কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য – চতুর্থ পরিচ্ছেদ

অভিরূপ সরকার

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

পরের দিন সকালবেলা আসলে আদিত্যর কোনও কাজ ছিল না। কিন্তু একটা পুরো দিন ধকলের পর সে একটু বেলা অব্দি ঘুমোতে চেয়েছিল। তাই সে তারক দাসকে বলেছিল দুপুর তিনটে নাগাদ গাড়ি পাঠাতে। তাছাড়া খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে চিন্তা করার জন্যেও আদিত্যর কিছুটা সময়ের দরকার ছিল। এইসব কারণে সে যে-নিষ্পাপ মিথ্যেটা তারক দাসকে বলল তা নিয়ে আদিত্যর কোনও পাপবোধ নেই।

আদিত্যর ঘুম ভাঙল বেলা পৌনে দশটায়। যতই ক্লান্ত থাকুক এত বেলা করে সে সাধারণত ওঠে না। সকাল নটার রোদ্দুর জানালার কাঁচ দিয়ে ঘরে ঢুকলেই তার ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু আকাশটা আজ পুরোপুরি মেঘাবৃত, বেলা পৌনে দশটাতেও ঘর এত অন্ধকার যে আলো জ্বালাতে হয়। আদিত্য অবশ্য আলো জ্বালাল না। মুখ ধুয়ে, ইলেকট্রিক কেটলিতে কফির জল বসিয়ে ঘর অন্ধকার করে জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তারপর কফি বানিয়ে কফি খেতে খেতে আরও অনেকক্ষণ তাকিয়েই রইল। ভাগ্যিস জানলাটা বন্ধ ছিল, না হলে বৃষ্টির ছাঁট এসে টেবিলের বইগুলো ভিজিয়ে দিত। শীত শীত করছে। আদিত্য উঠে গিয়ে ফ্যানের স্পিডটা কমিয়ে দিল।

আবার বৃষ্টি নেমেছে। জানলার কাঁচে বৃষ্টির শব্দ। অনেক বছর আগে পড়া কয়েকটা কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল আদিত্যর। ‘দূরে এসে ভয় ভয় থাকি, সে হয়তো এসে বসে আছে / হয়তো পায়নি ডেকে, একা ঘরে জানালার কাঁচে/ বৃষ্টির বর্ণনা শুনে ভুলে গেছে এটা কোন সাল।’ কেয়াকে একটা ফোন করলে হতো। ডুয়ার্সেও কি বৃষ্টি পড়ছে? দক্ষিণ, উত্তর দুই বঙ্গেই বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। এটা বর্ষার বৃষ্টি নয়। এত তাড়াতাড়ি বর্ষা আসার প্রশ্নই ওঠে না। বঙ্গোপসাগরে নাকি নিম্নচাপ হয়েছে। তাই ঝড়-বাদল। নিচে মহাত্মা গান্ধী রোড দিয়ে গাড়িগুলো খুব সাবধানে যাচ্ছে। চায়ের দোকানের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজে যাচ্ছে একটা গোরু। তার সাদা গা দিয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। একটাই ছাতা মাথায় দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে দুটো লোক রাস্তা পার হয়ে গেল।

আদিত্য সিগারেট ধরিয়েছে। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে তার। বটুক সামন্তর ঘরে একটা সেফ আছে। পুলিশ কি তার সন্ধান পেয়েছে? যদি সেফটা খোলা হয়ে থাকে কী পাওয়া গেছে তার মধ্যে? আদিত্যর মন বলছে দরকারি কোনও তথ্য সেফ-এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু সুদর্শন শিকদার আদৌ কোঅপরেটিভ নয়। সেফ-এর মধ্যে কিছু পাওয়া গেলেও সে আদিত্যকে বলবে না। গৌতমকে দিয়ে তাকে রিকোয়েস্ট করা যেতে পারে। গৌতম বললে অবশ্য সেটা রিকোয়েস্ট নয়, অর্ডার হয়ে যাবে। কিন্তু সে যাই হোক, সব ব্যাপারে গৌতমকে জড়াতে ভাল লাগে না। বিশেষ করে তার ক্লায়েন্ট জাহাঙ্গির খানেরও বেশ কিছু দু-নম্বরি ব্যাপার আছে। সেগুলো তো সে পুলিশকে বলতে পারবে না। বলাটা আনএথিকাল হবে। আবার না-বলাটাও আইনের দিক থেকে ভাবলে আনএথিকাল। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। কেসটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই ভাল ছিল।

ইউ এস ডলারের ব্যাপারটাও ভাবাচ্ছে। ফিরদৌসের কথা শুনে মনে হলো ডলারে লেনদেন কুমুদিনীতে খুব বেশি হয় না। হয়ত এই প্রথম হল। এইরকম অদ্ভুত একটা বিনিময় মাধ্যম নির্বাচন করার কারণ কী? জাহাঙ্গির খান ডলারের ব্যাপারটা স্রেফ চেপে গেছিল। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। ডলারটা যে বেআইনিভাবে জোগাড় করা তাতে সন্দেহ নেই।

আদিত্য ল্যাপটপ খুলে ইউ টিউবে নিখিল ব্যানার্জীর মেঘ লাগাল। কেটলিতে আর একটু জল ভরে সুইচটা অন করে দিল। এবার চা খেতে হবে। কেয়া কোথায় ঘুরছে? যেখানে ঘুরছে সেখানে কি বৃষ্টি পড়ছে? নিখিল মধ্যলয় ঝাঁপতালে গত ধরেছেন। সুর ঘুরতে ঘুরতে উঠছে আবার ঘুরতে ঘুরতে নামছে। যেমন বৃষ্টির দিনে হাওয়া ঘুরতে ঘুরতে ওঠানামা করে। নিখিল ব্যানার্জী প্রায় এক মিনিট ধরে তিন সপ্তকব্যাপী একটা গমক-তান করে আদিত্যকে কিছুক্ষণের জন্য অবশ করে দিলেন। হুঁশ ফিরে আসতে আদিত্য উঠে গিয়ে চা ভেজালো। আজকাল সে টি-ব্যাগের বদলে সাবেকি দার্জিলিং চা টিপটে ভিজিয়ে খাবার বিলাসিতা শুরু করেছে। চা-টাও বেশ দামী, অন্তত তার রোজগারের আন্দাজে। তার আপিসবাড়ির সিকিউরিটি শ্যামল ডালহৌসি পাড়ার অরফ্যান থেকে চা-টা এনে দেয়।

নিখিল ব্যানার্জীর মেঘ শেষ হয়ে গেছে। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে মোবাইলে কেয়ার নম্বরটা লাগাল আদিত্য। ভেবেছিল রেকর্ডেড মেসেজ শুনতে পাবে ‘আপনি যাকে ফোন করেছেন তিনি নেটওয়ার্ক সীমার বাইরে আছেন’। তার বদলে, কী আশ্চর্য, একবারের চেষ্টাতেই ফোনটা বাজতে লাগল।

‘কেমন আছ?’ কেয়ার গলাটা খুব ঝলমলে শোনাচ্ছে।

‘আজ কোথায় রয়েছ? বেড়াতে যাওনি?’

‘জলদাপাড়ায় আছি। আজ জাঙ্গল সাফারি নেবার কথা ছিল। হাতির পিঠে চড়ে। কিন্তু এখানে প্রবল বৃষ্টি নেমেছে। বাইরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। জঙ্গলের ভেতরেই একটা রিসর্টে রয়েছি। চারজন মিলে গল্প করছি।’

‘এখানেও খুব বৃষ্টি পড়ছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। দশটা অব্দি ঘুমিয়ে এইমাত্র উঠলাম। উঠে এখন চা খাচ্ছি। হোটেলে আটকে থাকতে তোমার খারাপ লাগছে নিশ্চয়।’

‘সত্যি কথা বলব? একটুও খারাপ লাগছে না। হাতির পিঠে উঠতে হবে ভেবে বেশ নার্ভাস ছিলাম। মনে হচ্ছে আর উঠতে হবে না। কাল ভোরবেলা গোরুমারা চলে যাচ্ছি। ওখানে জিপে করে ঘুরব। সেটা অনেক ভাল।’

‘কী কী জীবজন্তু দেখলে?’

‘অনেক কিছু। হরিণ, বাইসন, গৌর, বিচিত্র সব পাখি। গণ্ডার এখনও দেখতে পাইনি। আজ দেখব ভেবেছিলাম, কিন্তু সেটা তো আর হচ্ছে না। কাল গোরুমারা গিয়ে হয়ত দেখতে পাব।’

‘জঙ্গলে বৃষ্টি কেমন লাগছে?’

‘অপূর্ব। অপূর্ব। তুমি দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে। চারদিকের সবুজগুলো যেন আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে আদিম পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি।’

‘বাঃ। চমৎকার।’

‘এখন আমরা যে রিসর্টটাতে আছি তার সামনে একটা জলাশয় আছে। রাত্তিরে সেখানে জন্তুরা জল খেতে আসে। সন্ধেবেলা আলো নিভিয়ে বারান্দায় বসে থাকলে তাদের দেখা যায়।’

‘খাবার-দাবার পাচ্ছ?’

‘খুব ভালই পাচ্ছি। এই তো এখন কফির সঙ্গে পাকৌড়া দেবে। দুপুরে খিচুড়ি করতে বলেছি।’

‘মনে হচ্ছে রাজার হালে আছ। রাজার নয়, থুড়ি, রানির হালে।’

‘বলতে পার। এই তো কটা দিন একটু মজা করব। তারপর ফিরে গিয়ে আবার স্কুল, ছাত্রী ঠেঙানো।’

‘ফিরে একটা ফোন কোরো।’

‘ফিরে কেন? তার আগেই করব। তুমিও ফোন করবে কিন্তু।’

‘করব। আজ তাহলে রাখি?’

‘দাঁড়াও। তোমাকে কী একটা যেন বলার ছিল। ও হ্যাঁ। তোমার হয়ত কাজে লাগতে পারে।’

‘কী?’

‘সেদিন ওই ক্যাফেতে বসে সুমনা ঘোষালের ছেলের নামটা মনে করতে পারছিলাম না, মনে আছে?। পরে মনে পড়ল। ছেলেটার নাম রনি, রনি ঘোষাল। পুরো নামটা বোধহয় রণপ্রিয় ঘোষাল। রোহিত ধামানির প্রোডাকশান ম্যানেজার।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ। ইনফরমেশনটা আমার কাজে লাগতে পারে। ভাল করে বেড়াও। এখন রাখছি।’

জাহাঙ্গির খানের বারান্দাটা আজ অন্য রকম দেখাচ্ছে। আসলে আগের দিন চারপাশটা খোলা ছিল। গঙ্গার আলো-হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আজ বৃষ্টির ছাঁট থেকে রেহাই পাবার জন্য চারদিকে ত্রিপল ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাইরের আলো ভেতরে আসে না। অবশ্য বাইরেও আজ সারাদিন মেঘের আঁধার। এখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে তবু বৃষ্টির বিরাম নেই। আকাশ মেঘহীন হলে হয়ত আকাশে কিছু আলো এখনও অবশিষ্ট থাকত। বারান্দার ভেতরে একটা বড় ঝাড় লন্ঠন জ্বলছে।

জাহাঙ্গির খান হুইল চেয়ারে বসে বিড়ি ধরিয়েছে। তার দেখাদেখি আদিত্যও সিগারেট ধরাল। ‘এবার বলুন আদিত্যবাবু আপনি কী জানতে পারলেন?’ জাহাঙ্গির খান আদিত্যর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘আপনি আমাকে দুটো জিনিস জানতে বলেছিলেন। আমি যতটা জানতে পেরেছি আপনাকে জানাচ্ছি।’

‘বটুকবাবুর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে?’

‘হয়েছে। প্রথমে অল্প সময়ের জন্য দেখা হল, পরে অনেকক্ষণ ধরে কথা হয়েছে। কাল সকালে ভবানীপুর থানায় যখন উনি হাজিরা দিতে এসেছিলেন তখন অল্প সময়ের জন্য দেখা হল। আপনার চিঠিটা দিতে উনি বিকেলে ওর বাড়িতে দেখা করতে বললেন। বিকেলে ওর বাড়িতে অনেকক্ষণ কথা হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনার পাঠানো কুড়ি কোটি টাকা উনি পেয়েছেন কিনা। উনি পরিষ্কার বলে দিলেন টাকাটা উনি পাননি।’

 ‘আমি ঠিক এইটাই সন্দেহ করেছিলাম।’ জাহাঙ্গির খান বিড়বিড় করে বলল। তারপর গলার আওয়াজটা একটু তুলে বলল, ‘আপনাদের যখন কথা হচ্ছিল তখন আর কেউ সেখানে ছিল?’

‘সুমনা ঘোষাল বলে যে মহিলার সঙ্গে উনি থাকেন তিনি প্রথমে ছিলেন। কিন্তু একটু পরেই তাকে বটুকবাবু ওপরে পাঠিয়ে দিলেন। তবে আড়াল থেকে তিনি আমাদের কথা শুনছিলেন কি না বলতে পারব না।’

‘ওই মেয়েছেলেটা খতরনাক আছে। বটুকবাবু কী করে ওকে এত বিশ্বাস করেন জানি না।’

‘সুমনা ঘোষাল বলছিল এমন তো হতে পারে জাহাঙ্গির খানই আসলে টাকাটা পাঠায়নি।’

কথাটা শুনে জাহাঙ্গির খানের চোয়াল শক্ত হল। একটু থেমে থেমে বলল, ‘ওই মেয়েছেলেটার সঙ্গে আমি পরে বোঝাপড়া করে নেব। বটুকবাবু আর কী বলল?’

‘বটুকবাবু জানতেন না ফিরদৌসকে পাওয়া যাচ্ছে না। বটুকবাবু ভেবেছিলেন আপনি অন্তত জানেন ফিরদৌস কোথায় আছে।’

‘আর কিছু?’

‘বটুকবাবু এটাও জানতেন না ওর অন্য দুজন এজেন্ট, গোবিন্দ রায় এবং শিবেন মাইতি, দুজনের কাউকেই পুলিশ ধরতে পারেনি, দু’জনেই নিখোঁজ।’

‘এটা তো আমিও জানতাম না।’ জাহাঙ্গির খানের গলাটা সত্যিকারের অবাক শোনাল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে ভাবছিল। তারপর আদিত্যকে বলল, ‘এবার ফিরদৌস সম্বন্ধে কী জানতে পারলেন বলুন।’

‘ফিরদৌসের সঙ্গেও আমার দেখা হয়েছে।’

‘ফিরদৌসের সঙ্গে দেখা হয়েছে! ফিরদৌসের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে!’ জাহাঙ্গির খান যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।

‘বলা উচিত, ফিরদৌসই আমার সঙ্গে দেখা করেছে।’

‘ফিরদৌস নিজের থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করেছে!’ জাহাঙ্গির খানের বিস্ময়ের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

‘হ্যাঁ। ফিরদৌসের লোক এসে প্রথমে আমার সঙ্গে দেখা করল। বলল, নাখোদা মসজিদের কাছে একটা জায়গায় ফিরদৌস আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। জায়গাটা জ্যাকারিয়া স্ট্রিটের একটা হোটেল, হোটেল সিতারা। আমি লোকটার সঙ্গে গেলাম। লোকটা আমাকে সেই হোটেলের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর মিনিট পনেরর মধ্যে ফিরদৌসকে নিয়ে এল। এটার থেকে মনে হয় ফিরদৌস ওই হোটেলের কাছেই কোথাও ছিল। তবে এখন আর সেখানে আছে কি না জানি না।’

‘কী বলল ফিরদৌস?’

‘ফিরদৌস বলছে সে টাকাটা বটুকবাবুর হাতে জমা দিয়েছে। সহদেব এবং জামিল ছাড়াও তাকে ব্যাগ নিয়ে বটুকবাবুর আপিসে ঢুকতে কুমুদিনী অফিসের অনেকে দেখেছে। পরে খালি ব্যাগ নিয়ে বটুকবাবুর আপিস থেকে বেরিয়ে যেতেও তাকে অনেকে দেখেছে। ব্যাগের চেন খোলা ছিল তাই সে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন ব্যাগটা যে ফাঁকা ছিল সেটা সকলের চোখে পড়ার কথা।’

‘তাহলে টাকাটা গেল কোথায়?’

‘ফিরদৌস খুব জোর দিয়ে বলছে টাকাটা বটুকবাবু মেরে দিয়েছেন। কুমুদিনীর অফিস পুলিশ রেড করে সিল করে দিয়েছে। সম্ভবত আর কখনও কুমুদিনী খুলবে না। এই অবস্থায় কম্পানি থেকে যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকুই বটুকবাবুর লাভ। ফিরদৌস বলছে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে বটুকবাবু এতদিন সৎভাবে ব্যবসা করে এসেছেন। এখন তো আর ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। তাই বটুকবাবুরও আর সৎ থাকার দরকার নেই।’

‘হুঁ।’ জাহাঙ্গির খান অন্যমনস্কভাবে বলল। সে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে।

‘আর একটা কথা। আপনি তো বলেননি আপনি কুড়ি কোটি টাকা ডলারে দিয়ে ছিলেন?’ আদিত্য সতর্ক ভাবে জিজ্ঞেস করল।

‘বলার দরকার মনে করিনি।’ জাহাঙ্গির খান খানিকটা আক্রমণাত্মকভাবে বলল। কোণঠাসা বেড়াল যেমন হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।

তার প্রতিক্রিয়াটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আদিত্য বলল, ‘ফিরদৌস বলছে, টাকাটা ডলারে চাওয়া হয়েছিল যাতে ওটা বহন করে নিয়ে যেতে বটুকবাবুর সুবিধে হয়। ফিরদৌসের মতে, টাকাটা পাবার পর ওটা বহন করে বটুকবাবু অন্য জায়গায় নিয়ে গেছেন।’

জাহাঙ্গির খান অনেকক্ষণ চুপ করে আছে। আদিত্য ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার আর কিছু রিপোর্ট করার নেই।’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘আমি আর আপনার কেসটার মধ্যে থাকতে চাই না। আপনি আমাকে রিলিজ করে দিন। যে টাকাটা আমি অ্যাডভান্স হিসেবে নিয়েছিলাম সেটার হিসেব নিয়ে এসেছি। যে টাকাটা বেঁচেছে সেটা আপনি ফেরত পাবেন।’

‘আপনাকে কিছু ফেরত দিতে হবে না। কোনও হিসেব দেবারও দরকার নেই। ধরে নিন ওই টাকাটা পুরোটাই আপনার পারিশ্রমিক এবং খরচপাতি।’ এতক্ষণে জাহাঙ্গির খানের গলার আওয়াজ শোনা গেল। ‘আমারও মনে হয় আপনার আর এই কেসের মধ্যে থাকার দরকার নেই। আপনি যেটুকু জানালেন সেটুকু আমার খুব কাজে লাগবে। বাকিটা আমি নিজেই সামলে নেব।’

ফেরার পথে আবার তুমুল বৃষ্টি। একে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে আলো নেই, তার ওপর অবিশ্রাম বৃষ্টির ফলে হেডলাইটের আলোতেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। ড্রাইভার পুরোটাই আন্দাজে চালাচ্ছে। আদিত্যর খুব ভয় করছিল। একটাই সান্ত্বনা, রাস্তায় গাড়ি প্রায় নেই। বিরাটিতে পৌঁছে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমল। গাড়ি যখন এয়ারপোর্টের কাছে পৌঁছেচে, আদিত্যর ফোনটা বেজে উঠল। সুপর্ণ ফোন করেছে।

‘কোথায় আছিস এখন?’

‘এয়ারপোর্টের কাছাকাছি রয়েছি। বাড়ি ফিরছি।’

‘শোন। তুই বলেছিলি না আমার ইনভেস্টিগেটারদের সুপারভাইজার সোমনাথ গুঁই-এর সঙ্গে কী একটা কম্পানি নিয়ে কথা বলতে চাস। সোমনাথ আমার বাড়িতে এসে আটকে পড়েছে। বৃষ্টির জন্যে ট্রেন বন্ধ তাই ফিরতে পারছে না। তুই কি আমার বাড়িতে আসতে পারবি? তাহলে সোমনাথের সঙ্গে কথা হতে পারে। দরকার হলে আমি গাড়িও পাঠাতে পারি। এলে রাত্তিরে খেয়ে যাবি। থেকেও যেতে পারিস। জানিস তো মা চলে যাবার পর থেকে আমাদের ভবানীপুরের বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে আছে। আসলে তোর সঙ্গে একটু আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে। গৌতম বা অমিতাভ সংসারী লোক। ওদের তো এইভাবে বলা যায় না। তুই একমাত্র ঝাড়া হাত-পা। আসবি? চলে আয় না?’

আদিত্য ভাবছিল। যদিও কেসটা থেকে সে ফরমালি মুক্তি পেয়ে গেছে তবু কিছু কৌতূহল রয়ে গেল। তাছাড়া আদিত্যর মন বলছে, কুমুদিনী বিত্ত নিগমের রহস্য থেকে তার এখনই মুক্তি ঘটবে না। সে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি চলে আসছি। তোর বাড়ির ডিরেকশনটা একবার বল। অনেকদিন যাইনি তো। এই বৃষ্টির মধ্যে বাড়িটা চিনতে ভুল হতে পারে।’

ঘন্টাখানেক পরে যখন আদিত্য সুপর্ণর দোতলার বসার ঘরে গুছিয়ে বসেছে তখন বৃষ্টি একেবারে থেমে গেছে।

‘বৃষ্টির এই এক বিপদ। খিচুড়ি বসালেই বৃষ্টি থেমে যাবে। ঠাকুরকে এত করে বলে খিচুড়ি বসালাম। বৃষ্টি থেমে গেলে আর খিচুড়ি খেয়ে মজা কোথায়?’ সুপর্ণ বলছিল।

‘এখানে তুই ঠাকুর পাস কোথায়? তুই তো নমাসে-ছমাসে আসিস।’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘আমাদের পুরোনো ঠাকুর এই পাড়াতেই থাকে। অন্য বাড়িতে রান্না করে। তবে আমরা এলে আমাদের রান্নাটাও করে দেয়। এখন যেমন চা করে দিতে বলেছি।’

‘তোর বউ-বাচ্চারা দেশে আসে না?’

‘কম আসে। আমারও খুব বেশি আসা হতো না, এই কাজটার জন্য এখন বছরে দুবার করে আসতে হয়।’

‘তোর ছেলেরা বাঙলা বলতে পারে?’

‘আগে পারত। আগে মানে যখন স্কুলে যেতে শুরু করেনি তখন। এখন আর বাঙলা বলতে চায় না। আমরা বাঙলা বললে ইংরিজিতে জবাব দেয়।’

‘আচ্ছা, অ্যামেরিকানরা আমাদের, মানে ভারতীয়দের সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখে? ব্রিটিশরা অনেকে রাখে আমি জানি। অনেকদিন আমাদের শাসন করেছিল তো। কিন্তু অ্যামেরিকানরা?’

‘আগে অ্যামেরিকানরা ভারতীয়দের সম্বন্ধে বেশ কম জানত। এ-ব্যাপারে আমার নিজেরই একটা মজার অভিজ্ঞতা আছে। এটা অনেক বছর আগেকার কথা। আমি তখন সদ্য মার্কিন মুলুকে পি এইচ ডি করতে গেছি। যে বাড়িটায় থাকতাম সেটা ইউনিভার্সিটিরই বাড়ি, এক মাঝবয়েসি মহিলা সেটা দেখাশোনা করেন। একদিন আমাকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ভারতীয় তো বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি ভারতের কোন অঞ্চল থেকে আসছ? আমি বেঙ্গল থেকে আসছি শুনে ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠে বললেন, কিন্তু বেঙ্গলিরা তো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এবার আমার আঁতকে ওঠার পালা। সবে মাস তিনেক হলো দেশ থেকে এসেছি। এর মধ্যে বাঙালি জাতটাই বিলুপ্ত হয়ে গেল? আমি সাধ্যমত প্রতিবাদ জানালাম, কিন্তু ভদ্রমহিলা শুনবেন কেন? তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোথাও পড়েছেন বেঙ্গলিরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর রহস্যটা পরিষ্কার হল। ভদ্রমহিলা রয়াল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে বাঙালিদের গুলিয়ে ফেলেছেন। আজকাল কিন্তু এরকম অজ্ঞানতা আর নেই।’

আদিত্য হোহো করে হাসছিল। হাসি থামিয়ে বলল, গল্পে গল্পে আসল কাজটাই ভুলে গেছি। তোর সেই ইনভেস্টিগেটরদের সুপারভাইজার ছেলেটি কোথায়? সোমনাথ না কী যেন নাম বলছিলি? তার সঙ্গে তো কথা বলতে হবে।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সোমনাথ। ওকে নিচে একটা ঘর দিয়েছি। রাত্তিরে ওখানে থেকে যাবে। ও এখন সেখানে বসে ওর ল্যাপটপে ডেটা ট্যাবুলেট করছে। দাঁড়া ওকে ডাকছি।’

বসার ঘরের সংলগ্ন একটা ভেতরের বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়ালে একতলার উঠোনটা দেখা যায়। উঠোনে কিছু অযত্নলালিত গাছ নিজেদের খেয়ালখুশি মতো বেড়ে উঠেছে। দুএকজন দুচারটে ফুলও ফুটিয়েছে। তার মধ্যে একটা কৃষ্ণকলি গাছের কেরামতি আলাদা করে চোখে পড়ে। একই শরীরে নানা রঙের ফুল ফুটিয়েছে সে। সুপর্ণ বারান্দায় বেরিয়ে গলা তুলে সোমনাথকে ডাকল। তার সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যও বেরিয়ে এসেছে। সাবেকি বাড়ির ভেতরটা দেখতে তার খুব ভাল লাগে। উঠোন, ছবি-আঁকা রঙিন কাঁচের জানলা, ঘুলঘুলি। এই বাড়িটা একেবারে বদলায়নি। তার কলেজ জীবনে যেমন ছিল প্রায় তেমনই রয়ে গেছে।

সোমনাথ সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। ‘ডাকছেন স্যার?’ সে সুপর্ণকে বলল।

‘হ্যাঁ, একটু এই ঘরে এস। আমার বন্ধু আদিত্য মজুমদার তোমাকে দু’একটা জিনিস জিজ্ঞেস করবে।’

ঠাকুর চা দিয়ে গেছে। আদা দেওয়া দুধ-চিনি মেশানো কড়া চা। চুমুক দিয়ে আদিত্যর ভালই লাগল। চায়ে দ্বিতীয় চুমুকটা দিয়ে সে সোমনাথকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তো এখানকার ইনফরমাল ফিনান্স কম্পানিগুলো সম্বন্ধে খুব ভাল জানেন, তো একটা বিশেষ কম্পানি, নাম কুমুদিনী বিত্ত নিগম, তাদের সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন?’

‘কুমুদিনী? নামটা চেনা লাগছে। আমাদের সার্ভেতে এই কম্পানিটা ছিল। সার্ভেতে যা পাওয়া গিয়েছিল আমার ল্যাপটপে নোট করা আছে। আমি নিচ থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে আসি?’

সোমনাথ নিচ থেকে ল্যাপটপ আনতে গেল। আদিত্য সুপর্ণকে বলল, ‘এই কম্পানিগুলো তোদের ঠিকঠাক তথ্য দেয়? এদের তো অনেক দুনম্বরি ব্যাপার আছে।’

‘সোজাসুজি দেয় না। সাধারণত কম্পানির কোনও কর্মচারীকে চুপিচুপি ধরতে হয়। কিছু টাকা কবুল করতে হয়। মুচলেখা দিতে হয় যে কর্মচারীটির নাম কখনই প্রকাশ করা হবে না। এত সব কাঠখড় পোড়ানোর পর কর্মচারীটি মুখ খোলে। কোনও নির্দিষ্ট প্রশ্নাবলীর উত্তর এরা দেয় না। নিজের কম্পানি সম্পর্কে যেটুকু জানে নিজের মতো করে বলে যায়। এইরকম কয়েকটা কম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলার পর আমরা অর্থনৈতিক আবহাওয়াটা সম্বন্ধে একটা গল্প খাড়া করি। একে বলা হয় এথনোগ্রাফিক স্টাডি। এতে বিশেষ কোনও কম্পানির নামের বা কাজের উল্লেখ থাকে না।’

‘কুমুদিনী বিত্ত নিগম সম্বন্ধে আপনি ঠিক কী জানতে চান?’ সোমনাথ ল্যাপটপ নিয়ে ফিরে এসেছে।

‘যেটুকু জানা যায় সবটাই জানতে চাই। এরা কোথায় টাকা ইনভেস্ট করে, কোথা থেকে টাকা তোলে, এদের ব্যবসার সাইজ কত, সবই জানতে পারলে ভাল হয়।’

সোমনাথ ল্যাপটপ খুলে কোনও একটা তথ্যের ফাইলে ঢুকে খুঁজতে শুরু করেছে। একটু পরে সে বলল, ‘কুমুদিনী সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু আমাদের ফাইলে নেই। রেসপন্ডেন্ট, অর্থাৎ কুমুদিনীর যে কর্মচারীটির সঙ্গে আমাদের ইনভেস্টিগেটরের কথা হয়েছে, সে বলেছে খুব বেশি তথ্য কর্মচারীদের জানতে দেওয়া হতো না। সে যতদূর জানে, বর্তমানে তিনটে বড় কম্পানিকে কুমুদিনী টাকা ধার দিয়েছে। একটা সিনেমা কম্পানি, নাম ‘নিউ এজ মুভিজ’, একটা নাইট ক্লাব, নাম ‘বুটলেগার’, আর একটা আলুর কোল্ড স্টোরেজ, নাম ‘মাতঙ্গিনী হিমঘর’। এই তিনটে জায়গায় এই মুহূর্তে কুমুদিনীর টাকা খাটছে। কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে রেসপন্ডেন্ট জানে না। কী সুদের হারে টাকা দেওয়া হয়েছে সেটাও সে জানে না। আসলে ওপর ওপর কুমুদিনীর ব্যবসা হল শেয়ার ব্রোকিং। আমাদের রেসপনডেন্ট সেই ব্যবসাটাই মূলত দেখাশোনা করে। যে নামগুলো সে বলেছে সেগুলো সে আপিসে কানাঘুষোয় শুনেছে। তাই নামগুলো সম্বন্ধে সে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত। কুমুদিনী এক সঙ্গে ম্যাক্সিমাম দু-তিনটে কম্পানিকে ধার দেয়। তার বেশি দেয় না।’

সোমনাথ থামল। সে ল্যাপটপে মুখ ডুবিয়ে আরও কীসব খুঁজছে। আদিত্য বলল, ‘আচ্ছা, কুমুদিনী কোথা থেকে টাকা তোলে, মানে কুমুদিনীর ফাইন্যান্সার কারা, সেটা কি জানা গেছে?’

‘সেটাই খুঁজছি। এই ডেটাটা অন্য জায়গায় স্টোর করা আছে।’ সোমনাথ কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে বলল।

‘তুই রাত্তিরে থেকে যাচ্ছিস তো?’ সুপর্ণ আদিত্যকে জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, থেকেই যাব ভাবছি। তুই ড্রাইভারকে ছেড়ে দে।’ আদিত্য একটু চিন্তা করে বলল। তারপর সামান্য থেমে বলল, ‘তোর মনে আছে কলেজে পড়ার সময় একবার তোর বাড়িতে রাত্তিরে ছিলাম?’

‘খুব মনে আছে। খুব মনে আছে। সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল। এইরকম নয়, এর থেকে আরও অনেক বেশি। জগুবাবুর বাজারে বুক সমান জল। বারবার মেসোমশাই ফোন করছিলেন। গাড়ি পাঠাতে চাইছিলেন। তুই বললি, জগুবাবুর বাজার পেরোতে গেলে গাড়ি ডুবে যাবে। শেষে মেসোমশাই তোকে এখানে থাকার পারমিশান দিলেন। ওফ! প্রচণ্ড মজা হয়েছিল।’

‘টাইম ফ্লাইজ। কতদিন কেটে গেল!’ আদিত্য অন্যমনস্কভাবে বলল।

‘সেই রাত্তিরে ডিনারে তোকে মা কী খাইয়েছিল সেটাও মনে আছে।’

‘আমারও মনে আছে। চিকেন আর হাঁসের ডিমের ডালনা।’ আদিত্য স্বপ্নালু গলায় বলল।

‘অদ্ভুত কম্বিনেশান। আসলে বাড়িতে যা ছিল তাই দিয়ে ডিনার। বাজারেও তো যাওয়া যাচ্ছিল না।’

‘তবে মাসিমার রান্নাটা সেদিন অমৃত লেগেছিল। মাসিমা সেদিন নিজের হাতে রান্না করেছিলেন।’

‘মা রান্নাটা সত্যিই ভাল করত। তবে শেষের দিকে আর পারত না।’

‘খুব বেশি পেলাম না স্যার।’ সোমনাথ ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে বলল। ‘এখানে দুটো কম্পানির নাম পাচ্ছি যারা বর্তমানে কুমুদিনীকে টাকা ধার দিয়েছে। প্রথমটা ‘মুখার্জি বিল্ডার্স’, এরা বিল্ডিং মেটিরিয়ালসের সাপ্লায়ার। দ্বিতীয়টা ‘সুরজমল ট্রেডিং কম্পানি’, এদের এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা। আরও নিশ্চয় আছে, কিন্তু আমাদের রেসপনডেন্ট বলতে পারেনি। আসলে যারা ধার নিয়েছে তাদের ব্যবসাগুলো ততটা বেআইনি নয়, তাই তারা তাদের নাম লুকোবারও তেমন চেষ্টা করেনি। কিন্তু যারা কুমুদিনীকে টাকা ধার দিচ্ছে, তাদের সেই টাকার একটা বড় অংশ কালো টাকা। তাই তাদের নামগুলো সহজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘আর কিছু জিজ্ঞেস করবি সোমনাথকে?’

আদিত্য মাথা নেড়ে না বলল। ‘তাহলে সোমনাথ তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। কাল তো তোমাকে খুব ভোরে উঠে ট্রেন ধরতে হবে। ঠাকুরকে বল তোমাকে খেতে দিয়ে দিতে।’ সুপর্ণ সোমনাথকে তাড়াতাড়ি ভাগিয়ে দিয়ে আবার পুরোনো দিনের আড্ডায় ফিরে আসতে চায়।

কয়েকটা দিন শুয়ে-বসে কেটে গেল। কুমুদিনীর কেস থেকে অব্যাহতি মিলেছে, হাতে অন্য কোনও কাজও নেই, আদিত্য টুকটাক বই পড়ছে, গান শুনছে, ঘুমোচ্ছে। মাঝে মাঝে বউবাজারে তার আপিস ঘরেও গিয়ে বসছে। কোনও মক্কেল নেই। আলস্যের একটা তীব্র নেশা আছে। আস্তে আস্তে সেই নেশাটা আদিত্যকে গ্রাস করে ফেলছে। তবে মনের গভীরে একটা অসন্তোষ, একটা অপূর্ণতা তাকে মাঝেমাঝেই পীড়া দেয়। কুমুদিনীর রহস্যটা অজানা রয়ে গেল।

আর একটা অস্বস্তি অবশ্য আছে। আদিত্য তাকে জোর করে মনের এককোণে সরিয়ে রেখেছে। অস্বস্তিটা বাহ্যত জাগতিক, টাকা-পয়সার। এখন তার সেভিংস অ্যাকাউন্টে যা আছে তাই দিয়ে টেনেটুনে আর সাত-আট মাস চলবে। তারপর কী হবে? এই সময়ের মধ্যে যদি কোনও আয় না হয়, তাহলে? আদিত্য ভেবে রেখেছে কী করবে। তার কয়েকটা ফিক্সড ডিপোজিট আছে। তখন সেগুলো ভাঙতে হবে। ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ভাঙলে আরও বছর দুয়েক চলে যাবে। অতএব চিন্তা কীসের? আর দু-বছর আট মাস পরে কী হবে এখন থেকে ভেবে লাভ নেই। আদিত্য অত দীর্ঘমেয়াদে প্ল্যান করতে পারে না। তবু একটা অস্বস্তি।

অস্বস্তির আসল কারণটা আদিত্য জানে। সে যতই চেষ্টা করুক না কেন, কেয়ার সঙ্গে সে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে। বস্তুত এ-ব্যাপারে আর তার নিজের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কেয়ার দিক থেকেও একটা পাকাপাকি সম্পর্কের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। তাদের দুজনেরই বয়েস হয়েছে। এখন না হলে আর কবে? কিন্তু এই প্রবল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আদিত্য কী করে একটা কমিটমেন্টে যাবে? কেয়ার অবশ্য খুব সিকিওর্ড একটা ইনকাম আছে। সে অনেকবার আদিত্যকে ইঙ্গিত দিয়েছে, সেই সিকিওর্ড ইনকামের ওপর ভরসা করে তারা অনায়াসে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারে। কিন্তু কেয়ার আয়ের ওপর নির্ভর করে তার দিন চলবে এটা ভাবলেই আদিত্যর জমিদারি পৌরুষ বিদ্রোহ করে ওঠে। তাছাড়া এটাও ঠিক যে এখনকার এই দায়িত্বহীন, বোহেমিয়ান, স্বাধীন জীবনটা আদিত্য বেশ উপভোগ করে।

দক্ষিণ বাংলায় এখনও দু-এক পশলা ঢাললেও, উত্তর বাংলায় আর বৃষ্টি নেই। কেয়ারা খুব বেড়াচ্ছে। রোজ ফোন করে। কত নতুন পাখি দেখল, পশু দেখল, ফুল দেখল, পাহাড়, জঙ্গল। কেয়ার মধ্যে একটা সরল ছেলেমানুষ আছে। জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে সেই ছেলেমানুষটা মুক্তি পেয়েছে। সব গল্প তার আদিত্যকে বলা চাই। কাল বিকেলের ফ্লাইটে কেয়ারা ফিরে আসছে।

বিকেলে হঠাৎ বিমল এসে হাজির। ‘আপনার খবরটা জোগাড় করতে একটু দেরি হয়ে গেল স্যার। আপনিও তো আর ফোন করেননি, তাই ভাবছিলাম কী হলো?’

 আদিত্য ভাবল, রোহিত ধামানি সম্পর্কিত তথ্য যে তার আর কাজে লাগবে না এই দুঃসংবাদটা পরে বিমলকে দেবে। সে মুখে বলল, ”তোমার বাড়ির খবর ঠিক আছে?’

‘মোটামুটি ঠিক আছে স্যার।’ বিমল একটু লাজুকভাবে হাসল।

‘তোমার বউ আর এখন ছেলের কাছে দিল্লি যেতে চাইছে না?’

‘না স্যার। এখন আর বায়না করছে না। আসলে কি হয়েছে স্যার, ছেলে নিজের রোজগারের টাকায় তার মাকে একটা মোবাইল কিনে পাঠিয়েছে। ওই অন লাইনে লোকে যেমন কিনে পাঠায়। তা আগে তো আমার বউ-এর নিজস্ব কোনও মোবাইল ছিল না, এখন নিজের একটা মোবাইল হতে মহাখুশি। তার ওপর আবার ছেলে তার রোজগারের টাকায় কিনে দিয়েছে। রোজ রাত্তিরে ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তাই এখন আর দিল্লি যাবার বায়না করছে না।’

‘বাঃ, চমৎকার।’ আদিত্য সত্যিই খুশি হয়েছে। সে একটু থেমে বলল, ‘এবার বল, কী জানতে পারলে।’

‘আপনি রোহিত ধামানির সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলেন স্যার। আমি যেটুকু জানতে পেরেছি আপনাকে বলছি। টালিগঞ্জ পাড়ায় চেনা কাউকে বার করতে গিয়েই দেরিটা হয়ে গেল।’

‘সে কী! তোমার মতো নেটওয়ার্ক কলকাতায় কজনের আছে? তোমার দেরি হয়ে গেল?’ আদিত্য মজা করে বলল।

‘স্যার, আমার অনেক চেনাশোনা ঠিকই। তবে ফিলিমের লাইনে ঠিক চেনাশোনা নেই।’

‘তাহলে কী করলে?’

‘চেনাশোনা বার করে ফেললাম স্যার। ওটাই বার করতে গিয়ে দেরি হল।’

‘বেশ, বেশ। আগে নিচে গিয়ে বলরামকে একটু চা আনতে বল। আর বিস্কুট। আজকাল আবার আমাদের এখানে তোমার ফেবারিট প্রজাপতি বিস্কুটটা পাওয়া যাচ্ছে না। তার বদলে একটা গোল বিস্কুট পাওয়া যাচ্ছে নোনতা-মিষ্টি মেশানো। আমার তো ভালই লাগল। ওটাই চারটে আনতে বল।’

মিনিট কুড়ি বাদে চায়ের ভাঁড়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আদিত্য সিগারেট ধরাল। তারপর বিমলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার বল।’

‘আমার ছোট শালা বলল তার এক বন্ধু আছে যে বন্ধুর এক কাকা টালিগঞ্জের সিনেমা স্টুডিয়োর বাইরে একটা চায়ের দোকান চালায়। রাস্তার দোকান হলে কী হবে, তাবড় তাবড় হিরো-হিরোইন নাকি ওই দোকানের চা খেয়ে বশ হয়ে আছে। সিনেমা পাড়ায় গিয়ে কালীশংকরের বা সেরেফ কালীদার চায়ের দোকান বললে যে-কেউ দেখিয়ে দেবে। শালার বন্ধু বলল, সিনেমা পাড়ার খবর কাকার মতো আর কেউ রাখে না। বড় বড় কাগজের রিপোর্টাররা কাকার কাছে কেচ্ছা খবরের খোঁজে আসে। তবে কাকা লোকটা যেমন হাড়-কেপ্পন তেমনি শয়তান। পয়সা ছাড়া কোনও খবর পেট থেকে বার করে না। শালার বন্ধু বলল, দ্যাখো, যদি বুড়োকে পটাতে পার। তবে কাজটা সহজ হয়।’

বিমল একটু থেমে বিস্কুটে কামড় বসাল। একঢোঁক চা খেল। তারপর ফের বলতে শুরু করল।

‘ছায়াছবি স্টুডিও খুঁজে নিতে অসুবিধে হলো না। গিয়ে শুনলাম ওখানে কিছুদিন আগেও তিন-চারটে ছোট ছোট স্টুডিও ছিল আর অনেকখানি ফাঁকা জমি। সেই সব একসঙ্গে নিয়ে ছায়াছবি স্টুডিও তৈরি হয়েছে। বিরাট স্টুডিও। এখানে শুধু যে শুটিং হয় তাই নয়, সিনেমা তৈরির অন্য সমস্ত কাজও হয়। আমার ভাগ্য ভাল, কালীদার চায়ের দোকানটা ছায়াছবি স্টুডিও থেকে খুব দূরে নয়। লোকে বলল, কিছুদিন আগে, যখন ছায়াছবি স্টুডিও তৈরি হয়নি, ওই ছোট ছোট স্টুডিওগুলো ধুঁকছিল, তখন কালীদার চায়ের দোকানের অবস্থাও টাইট হয়ে গিয়েছিল। এখন ছায়াছবি স্টুডিও তৈরি হবার ফলে কালীদার ভাগ্য খুলে গেছে। অবশ্য কালীদার একার নয়। আশেপাশে যত দোকান ছিল, সকলের।’

বিমল এক চুমুকে ভাঁড়ের বাকি চা-টা শেষ করে আর একটা বিস্কুটে কামড় লাগাল। আদিত্য বলল, ‘দ্যাখো তো, কেটলিতে বোধহয় আর একটু চা আছে। থাকলে আমাকেও একটু দাও, তুমিও নাও। কেটলির অবশিষ্ট চায়ে দুটো ভাঁড় পুরো হয়ে গেল। চা-টা অবশ্য একটু ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আদিত্য চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তারপর?’

‘তারপর কালীশংকরবাবুর কাছে গিয়ে ছোট শালার বন্ধুর নাম করে বললাম, আমি সরিতের বন্ধু। কাজের খোঁজে এপাড়ায় এসেছি। যে কোনও কাজ। তা সরিৎ বলল আপনার সঙ্গে দেখা করলে কাজ একটা জুটে যাবে। বুড়ো মহা ঠ্যাঁটা। বলল, সরিৎ আবার কে? আমি কোনও সরিৎ-টরিতকে চিনি না। আমি বললাম, আপনার ভাইপো সরিৎ। ওই যে বেনেপুকুরে থাকে। ট্র্যাম কম্পানিতে চাকরি করে। তখন বুড়ো বলল, ও পল্টুর কথা বলছ? হ্যাঁ ওর বাবা আমার সেজদা হয়। বহুদিন তো ওরা আমার খোঁজখবর নেয় না। তা এতদিন পরে হঠাৎ তোমাকে এখানে কী মতলবে পাঠাল? বুড়োকে অনেকক্ষণ ধরে বোঝালাম যে আমি সত্যিই কোনও মতলবে আসিনি, শুধু কাজের খোঁজে এসেছি। শুনেছি এখানে বিরাট খরচ করে ‘ফেরারি’ ছবির শুটিং হচ্ছে। তাই মনে হল ফাই-ফরমাশ খাটার জন্যে ওদের নিশ্চয় লোকের দরকার হবে। সরিৎ মানে পল্টু বলল আপনি একটু বলে দিলেই ওখানে কাজ পেয়ে যাব। বুড়ো বলল, আগে দেখি তুমি কেমন কাজের লোক। আমার দোকানে দুদিন কাজ করে দেখাও তো। আমি কিন্তু টাকা-পয়সা দিতে পারব না। তবে দুপুরের খাওয়াটা পাবে। যদি ভাল করে কাজ কর, তাহলে ‘ফেরারি’ ছবির শুটিং-এর ফ্লোরে কাজ করার জন্য তোমার নামটা সুপারিশ করে দেব। আমি বললে নিশ্চয় তোমাকে ওরা নিয়ে নেবে।’

‘লোকটা তোমাকে বিনি পয়সায় খাটিয়ে নিল?’

‘কী করব স্যার, বুড়োটার পেট থেকে কথা বার করার জন্যে ওর কথায় রাজি হয়ে গেলাম। চায়ের দোকানে খুব খাটনি, রাত্তিরে আবার নাইট গার্ডের কাজ। ভাগ্যিস রাত্তিরটা খানিকটা ঘুমোতে পারি, না হলে দুটোকে একসঙ্গে সামলাতে পারতাম না। হেমন্ত বলে একটা ছেলে, সেও ওই চায়ের দোকানে কাজ করে, আমার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। হেমন্ত বলল, তুমি তো আচ্ছা উজবুক। বুঝতে পারছ না তোমাকে বিনি পয়সায় দুদিন খাটিয়ে নিয়ে তারপর তাড়িয়ে দেবে। আসলে এই দোকানে দামু বলে আর একজন কাজ করে। সে দেশে গেছে। তাই তার জায়গায় বুড়ো তোমাকে খাটিয়ে নিচ্ছে। আমি বললাম, সবই বুঝি ভাই। তবু আশায় আশায় খেটে যাচ্ছি। যদি একটা কাজ পাওয়া যায়।’

‘এইভাবে কদিন কাজ করলে?’

‘তিনদিন স্যার। চারদিনের দিন দামু ফিরে এল। বুড়ো আমাকে বলল, তোমাকে আর লাগবে না। তুমি অন্য জায়গায় কাজ দ্যাখো। আমার লোক ফিরে এসেছে। তোমাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াব কেন? আমি বললাম, সে কী! আপনি যে বললেন আপনি বলে দিলে ‘ফেরারি’ ছবির সেটে ফাই-ফরমাস খাটার জন্য কাজ পেয়ে পাব। তাই তো ঘাড়-মুখ গুঁজে কটা দিন আপনার দোকানে কাজ করলাম। আপনি আমার জন্যে একটু বলে দেবেন না? বুড়ো বলল, ‘ফেরারি’ ছবির কাজ এখন হচ্ছে নাকি? রোহিত ধামানির হিরের ব্যবসায় কী যেন গণ্ডগোল হয়েছে। অনেক টাকা দরকার। তাই সে এখন সিনেমায় টাকা ঢালতে পারছে না। ফরেনে শুটিং বন্ধ। আমি বললাম, আমি তো ফরেনে যেতে চাইছি না। এখানে ছায়াছবি স্টুডিয়োতে ওদের যে শুটিংটা চলছে সেখানে কাজ পেলেই হবে। বুড়ো বলল, ছায়াছবিতে ওদের কচু শুটিং চলছে। ওদের প্রোডাকশান ম্যানেজার, বাচ্চা একটা ছেলে, নাম রনি ঘোষাল, বলা নেই কওয়া নেই পাঁচদিন ধরে বেপাত্তা। কেউ জানে না সে কোথায়। তাই শুটিং বন্ধ। ডিরেক্টারের মাথায় হাত। ওরা এখন তোমায় ঘন্টা কাজ দেবে। তুমি অন্য জায়গায় দ্যাখো। আমি গলাটাকে করুণ করে বললাম, ‘ফেরারি’ না হোক, ছায়াছবি স্টুডিওতে তো আরও কত শুটিং চলছে। কোথাও একটু বলে দিন না। আপনার তো কত চেনা। বুড়ো বলল, চেনা আছে বলেই তো জানি। এ-চত্বরে কোত্থাও কাজ খালি নেই। তুমি অন্য কোথাও দ্যাখো। কী আর করি? বুড়োকে বাছাবাছা দু-চারটে গালাগাল দিয়ে চলে এলাম। গালাগালগুলো বুড়ো গায়েও মাখল না। আসার সময় হেমন্ত বলল, বুড়ো আগে থেকেই জানত ‘ফেরারি’র শুটিং এখন বন্ধ। ওখানে কাজ পাওয়া যাবে না। তোমাকে মিথ্যে আশা দিয়ে খাটিয়ে নিল। আমি কিন্তু তোমায় সাবধান করে দিয়েছিলুম।’

বিমল থামল। ঠাণ্ডা চা-টা এক চুমুকে খেয়ে শার্টের আস্তিনে মুখ মুছল।

আদিত্য বলল, ‘তোমার কথা থেকে তিনটে জিনিস জানতে পারলাম। এক, রোহিত ধামানির আসল ব্যবসাটা হিরের। দুই, সে ব্যবসাতে কোনও কারণে অনেক টাকার দরকার পড়েছে। আর তিন, ‘ফেরারি’র প্রোডাকশান ম্যানেজার রনি ঘোষাল চার-পাঁচদিন ধরে নিখোঁজ। কিন্তু বিমল, আসল কথাটা হল, এই তথ্যগুলো আর আমার কোনও কাজে লাগবে না। যে কাজের জন্য এগুলো দরকার ছিল সেই কাজটা থেকে আমার মক্কেল আমাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। তুমি এই দু-হাজার টাকা ধর। এর বেশি দেবার সামর্থ্য এখন আমার নেই।’

যেসব জিনিস আদিত্য পছন্দ করে না, ক্রম অনুযায়ী তার একটা তালিকা করলে ভোরে ঘুম থেকে ওঠাটা সেই তালিকার একেবারে ওপরের দিকে থাকবে। কোনও কাজ আছে বলে নিজের থেকে উঠে পড়াটা তবু সহনীয়, কিন্তু টেলিফোনের বেমক্কা শব্দে ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো খারাপ জিনিস, আদিত্যর মতে, খুব কমই আছে। সেই কারণে আদিত্য কিছুদিন রাত্তিরে শোবার আগে ফোনটা সুইচ অফ করে রাখত। দুর্ভাগ্যবশত, ক্রমশ আদিত্য বুঝতে পারল এই অভ্যাস তার গোয়েন্দা জীবনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। গোয়েন্দাদের যে অসুবিধাজনক সময়ে, বলতে গেলে যে কোনও সময়েই, ফোন আসতে পারে, এই সত্যটা আদিত্য এখন মেনে নিয়েছে। তাই আজকাল ফোনটা সে চব্বিশ ঘন্টা খোলা রাখে।

আজ ভোরবেলা ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছিল। আদিত্য উঠে ফোনটা ধরার আগেই সেটা থেমে গেল। আদিত্য দেখল গৌতম ফোন করেছে। ঘড়িতে পৌনে ছটা। গৌতমের ভোরে উঠে ব্যায়াম করার অভ্যাস আছে, আদিত্য জানে। কিন্তু এটাও জানে যে নিজে ভোরে উঠে আদিত্যকে ঘুম থেকে তুলে দেবার মতো চ্যাংড়ামি করার বয়েস বা প্রবণতা গৌতমের আর নেই। তার মানে, কোনও বিশেষ দরকারে গৌতম ফোন করেছে। আদিত্য বাথরুম থেকে ঘুরে এসে গৌতমের নম্বরটা লাগাল।

‘সরি, বিশেষ দরকারে তোকে এই সাতসকালে ফোন করতে বাধ্য হলাম।’ গৌতম সামান্য হাঁপাচ্ছে। নিশ্চয় সিট-আপ করছিল।

‘তুই খেজুর করার জন্যে ভোরবেলা ফোন করিসনি এটা বুঝতে পেরেছি। বল কী ব্যাপার।’ আদিত্য ঈষৎ ঘুম-জড়ানো গলায় বলল।

‘শোন। কয়েকদিন আগে তুই জ্যাকারিয়া স্ট্রিটের একটা হোটেলে ফিরদৌস রহমান বলে কারও সঙ্গে দেখা করেছিলি?’

‘করেছিলাম তো। কেন? তার কী হয়েছে?’

‘লোকটা কাল রাত্তিরে খুন হয়েছে। বলা যায়, নৃশংসভাবে খুন হয়েছে। হি ওয়াজ ব্রুটালি টরচার্ড বিফোর হি ওয়াজ কিল্ড। দুটো হাতে গুলি লেগেছে। দুটো পায়েও গুলি লেগেছে। আর একটা গুলি ওর বুকের বাঁদিক দিয়ে হার্ট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। মনে হয় তাতেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে। আমি অবশ্য ডেডবডি দেখিনি। যা রিপোর্ট শুনলাম তাই বলছি।’

আদিত্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। এতটাই যে তার মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছিল না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে গৌতম বলল, ‘আদিত্য, শুনতে পাচ্ছিস?’

‘শুনতে পাচ্ছি। তারপর বল।’ আদিত্য খুব ম্রিয়মাণ গলায় বলল।

‘তোর গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?’

‘আমি লোকটার স্ত্রীকে এবং পিসিকে একরকম কথা দিয়েছিলাম যে আমি ওকে রক্ষা করব। কী যে আফশোস হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।’ আদিত্যর গলাটা মানসিক অবসাদগ্রস্ত রুগির মতো শোনাল। ‘তোরা জানলি কী করে আমি ফিরদৌসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম?’

‘সেলিম বলে লোকটার এক অনুচর আছে। পুলিশকে সে বলেছে কয়েকদিন আগে আদিত্য মজুমদার বলে একজন ভদ্রলোককে তার আমহার্স্ট স্ট্রিটের মেস থেকে এই সিতারা হোটেলে সে নিয়ে এসেছিল। ফিরদৌস আদিত্য মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। আদিত্য মজুমদারের যে ডেস্ক্রিপশন সেলিম দিয়েছে তার সঙ্গে তোর চেহারা মিলে যাচ্ছে। তোকে তো পুলিশের অনেকেই চেনে। বিশেষ করে সোমেন বলে যে ছেলেটি এই কেসটা ইনভেস্টিগেট করছে সে তোর বেজায় ভক্ত। সোমেন আমাকে ফোন করেছিল। বলল, স্যার এই কেসটাতে যদি আদিত্যবাবুর একটু হেল্প পাওয়া যায়, খুব ভাল হয়। উনি তো নিশ্চয় কেসটার সম্বন্ধে অলরেডি খানিকটা জানেন। তা তুই কি একটু এই কেসটাতে পুলিশকে সাহায্য করতে পারবি?’

‘নিশ্চয়। কেসটা সলভ করার ব্যাপারে আমার তো একটা মরাল দায়িত্ব আছে। আমি কেন সিতারা হোটেলে ফিরদৌসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, বলছি। তার আগে একটা কথা বল, ফিরদৌস কি সিতারা হোটেলেই খুন হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। সিতারা হোটেলের চারতলার একটা ঘরে ফিরদৌস খুন হয়েছে। গত পাঁচ সপ্তাহ সে ওই ঘরেই বসবাস করছিল।’

‘হুঁ। আমি ওই হোটেলেরই একটা ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমাকে ফিরদৌস বলেছিল সে একটু দূরে কোনও বন্ধুর বাড়িতে আছে। যেখান থেকে তাকে এসকর্ট করে আনতে ওর অনুচরের মিনিট পনের সময় লেগেছিল। আমি ধরে নিয়েছিলাম ফিরদৌস হোটেল থেকে সাত-আট মিনিটের দূরত্বে আছে। ফলে সেখানে গিয়ে ফিরদৌসকে নিয়ে আসতে ওই ছেলেটির পনের মিনিট লেগেছে। এখন বুঝতে পারছি ফিরদৌস হোটেলের ভেতরেই ছিল। শুধু আমাকে ভুল বোঝানোর জন্যে মিনিট পনের দেরিতে এসেছিল।’ আদিত্য প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলল।

‘তুই পুরো ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলবি?’

‘বলছি, শোন। গল্পের গোড়াটা তোর জানা তাই বুঝতে সুবিধে হবে।’

আদিত্যর বলা হয়ে গেলে গৌতম বলল, ‘আমি এবার বলি কেন এই সাতসকালে তোকে ফোন করলাম। ফিরদৌস রহমানের বডি এখনও সিতারা হোটেলেই রয়েছে। ইন্সপেক্টার সোমেন মুখুটি, মানে যার কথা তোকে একটু আগে বললাম, অলরেডি দলবল নিয়ে ওখানে পৌঁছে গেছে। কেউ একজন পুলিশ অফিসার সাতটা নাগাদ তোকে তোর মেস থেকে তুলে নিয়ে সিতারা হোটেলে পৌঁছে দেবে। তুই তৈরি হয়ে নে। আমি বিকেলের দিকে তোকে ফোন করে জেনে নেব কী হল।’

ফোন রেখে দিয়ে আদিত্য দেখল ঘড়িতে সোয়া ছ’টা বেজে গেছে।

কাঁটায় কাঁটায় সাতটার সময় একটা পুলিশের জিপ আদিত্যকে তুলে নিল। ড্রাইভারের পাশে বসা অল্পবয়সী উর্দিপরা অফিসারটি আদিত্যকে বলল, ‘আমি সাব ইন্সপেক্টার চাকি। আপনাকে সিতারা হোটেলে পৌঁছে দেবার ভার আমার ওপর পড়েছে। আপনার জন্য ইন্সপেক্টার মুখুটি সিতারা হোটেলে অপেক্ষা করছেন।’

পুলিশের গাড়িটা মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড়ে পৌঁছে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে গেল। এত ভোরে ট্র্যাফিক জ্যামের একটাই কারণ। পণ্যবাহী ট্রাকগুলো সার বেঁধে শহরে ঢুকছে। আটটার পরে তারা আর ঢুকতে পারবে না। তাই এত তাড়াহুড়ো। পেছনে পুলিশের আর একটা গাড়ি রয়েছে। পুলিশের গাড়ি দু’টো যতক্ষণে ট্রাকের ভিড় ঠেলে জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটে পৌঁছতে পারল ততক্ষণে কলকাতা শহর ঘুমের ক্লান্তি মুছে ফেলে আর একটা কর্মচঞ্চল দিনের জন্যে তৈরি হয়ে উঠেছে।

‘আমি সৌম্যেন্দ্রনাথ মুখুটি। নাথ এবং ইন্দ্রর সঙ্গে সঙ্গে ঔ-কার আর য-ফলাটাও বাদ দিয়ে আমাকে সবাই সোমেন মুখুটি বলে ডাকে। আপনিও তাই বলবেন। আমি আপনার একজন ভক্ত, আদিত্যবাবু। চন্দ্রলেখা সেনের কেসটার সময় আমি আলিপুরে পোস্টেড ছিলাম। তখন আপনাকে দেখেছি, কিন্তু আলাপ হয়নি।’ সোমেন মুখুটি হাসল। আদিত্য আন্দাজ করল সোমেনের বয়েস চল্লিশের এদিক-ওদিক। মেদহীন বেতের মতো শরীর, তবে মাথার চুল অকালে পাতলা হয়ে গেছে। সে বড়রাস্তার ওপরেই আদিত্যর জন্য অপেক্ষা করছিল।

‘আমি আপনাকে সময় মতো এই কেসটার সঙ্গে আমার ইনভলভমেন্টের ইতিহাসটা সংক্ষেপে বলে দেব। ব্যাকগ্রাউন্ডটা বুঝতে আপনার সুবিধে হবে।’ আদিত্যও হাসল।

‘আমি একবার ওপর ওপর খুনের জায়গাটা দেখে নিয়েছি। এবার আপনার সঙ্গে ভাল করে দেখব।’ সোমেন মুখুটি আদিত্যর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলল।

হোটেল সিতারার সামনে কয়েকজন পুলিশ ঘোরাফেরা করছে। রিসেপশন ফাঁকা। আদিত্যর মনে পড়ল দু-দিন আগে সে যখন এখানে এসেছিল রিসেপশনে একটা ছেলে বসেছিল। রিসেপশনের ডানদিকে বেঁকে গেলে লিফট। সেদিন তিনতলায় উঠেছিল। আজ চারতলায় যেতে হবে। যে উর্দিপরা পুলিশ অফিসার আদিত্যদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সে লিফটে চারতলার বোতামটা টিপতে টিপতে বলল, ‘স্যার পুরো চারতলাটা সিল করে দিয়েছি। পাঁচজন বোর্ডার চারতলায় ছিল, তাদের তিনতলা আর দোতলায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

 ‘কত নম্বরে ঘটনাটা ঘটেছে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘চারশো বারো নম্বর ঘরে স্যার। এটা একটা সুইট। হোটেলের বেস্ট দু-টো ঘরের একটা।’

চারশো বারো নম্বর ঘর লিফট থেকে নেমে বাঁ দিকে। ঘরের দরজা খোলা। দরজার সামনে দুজন উর্দিপরা বন্দুকধারী পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। তারা সোমেন মুখুটিকে দেখে স্যালুট করল।

‘বডি কোথায়?’ আদিত্য ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল।

‘সোফার সামনে শোয়ানো আছে স্যার।’

সুইটটা মোটামুটি বড়। দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা ছোট্ট প্যাসেজ, তার ডানদিকে বাথরুম, বাঁ দিকে ওয়ার্ডরোব। আরও ভেতরে ঢুকলে একদিকে শোবার জায়গা। ডবোল খাট, একটা রাইটিং টেবিল, ক্যাবিনেটের ওপর টেলিভিশন, ক্যাবিনেটের মধ্যে রাখা সেফ, একপ্রস্ত ড্রয়ার। অন্যদিকে বসার ব্যবস্থা। সোফাসেট, ঢাউস একটা টেলিভিশন, ল্যাম্পশেড। এক কোণে সাইড টেবিলের ওপর চা-কফি বানিয়ে নেবার সরঞ্জামও রয়েছে। বসার জায়গাটা শোবার জায়গাটার থেকে পর্দা টেনে আলাদা করে দেওয়া যায়।

ফিরদৌসের সাদা চাদর ঢাকা শরীরটা সোফার সামনে কার্পেটের ওপর শোয়ানো ছিল। দুটো পা, দুটো হাতের কব্জি এবং বুকের বাঁদিকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে সাদা চাদরটা লাল হয়ে গেছে। আদিত্য চাদরটা সরিয়ে মৃতদেহের মুখের দিকে তাকাল। সন্দেহ নেই, ফিরদৌস রহমান। কিন্তু তার মুখটা যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে, হাতের এবং পায়ের গুলিগুলো আগে লেগেছিল। হয়ত ফিরদৌসকে যন্ত্রণা দেবার জন্যেই গুলিগুলো করা হয়েছিল। হাতে বা পায়ে গুলি লাগলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মরে না। আদিত্য অনুমান করল, খুনি ফিরদৌসের কাছ থেকে কোনও গোপন কথা জানতে চেয়েছিল এবং সেটা জানার জন্য ফিরদৌসকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়েছিল। হয়ত গোপন কথাটা জানতে পারার পরে বুকে গুলি করে ফিরদৌসকে মেরে ফেলা হয়।

কার্পেটের ওপরেও অনেকটা জায়গা জুড়ে রক্তের ছাপ। সোফা থেকে খানিকটা দূরে একটা জায়গায় অনেকটা রক্ত চাপ বেঁধে আছে। সম্ভবত এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ফিরদৌসের শরীরে প্রথম গুলিটা লেগেছিল। আদিত্য আন্দাজ করল, প্রবল যন্ত্রণায় সে মাটিতে বসে পড়েছিল। সম্ভবত মাটিতে হেঁচড়ে হেঁচড়ে খানিকটা এগোবার চেষ্টা করেছিল। এগোবার সময় তাকে আরও কয়েকবার গুলি করা হয়। কার্পেটের ওপর তার প্রমাণ রয়েছে।

চাদরটা পুরো সরিয়ে আদিত্য মৃতদেহটা পরীক্ষা করছিল। খানিকক্ষণ পর সে বলে উঠল, ‘দেখুন সোমেনবাবু, খুনির নিশ্চয় ফিরদৌসকে প্রবল যন্ত্রণা দেবার উদ্দেশ্য ছিল। হয়ত কোনও কথা বার করার জন্যে খুনি ফিরদৌসকে যন্ত্রণা দিয়েছিল। শুধু খুন করার ইচ্ছে থাকলে তো প্রথমেই বুকে গুলি করত।’

‘আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।’ সোমেন নির্দ্বিধায় জানাল।

‘তার সঙ্গে এটাও আমার মনে হয় যে খুনি একজন ওস্তাদ বন্দুকবাজ। প্রত্যেকটি গুলি একেবারে লক্ষ্যভেদ করেছে। অর্থাৎ খুনি ঠিক যেখানে গুলিটা লাগাতে চেয়েছিল ঠিক সেখানেই গুলিটা লাগিয়েছে। আচ্ছা, মৃতদেহটা ঠিক কোন পজিশনে ছিল?’ আদিত্যর প্রশ্নটা ঘরে পাহারারত পুলিশ অফিসারের উদ্দেশে।

‘মাথাটা ছিল বড় সোফাটার ওপর। শরীরটা ছিল চিৎ হয়ে কার্পেটের ওপর। আর ডান হাতটা সোফার পাশে যে সাইড-টেবিলটা আছে সেদিকে বাড়ানো ছিল। কেন বাড়ানো ছিল সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি। সাইড টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে একটা রিভলভর ছিল। মনে হয়, চারটে গুলি লাগার পরেও কোনওরকমে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে এসে ফিরদৌস ড্রয়ার খুলে বন্দুকটা বার করার চেষ্টা করেছিল। ড্রয়ার খুলে সে অবশ্য বন্দুকটা বার করতে পারেনি। সম্ভবত তার আগেই শেষ গুলিটা তার বুকে লেগেছিল।’ পুলিশ অফিসারটি থামলেন। একটু থেমে বললেন, ‘এই ঘরে টিভিটা ফুল ভলুমে চলছিল। সম্ভবত, ফিরদৌসের আর্তনাদ ঢাকার জন্যে খুনি টিভিটা ফুল ভলুমে চালিয়ে দিয়েছিল। যদিও ঘরগুলো মোটামুটি সাউন্ড-প্রূফ তবু খুনি রিস্ক নেয়নি।’

‘হাতে এবং পায়ে গুলি লাগার পর বেশ কিছুক্ষণ মনে হয় ফিরদৌস বেঁচে থেকে যন্ত্রণা পেয়েছিল। না হলে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রথম চারটে গুলি লেগেছিল সেখানে এতটা রক্তপাত হতো না।’ আদিত্য নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল।

‘যে বন্দুকটা পাওয়া গেছে সেটা কি লাইসেন্সড?’ সোমেন মুখুটি জিজ্ঞেস করল।

‘আমরা ফিরদৌসের জিনিসপত্রের সঙ্গে কোনও রিভলভরের লাইসেন্স পাইনি স্যার। মনে হচ্ছে বন্দুকটা বেআইনি। তবে আরও ভাল করে ইনভেস্টিগেট করতে হবে।’

‘লাইসেন্সড হোক বা আন-লাইসেন্সড, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল ফিরদৌস রিভলভর ক্যারি করত কেন? সে কি ভয় পাচ্ছিল কেউ তার ক্ষতি করতে পারে? নাকি অন্য কোনও কারণে সঙ্গে বন্দুক রাখা তার দরকার হয়েছিল?’ আদিত্য স্বগতোক্তি করল। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে সে পুলিশ অফিসারটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘রিভলভর ছাড়া ফিরদৌসের সঙ্গে আর কী কী জিনিস ছিল?’

‘একটা কালো রঙের সুটকেস, একটা বড় নীল রঙের ব্যাগ। কয়েকটা প্যান্ট-শার্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি, দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম, কিছু ওষুধ, অন্তর্বাস, একটা ল্যাপটপ, মানে একজন সাধারণ মানুষ যা যা ব্যবহার করে সেইসব জিনিস। আর দুটো মোবাইল। জিনিসগুলো সবই ওই সুটকেসে রাখা আছে।’

ব্যাগ আর সুটকেসটা কার্পেটের ওপর রয়েছে। আদিত্য সুটকেস খুলে জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর ব্যাগটা খুলে দেখল সেটা একেবারে ফাঁকা। ‘আর কিছু নেই?’ সে অফিসারটিকে জিজ্ঞেস করল।

‘না। যা ছিল ওই সুটকেসেই রাখা আছে।’

‘আশ্চর্য! খুনি ফিরদৌসের মোবাইলগুলো রেখে গেল কেন? যা মনে হচ্ছে, খুনি ফিরদৌসের চেনা লোক। ফিরদৌস নিজেই তাকে দরজা খুলে ঘরে ঢুকিয়েছিল। তাই যদি হয়, তাহলে ফিরদৌসের মোবাইলে খুনির চিহ্ন থেকে যাবার কথা। সেক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে খুনি ফিরদৌসের মোবাইল দু’টো সঙ্গে নিয়ে যাবে। সেটা সে করল না কেন?’ আদিত্য বিড়বিড় করে বলল।

‘তাহলে কি ফিরদৌসের মোবাইলগুলো থেকে খুনির কোনও হদিশই পাওয়া যাবে না?’ সোমেন মুখুটি আদিত্যর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।’

‘সেটা এখনই বলা শক্ত। খুনি ভুল করেও মোবাইল দু-টো ফেলে যেতে পারে। ফিরদৌসের মোবাইলগুলো থেকে ফোন নম্বরগুলো যদি উদ্ধার করতে পারেন, তাহলে গত এক-দুই সপ্তাহে কার কার সঙ্গে ওর ফোনে কথা হয়েছে সেটা বার করা শক্ত হবে না। মেসেজগুলোও দেখতে হবে।’ আদিত্য ভাবতে ভাবতে বলল। ‘কার কার সঙ্গে ওর ফোনে কথা হয়েছিল যদি জানতে পারেন, আমাকে একটু জানাবেন? আর ল্যাপটপটা দেখবেন। যদি কিছু পাওয়া যায়।’

‘নিশ্চয় জানাব।’

নীল ব্যাগটা আদিত্যকে ভাবাচ্ছে। এইরকম একটা ব্যাগ সে আগে কোথাও দেখেছে।

‘আচ্ছা, ফিরদৌসকে জীবিত অবস্থায় শেষ কে দেখেছে?’ কিছুক্ষণ পরে সোমেন পুলিশ অফিসারটিকে প্রশ্ন করল।

‘ফিরদৌস ডাইনিং হলে খেতে নামত না। রুম সারভিসে খাবার আনিয়ে খেত। গতকাল রাত্তিরেও সে রুটি-মাংস আনিয়েছিল। রাত্তির দশটা নাগাদ বেয়ারা এঁটো বাসনগুলো নিতে ঘরে ঢুকেছিল। সে বলেছে, ফিরদৌস তখন সোফার ওপর বসে টিভি দেখছিল। সে-ই মনে হয় ফিরদৌসকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখেছে। মানে খুনি ছাড়া।’

‘ফিরদৌসের মৃতদেহটা কে প্রথম দ্যাখে?’

‘ফিরদৌস বলেছিল ওকে যেন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে তুলে দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী রিসেপশন থেকে ওকে ফোন করা হয়েছিল। বারবার ফোন করা সত্ত্বেও কেউ ফোন ধরছে না দেখে দুজন বেয়ারা ফিরদৌসের ঘরে গিয়ে বেল বাজায়। তাতেও কোনও সাড়া না পেয়ে তাদের একজন, যে রাত্তিরে রিসেপশনে থাকে, ম্যানেজারকে ফোন করে। ম্যানেজার আসার পর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খোলা হয়। ঘরের ভেতরে ফিরদৌস মরে পড়েছিল।’

‘রাত্তিরে রিসেপশনে কে থাকে?’ আদিত্য প্রশ্ন করল।

‘আমরা জিজ্ঞেস করেছি। রাত্তির দশটার সময় রিসেপশনের ছেলেটা বাড়ি চলে যায়। আবার সকাল আটটায় আসে। হোটেলের একজন বেয়ারা রিসেপশন ডেস্কের পেছনে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমোয়। আর বাইরে একজন সিকিউরিটি সারা রাত্তির জেগে বসে থাকে। রাত্তিরে এসে কেউ হোটেলে চেক ইন করতে চাইলে সে-ই রিসেপশনের বেয়ারাকে ডেকে তুলে দেয়। বেয়ারাই তখন রেজিস্টারে এন্ট্রির করিয়ে নেয়। তবে তেমন ঘটনা কালেভদ্রে ঘটে।’

‘তার মানে, এই হোটেলে হাতে লেখা রেজিস্টারে বোর্ডারদের নাম ঠিকানা এন্ট্রির করা হয়?’ সোমেন জিজ্ঞেস করল।

‘এটা এখনও আমাদের চেক করা হয়নি স্যার। আমি বরং হোটেলের ম্যানেজারকে ডাকি।’

ডাক পড়তে পারে এই আশঙ্কায় ম্যানেজার বোধহয় কাছেই অপেক্ষা করছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে দোরগোড়ায় দেখা গেল।

‘আসতে পারি স্যার?’ ম্যানেজারের গলার আওয়াজ ঈষৎ মেয়েলি। খর্বকায়, স্থূলতনু। কালো জামার ওপর একটা সাদা টাই পরেছে।

‘আসুন। ভেতরে আসুন।’ সোমেনের বলার ধরনে পুলিশি ধমক। ‘আপনার নাম কী?’

‘আমার নাম স্যার সফিকুল ইসলাম। আমি এই হোটেলের ম্যানেজার।’

‘কতদিন এখানে চাকরি করছেন?’

‘তিন বছরের বেশি হয়ে গেল স্যার। সামনের নভেম্বর মাসে চার বছর পুরো হবে।’

‘বাড়ি কোথায় আপনার?’

‘দেশের বাড়ি স্যার বাগনানে। এখানে রয়েল হোটেলের কাছে একটা মেসে থাকি।’

‘আপনার ডিউটিটা কটা থেকে কটা?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘সকালে নটার মধ্যে চলে আসি। হোটেল থেকে বেরোতে বেরোতে রাত্তির আটটা বেজে যায়। আজ অবশ্য ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।’

‘কার কাছ থেকে ফোন পেলেন?’

‘রহমান বলে যে ছেলেটা রাত্তিরে রিসেপশনে থাকে সে ভোরবেলা ফোন করেছিল।’

‘হোটেলের চেক ইন চেক আউটটা কি আপনারা হাতে লেখা রেজিস্টারে এন্ট্রির করেন?’ সোমেন মুখুটির প্রশ্ন।

‘না স্যার। ওটা কম্পিউটারে করা হয়। রিসেপশনে একটা ডেক্সটপ আছে। ওটাতে চেক ইন চেক আউট, বিলিং সব হয়। অ্যাকাউন্টস সেকশনেও দু-টো কম্পিউটার আছে। আর দু-টোর একটা আছে আমার ঘরে, অন্যটা মালিকের ঘরে। ল্যান দিয়ে একটা কম্পিউটার থেকে অন্যগুলোতে অ্যাক্সেস করা যায়।’

‘আপনাদের মালিক কোথায় থাকে?’

‘মালিক দুবাই-এ থাকে। দুবাই-এ মালিকের দু-টো হোটেল আছে। সেটাই মালিকের মেন ব্যবসা। এই হোটেলটা মালিকের বাবার। বাবা মারা যাবার পর মালিকের হয়েছে। এটাকে সেন্টিমেন্টাল কারণে মালিক রেখে দিয়েছে। তবে এখানে মালিক আসে খুব কম।’

‘শুনলাম রাত্তিরে কেউ চেক ইন করলে রিসেপশনে যে বেয়ারা থাকে সে-ই এন্ট্রির করিয়ে নেয়। সে কি কম্পিউটার অপরেট করতে পারে?’

‘না স্যার। রহমান কম্পিউটার খুলতে পারে না। রাত্তিরে কেউ এলে একটা খাতায় টেম্পোরারিলি তার নাম ঠিকানা এন্ট্রির করে নেওয়া হয়। পরদিন সকালে রঞ্জিত মানে আমাদের রিসেপশনে যে কাজ করে সেই ছেলেটা এলে নাম-টামগুলো কম্পিউটারে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। তবে এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটে।’

‘প্রশ্ন হল, কাল রাত্তিরে রঞ্জিত বাড়ি চলে যাবার পর কি কেউ হোটেলে চেক ইন করেছিল?’

‘এটা আমাকে রেজিস্টার খাতাটা দেখে বলতে হবে। খাতাটা নিচে আছে। নিয়ে আসছি।’ ম্যানেজার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করল।

‘আমরা ওর সঙ্গে নিচে যাই না। তাহলে কম্পিউটারের এন্ট্রিরগুলোও দেখে নেওয়া যাবে।’ আদিত্য সোমেন মুখুটির দিকে তাকিয়ে বলল।

‘বেশ তো তাহলে নিচে যাওয়া যাক। মনে হচ্ছে এ-ঘরে আপাতত আর কিছু দেখার নেই।’ সোমেন নিচে যাবার জন্য পা বাড়াল।

রহমান নিচেই ছিল। রঞ্জিত বলে ছেলেটাও ফোন পেয়ে চলে এসেছে। রহমানের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেল। কাল রাত্তির এগারোটা নাগাদ একজন গেস্ট চেক ইন করেছিল। হাতে লেখা রেজিস্টারে তার নাম রয়েছে দিলীপ সাক্সেনা। আসানসোলের একটা ঠিকানা থেকে সে আসছে। তাকে কেমন দেখতে রহমান খুব ভাল বলতে পারল না। রাত্তিরে রিসেপশনের অর্ধেক আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়। জায়গাটা আলো-আঁধারি হয়ে থাকে। সেই কম আলোয় ভাল করে লোকটাকে দেখা যায়নি। তবে রহমানের মনে আছে যে লোকটার মুখে চাপদাড়ি ছিল।

চেক ইন করার সময় অবশ্য আই ডি দেখতে হয়। আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স বা প্যান কার্ড। আই ডি-র ফটো কপি করে রাখা নিয়ম। কিন্তু ফটোকপির মেশিনটা থাকে আপিস ঘরে। সেটা রাত্তিরে বন্ধ থাকে। রহমান ফটোকপির মেশিনটা চালাতেও পারে না। তাই দিলীপ সাক্সেনার আই ডি-র কপি নেওয়া হয়নি। রহমান তাকে বলেছিল সকালে কেউ এসে তার আই ডি-টা নিয়ে কপি করে ফেরত দিয়ে যাবে।

দিলীপ সাক্সেনাকে চারতলায় চারশ’ তিন নম্বর ঘরটা দেওয়া হয়েছিল। পরে চারতলাটা সিল করে দেবার পর তাকে দোতলায় দু’শো এক নম্বর ঘরটা অ্যালট করা হয়। চারতলার অন্য গেস্টদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে সে রিসেপশন থেকে দু-শো এক নম্বর ঘরের চাবিটা নেয় এবং চাবি নিয়ে ওপরে চলে যায়। কিন্তু বেড টি দেবার জন্য বেয়ারা অনেকবার বেল বাজালেও সে দরজা খোলেনি।

সকলে মিলে দু-শো এক নম্বর ঘরে যাওয়া হল। চার-পাঁচবার বেল বাজানোর পরেও কেউ দরজা খুলছে না। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খোলা ছাড়া উপায় নেই। দরজা খুলে দেখা গেল ঘর ফাঁকা। বিছানাটাও ব্যবহার করা হয়নি। দিলীপ সাক্সেনা উধাও হয়ে গেছে।

‘আপনাদের সিসি ক্যামেরা নেই?’ আদিত্য ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল।

‘আছে তো। সিসি ক্যামেরার ফুটেজগুলো পুলিশ নিয়ে যাবে বলেছে। সেই মতো ওগুলো আমরা তৈরি করে রেখেছি।’

‘ফুটেজগুলো এখনও দেখা হয়নি, লালবাজারে নিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখতে হবে।’ সোমেন মুখুটি জানাল।

‘একবার কাল রাত্তিরের ফুটেজটা দেখতে পারলে হতো। চারতলায় কারা এসেছিল জানা যেত।’ আদিত্য মুখুটির দিকে তাকিয়ে বলল।

রিসেপশনের পিছনে একটা ছোট্ট ঘরে মনিটার এবং সিসি ক্যামেরার যন্ত্রটা বসানো আছে। ক্যামেরায় চারতলার খানিকটা ধরা পড়ে, পুরো চারতলাটা ধরা পড়ে না। লিফট দিয়ে কেউ চারতলায় উঠলে তাকে লিফট থেকে নামতে দেখা যায়। যেমন দেখা গেল, রাত্তির এগারোটা চৌত্রিশে একটা দাড়িওলা লোক একটা ছোট ব্যাগ হাতে চারতলায় লিফট থেকে নামছে। মনে হয় ওই সময় দিলীপ সাক্সেনা বলে সেই ব্যক্তি রিসেপশনে চেক ইন করে তার ঘরের দিকে যাচ্ছিল। এ-থেকে অবশ্য আদৌ প্রমাণিত হয় না যে সে-ই ফিরদৌসকে খুন করেছে। চারশ’ বারো বা চারশ’ তিন নম্বর ঘরের প্রবেশদ্বারগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আসে না।

‘আচ্ছা, যদি কেউ সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় উঠে আসে তা হলে কী সে সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়বে?’ আদিত্য ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল।

‘সিঁড়ির এক্সিটটা লিফটের ঠিক উল্টোদিকে। কেউ লিফট দিয়ে উঠলে যেমন সিসি ক্যামেরায় দেখা যাবে তেমনি সিঁড়ি দিয়ে উঠলেও সে সিসি ক্যামেরার চোখ এড়াতে পারবে না।’

আদিত্যরা আবার নিচে রিসেপশনে ফিরে এসেছে। কম্পিউটার খুলে দেখা গেল, ফেব্রুয়ারি মাসের ন’তারিখ সকালে ফিরদৌস রহমান হোটেলে চেক ইন করেছিল। আদিত্যর মনে পড়ে গেল সেদিনই কুমুদিনীর অফিস রেড করা হয়। প্রথম থেকেই ফিরদৌস চারশো বারো নম্বর ঘরে ছিল। তাছাড়া তিনশো সাত নম্বর ঘরটাও সে কিছুদিন আগে নিয়ে রেখেছিল। এখানে কয়েকবার সে মিটিং করেছে।

‘আমি নিজেই তো এই ঘরে দু-দিন আগে ফিরদৌসের সঙ্গে মিটিং করেছি।’ তারপর কী একটা মনে পড়ে যাওয়ায় সে পাহারারত পুলিশ অফিসারটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, সেদিন যে লোকটি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, যার নাম শুনলাম সেলিম, তাকে আপনারা কোথায় পেলেন?’

‘ভোরবেলা সে ফিরদৌসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। বোধহয় একসঙ্গে দুজনের কোথাও যাবার কথা ছিল। হয়তো সেইজন্যেই ফিরদৌস তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে চেয়েছিল। যাই হোক, আমরা তখনই লোকটাকে পাকড়াও করলাম। তার কাছেই তো জানতে পারলাম আপনি দু-দিন আগে এখানে ফিরদৌসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।’ পুলিশ অফিসারটি জানালেন।

‘আর একটা কথা। ধরা যাক দিলীপ সাক্সেনা নামক ব্যক্তিই খুনটা করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, খুনটা করে সে যদি তখনই হোটেল থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে কি তাকে কেউ দেখতে পাবে?’ আদিত্য রঞ্জিতকে প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ স্যার। আমাদের হোটেলের সিকিউরিটি সারারাত বাইরে জেগে থাকে। রহমান ঘুমিয়ে পড়লেও সে কিন্তু ঘুমোয় না। সারারাত জেগে থাকাটাই তার কাজ। কেউ রাত্তিরে হোটেল থেকে বেরোলে সিকিউরিটি নিশ্চয় তাকে দেখতে পাবে।’ রঞ্জিত বলল।

সিকিউরিটিকে ডেকে জানা গেল, আগের রাত্তিরে কেউ হোটেল থেকে বাইরে বেরোয়নি। শুধু একজন সাহেব রাত্তির এগারোটা নাগাদ হোটেলে ঢুকে চেক ইন করেছিলেন।

সোমেন মুখুটি যখন আদিত্যকে তার মেসের সামনে নামিয়ে দিল তখন বেলা সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে।

‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে কিছু পাওয়া গেলে আমাকে জানাবেন, প্লিজ।’ আদিত্য গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল।

‘নিশ্চয় জানাব। দেখা হবে।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন