আশাপূর্ণা দেবী
বাড়ি ফিরতে রোদ চড়চড়ে বেলা, দুপুর হয় হয়।
সামনের রাস্তা দিয়ে বাড়ি না ঢুকে পিছনের আমবাগানের ছায়ায় ছায়ায় ঢুকবেন বলে উল্টোমুখো রাস্তা ধরে ঢেঁকিঘরের পাশ দিয়ে উঠোনে চলে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন চন্দ্রকান্ত। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে হবে বলে কষ্ট হল।
ঢেঁকিঘরের পাশের এই উঠোনটার মাঝখানেই বড় জেঠিদের পার্টিশনের প্রাচীর। টানা লম্বা সেই প্রাচীরটা ভর্তি করে ঘুঁটে লাগাচ্ছেন সুনয়নী। পচা গোবরের গন্ধে নাক চাপতে হল।
সুনয়নীর চুলগুলো ঝুঁটি করে মাথার চুড়োয় তোলা। সুনয়নীর পরণে একখানা, ও গায়ে একখানা গামছা। সুনয়নীর হাতে গোবর, মুখে ঘাম। সেই ঘাম ভেদ করে ফুটে উঠেছে ত্বকের রক্তিমা। এমনিতে শাঁখের মত শাদা, কিন্তু রোদে হয়ে উঠেছে লাল।
কিন্তু গালের ওই রক্তিমাভা কি চোখে পড়ে চন্দ্রকান্তর? লজ্জায়, ক্ষোভে নিজেই তো রক্তিম হয়ে ওঠেন তিনি।
কী কুৎসিত! কী জঘন্য!
দ্রুত এগিয়ে এসে বলে উঠলেন, ছোট বৌ!
ওমা! ই কি! তুমি এদিকে কোনখান থেকে?
বিব্রত হয়ে গায়ের গামছার খুঁটটা টেনে মাথায় তোলবার বৃথা চেষ্টায় গাটাই আদুল হয়ে যায় সুনয়নীর। বাড়তির ভাগ—গালে কপালে বুকে লাগে গোবরের ছোপ।
থাক থাক, আর লজ্জায় কাজ নেই—
চন্দ্রকান্ত ক্ষুব্ধ গাম্ভীর্যে বলেন, যথেষ্ট হয়েছে। ‘লজ্জা’ জিনিসটা যে কী, সে জ্ঞানই যদি থাকতো! তা এসব করবার লোক জোটেনি? বাগদী বৌ মরে গেছে?
বালাই ষাট মরবে কেন? দিব্যি আছে। রাঁধছে খাচছে। ঘুঁটেগুলো দেবার গা নেই, সাতদিন ধরে গোবরের ডাঁই পচাচছে। আর ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে।
ওঃ। তাই। তাই তুমি সেই পচা গোবরের সদগতি করতে লেগে গেছ? নিজের থেকেও দামী মনে হল তোমার ছোটবৌ এই পচা গোবরগুলো?
সুনয়নী তখনো মাথা ঢাকবার বৃথা চেষ্টায় গামছার খুঁটটাকে দাঁতে কামড়ে হাত উল্টে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছেন। করতে করতেই বলে ওঠেন, দামী সস্তা আবার কী! গেরস্ত ঘরের বৌ, একটু গেরস্তালী কাজ করলে হাত ক্ষয়ে যাবে? যাও তো ওদিকে, ব্যস্ত কোর না বাবু। কে কোনদিকে এসে পড়বে—
এসে পড়লে তোমায় তো দেখবেই এই মূর্তিতে।
আমায় একলা দেখলে আবার কী! গেরস্ত ঘরের বৌ—ঝি একবারো গামছা পরে না? বেম্ম তো নেই, হিঁদু বাঙালী তো! গাঁ ঘরে বসত।
তা বটে। তাতেই সাতখুন মাপ।
চন্দ্রকান্ত সুনয়নীর ব্যতিব্যস্ত বিব্রত ভাব দেখে আর দাঁড়াল না। এসেই গৌরমোহনের গল্প করবেন বাড়িতে—এই ভাবতে ভাবতে আসছিলেন, ছন্দ কেটে গেল। গল্পটা অবশ্য পিসি খুড়ির কাছেই, তবু সুনয়নী তো থাকতো ধারে কাছে।
বাবা, এতোক্ষণে এলি তুই? কোন ভোরে বেরিয়েছিলি!
পিসিমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ওখেনে তো জলটল খেয়ে এসেছিস। গৌরের ছেলে বলে গেল।
না খেলে ছাড়বে?
বলেই চন্দ্রকান্ত ইতস্ততঃ গলায় বলেন, বাগদী বৌয়ের কী হল পিসিমা? পচা গোবরের পাহাড় নিয়ে তোমাদের ছোটবৌমা—
ইতস্ততঃ তো করতেই হবে। এখুনি যদি পিসিমা ‘বৌয়ের দুঃখে গলে গেলি’ বলে সাত কথা শুনিয়ে দেন।
কিন্তু না। উল্টোই হলো।
পিসিমা বলেন, ওই তো দ্যাখনা! বললে শুনছে কে! বাগদী বৌ অবিশ্যি কামাই করছে। কিন্তু তাড়াই বা কী? সাতদিন পচছে। নয় আর একদিনও পচবে। চোদ্দবার বারণ করলাম, তা বলে কি—কাজ পড়ে থাকলে আমার স্বস্তি থাকে না। আমি তো বাবা মরে গেলেও ওই কম্মটিতে হাত লাগাতে যাইনে। তিনদিন তিন রাত্তিরে হাতের পচা গন্ধ যায় না। ছোটবৌমার তো শরীরে ঘেন্না পিত্তির বালাই নেই। যত বলি, ততো হেসেই আকুল হয়।
চন্দ্রকান্ত সরে আসেন।
অভিযোগই করছেন পিসিমা।
কিন্তু সেটাই কি আসল? তার মধ্যে থেকে কি অপরাধিনীর প্রতি প্রশ্রয়ের সুর স্পষ্ট হয়ে উঠছে না? প্রশ্রয়ের আর প্রশংসার! যে মারণাস্ত্রে সুনয়নী নামের মানুষটা নিহত।
দোতলায় উঠে এসে দেখলেন, নীলকান্ত অভিনিবেশ সহকারে পাখিমারা গুলতি তৈরি করছে। নীলকান্তর হাতে একটা গাছের দু’ডালের মাঝখানের কোনাচে ডাল, শক্ত পোক্ত, আর খানিকটা শক্ত দড়ি। দুটোকে ধরে টেনে টেনে বাঁধছে মজবুত করে।
চন্দ্রকান্ত বিরক্তভাবে নিজের ঘরে ঢুকে যাচ্ছিলেন, কি ভেবে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আবার গুলতি তৈরি করছো নীলকান্ত? অকারণ জীবহত্যার চেষ্টার বিষয়ে সেদিন যা বলেছিলাম, ভুলে গেছ?
নীলকান্ত এই দেখা ঠেখার পরও হাতের জিনিসটা লুকোতে চেষ্টা করে মিনমিনিয়ে বলে, পাখির জন্যে নয়, বাঁদর মারা হবে।
বাঁদর! গুলতি দিয়ে বাঁদর মারা হবে? এটা কে শেখালো তোমায়?
মা।
মা! তোমায় বলেছেন একথা?
নীলকান্ত হঠাৎ জোরের সঙ্গে বলে ওঠে, তা বলবেন না তো কী? কষ্ট করে বড়ি দেওয়া হবে, আচার বানানো হবে, আর বাঁদর পাজীরা খেয়ে নেবে? আবদার না কি?
ওঃ! তাই জন্যে তাদের গুলতি দিয়ে মারতে হবে? বাঃ! তা ওরা জীব নয়? ওদের মারায় পাপ নেই?
নীলকান্তর গলা আরো সহজ হয়ে এলো, মরবে না হাতী! বাঁদর মারা এতো সোজা যেন।
বেটক্করে লেগে গেলে মরতেও পারে।
তা মরুক গে। ওরা তো পাজী।
চন্দ্রকান্ত ছেলের মুখের দিকে তাকান। মায়ের রূপের উত্তরাধিকারী। আবার বাড়ির মত লম্বা ছাঁদের গড়ন পেয়েছে, হঠাৎ দেখলে ওই ষোলো সতেরো বছরের ছেলেটাকে যুবক বলে ভুল হয়। কিন্তু মুখের রেখায় কোথায় সেই পরিণতির ছাপ? বালকোচিত কথা, বালকোচিত মুখ।
আস্তে বললেন, পাজী বলে মারতে হবে? আমরা মানুষরাও তো পাজী।
আহা! নীলকান্ত এটা বাবার তামাসা ভেবে বলে, আমরা কেন পাজী হতে যাব?
কেন হতে যাব? তা জানি না, তাইতো দেখা যায়। মানুষের মধ্যে পাজী দেখতে পাওনা তুমি?
নীলকান্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বাপের কাছে সরে এসে আস্তে বলে, খুব দেখছি। ঠিক বলেছ বাবা, নতুন কাকা না দারুণ পাজী। নতুন কাকিমাকে এমন মারে।
কী বললে, অ্যাঁ, মারে? শশী স্ত্রীকে মারে?
চন্দ্রকান্তর পক্ষে এই অবাক হওয়াটা হয়তো অদ্ভুত, হয়তো বা ন্যাকামি বলেই মনে হতে পারে। কারণ শশীকান্ত সম্পর্কে ওই মহৎ সংবাদটি, কেবলমাত্র যে বাড়ির সকলেরই জানা তা নয়, পাড়ার সকলেরও জানা। অথচ চন্দ্রকান্ত অবাক হলেন। তার কাছে সত্যিই খবরটি অজ্ঞাত, তাই ধারণারও অগোচর।
এই অগোচরের কারণ হচ্ছে, এ ধরনের কথা চন্দ্রকান্তর কানে তুলতে সাহস হয় না কারো। অজানা একরকম ভীতি আছে সকলের, চন্দ্রকান্ত সম্বন্ধে। এমনিতে মানুষটা শান্ত ধীর ভদ্র মমতাশীল হৃদয়বান। কিন্তু সত্যকার কোনো অন্যায় দেখলে আগুনের মত জ্বলে ওঠেন।
সংসারের মাথার উপর চন্দ্রকান্ত আছেন মাথা রক্ষার ছাতার মত। বর্ষণের ভরসা নিয়ে জলভরা মেঘের মত। আবার বুঝি সর্বদা উদ্যত বজ্রের মত।
কে জানে, এ খবর কানে গেলে শশীকান্তর উপর কী বজ্র ভেঙ্গে পড়ে! আরো ভয় এই, বৌ ঠ্যাঙ্গানোর খবরের সূত্রে আরো কিছু যদি জানাজানি হয়ে পড়ে। এই সব ভয়েই বাড়ির লোক তো বটেই, পাড়ার লোকরা পর্যন্ত খবরটা চন্দ্রকান্তর কাছে চেপে যায়। এমন কি বড়দা মেজদা পর্যন্ত, যাঁরা নাকি একান্ন ছেড়ে ভিন্ন অন্ন হয়ে অবধি খাঁটি জ্ঞাতির মতই ব্যবহার করে আসছেন।
কিন্তু বড়দা আর শশীর নামে লাগাতে আসবেন কোন মুখে? শশীর বৌ অশ্রুমতী তাঁর শালীঝি হলেও, সবটাই চেপে যেতে হয়। শশীর বিবাহকালীন পরিস্থিতিটা চন্দ্রকান্ত যদি বা ভুলে গিয়ে থাকেন, বড়দা শ্রীকান্ত নিজে ভুলতে পারেন নি। তাঁর পৃষ্ঠবল না পেলে সাত—সকালে বিয়ে হতে শশীর?
তাছাড়া অন্যদের কাছে ব্যাপারটা তো সত্যই ভয়ানক কিছু নয়! পরিবারকে ধরে ঠ্যাঙ্গানো, অথবা দুলে বাগদী পাড়ায় রাতচরা এ আর এমন কি নতুন কথা? পাড়া হাটকালে এমন কত বেরোবে! শুধু ছেলে ছোকরা কেন, বুড়ো হাবড়াদের মধ্যেও এ দোষ বিদ্যমান। শুধু চন্দ্রকান্ত এসব টের পান না।
কেউ টের পাওয়াতে আসেও যায় না।
সবাই জানে—চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত মানুষ, ছাপার অক্ষরে বই বেরোয় তাঁর। তিনি কখনো ছোট কথা কইতে জানেন না। জ্ঞাতিদের সঙ্গে ভাগ ভিন্নর সময় কী পরিমাণ উদারতা দেখিয়েছেন। চন্দ্রকান্ত ভাগের ব্যাপারে কত স্বার্থত্যাগ করছেন এবং সেই ভাগের সময় সংসারে যে কটি অখাদ্য মাল ছিল সব কটিকে নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন, এসব তো কারো অবিদিত নেই। সম্পর্ক তো সকলেরই সমান। চন্দ্রকান্ত সেকথা মুখে আনেন নি। যেসব মানুষকে অন্য দশজনের মাপে মাপা যায় না, অন্য দশজনের ছাঁচে ফেলা যায় না, তার সম্পর্কে লোকের অস্বস্তি থাকে। নির্ভয় হয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে না।
অপর দিকে আবার সেজগিন্নীর ভয়। সর্বদা গোবর জলের ঘটি নিয়ে ঘুরে বেড়ালে কি হবে, গলার জোরে তিনি হয়কে নয় এবং নয়কে হয় করে মানুষকে স্তম্ভিত করে দিতে পারেন, গালির জোরে লোককে অবশ করে দিতে পারেন। তাঁর ছেলের কথা নিয়ে কে কথা কইতে যাবে? ছেলেটিও তো কম গোঁয়ার নয়? চন্দ্রকান্তকেই যা ভয় করে। আর কাউকে কেয়ার করে?
কাজেই সকলেই মুখে তালা চাবি দিয়ে থাকেন। আজ নীলকান্তর আচমকা অসতর্কতায় চন্দ্রকান্ত চকিত, চমকিত।
শশী স্ত্রীকে মারে? তুমি জেনে বলছ? ঠিক জানো?
নীলকান্ত এরকম প্রশ্নে ভয় পেল, কিন্তু আর তো এখন পিছনো যায় না। ডুবেছি, না ডুবতে আছি! বাপের প্রশ্নের উত্তর দিতেই হয়, জানিই তো।
আর কেউ জানে?
নীলকান্তর কথার ভঙ্গীও মায়ের মত। নীলকান্ত হাত দুটো উল্টে বলে, বিশ্বসুদ্ধ লোকই জানে।
বাড়ির লোকেরা? তোমার মা?
খুব জানেন। নীলকান্ত মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, মা আবার জানে না? মা তো নতুন খুড়িকে কত বলে, ‘কেন কথা শুনিস না? মার খেয়ে মরিস।’ কিছু লাভ হয় না। রোজ মারে। আজও তো মেরেছে তখন।
কখন?
এই যে তখন। নতুন কাকা না—মিছিমিছি করে—চণ্ডীতলায় যাচ্ছি বলে এই ওপরের ওই পচা ঘরটার মধ্যে কপাট বন্ধ করে ঘুম মারছিল। নতুন খুড়ি অতো জানে না, ডাকতে গেছে, ব্যাস। মেরে একেবারে হাড়গুঁড়ো।
চন্দ্রকান্ত ছেলের মুখের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি ফেললেন, সত্য বলছে, না কাকার প্রতি কোন আক্রোশের বশে! তা মনে হল না, মুখে এক প্রকার নির্বোধ খাঁটিত্বের ছাপ—তার সঙ্গে বেদনারও। ওই বৌটি দৈবাৎই তাঁর চোখ পড়ে, সাবেকী বাড়ির বিচিত্র নক্সার নানান ফাঁক ফোঁকরের মধ্যে কোনখানে যে ওই মেয়েটা আপন অস্তিত্ব গোপন করে বসে থাকে!
গম্ভীর প্রশ্ন করেন চন্দ্রকান্ত, কোথায় শশী? তোমার নতুন কাকা? ডাকো তো একবার।
সে এখন আছে নাকি?
নীলকান্ত স্বভাবসিদ্ধ বালকের ভঙ্গীতে হঠাৎ হিহি করে হেসে ওঠে। নতুন কাকা এখন আছে নাকি? তোমাকে আসতে দেখেই বাগানের দরজা খুলে—হি হি—তোমায় বাঘের মতন ভয় করে। সেজ ঠাকুমা তো বলেন, ছোড়দার ভয়ে একেবারে কেঁচো হয়ে যাস যে, ছোড়দা—বাঘ না ভালুক? তবুও সাহস নেই। হি হি হি। একদম সটকান মেরেছে—
নীলকান্ত নিজেও সর্বদা বাবাকে এড়িয়ে চলবার তালে থাকে, তবে বাবা কথা কইলে প্রাণটা খুলে বসে। তাই আবারও হি হি করে ওঠে। হয়েছেও তেমনি মজা। মা ঘুঁটে ঠুকছিল, সেই পচা গোবরে পা হড়কে, হি হি। মজা না সাজা।
থামো। চুপ করো।
চন্দ্রকান্ত পায়চারি করতে থাকেন। আর কথা বলেন না। নীলকান্ত নামক একটা প্রাণী যে সেখানে রয়েছে, তাও বোধ হয় ভুলে যান।
নীলকান্তও এই বিস্মৃতির সুযোগ নিয়ে বাঁচে। নিজের মালপত্র গুটিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে সরে পড়ে।
চন্দ্রকান্ত অবাক হয়ে ভাবেন, আমি তাহলে একটা অবোধ অন্ধ? বাড়িতে এমন একটা অনাচার ঘটে চলেছে—আমি জানি না। অথচ সব্বাই জানে।
তার মানে, সব্বাই আমাকে চেপে যায়। আমার অন্ধত্বের সুযোগ নেয়।
সুনয়নীও আশ্চর্য!
অথচ এমনিতে সুনয়নী কারও নিন্দে করবার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। আমার সঙ্গে যেটুকু গল্প সে করতে আসে, তার সবই তো প্রায় অপরের সমালোচনা, আর অপরের ব্যাখ্যানা।
অনেকক্ষণ বলার পর যখন টের পায় আমার কানের মধ্যে কিছুই ঢোকেনি, তখন—খুব মানুষের সঙ্গে কথা কইতে এসেছিলাম—বলে রাগ করে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
যৌবনকালের জোড়া পালঙ্কখানিই সুনয়নীর ভাগে। চন্দ্রকান্ত রাত্রে লেখাপড়ার সুবিধা হবে বলে একটা তক্তোপোষে নিজের ব্যবস্থা কায়েম করে নিয়েছেন। আড়াল দেওয়া সেজ—এর বাতি জ্বালেন যাতে সুনয়নীর চোখে আলো না লাগে।
এক আধবার মমতা আসে না কি চন্দ্রকান্তর! মনে হয় নাকি, রাগটা ভাঙাবার চেষ্টা করা উচিত। রাগ মানেই তো দুঃখ। কিন্তু সাহস হয় না, ভালবাসা শব্দটার একটাই মানে জানেন সুনয়নী। জানেন, রাগ ভাঙাতে কাছে আসার একটাই অর্থ। তাই হয়তো ফট করে বলে বসেন, বুড়ো বয়েসে যে আবার ভারী শখ দেখছি পণ্ডিতের।
রেগে নয়, বিজয়িনীর ভঙ্গীতে নিশ্চিত প্রত্যাশার সুরে।
কী করতে পারেন তখন চন্দ্রকান্ত, ছিটকে সরে আসা ছাড়া?
কিন্তু সেকথা থাক।—এই কথাটা ভেবে যন্ত্রণায় অস্থির হচ্ছেন চন্দ্রকান্ত, বাড়ির মধ্যে একটা নিরুপায় মেয়ে এইভাবে অত্যাচারিত হয়ে চলেছে, অথচ বাড়ির এতোজন মহিলা তার প্রতিকার তো দূরের কথা, টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। এটা কী করে হয়? এটা কী করে হতে পারে?
বেশীক্ষণ চিন্তার সময় ছিল না। আহারের ডাক পড়ল।
চন্দ্রকান্ত থমথমে মুখে সামান্য কিছু খেয়েই প্রশ্ন করলেন, পিসিমা, শশী তার স্ত্রীকে মারে এটা সত্যি?
পিসি চমকান।
তবে সামলেও নেন, খুব অবলীলায় বলে ওঠেন, এই অখাদ্য কথাটা আবার তোর কানে তুলতে গেল কে?
পিসিমা!
চন্দ্রকান্ত গম্ভীর গলায় বলেন, কে কানে তুলল, সেটা আসল কথা নয়। আসলটা হচ্ছে, বাড়িতে একটা মেয়ের উপর অত্যাচার হয়ে চলেছে অথচ তোমরা কেউ কিছু বলছ না?
পিসি ভবতারিণী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, গোঁয়ার গোবিন্দ বেটাছেলে যদি নিজের পরিবারকে ধরে ঠেঙায়, কার কি হাত আছে বাবা?
হাত নেই বলে চুপ করে বসে থাকবে?
তা কী করবো? নিজের মা যার পিষ্ঠবল তাকে শাসন করতে যাবার ধাষ্টামো কার হবে?
ভবতারিণী কথা ধরলে একেবারে শেষ না করে ছাড়েন না। ছেদ ভেদ থাকে না, কমা সেমিকোলন থাকে না, কাজেই ওঁর কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়।
পিসির থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চন্দ্রকান্ত বলেন, মা পৃষ্ঠবল?
তবে না তো কী? মা আস্কারা না দিলে এতো বাড় বাড়তো? সেজ গিন্নিটির তো বুদ্ধি—সুদ্ধি মানুষের মতন নয়, বৌয়ের ওপর হিংসে আকোচ, তাই ছেলেকে টুইয়ে দেয় অত্যেচার করতে।
গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিসি বলে, সংসারে যাই আমি এক দজ্জাল আচি আর তুমি হেন ছেলে আছো, তাই সংসারের আস্ত চেহারাটি আচে। নচেৎ উনি গিন্নী একখানি ঘর তিনখানি করতেন।
এসব কথায় বিরক্ত হন চন্দ্রকান্ত। অসহিষ্ণুভাবে বলেন, ওসব কথা থাক, শশীকে যেভাবেই হোক শাসন করা দরকার। এই সব মারধোর বন্ধ করতে হবে।
ভবতারিণী একটু হেসে ওঠেন। বলেন, পারো তো বন্ধ কর। তুমি বিজ্ঞবিচক্ষণ, তোমায় আর পিসি কি জ্ঞান দেবে! তবে ঝুনো মাথার দাম আচে, তাই বলচি—স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মদ্যে মাতা গলাতে গেলে ধাষ্টামো বৈ আর কিছু হয় না। হয়তো লোকসমাজে মুক রাখতে ওই বৌই বলে বসবে, কই মারেনি তো। মারে না তো। ত্যাখন?
চন্দ্রকান্ত একটু চুপ করে যান।
ঝুনো মাথাকে অস্বীকার করতে পারেন না।
লোকসমাজে মুখ রাখা। অমোঘ তার শাসন। ‘লোকসমাজ’ এইটাই বোধকরি সমাজবদ্ধ মানুষের সব থেকে বড় প্রভু।
কিন্তু এককথায়ই থেমে যাবেন?
অন্যমনস্কভাবে বলেন, তাহলে তুমি বলছো শশীকে শাসন করার দরকার নেই?
ভবতারিণী ব্যস্তভাবে বলেন, আমি কিছুই বলিনি বাবা। তুমি যদি পারো, কর শাসন। তবে ফল বিপরীত হতে পারে। তোমার শাসন খেয়ে হয়তো মুখপোড়া ছেলে আকোচের বশে—তুমি য্যাতোটি শাসন করবে, তার চতুরগুণ তাড়নটি করবে ঘরে গে। সেখেনে তো আর তুমি শাসন চালাতে যেতে পারবেনি বাবা। শশী মুখপোড়া কাজ ভাল করচে তা বলচিনে, খুবই মন্দ করচে, তবে নতুন কিছুই করেনি। পরিবার ঠ্যাঙানো কি জগৎ সংসারে নতুন ছিষ্টি চন্দোর? ঘরে ঘরেই ওই আপদ। তবে সবাই সব ঠ্যাঙানী টের পায় না। সেই যে কতায় আচে না—’মনে কাঁদলাম কেউ জানলনি, বনে কাঁদলাম কেউ শুনলনি, জনে জনে ধরে কাঁদলাম, ত্যাখন লোকে বলল, আহা দুঃখী বটে।’
বাপের সঙ্গে একটু তফাতে নীলকান্ত খেতে বসেছে, সে হঠাৎ হেসে উঠে বলে, ঠাকুমা যে কত ছড়া জানে! মার খাওয়ারও ছড়া জানে।
ছেলেটাকে কিছুতেই গুরুজন সম্পর্কে সম্যক সম্মানসূচক বাক্য শেখানো গেল না। বলে বলে পারা যায় না।
তবু এখনো চন্দ্রকান্ত বিরক্ত হয়ে তাকাল।
সেটা দেখতে পায় না এই যা।
ভবতারিণী নিজের হেঁসেলের দিকের কিছু অবদান পরিবেশন করতে করতে বলেন, তা থাকবে নি ক্যানো? মার যে একরকমের যাদু! কেউ হাতে মারে, কেউ ভাতে মারে, কেউ বচনে মারে, কেউ ব্যাভারে মারে, কেউ বুঝে মারে কেউ না বুঝে মারে,—মার খেতে খেতেই জীবন অতিবাহিত করা। ও তোমার মেয়েপুরুষ ভেদ নেই, গরীব বড়মানুষে রক্ত ভেদ নেই। পেত্যক্ষে অপেত্যক্ষে কে যে কত পড়ে পড়ে মার খেয়ে চলেচে, তার হিসেব আছে?
স্বভাবগত পদ্ধতিতে এক দমে তত্ত্ব কথার বান বইয়ে তবে ক্ষ্যামা দেন ভবতারিণী।
কিন্তু চন্দ্রকান্তও কেন হঠাৎ এমন থেমে যান? স্তব্ধ হয়ে যান? হাতের ভাতটা মাখতে মাখতে যে হাত থেমে গেছে তা যেন মনেই থাকে না। শুধু আরো একবার ঝুনো মাথাকে স্বীকার করেন।
ভবতারিণীর অক্ষর পরিচয় নেই, শ্বশুরবাড়ির কী একটু ধানপান বিষয়—সম্পত্তি আছে, তার পাওনা—কড়ি নিয়ে সই দিতে ‘টিপসই’ দেন। কিন্তু ভবতারিণীর জীবনদর্শন, ভবতারিণীর জীবনবোধ, মানব চরিত্র সম্পর্কে জ্ঞান কী পরিষ্কার! প্রকাশভঙ্গী কী জোরালো!
‘পড়ে পড়ে মার খাওয়া’ কথাটা সন্দেহ নেই শব্দ ভাণ্ডারের একটি সম্পদ। একটি ছত্রে একটি দুঃসহ জীবনের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রত্যক্ষে ধরা দেয়।
পড়ে মার খাওয়ার নজির চন্দ্রকান্তর জানা জগতেই কি নেই?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন