সূর্যোদয় – ৭

আশাপূর্ণা দেবী

সাত

চন্দ্রকান্ত যখন ও—বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বন্ধুর সঙ্গে বিশ্রামালাপে রত, তখন এ—বাড়িতে মহিলা মহলে এক উত্তপ্ত উত্তেজনার চাষ চলছে।…বাড়ির সকলে তো বটেই, উঠোনের মধ্যবর্তী পাঁচিলতোলা তালাবন্ধ দরজা খুলে ফেলে জ্যাঠতুতোরা সবাই এসে জড়ো হয়েছেন এবং সবাইকে জেরা করছেন।

অথর্ব বড় জ্যেঠি প্রাচীরের ওধার থেকে ভাঙা গলায় চেঁচাচ্ছেন, কী হয়েছে আমায় একবার বলে যাবি তো তোরা? হারামজাদিরা, অ নক্কীছাড়া মেয়েমানুষরা, হৈ চৈ করে বেরিয়ে গেলি, ভাবচিস না যে একবার বুড়িটা আটকাটিয়ে মরবে।

কিন্তু সেদিকে কারো কান নেই।

এখানে জেরাকর্ত্রীর প্রধান হচ্ছেন গুপ্তদের বড়বৌ। অশ্রুমতী যাঁর বোনঝি। টেঁপির মার চীৎকার তাঁর কানেই আগে পৌঁছেছিল।

জলে ডুবে গিয়েও ডুব জল থেকে উঠে আসা অশ্রুমতী দাওয়ার ধারে শুধু একখানা মাদুরে শুয়ে আছে, কারণ তাকে শুকনো একখানা কাপড় পরানো হলেও গা মাথা মোছানো যায় নি, ভিজে চুলের রাশি থেকে জল ঝরছে, কাজেই বালিশ বিছানায় শোওয়াবার প্রশ্ন ওঠেনি। অশ্রুমতীর চোখ দিয়ে যে পরিমাণ অশ্রুধারা নির্গত হচ্ছে, জমিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে তাতেও ডুবে মরতে পারতো অশ্রুমতী। জমিয়ে রাখা হচ্ছে না এই যা।

কিন্তু অশ্রুমতী তো কিছুতেই স্বীকার করছে না, সে ডুবে মরতে গেয়েছিল। কেন তা যাবে? তার এতো সুখের শ্বশুরবাড়ি, এতো সুখের জীবন, মরতে যাবে কী দুঃখে? হঠাৎ পা পিছলে গিয়ে—

এদিকে টেঁপির মা বিপরীত সাক্ষ্যে মুখর।

হঠাৎ পা পিচলে? বললেই হল? শ্যাওলা নাই, দাম নাই, খটখটি ঘাট, আমি বুড়ি পাঁজা পাঁজা বাসন নে যেতেচি, আসতেছি, পা পিচলোচছে না, আর তুমি তেজপাতা হেন মেয়ে অমনি হঠাৎ পা পেচলালো?…বলি হঠাৎ পা পেচলাতে মানুষ ভরদুকুরে হাতের উলি, গলার হার খুলে থুয়ে চোরের মতন চুপিসাড়ে ইদিক উদিক চাইতে চাইতে ঘাটে আসে? হাতে শুধু শাঁখা, গলা খালি। অতএব মেয়েমানুষ, তুমি সোয়ামী শাউরির হাতে দড়ি দেওয়াতে এই মতলব ভেঁজেছিলে?

অশ্রুমতী অশ্রুর সাগরে ভাসে। খুলে রেখে যাবে কেন? হার বালা খুলে সাজিমাটি দিয়ে পরিষ্কার করছিল, সেই জন্যেই অসময়ে ঘাটে আসা। তা হাত ফসকে গয়না দুটো গেল জলে পড়ে, তাতেই না তাড়াতাড়ি জলের মধ্যে নেমে যাচ্ছিল, আর সেটা তুলতে গিয়েই—

কিন্তু এতগুলো জেরার মুখের সামনে অশ্রুমতী নামের মেয়েটা কি বটবৃক্ষের মত স্থির থাকবে? শুকনো খড়ের মত উড়ে যাবে না?

হাত ফসকে পড়ে গেল?

গেল তো গেল কোথায়? পুকুর তো তোলপাড় করল টেঁপির বাপ আর তার ভাগ্নে।…যারা টেঁপির মার পরিত্রাহি চীৎকারে মাঠ থেকে ছুটে এসে অশ্রুমতীকে জল থেকে টেনে তুলে ছিল।

ভবতারিণী তাদের দুজনকে তৎক্ষণাৎ নগদ একটা করে টাকা বখশিস দিয়েছেন এবং অশ্রুমতীর জবানবন্দীটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করছেন। চোখও টিপেছেন আরো কিছু দেবেন বলে, কিন্তু অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরা এতোবড় সমারোহময় নাটকের এমন ঝুলে পড়া পরিসমাপ্তি দেখতে রাজী হবে কেন? তাছাড়া আসল প্রত্যক্ষদর্শী টেঁপির মা। যে আগাগোড়া জলজেয়ন্ত চোক চেয়ে দেকেচে।

বাসনের পাঁজা ঘাটে ভিজিয়ে ঘাটের ওপাশটায় নারকেল গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল বটে বেচারী, কিন্তু চোখ তো ঘাটেই ছিল বাসনগুলোকে পাহারা দিতে।…সে দেখল না—চোরের মত ইদিক উদিক তাকাতে তাকাতে নতুন বৌদি ঘাটে নামল! গহোনা মেজেচে না হাতী। এসেই তো নেবে গেল।…আমি বলি কী না কি! কিন্তুক চোক আমি নড়াইনি, ভাব গতিক দেকে সন্দ লাগল, তা পরে দেকি ডুব দে আর ওটে না। ত্যাখন না চীচকার মিচকার করনু। ওনারা যাই মাটে ছেলো—

এতোখানি বাহাদুরীর লোভ ছেড়ে দেবে সে?

আচ্ছা তা হলে গহণা দুটো? ডুবে মরার মতলবে যদি খুলেই রেখে দিয়ে থাকে তো ঘরে আছে। …ঘোষণা করলেন ভবতারিণী, খুঁজুক তালে সেজগিন্নী।

সেজগিন্নী ঝেড়ে জবাব দেন, কোতায় কোন আঁদাড়ে লুকিয়ে রেকে থুয়েচে, আমি খুঁজতে যাবো কোতায়? রেকেচে কি সেই শুকনোচণ্ডী ভাইটার হাত দে পাচার করেচে তাই বা কে জানে? আসে তো সেটা মাজে মাজে।

ওদিকে অশ্রুমতীর যে মাসি উঁকি মেরেও দেখেন না কোনো দিন, সে—ই দিদির উদ্দেশে বিলাপ করতে করতে অশ্রুমতীর ভিজে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতির পটভূমিকায় নীলকান্ত ইস্কুল থেকে এসে দাঁড়িয়েই বলল, বাবা আসছে গৌরকাকার বাড়ি থেকে। দেখতে পেলাম।

দেড় ক্রোশ পথ ভেঙে ইস্কুলে যেতে হয়। যেতে আসতে তিনক্রোশ। গ্রামের মধ্যে তো ইস্কুল নেই। তা কটা ছেলেই আর প্রত্যহ এতো ব্যাগার খাটতে চায়? নীলকান্ত ও তার সম্প্রদায় বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে ও পকেটে নাড়ু মোয়া নিয়ে বেরোয়, খুব খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটি জায়গা নির্বাচন করে জমিয়ে বসে।…লোকের বাগানের ফল পাকড় দেখতে পেলে তার সদ্ব্যবহার করে, ঢিল মেরে মেরে কাঁচা আম পাড়ে, পেন্সিলকাটা ছুরিটা দিয়ে কেটে নুন দিয়ে ওগুলো খায়, অবশেষে আন্দাজ মত সময়ে বইখাতা গুছিয়ে তুলে বাড়ি ফেরে।… যথাসময়ে ক্লাসে উঠলে এতোদিনে এন্ট্রান্স পাশ করে কলেজে পড়তে যেতে পারতো নীলকান্ত, কিন্তু বছর দু’বছরে এক একবার ক্লাশে ওঠে সে।…অথচ চন্দ্রকান্তও ছাড়বেন না। শশীকান্তর স্নেহময়ী জননীর মত নীলকান্তর জননীও বলেছিলেন, ওর দ্বারা হবে না বাপু, ওকে ছাড়ান দাও। একটা মাত্তর তো ছেলে, কত খাবে? তোমার যা খুদকুঁড়ো আছে, তাতে ওর জীবনটা কাটবে না?

চন্দ্রকান্ত কথা বলেন না, শুধু গভীর তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছিলেন। অতঃপর আর কিছু বলেন নি সুনয়নী।…শুধু ছেলে যখন রোদে ঘেমে এসে দাঁড়ায়, তখন গামছা দিয়ে ছেলের মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে তার বাপের নিষ্ঠুরতা নিয়ে আক্ষেপ করেন।

আজ আর সুনয়নীর হাতে গামছা নেই, ছেলের জন্যে শুকনো কুলভিজের শরবৎ করাও নেই। সুনয়নী আধ ঘোমটা টেনে গিন্নীদের পিঠের আড়ালে বসে আছেন।…নীলকান্ত আসতেই চুপি চুপি ভবতারিণীকে বলে উঠে যান। চলে যান ছেলেকে নিয়ে দোতলায়।

নীচেরতলার দৃশ্যটা দেখে নীলকান্ত হকচকিয়ে উঠে এসেছে ইস্কুলের জামাকাপড় ছাড়তে। দোতলায় সিঁড়ির পাশে একটা অচ্ছুৎ আলনা আছে, তাতে ওই অচ্ছুৎ জামা কাপড় ছেড়ে ভিজে গামছা পরে তবে কাচা আলনায় হাত দিতে হয়।…আজ তাকে সে সময় না দিয়েই সুনয়নী উঠে এসে তাড়াতাড়ি সংক্ষেপে যা হোক কিছু বোঝান।…ভবতারিণীর নির্দেশিত কথাই বলেন, পা পিছলে ডুবে গেছল নতুন খুড়ি। ভাগ্যে টেঁপির মা দেখতে পেয়েছিল।

কিন্তু চন্দ্রকান্তর কাছে প্রকৃত কথাটি বলবার জন্য প্রাণ অস্থির হচ্ছে। এমন একটা নাটকীয় ঘটনা না বলে পারা যায়?

দোতলাতেই অপেক্ষা করতে হবে, নইলে তো নির্জনে পাওয়া যাবে না স্বামীকে। অতএব প্রকাণ্ড দালানটা ঝাঁটা দিয়ে সাফ করতে বসেন সুনয়নী। একটা উপলক্ষ না হলে চলবে কেন? বরের অপেক্ষায় বসে আছি? ছি ছি। কেউ বুঝতে পারলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে না?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন