সূর্যোদয় – ১

আশাপূর্ণা দেবী

এক

প্রস্তুতি চলছে অনেকক্ষণ থেকে।

আশ্চর্যসুন্দর মহান আবির্ভাবের প্রস্তুতি।

সারা পূব আকাশ জুড়ে সেই প্রস্তুতির সমারোহ।

শিল্পী বসেছেন রং—তুলি নিয়ে, চলছে তুলির টান একটার পর একটা। সেই টানে ফুটে ফুটে উঠছে—কী লাবণ্য, কী সুষমা!—রং একটাই, কিন্তু একটা রং থেকেই যে বর্ণ—বৈচিত্র্যের কত কারিগরি সম্ভব, এ যেন তারই নমুনার আসর।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লাগে, চমক লাগে, অন্তরালে অবস্থিত অদৃশ্য সেই মহান শিল্পীর পরম মহিমার কাছে মাথা নত হয়ে আসে।—নিত্য দেখা এই অপরূপ উদ্ভাসনের দৃশ্য চন্দ্রকান্তর মধ্যে যেন একটা ব্যাকুলতা এনে দেয়। বিরহের মত, বিচ্ছেদ বেদনার মত। পরম কোনো উপলব্ধির আনন্দ বুঝি বিষণ্ণ বেদনারই সমগোত্র।

তবু এই অনির্বচনীয় স্বাদটুকুর জন্য শেষ রাত্রি থেকে আর ঘুম হয় না চন্দ্রকান্তর। ঘোর ঘোর অন্ধকার থাকতে বিছানা ছেড়ে উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে শুদ্ধ বস্ত্র পরে পূবের দালানের খোলা খিলানের সামনে পাতা জলচৌকিটায় এসে বসেন—আকাশের দিকে চোখ মেলে।

এ একটা নেশার মত চন্দ্রকান্তর।

চিরপুরাতনের এই নিত্যনতুন প্রকাশ, চন্দ্রকান্তর কাছে যেন এক অফুরন্ত বিস্ময়ের ডালি।

যেন প্রতিটি তিমির রাত্রির অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে চন্দ্রকান্তকে এই আশ্চর্য উপহারটি দেবার জন্যই তার ডালি সাজানো। ঋতুতে ঋতুতে প্রকাশভঙ্গীর বৈচিত্র্য। তবে সব থেকে মনোরম বুঝি এই গ্রীষ্ম ঋতুর নির্মল ঊষার আকাশ। এ ঋতুতে রাত্রি শেষ না হতেই যবনিকা উত্তোলনের আভাস দেখা দেয়।

আকাশে বর্ণচ্ছটা, বাতাসে প্রাণকণা।

আর কোনো ঋতুতে এমন দীর্ঘস্থায়ী সমারোহ নেই আবির্ভাব উৎসবের। আর ক’দিন পরেই ঋতুর পালা বদল হবে, বর্ষা এসে পড়বে, পঞ্জিকার পাতায় তার ইশারা। সে সময় নিজেকে যেন বড় বঞ্চিত লাগে চন্দ্রকান্তর। এখন তাই লোভীর মত প্রথম থেকে শেষটুকু পর্যন্ত উপভোগ করে নেবার জন্যে উঠে এসে বসে থাকেন, অনুভূতির গভীরে গিয়ে।

অবশেষে রূপ থেকে অপরূপ, জ্যোতিঃ থেকে জ্যোতির্ময়। কোলের উপর জড়ো করে রাখা দুখানা হাত আপনিই জড়ো হয়ে যায়, আর বুঝি আপনিই উচ্চারিত হয়—

ওঁ জবাকুসুম সংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যূতিং—

একটু পরে আস্তে পাশে রাখা গীতাখানা তুলে নিয়ে খুলে ধরেন। পড়তে হয় না, সবই মুখস্থ, তবু নিত্য পাঠের নিয়ম রাখতে সামনে খুলে ধরা। ‘পেজমার্ক’ হিসেবে আছে ছোট্ট একটু ময়ূরপুচ্ছ, চন্দ্রকান্তর বাবার আমলের। —বাবার পাঠ করা গীতা, বাবার হাতের ‘পৃষ্ঠা চিহ্ন’। এটি চন্দ্রকান্ত তদবধিই পাঠের অভ্যাস করেছেন। পাঠ শেষে আবার সেটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বই মুড়ে ফেলে মৃদুকণ্ঠে উচ্চারণ করে চলেন—গীতা মে হৃদয়ং পার্থ, গীতা মে সারমুত্তমম—

গীতামাহাত্ম্য! এও নিত্য পাঠের অঙ্গ।

হোলো তোমার?

স্তব্ধতার সুর কেটে দিয়ে ঝনঝনিয়ে উঠল এই আকস্মিক প্রশ্নের আঘাত। যেন নিস্তব্ধ দুপুরে দূরবর্তী ঘুঘুপাখির উদাস করুণ সুরের একটানা ছন্দের মাঝখানে উচ্চকিত হয়ে উঠল একটা চিলের কর্কশ ডাক।

চন্দ্রকান্ত চমকে ফিরে তাকালেন।

—অথচ চমকাবার কারণ ছিল না। আকস্মিক নয়, নির্দিষ্ট নিয়মের প্রশ্ন।—সুনয়নী এসে দাঁড়িয়েছেন শ্বেত পাথরের গেলাসে মিছরির পানা নিয়ে। এটাই চন্দ্রকান্তর সকালের পানীয়। এও তো প্রতিদিনই নতুন হয়ে দেখা দেয় পুষ্টি আর তুষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়ে, দেখা দেয় শুভ্র সুন্দর আধারে বাহিত হয়ে। তবু কী একঘেয়ে লাগল, কী অরুচিকর!

জিনিসটা একঘেয়ে? না, একঘেয়ে এই বহু—ব্যবহারে জীর্ণ প্রকাশ ভঙ্গীটা?

চন্দ্রকান্ত চট করে গেলাসটার জন্যে হাত বাড়ালেন না। সুনয়নীর দিকে তাকালেন একবার। সন্দেহ নেই, সদ্য স্নান করে এসেছেন সুনয়নী। কিন্তু পরনের তসর শাড়িটা মলিন বিবর্ণ লাট হয়ে যাওয়া, তেল—হলুদের হাত মোছার ছাপও সুস্পষ্ট।

দু’হাতে মোটা মোটা দু’গাছা কুমীর না হাঙর—কী যেন মুখো বালার সঙ্গে শাঁখের শাঁখা, বাঁ হাতে গোটা আষ্টেক নোয়া। ভিজে চুলের সিঁদুরের রেখাটা ভিজে ভিজে হয়ে কপালের উপর গড়িয়ে আসছে, আর সেই গড়িয়ে আসার ঠিক নীচেই গোলা সিঁদুরের চটচটে প্রকাণ্ড টিপটা নাকের উপর নেমে আসার তাল করছে।—শিরা প্রকট হয়ে ওঠা শীর্ণ মুখটায় এতো বড় টিপখানা যেন একটা অসঙ্গতি। সদ্য স্নাতা, কিন্তু সদ্য—স্নানের স্নিগ্ধ প্রশান্তি কই?

চন্দ্রকান্তর মনে হল, একদা সব সময় মনে হয়েছে ‘সুনয়নী’ নামটা কী সার্থক। ঘরে পরে বলেছেও সবাই সে—কথা। এখন আর ওর নামটা কারও মনেই পড়ে না। অবশ্য মনে পড়বার খুব কারণও নেই, নাম ধরে তো আর ডাকেন নি কখনো? স্ত্রীলোকের পক্ষে স্বামীর নাম উচ্চারণে শাস্ত্রীয় বাধা, পুরুষের পক্ষে তো তেমন কোনো বাধা নেই, তবু স্ত্রীকে কে কবে নাম ধরে ডাকে?—সেই যে একদা ছোটবৌ নামের জামাটা গায়ে চড়িয়ে এ—সংসারে ঢুকেছিল ‘সুনয়নী’ নামের মেয়েটা, ওই জামার আড়ালে তার নিজস্ব পরিচয়টা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

নাও ধরো। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে হাঁ করে?

চন্দ্রকান্ত হঠাৎ গাম্ভীর্য ত্যাগ করে একটু হেসে বলেন, আমি যতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবো।

ঢং। সুনয়নী ঠোঁটটা টিপে একটু ভুরুর ভঙ্গিমা করলেন।

ঢং কেন? দেখছিলামই তো হাঁ করে।

আচ্ছা খুব ন্যাকামি হয়েছে। নাও নাও—ছিষ্টির কাজ পড়ে।

চন্দ্রকান্ত হাত বাড়িয়ে গেলাসটা নিয়ে বলে উঠলেন, নেহাৎ কম ভোরে তো ওঠো না, ভোরের আকাশটা একটু দেখতে ইচ্ছে করে না?

সুনয়নী আবার ভ্রূভঙ্গী করলেন, কী দেখতে ইচ্ছে করে না?

ভোরবেলার পূব আকাশ। সূর্যোদয়ের দৃশ্য।

সূর্যি ওঠার দৃশ্য! সুনয়নী একটু ঝংকার দিলেন, খেয়ে—দেয়ে তো কাজ নেই আমার, তাই ভোরবেলা তোমার মতন আকাশ পানে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকব! বলে ঘুম থেকে উঠে পর্যন্তই চর্কি—পাক!

আচ্ছা, এতো কি কাজ তোমাদের বলতে পারো?

চন্দ্রকান্ত গেলাসটা মুখে তুলতে গিয়েছিলেন, আবার নামিয়ে ধরে প্রায় হতাশ গলায় বলেন, এতোগুলি মেয়েছেলে তোমরা, সবাই শুনি সকাল থেকে চর্কি—পাক ঘোরো। সেই চর্কিটা কী?

কী? তাই এখন তোমায় বোঝাবো বসে? নাও নাও, খেয়ে নাও তো। গেলাসটা নিয়ে যাই। কোথায় নামিয়ে রাখবে, কে ঠোক্কর দেবে, হয়ে যাবে দফা গয়া।

পতিসেবার পুণ্যটি অর্জন করতে শখ, তার জন্যে একটু সময় দিতে রাজি নয়।

চন্দ্রকান্ত গেলাসটা খালি করে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন। নীলকান্ত উঠেছে?

এই এক শখ চন্দ্রকান্তর—ছেলের পুরো নামটা ধরে ডাকা।

কে নীলে? সুনয়নী ঠোঁট উল্টে বলেন, সে নইলে আর এই সাতসকালে উঠবে কে?

অন্যায়, খুব অন্যায়! একটু পরেই তো পণ্ডিতমশাই এসে যাবেন।

পণ্ডিতও তেমনি, ও ওঠে না দেখে নিজেও দেরি করে আসেন।

আশ্চর্য! বরং ঠিক সময় এসে ছাত্রকে লজ্জা দিয়ে শিক্ষা দেয়া উচিত।

সুনয়নী আর একবার ঠোঁট ওল্টান, হ্যাঁ, বিশ্বসুদ্ধু লোক যে তোমার মতন উচিতের পুঁথি হাতে নিয়ে বসে আছে।

গেলাসটা নিয়ে সুনয়নী চলে যান।

চন্দ্রকান্তর হঠাৎ মনে হয়, একদা সুনয়নীর ঠোঁটের গড়নটা কী সুকুমার ছিল! একটা বিশ্রী মুদ্রাদোষের জন্যে গড়নটাই বদলে গেছে।

শুধুই কি চোখ আর ঠোঁট?

মাথা থেকে পা অবধি সমস্ত গঠন—ভঙ্গিমাটাই কি ছিল না সুন্দর সুকুমার? ছিল। বড় সুন্দরই ছিল।

বৌ দেখে চন্দ্রকান্তর ঠাকুমাকে সবাই ধন্যি ধন্যি করেছিল, নাতবৌ এনেছ বটে চন্দরের ঠাকুমা, যেন সরস্বতী প্রতিমাখানি।

হ্যাঁ, ‘সরস্বতী প্রতিমাই’ বলেছিলেন সবাই, বাজার চলতি ‘লক্ষ্মী—প্রতিমা’ কথাটি ব্যবহার করেন নি।

নতুন কনের শাঁখের মত শাদা রঙের সঙ্গে নিখুঁৎ কাটছাঁটের মুখ আর পাতলা ছিপছিপে গড়ন। সরস্বতীর তুলনাই মনে আনিয়ে দিয়েছিল দর্শকদের।

এই ‘ধন্যি ধন্যি’ পড়ে যাওয়ার ধ্বনিটা সদ্য তরুণ অথবা প্রায়—কিশোর বরের কাছে এসে পৌঁছেছিল বৈকি। বাড়ির পাকাচোকা ছোট মেয়েগুলোর মারফৎ। মুখরাপ্রখরা বৌদি—স্থানীয়দের মারফৎ। নইলে আর কীভাবে হবে? বিয়েবাড়িতে গিন্নীরা যেখানে মহোৎসাহে একসঙ্গে মসগুল, বিয়ের বর তো সেখানের ত্রিসীমায় নেই।

বিয়ের বহুবিধ অনুষ্ঠানের মধ্যেকার নিজ ভূমিকাটুকু পালনের শেষেই তো বরের অন্তঃপুর—রঙ্গমঞ্চ হতে দ্রুত প্রস্থান।

তবু কানে এসে যাচ্ছে প্রায় সবই।

কম্পিত পুলকিত দুরূ—দুরূ বক্ষ বর গভীর হতাশার সঙ্গে ভেবেছে—আমায় কি আর একটু দেখতে দেবে? কী সব পুজোটুজো হয়ে গেলেই তো বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। লোকমুখে অবশ্য শুনেছে, বরকেও নাকি সেই সঙ্গে যেতে হয়, ‘জোড়ে’ না কি!…কিন্তু তাতে আর লাভটা কী হবে, ঘোমটাখোলা মুখটা তো আর দেখতে দেবে না কেউ।

বিয়ের রাত্রে ‘শুভদৃষ্টি’ নামের ব্যাপারটার সময় অবশ্য একটা সুযোগ হারিয়েছে। উপায় কী? সবাই মিলে বলেছিল, তাকাও তাকাও, তাকিয়ে দেখো। তাকা না তাকা একবার—তাকাতে হয়!…কিন্তু তাই আবার পারা যায় নাকি? মাথাখারাপ!

কনে কি করেছিল কে জানে, দু’হাতে একখানা আস্ত পানপাতা মুখে চাপা দিয়ে তো বসেছিল পিঁড়ি ঘোরাবার সময়। সে পান ফেলে দিয়ে ‘সুনয়নযুগল’ মেলে দেখেছিল কি! বর অন্তত তা জানে না। বর মুখও তোলেনি, চোখও খোলেনি।

কিন্তু নিজালয়ে এসে বৌয়ের রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে মনে হতে থাকল, আহা, তখন যদি একবার দেখে নিতাম।

‘ফুলশয্যে’ বলেও একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু তার পিছনে তো একটা গভীর ষড়যন্ত্রও ছিল। ক্ষুদে ভাগ্নী ‘মেন্তি’ চোখ মুখ ঘুরিয়ে চুপি চুপি একফাঁকে লাগিয়ে গিয়েছিল, ‘জানো ছোটমামা, ওরা না সব্বাই আড়ি পাতবে। তুমি যেন বোকার মত কনে মামীমার সঙ্গে কথা কয়ে বোসো না।’

অতএব সুযোগ জোটেনি।

কিন্তু পরে দেখা গেল, ‘ওরা’ অর্থাৎ কৌতূহলাক্রান্ত মহিলাকুল একেবারে অবিবেচক নয়। অষ্টমঙ্গলার আগের রাত্রে ওঁরা এমন একটি ঘরে বরকনের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন, যার কোনোদিক থেকেই আড়ি পাতবার উপযুক্ত গলতি জায়গা নেই। তেমন দুর্দান্ত কৌতূহল থাকলে আমবাগানের দিকে বাঁশের ভারা বেঁধে উঠতে হবে। অবশ্য এ—ব্যবস্থার বহিরঙ্গের দৃশ্যে এটাই প্রকাশ, বাড়িতে মেলাই অভ্যাগত তখনো মজুত, ঘরের অকুলান। অতএব কোণের দিকের ওই ছোট্ট মানুষ দুটোর জন্যে বরাদ্দ হোক।

বড় ঘরে জোড়া পালঙ্ক ফুলশয্যা তো হয়ে গেছে।

পরেও কিন্তু জানলার সংখ্যায় দীন সেই ছোট্ট ঘরটাই অনেকদিন পর্যন্ত বাড়ির ছোট ছেলে—বৌয়ের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল।… তা প্রথম সেই ঘরটায় ঠাঁই পেয়ে বর যখন বাড়ির দিকে সবটাই চাপা দেখেছিল, তখন কৃতার্থ হয়ে বৌয়ের কাছাকাছি খাটের একধারে বসে অনেকক্ষণ ঘামার পর বুকে জোর নিয়ে বলে ফেলেছিল, একটু ছোঁব তোমায়?

এ—প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে কনের ঘোমটা সরে গিয়েছিল আর তার সুগঠিত সুকুমার ঠোঁটটা উল্টে গিয়েছিল। কিন্তু শুধুই কি উল্টে গিয়েছিল? সেই ঠোঁটজোড়া থেকে একটি তিনাক্ষরযুক্ত কথা বেরিয়ে আসেনি? …হ্যাঁ, স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিল বর—

‘মরণ।’

সেই প্রথম ছন্দপতন।

বাড়িতে ছোট মেয়ে অনেক আছে, তারাও কম পাকাটে নয়। হয়তো চন্দ্রকান্তর নিজের ভাগ্নী—ভাইঝিরাই এরকম শব্দ ব্যবহার করে থাকে।…চন্দ্রকান্তর ছোটমাসির মেয়ে তো (কতই বা বয়েস তার, সুনয়নীর থেকে এমন কিছু না) কথায় কথায় বলে, ‘গলায় দড়ি আমার।’

চন্দ্রকান্তর কানে এলেই কানে বাজে, কিন্তু এমন প্রাণে বাজেনি কোনোদিন।

মাসতুতো বোনকে তবু বকা যায়। বলা যায়, এই এমন গিন্নীদের মতন বিচ্ছিরি করে কথা বলিস কেন?

কিন্তু এই সর্বালংকার—ভূষিতা সরস্বতী প্রতিমাকে কি বকা যায়? শুধু নিজেই মলিন হওয়া যায় মাত্র।

ঘরে আলোর মধ্যে দেয়ালে—লাগানো একটা ‘দেয়ালগিরি।’ কেরোসিনের আলো, পলতে বাড়ালে দিব্যি আলোই হবে। কিন্তু পলতে কমানো ছিল। তাই একটা আবছা আবছা আলো। সেই আলোয় ওই মেয়েকে যেন পরীর দেশের রাণীর মত দেখতে লাগছে। বিগলিত ‘চন্দর’ বিচলিত চিত্তে ভাবে, এই মুখ থেকে অমন বিচ্ছিরি একটা কথা বেরোলো কী করে?

তারপর ভাবল, গিন্নীদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে বোধহয়, তাতেই এই বিশ্রী অভ্যাস। সেরে যাবে। এ—বাড়িতেও যে গিন্নীদের সঙ্গেই ঘুরবে একথা তখন মনে পড়ল না।…

একটুক্ষণ পরে মনের মলিনতা ঝেড়ে ফেলে বলল, আলোটা একটু বাড়িয়ে দেব?

কেন? আলো বাড়িয়ে কী সগগো লাভ হবে?

যদিও এটাও ছন্দের আর ধাপ পতন, তবু ছেলেটা একটু সাহসী হয়ে উঠেছে। তাই বলে ফেলে—তোমায় একটু বেশী করে দেখব।

বলার পরক্ষণেই একটুকরো হাসি ছিটকে উঠল সেই ললিত লাবণ্যময় সুকুমার ঠোঁটটা থেকে।…

হাসিটার জাত কী, সেটা অনুধাবন করবার সময় নেই, হাসিটাই তো পরম প্রাপ্তি। কৃতার্থমন্য বর খাট থেকে নেমে পড়ে দেয়ালের দিকে এগিয়ে যায় হাতটা বাড়িয়ে। কিন্তু সে তো মুহূর্তমাত্র।… আলোর দিকে বাড়ানো মনটা আর হাতটা ফিরে এল নিজের মধ্যে।

ওই হাসির টুকরোটার সঙ্গে যে একটা কথার টুকরোও ছিটকে উঠে ঢিলের মত এসে লাগল—সঙ না পাগল!

খাটের একধারে নিজের জন্যে নির্দিষ্ট বালিশটায় মাথা গুঁজে ছেলেটা সেই যে শুয়ে পড়ল কনের দিকে পিঠ করে, সারা রাত্তিরের মধ্যে আর নড়ল চড়ল না।

বেশ কিছুক্ষণ যাকে বলে অলংকার শিঞ্জিনী, তা কানে আসতে থাকল। অস্বস্তিও হতে থাকল। মনে হতে থাকল, এতো নড়ছে কেন? ছারপোকা কামড়াচ্ছে? কই আমায় তো কামড়াচ্ছে না!…আসলে অন্য বাড়ির বিছানায় ঘুম আসছে না, এরকম হয় অনেকের। কে জানে, ওদের বাড়ির বিছানা হয়তো বেশী নরম।…কে জানে, মায়ের কাছে শোওয়া অভ্যাস কিনা!

কনের নড়া চড়ার শব্দে এমন অনেক প্রশ্নই মাথায় এলো, কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করবার সাহস হল না। কি জানি ঠকাস কী উত্তর আসবে পাথরের টুকরোর মত, অথবা পাথুরে ঢিলের মত।

পরদিন যে কোথায় কী ঘটনা ঘটল কে জানে। কোনো একসময় পিসতুতো বড়দিদি পদ্মলতা চুপি চুপি জিগ্যেস করে বসল, হ্যাঁরে চন্দর—কাল বউয়ের সঙ্গে কথা কসনি? কেঁদে কেঁদে মরছে।

চন্দ্রকান্ত প্রথমে শাদা হয়ে গেলো, তারপর নীল হলো, অতঃপর লাল হলো।

কেন কথা কসনি, কেন? বল?

বহুকষ্টে উত্তরটা আদায় করতে পারল দিদি। বাঃ! কী কথা কইবো?

পদ্মলতা বড়দিদি হলে কি হবে? বড় ফাজিল মেয়ে।

চন্দ্রকান্তর উত্তর শুনে মুখকে অমায়িক আর বিস্ময়াহত করে বলল, ওমা! তোদের ইস্কুলে পড়ায় নি, কী কথা কইতে হয় বৌয়ের সঙ্গে! মাষ্টার শেখায় নি?

আঃ! ধ্যেৎ!…

বলে পালিয়েছিল বর, কিন্তু অতঃপর মনের মধ্যে এক নতুন ছন্দের করুণ রাগিনী অনাহত সুরে বেজেই চলেছিল। …বৌ কেঁদে কেঁদে মরছে…বৌ কেঁদে কেঁদে মরছে…বৌ…বৌ…কেমন দেখায় সেই পরীকে কাঁদলে? কেমন দেখাচ্ছে? চন্দর কি দেখতে পাবে না একবার? কেন? চন্দর কি কেউ নয়?…বৌকে তোমরা পেতে কোথায়, যদি চন্দর টোপর ফোপর পরে গিয়ে খেটে খুটে নিয়ে না আসতো? এখন আর চন্দরের কোনো অধিকারই নেই।

কান্না মুখটা দেখতে কেমন এটা ভাবতে ভাবতে নিজেই প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠেছিল বর। আর নিজেকে নিজে ঠাশ ঠাশ করে চড়াতে ইচ্ছে হয়েছিল। এমন বোকা আমি, এমন বুদ্ধু আমি! বাড়ি সুদ্দু সবাই জানল, আমার অবহেলায় বৌ বেচারী কেঁদে কেঁদে মরছে।…আর কি কখনো ওরা আমাকে বৌয়ের ঘরে ঢুকতে দেবে? কক্ষনো দেবে না। দোষ শুধরে নেবার সুযোগ আর পাবো না। আমার ভাগ্য!

তা সত্যি চন্দরের ভাগ্যে সে দোষ শুধরে নেবার সুযোগ আর জুটল না। নাটকের পরবর্তী দৃশ্যে দেখা গেল বৌ হি হি করে হাসছে। চড়বড়িয়ে কথা বলছে।

না, অনেক দিন পরে নয়, সেই দিনই।

সেই দিনই তো অষ্টমঙ্গলায় জোড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া। সেখানে কান্নার প্রশ্ন কোথায়? নিজ ভূমিতে এসে তো নিজমূর্তি। বৈঠকখানা বাড়ি থেকেই শোনা যাচ্ছে, বৌ তা সদ্য শ্বশুরবাড়িবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোথায় কার সঙ্গে যেন হি হি করছে।

সখীদের সঙ্গে? না, মা পিসিদের সঙ্গে?

সখীদের সঙ্গে হলেই তো হয়েছে আর কি। নির্ঘাৎ সেই গত রাত্তিরের বরের কথা না বলার ইতিহাস ব্যক্ত করবে। সখীরা কি তাহলে চন্দরকে আস্ত রাখবে?

নাঃ, বোধহয় মা পিসির সঙ্গেই। একজন গিন্নীর গলা শুনতে পাওয়া গেল, গলা ছেড়ে কত হি হি করছিস? বাড়িতে জামাই রয়েছেন না?

কিন্তু তারপর ওর তো হি হি—টা বাড়লো বই কমল না।

রয়েছে তো রয়েছে, কী করবে আমায়? ফাঁসি দেবে?

হঠাৎ এতোকাল পরে সেই বেপরোয়া গলার প্রশ্নবেশী মন্তব্যটা যেন স্পষ্টই শুনতে পেলেন চন্দ্রকান্ত।

ফাঁসি শব্দটা ফাঁস থেকেই না?

তেরোদশী কখন ছাড়বে একবার দ্যাখ তো চন্দর—

কোথায় যেন একটা মিহি জালের নরম বুনুনির উপর একটা ঢিল এসে লাগল।

পাশের দেয়ালের কুলুঙ্গি থেকে পঞ্জিকাখানা পেড়ে নিয়ে উল্টে দেখে বলেন, তেরোদশী? তেরোদশী—তেরোদশী—তেরোদশী—ছাড়ছে বেলা তিনটেয়।

মরেছে। পিসি ব্যাজার গলায় বলে ওঠেন, তার মানে চৌপর বেলা গড়িয়ে সেই বিকেল বেলায় গেলন।

গেলন!

কী কুশ্রী, কী কুৎসিত শব্দ। শব্দটার ধাক্কায় যেন সকালের এই নির্মল আকাশটা ঘোলাটে হয়ে গেল। কিন্তু শব্দটা কি জীবনে এই প্রথম শুনলেন চন্দ্রকান্ত? আজীবনই তো শুনে আসছেন। আশৈশব। জেঠি পিসি সেজখুড়িদের মুখে। ওদের জীবনটা যে কত মূল্যহীন, কত ধিকৃত, সেইটা বোঝাবার জন্যেই ওঁরা নিজেদের সম্পর্কে এরকম অবজ্ঞেয় উক্তি করে থাকেন। বিশেষ করে পিসি। নাকি জ্ঞানোন্মেষের আগেই বিধবা হয়ে বসে আছেন।

পিসি নিরিমিষ ঘরের রান্না করতে যাবার সময় স্বচ্ছন্দে বলেন, বেলা গড়ালে, যাই পিণ্ডি চড়াইগে।…বাগদি বৌ—কে কদাচ কখনো যদি একখানা কাপড় কাচতে দেন তো বলেন, বৌ আমার ন্যাকড়াখানা সেদ্ধ করা আছে, ঘাট থেকে একটু ডুবিয়ে এনে মেলে দে তো—।

আর মাঝে মাঝে ওই গেলনের মাত্রা একটু বেশী করে ফেলে রোগ বাধিয়ে বলেন, চন্দর তোর ওই হোমো—পাখির দানা মানা দুটো দে দিকিন—পেটটা কেমন গুলোচছে। …জানি নিষিন্দে পাতা যমে ছোঁয় না, তবু গেরস্তকে পাছে ভোগাই তাই—

অসুখ করেছে একটু ওষুধ দে—না বলে এতো সব বিশ্রী কথা।

চন্দ্রকান্তর অভ্যস্ত কানও মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে। বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন? বিকেলবেলাই বা গেলেন কেন?

শোনো কথা। কেন—সে কথা জানিস নে তুই? তেরোদশী না ছাড়লে বেগুন চলবে?

চন্দ্রকান্ত তবু বলে ওঠেন, তা বেগুনটা বাদ দিয়ে সময়ে খেয়ে নেওয়া যায় না?

পিসি কদমছাঁট মাথাটায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে খটখটিয়ে বলেন, বেগুন বাদ দেবো? শোনো কথা। বেগুন ছাড়া চচ্চড়ি জমবে? সুক্ত জমবে? ঝালের ঝোলটি জম্পেস হবে? কথাতেই বলে বিধবার বড়ি বেগুনের ঝোল—।

ইহ—সংসারে আর কোনো রান্না নেই? আর কোনো আনাজ নেই?

থাম বাবা।

পিসির মুখে একটা উপহাসের হাসি ফুটে ওঠে। যেন একটা অর্বাচীনের কথা শুনলেন।

দু—ঘণ্টা আগে গিলে কি চারখানা হাত পা বেরোবে?…যাই ভালই হলো, পিণ্ডি সেদ্ধর আগে ধোঁয়া উনুনে চারটি মুগ কড়াই ভেজে নেওয়া যাবে।

চলে যান পিসি বকের মত পা ফেলে ফেলে।

আবার একটু বসে থাকেন চন্দ্রকান্ত।

আকাশের সেই বর্ণচ্ছটা অন্তর্হিত। সাদা রোদ্দুর দালানের দেয়ালে এসে পড়েছে। উঠে পড়লেন।

নীচের তলায় নেমে এলেন।

নেমে এসেই থমকে যেতে হল, কোথা থেকে যেন সেজখুড়ির চাপা ক্রুদ্ধস্বর উচ্চারিত হতে শোনা গেল, খবরদার। টুঁ শব্দটি না। এ কথা যদি চন্দরের কানে ওঠে, তোমায় আমি বঁটিকাটা করবো।

কোথা থেকে এলো কথাটা! সিঁড়ির তলার চোরকুঠুরি থেকে কি? দুদিকে দেয়াল চাপা সিঁড়িতে তো চোরকুঠুরি একটা থাকেই। চোরকুঠুরি আর চিলেকোঠা—এ দুটো তো সিঁড়ির সঙ্গে উপরি পাওনা।

সে যাক, কী এই কথা? যা চন্দরের কানে ওঠার এতো ভয়, চন্দরের কানে ওঠানোয় বঁটি—কাটা করার মতো শাস্তি ঘোষণা। কারই বা কথা? কার সঙ্গে চন্দ্রকান্তর বিশেষ কোনো যোগসূত্র আছে!

সেজখুড়িরই গলা কি?

না, বাড়িতে আরো কেউ এসেছে টেসেছে? দিনের অধিকাংশ সময়ই তো সেজখুড়ি শুচিবাইয়ের ধান্ধায় অতিবাহিত করেন। সংসারে কারো সঙ্গেই তো তেমন প্রত্যক্ষ যোগ নেই। ওনাদের পিণ্ডি সেদ্দর হেঁশেলে ওঁর কোনো কাজ নেন না পিসি ওনার হাতে পায়ে হাজা বলে। তাছাড়া সর্বত্র গোবরজল ছিটিয়ে ছিটিয়ে এমন বদভ্যাস হয়ে গেছে যে, খাবার জিনিসেও সেটা চালান করে বসে। জল গোবর না হোক নিদেন পক্ষে শুকনো ঘুঁটের গুঁড়ো। খাবার জলের কলসীর মধ্যে, ঘন দুধের কড়ার মধ্যে থেকে প্রায়শঃই জিনিসটা আবিষ্কার হয়। তখনই ব্যাপারটা পুরুষমহলেরও কানে উঠে পড়ে। পিসি তো আর ছেড়ে কথা কইবার মেয়ে নয়, আর জেঠিও ছোট জায়ের প্রতি এতো মমতাময়ী নয়। হৈ চৈতে বাড়ি ভরে যায়।

সেজখুড়ি অবশ্য তাতে খুব দমেন না, তর্ক চালান। বলেন, তা গেলেই বা পেটে একটু গোবর, মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? রাত্তিরদিনই তো পাপপাতক করা হচ্ছে সংসারে, ফোঁকটে যদি প্রাচিত্তির হয়ে যায়, মন্দটা কী?

সেই সেজখুড়ি হঠাৎ নিজে এতো বড় একখানা পাপ সংকল্প ঘোষণা করলেন। আশ্চর্য বৈকি! বঁটিকাটা করবার ভীতি প্রদর্শন। পাপ বলা যায় না? নাঃ, বোধহয় আর কেউ। উনি তো এ সময় উঠোনে গোবর—গোলা ছিটিয়ে বেড়ান।

কিন্তু কী সেই ঘটনা, যা চন্দরের কানে ওঠা সম্বন্ধেই সাবধানতা? মন থেকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করতে করতে চলে এলেন আমিষ রান্নাঘরের দিকের রোয়াকে। এখানেও তো কোনো বৈলক্ষণ নেই। এ ঘরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সুনয়নী যথারীতিই নিজাসনে বিরাজমান।

কাঠের উনুনে সবে আঁচ পড়েছে। ঘর ধোঁয়ায় ভর্তি, সুনয়নী সেই ধোঁয়ার অন্তরালেই কী যেন করছেন।

চন্দ্রকান্ত এদিকে ওদিকে তাকালেন। না, ধারে—কাছে পিসি নেই, ছোটখুড়িও নেই। সেজখুড়ি তো থাকবেনই না।। অতএব নির্ভয়। চল্লিশোত্তীর্ণ চন্দ্রকান্ত এটি দেখে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে তবে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে আসেন। দরজার কাছে আসতেই ধোঁয়ার ধাক্কা। তাড়াতাড়ি চোখ বুজে ফেলে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠলেন, এতো ধোঁয়ার মধ্যে কেন? বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো।

আহা, সুনয়নী তো বললেও বলতে পারতেন, রন্ধনশালাতে যাই, তুঁয়া বঁধু গুণ গাই, ধূয়ার ছলনা করি কাঁদি—

কবি গ্রন্থকার বৈষ্ণব সাহিত্য রসে রসিক পণ্ডিত চন্দ্রকান্ত গুপ্তর সহধর্মিণীর উপযুক্তই হত সেটা। কিন্তু তাতো হবার নয়। হবেই বা কেন? ক’জনের ভাগ্যে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ঘটনার ফসল ফলে? ধোঁয়ার আড়াল থেকে সুনয়নীর ঈষৎ ব্যঙ্গরসাশ্রিত চাঁচাছোঁলা কণ্ঠ উচ্চকিত হলো, জন্ম গেল ছেলে খেয়ে, আজ বলছে ডানা। তুমি আবার কী করতে ধোঁয়ায় এলে? সরো সরো, সরে যাও।

সরেই এলেন চন্দ্রকান্ত।

জানেন আর বলা বৃথা। চেনেন তো সুনয়নীকে। দেখে আসছেন দীর্ঘকাল। যতদূর নয়, ততদূর একজেদি এক—বগগা। অথচ গিন্নী মহলে সুখ্যাতির শেষ নেই। ছোটবৌমা বলতে সবাই অজ্ঞান। ছোটবৌমার মতন লক্ষ্মী মেয়ে নাকি ভূভারতে দুটি নেই।

আরো তো সব বৌ আছে, এক দেয়ালেই ঘর, পার্টিশানের ওপারে বসবাস, বড় জেঠির বৌ—রা, (যাদের সূত্রে সুনয়নী শ্বশুর শাশুড়ীর একমাত্র ছেলের বৌ হয়েও ছোট বৌ) তাদের নিন্দেয় নাকি কান পাতা ভার।

চন্দ্রকান্তর কান নাকি কাছিমের চামড়ায় ঢাকা, অন্তত সুনয়নীর তাই মত। তবু ওই সব নিন্দে—সুখ্যাতি মাঝে মাঝে কানে এসে ঢুকে যায়। ও বাড়ির ওই বড়বৌ, মেজবৌ, সেজবৌ—রা নাকি স্বার্থপর, গতর—কুঁড়ে, নিজের ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো মাখানো নিয়েই বিভোর, আর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সংসারের আর কারো দিকে তাকিয়ে দেখে না।

মাঝে মাঝেই এসব কানে আসে, পিসিই তোলেন কানে এবং ওদের মুণ্ডুপাত ক’রে পরিশেষে ছোটবৌমার গুণের ব্যাখ্যায় পঞ্চমুখ হন। শুনে চন্দ্রকান্ত পুলকিত হবেন, এই ভেবেই কি তাঁকে শুনিয়ে বলেন? হয়তো সেটাই একটা কারণ, আবার গভীর গোপন আরও কারণ বিদ্যমান। কিন্তু চন্দ্রকান্ত কি পুলকিত হন? চন্দ্রকান্তর কি মনে হয় না—অনেকখানি দাম দিয়ে এই সুখ্যাতিটুকু কিনছে নির্বোধ ছোটবৌ। তার বোধহীনতার সুযোগ নিয়ে সবাই তাকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে। চন্দ্রকান্ত যাই ভাবুন, সুনয়নীর বড় সুনাম।

সধবা হয়েও বিধবা গিন্নীদের পদ্ধতিতে নিজের সম্পর্কে তুচ্ছ—তাচ্ছিল্য দেখায় বলেই কি সুনয়নীর গিন্নীমহলে এতো প্রতিষ্ঠা? বৌ বটে ছোট বৌমা। ভূভারতে এমন রূপে গুণে আলো করা বৌ আর দুটি দেখবে না।

এই তাঁদের অভিমত।

এই অভিমতের সঙ্গে যোগ হয় ‘লোকের বাড়ির বৌ ঝি এসে দেখে শিখে যাক। শরীরকে শরীর বলতে জানে না। আমার আমার বলতে জানে না, সাজগোজের দিক দিয়ে হাঁটে না। এমন নইলে মেয়েমানুষ।’

বলতেই হবে, এইগুলোই যদি ‘আদর্শ নারী’র গুণ হয়, তো সুনয়নী সে আদর্শে ফার্ষ্ট ক্লাশ ফার্ষ্ট।

সুনয়নীর ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে না, অসুখ করলে কষ্ট হয় না, শীতে শীত করে না, গরমে গরম হয় না, উপোসে পিত্তি পড়ে না, খাবার বেলা পার হয়ে গেলেও খিদে পায় না—এবং সুনয়নীর দিনান্তে একবারও বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। অবকাশ হলেই সুনয়নী বাড়তি কাজ আবিষ্কার করে নিয়ে হাত চালাতে বসে।

কেউ অনুযোগ করলে বলে, দিনের বেলা গা গড়ালে রক্ষে আছে? রাতে ঘুম হবে না। হবে কি হবে না, তার সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে যাচ্ছে কে?

সুনয়নী যে দিনান্তে অপরাহ্ণ বেলায় একবার আর্শি চিরুনী নিয়ে বসেন, সেটা কেবলমাত্র ‘এয়ো—স্ত্রী’র এয়োত্ব রক্ষার্থে, প্রসাধনার্থে নয়।—সুনয়নী যে ভাতের পাতে মাছটুকু নিয়ে বসে, সেই নেহাত পতির মঙ্গলার্থে, জিভের আস্বাদে নয়। সেটা যে নয়, তা বোঝা যায়, অনেক বেশী মজুত থাকতেও, সুনয়নী মাছের কাঁটা চোপড়া কি চুনো মৌরলা রাখবে নিজের জন্যে।—সর্বোপরি রোগ—ব্যাধি হলে সুনয়নী ওষুধ খেতে রাজী হন না, ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেন, গলায় দড়ি আমার, এইটুকুতেই ওষুধ গিলে মরবো? আগে মরণের রোগ আসুক।—নিজেকে এত অগ্রাহ্য!—এ বৌ—ও যদি ‘পাশের ওপর জলপাণি’ না পায় তো পাবে কে?

এরকম অনেক কিছুই জানা হয়ে গেছে চন্দ্রকান্তর, অতএব বুঝে ফেলেছেন আর ছারা নেই। তবে ভেবে আশ্চর্য হন, দোষগুলো গুণের পর‍্যায়ে উঠে গেছে কোন নীতিশাস্ত্রে? চন্দ্রকান্তর তো মনে হয়, সুনয়নীর মত জেদি, অবাধ্য, অনমনীয় মেয়ে তিনি কম দেখেছেন। কি জানি আদৌ দেখেছেন কিনা!…প্রায়শঃই মনে মনে বলেন চন্দ্রকান্ত, বড় বেশী দাম দিয়ে বড় তুচ্ছ একটা মাল কিনেছ ছোট বৌ। মনে করছ—ভারী, মজবুত, চিরস্থায়ী। দেখো, এতোটুকু অসাবধান হয়েছ কি ভেঙে টুকরো টুকরো।

সারাজীবন সাবধানে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বুকে করে বয়ে নিয়ে চলেছ, বুঝতে পারছ না—কিসের বদলে কী বিকোচ্ছ।

চিরদিন একান্ত সন্নিকটে থেকেও চন্দ্রকান্ত এই অপচয়িত জীবনের একটি নিরুপায় দর্শকমাত্র।

‘সন্নিকটে’ কিন্তু নিকটে কি?

তবু চন্দ্রকান্ত ছাড়া আর কার হিসেবের খাতায় এই অগাধ অপচয়ের হিসাবটা লেখা হয়ে চলেছে?

অধ্যায় ১ / ১২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন