আশাপূর্ণা দেবী
একখানা ময়লা গামছা কোমরে জড়িয়ে আর একখানা ময়লা গামছায় গা মাথা রগড়ে মুছতে মুছতে শশীকান্ত চাপা আক্রোশের গলায় বলে ওঠে, এই তুমি। তুমিই হচ্ছো যত নষ্টের গোড়া।
নিবারণী দেবী, যিনি নাকি চন্দ্রকান্তর সেজ খুড়ি, মিনমিনে গলায় বলেন, কেন? আমি আবার তোর কী পাকাধানে মই দিলাম?
দিলে না! দিলেই তো? রাতদিনই দিচ্ছো। শশী, বাবা, রাতে যা করিস তা করিস, ভোরে খিড়কির থেকে একটা ডুব দে তবে ঘরে আসিস—
মায়ের বাকভঙ্গীর অনুকরণ করে ভেঙিয়ে উঠে কথা শেষ করে শশীকান্ত—জগৎ সংসারে সবাই জানে, বেটাছেলে আড়াই পা বাড়ালে শুদ্ধ, উনি শুচিবাই বুড়ি এলেন নতুনশাস্তর নিয়ে। ঘাট থেকে ডুব দিয়ে আসতে গেলে লোকের চোখ বাঁচাতে পারবে তুমি? হয়ে গেল আজ মোক্ষম। একেবারে যমের মুখোমুখি।
কথার মাঝখানে শশীর বৌ অশ্রুমতী গলা অব্দি ঘোমটায় ঢেকে নিঃশব্দে একখানা জলকাচা ধুতি এনে শশীর কাছ বরাবর মাটিতে নামিয়ে রেখে গেল। নিবারণী তার দিকে একটা তিক্ত দৃষ্টি হেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠেন, আর এই এক হয়েছে জন্মরুগ্নী। তুলে ধরতে উলে যাচ্ছেন। জগতের কোনো কম্মে যদি লাগে।
বল, তবু বল একবার শুনি—
শশী দুখানা গামছাই দেয়ালে পোঁতা দুটো পেরেকে আটকে আটকে ঝুলিয়ে দিয়ে মুখটা বাঁকিয়ে বলে, ইহ—সংসারে নেয্য কথা তো বড় শুনতে পাইনে। কোন চুলো থেকে যে একখানি রঙের রাধা নিয়ে এনে সংসারে ভর্তি করেছিলে!
নিবারণী ক্রোধের গলায় বলেন, আমি এনেছিলাম খুঁজে পেতে? তোর বড়দা তখন বড্ড হিতুষী মুরুব্বী হয়ে নিজের শালী ঝিকে এনে বিয়ে দেওয়ালো না? মেয়ে যে রাঙের রাধা সে কথা ওর জানা ছেল না? আমি যাই ভাল মানুষের মেয়ে তাই ওই রুগনী মরুনীকে নিয়ে ঘর করছি; অন্য মা হলে ওই নলতে সলতে বৌকে নিব্বাসন দিয়ে ছেলের আবার বিয়ে দিতো।… গলাটা বেশ চোস্ত করেই বলেন নিবারণী, যাতে শুধু বৌ—ই নয়, বাড়ির অন্যেরাও শুনতে পায়। আবার অদূরে কার পায়ের শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখে আঁচল চাপা দেন। তা আমার আবার অঙ্খার। আজন্ম পরের গলে গেরো হয়ে পড়ে আচি, বাপের কুলে পয্যন্ত একটা মশামাছি অব্দি নেই। কোন মুকে বলবো, ওগো, এই আমার ইচ্ছে, এই আমার সাধ—
থাক থাক—আর ঘ্যান ঘ্যান করতে হবে না। শশীকান্ত একটা জলচৌকী টেনে নিয়ে বসে পড়ে বলে, কিছু গিলতে টিলতে পাওয়া যাবে? না হরিমটর?
নিবারণীর হাতে একটা গোবরজল গোলা ঘটি, থানের খুঁটেয় এতোগুলি ঘুঁটের বুচি, নিবারণী ওই গোবরগোলা জল একটু দালানে ছিটিয়ে দিয়ে হাত বুলিয়ে মুছে নিয়ে হাঁক পাড়েন, কই গো নবাবকন্যে, হতভাগা গরীবটার ভাগ্যে কিচু জুটবে, কি জুটবে নি?
অশ্রুমতীর হৃৎস্পন্দন স্থির হয়ে আসে।
কিন্তু অশ্রুমতী কী করবে?
সে কি ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে কলসী—হাঁড়ি নেড়ে মুড়ি নারু ঢেলে নিয়ে আসবে? উঠোনের মাচার গাছে তো অগুনতি শশা ঝুলছে। মুড়ির সঙ্গে নারকেল কি শশা না হলে শশীকান্ত রেগে আগুন হয়, কিন্তু অশ্রুমতী কি নিজের বরের জন্যে গাছ থেকে শশা ছিঁড়ে নিয়ে এসে ছাড়াতে বসবে?…
আরো পাঁচজন খেতে জুটলে তবু হাত পা বার করা যায়, এ যে বেঁধে মারা। জলখাবারের পত্তন পড়তে এখনো দেরী আছে, শশীকান্তের যদি মাথায় জল দেওয়ার কারণে পেটে আগুন জ্বলে ওঠে, তার জন্যে তো গেরস্ত প্রস্তুত নেই।
অশ্রুমতী অশ্রুধারায় ঝাপসা চোখে ভাবে—শাশুড়ী তো জানেন সবই, তবু ছেলের সামনে বৌকে দোষী করছেন কেন? এসে না হয় দেখে যান অশ্রুমতীর অবস্থাটা কী? স্রেফ ভিখারিনীর মূর্তিতে তো ভাঁড়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে ভিক্ষাপাত্র হাতে।
ভিক্ষাপাত্রই। শশী যে বেতের ধামিটায় মুড়ি খায়, সেটাই অশ্রুমতীর হাতে। অশ্রুমতী অস্ফুটে একবার আপন আর্জি পেশ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছে। জলখাবারের গিন্নী ছোট খুড়—শাশুড়ী ননীবালা স্নান সেরে এসে লক্ষ্মীর দেয়ালের সামনে আহ্নিকে বসেছেন। অশ্রুমতীর অস্ফুট আবেদনে একবার ফিরে তাকিয়ে ‘অপেক্ষা’ করতে ইসারা করে আবার চোখ বুজেছেন। কে জানে কখন খুলবেন!
প্রতিটি মুহূর্ত এক একটি প্রহর।
অশ্রুমতী কি আর একবার ডাকবে?
গলা দিয়ে শব্দ বেরোবে?
তাহলে কি ও ঘরে গিয়ে অবস্থাটা বলে আসবে? কিন্তু নড়বে কেমন করে? মাটির সঙ্গে তো পুঁতে গেছে অশ্রুমতী নামের মেয়েটা।
শালার সংসারের ক্যাঁথায় আগুন।—
শশীকান্ত চৌকীটা ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, পেটের মধ্যে খাণ্ডবদাহন হচ্ছে, ভিজে মাথা শুকিয়ে পিত্তি পড়ে গেল, একমুঠো মুড়ি গুড় জুটল না? তুমিই বা গোবর জলের ঘটি ধরে সঙের মতন দাঁড়িয়ে আছো কেন নবাব নন্দিনী গর্ভধারিণী? শশেকে খাটে চড়িয়ে পাঠিয়ে দিয়ে ছড়া গোবর দেবে বলে?
দুগগা দুগগা! ষাট ষাট!
নিবারণী চোখ মুছে দুগগাকে স্মরণ করে ষাট বাঁচিয়ে বলেন, যাতা অকতা কুকতা তোর মুকে।…
তা যেমন মা, তার তেমনি ছা। কেন তুমি একবার দেখতে যেতে পারছ না, তোমাদের ভাঁড়ারে আগুন লেগেছে কিনা।
নিবারণী বেজার গলায় বলেন, আমি এখন ভাঁড়ারের পৈঠেয় উঠবো? না চান, না কিছু।
ছোটগিন্নীর এলাকা দালানের ও প্রান্তে হলেও শশীর ডাক—হাঁক কানে যাবে না, এতো ধ্যানস্থ হয়ে যান নি ছোটগিন্নী। এখন তিনি গলা তুলে বলে ওঠেন, তা ভাঁড়ারে আগুন লাগতে অধিক দেরীও নেই বাছা—বংশে যখন তোমাদের মতন মহাপুরুষের জন্ম হয়েছে। তা এ ঘরে হাপসা কেন বাছা, নেয্য জায়গায় এসে বোস না। চন্দর বেড়িয়ে ফেরেন নি, তাই মায়ের পায়ে মুণ্ডুটা একটু ঠুকতে বসেছিলুম।…আসবে? না বৌয়ের হাতে দিয়ে দেব?
কি মনে করে শশী কোঁচার খুঁটটা টেনে এ দালানে এসে বসে। এখানে তিন—চারখানা পিঁড়ি পাতাই আছে। কাঁঠাল কাঠের ভারী পিঁড়ি, কোণে কোণে নক্সা কাটা। তার একটায় বসে পড়ে ঘাড় গুঁজে বলে, খিদে লেগেছে তাই বলা—
তা খিদে তো নাগতেই পারে—
ছোটখুড়ির অমায়িক গলা—বেলা তো কম হয় নি। কই নতুন বৌমা, পাত্তরটা!
চকচকে পিতলের কলসীতে মুড়ি ভেজে গরম গরম বেলায় ভরা থাকে।
ততোধিক চকচকে একটা পিতলের রেক—এ হড়হড় করে মুড়ি ঢেলে শশীর সামনের ধীমিতে ঢেলে দেন ননীবালা, আর এক ছোট্ট ঘড়া থেকে বার করে আনেন ছোলা মটর ভাজা, এবং একটা ছোট কাঁসার রেকাবিতে করে চারটে নারকেল নাড়ু বসিয়ে দিয়ে যান।
কৃতজ্ঞতায় বিগলিত শশী বলে, তিলের নাড়ু আছে নাকি ছোট খুড়ি?
আছে বোধহয় দু’টো, দেখি—
আবার ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে যান ননীবালা, আর ডেকে বলে যান, মাচা থেকে দুটো শশা ছিঁড়ে আনো না নতুন বৌমা, শশী মুড়ির সঙ্গে ভালবাসে—
এবার কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হবার পালা অশ্রুমতীর।
ছোটগিন্নী মুখে যতই ব্যাজার ভাব দেখান, কাউকে খাওয়াতে বসলে যত্ন না করে পারেন না। বলতে কি, স্বেচ্ছায় তিনি এই জলপানির ভারটি নিজের হাতে নিয়ে রেখেছেন।…খানিক বেলায় মুনিষরা আসে, গোয়ালের চাকরটা আসে, গরুর রাখাল আসে, বাসনমাজা ঝি আর তার নাতিটা আসে। সব্বাইকার জলপানি বরাদ্দ।—
ওদের জন্যে অবশ্য মোটা চালের চাল ভাজা। তবে সেই চালভাজার সঙ্গে আনুষঙ্গিকও আছে। বাটি বাটি গুড়, ব্যাসন নাড়ু, পককান্ন, তেল নুন কাঁচা লংকা।—গাছের শশার বহর দেখলে তাও ছিঁড়ে নিতে বলেন। আর কেউ ওদের পরিবেশন করলে পছন্দ হয় না ননীবালার।
দ্বিতীয় প্রস্থ মুড়ি আর তিলের নাড়ু খেয়ে বড় গেলাসের এক গেলাস জল খেয়ে শশী পরিতৃপ্তির শব্দ উচ্চারণ করে গলা তুলে বলে, আমি একটু চণ্ডীবাড়ির ওদিকে যাচ্ছি ছোট—খুড়ি, কেউ খোঁজ করলে বলে দিও।
কেউ অর্থে অবশ্যই চন্দ্রকান্ত।
কিন্তু চণ্ডীবাড়ি কি গুপ্তদের দোতলার শেষ কোণার ঘরে!
ছেলের বৌকে অকারণ খিঁচিয়ে নিবারণী চাপা গলায় বলেন, খবরদার। কাউকে নাগিয়ে দিতে যাবি না হারামজাদি যে, শশে ওপরে ঘুমোতে গেচে।—বুঝতে পেরেচিস? ঘুমে বাছা নটপট করছে, একটুক্ষ্যাণ ঘুমোতে না পেলে বাঁচবে কেন?—নাগিয়ে যদি দিস, তোর একদিন কি আমার একদিন। —যাও এক ঘটি জল নে গে রেকে এসো ওর মাতার কাচে, তেষ্টা পেলে গলা তুলে ডেকে চাইতে পারবে নি তো। আহা, বাছা আমার যেন চিরচোর! বাপ নেই বলেই তো? আজ যদি ওর বাপ থাকতো, কারুর সাদ্যি ছেলো চোক রাঙাতে? পরাশ্রয়ী তো নয়? নিজের বাপ দাদার ভিটে, শুধু দুটো ভাত কাপড়। তার জন্যেই এতো নীচু হয়ে থাকা।— সঙের মতন দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও। আসার সময় কপাটটা ভেজিয়ে দে এসো। আর এই বলে রাকচি, খবরদার, যেন কেউ টের না পায় শশে ঘরে আচে।
শশী ভূমিষ্ঠ হবার আগে ওর বাপ মরেছিল, তবু নিবারণী ওর বাপ থাকা আর না থাকার অবস্থার তুলনা—মূলক আলোচনায় আক্ষেপ করতে ছাড়েন না।
শশীকান্ত যে ঘরটা অকাল নিদ্রার জন্যে বেছে নিয়েছিল, সেটা বলতে গেলে বাড়ির বাড়তি আবর্জনার ঘর। ভাঙা। ভাঙা টুল, নড়বড়ে আলনা, তুলো বেরিয়ে যাওয়া তোষক, ছেঁড়া মশারির ডাঁই, পুরনো কাপড়ের পোঁটলা ইত্যাদি। একটা যে ইঁট—ঠেকানো তেপায়া চৌকী পড়ে আছে, সেও জঞ্জাল হিসেবেই, তবু তার ওপর কিছু তোষক বালিশও আছে ওই রাখার জন্যেই।—এটাই শশীর সুখের ষোলোকলা। যখনই বাড়িতে থেকেও গা—ঢাকা দেবার তাল করে শশী, এইখানে এসে শুয়ে পড়ে। সন্দেহের অতীতই জায়গাটা।
আর প্রধান সুবিধে—প্রবেশ পথটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। দালান ছাড়িয়ে ঘেরা বারান্দার কোণে।
জলের গ্লাশটা নিয়ে ঘরে ঢুকল অশ্রুমতী।
মোটা একটা ময়লা তেলচিটে ওয়ারবিহীন পাশ—বালিশ জড়িয়ে শুয়েছিল শশী। দরজা খোলার শব্দে চমকে ‘কে’ বলেই উঠে বসে খিঁচিয়ে বলে উঠল, আবার কী করতে জ্বালাতে এলি?
পিসির কানে শশীকান্তর স্ত্রীর প্রতি মধুর সম্বোধন গেলে রাগ করে পিসি বলে, বদ্যির ঘরের ছেলে, পরিবারকে ‘তুই মুই’ কী রে? তুমি বলতে মুখে ফোসকা পড়ে?
অতএব শশীকান্ত লোক সমাজে একটু সামলে চলে। কিন্তু একা কোর্টে পেলে সামলাবার প্রশ্ন নেই। এমন সুবর্ণ সুযোগে তুই তো সামান্য, পিটিয়ে লাশ করাও চলে।
অশ্রুমতী ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, মা বললেন জলটা—ওর বেশী সাহসে কুলোয় না তিন ছেলের মা অশ্রুমতীর। ‘ছেলে’ অবশ্য নয়, মেয়ে। জন্ম—রুগ্ন হাড়সার তিনটে মেয়ে। যারা অশ্রুমতীর দুঃখের বোঝা আর পরাজয়ের স্বাক্ষর। তাই সাহসের প্রশ্ন নেই।
শশীকান্ত হাত বাড়িয়ে বলে, এদিকে আয়।
ওঃ। সরে এসে মারবার পরিশ্রমটুকুও করবে না। পায়ে হেঁটে গিয়ে মার খেতে হবে।— এগিয়ে গেলেই যে নির্ঘাৎ গালে ঠাস করে একটা চড় মারবে তাতে সন্দেহ কী?
অশ্রুমতী নড়ে না।
অথবা নড়তে পারে না।
কী? ন্যাকামি হচ্ছে? চুলের মুঠি ধরে টেনে আনতে হবে?—শশীকান্তর ভঙ্গী হিংস্র ক্ষুধার্ত।
অশ্রুমতীর সর্বশরীর থরথরিয়ে আসে, অশ্রুমতীর বুক ধড়ফড় করে ওঠে, চোখে জল উপচে ওঠে, এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় অশ্রুমতী আসন্ন ঝড়ের মুখে।—ভগবান।— ঘাড়ে পিঠে বুকে পেটে যেখানে হয় মারুক, যেন গালে না মারে। বড় লজ্জা! বড় লোক জানাজানি! লুকোবার উপায় নেই। তিন চারদিন কালসিটের দাগ থাকে।
ভগবান বোধয় বেচারী অশ্রুমতীর প্রার্থনা শুনতে পান।
গালে চড় বসিয়ে দেয় না তার পতি দেবতা।
কিন্তু ঠাশ করে গালে একটা চড় বসিয়ে দেওয়া কি এর থেকে বেশী ভয়াবহ ছিল?—
কিছুক্ষণ পরে যখন ‘দূর হ কাঠের পুতুল’ বলে অশ্রুমতীর রোগা শরীরটা চৌকী থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে আবার গুছিয়ে ঘুমের জোগাড় করে শশীকান্ত, তখন তার হাতের মুঠোয় অশ্রুমতীর গলার সরু বিছে হার ছড়াটা।
কষ্টে কান্না থামিয়ে অশ্রুমতী বলে, গলা খালি দেখলে সবাই কী বলবে?
কী আবার বলবে? খানিক গাল—মন্দ করবে। তারপর থেমে যাবে।
জিগ্যেস করবে না কোথায় গেল?
করবে নিশ্চয়। বলবি চান করতে গিয়ে টিপকল খুলে জলে পড়ে গেছে।
আস্ত রাখবে আমায়?
না রাখে, ভাঙবে। যাকে দিয়ে এতটুকু সুখ নেই, অমন পরিবার থাকাই বা কী, যাওয়াই বা কী? নিজেই জলে ডুবতো না। লোকে ভাববে গয়নাসুদ্ধ ডুবেছে।
মেয়ে তিনটেকে কেউ দেকবে জানলে এক্ষুনি জলে ডুবতে যেতাম। তোমার মা তো ওদের কাঠি করেও ছোঁন না।
অ্যাঁ! কী বললি?
মাতৃভক্ত শশীকান্ত মাতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বৌয়ের ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলে, আমার মা তুলছিস?—মায়ের কথা নয়ে কথা?—জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব না? ফের বলবি? ফের বলবি? যা বেরো দূর হয়ে যা।—স্বামী তোর একটা সোনা নিয়েছে বলে হাপসাচচিস? লজ্জা করে না? নিয়েছি তোর সাতপুরুষের ভাগ্যি তা জানিস?—স্বামীর কোনো কম্মে লাগিস খ্যাংরা কাঠি! অ্যাঁ লাগিস? তিনতিনটে মেয়ে বিইয়ে আমায় উদ্ধার করেছেন। হার নিয়েচি বেশ করেচি। কাউকে যদি বলবি, তো তোর ওই অরিস্টি—গরিস্টি—পাপিষ্ঠী মেয়ে তিনটেকে খালের ধারে গুঁজে রেখে আসবো। ব্যস, আমার এই শেষ কথা।
এই এক মোক্ষম অস্ত্র।
একেবারে ঠাণ্ডা করে দেওয়া যায়।
অশ্রুমতী নামের মেয়েটা এই অস্ত্রে একেবারে নিথর!—মেয়ে কটা তার প্রাণ। সেটা বোঝে বলেই শশী এই অস্ত্রটাই শানিয়ে রাখে।
‘হিতবানী’ তো তোমার ‘কাব্যকণিকা’র খুব প্রশংসা করেছে।—নিয়ে এলাম কাগজখানা—
হাতের কাগজখানা ফরাসের উপর বিছিয়ে ধরে গৌরমোহন। সেই মুদ্রিত জায়গাটিতে আঙুল ঠেকিয়ে বলেন, ‘হিতবাদী’ বড় একটা এরকম ছাপে না। যাক—ভাই, তুমি একটা কাজের মত কাজ করে চলেছ।
চন্দ্রকান্ত সেই কলামটার উপর চোখ রেখে লজ্জিত হাসি হেসে বলেন, কাজের মত কাজই বটে। ছেলেখেলা করি একটু।—তুমি জোর করে খাতাটা নিয়ে গিয়ে এই কাণ্ডটি করেছিলে, তাই হল। আমার তো জমাই হচ্ছে কেবল।
খুব অন্যায়। এসব জিনিস ছাপা হওয়া দরকার। ‘ছেলেখেলা’ হলে আর কাগজে সুখ্যাতি করতো না—
গৌরমোহনের কণ্ঠে উৎসাহ উদ্দীপনা আনন্দের অভিব্যক্তি।
এই তো দেখো না, ‘কাব্যকণিকা’র কবিতাগুলিকে ‘কণিকা’ মাত্র বলা কবির অধিক বিনয়ের লক্ষণ। দেশাত্মবোধক কবিতাগুলি যথার্থই আন্তরিক আবেগপ্রসূত।—সমাজচিন্তা সম্পর্কিত কবিতাগুলিতে যেমন সমাজের অনাচার—অত্যাচারের উপর তীব্র কশাঘাত আছে, তেমনি আবার কবির দরদী হৃদয়ের বেদনাবোধের স্পর্শ আছে।—’জননী’ কবিতাটিতে কবির চিন্তার স্বচ্ছতা, বক্তব্যের ঋজুতা ও সুগভীর অনুভূতি দেখিতে পাওয়া যায়। আমরা একটি স্তবক উদ্ধৃতির লোভ সংবরণ করিতে পারিতেছি না—
হে জননী—
তুমি কি কেবলই রবে ‘স্নেহময়ী’ রূপে
শুধু সহ্য শুধু ক্ষমা,
শুধু স্নেহ শুধু মায়া
অক্লান্তে সেবিয়া যাবে, ধীরে
চুপে চুপে?
হবে না কি ‘অগ্নিময়ী’ কঠোর?
অপদার্থ কুসন্তানে—
কঠিন আঘাত হেনে—
ঘুচায়ে দিবে না তার ‘কাল’ ঘুমঘোর?
স্থানাভাবে অধিক উদ্ধৃতি সম্ভব হইল না, তবে কবি জননীর যে আদর্শ রূপ কল্পনা করিয়াছেন ও তাঁহাদের যে কর্মপন্থা নির্দেশ করিয়াছেন, তাহা যুগোপযোগী হইয়াছে।
চন্দ্রকান্ত অল্প বয়স্ক নয়, চন্দ্রকান্তর প্রকৃতিতে গৌরমোহনের মত উচ্ছ্বাস নেই, তবু চন্দ্রকান্তর বুকের মধ্যে তোলপাড় করে ওঠে, যেন একটা বেদনার মত আনন্দ বোধ হয়।
তবু চন্দ্রকান্ত মৃদু হেসে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেন, এই সমালোচকটি তুমিই নও তো?
কী যে বল?
গৌরমোহনও হাসেন, আমি কে যে আমার বক্তব্য ছাপবে? তবে হ্যাঁ, প্রকাশের জন্যে দেওয়ার বাহাদুরীটা গৌরমোহনের প্রাপ্য। এবারেও তোমার কিছু কবিতা নিয়ে যাব। জমেছে তো কিছু?
চন্দ্রকান্তর মুখে আসে, এখন আমার কবিতার থেকে গদ্য রচনায় ঝোঁক হয়েছে,—লজ্জায় বলে ফেলতে পারেন না শুধু হেসে বলেন, তা জমেছে। যাক, থাকছ কতদিন?
কতদিন আর? মাত্র তো সাত দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি।
চন্দ্রকান্ত বলেন, কলকাতার অবস্থা এখন কী রকম?
গৌরমোহন একটু তাকিয়ে বলেন, কোন অবস্থার কথা জানতে চাইছ? অর্থাৎ কোন বিষয়ে?
সব বিষয়েই। শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম, সামাজিক আচার—আচরণ, নব্য যুবকদের মতিগতি, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামিতা—
ওরে বাবা! তোমার ‘কোশ্চেন পেপার’ পড়তেই তো আমার একটা বেলা কেটে যাবে। সব অ্যানসার দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভবও নয়, এক কথায় বলা চলে—কলকাতা হচ্ছে বহুরূপী।—একই মাটিতে একদিকে ধর্মের বন্যা, অপর দিকে পাপের স্রোত, একদিকে শিক্ষা সভ্যতা কালচারের অগ্রগতি, অপর দিকে পাপের স্রোত, একদিকে শিক্ষা সভ্যতা কালচারের অগ্রগতি, অপর দিকে সভ্যতার নামে অসভ্যতা, শিক্ষার নামে বিভ্রান্তি। আর স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা যদি বলো—আচ্ছা চন্দর—
গৌরমোহন ব্যগ্রভাবে বলেন, তুমি একবার চলো না। কতকাল তো যাওনি। সেই অবধিই তো কলকাতাকে বর্জন করে বসে আছো।
চন্দ্রকান্ত গৌরমোহনের কথায় চকিত হন। তারপর আস্তে বলেন, ওটা কোন কথা নয়। বর্জনও নয়, তদবধিও কিছু নয়। যাওয়া হয়ে ওঠে না। এই পর্যন্ত।
চুপ করে যান দু জনেই। যেন অতীত স্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়ে অবগাহন করেন।
একটু পরে চন্দ্রকান্ত গভীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলেন, তুমিতো সবই জানো। বড়দারা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি বড়ই বন্দী হয়ে গেছি। বাড়িতে তো আর দ্বিতীয় পুরুষ অভিভাবক নেই। অথচ—
গৌরমোহন বলেন, শশীকান্ত এখনো মানুষের মত হল না?
হলে আর ভাবনা কী ছিল? বরং মনে হচ্ছে, বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে দুর্মতি বাড়ছে। সেজ খুড়ির অদৃষ্ট। এই সব বন্ধনে—
তাহলেও—
গৌরমোহন বলেন, একবার চলো কয়েকটা দিন থেকে আসবে। মুক্তারাম বাবুর স্ট্রীটের সেই আগের বাসাটা বদল করেছি সে তো জানো? শোভাবাজারের এই বাসাটা অনেক বড়, অনেক জায়গা। বড় বড় পাঁচখানা ঘর, দালান উঠোন। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।
চন্দ্রকান্ত অন্যমনা ভাবে বলেন, আমার আবার কী অসুবিধে? কেষ্টর মায়ের অসুবিধে ঘটানো—
কৃষ্ণমোহন গৌরমোহনের বড় ছেলে, ডাকনাম কেষ্ট। গৌরমোহন ব্যস্ত হয়ে বলেন, আ ছি ছি। এ কী বলছ চন্দর? কেষ্টর জননী মানুষজন খুব ভালবাসে। রান্নায় খুব ওস্তাদ তো। খাওয়াতে টাওয়াতেও—
গৌরমোহনের কথার মাঝখানেই কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়, বাড়ির ভিতর থেকে গোবিন্দ দুহাতে একটি থালা ধরে নিয়ে এসে দাঁড়ায়। নানাবিধ ফল ও মিষ্টান্ন থালা বোঝাই।
চন্দ্রকান্ত শিহরিত হন। কী সর্বনাশ, এতো কে খাবে?
তুমিই খাবে। সকাল বেলা তো সেই শুধু সরবৎ খেয়ে বেরিয়েছ?
একথা কে বলল তোমায়?
বাঃ। চিরকাল যা কর জানি না? অভ্যাসের নড়চড় করবার লোক তো তুমি নও। খাও খেয়ে নাও। আমি তো ভাবছিলাম, গোবিন্দকে একবার তোমার বাড়ি পাঠিয়ে দিই। পিসিমাকে বলে আসুক, আজ তুমি এখানেই সারাদিনটা থাকবে খাবে।
না, না।
চন্দ্রকান্ত ব্যস্ত হন, এসব আবার কেন?
আর কিছু নয়, অনেক কথা জমে আছে, মনে হচ্ছে সারাদিনেও ফুরোবে না। যাক না গোবিন্দ—
চন্দ্রকান্ত অবশ্য অনুরোধ কাটিয়ে নেন।
বন্ধু গর্বে যাতে আঘাত না লাগে গৌরমোহনের, এমন কোমলভাবেই বলেন, পিসিমার ছুতোও দেখান, তবু গৌরমোহন একেবারে ছাড়েন না। কথা হয়—তাঁর এই ছুটির কদিনের মধ্যে একটা দিন দুই বন্ধুতে একসঙ্গে ভাত খাওয়া হবে।
চন্দ্রকান্ত হেসে বলেন, সেটা আমার বাড়িতেই বা নয় কেন? না কি বদ্যি বাড়িতে চলবে না?
গৌরমোহন হেসে ফেলে বলেন, চিরকালইতো চলে এলো, হঠাৎ প্রশ্ন কেন? পিসিমার হাতে খেয়ে খেয়েই তো মানুষ হয়েছি—ঠিক আছে, একটা দুপুর তাও হবে। বামুনের ছেলে, পেটুক জাত, ভোজনে ব্যাজার নেই। তবে এ বাড়ির গিন্নীরও সাধটা মেটানো চাই। বামনাইয়ের কথা আর তুলোনা ভাই, কলকাতায় বসবাস করতে গেলে জাতের বড়াই করা ধৃষ্টতা। তাছাড়া—কেষ্টর মায়ের শরীর খারাপ হওয়ায় বাড়িতে তো রাঁধুনী বামুনেরও আমদানী করতে হয়েছিল, উড়িষ্যার মাল, পৈতে একটা গলায় ছিল, ওতেই সন্তুষ্ট থেকেছি। গিন্নী ভাল হয়ে অবশ্য তাকে ভাগালেন।
কী হয়েছিল গিন্নির?
অন্যমনস্কভাবে বললেন চন্দ্রকান্ত।
গৌরমোহন একটু লজ্জিত হাসি হেসে বলেন, আর বল কেন, বুড়ো বয়সের কেলেংকারী।
তাই না কি?
চন্দ্রকান্ত একটু সচেতন হলেন।
গৌরমোহন বলেন, টিঁকল না, শুধু কষ্টই সার হল। অসময়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার বাড়তি ফল ওই স্বাস্থ্য ভঙ্গ। তুমি বেশ আছ ভাই, নীলকান্তর পর চুপচাপ। আমার তো দ্যাখো দুই মেয়ের পর কেষ্ট, লালু, এই গোবিন্দ, আর ওইতো শুনলে—
চন্দ্রকান্ত একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, নীলকান্তর জন্মের আগেরগুলিকে বুঝি হিসেব থেকে বাদ দিচ্ছো?
আহা। ঈস! ইয়ে—মানে—
গৌরমোহনের মুখটা অপ্রতিভ অপ্রতিভ লাগে।
ভুলেই গিয়েছিলেন সত্যি।
চন্দ্রকান্তের প্রথম পুত্র—সন্তানটি আঁতুড় ঘরেই মারা যায়।
ধাইয়ের মতে পেঁচোয় পেয়েছিল, সুনয়নীর মতে—ধাইয়ের অসাবধানতায় হাত থেকে পড়ে গিয়ে তড়কা হয়েছিল।
দ্বিতীয়বার সুনয়নী আঁতুড় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন যমজ কন্যা নিয়ে। এটা অনেকের কাছেই খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছিল। ভগবান একজনকে অকালে নিয়ে ফেলে অনুশোচনায় পড়ে একসঙ্গে দুটিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। চিরকেলে পাকা কথা কইয়ে সুনয়নী অবশ্য বলেছিল, হ্যাঁ খুব পুণ্যি করেছেন ভগবান, নাকের বদলে নরুণ দিয়েছেন।
তবে কন্যা যুগলের আদরের ঘাটতি ছিল না, কারণ মেয়ে দুটি হয়েছিল পরমা সুন্দরী। কিন্তু সেটাই হল কাল, সুনয়নীর বাপের বাড়ির দিকের এক দূর—সম্পর্কের আত্মীয় তাঁর একজোড়া যমজ ছেলের জন্য মেয়ে দুটিকে পছন্দ করে ফেলে এমন ঝুলে পড়ল যে নিতান্ত বালিকা বয়সেই তাদের গোত্র ছাড়া করে ফেলতে বাধ্য হলেন চন্দ্রকান্ত। তখন অবশ্য চন্দ্রকান্তর বাবা বেঁচে।
চন্দ্রকান্ত এই বিপদ থেকে উদ্ধার হতে তাঁর শরণ নিয়েছিলেন। তিনিও এতে খুব উৎসাহী ছিলেন না। যমজ পাত্র পাত্রীর বিবাহ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পূর্ণ অনুমোদিত নয় বলেই স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠল কুটুম্বর মর্যাদা রক্ষার।
বিয়ের প্রস্তাবক—কর্তা স্বয়ং সুনয়নীর বাবা, অতএব চন্দ্রকান্তরও পিতৃতুল্য গুরুজন, তাঁর একান্ত নির্বেদ সত্ত্বেও অরাজী হওয়া মানেই তাঁকে অসম্মান করা।
সুনয়নী তো একেবারে বাপের দিকে। তার মতে, একসঙ্গে একজোড়া কন্যাদায় উদ্ধার হয়ে যাওয়ার এই সুবর্ণ সুযোগ ছাড়ছেন এঁরা কেবলমাত্র প্রস্তাবটা গরীব কুটুম্বর কাছ থেকে এসেছে বলে! বাবার এতে মুখ থাকবে? এই সুনয়নীর নিভৃত—রাত্রির পটভূমিকা হলো—আমার বাবা গরীব, কিন্তু একটা মান্যমান লোক। তাছাড়া—পাত্রপক্ষ তো মস্ত বড় লোক। তোমরাই তোদের কাছে ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে।
তা সেটাই বা কি লাভ?
বলি মেয়ে তো সুখে থাকবে।
তুমি পারবে এখন থেকে ওদের ছেড়ে থাকতে?
সুনয়নীর পাকা গিন্নী কথা, তা মা যখন হয়েছি, এ দুঃখ তো সইতেই হবে। আজ দশ বছরের আছে, কাল বারো বছরের হয়ে উঠবে। মেয়ের বাড় কলা গাছের বাড়। এরপর ওই মেয়েদের নিয়ে ভুগতে হবে কিনা তা দিব্যি গেলে বলতে পারো? যমজের আধখানা লোকে সহজে নিতে চাইবে? আর এ সম্বন্ধ যদি তোমরা হেলায় ঠেলো, বাবা আর তোমাদের বাড়ির ছায়াও মাড়াবেন না তা মনে রেখো।
চন্দ্রকান্তর বাবা বললেন, এরকম ক্ষেত্রে রাজী হওয়া ছাড়া উপায় দেখি না চন্দর। বৌমার যুক্তিটাও ফেলবার নয়, এরকম সবদিকে ভাল পাত্র সব সময় পাওয়া যায় না, মেয়েরা না হয় দুবছর এখানেই থাকবে—
অতএব পিতৃশরণ নেওয়াও কাজে লাগেনি চন্দ্রকান্তর। কিন্তু সেই সর্বাংশে ভাল পাত্রের পিতাটি যে সর্বাংশেই খারাপ তা বোঝা গেল বিয়ের পরে।
দু বছর তো দূরস্থান, দুদিনও বৌদের বাপের বাড়ি রাখতে রাজী হলেন না তারা। সেটা নাকি তাঁদের কুলগত নিয়মের বহির্ভূত।
আগে এ নিয়ম জানানো হয়নি কেন এ প্রশ্নে কিছু বচসা হল, এবং সেই সূত্রে চিরতরেই আসা বন্ধ হয়ে গেল মেয়েদের। পাঠাতেই যদি হয় জন্মের শোধই পাঠাবেন, এমন ঘোষণা পত্র পাঠালেন তারা। চন্দ্রকান্ত অবশ্য বলেছিলেন বাপের কাছে, তাই পাঠাক। জন্মের শোধই পাঠাক।
বয়েস তখন কম, রক্ত তপ্ত। এই সিদ্ধান্তই নেবেন স্বাভাবিক। কিন্তু চন্দ্রকান্তর ঠাণ্ডামাথা বাবা বললেন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখড়ের প্রাণ যায়। নিজেদের জেদের লড়াইয়ে মেয়ে দুটোর—আখের ঘোচাবি বাবা? একটা আধটা নয়, দু—দুটো মেয়ে। তাদের চিরকালের কথাটা ভাব। তুই নাহয় তাদের ভাত কাপড় দিতে পারবি, কিন্তু স্বামী সংসার দিতে পারবি?
চন্দ্রকান্ত মাথা হেঁট করলেন।
অতএব নাটকে যবনিকা পতন।
মজা এই যে, কুটুম্ব বিচ্ছেদের ভয়ে এই ঘটনা ঘটানো, এ—ব্যাপারে সেই বিচ্ছেদই ঘটলো। সুনয়নীর বাবা এতে জামাইয়ের দোষ দেখে তারপর আর এ বাড়িতে পদার্পণ করেন না। ক্রমশঃ যেন ভুলেই গেল সবাই, ফুলি টুলি নামে টুকটুকে দুটো মেয়ে এ বাড়িতে ছিল।
অনেকদিন পরে কোথায় কোন মেলায় না মন্দিরে নাকি মেয়েদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলেন সুনয়নী, মেয়েরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে শাশুড়ির পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অতঃপর আর কি হতে পারে?
গৌরমোহনের এ ইতিহাস জানা।
দৈবাৎ ভুলে গিয়েছিলেন, তাই চন্দ্রকান্তের সন্তান সংখ্যার উল্লেখ করে ফেলেছিলেন। এখন অপ্রতিভ হলেন।
চন্দ্রকান্ত বললেন, লজ্জা পাবার কিছু নেই ভাই, আমরাই তো প্রায় ভুলে গেছি তাদের। নীলকান্তর জননীর আচার আচরণ দেখলে তো মনে হয় না, নীলকান্ত ছাড়া আর কখনো কেউ ছিল ওর।
স্ত্রী সম্পর্কে ‘মা’ শব্দটাই উচ্চারণ নিষেধ, তাই ‘জননী’ বলেই কাজ সারতে হয়।
চন্দ্রকান্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলেন, আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ কি জানো গৌর, যে আমি বাল্য বিবাহের এতো বিরোধী, সেই আমারই মেয়েদের বিয়ে হল বলতে গেলে শিশুকালে। অথচ এমনিতেই এখন নানা কারণে বাল্য বিবাহ কমে আসছে। শুধু দুঃখ নয়, লজ্জাও। বড় লজ্জা।
হঠাৎ আবার একটা স্তব্ধতা নামে।
এবার তাহলে উঠি গৌর।
একটু পরে বলেন চন্দ্রকান্ত।
আচ্ছা এসো, আমিও যাব পিসিমার সঙ্গে দেখা করতে। কাল দুপুরের কথা বলে আসবো। তুমি আর নীলকান্ত—
নীলকান্ত? না না। ওটা থাক।
চন্দ্রকান্তর কণ্ঠে ব্যাকুলতা।
গৌরমোহন বিস্মিত হন, কেন বল তো?
না এমনি, মানে তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
চন্দ্রকান্ত উঠে পড়েন।
যাবার মুখে বলে যান, মনের কথা বলবার মত লোক জগতে বড় দুর্লভ গৌর।
কথাটা সত্যি। চন্দ্রকান্ত তাঁর সেই সামাজিক উপন্যাসের পরিকল্পনার কথা বলতে চান গৌরমোহনকে। বলতে চান পরামর্শের জন্যেও। বর্তমানকে নিয়ে লেখা সহজ, অতীতকে নিয়ে আরো সহজ, কিন্তু ভবিষ্যৎকে নিয়ে? তাতে পদে পদে চিন্তার প্রশ্ন। কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিলে তো চলবে না। ‘রূপকথা’ না হয়ে যায়।
এসব কথা নীলকান্তর সামনে হতে পারে না। সেই নিয়ে মায়ের কাছে গল্প করতে বসবে। এমনিতে নেমন্তন্নতেই ভয়। ছেলে কোথাও নেমন্তন্ন গেলে, কোন খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে গেলে বাড়ি ফেরা মাত্রই সুনয়নী প্রশ্ন করবে, কী খেলি? তারপর তালিকা শুনে হয় সমালোচনা আর ব্যাখ্যানায় মুখর হবে, নয় চোখ কপালে তুলে ধন্যি ধন্যি করে সুনয়নী নিজে কবে কোথায় কী কী ‘বড়’ নেমন্তন্ন খেয়েছে, তার ফিরিস্তি দিতে বসবে। হয়তো সে ফিরিস্তিতে শুনতে হবে—সুনয়নীর পিসেমশাই একা আস্ত একটা পাঁঠা খেতে পারেন, একটা বিয়ে বাড়িতে এক গামলা মাছ ফুরিয়ে দিয়ে কী জব্দই না করেছিলেন।
অথবা সুনয়নীর মামা একাসনে বসে আড়াই সের বোঁদে আর সাড়ে তিন সেরি দইয়ের হাঁড়ি শেষ করেও আবার পুরোদমে মাছ, লুচি, ডাল, তরকারি খেয়ে কত অনায়াসে হজম করতেন।
প্রসঙ্গ আর ফুরোতেই চায় না।
চন্দ্রকান্তর মনে হয়, কী অরুচিকর এই সব প্রসঙ্গ। চন্দ্রকান্তর চিন্তায় অতিরিক্ত আহার বীভৎসতার সামিল, আর সুনয়নীর মতে সেটা রীতিমত বাহাদুরীর ব্যাপার।…
ছোট মামা না একবার কালীপুজোর পরদিন বাজি রেখে চারচারটি পাঁঠার মুণ্ডু খেয়েছিলেন—জানিস?
চন্দ্রকান্তর কানের কাছেই এ আলোচনা।
উঠে গিয়েছিলেন চন্দ্রকান্ত সেখান থেকে।
যাবার সময় শুনতে পেয়েছিলেন, তোমার ছোট মামা খুব বীর, তাইনা মা?
নিশ্চয়।
বালক পুত্রের কাছে ‘বীরের’ ধারণা জন্মানোর এই উপকরণ সম্বল ছিল সুনয়নীর।
কিসের সম্বলই বা আছে সুনয়নীর? কোথাও কোনোখানে?
কী নিঃসম্বল! কী রিক্ত!
অথচ সেই রিক্ততা সম্পর্কে বোধ মাত্র নেই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন