অভিরূপ সরকার
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ভবানীপুর পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার জন্য আদিত্য মেট্রো ধরেছিল। যতীন দাস পার্কে নেমে বাঁ দিকে গেলেই আশুতোষ কলেজ, আর কলেজ পেরিয়ে দু-পা হাঁটলে একেবারে বড় রাস্তার ওপরেই ভবানীপুর পুলিশ স্টেশন। কলেজে পড়ার সময় সে এদিকে মাঝে মাঝে আসত। তার এক সহপাঠী, দীপঙ্কর সেন, তখন থাকত ভারতী সিনেমা হলের পেছন দিকে, রূপচাঁদ মুখার্জী লেনে। সে আর দীপঙ্কর বিএসসি পরীক্ষার আগে অনেকটা সময় একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। পড়াশোনা ছাড়াও দু-জনে এই ভবানীপুরের সিনেমা পাড়ায় সিনেমা দেখেছে অনেক। দীপঙ্করের পাল্লায় পড়ে আদিত্যর বাংলা সিনেমা দেখার শুরু, নাহলে সে বাংলা সিনেমার ভক্ত কোনও কালেও ছিল না। তারপর এমন একটা সময় এল যখন দেখা গেল দীপঙ্করের থেকে তারই বাংলা সিনেমা দেখায় উৎসাহ বেশি। সেই উৎসাহটা অবশ্য খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তবে এখনও তার কলেজ জীবনের দু-একটা বাংলা ছবি টেলিভিশনে দেখালে আদিত্য স্মৃতিমেদুর হয়ে দেখতে বসে যায়।
দীপঙ্করের সঙ্গে বহুদিন যোগাযোগ নেই। আমেরিকায় থাকে, দেশে প্রায় আসেই না। এলেও আদিত্যর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে ওঠে না।
আদিত্য যখন কলেজ জীবনে এ পাড়ায় আসত তখন ভবানীপুর পুলিশ স্টেশনের বাইরেটা লাল রঙের ছিল। এখন সেটা নীল-সাদা হয়েছে। কিন্তু থানার গায়ে সেই অদ্ভুত লেখাটা এখনও রয়েছে। বিশ বছর আগে দীপঙ্করের বাড়ি যাওয়ার পথে আদিত্য রোজ দেখত ভবানীপুর থানার গায়ে মোটা-মোটা ইংরেজি অক্ষরে লেখা আছে ‘পোলিস সেকশন হভস’। থানার সদর দরজার ওপরে এত বছর বাদেও লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। ঠিক যেখানে আগে ছিল। কিন্তু কথাটার মানে কী? ‘পোলিস সেকশন’-এর মানে না হয় করা গেল পুলিশের একটা অংশ। কিন্তু হভস? এর মানে কি হাউস? মানে পুলিশ কোয়ার্টার? থানার ওপরে অবশ্য পুলিশদের বসবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। ওপরের বারান্দা থেকে নিচে ঝাঁপ খেয়েছে শুকোতে দেওয়া শাড়ি। ওখানেই হয়ত বড়বাবু থাকেন।
বড়বাবুর কথায় আদিত্যর মনে পড়ে গেল আসার সময় বড়বাবুকে ফোনে পাওয়া যায়নি। ফোনটা সুইচড অফ ছিল। কাল রাত্তিরে অবশ্য গৌতম বড়বাবুকে ফোন করে দিয়েছিল। অর্থাৎ আদিত্য যে আজ সকালে থানায় আসবে সেটা বড়বাবু জানেন, কিন্তু কখন আসবে সেটা জানেন না। মানে, আদিত্য ফোন করে জানাতে পারেনি।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আদিত্য খেয়াল করেনি কখন থানার ভেতরে ঢুকে গেছে।
‘বলুন কী ব্যাপার?’ ঢুকেই সামনের টেবিলে একজন প্লেন ড্রেসের পুলিশ বসে আছে। সে বেশ ভদ্রভাবেই কথাটা জিজ্ঞেস করল। আদিত্য আন্দাজ করল এ কোনও এ এস আই হবে।
‘বড়বাবুর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।’ আদিত্য খানিকটা ইতস্তত করে বলল।
‘বড়বাবুর সঙ্গে কী দরকার?’ এ এস আই-এর গলাটা এবার সন্দিগ্ধ শোনাল।
‘দরকারটা, মানে একটু ব্যক্তিগত। কাল রাত্তিরে অ্যাডিশানাল কমিশনার গৌতম দাশগুপ্ত বড়বাবুকে আমার নাম করে ফোন করে দিয়েছেন। আমি আসব বড়বাবু জানেন।’ আদিত্য যথাসম্ভব বিনীতভাবে বলল।
‘ঠিক আছে, আপনি বসুন। বড়বাবু কাজে বাইরে গেছেন। মনে হয়, ফিরতে দেরি হবে। আপনি ওই বেঞ্চিটায় বসুন।’ গৌতম দাশগুপ্ত-র নাম শুনে এ এস আই-এর গলাটা একটু নরম শোনাল।
‘আমি তাহলে একটু চা খেয়ে আসি?’
‘আসুন। বড়বাবু আধঘন্টার আগে ফিরবেন বলে মনে হয় না। আচ্ছা, আপনার নামটা বলে যান। ইতিমধ্যে বড়বাবু ফিরে এলে বলে রাখব।’
আদিত্য নিজের নামটা একটা চিরকুটে লিখে এ এস আই-এর টেবিলে রাখল। ‘যদি বড়বাবু চলে আসেন বলবেন আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি।’
‘আপনি ধীরে-সুস্থে চা খেয়ে আসুন। বললাম তো, বড়বাবু আধঘন্টার আগে ফিরবেন না’। এ এস আই একটা মোটা খাতা খুলে কীসব লিখতে শুরু করল।
আদিত্যর খিদে পেয়েছে। সকালে তাড়াহুড়ো করে বেরতে গিয়ে কিছু খাওয়া হয়নি। সে থানা থেকে বেরিয়ে পূর্ণ সিনেমা অব্দি হেঁটে গেল। জায়গাটা ভীষণ বদলে গেছে। পূর্ণ, ভারতী দুটো সিনেমা হলই বন্ধ। বিজলি আর উল্টো ফুটপাথের ইন্দিরা সিনেমা কোনও রকমে চলছে। বনফুল রেস্টোরেন্টটা সবে খুলেছে। ওখানে চা পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগে কিছু খাওয়া দরকার। বনফুল-এ টোস্ট-অমলেট পাওয়া যেতে পারে। অন্য বিকল্প, রাস্তা পেরিয়ে ওপারে শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে গিয়ে কচুরি-জিলিপি খাওয়া। বহুদিনের দোকান। আশ্চর্য ব্যাপার, এই বদলে যাওয়া ভবানীপুরে এখনও এই মিষ্টির দোকানটা টিকে রয়েছে। খানিকটা স্মৃতিতাড়িত হয়ে আদিত্য রাস্তা পার হল। শ্রীহরি থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপরে সেই পুরোনো চায়ের দোকানটাও আছে। কচুরি-জিলিপি খাবার পর ওখানেই চা-টা খেয়ে নেওয়া যাবে।
মিনিট পঁয়ত্রিশ পরে একটা খবর কাগজ কিনে আদিত্য আবার থানায় ঢুকে দেখল এ এস আই ছেলেটি একাই তার টেবিলে বসে আছে। ‘বড়বাবু এখনও আসেননি।’ সে অল্প হেসে বলল। তার হাসিটা খানিক বিষণ্ণ ধরনের।
আদিত্য তার পূর্বনির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসে খবর কাগজটা মিনিট দুয়েক পড়েছে, দু-জন মহিলা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে থানার ভেতরে ঢুকলেন। দেখে মনে হয় মা আর মেয়ে। আদিত্য খবর কাগজে মুখ ঢেকে এ এস আই-এর সঙ্গে তাদের কথোপকথন শুনছিল।
‘বলুন।’ এ এস আই-এর গলা।
‘আমার মোবাইলটা চুরি হয়ে গেছে। সবাই বলল থানায় ডায়েরি করতে হবে।’ আদিত্য খবর কাগজের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখল মা চুপ করে আছে, মেয়ে কথা বলছে।
‘ডায়েরি নয়, ডুপ্লিকেটে একটা দরখাস্ত দিন। দরখাস্তর ডুপ্লিকেট কপিটা রিসিভ করিয়ে নিয়ে যান। নতুন সিমের জন্য লাগবে। দরখাস্তে আপনি যেন অফিসার ইন চার্জকে জানাচ্ছেন যে এই অঞ্চলে কোথাও আপনার মোবাইলটা হারিয়ে গেছে। চুরি গেছে লিখবেন না। দরখাস্ততে মোবাইলের নম্বর আর হারিয়ে যাওয়ার তারিখটা দেবেন। আর আপনার ঠিকানাটা। আপনি এই অঞ্চলে থাকেন তো?’
‘আমরা বেলতলা রোডে থাকি। কিন্তু চুরি গেছে লিখব না কেন? মোবাইলটা তো যতীন দাস পার্ক স্টেশনে চুরিই হয়েছে। আমি জানি ওখানেই চুরি হয়েছে।’
‘ম্যাডাম, আপনি যদি লেখেন চুরি হয়েছে তাহলে আমাদের ফর্মালি ডায়েরি নিতে হবে, তদন্ত করতে হবে। আমাদের অত ম্যান-পাওয়ার নেই। তাই বলছি, আপাতত হারিয়ে গেছে বলে আমাদের ইনফরমেশন দিন। তাতে আপনার এখনকার মতো কাজ চলে যাবে। আর মোবাইলটা যদি উদ্ধার করতে চান তাহলে বাড়ি গিয়ে দেখুন মোবাইলের বাক্সটা আছে কিনা। থাকলে দেখবেন ওটার গায়ে মোবাইল সেটটার একটা নম্বর লেখা আছে। এটা কিন্তু ফোন নম্বর নয়, মোবাইল সেটটার নম্বর। নম্বরটা আমাদের দিলে আমরা হয়ত সেটটা উদ্ধার করে দিতে পারব। মানে সেটটা যদি পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে কেউ ইউজ করে তাহলে ওটাকে আমরা ট্রেস করতে পারব। রাজ্যের বাইরে পাচার হয়ে গেলে কিছু করতে পারব না। ঠিক আছে?’
আদিত্য মনে মনে এ এস আই-এর ঠাণ্ডা মেজাজের প্রশংসা না করে পারল না।
ইতিমধ্যে আর একজন থানায় ঢুকেছে। আদিত্য খবর কাগজের আড়াল থেকে উঁকি মারল। নাঃ, বড়বাবু নয়। সাদা প্যান্ট কালো কোট পরা এক ছোকরা উকিল।
‘এই যে কোকিল সাহেব, খবর কী?’ এ এস আই উকিলকে লক্ষ করে বলল।
‘আমাদের আর কী খবর হবে? খবর তো সব তোমাদের। বড়বাবু এসেছে? কাল তো বিহারি ডাক্তার রোডের ওই ডাকাতির কেসটা কোর্টে ওঠার কথা। তার আগে একবার বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল।’ উকিলবাবু বললেন।
‘বড়বাবু নয়, মেজোবাবুর সঙ্গে কথা বলতে হবে। কেসটা এখন মেজোবাবুই দেখছে। বড়বাবু তোমাকে বলতে বলেছে। তুমি ভেতরে গিয়ে মেজোবাবুর সঙ্গে কথা বল।’
‘আগে একবার বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলে নিলে ভাল হতো। বড়বাবু ভেতরে আছে তো?’
‘কোথায় আছে? সেই সকালবেলা একটা ইনভেস্টিগেশনে বেরিয়ে এখনও ফেরেনি। যাওয়ার সময় মেজবাবুকে কেসটা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। তুমি মেজোবাবুর সঙ্গে কথা বল। নাকি তোমার বড়বাবুর সঙ্গে কথা না বললে মন উঠবে না? আপনাদের দরখাস্ত লেখা হল?’ শেষের বাক্যটা অবশ্য মোবাইল-হারা মা-মেয়ের উদ্দেশে।
উকিলবাবু ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। এ এস আই বলল, ‘একটা সিগারেটও দিয়ে যাবে না?’
‘সে কী? তোমরা থানার ভেতরে সিগারেট খাও?’ উকিলবাবু পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করতে করতে বলল।
‘থানার ভেতরে খাই না। বড়বাবু সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে খুব কড়াকড়ি করছে। থানার ভেতরে সিগারেট খাওয়া একেবারে বন্ধ। বাইরে যখন চা খেতে যাব তখন খাব।’
সিগারেটের কথা শুনে আদিত্যর ধূমপানের ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। সে উঠে দাঁড়িয়ে এ এস আই-কে বলল, ‘আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি।’
বাইরে বেশ রোদ্দুর। আদিত্য ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। একটা চা-ওলা দেখতে পেলে একটু চা খাওয়া যেত। আশুতোষ কলেজ অব্দি হাঁটতে পারলে হয়ত চা-ওলার দেখা মিলবে, কিন্তু এই রোদ্দুরে ওইটুকুও হাঁটতে ইচ্ছে করে না। আদিত্য দেখল ঘড়িতে এগারোটা। আপিসযাত্রীরা এখনও রাস্তায়। বাসে, মিনিবাসে ভিড়। বিজলি সিনেমায় দু-একজন টিকিট কাটতে ঢুকছে। দেখে আদিত্যর ভালই লাগল। কোনও পুরোনো জিনিসকে টিকে থাকতে দেখলে আদিত্যর ভাল লাগে। লাইটহাউস সিনেমায় হালে গজিয়ে-ওঠা জামাকাপড়ের দোকানটা আদিত্যর চোখকে রীতিমত পীড়া দেয়। কলকাতার সুন্দর জিনিসগুলো কি আর কিছুই থাকবে না?
হঠাৎ আদিত্য ডান চোখের কোনা দিয়ে দেখল কালো লম্বা-চওড়া চেহারার এক ভদ্রলোক একটা গাড়ি থেকে নেমে থানায় ঢুকে গেলেন। এক ঝলক দেখে ভদ্রলোককে চেনা-চেনা লাগল আর তার পর মুহূর্তেই আদিত্য উপলব্ধি করল ইনিই সেই বটুক সামন্ত যার সঙ্গে কথা বলার জন্য সারা সকাল সে হাপিত্যেস করে বসে আছে। চট করে সে তার আধখাওয়া সিগারেটটা ফেলে, জুতো দিয়ে মাড়িয়ে, নিভিয়ে, অর্ধেক জোরে হেঁটে অর্ধেক দৌড়ে গিয়ে ভদ্রলোকের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে থানার ভেতরে ঢুকল। ঢুকে শুনতে পেল সেই এ এস আই ছেলেটি বলছে, ‘আজ একটু বসতে হবে বটুকবাবু। বড়বাবু বাইরে গেছেন। অনেকক্ষণ গেছেন। এবার এসে পড়বেন।’
‘আপনার কাছে হাজিরাটা দিয়ে গেলে হবে না?’ বটুকবাবুর গলাটা গমগমে, সাহেবরা যাকে বলে ডিপ ব্যারিটোন।
‘না। ওটা বড়বাবুকেই দিতে হবে। একটু বসুন না।’
বটুকবাবু বেঞ্চির ওপর বসলেন। আদিত্য একটু দূরত্ব রেখে তার পাশে বসল। বসে খবর কাগজটা খুলে পড়তে লাগল। আদিত্যর ভাগ্য ভাল একটু পরেই এ এস আই ছেলেটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীর পায়ে দরজা দিয়ে থানার বাইরে বেরল। বোধহয় উকিলবাবুর কাছ থেকে পাওয়া সিগারেটটার সদ্ব্যবহার করার জন্যে।
আদিত্য বটুকবাবুর দিকে আর একটু সরে এসে চাপা গলায় বলল, ‘আপনি কি সত্যজিৎ সামন্ত?’
বটুকবাবু গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলেন। সম্ভবত আদিত্য যে পাশে বসে আছে সেটাই তিনি খেয়াল করেননি। আদিত্যর কথায় চোখ তুলে তাকালেন। ‘হ্যাঁ আমিই সত্যজিৎ সামন্ত। আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না?’ বটুকবাবু গমগমে গলায় বললেন।
‘আমাকে আপনি চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব বলে সেই সকাল থেকে এখানে বসে আছি।’
‘আমার সঙ্গে কথা বলবেন বলে সকাল থেকে বসে আছেন? শুনুন, আপনি যদি মিডিয়ার লোক হন তাহলে কেটে পড়ুন। মিডিয়াকে আমার কিচ্ছু বলার নেই।’ বটুকবাবু রীতিমত উত্তেজিত হয়ে বললেন। ‘পুলিশই বা কেমন? কোর্ট থেকে তো অর্ডার দিয়ে দিয়েছে, মিডিয়াকে আমার কথা কিছু জানানো হবে না। তবু আপনারা জেনে গেছেন? পুলিশকে কত টাকা খাইয়েছেন?’ বটুকবাবুর গলাটা তিক্ত শোনাল।
‘বটুকবাবু, আমি মিডিয়ার লোক নই। আমাকে জাহাঙ্গির খান আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য পাঠিয়েছে।’ আদিত্য মৃদুভাবে বলল।
‘জাহাঙ্গির খান?’ বটুকবাবুর কপালে তিন থাক ভাঁজ পড়েছে।
‘আজ্ঞে, জাহাঙ্গির খান। হালিশহরের জাহাঙ্গির খান। তিনি আমাকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পাঠিয়েছেন।’
‘কী বলছে জাহাঙ্গির খান?’
আদিত্য উত্তর দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দেখতে পেল এ এস আই দরজা দিয়ে ঢুকছে। সে গলাটা খুব নামিয়ে বলল, ‘এখানে বলা যাবে না। আপনার বাড়িতে দেখা করা যাবে?’
এ এস আই ছেলেটি ইতিমধ্যে আদিত্যদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বটুকবাবুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘এই মাত্র বড়বাবু ফোন করেছিলেন। একটা জরুরি তদন্তের কাজে আটকে গেছেন। কখন থানায় ফিরবেন উনি নিজেও জানেন না। ঘণ্টা দুয়েকও লাগতে পারে আবার ফিরতে ফিরতে বিকেলও হয়ে যেতে পারে। আমাকে বললেন আপনাকে দিয়ে হাজিরা খাতায় সই করিয়ে নিতে। মানে, এটা শুধু আজকের জন্যে। আপনি আমার সঙ্গে ভেতরে আসুন।’ তারপর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুনলেন তো আজ বড়বাবুর ফেরার কোনও ঠিক নেই। আপনি বরং আরেক দিন আসুন।’
বটুকবাবুকে নিয়ে এ এস আই ছেলেটি ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর আদিত্য উঠে পড়ল। উঠে এ এস আই-এর টেবিলের সামনে এসে দেখল তার নাম লেখা চিরকুটটা একটা পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রাখা রয়েছে। সে চিরকুটটা পকেটস্থ করল। ওটার আর প্রয়োজন নেই। বটুক সামন্তর সঙ্গে দেখা তো হয়েই গেল। তবে কথা এখনও শেষ হয়নি। আদিত্য ধীর পায়ে থানার বাইরে এসে ছায়ায় দাঁড়াল। একটা সিগারেট ধরাল। এখন কিছুক্ষণ বটুকবাবুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বটুকবাবুর গাড়িটা থানার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। হন্ডা অ্যাকর্ড, ওপর দিকের মডেল।
মিনিট পাঁচেক পরে বটুকবাবু থানা থেকে বেরলেন। তিনি গাড়িতে উঠতে যাবেন এমন সময় আদিত্য তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
‘ও আপনি! জাহাঙ্গিরের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না, ফোনটা পুলিশ ট্যাপ করে রেখেছে। আপনার সঙ্গেই কথা বলে নেব। আপনি জাহাঙ্গিরকে জানিয়ে দেবেন। জাহাঙ্গির কোনও চিঠি-টিঠি দিয়েছে?’
আদিত্য বটুকবাবুকে লেখা জাহাঙ্গির খানের চিঠিটা টি-শার্টের পকেট থেকে বার করে বটুকবাবুর হাতে দিল। খাম ছিঁড়ে তাতে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি সেটাকে পকেটে পুরলেন। তারপর বললেন, ‘২৩৪ প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে আমি থাকি। নীল রঙের দোতলা বাড়ি। আজ বিকেল পাঁচটায় আসবেন।’
গৌতম একটা মেসেজ করেছে। তাতে লেখা, সুদর্শন শিকদার, তারপর একটা দশ ডিজিটের সংখ্যা। সংখ্যাটা, বোঝাই যাচ্ছে, একটা মোবাইল নম্বর। সন্দেহ নেই, সুদর্শন শিকদার নামক ভদ্রলোকের নম্বর। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ আদিত্য মনে করতেই পারছিল না সুদর্শন শিকদার লোকটা কে? তারপর হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল সুদর্শন শিকদার বটুক সামন্তর কেসটা ইনভেস্টিগেট করছে। গৌতম বলেছিল তার নম্বরটা পাঠাবে। আদিত্য নিজেকে ধিক্কার দিল, এই স্মৃতিশক্তি নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করলে তার কপালে দুঃখ আছে।
সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। আদিত্য বনফুল রেস্টোরেন্টে ঢুকে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে মোবাইলে শিকদারের নম্বরটা লাগাল।
‘হ্যালো’ বলে ওপার থেকে যে শব্দটা এল সেটা আসলে একটা প্রশ্ন। অর্থাৎ ওপার থেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে ‘আপনি কে?’।
‘আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আমার কথা সম্ভবত অ্যাডিশানাল কমিশানার গৌতম দাশগুপ্ত আপনাকে বলেছেন। আপনার সঙ্গে ওই বটুক সামন্তর কেসটা নিয়ে একটু কথা বলতে চাইছিলাম।’ আদিত্য বিনীতভাবে বলল।
‘বুঝতে পেরেছি। স্যার আপনাকে হেল্প করতে বলেছেন। অবশ্য বলার দরকার ছিল না। আপনার কথা লালবাজারে সবাই জানে। আপনি বলুন কখন আসবেন।’
‘কখন এলে আপনার সুবিধে হবে আপনিই বলুন।’
ওপারে কিছুক্ষণ নীরবতা। মনে হল, শিকদার ভাবছে। আধ মিনিট ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘আপনি এখন কোথায় আছেন?’
‘ভবানীপুরে।’
‘আপনি আধঘন্টার মধ্যে লালবাজারে চলে আসতে পারবেন? তিনতলায় ইকনমিক অফেন্স-এর নতুন ডিপার্টমেন্ট হয়েছে, আমি সেখানে বসি।’
‘আমি চলে আসছি। তবে আধঘন্টার জায়গায় হয়ত চল্লিশ মিনিট হয়ে যেতে পারে।’
‘অসুবিধে নেই। তবে আমাকে একটা নাগাদ একটু বেরতে হবে।’
‘ঠিক আছে, আমি চলে আসছি।’
ইতিমধ্যে চা এসে গেছে। তাড়াহুড়ো করে জিভ পোড়ানোর কোনও মানে হয় না। আদিত্য চায়ে একটা চুমুক দিয়ে ধীরেসুস্থে সিগারেট ধরাল। ভবিষ্যৎ কার্যক্রম ঠিক করতে হবে। বটুকবাবুকে এক ঝলক দেখে ঠিক বোঝা গেল না লোকটা কেমন। কুমুদিনীর ব্যবসাটা সম্বন্ধেও আর একটু জানা দরকার। ফোন বাজছে। সাড়া দিতে একটি মেয়ে জানতে চাইল আদিত্য রান্নাঘরের চিমনি কিনতে উৎসাহী কিনা। তাকে নিরস্ত করে, চা ও সিগারেটের সদ্ব্যবহার করে, চায়ের দাম মিটিয়ে আদিত্য যখন রেস্টোরেন্ট থেকে বেরল তখন প্রায় পৌনে বারোটা।
‘আমার একটু দেরি হয়ে গেল। মেট্রো পাচ্ছিলাম না।’
‘কোনও অসুবিধে নেই। একটার সময় আমাকে বেরতে হচ্ছে না। ভাবছিলাম আপনাকে ফোন করে বলব ধীরেসুস্থে আসুন, তা কিছুতেই কানেকশান পেলাম না।’
‘আমি বোধহয় তখন মেট্রোতে ছিলাম।’
‘তাই হবে। এবার বলুন কী জানতে চান।’
সুদর্শন শিকদারের বয়েস যতটা কম হবে আদিত্য ভেবেছিল, ততটা কম নয়। ঈষৎ স্থূলকায়, রগের চুলে পাক ধরেছে। আত্মবিশ্বাসী।
আদিত্য বলল, ‘সম্প্রতি কুমুদিনী বিত্ত নিগমের যে কেসটা আপনি দেখছেন সেটার সম্বন্ধে একটু জানতে চাইছিলাম। কেন জানতে চাইছি বা ঠিক কী জানতে চাইছি সেটা পরিষ্কার করে বললে মনে হয় আপনার বুঝতে সুবিধে হবে।’
শিকদার উত্তর দিল না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে রইল। আদিত্য বলতে লাগল, ‘আপনি তো জানেন আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। আমার একজন ক্লায়েন্ট, নাম জাহাঙ্গির খান, ব্যবসায়ী, হালিশহরে বিড়ির বড় ফ্যাক্টরি আছে, কুমুদিনীতে বেশ কিছু টাকা ইনভেস্ট করেছিল। কুড়ি কোটির মতো। টাকাটা সম্ভবত বটুকবাবুর কাছে পৌঁছোয়নি। অন্তত জাহাঙ্গির খানের তাই ধারণা। বটুকবাবুর সঙ্গে অবশ্য আমার ক্লায়েন্টের সরাসরি কথা হয়নি। একটা সম্ভাবনা, টাকাটা যার হাত দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, যে কুমুদিনীর একজন বড় এজেন্ট, সে মেরে দিয়েছে।’
‘এই এজেন্টের নাম কী?’ আদিত্যকে থামিয়ে শিকদার প্রশ্ন করল।
‘ফিরদৌস রহমান। সে আবার আমার ক্লায়েন্টের আত্মীয় হয়। তাই আমার ক্লায়েন্ট বিশ্বাস করে তার হাত দিয়ে টাকাটা পাঠিয়েছিল।’
‘ফিরদৌস রহমান নামটা আমাদের পরিচিত। কুমুদিনীর তিনজন এজেন্ট, এদের সকলেরই কাজ কুমুদিনীর জন্য টাকা তোলা। গোবিন্দ রায়, ইনি কুমুদিনীর সব থেকে পুরোনো এজেন্ট। ফিরদৌস রহমানের কথা আপনি জানেন। আর শিবেন মাইতি, ইনিও পুরোনো। গোবিন্দ আর শিবেন প্রায় গোড়া থেকেই কুমুদিনীর সঙ্গে আছে। ফিরদৌস অনেক পরে এসেছে, তার বয়েসও অন্য দু-জনের তুলনায় কম।’
‘এদের কোনও সাব-এজেন্ট নেই?’
‘না। এরাই শুধু কুমুদিনীর জন্য টাকা তোলে। আর কেউ নয়। আসলে কুমুদিনীর বিজনেস মডেলটা বেশ আলাদা। এরা আমজনতার কাছ থেকে টাকা তোলে না। টাকা তোলে দু-চারজন বড়লোক পার্টির কাছ থেকে। অল্প টাকা নয়, অনেক টাকা। যে টাকাটা এরা তোলে তার বেশিরভাগটাই কালো টাকা, মানে তার ওপর ইনকাম ট্যাক্স দেওয়া নেই।’
‘টাকাটা নিয়ে এরা কী করে?’
‘বলছি। প্রথমে এরা এক-একটা প্রস্পেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট আইডেন্টিফাই করে। সাধারণত এদের চেনা কারও প্রজেক্ট। কখনও কখনও নতুন কারও প্রজেক্টও হতে পারে। কেউ হয়ত নতুন কোনও সিনেমায় টাকা ঢালতে চাইছে, কেউ নতুন একটা বার বা নাইট ক্লাব খুলতে চাইছে, কেউ হয়ত একেবারে আনকোরা নতুন ধরনের কোনও ব্যবসা শুরু করতে চাইছে। এই প্রজেক্টগুলো কোনওটাই বেআইনি নয়। তবে প্রত্যেকটাতে ঝুঁকি প্রচুর। প্রজেক্ট আইডেন্টিফাই করা হয়ে গেলে কুমুদিনীর এজেন্টরা ফাইন্যান্সার খুঁজতে শুরু করে। এই ফাইন্যান্সাররা সকলেই কুমুদিনীর চেনা। তাদের কাছেই এজেন্টরা অ্যাপ্রোচ করে। প্রজেক্ট পছন্দ হলে ফাইন্যান্সার প্রজেক্টে টাকা ঢালে, যে টাকাটা, আগেই বলেছি, সাধারণত কালো টাকা হয়। প্রজেক্টে ধার দিয়ে যে সুদটা পাওয়া যায় সেটা সাধারণত কুমুদিনী এবং ফাইন্যান্সারের মধ্যে ফিফটি-ফিফটি ভাগ হয়। আর প্রজেক্ট ফেল করলে ফাইন্যান্সার তার প্রিন্সিপালের ফিফটি পার্সেন্ট ফেরত পেয়ে যায়। এটা একটা ইনশিয়োরেন্স। টাকাটা কুমুদিনীর পকেট থেকে যায়। তবে কুমুদিনীর সিলেক্ট করা প্রজেক্টগুলো খুব রেয়ারলি ফেল করে। এসব আমরা বটুক সামন্তকে জেরা করে জানতে পেরেছি।’
‘এক সঙ্গে কটা প্রজেক্টে কুমুদিনী ধার দেয়?’
‘খুব বেশি নয়। বড় বড় প্রজেক্ট তো। আমাদের ধারণা সাইমাল্টেনিয়াসলি চার পাঁচটার বেশি প্রজেক্টে কুমুদিনী ধার দেয় না। বটুকবাবু সরাসরি কিছু বলেননি, তবে ওর সঙ্গে কথা বলে আমাদের এইরকম মনে হয়েছে।’
‘এই মুহূর্তে কুমুদিনী কাকে কাকে ধার দিয়েছে? ফাইন্যান্সিয়াররাই বা কারা? এসব জানতে পেরেছেন?’
‘এই আসল ইনফর্মেশনগুলোই তো জানতে পারছি না। বটুকবাবু বলছেন এসব তিনি কিছু জানেন না। এটা পরিষ্কার যে তিনি তার ক্লায়েন্টদের প্রোটেক্ট করছেন। যারা টাকা ধার নিয়েছে তারা তো আগ বাড়িয়ে এসে বলবে না যে তারা এত টাকা ধার নিয়েছে। আর যারা ধার দিয়েছে তারাও কিছু বলছে না কারণ সম্ভবত যে টাকাটা তারা ধার দিয়েছে সেটা ইনকাম ট্যাক্সের খাতায় দেখানো নেই।’
‘একজন ফাইন্যান্সারের নাম তো আমরা জানতে পারছি। জাহাঙ্গির খান। সে নিজেই আমাকে বলেছে অতীতে বেশ কয়েকবার সে কুমুদিনীকে টাকা দিয়েছে।’
‘হ্যাঁ, সেটা অবশ্য জানা গেল। কিন্তু শেষ যে কুড়ি কোটি সে দিয়েছে বলছে, সেটা কোথায় গেল জানা যাচ্ছে না।’
‘জাহাঙ্গির খান বলছে টাকাটা রোহিত ধামানি বলে একজন ফিল্ম প্রোডিউসারকে দেওয়ার জন্য বটুকবাবু চেয়েছিলেন। রোহিত ধামানি নাকি নতুন কী ছবি করছে তার জন্য টাকাটা দরকার।’
‘রোহিত ধামানির নামটা আমরাও কানাঘুষোয় শুনেছি। আপনার কাছ থেকে কনফার্মড হলাম।’
‘আচ্ছা, বটুকবাবুর এজেন্টেদের কাছ থেকে কিছু বার করা যায়নি?’
‘ও হো। আপনাকে তো বলতেই ভুলে গেছি। বটুকবাবু অ্যারেস্ট হওয়ার পর থেকে তিনজন এজেন্টই গা ঢাকা দিয়েছে। আমরা এখনও তাদের হদিশ করতে পারিনি।’
‘হুঁ, বুঝলাম। তা কুমুদিনীর আপিসের কেউ কিছু বলতে পারল না?’
‘এখন অব্দি কাউকে দিয়েই কিছু বলাতে পারিনি। চারজন অ্যারেস্টেড আছে, কিন্তু মুখ খুলছে না। আসলে এসব কেসে থার্ড ডিগ্রি করলে লাভ হয়। কিন্তু ইকনমিক ক্রাইমে থার্ড ডিগ্রি করার অসুবিধে আছে।’
‘আচ্ছা, বটুকবাবুর একজন সেক্রেটারি ছিল না? সে এখন কোথায়?’
‘সে তো ওই চারজন অ্যারেস্ট-হওয়াদের একজন। আপাতত আমাদের জিম্মাতেই আছে। কিন্তু কিছু বলছে না। মুখ টিপে আছে।’
‘সাধারণত বরোয়ার-লেণ্ডারদের নামের লিস্ট, কত টাকা তারা নিয়েছে বা দিয়েছে, কত টাকা বাকি আছে এইসব তথ্য কোনও কম্পিউটারে থাকে। আজকাল ইনটারেস্ট ক্যালকুলেট করার জন্যে অনেক সফটওয়ারও হয়েছে। তা, কুমুদিনীর অফিস থেকে সেরকম কোনও কম্পিউটার পাওয়া যায়নি?’
শিকদার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘অফিসে দশ-বারোটা ডেস্কটপ কম্পিউটার ছিল। কোনওটাতেই কাজের কিছু পাওয়া যায়নি। একটাতে স্টাফদের মাইনে, ছুটির হিসেব এইসব আছে। অন্য একটাতে চিঠিপত্র লেখা হয়, পুরোনো চিঠিগুলো সেভড আছে। ওপর ওপর কুমুদিনীর যেটা ব্যবসা, স্টক ব্রোকিং, সেই সংক্রান্ত সব চিঠি। আর বাকি কম্পিউটারগুলোয় স্টক কেনাবেচা হয়। কোনওটাই আমাদের জন্য দরকারি নয়।’
‘ল্যাপটপ, ট্যাবলেট এসব কিছু ছিল না?’
শিকদার আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর নিরাসক্ত গলায় বলল, ‘খুঁজেছিলাম। আর কিছু পাইনি। আরো খুঁজে দেখতে হবে। অফিসটা তো সিল করাই আছে।’
আদিত্যর মনে হচ্ছিল শিকদার মিথ্যে কথা বলছে। কুমুদিনীর অফিস থেকে সে কিছু একটা পেয়েছে, কিন্তু বলছে না কী পেয়েছে। আদিত্য অন্য প্রসঙ্গে গেল।
‘যে চারজন স্টাফকে আপনারা অ্যারেস্ট করেছেন ওরা ছাড়া কুমুদিনীর আর কতজন স্টাফ আছে?’
‘ওই চারজন ছাড়া আর যে কয়েকজন আছে তারা কেউ অ্যাসিস্টেটেন্ট কেউ সাব-স্টাফ মানে, কেউ কম্পিউটারে শেয়ার কেনাবেচা করে, চিঠিপত্র লেখে, হিসেবপত্র দ্যাখে, আবার কেউ কেউ বেয়ারা, ঝাড়ুদার, রেকর্ড সাপ্লায়ার। একজন ক্যান্টিনে চা বানায়। এদের সকলকেই আমরা ছেড়ে দিয়েছি। সত্যজিৎ সামন্ত ছাড়া তিনজন অফিসার আর সত্যজিৎ সামন্তর সেক্রেটারি এই চারজনকে আমরা কাস্টডিতে নিয়ে রেখেছি।’
‘আর ওই তিনজন এজেন্ট? যাদের কথা বললেন?’
‘আমরা যখন কুমুদিনী রেড করছিলাম, তারা কেউই অফিসে ছিল না। তাদের কথা পরে বটুকবাবুর কাছ থেকে জেনেছি। বটুকবাবু তাদের ঠিকানাও দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কাউকেই তাদের ঠিকানায় পাওয়া যায়নি।’
‘এরা জানল কী করে কুমুদিনী রেড হচ্ছে?’
‘বোধহয় ওই অ্যাসিস্টেন্ট বা সাব-স্টাফেদের কেউ ওদের জানিয়ে দিয়েছিল। এটা আমরা পরে আন্দাজ করেছি। রেড করার সময় তো এজেন্টদের অস্তিত্বই জানা ছিল না।’
‘আচ্ছা, ওই যাদের ছেড়ে দিয়েছেন তাদের ঠিকানাগুলো আছে তো? মানে দরকার হলে তাদের কন্ট্যাক্ট করা যাবে তো?’
‘ঠিকানাগুলো আছে। তবে সেগুলো ঠিক না ভুল চেক করা হয়নি। আসলে কুমুদিনীর মতো আরও অনেকগুলো কম্পানি রেড করা হল, আরও কয়েকটা হবে, তাই ম্যানপাওয়ারের একটু শর্টেজ রয়েছে।’
আরও দু-একটা প্রশ্ন করে আদিত্য উঠে পড়ল। শিকদার তাকে যা তথ্য দিয়েছে তার তুলনায় সে-ই বোধহয় শিকদারকে খবর দিয়েছে বেশি। জাহাঙ্গির এবং রোহিত ধামানির খবর শিকদার মনে হয় কিছুটা জানত। তবু আদিত্যর কাছ থেকে যাচাই করে নিতে পেরে ওর বেশ সুবিধে হল। লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। নিজের সংগ্রহ করা খবরগুলো চট করে কাউকে জানাতে চায় না। আদিত্য নিশ্চিত শিকদার আরও অনেক কিছু জানে।
লাঞ্চ খেতে আদিত্যর একটু দেরি হয়ে গেল। লালবাজার থেকে তার আপিস খুব দূরে নয়, হেঁটে মিনিট ছ-সাত। সুদর্শন শিকদারের দপ্তর থেকে বেরিয়ে সে দুটোর আগেই তার আপিসে পৌঁছে গিয়েছিল। এসে দেখে শ্যামল গেটে নেই। রোজ শ্যামল তার লাঞ্চ এনে দেয়, আজ তাহলে কে লাঞ্চ আনবে? সে শ্যামলের মোবাইলে একটা ফোন করল।
‘একটু কাজে বাগরি মার্কেট এসেছি স্যার। আধঘন্টার মধ্যে ফিরে আসছি।’ শ্যামল জানাল। ‘আমি ভাবলাম আপনি আজ আর আসবেন না।’
‘তুমি আসার সময় আমার জন্য খাবারটা নিয়ে এস। ওই একই খাবার। একটা প্লেন ধোসা আর একটা শসা।’
‘এখন বোধহয় ধোসা আর পাওয়া যাবে না। অন্য কিছু আনব?’
‘তাহলে টোস্ট আর ঘুগনি এনো। আর শসা।’
‘একটা মামলেট ভাজিয়ে আনব?’
‘ঠিক আছে নিয়ে এস। তবে তাড়াতাড়ি এস। তোমার সঙ্গে টাকা আছে তো?’
‘যেটুকু আছে তাতে টোস্ট-ঘুগনি-মামলেট হয়ে যাবে স্যার।’
আদিত্য ফোনটা অফ করে কেটলিতে জল গরম করতে দিল। খাবার আসতে দেরি হবে। ততক্ষণে একটা কফি খাওয়া যেতে পারে। একটু গানও শোনা যেতে পারে। সকালে সে ল্যাপটপটা আপিসে রেখে গিয়েছিল। সেটা অন করে আলি আকবরের মধুমত সারং লাগাল। আদিত্যর মনে পড়ে গেল বাবা তাকে বলেছিল আলি আকবররা দুই নিষাদ লাগিয়ে যেটা মধুমত সারং বলে বাজান, অন্য বেশিরভাগ ঘরানায় তাকেই বলে বৃন্দাবনী সারং। আর বৃন্দাবনী সারং বলে যেটা বাজান তাতে শুধু শুদ্ধ নিষাদটাই লাগে। মধ্যলয় ত্রিতালে গত। স্বপন চৌধুরি অসাধারণ সঙ্গত করছেন। আদিত্য এত মগ্ন হয়ে বাজনা শুনছিল, খেয়াল করেনি কফির জলটা অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। কফি নিয়ে বসতে না বসতেই খাঁ সাহেব দ্রুত একতালে অন্য গত ধরলেন।
বাজনাটা বেশি লম্বা নয়। উনিশ মিনিট। শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কেয়ার ফোন।
‘ঠিকমত পৌঁছলাম কি না জানার জন্যে একটা ফোন পর্যন্ত করলে না।’ কেয়ার গলায় প্রবল অভিযোগ।
‘বিশ্বাস কর, কাজের খুব চাপ ছিল। আমি সারা সকালটা ভবানীপুর থানা আর লালবাজারে কাটিয়েছি। এখনও লাঞ্চটাই খাওয়া হয়নি। এইমাত্র আপিসে এসে ভাবছিলাম তোমাকে ফোন করব।’ আদিত্য কাতরভাবে বলল।
শেষের কথাটা অবশ্য একেবারে মিথ্যে নয়। মধুমত সারং-এর পর গৌড় সারং শোনার ইচ্ছে ছিল আদিত্যর। তবে তার আগে সে সত্যিই ভেবেছিল কেয়াকে একটা ফোন করে নেবে।
‘লাঞ্চ খাওনি কেন?’
‘যে ছেলেটা খাবার এনে দেয় সে একটু অন্য জায়গায় গেছে। এক্ষুনি এসে পড়বে। তুমি এখন কোথায়?’
‘বাগডোগরা থেকে গাড়িতে উঠে ডুয়ার্সের দিকে যাচ্ছি। এখনও জঙ্গলে ঢুকিনি। লোকবসতির মধ্যেই আছি। হয়ত এর পরে আর সিগনাল পাওয়া যাবে না, তাই ফোন করে নিলাম।’
‘খুব ভাল করেছ। আমি রাত্তিরের দিকে ফোনের চেষ্টা করব। দেখি সিগনাল পাই কি না। ততক্ষণে পৌঁছে যাবে নিশ্চয়।’
‘ঠিক আছে রাত্তিরে কথা হবে।’
ফোনটা রেখে কফির অবশিষ্টাংশ গলাধঃকরণ করল আদিত্য। তারপর আবার ফোনটা হাতে নিয়ে বিমলের নম্বরটা লাগাল। নম্বরটা বেজে যাচ্ছে। বিমল গেল কোথায়? তার তো নাইট ডিউটি। এই সময় তার বাড়িতে থাকার কথা। ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল। রেকর্ডেড মেসেজ মহিলার গলায় বলল, আপনি যাকে কল করছেন তিনি এখন আপনার কলটা নিতে পারছেন না। ফোনটা নামিয়ে রেখে আদিত্য মত পরিবর্তন করে গৌড় সারং-এর বদলে আলি আকবর খাঁ সাহেবের বিলাসখানী টোড়ি লাগাল। লাগাতে না লাগাতে ফোনটা বেজে উঠেছে। বিমল ফোন করছে। বাজনাটা পজে দিয়ে ফোনটা ধরল আদিত্য।
‘জোর ঘুমিয়ে পড়েছিলুম স্যার। আপনার ফোনটা শুনতেই পাইনি। গিন্নি ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলল, ফোন বাজছে।’ বিমলের গলা থেকে এখনও ঘুমের রেশ কাটেনি।
‘তোমার খবর কী? অনেকদিন আস না, ফোন-টোনও কর না।’
‘গত এক মাস খুব ঝামেলায় ছিলাম স্যার। আপনি তো জানেন, ছেলেটা মানুষ হল না। লেখাপড়া শিখল না। কাজটাজও কিছু করে না। তো আমি এসব নিয়ে একদিন খুব বকাবকি করেছিলুম। পরদিন থেকে বাবু বাড়ি ছেড়ে বেপাত্তা। গিন্নি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিল। সারাদিন আমাকেই দুষছে। আমি ওরকম করে না বললে ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যেত না।’
‘পুলিশে খবর দাওনি?’
‘না স্যার। পুলিশ অব্দি যাইনি। আসলে আমার একটু রাগ হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল, খুঁজে কী হবে? দুদিন বাদে পেটে টান পড়লে নিজের থেকেই সুড়সুড় করে বাড়ি ফিরে আসবে। বলতে কি, আমার একটা জেদ চেপে গিয়েছিল। আমি তো ছেলেকে অন্যায্য কিছু বলিনি। গিন্নিই ওকে আদর দিয়ে নষ্ট করেছে। আমার জেদ, আমি কিছুতেই নিজের থেকে খোঁজ করব না। এইভাবে দিন কুড়ি কেটে গেল। গিন্নি না খেয়ে না ঘুমিয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। মেয়েটাও দাদার জন্য কান্নাকাটি করে। আমি ভাবলাম, এইবার জেদ ছেড়ে ছেলেটার খোঁজ করা দরকার। ঠিক এই সময় আমার মেয়ের মোবাইলে ছেলের মেসেজ এল। সে দিল্লি গিয়ে রাজমিস্তিরির জোগাড়ের কাজ করছে। আমাদের বস্তি থেকে কিছু লোক কাজ নিয়ে দিল্লি গিয়েছিল। ও আমাদের কিছু না বলে তাদের ওখানে চলে গেছে। তাদের সঙ্গে থাকে, তারাই কাজ জোগাড় করে দিয়েছে। নয়ডায় একটা খুব উঁচু বাড়ি উঠছে। সেখানে কাজ পেয়েছে। আমার সঙ্গে ছেলের কথা হয়নি, তবে গিন্নির সঙ্গে হয়েছে, আমার মেয়ের সঙ্গে হয়েছে। ওরা খুব খুশি। আমিও খুশি কারণ এতদিনে ছেলেটা নিজে রোজকার করছে।’
বিমলের দীর্ঘ সংলাপের মাঝে আদিত্যর লাঞ্চ এসে গেছে। সে খেতে খেতে বিমলের কথা শুনছিল। অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিমলের পরিবারে কোনওরকম ঝামেলা হচ্ছে না এরকম আদিত্য আগে কোনও দিন শোনেনি।
‘তাহলে এখন তো তোমার আর কোনও সমস্যা নেই।’ আদিত্য ওমলেটের একটা টুকরো মুখে দিয়ে ঈষৎ জড়ানো উচ্চারণে বলল।
‘না স্যার। ঝামেলা আছে। এখন বউ বায়না ধরেছে ছেলেকে দেখতে সে দিল্লি যাবে। কিন্তু কার সঙ্গে যাবে? ও তো আর একা ট্রেনে করে যেতে পারবে না। আর আমার পক্ষে এখন ছুটি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কম্পানি আমাকে কিছুতেই ছুটি দেবে না।’
‘হুঁ, বুঝলাম। একটু ভাল করে বুঝিয়ে বললে তোমার গিন্নিও বুঝতে পারবে। বিশেষ করে বোলো যে দিল্লিতে তোমাদের থাকার কোনও জায়গা নেই। তোমার ছেলে নিশ্চয় অনেকের সঙ্গে একটা ঘরে থাকে। সেখানে তার মা গিয়ে কোথায় থাকবে?’
‘অবশ্যই বলব স্যার। এই পয়েন্টটা আমার মাথায় আসেনি। এবার আপনি বলুন স্যার। নিশ্চয় কোনও দরকারে ফোন করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, একটা দরকার ছিল। সিনেমা পাড়ায়, মানে টালিগঞ্জে একটু খোঁজখবর করতে হবে। পারবে তো?’
‘নিশ্চয় পারব স্যার। আমি যে বাড়িটাতে সিকিউরিটির কাজ করি সেটা সিনেমা পাড়া থেকে হেঁটে মিনিট দশেক। আমার কোনও অসুবিধে হবে না স্যার। আপনি বলুন কী জানতে হবে।’
‘তাহলে শোনো। রোহিত ধামানি বলে টালিগঞ্জের সিনেমা পাড়ায় একজন প্রোডিউসার আছে। তার সম্বন্ধে যা-কিছু জানা যায় জেনে এস। ধামানি এখন ‘ফেরারি’ বলে একটা হাই-বাজেট ছবি করছে। এত টাকার ছবি নাকি টালিগঞ্জে আগে হয়নি। কিছু শুটিং বিদেশে হয়েছে। আরও কিছু হবে। এই ছবিটার প্রোডিউসারের সম্বন্ধে আমার বিশেষ করে জানা দরকার। আর ছবিটার সম্বন্ধেও। ছবিটা কতটা বাকি, যদি ছবির কাজ এখন আটকে গিয়ে থাকে তাহলে কেন আটকে গেছে এইসব কিছু জানতে হবে। প্রোডিউসারের নাম রোহিত ধামানি আর ছবির নাম ‘ফেরারি’। মনে থাকবে তো?’
‘মনে থাকবে স্যার, অবশ্যই মনে থাকবে।’
‘আর হ্যাঁ। ‘ফেরারি’র ইনডোর শুটিং হচ্ছে টালিগঞ্জ পাড়ায় ছায়াছবি বলে একটা স্টুডিওতে। এটা আনকোরা নতুন একটা স্টুডিও, বছর খানেক হল তৈরি হয়েছে। এই স্টুডিওটা নাকি বোম্বাই বা সাউথ ইণ্ডিয়ার বেস্ট স্টুডিওগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। সব আধুনিক ফেসিলিটি নাকি এদের আছে। তুমি ওখানে গিয়ে খোঁজ কোরো।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
‘আশা করি তুমি দু-এক দিনের মধ্যে কিছু খবর পেয়ে যাবে। খবর পেলে চলে এস। আমিই তোমাকে ফোন করে বলে দেব কোথায় আসতে হবে, মেসে না আপিসে। আর যখন আসবে তখন তোমার পেমেন্টটা করে দেব।’
‘আপনি পেমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত হবেন না স্যার। আগে খবরটা তো আনি।’
২৩৪ নম্বর বাড়িটা প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের উত্তর প্রান্তে। ছিমছাম দোতলা বাড়ি, সদ্য রঙ করা হয়েছে। বাড়ির নাম ‘কুমুদিনী’। অতএব এটা যে বটুকবাবুরই বাড়ি তা নিয়ে সন্দেহ নেই। রাস্তা থেকে দেখা যায় দোতলার বারান্দাটা গাছপালায় ভর্তি। ক্যাকটাস, অর্কিড, পাতাবাহার। দু-একটা ফুলগাছের টবও রয়েছে। একটা লোহার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই ড্রাইভওয়ে। সকালে দেখা হন্ডা অ্যাকর্ডটা সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে পাশাপাশি দুটো গ্যারেজ। একটা ফাঁকা, সম্ভবত সেটাই হন্ডা অ্যাকর্ড-এর বাসস্থান। অন্য গ্যারেজটাতে একটা বড় গাড়ি বিশ্রাম করছে। এক ঝলক দেখে আদিত্যর মনে হল বি এম ডাবলু।
ড্রাইভওয়ের একপাশে সদর দরজা। আদিত্য বেল বাজিয়ে নিজের ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা বাজতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি আছে। তার মানে সময়ের আগেই পৌঁছে গেছে সে। উর্দিপরা বেয়ারা দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। আদিত্য নিজের নাম বলতে সে ঘাড় নাড়ল। নিশ্চয় তাকে বটুকবাবু নামটা বলে রেখেছেন।
বটুকবাবুর বসার ঘরটা রীতিমত বড়। যেমন বড়লোকদের হয়। কিন্তু আদিত্যর মনে হল আসবাবগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব আছে। যেন কিছু দামি দামি আসবাব তাড়াহুড়ো করে পাশাপাশি রেখে ঘরটা ভরিয়ে ফেলা হয়েছে, কিন্তু একটার পাশে আর একটাকে মানায় কি না তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করা হয়নি।
আদিত্যকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই দোতলার সিঁড়ি দিয়ে বটুকবাবু নেমে এলেন। খোলা দরজা দিয়ে আদিত্য দেখতে পেল তিনি নেমে আসছেন। পরনে গেরুয়া সিল্কের লুঙ্গি, সাদা সিল্কের ফতুয়া।
‘বলুন, জাহাঙ্গির কী বলে পাঠিয়েছে। ফিরদৌস কোথায় গেল? ফিরদৌস? আগে তো তাকে দিয়েই খবর পাঠাত জাহাঙ্গির। ফিরদৌস কি পুলিশের হেফাজতে রয়েছে?’ বটুকবাবু গমগমে গলায় বললেন।
‘ফিরদৌসকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশও জানে না, জাহাঙ্গির সাহেবও জানেন না সে কোথায় আছে। তাই জাহাঙ্গির সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন।’ আদিত্য সহজ গলায় বলল।
‘ফিরদৌসকে পাওয়া যাচ্ছে না?’ বটুকবাবুর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ‘আমি তো ভাবছিলাম ওকেও পুলিশ ধরেছে।’
‘তার থেকেও বড় একটা প্রশ্ন আছে। রোহিত ধামানির নতুন ছবিতে ইনভেস্ট করার জন্য কুড়ি কোটি টাকা জাহাঙ্গির খান ফিরদৌসের হাত দিয়ে আপনার কাছে পাঠিয়েছিল। ফেব্রুয়ারির আট তারিখে। আপনি কি সেই টাকাটা পেয়েছেন?’
প্রশ্নটা শুনে বটুকবাবুর মুখে পরপর কয়েকটা অভিব্যক্তি খেলে গেল বিস্ময়, অবিশ্বাস, দুশ্চিন্তা, হতাশা। আদিত্যর মনে হল, অভিব্যক্তিগুলো যদি বানানো হয় তাহলে বটুকবাবু খুব উঁচু দরের অভিনেতা। সে বটুকবাবুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য খানিকটা সময় দিল। তারপর বলল, ‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি টাকাটা পাননি। তাহলে ধরে নিতে হবে ফিরদৌসের কাছেই টাকাটা আছে।’
‘শুনুন, কিছুদিন আগে এক কোটি টাকা ফিরদৌস আমাকে এনে দিয়েছিল। কুড়ি কোটি নয়, এক কোটি। কুড়ি হাজার পাঁচশ’ টাকার নোট। তবে সেটা অন্য ইনভেস্টারের কাছ থেকে এসেছিল। কিন্তু কুড়ি কোটি টাকা তো ফিরদৌস আমাকে দেয়নি।’
‘এই এক কোটি টাকা কবে নাগাদ ফিরদৌস আপনাকে এনে দিয়েছিল?’
‘দিনটা আমার মনে আছে। যেদিন কুমুদিনী রেড হল তার ঠিক আগের দিন, মানে ওই ফেব্রুয়ারির আট তারিখেই।’
‘জাহাঙ্গির খান বলছেন, আট তারিখে কুড়ি কোটি টাকা নিয়ে রওনা হওয়ার আগে জাহাঙ্গির খানের ফোন থেকে ফিরদৌস আপনার সেক্রেটারিকে ফোন করে বলেছিল সে টাকা নিয়ে আসছে এটা যেন আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। আপনার সেক্রেটারি আপনাকে কিছু জানায়নি?’
‘জানিয়েছিল। আমার সেক্রেটারি আমাকে বলেছিল ফিরদৌস টাকা নিয়ে আসছে। আমি ধরে নিয়ে ছিলাম ওই এক কোটি টাকা নিয়ে ফিরদৌস আসছে। কারণ এটা নিয়ে ফিরদৌসের সঙ্গে তার আগের রাত্তিরে আমার কথা হয়েছিল।’
‘তাহলে তো ধরে নিতে হবে কুড়ি কোটি টাকাটা ফিরদৌসের কাছেই আছে।’ আদিত্য চিন্তান্বিত গলায় বলল।
‘যদি ধরে নিই পুলিশের ঝামেলার ফলে সে টাকাটা আমার কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি তাহলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে টাকাটা সে জাহাঙ্গিরকে ফেরত দিয়ে দিল না কেন?’ বটুকবাবুর গমগমে গলাটা হঠাৎ খুব দুর্বল শোনাচ্ছে।
‘এমন তো হতে পারে জাহাঙ্গির খান টাকাটা আদৌ ফিরদৌসকে দেয়নি। আমাদের বিপদ দেখে জাহাঙ্গির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে।’
কথাটা যিনি বললেন তিনি কখন পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছেন আদিত্য টের পায়নি। কথাটা বলে তিনি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। আদিত্য দেখল, যৌবন-উত্তীর্ণ এক মহিলা, ঈষৎ চাপা রঙ, ছোট কাটের ব্লাউজ, উদ্ধত নারীত্ব, চেহারায় এখনও কিছু চটক বাকি রয়ে গেছে। আদিত্য এর ছবি ইন্টারনেটে, খবর কাগজে দেখেছে। তার অনুমান করতে কষ্ট হল না ইনিই সুমনা ঘোষাল।
‘তুমি আবার নিচে নেমে এলে কেন?’ বটুক সামন্তকে বিচলিত দেখাল।
‘তোমাদের কথা শুনে নিচে নেমে এলাম। ভাবলাম জাহাঙ্গির খান কাকে পাঠাল একবার দেখে আসি।’
‘আমার মনে হয় তুমি মিথ্যে সন্দেহ করছ। ইনি জাহাঙ্গির খানের চিঠি নিয়ে এসেছেন। আর যদি বল জাহাঙ্গির আমাকে ঠকাবার চেষ্টা করছে, আমি সে কথা মানব না। বহুদিন ব্যবসা করছি, আমি লোক চিনি।’
বটুকবাবুর কথাটা প্রায় অগ্রাহ্য করে সুমনা ঘোষাল আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি জাহাঙ্গির খানের কম্পানিতে কাজ করেন? আপনাকে আগে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’
‘আমি জাহাঙ্গির খানের কম্পানিতে কাজ করি না। পেশায় আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। কুড়ি কোটি টাকা সন্ধান করার জন্য জাহাঙ্গির খান আমাকে নিয়োগ করেছেন।’ আদিত্য সুমনা ঘোষালের দিকে তাকিয়ে বলল।
‘আপনি গোয়েন্দা?’ বটুকবাবুর চোয়ালটা শক্ত হল।
‘চিন্তা করবেন না বটুকবাবু। পুলিশের সঙ্গে আপনার যে সমস্যাটা চলছে সেখানে আমার কোনও ভূমিকা নেই। আমার একটাই উদ্দেশ্য। আমার মক্কেল জাহাঙ্গির খানের কুড়ি কোটি টাকা কোথায় গেল সেটা সন্ধান করা।’
‘টাকাটা কিন্তু ফিরদৌস আমাকে দেয়নি। ওই ধরনের জোচ্চুরির কারবার করলে আমি এতদিন ব্যবসা চালাতে পারতাম না।’ বটুকবাবুর গলাটা প্রায় অসহায় শোনাল।
‘আমি আপনার কথাটা জাহাঙ্গির খানকে জানিয়ে দেব। তবে আমার মনে হয় আর একটা খবর আপনার জানা দরকার। শুধু ফিরদৌস নয়, আপনার অন্য দু-জন এজেন্ট, গোবিন্দ রায় এবং শিবেন মাইতি, তারাও কিন্তু নিখোঁজ। অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ এখনও তাদের সন্ধান করতে পারেনি।’
‘আপনি এটা কী করে জানলেন?’ সুমনা ঘোষাল উদ্ধতভাবে আদিত্যকে আক্রমণ করল।
‘লালবাজারে আমার কিছু চেনাশোনা আছে। তাদের কাছ থেকে জেনেছি। অবাক হচ্ছি, খবরটা বটুকবাবুর কাছে এতদিনেও পৌঁছয়নি কেন?’ আদিত্য সুমনার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘এ কিন্তু পুলিশের লোক। আমি তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি। এর সঙ্গে খুব ভেবেচিন্তে কথা বল।’ সুমনা বটুকবাবুর দিকে খানিকটা সরে গিয়ে বলল। যেন আদিত্যর কাছাকাছি থাকলে তার ক্ষতি হয়ে যাবে।
‘মিতুল তুমি ওপরে যাও। আমি এই ব্যাপারটা দেখছি।’ বটুকবাবুর গলায় সেই পুরোনো কর্তৃত্বটা ফিরে এসেছে। ‘এর মধ্যে তোমার থাকার কোনও প্রয়োজন দেখছি না।’
সুমনা ঘোষাল একটু একটু করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। সিঁড়ির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে গলা তুলে বলল, ‘সাবধানে এই লোকটার সঙ্গে কথা বোলো। লোকটা খারাপ মতলবে এসেছে, আমি বলে দিচ্ছি।’
সুমনা চলে যাওয়ার পর বটুকবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছেন। তারপর থেমে থেমে বললেন, ‘আপনার কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। আপনি তো প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনি নিশ্চয় টাকাটার সন্ধানে ফিরদৌসের খোঁজ করবেন। যদি ফিরদৌসের খোঁজ পেয়ে আমাকে জানাতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে আলাদা করে একটা পারিশ্রমিক দেব। জাহাঙ্গির যা দেবে তার ওপর। আর যদি গোবিন্দ বা শিবেনের সন্ধানও দিতে পারেন তাহলে আরও কিছু পারিশ্রমিক আপনার পাওনা হবে। কিন্তু ফিরদৌস, গোবিন্দ বা শিবেনের সন্ধান পেলেও আপনি পুলিশকে জানাতে পারবেন না। আপনি কি আমার প্রস্তাবে রাজি আছেন?’
আদিত্য খানিকটা চিন্তা করে বলল, ‘আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি আছি। তবে একটা শর্তে। আপনার ব্যবসা সংক্রান্ত কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হবে।’
‘সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। আপনি প্রশ্ন করুন, উত্তর দেওয়ার হলে আমি দেব।’
‘ঠিক আছে। আমার প্রথম প্রশ্ন, এই মুহূর্তে আপনার কোথায় কোথায় টাকা খাটছে? অর্থাৎ আপনার ব্যবসা হঠাৎ উঠে গেলে কোন কোন পার্টিকে আর টাকা ফেরত দিতে হবে না?’
‘পুলিশ আমাকে এই প্রশ্নটা বারবার করেছিল। আমি উত্তর দিইনি কারণ ক্লায়েন্টদের প্রোটেক্ট করা আমার প্রধান দায়িত্ব। মাফ করবেন, আপনাকেও এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। আজ আপনার সঙ্গে প্রথম দেখা। আমি জানি না আপনাকে কতটা বিশ্বাস করা যায়। পরের প্রশ্ন?’
‘আমি ধরে নিচ্ছি ওই একই কারণে এই মুহূর্তে আপনার ফাইন্যান্সার কারা সেটাও আপনি আমাকে বলবেন না।’
‘আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন।’
‘আমার পরের প্রশ্ন, যে এক কোটি টাকা ফিরদৌস আপনাকে আট তারিখে এনে দিয়েছিল, সেই টাকাটা এখন কোথায়?’
বটুকবাবুর চোয়াল শক্ত হল। তিনি বললেন, ‘এই প্রশ্নটার উত্তরও আমি দিতে পারব না।’
‘তাহলে আর একটা প্রশ্নই আপনাকে করব। জাহাঙ্গির খান যখন তার টাকার খোঁজ নিতে আপনার দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করেছিল তখন একজন মহিলা ফোনটা ধরে বলেছিলেন আপনার কম্পানি জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে কুড়ি কোটি টাকা পায়নি। আপনি কি বলতে পারেন এই মহিলা কে হতে পারে?’
আদিত্য লক্ষ করল চকিতে বদলে যাচ্ছে বটুকবাবুর মুখের অভিব্যক্তি। একটা ভয়, একটা আশঙ্কার ছায়া যেন তার মুখে। মিনিট খানেকের মধ্যেই অবশ্য বটুকবাবু নিজেকে সামলে নিলেন। শান্ত গলায় বললেন, ‘না, কে ফোন ধরেছিল আমি ঠিক বলতে পারব না। এটা আমার সেক্রেটারির আরেকটা নম্বর। আমি এইটুকু জানি যে আমার সেক্রেটারি শৌভিক নন্দকে আমার সঙ্গেই পুলিশ ধরেছিল। সে এখনও পুলিশের কাস্টডিতেই আছে। কিন্তু তার মোবাইলটা সে কোথায় রেখে এসেছে আমি বলতে পারব না। অতএব সেই মোবাইলে কে ফোন ধরেছিল তাও আমার জানা নেই।’
আদিত্য চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন, বটুকবাবু। আপনার প্রস্তাবটা আমি গ্রহণ করতে পারলাম না। তবে যে কাজে আমি এসেছিলাম সেটা হয়ে গেছে। এইবার জাহাঙ্গির খানের কাছে আমার রিপোর্ট জমা দিতে পারলেই আমার কাজ শেষ। আমাকে সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। চললাম, নমস্কার।’
বাইরে এসে আদিত্য দেখল আকাশে মেঘ জমেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। দু-একটা বৃষ্টির ফোঁটা তার গায়ে এসে পড়ল। সঙ্গে ছাতা নেই। জোরে বৃষ্টি নামার আগে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে মেট্রো স্টেশনে পৌঁছতে হবে। আদিত্যর ভাগ্যটা ভাল যাচ্ছে বলতে হবে। সে মেট্রো স্টেশনে পৌঁছোনোর আগেই এক ঝলক ঝোড়ো হাওয়া এসে মেঘগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। আর তারপর থেকে একটা আশ্চর্য উজ্জ্বল আলোতে সারা আকাশটা ভরে গেছে। কনে দেখা আলো। ঘড়িতে ছটা বাজে।
মেসে ফিরে আদিত্য কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল। সাধারণত এরকম অসময় ঘুমোনো তার অভ্যেস নেই, কিন্তু আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। বস্তুত আলোটা না নিভিয়েই সে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়েছিল। কখন আপনা থেকেই চোখ দু-টো বন্ধ হয়ে এসেছে সে বুঝতেই পারেনি। বলরামের হাঁকাহাঁকিতে চোখ খুলতে হল।
‘একজন লোক আপনার খোঁজ করছে। নিচে সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল তোমার বাবুকে একবার ডেকে দাও না।’
‘কোন বাবুকে ডাকতে বলেছে? এখানে তো অনেক বাবু আছে। আমাকেই ডাকছে বুঝলি কী করে?’
‘আমি তোমার নাম জানি না নাকি? হিন্দিতে আমাকে বলল আদিত্যবাবু এখানে থাকে? তাকে একবার ডেকে দাও না ভাই।’
আদিত্য একটু অবাক হয়েছে। এখানে সাধারণত কেউ তার খোঁজ করতে আসে না। এখানে কে এল? সে বাইরে যাবার জামা-প্যান্ট পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বলরামকে বলল, ‘তুই নিচে গিয়ে লোকটাকে দাঁড়াতে বল। আমি এক্ষুনি আসছি।’ পরে বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে, কাবলি জুতোটা পায়ে গলিয়ে নিয়ে সে একতলায় নেমে দেখল রোগা বেঁটে মত একটা লোক সদর দরজার বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছে। লোকটাকে আদিত্য আগে কখনও দেখেনি।
‘নমস্তে সাব। আপনিই তো আদিত্যবাবু আছেন?’
লোকটা অবাঙালি, বাংলায় পশ্চিমা টান।
‘কী ব্যাপার?’ আদিত্য প্রতি নমস্কার করে বলল।
‘আপনি কি সাব আমার সঙ্গে একটু আসতে পারবেন? বেশি দূরে নয়। এই নাখোদা মসজিদের কাছে।’
‘আমি হঠাৎ সেখানে যেতে যাব কেন?’ আদিত্য সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘সাব, ওখানে আপনার জন্যে ফিরদৌস রহমান ইন্তজার করছে। আপনার সোঙ্গে দোমিনিট কথা বোলতে চায়। ফিরদৌস বলছে এখানে আসা ওর জন্যে সেফ নয়। আপনাকে খুব রিকোয়েস্ট করেছে, কি আপনি যদি একবার আসেন। আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে লিয়ে যাবার জন্য।’
আদিত্য এক মুহূর্ত ভেবে ঠিক করে ফেলল সে যাবে। নাখোদা মসজিদের ওদিকটা খুব নিরাপদ পাড়া নয়। কিন্তু ওইটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। সে লোকটাকে বলল, ‘আপনি আগে আগে চলুন। আমি আপনাকে ফলো করছি।’
আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে লোকটা মহাত্মা গান্ধী রোড ধরল। কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে রাস্তা পার হয়ে দক্ষিণ দিকের ফুটপাথে উঠে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরেই চিত্তরঞ্জন এভিনিউ-এর মোড়ের দিকে হাঁটা লাগাল। লোকটা যে গতিতে হাঁটছে আদিত্য অত তাড়াতাড়ি হাঁটে না। সে একটু হাঁপিয়ে যাচ্ছিল। সিগারেট খাবার পরিণতি। আর একটা সমস্যা হল হাঁটতে হাঁটতে লোকটা মাঝে মাঝেই পিছন ফিরে দেখছিল আদিত্য ঠিকঠাক আসছে কিনা। কেউ যদি তাদের ফলো করে তাহলে সে সহজেই বুঝে যাবে আদিত্য কোথায় যাচ্ছে। মহাত্মা গান্ধী রোডে ভিড় আছে। মেহবুব ব্যান্ড এবং আরও ছোটখাট দু-একটা ব্যান্ডপার্টির দোকান পেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা চিত্তরঞ্জন এভিনিউ-এর মোড়ে পৌঁছল। চিত্তরঞ্জন এভিনিউটা পার হয়ে এইবার চিত্তরঞ্জন এভিনিউ ধরেই বাঁদিকে বেঁকল লোকটা। আদিত্য আন্দাজ করল লোকটা মহম্মদ আলি পার্কের উল্টোদিকের রাস্তাটা ধরবে, যে রাস্তায় মুনলাইট বলে একটা সিনেমা হল আছে। আদিত্যর কলেজ জীবনে ওই রাস্তায় কৃষ্ণা বলে আর একটা সিনেমা হল ছিল। এখন বোধহয় সেটা আর নেই। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সে দুটো হলেই সিনেমা দেখেছে। আদিত্য জানে ওই রাস্তাটা ধরে সোজা গেলেই নাখোদা মসজিদ।
এখন তারা চিত্তরঞ্জন এভিনিউ ধরে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। লোকটা কিন্তু মুনলাইট সিনেমার রাস্তাটা না ধরে আরও এগিয়ে গেল। এগিয়ে পরের রাস্তায় ডানদিকে বেঁকল। এটা জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট, আদিত্যর চেনা রাস্তা। এখানে কয়েকটা দুর্দান্ত কাবাবের দোকান আছে। জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট ধরে সোজা গেলেই চিৎপুর পড়বে। তারপর ডানদিকে বাঁক নিলেই নাখোদা মসজিদ।
চিৎপুর পৌঁছনোর আগেই অবশ্য লোকটা থেমে গেল। রাস্তার বাঁদিকে, জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের ওপরেই একটা হোটেল। হোটেল সিতারা। লোকটা তার সামনে থেমে ইশারায় আদিত্যকে হোটেলের ভেতরে ঢুকতে বলল। নিজেও ঢুকল। হোটেলটা মাঝারি মানের। ঢুকেই একটা রিসেপশানের মতো রয়েছে। রিসেপশানে বসে একটা ছোকরা মোবাইলে সিনেমা দেখছে। ছোকরাকে লোকটা বলল, ‘তিন সো সাত কা চাবি’।
চাবি হাতে নিয়ে লোকটা আদিত্যর দিকে ফিরল। বলল, ‘সাব, আপ তিন সো সাত নম্বর রুম মে থোড়া সা ওয়েট কিজিয়ে। ম্যায় ফিরদৌস সাহাব কো লে কর আ রহা হুঁ। হম পাঁচ মিনিট মে আ জায়েঙ্গে।’
হোটেলে লিফট আছে। সেটা রিসেপশানের তলাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটা আদিত্যকে নিয়ে লিফটে উঠল। তিনতলায় উঠে একটা ঝাঁকানি দিয়ে থেমে গেল লিফটা। তিনশ সাত নম্বর ঘর লিফট থেকে নেমে বাঁদিকে। দরজা খুলে যে ঘরটাতে আদিত্যকে লোকটা ঢোকাল সেটা বেশ বড়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একদিকে পরিপাটি বিছানা করা ডবল বেড, অন্যদিকে সোফা সেট। আদিত্য সোফায় বসল।
আদিত্যকে বসিয়ে লোকটা ঘর থেকে বেরনোর জন্য দরজার হাতলে হাত ছুঁইয়েছে, আদিত্য তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে সিগারেট খাওয়া যাবে?’
‘আরামসে সিগ্রেট পিজিয়ে। কোই দিককত নহি।’ লোকটা অভয় দিল। তারপর কী যেন মনে পড়েছে এমনভাবে বলল, ‘চায় পিয়েঙ্গে সাব? ইধর বহুত বড়িয়াঁ চায় বনতি হ্যায়।’
এক কাপ চা পেলে মন্দ হতো না। আদিত্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সে খেয়াল করল লোকটা তার নিজের জায়গায় এসে আর বাংলা বলছেই না।
এক কাপ চা এবং দুটি সিগারেট শেষ করার পর আদিত্যর ঘুম এসে গিয়েছিল। ঠিক ঘুম নয়, ঝিমুনি। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে আদিত্যর চটকাটা ভেঙে গেল। লোকটা ফিরে এসেছে। সঙ্গে যাকে এনেছে, আদিত্য নিশ্চিত, তারই ছবি তারক দাস হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিল। তবে ছবিতে ফিরদৌস রহমানকে দেখে যতটা লম্বা-চওড়া মনে হয়েছিল আসল মানুষটা মোটেই ততটা নয়।
ফিরদৌস ঘরে ঢুকে অন্য লোকটাকে ইশারায় চলে যেতে বলল। লোকটা বেরিয়ে যেতে দরজা বন্ধ করে আদিত্যর উল্টোদিকের সোফায় এসে বসল সে। বলল, ‘আপনি যে এসেছেন এর জন্যে আমি কতটা কৃতজ্ঞ বলে বোঝাতে পারব না। আপনাকে এইভাবে কষ্ট দেবার জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত। কিন্তু আমার আর কোনও উপায় ছিল না।’
ফিরদৌসের বাংলাটা শহুরে এবং পরিশীলিত, তবে তার পিসির মতো তাতে একটা হালকা পশ্চিমি টান আছে। মুখটা মেয়েলি সুন্দর। চোখের নিচে কালি এবং গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি জানান দিচ্ছে ইদানীং লোকটা খুব শান্তিতে নেই।
‘আমি এখন তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছি। অথচ আমার কোনও দোষ নেই।’ ফিরদৌস প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। ‘আপনার কথা সাবিনা আমাকে বলেছে। আমার পিসিও বলেছে। পিসি বলল, আপনার দয়া-মায়া আছে, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান আছে। আপনাকে আমার কথাটা বুঝিয়ে বললে আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন।’
‘কিছু না লুকিয়ে ব্যাপারটা যদি আমাকে প্রথম থেকে খুলে বলেন তাহলে আমার বুঝতে সুবিধে হবে।’ আদিত্য ফিরদৌসকে থামিয়ে দিয়ে বলল।
‘সেটাই বলছি। সেটা বলব বলেই তো আপনাকে আসতে বললাম। দেখুন গত মাসে, মানে ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে, আমাকে ফুপাজি বললেন বটুকবাবুর কাছে একটা মোটা টাকা পৌঁছে দিতে হবে। ফুপাজির স্ট্রোকের পর থেকে এই কাজটা আমি কয়েকবার করেছি। তাই আমি খুব একটা অবাক হলাম না। ফেব্রুয়ারির আট তারিখে সকালবেলা ফুপাজি আমাকে ডেকে একটা ব্যাগ দিলেন। বললেন, দেখে নাও। এতে টাকাটা আছে। আমি ব্যাগ খুলে গুনে নিলাম। ফুপাজি বললেন টাকাটা বটুকবাবুকে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে দিতে হবে। সহদেব আর জামিলকে তোমার সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি। এতগুলো টাকা তো। সাবধানে যাবে। আমি সহদেব আর জামিলকে নিয়ে টাকার ব্যাগ সমেত রওয়ানা হয়ে গেলাম। রবি গাড়ি চালাচ্ছিল। সহদেব আর জামিল সামনে। আমি টাকার ব্যাগ নিয়ে পিছনে।’
‘একটা জিনিস বলুন।’ আদিত্য ফিরদৌসকে থামিয়ে দিয়ে বলল। ‘রওয়ানা হবার আগে আপনি বটুকবাবুকে একটা ফোন করেছিলেন। কিন্তু তাকে ফোনে পাননি। তার সেক্রেটারিকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আপনারা আসছেন। আমার প্রশ্ন, গাড়িতে উঠে কি আপনি বটুকবাবুকে আর ফোন করেছিলেন?’
‘না। আর বটুকবাবুকে ফোন করা হয়নি। আমার মনে হয়েছিল ওর সেক্রেটারিকে জানিয়ে দিলেই উনি জানতে পেরে যাবেন যে আমরা আসছি।’
‘গাড়িতে থাকার সময় আর কোনও ফোন কি আপনার এসেছিল?’
‘আসতেও পারে। ঠিক মনে পড়ছে না। অনেকদিন হয়ে গেল তো।’
‘ঠিক আছে। বুঝেছি। তারপর কী হল বলুন।’
‘দুপুরের আগেই আমরা কুমুদিনীর অফিসে পৌঁছে গেলাম। অফিসে তখন চার-পাঁচজন কাজ করছিল। সকলেই ব্যাগ হাতে আমাকে ঢুকতে দেখেছে। বটুকবাবুর সেক্রেটারি শৌভিক নন্দ সাহেবের ঘরের বাইরে বসেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম সাহেব ভেতরে আছে কি না। শৌভিক বলল, সাহেব আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি সহদেব আর জামিলকে বাইরে বসতে বললাম। কারণ আমি জানতাম সাহেব বাইরের লোকের সামনে টাকার লেনদেন করেন না। তাছাড়া টাকাটা রাখার জন্যে সাহেবকে সেফ খুলতে হবে। বাইরের লোকের সামনে সাহেব সেফ খোলেন না। আমাদের সামনেও নয়।’
‘তারপর?’
‘সাহেব দেখলাম আমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখে বললেন, টাকা এনেছ? আমি বললাম হ্যাঁ। সাহেব ইন্টারকমে শৌভিককে বললেন, এখন যেন আমার ঘরে কেউ না ঢোকে। তারপর আমাকে বললেন, তুমি ব্যাগ থেকে নোটগুলো বার করে আমার টেবিলে রাখ। আমি গুনে গুনে নোট বার করে সাহেবের টেবিলে রাখলাম। সাহেব বললেন এইবার তুমি বাইরে অপেক্ষা কর। আমি তোমাকে ডেকে নেব। আমি বাইরে এসে বসলাম। শৌভিক যেখানে বসে তার সামনে একটা চেয়ার আছে। সেখানে। আন্দাজ করলাম সাহেব এখন সেফ খুলে টাকাগুলো তুলে রাখবেন।’
‘সেফটা কোথায় আছে?’
‘সাহেবের ঘরেই কোথাও সেফটা আছে। ঠিক কোথায় আছে জানি না। শুনেছিলাম সেফটা কোনও ছবির পিছনে দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো আছে। সেফের চাবি সাহেবের কাছে থাকে।’
‘তাহলে হয়ত পুলিশ সেটা খুঁজে বার করেছে।’ আদিত্য অন্যমনস্কভাবে বলল।
তারপর যেন কিছু একটা মনে পড়ে গেছে এমনভাবে বলল, ‘আচ্ছা, একটা খুব দরকারি কথা জানার আছে। কুড়ি কোটি টাকা যদি পুরোটা দু-হাজার টাকার নোটেও হয় তাহলে একশটা করে নোটের এক হাজারটা বান্ডিল লাগে। এক হাজারটা বান্ডিল, মানে এক লক্ষটা নোট তো একটা ব্যাগে ধরবে না। তাছাড়া এক-একটা নোটের যদি এক গ্রাম করে ওজন হয়, তাহলে এক লক্ষ নোটের ওজন একশো কেজি। সেটা তো একজনের পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কী করে আপনি অতগুলো টাকা নিয়ে গেলেন?’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। ইন্ডিয়ান রুপিতে কুড়ি কোটি টাকা একার পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি ভাবলাম আপনাকে ফুপাজি বলেছেন। আমি টাকাটা ইউ এস ডলারে নিয়ে গিয়েছিলাম।’
‘ইউ এস ডলার!’ আদিত্য বিস্ময়টা চাপতে পারছে না।
‘হ্যাঁ। একশ’ ডলারের কুড়ি হাজার নোট, হাওয়ালা বাজারে এক ডলার একশ টাকা, মানে একটা একশ ডলারের দাম ইন্ডিয়ান রুপিতে দশ হাজার টাকা। তার মানে কুড়ি হাজারটা নোটের দাম কুড়ি কোটি ইন্ডিয়ান রুপি।’
সেদিন জাহাঙ্গির খানের বাড়ি থেকে ফেরার পথে আদিত্যর যে খটকাটা লেগেছিল সেটা আজ পরিষ্কার হল। সে মনে মনে হিসেব করল, এক একটা নোটের ওজন এক গ্রাম করে হলে কুড়ি হাজারটা নোটের ওজন কুড়ি হাজার গ্রাম, মানে কুড়ি কেজি। এটা অনায়াসে একজন বয়ে নিয়ে যেতে পারে।
‘টাকাটা কী ধরনের ব্যাগে ছিল?’ আদিত্য জজ্ঞেস করল।
‘নীল রঙের বড় ট্র্যাভেল ব্যাগ।’
‘হুঁ, তারপর কী হল?’
‘খুব বেশি আর কিছু হল না। কিছুক্ষণ পরে সাহেব আমাকে ঘরে ডাকলেন। দেখলাম নোটগুলো আর টেবিলের ওপর নেই। ফাঁকা ব্যাগটা মাটিতে পড়ে আছে। তার মানে নোটগুলো সেফ-এ উঠে গেছে। সাহেব আমাকে বললেন, সব ঠিক আছে। আমি টাকা গুনে তুলে নিয়েছি। তুমি ব্যাগটা নিয়ে যাও। আর জাহাঙ্গির খানকে বোলো আমি রাত্তিরের দিকে ওকে ফোন করে নেব। আমি ফাঁকা ব্যাগটা নিয়ে সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।’
‘তার মানে আপনি টাকার ব্যাগ নিয়ে ঢুকেছেন এবং ফাঁকা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন এটা সেক্রেটারি শৌভিক নন্দ সমেত আরও চার-পাঁচজন দেখেছে, তাই তো?’ আদিত্য যাচাই করে নেবার গলায় বলল।
‘ঠিক তাই। যখন ব্যাগ নিয়ে ঢুকছি তখন ব্যাগের মুখটা বন্ধ ছিল। তবে ব্যাগে যে টাকা ঢোকানো হয়েছে সেটা তো জামিল আর সহদেব জানে। কারণ ওরা বলল ওরাই ডলারগুলো ব্যাগে ভরেছে। আর যখন বেরোচ্ছি তখন তো ব্যাগের চেন খোলা। সকলেই দেখেছে ব্যাগে কিছু নেই। তাহলে আমি কেমন করে চোর হলাম, আদিত্যবাবু?’
প্রশ্নের উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে আদিত্য বলল, ‘টাকাটা পৌঁছে দেবার পর আপনি কী করলেন?’
‘আমি ফাঁকা ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দিয়ে সহদেব আর জামিলকে হালিশহর পাঠিয়ে দিলাম। ওদের নিয়ে রবি চলে গেল। আমার ছোটবেলার এক বন্ধু খুব অসুস্থ হয়ে বাইপাসের ধারে একটা নার্সিং হোমে ভর্তি আছে। আমি তাকে দেখতে যাব বলে কলকাতায় থেকে গেলাম। পরের দিন কুমুদিনী রেড হল। অফিস সিলড হয়ে গেল। আমি খবর পেয়ে আর অফিসের দিকে যাইনি। গেলে আমিও অ্যারেস্টেড হয়ে যেতাম।’
‘কুমুদিনী রেড হচ্ছে আপনি কী করে জানলেন?’
‘পাশের অফিসের একজন খবর দিল। আমি তার নাম বলব না।’
‘যেদিন আপনি টাকা জমা দিলেন সেই রাত্তিরটা আপনি কোথায় কাটালেন?’
‘এক বন্ধুর বাড়িতে। এখনও সেখানেই আছি। জায়গাটা কোথায় আমি বলতে পারব না। আমার নিজের সেফটির জন্যেই বলতে পারব না।’
‘টাকাটা এখন কোথায় আছে বলে আপনার মনে হয়?’
‘আমি শিয়োর টাকাটা বটুক সাহেবের কাছেই আছে। সাহেব মিথ্যে কথা বলছেন যে টাকাটা তিনি পাননি।’
‘আপনি জানলেন কী করে যিনি টাকাটা ধার নেবেন বলেছিলেন তার কাছে টাকাটা চলে যায়নি?’
‘সেটার সম্ভাবনা কম। এটা হতে হলে সেদিন কাউকে এসে টাকার ব্যাগটা নিয়ে যেতে হতো। কিন্তু আমার কাছে খবর আছে যারা টাকাটা ধার চেয়েছিল তাদের কাছে টাকাটা এখনও পৌঁছয়নি। আমার মনে হয় টাকাটা বটুক সাহেবই সরিয়ে ফেলেছেন।’
‘কিন্তু এতদিন ধরে উনি ব্যবসা করছেন। কখনও কাউকে ঠকাননি। এই বয়েসে এসে বটুকবাবু হঠাৎ লোক ঠকাবেন কেন?’
‘আদিত্যবাবু, বোঝার চেষ্টা করুন, পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। সারাদেশে ইললিগাল ফিনান্স কম্পানিগুলোর ওপর পুলিশ ক্র্যাক-ডাউন করেছে। বটুক সাহেব বুঝতে পেরেছেন এই পরিস্থিতিতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। অতএব এখন যেটুকু পারা যায় কম্পানির থেকে নিংড়ে নিয়ে কেটে পড়তে হবে। আগে বটুক সাহেব কখনও লোক ঠকাননি কেন? কারণ তিনি জানতেন একবার কাউকে ঠকালে এত দুর্নাম হবে যে আর ব্যবসা চালানো যাবে না। তার থেকে লোক না ঠকিয়ে সুনাম বজায় রেখে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া ভাল। এটাই ছিল সাহেবের লং টার্ম ভিশন। ওই ইংরেজিতে বলে না অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি? তার মানে হল অনেকদিন ব্যবসা চালাতে গেলে সৎ থাকাটাই সব থেকে ভাল রাস্তা। কিন্তু এখন তো আর লং টার্ম ভিশনের কোনও মানেই হয় না। কম্পানির আর তো কোনও ফিউচার নেই। অতএব যেটুকু সম্ভব হাতিয়ে নিয়ে কম্পানি বন্ধ করে দিতে হবে। দুঃখের ব্যাপার, টাকা হাতালেন বটুক সাহেব আর দোষ পড়ল আমার ঘাড়ে।’
‘আর একটা প্রশ্ন। ইউ এস ডলারে কেন টাকাটা দেওয়া হল?’ আদিত্য তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে ফিরদৌসের দিকে তাকাল।
‘কেন ঠিক বলতে পারব না। কোনও কারণ নিশ্চয় ছিল, কিন্তু আমি সেটা জানি না। হয়ত যারা টাকাটা ধার চেয়েছিল, তারা ডলারে চেয়েছিল। তবে বটুক সাহেব যদি টাকাটা সরিয়ে ফেলার প্ল্যান করে থাকেন তাহলে ইউ এস ডলারে হলেই তার পক্ষে টাকাটা একা ক্যারি করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেদিক থেকে দেখলে টাকাটা ডলারে চাওয়ার একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।’
‘আগে কি কখনও কুমুদিনীতে ডলারে ট্রানঞ্জাকশন হয়েছে?’
ফিরদৌস কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘হলেও আমার জানা নেই।’
‘পরের প্রশ্ন। আপনি না হয় জাহাঙ্গির খানের ভয়ে লুকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু অন্য দুজন এজেন্ট, গোবিন্দ রায় এবং শিবেন মাইতি, তারা লুকিয়ে রয়েছেন কেন?’
‘হয়ত অ্যারেস্ট হবার ভয়ে। তবে আমি জোর দিয়ে কিছু বলতে পারব না। আমার সঙ্গে তো এদের কোনও কথা হয়নি। অফিস রেড হবার খবরটাও যে এরা কোথা থেকে পেল আমি জানি না।’
‘এবার শেষ প্রশ্ন। বটুকবাবু বলছেন, কুমুদিনী রেড হবার আগের দিন আপনি এক কোটি টাকা বটুকবাবুকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কুড়ি কোটি নয়, এক কোটি। পাঁচশ’ টাকার কুড়ি হাজারটা নোট। দুশটা বাণ্ডিল। এটা কি সত্যি?’
প্রশ্নটা শুনে ফিরদৌস যেন খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সে বলল, ‘রেড হবার আগের দিন আমি ওই কুড়ি লক্ষ ইউ এস ডলারই শুধু বটুকবাবুর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। একদিনের পক্ষে ওটাই কি যথেষ্ট নয়?’
‘ঠিক আছে ফিরদৌস সাহেব। আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আমি আমার রিপোর্টটা কাল-পরশুর মধ্যে জাহাঙ্গির খানের কাছে দিয়ে দেব। আমার মনে হয়, জাহাঙ্গির সাহেব বুদ্ধিমান লোক। তিনি সব বুঝতে পারবেন।’
আদিত্য যখন মেসে ফিরে এল তখন ন-টা বেজে গেছে। খাবার ঘরে নিরানন্দ রুটি-তরকারি দিয়ে ডিনার সমাধা করে সে ঘরে এসে সিগারেট ধরাল। আর তখনই বেজে উঠল মোবাইলটা। তারক দাস ফোন করছে।
‘বস জানতে চাইছেন আপনার কাজ কতটা এগোল। আপনি কাল একবার হালিশহরে আসতে পারবেন? আমরা গাড়ি পাঠিয়ে দেব।’
‘সকালের দিকে আমার একটু কাজ আছে। দুপুরের দিকে পাঠাতে পারবেন? এই ধরুন তিনটে নাগাদ?’
‘কোনও অসুবিধে হবে না। কাল সারাদিন বস ফ্রি আছেন। তাহলে তিনটের সময় আপনার অফিসে গাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে। গুড নাইট।’
‘গুড নাইট।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন