আশাপূর্ণা দেবী
ভিতর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বার বাড়ির দিকে আসছেন, দেখতে পেলেন, শশীকান্ত পাশ দরজা দিয়ে বাইরে থেকে ঢুকে আসছে।
চন্দ্রকান্তর চোখে চোখ পড়তেই সাঁ করে ভিতরে ঢুকে যাবার তাল করেও কেমন থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সাঁ করে যাবেই বা কী করে?
শশীকান্তর পরণে সপসপে ভিজে ধুতি, মাথার চুল থেকে জল ঝরছে, কাঁধে একটা ভিজে ফতুয়া গামছার মত লম্বমান। তার থেকেও জল ঝরছে।
দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা ‘স্নান’ নয়, নেহাতই সবস্ত্রে ডুব মাত্র। হঠাৎ এর কী প্রয়োজন ঘটল?
চন্দ্রকান্তর কণ্ঠস্বরে বিস্ময়, কী ব্যাপার শশী? এ সময় এভাবে?
শশী নামক ব্যক্তিটি বিশ্বসংসারে যদি কাউকে ভয় করে থাকে তো সে ব্যক্তি ভূতও নয়, ভগবানও নয়, মাত্র ছোড়দা। বড়দা মেজদাদের সামনে তো হাত আড়াল দিয়ে তামাক খায় শশী, কিন্তু ছোড়দা? সাক্ষাৎ যমসদৃশ।
তা উপার্জনে অক্ষম অপদার্থ শশীর ভাগ্যটাও এমন মন্দ, আশ্রয় জুটেছে এই যমেরই কাছে। একই সম্পর্কের অন্য দাদারা তো ডেকেও কথা বলে না।
হঠাৎ সামনে যম দেখলে লোকের যা হয়, তাই হল শশীর। শশী ঘাড় গুঁজে কুঁকড়ে কুঁকড়ে যা উত্তর দিল তার অর্থ হচ্ছে—সারারাত গরমে ঘুম হয় নি, ভোরবেলায় ঘেমে যাচ্ছিল, তাই তাড়াতাড়ি খিড়কি পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এসেছে।
চন্দ্রকান্ত সন্দেহের গলায় বলেন, সারা রাত যে ঘুম হয়নি, সে তো মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু এতো গরম পেলে কোথায়? কাল রাত্রে তো খুব বাতাস বইছিল, বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
কী জানি, আমার কি রকম—খুব ঘামটাম রাতে কী হয়েছিল না হয়েছিল কে জানে, এখন এই সকালেই ঘামতে শুরু করে শশীকান্ত—ভিজে কাপড় সত্বেও।
পেট—টেট গরম হয়েছিল বোধ হয়, চন্দ্রকান্ত বলেন, যাও—চট করে ভিজে কাপড় ছেড়ে ফেলোগে—স্নান করতে গিয়েছিলে, গামছা নিয়ে যাওনি! আশ্চর্য! এটা কত অবিধি জান?
না, মানে—ইয়ে ঠিক চানই করব ভেবে যাইনি, জলটা দেখে—
বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল শশী। জলটা দেখে কী ভাবের উদয় হল, সেটা অব্যক্ত রেখে সরেই পড়ল।
চন্দ্রকান্তর কপালে একটা রেখা দেখা গেল, শশীর আচরণটা যেন ঠিক স্বাভাবিক মনে হল না, আমার কাছে যেন কিছু গোপন করল।—রাত্রে কি কোনো অচ্ছুৎ জাতির শবদাহ করতে গিয়েছিল? কিন্তু তাতে গোপনের কী আছে? চন্দ্রকান্ত তো ইতিপূর্বে অন্য ক্ষেত্রে ঘোষণা করে থাকে, ‘মড়ার আবার জাত কী? বিপদগ্রস্ত প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে যাওয়াই উচিত শাস্ত্র’। তবে অকারণ ভয়।… শশীটা বরাবরই আমায় ভারী ভয় করে। কেন কে জানে! আমি তো কখনো তিরস্কার করি না।
স্বভাবটাই যে শশীর মুখচোরা তাতো নয়, চন্দ্রকান্তর অন্তরালে যে রীতিমত দাপট করে বেড়ায়, সেটা তো অবিদিত নেই কারো। সংবাদ পরিবেশক সংস্থা থেকে জেনে বাড়ি ফিরে একবার শশীকে ডেকে জিগ্যেসাবাদ করতে হবে।
ভাবতে ভাবতে এগোলেন, কারণ এটা চন্দ্রকান্তর প্রাতঃভ্রমণের কাল। নিয়ম করে অনেকখানিটা হাঁটেন তিনি।
পথে বেরোলেই একটা অসুবিধে, দোহাত্তা ‘সেলাম’ খেতে হবে। বয়োজ্যেষ্ঠ আর ব্রাহ্মণ বাদে যে কেউ পথে চোখাচোখি হলেই দাঁড়িয়ে পড়বে এবং এগিয়ে এসে পেন্নাম ঠুকবে।
চন্দ্রকান্ত যতই বলেন, প্রত্যহ দেখা হচ্ছে, তবু আবার এসব কেন বাবা? পথের ধুলো—
তা উত্তরটা যোগানোই থাকে। গ্রামের চাষাভুষো, তেলি, মালী, কামার, কুমোর, দার্শনিকতায় কেউই কম যায় না। এখন তারক তেলি প্রণামান্তে প্রণামের পদরজঃ মাথায় বুকে ও জিভে ঠেকিয়ে দরাজ গলায় বলে উঠল, পেত্যহ দেকা হলো বলো কি সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরের দরজায় মাথা ঠুকবো নি ছোট কত্তা? না—বুড়ো শিবের থানের ধুলোয় গড়াগড়ি দেব নি?
তোরা বড় অধিক বাড়াস তারক। এতো কিসের? আমি তো ব্রাহ্মণ সন্তানও নই।
তারক জিভ কেটে বলে, ‘নয়’ বলবেন না ছোট কত্তা, আপনি যাঁর সন্তান, তিনি বাম্ভনের দশগুণ বাড়া। মহা মহা বাম্ভনের থেকে চড়া বাম্ভন ছিলেন কবরেজ মশাই। তেমন মানুষ এ তল্লাটে একটা বের করুন দিকিন।…কত কাল হল সগগে গেচেন, এখনো গরীব গুর্বোরা তেনার নাম করে ঘুরতেচে!…
তারক জোড়—করে সেই সগগের উদ্দেশ্যে একটা প্রণতি জানিয়ে বলে, আর ধুলো? ধুলোর কতা বলতেচেন? মহাজনদের চরণপশ্যে সব ধুলোই ‘রজ’ হয়ে যায় ছোট কত্তা।
ওরে বাবা, তুই তো বেশ শাস্তর পালা শিখে ফেলেছিস রে তারক। তা যাচ্ছিস কোথা? গায়ে জামা উঠেছে দেখছি। কুটুম বাড়ি বুঝি?
আগ্যে যা বলেচেন। খুকির শউর বাড়ি যেতেচি। মেয়েডারে পেটিয়ে দে অব্দি সব্বদা যেন চতুদ্দিকে শুণ্যি দেকি। খুকির গভ্যোধারিণী তো মেয়ের খেলাপাতি পুতুলের পেঁটরি দেকে আর ধরে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। আহা খুকী আমার একটা পুতুলকে ‘ছেলে’ করেছেলো। সেইটা ছাড়া একদণ্ড থাকত নি, সঙ্গে নে খেতো, কাচে নে শুতো। সেইটা নে যেতে চেয়েছেলো, তা কুটুমবাড়ির পাচে কেউ কিচু বলে, তাই ওর গভ্যোধারিণী নে যেতে দেয়নি। এখন সেই দুখ্যে হাপসে হাপসে মরতেচে।
চন্দ্রকান্তর কন্যা নেই, ভাবেন—ভাগ্যিস নেই। থাকলে তো এই নাটকেরই অভিনয় হতো। দুঃখিত গলায় বললেন, মেয়ের বয়েস কতো?
এঁজ্ঞে—এই সাত পেরিয়ে আটে পা দেবে।
এতো কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছ কেন তারক? জানো, এতো শিশুকালে বিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কত পণ্ডিতজন মাথা খাটাচ্ছেন।
তারক একটা উদাস উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলে, পণ্ডিতজনা মাতা খাটাচচেন বলে কি আর এই হতোভাগা মুখ্যুজনাদের মাতা পোস্কের হবে ছোট কত্তা? এ হতভাগারা যে আঁদারে, সেই আঁদারেই থাকবে।
চন্দ্রকান্ত একটু কৌতুক অনুভব করলেন। বললেন, আঁধার বলে বুঝতে জানলে তো আর আঁধার থাকত না রে! নিজেই ভেবে দ্যাখ, এখানে মেয়ে পাঠিয়ে তোদের এই কষ্ট, আবার সেখানে কচি মেয়েটারও কত কষ্ট।
তারক মুখটা একটু ফেরায়, কোঁচার খুঁটটা তুলে সারা মুখটা মোছার ছলে চোখ দুটো মুছে নেয়, তারপর গলা ঝেড়ে বলে, সেই শুনেই তো আরো পাঁচজনে বলতেচে শাউড়িমাগী না কি বড্ড মারধোর করে, খুন্তি পুইড়ে ছ্যাঁকা দেয়—
অ্যাঁ! চন্দ্রকান্ত শিউরে উঠে বলেন, তবু এখানে বসে আছিস? নিয়ে চলে আয়।
তারক দোমনা গলায় বলে, সে কথা ভাবি। তবে আমার ব্যাই লোকটা ভাল বেচক্ষণ। ও পরিবারকে ধমকে দে বলে, চার কুড়ি ট্যাকা পণ দে বৌ এনিচি, সেই বৌকে যদি মেরে ধরে মেরে ফেলিস, আর বৌ জোটাতে পারবো আমি? মরিস মাগী চেরদিন হাঁড়ি ঠেলে। তাতেই মাগী এটটু সমজায়। খুকীর শউরবাড়ির পাশেই আমার এক ভাগ্নীর শউরবাড়ি, তাই এতো বিত্তান্ত জানা।
চন্দ্রকান্তর ভিতর থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ওঠে। কত সহজে কত ভয়ানক অনাচার মেনে নেয় এরা! এ নিয়ে চলেছে সমাজ।
নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, তোর বেয়াই ভাল বলেই কি তোর ভরসা আছে? ভেতরকার কলকাঠি তো মেয়েছেলেদের হাতে। এতো কচি বয়সে বিয়ে দেওয়াটা বাপু খুব খারাপ। প্রতিজ্ঞা করে এর একটা বিহিত করা উচিত।
তারকও নিঃশ্বাস ফেলে—গরীবের কি আর ইচ্ছে পিতিজ্ঞে খাটে ছোট কত্তা? আমার জেঠাতো ভাই চরণ—সেও তো ছ’বছরের মেয়েটার বে ঠিক কর ফেলেচে। ঠেকায় পড়ে কতদিন হল জমি বন্দক দে রেখেছিলো, ছাড়াতে মুরোদ হচ্ছে না, মেয়েটার বে দে পাঁচ কুড়ি এক ট্যাকা পণ পাবে, জমিটা ছাড়ান করে দিতে পারবে।
ওঃ! তাহলে মেয়েও তোদের ঘরে এক একটা তালুক বল? দশটা মেয়ে থাকলে রাজা!
চন্দ্রকান্ত বিষণ্ণ মনে এগিয়ে যান। তারপর ভাবেন, কিন্তু তারকদেরই বা অবজ্ঞা করছি কেন? আমাদের উচ্চবর্ণের ঘরেও তো ওই একই অবস্থা। শুধু জিনিসটার হেরফের। মেয়ে নয় ছেলে।…ছেলে মানেই তালুক। নচেৎ শশীর বিয়ের সময়ও সেজখুড়ি পণের কথা ভেবেছিলেন। ভেবেছিলেন কেন—পরোক্ষে আদায়ও তো করেছিলেন। চন্দ্রকান্ত কন্যাপক্ষের কাছে দাবি করতে দেননি বলে নিজেই সেই দাবির টাকা খুড়ির হাতে ধরে দিয়েছিলেন—’ছেলের বিয়ের খরচা কোরো’ বলে। এতে সকলেই অসন্তুষ্ট হয়েছিল।
পিসি তো বটেই, সুনয়নীও। তাছাড়া বড়দা? একদা যিনি বাড়িতে পার্টিশান তুলে ভাগ ভিন্ন হবার চেষ্টায় সব থেকে বেশী জোরদার ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং বিধবা পিসি খুড়িদের মত আলতু ফালতু মালকে ঠাঁই দেবার মত ঠাঁই তার নেই ঘোষণা করে দায়িত্ব—মুক্ত হয়েছিলেন, তিনি কেমন করে যেন সহসা অনাথা সেজখুড়ির ছেলের বিয়ের ব্যাপারে প্রধান অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে বসে সমস্ত ব্যাপারেই চন্দরের গোঁয়ার্তুমি দেখছিলেন, আর সেজ খুড়ির হৃদয়—বেদনার শরিক হচ্ছিলেন।
সকলেরই বক্তব্য—একটু চাপ দিলেই কনের বাপের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে নেওয়া যেত। গোঁয়ার্তুমির বশে অথবা বুদ্ধির দোষে সেই মোটা পাওনাটি পেতে দিলে না তুমি বেচারী বিধবা খুড়িকে। এখন নিজে গচ্ছা দিয়ে চন্দ্রকান্ত, নিজের মুখ রাখছে। কিন্তু তাতে কার কী, মেয়ের বাপকে চাপ দিয়ে ‘বাপ’ বলিয়ে কতটি ঘরে তোলা যেত, জানো তুমি!
আদর্শ বৌ সুনয়নী পিস—শাশুড়ীর গোড়েই গোড়। চন্দ্রকান্তর সামনে তিনি শাশুড়ীদের সঙ্গে কথা বলেন না, কিন্তু চন্দ্রকান্তর কানে পৌঁছনোয় বাধা ঘটে না। ঘোমটা দিয়ে পিস—শাশুড়ীর পিছনে বসে বলেন, যা বলেছ পিসিমা, একেই বলে গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়া।
উচ্চবর্ণের বলে কতই অহংকার আমাদের, কিন্তু জীবনচর্চায় ওদের সঙ্গে তফাৎ কোথায়?
শুধু ওদের বলে নয়, আমাদের বলে নয়, সমগ্র সমাজটারই রন্ধ্রে রন্ধ্রে শনি। কুপ্রথা আর কুসংস্কারের নৈবেদ্য সাজানোই আছে সেই শনি—দেবতার পুজোর জন্য। দেবতা আর সিংহাসনচ্যুত হবেন কি করে?
আস্তে আস্তে পথ হাঁটেন চন্দ্রকান্ত। মাথার মধ্যে একটা ছন্দ পাক খাচ্ছে, দু একটি তীব্র শব্দ সম্বলিত জ্বলন্ত ছত্র সেই ছন্দকে আশ্রয় করে থিতু হয়ে বসতে চাইছে, কিন্তু হচ্ছে না।…কলম কাগজ নিয়ে না বসলে ঠিক হয় না। তৈরি হয়ে ওঠা ছত্রগুলোও যেন হাত ফসকে পালিয়ে যায়।
কতকাল ঘুমাইবি আর?
কত যুগ যুগান্তর হয়ে গেল পার।
এ যে তোর মৃত্যুঘুম, এর থেকে হবি না উদ্ধার?
—নাঃ, শেষ ছত্রটা অচল।
বেড়িয়ে ফিরেই দোয়াত কলম নিয়ে বসতে হবে।
এই যে বাবাজী বের হয়েছ?
খড়ম খটখটিয়ে এগিয়ে আসেন বটু ভটচার্য। বটু ভটচার্যের পরণে ছালটির ধুতি, গায়ে শক্তি নামাংকিত নামাবলী, কপালে রক্তচন্দনের টিকা, মাথায় রক্তপুষ্প সম্বলিত শিখা, পায়ে উঁচু খুরো খড়ম, হাতে পিতলের জালিকাটা সাজি।…সারা সকাল বটু ভটচার্য এই সাজিটি হাতে ঝুলিয়ে ফুল সংগ্রহ করে বেড়ান। পাড়ার হেন বাড়ি নেই, যে বাড়ির উঠোনে বাগানে বটু ভটচার্যের প্রবেশাধিকার নেই। আপন শক্তিতেই এ অধিকার অর্জন করে নিয়েছেন তিনি।
বটুর ভয়ে গাছের ফুল সামলাতে যে যত ভোরেই উঠে পড়ুক, বটু তার আগে এসে হাজির।
লোকেদের আপন গাছের ফুল সামলানোর ওই অপচেষ্টাকে ধিক্কার দেন বটু। ছিঃ! ছিঃ! রাত থাকতে গাছটাকে নির্মূল করে ফেলেছিস?…বলি তোর ঠাকুর আর বটু ভটচার্যের ঠাকুর কি আলাদা রে?…বটু যখন তার ঘরে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দেয়, খোদ সেই জগজ্জননী মায়ের পায়ে গিয়ে পড়ে, বুঝলি? তবে? তবে আবার নির্বুদ্ধির মতন ফুল সামলে মরিস ক্যানোরে বাপু?
বটু ভটচার্য শূদ্র যাজক, ব্রাহ্মণ যাজক পুরোহিত মহলে ওঁর কলকে নেই। কিন্তু বটু নিজেকে ‘সাধক’ বলে প্রতিপন্ন করে বিশেষ কলকে—র আশা পোষণ করে থাকেন। তাই বটুর কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তিনি বুঝি সেই জগজ্জননী মায়ের খাস মহলের প্রজা।
কিন্তু লোকে ওঁর পিছনে বক দেখায়, মুখে হাত আড়াল দিয়ে হাসে। কারণ আছে। বটুর বয়স অপরাহ্নে চলে এলেও, মন্দ লোকে বলে থাকে, বটু ভটচার্যের এই শেষরাত থেকে সাজি হাতে নিয়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্য আলাদা, সাজিটা ছল। নচেৎ ঘাটের পথগুলি ছাড়া আর পথ খুঁজে পান না কেন ভটচার্য?
সকলেই অশ্রদ্ধা করে, হাসাহাসি করে, তবু মুখের উপর বড় কেউ কিছু বলে ওঠে না। কারণ, রাগলে বটুর জ্ঞান থাকে না, শাপ শাপান্ত করে ছাড়ে।…তদুপরি আবার বটুর এক মাসি, যিনি বটুর বাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী, তিনি নাকি আবার তুকতাকে পটিয়সী। আর শনি, মঙ্গলবারে—অমাবস্যা পড়লে তাঁর উপর মা কালীর ভর হয়।
এ লোককে চটানোর সাহস হয় না। তাই যে যার গাছের ফুল সামলাবার চেষ্টা করে। বৌ ঝি—রা সামলে মরে আপন আপন স্নান—দৃশ্য।
চন্দ্রকান্ত এই লোকটাকে অত্যন্ত অশ্রদ্ধা করেন। অথচ এমনই আশ্চর্য, প্রত্যহ প্রাতঃকালে ওর মুখ—দর্শন করতেই হবে। যে রাস্তা দিয়েই হাঁটুন, কোনোখানে না কোনোখানে বটু এসে আবির্ভূত হবেনই।
বটুর হাতের বৃহৎ সাজিটি ভর্তি হয়ে উপচে পড়তে চাইছে, তবু বটু লালায়িত দৃষ্টিতে শোভারাম ঘোষের উঠোনে ফুটে থাকা কাঠচাঁপাগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতেই বলে ওঠেন, বাবাজীর আমার শরীরে আলস্য বলে কিছু নাই।…পূবের আকাশের সূয্যি, আর এই আমাদের ঘরের চন্দর, সমান নিয়মী।
এতো জুৎসই একখানা কথা বলে ফেলতে পেরে বটু বড় আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন।
চন্দ্রকান্ত পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার তাল করতে করতে বলেন, আপনিও তো কম নিয়মী নন ভটচার্য মশাই! নিত্যই এই এক সময়—
আমার কথা বাদ দাও বাবা। বটু বলেন, আমার কি বিছানায় পড়ে থাকার জো আছে বাবাজী? দজ্জাল বেটি ঘাড় ধরে উঠিয়ে ছাড়ে। বেটির এই হতভাগা বটুককে নিয়ে যে কী খেলা—এই, এই আহা অমন করে আঁকশি দিসনে রে! মড়কা ডাল—
কিন্তু ততক্ষণে শোভারামের বছর আষ্টেক নয়ের মেয়েটা আঁকশি বাগিয়ে কাঠচাঁপার থোকা থোকা ফুলসমেত ডালের আগাগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে কোঁচড়ে ভরে ফেলেছে।
বটু আর চন্দ্রকান্তর দিকে ফিরে তাকান না, ওই মেয়েটার প্রতিই মনোনিবেশ করেন। আঁকশি দিয়ে ওভাবে ফুল পাড়া যে কত গর্হিত, সেটা বোঝাবার জন্যে বার বার তার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেন এবং ইস—সব ফুলগুলো তুলে নিয়ে নিলি, আমার মায়ের জন্যে কিছু রাখলি নি?…বলে জোর করে মেয়েটার কোঁচড় থেকে কিছু ফুল নিয়ে নিজের সাজিতে ভরেন।
মেয়েটা হঠাৎ একবার ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে।
পরক্ষণেই আঙ্গুল মটকে মটকে বিজবিজ করে গাল দেয় এবং পলায়নপর বটুর পিছন দিকে জিভ দেখায়।
পলায়নই ভালো, কারণ মেয়েটার ভ্যাঁ করা দেখেই বেগতিক বুঝেছেন বটু।
চলে যেতে যেতেও ঘটনাটা শেষ অব্দি চোখ এড়াল না চন্দ্রকান্তর। ভিতরে ভিতরে ভারী একটা গ্লানি বোধ করলেন। সকালের আলোয় আর জীবনরসের আস্বাদ নেই।
শ্রদ্ধা করবার মতো মানুষ ক্রমশঃই চলে যাচ্ছে ইহ—সংসার থেকে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখব এমন মুখ বিরল। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখার কথা ভাবতে গেলেই বাবার কথা মনে পড়ে যায় চন্দ্রকান্তর।
কী ছিল সেই মুখে—যাতে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করতো! এখন একটা ছোট ছেলেকে দেখতে পাচ্ছেন চন্দ্রকান্ত, যে ছেলেটা খেলতে খেলতে পড়তে পড়তে, কোনো কিচ্ছু না করতে করতেও চোখ তুলে অপলকে তাকিয়ে আছে তার বাবার মুখের দিকে। কিন্তু শুধুই কি সেই ছোট ছেলেটাই? একজন যুবা নয়? একটি বিবাহিত পুরুষ নয়? একজন পুত্রের পিতা নয়?
তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন বিভোর হয়ে যেত।
কী ছিল সেই মুখে? দীপ্তি? প্রসন্নতা? ঔদার্য? নাকি গাম্ভীর্য, গভীরতা, আত্মমগ্নতা? কিসে আকৃষ্ট হতো সেই ছেলেটা? সব মিলিয়ে একটা আশ্রয়, এই তো?
আমি আমার ছেলের হৃদয়ে সেই আসন পাততে পারিনি—
নিঃশ্বাস ফেললেন চন্দ্রকান্ত। আমারই অক্ষমতা। পিতাপুত্রের হৃদয়ে হৃদয়ে কোনো গভীর যোগসূত্র তো নেইই, পারিবারিক জীবনে, পরিবারের সকলের মধ্যে যে সাধারণ যোগসূত্র থাকে, তাও প্রায় দুর্লভ। এতো কম দেখা—সাক্ষাৎ ঘটে ওর সঙ্গে আমার যে, দুটো সহজ কথার আদান—প্রদানও হয় না।—অথচ বাবার কাছে গল্পচ্ছলে আমি কত কী শিখবার সুযোগ পেয়েছি!
বাপের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে, এমন পরিস্থিতিগুলি সযত্নে পরিহার করে নীলকান্ত। সেটা চন্দ্রকান্তর অজানা নয়। তবু ছেলেকে দোষ দেন না। ভাবেন, আমারই ত্রুটি। আমার মধ্যেই সে শক্তির অভাব যে শক্তিতে আপন আত্মজের চিত্তে প্রভাব বিস্তার করা যায়। এটাই তো সংসারে সব থেকে কঠিন ঠাঁই।
অথচ সুনয়নী কতো সহজেই সে প্রভাব বিস্তার করে বসে আছেন। মা—কে নীলকান্ত প্রাণতুল্য ভালবাসে, আবার যমতুল্য ভয় করে।—মার সঙ্গে দিব্যি মাই ডিয়ার ভাবে গালগল্পও করে বসে বসে, আবার মা একটু চোখ রাঙালেই কাঁটা।
এটা কী করে হয় জানা নেই চন্দ্রকান্তর।
এমনিতে তো সুনয়নীকে মান মর্যাদা বজায় রাখা কাজ করতে বিশেষ দেখেন না। সুনয়নী অনায়াসেই পানের বাটা বিছিয়ে বসে সাজতে সাজতে নিজের মুখে একটা ফেলে, অপর একটা ছেলের দিকে বাড়িয়ে ধরতে পারেন, আবার অতি সহজেই ‘দূরহ আমার সুমুখ থেকে, তোর মতন হাড় বজ্জাতে ছেলের মুখদর্শনেও পাপ—’ বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেও পারেন।
ওই পান দেওয়ার ব্যাপারটা একদিন চোখে পড়ে যাওয়ায় চন্দ্রকান্ত সুনয়নীকে বোঝাতে উদ্যত হয়েছিলেন, কাজটা অসঙ্গত। এতে মাতৃসম্ভ্রম ক্ষুণ্ণ হয়, কিন্তু বোঝানো হয়নি। সুনয়নী প্রথম পর্বেই থাবাড়ি দিয়ে বলে উঠেছিলেন, অতো বিচার করলে চলে না। ছেলে কি কুটুম? তাই সর্বদা হিসেব করে চলতে হবে, কিসে আমার মান থাকবে আর কিসে মান যাবে!—যখন যা ইচ্ছে হবে করব,—বকার সময় বকব, আহ্লাদ দেবার সময় আহ্লাদ দেব। চুকে গেল ল্যাটা,—সাধে কি আর নীলে তোমার কাছ থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়? দেখা হলেই তো উপদেশ ঝাড়বে!
আমি কি ওকে খুব উপদেশ দিই?
সুনয়নী ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে জাঁতি চালিয়ে সুপুরি কাটতে কাটতে বলেছিলেন, মুখে গ্যাজ গ্যাজ করে না দাও, চোখ মুখের ভাবেই বুক হিম করে দাও। তোমার দিকে ঘেঁসবে কি! আমি ডাকাবুকো ডাকাত, তাই তোমার ভয় খাই না। আর সবাইকে দেখো।
কিন্তু নিজের ওই অন্যের বুক হিম করে দেবার ক্ষমতাটা সম্পর্কে সচেতন নন চন্দ্রকান্ত। নিজেকে তো খুব নীরব রাখতেই ভালবাসেন। তাই রেখেই চলেন। অথচ লোকে যে তাঁকে ভয় করে, সমীহ করে দূরে রাখতে চায়—তাও চোখ এড়ায় না। এর অর্থ অনুভব করতে পারেন না।
—হ্যাঁ, আমারই ত্রুটি, মনে মনে ভাবলেন চন্দ্রকান্ত—আমার অক্ষমতা, আমি কারো সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে পারি না।—কিন্তু কার সঙ্গে হবো? কোথায় সেই অন্তর? যার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার ইচ্ছে জাগে?
বড়দীঘির ধার পর্যন্ত হেঁটে আবার ফিরে আসা, এটাই সাধারণতঃ নিয়ম চন্দ্রকান্তর। আজও তাই ফিরছিলেন, দেখলেন সামনে উদ্ধব দুলে। তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে।
দাঁড়ালেন।
উদ্ধব রাস্তার ধুলোমাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে একটা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম সেরে নিয়ে দু’হাতে নিজের কান দু’টো মুলে বলে উঠল, ছোটকত্তা বাবু, অপরাধ নিবেন নি। আপনার জন্যিই আমরা ছোটলোকরা এ্যাখনো মাতা হ্যাঁট করে আচি, কিন্তুক আর বোদায় চলবে নি।—ছোঁড়া ছোকরাগুলানকে খামিয়ে রাখতে পারতেচি নে—
চন্দ্রকান্ত অবাক হলেন।
বলতে গেলে প্রায় আকাশ থেকেই পড়লেন। চন্দ্রকান্ত বলেন, কী হলো রে উদ্ধব? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না—
উদ্ধব ক্ষুব্ধ উত্তর দেয়, পারবেন নি তা জানি। আপনি হল গে আকাশের দ্যাবতা, মাটির পিরথিমির খবর বাত্তা জানেন নি। তবে আপনার নাগাল য্যাখন পেনু একবার, ত্যাখন জানিয়ে রাখি, অ্যাকটা কিছু ঘটে গেলে দোষ নিওনি। আমরা ছোটলোক, মুখ্যু, হতভাগা, সবই মানতেচি। তবে আপনাদের বড়লোকদেরও এডা মানতি হবে, ছোটলোকের ঘরের মেয়েছেলেদেরও ইজ্জৎ আচে।
চন্দ্রকান্ত দিশেহারা দৃষ্টিতে তাকান।
ব্যাকুলভাবে বলেন, তোর কথাটাতো আমি—
কথা শেষ হয় না, কোথা থেকে বদন দুলে এসে দাঁড়ায়। উদ্ধবের ভাইপো। কালো পাথরে কোঁদা চেহারা, ঘাড়ে বাবরি চুল। চওড়া মুখটার ধারে পাশে ওই চুলগুলো ফুলে থাকায় মুখটায় যেন সিংহ সিংহ ভাব। হাতে মাথা ছাড়ানো বাঁশের লাঠি।
বদন উদ্ধবকে প্রায় ঠেলে দিয়ে বলে, তুই এখেনে কী করতেচিস?
উদ্ধব ঠেলা খেয়ে রেগে উঠে বলে, করব আবার কী? ছোটকর্তাকে দেখনু তাই একটা পেন্নামের জন্যি—
আচ্চা হয়েছে তো পেন্নাম? যা ঘর যা—
যাচ্চি বাবা যাচ্চি, বুড়ো উদ্ধব জোয়ান ভাইপোর তাড়নায় অনিচ্ছার সঙ্গে চলে যায়।
চন্দ্রকান্ত ফিরতে যাচ্ছিলেন, বদন মাটিতে একটু হেঁট হয়ে একটা প্রণামের মত করে নিয়ে বলে ওঠে, খুড়ো কী বলতেছেলো?
বদনের কণ্ঠস্বরে চাপা উত্তাপ।
চন্দ্রকান্ত বোঝেন, ভিতরে কোনো গৃহ—কলহের ব্যাপার আছে। আবার চিন্তা করেন—কিন্তু উদ্ধবের বক্তব্যের সঙ্গে তো ঠিক গৃহকলহের সুর নেই, তার অভিযোগ যেন ভদ্দরলোকেদের বিরুদ্ধে। তবে কোনো চাপা আগুনকেই উস্কোনো ভাল নয়, তাই মৃদু হেসে বলেন, কী আর বলবে? ভক্তিটক্তি দেখাচ্ছিল।
বদন তার বাঁয়ের দিকে এসে পড়া বাবরি চুলের গোছা মাথা ঝাঁকিয়ে পিঠের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, খুড়োর মাথাটায় ইদানীং একটু গণ্ডগোল হয়ে গ্যাচে—বুজলেন। ওর কতা বিশ্বেস করবেন নি।
চন্দ্রকান্ত বললেন, বিশ্বাস অবিশ্বাসের কি আছে? উদ্ধব তো কিছু বলেনি।
না বললিই ভালো, হট খট এটা ওটা বলে বেড়ায়, তাই বলতেচি।
বদন হাতের মাথা ছাড়ানো বাঁশের লাঠিটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে গটগটিয়ে চলে যায়।
চন্দ্রকান্তর মনে হয়, ওর ওই ভঙ্গীটার মধ্যে যেন কোনো একটা কঠিন সংকল্পের রূঢ় দৃঢ়তা।
চন্দ্রকান্তর চেতনার গভীরে একটা আসন্ন অশুভের ছায়া পড়ে।
কোথায় কী হয়েছে?
কোথায় কী হতে পারে?
উদ্ধবের কথায় কিসের ইসারা ছিল?
চিন্তমগ্নভাবে খানিকটা চলতে চলতে—জোর করে মনের অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেললেন। —দূর, ওই ভাইপোটার কথাই বোধ হয় ঠিক। উদ্ধবের মাথার মধ্যেই কোনো গণ্ডগোল ঘটেছে।
অস্বস্তিকে একেবারে দূরীভূত করতে, নতুন যে গ্রন্থের পরিকল্পনা করেছেন, তার চিন্তা করেন। কাব্য ছেড়ে—গদ্য লিখতে হচ্ছে। প্রথম দু’একবার ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনেই লিখতে শুরু করেছিলেন, পছন্দ হয়নি, ঠেলে রেখে দিয়েছেন। বঙ্কিমবাবুর অক্ষম অনুকরণ বলে ঠেকেছে। একটা নতুন সামাজিক জীবন নিয়ে ভাবছেন চন্দ্রকান্ত। যে ভবিষ্যৎ সমাজের ছবি মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই উজ্জ্বল আশ্বাসের বাণী বহন করে নিয়ে এসে আশার আলো দেখায়, সেই সমাজের কাহিনী রচনা করতে চান চন্দ্রকান্ত। এই চাওয়াটা কি ধৃষ্টতা?
মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন চন্দ্রকান্ত। যদি লিখে উঠতে পারেন, সে গ্রন্থের নাম দেবেন : আগামীকালের আলেখ্য।
সেই আগামীকালটা যে ঠিক কোন কালের মঞ্চে পা ফেলবে, সেটা এখনো বুঝতে পারছেন না চন্দ্রকান্ত। একশো বছর পরে—ওঃ, সে যে বড় দূরে! তবে আশী বছর পরে? সেও কম কি? আরো কমেই বা নয় কেন? সত্তর, ষাট, পঞ্চাশ। তখন দেশের এবং সমাজের অবস্থা কেমন হতে পারে! অথবা বলা যায়, কেমনটি হলে ভাল হয়। মাঝে মাঝে তারই এক—একটা রোমাঞ্চময় কল্পনায় আন্দোলিত হন চন্দ্রকান্ত। টুকরো টুকরো ছবি মনের মধ্যে ভেসে ভেসে ওঠে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ একটা খসড়া করে ফেলে, তাকে রূপ দেবার চেষ্টায় সফল হতে পারছেন না। চিন্তার খেই হারিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। দানা বাঁধতে পারছে না।
কী কী হলে ভাল হয়, আর কতটুকু হয়ে ওঠা সম্ভব, এই দুটো চিন্তার সংঘর্ষে সেই ভবিষ্যৎকালের কাহিনীর পাত্র—পাত্রীর চরিত্রগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে না, ঝাপসা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
শুধু একটা শর্ত নিশ্চিত সত্য রূপে বিদ্যমান, সেটা হচ্ছে—সেই কালের চেহারা হবে,—দেশ পরাধীনতার গ্লানি মুক্ত, বন্দেমাতরম মন্ত্রের মহাদান—ভারতবাসীই ভারতবর্ষের অধীশ্বর। আরও একটা শর্ত, সেই ভাবী সমাজে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারী—সমাজের জীবন কেবলমাত্র ধূমলিন রান্নাঘরের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে না। লজ্জার ওজনটা তাদের শুধু ঘোমটার দৈর্ঘ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। লজ্জাস্কর বস্তু যে অন্য অনেক আছে সে বোধ জন্মেছে। তাদের চিন্তার জগতে তেরোদশীতে বেগুন খাওয়া না খাওয়ার প্রশ্নটাই একটা বৃহৎ জায়গা দখল করে নেই, বৃহৎ পৃথিবীর বিচিত্র জীবনচর্চার সঙ্গে একাত্মা হবার স্বাদের আশায় উন্মুখ হচ্ছে তারা। ছোট গণ্ডী ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসবার সাধনা করছে। জীবনের এই নিদারুণ অপচয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু শুধুই কি নারী জাতির উন্নতির কথাই ভাবেন চন্দ্রকান্ত?
জীবনের অপচয়ের দৃশ্য তো অহরহ সর্বত্র।
কী অলসতা, কী কর্মহীনতা! কেবলমাত্র তাস পাশা খেলে, মাছ ধরে আর বাজে গালগল্প করে বৃথা জীবনযাপন করছে গ্রামের অধিকাংশ ছেলে। চিন্তাহীন উদ্যমহীন এই নিরেট মুখগুলো দেখলে কেমন একরকমের অস্থিরতা আসে চন্দ্রকান্তর। এসবের কী—ই বা লিখতে পারবেন চন্দ্রকান্ত? কতটুকুই বা লিখতে পারবেন?
ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
অশ্বত্থতলার ছায়ায় এই সকালবেলাই সেই অপচয়ের একটু নমুনা। গাছের গোড়ায় ধুলো মাটি আর শিকড়ের উপর চেপে বসে গোটা পাঁচ—ছয় ছেলে। কে ওরা? নীলকান্তর মত কে যেন!
না, নীলকান্ত নয়। কিন্তু হলেও হতে পারতো। সেই বয়েসেরই ছেলে কটা। হাঁটুর উপর ধুতি তোলা, খালি গা, খুব হাত মুখ নেড়ে গল্প করছে, জায়গাটা তামাকের গন্ধে ভরপুর। অথচ ধারে কাছে হুঁকো—কলকের চিহ্ন নেই। তার মানে অন্য কোনো পদ্ধতিতে ধোঁয়া খাওয়ার চাষ চলছে। হাতের মধ্যে গাছের পাতা পাকিয়ে কেমন করে যেন টান দিতে শেখে এরা।
ওরা চন্দ্রকান্তকে না দেখতে পাওয়ার ভান করছে।
চন্দ্রকান্ত যে ওদের দিকেই এগিয়ে আসবেন, তা ভাবেনি। এসে পড়েছেন দেখে তাড়াতাড়ি গা—ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। চন্দ্রকান্ত শান্ত গলায় বললেন, সকালবেলা এভাবে বসে কেন বাবারা? কাজকর্ম নেই?
ওরা ঘাড় চুলকে বলল, না—ইয়ে বারোয়ারীতলায় যাত্রাগান হবে সেই খবরটার জন্যে—
বারোয়ারীতলায় যাত্রাগান হবে? কবে?
আজ্ঞে ওই, কবে যেন রে সাধু?
ইয়ে মনসার ভাসানের দিন।
মনসার ভাসান? সে কি? তার ত এখন অনেক দেরী।
না, না, মনসাপুজোর দিনকে।
মনসা পুজো? দশহরার দিনের কথা বলছ?
ছেলেগুলো উত্তর খুঁজে পেয়ে মহোৎসাহে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। তাই না রে ভজা?
তারও দেরী আছে বাপু, এখন তো সবে বৈশাখ চলছে। তার জন্যে এখন থেকে কী হচ্ছে? তোমরা করবে যাত্রাগান?
বলা বাহুল্য, অধোবদন হল ওরা।
চন্দ্রকান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দিনের শ্রেষ্ঠ কাল সকাল, আর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাল কৈশোরকাল। দুটোই বৃথা অপচয় করো না তোমরা। আর কারো ক্ষতি হচ্ছে না—নিজেদেরই ক্ষতি করছো।
ছেলেগুলো আমতা আমতা করছিল। চন্দ্রকান্ত চলে যেতেই আবার বসে পড়ে বলে উঠল : এই এক গুরু—ঠাকুর আছেন বাবা গাঁয়ে, কারুর একটু স্বস্তি আছে! বদ্যির ছেলে, নাড়ি টিপে বেড়া না বাবা, তা না কেতাব লিখছে, আর যাকে পারছে ধরে ধরে লেকচার শোনাচ্ছে।
দূর! আমেজটাই মাটি করে দিল। দিব্যি মৌজ করে বসা হয়েছিল। ব্যাটা, দু’দশ বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিস বলে যেন যারা পরে এসেছে তাদের মাথা কিনে নিয়েছিস। ধ্যেৎ!
আর চন্দ্রকান্ত যেতে যেতে ভাবছিলেন, বড়দের দেখলে তটস্থ হয় এখনো, এটুকু সভ্যতা আছে ছেলেগুলোর মধ্যে। অর্থাৎ এখনো আদায় আছে।
এই জীবনগুলোকে যদি ঠিক পথে চালিত করা যেতো!
ফের সেই পুরনো ভাবনাতেই ফিরে আসেন চন্দ্রকান্ত, কিন্তু ভাবনা আর অধিক দূর অগ্রসর হতে পারে না। বর্তমানের পাথুরে পরিবেশটা যেন চন্দ্রকান্তের ওই চিন্তার বিলাসকে দুয়ো দিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হাসতে থাকে।
বাবা, বদ্যি জ্যাঠা—
বালককণ্ঠের এই উচ্ছ্বসিত উক্তিতে চমকে তাকালেন চন্দ্রকান্ত।
গৌরমোহনের ছেলে গোবিন্দর গলা না?
বাবা বলে কথা বলল। গৌরমোহন এসেছে তাহলে?
হঠাৎ ভারী ভাল লাগল। চন্দ্রকান্তর মনে হলো, ঠিক এই মুহূর্তে গৌরমোহনকেই যেন খুব দরকার ছিল তাঁর।
ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।
সামনেই গৌরমোহন।
দুজনেরই মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
আরও একবার মনে হল চন্দ্রকান্তর—আশ্চর্য! টের পাচ্ছিলাম না, এখন বুঝতে পারছি—ঠিক এই মুহূর্তে গৌরমোহনকেই বড় দরকার হচ্ছিল আমার। গৌরমোহনের কাছাকাছি এলে মনে হয়, সংসারে অন্তরঙ্গ হতে পারার মত মানুষ হয়তো একেবারে বিরল নয়।
কবে এলে?
কাল সন্ধ্যায়।
গৌরমোহনের একটা হাত আঁকড়ে ধরে আছে তার বালক—পুত্র গোবিন্দ, গৌরমোহনের অপর হাতে একখানা পাট করা খবরের কাগজ।
তোমার কাছেই আসছিলাম—
গৌরমোহনের স্বর উৎফুল্ল।
তোমার কাছেই চলো—
চন্দ্রকান্তর স্বরে গভীর অভিব্যক্তি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন