কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

অভিরূপ সরকার

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দোলের সকালে আদিত্য পারতপক্ষে বাইরে বেরোয় না। তাদের পাড়াটা অবাঙালি অধ্যুষিত, এখানে দোল খেলার নামে দুদিন ধরে কার্যত তাণ্ডব চলে। বেলুনের মধ্যে নোংরা জল ও নোংরাতর তরল পদার্থ ভর্তি করে নিরীহ, অনিচ্ছুক পথচারীদের গায়ে ছুঁড়ে মারা হয়। এটা করে কারা যে আনন্দ পায়, আদিত্য জানে না। সে শুধু এইটুকু জানে, দোলের দিন ওইসব ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে নিজের ঘরে বসে গান শোনাটাই বুদ্ধির কাজ। আদিত্য এখন তাই করছে। তবে সকালটা ঘরে থাকলেও বিকেলে বেরতেই হবে। অমিতাভ রাত্তিরে খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছে।

এই মুহূর্তে ইউটিউবের মাধ্যমে ভীমসেন যোশী বসন্ত রাগে সেই পুরোনো হোলির গান ‘ফাগওয়া ব্রিজ দেখন কো চলরি’ শোনাচ্ছেন। গান শুনতে শুনতে আদিত্য ভাবছিল গৌতমকে কিছু ইনফরমেশনের জন্য ফোন করতে হবে। কিছুদিন আগে গৌতমের আর-একটা প্রোমোশন হয়েছে। লালবাজারে এখন তার প্রচুর প্রভাব। পুলিশের কোনও গোপন তথ্য জানতে হলে গৌতমকে ফোন করাটাই সব থেকে ভাল। কিন্তু তার আগে কিছু হোমওয়ার্ক করা দরকার। দেখা দরকার, কুমুদিনী বিত্ত নিগম ও তার মালিক সম্বন্ধে মিডিয়া কতটুকু জানাতে পারছে। রোহিত ধামানি নামক ফিল্ম প্রোডিউসারটির সম্বন্ধেও জানা দরকার।

ইন্টারনেট একটা অফুরন্ত তথ্যের ভাণ্ডার। কুমুদিনী বিত্ত নিগম গুগল করতে বেশ কয়েকটা এনট্রি চলে এল। বেশিরভাগই বিভিন্ন খবর কাগজে কুমুদিনী নিয়ে সাম্প্রতিক যে খবরগুলো বেরিয়েছে তার অন লাইন সংস্করণ। আদিত্য তার ডায়েরিতে মূল ঘটনাগুলো নোট করে নিচ্ছিল। বিভিন্ন খবর কাগজের প্রতিবেদন থেকে কুমুদিনী এবং তার মালিক সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যাচ্ছে। তার মধ্যে কিছু তথ্য অবশ্য জাহাঙ্গির খানের কাছ থেকেই জানা গিয়েছিল। সেই তথ্যগুলো এবং বাড়তি আরও যেটুকু ইন্টারনেট থেকে জানা যাচ্ছে সেগুলো পড়ে নিজের মতো করে সাজিয়ে লিখে নিতে আদিত্যর সারা সকালটা কেটে গেল। ভাগ্যিস বাঙালি পাঠক গল্প ভালবাসে, নাহলে খবর কাগজগুলো এতটা ফেনিয়ে লিখত না। অবশ্য আদিত্যর লেখার মধ্যে তার নিজের কল্পনাও কিছু মিশে ছিল, যেমন ‘পারসোনাল নোটস’-এ থাকে। আসলে মিডিয়ার লেখাগুলো থেকে সে একটা গল্প খাড়া করার চেষ্টা করছিল।

কুমুদিনী বিত্ত নিগমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান স্বত্বাধিকারী সত্যজিৎ সামন্ত, ওরফে বটুক সামন্ত। বটুক সামন্তর বাবা মহাদেব সামন্ত বর্ধমানের জোতদার ছিলেন। টাকা ধার দেবারও বড় ব্যবসা ছিল তার। মহাদেবের দুই ছেলের কেউই কিন্তু কৃষিকাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখেনি। মহাদেব মারা যাবার পর দুই ছেলে মিলে বাবার জমিজমা প্রায় সবই বেচে দিয়েছিল। বড় ছেলে তার ভাগের টাকা দিয়ে কন্সট্রাকশনের বিজনেস শুরু করে। ছোট ছেলে বটুক সামন্তই বরং কিছুটা বাবার লাইনে রয়ে গেছে। কুমুদিনী বিত্ত নিগম নামে স্টক ব্রোকিং কম্পানি হলেও তার আসল কাজ টাকা ধার দেওয়া।

প্রথম কয়েক বছর বটুক সামন্ত নিজের পুঁজি থেকে কিছু কিছু নতুন ব্যবসায় ধার দিয়েছিল। এখন হলে তার ধার দেওয়া পুঁজিকে বলা যেত ভেনচার ক্যাপিটাল, নতুন ব্যবসাগুলোকে বলা যেত স্টার্ট আপস। কিন্তু তিন দশক আগে, যখন বটুক সামন্ত তার ব্যবসা শুরু করেছিল, তখনও এসব নাম বাজারে আসেনি। সে যাই হোক, এই ধারগুলোতে ঝুঁকির মাত্রা একটু বেশিই ছিল, তাই বটুক সামন্তর সুদের হারও ছিল বেশ চড়া। তবে লোকে বলে, কাকে ধার দেওয়া উচিত আর কাকে নয় এ-ব্যাপারে বটুক সামন্তর একটা আশ্চর্য ষষ্ঠেন্দ্রিয় কাজ করত। ফলে ধার দেওয়া টাকার একটা বড় অংশ শোধ হয়ে যেত। তাছাড়া সঙ্গত কারণে কেউ ধার শোধ দিতে না পারলে বটুক সামন্ত তাকে নানারকম ছাড় দিত, ধার শোধ করার তারিখটাও পিছিয়ে দিত। বস্তুত, আধুনিক ব্যাঙ্কিং-এর কায়দা-কানুনগুলো কিছুটা তার সহজাত বুদ্ধি দিয়ে আর অনেকটাই বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে বটুক সামন্ত রপ্ত করে ফেলেছিল।

একটু একটু করে বটুক সামন্ত আরও বড় জায়গায় ধার দিতে শুরু করল। বড় জায়গা মানে যাত্রা, সিনেমা, বার, নাইট ক্লাব। টাকা ধার দেওয়ার সময় বটুক সামন্ত একটা জিনিসই দেখত। সে দেখত, যে-ব্যবসায় সে ধার দিচ্ছে সেটা আইনসম্মত কিনা। বেআইনি ব্যবসায় সে কখনও ধার দিত না। কিন্তু যে-ব্যবসায় সে টাকা ধার দিচ্ছে তার নৈতিকতা নিয়ে সে কখনও মাথা ঘামাত না। অবশ্য আর একটা দিক থেকে তার ব্যবসাটা বেআইনি রাস্তায় পা দিয়েছিল। ব্যবসাটা বাড়াতে গেলে, অর্থাৎ আরও আরও টাকা ধার দিতে গেলে, সে দেখল তার টাকার প্রয়োজন। কোথায় সে অত টাকা পাবে? কোনো ব্যাঙ্ক তাকে অত টাকা দেবে না। তাই সে বাঁকা পথ ধরল।

আমাদের দেশে এবং আমাদের রাজ্যে এমন লোকের অভাব নেই যাদের বিস্তর কালো সম্পত্তি আছে। সম্পত্তিগুলো অনেক সময় বেনামী জমি-জমায় আটকে থাকে, কখনও পড়ে থাকে নগদে, কখনও বা গয়নাগাঁটিতে। ইচ্ছে থাকলেও টাকার মালিক টাকাটা কোথাও খাটিয়ে বাড়িয়ে নিতে পারে না। বটুক সামন্ত এইসব কালো টাকার হদিশ করে সেগুলো তার মহাজনী ব্যবসার কাজে লাগাতে শুরু করল। কালো টাকার মালিক পাবে মাসিক এক পার্সেন্ট সুদ, বটুক সামন্তর কম্পানি পাবে আরও এক পার্সেন্ট। যেসব জায়গায় বটুক সামন্ত টাকা ধার দিত সেখান থেকে মাসিক দু-পার্সেন্ট সুদ আদায় করাটা মোটেই শক্ত নয়। কালো টাকা ধার দেওয়া শুরু করার পর থেকে কুমুদিনীর ব্যবসা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। গত ৯ ফেব্রুয়ারি, যখন বটুক সামন্তকে কুমুদিনী থেকে অ্যারেস্ট করে কুমুদিনী বিত্ত নিগমের পুরো অফিস সিল করে দেওয়া হয় তখন, পুলিসের প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, বাজারে কুমুদিনীর দেওয়া ধারের পরিমাণ একশো কোটি টাকার বেশি। দুর্ভাগ্যবশত, কারা কতটা ধার নিয়েছে এবং কারা কতটা কালো টাকা কুমুদিনীকে ধার দিয়েছে তার কোনও তালিকা পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। অনুমান করা হচ্ছে, কোথাও একটা তালিকাগুলো আছে, কিন্তু কোথায় পুলিশ জানে না।

সংবাদপত্রগুলো একটা প্রশ্ন বারবার তুলছে। প্রশ্ন উঠছে, কী করে এত বছর ধরে পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে কুমুদিনী ব্যবসা চালিয়ে গেল? আর এখনই বা কী এমন ঘটল যাতে হঠাৎ পুলিশ তৎপর হয়ে কুমুদিনীর মালিককে অ্যারেস্ট করে ফেলল? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর পুলিশ দেয়নি, কিন্তু সাংবাদিকরা মনে করছে এর পিছনে গভীর কোনও রহস্য আছে।

বটুক সামন্ত সম্বন্ধে কিছু ব্যক্তিগত তথ্যও মিডিয়া থেকে জানা গেল। বটুক সামন্তর বয়েস বছর ষাট-বাষট্টি। তার স্ত্রী এবং একমাত্র পুত্র, দু-জনেই বর্তমান, কিন্তু কেউই তার সঙ্গে থাকে না। বস্তুত, স্ত্রী-পুত্রর সঙ্গে বটুকবাবুর সম্পর্কটা বেশ ছাড়া-ছাড়া। বহুদিন আগে বটুক সামন্তের সঙ্গে মনোমালিন্যের ফলে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বটুকবাবুর স্ত্রী আলাদা থাকতে শুরু করেছিলেন, এখনও তাই থাকেন। যদিও, মিডিয়ার খবর, কাগজে কলমে বিবাহ-বিচ্ছেদ তাদের হয়নি। ওপর ওপর একটা সম্পর্ক এখনও টিকে আছে। বটুকবাবু মাঝে মাঝে স্ত্রী-পুত্রকে দেখতে আসেন। বটুকবাবুর ছেলে এখন বড় হয়ে গেছে। তার মা-ই তাকে মানুষ করেছে। সে বর্ধমান মেডিকাল কলেজে বাচ্চাদের ডাক্তার, বর্ধমানেই তার মাকে নিয়ে থাকে। মা-ছেলে বাবার খবর খুব বেশি রাখে না।

বটুক সামন্তর আরেকটা সংসার আছে। সাতপাক ঘোরা, মালাবদল করা সংসার নয়, বৈবাহিক সম্পর্ক বহির্ভূত হাফ-গেরস্থালি। বটুকবাবুর ক্ষেত্রে কিন্তু এই দ্বিতীয় সম্পর্কটাই টিকে আছে। বটুক সামন্তর সঙ্গে যখন অভিনেত্রী সুমনা ঘোষালের প্রথম আলাপ হয় তখন সুমনার ফিল্মি কেরিয়ার নিঃসন্দেহে ঊর্ধ্বমুখী। একটা বাংলা ছবিতে বটুক সামন্ত কিছু পয়সা লগ্নি করেছিল। সেই ছবির ঠিক নায়িকা নয়, সহনায়িকা ছিল সুমনা ঘোষাল। সুমনার বয়েস তখনও তিরিশ ছাড়ায়নি, বটুক সামন্তর বয়েস সদ্য তিরিশ ছাড়িয়েছে। সে যাত্রা সম্পর্কটা কত দূর এগিয়েছিল জানা যায় না, তবে তার পরের কয়েক বছর ফিল্মি জমায়েত-টমায়েতে মাঝে-মাঝে দু-জনকে এক সঙ্গে দেখা যেত।

 সুমনা ঘোষালের বংশ-পরিচয় কিছুটা ঘোলাটে ছিল। তার মা সুনয়না ছিলেন পুরোনো যুগের পেশাদার নাট্যাভিনেত্রী। কিছুদিনের জন্য সুনয়নার সঙ্গে অজয় ঘোষাল নামে এক নাট্য-পরিচালকের সম্পর্ক হয়। থিয়েটার জগতের পুরোনো লোক যারা বেঁচে আছেন, তাঁরা কেউ কেউ মনে করেন, সুমনা সেই সম্পর্কের ফল। অবশ্য অন্য সম্ভবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শোনা যায়, সুমনার জন্মের কিছুদিন বাদে অজয় ঘোষাল তার স্ত্রীর কাছে ফিরে যায়। সুমনাকে তার মা একা হাতেই বড় করেছিলেন। অভিনয় করতে এসে একটা ভদ্র গোছের পদবী সুমনার দরকার ছিল। কিন্তু তার মায়ের কোনও পদবী ছিল না। সুমনা অজয় ঘোষালের পদবীটাই গ্রহণ করে। এর থেকে মনে হতেই পারে অজয় ঘোষালই তার জন্মদাতা পিতা।

বটুক সামন্তর সঙ্গে আলাপ হওয়ার কয়েক বছর পরে সুমনা ঘোষাল দু-একটা হিন্দি সিরিয়ালে অভিনয়ের বরাত পেয়ে কিছুদিনের জন্য মুম্বাই চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে সে উপলব্ধি করল বাংলা ছবিতে অভিনয় করার জন্য আর কেউ তাকে ডাকছে না। আসলে সে টের পায়নি ইতিমধ্যে একটু একটু করে বাংলা ছবিতে অভিনয়ের ধরনটাই পালটে গেছে। সে যেরকম চড়া দাগের অভিনয় ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছে, করে এসেছে, যেটা গ্রামের দিকের দর্শক এক সময় খুব পছন্দ করত, এখন বাংলা ছবিতে সেরকম অভিনয় আর চলে না। কিছুদিন সে যাত্রায় অভিনয়ের চেষ্টা করল। কিন্তু যাত্রায় অভিনয় করা মুখের কথা নয়। ভ্রাম্যমান জীবন, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক থাকে না, ঘুমেরও কোনও বাঁধাধরা সময় নেই। সুমনা ঘোষাল অসুস্থ হয়ে যাত্রার লাইনটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।

হাতে কাজ নেই, ব্যাঙ্কে টাকা-পয়সা নেই, আত্মীয়স্বজন বা বংশ-পরিচয় নেই, এমনকি তার শরীর, যা দিয়ে সে এক সময় অনায়াসে পুরুষদের আকর্ষণ করত, সুমনা টের পেল, সেটাও শিথিল হয়ে আসছে। এই সময় তার সঙ্গে বটুক সামন্তর আবার দেখা হয়। সেটা বারো-তেরো বছর আগেকার কথা। বটুক সামন্তর ব্যক্তিগত জীবন তখন তলানিতে ঠেকেছে। তার বউ ছেলেকে নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। জনশ্রুতি, সেই চলে যাওয়ার পিছনে বটুক সামন্তের চরিত্রগত শৈথিল্যের ইন্ধন ছিল। সে যাই হোক, সেই সময়ে বটুক এবং সুমনা দু-জনেই আশ্রয় খুঁজছে, সঙ্গী খুঁজছে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তাদের ভেতর একটা মেলবন্ধন ঘটে যায়। বটুক সামন্তর ব্যবসা তখন রমরমিয়ে চলছে। সে সুমনার জন্য টালিগঞ্জ এলাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে দেয়। সেই ফ্ল্যাটে সুমনার সঙ্গে সে নিজে মাঝে মাঝে গিয়ে থাকত। কিন্তু ভবানীপুর অঞ্চলে তার যে পুরোনো বাড়িটা ছিল সেটা সে অ্যারেস্ট হওয়ার দিন অব্দি ছাড়েনি।

ফিল্ম প্রোডিউসার রোহিত ধামানি সম্বন্ধেও ইন্টারনেট থেকে কিছু তথ্য জানা গেল। ধামানির ফিল্ম কম্পানির নাম ‘নিউ এজ মুভিজ’। এই ব্যানারে সে এখন অব্দি বাইশখানা সিনেমা প্রোডিউস করেছে। তার মধ্যে ‘নাগিনী কন্যার অভিশাপ’, ‘শাঁখা সিঁদুর’, ‘রাঙাবউ’ ‘ঢপের চপ’ ইত্যাদি কিছু ছবি গ্রামাঞ্চলে ভালই ব্যবসা করেছে। কিছু ছবি আবার সুপারফ্লপ। ধামানির নতুন ছবির নাম ‘ফেরারি’। ছবির খানিকটা শুটিং ইয়োরোপে হয়েছে, বাকিটা হবে আলাস্কার টনগ্যাস ন্যাশানাল ফরেস্টে। এত বিগ বাজেট বাংলা ছবি নাকি সাম্প্রতিক কালে হয়নি। দু-একটা গসিপ ম্যাগাজিন বলছে, এই মুহূর্তে টাকার জন্য শুটিং আটকে আছে, টাকার জোগাড় হলেই আবার শুটিং শুরু হবে।

আদিত্য লেখা বন্ধ করে একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর টেবিলের ওপর থেকে মোবাইলটা তুলে তার পুলিশ বন্ধু গৌতম দাশগুপ্তর নম্বরটা লাগাল। গৌতম আবার রিং টোন বদলেছে। আগে গৌতমকে ফোন করলে কিশোরকুমার কিছুক্ষণ ‘জীবন সে ভরি তেরি আঁখে’ শোনাতেন। কয়েক সপ্তাহ হল তাঁর বদলে মহম্মদ রফি ‘আভি না যায়ো ছোড় কর’ শোনাচ্ছেন। দুটো গানই আদিত্যর খুব ভাল লাগে। গৌতমের কলার টিউনটা শুনতে শুনতে সে ভাবছিল আজ দুপুরে ইউ টিউবে পুরোনো হিন্দি গান শুনলে বেশ হয়।

 ‘কী রে, দোল-টোল খেলছিস?’ দু-রাউন্ড গান বাজার পর গৌতম ফোন ধরল।

 ‘না, না। দোলের ভয়ে দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছি। অবশ্য এখানে আমাকে রঙ দেওয়ার মতো কেউ নেই। তুই দোল খেলেছিস?’ আদিত্য কথা বলতে বলতে মুখে একটা সিগারেট লাগাল।

 ‘আমারও এবার দোল খেলা হচ্ছে না। মালিনী বাচ্চা নিয়ে হোলি খেলতে দিল্লী গেছে। বাড়ি ফাঁকা। আমি হাতে একটু সময় পেয়ে বারান্দায় গাছগুলোর পরিচর্যা করছিলাম।’

 আদিত্য আন্দাজ করতে পারল কেন গৌতমের ফোন ধরতে দেরি হচ্ছিল।

 ‘আজ সন্ধেবেলা কী করছিস? আমার বাড়িতে চলে আয় না। একটা হুইস্কির বোতল অনেক দিন ধরে পড়ে আছে। তুই এলে খুলব।’ গৌতম ষড়যন্ত্র করার গলায় বলল।

‘আজ হবে না রে। সন্ধেবেলা অমিতাভ আগেই নেমন্তন্ন করে রেখেছে। মালিনীর মতো রত্নাও ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। একা একা খেতে ভাল লাগে না, তাই আমাকে ডেকেছে। বাইরে থেকে খাবার আনাবে। তুই একা আছিস জানলে তোকেও নিশ্চয় ডাকত। তুই বরং আমার সঙ্গে চল। না হলে একা বাড়িতে বসে বোর হবি। আমি অমিতাভকে ফোন করে দিচ্ছি। ওর সঙ্গে তো আর কোনও ফর্মালিটি নেই।’

 ‘ঠিক হ্যায়। তোর সঙ্গেই যাব। তুই অমিতাভকে ফোন করে বলে দে। আমিও রঘু ডাকাতের মতো ওকে ফোন করে বলছি সন্ধেবেলা ওর বাড়িতে চড়াও হব। তাহলে সন্ধেবেলা দেখা হচ্ছে। সাতটার মধ্যে আমি অমিতাভর বাড়িতে পৌঁছে যাব।’ আদিত্যর মনে হল গৌতম ফোনটা কেটে দেওয়ার মতলব করছে।

 ‘দাঁড়া, দাঁড়া। ফোনটা রাখিস না। তোর সঙ্গে কথা আছে।’ আদিত্য তাড়াতাড়ি বলল।

 ‘বল।’

‘কুমুদিনী বিত্ত নিগম বা তার মালিক সত্যজিৎ ওরফে বটুক সামন্ত সম্বন্ধে কিছু তথ্য দরকার ছিল, যে বটুক সামন্তকে সম্প্রতি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তুই কি জানিস ব্যাপারটা?’

‘কুমুদিনী বিত্ত নিগম? তুই আবার এর মধ্যে ঢুকলি কী করে?’ আদিত্যর শেষ প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে গৌতম পালটা প্রশ্ন করল। সে যেন একটু অবাক হয়েছে।

‘আমার এক ক্লায়েন্ট কুমুদিনীকে কিছু টাকা ধার দিয়েছিল। সে জানতে চায় টাকাটা কুমুদিনী অব্দি পৌঁছেছিল নাকি যার হাত দিয়ে টাকাটা পাঠানো হয়েছিল সে-ই মেরে দিয়েছে। টাকাটা অবশ্য, আমার ধারণা, খানিকটা কালো।’

‘এটা তো একমাত্র বটুক সামন্তই বলতে পারে। আমি যতদূর জানি, গতকাল বিকেলে বটুক সামন্ত বেল-এ ছাড়া পেয়েছে। খবরটা এখনও মিডিয়ার কাছে পৌঁছয়নি। বটুক সামন্তই পুলিশ এবং কোর্টকে অনুরোধ করেছিল তার জামিনে মুক্তি পাওয়ার খবরটা যেন এখনই প্রেসকে জানানো না হয়। খবরটা জানতে পারলে সাংবাদিকরা তাকে ছিঁড়ে খাবে। কোর্ট ঠিক করে দিয়েছে বটুক এখন তার ভবানীপুরের বাড়িতে থাকবে। ভবানীপুর থানায় নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে তাকে। তুই আগামীকাল একবার ভবানীপুর থানায় খোঁজ কর। আমি ওখানকার বড়বাবুকে বলে রাখব। উনি হয়ত বটুকবাবুর সঙ্গে তোর দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আর কিছু জানতে চাস?’

‘মিডিয়া রিপোর্ট থেকে কেসটা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করতে পেরেছি। কিন্তু ডিটেলটা আর একটু জানতে পারলে ভাল হত। বিশেষ করে একটা প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি না। এতদিন ধরে বটুক সামন্ত তো নির্বিঘ্নে ব্যবসা করছিল। হঠাৎ এখন পুলিশ তাকে ধরল কেন?’

‘আমি কেসটার মধ্যে খুব বেশি ঢুকিনি। তুই যদি ঢুকতে চাস তাহলে সুদর্শন শিকদার বলে যে ছেলেটি কেসটা ইনভেস্টিগেট করছে তার সঙ্গে তোকে যোগাযোগ করিয়ে দেব। আর তুই যে প্রশ্নটা করলি তার একটা মোটামুটি উত্তর আমি দিতে পারি। দিল্লী থেকে একটা ইন্সট্রাকশান এসেছে ভুয়ো এবং বেআইনি ফিনান্স কম্পানিগুলোর ওপর ক্র্যাক-ডাউন করতে হবে। কুমুদিনী ছাড়াও আরও কয়েকটা কম্পানিকে সিল করে দেওয়া হয়েছে। ডিটেলটা তোকে শিকদার বলতে পারবে। আমার কাছে শিকদারের নম্বরটা নেই। কাল অফিস গিয়ে আমি ওটা তোকে জানিয়ে দেব। আর কিছু?’

‘আপাতত এইটুকুই থাকুক। সন্ধেবেলা দেখা হচ্ছে।’ আদিত্য গৌতমের কানেকশানটা কেটে দিয়ে, অমিতাভর নম্বরটা লাগাল।

আদিত্যদের মেসে দোলের দিন দুপুরবেলায় নিরামিষ খিচুড়ি রান্না হয়। এটা ওখানকার পুরোনো প্রথা। বহুদিন আগে এই মেস ও হোটেলের মালিক ছিলেন গিরিধারী দাস। তিনি ছিলেন ঘোর বৈষ্ণব। তাঁর আমলে দোল-পূর্ণিমার রাত্তিরে হোটেলের দোতলায় ঘটা করে রাধা-গোবিন্দকে ভোগ দেওয়া হতো। সেই থেকে দুপুরবেলায় খিচুড়ি রান্নার প্রথা চলে আসছে। গিরিধারী দাস অনেক দিন নেই, মেসও হাতবদল হয়ে গেছে। কিন্তু খিচুড়ি রান্নার প্রথাটা রয়ে গেছে। দু-একজন একালের বোর্ডার দাবি তুলেছিল, দোলের দিন দুপুরে মাংস-ভাত চাই। কিন্তু মেসের পাচক ভানু ঠাকুর, যে গিরিধারী দাসের আমল থেকে এখানে রয়েছে, সেই দাবি খারিজ করে দিয়েছে। আসলে ভানু ঠাকুর নিজেও বৈষ্ণব। সে আদিত্যকে বলেছে, দোলের দিন খিচুড়ি রান্নার পর মনে মনে গোবিন্দকে ‘উৎছুগগু’ করে নিয়ে তারপর সে সবাইকে খেতে ডাকে। তাই দোলের দিন মাংস রান্নার প্রশ্নই ওঠে না। এই মেসে ভানু ঠাকুরের কথার ওপর কথা বলবে এমন লোক নেই। মেসের বর্তমান ম্যানেজার লোকটা কর্কশ মেজাজের, কিন্তু সে-ও ভানু ঠাকুরকে সমীহ করে চলে। কারণ সে জানে ভানু ঠাকুরের হাতের রান্নার কারণেই মেস ও হোটেলের এত চাহিদা। ভানু ঠাকুর না থাকলে দুদিনে সব উঠে যেত।

দোলের দুপুরে খিচুড়ি-বেগুনি খেতে আদিত্যর ভালই লাগে। সে ভাবছিল এবার চান করে খেতে যাবে, বলরাম এসে দরজায় উঁকি মারল।

‘একবার বাইরে এস তো।’ বলরাম গলা বাড়িয়ে বলল।

‘কী ব্যাপার রে?’

‘এস না একবার বাইরে।’ বলরাম আবার বলল।

আদিত্য ব্যাপারটা বুঝেছে। বলরাম তাকে আবীর দেবে বলে বাইরে বারান্দায় ডাকছে। সে বাইরে আসতে বলরাম তার পায়ে একটু আবীর দিয়ে প্রণাম করল। গোলাপি আবীর খানিকটা মেঝেতে পড়েছে, খানিকটা আদিত্যর পায়ে। বলরাম বলল, ‘মেঝেটা পরিষ্কার করে দিতে হবে। ম্যানেজার বলেছে তিনতলায় রঙ খেলা একদম চলবেনি। এখানে আবীর পড়ে আছে দেখলে খুব রাগ করবে। তুমি তো আর নিচে নামবেনি।’

বলরাম ঝ্যাঁটা আনতে গেল। আদিত্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছিল। খুব বেশি লোক রাস্তায় নেই। শুধু মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি হুস হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা বেহারিদের দল রঙ মেখে ঢোল বাজাতে বাজাতে চলেছে। একটা গানও গাইছে। দেহাতি হোলির গান। বলরাম ঝ্যাঁটা নিয়ে ফিরে এল। আদিত্য পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বার করে বলরামের হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখ। বাচ্চাদের মিষ্টি কিনে দিস।’

‘এটা আবার কেন?’ বলরাম টাকাটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলতে হয় বলে বলল।

আদিত্য তার কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর বাড়ির খবর কী? সব ঠিকঠাক চলছে তো?’

‘এমনিতে তো ভালই চলছিল, কিছুদিন আগে এক ঝামেলা হয়েছে। আমাদের ওদিকে নবোদয় বলে একটা কম্পানি ছিল। তারা টাকা ধার দিত, আবার আমার মতো লোকেদের টাকা জমা নিয়ে ভাল সুদও দিত। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক যা করে এরাও তাই করত। শুধু ধারের ওপর সুদটা নিত বেশি। আবার টাকা জমা রাখলে ব্যাঙ্ক যা সুদ দেয় তার থেকে ঢের বেশি সুদও দিত।’

বলরাম একটু থামল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘ওই নবোদয় কম্পানির কর্তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।’

‘কেন? পুলিশ ধরে নিয়ে গেল কেন?’ আদিত্য ভুরু কোঁচকাল।

‘বলছে, এসব নাকি বেআইনি ব্যবসা। এসব ব্যবসা করতে গেলে নাকি গরমেন্টের অনুমতি লাগে। সেসব নাকি এদের নেই। যত্ত বাজে কথা। পুলিশের টাকা খাওয়ার মতলব। এত বছর ধরে ব্যবসা চালাচ্ছে আগে তো কেউ এসব কথা বলেনি।’

‘তা, তোর তাতে কী অসুবিধে হচ্ছে?’

‘আমার অসুবিধে হবেনি? আমি আর আমার গিন্নি মিলে গতরে খেটে কিছু টাকা জমিয়েছিলুম। তার মধ্যে হাজার কুড়ি টাকা ওই নবোদয় কম্পানিতে রাখা ছিল। এখন শুনছি সেসব টাকা নাকি আর ফেরত পাওয়া যাবেনি।’ বলরামের গলাটা ধরে এল। ‘কুড়ি হাজার টাকা আমাদের কাছে অনেক টাকা গো!’

‘আর যারা টাকা ধার নিয়েছিল? তাদের কী হবে?’

‘তাদের তো ভারি মজা। সবাই বলছে, তাদের নাকি আর টাকা শোধ দিতে হবেনি। আমার বাবা তো ছোট থেকে আমাদের শেখাল যেটুকু পারো টাকা জমাও। কখনও কারো কাছে ধার কোরোনি। এখন তো দেখছি ধার করলেই ভাল ছিল।’

‘কিন্তু বিপদে-আপদে ধারও তো আর পাওয়া যাবে না। তোদের গ্রামে ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক কিছু নেই?’

‘আমাদের গ্রামে নেই। একটু দূরে আছে। কিন্তু থাকলে কী হবে, ব্যাঙ্ক তো আর আমাদের টাকা ধার দেবেনি। আমাদের মানে আমার মতো যাদের জমি-জমা নেই, বন্ধক রাখার কিছু নেই, ব্যাঙ্ক তাদের টাকা ধার দেবে কেন? ধার দিলে ওই নবোদয় কম্পানিই দিত। তারা তো অনেক দিন ওই অঞ্চলে ব্যবসা করছে। তাদের লোক আমাদের সকলকে চেনে।’

‘তা তোরা পুলিশকে গিয়ে বলিসনি যে ওই কম্পানিতে তোদের টাকা জমা আছে?’

‘পুলিশ নয়, পঞ্চায়েতকে বলেছি। পঞ্চায়েত থেকে নাকি সরকারের কাছে লিস্টি জমা দিয়েছে। নবোদয় কম্পানিতে কার কত টাকা জমা ছিল সেসব লেখা আছে ওই লিস্টিতে। সঙ্গে কম্পানি যে কাগজ দিয়েছিল তার ছবি জমা দিয়েছি। তবে পঞ্চায়েত কতটা কী করতে পারবে জানি না। তোমার তো পুলিশের উঁচু মহলে খুব চেনাশোনা আছে। একটু দ্যাখো না টাকাটা উদ্ধার করে দিতে পারো কি না।’

আদিত্যর খিদে পাচ্ছিল, সে বলল, ‘পরে তোর সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলব। এখন খেয়ে আসি। দেরি করলে খিচুড়ি ফুরিয়ে যাবে।’

খাবার ঘরে ঢোকার আগে আদিত্য পিছন ফিরে দেখল বলরাম তখনও ঝ্যাঁটা হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

খাবার পর ঘরে ফিরে এসে আদিত্য একটা সিগারেট ধরানোর মতলব করছিল, মোবাইলে পিঁক করে শব্দ হতে বুঝল হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের বেশিরভাগ, বিশেষ করে ভিডিও-টিডিওগুলো, আদিত্য খোলে না। না খুলেই ডিলিট করে দেয়। অধিকাংশই অবশ্য খোলার যোগ্য নয়। কারো অভ্যাস রোজ সকালে গোলাপ ফুলের ছবি সমেত গুড মর্নিং পাঠানো। কারও নিরলস বদ-রসিকতা পাঠিয়ে যাওয়ার অভ্যাস। কেউ নিয়ম করে সম্পূর্ণ ভুল খবর পাঠানোর দায়িত্ব নিয়েছে। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক নেতাদের ছবি সহ বার্তা পাঠায়। এসবের কোনওটাই আদিত্যর কাজে লাগে না। তবে দু-চারজন বন্ধু আছে যাদের মেল না খুললেই নয়।

সম্প্রতি এই তালিকায় কেয়া বাগচির নামটা যুক্ত হয়েছে। কেয়ার সঙ্গে চন্দ্রলেখা অন্তর্ধানের সময় আলাপ, একটা বন্ধুতাও তখন তৈরি হয়েছিল, সেটা টিকে আছে এখনও। শুধু টিকে আছে বললে ভুল হবে, আদিত্যর অস্বস্তি সত্ত্বেও সম্পর্কটা ক্রমে আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

হোয়াটসঅ্যাপ খুলে আদিত্য দেখল, কেয়া মেসেজ করেছে, ‘কেমন আছ? দোল খেলেছ?’ সঙ্গে তার নিজের কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে। হস্টেলের ছাদে কেয়া এবং অন্যান্য হস্টেলবাসিনীরা রঙ মেখে ভূত হয়ে দোল খেলছে। অন্যদের থেকে বেশ খানিকটা লম্বা বলে ছবিতে কেয়াকে আদিত্য আলাদা করতে চিনতে পারল।

‘ভাল আছি। দোল খেলিনি।’ আদিত্য এই সংক্ষিপ্ত উত্তর পাঠানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে ‘টাইপিং’ কথাটা ফুটে উঠল। অর্থাৎ কেয়া গল্প করার মুডে আছে। আদিত্য মোবাইল রেখে ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল। তারপর কেয়ার পাঠানো লম্বা মেসেজটা না পড়েই মোবাইলে কেয়ার নম্বরটা লাগাল। হোয়াটসঅ্যাপে লিখে লিখে গল্প করার অভ্যাসটা আদিত্য এখনও রপ্ত করতে পারেনি। তার থেকে সরাসরি কথা বলা ভাল।

‘কী? উত্তর দিলে না যা জিজ্ঞেস করলাম?’ ফোন ধরেই কেয়া বুলেটের মতো প্রশ্ন করল।

‘কী জিজ্ঞেস করলে?’ আদিত্য মৃদুস্বরে বলল।

‘হায় কপাল! অত বড় একটা মেসেজ করলাম পড়েও দেখলে না?’

‘পরে পড়ে নেব। এখন কী জিজ্ঞেস করছ, বল।’

‘কিছু না। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করিনি। ছাড়।’

আদিত্যর মনে হল কেয়া একটু চটেছে। সে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কথাটা অন্য দিকে নিয়ে গিয়ে নরমভাবে বলল, ‘দুপুরের খাওয়া হয়েছে?’

কেয়ার একটা গুণ আছে, বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারে না। সে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘একটু আগে খেয়ে ওপরে উঠেছি।’ তারপর আর একটু থেমে বলল, ‘তোমার খাওয়া হয়েছে?’

‘আমিও একটু আগে খেয়ে ঘরে এসেছি।’

‘তার মানে নিশ্চয় এখন সিগারেট ধরিয়েছ। ঠিক বলছি কি না? কবে যে ওটা ছাড়বে জানি না।’

আদিত্য চুপ করে রইল। কোনও উত্তর তো তার কাছে নেই। সে নিজেও আজকাল বোঝে সিগারেটটা ছাড়া দরকার। কিন্তু কী করবে? কিছুক্ষণ সিগারেট না খেলেই অস্থির অস্থির লাগে! আর খাবার পরে একটা সিগারেট তো না খেলেই নয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘তোমাদের হস্টেলে আজ কী খাওয়াল?’

‘দোলের দিন মাংস-ভাত ছাড়া আবার কী খাওয়াবে?’

‘আমাদের তো নিরামিষ। খিচুড়ি-বেগুনি।’

‘দোলের দিন নিরামিষ! কেন? কোন দুঃখে?’

‘আমাদের আগের মালিক বোষ্টম ছিল। দোলের দিন রাধা-গোবিন্দের পুজো করত। খিচুড়ি ভোগ দিত। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।’

‘আর রাত্তিরে কী ব্যবস্থা? বৈষ্ণব মালপোয়া? লুচি মোহনভোগ?’

‘আরে না, না। লুচি কে খাওয়াবে? স্রেফ রুটি-তরকারি। নিরামিষ। তবে আজ রাত্তিরে আমি এখানে খাচ্ছি না। অমিতাভদের বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে।’

‘বাঃ। তাহলে তো তুমি সন্ধেবেলা বালিগঞ্জের দিকে যাচ্ছ। স্ট্রেঞ্জ কোয়েনসিডেন্স, আমারও আজ রাত্তিরে গোলপার্কের কাছে এক কলিগের বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন। আমি সাতটা নাগাদ ওখানে পৌঁছব ভাবছি। একটা গাড়ি ভাড়া করেছি। রাত্তিরে ফিরতে হবে তো। যাওয়ার সময় তোমাকে কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে তুলে নিয়ে বালিগঞ্জে নামিয়ে দিতে পারি। ফেরার সময়ও আমার সঙ্গে ফিরতে পার। আজ ছুটির দিনে মেট্রো তো বেশিক্ষণ চলবে না। আর তুমি যা কিপটে, ট্যাক্সি করবে বলে মনে হয় না। সেই বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে।’

‘তুমি তুলে নিলে তো খুবই ভাল হয়। একটু আগে আগে এস। কিছুক্ষণ একসঙ্গে বসে কোথাও কফি খাওয়া যাবে।’ একসঙ্গে বসে কফি খাওয়ার প্রস্তাবটা অজান্তেই আদিত্যর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।

‘আদিত্য মজুমদার আমার সঙ্গে বসে কফি খেতে চাইছে! তাও নিজের থেকে! আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম!’ আদিত্যর মনে হল, কেয়ার গলায় ওপর ওপর যতই ঠাট্টা থাকুক, ভেতরে ভেতরে সে বেশ খুশি হয়েছে।

আদিত্য বহুদিন ধরে লক্ষ করছে দোলের সন্ধেবেলা বাঙালি মেয়েদের আশ্চর্য সুন্দর দেখায়। যেন আকাশ থেকে নিয়ম জারি হয়েছে এক রহস্যময় অলৌকিক আভা ওই বিশেষ সন্ধেবেলা প্রত্যেকটি বাঙালি মেয়ের মুখের ওপর এসে পড়বে। আসল ব্যাপারটা বোধহয় নেহাতই জাগতিক। সারা সকাল দোল খেলার পর মেয়েরা নিশ্চয় শ্যাম্পু করে, ফলে তাদের চেহারায় একটা শুষ্ক, তাপসী ভাব ফুটে ওঠে। আদিত্যর ধারণা, সেই তাপসী শুষ্কতার সঙ্গে মুখমণ্ডলে রয়ে যাওয়া রঙের আভাকে মেশালেই এই অলৌকিক আভার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

তার পাশে বসে থাকা কেয়া বাগচির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আদিত্য এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিল। কেয়ার বয়েস তার মতই হবে। অর্থাৎ বছর চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। এই বয়েসে অবিবাহিত মেয়েদের শরীর খানিকটা শুকিয়ে যায়। কেয়ারও গেছে। বিবাহিত মেয়েদের বেলায় ঠিক এর উল্টো। স্বাভাবিক দাম্পত্য এবং তার সঙ্গে দু-একটা সন্তান হওয়ার পর সাধারণত দেখা যায় বিবাহিত বাঙালি মেয়েরা একটু মুটিয়ে যাচ্ছে। হয়ত সবাই নয়, তবে অনেকেই।

তাদের গাড়িটা এখন এসপ্লানেড পেরোচ্ছে। দোলের সন্ধেবেলা সাহেব পাড়া ফাঁকা, শুধু লিন্ডসে স্ট্রিটে কিছু ভিড়। কেউ কেউ দোলের ছুটির সুযোগ নিয়ে নিউ মার্কেটে বাজার করতে এসেছে। কেয়াও আজ শ্যাম্পু করেছে। হাওয়ায় চুল উড়ছে। সামলাতে পারছে না। জানালার কাচটা তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে এসি চালাতে বলল। বদ্ধ গাড়ির মধ্যে কেয়ার চুলের গন্ধ আর তার মেয়েলি পারফিউমের সুবাস এই দুই মিলিয়ে আদিত্যকে খুব টানছে। আদিত্যর মনে হচ্ছিল, সারাদিন রোদ্দুরে শুকোনোর পর কাচা জামাকাপড় থেকে যেমন একটা টাটকা গন্ধ মেশানো চাপা উত্তাপ আসে, কেয়ার ঈষৎ শুকিয়ে আসা শরীর থেকে তেমন একটা উত্তাপ আসছে।

‘পার্ক স্ট্রিট ধরে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি হয়ে যাব? নাকি একেবারে সোজা গিয়ে সাদার্ন এভিনিউ ধরব? গোলপার্ক যাবেন তো?’ ড্রাইভার পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছনোর আগেই জিজ্ঞেস করল।

‘তুমি এখন সোজা চল। রাসবিহারীর মোড়ে পৌঁছে বাঁয়ে যাবে। তারপর আমি বলে দেব কোথায় যেতে হবে।’

কেয়া ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজকাল পূর্ণ দাস রোডে অনেকগুলো ক্যাফে হয়েছে। আমাদের নর্থ ক্যালকাটায় ওরকম নেই। সেদিন স্টারি নাইটস বলে একটাতে এসেছিলাম। বেশ ভাল কফি করে। ওখানেই যাই।’

‘স্টারি নাইটস? জব্বর নাম দিয়েছে তো।’

‘যতদূর মনে পড়ছে নামটা স্টারি নাইটস-ই ছিল। অন্য কিছুও হতে পারে। তবে নামটা ভুল করলেও জায়গাটা মনে আছে। উল্টো দিকে একটা ধাবা কাম রোলের দোকান। চিনে ঠিক চলে যেতে পারব।’ কেয়া স্টারি নাইটস-এর অনুষঙ্গটা ধরতে পারেনি।

‘তুমি যেখানে নিয়ে যাবে। আমি এসব ক্যাফে-ট্যাফের খবর একেবারেই রাখি না।’ আদিত্য আত্মসমর্পনের ভঙ্গীতে বলল।

‘তোমাকে বলেছি? কাল আমরা এক সপ্তাহের জন্য ডুয়ার্সে বেড়াতে যাচ্ছি?’ কেয়া হঠাৎ মনে পড়ে যাবার মতো করে বলল।

‘বলেছিলে। কিন্তু কালকেই যাচ্ছ সেটা খেয়াল ছিল না। কে কে যাচ্ছ?’

‘হস্টেল থেকে আমরা চারজন যাচ্ছি। তিনটে ফরেস্ট রিসর্ট বুক করেছি, প্রত্যেকটাতে দু-দিন করে থাকব। এখান থেকে বাগডোগরা প্লেনে। বাগডোগরা থেকে একটা ড্রাইভারসুদ্ধু ইনোভা ভাড়া করা হয়েছে। সে-ই আমাদের পুরোটা ঘোরাবে। তারপর ফেরার সময় এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেবে।’

‘চমৎকার ব্যবস্থা। ভাল করে ঘুরে এস। শুনেছি ডুয়ার্স ভীষণ সুন্দর।’

‘তুমি আমাকে ফোন করবে কিন্তু।’ কেয়া আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল।

আদিত্য খানিকটা অসহায়ভাবে খেয়াল করল কেয়া এক সপ্তাহ থাকবে না শুনে তার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

স্টারি নাইটস-এর বাইরে ফুটপাথের ওপর ছাতার তলায় চেয়ার-টেবিল পাতা। ভেতরেও বসার ব্যবস্থা আছে। দেয়ালে ভ্যান গগের স্টারি নাইটস। নকলটা মন্দ হয়নি। তবে আদিত্য কোথাও একটা পড়েছিল আসল ছবিটা খুব বড় নয়। নকল ছবিটা কিন্তু একটা দেয়াল জুড়ে ফ্রেসকোর মতো করে এঁকেছে। অন্য দেয়ালগুলোতে আরও কিছু বিখ্যাত ভ্যান গগ–স্টিল লাইফ, বাতাসকল, কৃষক দম্পতি হলুদ খড়ের পাশে শুয়ে বিশ্রাম করছে। ক্যাফের মালিক, নাকি যে ইন্টিরিয়ার ডেকরেটার ক্যাফেটা সাজিয়েছে সে, কে ভ্যান গগের ভক্ত? আদিত্যর ভ্যান গগ দেখলে জীবনানন্দের কবিতা খুব মনে পড়ে। যেমন স্টারি নাইটস দেখলে তার মনে পড়ে যায় সেই আশ্চর্য লাইন ‘হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে’।

ক্যাফেতে বেশ ভিড়। ভেতরে, বাইরে কোথাও বসার জায়গা নেই। আদিত্যদের ভাগ্য ভাল, মিনিট দুয়েক রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর বাইরে একটা টেবিল খালি হল। এঁটো বাসনগুলো সরিয়ে নিয়ে যাবার আগেই কেয়া সেখানে একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়ল। অগত্যা আদিত্যও গিয়ে বসল তার উল্টো দিকে।

‘তোমাকে দুপুরে যেটা জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিলে না তো?’ কেয়া বলল।

ভাগ্যক্রমে কেয়ার শেষ হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটা আদিত্য পড়ে এসেছে। সে বলল, ‘তুমি জিজ্ঞেস করেছ, দোল খেলি না কেন? দোলের দিন সকালে কীভাবে সময় কাটালাম? দোল খেলতে ভাল লাগে না, তাই খেলি না। খুব ছোটবেলায় মামারবাড়িতে গিয়ে দোল খেলতাম। তারপর মামাতো দিদিদের বিয়ে হয়ে গেল, মামাও মারা গেল, আর কার সঙ্গে দোল খেলব? মামা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে আমার মাও চলে গেল। মামারবাড়িতে আর যাওয়াই হতো না। দোলের দিনটা বাবার সঙ্গে কাটাতাম। বাবা আর আমি একসঙ্গে বসে সারাদিন গান শুনতাম। ঠুংরি, হোরি, চৈতি, কাজরি। দোলের দিন শুনব বলে বাবা পুরোনো স্পুল থেকে গান বাছাই করে রাখত। সেই পুরোনো স্পুলগুলো সব হারিয়ে গেছে।’ আদিত্যর গলাটা হঠাৎ খুব বিষণ্ণ শোনাল।

‘বাব্বা, কী আঁতেল। আজ সকালে কী করলে?’ কেয়া হালকা গলায় বলল।

‘কিছুক্ষণ গান শুনলাম। তারপর একটা সিনেমা দেখার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ দেখে আর ভাল লাগল না।’

‘কী সিনেমা?’

‘একটা পুরোনো হলিউড। ক্যাথারিন ড্যানিউব, মার্সেলো মাস্ত্রাওনির ছবি। ইউটিউবে আছে। সিনেমার কথায় মনে পড়ল, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করার ছিল।’

‘সিনেমার ব্যাপারে?’

‘হ্যাঁ। সিনেমার ব্যাপারে। বাংলা সিনেমার অনেক খবর তো তুমি রাখ। সুমনা ঘোষাল বলে কারও কথা জান? বাংলা সিনেমায় মেনলি সাইড রোলে করত, এক সময় দু-একটা বি-গ্রেড ছবিতে নায়িকাও হয়েছিল। হিন্দি সিরিয়ালেও করেছে।’

‘একটু একটু জানি, খুব বেশি জানি না।’ কেয়া ভুরু কোঁচকাল।

‘খুব বেশি জানার কথা নয়। যেটুকু জান একটু বলবে? এটা একটা ইনভেস্টিগেশনের জন্য আমার খুব দরকার।’

‘সুমনা ঘোষাল, আমার যতদূর মনে পড়ছে, আশির দশকের গোড়ার দিকে প্রথম সিনেমায় এসেছিল। প্রথম ছবি ‘দামাল মেয়ে’, নায়িকার ছোট বয়েসের ভূমিকায়, তখন সিনেমায় তার নাম ছিল মীনা। ছোটদের ছবি। আমি তখন বহরমপুরে থাকি। বাবা-মার সঙ্গে দেখেছিলাম। তারপর বোধহয় দশ-বারো বছর তাকে সিনেমায় দেখিনি। সুমনা ঘোষাল হিসেবে নায়িকার ভূমিকায় বোধহয় প্রথম ছবি ‘রঙিন স্বপ্ন’। এই সিনেমাটা আমি কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে দেখেছিলাম। তার মানে সেটা মিড নাইন্টিস বা তার আর একটু পরে হবে। একেবারে বাজে ছবি। ওর সঙ্গে যে ছেলেটা হিরোর পার্ট করেছিল সেও বেশ রদ্দি। সুমনা তবু পরে আরও চান্স পেয়েছে, ওই ছেলেটা কিন্তু একেবারে হারিয়ে গেছে। তার নামটাও আমার মনে নেই। ‘রঙিন স্বপ্ন’ নামটা মনে আছে কারণ ওটার কিছু সিন আমাদের কলেজে শুটিং হয়েছিল। ইন ফ্যাক্ট ওই কারণেই আমরা দল বেঁধে সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম। ‘রঙিন স্বপ্ন’-র আগে হয়ত সুমনা ঘোষাল ছোট-খাট কিছু রোল করেছিল, আমি ঠিক বলতে পারব না। তুমি সুমনা ঘোষালের কোনও ছবি দেখনি?’

কথাটা বলেই কেয়া নিজেকে শুধরে নেওয়ার মতো করে বলল, ‘না, না। তুমি কেমন করে দেখবে? তুমি তো আবার সাহেব, বাংলা সিনেমা দেখই না।’ তার শেষের কথাগুলোতে কিছু ঠাট্টা ছিল।

‘তুমি যা ভাবছ তা কিন্তু মোটেই নয়। আমি কলেজে পড়ার সময় প্রচুর বাংলা সিনেমা দেখেছি। সুমনা ঘোষালের সিনেমাও দেখেছি। তবে সেটা সেই কলেজে পড়ার সময়। তারপর আর খুব একটা বাংলা কমার্শিয়াল ছবি দেখা হয়নি। আমার মনে হল তুমি সুমনা ঘোষালের সম্বন্ধে আমার থেকে বেশি জানবে।’

‘যেটুকু মনে পড়ল বললাম তো।’

‘আর কিছু মনে পড়ছে?’

বেয়ারা এতক্ষণে এঁটো কাপ-প্লেটগুলো নিয়ে যেতে এসেছে। দুটো কফি দেওয়ার কথা বলতে সে না শুনে চলে গেল। বোধহয় অর্ডার নেওয়ার লোক আলাদা।

‘সবাই বলে সুমনা ঘোষাল ডিরেক্টর অজয় ঘোষালের মেয়ে।’ কেয়া একটু ভেবে নিয়ে আবার শুরু করল। ‘এটা যারা সিনেমা পত্রিকা পড়ে সবাই জানে। সুমনার মাও অভিনেত্রী ছিলেন, তার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। তবে এটা মনে আছে যে একটা সময় সুমনা ঘোষাল প্রোডিউসার রোহিত ধামানির সঙ্গে থাকত। আরও কার কার সঙ্গে যেন থাকত। একেবারে গঙ্গাজলে ধোয়া চরিত্র। এইসব নিয়ে সিনেমা পত্রিকাগুলোতে প্রচুর কেচ্ছাও বেরোত। সুমনা ঘোষালের একটা ছেলে আছে। কেউ বলে সে রোহিত ধামানির ছেলে। আবার কেউ বলে অন্য কারও। ছেলেটার নামটা ভুলে যাচ্ছি। গসিপ ম্যাগাজিনগুলোতে ছেলেটার ছবি দেখেছি।’

‘রোহিত ধামানির দ্বারা সুমনা ঘোষালের ছেলে?’ এটা আদিত্যর কাছে নতুন খবর। ‘কী রকম বয়েস হবে তার?’

‘আমি কী করে বলব? মনে হয়, বছর চব্বিশ-পঁচিশ হবে। ঠিক বলতে পারব না। ‘ফেরারি’ বলে রোহিত ধামানি একটা নতুন ছবি প্রোডিউস করছে, তাতে নাকি সে প্রোডাকশানের চার্জে আছে। মানে প্রোডাকশান ম্যানেজার। কাগজে ছবি বেরিয়েছিল। ছেলেটার নামটা মনে পড়ছে না। কিছু একটা ঘোষাল। মায়ের পদবীটা নিয়েছে। কিন্তু কিছু গসিপ কলাম লিখছে সে নাকি আসলে রোহিত ধামানিরই ছেলে।’

‘আচ্ছা, সত্যজিৎ সামন্ত বলে কারও নাম জান? ডাকনাম বটুক সামন্ত।’

‘না তো।’

‘বটুক সামন্ত হল সেই ব্যক্তি যার সঙ্গে সুমনা ঘোষাল বর্তমানে থাকে। নাম শোনোনি?’

‘কোনও দিনও শুনিনি। আসলে সুমনা ঘোষাল নিয়ে গসিপ ম্যাগাজিনগুলোর আর কোনও ইন্টারেস্ট নেই। এই লোকটাও কি সিনেমার প্রোডিউসার?’

‘সরাসরি নয়। তবে পরোক্ষভাবে টাকা ঢালে।’

‘ঠিক বুঝলাম না।’

‘খুলে বললেই বুঝতে পারবে।’

‘তোমার ইনভলভমেন্টটা এখানে কোথায়?’

‘সেটা জানতে গেলে তোমাকে পুরো গল্পটা শুনতে হবে। শোনো, সংক্ষেপে গল্পটা বলছি।’

কেয়া বাগচি আদিত্যকে যখন অমিতাভ-রত্নাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল তখন সোয়া সাতটা বেজে গেছে।

‘চিনে খাবি? না মোগলাই?’ অমিতাভ জিজ্ঞেস করল। ‘খাবারের অর্ডারটা এখনই দিয়ে রাখি। ওরা দিতে খুব সময় নেয়।’

ঘরে আদিত্য ছাড়া আরও দুজন অতিথি। গৌতম দাশগুপ্ত আদিত্যর আগেই একটা শিভাস রিগালের বোতল নিয়ে পৌঁছে গেছে। অন্য অতিথির নাম সুপর্ণ রায়, আদিত্যদের কলেজের বন্ধু, আদিত্য আসার মিনিট পাঁচেক পরে এসেছে। সুপর্ণ পেশায় অর্থনীতিবিদ, আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়, সম্প্রতি কিছু দিনের জন্য একটা বিশ্ববিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি নিয়েছে। সেই কাজের সুবাদে আজকাল তাকে মাঝে মাঝে ভারতে আসতে হয়।

সুপর্ণ আসবে আদিত্য জানত না। তার আসাটা নেহাতই আকস্মিক। সে বিকেলে কলকাতা পৌঁছে অমিতাভকে ফোন করে বলেছিল সন্ধেটা ফ্রি আছে। অমিতাভ তাকে নেমন্তন্ন করে দিয়েছে। কলেজে আদিত্য আর সুপর্ণ খুব বন্ধু ছিল। এখন অবশ্য কালেভদ্রে দেখা হয়। বরং অমিতাভর সঙ্গে সুপর্ণর কিছু যোগাযোগ আছে।

‘আমি চিনের ফরে। আজকাল মোগলাই খেয়ে হজম করতে পারি না।’ গৌতম সবার আগে তার মত জানিয়ে দিল।

‘চিনেটা ডেফিনিটিলি সেফ। তবে আমার চিংড়িতে অ্যালার্জি আছে। আদিত্য?’ সুপর্ণ আদিত্যকে জিজ্ঞেস করল।

‘ঠিক আছে চিনেই হোক। তবে গৌতমের হুইস্কিটার সদ্ব্যবহার করতে গেলে কাবাব-টাবাব জাতীয় কিছু থাকলে ভাল হত।’ আদিত্যর গলাটা একটু অনিশ্চিত শোনাচ্ছে।

‘আমিও তো সেইজন্যেই মোগলাই-এর কথা ভাবছিলাম।’ অমিতাভ এতক্ষণে মত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছে।

‘তাহলে কি দুটোই খাওয়া হবে? প্রথমে কিছু কাবাব এবং পরে চিনে।’ গৌতমের গলায় দ্বিধা।

‘না, না। মোগলাই আর চিনে মেশালে আমার মনে হয় এসথেটিকসটা ঘেঁটে যাবে। মানে, কালিনারি এসথেটিকস। তার থেকে পুরো মোগলাই-ই ভাল। আদিত্য, কী বলিস?’ সুপর্ণ সমর্থনের আশায় আদিত্যর দিকে তাকাল।

‘আই অ্যাম অল ফর মোগলাই।’ আদিত্য তার পছন্দটা ঠিক করে ফেলেছে।

‘তাহলে মোগলাই বলে দিচ্ছি। গৌতম, ঠিক আছে তো?’ অমিতাভ গৌতমের সম্মতির আশায় তার দিকে তাকাল।

একঘরে হয়ে গিয়ে গৌতম দমে গেছে। ম্রিয়মাণ গলায় বলল, ‘ওক্কে।’

‘মাস কয়েক হল লেকের কাছে ‘লখনৌ নগরী’ বলে একটা রেস্টোরেন্ট হয়েছে। কয়েকটা রিভিউ পড়লাম, সব কটা রিভিউই বলছে এদের রান্না অসাধারণ। আমি ওখানেই অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। ওদের হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে।’ অমিতাভ ল্যাপটপে ‘লখনৌ নগরী’র ফোন নম্বরটা খুঁজতে খুঁজতে বলল।

একটু পরে সকলে যখন হুইস্কির গ্লাস হাতে থিতু হয়েছে, আদিত্য সুপর্ণকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই ভারতে কী কাজ নিয়ে এসেছিস?’

‘আমরা এখানে একটা বড় প্রজেক্ট করছি। শুধু ভারতে নয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কাতেও। প্রজেক্টটা ইনফরমাল ক্রেডিট মার্কেটের ওপর। বছর তিনেক আগে প্রজেক্টটা আরম্ভ হয়েছে। মনে হয় আরও দু-তিন বছর চলবে। আমরা ভারতীয় ইনফরমাল ক্রেডিট মার্কেট নিয়ে একটা সার্ভে কমপ্লিট করে ফেলেছি। তারপর ওই একই সেট অফ রিসার্চ কোয়েশ্চেনস মাথায় নিয়ে এখন বাংলাদেশ-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার ইনফরমাল ক্রেডিট মার্কেটগুলো খুঁটিয়ে দেখব।’

‘ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবি?’ অমিতাভ বেশ উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল। লেখাপড়ার ব্যাপারে অমিতাভর সর্বদাই একটা অকৃত্রিম উৎসাহ আদিত্য লক্ষ করেছে।

‘বলছি।’ সুপর্ণ একটু ভেবে নিয়ে আবার শুরু করল। ‘আমাদের দেশে অসংখ্য ছোট-ছোট ব্যবসায়ী আছে, কল-কারখানার মালিক আছে, চাষি আছে যারা নানা কারণে ব্যাঙ্ক থেকে ধার পায় না। লোকাল মহাজন বা লেন্ডিং এজেন্সিরা এদের ধার দেয়। এই লেন্ডিং এজেন্সিগুলো যে ধারটা দিচ্ছে তাকে ইনফরমাল ক্রেডিট বলা হচ্ছে। ইনফরমাল, কারণ এইসব এজেন্সিগুলো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে নয়। এরা এদের ইচ্ছে মতো সুদ নেয়, সাধারণত বেশ বেশি হারে সুদ নেয়, আবার সুদ আদায়ের জন্য নানারকম আনস্ক্রুপুলাস মিনস নিতেও এদের বাধে না। বাংলা গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় এইসব সুদখোর মহাজনদের ইনভেরিএবলি ভিলেন হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু উল্টোদিকে এটাও ঠিক যে, যতই কোয়ারসিভ হোক, এক্সপ্লয়টেটিভ হোক, যেহেতু বেসিক ব্যাঙ্কিং সার্ভিস এখনও আমাদের দেশের সব জায়গায়, বিশেষ করে রিমোট গ্রামগুলোতে, পৌঁছতে পারেনি, এই ইনফরমাল লেন্ডাররা সাধারণ মানুষদের লাইভলিহুড সাপোর্ট করার ব্যাপারে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা এদের নিয়েই কাজ করছি।’

‘তোরা কীভাবে রিসার্চ কোয়েশ্চেনগুলো ঠিক করিস? আগে থেকেই ভাবা থাকে?’ অমিতাভ জিজ্ঞেস করল।

‘কিছু প্রশ্ন ভাবা থাকে। কিছু কাজ করতে করতে মাথায় আসে। প্রথমে একটা পাইলট সার্ভে করা হয়। তার বেসিসে রিসার্চ কোয়েশ্চেনগুলো ফরমুলেট করে কোয়েশ্চেনেয়ার তৈরি করা হয়। তারপর মেন সার্ভে। এটাই সাধারণ প্রসিডিওর। তবে একটা প্রশ্ন প্রথম থেকেই মাথায় ছিল। বোঝার চেষ্টা করেছি, ভারতে বা অন্য দেশগুলোতে ইনফরমাল লেন্ডিং আর ফরমাল লেন্ডিং, মানে ব্যাঙ্ক ইত্যাদিরা যেসব ধারগুলো দিচ্ছে, এই দুই-এর প্রপোরশানটা রাফলি কত। এর থেকে ইনফরমাল লেন্ডিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা যায়।’

‘আচ্ছা, একটা জিনিস বল। এই ইনফরমাল লেন্ডাররা যে টাকাটা ধার দেয় সেটা কোথা থেকে আসে?’ এবার আদিত্যর প্রশ্ন।

‘নানা জায়গা থেকে আসতে পারে। পরিবারের টাকা পুরুষানুক্রমে খাটছে এরকম যেমন আছে, তেমনি ইনফরমাল লেন্ডার চড়া সুদে বাজার থেকে টাকা তুলে আরও চড়া সুদে ধার দিচ্ছে এরকম এক্সাম্পেলও আমি অনেক পেয়েছি। তবে বাজার থেকে টাকা তুলতে গেলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স লাগে, সেটা এদের কারোরই নেই।’

‘এইভাবে লাইসেন্স ছাড়া যারা বাজার থেকে টাকা তোলে তাদের ওপর কিছুদিন ধরে সারাদেশ জুড়ে পুলিশ ক্র্যাক-ডাউন করছে, এটা তুই জানিস তো?’ এবার গৌতমও সুপর্ণর গবেষণায় উৎসাহ পেয়েছে।

‘জানি তো। ইন্ডিয়াতে এরকম কিছু হতে পারে আগেই খানিকটা খবর পেয়েছিলাম। আর সেইজন্য ইন্ডিয়ার সার্ভেটা আগে আগে করে ফেললাম। এখনকার মতো অবস্থা হলে সার্ভেটাই বন্ধ হয়ে যেত। বেশিরভাগ কম্পানিই তো এখন তালা মারা। আসলে, ভারত সরকারের কোনও দোষ নেই। ইদানীং সারাদেশ ভুয়ো কম্পানিতে ছেয়ে গিয়েছিল, যারা অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষদের বুজরুকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা তুলছিল। টাকা ফেরত দেওয়ার ইচ্ছে তাদের ছিল না, কেবল কম্পানির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করার জন্যে প্রথম দিকে কিছু লোককে কিছু কিছু সুদ দেওয়া হয়েছে যেটা নতুন আসা ডিপোজিট থেকেই দেওয়া হয়েছে। শুধু অশিক্ষিত মানুষ কেন, বেশ কিছু শিক্ষিত মানুষও এদের ফাঁদে পা দিয়েছে।’ সুপর্ণ ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে বলল।

‘পনজি স্কিম।’ গৌতম বলল।

‘ঠিক বলেছিস। পনজি স্কিম।’ সুপর্ণকে উৎসাহিত শোনাল। ‘চার্লস পনজি, বস্টনের কুখ্যাত ফ্রডস্টার, গত শতাব্দীর বিশের দশকে এই কায়দায় বহু ডিপোজিটারের টাকা আত্মসাৎ করেছিল। কায়দাটা খুব সহজ। প্রথমে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে স্কিমের খবরটা ছড়িয়ে দেওয়া হতো। বলা হতো, এখানে টাকা রাখলে বাজারের তুলনায় অনেক বেশি সুদ পাওয়া যাবে। ক্রেডিবিলিটি তৈরি করার জন্য প্রথম প্রথম কিছু ডিপজিটারকে সেই চড়া সুদ দেওয়াও হতো। সুদ দেওয়া হতো টাকাটা কোথাও খাটিয়ে নয়, নতুন যে ডিপজিট আসছে তার থেকে। আর ডিপোজিটের বাকি অংশটা, বলা যায় বেশির-ভাগটা, চার্লস পনজির পকেটে চলে যেত। যতদিন নতুন নতুন ডিপজিট আসছে ততদিন চলত এই জোচ্চুরির ব্যবসা। তারপর নতুন ডিপজিট আসা বন্ধ হয়ে গেলে, বুদ্বুদ ফেটে যেত, স্কিম উঠে যেত।’

‘দুর্ভাগ্যবশত, প্রায় একশ বছর পরেও আমাদের দেশে এই কায়দায় লোক ঠকানো চলছে। সেন্ট্রাল গভরমেন্ট যে অ্যাডভাইসারিটা স্টেটগুলোকে পাঠিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ভুয়ো কম্পানিগুলো সারা দেশের পাবলিকের কাছ থেকে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা তুলেছে, এবং এর ফলে প্রতারিত হয়েছে প্রায় সাত কোটি মানুষ। তাই সেন্ট্রাল গভরমেন্ট নির্দেশ দিয়েছে, যেসব কম্পানি লাইসেন্স ছাড়া পাবলিকের কাছ থেকে টাকা তুলছে তাদের মালিকদের অ্যারেস্ট করতে হবে আর সেই কম্পানিগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে।’ গৌতম কথা বলতে বলতে একটু থামল। তারপর বলল, ‘যত বেশি দিন ধরে একটা পনজি স্কিম চলবে তত বেশি লোক এর আওতায় আসবে। ফলে বাবল্ বার্স্ট করলে তত বেশি ক্ষতি। তাই সরকার আর দেরি করতে চায়নি।’

‘তোর রিসার্চের মধ্যে কি পনজি কম্পানিগুলো আছে?’ অমিতাভ সুপর্ণকে জিজ্ঞেস করল।

‘না। আমাদের রিসার্চ, পনজি নয় এমন কম্পানি বা লেন্ডিং এজেন্সিগুলোকে নিয়ে। এটা ঠিক যে বাজার থেকে টাকা তোলার লাইসেন্স এদের নেই। কিন্তু এটাও ঠিক যে এরা লোক ঠকাবে বলে বাজারে আসেনি। এদের উদ্দেশ্য, ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া। এমন কম্পানি অনেক আছে যারা গত কুড়ি-তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে লাইসেন্স ছাড়াই টাকা তুলছে, সেই টাকা খাটাচ্ছে, ডিপজিটারদের নিয়মিত সুদ দিচ্ছে, টাকা ফেরত দিচ্ছে। এদের সুদের হার বেশি কারণ টাকা খাটানোর ব্যাপারে এরা বেশ ঝুঁকি নেয়। এরাই সেই ইনফরমাল লেন্ডার যাদের আমরা স্টাডি করছি। বললাম না, ইকনমিতে এদের একটা বড় ভূমিকা আছে। সমস্যা হল, সেন্ট্রাল গভরমেন্টের ডিরেক্টিভের ফলে এই কম্পানিগুলোকেও পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। ভাগ্যিস সার্ভেটা হয়ে গিয়েছিল। এতে কিন্তু সাধারণ মানুষেরই ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে সেই মানুষগুলোর ক্ষতি হচ্ছে যাদের কাছে আধুনিক ব্যাঙ্কিং এখনও পৌঁছতে পারেনি। এই ইনফরমাল, কোট-আনকোট অনেস্টলেন্ডারদের ব্যাপারে সরকারের কী পলিসি হওয়া উচিত সেটা হোপফুলি আমাদের রিসার্চ থেকে উঠে আসবে।’

‘তোরা এই সার্ভেগুলো কাদের দিয়ে করাস? কোনও এজেন্সিকে দিয়ে দিস নাকি নিজেরাই লোক দিয়ে করাস?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘দুরকমই হয়। তবে এক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের ফিল্ড ইনভেস্টিগেটাররাই সার্ভেটা করেছে। এরা গ্রাউন্ড লেভেল রিয়ালিটিটা খুব ভাল বোঝে। সেইভাবেই এদের সিলেক্ট করা হয়েছিল। ইন্ডিয়াকে চারটে জোনে ভাগ করে চারটে আলাদা টিম তৈরি হয়েছে। চারটে টিমের কাজ কোয়র্ডিনেট করার জন্য একজন আছে সে আমাকে রিপোর্ট করে। অবশ্য আমি নিজেও মাঝে মাঝে ফিল্ড-এ গেছি।’

‘আচ্ছা, এই পশ্চিমবঙ্গে যারা সার্ভেটা করেছে তাদের কারও সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে পারি?’ আদিত্য ব্যগ্রভাবে বলল।

‘নিশ্চয় পারিস। আমিই ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু এসব ব্যাপারে তোর হঠাৎ এত উৎসাহ হল কেন?’ সুপর্ণ রীতিমত অবাক হয়েছে।

‘অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্ট নয়, পেট চালানোর জন্য যে কাজটা আমাকে করতে হয় সেটার জন্য এই ব্যাপারটা আমার একটু জানা দরকার।’

‘কিচ্ছু বুঝলাম না।’ সুপর্ণর মুখটা হতভম্ভ দেখাল।

‘খুলে বললেই বুঝতে পারবি। খুলে বলছি। গৌতম খানিকটা জানে। আজ সকালেই ওর সঙ্গে এটা নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু তার আগে বল, কার সঙ্গে কথা বলব?’

‘তুই ঠিক কী জানতে চাস?’

‘আমি একটা বিশেষ কম্পানি সম্বন্ধে জানতে চাই। কম্পানিটার নাম কুমুদিনী বিত্ত নিগম। মালিকের নাম সত্যজিৎ সামন্ত। সম্প্রতি পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করেছে।’

‘আমি তোকে একজনের ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি। ছেলেটির নাম সোমনাথ, সোমনাথ গুঁই। ও আমাদের একজন সুপারভাইজার, মানে ওর কাজ ইনভেস্টিগেটারদের সুপারভাইজ করা। পশ্চিমবঙ্গের ইনফরমাল লেণ্ডারদের সম্বন্ধে ওর থেকে ভাল আর কেউ জানে না। একটা বিশেষ কম্পানির ব্যাপারে স্পেসিফিক ইনফরমেশন ওই দিতে পারবে। অবশ্য এই কম্পানিটা যদি আমাদের স্যাম্পেলে না উঠে থাকে তাহলে সোমনাথ কিছু বলতে পারবে না। এই কম্পানিটা কত বড়?’

‘পুলিশের প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী এদের একশো কোটি টাকার বেশি বাজারে খাটছে।’

‘ওরে ব্বাবা। তাহলে তো বেশ বড় কম্পানি। তার মানে আমাদের স্যাম্পেলে নিশ্চয় আছে। বড় কম্পানির সবকটাকে আমরা স্যাম্পেলে নিয়েছি।’ সোমনাথ গুঁই-এর নম্বরটা খোঁজার জন্য সুপর্ণ পকেট থেকে তার মোবাইলটা বার করল।

 দশটা নাগাদ খাওয়া শেষ করে আদিত্য বারান্দায় গিয়ে সবে সিগারেট ধরিয়েছে, এমন সময় তার মোবাইলটা বেজে উঠল। কেয়া ফোন করছে।

‘তুমি আমার সঙ্গে ফিরবে? তুমি যদি আমার সঙ্গে না ফেরো তাহলে আমি এখনই এখান থেকে উঠব ভাবছিলাম। তুমি যদি আমার সঙ্গে ফেরো তাহলে আরও কিছুক্ষণ বসতে পারি।’

‘ঠিক আছে। কটা নাগাদ ফিরতে চাও?’

‘এগারোটায় উঠছি? খুব রাত্তির হয়ে যাবে?’

‘আমার আবার কীসের রাত্তির? তবে তোমার পক্ষে একটু রাত্তির। বাগবাজারে তোমার হস্টেলে পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা পৌনে বারোটা বেজে যাবে। ঠিক আছে। আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

‘আমাকে হস্টেলে পৌঁছে দিয়ে তোমাকেও গাড়িটা বাড়ি পৌঁছে দেবে। মহাত্মা গান্ধী রোডে গাড়ির গ্যারেজ। তোমার মেসের খুব কাছে।’

‘ওক্কে। তুমি তাহলে বেরোনোর ঠিক আগে আমাকে একটা ফোন কোরো। আমি নিচে নেমে ওয়েট করব।’

আদিত্য টের পেল কেয়ার সঙ্গে আরও খানিকটা সময় কাটাতে পারবে ভেবে তার খুব ভাল লাগছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন