেন এবং ৭৩২ খ্রীঃ বসন্তকালে ১,০০০০০ লক্ষ সৈন্য লইয়া এই পথে পালোনা অতিক্রম করিয়া রোনসেসভালেস গিরিপথের মধ্য দিয়া ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। তবে এক লক্ষ সৈন্যের সংখ্যা অতিরঞ্জিত বলিয়া মনে হয়। তিনি রোন নদীর তীরে অবস্থিত আর্লেস আক্রমণ করিয়া তুমুল যুদ্ধের পর অধিকার করেন।

তিনি বোর্ডেক্সের তীরে ইউদেসকে পরাজিত করিয়া ফ্রান্সের বিখ্যাত বন্দর বর্তিমাস্ক অধিকার করিয়া প্রচুর সম্পদ হস্তগত করেন। ফ্রান্সের উত্তরে অবস্থিত বুরগুডিসহ লিওন, বেসাসকোন এবং সেন্স শহরগুলিও তাহার হস্তগত হয়।

তুরস অথবা পইটিয়ার্সের যুদ্ধ

আবদুর রহমান অতঃপর উত্তর-ফ্রান্স অভিমুখে অগ্রসর হন। অসহায় ইউডেস তাহার পুরাতন শত্রু ফ্রান্সের রাজা চার্লসের সহিত মতবিরোধ দূর করিয়া তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা করেন। চার্লস তাঁহার আহবানে সাড়া দিয়া বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন। চার্লস এবং ইউডেস সম্পাদিত সন্ধি সম্পর্কে মুসলিম গোয়েন্দাদের ব্যর্থতায় আবদুর রহমান বিস্মিত হন। নদী এবং পাহাড়ের

গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সৈন্য মোতায়েন করিবার ফলে সামান্য সংখ্যক সৈন্য অবশিষ্ট থাকে। শৃঙ্খলা বোধহীন বার্বার সৈনিকগণ কঠোর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও লুণ্ঠন ও বর্বরোচিত কার্যে লিপ্ত হয়। গানিমতের মালের লোভে তাহাদের কর্তব্যবোধ এবং শৃখলার কথা ভুলিয়া যায়। ইহা ব্যতীত মুসলমানদের মধ্যে গোত্রীয় কোন্দল আবার মাথাচাড়া দিয়া ওঠে। এইরূপ বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনী লইয়া খ্রীস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। রমজান ১১৪ হিঃ/৭৩২ খ্রীঃ অক্টোবর মাসে লোয়াইর নদীর তীরে সাড়ে বার মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত পইটিয়ার্সে ও তুরসের মধ্যবর্তী সমতল ভূমিতে উভয় পক্ষের সেনাদল মিলিত হয়। খণ্ডযুদ্ধে প্রায় এক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়। এই খণ্ড যুদ্ধ চলাকালে কোন পক্ষই অপর পক্ষকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করিতে সাহস পায়না। এই খণ্ড যুদ্ধ মুসলমানদের অনুকূলে থাকে এবং অবশেষে সাধারণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যখন ফ্রান্সের পরাজয় অত্যাসন্ন সেই মুহূর্তে গানিমত সংগ্রহের জন্য মুসলিম সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আবদুর রহমান শৃঙ্খলা ফিরাইয়া আনিতে চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হন। দশম দিবস সন্ধ্যা বেলায় যুদ্ধপরিচালনা করিবার সময় তিনি নিহত হন। নেতার মৃত্যুতে মুসলিম সেনাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে তাহার সহযোগীদের মধ্যে সাংঘাতিক মতবিরোধ দেখা দেয়। সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হইয়া রাতের অন্ধকারে তাহারা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে।

পশ্চাৎ অপসারণকারী মুসলিম সেনাদের পশ্চাদ্ধাবনে ফ্রাঙ্ক সেনাবাহিনী অতিরিক্ত পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। অস্ত্রশস্ত্রসহ সম্পূর্ণ মুসলিম শিবির খ্রীস্টানদের হস্তগত হয়। চার্লস আহত মুসলমানদের হত্যা করিয়া মারটেল হন্তা” উপাধি লাভ করেন। তিনি পুনরায় উত্তর দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকের মতে, তুরসের যুদ্ধ একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ তাহাদের মতে, ঐ যুদ্ধের ফলেই খ্রীস্টান-ইউরোপে মুসলমানদের অনুপ্রবেশ চিরতরে বন্ধ হইয়া যায়।

ইহা সত্য যে কিছু সংখ্যক পশ্চাৎ অপসারণকারী মুসলিম পলাইয়া যায় এবং পুনরায় এই পথে ফ্রান্সে অনুপ্রবেশের চেষ্টা পরিত্যাগ করে। ওয়াদী লাক্কোর ন্যায় সমস্ত সেনাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনয়ন করিয়া সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা হয়। এই যুদ্ধে চার্লস মার্টেল পরাজিত হইলে সম্পূর্ণ পশ্চিম ইউরোপের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটিত। কারণ মুসলমানদের সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করিবার মত শক্তিশালী সেনা তাহাদের ছিলনা। এই যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় ইউরোপে তাহাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে ততটা অন্তরায় ছিল না, যতটা ছিল মুসলিম নেতাদের মধ্যে অনৈক্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আত্মকলহ সৃষ্টির কারণ। আরব এবং বার্বারদের জাতিগত উদাসীনতা এবং নব মুসলমানের আত্মতৃপ্তিহীনতা স্পেনের মুসলিম সমাজকে করে কলঙ্কিত। যোদ্ধা বলিয়া খ্যাত বার্বাররা অভিযোগ করে যে, তাহাদের দেওয়া হইয়াছে অনুর্বর মেসেতা এবং আরবরা ভোগ

করিতেছে পূর্ব-দক্ষিণে স্পেনের উর্বর অঞ্চলসমূহ। দামেস্কের খলিফার দুর্বলতার সুযোগ লইয়া মুসলমানগণ স্পেনে সীমাহীন ক্ষমতা লাভ করে ও চরিত্রের গুণাবলী হারাইয়া ফেলে। তদুপরি মধ্যফ্রান্সের আবহাওয়া তাহাদের প্রকৃতির উপযোগী ছিল না। কারণ তাহারা আসে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল হইতে। পূর্ববিজিত এলাকায় বাকী সৈন্য মোতায়েন রাখিবার ফলে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য দ্বারা মধফ্রান্স দখলে রাখা অসম্ভব হইয়া পড়ে। ইহার পর আর আরবরা অভিযান পরিচালনা করিয়াছে বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায়না। মুসলমানগণ ৭৩৪ খ্রীস্টাব্দে এভিগনন অবরোধ করে এবং নয় বৎসর ধরিয়া লিওনসে লুণ্ঠন করে। ৭৫৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তাহারা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান নারবোন তাহাদের অধিকারে রাখে। চার্লস মারটেল ও তাহার উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত ফ্রাঙ্কদের অভিযান প্রতিহত করিবার জন্য আরবরা দক্ষিণাঞ্চলের উপজাতীয়দের সাহায্য কামনা করে।

গৃহযুদ্ধ ও আরব গোত্রসমূহ

৭৫৬ খ্রীস্টাব্দ হইতে স্পেনের স্বাধীন ইমারত প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের ফল হিসাবে তাহাদের এই পরাজয়বরণ করিতে হয়। আরব, বার্বার, সিরীয়, এবং নওমুসলিমগণ পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত ছিল। প্রথম তিন দল ছিল বিজয়ী এবং শেষোক্ত দল ছিল বিজিত। আরবরা তাহাদের পূর্বপুরুষের গোত্রীয় আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ধারাকে ত্যাগ করিতে শুরু করে। তাহারা সিরীয় ও বার্বারদের উপেক্ষা করিত এবং নওমুসলিমদের করিত ঘৃণা।

আরব গোত্রসমূহের মধ্যে বানু আদনান, বানু হাশিম, বানু উমাইয়া, বানু মাখজুম, বানু ফিহর এবং অন্যান্য গোত্র জীবিকার উজ্জ্বল সম্ভাবনায় আন্দালুসে বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু তাহারা এই নতুন দেশে লইয়া আসিয়াছিল তাহাদের পুরাতন কেন্দ্রীয় বিদ্বেষ এবং প্রতিদ্বন্দিতা। তাহারা মুজারী, হিমিয়ারী (অথবা ইয়ামানী) দুই পুরাতন গোষ্ঠীর অধীনে সংগঠিত ছিল। শেষোক্ত দল ছিল শিয়া আদর্শে বিশ্বাসী এবং প্রথম দল ছিল গোঁড়া সুন্নী দলভুক্ত। কালবী (ইয়ামনী) এবং কাইসী (উত্তর-আরব) গোত্রদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল পুরাতন শক্রতা। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (মৃত ৭১৯ খ্রীঃ) এবং পরবর্তী উমাইয়া খলিফাগণ এই গোত্রীয় বিদ্বেষকে দূরিভূত করিবার জন্য কোন প্রচেষ্টাই চালান নাই। ফলে এই বিদ্বেষ দূরবর্তী প্রদেশগুলিতেও বিস্তার লাভ করে। খলিফা ইয়াজিদ বিন আবদুল মালিক, কালবী গোত্রের বিশর বিন সাফওয়ান নামে জনৈক জেনারেলকে আফ্রিকার গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে কালবী নেতা আনবাসাহ বিন সাহিমকে কাইসী নেতা আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ আলগাফির স্থলে স্পেনের গভর্নর নিযুক্ত করেন। গাফিকীকে নিযুক্ত করেন পূর্ব-স্পেনের ডিপুটি গভর্নর। এই গোত্রীয় বিদ্বেষ ও বিরোধের ফলে স্পেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।

আবদুল মালিক

(৭৩২-৩৪ খ্রীঃ)

আবদুর রহমানের পর মদীনার জনৈক নেতা আবদুল মালিক স্পেনের গভর্নর নিযুক্ত হন। ৭৩২ খ্রীস্টাব্দের অক্টোবর মাসে তুরসের যুদ্ধে আবদুর রহমান নিহত হন। আবদুল মালিক মুসলমান সেনাদের হৃত গৌরবকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হন এবং আরবগণ নাভাররের খ্রীস্টানগণকে পরাজিত করেন। বর্ষাকালে গিরিমালা অতিক্রম করিয়া তিনি এভিগনন ও সেন্টরেমী অধিকার করেন। এই যুদ্ধের সময় জনগণের সহিত তিনি যে নিষ্ঠুর এবং নির্দয় ব্যবহার করেন তাহাতে পুরাতন বিদ্বেষ এবং বিরোধিতা আবার মাথা চাড়া দিয়া ওঠে। সেনাবাহিনীর মধ্যে এই বিদ্বেষ ও বিরোধীতা পূর্ব হইতেই বিদ্যমান ছিল। ইহারই প্রতিক্রিয়া হিসাবে ৭৩৪ খ্রীস্টাব্দে তিনি পদচ্যুত হন।

উকবাহ

আফ্রিকার গভর্নর জেনারেল উবায়দুল্লাহ কর্তৃক উকবাহ বিন হাজ্জাজ সালুবী (৭৩৪-৭৪০ খ্রীঃ) আবদুল মালিকের স্থলে স্পেনের গভর্নর নিযুক্ত হন। নতুন গভর্নর উকবাহ ছিলেন দয়ালু ও সুবিচারক। সর্বপ্রথম তিনি জনশিক্ষা ও সুবিচারের প্রতি গুরুত্ব দেন এবং প্রশাসনযন্ত্রকে পুনর্বিন্যাস করেন। উকবাহ ছিলেন একজন সুদক্ষ সেনাপতি। তাঁহার অধীনে মুসলিম বাহিনী ফ্রান্সের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে। তিনি যুদ্ধ অভিযানের জন্য সুবিধাজনক স্থানসমূহ সুরক্ষিত করেন। তিনি পিয়েডমন্ট, টরোইস চাটেআউক্সে, সেন্টপল, ডনজেরে, ভ্যালেন্স ও বারগুণ্ডি অধিকার করেন এবং মধ্যফ্রান্স অধিকার করিবার হুমকি প্রদান করেন। তিনি গ্যালিয়ার ও আরিয়াসের বিদ্রোহীদের দমন করিয়া তথায় মুসলিম উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেন।

চার্লস মার্টেল মার্সেলেদের আক্রমণ করায় নারবোনের ডিউক গভর্নর ইউসুফ বিন আবদুর রহমানের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি মুসলিম আধিপত্য স্বীকার করিয়া নেন। ৭৩৭ খ্রীস্টাব্দে চার্লস স্পেনের মুসলমানদের অধীন করদরাজ্য প্রভেন্সকে পুনরায় আক্রমণ করেন। ইউসুফ বিন আবদুর রহমান চার্লসের খ্রীস্টান বাহিনীর মোকাবেলা করিয়া পরাজিত হন এবং প্রভেন্স হাত ছাড়া হইয়া যায়। চার্লস মার্টেল ললামবার্ডসের রাজা লিউন্ডের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এবং বাস্কগণকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন। এইরূপে উকবাহকে অপ্রত্যাশিত ভাবে সুসংগঠিত বাহিনীর সম্মুখীন হইতে হয়। পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করিয়া ফ্রাঙ্কস লোয়ারের দক্ষিণে দেশের এক বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেন। উত্তর-আফ্রিকার বার্বার রাণী কাহিনা যেমন মুসলিম অগ্রাভিযানকে প্রতিহত করিবার উদ্দেশ্যে করিয়াছিলেন।১২ বেজিয়ের, আগদে নিমেস এবং মাগুলোনের ন্যায় প্রসিদ্ধ শহরসমূহ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। নারবোন ও অন্যান্য কয়টি শহর মুসলমানদের অধিকারে থাকে। ৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে আফ্রিকায় রক্তক্ষয়ী বার্বার বিদ্রোহ দেখা দিলে আফ্রিকার গভর্নর জেনারেল উবায়দুল্লাহ উকবাহকে ডাকিয়া পাঠান। জানুয়ারী ৭৪১ খ্রীঃ/ হিজরী ১২৩ সফর মাসে উকবাহ দেহ ত্যাগ করেন। বাবার এবং হেজাজী সৈনিকগণ আবদুল মালিককে পুনরায় স্পেনের গভর্নর নির্বাচিত করেন।

আস্তুরিয়া কর্তৃক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা

আমীর আনসারের সাথে যুদ্ধে পিলাইও শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। তিনি ৭৩৭ খ্রীঃ অনতিকালে মৃত্যু বরণ করিলে তাহার পুত্র ফাবিলা আস্তুরীয়াদের নেতা নির্বাচিত হন এবং শিকার কালে তাঁহার মৃত্যু ঘটে। তাহার পুত্র অপ্রাপ্ত বয়স্ক বলিয়া পিলাইওর জামাতা আলকানসা ৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে খ্রস্টানদের নেতা নির্বাচিত হন। উকবাহ বিন হাজ্জাজের আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তনের ফলে স্পেনে বিদ্বেষ ও মতবিরোধ বিস্তার লাভ করে। এই সুযোেগে আলকানসা গ্যালিসিয়া এবং বর্তমান পর্তুগালের কিছু অংশ দখল করিয়া নিজেকে গ্যালিসিয়া এবং আরিয়ার রাজা বলিয়া ঘোষণা করেন। এই সুযোগে তিনি উত্তর-পশ্চিমে নিরাপদে থাকিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।

বার্বার বিদ্বেষ ও বিদ্রোহ

বার্বারদের আদি বাসস্থান ছিল আফ্রিকায়। রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক হইতে তাহাদের আদি দেশের সহিত গভীর সম্পর্ক বজায় ছিল। উত্তর-আফ্রিকায় কোন বার্বার অসন্তুষ্টি দেখা দিলে স্পেনের বার্বারগণ আমীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিত। বার্বাররা স্পেনে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করিয়াছিল। তাঁহাদিগকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় নাই। মুসার অনুগত আরবরা দক্ষিণ স্পেনের সমতল উর্বরভূমি ভোগ করিত। তারিকের অনুগত বার্বারদের দেওয়া হইয়াছিল উত্তরের পাহাড়িয়া অঞ্চল এবং লা মাঞ্চা ও এস্টেরে-মাদুরার অনুর্বর ভূমি। বার্বাররা কৃষিকার্য ও মেষ পালন করিতেন। জীবন ধারণের জন্য তাহাদের একদিকে কঠিন পরিশ্রম করিতে হইত অন্যদিকে জীবন ও ইজ্জতের জন্য খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে সর্বদা যুদ্ধ করিতে হইত। আরবরা তাহাদের গানিমত ছিনাইয়া লইয়া, নেতাকে জেলে পুড়িয়া অপমান করিয়াছিল।

ইহাতে তাহাদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিদ্রোহ স্পেনের সামান্য অংশে দেখা দেওয়ায় দ্রুত দমন করা সম্ভব হয়। উসমান বিন আবু নিসাহ যাহাকে খ্রীস্টানরা মুনু অথবা মনুজা বলিয়া ডাকিতেন তিনি ছিলেন স্পেনে তারিকের সহিত চারজন আগমনকারীর অন্যতম। আর্কিটনের ডিউক ইউডেসের কন্যা অপরূপ সুন্দরী লামপেজিয়েকে তিনি বিবাহ করেন। গিরিমালার অপর পার্শ্বে পুইসেরদার নিকটে সেরডাগ্নেতে তিনি নিজেকে স্বাধীন বলিয়া ঘোষণা করেন। তাহার ছিল স্বল্পসংখ্যক বার্বার সমর্থক। ৭৩০ খ্রীস্টাব্দে স্পেনের গভর্নর আবদুর রহমান তাহার বিদ্রোহকে অতি সহজেই দমন করেন। তিনি গ্যালিসিয়ায় পলাইয়া যান কিন্তু পশ্চাদ্ধাবন করিয়া তাহাকে হত্যা করা হয়। তাহার স্ত্রী ও অন্যান্য বন্দীরা আবদুর রহমানের সমর্থকদের হাতে ধরা পড়েন। তিনি তাহাকে দামেস্কে প্রেরণ করেন। খলিফা হিশামের পুত্রের সহিত তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

অধিকাংশ বার্বার ছিলেন খারিজী মতাবলম্বী। তাহারা উমাইয়া এবং আলীয়দের বিরুদ্ধাচারণ করিত। স্পেন ও আফ্রিকার ইতিহাসে এক চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বলিয়া

তাহারা পরিচিত। ওমর ইবনে আবদুল আজিজের করপ্রথা যে সমস্ত আমলারা পরিবর্তন করিয়াছিল, বার্বাররা তাহাদের ঘৃণা করিত। বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। বার্বারগণ ছিল স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি। তাহাদের বিরোধিতা পরবর্তীকালে ধর্মীয়রূপ পরিগ্রহ করে। খারিজী মতে বিশ্বাসী বার্বারগণ আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত বলিয়া বিশ্বাস করিত। নয় বৎসর ব্যাপী (৭৩৪-৪২ খ্রীঃ) এই বিদ্রোহ ইফ্রিকীয়ায় শান্তি বিনষ্ট করে এবং আফ্রিকার পশ্চিমে মরক্কো হইতে কায়রোওয়ান পর্যন্ত এলাকার শান্তি ও প্রগতির পক্ষে হুমকি হইয়া দাঁড়ায়। এখন ইহা স্পেনেও বিস্তার লাভ করে।

এইবার তাহারা একজন ধর্মীয় (ইমাম) নেতার অধীনে আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ সারাগোসা ব্যতীত অন্যান্য শহরে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাহারা তাহাদের সেনাবাহিনীকে তিন দলে বিভক্ত করে। প্রথম দল টলেডো অবরোধ করে, দ্বিতীয় দল অগ্রসর হয় কর্ডোভা আক্রমণের উদ্দেশ্যে এবং আল-জেসিরাস ও সিউটাকে অধিকার করিবার জন্য তৃতীয় দল নিয়োজিত হয়। আবদুল মালিক তাহাদের বিরুদ্ধে কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেন কিন্তু উহা প্রতিহত করা হয়। ৭৫০ খ্রীস্টাব্দে স্পেনে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে অসন্তুষ্ট বার্বারগণ স্পেন হইতে আফ্রিকায় আগমন করে।

স্পেনে সিরীয়বাসী

মুসার সহিত আগমনকারী আরবদের প্রথম দলটি বালাকিউন নামে পরিচিত। পরবর্তী আগমনকারীগণ সিরীয় (সামিউন) নামে খ্যাত। সিরীয়বাসীগণ আফ্রিকার মধ্য দিয়া তাহাদের নেতা বালজ ইবনে বিশর আলকুশাইরীর সহিত স্পেনে আগমন করে। খলিফা হিশাম আফ্রিকায় বার্বারদের বিদ্রোহকে দমন করিবার জন্য ৭৪১ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে কুলসুম বিন আইয়াদের নেতৃত্বে ২৭,০০০ সিরীয় সৈন্য প্রেরণ। করেন।১৩ গোত্রীয় বিদ্বেষ এবং হেজাজ ও মদীনাবাসীদের প্রতি সিরীয়বাসীদের ঘৃণার কারণে সিরীয়গণ সেবু নদীর তীরে বাকদুরার যুদ্ধে পরাজিত হয়। বালজ ইবনে বিশরের নেতৃত্বে ৭০০০ সৈন্যের একটি দল মূল সেনাদল হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সিউটাতে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাহারা পাঁচ ছয়বার বার্বারদের আক্রমণকে সাফল্যের সহিত প্রতিহত করে।

বার্বারগণ শহরের সরবরাহকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখে। সিরীয়গণ স্পেনে গমনের চেষ্টা করে। ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে সিরীয়বাসীদের হাতে হেজাজের আল-হাররাতে মদীনাবাসীদের শোচনীয় পরাজয় এবং নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা স্মরণ করিয়া স্পেনের গভর্নর আবদুল মালেক প্রথমে সিরীয়দের স্পেনে প্রবেশের বিরোধীতা করেন। পরবর্তীকালে বার্বারদের মারাত্মক বিদ্রোহে তাহার অস্তিত্ব বিপন্ন হইলে আবদুল মালেক এক জাহাজ বোঝাই১৪ খাদ্য ও বস্ত্র সিরীয়দের সাহায্যে প্রেরণ করেন এবং শর্তাধীনে তাহাদিগকে সিউটা হইতে স্পেনে আসিবার অনুমতি প্রদান করেন। প্রতিদলের দশজন নেতাকে আবদুল মালেকের হস্তে জামিন হিসাবে অর্পণ করিয়া এবং বার্বার বিদ্রোহকে দমন করবার পর বার্বার আধিপত্য হইতে মুক্ত আফ্রিকার নিরাপদ

অঞ্চলে প্রত্যাবর্তন করিবার শর্তে তাহারা স্পেনে প্রবেশ করে। তাহাদের আগমনে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। কতিপয় স্পেনীয় আরবের সাহায্যে সিদনীয়া, কর্ডোভা ও টলেডোর বার্বারদিগকে পরাজিত এবং তাহাদের ধন সম্পদের বিপুল ক্ষতিসাধন করে।

মদীনাবাসী ও সিরীয়বাসীদের যুদ্ধ

স্পেন ত্যাগের প্রশ্নে কাইসাই সম্প্রদায়ভুক্ত সিরীয়দের সম্মুখে সমস্যা দেখা দেয়। কালবী সম্প্রদায়ভুক্ত গভর্নর আবদুল মালিক তাহাদের যাতায়াতের সুব্যবস্থা না করিয়াই তাহাদিগকে সিউটাতে নির্বাসন দিতে ইচ্ছা করেন। সিউটাতে ইতিপূর্বেই বার্বারদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কাইসী ও কালবী সম্প্রদায় আধুনিক রাজনৈতিক দলের ন্যায় কার্য পরিচালনা করিত। সিরীয়রা সীমাহীন অধিকার ও ক্ষমতা ভোগ করিত এবং তাহারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। আবদুল মালিকের আদেশ অমান্য করিয়া তাহারা কর্ডোভা অভিমুখে অগ্রসর হয় এবং আবদুল মালিককে সিংহাসনচ্যুত করিয়া তাহারা বালজ ইবনে বিশরকে ৭৪১ খ্রীস্টাব্দের ২০শে ডিসেম্বর স্পেনের গভর্নর বলিয়া ঘোষণা করে। সিরীয় জামিনদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং আবদুল মালিককে কর্ডোভার আবি আইউব প্রসাদের বাহিরে আনিয়া হত্যা করা হয়। মদীনাবাসী ও সিরীয়বাসীদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।

মদীনাবাসীদের নেতৃত্ব প্রদান করেন আবদুল মালিকের পুত্র উমাইয়া ও কুতন এবং তাহাদের সাহায্য করে লাখমী সম্প্রদায়ভুক্ত আবদুর রহমান বিন হাবিব আল ফিহরী। মদীনাবাসীদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০,০০০ ভিন্নমতে ১,০০০০০ লক্ষ।১৫ অপরদিকে সিরীয়গণ ১২,০০০ হাজারের অধিক সৈন্য সংগ্রহ করিতে ব্যর্থ হয়। নারবোনে নিযুক্ত কমান্ডার্স নারবোন ত্যাগ করিয়া আবদুল মালিক ও তাঁর পুত্রদের পক্ষে গভর্নর আবদুর রহমান আলকাসাহর নেতৃত্বে গৃহযুদ্ধে যোগদানের জন্য আগমন করে। ৭৪২ খ্রীস্টাব্দে আগস্ট মাসে কর্ডোভার নিকট ডালবাহতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মদীনাবাসী পরাজয় বরণ করে এবং ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মদীনাবাসীদের পক্ষে ১০,০০০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। অপরপক্ষে সিরীয় সৈন্য নিহত হয় ১,০০০ হাজার এবং তাহারা কর্ডোভা পুনর্দখল করে।১৬ গুরুতর আহত বালজের মৃত্যুর কিছুদিন পর থালাবাহ বিন ছালমাহ আল-আমিলী (অজিলি) নামক জনৈক সিরীয়কে স্পেনের গভর্নর বলিয়া ঘোষণা করা হয়। মুজারীদের প্রতি থালাবা বিন ছালমার পক্ষপাতিত্বের দরুন ইয়ারুন বাজে বিদ্রোহী হইয়া ওঠে এবং তাহারা বার্বার ও নওমুসলিমদের সহিত যোগদান করে।

থালাবা বিন ছালামাহ ঈদের দিন মদীনাবাসী ও বার্বারদের মেরিদাতে আক্রমণ করিয়া পরাজিত করেন। নেতাদের সহ নারী ও শিশুদের প্রায় ১০,০০০ হাজার জনকে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করা হয়। ৭৪৩ খ্রীস্টাব্দের মে মাসের এক শুক্রবারে তাহাদিগকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রয় করা হয়। শক্র নিশ্চিহ্ন হইলেও তাহার শাসন

মেরিদা এবং কর্ডোভার বাহিরে প্রসার লাভ করিতে পারে নাই। গৃহযুদ্ধ চলিতে থাকে এবং প্রশাসন যন্ত্র প্রায় ভাঙ্গিয়া পড়ে।

আবুল খাত্তার

আন্দালুসীয়ার জনগণ অত্যাচার ও গৃহযুদ্ধের দরুন হাঁফাইয়া ওঠে। তাহাদের অনুরোধে আবুল খাত্তার নামে পরিচিত কালবী গোত্রের হুসাম বিন দিরার (৭৪৩-৪৫ খ্রীঃ) স্পেনের গভর্নর নিযুক্ত হন। আফ্রিকার ভাইসরয় হানজালাহ বিন সাফওয়ান কালবী রজব ১২৫ হিঃ/ ৭৪৩ খ্রীঃ কুতন ও উমাইয়াসহ ১০,০০০ হাজার আরব যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেন। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সিরীয়দের রাজধানী হইতে বিতাড়িত করেন। থালাবাহসহ এক ডজন দাঙ্গাবাজ গোত্রীয় নেতাকে আফ্রিকায় নির্বাসিত করা হয়। সিরীয়দের মধ্যে জায়গীর হিসাবে সরকারী জমি প্রদত্ত হয়। কিন্তু জমিতে তাহাদের কোন স্বত্ব দেওয়া হয় না।১৭ বিরোধী দলগুলিকে দেশের বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়া আবুল খাত্তার দেশের অভ্যন্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও ইহা ছিল খুবই সাময়িক ব্যাপার। ইয়ামানী শিয়াদের প্রতি তাহার পক্ষপাতিত্ব সুন্নী মুজারীদিগকে বিদ্বেষ ভাবাপন্ন করিয়া তোলে, ফলে এক নতুন বিদ্রোহ দেখা দেয়। এমন প্রচণ্ড বিদ্রোহ ইতিপূর্বে আর কখনও ঘটিতে দেখা যায় নাই। তিনি সুমাইল বিন হাতিম, আবুল আতাকাসী, আবদুল মালিকের পুত্র উমাইয়াহ ও কুতন এবং ছালাবাহ বিন ছালামাহ হাদাবী প্রমুখের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন।

ইয়ামানী শিয়া এবং সিরীয় সুন্নীদের মধ্যে যুদ্ধ

স্পেনের গভর্নরদের ন্যায় উমাইয়া খলিফারা স্বৈরাচারী ছিলেন না। তাহারা শাসন কার্যে স্থানীয় আরবদের মতামতের গুরুত্ব প্রদান করিতেন। পরিণামে যখন খলিফারা দুর্বল হইয়া পড়ে প্রভাবশালী আরব নেতারা শাসন পরিচালনায় তাহাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। ইহার ফলে পুরাতন গোত্রীয় বিদ্বেষ মাথা চাড়া দিয়া ওঠে। সুমাইল বিন হাতিমের পিতামহ সীমার ইমাম হুসাইনকে হত্যা করিয়াছিল। সুমাইল বিন হাতিম ছিল কাইসী গোত্রের প্রধান। আবুল খাত্তারের বিরুদ্ধে সে ব্যক্তিগত ঘৃণা পোষণ করিত। সুমাইল জুজামী এবং লক্ষ্মী নামে দুই ইয়ামানী উপজাতীয় দলকে গভর্নরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উত্তেজিত করে।

তাহাদের সম্মিলিত বাহিনী জুজামী নেতা ও হালাবাহ বিন ছালামাহর নেতৃত্বে রাজকীয় বাহিনীকে গোয়াদালেট নদীর তীরে পরাজিত করিয়া গভর্নর আবুল খাত্তারকে বন্দী করে। কালবী নেতা আবদুর রহমান ইবনে নুয়াইম তাহাকে মুক্তি প্রদান করেন। আবুল খাত্তার পুনরায় তাঁহার লোকদের একত্রিত করিতে চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য হন। মুজারীগণ ছালাবাহ বিন ছালামাহকে স্পেনের গভর্নর নির্বাচিত করেন। সুমাইলের হাতের পুতুল হিসাবে তিনি শুধু ছয়মাস গভর্নর হিসাবে স্পেনের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাহার মৃত্যুর পর (শাবান ১২৯ হিঃ/ ৭৪৭ খ্রীঃ) সুমাইল গভর্নর না হইয়া এইপদ নারবোন ও বার্সিলোনার সেনাপতি ইউসুফ বিন

আবদুর রহমান আল ফিহরীকে প্রদান করেন ৭৪৭ খ্রীস্টাব্দে। আল কায়রোওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা উকবা ইবনে নাফির বংশধর ছিলেন ইউসুফ। গোত্রীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহযুদ্ধ চলার সময়ে এবং পরবর্তীকালে সুমাইল তাহার ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করেন। এবং শান্তিপ্রিয় ইউসুফ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার খাতিরে গভর্নরের পদ গ্রহণ করতে রাজী হন। ইউসুফের গভর্নর হিসাবে নিযুক্তি তাহার পিতা আফ্রিকার গভর্নর জেনারেল আবদুর রহমান বিন হাবিব সমর্থন করেন।

সেকুন্দার যুদ্ধ

ছালাবাহ বিন ছালামাহর পুত্র নিগ্রো আমর সুমাইল অসন্তুষ্ট হইয়া আবুল খাত্তার এবং ইয়াহিয়া বিন হুরাইছ আল জুজামীর সহিত যোগদান করেন। যেহেতু শেষোক্ত গোত্রীয় আবুল খাত্তারের গোত্র হইতে সংখ্যায় বেশী ছিলেন সেইহেতু ইবনে হুরাইছ সম্মিলিত সেনাবাহিনীর নেতা নির্বাচিত হন। গোয়াদালকুইভিরের বাম তীরে দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুজারী এবং ইয়ামানী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে প্রতি এক বছর পর পালাক্রমে এক একজন গোত্রীয় নেতা দেশ শাসন করিবে।

৭৪৭ খ্রীস্টাব্দে প্রথম বৎসরে ইউসুফ দেশ শাসনের জন্য নির্বাচিত হন। এক বৎসর অতিবাহিত হইবার পর সুমাইল ইয়ামানী এবং ইউসুফের নিজের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ইয়ামানী প্রতিনিধিকে ইউসুফের স্থলাভিষিক্ত করিতে ব্যর্থ হন। পুনরায় দুই পক্ষের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এক সপ্তাহ স্থায়ী এই যুদ্ধ কর্ডোভার বিপরীত দিকে শাকুন্দাহর (সেকুন্দা) নিকট গোয়াদালকুইভিরে সংঘটিত হয়। সুমাইলের অনুরোধে ইউসুফ কর্ডোভার সাধারণ দোকানদারকে পর্যন্ত এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণের আহবান জানান।

ইউসুফ এবং সুমাইল বিজয় লাভ করেন এবং শত্রুরা চিরতরে নির্মূল ও ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। আবুল খাত্তার এবং ইবনে হুরাইস ধৃত ও নিহত হন। ইয়ামানীদের বিদ্রোহ দমন করা হয়। ৭৪৯ খ্রীস্টাব্দে স্পেনে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয় ফলে প্রথম আলফন্সের রাজ্যবিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয়। মুসলমানরা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত থাকায় তিনি লিও, ক্যাস্টাইল এবং অন্যান্য জায়গা দখল করেন।

কোরাইশ ও সিরীয়দের যুদ্ধ

সুমাইলের আধিপত্য হইতে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে ৭৫০ খ্রীস্টাব্দে ইউসুফ তাহাকে সারাগোসার গভর্নর নিযুক্ত করেন। সারাগোসার অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল রসুলের সাহাবী মুসয়ার বিন উমাইয়েরের বংশধর। কর্ডোভার আমীর আবদারী এবং সারাগোসার ইয়ামানী নেতা হুবাব জাহরী, কুরাইশ নেতা সুমাইল, ইউসুফের বিরুদ্ধে আব্বাসীদের পক্ষ অবলম্বন করেন। বাবার এবং ইয়ামানী সৈন্যদের এক বিরাট বাহিনী সংগ্রহ করিয়া তাহারা সুমাইলের প্রেরিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এবং ৭৫৩/৪ খ্রঃ সারাগোসা অবরোধ করে। সুমাইলকে সাহায্য করিতে ইউসুফ ব্যর্থ হন। জনৈক কালবী সর্দার উবাইয়েদ (আবদুল্লাহ বিন আলী)১৯ তিনশত ষাটজন অশ্বারোহী সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং বানুকাব নেতা ইবনে শিহাব (সুলায়মান)২০

সমভিব্যাহারে সুলায়মানের সাহায্যে অগ্রসর হন। যাত্রা পথে চারশত মুজার তাহাদের সহিত যোগদান করে। নতুন সৈন্যের আগমনে আমীর এবং হুবাব অবরোধ প্রত্যাহার করিয়া ৭৫৫ খ্রীস্টাব্দের প্রথম দিকে পলায়ন করেন।

নব মুসলিমগণ

চতুর্থ এবং শেষদল যাহারা গৃহযুদ্ধের সহিত জড়িত ছিল তাহারা হইল নব মুসলীমগণ (মুয়াল্লাকুল) তাহারা ছিল স্পেনে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাহারা অধিকাংশই ছিল দেশের অভ্যন্তরের কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, কারিকর ও শ্রমজীবী। বিজয়ীরা সাধারণত স্পেনীয়দের ধর্মান্তরে উৎসাহিত করিতেন না। কারণ ইহাতে কোষাগার ক্ষতিগ্রস্ত হইত। নব মুসলমানগণ আরব ও বার্বারদের ঘৃণা করিত। প্রথম দলকে তাহাদের অহঙ্কারের জন্য, আর শেষোক্ত দলকে তাহাদের অসভ্য ও কঠোর কর্কশ ব্যবহারের জন্য। দেশের প্রধান শহরের ধর্মান্তরিত মুসলমানগণ ছিলেন ধনী ও সম্ভান্ত পরিবারের। ৭৫০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একজন অনারব ছিল অপর একজন আরবের আশ্রিত। বৃত্তিভভাগের ব্যাপারে মুসলিম রাষ্ট্রে একজন আশ্রিত ব্যক্তি একজন আরবের তুলনায় কম বৃত্তি পাইত। এই ব্যবস্থা মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করিয়া স্পেনীয় মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

গোঁড়া খ্রীস্টানগণ স্পেনীয় মুসলমানদের ঘৃণা করিত এবং স্বধর্মত্যাগী বলিয়া সম্বোধন করিত। খ্রীস্টান এবং দেশীয় মুসলমানদের সহিত বিবাহ প্রচলিত ছিল। নব মুসলমানের কোন শিশু জন্মগ্রহণ করিলে সে মুয়াল্লাদ বলিয়া পরিচিত হইত। পার্সীয়ানদের ন্যায় নব মুসলমানগণকেও আরব এবং বার্বারগণ ঘৃণা করিত এবং তাহাদিগকে দাসপুত্র বলিয়া ডাকিত। তাহাদিগকে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ সরকারী চাকুরী প্রদান করা হইত না ফলে তাহারা আরব শাসনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে ও পরবর্তীকালে আরব শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হইয়া ওঠে এবং অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী উত্থাপন করে। আরব প্রাধান্যকে খর্ব করিবার জন্য তাহারা বিভিন্ন দলে যোগদান করিতে শুরু করে। ইহার ফলে স্পেনে মতবিরোধের আর একটি সূত্রপাত ঘটে।

বিভিন্ন দলকে একত্র করা এবং দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপন করা সত্যই দুরূহ ব্যাপার ছিল। দামেস্কের উমাইয়া খলিফা শান্তি প্রতিষ্ঠা করিতে ব্যর্থ হন। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন (৭৩২-৭৫৫ খ্রীঃ) চলাকালীন প্রায় পঞ্চাশ জন গভর্নর একের পর এক স্পেনের শাসন কার্যে নিযুক্ত হন। এই দ্রুত আগমন ও নির্গমনে তাহারা অতি সামান্য সময়ই দেশের বিশৃঙ্খল অবস্থার উন্নতি বিধানে ব্যয় করিতে সমর্থ হন। গৃহবিবাদ এবং আরিয়ার প্রথম আল ফন্সের চাপে উত্তর-পশ্চিম উপদ্বীপের প্রায় এক চতুর্থাংশ স্থান মুসলমানদের হস্তচ্যুত হয়।

 ফ্রান্স হইতে মুসলমান উৎখাত

ইউসুফ যখন অভ্যন্তরীণ শত্রু দমনে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় চার্লস মার্টেলের উত্তরাধিকারী এবং পুত্র পেপিন (Papin the short) ৭৫৫ খ্রীস্টাব্দে ফ্রান্সের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করে। ফরাসীগণ

মুসলিম নগরী আগদে, বেজিয়ার্স, লডেভ এবং অন্যান্য শহর ধ্বংস করে এবং মুসলিম আবাল বৃদ্ধ বণিতা এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুসলমানকে হত্যা করে। তাহারা হাসপাতাল, স্কুল এবং মসজিদে অগ্নি সংযোগ করে। কয়েক বৎসর গোলযোগপূর্ণ সময়ে উত্তর স্পেনের পর্বতসঙ্কুল এলাকা হইতে মুসলমানদিগকে প্রত্যাহার করা হয়। এই দুর্গম এলাকায় খ্রীস্টানগণ নিজেদের দৃঢ়ভাবে সুরক্ষিত করিয়াছিল এবং সেখান হইতে মুসলিম স্পেনে পরবর্তীকালে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। মুসলমানরা যখন গৃহযুদ্ধে ব্যাপৃত সেই সময় পিলাইও আস্তুরিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং চালর্স মার্টেল ও তাহার উত্তরাধিকারগণ ফ্রান্সের মুসলমানদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে।

ফ্রান্স হইতে মুসলমানদের উৎখাতের কারণসমূহ

১। আবদুর রহমান আল-গাফিকীর পর অন্য কোন যোগ্য গভর্নর তাহার স্থলাভিষিক্ত না হওয়ার দরুন আরব এবং বার্বারদের মধ্যে গোত্রীয় বিদ্বেষ দেখা দেয়, ফলে উভয় সম্প্রদায়ই হিংস্র হইয়া ওঠে। ২। উমাইয়া খিলাফতের সময় কেন্দ্রীয় প্রশাসন-যন্ত্রের দুর্বলতা, আফ্রিকার ভাইসরয় কর্তৃক পুনঃ পুনঃ গভর্নর পরিবর্তন এবং গভর্নররা খলিফা কর্তৃক প্রত্যক্ষ নির্বাচিত না হওয়ায় খলিফার প্রতি গভর্নরগণ সামান্যই শ্রদ্ধশীল ছিল।

৩। আরব, বার্বার, সিরীয়, এবং নব মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য ও শৃঙ্খলাবোেধ হীনতা, অসন্তোষ ও বিদ্বেষ গৃহযুদ্ধের জন্ম দেয়। অধিকাংশ সময় এই বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় তাঁহারা রাজ্য বিস্তার ও দেশের প্রশাসন কাজে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে পারেন নাই। ৪। দক্ষিণ ফ্রান্সে নিয়োজিত জেনারেলদের কর্তব্যে অবহেলা, যেমন—স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশ গ্রহণের পরিবর্তে নারবোনের কমান্ডার স্থান পরিত্যাগ করেন।

৫। দুর্গম পার্বত্য এলাকা, যেমন— স্পেন হইতে ফ্রান্সকে পৃথককারী গিরিমালাসমূহ। ইহা দুই দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সীমা হিসাবে কাজ করে। সামান্য কয়টি গিরিপথ ব্যতীত এইগুলি বৎসরের অধিকাংশ সময়ই বরফাবৃত থাকিত। মেসেতার উচ্চ মালভূমি সহজে সৈন্য পরিচালনা এবং সড়ক পথে যোগাযোগের জন্য ছিল বিরাট বাধা। সর্বোপরি মধ্যফ্রান্সের আবহাওয়া, ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়ায় অভ্যস্ত বার্বার এবং সিরীয়দের জন্য ছিল সম্পূর্ণ অসহ্য।

৬। গৃহযুদ্ধ নৌবাহিনীর উন্নয়ন সাধন এবং ফ্রান্সের নতুন ভূমি দখলে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে নারবোনের মুসলিম সেনাঘাটি প্রাচ্যের অনুরূপ বসরা, কুফা এবং ফুসতাতের ন্যায় শক্তিশালী হইতে পারে নাই।

৭। কর্ডোভা এবং কায়রোওয়ানই একমাত্র জায়গা যেখান হইতে যুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সে অবস্থিত সৈন্যগণ অতিরিক্ত সৈন্য ও রসদ পাইতে পারিত—কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র হইতে উহা ছিল বহুদূরে অবস্থিত। ফলে অতিরিক্ত সৈন্য ও রসদ সরবরাহে নিরাশ হইয়া

ফ্রান্সের যুদ্ধে মুসলিম সেনাগণ পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। শত্রু সৈন্যদের প্রদত্ত সুযোগে মুসলিম সেনাবাহিনী পশ্চাদপসারণের সুযোগ লাভ করে। অন্যথায় অগণিত সৈন্য নৃশংসভাবে নিহত হইত। এই সমস্ত অসুবিধা, নিজেদের আত্মকলহ ও বিদ্বেষ এবং শৃঙ্খলা বোধহীনতার কারণে মুসলমানরা বহুবার ফ্রান্সে তাহাদের অধিকার ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। তাহারা একমাত্র নারবোনকে২২ অধিকারে রাখিতে পারিত কিন্তু তাহাও প্রথম আবদুর রহমানের সময়ে ফরাসীগণ দখল করিয়া নেয়।

দামেস্ক খিলাফতের অধীনস্থ আমীর শাসন আমলের পর্যালোচনা

এই অধ্যায়ের প্রারম্ভে স্পেনের আমীরদের ক্ষমতা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হইয়াছে। এখানে অধীনস্থ আমীর শাসন আমলের চারিটি প্রধান বিষয়ে পর্যালোচনা করা হইল।

(১) স্বজাতীয়তা বোধ (আসাবিয়াহ) (২) গণ-প্রশাসন (৩) সামরিক ব্যবস্থা বিভাগ এবং (৪) স্পেনীয় সমাজ ব্যবস্থা।

স্বজাতীয়তা বোধ (আসাবিয়াহ): বার্বার গোত্রগুলি অপেক্ষা আরব গোত্রগুলির মধ্যে এই অনুভূতি অধিক প্রবল ছিল। বার্বাররা আরবদের অপেক্ষা অনেকাংশে ঐক্যবদ্ধ ছিল। আরবগণের বিরোধীতা করিবার জন্য বাধ্য হইয়া তাহারা ঐক্যবদ্ধ হইয়াছিল। আরবরা ইসলামের পূর্বে কখনও রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল না। অন্যদিকে ইসলামের পূর্বেই বার্বাররা গ্রীক এবং রোমানদের অধীনে ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। তদুপরি উমাইয়াগণ তাহাদের জাতীয়তা বোধ বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টির মাধ্যমে শাসন করিবার নীতি গ্রহণ করিয়াছিলেন। কারবালা এবং হাররার হৃদয় বিদারক ঘটনার স্মৃতি আরবদের মধ্যে পুনরায় গোত্রীয় চেতনা জাগাইয়া দেয়। স্পেনে আগমনের পর আরবগণ কাইজী, কালবী, ইয়ামানী, মুজারী, ওসাদী নাবাসী অথবা হিজাজী এবং সিরীয় প্রভৃতি দলে বিভক্ত হইয়া পড়ে। গোত্রীয় অনুভূতিই গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণের পিছনে কাজ করে। ফলে আমীরগণ খুব কম সময়ই দেশের উন্নয়নমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করিবার সুযোগ লাভ করে। পরিণামে আন্তগোত্রীয় যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয় এবং অসংখ্য লোক নিহত হয়। আসকীর ইউসুফ বিন আবদুর রহমান তাঁহার দেহরক্ষী হিসাবে নিযুক্ত করিবার জন্য সামান্য পঞ্চাশ জন সৈন্য সংগ্রহ করিতে ব্যর্থ হন। দেশের উত্তর অঞ্চলে বসবাসকারী খ্রীস্টানগণ ইহার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে এবং আস্তুরীয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার বংশধর প্রথম আলফন্সে স্পেনের এক চতুর্থাংশ দখল করে। ইহার ফলে স্পেন মুসলিম ও খ্রীস্টান এই দুই এলাকায় বিভক্ত হইয়া পড়ে। কয়েক শতাব্দী ধরিয়া একে অপরের অংশ দখল করিবার চেষ্টায় রত থাকে। শেষ পর্যন্ত উত্তরের খ্রীস্টান দক্ষিণ অঞ্চলের মুসলিম এলাকা জবর দখল করে।

গণ-প্রশাসন ও উমাইয়া সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রদেশের মত স্পেনের আমীরও ছিলেন সরকারের সামরিক ও বেসামরিক প্রধান। কর আদায় ও শান্তি রক্ষার জন্য দেশকে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগে ভাগ করা হয়। এবং প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পিত ছিল গভর্নরদের উপর। প্রয়োজনের সময় তাহাদিগকে (কেন্দ্র) কর্ডোভা হইতে সৈন্য সরবরাহ করা হইত। স্থানীয় জনসাধারণের মধ্য হইতে কর আদায়কারী নিযুক্ত হইত। তাহারা কমিশনার বলিয়া পরিচিত ছিল। পুলিশ শহরের শান্তি রক্ষা করিত এবং পৌর প্রশাসনের প্রতিও লক্ষ্য রাখিত। বড় শহরে অবস্থিত বিচারালয় ফৌজদারী ও সাধারণ মামলার রায় প্রদান করিত। বড় বড় শহরে খ্রীস্টানদের জন্য নিজস্ব বিচারালয় ছিল। যেখানে তাহাদের নিজস্ব বিচারালয় থাকিত না সেখানে মুসলমান বিচারপতিগণ খ্রীস্টান পাদ্রীদের সহযোগিতায় তাহাদের মামলার ফয়সালা করিতেন। আমীরগণ নিজেরাই বিচার কার্য পরিচালনা করিতেন কিন্তু আপিল আদালত অবস্থিত ছিল কায়রোওয়ানে। আন্দালুসের কর ব্যবস্থাপনা দামেস্কের কর ব্যবস্থার অনুরূপ ছিল। নিম্ন বর্ণিত উৎস হইতে কর সংগ্রহ হইত।

জমির খাজনা (খারাজ), জিজিয়া, বাজেয়াপ্তকৃত সম্পত্তির ফাই, জাকাত, উশর (জমিতে উৎপন্ন দ্রব্যের এক দশমাংশ) উশুর ব্যবসায় সম্পদের দশমাংশ, বন্দর শুল্ক, চার্চে রক্ষিত সম্পদের উপর নির্ধারিত কর। সাফদের ভূমিতে মালিকানা স্বত্ব প্রদত্ত হইয়াছিল। তাহাদের ভূমি চাষাবাদের অনুমতি দেওয়া হইয়াছিল। জমির প্রকারভেদে এক ষষ্ঠাংশ হইতে অর্ধেক পর্যন্ত সরকারি কর বাবদ রাষ্ট্র এবং জায়গীরদারকে দিতে হইত। সামাহ বিন মালিক আল খাওলানীর সহিত যেসব আরব এবং বালজ ইবনে বিশরের সহিত যে সমস্ত সিরীয় স্পেনে আগমন করিয়াছিল তাহাদিগকে দেশের উত্তরাংশে বসতি স্থাপনের জন্য জমি প্রদান করা হইয়াছিল। বাগানে উৎপন্ন দ্রব্যকে কর হইতে রেহাই দেওয়া হইয়াছিল। ধর্মান্তরিত নব মুসলিমদিগকে জিজিয়া প্রদান হইতে অব্যাহতি দান করা হইয়াছিল। কিন্তু তাহাদিগকে জমির খাজনা দিতে হইত। তাহাদিগকে উশর এলাকাভুক্ত জমির উৎপন্ন দ্রব্যের এক দশমাংশ কর দিতে হইত। নারী, শিশু, যাজক এবং অক্ষম ব্যক্তিকে জিজিয়া হইতে মুক্তি দেওয়া হইয়াছিল। ইহুদীরা কর প্রদান করিত। স্পেন বিজয়ের সময় সামরিক সাহায্য ও উপনিবেশ স্থাপনে সহযোগিতার স্বীকৃতি স্বরূপ খুব সম্ভব তাহাদিগকে জিজিয়া থেকে অব্যাহতি দান করা হইয়াছিল। কর রূপে প্রাপ্তসম্পদ কর্ডোভায় বায়তুলমালে জমা হইত। আমীরের কর আদায় করার ক্ষমতা ছিল এবং তাঁহারা আদায়কৃত কর সেনা সংগঠন ও রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যয় করিতেন। আমীরের অনুমোদন ব্যতীত কোন নতুন খাতে বড় অঙ্কের টাকা ডেপুটি গভর্নরগণ ব্যয় করিতে পারিতেন না। মুসা বিন নুসাইর মোটা টাকা স্পেন হইতে দামেস্কে আনেন। কিন্তু তাহার পরে আর কেহই কায়রোওয়ানে নিয়মিত কর প্রেরণ করেন নাই। খালিফা ওমর ইবনে

আবদুল আজিজের আদেশ পাইয়া আমীর সামহ বিন মালিক আল-খাওলানী ইসলামী আদর্শ মোতাবেক কর প্রথা পুনর্বিন্যাস সাধন করেন এবং আদায়কৃত করের কিছু অংশ দামেস্কে প্রেরণ করার জন্য তিনি পৃথক করিয়া রাখিতেন। খলিফার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর উহা উন্নয়নমূলক কর্মে ব্যয় করেন। বাবার বিদ্রোহীকে দমন করিবার জন্য আফ্রিকার গভর্নর জেনারেল উকবা বিন হাজ্জাজ সামুলীকে প্রচুর কর লইয়া আফ্রিকায় আগমনের আহ্বান জানান। দামেস্কে এবং কায়রোওয়ানে উদ্বৃত্ত কর পাঠাইবার নিয়মিত কোন ব্যবস্থা ছিল না। কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। অনাবৃষ্টি এবং দুর্ভিক্ষের বৎসর ভূমির খাজনা আদায় করা হইত না এবং কৃষকদিগকে নগদ ও তাকাভী ঋণ প্রদান করা হইত। নগর ও বন্দরে ব্যবসায়ীদের থাকার জন্য ও বাণিজ্য সামগ্রী বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসংখ্য সরাইখানা নির্মিত হইয়াছিল। গথিক শাসন আমলে যে সমস্ত শিল্প কারখানা বন্ধ হইয়া গিয়াছিল ইহুদীগণ পুনরায় সেগুলি চালু করে।

উদ্বৃত্ত শিল্পসম্ভার ও কৃদ্ৰিব্য রফতানী করা হইত। তৎকালীন স্পেনের বিখ্যাত বন্দর ছিল আলজাসিরা। অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্য সাধারণত আফ্রিকার বন্দর তাঞ্জিয়ারের মাধ্যমে সম্পন্ন হইত।

সেনাবাহিনী সংগঠন

আমীরী শাসন আমলে সাধারণত স্পেনে সেনাবাহিনীর চাহিদা ও প্রয়োজনের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হইত। সেনাবাহিনী গঠিত হইত গোত্রীয় ভিত্তিতে। অশ্বারোহী ও পদাতিক এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল সেনাবাহিনী। আরব, বার্বার এবং পরবর্তীকালে নও-মুসলিমদের সমন্বয়ে এই সেনাবাহিনী গঠিত হইয়াছিল। সেনাবিভাগে তিন জন সেনাপ্রধান থাকিত। পদাতিক বাহিনী প্রধান। (সাহিবুর রেজাল), অশ্বারোহী সেনাপ্রধান (সাহিবুল খারেল) ও পতাকাবাহী (আলম বরদার) সেনাপ্রধান। ইহাদের মধ্যে একজন প্রধান সেনাপতি (সিপাহসালার) ছিলেন, যিনি গোত্রীয় প্রধান অথবা জায়গীরদার অথবা তাহার মনোনীত ব্যক্তি হইতেন।

সম্মিলিত বাহিনীপ্রধান নির্বাচিত হইতেন আমীর স্বয়ং অথবা তাহার মনোনীত ব্যক্তি। সেনাবাহিনীর ছাওনী ও ক্যাম্পে শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি সর্বদা আরব ও বার্বারদের বংশ গৌরবের প্রতি দৃষ্টি রাখিতেন। জেহাদের আদর্শের প্রতি উপেক্ষা এবং গানিমতের প্রতি অত্যধিক লোভ যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের জন্য সময় সময় ক্ষতিকর প্রমাণিত হইয়াছে এবং বিপর্যয় ডাকিয়া আনিয়াছে। বিশেষ করিয়া ফ্রান্সের যুদ্ধের সময় ইহাতে খুবই ক্ষতি সাধিত হয়। কর্ডোভাতে নিয়মিত বেতনভোগী সার্বক্ষণিক সেনাবাহিনী ছিল খুব সামান্য। অনিয়মিত সেনা সেই সময় শুধু গানিমত ও রেশন পাইত। যুদ্ধে সৈন্যদের মৃত্যু হইলে তাহাদের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করিতেন মৃতসেনা যে উপজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেই উপজাতির প্রধান। সীমান্ত প্রদেশের গভর্নরদের সেনাবাহিনী পরিচালনার বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হইত। দূরবর্তী

ফাড়ি ও দুর্গে নিয়মিত সেনাদের শৃঙ্খলাবোধ ও যথাযোগ্য সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হইত।

সমাজ জীবন

মুসলিম-স্পেনের প্রজাকুল ছিলেন অমুসলিম, নব-মুসলিম ও মুসলমানদের সমন্বয়ে গঠিত। ইসলাম রাষ্ট্রীয় ধর্ম হওয়ায় মুসলমানরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করিত। আরব ও বার্বার বিজয়ীরা স্পেনকে তাহাদের নিজস্ব দেশ হিসাবে গড়িয়া তোলে। তাহারা সেখানে বসতি স্থাপন করে, নিজস্ব গ্রাম ও শহরে হাট-বাজার প্রতিষ্ঠা করে, একই গোত্রীয় লোকদের দ্বারা এক একটি গ্রাম অথবা মহল্লা গড়িয়া ওঠে। তাহারা তাহাদের আরব ও সিরিয়ায় অবস্থিত পুরাতন বসতির সহিত মিল রাখিয়া নব প্রতিষ্ঠিত এলাকার নামকরণ করিত। প্রতিটি মসজিদের পার্শ্বে মাদ্রাসা গড়িয়া উঠিয়াছিল এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই সরকারি জমি প্রদান করা হইত। সামাহ বিন মালিক আল খাওলানী তাহার দরবারে উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের (পণ্ডিতকে) আহবান জানান।

ধর্মীয় শিক্ষা চালু ছিল। তথাপি মুসলিম সমাজ বার্বার ও আরবদের সাংস্কৃতিক ধারায় গড়িয়া উঠিয়াছিল। আরব ও বার্বারদের গোত্রীয় প্রীতি এত তীব্র ছিল যে ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষার উপর ভিত্তি করিয়া গড়িয়া ওঠা সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা কল্পনাই করা যাইত না। তাহাদের মধ্যে মতানৈক্য এমন প্রবল ছিল যে, আরব ও বার্বারদের জন্য পৃথক মসজিদ ও মাদ্রাসা ছিল।

আরব ও বার্বারদের মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও তাহারা স্পেনের নব-মুসলমান ইহুদী ও খ্রীস্টানদের সহিত ব্যবহারে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিত। স্পেন বিজয়ে মুসলমানদের সাহায্য ও সহযোগিতা করার প্রতিদান স্বরূপ ইহুদীগণ বিশেষ সুযোেগ ও সুবিধা ভোগ করিত। তাহাদিগকে বিভিন্ন নগরে পুনর্বাসন করা হয় এবং অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। খ্রীস্টানদের মধ্য হইতে যাহারা মুসলিম অভিযানে বাধার সৃষ্টি করে, তাহারা যুদ্ধের সময় ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যাহারা যুদ্ধ চলার সময়ে আত্মসমর্পণ করিত, বিজয়ী মুসলমান ও তাহাদের মধ্যে সুবিধাজনক শর্তে চুক্তি সম্পাদিত হইত। চুক্তিরশর্ত পরবর্তীকালে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত খ্রীস্টানদের নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়। তাহারা ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সম্মানের সহিত জীবন যাপন করিত। সাধারণ মুসলমান তাহাদের সহিত মিলিয়া মিশিয়া জীবন যাপন করিত এবং তাহাদের কন্যাদের সহিত বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হইত। যদিও মুসলমান কন্যাদের সহিত খ্রস্টানদের বিবাহ হইত না। গীর্জাসমূহ পরিচালনার জন্য আইন কানুন রচনা করা হইয়াছিল। স্পেনে চার্চ পরিচালনা পরিষদের প্রধান ছিলেন টলেডোর প্রধান গীর্জার পোপ। গীর্জা পরিচালনা পরিষদকে সভা অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হইত। যদিও ধর্ম প্রচারের সুযোেগ হইতে তাহাদিগকে বঞ্চিত করা হইয়াছিল। মুসলমানদের সহিষ্ণুতার

দরুন গৃহযুদ্ধের সময়ও খ্রীস্টানগণ নিরাপদে ছিল। কিন্তু খ্রীস্টানরা মুসলমানদের এই সহিষ্ণুতার সুযোগ গ্রহণ করিয়া সংঘবদ্ধ হয় এবং দেশের উত্তরাংশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিয়া ইহাকে উত্তর-পূর্বে মুসলিম বিজিত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত করে।

ইসলামী রাষ্ট্রে নব মুসলিমগণ যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করিবার আশা করিয়াছিল উহা হইতে তাহারা বঞ্চিত হয়। সামাজিক ন্যায় বিচার হইতে আরব ও বার্বারগণ তাহাদিগকে বঞ্চিত করে। ইসলামের প্রতি নব মুসলমানদের আনুগত্যকে সন্দেহের চোখে দেখা হইত। গথশাসন আমলে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ স্পেনীয়দের দাস ও দাসপুত্র বলিয়া ঘূণা করা হইত। পরবর্তীকালে অন্যান্য নব মুসলমানদিগকেও এই নামে অভিহিত করা হয়। আরব ও বার্বারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে তাহাদের এই অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নব মুসলিমগণ বিজয়ী মুসলমানগণের জাতীয়তা বোধ (আসাবিয়াহ) এবং ইসলামী আদর্শের ও শিক্ষার অভাবে গভর্নর শাসন আমলে ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক জীবনে উহা ব্যবহারের খুব কম সময় ও সুযোগ পায়। সরকার কর্তৃক অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া যায়। সেভিল ও অন্যান্য শহরে সরকারী সাহায্যে তাহাদের জন্য মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মিত হয়। ব্যবসা, কৃষি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। তাহারা ক্ষেত খামারে কৃষক ও শিল্পকারখানায় শ্রমিকের ন্যায় কাজ করিত। কিন্তু তাহাদিগকে পদস্থ সরকারী পদে নিয়োগ করা হইত না। স্বৈরতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারের সেই যুগে ইহা কেহ আশাও করিতে পারেনা। বিশেষ করিয়া স্পেনের শাসন ব্যবস্থায় যখন সামরিক ও গোত্রীয় শক্তির প্রভাব ছিল প্রবল। এমন কি এই সময় স্পেন বিজয়ে আরবদের সহিত অংশ গ্রহণকারী বার্বারগণ পর্যন্ত আরবদের সমান অধিকার ভোগ করিতে পারিত না। তাহাদের সমধর্মাবলম্বী গথ শাসনামল অপেক্ষা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর নিঃসন্দেহে তাহাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। একের পর এক দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি, বিভিন্ন বিদ্রোহে ইন্ধন যোগায় এবং উপর্যুপরি খ্রীস্টান আক্রমণ পরিবর্তন আকাক্ষী জনগণের মধ্যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করে। বার্বার ও নবমুসলিমগণ আরব শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া পুরাতন প্রভুর স্থলে নতুন প্রভুকে স্বাগতম জানায়। স্পেনের উমাইয়া মাওয়ালী ও স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ক্রীতদাসগণ ছিল আবদুর রহমানের সমর্থক। সর্বোপরি আবদুর রহমান নিজে ছিলেন একজন সুযোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি জানিতেন কিরূপে সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতে হয়। ইউসুফ স্পেনের শাসনকর্তা হইলেও প্রকৃতপক্ষে দেশ শাসন করিতেন সুমাইল। ৭৫৫ খ্রীস্টাব্দের শেষ পর্যায়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সহিত সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং এই সম্পর্ক এমন স্তরে পৌছে যে আফ্রিকা হইতে আবদুর রহমানকে আহবানের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি অবহিত থাকা সত্ত্বেও ইউসুফের নিকট উহা গোপন রাখেন। যাহার ফলে ইউসুফের পতন ঘটে।

তথ্য নির্দেশ

১। আল মাক্কারী, নাফলুল-তিব, ভল্যুম ১, পৃঃ ১৩২। ২। দ্যা তারিখ-ই-আন্দালুস ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৩৬-৩৭।

ইবনুল আছির, ভম ৫, পৃঃ ১৪। ৪। প্রথমে ইহার এলাকা ছিল ১৫ বর্গ মাইল, আখবার আল-আন্দালুস, (স্কটল্যান্ডের ইতিহাস, উর্দু

তর্জমা), ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৪৫; স্কট, হিস্ট্রি অব দ্যা মুরিশ ইম্পায়ার ইন ইউরোপ, ফিলাডেলফিয়া

১৯০৪, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৫০-৫১; আল-মাক্কারী, নাফলুল-তিব’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫১২। ৫। রিয়াসত আলী, দ্যা তারিখ-ই-আন্দালুস, ১ম খণ্ড পৃঃ ১৫৬।

ইয়াহিয়া বিন আলকামাক কাল্পী সেথমাউন আবী নিসাব খাতমি, হুদায়ফা বিন আহওয়াজ কাইসি, হাইথাম বিন জিকাইদ কাকী এবং মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আসজিম’। রিয়াসত আলী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৩। দ্যা ইসলামিক রিভিউ, লন্ডন, জুন ১৯৫৮, পৃঃ ১৭-১৮।

হিট্টি, হিস্ট্রি অব দ্যা আরবস, লন্ডন ১৯৫১, পৃঃ ৫০১ ও টীকা-৩। ১০। পারেজা, ফিলিক্স এম. ইসলামোলোজিয়া, তমো-প্রথম, মাদ্রিদ, ১৯৫২-১৯৫৪, পৃঃ ১৬৩ দ্রষ্টব্য। ১১। রিয়াসত আলী, দ্যা তারিখ-ই আন্দালুস ১ম খণ্ড পৃঃ ১৮১। ১২। আমীর আলী, এ শর্ট-হিস্ট্রি অব দ্যা স্যারাসিস, পৃঃ ৯৮-৯৯ দ্রষ্টব্য। ১৩। ইবন ইজারী, বেয়ান, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯। তিনি ছিলেন বার্সিলোনার নিয়মিত ডেপুটি গভর্নর এবং

তিনি ন্যারভোনের যুদ্ধে স্বীয় যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। ১৪। ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ১৪৩; রিয়াসত আলী, তারিখ-ই-আন্দালুস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৮১। ১৫। ডজি, স্পেনিশ ইসলাম, পৃঃ ১৪৪। ১৬। ইবন ইজারী, বেয়ান, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৩-৩৪, ৪৮-৪৯ দেখুন। ১৭। ইবনুল আছির, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ২৮৬-৮৭; আখবার মাজমুয়া, পৃঃ ৫৭। ১৮। রিয়াসত আলী, দ্যা তারিখ-ই-আন্দালুস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২১১। ১৯। ডজি, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১০। ২০। রিয়াসত আলী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১১। ২১। ডজি, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৮-৬০। ২২। শেরওয়ানী হারুন খান, মুসলিম কলোনিজ ইন ফ্রান্স, নর্দান ইটালী এ্যান্ড সুইজারল্যান্ড, লাহোর, ১৯৬৪ পৃঃ ১২৯-১৭৯।

সকল অধ্যায়

১. উপক্রমণিকা (মুসলিম স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাস)
২. প্রথম অধ্যায় : মুসলমানদের স্পেন বিজয়
৩. দ্বিতীয় অধ্যায় : দামেস্ক-খেলাফতের অধীন উমাইয়া আমীরদের শাসন
৪. তৃতীয় অধ্যায় : স্বাধীন উমাইয়া আমীরদের রাজত্ব
৫. চতুর্থ অধ্যায় : প্রথম হিশাম
৬. পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম হাকাম
৭. ষষ্ঠ অধ্যায় : দ্বিতীয় আবদুর রহমান
৮. সপ্তম অধ্যায় : প্রথম মুহাম্মদ
৯. অষ্টম অধ্যায় : মুনজির ও আবদুল্লাহ
১০. নবম অধ্যায় : উমাইয়া খিলাফত
১১. দশম অধ্যায় : দ্বিতীয় হাকাম
১২. একাদশ অধ্যায় : হাজীব আল-মনসুর
১৩. দ্বাদশ অধ্যায় : স্পেনে উমাইয়া খিলাফতের পতন
১৪. ত্রয়োদশ অধ্যায় : স্পেনের উত্তরাঞ্চলে খ্রীস্টান রাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয়
১৫. চতুর্দশ অধ্যায় : প্রথম পর্যায় ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহ
১৬. পঞ্চদশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পর্যায় – উত্তর আফ্রিকার শাসন
১৭. ষষ্ঠদশ অধ্যায় : তৃতীয় পর্যায়ঃ নাসরী রাজবংশ
১৮. সপ্তদশ অধ্যায় : মরিস্ক জাতি
১৯. অষ্টাদশ অধ্যায় : স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের কারণসমূহ
২০. উনবিংশ অধ্যায় : শাসনকার্য ও প্রশাসন
২১. পরিশিষ্ট-ক : ইক্রিতিশে কর্ডোভান মুসলমানদের শাসন
২২. পরিশিষ্ট-খ : স্পেনে মুসলিম শাসকদের বংশানুক্রমিক তালিকা
২৩. পরিশিষ্ট-গ : উত্তর-স্পেনে খ্রিষ্টান শাসকদের কালানুক্রমিক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন