অভিরূপ সরকার
দশম পরিচ্ছেদ
গঙ্গার ধারে একটা নতুন রেস্টোরেন্ট হয়েছে। কিছুদিন আগে অমিতাভদের সঙ্গে আদিত্য একবার সেখানে গিয়েছিল। খাবারটা বেশ ভাল। মূলত কন্টিনেন্টাল, কয়েকটা ভারতীয় পদও পাওয়া যায়। দাম একটু বেশি, তবে নমাসে ছমাসে এলে গায়ে লাগে না। এখানকার খাবার খেয়ে পুরোনো স্কাইরুমের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, আর তখনই আদিত্য ঠিক করেছিল কেয়াকে নিয়ে একদিন এখানে আসতে হবে।
বহরমপুর থেকে ফেরার পথে আদিত্য লালগোলা ধরেছে। ট্রেনে ফিরতে ফিরতে বারবার কেয়ার কথা মনে হচ্ছিল। সম্পর্কটা আর এভাবে ভাসতে দেওয়া যায় না। একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে। গতকাল সে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। তার পেশায় এটা একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। কেয়াকে এসবের মধ্যে জড়িয়ে ফেলা কি ঠিক হবে? যদি ঠিক না হয় তাহলে এখনই তার উচিত কেয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা শেষ করে দেওয়া। কিন্তু তার আগে কেয়াকে নিয়ে ওই নতুন রেস্টোরেন্টটাতে যেতেই হবে।
পলাশি থেকে অনেকগুলো কলেজের ছেলেমেয়ে উঠল। ওরা আদিত্যর কাছেই বসেছে। আড়ি পেতে ওদের কথা শুনতে আদিত্যর বেশ লাগছিল। এই বয়সে ছেলেমেয়েরা সামান্য কারণে প্রাণ খুলে হাসতে পারে, যেটা আদিত্য আর পারে না। কথাটা ভেবে আদিত্যর একটু বিষণ্ণও লাগছিল। ঘণ্টা দেড়েক পরে ওরা কৃষ্ণনগরে নেমে যেতে ট্রেনটা ফাঁকা হয়ে গেল। আর আদিত্যও ঘুমিয়ে পড়ল।
আদিত্য যখন মেসে পৌঁছল তখন খাবার ঘর দুপুরের খাওয়ার জন্য আর খোলা নেই। শেয়ালদায় নেমে আদিত্য ভেবেছিল জোরে পা চালিয়ে হাঁটলে লাঞ্চ বন্ধ হবার আগে পৌঁছে যেতে পারবে। অল্পের জন্যে সেটা হল না। আজকাল বোধহয় উইকডেগুলোতে একটু আগেই এরা দুপুরের খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে।
আদিত্যর ভাগ্য ভাল বলরামকে দেখতে পেয়ে গেল।
‘টোস্ট-মামলেট নিয়ে আসতে পারবি? দুটো মাখন-মরিচ টোস্ট আর একটা ডবল ডিমের মামলেট। আর চা। তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। খুব খিদে পেয়ে গেছে।’
‘আমাকে একটা ফোন করে দিলে পারতে। আমি খাবার রেখে দিতাম। রাত্তিরে তো ফেরনি দেখলাম। কোথায় গেছিলে?’
‘বহরমপুর গেছিলাম। শেয়ালদায় নেমে ভাবলাম ঠিক পৌঁছে যাব। আজকাল আগে আগে খাবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে কেন রে?’
‘কেন আবার? ম্যানেজারবাবুর হুকুম। সকালে ভাত ডাল তরকারি বাঁচলে বিকেলে চালিয়ে দেওয়া যায়। যা পুকুর চুরি চলছে।’
‘তুই আগে খাবারটা নিয়ে আয়। খেয়ে নিয়ে তারপর চান করতে ঢুকব।’
আদিত্য ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ ফ্যান চালিয়ে বসল। তারপর বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে বিছানায় লম্বা হল। ঘড়িটা দেখে নিয়ে কেয়ার ফোনটা লাগাল। কেয়ার ইস্কুলে এখন টিফিন চলার কথা।
‘কলকাতায় ফিরেছ?’
‘ফিরেছি।’
‘কখন ফিরলে?’
‘এই কিছুক্ষণ আগে। মেসে ফিরে ফোন করছি।’
‘লাঞ্চ খেয়েছ?’
‘মেসে ফিরে দেখলাম লাঞ্চ বন্ধ হয়ে গেছে। বলরামকে টোস্ট-অমলেট আনতে দিয়েছি।’
‘টোস্ট-অমলেট খেলে পেট ভরে? সকালে কটায় বেরিয়েছ?’
‘বেশ ভোরে বেরিয়েছি। শুধু চা-বিস্কুট খেয়ে। শোনো, আজ সন্ধেবেলা দেখা করতে পারবে? আজ তো বুধবার, তোমার টিউশানি নেই।’
কেয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর দ্বিধা-জড়ানো গলায় বলল, ‘আমাদের ইস্কুলের শকুন্তলাদির সঙ্গে আজ একটু সিটি সেন্টারে যাব বলেছিলাম। অনেকদিন ধরে বলে রেখেছে। কাল আর পরশু তো সন্ধেবেলা পড়ানো আছে। শনিবার দেখা করবে?’
‘ঠিক আছে। শনিবারই দেখা হবে তাহলে। যদি বেঁচে থাকি।’
‘ও আবার কী কথা? হঠাৎ কী হয়েছে তোমার?’
আদিত্য বলতে চেয়েছিল, ‘কেয়া, কাল আমি একেবারে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। তাই তোমাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।’
কিন্তু সেসব না বলে সে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি। এমনি মজা করে বললাম। তুমি আজ ঘুরে এস। শনিবার দেখা হবে। তার আগে ফোন করে নেব।’
আদিত্য ফোন কেটে দিয়ে দেখল বলরাম খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিমল ফোন করল খাওয়া শেষ হবার আরও মিনিট পনেরো বাদে।
‘তুমি এখন কোথায়?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে লেগে আছি স্যার। উনি আজ আবার সিঙ্গুরের ওই বাড়িটায় গিয়েছিলেন। সঙ্গে একটা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ছিল। একটু আগে একটা সুটকেস নিয়ে আবার ওই হোটেলটায় এসেছিলেন।’
‘কত বড় সুটকেস?’
‘কালো রঙের বড় একটা সুটকেস। ওই যেরকম সুটকেস নিয়ে লোকে বেড়াতে যায়।’
‘তারপর?’
‘আমি বাইরে ভাড়া গাড়িটায় বসে অপেক্ষা করলাম। উনি কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন। এবার কিন্তু হাতে সেই সুটকেসটা আর নেই।’
‘তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে উনি বিভিন্ন জায়গায় রকমারি ব্যাগ-সুটকেস পৌঁছে দেবার কাজ নিয়েছেন।’
‘তাই হবে স্যার। আমি তো তাই দেখছি।’
‘শোনো, তুমি লোকটাকে চোখে চোখে রাখ। তারপর আমাকে রাত্তিরের দিকে ফোন কোরো।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
‘তুমি কাজ থেকে কতদিনের ছুটি নিয়েছ?’
‘আপাতত তিনদিনের ছুটি নিয়েছি স্যার। কাল পর্যন্ত ছুটিতে আছি।’
‘ঠিক আছে। হয়তো কালই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। নাহলে আর বড় জোর দু-তিন দিন। তাহলে রাত্তিরে আমাকে ফোন কোরো, কেমন?’
বিমলের ফোনটা কেটে দিয়ে এবার গৌতমকে ফোন করল আদিত্য। প্রায় আধঘণ্টা ধরে কথা বলল। একটা যুদ্ধের ছক তৈরি হচ্ছে। কাল থেকে যুদ্ধ শুরু হবে।
‘এই হেমন্তটা শোন। খুব রেয়ার। নিখিল ব্যানার্জী, বাহাদুর খান ডুয়েট। ১৯৬১ সালে বেনারসে বাজিয়েছিল। হেমন্ত-এর পরে মানঝ খাম্বাজ। ইউ-টিউবে খানিকটা আছে। পুরোটা নেই। বহু কষ্টে এক বন্ধুর পরিচিতের কাছ থেকে পুরোটা জোগাড় করেছি। ভদ্রলোকের বাড়ি বেনারসে। বিএইচইউ-তে ইতিহাস পড়ান। এই পিসটা ওর বাবার কালেকশান থেকে উদ্ধার করলাম।’ অমিতাভর গলায় প্রবল উৎসাহ। ‘এরপর রবিশঙ্করের দুটো হেমন্ত শোনাব। একটা আরলি ফিফটিস আর একটা সিক্সটিসের মাঝামাঝি। শুনলেই দুটোর মধ্যে তফাতটা বুঝতে পারবি।’
কেয়ার সঙ্গে দেখা হল না বলে আদিত্যর মেজাজটা খারাপ হয়ে ছিল। মন ভাল করতে অমিতাভদের বাড়ি চলে এসেছে। ভালই হল। সন্ধেটা আড্ডা দিয়ে গান শুনে কেটে যাবে।
‘এই আদিত্য। তুই কিন্তু রাত্তিরে খেয়ে যাবি।’ রত্না রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল।
নিখিল ব্যানার্জী খরজের তারে সুর লাগিয়েছেন। বাহাদুর খাঁ তার ওপরের সপ্তকে সঙ্গ দিচ্ছেন।
‘আমাকে আজ তাড়াতাড়ি উঠতে হবে রে। কাল সকালে কাজ আছে।’ আদিত্য গলা তুলে বলল।
‘ঠিক আছে। নটার মধ্যে আমার রান্না হয়ে যাবে।’
কিছুক্ষণ ধরে বাজনা চলছে। অমিতাভ, আদিত্য দুজনেই চুপ করে শুনছে। হঠাৎ একটা দরকারি কথা মনে পড়ে যাওয়াতে অমিতাভ বলে উঠল, ‘দাঁড়া। তোকে একটা কথা বলার ছিল। এখনই বলে দিই। পরে ভুলে যাব। বাজনাটা একটু বন্ধ করছি। আদিত্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খুব দরকারি কথা না হলে তো অমিতাভ বাজনা থামায় না।
‘সেদিন তোর সঙ্গে আমার পুরোনো বন্ধু নীলাদ্রির আলাপ করিয়ে দিলাম মনে আছে?’ অমিতাভ বাজনাটা পজে দিতে দিতে বলল।
‘হ্যাঁ, মনে আছে। তার কী হয়েছে?’
‘তার কিছু হয়নি, সে বহাল তবিয়তেই আছে। কিন্তু তার ছাত্র, শুভঙ্কর সামন্ত বলে সেই বর্ধমানের ডাক্তার, সে হঠাৎ রুগি, হাসপাতাল সব ফেলে উধাও হয়ে গেছে। তুই তার সঙ্গে দেখা করার পর থেকেই সে উধাও। শুভঙ্কর ওই অঞ্চলের খুব নির্ভরযোগ্য একজন বাচ্চাদের ডাক্তার। খুব দুর্মুখ, কিন্তু ভাল ডাক্তার বলে সকলেই সেসব মেনে নেয়। সে হঠাৎ উধাও হয়ে যেতে বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা খুব বিপদে পড়ে গেছে। নীলাদ্রিই তো তোকে তার কাছে পাঠিয়েছিল। তুই কি তাকে কিছু বলেচিস যাতে সে ভয় পেয়ে যেতে পারে? নীলাদ্রি খুব উতলা হয়ে আমাকে ফোন করেছিল।’
‘আরে না না। আমি তাকে তেমন কিছু বলিনি। বরং সে-ই আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে বলেছিল। আসলে আমি তো শুভঙ্কর সামন্তকে সাহায্য করতেই গিয়েছিলাম। লোকটা সেটা বুঝতেই চাইল না। ওর বাবার দু-নম্বরি টাকায় ও একটা নার্সিং হোম বানাচ্ছে। ওর হাবেভাবে মনে হল, টাকাটা কোথা থেকে আসছে সেটা নিয়ে ওর কোনও মাথাব্যথা নেই। যেহেতু নার্সিং হোম বানানোর উদ্দেশ্যটা মহৎ তাই টাকার সোর্সটা নিয়ে ভাবতে ও রাজি নয়। কিন্তু এন্ড দিয়ে তো মিনস জাসটিফাই করা যায় না। সেটাই ওকে বলতে গেছিলাম, কিন্তু ও এমন তেড়ে উঠল যে আমারও রাগ হয়ে গেল। আমি ওকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে চলে এলাম। এখন তুই বলছিস লোকটা গা ঢাকা দিয়ে আছে। তার মানে হয় লোকটা খুব ভিতু আর না হয় গভীর কোনও গণ্ডগোলের সঙ্গে ওর যোগ আছে। যাই হোক, মনে হচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যে এই কেসটার একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। তখন ডাঃ শুভঙ্কর সামন্তর আসল চেহারাটাও স্পষ্ট হয়ে যাবে। তুই এইটুকু তোর বন্ধুকে বলে দিতে পারিস।’
অমিতাভ আবার বাজনাটা চালিয়ে দিয়েছে। হেমন্ত-এর আলাপ-জোড়-ঝালা শেষ হয়ে সবে মানঝ খাম্বাজ শুরু হয়েছে এমন সময় গৌতমের ফোন।
‘লোকটা নিজে এসে হোটেল থেকে ওটা কালেক্ট করে নিয়েছে। আজ রাত্তিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। কাল কিন্তু তোকে আমি সকাল সকাল তুলে নেব।’
‘এই একটু পরেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ছি।’ আদিত্য বলার সাহস পেল না সে এখন অমিতাভদের বাড়িতে।
রাত্তিরে আদিত্য যখন বাড়ি ফিরল তখন প্রায় এগারোটা বাজে। বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগে বিমল ফোন করল।
‘লোকটা একজন মহিলাকে নিয়ে বাইপাসে একটা পাঁচতারা হোটেলে এসেছিল স্যার। বোধহয় ওর বান্ধবী। একটু আগে বান্ধবীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে লোকটা বাড়ি ফিরে গেছে।’
‘ঠিক আছে। তুমি বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়। কাল খুব ভোরে উঠতে হবে।’
এত সকালে আদিত্য কখনও লালবাজারে আসেনি। গৌতম তাকে নিয়ে যখন লালবাজারে ঢুকল তখন সবে ছটা বেজেছে। গৌতমের ঘরের সামনে একজন বেয়ারা অত সকালেও বসেছিল। সম্ভবত সে জানত সাহেব সকাল সকাল আসবে। গৌতম তাকে দেখতে পেয়ে আদিত্যকে জিজ্ঞেস করল, ‘চা খাবি, না কফি?’ তারপর নিজেই বলল, ‘এখন কফিই হোক। ঘুমটা কাটবে। পরে চা খাব।’
গৌতমের ঘরের একদিকে বেশ আরামদায়ক একটা সোফা সেট আছে। গৌতম বলল, ‘তুই আরাম করে সোফায় বোস। আমি আমার টেবিলে বসে কয়েকটা ফাইল দেখে নিই। কাল বিকেলেই ফাইলগুলো ছেড়ে দেবার কথা ছিল, হয়ে ওঠেনি।’
আদিত্য বসে বসে ভাবছিল। এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের করণীয় আর কিছু নেই। সিঙ্গুরের সেই বাড়িটায় পুলিশ রেড করতে গেছে। বাড়িটা চিনিয়ে দেবার জন্য বিমল গেছে পুলিশের সঙ্গে। তারা যখন লালবাজারে ঢুকছিল তখন খবর এল পুলিশ সদ্য সিঙ্গুরে পৌঁছেচে। কফি এল। তার সঙ্গে চারটে খবর কাগজ। আদিত্য একটা ইংরেজি কাগজ তুলে হেডলাইনগুলোতে চোখ বোলাচ্ছে এমন সময় গৌতম তার কফির কাপটা নিয়ে সোফায় এসে বসল।
‘মালিনী কেমন আছে রে? অনেকদিন দেখা হয়নি।’
‘এমনিতে ঠিকঠাকই আছে, তবে কাজের খুব চাপ। আজকাল কর্পোরেট সেক্টরের মতো সরকারি চাকরিতেও টার্গেট দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুখে থাকা শক্ত।’
‘মেয়ের তো এইট হয়ে গেল?’
‘হ্যাঁ। দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। বুঝতে পারি আজকাল মেয়ের নিজস্ব জগৎ হয়েছে। আমরা সেখানে ঢুকতেই পারি না।’ গৌতমের গলাটা বিষণ্ণ শোনাল।
গৌতমের ফোনটা বেজে উঠেছে। গৌতম ফোনটা রিসিভ করে স্পিকার মোডে দিয়ে দিল যাতে আদিত্যও শুনতে পায়।
‘সিঙ্গুর থেকে ইন্সপেক্টার প্রদীপ রাহা বলছি স্যার। আমি এখানে চার্জে আছি।’
‘হ্যাঁ, বলুন কী হল?’ গৌতমের গলায় উৎকণ্ঠা।
‘অপরেশন শেষ হয়ে গেছে স্যার। বাবলু মণ্ডল ক্যাপচার্ড হয়েছে। তবে সিরিয়াসলি ইনজিয়োর্ড। বাঁচার আশা কম। তিন চারটে জায়গায় গুলি লেগেছে। প্রফিউস ব্লিডিং হচ্ছে। আমরা ওকে যত তাড়াতাড়ি পারি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘আমাদের কেউ জখম হয়নি তো?’
‘হয়েছে স্যার। দুজন এ এস আই জখম হয়েছে। রাণা বাগ আর সলমন আলি। তার মধ্যে সলমনের আঘাতটা বেশ সিরিয়াস। পাঁজরায় গুলি লেগেছে স্যার। হার্টে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যেত। আমরা ওদের দুজনকেও হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। এই বাবলু মণ্ডল ভীষণ খতরনাক ক্রিমিনাল স্যার। পুলিশ দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার ওপেন করেছে। অত তাড়াতাড়ি বন্দুক বার করবে বুঝতে পারিনি। রাণা আর সলমন সামনে ছিল, তাই জখম হয়েছে।’
‘বাড়িটা থেকে কিছু পাওয়া গেল?’
‘প্রচুর ক্যাশ পাওয়া গেছে স্যার। এখনও কাউন্ট করা হয়নি, তবে ওপর ওপর দেখে মনে হল ষাট-সত্তর লাখ হবে। চারটে ফায়ার আর্ম পাওয়া গেছে। দুটো চাইনিজ নাইন এম এম পিস্তল, একটা টেলিস্কোপ লাগানো জার্মান রাইফেল আর একটা দিশি ওয়ান শটার। আর তিনটে মোবাইল পাওয়া গেছে।’
‘ভেরি গুড। আপনার অপারেশন সাকসেসফুল। কনগ্র্যাচুলেশনস।’
‘থ্যাংক ইউ স্যার, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ স্যার।’
‘ঠিক আছে। আপনারা আহতদের নিয়ে হাসপাতালে যান। ওখানে পৌঁছে একটা খবর দেবেন।’
‘স্যার।’
ফোনের কানেকশনটা অফ করে গৌতম আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার তাহলে বেরিয়ে পড়ি?’
‘আরও দুটো খবর আসা তো বাকি রয়ে গেল।’ আদিত্য একটু ইতস্তত করে বলল, ‘চল, বেরিয়েই পড়ি। পথে যেতে যেতে মনে হয় খবর এসে যাবে। সব থেকে টাফ অপরেশনটাই তো হয়ে গেল। আমি ভাবিনি এত সহজে হয়ে যাবে।’
গৌতমের গাড়িটা যখন এসপ্লানেড পেরোচ্ছে শিকদারের ফোন এল।
‘জাহাঙ্গির খান অ্যারেস্টেড হয়েছে স্যার। একটু রেজিস্ট করছিল। তবে লোকটা সত্যিই ইনভ্যালিড। তাই কোনও অসুবিধে হয়নি। আমরা ওকে নিয়ে লালবাজারে আসছি।’
‘ওকে। ওয়েল ডান। চলে আসুন।’
গৌতম ফোনটা পকেটে পুরে আদিত্যকে জাহাঙ্গির খান অ্যারেস্ট হবার খবরটা সবে দিয়েছে, আবার ফোন এল। এবার ইন্সপেকটার চাকি। গৌতম ফোনটাকে স্পিকার মোডে দিয়ে দিয়েছে।
‘অ্যারেস্ট হয়ে গেছে স্যার। কোনও ঝামেলা করেনি। শুধু বারবার বলছে, আমি নির্দোষ। আমাকে মিছিমিছি আপনারা হ্যারাস করছেন।’
‘ঠিক আছে, আপনি ওকে নিয়ে লালবাজারে চলে আসুন। আমরা একটু পরে পৌঁছচ্ছি। ওর মোবাইলগুলো সিজ করেছেন তো?’
‘করেছি স্যার। দুটো মোবাইল পাওয়া গেছে।’
‘ঠিক আছে। চলে আসুন।’
সোয়া সাতটা নাগাদ আদিত্য আর গৌতমকে নিয়ে গৌতমের গাড়িটা বটুকবাবুর গেটের সামনে দাঁড়াল। পেছনে আর একটা পুলিশের গাড়ি, তাতে দুজন মহিলা পুলিশও আছে।
আদিত্য লক্ষ করল আজও বি এম ডাবলুটা জায়গায় নেই, শুধু হন্ডা অ্যাকর্ডটা দাঁড়িয়ে আছে। সেই উর্দিপরা বেয়ারাটাই দরজা খুলল। অতগুলো পুলিশ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে।
‘বটুকবাবুকে খবর দাও। বাড়ি সার্চ করা হবে।’
খবর দিতে হল না। বটুকবাবু নিজেই নিচে নেমে এসেছেন। তাঁর পেছন পেছন সুমনা ঘোষাল।
‘মিঃ সত্যজিৎ সামন্ত, আপনার বাড়ি সার্চ করা হবে। আমাদের কাছে ওয়ারেন্ট আছে।’ গৌতম পুলিশি গাম্ভীর্য নিয়ে বলল। ‘আমি অ্যাডিশানাল পুলিশ কমিশানার গৌতম দাশগুপ্ত আর ইনি আমার বন্ধু আদিত্য মজুমদার, কুমুদিনীর কেসটাতে আমাদের সাহায্য করছেন। আদিত্যর সঙ্গে বোধহয় আপনাদের আগেই পরিচয় হয়েছে।’
‘আপনারা কিছুদিন আগেই তো সার্চ করলেন। কিছুই তখন পাওয়া যায়নি। আবার কেন সার্চ করবেন? পুলিশ কিন্তু বারবার এইভাবে নিরপরাধ নাগরিকদের উত্যক্ত করতে পারে না।’ বটুকবাবুর গলায় অসীম বিরক্তি। সেটা আসল না বানানো বোঝা গেল না।
‘আপনি নিরপরাধ কিনা ভবিষ্যৎ বিচার করবে। আপাতত আমাদের কাজ করতে দিন। আমার অফিসাররা যতক্ষণ বাড়িটা সার্চ করবে ততক্ষণ আমরা আপনার অনুমতি নিয়ে এখানে বসছি। আপনাদের দু-জনের সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে। আপনারা দুজনেও প্লিজ বসুন।’ কথাগুলো বলে গৌতম বসে পড়ল। তার দেখাদেখি আদিত্যও।
একটু ইতস্তত করে বটুকবাবু বসল বটে কিন্তু সুমনা ঘোষাল দাঁড়িয়েই রইল। কয়েকবার অনুরোধ করেও তাকে বসানো গেল না। সুমনা ঘোষালের মুখে পরিষ্কার একটা আশঙ্কা ফুটে উঠেছে।
‘মিঃ সামন্ত, আপনাকে প্রথমেই জানাই কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য আমরা সমাধান করে ফেলেছি। এই কঠিন কাজটা অবশ্য মূলত করেছে আমার বন্ধু আদিত্য মজুমদার। আমরা তাকে সাধ্যমত সাহায্য করেছি। আমরা ঠিক কী জানতে পেরেছি সেটা আমরা আপনাদের জানাতে চাই। সেটা জানলে আপনারা বুঝতে পারবেন কেন আবার আমরা আপনার বাড়িটা সার্চ করতে এসেছি।’
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি বলছেন, কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য আপনারা সমাধান করে ফেলেছেন। রহস্যটা কী সেটা প্রথমে বোঝা দরকার। আমি একটা ফিনানশিয়াল কম্পানি চালাই। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই পুলিশ এসে আমার অফিস সিল করে দিল। আমার ব্যবসা বন্ধ করে দিল। আমাকে এবং আমার অফিসারদের ধরে নিয়ে গেল। কেন এরকম করল, সেটাই তো আমার কাছে সব থেকে বড় রহস্য। এই রহস্যের উত্তর কি আপনারা দেবেন?’
‘নিশ্চয় দেব, বটুকবাবু। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কয়েকটা রহস্যের উত্তর আমাদের পেতে হবে। জাহাঙ্গির খানের পাঠানো কুড়ি কোটি টাকা কোথায় গেল? জাহাঙ্গির খান হঠাৎ ইউ এস ডলারে টাকাটা পাঠাল কেন? নাকি জাহাঙ্গির খান আসলে কোনও টাকাই পাঠায়নি? আপনার কর্মচারি ফিরদৌস রহমানকে কে খুন করল? কেন খুন করল? গোবিন্দ রায়কেই বা কে খুন করল? আপনি হয়তো জানেন না, আপনার অফিসের লুকোনো সেফ থেকে পুলিশ এক কোটি টাকা ক্যাশ উদ্ধার করেছে। টাকাটা ওখানে কে রাখল? ইন ফ্যাক্ট, আপনার ক্লায়েন্ট পিটার অরোরার নাইটক্লাবে পল্লবী বলে যে মেয়েটি কাজ করত তার খুন হওয়ার সঙ্গেও কুমুদিনী রহস্যের গভীর যোগ আছে। অতএব সেই রহস্যটাও ভেদ করা দরকার। আর একটা প্রশ্ন। মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানি আপনাদের মারফত কোটি কোটি টাকা লেনদেন করত কেন? অন্য কোনও কম্পানি তো তার ধারেকাছেও লেনদেন করত না। সৌভাগ্যবশত, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরই আমরা পেয়েছি। একটাই প্যাটার্ন। একটাই গল্প। সেটা বুঝতে পারলে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। আপনি ও শ্রীমতী ঘোষাল একটু মন দিয়ে শুনুন। গল্পটা আদিত্য আপনাদের বলবে।’ গৌতম থামল। আদিত্যর দিকে তাকাল। বটুক সামন্ত নিশ্চুপ। সুমনা ঘোষাল বটুকবাবুর পাশে বসে পড়েছে।
‘আপনাদের গল্প শোনার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। চল মিতুল, আমরা ওপরে গিয়ে বসি। আপনাদের কাজ হয়ে গেলে দয়া করে আমাদের জানাবেন।’ বটুকবাবু উঠে দাঁড়ালেন।
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমরা আপনাদের গল্প শোনার জন্য বাধ্য করতে পারি না। তবে একটা কৌতূহল হচ্ছে। বটুকবাবু আপনার বি এম ডাবলু গাড়িটা কোথায় গেল? ওটাকে কিছুদিন হল দেখছি না।’ আদিত্য ঠান্ডা গলায় বলল।
‘ওটা বিক্রি করে দিয়েছি। আমার ব্যবসাপত্র তো আপনারা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমার সংসার চলবে কী করে?’ বটুকবাবুর গলায় তিক্ততা।
‘গাড়িটার যা দাম আপনার সংসার চালাতে অত টাকা লাগার কথা নয়। আমাদের খবর, কোনও কারণে আপনার হঠাৎ অনেক টাকার দরকার হয়েছিল এবং সেই জন্য আপনি গাড়িটা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। একই কারণে শুভঙ্কর সামন্তর নার্সিং হোম তৈরির জন্যেও কিছুদিন যাবত আপনি টাকা দিতে পারছিলেন না।’
‘আপনারা তো সবই জানেন দেখছি। তাহলে আর আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন?’ বটুকবাবু বেশ রেগে গেছেন।
‘ওই একটু মিলিয়ে নিচ্ছিলাম আর কি।’ গৌতম ঠাট্টার সুরে বলল।
‘শুনুন, আমরা আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য নই। আগে আমি আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলব। চল মিতুল, আমরা ওপরে যাই। আপনাদের সার্চ করা হয়ে গেলে দয়া করে আমাদের জানাবেন।’
বটুকবাবু সুমনা ঘোষালকে নিয়ে ওপরে উঠে যাবার পর আদিত্য আর গৌতম চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইল। গৌতমের সঙ্গীরা বাড়ি তোলপাড় করে খোঁজাখুঁজি করছে।
আদিত্য সিগারেট ধরিয়েছে। গৌতম বলল, ‘আমাকে একটা দে। ভীষণ টেনশান হচ্ছে। জিনিসটা না পাওয়া গেলে কিন্তু কোনও কেস দাঁড়াবে না।’
প্রায় পৌনে দু-ঘণ্টা কেটে গেল। সার্চ পার্টির লোকজন নিচে নেমে এসেছে। ক্রমাগত সিগারেট টেনে আদিত্যর অসুস্থ লাগছে। মাথা নিচু করে বসে আছে গৌতম।
সুমনা ঘোষালকে নিয়ে বটুকবাবু আবার নিচে নেমে এসেছেন। মুখে মুচকি মুচকি বিজয়ীর হাসি।
‘এত খোঁজাখুঁজি করেও তো কিছু পেলেন না। এবার তাহলে আপনারা আসুন, না কী? আমরা স্নান খাওয়া-দাওয়া করি। ব্যবসার কাজে আমাকে একটু বেরোতেও হবে।’ বটুকবাবু গৌতমের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম গলায় বললেন।
গৌতম আদিত্যর দিকে তাকাল। আদিত্য বটুকবাবুর কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বটুকবাবুকে বলল, ‘বটুকবাবু, আপনি কি জানেন আপনার ছেলেকে পুলিশ অ্যারেস্ট রেখেছে। আপনি খবর পেয়েছেন কি?’
‘শুভঙ্করকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে? কখন? আজ সকালেই তো ওর সঙ্গে কথা হল। শুভঙ্করকে পুলিশ হঠাৎ অ্যারেস্ট করবে কেন?’ বটুকবাবুকে একই সঙ্গে বিভ্রান্ত এবং উদ্বিগ্ন দেখাল।
‘না, না। ডাঃ শুভঙ্কর সামন্তকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেনি। পুলিশ জানেও না তিনি কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছেন। জানতে চায়ও না। কিন্তু উনি ছাড়া আপনার আরও তো ছেলে আছে, বটুকবাবু?’
কথাটা বলে আদিত্য আড়চোখে সুমনা ঘোষালের দিকে তাকাল। সুমনা বটুকবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘শুভঙ্কর ছাড়া আমার আর কোনও ছেলে নেই। শুভঙ্কর আমার একমাত্র সন্তান।’ বটুকবাবু দৃঢ় গলায় বললেন।
আদিত্য দেখল সুমনার চোখে বিদ্যুৎ জমা হচ্ছে।
‘আমাদের কাছে কিন্তু খবর আছে আপনার আর একটি ছেলে আছে। কিন্তু যেহেতু সে আপনার বৈধ স্ত্রীর সন্তান নয়, আপনি তার পিতৃত্ব কোনও দিনই স্বীকার করেননি।’
‘আপনার খবর ভুল। মিথ্যে। একটা ডাহা মিথ্যে দিয়ে আমাকে আপনারা ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।’ বটুকবাবুর গলাটা সপ্তমে চড়ে গেছে। ‘আপনারা এবার যান। দয়া করে যান। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।’ বটুকবাবুর গলা তার সপ্তকে। উত্তেজনায় তিনি দাঁড়িয়ে উঠেছেন।
‘আমার খবরটা কিন্তু একেবারে পাকা।’ আদিত্য নিচু গলায় বলল।
‘না। পাকা নয়। মিথ্যে। মিথ্যে কথা। সম্পূর্ণ মিথ্যে।’ বটুকবাবু হিস্টিরিক হয়ে গেছেন।
‘মিথ্যে হবে কেন? আপনাদের খবরটা একেবারে সত্যি। একশোভাগ সত্যি। আর কতদিন সত্যিটাকে লুকিয়ে রাখবে? তোমার মতো কাপুরুষ, ইতর মানুষ আর দুটো দেখলাম না।’ সুমনা ঘোষালের গলাও চড়ে গেছে। তিনিও উঠে দাঁড়িয়েছেন। বটুক সামন্ত হতভম্ভ হয়ে গেছে।
আগুনঝরা দৃষ্টি নিয়ে বটুক সামন্ত আর সুমনা ঘোষাল পরস্পরের দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে রইল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে সুমনা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা শুধু বাড়ির ভেতরটা দেখছেন কেন? বাইরেটাও দেখুন।’
বটুক সামন্তকে বাড়ির ভিতরে রেখে আদিত্য আর গৌতম বাইরে বেরিয়ে এল।
‘আমরা এখানে আসার পর বাড়ি থেকে কেউ বেরোয়নি তো?’ আদিত্য একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করল।
‘আমরা কাউকে বেরোতে দিইনি স্যার। গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার বেরোতে চেয়েছিল। বলল তেল ভরতে যাবে। আমরা তাকেও বেরোতে দিইনি।’ পুলিশ অফিসারটি সসম্ভ্রমে জানাল।
‘গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার বেরোতে চেয়েছিল? আগে জানাননি কেন?’ আদিত্যর গলায় উত্তেজনা। গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গাড়িটা সার্চ করতে হবে।’
ড্রাইভার গাড়িতেই বসেছিল। তাকে বেরিয়ে আসতে বলল আদিত্য। তারপর পার্শ্ববর্তী পুলিশটিকে বলল, ‘সিটগুলো তুলে দেখুন, কিছু পাওয়া যায় কিনা।’
সিট তুলে কিছুই পাওয়া গেল না। ডিকিতেও কিছু নেই। বনেট খুলে দেখা গেল সেখানেও কিছু নেই।
ড্রাইভারটা বোকা বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য পুলিশটিকে বলল, ‘গাড়ির তলায় ঢুকে একটু দেখবেন, কিছু পাওয়া যায় কিনা?’
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে পুলিশটি গাড়ির তলায় ঢুকে গেল। যখন সে বেরোল তার পিঠে কাদার ছাপ, মুখে গ্রিজের কালি, কিন্তু হাতে দুটো মাঝারি সাইজের কালো বাক্সের মতো জিনিস রয়েছে। ভাল করে দেখলে বোঝা যায় ডেস্কটপ কম্পিউটারের দুটি হার্ড ডিস্ক।
‘গাড়ির নিচে সেলোটেপ দিয়ে লাগানো ছিল স্যার।’ পুলিশটি ঈষৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
একটু পরে, খবর পেয়ে সুমনা সহ বটুক সামন্ত যখন বাইরে বেরিয়ে এসেছে, গৌতম পুলিশি গাম্ভীর্য নিয়ে বলল, ‘আমাদের সার্চ শেষ হয়েছে। যা খুঁজছিলাম আমরা পেয়ে গেছি। আমরা এবার যাব। তবে বটুকবাবু, আমাদের সঙ্গে আপনাকেও লালবাজার যেতে হবে। আর সুমনা দেবী, আপনাকেও।’
‘আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন আমি আদালত থেকে জামিন পেয়েছি।’ বটুক সামন্ত উদ্ধতভাবে বলল।
‘ভুলিনি, বটুকবাবু। মোটেই ভুলিনি। আর তাই নতুন করে আদালত থেকে আপনার গ্রেপ্তারের অনুমতি করিয়ে এনেছি।’ গৌতম ঠান্ডা গলায় বলল।
‘কিন্তু আমাকে কেন আপনাদের সঙ্গে যেতে হবে? আমি কী করলাম?’ সুমনা ঘোষাল নিরীহভাবে বলল।
‘আপনি বটুকবাবুর ব্যাবসাপত্রের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানেন। তাই আপনাকেও আমাদের দরকার। আপনাকে গ্রেপ্তার করার ওয়ারেন্টও আমাদের আছে।’ গৌতম ঠান্ডা গলায় জানাল।
‘আমরা একেবারে অন্ধকারে রয়েছি স্যার। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। আমাদের একটু খুলে বলবেন কেসটার ব্যাপারে কীভাবে আপনি এগোচ্ছেন? কাকে সন্দেহ করছেন? সবটা ডিটেলে জানতে চাই স্যার।’ সাব-ইন্সপেক্টার চাকি ছেলেমানুষের মতো আবদারে গলায় বলল।
গৌতমের অফিস-সংলগ্ন যে মিটিং রুমটা আছে সেখানে আদিত্য, গৌতম, শিকদার, মুখুটি, প্রদীপ রাহা এবং চাকি ছাড়াও আরও কয়েকজন অফিসার জমায়েত হয়েছে। উপপত্নী সমেত বটুকবাবু গ্রেপ্তার হবার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে।
‘কুমুদিনীর কেসটা আমি মোটামুটি সলভ করে ফেলেছি।’ আদিত্য বলতে শুরু করল। ‘যে উপাখ্যানটা আমি বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড় করিয়েছি তাতে কিছু অনুমানও আছে। তবে সেগুলো এলোপাথাড়ি অনুমান নয়, বলা যায় এডুকেটেড গেস। কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য বুঝতে গেলে কুমুদিনীর আসল বিজনেস মডেলটা দিয়ে শুরু করতে হবে। ওপর ওপর কুমুদিনী শেয়ার কেনাবেচার দালালি করত। আর একটু তলায় তলায় লোকের দুনম্বরি টাকা সিনেমা-যাত্রা-নাইট ক্লাবে খাটানোর ব্যবস্থা করে দিত। কিন্তু কুমুদিনীর আসল ব্যবসাটা এই দুটোর কোনওটাই ছিল না। বটুক সামন্তর মূল ব্যবসাটা আমরা প্রথমে ধরতে পারিনি। তারপর একদিন চাকি আমাকে বলল, মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট নামে একটা কম্পানি কুমুদিনী মারফত শেয়ার বাজারে কোটি-কোটি টাকা খাটায়। ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক মনে হল। চাকি আর আমি মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানিতে গিয়ে দেখলাম একেবারে হতশ্রী একটা অফিস। দেখে মনে হয় না এরা কোটি-কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারে। কম্পানির মালিকের ঠিকানা জোগাড় করে সেখানেও হানা দেওয়া হল। আস্তে আস্তে জানা গেল কুমুদিনীর আসল ব্যবসা উগ্রপন্থীদের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে দেওয়া। কিছুদিন ধরে যে ব্যবস্থাটা চালু ছিল সেটা এইরকম। টাকাটা ইউ এস ডলারে বাংলাদেশ বর্ডার পেরিয়ে প্রথমে জাহাঙ্গির খানের কাছে আসত। হয়তো জাহাঙ্গিরের বাংলাদেশে বিড়ি রপ্তানির নেটওয়ার্কটা কোনওভাবে ব্যবহার করা হত। জাহাঙ্গির সেই ডলারটা পাঠিয়ে দিত বটুক সামন্তর কাছে। বটুক সামন্তর কাছ থেকে মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানি ডলারটা নিয়ে তাই দিয়ে ড্রাগ, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি বেআইনি জিনিসপত্র আমদানি করত। বলাই বাহুল্য, এই জিনিসগুলো কিনতে হত হার্ড ক্যাশ অর্থাৎ ডলার দিয়ে। তাই তাদের ডলারের দরকার হত। ডলারের বদলে সমান মূল্যের টাকা উগ্রপন্থীদের অ্যাকাউন্টে মহাদেব কম্পানি ট্রান্সফার করে দিত। এই উগ্রপন্থীরা ভারতে অপরেট করে। তাই তাদের দরকার ইন্ডিয়ান রুপি। পুরো ডিলটা থেকে কুমুদিনী যে টাকাটা পেত সেটা মহাদেব কম্পানির হয়ে শেয়ার কেনাবেচার কমিশন হিসেবে কুমুদিনীর খাতায় দেখানো হত। বলাই বাহুল্য, এসব ডিল থেকে জাহাঙ্গিরও একটা মোটা টাকা পেত।
‘উগ্রপন্থীদের অ্যাকাউন্ট নাম্বারগুলো মাঝেমাঝেই বদলে যেত। কোন অ্যাকাউন্টে কত টাকা পাঠাতে হবে তার একটা মাস্টার লিস্ট থাকত বটুকবাবুর ঘরের দুটো কম্পিউটারের মধ্যে। এই কম্পিউটার দুটোর মধ্যে কুমুদিনীর অন্যান্য জায়গায় খাটানো টাকার হিসেবও থাকত। মানে সিনেমা-যাত্রা-নাইট ক্লাব জাতীয় প্রকল্পে যে টাকাটা খাটত তার হিসেব। যেহেতু এই টাকারও অনেকটা দু-নম্বরি টাকা, বটুকবাবু নিজের কম্পিউটারে এই হিসেবটাও রাখতেন, অন্য কাউকে বিশ্বাস করতেন না।
‘সব কিছুই বেশ ভাল চলছিল। লালবাজারে ছিল বটুকবাবুর অর্থভুক এক পুলিশ। পুলিশের দিক থেকে যাতে কোনও ঝামেলা-টামেলা না হয়, সেটা সে দেখত। পুরো ব্যবসাটার কথা জানত ঠিক তিনজন। বটুক সামন্ত, তার একান্ত বিশ্বাসী কর্মচারী ফিরদৌস রহমান আর বটুকবাবুর অর্থভুক সেই পুলিশ। আগে ডলার ঢুকত অন্য একটা চ্যানেলে। সেই চ্যানেলটায় কিছু একটা সমস্যা দেখা দেওয়ার ফলে একটা বিকল্পের দরকার হয়েছিল। ফিরদৌসই তখন জাহাঙ্গিরের সঙ্গে বটুকের আলাপ করিয়ে দেয়। ফিরদৌসকে বটুক সামন্ত সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত।
‘জাহাঙ্গির খানও কিন্তু বটুক সামন্তর আসল ব্যবসার ব্যাপারটা পরিষ্কার জানত না। তাকে সেটা জানানো হয়নি। জানানোর দরকারও ছিল না। বস্তুত, এসব ব্যাপার যত কম লোক জানে তত ভাল। জাহাঙ্গির শুধু জানত কিছু বেআইনি ডলার বাংলাদেশ থেকে তার হাতে এসে পৌঁছলে তাকে সেই টাকা বটুক সামন্তর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কাজটা আদৌ শক্ত নয়। কিন্তু কাজ হয়ে গেলে মোটা টাকা তার ঘরে আসবে। সে সেই মতো কাজ করে ভাল টাকা কামাচ্ছিল।’
বেয়ারা চা নিয়ে এসেছে। অফিসারদের জন্য কাগজের কাপে, অ্যাডিশানাল কমিশানার সাহেব এবং তাঁর বন্ধু আদিত্য মজুমদারের জন্য ফাইন চায়নার পেয়ালা-পিরিচে। পুলিশের মধ্যে এটুকু হায়ারারকি থাকবেই।
চিনি-দুধ দেওয়া চা, চমৎকার ফ্লেভার। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আদিত্যর মনে পড়ল, কোথায় যেন পড়েছিল, ব্রিটিশ আমলের ‘পুক্কা সাহিব’রা দুধ-চিনি দিয়েই দার্জিলিং চা পছন্দ করত।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আদিত্য আবার বলতে শুরু করল, ‘সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল, হঠাৎ দিল্লি থেকে নির্দেশ এল ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেআইনি ফিনান্স কম্পানিগুলোর ওপর ক্র্যাক ডাউন করতে হবে। কুমুদিনী অবশ্য ঠিক ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ফিনান্স কম্পানি নয়, তার ব্যবসা অনেক দিনের, কিন্তু ব্যবসাটা যে বেআইনি তাতে তো সন্দেহ নেই। তাই অন্যান্য কম্পানির সঙ্গে সঙ্গে কুমুদিনীও পুলিশ রেড-এর কোপে পড়ল। কুমুদিনী রেড হবে এই খবরটা বটুক সামন্তর কাছে পৌঁছল একেবারে শেষ মুহূর্তে, যেদিন সকালে রেড হবে তার আগের রাত্তিরে। দুর্ভাগ্যবশত, কুমুদিনীর বেতনভুক পুলিশটি এর আগে খবরটা পায়নি, তাই বটুককেও জানাতে পারেনি।
‘খবরটা শুনে বটুকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আগেই বলেছি, বটুকের ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য তার ঘরের দুটো কম্পিউটারে থাকত। সেসব তথ্য পুলিশের হাতে পড়লে সমূহ সর্বনাশ। রেড হবার আগে এই কম্পিউটার দুটোর হার্ড ডিস্কগুলো খুলে বার করে নেবার সময় ছিল না। অত রাত্তিরে কম্পিউটার মেকানিক কোথায় পাওয়া যাবে? তাছাড়া হার্ড ডিস্ক ছাড়া দুটো কম্পিউটার পড়ে রয়েছে দেখতে পেলে পুলিশও সন্দেহ করবে। তাই রেড হবার আগের রাত্তিরে, সিপিইউ, মনিটার, কিপ্যাড সব সমেত কম্পিউটার দুটো একটা নীল ব্যাগে ভরে নিয়ে ফিরদৌস হাওয়া হয়ে গেল। বটুকবাবুই একটা গাড়িতে তুলে তাকে বিদায় করে দিলেন। ঠিক হল, অজ্ঞাতবাসের একটা নির্ভরযোগ্য আস্তানা খুঁজে নিয়ে সে পরে বটুকবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। পরের দিন বেলা বারোটা নাগাদ সিতারা হোটেলে ফিরদৌস চেক ইন করল। সম্ভবত যুৎসই একটা আস্তানা খুঁজে পেতে তার একটু সময় লেগে গিয়েছিল।’
‘এই নীল ব্যাগের ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটার কথা ভাল করে বল।’ গৌতম এতক্ষণ পরে মুখ খুলেছে।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। নীল ব্যাগের প্রসঙ্গ বারবার আসবে। তাই জানিয়ে রাখি গত ক্রিসমাসে কুমুদিনী তার ক্লায়েন্টদের এবং কিছু কিছু কর্মচারীকে একটা করে বড় নীল ব্যাগ গিফট দিয়েছিল। অন্যদের মতো জাহাঙ্গির খানও ওইরকম একটা ব্যাগ উপহার পেয়েছিল, ফিরদৌসও পেয়েছিল। ব্যাগগুলো সব এক রকম দেখতে। ওই নীল ব্যাগটা করেই রেড হবার আগের দিন ফিরদৌসের হাত দিয়ে জাহাঙ্গির খান কুড়ি কোটি টাকা পাঠিয়েছিল। ইন ফ্যাক্ট, ব্যাগটা টাকা ক্যারি করার কাজেই লাগত। যেদিন জাহাঙ্গির খানের লোক আমাকে হালিশহরে নিয়ে যেতে এসেছিল সেদিনও ব্যাগটা তাদের সঙ্গে ছিল। আমাকে জাহাঙ্গিরের ম্যানেজার তারক দাস বলেছিল কলকাতা থেকে কালেক্ট করা কিছু পেমেন্ট তারা ব্যাগটাতে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে, ব্যাগটা আমি দেখেছি। জাহাঙ্গির খানের কুড়ি কোটি টাকা পাঠানোর প্রসঙ্গে পরে আসব। আপাতত বলি, সকলকে দেবার পরেও একটা ব্যাগ বেঁচে গিয়েছিল। সেটা কুমুদিনীর আপিসেই পড়েছিল। ফিরদৌস সেই ব্যাগটা করেই কম্পিউটার দুটো নিয়ে যায়।’
জানলায় চিৎপুর। ট্র্যাম। দুপুরে বাসগুলো কিছুটা ফাঁকা। রোদ্দুরে শহরটা ঝলসে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর এসি চলছে বলে বাইরের গরমটা টের পাওয়া যায় না। চায়ের কাপের তলানিটা মুখে ঢেলে দিয়ে আদিত্য আবার শুরু করল।
‘বটুকের সঙ্গে ফিরদৌসের একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া হয়েছিল। যতদিন না পুলিশের ঝামেলা পুরোপুরি চুকে যায় ততদিন তারা পরস্পরকে ফোন করবে না। বটুক ধরে নিয়েছিল কুমুদিনী রেড হবার পর তার ফোন পুলিশ ট্যাপ করবে। তাই ফোনে গোপন কোনও কথা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সরাসরি ফোনে কথা না হোক, যোগাযোগ তো একটা রাখতেই হবে। অন্তত দুটো জিনিস বটুকের জানা দরকার। এক, জানতে হবে ফিরদৌস কোথায় গিয়ে লুকোল। দুই, জানতে হবে, হার্ড ডিস্ক দুটো কম্পিউটার থেকে বার করা গেল কিনা। কার মাধ্যমে বটুক ফিরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ করবে? অর্থভুক পুলিশটি জানাল তার মাধ্যমে এই কাজ সম্ভব নয়। তার পক্ষে এই কাজ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। অতএব বটুক, ফিরদৌস এবং অর্থভুক পুলিশ এই তিনজন ছাড়াও চতুর্থ এক ব্যক্তিকে বৃত্তের মধ্যে নিয়ে আসা হল, যার মাধ্যমে ফিরদৌস বটুক সামন্তর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এই ব্যক্তিকে বটুকের ব্যবসার খানিকটা জানাতেই হল।’
‘এই চতুর্থ ব্যক্তিটি কে সেটা কি জানতে পেরেছেন?’ চাকি উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘পেরেছি। তার কথায় একটু পরেই আসছি। আগে দেখা যাক ফিরদৌসের কী হল। সিতারা হোটেলে পৌঁছে ফিরদৌসের প্রথম কাজ হল দুটো কম্পিউটার থেকে দুটো হার্ড ডিস্ক বার করার ব্যবস্থা করা। কাজটা সে নিজে পারবে না। তার জানা একজন বিশ্বাসী কম্পিউটার মেকানিক আছে যে কাজটা পারবে। কিন্তু তার ফোন নম্বরটা ফিরদৌসের কাছে নেই। সে স্ত্রীকে ফোন করে মেকানিকের নম্বরটা চেয়ে নিল। এটা তার স্ত্রী আমাকে বলেছে। মেকানিকের নাম জয়দেব। আমি জয়দেবের ফোন নম্বরটা ফিরদৌসের স্ত্রীর কাছ থেকে জোগাড় করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম সে ফিরদৌসের কথা মতো হোটেল সিতারায় এসে দুটো কম্পিউটার সমেত ব্যাগটা তার দোকানে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর দুটো হার্ড ডিস্ক বার করে হোটেল সিতারায় ফিরদৌসের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। ফিরদৌস তাকে কম্পিউটারের বাকি অংশগুলো রেখে দিতে বলেছিল। তাই সে সেগুলো রেখে দিয়েছে। কিন্তু যে ব্যাগটা করে সে কম্পিউটার দু-টো নিয়ে এসেছিল সেটা সে ফিরদৌসকে ফেরত দিয়েছিল। বস্তুত ওই ব্যাগটা করেই সে হার্ড ডিস্ক দুটো সিতারা হোটেলে ফেরত নিয়ে গিয়েছিল। হার্ড ডিস্ক দুটো পাবার পর ফিরদৌস সেগুলো অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়েছিল। আমরা তাই ব্যাগটা ফাঁকা দেখেছিলাম।
‘হার্ড ডিস্ক দুটো ফিরদৌস কোথায় সরিয়ে রেখেছিল?’ সোমেন মুখুটি প্রশ্ন করল।
‘একটা ডিস্ক সে তার কলিগ গোবিন্দ রায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল। আর একটা সে তার ছোটবেলার সুইটহার্ট জয়া অধিকারীর বাড়িতে লুকিয়ে রেখে এসেছিল। গোবিন্দ রায় যে ফিরদৌসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল সেটা সিতারা হোটেলের সিসি টিভিতে ধরা পড়েছে। জয়া অধিকারীর কাছ থেকেও আমি জানতে পেরেছিলাম খুন হবার কয়েক দিন আগে ফিরদৌস তার বাড়িতে এসেছিল। যে কোনও কারণেই হোক, ফিরদৌস ডিস্ক দুটো নিজের কাছে রাখতে ভরসা পাচ্ছিল না।’
‘তাও ফিরদৌস খুন হয়ে গেল?’ এবার শিকদারের গলা।
‘ডিস্ক দুটোর জন্যেই যে ফিরদৌসকে প্রাণ হারাতে হল তাতে সন্দেহ নেই। এবার ফিরদৌস কেন খুন হল তার উত্তরে আসি। যে চতুর্থ ব্যক্তিটিকে বটুক সামন্ত বিশ্বাস করে ফিরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগের ভার দিয়েছিল, সে কিন্তু বটুকের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি। বস্তুত, সে ঠিক করল এই হার্ড ডিস্ক দিয়েই বটুককে পথে বসাবে। বটুকের ওপর তার অনেক দিনের রাগ ছিল যেটা বটুক আদৌ টের পায়নি। পূর্ব-পরিকল্পনা মতো ফিরদৌস তাকে ফোন করে জানাল সে সিতারা হোটেলে লুকিয়ে আছে এবং হার্ড ডিস্ক দুটো কম্পিউটার থেকে বার করা গেছে। বলল, খবরটা যেন বটুকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই ব্যক্তি কিন্তু ফিরদৌসের কথাটা স্রেফ চেপে গিয়ে বটুককে বলল, ফিরদৌস ফোন করে বলছে পঞ্চাশ কোটি টাকা না পেলে সে হার্ড ডিস্ক দুটো পুলিশের হাতে তুলে দেবে। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বটুককে সে একটা চিঠিও পাঠাল যাতে একই কথা লেখা আছে।
‘এই ব্যক্তির কিন্তু ফিরদৌসের ওপর আলাদা করে কোনও রাগ ছিল না। তবে সে জানত বটুকের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে গেলে হার্ড ডিস্ক দুটো তার হাতে আসা দরকার। তার জন্য অবশ্য যদি ফিরদৌসকে খুন করতে হয়, তার আপত্তি নেই। সে ফিরদৌসকে খুন করে হার্ড ডিস্ক দুটো হাতানোর জন্যে একজন কুখ্যাত সুপারি কিলারকে নিযুক্ত করল। এই সুপারি কিলারের নাম বাবলু মণ্ডল। সিতারা হোটেলের সিসি টিভি ফুটেজ থেকে আমরা জানতে পেরেছি বাবলু মণ্ডল এক্রামুল হক নাম নিয়ে সিতারা হোটেলে চেক ইন করে।’
‘অনেকগুলো খুনের মামলায় বাবলু মণ্ডলকে পুলিশ খুঁজছিল। অবশেষে সিঙ্গুরের কাছে একটা বাড়িতে তাকে পাওয়া গেছে। পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে বাবলু মণ্ডলের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশেরও দুজন জখম হয়েছে, তার মধ্যে একজনের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।’ গৌতম গম্ভীর গলায় বলল।
‘ফিরদৌসের খুন হওয়ার ব্যাপারটা একটু ডিটেলে বলবেন স্যার? আমরা তো সিতারা হোটেলে একসঙ্গে ইনভেস্টিগেট করলাম। তাই ডিটেলে জানতে ইচ্ছে করছে ঠিক কীভাবে ফিরদৌস খুন হয়েছিল।’ চাকি আদিত্যকে বলল।
‘বলছি। সেটাই বলছি। যে বাবলু মণ্ডলকে নিযুক্ত করেছিল, সে জানত ফিরদৌস কোথায় লুকিয়ে রয়েছে। সেই জায়গাটা, অর্থাৎ সিতারা হোটেলটা, সে বাবলু মণ্ডলকে দেখিয়ে দিয়েছিল। সে নিজে চেনায়নি। তার একজন সহযোগী ছিল, সে চিনিয়ে দিয়েছিল। আমার মনে হয়, তার পরেই এক্রামুল হক নাম নিয়ে বাবলু মণ্ডল সিতারা হোটেলে গিয়ে ওঠে। সে একজন পাকা খুনি। ফিরদৌসের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে তার খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। দুজনের বন্ধুত্ব ভালই জমেছিল, অন্তত রমেশ বেয়ারার কথা শুনে তাই মনে হয়। আমার ধারণা, ঘটনার দিন রাত্তির এগারোটা নাগাদ গালে চাপদাড়ি লাগিয়ে দিলীপ সাক্সেনা নামে বাবলু মণ্ডল সিতারা হোটেলে আবার নতুন করে চেক ইন করে। রিসেপশনটা আধো-অন্ধকার ছিল বলে রিসেপশনের ছেলেটা তাকে চিনতে পারেনি। রাত্তির হয়ে গিয়েছিল বলে তাকে কোনও আইডিও দেখাতে হয়নি। নিজের ঘরে গিয়ে সে ইন্টারকম দিয়ে ফিরদৌসকে ফোন করে বলে সে এক্রামুল বলছে। তার অসম্ভব মাথা ধরেছে। ফিরদৌস কি তাকে একটা মাথা ধরা কমানোর ওষুধ দিতে পারে? সম্ভবত সে আগে থেকেই কথায় কথায় জেনে নিয়েছিল ফিরদৌসের কাছে মাথা ধরার ওষুধ সব সময় মজুত থাকে। মাথা ধরাটা আমি আন্দাজে বলছি। এটা মাথা ধরার জায়গায় অম্বলও হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা একই। যাই হোক, ফিরদৌস তাকে তার ঘরে চলে আসতে বলে। বাবলু মণ্ডল, ওরফে দিলীপ সাক্সেনা লিফট দিয়ে উঠে তারপর দাড়ি খুলে রেখে এক্রামুল হক সেজে ফিরদৌসের ঘরে গিয়ে তাকে যন্ত্রণা দিয়ে খুন করে। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল ফিরদৌসের কাছ থেকে হার্ড ডিস্ক দুটো হাতানো। কিন্তু ইতিমধ্যেই ফিরদৌস হার্ড ডিস্ক দুটো অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেলেছিল। আগেই বলেছি, একটা ডিস্ক সে তার কলিগ গোবিন্দ রায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল। আর একটা সে তার ছোটবেলার বান্ধবী জয়া অধিকারীর বাড়িতে লুকিয়ে রেখে এসেছিল। ডিস্কগুলো যে ফিরদৌসের কাছে নেই সেকথা আততায়ী বিশ্বাস করেনি। হয়তো কথা বার করার জন্যে সে ফিরদৌসকে আরও খানিকক্ষণ যন্ত্রণা দিত কিন্তু ফিরদৌস যখন আহত অবস্থায় ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিজের বন্দুকের কাছে প্রায় পৌঁছে গেল তখন তাকে মেরে ফেলা ছাড়া আততায়ীর আর কোনও উপায় রইল না। মনে হয়, ফিরদৌসের কাছেও যে বন্দুক থাকতে পারে সেটা আততায়ী আন্দাজ করতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে শেষ গুলিটা ফিরদৌসের বুকে করে।
‘এখানে তিনটে জিনিস লক্ষ করতে হবে। এক, যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ফিরদৌস বলে দিয়েছিল ডিস্ক গোবিন্দ রায়ের কাছে আছে যে কারণে পরে ওই বাবলু মণ্ডলের হাতেই গোবিন্দ খুন হয়। সে প্রসঙ্গে পরে বিশদে আসব। কিন্তু জয়ার কথা ফিরদৌস বলেনি। বললে জয়া এতদিন বেঁচে থাকত না। দুই, ফিরদৌসের সঙ্গে এক্রামুল সব সময় ইন্টারকমে কথাবার্তা বলেছে। তাই ফিরদৌসের মোবাইল থেকে এক্রামুলের কোনও হদিশ পাওয়া সম্ভব হয়নি। এবং এই কারণেই খুনি ফিরদৌসকে খুন করে তার মোবাইল দুটো ফেলে রেখে গিয়েছিল। তিন, ফিরদৌসকে খুন করার পর এক্রামুল দিলীপ সাক্সেনা সেজে লিফট দিয়ে নেমে নিজের ঘরে ফিরে গেল। সিসি টিভি দেখে আমাদের মনে হল দিলীপ সাক্সেনা ফিরদৌসকে খুন করে লিফট দিয়ে নেমে গেল। আমরা ধরে নিলাম সে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু সিকিউরিটি হলফ করে বলল সে কাউকে বাইরে যেতে দেখেনি। আমরা ভাবলাম সিকিউরিটি নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। আসলে সে সত্যি কথাই বলছিল। সে সত্যিই কাউকে বেরোতে দেখেনি। খুন করার পর নিজের পুরোনো ঘরে গিয়ে বাবলু মণ্ডল ওরফে এক্রামুল আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ল। পুলিশ যখন হন্যে হয়ে দিলীপ সাক্সেনাকে খুঁজছে তখন বাবলু মণ্ডল সম্ভবত আরাম করে ঘুমোচ্ছে।’
‘কিন্তু বাবলু মণ্ডলকে কে নিযুক্ত করেছিল?’ মুখুটি আবার জিজ্ঞেস করল। সে আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছে না।
‘বলছি, বলছি। কিন্তু ধাপে ধাপে না এগোলে বোঝা যাবে না কেন আমরা তাকে অপরাধী মনে করছি।’ আদিত্য মুখুটির দিকে তাকিয়ে বলল। ‘আপাতত পরের খুন, অর্থাৎ গোবিন্দ রায়ের মৃত্যুর ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। গোবিন্দ তার মৃত্যুর আগের দিন আমার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল তার কাছে একটা কিছু আছে যেটা সে পুলিশের একেবারে বড় কর্তার হাতে তুলে দিতে চায়। আর কাউকে সে বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ তার কাছে খবর ছিল পুলিশের একটা অংশ তার শত্রুদের হয়ে কাজ করছে, যদিও কে তার শত্রু সেটা সে বলেনি। এখন আমরা জানতে পেরেছি জিনিসটা আর কিছু নয়, দুটো হার্ড ডিস্কের একটা, যেটা সে ফিরদোসের কাছ থেকে পেয়েছিল। আসলে, দুটো ডিস্ক একসঙ্গে না মেলালে উগ্রপন্থীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো জানা সম্ভব ছিল না। একটা ডিস্কে আলাদা আলাদা ফাইলে অ্যাকাউন্ট নম্বরগুলো ছিল। কিন্তু ফাইলগুলো খোলার জন্যে যে পাসওয়ার্ডগুলো দরকার, সেগুলো ছিল অন্য ডিস্কটাতে। অর্থাৎ অ্যাকাউন্ট নাম্বারের ফাইল এবং ফাইল খোলার পাসওয়ার্ড আলাদা দুটো কম্পিউটারে থাকত। ফিরদৌস হয়তো ভেবেছিল শুধু একটা ডিস্ক নিয়ে গোবিন্দ খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। তাই সাহস করে সে একটা ডিস্ক গোবিন্দর হাতে তুলে দিয়েছিল। অবশ্য গোবিন্দ এত কথা জানত বলে মনে হয় না। সে শুধু এইটুকু জানত যে কিছু লোকের কাছে এই ডিস্কের মূল্য অপরিসীম, তাই এই ডিস্কের জন্যে সে খুন হয়ে যেতে পারে।
‘গোবিন্দ যেদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, তার সঙ্গে একটা ব্যাকপ্যাক ছিল। আমি নিশ্চিত, সেই ব্যাকপ্যাকে ডিস্কটা নিয়ে সে ঘুরছিল। ওটা হোটেলে রেখে আসার ঝুঁকি তার নেবার কথা নয়। সে খুন হবার পর, বলাই বাহুল্য, ব্যাকপ্যাক সহ ডিস্কটা উধাও হয়ে যায়। খুনি কীভাবে জানলা দিয়ে গোবিন্দর ঘরে ঢুকেছিল সেটাও আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। খুনটা যে একজন পেশাদার খুনি করেছে সেটাও বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না খুনি বা খুনিকে যে নিযুক্ত করেছে সে গোবিন্দর গোপন ডেরার সন্ধান পেল কী করে?’
‘আর এক প্রস্ত চা বলা যাক।’ গৌতম বেল বাজিয়ে তার বেয়ারাকে ডাকল। তারপর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই বলে যা। গল্প ভীষণ জমে গেছে। এখন থামা যাবে না।’
‘গোবিন্দ রায় আমার কাছ থেকে একটা খবর জানতে পেরেছিল যেটা সে আগে জানত না। সে জানতে পেরেছিল পল্লবী ভদ্র খুন হয়েছে। খবরটা তাকে খুবই বিচলিত করেছিল। কারণ পল্লবীকে সে বেশ ভালই চিনত। পল্লবীর প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ডকেও চিনত। পিটার অরোরার সঙ্গে সম্পর্ক হবার আগে পল্লবী মাঝে মাঝে বুটল্যাগারের কাজ নিয়ে কুমুদিনীতে আসত। মনে হয় তখনই গোবিন্দ রায়ের সঙ্গে তার পরিচয়। তার প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ডও নানা কাজে কুমুদিনীতে আসত। হয়তো কখনও কখনও পল্লবী তার বয়ফ্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়েই কুমুদিনীতে আসত। গোবিন্দ পল্লবীর ব্যাপারটা ভাল করে জানার জন্যে পল্লবীর প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করে। পল্লবীর প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ডকে গোবিন্দ এক মুহূর্তের জন্যেও সন্দেহ করেনি। তাই তার হোটেলের হদিশও তাকে বলে দিয়েছিল। বিষণ্ণ এই ছেলেটিকে গোবিন্দর ভাল লাগত। তার মনে হত ছেলেটির প্রতি পল্লবী অন্যায় করেছে। আমরা জানতে পেরেছি, সুমনা ঘোষাল আমাদের জানিয়েছেন, পল্লবীর প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড ছিল তার ছেলে রণপ্রিয় ঘোষাল। অর্থাৎ রণপ্রিয় ঘোষালকেই গোবিন্দ তার হোটেলের ঠিকানাটা জানিয়েছিল। রনি বলেছিল গোবিন্দর সঙ্গে দেখা করতে আসবে। রনি ঘোষালই গোবিন্দ রায়ের ঠিকানাটা বাবলু মণ্ডলকে জানিয়ে দেয়, কারণ সুমনা ঘোষালের পাপকর্মের সহযোগী ছিল তার নিজের ছেলে, রণপ্রিয় ঘোষাল। আর যে চতুর্থ ব্যক্তির কথা একটু আগে বলছিলাম, যার মাধ্যমে বটুক ঠিক করেছিল ফিরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে, সে আর কেউ নয়, সুমনা ঘোষাল। সুমনা ঘোষাল আর তার ছেলে মিলে বাবলু মণ্ডলকে নিযুক্ত করেছিল ফিরদৌসকে খুন করে ডিস্ক দুটো উদ্ধার করার জন্য।’
ঘরে নীরবতা। এতটাই যে একটা আলপিন পড়লেও শোনা যাবে। আদিত্য একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল।
‘একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, যে চতুর্থ ব্যক্তির কাছে বটুক সামন্ত তার গোপন ব্যবসার কথা কিছুটা প্রকাশ করেছিল সেই ব্যক্তি সুমনা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। সুমনা বটুকের কাছের মানুষ, তার সঙ্গে বটুকের রোজ দেখা হচ্ছে। ফলে গোপন কোনও তথ্য বটুকের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য সুমনাই আইডিয়াল। তাছাড়া বটুক ধরে নিয়েছিল সুমনার ওপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। কিন্তু বটুক জানত না সুমনা আর তার ছেলে তাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করে। কেন সেটা বলছি। বটুক এবং সুমনা দুজনেরই যখন অল্প বয়েস সে সময় তাদের প্রথম সম্পর্ক হয়। সেই সম্পর্কের ফলে সুমনার যে সন্তান হয়, তার নাম রণপ্রিয় ঘোষাল। রনি আসলে বটুকেরই ছেলে। কিন্তু বটুক সেই পিতৃত্ব অস্বীকার করে। সেই সময় সম্ভবত বটুক ছাড়াও আরও দু-একজনের সঙ্গে সুমনার বন্ধুত্ব ছিল, তাই বটুকের মনে হয়েছিল সে আগ বাড়িয়ে কেন সুমনার সন্তানের দায়িত্ব নিতে যাবে? সুমনা কিন্তু জানত কে তার ছেলের বাবা, তাই এটা নিয়ে তার মনে বিপুল অভিমান জমে ছিল। সে দু-একবার নিশ্চয় বটুক সামন্তকে রনির পিতৃত্ব স্বীকার করে নিতে পীড়াপীড়ি করেছিল, কিন্তু বটুক সামন্ত রাজি হয়নি। এর পর কিছুদিনের জন্য সুমনা ঘোষাল মুম্বাই চলে গেল, বটুক-সুমনার সম্পর্কে ছেদ পড়ল। বেশ কয়েক বছর পরে যখন তাদের আবার দেখা হল, আস্তে আস্তে একটা সম্পর্কও তৈরি হল, তখন বটুক সামন্ত সুমনার ছেলের কথা প্রায় ভুলেই গেছে। সুমনার যেহেতু আর কোথাও যাবার জায়গা ছিল না সে বটুক সামন্তর সঙ্গে থাকতে শুরু করল। কিন্তু পুরোনো অপমানের কথা সে এক দিনের জন্যেও ভোলেনি। বটুকের প্রতি তার ঘৃণা সে একটু একটু করে তার ছেলে রনির মধ্যেও ভাল মতন চারিয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তু সুমনা যে তাকে এতটা ঘৃণা করে সেটা বটুক সামন্ত ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেনি। উলটে সে তার রক্ষিতা সুমনা ঘোষালকে পুরোপুরি বিশ্বাস করত। ফলে, ফিরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তাকেই বেছে নিয়েছিল।
‘ফিরদৌস এবং হার্ড ডিস্ক দুটোর কথা জানার পর সুমনা সেই সব কথা তার ছেলেকে জানাল। দুজনে মিলে বটুক সামন্তকে সর্বস্বান্ত করার প্ল্যান তৈরি করল। এমনিতে তো আর বটুক সুমনার ছেলেকে কিছু দেবে না, তাই বাঁকা পথই নিতে হবে। বস্তুত, একটা পঁচিশ লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের নমিনি হওয়া ছাড়া রনির কপালে আর কিছুই জোটেনি। হয়তো বটুক সামন্ত ভাবত সে সারা জীবন তার আইনসিদ্ধ স্ত্রী এবং সন্তানের প্রতি অবিচার করে এসেছে। তাই তার যা আছে সে তার আইনসিদ্ধ ছেলে শুভঙ্কর সামন্তকেই দিয়ে যেতে চেয়েছিল। আবার বলছি, বটুক যদি জানত সুমনার মনে বটুকের প্রতি পাহাড় প্রমাণ ক্ষোভ এবং ঘৃণা জমে আছে, তাহলে নিশ্চয় বটুক তার উপপত্নীকে এতটা বিশ্বাস করত না। সুমনাও কখনও তার পাহাড় প্রমাণ ঘৃণার কথা বটুককে টের পেতে দেয়নি। এ থেকে মনে হয় সুমনা একজন উঁচুদরের অভিনেত্রী ছিল।’
‘তুই কী করে বুঝতে পারলি বটুক সামন্তই রনির বাবা?’ গৌতম প্রশ্ন করল।
‘পুরোপুরি বুঝিনি, তবে সন্দেহ করেছিলাম। রনিকে অনেকটাই তার মার মতো দেখতে, বটুক সামন্তর সঙ্গে তার চেহারায় খুব একটা মিল নেই। কিন্তু রনির কণ্ঠস্বর অবিকল বটুক সামন্তর মতো। এটা আমি রনির সঙ্গে প্রথম দিনের আলাপেই খেয়াল করেছিলাম। তাছাড়া বটুক সামন্ত যে শুভঙ্করকে সমস্ত সম্পত্তির ওয়ারিস করেছে এ-ব্যাপারে সুমনা ঘোষাল আমার সামনেই একদিন বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেছিল। এখন অবশ্য সুমনা ঘোষাল পরিষ্কার করে পুলিশকে বলে দিয়েছে যে রনি বটুক সামন্তরই ছেলে।’
‘পল্লবী ভদ্রের খুনটা কি তাহলে আলাদা একটা ঘটনা? ওটার সঙ্গে কি কুমুদিনী মামলার কোনও সম্পর্কই নেই?’ চাকি ঈষৎ চিন্তান্বিত গলায় প্রশ্ন করল। ‘আমি তো ভাবলাম পল্লবী ভদ্রকে খুন করার জন্যেই আমরা রনিকে অ্যারেস্ট করলাম। ও অবশ্য বলছিল ও ইনোসেন্ট। ওকে মিছিমিছি হ্যারাস করা হচ্ছে।’
‘না, না। রনি একেবারেই ইনোসেন্ট নয়। পল্লবীকে ও নিজের হাতে খুন করেছে। পল্লবী ওকে ছেড়ে পয়সার লোভে পিটার অরোরার রক্ষিতা হয়ে যাওয়াটা, বলাই বাহুল্য, রনি পছন্দ করেনি। কিন্তু শুধু সেইটুকু কারণে ও পল্লবীকে খুন করত না। পল্লবীকে ও খুন করে এক কোটি টাকার জন্য। খুন করার আগে ও পল্লবীকে টর্চার করেছিল। হয়তো টাকাটা কোথায় আছে জানার জন্যে। হয়তো নিছক ঘৃণা এবং আক্রোশবশত। কিন্তু টাকাটা রনির খুব দরকার ছিল। ওই টাকা দিয়েই বাবলু মণ্ডলকে হায়ার করেছিল রনি এবং সুমনা। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী বাবলু মণ্ডল বেশ এক্সপেনসিভ। আমি প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না বাবলু মণ্ডলের টাকাটা সুমনা ঘোষালরা জোগাড় করল কোথা থেকে। তারপর একদিন টিভিতে পল্লবী ভদ্রর খুন হওয়ার খবরটা চোখে পড়ল। পরে গোবিন্দ রায়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম পিটার অরোরা তার জুয়ার আড্ডার জন্য কুমুদিনীতে টাকা ভাঙাতে এসেছিল। সে এনেছিল পঞ্চাশ বান্ডিল দু-হাজার টাকার নোট, অর্থাৎ এক কোটি টাকা। সেই টাকাটা আমরা বটুক সামন্তর লুকোনো দেয়াল আলমারিতে খুঁজে পেয়েছিলাম। পঞ্চাশ বান্ডিল দু-হাজার টাকার নোটের বদলে বটুক সামন্ত তাকে দুশো বান্ডিল পাঁচশো টাকার নোট দিয়েছিল। এই রকম কিছু সার্ভিস কুমুদিনী তার ক্লায়েন্টদের দিত।
‘ভাঙানো টাকাটা নিয়ে পিটার পল্লবীর বাড়িতে গিয়েছিল। সেখানে সে তিন দিন কাটায়। তারপর তাকে সন্ধেবেলা দিল্লির ফ্লাইট ধরতে হয়েছিল। দিল্লি যাবার আগে সে টাকাটা পল্লবীর বাড়িতে রেখে যায়। পিটার অরোরা যে কুমুদিনী থেকে টাকা ভাঙিয়ে নিয়ে গেছে সেটা বটুক সামন্ত মারফত সুমনা জানত। ফলে রনিও ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। তিন দিন পল্লবীর সঙ্গে কাটিয়ে পিটার দিল্লি চলে গেছে এটা সম্ভবত পল্লবীই রনিকে জানিয়েছিল। পল্লবীর এক পুরুষে মন উঠত না। পিটার শহরে না থাকলে সে রনিকে ডেকে নিত। যদিও রনির আর একজন বান্ধবী ছিল মাঝে মাঝে পল্লবীর সঙ্গে রাত্তির কাটাতে সম্ভবত রনিরও মন্দ লাগত না। পিটার যে রাত্তিরে দিল্লি চলে গেল সেই রাত্তিরেও রনিকে পল্লবী ডেকেছিল। কিংবা সম্ভবত রনিই পল্লবীর কাছ থেকে সেই রাত্তিরের জন্যে একটা নেমন্তন্ন আদায় করে নিয়েছিল। সে আন্দাজ করেছিল টাকাটা পল্লবীর বাড়িতেই আছে। পল্লবীকে খুন করে সে টাকাটা নিয়ে চলে যায়। যেহেতু বাড়িতে সিসি টিভি ছিল না আর সিকিউরিটি ছেলেটিও একটা উড়ো ফোন পেয়ে দেশের বাড়ি চলে গিয়েছিল, তাই পল্লবীর বাড়িতে ঢোকার সময় রনিকে কেউ দেখতে পায়নি। উড়ো ফোনটা মনে হয় রনিই করেছিল। অনুমান করছি, কোনও কারণ দেখিয়ে ফোন নম্বরটা রনি পল্লবীর কাছ থেকেই জোগাড় করেছিল। রনি যে মাঝে মাঝে পল্লবীর বাড়িতে রাত কাটাত সেটা সিকিউরিটি ছেলেটা আমাদের বলেছে। রনিকে ছবিতে দেখে চিনতে পেরেছে সে। রনির সঙ্গে পল্লবীর আর কোনও সম্পর্ক নেই, এটা তার মা মিথ্যে বলেছিল।’
‘রনি তাহলে পল্লবীকে মারার প্ল্যান করেই তার বাড়িতে গিয়েছিল?’ চাকি জিজ্ঞেস করল।
‘আমার তো তাই মনে হয়। বটুক সামন্তর হার্ড ডিস্ক নিয়ে ফিরদৌস লুকিয়ে রয়েছে এই খবরটা জানার দিন তিনেক পরে পল্লবীর বাড়িতে রনি রাত কাটাতে যায়। ইতিমধ্যে সে নিশ্চয় তার মায়ের সঙ্গে বসে ঠিক করে ফেলেছে ফিরদৌসের কাছ থেকে হার্ড ডিস্ক দুটো হাতাতে হবে। কিন্তু এই কাজটা সরাসরি তার দ্বারা হবে না। এর জন্যে প্রফেশানাল কাউকে চাই। প্রফেশানাল কাউকে ভাড়া করতে গেলে আবার অনেক টাকার দরকার। রনি যখন শুনল পল্লবীর বাড়ি থেকে এক কোটি টাকা পাবার সম্ভাবনা আছে, তখন সে সেই সুযোগটা লুফে নেয়।’
‘আমরা কিন্তু আসল সমস্যাটা থেকে সরে যাচ্ছি। আমাদের ভুললে চলবে না, কুড়ি কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। টাকাটা কোথায় গেল সেটা কিন্তু আমরা এখনও জানতে পারলাম না।’ সোমেন মুখুটি মনে করিয়ে দিল।
‘ঠিক বলেছেন। এবার তাহলে কুড়ি কোটি টাকা উধাও হয়ে যাবার প্রসঙ্গে আসি। মুখুটি সাহেব প্রশ্ন করেছেন, টাকাটা কোথায় গেল? আমার উত্তর, টাকাটা যেখানে যাবার কথা ছিল সেখানেই গেছে। অর্থাৎ সত্যি এটাই যে টাকাটা, থুড়ি ডলারগুলো, ফিরদৌস ঠিক সময় মতোই বটুক সামন্তর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। আর প্ল্যান-মাফিক সেগুলো একটু পরে মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানির লোক এসে নিয়ে গিয়েছিল।’
‘কিন্তু জামিল আর সহদেব যে বলেছিল পথে একটা লরি খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে তাদের থামতে হয়েছিল। তখন ফিরদৌস একা গাড়িতে ছিল। সেই সাক্ষীর কোনও দাম নেই? সেই সময় তো ফিরদৌস টাকাটা সরিয়ে ফেলতেই পারত? ফিরদৌসের ঘরে আমরা যে ফাঁকা নীল ব্যাগটা দেখেছিলাম হয়ত সেটাতেই ডলারগুলো ছিল। এমন তো হতেই পারে, ফিরদৌসকে খুন করে খুনি সেই ডলারগুলো নিয়ে গেছে।’ মুখুটি এখনও তার তত্ত্বটা আঁকড়ে ধরে রয়েছে।
‘মুখুটি সাহেব, আপনার তত্ত্বটার কয়েকটা সমস্যা আছে। প্রথম সমস্যা, খুনি ডলারগুলো ব্যাগ থেকে বার করে নিয়ে ব্যাগটা ফেলে রেখে গেল কেন? এটাই তো স্বাভাবিক যে সে ব্যাগসুদ্ধু টাকা নিয়ে চম্পট দেবে। এতে শুধু পরিশ্রম নয়, সময়ও বাঁচত। দু-নম্বর সমস্যা, ব্যাগটা এতটাই বড় যে ফিরদৌসের হোটেলের ঘরে সেটা ভাল করে লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। একটু এদিক-ওদিক দেখলেই সেটা বেরিয়ে পড়ত। তাহলে ফিরদৌসের ওপর কথা বার করার জন্যে অত্যাচার করা হল কেন? তাহলে কি খুনি অন্য কিছু খুঁজছিল? তিন নম্বর সমস্যা, ফিরদৌসের সহযোগী ঠিক কে সেটা বোঝা গেল না। নিশ্চয় শিবেন মাইতি নয়, কারণ মুখুটির থিওরি অনুযায়ী সে-ই লোক পাঠিয়ে ফিরদৌসকে খুন করিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছিল। তাই যদি হয় তাহলে সে প্রথমে টাকাটা ফেরত দেবে কেন? সে তো কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টাকাসুদ্ধু ব্যাগটা হাতে পেয়েই চম্পট দিতে পারত। আবার ফিরদৌসের খুনি গোবিন্দ রায়ও নয়। ফিরদৌস তাকে বিশ্বাস করত। সি সি টিভির ফুটেজ থেকে আমরা জানতে পেরেছি গোবিন্দ রায় ফিরদৌসের সঙ্গে দেখা করতে একবার হোটেল সিতারাতেও এসেছিল। কিন্তু সে যদি ফিরদৌসের সঙ্গে মিলে টাকাটা চুরিই করবে তাহলে সে আমার কাছে আসবে কেন? পুলিশের বড় কর্তার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে কেন?’
‘আর জামিল, সহদেব আর ড্রাইভার রবির সাক্ষ্য? সেটা কি আমরা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করব?’ মুখুটি আবার মনে করিয়ে দিল।
‘আমরা জানতে পেরেছি, এবং সম্ভবত আপনিও জানেন যে জামিল, সহদেব এবং রবি তিনজনেই পুরোনো ক্রিমিনাল। বিশেষ করে একটা ডাকাতি এবং খুনের মামলায় পুলিশ তিনজনকেই সন্দেহ করছিল। জাহাঙ্গির খান টাকা খরচ করে তিনজনকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচায় এবং নিজের কম্পানিতে কাজ দেয়। তাই ওই তিনজন জাহাঙ্গিরের হাতের পুতুল হয়ে ছিল। কিন্তু আমার ধারণা, এক্ষেত্রে জাহাঙ্গির নয়, পুলিশেরই কেউ, ওদের অতীতটা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে, ওদের দিয়ে মিথ্যে সাক্ষী দিইয়েছে।’
মুখুটি মাথা নামিয়ে আছে। গৌতম সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, ‘একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকে যাচ্ছে। বটুক সামন্ত কেন জাহাঙ্গির খানকে ধারণা দিল যে ফিরদৌস টাকা চুরি করে পালিয়েছে? সে তো এর মধ্যে জাহাঙ্গির খানকে না জড়ালেই পারত।’
‘অনিবার্য প্রশ্ন। আমি এর উত্তর দিচ্ছি।’ আদিত্য গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলল। ‘বটুক সামন্ত চেয়েছিল জাহাঙ্গির খান ফিরদৌসকে খুঁজে বার করুক। যেহেতু তার ওপর পুলিশের নজর রয়েছে সে নিজে কাজটা করতে পারছিল না। কিন্তু সে তো আর বলতে পারে না ফিরদৌস দুটো হার্ড ডিস্ক নিয়ে পালিয়ে গেছে। বললে তার গোপন ব্যবসার কথাও বলতে হতো। তার বদলে সে বলল ফিরদৌস টাকা মেরে পালিয়ে গেছে। সে জানত এটা বললে জাহাঙ্গির ফিরদৌসকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করবেই। সব থেকে বড় কথা, বটুক সামন্ত ভেবেছিল, পুলিশ টাকা চুরির মামলার পেছনে দৌড়লে আসল ব্যাপারটা, অর্থাৎ হার্ড ডিস্ক নিয়ে ফিরদৌসের উধাও হয়ে যাবার রহস্যটা চাপা পড়ে যাবে। কুড়ি কোটি টাকা চুরি যাবার ব্যাপারটা ছিল আসলে একটা স্মোকস স্ক্রিন, যার আড়ালে বটুক তার আসল ব্যবসাটাকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল।’
‘ফিরদৌস কোথায় লুকিয়ে আছে সেটা তার স্ত্রী কি জানত?’ শিকদার প্রশ্নটা করল।
‘না, জানত না। ফিরদৌস যে তার অজ্ঞাতবাস থেকে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলত সেটা সত্যি। কিন্তু সে ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে সেটা তার স্ত্রীকে সে বলেনি। সম্ভবত স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্যেই বলেনি। তাছাড়া সাবিনা খাতুন কলকাতার মেয়ে নয়। জ্যাকারিয়া স্ট্রিট অঞ্চলটা সে একেবারেই চেনে না। হয়তো সেই কারণেও ফিরদৌস সাবিনাকে বলেনি সে কোথায় লুকিয়ে আছে। বললেও সাবিনা বুঝতে পারত না। কিন্তু সাবিনা ফিরদৌসকে নিশ্চয় বলেছিল জাহাঙ্গির খান তাকে টাকা চুরির দায়ে খুঁজছে, কারণ বটুক সামন্ত বলেছে সে কুড়ি কোটি টাকা পায়নি। সন্দেহ নেই, এটা শুনে ফিরদৌস আকাশ থেকে পড়ল। তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল বটুক সামন্তর সঙ্গে যোগাযোগ করা। যোগাযোগ করে বটুককে বলা, সে তো নিজের হাতে বটুকের হাতে টাকাটা পৌঁছে দিয়েছে। তাহলে বটুক টাকাটা পায়নি বলছে কেন? এরকম কখনও আগে তো হয়নি। কিন্তু বটুকের ফোন সম্ভবত পুলিশ ট্যাপ করছে। তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় ফিরদৌস সুমনা ঘোষালকে ফোন করেছিল। কিন্তু তার কথাগুলো সুমনা বটুককে জানায়নি।’
‘আচ্ছা, বটুক সামন্ত তো ধুরন্ধর লোক। সে তার রক্ষিতাকে একবারের জন্যেও সন্দেহ করল না কেন? অন্তত সে তো সুমনার মোবাইলটা চেক করে দেখতে পারত ফিরদৌস কোনও ফোন করেছে কিনা? গৌতম জিজ্ঞেস করল।
‘বটুক সুমনাকে সন্দেহ করেনি সেটা সুমনার অসাধারণ অভিনয়ের গুণে। আর সুমনার মোবাইলটা চেক করার দরকার হয়নি। যে দুবার ফিরদৌস সুমনাকে কল করেছিল সেই দুবারই সুমনা নিজে বটুককে তার মোবাইলটা দেখিয়ে বলেছিল ফিরদৌস তাকে কল করেছিল। ফিরদৌস সুমনাকে যে কথাগুলো বলেছিল সেটা অবশ্য সে বটুককে বলেনি। তার বদলে সে বটুককে বলেছিল ফিরদৌস ফোন করে হার্ড ডিস্ক দুটো ফিরিয়ে দেবার বিনিময়ে টাকা চাইছে। সুমনা ভেবেছিল, পুলিশ হয়তো তাকে করা ফিরদৌসের কলগুলো একদিন ট্রেস করতে পারবে। তাই ফিরদৌস যে তাকে কল করেছিল সেটা লুকিয়ে লাভ নেই। শুধু তার সঙ্গে ফিরদৌসের আসলে কী কথা হয়েছিল সেটা বটুক না জানতে পারলেই হল। এদিকে পুলিশের ভয়ে ফিরদৌসও মোবাইল বন্ধ রেখেছিল। তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। তাই সুমনার মুখের কথার ওপর নির্ভর করা ছাড়া বটুকের উপায় ছিল না।’
‘আমাদের খুব কৌতূহল আছে স্যার আপনি কী ভাবে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন।’ শিকদার মৃদু গলায় জানতে চাইল।
বেয়ারা আবার চা নিয়ে এসেছে। সঙ্গে ক্রিম ক্র্যাকার।
‘একদিনে বুঝিনি। একটু একটু করে বুঝেছি। জাহাঙ্গির খানের সঙ্গে প্রথম দিন কথা বলে তার গল্পে আমি দু-একটা অসঙ্গতি লক্ষ করলাম।’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আদিত্য আবার বলতে শুরু করেছে। ‘একটা বড় অসঙ্গতি হল, যদি দু-হাজার টাকার নোটেও কাউকে কুড়ি কোটি টাকা নিয়ে যেতে হয় তাহলে যে বিপুল পরিমাণ নোট বহন করতে হবে সেটা একটা ব্যাগে আঁটানো প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া এর ওজনটাও একজনের পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়া শক্ত। একটু হিসেব করলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। একটা দু-হাজার টাকার নোটের বান্ডিলে থাকে একশোটা নোট, মানে দু-লক্ষ টাকা। তাহলে এক হাজারটা এরকম বান্ডিল নিলে তবে কুড়ি কোটি হবে। এক হাজারটা বান্ডিল একটা ব্যাগে আঁটানো সহজ নয়। তাছাড়া, এক একটা নোটের যদি এক গ্রাম করে ওজন হয়, তাহলে এক হাজার বাণ্ডিল অর্থাৎ এক লক্ষ নোটের ওজন হচ্ছে এক লক্ষ গ্রাম, মানে একশো কিলোগ্রাম। ওয়েট লিফটার ছাড়া একশো কিলো ওজন কেউ বহন করে নিয়ে যেতে পারে না।
‘আরেকটা অসঙ্গতি হল, কুমুদিনী যেরকম শর্তে ব্যবসা করে বলে জাহাঙ্গির খান বলছে, তাতে কুমুদিনীর পক্ষে লাভ করা শক্ত। বিশেষ করে এই কারণে যে, যেসব জায়গায় কুমুদিনী টাকা খাটায় সেগুলোর সব ক-টাতেই বেশ ঝুঁকি আছে। ‘নিউ এজ মুভিজ’-এর কথাই ধরা যাক। ওরা যেমন হিট ছবি প্রোডিউস করেছে তেমনি প্রচুর ফ্লপ ছবিও করেছে। হিট এবং ফ্লপ ছবির অনুপাত মোটামুটি অর্ধেক-অর্ধেক। এই রকম অবস্থায়, মানে এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রজেক্টের ক্ষেত্রে কুমুদিনীর বিজনেস মডেলটা চলা শক্ত। আমি অঙ্ক কষে দেখেছি। সেই অঙ্কের মধ্যে আর যাচ্ছি না। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, কুমুদিনী যে ব্যবসাটা করে বলে জাহাঙ্গির খান বলছে তা ছাড়াও আরও কোনও ব্যবসা কুমুদিনীর আছে বলে আমার মনে হল। বিশেষ করে বটুক সামন্তর লাইফ-স্টাইলটা দেখার পর।
‘পরে ফিরদৌসের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম টাকাটা সে ইন্ডিয়ান রুপিতে নয়, ইউ এস ডলারে নিয়ে গিয়েছিল। কুড়ি লক্ষ ইউ এস ডলার, হাওয়ালা বাজারে যার দাম কুড়ি কোটি টাকা। একশো ডলারের কুড়ি হাজারটা নোট। এক একটা নোটের এক গ্রাম করে ওজন ধরলে মোট ওজন কুড়ি কিলোগ্রাম। একশোর বান্ডিল দুশোটা। জাহাঙ্গির খানের ব্যাগে অনায়াসে এঁটে যাবে। একজনের পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়াও কঠিন নয়। জাহাঙ্গির খানও পরে আমার কাছে স্বীকার করেছিল তার পাঠানো টাকাটা ইউ এস ডলারেই ছিল। যদিও প্রথমে সে কথাটা বেমালুম চেপে গিয়েছিল।’
‘কিন্তু কেন ইউ এস ডলার? সেটা কি বয়ে নিয়ে যাবার সুবিধের জন্যে?’ শিকদার প্রশ্ন করল।
‘আপাতদৃষ্টিতে সে রকম মনে হতে পারে বটে কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে সেটা হতেই পারে না। টাকাটা যদি ভারতীয় মুদ্রায় দরকার হয় তাহলে সেটা একবার ডলারে কনভার্ট করে আবার তাকে ভারতীয় মুদ্রায় কনভার্ট করার কোনও মানেই হয় না। বিশেষ করে যখন একটা মুদ্রা থেকে আর একটা মুদ্রায় কনভার্ট করার ঝামেলা এবং খরচ দুই-ই আছে। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছিল বটুক সামন্ত ইউ এস ডলারই চেয়েছিল। ডলার নিয়ে বটুক সামন্ত কী করবে? এই প্রশ্নটার উত্তর তখনই পেলাম যখন মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানির কথাটা চাকি জানাল। এর সঙ্গে আরও দুটো জিনিসকে মেলালাম। ফিরদৌসের জয়দেব মেকানিককে খবর দেওয়া এবং কুমুদিনী রেড করে সন্দেহজনক কিচ্ছু না পাওয়া। যদি হালকা বেআইনি কিছু কুমুদিনীর কম্পিউটারগুলো থেকে পাওয়া যেত তাহলে হয়তো আমার সন্দেহটা হার্ড ডিস্কের দিকে যেত না।’
‘স্যার, একটা কথা বুঝলাম না। আদিত্যবাবুকে মারার জন্যে না হয় বাবলু মণ্ডলই বহরমপুরের লোকাল কোনও সুপারি কিলারকে হায়ার করেছিল। কিন্তু একটা ডিস্ক যে বহরমপুরে জয়া অধিকারীর বাড়িতে লুকোনো থাকতে পারে এটা বাবলু মণ্ডল আন্দাজ করল কী করে?’ গৌতমের দিকে তাকিয়ে শিকদার বলল।
‘উত্তরটা আদিত্যই দিক।’ গৌতম আদিত্যর দিকে ফিরল।
‘আমি সুমনা ঘোষাল আর তার ছেলের জন্যে একটা ফাঁদ পেতে ছিলাম। খানিকটা দৈবক্রমে আমি জানতে পেরেছিলাম জয়া অধিকারী বলে ফিরদৌসের একজন পুরোনো প্রেমিকা আছে যার সঙ্গে তার যোগাযোগ শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। জয়া অধিকারীর বাড়িতে গিয়ে আমার মনে হল ডিস্ক লুকিয়ে রাখার পক্ষে এটা আদর্শ জায়গা। তাছাড়া খুন হবার কয়েকদিন আগে ফিরদৌস জয়া অধিকারীর সঙ্গে দেখা করতেও এসেছিল। তাই ডিস্কটা ওখানে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু জয়া অধিকারীর অস্তিত্ব সম্পর্কে সুমনা ঘোষাল বা তার ছেলের জানার কথা নয়। তাই আমি ইচ্ছে করে সুমনার উপস্থিতিতে বটুকবাবুকে জয়া অধিকারীর কথাটা জানিয়ে দিলাম। ভাবলাম, এর পর যদি জয়ার বাড়িতে হামলা হয়, তাহলে নিশ্চিত হয়ে যাব সুমনা এর মধ্যে আছে।
‘ঠিক সেটাই হল। কিন্তু আমার আন্দাজে একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম রাত্তিরের অন্ধকারে আততায়ী জয়ার বাড়ি হামলা করবে। সেটা না করে সে আমার পেছনে একজনকে লেলিয়ে দিয়ে নিজে ফেরি পার হয়ে এসে জয়ার বাড়িতে ঢুকে অপেক্ষা করছিল। আমাদের ভাগ্য ভাল জয়া প্রাণে বেঁচে গেছে। না হলে আমি নিজেকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারতাম না। যাই হোক, শেষ খবর পেয়েছি, তাকে দু-একদিনের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে।
‘আমি রনি ঘোষালের পেছনে আমার সহকারি বিমল গায়েনকে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। রনিকে ফলো করে বিমল সিঙ্গুরের কাছে বাবলু মণ্ডলের গোপন আস্তানার কথা জানতে পারে। রনি সেখানে বাবলু মণ্ডলকে ব্রিফকেসে করে টাকা দিয়ে এসেছিল। পরে সে জয়া অধিকারীর বাড়ি থেকে লুট করা ডিস্কটা বাবলু মণ্ডলের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিল। এই ডিস্কটা এবং আগেরটা যেটা গোবিন্দ রায়ের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল, দুটো ডিস্কই সে একটা কালো সুটকেসে পুরে লিন্ডসে স্ট্রিটের হোটেল ক্রসরোড-এ রেখেছিল। কলকাতার কিছু হোটেল আছে যারা স্টোরেজ স্পেস ভাড়া দেয়। হোটেল ক্রসরোড তাদের মধ্যে একটা। সেখান থেকে বটুকবাবু ডিস্ক দুটো নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। বলাই বাহুল্য, এর জন্যে বটুকবাবুকে বেশ মোটা একটা টাকা রনির বেনামি অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতে হয়েছে। টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বি এম ডাবলুটাও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। চাকির প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, ডিস্ক দুটোর জন্যে মোট দশ কোটি টাকা বটুকবাবুকে দিতে হয়েছিল। এর বেশি টাকা জোগাড় করা যায়নি। রনিও সেটা বুঝতে পেরেছিল।’
আদিত্য থামল। অফিসাররা এক এক করে চলে যাচ্ছে। গৌতম মুখুটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি মিনিট পনেরো পরে একবার আমার ঘরে এস।’ তারপর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ঘরে চল। ওখানেই আর একবার চা খাওয়া যাবে।’
একটু পরে নিজের চেয়ারে বসে গৌতম বলল, ‘আমার নিজের এখনও দুএকটা খটকা আছে। দেখি তুই সেগুলো পরিষ্কার করতে পারিস কিনা।’
‘বল। চেষ্টা করে দেখি।’ আদিত্য চেয়ারে বসতে বসতে বলল।
‘আমার প্রথম প্রশ্ন, সুমনা একদম শেষে বটুককে ধরিয়ে দিল কেন? সে যদি আমাদের হিন্ট না দিত আমরা সম্ভবত বাইরেটা খুঁজেই দেখতাম না।’
‘সুমনা এবং তার ছেলে রনি বটুকের সর্বনাশ চেয়েছিল। টাকা যা পাবার সেটা তো তাদের পাওয়া হয়েই গিয়েছিল, বটুকের কাছ থেকে আর কিছু তাদের পাবার ছিল না। এরপর বটুক দেশদ্রোহীতার দায়ে জেলে গেলে তাদের প্রতিহিংসার ষোলো কলা পূর্ণ হত। তবু বলব, সুমনা হয়তো সেদিন আমাদের আগ বাড়িয়ে সাহায্য করত না, যদি না আমি তার ভেতরের ঘৃণাটাকে উসকে দিতে পারতাম। টাকা পাবার পর হয়তো সে বটুককে ক্ষমাই করে দিত। কিন্তু হার্ড ডিস্ক দুটো খুঁজে না পেয়ে আমি মরিয়া হয়ে একটা শেষ চেষ্টা করলাম। বটুকের অবৈধ ছেলের কথা পাড়লাম। বটুকের মুখ দিয়ে বলাতে পারলাম যে শুভঙ্কর ছাড়া তার আর কোনও ছেলে নেই। এটা শুনে সুমনার পুরোনো ঘৃণা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সে বটুককে ধরিয়ে দিল।’
‘আর একটা প্রশ্ন। ফিরদৌস যখন সাবিনার কাছে শুনল জাহাঙ্গির খান তাকে টাকা চুরির দায়ে সন্দেহ করছে তখন সে সরাসরি জাহাঙ্গির খানকে ফোন করল না কেন?’
প্রশ্নটা শুনে আদিত্য খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘এই প্রশ্নটা আমাকেও ভাবিয়েছে। এর একেবারে সঠিক উত্তর আমার কাছে নেই। তবে একটা আনুমানিক উত্তর দিতে পারি। আমার অনুমান, ফিরদৌস জাহাঙ্গির খানকে ফোন করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে সে নির্দোষ। তখন জাহাঙ্গির খান সম্ভবত ফিরদৌসকে প্রশ্ন করেছিল, সে যদি সত্যিই নির্দোষ হয় তাহলে সে লুকিয়ে রয়েছে কেন? এই প্রশ্নের কোনও সন্তোষজনক উত্তর ফিরদৌস দিতে পারেনি। সন্তোষজনক উত্তর দিতে গেলে তাকে হার্ড ডিস্ক দুটোর কথা বলতে হত, যেটা বলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফিরদৌসের ওপর বটুক সামন্তর কড়া নির্দেশ ছিল কুমুদিনীর আসল ব্যবসার কথা কাউকে বলা যাবে না।’
‘কিংবা হয়তো জাহাঙ্গির এই রকম একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে পারে আশঙ্কা করে ফিরদৌস তাকে ফোনই করেনি।’ গৌতম চিন্তা করতে করতে বলল।
‘হ্যাঁ। সেটাও হতে পারে।’ আদিত্য কথা বলতে বলতে দরজার দিকে তাকাল।
বেয়ারা চা নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। প্রায় তার পেছন পেছন সোমেন মুখুটি।
চায়ের কাপে একটা চুমুক লাগিয়ে গৌতম মুখুটিকে বলল, ‘গোবিন্দ রায় আদিত্যকে বলেছিল পুলিশের ভেতরে কিছু ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছে। ইংরেজিতে যাকে বলে মোল। এই মোলটি পুলিশ বিভাগের গোপন খবর বটুক সামন্তকে জানিয়ে দিত। আমাদের জানা দরকার, সেই ব্যক্তিটি কে? তোমার এবং তোমার স্ত্রীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে তোমাদের আয়ের তুলনায় সঞ্চয় অযৌক্তিকভাবে বেশি। এই ব্যাপারে ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি শিগগির শুরু হবে। ততদিন তোমাকে সাসপেন্ডেড থাকতে হবে। তুমি কাল-পরশুর মধ্যেই চিঠি পেয়ে যাবে।’
আদিত্য বলল, ‘মুখুটি সাহেব, আপনি আমাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, আসল মামলাটা টাকা চুরির। একটা বেশ বিশ্বাসযোগ্য কেসও আপনি সাজিয়ে ফেলেছিলেন। আপনার কাজ ছিল ডিস্ক উধাও হয়ে যাবার ব্যাপারটা থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখা। আমার তখনই আপনার ওপর সন্দেহ হয় যখন আপনি টাকা চুরির কেসটার ওপর অতটা জোর দিচ্ছিলেন। আপনার ওপর সন্দেহ হবার পর থেকেই আমি ইন্সপেক্টার শিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করি। বহরমপুর যাবার সময় ওকেও চলে আসতে বলি। বহরমপুরের হোটেলে উনি সময় মতো এসে না পৌঁছলে আমি এতদিনে মরে ভূত হয়ে যেতাম।’
মুখুটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর গৌতম বলল, ‘আমার আরও কিছু প্রশ্ন আছে।’
‘বল, বল, কী প্রশ্ন। আমি সাধ্যমতো উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।’ আদিত্য সোফায় হেলান দিয়ে বসল।
‘ভাবছিলাম, জাহাঙ্গির খানকে যে মহিলা ফোনে বলেছিলেন কুমুদিনীতে কুড়ি লক্ষ ডলার এসে পৌঁছয়নি, তিনি কি সুমনা ঘোষাল?’
‘অবশ্যই। তিনি ছাড়া আর কে হবে? বটুক তাকে বলে রেখেছিল জাহাঙ্গির ফোন করলে তাকে বলে দিতে যে টাকা পৌঁছয়নি। এক্ষেত্রে সুমনা বটুকের অবাধ্য হয়নি। অবাধ্য হবার কোনও কারণ ছিল না।’
‘আমার পরের প্রশ্ন, রনি ঘোষাল বাবলু মণ্ডলের মতো ক্রিমিনালের সঙ্গে যোগাযোগ করল কী ভাবে?’
‘এই প্রশ্নটার সঠিক উত্তর আমিও জানি না। তবে চাকী তদন্ত করে জানতে পেরেছে যে বাবলু মণ্ডল মাঝে মাঝে বুটলেগার ক্লাবে যেত। আর পল্লবী বুটলেগার ক্লাবে চাকরি নেওয়ার পর রনিও সেখানে যেত। পল্লবী নিউটাউনের ফ্ল্যাটে চলে আসার আগে, অর্থাৎ যখন তার সঙ্গে পিটার অরোরার প্রেম ততটা জমেনি তখন, রোজ রাত্তিরে রনিই পল্লবীকে বাড়ি পৌঁছে দিত। আমার অনুমান, বুটলেগার ক্লাবেই রনির সঙ্গে বাবলু মণ্ডলের আলাপ হয়।’
‘আমার শেষ প্রশ্ন, ‘ফেরারি’ ছবির জন্য জাহাঙ্গির খানের কি আদৌ টাকা দেবার কথা ছিল?’
‘ছিল। তবে কুড়ি কোটি নয়, পাঁচ কোটি। টাকাটা দেবার আগে অবশ্য খবর পাওয়া গেল ধামানির অর্থাভাবের কারণে প্রজেক্টটা ডুবতে বসেছে। তাই শেষ পর্যন্ত বটুক টাকাটা জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে নেয়নি। এটাও চাকী জেরা করে বার করেছে। ছেলেটা কিন্তু বেশ কাজের।’
‘সন্দেহ নেই। দেখি, ওর আর শিকদারের জন্য একটা অ্যাওয়ার্ড-ট্যাওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। ভুললে চলবে না, শিকদার তোর প্রাণ বাঁচিয়েছে।’
‘আমি কাতার চলে যাচ্ছি। আমার ছোট ভাই-এর কাছে। সাবিনা আর তার মেয়েদেরও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। আবার কবে আসতে পারব জানি না। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসার ইচ্ছে নেই। আমার আর সাবিনার দুজনের সংসারই তো একেবারে ছারখার হয়ে গেছে। দূরে থাকলে কিছুটা ভুলে থাকা যাবে।’ নুসরতের গলাটা ভীষণ দুঃখী শোনাল।
‘সাবিনা কেমন আছে?’ আদিত্য সাবধানী গলায় বলল। তারপর একটু ইতস্তত করে যোগ করল, ‘জয়া অধিকারীর সঙ্গে ফিরদৌসের ব্যাপারটা জানতে পেরেছে?’
‘না জেনে উপায় কি? খবর কাগজ আর টেলিভিশনগুলো তো দিনের পর দিন ওইসব নিয়েই বলে যাচ্ছে। এরকম রসাল খবর তো তারা চট করে পায় না। তবে আমি বলব শাপে বর হয়েছে। জয়া অধিকারীর ব্যাপারটা জানতে পারার পরে ফিরদৌসের মৃত্যুর শোকটা সাবিনা খানিকটা সামলে নিয়েছে।’
‘মনে হয়, একটা শকের ওপর আর একটা শক কিছুটা পজিটিভ রেজাল্ট দিয়েছে। ওই নেগেটিভ-নেগেটিভ মেলালে যেমন পজিটিভ হয় আর কী।’ নুসরতের দাদা ইনামুর হালকা গলায় বললেন।
‘না, না। ঠিক তা নয়। আমার অনুমান, সাবিনার এখন মনে হচ্ছে যে-ফিরদৌসকে সে এতটা ভালবাসত, যে-ফিরদৌসের জন্যে সে এত কষ্ট পাচ্ছিল, সেই লোকটাই তো তার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল না। অবিশ্বস্ত স্বামীর জন্য সে কেন কষ্ট পেতে যাবে?’ নুসরত থেমে থেমে বললেন।
‘সাবিনার সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভাল লাগত। ওকে সঙ্গে নিয়ে এলেন না কেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমি বলেছিলাম। সাবিনা আসতে চাইল না। বোধহয় ফিরদৌস সংক্রান্ত সব কিছু ও ভুলে যেতে চায়। এখানে এলেই ওর ফিরদৌসের কথা মনে পড়ে যেত।’ কথা বলতে বলতে নুসরত তাঁর হাতের ব্যাগটা খুললেন।
‘জাহাঙ্গির খান তো এখনও পুলিশ হেফাজতেই আছেন?’ আদিত্য খানিকটা দায়সারা ভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। আমার স্বামী পুলিশ হেফাজতেই আছে। তার উকিল বেল-এর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। পায়নি। দেশদ্রোহীরা বেল পায় না।’ নুসরতের চোয়াল শক্ত হল। শুনেছি বটুক সামন্তও জেলে আছে।’
ঘরের আবহাওয়াটা ভারী হয়ে উঠছে। আদিত্য কথা ঘোরানোর জন্য ইনামুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি তো বহরমপুরের। আপনি ফিরদৌসের সঙ্গে জয়া অধিকারীর সম্পর্কের কথাটা জানতেন না?’
‘অনেকদিন আগে একটা কেলেঙ্কারি হয়েছিল। সেটা জানতাম। কিন্তু তার পরেও এতদিন যে ফিরদৌস জয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছিল সেটা জানতাম না। আসলে আমি তো অনেকদিন বহরমপুর ছাড়া। তাই ওখানকার খবর-টবরও আর রাখা হয় না।’ ইনামুল তাঁর কফির কাপে চুমুক লাগালেন।
‘আপনারা কবে চলে যাচ্ছেন? টিকিট হয়ে গেছে?’ আদিত্য নুসরতের দিকে তাকিয়ে বলল।
‘সামনের বুধবার। টিকিট কাটা হয়ে গেছে। হাতে সময় বেশি নেই। ভেবেছিলাম আপনার সম্মান-দক্ষিণাটা ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার করে পাঠিয়ে দেব।’ নুসরত তাঁর খোলা ব্যাগ থেকে একটা চেক বার করলেন। ‘কিন্তু তারপর ভেবে দেখলাম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে না গেলে অধর্ম হবে। আপনি আমার কতটা উপকার করেছেন আপনি নিজেই জানেন না।’
নুসরত উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর দেখাদেখি তাঁর দাদাও। আদিত্য চেকটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আপনারা ভাল থাকবেন। সাবিনার জন্যে আমার শুভ কামনা রইল।’
ওরা দুজন আদিত্যর আপিস থেকে বেরিয়ে যাবার পর আদিত্য আড়চোখে চেকটার দিকে তাকাল। এই টাকায় এখন তার বেশ কিছুদিন চলে যাবে।
মেসের দরজার সামনে আদিত্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে দুটো সুটকেস, পিঠে ল্যাপটপের ব্যাগ। সুটকেস দুটো এত ভারী যে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সে তাই ও-দুটোকে পায়ের কাছে নামিয়ে রেখেছে। ব্যাগটাও নেহাত হালকা নয়। দুটো সুটকেস আর ব্যাগের মধ্যে তার জাগতিক সম্বল প্রায় সবটাই এঁটে গিয়েছে। বেশিরভাগটাই অবশ্য বই। তাই এত ভারী। এর বাইরে যেটুকু পড়ে রইল, দু-একবার এসে নিয়ে গেলেই চলবে।
‘চললে তাহলে?’ বলরাম এসে সামনে দাঁড়াল।
‘হ্যাঁ রে, চললাম। তবে ঘরটা এক্ষুনি ছাড়ছি না। কিছু জিনিসও রয়ে গেল। ওগুলো নেবার জন্যে দু-একবার আসতে হবে। তোরা সবাই ভাল থাকিস।’ আদিত্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরাল।
‘আমাদের আর ভাল থাকা। ম্যানেজার তার গাঁয়ের কাকে যেন ঢোকাতে চায়। আমাদের টিকতে দিচ্ছে না। খুব বেশি দিন এখানে থাকতে পারব বলে মনে হয় না।’ বলরাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘শোন। তুই যদি এখানকার কাজটা ছেড়ে দিবি ঠিক করে ফেলিস তাহলে আমাকে একটা খবর দিস। আমার ফোন নম্বর তো তোর কাছে আছে। আমাদের একটা লোক কিন্তু দরকার হবে।’ আদিত্য দেখতে পেল একটা নীল রঙের মারুতি সুইফট ডিজায়ার আস্তে আস্তে তাদের মেসের গলিটায় ঢুকছে।
কেয়ার গাড়ি নিয়ে আসার কথা। সে কেয়ার জন্যেই অপেক্ষা করছে। কেয়া এসে তাকে তুলে নেবে।
গতকাল একটা শনিবার ছিল, তার আগের শনিবার, খুব অনাড়ম্বরভাবে, সে আর কেয়া রেজিস্ট্রি বিয়েটা সেরে ফেলেছে।
আসলে ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি ঘটে গেল। এতটাই তাড়াতাড়ি যে পুরো ব্যাপারটা এখনও আদিত্যর অবাস্তব মনে হচ্ছে। আবার এটাও ঠিক, খুব বেশি ভাবতে বসলে আদিত্য কোনও দিনই বিয়ে করে উঠতে পারত না। কুমুদিনী রহস্য সমাধান হয়ে যাবার তিন-চারদিন পরে আদিত্য আর কেয়া গঙ্গার ধারে সেই নতুন রেস্টোরেন্টটাতে খেতে গিয়েছিল। সেখানে বসে যখন তারা খাবারের অপেক্ষা করছে তখন হঠাৎ, আদিত্যর মাথায় কী ভূত চাপল কে জানে, সে কেয়াকে বলল, ‘আমাকে বিয়ে করবে, কেয়া?’ শুনে কেয়া কেঁদে-কেটে অস্থির।
সেখান থেকে সেই রাত্তিরেই সোজা অমিতাভদের বাড়ি। পথে সারাটা রাস্তা আদিত্য কেয়ার হাত দুটো ধরে ছিল। নইলে কেয়াকে সামলানো যাচ্ছিল না। কেয়াকে এতটা ইমোশানাল হতে আদিত্য আগে কখনও দেখেনি। অমিতাভর কাছে যাবার কারণ, আদিত্য জানত, অমিতাভর খুব চেনা একজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আছে। ইস্কুলের পুরোনো বন্ধু। সে নিশ্চয় আদিত্যদের সাহায্য করতে পারবে।
অমিতাভর বিস্ময়, রত্নার উচ্ছ্বাস, গৌতমের টিপ্পুনি ইত্যাদি টুকিটাকিগুলো বাদ দিয়ে সংক্ষেপে বলতে গেলে, এর পাঁচ সপ্তাহ পরে একটা শনিবার সতীশ মুখার্জী রোডে রেজিস্ট্রার সাহেবের বাড়িতে আদিত্য আর কেয়া সই করে বিয়েটা সেরে ফেলে। আদিত্যর দিকে ছিল অমিতাভ আর গৌতম, দু-জনেই সস্ত্রীক। কেয়ার দিকে তার চার-পাঁচজন বন্ধু। তারপর সকলে মিলে বালিগঞ্জের একটা রেস্টোরেন্টে খাওয়া-দাওয়া হল। সেটা আটদিন আগেকার কথা। আর আজ একটা রবিবার আদিত্য নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে।
ইতিমধ্যে অবশ্য সে আর কেয়া দেশবন্ধু পার্কের কাছে একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া করে ফেলেছে। ছোট ফ্ল্যাট, তবে বাড়িটা নতুন। বাড়ির মালিকের মেয়ে কেয়ার কাছে টিউশান পড়ত। একটা রট-আইরনের খাট কেনা হয়েছে, ওটাই সস্তা পড়ল, আর রট-আইরনেরই কিছু অন্যান্য আসবাব। দামে কম হলেও দেখতে মন্দ নয়। আর একটা আলমারি। তাছাড়া ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, গ্যাস-স্টোভ। টিভি এখনও কেনা হয়নি। বাড়িটায় কয়েকটা আলো-পাখা লাগানো ছিল। তাই ওগুলো আর কিনতে হয়নি। সারাজীবন হস্টেলে হস্টেলে কাটিয়েছে বলে কেয়া রান্না-বান্না কিচ্ছু জানে না। তার তুলনায় আদিত্যই বরং খানিকটা রান্না করতে পারে। সবার ওপরে ইউ-টিউব তো আছেই।
নীল গাড়িটা কেয়াই নিয়ে এসেছে। কেয়ার হলদে ডুরে শাড়ি রোদ্দুরে ঝলমল করছে। কেয়া সিঁদুর পরেছে। গায়ে হালকা গয়না। একেবারে অচেনা দেখাচ্ছে কেয়াকে। গাড়ির ডিকিটা কেয়ার জিনিসপত্রে ভরে গেছে। আদিত্যর একটা সুটকেসের জায়গা হল ড্রাইভারের পাশে, গাড়ির সামনের সিটে। অন্যটা পিছনের সিটে রাখতে হল। সুটকেসটা রাখার পর পেছনে খুব বেশি জায়গা বাকি রইল না। দু-জনকে ঘেঁসাঘেঁসি করে বসতে হয়েছে।
বলরাম মেসের দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। ওই মেস, মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে বেরোনো এই গলি, গলির মোড়ে গোপাল-নেপালের মুদির দোকান, সাইকেল সারাই-এর দোকান, বড়রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথে বেঞ্চি-পাতা চায়ের দোকান, আদিত্য টের পেল, খুব মায়ায় জড়িয়ে রেখেছিল তাকে। এত মায়া সে আগে কখনও টের পায়নি। কম দিন তো থাকা হল না এখানে। গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। কেয়ার নতুন শাড়ি থেকে একটা আশ্চর্য গন্ধ আসছে। কেয়ার শরীরের অবয়ব, স্পর্শ, ঘ্রাণ আদিত্যকে চুম্বকের মতো টানছে। তবু সেই তীব্র শরীরী আকর্ষণের মধ্যেও আদিত্য হঠাৎ খুব বিষণ্ণ বোধ করল।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন