অভিরূপ সরকার
প্রথম পরিচ্ছেদ
দুটো লোক ঘরে ঢুকেছে। একটা লম্বা, একটা বেঁটে।
‘আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম,’ লম্বা লোকটা জানাল। তারপর এগিয়ে আদিত্যর টেবিলের সামনে এসে বলল, ‘বসতে পারি?’
‘বসুন, বসুন। অবশ্যই বসুন।’ আদিত্য লম্বাকে কথাটা বলে তার সঙ্গের বেঁটে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনিও বসুন।’
লম্বা লোকটা আদিত্যর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। হাতের বড় নীল রঙের ব্যাগটা নামিয়ে রাখল পায়ের নিচে। বেঁটে কিন্তু তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে আদিত্য আবার বলল, ‘আপনি বসুন।’
আদিত্য বলা সত্ত্বেও বেঁটে লোকটা ঠায় দাঁড়িয়েই রইল। আদিত্যর মনে হল, লম্বা-বেঁটের মধ্যে একটা শ্রেণিবিভাগ আছে। লম্বার পাশে বসার অধিকার বেঁটের নেই। ব্যাপারটা আদিত্যর আগেই বোঝা উচিত ছিল। লম্বা-বেঁটের হাবভাব, পোশাক-আশাক, চেহারা-বয়েস সব কিছুই আলাদা। লম্বার পরনে ধোপদুরস্ত ফুলহাতা সাদা শার্ট, গাঢ় রঙের ট্রাউজার। বুক-পকেটে পেন গোঁজা। বয়েস, মনে হয়, পঞ্চাশের এদিক-ওদিক। তার বেঁটে সঙ্গী প্যান্ট-টি-শার্ট পরেছে, দুটোই একটু বেশি চকচকে, সস্তার জিনিস যেমন হয়। আদিত্য লক্ষ করল, টি-শার্টটা বাঁ-দিকে বগলের নিচ থেকে সামান্য ফুলে আছে। চট করে চোখে পড়ে না, নজর করে দেখলে বোঝা যায়। বেঁটে লোকটার বয়েস তিরিশের বেশি হবে না।
একটু আগে শ্যামল চা আনতে গেছে। যাওয়ার সময় দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে যায়নি। সেই ভেজানো দরজা ঠেলে লম্বা-বেঁটে দুজনে আদিত্যর আপিসে ঢুকে পড়েছে। একবার নক করে ঢুকবে তো! বেঁটে না হয় লম্বার তল্পিবাহক হয়ে এসেছে, কিন্তু লম্বার তো এইটুকু সহবত জ্ঞান থাকা উচিত ছিল।
‘আমার নাম তারক দাস, আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।’ লম্বা লোকটা দ্বিতীয়বার মনে করিয়ে দিল। তার সঙ্গীর সঙ্গে আদিত্যর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আদৌ প্রয়োজন বোধ করল না সে। বেঁটে লোকটা যেন ঘরে থেকেও নেই।
আদিত্যর মনে পড়ে গেল গত পরশু এই তারক দাসই তাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, বিশেষ দরকার, আজ দেখা করতে আসবে। তারপর অবশ্য আর ফোন-টোন করেনি। কী দরকারে আদিত্যর সঙ্গে দেখা করতে চায় সেটাও ফোনে বলেনি।
শ্যামল চা নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। হাতে কেটলি আর ভাঁড়। আজকাল আদিত্য ঘরেই চা-কফি বানিয়ে নেয়, কিন্তু কদিন হল চা এবং কফি দুটোই ফুরিয়ে গেছে। তাই আজ শ্যামলকে পাঁচ-ছকাপ চা আনতে বলেছিল। ইচ্ছে ছিল, ফ্লাস্কে রেখে সারাদিন চালিয়ে নেবে। ভালই হল, অতিথিদের জন্য চা আনতে শ্যামলকে আর নীচে যেতে হবে না। এই পুরোনো বাড়ির সিঁড়িগুলো বেজায় উঁচু-উঁচু, সিঁড়ি ভাঙতে বেশ কষ্ট হয়। সে লম্বা লোকটাকে বলল, ‘আপনারা একটু চা খাবেন তো?’
লোকটা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাবার পর আদিত্য খেয়াল করল তার ঘরে মাত্র দুটো কাপই আছে। ভাগ্যিস শ্যামল একটা ভাঁড় সঙ্গে এনেছিল। দুটো কাপে চা ঢেলে শ্যামল আদিত্যর টেবিলে রাখল। একটা আদিত্যর জন্যে, আর-একটা তার উলটো দিকে উপবিষ্ট তারক দাসের জন্যে। তারপর ভাঁড়ে চা ঢেলে এগিয়ে দিল বেঁটের দিকে। মনে হয়, শ্যামলও লম্বা-বেঁটের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্যটা ধরতে পেরেছে। বেঁটে চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে তাতে সশব্দে চুমুক লাগাল। কেটলির উদ্বৃত্ত চা দেরাজের ওপরে রাখা ফ্লাস্কে ঢেলে দিয়ে শ্যামল চলে গেল। যাওয়ার সময় দরজাটাও বন্ধ করে দিয়ে গেল।
লম্বা লোকটা, অর্থাৎ তারক দাস, মনে হয় শ্যামল চলে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল। শ্যামল চলে যাওয়ার পর সে মুখ খুলল, ‘আমার আসার কারণটা এবার বলি।’
আদিত্য হাত তুলে বলল, ‘এক মিনিট।’ তারপর সে উঠে রাস্তার দিকের জানালাটা খুলে দিয়ে ফের চেয়ারে এসে বসল। ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে তারক দাসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘চলবে?’
খানিক ইতস্তত করে সিগারেট গ্রহণ করল তারক দাস। আদিত্য তার এবং নিজের সিগারেট ধরিয়ে পোড়া দেশলাই কাঠিটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘এবার বলুন।’
‘আমরা জগৎমাতা টোব্যাকো কম্পানি থেকে আসছি। আমি কম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। হালিশহরের কাছে আমাদের ফ্যাক্টরি। আমাদের কম্পানির নাম নিশ্চয় শুনেছেন।’
তারক দাসের বলার ভঙ্গীতে মনে হল, শিশু বয়েস থেকে প্রতিটি বাঙালির জগৎমাতা টোব্যাকো কম্পানির কথা জানা উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, ওরকম কোনও নাম আদিত্য কস্মিনকালেও শোনেনি। কিন্তু তারক দাসকে সেকথা জানালে সে যে শুধু মর্মাহত হবে তাই নয়, সম্ভবত আদিত্যর সাধারণ জ্ঞান নিয়েও সন্দিহান হয়ে উঠবে। তাই আদিত্য মুখ দিয়ে এমন একটা শব্দ করল যার মানে হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে।
তারক দাস অবশ্য আদিত্যর সম্মতির তোয়াক্কা না করেই বলতে লাগল, ‘আমাদের ফ্যাক্টরিটা গঙ্গার ধারেই। রামপ্রসাদের ভিটে থেকে পনেরো মিনিটের রাস্তা। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে থেকে সরাসরি এলে মিনিট পঁচিশ। কিছুদিন হল টাকা-পয়সা নিয়ে কম্পানিতে গণ্ডগোল লেগেছে। একটা বড় রকমের টাকা উধাও হয়ে গেছে। তার হদিশ করার জন্য আমাদের কম্পানির মালিক আপনাকে নিয়োগ করতে চান। আপনি রাজি হলে আপনাকে নিয়ে হালিশহর যাব। ওখানেই মালিক থাকেন।’
‘আপনাদের কম্পানি তো বিড়ি তৈরি করে।’ আদিত্য আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল। তবে আন্দাজটা ইংরেজিতে যাকে বলে এডুকেটেড গেস। দিশি টোব্যাকো কম্পানি বিড়ি ছাড়া আর কী তৈরি করতে পারে?
‘তৈরি করে মানে?’ আদিত্যর ন্যূনকথনে তারক দাস বিস্মিত। ‘শুধু উত্তর চব্বিশ পরগনা নয়, সমস্ত সাউথ বেঙ্গলে আমাদের মতো বড় বিড়ি ফ্যাক্টরি আর নেই। মনমোহন বিড়ি অবশ্য দাবি করে ওরা আমাদের থেকেও বড়। কিন্তু ওদের হিসেবে অনেক জল আছে। আমরা বছরে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট কোটি টাকার বিড়ি তৈরি করি।’
‘পঞ্চাশ-ষাট কোটি!’ আদিত্য এবারে সত্যি-সত্যি অপ্রস্তুত। তার কোনও ধারণাই ছিল না বিড়ির ব্যবসা এত বড় হতে পারে।
‘তার থেকে বেশি বই কম নয়। আমাদের ফ্যাক্টরিতে কতজন কাজ করে জানেন? সরাসরি কাজ করে পাঁচ হাজার, বাইরে বিড়ি বাঁধার কাজ করে আরও হাজার কুড়ি। এতগুলো মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে যে কম্পানি তার গুরুত্বটা বুঝতে পারছেন?’
আদিত্য বুঝতে পেরেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘তা আপনাদের কম্পানিতে গণ্ডগোলটা কোথায়, একটু খুলে বলবেন?’
‘খুলে আমি বলতে পারব না। ব্যাপারটা আমি ওপর ওপর জানি। এইটুকু জানি যে একটা মোটা টাকার গড়বড় হয়েছে। কীভাবে হল, কে টাকাটা নিতে পারে সেসব জানেন আমাদের মালিক। তিনিই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আপনি গেলে তিনি সব কথা খুলে বলবেন। অবশ্য আপনার যদি যেতে আপত্তি না থাকে।’
‘না, না। আপত্তি কীসের। কবে যেতে হবে বলুন।’
‘আমার ওপর হুকুম হয়েছে সম্ভব হলে আপনাকে আজই নিয়ে যেতে। এখন যেতে পারবেন? ঘন্টা দুয়েক-এ পৌঁছে যাব।’
আদিত্য দেখল ঘড়িতে এগারোটা দশ বেজেছে। এখন রওনা হলে সন্ধে ছ-টা-সাতটার মধ্যে ফিরে আসা যাবে। সে বলল, ‘ঠিক আছে। চলুন। আমার অসুবিধে নেই।’
‘রবিকে ফোন করে গাড়িটা এখানে নিয়ে আসতে বল। কোথায় পার্ক করেছে কে জানে?’ তারক দাস তার বেঁটে সঙ্গীকে নির্দেশ দিল। তারপর আদিত্যর দিকে ফিরে অভিযোগের স্বরে বলল, ‘আপনাদের এখানে গাড়ি রাখার খুব ঝামেলা, দাদা।’
বেঁটে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রাইভারকে ফোন করছে, তারক দাস একটু নীচু গলায় আদিত্যকে বলল, ‘আপনি আপনার ফিস-এর ব্যাপারটা নিয়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।’
‘সে ঠিক আছে। আপনি শুধু বলুন আপনার এই সঙ্গীটি কে? ও আপনার সঙ্গে এসেছে কেন?’
প্রশ্নটা শুনে তারক দাস একটু থমকে গেল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘ওর নাম সহদেব। ও মালিকের বডিগার্ড। মালিক ওকে আমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে। আসলে কলকাতায় কয়েকটা বড় পেমেন্ট নেওয়ার ছিল। সেসব নিয়ে আপনার কাছে আসছি। আমাদের ব্যবসায় এখনও ক্যাশটাই চলে বেশি। এই যে ব্যাগটা দেখছেন এতে কিছু টাকা আছে। তাই সহদেবকে কাছে কাছে রেখেছি।’ তারক দাস হাসল।
আদিত্যর আগেই সন্দেহ হচ্ছিল, এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে কেন সহদেবের জামার বাঁ-দিকটা ফোলা-ফোলা লাগছিল। লোকটার সঙ্গে অস্ত্র আছে। লোকটা কেন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সেটাও বোঝা যাচ্ছে। পাহারা দিতে গেলে বসা চলে না।
এয়ারপোর্ট পেরিয়ে যশোর রোডে পড়ে গাড়িটা জ্যামে আটকে গেল। কাল দোলযাত্রা। আদিত্য দেখল খাসির মাংসের দোকানের সামনে লম্বা লাইন পড়েছে। দোলের দিন মাংস খাবার উৎসাহ তাহলে এখনও মানুষের কমেনি। মাংসের দোকানের পাশে বিলিতি মদের দোকানেও ভিড়। আদিত্য খেয়াল করল, মদের লাইনে পেন্টুলুন পরা কয়েকটি যুবতীও দাঁড়িয়ে রয়েছে। বোধহয় কলেজ-টলেজে পড়ে। পথ চলতি মানুষ দাঁড়িয়ে গিয়ে তাদের হাঁ করে দেখছে। আদিত্য ভাবল, এতে দেখার কী আছে? পুরুষমানুষ লাইন দিয়ে মদ কিনতে পারলে মেয়েরা কিনবে না কেন?
গাড়িটা টয়োটা ইনোভা। সহদেব সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসেছে। পিছনের সিটে আদিত্যর পাশে তারক দাস। তার পায়ের কাছে টাকার ব্যাগ। একটু একটু করে জ্যামটা ছাড়ছে, গাড়িটা এগোচ্ছে শম্বুকগতিতে। আরও কয়েক মিনিট পরে রাস্তা ফাঁকা পেয়ে গাড়ি যখন খানিকটা স্পিড নিয়েছে তখন তারক দাস ড্রাইভারের উদ্দেশে বলে উঠল, ‘আর একটু গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে বিরাটির রাস্তাটা ধরে নাও। ওটা ধরে খানিকটা গেলেই কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে পেয়ে যাবে। একটু টেনে চালালে ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারব।’
‘বিরাটিতে জ্যাম না থাকলে পৌঁছে যাব দাদা। তবে বিরাটিতে কতটা জ্যাম থাকবে আগে থেকে কেউ বলতে পারে না।’ ড্রাইভার রবির গলা শোনা গেল।
রবির আশঙ্কা অমূলক নয়। বিরাটিতে ঢুকেই গাড়ির গতি আবার মন্থর হয়ে গেল। এখানেও হোলির বাজার। ফুটপাথে রঙ, আবীর, পিচকিরির অস্থায়ী বেসাতি। মাংসের দোকানে ভিড়, বিলিতি মদের জন্যে লম্বা লাইন। বিরাটি পেরোতে আধঘন্টা লেগে গেল।
আরও কিছু পরে গাড়ি ব্যারাকপুর পৌঁছে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরল। আদিত্য খানিকটা আলাপ করার ভঙ্গীতে তারক দাসকে বলল, ‘আপনার কি জগৎমাতা কম্পানিতে অনেকদিন হয়ে গেল?’
‘হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর থেকে এখানে কাজ করছি। আমার বাবা আর ছোটকাকা এখানে কাজ করত। তাদের সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে যেতাম। আমাদের বাড়ি হালিশহরেই। তা, ইস্কুল পাশ করার পর মালিক বাবাকে বলল তারকের আর পড়ে কী হবে, আমার কারখানায় ঢুকিয়ে দাও। বাবাও রাজি হয়ে গেল। সেই থেকে কারখানায় আছি। এখানে কাজ করতে করতে বি কম পাশ করলাম, কস্টিংটা করার ইচ্ছে ছিল, হল না। ফ্যাক্টরিতে প্রচুর কাজ। এত কাজ করে পড়ার সময় পাওয়া যায় না। মালিকও বলল ঢের পড়েছিস, আর পড়ে কী করবি?’
‘আপনার বাবা কারখানায় কী কাজ করতেন?’
‘বাবাও এখানে হিসেবপত্তর দেখত। মানে অ্যাকাউন্টস-এর কাজ। মালিকের বাবার আমলে আমার বাবা এখানে ঢুকেছিল। মালিকের বাবা আমার বাবাকে খুব বিশ্বাস করত। তবে তখনকার অ্যাকাউন্টস আর এখনকার অ্যাকাউন্টস-এ অনেক ফারাক।’
‘আপনার এখনকার মালিকের নাম কী?’
‘আমাদের মালিকের নাম জাহাঙ্গির খান।’
‘জাহাঙ্গির খান? মুসলিম? মালিক মুসলিম আর কম্পানির নাম জগৎমাতা টোব্যাকো?’ আদিত্য বেশ অবাক হয়েছে।
‘হ্যাঁ। মুসলমান মালিকের হিন্দু কম্পানি। অনেকেই অবাক হয়। আসলে মালিকের বাবা আসগর খান আর তার বন্ধু কাঁচড়াপাড়ার শ্যামাপদ হাজরা এই দুজন মিলে কম্পানি শুরু করেছিল। শ্যামাপদর টাকা। আর আসগর খান গতরে খেটে কম্পানি চালাবে। শ্যামাপদ শাক্ত বাড়ির লোক। তার ইচ্ছা অনুযায়ী কম্পানির নাম হয় জগৎমাতা টোব্যাকো। বিড়ির ব্যবসায় আসগরের কিছু অভিজ্ঞতা ছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে কম্পানিটাকে দাঁড় করাচ্ছিল। বছর পনের এইভাবে চলার পর শ্যামাপদর মৃত্যু হয়। শ্যামাপদর ছেলেদের বিড়ির ব্যবসায় থাকার ইচ্ছে ছিল না। কম্পানিতে তাদের অংশগুলো একটু একটু করে কিনে নেয় আসগর খান। কয়েক বছরের মধ্যে পুরো কম্পানিটাই তার হয়ে যায়। ততদিনে কম্পানি খুবই দাঁড়িয়ে গেছে। তাই মালিকানা আসগরের হাতে পুরোপুরি চলে এলেও সে আর কম্পানির নাম বদলাতে চায়নি। এখনও সেই নামই চলে আসছে।’
‘বুঝলাম। তা আপনাদের এখনকার মালিকের বয়েস কত?’
‘খুব বেশি নয়। এই তো কিছুদিন আগে ঘটা করে মালিকের ষাট বছরের জন্মদিন হল। আর তার পরেই সেই খারাপ ঘটনাটা ঘটল।’
‘খারাপ ঘটনা? কী খারাপ ঘটনা?’
‘ষাট বছরের জন্মদিন হওয়ার মাস খানেক পরে মালিকের একটা স্ট্রোক হয়। বেশ বড় স্ট্রোক। প্রাণটা যায়নি বটে, তবে একদিকটা একেবারে পড়ে গেছে। স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে মালিক হুইল চেয়ারে। কথাটাও বলে জড়িয়ে জড়িয়ে। তাই তো আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছে। না হলে নিজেই চলে আসত।’
ফাল্গুনের দুপুর। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। রোদ্দুরে তেমন তেজ নেই। এক্সপ্রেসওয়ের ধারে একটা খাল অনেকক্ষণ ধরে আদিত্যদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। কখনও কালভার্টের নিচে লুকিয়ে পড়ছে। আবার কখনও উন্মুক্ত প্রান্তরের ভেতরে ঢুকে গিয়ে বিরাট জলাশয় তৈরি করছে। আদিত্য দেখতে পেল, জলাশয়ে দু-একটা জেলে নৌকো অনিশ্চিত জাল ফেলে বসে আছে। পাড়ে তাদেরই মতো মাছের আশায় একঠেঙে তপস্বী বক। আর মাঝে মাঝে হাইওয়ের পাশে ভুঁইফোঁড় দৈত্যের মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এক-একটা পানশালা। এখন সেগুলো বন্ধ। বোধহয় রাত্তিরে খুলবে। তখন খানাপিনা হবে। নাচগান হবে।
‘আপনার মালিকের ছেলেমেয়ে নেই? মানে ভাবছিলাম, মালিক তো অসুস্থ। তাহলে কম্পানি দেখাশোনা করে কে?’ আদিত্য বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে আলগোছে প্রশ্ন করল।
‘মালিকের ছেলেমেয়ে নেই। মালকিনের একটা অকালকুষ্মাণ্ড ভাইপো আছে, তাকে মালিক বিশ্বাস করে অনেক দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি। এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারব না। তবে মালিকের কড়া হুকুম, মালকিনের ভাইপোকে যেন কেউ পয়সা-কড়ি দিয়ে বা অন্য কোনওভাবে সাহায্য না করে। এখন কম্পানিটা বলতে গেলে আমরাই চালাই। অবশ্য হুইল চেয়ারে বসে থাকলে কী হবে, মালিকের দাপট এক ফোঁটাও কমেনি। মাথাও পরিষ্কার কাজ করে। বড় সিদ্ধান্তগুলো মালিকই নেয়। তাই আমাদের কাজ করতে কোনও অসুবিধে হয় না।’
নৈহাটির মোড় পেরিয়ে আরও খানিকক্ষণ চলার পর গাড়ি বাঁদিকে বেঁকল। মিনিট দশেক পরে লেভেল ক্রসিং, আর একটু পরে গঙ্গা। গঙ্গার ধারেই জগৎমাতা বিড়ি কম্পানির মস্ত কারখানা। গাড়ি যখন কারখানার মেন গেট দিয়ে ঢুকছে, আদিত্য দেখল তার ঘড়িতে একটা পঁচিশ বেজেছে। তারক দাস তাদের পৌঁছ-সংবাদ দিয়ে কাউকে একটা ফোন করল। তারপর আদিত্যকে বলল, ‘আপনাকে প্রথমে আমাদের অতিথিশালায় নিয়ে যাচ্ছি। দুপুরের খাওয়াটা ওখানে খেয়ে একটু গড়িয়ে নেবেন। মালিক আপনার সঙ্গে ঠিক সাড়ে তিনটেতে দেখা করবে। আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।’
আদিত্য আপত্তি করল না। তার বেশ খিদে পেয়ে গেছে।
অতিথিশালাটিকে ঠিক ফাইভ স্টার বলা যাবে না। তবু মধ্যাহ্নভোজনটা আদিত্যর ভালই লাগল। সাদামাটা ডাল-ভাত, উচ্ছে-আলু ভাজা, কাতলা মাছের ঝোল, টমেটোর চাটনি। মাছটা বেশ টাটকা, মনে হয় লোকাল, ডালটাও মন্দ করেনি, আর উচ্ছে-আলু ভাজা তো আদিত্যর ফেভারিট। একতলায় খাবার জায়গা, দোতলায় বিশ্রামের ব্যবস্থা। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আদিত্য দেখল পাশাপাশি দুটো ঘর। তার মধ্যে একটা খুলে দিয়ে অতিথিশালার ভৃত্যটি চলে গেল। ঘরে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। মনে হয় অনেকদিন কেউ থাকেনি। বিছানার চাদরটাও বদলালে ভাল হতো। ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে কোনও হাত ধোয়ার বেসিন নেই, শুধু একটা জলের কল আছে, আর চান করার জন্য মগ-বালতি। আদিত্য বালতিটাকে কলের নিচে রেখে সন্তর্পণে হাত-মুখ ধুয়ে নিল, যাতে প্যান্টটা ভিজে না যায়। তারপর ঘরে ফিরে জামা খুলে বিছানায় লম্বা হল।
আদিত্য ঘুমিয়ে পড়েছিল, দরজায় খট-খট শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। দরজা খুলে দ্যাখে মধ্য-তিরিশের এক যুবতী দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদিত্য তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আপনার সঙ্গে খুব দরকারি কয়েকটা কথা আছে। আমাকে একটু ভেতরে ঢুকতে দেবেন? এখানে আমাকে কেউ দেখতে পেলে খুব বিপদে পড়ে যাব।’
কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটি আদিত্যর অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে নিজেই ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর কাতর গলায় বলল, ‘দরজাটা বন্ধ করে দিন, প্লিজ।’
মেয়েটির মরিয়া ভাব দেখে আদিত্য দরজাটা বন্ধ করে দিল। যদিও দরজা বন্ধ করার সময় আদিত্যর মনে হচ্ছিল কাজটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। ঘরে খাট ছাড়া শুধু একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। চেয়ারের পিঠে আদিত্যর শার্টটা ঝোলানো। আদিত্য তাড়াতাড়ি শার্টটা তুলে নিয়ে গায়ে গলাতে গলাতে বলল, ‘বসুন।’ সে নিজে খাটের ওপর বসল।
এতক্ষণে আদিত্য মেয়েটিকে ভাল করে দেখার সুযোগ পেয়েছে। ছিপছিপে, ছোটখাট চেহারা। ময়লা রঙ, তীক্ষ্ন নাক, চোখের মণি ঈষৎ কটা। ময়লা রঙের সঙ্গে কটা চোখটা বেমানান, মনে হয় যেন বাঙালি শরীরে বিদেশি কোনও রক্তের বেআইনি অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আদিত্য মেয়েটির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে একটু কড়া গলায় বলল, ‘ব্যাপার কী? আপনি হট করে আমার ঘরে ঢুকে এলেন কেন?’
‘বলছি দাদা, সব বলছি। বলব বলেই তো এসেছি।’ মেয়েটি সামান্য হাঁপাচ্ছে। উত্তেজনায় না পরিশ্রমে বোঝা গেল না। একটু দম নিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আমার নাম সাবিনা, সাবিনা খাতুন। আমার হাসবেন্ডের ফুপু, মানে পিসি এই কম্পানির মালিক জাহাঙ্গির খানের ওয়াইফ।’ মেয়েটি আবার দম নেওয়ার জন্য থামল।
‘মানে, আপনার স্বামী এখানকার মালকিনের ভাইপো। তা আপনার স্বামীর নাম কী?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমার হাসবেন্ডের নাম ফিরদৌস। ফিরদৌস রহমান। আমরা এখানেই থাকি। ফিরদৌস এই কম্পানির কাজও করে আবার অন্য কাজও করে। আগে পুরোটাই অন্য কাজ করত, তারপর ফুপাজি আমাদের এখানে নিয়ে এলেন। ফুপাজির তো ছেলেমেয়ে নেই, তাই ফিরদৌসকে তিনি নিজের ছেলের মতোই দেখতেন।’
‘দেখতেন কেন? এখন আর দেখেন না?’
‘সেটাই তো বলতে এসেছি। কিছুদিন আগে কম্পানিতে একটা মোটা টাকার গরমিল ধরা পড়ে। ফুপাজির মনে হয়েছে টাকাটা ফিরদৌস সরিয়েছে। আল্লা জানেন ফিরদৌস নির্দোষ। আর আমি জানি ফিরদৌস এরকম কাজ করতেই পারে না। আমাদের পনের বছর বিয়ে হয়েছে। ফিরদৌস যদি চোর হত আমি ঠিক বুঝতে পারতাম। দুটো বাচ্চা নিয়ে আমি এখন কী করব? কোথায় যাব? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’ বলতে বলতে সাবিনা খাতুনের গলা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
‘ফিরদৌস এখন কোথায়?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘সেটাই তো সমস্যা হয়েছে। ফিরদৌস পালিয়ে গেছে। কোথাও লুকিয়ে আছে। কোথায় আছে আমিও জানি না।’
‘ফিরদৌস যদি নির্দোষই হবে তাহলে সে পালাল কেন?’
‘ভয়ে, দাদা, ভয়ে। ফুপাজিকে বোধহয় আপনি এখনও দেখেননি। দেখলে বুঝবেন, ভয়ঙ্কর লোক। ভালমানুষ হলে এত বড় বিড়ি কম্পানি চালানো যায় না। এখানে নানারকম ব্যাপার চলে। হয়ত সব বিড়ি কম্পানিতেই চলে। মুন্সি, মানে ঠিকাদারদের সামলাতে হয়। ফ্যাক্টরির ওয়ার্কারদের সামলাতে হয়। এসবের জন্যে মালিকের পোষা গুণ্ডারা থাকে। ফুপাজিরও আছে। ফিরদৌস ভয় পেয়েছিল মালিক বুঝি ওর ওপর তার গুণ্ডাদের লেলিয়ে দেবে। হয়তো তাকে জানেই মেরে ফেলবে। ফিরদৌস মিছিমিছি ভয় পায়নি। ফুপাজি খুব রাগী লোক। রাগ পুষেও রাখে। ফিরদৌস গা-ঢাকা দেওয়ার পর আমার ওপরেও অনেক চোটপাট হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছিল, ফিরদৌস কোথায় লুকিয়ে আছে না বললে আমি আর আমার বাচ্চারা কেউ রেহাই পাব না। আমি তো জানিই না ফিরদৌস কোথায় আছে, কী করে বলব?’
‘আমার কাছে এলেন কেন?’
‘আমি জানি আপনাকে টাকা উদ্ধারের জন্য ডাকা হয়েছে। হয়ত ফিরদৌসকেও খুঁজে বার করতে বলবে। আপনি ফিরদৌসকে বাঁচান।’
‘ফিরদৌস যদি দোষী হয়, তাকে বাঁচাবো কী করে?’
‘আমি জানি, ফিরদৌস টাকা সরায়নি। কিন্তু যদি সে টাকা নিয়েও থাকে, তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিন। দয়া করে ফুপাজির হাতে তুলে দেবেন না। তাহলে ওরা ফিরদৌসকে মেরেই ফেলবে। অবশ্য পুলিশ-টুলিশের ঝামেলায় ফুপাজি যেতে চাইবে না। কারণ আমার ধারণা যে টাকাটা পাওয়া যাচ্ছে না তার পুরোটাই দু-নম্বরি।’
‘আমি এখানে আসছি আপনাকে কে বলল?’
‘সেটা আমি বলতে পারব না। আমাকে বিশ্বাস করে যে বলেছে আমি কী করে তার সঙ্গে বেইমানি করব?’
আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। তিনটে পাঁচ। একটু পরেই তারক দাস তাকে নিতে আসবে। সে সাবিনাকে বলল, ‘আপনি এবার আসুন। এক্ষুনি আমাকে নিতে লোক আসবে। আপনাকে এখানে দেখলে আমরা দুজনেই বিপদে পড়ব। একটা কথা মনে রাখবেন। আমি বেআইনি কোনও কাজ করি না। আর যদি মনে হয় ফিরদৌসকে আপনাদের মালিকের হাতে তুলে দিলে তার প্রাণসংশয় হতে পারে, তাহলে আমি কখনই সে কাজ করব না। এবার আসুন। নমস্কার।’
আদিত্য আগে খেয়াল করেনি দোতলার বারান্দার একধার দিয়ে একটা লোহার সিঁড়ি আছে। সাবিনা এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিঃশব্দে সেই সিঁড়িটা দিয়ে নেমে গেল। সম্ভবত এই পথেই সে এসেছিল।
বারান্দাটা বিশাল। এ-মুড়ো ও-মুড়ো মিলিয়ে মাথার ওপর তিনটে ফ্যান ঘুরছে। না ঘুরলেও চলত। সামনে গঙ্গা। হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। ফ্যানগুলো বন্ধ থাকলে গঙ্গার হাওয়াটা আরও উপভোগ করা যেত।
‘আমাদের ব্যবসায় তিনটে লেভেল আছে।’ জাহাঙ্গির খান তার ব্যবসার কথা বলছিল। ‘একেবারে নিচের তলায় আছে বিড়ি বাঁধার মেয়ে-বউরা। এরা নিজেদের বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধার কাজ করে। ঠিকেদাররা আছে মাঝের স্তরে, এদের বলা হয় মুন্সি। ঠিকেদাররা মেয়েদের বিড়ি বাঁধার জিনিসপত্র আগাম দেয়। আবার বাঁধা হয়ে গেলে কাঁচা বিড়িগুলো তাদের কাছ থেকে নিয়ে ফ্যাক্টরিতে জমা করে দেয়। ফ্যাক্টরিটা তিন নম্বর লেভেল। সেই বিড়িগুলো এখানে কাঠকয়লার আঁচে স্যাঁকা হয়। বান্ডিল করে প্যাকিং হয়। তারপর গ্রামে-গঞ্জে বিক্রির জন্য চালান হয়ে যায়।’
জাহাঙ্গির খানের কথা শুনতে শুনতে আদিত্য তাকে ভাল করে লক্ষ করছিল। হুইল চেয়ারে বসা লোকটার কথায় জড়তা আছে। কী বলছে বুঝতে গেলে একটু মন দিয়ে শুনতে হবে। কিন্তু কথা বলায় জড়তা থাকলেও চিন্তায় জড়তা নেই। মনে হয়, লোকটা শরীরের বাঁ-দিকটা নাড়াতে পারে না। ডান হাত, ডান পা নাড়াতে পারছে। হাতের কব্জি, চওড়া কাঁধ, ঘাড়ের গড়ন দেখলে বোঝা যায় এক সময় লোকটা বেশ জোয়ান ছিল। সম্ভবত নিয়মিত শরীরচর্চা করত। কঠিন মুখ। তার ওপর চৌকো মুখমণ্ডলের একদিকটা পড়ে যাওয়ার ফলে মনের ভাবগুলো পুরোপুরি মুখে ফুটে ওঠে না। এই অর্ধ-অভিব্যক্তিহীনতা জাহাঙ্গির খানের মুখমণ্ডলকে বাড়তি নিষ্ঠুরতা দিয়েছে।
‘কতদূর চালান যায় আপনাদের বিড়ি?’
‘উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি আমাদের মাল সব জায়গায় যায়। বাংলাদেশেও প্রচুর এক্সপোর্ট হয়। আমাদের বিড়ি একবার খেলে ভোলা যাবে না। আপনি বিড়ি-সিগ্রেট খান তো? আমাদের বিড়ি একটা খেয়ে দেখুন না।’
টেবিলে রাখা একটা সুদৃশ্য রুপোর কৌটো খুলে জাহাঙ্গির খান আদিত্যর দিকে একটা বিড়ি এগিয়ে দিল। নিজেও একটা নিল। দামী লাইটার দিয়ে তার নিজের বিড়িটা ধরিয়ে আদিত্যরটাও ধরিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘আমি নিজের ফ্যাক্টরির বিড়ি ছাড়া আর কিচ্ছু খেতে পারি না। বিদেশি সিগ্রেটও স্বাদে আমাদের বিড়ির কাছে হার মানবে। অন্তত আমার তাই মনে হয়। অবশ্য এই অসুখটার পরে ডাক্তার আমাকে বিড়ি-সিগ্রেট ছেড়ে দিতে বলেছিল। কিন্তু ও কী ছাড়া যায়? ক্লাশ সিক্স থেকে খেয়ে আসছি। কী? কেমন লাগছে আমাদের বিড়ি?’
বিড়ির স্বাদ আদিত্যর কাছে নতুন নয়। গোয়েন্দাগিরির পেশায় আসার আগে একটা সময় এসেছিল যখন সে প্রায় এক বছর ধরে বেকার। ইস্কুলের চাকরিটা চলে গেছে। জমা টাকাও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ফলে মেসের ভাড়া বাকি পড়ছে। মেসের মিলও বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সময় মাস ছয়েক আদিত্য বিড়িই খেত। তবে স্বীকার করতেই হবে এই বিড়িটার স্বাদ অনেকটাই আলাদা। সে বলল, ‘আপনাদের বিড়ি কিন্তু সত্যিই খুব ভাল। আপনার জেনারেল ম্যানেজার বলছিলেন আপনাদের ফ্যাক্টরিতে বছরে পঞ্চাশ-ষাট কোটি টাকার বিড়ি প্রোডাকশান হয়।’
‘আগে আরও বেশি হতো। এই শালা নোট বাতিলের ঝামেলা এসে ব্যবসার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।’
‘সে তো তিন বছর হতে চলল। এখনও ঝামেলা?’
‘ব্যবসায় একবার চোট লাগলে সারতে সময় লাগে। অনেক সময় কোনও দিনই সারে না। নোট বাতিল তো বিরাট একটা চোট।’
‘আপনাদের বোধহয় সবই ক্যাশ ট্র্যানসাকশন?’ আদিত্য ব্যবসায় চোটের ব্যাপারটা ভাল করে বোঝার জন্যে প্রশ্নটা করল।
‘ঠিক ধরেছেন। আমাদের এখানে সব লেনদেনই নগদে হয়। যেসব মেয়ে-বউরা বিড়ি বাঁধে তাদের বেশিরভাগেরই তো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। তারা চেক নিয়ে কী করবে? নোট বাতিল হয়ে যেতে হঠাৎ লেনদেন ভীষণ কমে গেল। ব্যবসা হবে কোথা থেকে? সেই ধাক্কা এখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারিনি।’
‘আপনাদের কাছে যে ক্যাশটা ছিল সেটা কী করলেন? ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিলেন?’ আদিত্য নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল।
প্রশ্নটা দৃশ্যতই জাহাঙ্গির খানকে বিদ্ধ করেছে। লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার মুখের যেদিকটা সচল সেদিকটা কয়েকবার কেঁপে উঠে থেমে গেল। যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছে। কয়েক মিনিট চুপ করে থাকার পর জাহাঙ্গির খান বলল, ‘আপনাকে যে কাজে ডেকেছি সেটার জন্য সব কথাই খুলে বলতে হবে। ঘটনাটার শুরু কিন্তু ওই নোট বাতিলের সময় থেকে।’
সত্যি বলতে কি, বিড়িটা খেয়ে আদিত্যর তেমন জুত হয়নি। সে বলল, ‘আপনি শুরু করার আগে আপনার অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট ধরাচ্ছি।’
‘ধরান, ধরান। নিশ্চয় ধরান। যার যেটা নেশা তার সেটা না হলে চলে?’ তারপর আদিত্যর সিগারেট ধরানো হয়ে গেলে জাহাঙ্গির খান বলতে শুরু করল, ‘আপনাকে খোলাখুলি বলি। আমাদের ব্যবসায় যেহেতু লেনদেনগুলো নগদে হয়, তাই তার অনেকটাই দেখানো হয় না। শুধু আয় নয়, যে নগদটা রোজকার লেনদেনের জন্য হাতে রাখতে হচ্ছে, সেটাও। বেশ বড় একটা নগদ লেনদেনের জন্য আমাদের ধরে রাখতে হয়। যে রাত্তিরে হঠাৎ নোট বাতিল ঘোষণা হল, আমাদের হাতে তখন বেশ কয়েক কোটি টাকা। তার বেশির ভাগটাই দেখানো নেই। মানে আপনাদের ভাষায় দু-নম্বরি। কিছু টাকা এর ওর নামে ব্যাঙ্কে জমা দিলাম। তাও হাতে বেশ কিছু রয়ে গেল। এই নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটছিল। হাতে তখন আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি আছে যার মধ্যে বাতিল নোটগুলো বদলে নিতে হবে, এই সময় ফিরদৌস এসে হাজির। ফিরদৌস আমার বড় শালার ছেলে। ভদ্র, নম্র ছেলেটাকে আমার বেশ ভালই লাগত। ফিরদৌস আমার সমস্যাটা আন্দাজ করেছিল। সে আমাকে বলল, ফুপাজি আমি আপনার সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব যিনি আপনাকে হেল্প করতে পারবেন। আমি তার কম্পানিতেই কাজ করি।’
‘ফিরদৌসের সঙ্গে এর আগে আপনার কখনও ব্যবসার ব্যাপারে কথা বা লেনদেন হয়েছিল?’
‘না। হয়নি। ফিরদৌস কী করে সেটাও আমি জানতাম না। কখনও কখনও ছুটি বা পরবের সময় ফিরদৌস তার বউ-বাচ্চা নিয়ে আমাদের এখানে আসত। তার ফুপি তাকে খুব ভালবাসত। বোধহয় এখনও বাসে।’
‘বেশ। তারপর কী হল বলুন।’
‘আমাদের হাতে সময় বেশি ছিল না। তাই ফিরদৌসকে নিয়ে পরের দিনই ওই ভদ্রলোকের অফিসে হাজির হলাম। কলকাতার পোদ্দার কোর্ট-এ অফিস। বিবাদী বাগের খুব কাছে। অফিসের দরজায় লেখা ‘কুমুদিনী বিত্ত নিগম, স্টক ব্রোকার’। আমি একটু অবাক হলাম, ফিরদৌস আমাকে স্টক ব্রোকারদের কাছে নিয়ে এল কেন?’
‘কুমুদিনী বিত্ত নিগম? নামটা চেনা লাগছে। দাঁড়ান, দাঁড়ান, কিছুদিন আগে এর মালিককে পুলিশ ধরেছিল না? কম্পানিটা কি পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে? কাগজে তাই যেন পড়েছিলাম।’ আদিত্য ভুরু কোঁচকাল।
‘আপনি একদম ঠিক বলেছেন। কুমুদিনীর মালিক অ্যারেস্টেড হয়েছে। কম্পানিটাও এখন বন্ধ। কিন্তু তিন বছর আগে প্রথম যখন মালিকের সঙ্গে আলাপ হল তখন কুমুদিনীর ব্যবসা খুব ভালই চলছে। সেদিন ভেতরে ঢুকে দেখলাম একটা বড় হল ঘরে দশ-বারোজন লোক কম্পিউটারে কাজ করছে। হলের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে ফিরদৌস আমাকে আরেকটা ছোট ঘরে ঢোকাল। এটা মালিকের খাস কামরায় ঢোকার ওয়েটিং রুম। একজন সেক্রেটারি বসে আছে। তাকে আমার নাম বলতেই সে খুব খাতির করে আমাকে মালিকের খাস কামরায় নিয়ে গেল। নিশ্চয় আমার নামটা আগে থেকে বলা ছিল। এই ঘরটা খুব সাজানো, সাইজেও বেশ বড়। মালিকের সঙ্গে ফিরদৌস আলাপ করিয়ে দিল, মালিকের নাম সত্যজিৎ সামন্ত, সবাই বলে বটুক সামন্ত। বটুকবাবু আমাকে বলল ফিরদৌস তাকে আমার কথা বলেছে। তারপর যা বলল সেটা সংক্ষেপ করলে এটাই দাঁড়ায় যে, ওপর ওপর স্টক ব্রোকার ফার্ম হলেও কুমুদিনীর আসল ব্যবসা টাকা তুলে খাটানো। বড় বড় ব্যবসাদার, যাদের কিছু দু-নম্বরি বাড়তি টাকা আছে, কুমুদিনী তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় খাটায়। টাকা খাটানোর প্রধান জায়গা বাংলা সিনেমা। টালিগঞ্জের প্রডিউসাররা সকলেই বটুকবাবুকে একডাকে চেনে। সিনেমা ছাড়াও তার কিছু টাকা যাত্রায় খাটছে, কিছু টাকা বার নাইট-ক্লাবে। আরও কিছু কিছু জায়গায়। সব কটার কথা বটুকবাবু বলেনি, আমিও জানি না। বটুকবাবু দুটো জিনিস জোর দিয়ে বলল। এক, কুমুদিনী কখনও কোনও বেআইনি ব্যবসায় টাকা খাটায় না। সিনেমা-যাত্রা-বার-নাইট-ক্লাব যেখানে যেখানে টাকা খাটানো হয়েছে তার প্রত্যেকটা লিগাল। দুই, এইসব ইনভেস্টমেন্টে রিস্ক আছে। হয়ত একটু বেশি রিস্ক। এই রিস্কটা যার টাকা তার সঙ্গে কুমুদিনী ফিফটি-ফিফটি হিসেবে শেয়ার করে নেয়। অর্থাৎ একশ টাকা খাটিয়ে যদি পঞ্চাশ টাকা ফেরত পাওয়া যায় তাহলে টাকার মালিককে বাকি পঞ্চাশ টাকার অর্ধেক মানে পঁচিশ টাকা কুমুদিনী ফেরত দিয়ে দেবে। অর্থাৎ সেই পঁচিশ টাকাটা কুমুদিনীর ক্ষতি। আর টাকার মালিক একশ টাকা খাটিয়ে পঁচাত্তর টাকা ফেরত পাচ্ছে। আর যদি পুরো টাকাটাই মার যায়, অর্থাৎ সিনেমা কম্পানি কিছুই ফেরত দিতে না পারে, তাহলেও টাকার মালিক পঞ্চাশ টাকা ফেরত পাচ্ছে। উল্টোদিকে ব্যবসা চললে টাকার মালিক মাসে এক পার্সেন্ট সুদ সহ টাকা ফেরত পাবে। আর কুমুদিনীও পাবে এক পার্সেন্ট। তবে কুমুদিনী খুব দেখেশুনে টাকা ধার দেয়। তাই তাদের খাটানো টাকা সচরাচর মার যায় না।’
জাহাঙ্গির খান থামল। বারান্দায় একজন এসেছে। তার হাতের ট্রেতে লস্যির গ্লাস, কাজুবাদামের প্লেট। সে চলে যাওয়া অব্দি জাহাঙ্গির খান চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘খেয়ে নিন। সবাই বলে আমাদের লস্যিটা খুব ভাল।’
‘একটা কথা বলুন,’ আদিত্য লস্যির গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘ব্যবসায় কত টাকা ক্ষতি হচ্ছে সেটা কুমুদিনী জানবে কী করে? আর জানলেই বা সঠিক অঙ্কটা টাকার মালিককে জানাবে কেন? ব্যবসায়ীর সঙ্গে ষড় করে কুমুদিনী তো টাকার মালিককে ঠকাতে পারে।’
‘আমার মাথাতেও ঠিক এই প্রশ্নটাই এসেছিল। কিন্তু আমি প্রশ্নটা করার আগেই বটুকবাবু বোধহয় আমার মনের দুশ্চিন্তাটা বুঝতে পারল। আমাকে বলল, দেখুন আমি তিরিশ বছরের ওপর কুমুদিনী চালাচ্ছি। এই কম্পানিটা চলে পুরোপুরি বিশ্বাসের ওপরে। যারা আমার কাছ থেকে টাকা নেয় এবং যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি খাটাই তারা সকলেই আমাকে বিশ্বাস করে। আমিও সকলকে বিশ্বাস করি। আপনি যদি আমার সঙ্গে কারবার করতে চান তাহলে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। কুমুদিনী আমার মায়ের নাম। আমার ছোটবেলায় মা মারা গেছেন। আমি মায়ের নাম নিয়ে অবিশ্বাসের কাজ করি না। অবশ্য আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন কি না সেটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার।’
আদিত্য ভাবল, বিশ্বাস? নাকি গুডউইল? বিশ্বাসভঙ্গ করে একবার কিছু টাকা মেরে দেওয়া যায়। কিন্তু তাহলে ভবিষ্যতে আর ব্যবসা করা চলবে না। অর্থাৎ ব্যবসা চালাতে গেলে গুডউইল অক্ষুণ রাখতে হবে, আর গুডউইল অক্ষুণ রাখতে গেলে বিশ্বাস অটুট রাখা দরকার। সে লস্যির গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘আপনার তো তখন একটা এমার্জেন্সি অবস্থা। টাকাগুলো পাল্টাতে না পারলে কিছুদিনের মধ্যেই তামাদি হয়ে যাবে।’
‘সেই চাপটা তো ছিলই। কিন্তু সেটা ছাড়াও বটুকবাবুকে দেখে মনে হলো লোকটাকে বিশ্বাস করা যায়। আমরা ব্যবসা করে খাই। তাই লোক দেখে মোটামুটি বুঝতে পারি কাকে বিশ্বাস করা যায়, কাকে যায় না। মোট কথা আমি রাজি হয়ে গেলাম। পরের দিন ফিরদৌসকে সঙ্গে নিয়ে পুরোনো এক হাজারের নোটে পাঁচ কোটি টাকা বটুকবাবুকে দিয়ে এলাম। বটুকবাবু একটা কাঁচা রসিদ কেটে দিল। আমি জানতাম ওই রসিদের কোনও দাম নেই। বটুকবাবুর মুখের কথারই যেটুকু দাম। আমি বটুকবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, টাকাটা আপনি পাল্টাবেন কী করে? বটুকবাবু বলল, ওটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ওসবের অনেক রাস্তা আছে। তবে বলে রাখি, আপনার এই টাকাটা আমি টালিগঞ্জে খাটাব। রোহিত ধামানি বলে একজন প্রডিউসার আছে। খুব বড় নয়, আবার খুব ছোটোও নয়। ওর সিনেমা গ্রামের দিকেই চলে বেশি। একটা কাজ হাতে নিয়ে এখন লাস্ট মোমেন্টে ওর কিছু টাকা শর্ট পড়ে গেছে। আপনার টাকাটা পেলে ওর খুব সুবিধে হবে।’
‘তারপর?’
‘এক বছরের মধ্যে মাসিক এক পার্সেন্ট সুদ সমেত আমি টাকাটা ফেরত পেয়ে গেলাম। বাতিল নোট দিয়েছিলাম বলে আলাদা করে ওরা কিছু টাকা কাটল না। আমি কুমুদিনীতে আবার ইনভেস্ট করলাম, এবার আর একটু বেশি। টাকাটা এবার ছ-মাসের মধ্যে ফেরত পেয়ে গেলাম। অবশ্যই সুদ সমেত। এরকম করে আরও দুবার টাকা ঢাললাম। কুমুদিনী আমাকে কোনওবারই নিরাশ করল না।’
‘তাহলে সমস্যা কবে দেখা দিল?’
‘হ্যাঁ, সেটাই বলছি।’ জাহাঙ্গির খান আর-একটা বিড়ি ধরাল। তার দেখাদেখি আদিত্যও সিগারেট ধরিয়েছে।
‘বছর দেড়েক আগে আমার একটা স্ট্রোক হয়।’ জাহাঙ্গির খান আবার বলতে শুরু করল। ‘সেই থেকে সমস্যার শুরু। মাস তিনেকের মধ্যে কিছুটা ভাল হয়ে উঠলাম, কিন্তু পুরো সুস্থ আর কোনওদিনই হলাম না। মাথা পরিষ্কার কাজ করে, কিন্তু শরীরের একদিকটা কাজ করে না। কোথাও যাওয়া একেবারে বন্ধ। আমার স্ট্রোকের পরে দুবার কুমুদিনীতে টাকা দিয়েছি। দুবারই ফিরদৌস টাকা নিয়ে গেছে, আবার সময়মতো সুদ সমেত টাকা ফেরত নিয়ে এসেছে। আমি তখন ফিরদৌসকে নিজের ছেলের মতো বিশ্বাস করি।’
‘ফিরদৌস কি তখন এখানে থাকত?’
‘ফিরদৌসের বউ-বাচ্চা থাকত। এখনও থাকে। ফিরদৌস এখান থেকে কলকাতায় যাতায়াত করত। কুমুদিনীর কাজটা ও ছাড়েনি।’
‘বেশ। বেশ। তারপর?’
‘তারপর মাস দুয়েক আগে, মানে গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, বটুকবাবু আমাকে ফোন করল। বলল, ওই ফিলিম প্রডিউসার রোহিত ধামানি একটা বিরাট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। ফরেনে সুটিং হবে। নামকরা সব আর্টিস্ট থাকবে। পঞ্চাশ কোটির প্রজেক্ট। আপনি কুড়ি কোটি মতো ইনভেস্ট করতে পারেন। আমি গ্যারেন্টি দিচ্ছি, একেবারে সিয়োর রিটার্ন। এক বছরে টাকা শোধ করে দেবে।’
‘আপনি দিলেন কুড়ি কোটি?’
‘আমি একটু লোভে পড়ে গেলাম। অত টাকা আমার হাতে তো বেকার পড়ে থাকে না। কুড়ি কোটি দিতে গেলে আমাকে ব্যবসা থেকে কিছু টাকা তুলে নিতে হবে। কিন্তু এদিকে তো বিড়ির ব্যবসাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রেডিয়োতে-টিভিতে সরকার বড় করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বিড়ি-সিগ্রেট খাওয়া কত খারাপ। ফলে আমাদের বিক্রি কমে যাচ্ছে। সেদিক থেকে ভেবে মনে হল, সিনেমায় কুড়ি কোটি ঢাললে মন্দ হবে না। টাকাটা জোগাড় করতে কটা দিন লেগে গেল। ফেব্রুয়ারির আট তারিখে, তারিখটা আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমি ফিরদৌসের হাতে টাকাটা দিয়ে বললাম বটুকবাবুকে দিয়ে এস। ওর সঙ্গে প্রোটেকশন হিসেবে সহদেব আর জামিলকে দিয়ে দিলাম। ওরা দুজনেই আমার বডিগার্ড, খুব বিশ্বাসী। সেদিন সন্ধেবেলা সহদেব আর জামিল ফিরে এল। বলল, ফিরদৌস কলকাতায় রয়ে গেছে, ওর কী একটা দরকারি কাজ আছে নাকি। রাত্তিরে ফিরদৌস ফোন করে বলল, টাকা বটুকবাবুর কাছে পৌঁছে গেছে। তবে ও নিজে একটা কাজে আটকে গেছে, দুদিন পরে ফিরবে। আমি তখন ফিরদৌসকে এতটাই বিশ্বাস করি যে বটুকবাবুকে ফোন করে ভেরিফাই করার কথাটা মাথাতেই আসেনি। দুদিন কেটে গেল, ফিরদৌস ফিরল না। ওকে ফোন করলাম। ফোন পরিষেবা সীমার বাইরে। আমি ওর বউকে জিজ্ঞাসা করলাম ফিরদৌস কোথায়। সেও কিছু বলতে পারল না। আমি এবার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বটুকবাবুর মোবাইলে ফোন করলাম। ফোন সুইচড অফ। কুমুদিনীর ল্যাণ্ডলাইনে ফোন করলাম, ফোন বেজে গেল। সহদেব আর জামিলকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা কী ফিরদৌসকে বটুকবাবুর হাতে টাকাটা তুলে দিতে দেখেছে? তারা বলল, ফিরদৌস তাদের বাইরে বসিয়ে রেখে কুমুদিনীর মালিকের ঘরে ঢুকেছিল। তারা এর বেশি আর কিছু দেখেনি। বটুকবাবুর সেক্রেটারির ফোন নম্বরটা আমার কাছে ছিল। সেখানে ফোন করলাম। এই ফোনটাও সুইচড অফ। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এমার্জেন্সির জন্য বটুকবাবু আর-একটা নম্বর আমাকে দিয়েছিল। সেই নম্বরে ফোন করলাম। একজন ফোনটা ধরল। মেয়েছেলের গলা। আমি নিজের পরিচয় দিলাম। সে বলল, কিছুদিন আগে বটুকবাবুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এখন কুমুদিনীর অফিস সিল করা। আমি খুব ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ফিরদৌসের হাত দিয়ে যে কুড়ি কোটি পাঠিয়েছিলাম সেটা বটুকবাবু পেয়েছেন তো? শুনে সেই মহিলা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় আমাকে বলল, ওরকম কোনও টাকা বটুকবাবু পাননি, পেলে আমি অবশ্যই জানতে পারতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে? মেয়েটা বলল, আমি কুমুদিনীতে কাজ করি। এর বেশি আর কিছু বলতে পারব না। এর দুদিন পরে কুমুদিনীর ব্যাপারটা বড় করে কাগজে বেরল।’
জাহাঙ্গির খান থামল। উত্তেজনায় তার শরীরের ডান দিকটা থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা হাতে সে আবার একটা বিড়ি ধরাল। তারপর যখন কথা বলতে শুরু করল তখন তার মুখে একটা আশ্চর্য প্রশান্তি এসেছে। খুব ঠাণ্ডা গলায় সে বলল, ‘আমি যেমন ভালবাসতে জানি তেমনি শাস্তিও দিতে জানি। ফিরদৌসকে আমি নিজের ছেলের মতো দেখতাম। প্রতিদানে সে যদি আমার সঙ্গে নেমখহারামি করে থাকে তাহলে শাস্তি তাকে পেতেই হবে। আপনাকে আমি দু-টো কাজ করতে বলব। এক, বটুকবাবু সত্যিই টাকাটা পেয়েছেন কি না এটা আপনাকে জানতে হবে। দুই, ফিরদৌসকে খুঁজে বার করতে হবে। তার ঠিকানাটা আমার চাই।’
জাহাঙ্গির খানের গলায় একটা অমোঘ নিষ্ঠুরতা ছিল। আদিত্য বুঝতে পারল কেন সাবিনা খাতুন এত ভয় পেয়েছে।
‘যেদিন ফিরদৌস আপনার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে গেল সেদিনটা ঠিক কী কী ঘটেছিল আপনি আর একটু ডিটেলে বলতে পারবেন?’ আদিত্য খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল।
‘একটু মনে করে বলতে হবে।’ জাহাঙ্গির খান একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, ‘সকালে, এই নটা সাড়ে নটা নাগাদ আমি ফিরদৌসকে ডাকলাম। টাকাটা আমার কাছে একটা ব্যাগের মধ্যে ছিল। ওই বড় ট্র্যাভেল ব্যাগগুলো যেমন হয়। আমি ফিরদৌসকে বললাম টাকাটা গুনে নাও। ফিরদৌস গুনে নিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বটুকবাবুকে ফোন করে বলে দিয়েছ তো টাকা নিয়ে আজ যাচ্ছ? ফিরদৌস বলল হ্যাঁ, কাল রাত্তিরে বলে দিয়েছি। তবে এখন আর একবার ফোন করে বলে দিচ্ছি। তারপর ফিরদৌস ফোন করার জন্যে পকেটে হাত দিয়ে বলল, এই যাঃ, আমার মোবাইলটা বাড়িতে ফেলে এসেছি। ফুফাজি আপনার মোবাইলটা থেকে ফোন করব?’
আদিত্য নিবিষ্ট হয়ে শুনছিল। জাহাঙ্গির একটু থামতেই সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি নিজে না ফোন করে ফিরদৌসকে ফোন করতে বললেন কেন?’
‘দেখুন স্ট্রোকটা হওয়ার পর থেকে দেখতেই তো পাচ্ছেন আমার কথা জড়িয়ে গেছে। টেলিফোনে আমার কথা কেউ বুঝতে পারে না। তাই ফিরদৌসকে ফোন করতে বলেছিলাম।’ জাহাঙ্গির খানের গলাটা বিষণ্ণ শোনাল।
‘বুঝতে পেরেছি। তারপর?’
‘তারপর আমার ফোন থেকেই ফিরদৌস বটুকবাবুকে ফোন করল। ফোনটা সুইচড অফ। ফিরদৌস বলল, আমার বোঝা উচিত ছিল। এই সময় তো বটুকবাবু ফোন অফ করে পুজো-পাঠ করেন। আমি বরং বটুকবাবুর সেক্রেটারি শৌভিক নন্দকে ফোন করে বলে দিই। ও বটুকবাবুকে জানিয়ে দেবে যে আমরা যাচ্ছি। ফিরদৌস বটুকবাবুর সেক্রেটারিকে ফোন করে বলে দিল।’
‘আপনার ফোন থেকে ফোনটা যেতে সেক্রেটারি অবাক হল না?’
‘আপনি বলতে এখন আমার মনে পড়ছে। ফিরদৌস ফোন করে প্রথমেই বলল আমি ফিরদৌস বলছি। আমার ফোনটা সঙ্গে নেই বলে ফুপাজির ফোন থেকে ফোন করছি। তুমি বটুকবাবুকে বলে দিও আজ দুপুরে আমি টাকা নিয়ে যাচ্ছি। উনি বললেই বুঝতে পারবেন।’
‘এর বেশি আর কিছু ফিরদৌস বলেনি?’
‘না। এইটুকুই বলেছিল। হয়ত সেক্রেটারিকে পুরোটা বলতে চায়নি।’
‘হুঁ। আচ্ছা ফিরদৌস যে বটুকবাবু আর তার সেক্রেটারিকেই ফোন করেছিল এটা আপনি চেক করেছিলেন।’
‘নিশ্চয়। ফোনটা তো আমার মোবাইল থেকেই করেছিল। তাই চেক করতে অসুবিধে হয়নি।’
‘আচ্ছা, সহদেব আর জামিলও তো ফিরদৌসের সঙ্গে গিয়েছিল। ওরা তিনজন মিলেই তো টাকাটা সরাতে পারে। আপনি একা ফিরদৌসকে কেন সন্দেহ করছেন?’
‘দেখুন, সহদেব আর জামিল দুজনেই বহুদিন আমার সঙ্গে আছে। টাকা চুরি করার হলে ওরা আরও অনেক বেশি টাকা অনেক দিন আগেই সরাতে পারত। আদিত্যবাবু, আমাকে ব্যবসা করে খেতে হয় তাই আমি লোক চিনি। সহদেব আর জামিলকে আমি নিজের ওয়াইফের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। ওরা আমার জন্য জান দিয়ে দিতে পারে। আমি তার প্রমাণও পেয়েছি।’
‘তাহলে কি আপনি নিজের ওয়াইফকে ততটা বিশ্বাস করেন না?’
‘আরে না, না। ওটা একটা কথার কথা বললাম। আমার ওয়াইফকে আমি পুরো বিশ্বাস করি।’ জাহাঙ্গির খানকে একটু লজ্জিত মনে হল।
আদিত্য অনেকক্ষণ ধরে ভাবল। তারপর বলল, ‘আমার একটা চিঠি দরকার। বটুক সামন্তর সঙ্গে দেখা হলে সে বিশ্বাস করবে কেন আমি আপনার কাছ থেকে আসছি?’
‘চিঠি?’ জাহাঙ্গির খানের গলাটা একটু দ্বিধাগ্রস্ত শোনাল। ‘স্ট্রোকটা হওয়ার পর থেকে আমি খুব ভাল লিখতে পারি না। খুব কষ্ট করে শুধু সইটা করতে পারি। দেখছি কী করা যায়।’
জাহাঙ্গির খান একটা বেল বাজাল। আদিত্য এতক্ষণ খেয়াল করেনি, বেলটা তার হুইল চেয়ারের ডান হাতলে লাগানো ছিল। ‘তারককে একবার আসতে বল।’ যে লস্যি নিয়ে এসেছিল সে দেখা দিতে জাহাঙ্গির খান তাকে নির্দেশ দিল।
তারক দাস ঘরে এসে ঢোকার পর আদিত্য শুনতে পেল তাকে জাহাঙ্গির খান বলছে, ‘তারক, বাংলায় একটা চিঠি টাইপ করে দিতে হবে। আমি শুধু সই করব। চিঠিটা সত্যজিৎ সামন্তকে লেখা হবে। চিঠিতে লিখবে, প্রিয় বটুকবাবু, আপনার ফোন বন্ধ, তাই সরাসরি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। এই চিঠি নিয়ে যে যাচ্ছে সে আমার লোক। নাম আদিত্য মজুমদার। সে আমার কথাগুলো আপনাকে বলবে। আপনি আপনার উত্তরটা এই লোকটিকেই দিয়ে দেবেন। আমার নমস্কার নেবেন। ইতি জাহাঙ্গির খান।’
চিঠিটা সই করে, একটা খামে পুরে আদিত্যর হাতে তুলে দিতে দিতে জাহাঙ্গির খান বলল, ‘আর কিছু লাগবে?’
‘হ্যাঁ, ফিরদৌসের একটা ছবি পেলে ভাল হত।’
‘ওটাও তারক ব্যবস্থা করে দেবে। ছবিটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলে হবে তো?’
‘নিশ্চয়।’
একটু পরে গাড়িতে উঠবে বলে আদিত্য বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গাড়িবারান্দার নিচে অপেক্ষা করছে এমন সময় একটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে বলল, ‘মালকিন আপনাকে একবার ডাকছে।’
মালকিন মানে কি জাহাঙ্গির খানের স্ত্রী? তিনি কেন আদিত্যকে ডাকবেন? মেয়েটির পেছন পেছন আদিত্য আবার বাড়ির ভেতর ঢুকল। মেয়েটি একতলার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল তাকে। প্রায় আসবাবহীন নিরাভরণ ঘর। শুধু একদিকে একটা তক্তোপোষের ওপর গোটা দুয়েক তাকিয়া। আদিত্য তক্তোপোষের ওপরে বসে ভাবছে, মালকিন এলে কোথায় বসবেন, এই সময় মালকিন এসে ঘরে ঢুকলেন। সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী, বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে, বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈষৎ মেদ জমেছে শরীরে। আদিত্য আন্দাজে ধরে নিল ইনি জাহাঙ্গির খানের স্ত্রী। সে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল।
‘আপনার সঙ্গে কথা বলাটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিলাম না। অনেক ভেবে মনে হল, আমি যেটুকু জানি সেটা আপনাকে জানিয়ে দেওয়াই ভাল।’
ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেখে আদিত্যও দাঁড়িয়ে রইল। ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বর ও শরীরের ভাষা অত্যন্ত পরিশীলিত, তবে একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে বাংলা উচ্চারণে একটা পশ্চিমের টান আছে। আদিত্য জানত, বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে পশ্চিমের মুসলমানদের বৈবাহিক সম্পর্ক-স্থাপন বিরল নয়। সম্ভবত এক্ষেত্রেও কোথাও একটা পুব-পশ্চিমের মিলন ঘটেছে।
‘আমিই সাবিনাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলাম। সাবিনা আমাকে বলেছে আপনাদের মধ্যে কী কী কথা হয়েছে।’
আদিত্য উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে রইল।
‘আপনি সাবিনাকে কথা দিয়েছেন ফিরদৌসকে আমার স্বামীর হাতে তুলে দেবেন না। আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি কথা রাখবেন।’
আদিত্য এবারেও উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে রইল।
‘আমার নিজের ছেলে নেই। ফিরদৌসকে আমি ছেলের মতই ভালবাসি। কিন্তু একই সঙ্গে ইনসাফের দিকটাও তো বাদ দেওয়া যায় না। যে কথাটা আমি কখনও আমার স্বামীকে বলিনি সেটা আপনাকে বলছি। কথাটা বোধহয় সাবিনাও জানে না। কথাটা বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু আপনাকে বলছি।’
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। পরের কথাগুলো বলার জন্য যেন শক্তি সঞ্চয় করছেন। আদিত্যও চুপ করে রইল। মিনিট খানেক নীরব থেকে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনি যেহেতু এই কেসটা নিয়ে ইনভেস্টিগেট করবেন, আপনার জানা দরকার ফিরদৌসের যখন উনিশ-কুড়ি বছর বয়েস তখন সে একটা চুরির কেসে জড়িয়ে পড়ে। এটা ঘটেছিল বহরমপুরে। ওখানে ফিরদৌসের বাবা, মানে আমার বড় দাদা, খুব ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক ছিলেন। কিছুদিন এম এল এ-ও ছিলেন। দাদা তার ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ফিরদৌসকে বাঁচিয়ে দেয়। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা দাদাকে এতটাই পারটার্ব করেছিল যে এর পর দাদা আর খুব বেশিদিন বাঁচেনি। হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল।’
‘আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ আদিত্য মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল।
‘বলুন।’
‘ফিরদৌসের বাবার নাম কী ছিল?’
‘ফিরদৌসের বাবার নাম হাবিবুর রহমান।’
‘অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম, বাকিটা আমি বার করে নেব। আপনার মতো মানুষ আরও দু-একটা থাকলে পৃথিবীটা অন্য রকম হয়ে যেত।’ ভদ্রমহিলার সততায় আদিত্য সত্যিই আপ্লুত হয়েছে।
‘আমি কিন্তু একবারও বলতে চাইছি না ফিরদৌস আমার স্বামীর টাকা নিয়ে পালিয়েছে। বরং আমি বলব ফিরদৌস নিজেকে শুধরে নিয়েছিল। তবু আমার মনে হল ফিরদৌসের পাস্ট হিসট্রিটা আপনার জেনে রাখা দরকার।’
‘আপনি কোনও চিন্তা করবেন না ম্যাডাম, ফিরদৌস যদি নির্দোষ হয় আমি গ্যারেন্টি দিচ্ছি তার কোনও ক্ষতি হবে না।’ আদিত্য এর বেশি আর কিছু বলতে পারল না।
ফেরার পথে আদিত্য একা। দোলপূর্ণিমার চাঁদ আকাশ ও মাটিতে মায়া বিস্তার করেছে। এখন চাঁদের আলো ছাড়া কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে আর কোনও আলো নেই। ‘কোন পূর্ণ চাঁদের মায়ায়’ গানটা তার মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, অন্য সময় হলে হয়তো দু’এক কলি গেয়েও ফেলত, কিন্তু এই মুহূর্তে আদিত্যর মন ভাল নেই। সে ধর্মসঙ্কটে পড়েছে। ফিরদৌসকে কি ধরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে? সাবিনা বলছে ধরতে পারলে জাহাঙ্গির খান তাকে মেরেও ফেলতে পারে। সাবিনাকে আদিত্য কথা দিয়েছে সে অনৈতিক কিছু করবে না। কিন্তু আসার আগে জাহাঙ্গির খানের কাছ থেকে আদিত্য কিছু অগ্রিম নিয়ে ফেলেছে। টাকা নিলে কাজ তো করতেই হবে। আর একটা অস্বস্তি, যে টাকাটা উদ্ধারের জন্য সে জাহাঙ্গির খানকে সাহায্য করতে চলেছে সেটা সম্ভবত পুরোটাই কালো টাকা। হয়তো যেটা সে অগ্রিম হিসেবে নিয়েছে, সেটাও। ইদানীং খুব টানাটানি যাচ্ছিল। কিছু টাকার খুব দরকার ছিল। না হলে আদিত্য জাহাঙ্গির খানের কাজটা নিত না।
সাড়ে আটটা নাগাদ মেসে ঢোকার সময় আদিত্য দেখল মহাত্মা গান্ধী রোডে ফুটপাথের ওপর বসে একটা লোক বাঁশি বাজাচ্ছে। হোলির গান। সুরটা আদিত্যর চেনা। ‘রঙ্গি সারি গুলাবি চুনরিয়া রে/ মোহে মারে নজরিয়া সামরিয়া রে’। মন্দ বাজাচ্ছে না। কিন্তু কোনও শ্রোতা নেই। তাতে অবশ্য লোকটার কিছু যায় আসে বলে মনে হল না। সে নিজের মনেই বাজিয়ে যাচ্ছে। আদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁশি শুনল। তারপর একসময় ঢুকে গেল তার মেসের গলিতে।
জাহাঙ্গির খানের গল্পতে কোথাও একটা অসংগতি আছে। আদিত্য সেটা এক্ষুনি ধরতে পারছে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন