সূর্যোদয় – ১১

আশাপূর্ণা দেবী

এগারো

ভরা দুপুরে চন্দ্রকান্তর সংসারে যখন একটা চাপা উত্তেজনার স্রোত বইছিল অশ্রুমতীকে নিয়ে, তখন গ্রামের আরও একটা জায়গা উত্তেজনায় থমথম করছিল।

এ উত্তেজনা দুলে পাড়ায়।

মেয়ে পুরুষ ছেলেবুড়ো এসে জড়ো হয়েছে বদন দুলের বাড়ির সামনের পোড়ো জমিটায়। সকলের মুখে উত্তপ্ত উত্তেজনা, গভীর উদ্বেগ। কারুর মুখে কোন কথা নেই। শুধু বুড়ো উদ্ধব কাঁপতে কাঁপতে হাঁপাতে হাঁপাতে সবাইকে ধরে ধরে কী যেন বোঝাতে চেষ্টা করছে। …কারুর কারুর মুখে মেনে নেওয়ার ছাপ, অধিকাংশের মুখেই অনমনীয়তার ভঙ্গী।

জোয়ান ছেলেগুলোর সকলের হাতেই লাঠি। মাঝে মাঝে কেউ কেউ অসহিষ্ণুভাবে লাঠিটা মাটিতে ঠুকছে। সকলের মাঝখানে ভীষণতার প্রতিমূর্তির মতো মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে বদন দুলে। কালো পাথরে কোঁদা গড়ন, ঘাড়ে বাবরি চুল, সেই বাবরি চুলের আবেষ্টনীর মধ্যে ভীষণাকৃতি মুখটা সমেত বদনকে কেশর ফোলানো সিংহের মত দেখতে লাগছে।

কথা নেই, গুঞ্জন আছে।

আগুন নেই, উত্তাপ আছে।

এই অবস্থা থাকতে থাকতেই আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসছিল। হঠাৎ সমস্ত জটলার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। আর কর্কশ অনার্য কণ্ঠের সমবেত হুংকার। মেয়েমানুষদের গলা থেকেও তার সমর্থন ওঠে।

দুলেবস্তির ভেতর থেকে একটা দল বেরিয়ে আসছে জ্বলন্ত মশাল হাতে নিয়ে। আসন্ন সন্ধ্যার আকাশের নীচে সেই মশাল হাতে কালো পাথুরে মানুষগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে, আদিম অরণ্য থেকে উঠে আসা গুহামানবের দল।

তবু উদ্ধব দুলে ওই কঠিন সংকল্পের মূর্তিগুলোর কাছে আবেদন জানাতে চেষ্টা করছিলো, অ্যাকনো সময় আছে বাবারা, মগজ ঠাণ্ডা করে ভেবে দ্যাক—অ্যাকবার। একটা বজ্জাত মেয়েছেলের নেগে অ্যাতোটা করতে যাবি কিনা! গোরা পুলিশদের মুকগুলান মনে আন বাবারা—

কেউ উদ্ধবের আবেদনে কর্ণপাত করছে বলে মনে হয় না। গ্রাহ্যও করে না। তারা শুধু বদনের মুখ থেকে শেষ হুংকারের অপেক্ষায় অসহিষ্ণু মুহূর্ত গুণছে।

উদ্ধব যেই বদনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, উঠল সেই হুংকার। ‘যা ঘর যা বুড়ো’—

উদ্ধবকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে আওয়াজ তুলল বদন।…

মেয়েছেলেরা কেউ যাবেনি।

পড়ল আর একটা বাজ!

যাবেই বা কী করে? তাদের ঘর আগলানো আছে, শিশু সন্তান আছে। তবু কটা ডাকবুকো মেয়ে যাচ্ছিল পিছু পিছু। ফের ধমকে উঠল বদন, তফাৎ যা।

উদ্ধব ককিয়ে ওঠে, লাসটার কী হবে রে বদন?

খবরদার। একদম চুপ। জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব। যা হবার ফিরে এসে হবে।

মশাল হাতে রে রে করে এগিয়ে এসেছে তারা সেই বাড়ীর দেউড়িতে, যে দেউড়ির ধুলোর উপর তাদের বাপ—ঠাকুর্দারা চিরদিন সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে প্রণিপাত জানিয়েছে।

কোতায় সেই হারামজাদা শুয়োর! বের করে দে সেটাকে। তার চামড়া ছাইড়ে নেই। বেরিয়ে আয় শুয়োরের বাচ্চা।

অন্ধকার নেমে এসেছে। গাঢ় গভীর অমাবস্যার রাত্রি। সেই জমাট অন্ধকারের গায়ে মশালের আগুন যেন ক্রুদ্ধ দৈত্যের চোখের মত জ্বলছে। মাঝে মাঝে বাতাসের ধাক্কায় কেঁপে কেঁপে ওঠায় ভয়াবহতা আরো প্রখর প্রকট।

* * *

তুমি কি খেপে গেলে? ওই রাক্কসদের মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে তুমি?

সুনয়নী লোকলজ্জা ভুলে সকলের সামনে চীৎকার করে ওঠেন।

চীৎকার করে ওঠেন ভবতারিণীও। ও বাপ, তোর হাতে ধরি। ওদের সুমুকে যাসনে।

না গেলে ওরা দেউড়ি ভাঙবে।

নোয়ার দেউড়ি ভাঙলেই হলো?

ওরা যদি খেপে ওঠে, পৃথিবী ভাঙতে পারে পিসিমা। ভদ্দরলোকের রক্তর মত ঠাণ্ডা রক্ত নয় ওদের। ধরতে এসোনা। দেখতে দাও আমায়, শুনতে দাও ওদের কথা।

গিয়ে দাঁড়ালেন দেউড়ির সামনে। নিজের হাতে প্রকাণ্ড ভারী তালাটা খুলে ধরলেন।

হঠাৎ থেমে গেল আওয়াজ।

স্তব্ধতা নামল একটু।

চন্দ্রকান্ত বললেন, কী চাও? লুঠ করবে? চলে এসো।

কে একজন বলে উঠল, আমরা ছোটলোক হতে পারি হুজুর, বেইমান নই।

তবে, বল কী দরকার?

আর কিচ্ছুতে কাজ নাই আমাদের হুজুর, শুধু—

হুজুর হুজুর রাক—

বদনের কণ্ঠে বজ্রনির্ঘোষ, সেই শূয়োরের বাচ্চাডারে বের করে দ্যান।

আবার হুংকারের রোল ওঠে।

চন্দ্রকান্ত অবশ্যই কিছু অনুমান করেন, তবু শান্ত কণ্ঠে বলেন, ভালভাবে কথা বল বদন, কে সে?

ক্যানো? মালুম হচ্ছেনি? তোমার ওই ভাইডা। শালাকে ডালকুত্তাকে দে খাওয়াবো।

শোনো, আমাকে বুঝতে দাও। কী হয়েছে বলতে হবে। আমি কিছুই জানি না।

চন্দ্রকান্তর দুটো হাত দুটো দেউড়িতে। মশালের আলোয় বিচিত্র একটা রূপ।

আবার কিছুটা নীরবতা। যারা আগুন লাগাবে বলে মশালগুলোকে নাচাচ্ছিল, তারা বেজার মুখে হাত থামায়। আর শক্ত মুখ একটা মাঝারি বয়সের লোক সরে আসে চন্দ্রকান্তর দিকে।

কি হয়েছে জানায়—

বদনের সংসারে আর কেউ নেই, না মা না ছাঁ, শুধু একটা ডবকা বয়সের বাচাল বৌ। বদন যখন কাজে যায়, তখন বৌকে তালা বন্ধ করে রেখে যায়। বন্ধ ঘরের মধ্যে সে খায়, ঘুমোয়, গাল পাড়ে। বদন এসে তার তালা খোলে। কিন্তু কিছুদিন থেকে ওই শয়তান শশীকান্তকে বদনের বাড়ির ধারে কাছে ঘুর ঘুর করতে দেখেছে অন্য মেয়েছেলেরা। বদন গোঁয়ার বলে চট করে বলে দিতে সাহস করেনি। কিন্তু বদনও যেন সন্দেহ করেছে ঘরে আর কেউ আসে। অথচ তালা ঠিকই ঝোলে।

মাঝে মাঝে বদনকে কাজের জন্য ভিন গাঁয়ে যেতে হয়, রাতে ফেরে না। সেদিন ডবল তালা লাগিয়ে রেখে যায়, তবু সন্দেহ জমাট হতে থাকে। আর বদন হিংস্র হতে থাকে।

কিন্তু কাউকে কেন পাহারা দিতে রেখে যায় না বদন? ওইতো! ওখানেই গোঁয়ার্তুমি। নোকে জানবি পরিবারকে এঁটে উটতি পারবে না বদন দুলে, অপরের সাহায্য নিতে হচ্চে।

তা তক্কে তক্কে থাকে বদন।

আজ সকালে মিচে করে বলেচে বেরুচ্চি। আজ আর আসবুনি—ব্যস, বজ্জাত মেয়েমানুষটা জো পেইচে—।

অতঃপর আর কি!

হাতে নাতে ধরা।

দিনদুপুরেই এসে হাজির হইচে ‘কবরেজ মোশায়ে’র কুলাঙ্গার ভাইপোটি—

তো যেই না বদনা দুয়োরের তালাচাবি খুলেচে, সেই নক্কীছাড়া পাজী ঘরের পেচন দে দৌড় দে দৌড়। বদনা দেকে সিঁদেল চোরের মতন কাণ্ড! ভিতের গোড়ায় ইয়া একখান সিঁদ। তলেতলে কেটে রেকে থুয়েচে, তার মুকে একখান প্যাঁটরা ঠেশে থুয়েচে কুসমি।

না। বদন তো আর সিঁদের গর্ত দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ধরতে যেতে পারে না, দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছুটেছে। দেখতে পায়নি।…ব্যাস, তখন অপর আসামীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং দিশেহারা রাগে এমন পিটন পিটিয়েছে যে, মরেই গেছে ‘কুসমি’ নামের সেই জ্বলজ্বলে ছটফটে বাচাল বেহায়া মেয়েটা। এতো শাসনেও যার মুখের হাসি কমতো না।

কুসুমের কোল—আঁচলের খুঁটেয় নাকি একজোড়া সোনার বুলি, আর একগাছা বিছেহার বাঁধা ছিল। নিয়ে এসেছে বদন।

বের করে দ্যাকানা বদন, সনাক্ত করুক ইনি।

বদন রুক্ষ গলায় বলে, উনি কি সনাক্ত করবে! আসামীকে বের করে দেক। সেটাকেও ‘লাশ’ করে দেব, তাপর মড়ার মুকের ওপর এই গয়োনা দুখান ছুঁড়ে মেরে ফাঁসিকাটে ঝুলতি যাব, ব্যাস। দেন, বের করে দেন।

আচ্ছা, দিচ্ছি।

যে লোকটা চন্দ্রকান্তর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আপোসের সুরে কথা বলছিল, সে নীচু গলায় বলে, পরিবারডারে প্রাণতুল্যি দেকতো হতভাগা, রাগের চোটি খুন করি ফ্যালে পাগলা বনি গ্যাচে।

ভিতরে চলে এলেন চন্দ্রকান্ত। মহিলাকুল যেখানে এক জায়গায় জড়ো হয়ে বসে আছেন নীলকান্তকে এবং ছোট ছোট মেয়ে তিনটেকে নিয়ে, সেখানে এসে বিনা ভূমিকায় গম্ভীর গলায় বলেন, ছাদের বড়ি আচারের ঘরের চাবিটা দাও সেজখুড়ি।

সেজখুড়ি চমকে উঠে বলেন, ওমা সিকি! সে ঘরের চাবি নিয়ে কী করবে অ্যাখোন তুমি? আকাচা কাপড়।

থামো। আর পবিত্রতা দেখাতে এসোনা। চাবিটা দাও।…

সুনয়নী ঠকঠক করে কাঁপেন। ঠকঠক করে কাঁপে নীলকান্ত। কাঁপতে থাকে অশ্রুমতীও।

শুধু ভবতারিণী, ননীবালা, টেঁপির মা অবাক হয়ে তাকান। হঠাৎ এটা কোন ভাষা!

ভবতারিণী ভয়ে ভয়ে বলেন, চলে গেচে ওরা?

চলে যাবে? শুধু হাতে চলে যাবে?

তবে উমনোর মধ্যে ঝুমনোর বাদ্যি বড়ির ঘরের চাবির খোঁজ কেন বাবা? আমাদের তার মদ্যে ঢুকিয়ে দে লুটতরাজ করতে ছেড়ে দিবি?

লুঠতরাজ করতে আসেনি ওরা। কথা পরে হবে। চাবিটা দিয়ে দাও সেজখুড়ি।

আর ছলনা চলবে না।

অতএব এবার নিবারণী বাঘিনীর মূর্তিতে রুখে দাঁড়ান, ক্যানো? তোমার হাতে চাবি দিতে যাব ক্যানো? আপনার প্রাণ বাঁচাতে আমার শিবরাত্তিরের সলতেটুকুকে রাক্ষোসের মুকে ধরে দেবে বলে? …চাবি? আমি দেব না। এই চললাম দুয়োর আগলাতে, দেকি আমায় না খুন করে কে দুয়োর খোলে!

চন্দ্রকান্ত সকলের মুখের দিকে তাকান।

বাইরে আবার যেন কলরোল উত্তাল হচ্ছে।

চন্দ্রকান্ত শান্ত গলায় বলেন, মহাপাপের মহা প্রায়শ্চিত্তই করতে হয় সেজখুড়ি।…ছেলে যদি তোমার খুন হয়, তো জেনো সে খুনের খুনী তুমি। তবু আজ আরও একটা খুনের হাত থেকে দৈবে রেহাই পেয়েছ। নইলে পুলিশ এতোক্ষণে সবাইয়ের হাতে দড়ি পরাতো। যাক, বলছি ভালয় ভালয় ওদের হাতে ধরে দিলে বরং রেহাই পেতে পারে হতভাগা। ধরে না দিলে বাড়ি জ্বালিয়ে দরজা ভেঙে টেনে বার করে নিয়ে গিয়ে আছড়ে মারবে।

কিন্তু এই আশ্বাসেই কি চাবিটা ফেলে দেবেন নিবারণী? তাই কি সম্ভব?

নিবারণী ক্রুদ্ধ গর্জনে বলেন, যা পারে করুক। আমায় না মেরে ওরা শশীর চুলের ডগাটুকু ছুঁক দিকি। পরের ছেলে বলে এতো সাউখুড়ি। বলি এ যদি তোমার নিজের ছেলেটি হতো?

চন্দ্রকান্ত কঠিন গলায় বলেন, যদি আমার নিজের ছেলে হতো? নিজের হাতে সে ছেলের টুঁটি ছিঁড়ে মেরে ফেলতাম।

নিবারণী উঠে দাঁড়ান।

কোমরের কাপড়টা ভালো করে জড়িয়ে নেন, যাতে চাবিটা কেউ কেড়ে নিতে না পারে। নিবারণীকে ডাকিনীর মত হিংস্র দেখতে লাগে। তীক্ষ্ন কণ্ঠে বলেন, আচ্ছা দেখবো। ছেলে জোয়ান হয়ে উঠতে আর ক’দিন? মরবো না তো। দেখবো সবই। তা তুমি মহাপুরুষ নিজের ছেলের টুঁটি ছিঁড়ো বাছা, আমার ছেলেকে শাসন করতে আসার কিসের এক্তিয়ার তোমার? আমরা তোমায় মান্যিমান করে চলি তাই? নচেৎ শাসন করবার তুমি কে? বাপ না, জ্যাঠা না, খুড়ো না, জ্ঞেয়াতি দাদা।…কই আর তো কেউ কিছু বলতে আসে না? দুটি ভাত দাও বলে?

চন্দ্রকান্ত স্তব্ধ হয়ে যান।

ওদিকে দেউড়ি ঝনঝন করে ওঠে। রব ওঠে—জয় মা চণ্ডী!

চন্দ্রকান্ত বেরিয়ে আসেন। হাত জোড় করেন। শান্ত গলায় বলেন, বার করে এনে দিতে পারলাম না বাবা। মাপ চাইছি। তোমরা তোমাদের ইচ্ছে মত যা পারো করো। বাড়ি জ্বালিয়ে, আমায় বেঁধে রেখে, মেরে—যেভাবে খুশী।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন