সূর্যোদয় – ১০

আশাপূর্ণা দেবী

দশ

অনেক দিন পরে সারাদিন বন্ধু সঙ্গ লাভে মনটা বড় ভাল লাগছিল—আকাশ বাতাস, গাছপালা।

গল্প করা কাকে বলে সে কথা তো ভুলেই গেছেন চন্দ্রকান্ত। চন্দ্রকান্তের যা চিন্তার জগত সেখানকার নাগাল পাবার মত লোকই—বা কোথায় এখানে?…চন্দ্রকান্তর অধীত গ্রন্থ সম্পর্কে কে এমন ওয়াকিবহাল যে তার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা চলে!

কেউ নেই, কেউ নেই।

চন্দ্রকান্তের সঙ্গে তাদের আকাশ—পাতাল ব্যবধান।…মেজদা তো একটা পাশ করা, দেখগে যাও তাকে। কে বিশ্বাস করবে?… সারা সকাল গরু হেট হেট করছে, তারপর তাদের জন্য খড় কাটছে, খোল মাখছে, ভুষি মাখছে, গোটা কতক গরু পুষে তাই নিয়েই মশগুল।

অথচ কেউ যে নেই, সে কথাটা আজ দশ বছরের মধ্যে মনে পড়েনি।

দশ বছর পরে আজ বন্ধু সঙ্গের আস্বাদ পেয়ে মনে পড়ল, বড় নিঃসঙ্গ তাঁর জীবনটা।

ভাল লাগার আরো একটা কারণ, গৌরমোহনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ঠিক করে ফেলেছেন—একবার কিছু দিনের জন্যে কলকাতায় যাবো।

কলকাতা যাবো। কলকাতা যাবো।

একটা যেন আনন্দের গুঞ্জন ধ্বনিত হয়ে চলেছে মনের মধ্যে।

আশ্চর্য! এই দীর্ঘকালের মধ্যে একবারের জন্যেও যাইনি কেন?

শুধুই কি সময়ের অভাব?

তা নয়। যেন একটা অভিমান বাধার প্রাচীর হয়ে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে অটল হয়ে।

কার উপর অভিমান?

হয়তো আপন জীবনের উপরই।

না কি ভবিষ্যতের সমস্ত সম্ভাবনা ধ্বংস করে দিয়ে যাঁরা একটা কিশোরছেলেকে বিবাহিত বলে দেগে দিয়েছিলেন তাদের উপর?

ভুলে গিয়েছিলেন। আজ আবার হঠাৎ—

বহুদিন পূর্বে শ্রুত একটা ব্যঙ্গ—র হাসির ধ্বনি কানে বেজে উঠল, ওমা! এইটুকুন ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে? ছি ছি!…

একটা ‘এইটুকুন’ মুখ থেকেই উচ্চারিত হয়েছিল, তবু ভয়ানক একটা দাহ সেই ছেলেটাকে যেন ঝলসে দিয়েছিল।…হয়তো সেখানেও জমে উঠেছিল একটা তীব্র অভিমান। …আর একদা যে উদার ধর্মছত্রতলে আশ্রয় নেবার জন্যে উদভ্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন চন্দ্রকান্ত, সেও তো চন্দ্রকান্তর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল।…

চলে আসার সময় মনে হয়েছিল চন্দ্রকান্তের, কলকাতা যেন তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

একটা খোলা রাস্তার দরজায় তালা চাবি লাগিয়ে দিয়ে তার দিকে পিঠ করে ঘরের মধ্যে বসে থাকার মত এই গ্রামের জীবনে নিজেকে ফেলে রেখেছেন চন্দ্রকান্ত। ধীরে ধীরে বহির্মুখী মনকে অন্তর্মুখী করে নিতে চেষ্টা করেছেন এবং সমস্ত অরুচিকর জিনিসগুলিকে সহ্য করে নেবার শক্তি সংগ্রহ করবার চেষ্টা করে চলেছেন।

তবু সহ্য হওয়া বড় শক্ত।

প্রহার সহ্য করা যায়, ‘হার’ সহ্য করা বড় কঠিন।

যাক, তবু আজ একটা আনন্দের সুর বাজছিল মনের মধ্যে। গৌরমোহনের মুখে বর্তমান কলকাতার কিছু কিছু ছবি একটু উদ্বেল করে তুলেছে। মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করে কেন একটা মুক্তির পথ বন্ধ করে রেখেছি এতোদিন?…অনেককে বোকা ভাবি, আমিও তো কম বোকা নয়?…

নীলকান্তকে যদি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কলেজে পড়াতে পারতাম! আমার বাবা অতদিন আগে তার ছেলের সম্পর্কে যে ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন, আমি তা পারছি না। এ বিষয়ে ভাবা দরকার।

কিন্তু পরামর্শ করবার লোক কোথায়?

জীবনের দোসর নেই চন্দ্রকান্তর।

তবু আসছিলেন উৎফুল্ল মনে। কলকাতায় যাবার কথাটা পাড়া যাবে কী ভাবে ভাবতে ভাবতে। প্রথমেই তো পিসিমা।…কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সেখানে? তারপর আর একখানা মুখ।

কিন্তু বাড়ি এসে সেই মুখ থেকে এমন একটা অভাবনীয় কথা শুনলেন।…যেটা চন্দ্রকান্তর হিসেবের বাইরে ছিল। শশীকান্ত বৌকে ধরে ‘ঠেঙায়’ এই ব্যাপারটা যখন বাড়ির প্রত্যেকে অতি সহজে উড়িয়ে দিল, প্রায় মায়েদের ছেলে ঠেঙানোর মতই স্বাভাবিক বলে ধরে নিল—তখন চন্দ্রকান্তও আর ও নিয়ে উচাটন হননি।

এখন আবার এ কী খবর?

সুনয়নী দোতলার দালানের জানালা দিয়ে পানের পিক ফেলে সরে এসে বললেন, আমি তামা তুলসী গঙ্গাজল হাতে নিয়ে বলতে পারি, গহনা নতুন ঠাকুরপোই মেরে ধরে কেড়ে নিয়েছে। সেই দুঃখে নতুন বৌ, তবে এও বলি, তিন তিনটে কচি বাচ্চা তোর, তাদের মুখ চাইলি না? তাদের দুগগতির কথা ভাবলি না? মায়ের প্রাণ না, পাষাণ বাবা! মরলি না, বেঁচে উঠলি তাই, নইলে অ্যাতোক্ষণ কী ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিতো মেয়ে তিনটে ভাবো?

থামো।

চন্দ্রকান্ত বললো, কে পাষাণ সে হিসেব করার বুদ্ধি থাকলে—যাক শশী কোথায়?

ওই তো বললাম, আজ একেবারে বেপাত্তা। অথচ রোজ থাকে। আমার বিশ্বাস সেজখুড়ি জানেন সন্ধান। তা নইলে একটু হানফানালি দেখলাম না কেন!…যাই বলো বাবু, গুরুজন হলেও বলছি, যত নষ্টের গোড়া ওই মা’টি—

আঃ! তুমি থামবে?…নীলকান্ত অদূরে বসে একটা ছেঁড়া ঘুড়ি ময়দার আঠা দিয়ে তাপ্পি লাগাচ্ছিল। বাপের কথায় বলে উঠল, খুব জানি।

কোথায়? কোথায় গেছে?

কোথাও নয়—

নীলু কাছে সরে এসে গলা নামিয়ে বলে, বাড়িতেই লুকিয়ে আছে।

বাড়িতে!

নীলু আঙুল উঁচিয়ে ছাদ দেখিয়ে দিয়ে আরো চুপি চুপি বলে, বড়ি আচারের ঘরে। সেজঠাকুমা লুকিয়ে রেখেছে। একটু আগে খাবার দিতে ঢুকেছিল, দেখতে পেলাম। আমি যে ওই কোণায় ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলাম তা দেখতে পায় নি বুড়ি।

আঃ নীলকান্ত!…চন্দ্রকান্তের মনে হল। তিনি কি কোনো কালে ওই ছাদটায় উঠেছেন? বড়ি আচারের ঘর! সেটা কী জিনিস। আমায় দেখিয়ে দিতে পারো?

পারবো না কেন? কিন্তু কাকাকে দেখতে পাবে না। সেজ ঠাকুমা কুলুপ লাগিয়ে রেখে গেছে।…

আচ্ছা সেজঠাকুমাকেই একবার। আচ্ছা থাক, আমিই যাচ্ছি। তুমি এ নিয়ে কাউকে কিছু—

চন্দ্রকান্তর কথা শেষ হয় না, হঠাৎ বাইরের দেউড়িতে বিরাট একটা রোল ওঠে। অনেকগুলো কণ্ঠের প্রচণ্ড চীৎকার।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন