সূর্যোদয় – ১২

আশাপূর্ণা দেবী

বারো

নাঃ, ওদের খুশীমত কিছুই করেনি ওরা।

ওরা কিছুক্ষণ জটলা করে আস্তে আস্তে চলে গিয়েছিল। ওদের হাতের মশালগুলো তখন নিভে গেছে। অন্ধকারে কালো কালো মানুষগুলো আরো চাপা একটা অন্ধকারের মত চলে গিয়েছিল আস্তে আস্তে।

টগবগিয়ে ফুটে ওঠা রক্তগুলো শুধু শুধু ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় ওদের যেন কেমন ঝিমোনো ঝিমোনো লাগছিল। বদনাকে দুজনে দুদিক থেকে ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

ওরা জানে, বাড়ি পৌঁছেই বদন কুসমির মড়াটাকে নিয়ে আছড়া আছড়ি করে কাঁদবে।…

তবে ওরা কেউ জানে না, কখন বদন দেউড়ির সামনের ধুলোর মধ্যে সেই গহনা দুটো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। ঠিক সেইখানে, যেখানে ওর বাপ দাদা সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে এঁদের প্রণিপাত করতো।…

চন্দ্রকান্ত গুপ্তের বাড়ির এতোটুকু কিছু টসকায়নি। একখানা ইঁটও খসেনি, একটু বালির চাপড়া ধ্বসেনি। লুঠতরাজের কথা তো ওঠেই না। …শুধু সারা গ্রামে ঢী ঢী পড়ে গিয়েছিল।…

এতো মহাপুরুষ, ত্যাঁতো মহাপুরুষ, বই লিখিয়ে পণ্ডিত—স্বার্থের সময় দেখো। লুঠতরাজ বাঁচাতে ওই দুলে ডাকাতদের সামনে খুড়তুতো ভাইটাকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন! নেহাৎ না কি সেজগিন্নি সিংহবাহিনী মূর্তিতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই তারা মানে মানে সরে গেল। নচেৎ কী হতো?

এটা যে চন্দ্রকান্তর খুব গর্হিত কাজ হয়েছে তাতে আর সন্দেহ কী? সত্যিই তো, খুড়তুতো ভাইকে শাসন করতে আসার তুমি কে?…একদা সেজকর্তা বাড়ির নিজের দিকে ভাগ বেচে দিয়ে টাকা নিয়েছিলেন, আর তুমি বদান্যতা দেখিয়ে তাদের সেই বেচে দেওয়া মহলে থাকতে দিয়েছিল, এই অহঙ্কারে? বেশ তো, গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দাও। শশীকান্ত স্ত্রী কন্যে আর বিধবা মাকে নিয়ে গাছতলায় থাকবে, তাও ভাল।…এমন নির্মায়িক শত্রুপক্ষের আশ্রয়ে থাকার চেয়ে গাছতলা শ্রেয়।…

যাঁরা এযাবৎ ‘বাবাজীবন’ বলে বিগলিত হতেন, তাঁরাও এসে এসে বলে যাচ্ছেন, কাজটা চন্দ্রকান্তর ঘোরতর গর্হিত হয়েছে…গাঁয়ে ঘরে কি ওই একটা মাত্তর ছেলেই দুলে বাগদীপাড়ায় ঘুরঘুর করে? ‘বয়েসকালের দোষ’ কথাটার তবে সৃষ্টি হয়েছে কেন? তাছাড়া বেচারার স্ত্রীটি যখন রোগগ্রস্ত। গোঁয়ারগোবিন্দ বদনা দুলে নিজে রাগের মাথায় পরিবারটাকে পিটিয়ে মেরে এসে ক্ষেপে গিয়ে যা তা বলল বলেই তুমি খুড়িকে জবরদস্ত করে চাবি নিতে গেলে? বিধবা খুড়ি, ওই সবেধন নীলমণিটুকু নিয়ে তোমার আশায় বিশ্বাস করে রয়েছে।

জনে জনে ওই কথাই বলছে।

ওই বিশ্বাস শব্দটাও ব্যবহার করেছে প্রায় সবাই।

তার মানে চন্দ্রকান্ত তাঁর পারিবারিক জীবনে ভয়ানক একটা বিশ্বাস ভঙ্গ করে বসেছেন।

সুনয়নীর মনের মধ্যেও সেই ভয়। তাই চন্দ্রকান্তর যাত্রাকালে সে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সেই কথাই বললেন।

এমনিতে চন্দ্রকান্তর কলকাতায় বাসা করার সংকল্প শোনা পর্যন্তই সুনয়নী সবাইকে ধরে ধরে শুনিয়ে চলেছেন, আমি যাবো কী বল? বেটাছেলের খেয়াল ক’দিন থাকে কে জানে! আমি মরতে ল্যাজ ধরতে যাবো কেন? বাসার সেই পায়রার খুপরি দুখানা ঘরের মধ্যে আমি টিঁকতে পারবো? হাঁপিয়েই মরে যাবো তো। বেশ থাকবো বাবা আমি পিসিমাদের কাছে—

কিন্তু চন্দ্রকান্তর বিদায়কালে সুনয়নী পায়ের ধুলো নিয়ে উঠে চোখ মুছে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, এখন আর কী বলবো! কলকাতায় বাসা নিচ্ছ শুনে মনটা দুলে উঠেছিল, ভেবেছিলাম চলে যাব তোমার সঙ্গে। কিন্তু সে ভরসা আর নেই। যা নির্মায়িক প্রাণ তোমার, আমার নীলু যদি কখনো একটা অকাম করে বসে, তুমি তার কী শাস্তি করবে তুমিই জানো। হয়তো হুকুম দেবে—পাপ করেছে, আগুনে ফেলে দাও ছেলেকে। প্রাচিত্তির হোক। তা তুমি বলতে পারো, তোমায় বিশ্বাস নেই।

বিশ্বাস নেই। চন্দ্রকান্তর উপর আর কারো বিশ্বাস নেই। অথচ নিজে চন্দ্রকান্ত এ পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসের নৌকোয় চেপে তরতরিয়ে পার হচ্ছি ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন। হয়তো এ আঘাতের দরকার ছিল। ভালই হল, মোহমুক্ত হলেন। আর চন্দ্রকান্তকে দায়িত্ববোধের ভারে ঝুঁকে পড়ে আটকে থাকতে হবে না।

গ্রাম থেকে স্টেশন ষোল মাইল দূর, গরুর গাড়ির পথ। শেষ রাত্তিরে গাড়ি নিয়ে এসে বসে আছে জয়দ্রথ, ঠিক সময় পৌঁছে দেবে। এখন থেকে না ছাড়লে ট্রেন ধরা শক্ত।

কুপী জ্বেলে গাড়ি ঠিক করেছে জয়দ্রথ। প্রদীপ ধরে গাড়িতে উঠলেন চন্দ্রকান্ত। চারিদিকে অন্ধকার। খোলা মাঠ, দূরে দূরে এক একটা গাছ, ঝাঁকড়া চুল মানুষের মত দেখতে লাগছে।

গাড়ির ক্যাঁচ কোচের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। যেন বিশ্ব চরাচর একটা জাল মুড়ি দিয়ে বসে আছে।

গরুরগাড়ির কতটুকু গতিবেগ? গাড়ি চলেছে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে।

গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। দুদিন আগে পর্যন্তও কি ভাবতে পারতেন চন্দ্রকান্ত—এই গ্রামটাকে চিরতরে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, অথচ মনে কোনো বেদনা আসছে না…যেন সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার বাইরে একটা অনুভূতিহীন অনুভূতি তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

কিন্তু সেই দুদিন আগে কি ‘চিরতরে ছেড়ে যাচ্ছি’ এমন কথা ভেবেছিলেন চন্দ্রকান্ত? ভাবা সম্ভব ছিল? অথচ আজ নিশ্চিত সংকল্পে গাড়িতে এসে উঠছেন। এখন হঠাৎ হঠাৎ এক একটা পাখি ডেকে উঠছে। নিথর প্রকৃতিতে জীবনের স্পন্দন জাগছে।

কি জানি কেমন ঠিক করেছে গৌরমোহন বাসাটা। কি জানি কেমনতর পরিবেশ।

আশ্চর্য! এখন সুনয়নী বললেন, মনটা দুলে উঠেছিল। সুনয়নীরও মন দুলে ওঠে? জগতে তাহলে এ ঘটনাও ঘটে? কিন্তু বড় পরে সুনয়নী, বড় দেরীতে। আর হয় না।

গাড়িটাকে একটা মোড় ঘোরালো জয়দ্রথ, আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন চন্দ্রকান্ত।

কখন? কখন শুরু হয়ে গেছে এ দৃশ্য?

পূবের আকাশে অনন্ত বর্ণচ্ছটা, অফুরন্ত বিস্ময়। গাড়ী চলেছে, পূব আকাশও চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। এ এক আশ্চর্য রহস্য। কত কোটি কতকাল ধরে আকাশ বসে আছে পৃথিবীর শিয়রে, চলেছে পৃথিবীর সঙ্গে। আর কোটি কল্পকাল ধরেই তিমির গভীর রাত্রির তপস্যায় সঞ্চয় করে তোলা অনির্বাণ জ্যোতি, অসীম প্রাণরস প্রবাহ উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীকে পরম প্রেমে, পরম মমতায়। ক্লান্তি নেই, আলস্য নেই, বিরাগ নেই।

চন্দ্রকান্ত কোন শহরে যাচ্ছেন?

সেখানে তাঁর জন্য একটি ছোট বাসা ভাড়া করা আছে বলে? কিন্তু সমস্ত পৃথিবী জুড়েই তো বাসা। ক্ষুদ্র বৃহৎ, সুখের দুঃখের। তবে? পৃথিবীর বিশেষ একটুখানি মাটি আঁকড়ে সেই বিশেষ একটি ছোট্ট বাসার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখবেন কেন চন্দ্রকান্ত?

জয়দ্রথ! তোমার গাড়ি নিয়ে ফিরে যাও বাবা, আমি এখানেই নামছি।

আজ্ঞে বলেন কি ছোট কত্তা, পথ যে এখনও অনেক বাকি। ইষ্টিশনে আসতে দেরী আছে।

নাঃ জয়দ্রথ, এসে গেছে আমার ইষ্টিশান। নামতে দাও আমায়। এই নাও।

পকেটে হাত পুরে একমুঠো টাকা পয়সা বার করলেন। এগিয়ে দিলেন জয়দ্রথের দিকে।

কিন্তুক ছোটকর্তা, এ যে একেবারে ধানক্ষেত, জন মনিষ্যের চিহ্ন মাত্তর নাই।

চন্দ্রকান্ত হেসে উঠলেন।

ধানক্ষেত তো আপনি জন্মায়নি জয়দ্রথ? জনমনিষ্যির হাত যে লেগে রয়েছে ওদের গায়ে। নামাও নামাও।

জয়দ্রথ গাড়ি নামাল। নেমে এলেন চন্দ্রকান্ত।

আছে। এখানেও সামনেই পূবের আকাশ।

পৃথিবীর কাছে কোন দিন বিশ্বাসভঙ্গ করবে না আকাশ। অকৃতজ্ঞ পৃথিবী যাই বলুক।

জয়দ্রথের গাড়ির চাকার ধুলোও ক্রমশঃ মিলিয়ে গেল, চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দটা ক্ষীণ হয়েও মিলিয়ে যেতে চাইছে না। ওইটা থেমে গেলেই চলতে শুরু করবেন চন্দ্রকান্ত। মাটিতে নেমে এসে আকাশটা আরো কাছাকাছি চলে এলো কী করে? আশ্চর্য তো!

এই অফুরন্ত আশ্চর্যের সঙ্গ রইল চন্দ্রকান্তর জন্যে। কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

অধ্যায় ১২ / ১২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন