আশাপূর্ণা দেবী
ভাতে বসতে তো কিছু দেরী রয়েছে, একটু চা চলবে চন্দর?
বন্ধুর প্রশ্নে চকিত হন চন্দ্রকান্ত, চা?
কী হে, জিনিসটার নামই ভুলে গেছ নাকি?
গৌরমোহনের কণ্ঠ কুণ্ঠিত, চোখ হাস্যোজ্জ্বল। আমার তো ভাই কলকাতায় থাকতে থাকতে ওই বদভ্যাসটি পাকা হয়ে গেছে। শুধু আমরাই বা বলি কেন, গিন্নীটিও ওই পাপে পাপী। ছেলেমেয়েগুলোকে অভ্যাস করাতে বারণ করি, তাও মাতৃস্নেহের বশে একটু আধটু পেসাদ চলে। যাই হোক, সরঞ্জাম সব আনা হয়েছে, খাবে তো বল, গিন্নীকে অর্ডার দিয়ে আসি।
চন্দ্রকান্ত একটু হেসে বলেন, না ভাই। অভ্যাস নেই, হয়তো রাতে ঘুম হবে না।
না হলে জেগে জেগে কবিতা রচনা করবে। গৌরমোহন হাসেন, তোমার খাতিরে আমারও একটু প্রাপ্তি ঘটতো।…যাক। তোমার মনে আছে চন্দর, আমাদের সেই প্রথম চা খাওয়ার ইতিহাস? দ্বিজেন আমাদের ধরে নিয়ে গেল, মেছোবাজারে না মুক্তারামবাবুর গলিতে, ঠিক মনে পড়ছে না—ওর এক মাসতুতো দাদার বাড়ি।…বলল তোদের আজ আমার বৌদির হাতের চা খাওয়াবো। আমাদের সে কী ভয়, যেন নিষিদ্ধ কোন নেশার পাত্র হাতে নিয়ে বসেছি। বুকটুক বেশ ধড়ফড় করেছিল। তুমি ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলে, মানুষ যে কী করে প্রথম মদ খায়? চায়েই তো হৃৎকম্প হচ্ছিল। অথচ কলেজের ছাত্ররা তখন ‘দোহাতা মদ’ খেতো।
চন্দ্রকান্ত বলেন, তুমি বললে বলেই মনে পড়ল।
তারপর তো বেশ চালানো গেল কিছুদিন, একটা চায়ের দোকানও আবিষ্কার হল।…গৌরমোহন হেসে ফেলে বলেন, আমি তো ভাই তদবধিই চা—খোর। তুমি দেশে এসে পুরনো ধাঁচেই রয়ে গেলে। অবিশ্যি ভালই করেছ, নির্জনে বসে বসে জ্ঞান—চর্চা করে চলেছ।
চন্দ্রকান্ত অন্যমনস্কভাবে বলেন, জ্ঞানচর্চা করছি কি অজ্ঞানচর্চা করছি জানি না ভাই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি তোমার মত কলকাতায় গিয়ে বসবাস করবার সুযোগ পেতাম, হয়তো জীবনের চেহারা অন্যরকম হতো।
সে তো হতোই—
গৌরমোহন বলেন, আমার তো হল পাকেচক্রে—মা গেলেন, জেঠিমা গেলেন, বৌকে একা রেখে যাই কী করে! অথচ এতো দূর থেকে রোজ অফিস যাওয়া—আসাও পোষাল না—মাঝেমাঝে এখানে আকাশ বাতাসের জন্য মন কেমন করে, প্রাণ হাঁপায়, তবে ওখানের সুখ—সুবিধে আরাম আয়েস ভেবে আর।—আমি বলি, রিটায়ার করার পর দেশের বাড়িতে এসে থাকব। বৌ বলে অসম্ভব।
চন্দ্রকান্ত বলেন, না আসাই বোধ হয় ভাল গৌরমোহন। এখানে আকাশ—বাতাস খোলা, কিন্তু মানুষগুলো বদ্ধ জলার মত। জীবনের কোন পরিবর্তন নেই। কূপমণ্ডুকের মত যে যেমন ছিল, সে সেখানেই বসে আছে। পঞ্চাশ বছরেও একতিল নড়চড় নেই। কলকাতার জীবনে প্রবাহ আছে, তরঙ্গ আছে, স্রোত আছে, ভাঙ্গন আছে।
চন্দ্রকান্তর এই গভীর আর বিষণ্ণ কণ্ঠের প্রভাবে আবহাওয়াটা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।
যদিও বাতাস আসছে এলোমেলো, দুপুরের গরম হলেও বৈশাখের বাতাসে মাদকতা আছে। জানলা দিয়ে একটা তেঁতুল গাছ চোখে পড়ছে, তার পাতাদের অবিরাম ঝিলিমিলি যেন হঠাৎ সমুদ্রের অবিরাম ঢেউয়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
বিশ্বপ্রকৃতির এই অকৃপণ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে বাস করেও মনুষ্য—প্রকৃতিতে সৌন্দর্যের এমন ঘাটতি কেন এখানে!
চন্দর, তোমার লেখাগুলি আনলে না?
পাগল।
কেন ভাই, আমি তো দেখি খুবই তারিফের যোগ্য। বিশেষ করে দেশাত্মবোধকগুলি—
নাঃ ভাই, ওসব ছেলেমানুষী লাগে এখন। ভাবছি—
কী ভাবছেন, বন্ধুর কাছে আস্তে আস্তে ব্যক্ত করেন চন্দ্রকান্ত। সমাজের চেহারা কেমন হলে ভাল হয়, তাই নিয়ে কল্পনা। সেই কল্পনার গাছে ফসল ফলাবার সাধ।
গৌরমোহন উৎসাহ দেন। বলেন, জিনিসটা একটা কিছু নতুন হবে। অতীতকে নিয়েই সবাই লেখে, কেউবা বর্তমানকে নিয়ে, কিন্তু ভবিষ্যৎকালকে নিয়ে! না, তোমার চিন্তাটা বেশ মৌলিক। মনে হচ্ছে—একদা এক গুপ্ত—কবি মেয়েদের লেখাপড়া শেখা নিয়ে যে ভবিষ্যৎ ছবি এঁকে টিটকিরি দিয়েছিলেন, আর এক গুপ্ত—কবি তার উচিত জবাব দিয়ে যাবে। কিন্তু ভাই—একবার কলকাতা গিয়ে কিছুদিন থাকা দরকার তোমার। সমাজ যে এখন বর্তমানে ঠিক কোথায় পৌঁছেছে, সে তুমি এখানে বসে বুঝতে পারবে না। তুলনা করলে—বহু বিষয়ে বাংলার এই গ্রামগুলো কলকাতার থেকে একশো বছর পিছিয়ে আছে। তবে? দুটো মিলিয়ে না দেখলে?
চন্দ্রকান্ত আস্তে বললেন, ভাবছি তাই যাব। তুমি আমার জন্যে একটা ছোট্ট বাসা দেখো।
কেন, আমার বাসায় থাকা চলবে না?
চন্দ্রকান্ত হাসেন, চলবে না কেন? তবে একা না থাকলে চোখ কান ঠিক সজাগ থাকে না।
গৌরমোহন ওই ‘একা’ শব্দটা ঠিক অনুধাবন করতে পারেন না, একা মানে কি যৌথ পরিবার থেকে সরে গিয়ে একা সংসার পাতা! বলেন, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে?
সর্বনাশ। নতুন করে আবার শব্দ তত্ত্ব পড়ো গৌরমোহন! ‘একা’ মানে কি সঙ্গে স্ত্রী?
বাঃ, তাহলে তোমার রান্নাটান্নার কী হবে? বন্ধুর বাড়ীতে যখন থাকছো না—
সেটা কোন চিন্তার বিষয়ই নয়। স্বপাকে সেরে নেওয়া যাবে।
গৌরমোহন মাথা নাড়েন, ওকথা বামুনের ছেলের মুখে সাজে চন্দর। বদ্যির ছেলের মুখে নয়।
তার মানে?
মানে এই, বদ্যির ছেলেদের অন্য অনেক ক্ষমতা থাকলেও রেঁধে খাবার ক্ষমতা নেই—এ আমার নিশ্চিত ধারণা। বদ্যির ছেলেরা এক গেলাস জল ঢেলে খেতেও পটুত্ব দেখাতে পারবে না।
অদ্ভুত কথা বলছ—
আরে বাবা, দেখে শুনে জেনেই বলছি। দেখলাম তো ঢের।
আচ্ছা দেখা যাক। বলেন চন্দ্রকান্ত। বলেন বটে—কিন্তু গৌরমোহনের নিশ্চিত ধারণার বিরুদ্ধে জোরালো তর্ক করতেও পেরে ওঠেন না। খুব বেশী তো আস্থা খুঁজে পাচ্ছেন না নিজের মধ্যে। তবু ওই তুচ্ছ সমস্যাটাকে প্রাধান্যও দিলেন না। বললেন, সে দেখা যাবে।
আমার কি মনে হচ্ছে জানো চন্দর—
কী?
মনে হচ্ছে, তুমি যদি সে সময় মনস্থির করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করতে তোমার মনের উপযুক্ত ক্ষেত্র পেতে। চিন্তার বিস্তারের জায়গা পেতে। কু—সংস্কারমুক্ত একটা ধর্মেরই দরকার ছিল তোমার।
উঁহু—
চন্দ্রকান্ত বাধা দিলেন। ওটা ঠিক বললে না—ওঁরা যে ‘কুসংস্কারমুক্ত’ আমি অন্ততঃ বলতে পারব না। মন আমি স্থির করে ফেলেছিলাম গৌরমোহন, যখন উদ্যত হয়েছিলাম। কিন্তু ফিরে এলাম কেন জানো? ওই কুসংস্কারে ঠেক খেয়েই।
কুসংস্কার! বল কী! কী দেখেছিলে বলতো?
দেখো গৌরমোহন, বলতে গেলে অনেক কথা। এতো দিন পরে আর কী বলব! তবে হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু সমাজের প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞা রীতিমত কুসংস্কারের মতই ওঁদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এ আমি প্রতিপদে লক্ষ্য করেছি ভাই। তার সঙ্গে শুচিবাই—
নাঃ। তুমি তো আমায় তাজ্জব করে দিচ্ছ চন্দর। আবার শুচিবাইও?
দেখো গৌরমোহন, শুধু দশবার পুকুরে ডুব দেওয়া অথবা, ছোঁওয়া—ছুঁৎই শুচিবাইয়ের একমাত্র লক্ষণ নয়। যে কোন ব্যাপারে অতিরিক্ত গোঁড়ামিকেই আমি শুচিবাই বলব!…আমি তখন ওই নবধর্মে আকৃষ্ট হয়ে যাঁর কাছে যাওয়া আসা করতাম, সেই যতীনবাবুর মধ্যে প্রকৃত ব্রহ্মের আদর্শ সম্বন্ধে যা গোঁড়ামি দেখতাম, তা আমার কাছে ‘শুচিবাই’ বলেই মনে হতো।… অবশেষে একদিন শুনতে পেলাম, কোন একটি ছোট ছেলেকে তিরস্কার করা হচ্ছে—তুই যে দেখছি হিন্দুবাড়ির ছেলেদের মত অসভ্য অবাধ্য হয়ে উঠছিস, সেদিনই নিজেকে নিবৃত্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম!…
চন্দ্রকান্ত হাসলেন, হয়তো এমন কিছুই নয়, আবার অনেকও।
কই সেদিন তো একথা বলনি। শুধু বলেছিলেন মনঃস্থির করতে পারছো না—
কথা তো তাই—ই গৌর!…তবে হ্যাঁ, ওদের কিছু আচার্যের মধ্যে যে উদার চিন্তা, যে গভীর ঈশ্বর উপলব্ধির এবং যে প্রশান্তি দেখেছি, তা আমায় যথেষ্ট মুগ্ধ করেছিল।…তাছাড়া মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। তবে ওই যা বললাম—মনে হল, এ সর্বসাধারণের জন্যে নয়।
গৌরমোহন আস্তে বলেন, আমাদেরও তো ওই ধরনেরই চিন্তাভাবনা ছিল। তুমি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলে। তাই বলছিলাম—
হয়েছিলাম গৌরমোহন, অস্বীকার করবো না। কিন্তু কাছে এসে সেখানে সেই গভীরতার স্পর্শ পেলাম না। আমার মনে হয়, যে ধর্মমত অপর ধর্মমতকে নীচু চোখে দেখে, তার মধ্যে প্রকৃত মনুষ্যত্ব বিকাশের উপাদানের অভাব।…আসলে—কোন ধর্মমত বা রাজনৈতিক মতবাদের উপর ভিৎ গেড়ে পূর্ণ মনুষ্যত্ব সম্ভব নয়। তোমার কী মনে হয়?
গৌরমোহন আস্তে আস্তে বলেন, আমরা ভাই আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজ রাখি না। বামুনের ছেলে, একদা গলায় একগাছা পৈতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটাকেই আঁকড়ে আছি। আর সেটা ধরে দু বেলা গায়ত্রীটা করি—এই পর্যন্ত।…তাছাড়া অফিস যাই, বাজার করি, ছেলেদের পড়াই, ঠেঙাই, গিন্নীর সঙ্গে কখনো রসালাপ কখনো কষালাপ চালাই। বলতে বাধা নেই—মাছ মাংস ডিম পিঁয়াজ সবই খাই, আর চেষ্টা করি কখনো যেন কোনো অকাজ কুকাজে মন না যায়। ব্যাস।
চন্দ্রকান্ত বন্ধুর হাতের উপর একটা হাত রেখে একটু আবেগ ভরে তাতে চাপ দিয়ে গাঢ়স্বরে বলেন, তুমিই প্রকৃত সুখী গৌরমোহন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন