সূর্যোদয় – ৮

আশাপূর্ণা দেবী

আট

কিন্তু এতো কাণ্ড হয়ে গেল, নাটকের মূল নায়ক কোথায়? শশীকান্ত? সে তো ইস্কুলেও যায় না, অফিস কাছারিতেও যায় না, দিবানিদ্রাটি তো ভালই করে।

সেজগিন্নীর এলাকা হচ্ছে নীচের তলাতেই, একেবারে একটেরে…সাবেকী বাড়ির ন্যায্য ভাগ। দোতলাটা—চন্দ্রকান্তর বাবা কবিরাজ মশাই বানিয়েছিলেন, সেটার সবটাই চন্দ্রকান্তর। ব্যাপারটা স্বার্থপরের মত দেখতে লাগে বলে সুনয়নী বড়জেঠির সংসারের খানিকটাকে দোতলায় ডেকে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, কিন্তু ভিন্নর পর আর তো সে পদ্ধতি চলল না? ছোট খুড়ির এলাকায় ছোটখুড়ি। বাকী শুধু ভবতারিণী।

তিনি তাঁর ঠাকুর দেবতাকে একতলায় ফেলে রেখে নিজে ঠাকুরদের শিরোধার্য হয়ে থাকতে রাজী হলেন না।

অতএব একা সুনয়নী।

প্রকাণ্ড দালানটা হাঁ হাঁ করে, সারি সারি ঘর শেকল বন্ধ পড়ে থাকে। সাধে আর ছেলের বিয়ে দেবার বাসনা জেগেছে? কিন্তু ওই চিরনিষ্ঠুর মানুষটি কি কখনো সুনয়নীর ভিতরটার দিয়ে তাকিয়ে দেখেন?

তবু মনের মধ্যে কথার ঢেউ উঠলে আর কার কাছে মুখ খুলবেন?

কাকে বলবেন—যে যতই চাপুক, আমি বাবা বুঝেছি ব্যাপারটা কী!…ডুবে মরতেই গিয়েছিল নতুন বৌ, মরল না তো, এখন বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলছে। না হলে রোজ নতুন ঠাকুর পো ঘরে দোর দিয়ে সারা দুকুর ঘুমোয়, আর আজকেই হাওয়া?…প্রেথমে তো সবাই ভেবেছিল, যেমন ঘুমোয় ঘুমোচ্ছে।…পিসিমা যখন বললেন, শশীকে ডেকে তুললো না কেন সেজবৌ? তখনও সেজখুড়ি বললেন, মরেতো আর যায়নি বৌ, একটু জলও গেলেনি। শুধু কেলেঙ্কারি। এ দেকতে আবার ব্যাটাছেলেকে ডাকবো কী?… ওমা তাপর কিনা দেখা গেল ঘরেই নেই।…কখন থেকে নেই সেজখুড়ি পর্যন্ত জানেন না।…বুঝতে পারছো ভেতরে গোলমাল?…নতুন বৌয়ের গায়ের গহনা দুটোও তো ভূতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতন।… ভয়ে তো তোমার কাছে সব কথা প্রকাশ করি না। কে প্রকাশ করেছে টের পেলে সেজখুড়ি কি আস্ত রাখবেন? ছেলের অনেক গুণ। নির্ঘাৎ গহনা নতুন ঠাকুরপোই সরিয়েছে। বৌ রাগ করে—

ঝাঁটা চালাতে চালাতে অনর্গল কথাগুলো মনে মনে আউড়ে যান সুনয়নী। এটা তাঁর বরাবরের মুদ্রাদোষ।

বৌঠাকরুণ যে রাগ করে ডুবে মরতে গিয়েছিলেন, তা হল খালি ধাষ্টামো! রাম বোকা তো! আত্মঘাতী হতে গেলেও বুদ্ধির দরকার।…নতুন—বৌয়ের যা বুদ্ধি, গলায় দড়ি দিতে গেলেও হয়তো এমন দড়ি বাঁধতো যে দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যেত।…সুনয়নীর এক মাসির বড়জা—নাকি মরবার জন্যে কলকে ফুলের ফল বেটে খেয়ে পাগল হয়ে বসে আছে। যতটি খেলে মরে ততোটি খায়নি।

আমি যদি কখনো ডুবে মরতে যাই বাবা, কখনো দিন—দুপুরে নয়। সন্ধের অন্ধকার হয়ে এলে ঘাট যখন শূন্য হয়ে যায়, তখনই হচ্ছে ডুবে মরবার যুগ্যি সময়।….তাও বাবা যদি মরি তো গলায় কলসী বেঁধে কলসীর মধ্যে পাথর পুরে।

হঠাৎ মনে মনে হেসে ওঠেন সুনয়নী, আ আমার মরণদশা। মরতে গেলে কেমন বুদ্ধি খাটাবো, এমন অনাছিষ্টি কথা ভেবে মরছি কেন?…অবিশ্যি মাঝে মাঝে ওই মানুষটির ওপর রাগে অভিমানে মরতে ইচ্ছে যায়। কিন্তু তাতে ওনার এতোটুকু লোকসান হবে? জব্দ হওয়া তো দূরে থাক, হয়তো টেরও পাবেন না।…তবে শুধু শুধু নীলেটাকে মা—হারা করে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাই কেন?

কিন্তু দোতলায় কি তিনি আসবেন না আজ জামা—কাপড় ছাড়তে? কই পাত্তা নেই কেন? …পিসির কাছে আদ্যোপান্ত শুনছেন বোধহয়।

আরো কত শুনতে হবে। আছেন তো কতজনা।

সাড়া—শব্দ আর পাচ্ছিনে। ওনাকে দেখে ঠাণ্ডা মেরে গেছে সবাই মনে হচ্ছে।…এতোক্ষণ তো যাত্রাথিয়েটারের মহল্লা চলছিল।

অস্থির সুনয়নী যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে যাচ্ছেন তখন দেখতে পেলেন চন্দ্রকান্ত আসছেন। তার মানে সব শুনেটুনে। যাক, যা শুনেছেন তা—তো ভূয়ো।

প্রকৃত কথাটি কোন দিক থেকে শুরু করবেন মনে মনে গাঁথতে থাকেন সুনয়নী।…

সুনয়নী কি জানেন, তিনি নাটকের যে দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে এসেছেন, সে দৃশ্যে যবনিকাপাত হয়ে গেছে?

বাবা আসছেন বলে নীলকান্ত চলে এসেছে, পিছনে পিছনে সুনয়নীও। সঙ্গে সঙ্গে যেন ভোজবাজির মত মুহূর্তে মঞ্চের সমস্ত কুশীলব অন্তর্হিত। শূন্য মঞ্চে আসন্ন সন্ধ্যার স্তব্ধ শান্তি।…কিছুক্ষণ পরে আবার শব্দ উঠবে। শঙ্খধ্বনির।

বহিরাগতরা চটপট বিদায় নিলেন উঠোনের দরজা দিয়ে। ছোটগিন্নী তাড়াতাড়ি কাপড় কাচতে চলে গেলেন টেঁপির মাকে সঙ্গে নিয়ে। যদিও মৃত্যু ঘটেনি, তবু যেন পুকুরঘাটের দিকে ভূতের আতঙ্ক।

এদিকে নিবারণী অশ্রুমতীকে প্রায় মাদুরসুদ্ধু হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলেছেন এবং নিজেও ঘরেই রয়ে গেছেন।

কেবলমাত্র ভবতারিণীই নির্বিকার। তিনি যথারীতি ঠাকুর ঘরের দরজার পাশে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছেন।…

সন্ধে দেওয়া আর শাঁক বাজানো দুটি কাজ ছোটগিন্নী ননীবালার। ঘাট থেকে এসেই নিজ কর্তব্য করবেন।

চন্দ্রকান্তর বারবাড়ি থেকে ভিতর বাড়িতে আসতেই এতো কাণ্ড হয়ে গেল, অতএব চন্দ্রকান্ত কোনো ব্যতিক্রম দেখতে পেলেন না।

ওঁকে ঢুকতে দেখেই ভবতারিণী বলে উঠলেন, কী—রে চন্দোর, খুব নেমন্তন্ন খেলি দেখছি। …দুপুরের ভোজে বিকেল গড়িয়ে গেল। তা কী রেঁধেছিল গৌরের বৌ, বল?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন