কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য – নবম পরিচ্ছেদ

অভিরূপ সরকার

নবম পরিচ্ছেদ

ট্রেনে বর্ধমানে গিয়ে সেদিনই অনায়াসে ফিরে আসা যায়। আদিত্যরই কয়েকজন বন্ধু আছে যারা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় এবং সপ্তাহে তিন বার কলকাতা থেকে বর্ধমান গিয়ে ক্লাস নিয়ে আবার সেদিনই ফিরে আসে। কিন্তু ডাঃ শুভঙ্কর সামন্ত আদিত্যকে সময় দিয়েছে রাত্তির সাড়ে নটায়। ডাক্তারদের সময় দেওয়া তো। সাড়ে নটা বলে অনায়াসে সাড়ে দশটা অব্দি বসিয়ে রাখতে পারে। অত রাত্তিরে আদিত্য ফিরবে কী করে? তাই সাত-পাঁচ ভেবে আদিত্য একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেলল। সঙ্গে গাড়ি থাকলে ফেরাটা সমস্যা হবে না। তবে রাত্তিরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রাকদের কনভয় বেরোয়। একবার একটা কনভয়ের পেছনে আটকে গেলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ বাড়ি থেকে রওনা হয়ে গেল আদিত্য। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ার একাধিক কারণ। একে তো ডাঃ শুভঙ্কর সামন্তর বাড়ি ও চেম্বার খুঁজে বার করার জন্য কিছুটা সময় হাতে রাখা প্রয়োজন। তার ওপর রত্না বারবার বলে দিয়েছে বর্ধমান শহরে গেলে ওখানকার গণেশের দোকান থেকে সীতাভোগ-মিহিদানা আনতে হবে। দু-রকম সীতাভোগ-মিহিদানা নাকি পাওয়া যায়। ঘি এবং এমনি। ঘি-এর দাম বেশি, এবং রত্না স্পষ্ট করে দিয়েছে সেটাই আনতে হবে। রত্নার কথা অমান্য করা অসম্ভব। তাই সেসব কাজের জন্যেও খানিকটা সময় হাতে রাখা দরকার। তাছাড়া যাবার পথে শক্তিগড়ে থেমে ল্যাংচা কেনারও ইচ্ছে আছে।

ডাঃ শুভঙ্কর সামন্তর বাড়ি এবং চেম্বারটা তারাবাগ পোস্টাপিসের কাছে। বাড়ির পাশেই চেম্বার। জায়গাটা কৃষ্ণসায়র থেকে খুব দূরে নয়। দিনের বেলা হলে কৃষ্ণসায়র পার্কে খানিকটা সময় কাটানো যেত, কিন্তু সন্ধেবেলা সেটা নিশ্চয় বন্ধ থাকবে।

কলকাতার রাস্তায় বেশ জ্যাম। দ্বিতীয় সেতু পেরিয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে অব্দি পৌঁছতেই অনেকটা সময় লেগে গেল। আদিত্য মনে মনে ভাবছিল, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ভালই করেছে। আজকাল রাস্তাঘাটের ওপর একেবারেই ভরসা করা যায় না। সাঁতরাগাছিতে পৌঁছে আবার জ্যাম। ব্রিজ সারাই হচ্ছে। দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। আধঘণ্টা হয়ে গেল। যানজট কাটিয়ে গাড়ি যখন ডানকুনি পৌঁছেচে তখন আদিত্যর হাতে আর পৌনে দু-ঘণ্টা বাকি।

‘আমাকে সাড়ে নটার মধ্যে তারাবাগ পোস্টাপিসের কাছে পৌঁছতে হবে। তার আগে শক্তিগড় থেকে ল্যাংচা কিনব, বর্ধমানে ঢুকে গণেশ সুইটস থেকে সীতাভোগ-মিহিদানা কিনব। এত কিছু করতে পারব?’

‘দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ফাঁকা পেলে সব কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু লরির জাম থাকলে কিছুই বলা যায় না।’ ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে জানাল।

এটা সেই গাড়ি যেটা কেয়া মাঝে মাঝে ভাড়া করে। ড্রাইভারও একই। গাড়িটা কেয়াই ভাড়া করিয়ে দিয়েছে। সৌভাগ্যবশত, আদিত্যরা যেদিকে যাচ্ছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের সেদিকটা একেবারে ফাঁকা। কিন্তু উল্টোদিকে সারি সারি কলকাতাগামী ট্রাক জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে আদিত্য শিউরে উঠল। ফেরার সময় রাস্তার এরকম অবস্থা থাকলে কপালে দুঃখ আছে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ড্রাইভার একশ’ কিলোমিটার স্পিড তুলে দিয়েছে। গাড়ি যখন শক্তিগড়ে তখন আদিত্যর ঘড়িতে আটটা চল্লিশ। ল্যাংচা কিনে, সীতাভোগ-মিহিদানা কিনে সে ডাঃ শুভঙ্কর সামন্তর বাড়িতে পৌঁছল সাড়ে নটা বাজার মিনিট ছয়েক আগে।

ডাঃ শুভঙ্কর সামন্তর বসতবাড়িটা একতলা। হাল ফ্যাসানের বাড়ি, দেখে মনে হয়, খুব বেশিদিন তৈরি হয়নি। বাড়ির গায়ে শুভঙ্কর সামন্তর নাম লেখা। পাশে আর একটা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার একতলাটা মোটামুটি তৈরি হয়ে গেছে, সেখানেই ডাঃ শুভঙ্কর সামন্তর চেম্বার। তার ওপরে, দোতলা থেকে পাঁচতলা অব্দি, বাকি বাড়ির কঙ্কালটুকু খাড়া করা হয়েছে মাত্র। একতলায় ঢোকার মুখে একটা অস্থায়ী সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ‘কুমুদিনী শিশু চিকিৎসালয়, তারাবাগ, বর্ধমান।’

 শুভঙ্কর সামন্ত বলেছিল রাত্তির সাড়ে নটা নাগাদ তার চেম্বারে চলে আসতে। সাড়ে নটা বাজতে আর সামান্য কয়েক মিনিট বাকি, কিন্তু এখনও চেম্বারে ভিড় উপচে পড়ছে। আদিত্য হিসেব করে দেখল, ডাক্তারবাবুর ছাড়া পেতে পেতে এখনও অন্তত এক ঘণ্টা। সে ড্রাইভারকে বলল, ‘আপনি খেয়ে আসুন। আমাকে এখানে বেশ কিছুক্ষণ থাকতে হবে মনে হচ্ছে।’

একতলায় ঢুকেই একটা রিসেপশন। আদিত্য ঢুকতেই রিসেপশনের মেয়েটি তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘আমি কাউকে দেখাতে আসিনি। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমার অন্য একটা দরকার আছে। উনি আমাকে সাড়ে নটার সময় আসতে বলেছিলেন।’ আদিত্য বিনীতভাবে জানাল।

‘মেডিক্যাল রেপ্রেসেন্টেটিভ? নটার সময় কিন্তু ওরা অনেকে ঢুকেছিলেন। এখন আর কোনও রেপ্রেসেন্টেটিভ স্যার অ্যালাউ করবেন না। আপনি ঠিক সময় এলেন না কেন?’

‘না, না। আমি মেডিক্যাল রেপ্রেসেন্টেটিভ নই। দেখুন আমার হাতে ব্যাগ ট্যাগ কিচ্ছু নেই।’ আদিত্য তার খালি হাত দুটো দেখিয়ে খানিকটা হাস্যকরভাবে নিজের কথাটা প্রমাণ করতে চাইল। তারপর নিজের হাবভাবে নিজেই লজ্জা পেয়ে গিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘আমার দরকারটা ব্যক্তিগত। আপনি আমার নামটা ডাক্তারবাবুকে গিয়ে বললেই উনি বুঝতে পারবেন।’

‘ঠিক আছে। আপনার নামটা এই স্লিপটায় লিখে দিন। আমি ডাক্তারবাবুকে দিয়ে আসছি।’

আদিত্য স্লিপে নিজের নাম এবং রেফারেন্স হিসেবে ডাঃ নীলাদ্রি দত্তর নাম লিখে টেবিলের ওপর রাখার পরেও রিসেপশানিস্ট মহিলা আদিত্যকে এবং তার লেখা স্লিপটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অনেকক্ষণ মোবাইলে কথা বলে গেলেন। মিনিট পাঁচেক এইভাবে কেটে যাবার পর ভদ্রমহিলা স্লিপটা নিয়ে ঢুকে গেলেন ডাক্তারবাবুর খাস কামরায়। একটু পরে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার আপনাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। একটু বসতে হবে। রুগি দেখা শেষ হলে স্যার আপনাকে ডেকে নেবেন।’

‘আমি কি তাহলে একটু চা খেয়ে আসতে পারি?’

‘ঠিক আছে। ঘুরে আসুন।’ ভদ্রমহিলা চারদিকে তাকিয়ে ঘরে অপেক্ষমাণ রুগির সংখ্যাটা একবার জরিপ করে নিলেন। তারপর বললেন, ‘আধঘণ্টার বেশি দেরি করবেন না।’

আসার পথে আদিত্য খেয়াল করেছিল এই গলিটার মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে। খাপরার চাল, দরমা দিয়ে ঘেরা রাস্তার চায়ের দোকান। আদিত্যর পক্ষে আপাতত ওই যথেষ্ট। তবে গাড়িতে আসার সময় চায়ের দোকানটাকে যতটা কাছে মনে হয়েছিল, হাঁটতে গিয়ে দেখল মোটেই ততটা কাছে নয়।

দোকানে আরও দু-চারজন চা খাচ্ছে।

‘ডাক্তারবাবুর চেম্বারে কি রোজই এরকম ভিড় থাকে?’ আদিত্য চায়ে চুমুক দিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করল।

‘কোন ডাক্তারবাবু? এই গলির মধ্যে তিনজন ডাক্তার।’ চা-ওলা ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল। যেন বলতে চায় তাদের এই মহল্লায় অভিজাত ব্যক্তিদের ছড়াছড়ি।

‘ওই ডাক্তার সামন্ত। যিনি বাচ্চাদের ডাক্তার।’ আদিত্য নিরীহ গলায় বলল।

‘ভদ্রলোককে নতুন পেয়ে গুপ্পি মারছ কেন, কানুদা?’ চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই একজন খদ্দেরের গলা শোনা গেল এক কোনা থেকে। ‘এই পাড়ায় ডাক্তার বলতে তো ওই শুভঙ্কর সামন্তই। অন্য দু-জন যাদের কথা বলছ তাদের একজন তো হোমোপাখি আর আরেকজন এতই বুড়ো যে নিজেই চোখে দেখতে পায় না।’

‘তুই জানিস ভট্টাচাজ্জি ডাক্তারের কত রুগি হয়?’ কানু নামক চা-ওলা হার মানার লোক নয়।

‘আরে ছাড়, ছাড়। হোমোপাখির আবার রুগি। দশ টাকার ভিজিট আর দশ টাকার ওষুধে হয়ে যায় বলে কিছু মুটে-মজুর ওখানে ভিড় করে। তোমাদের ভট্টাচাজ্জি কোনও দিন রোগ সারাতে পেরেছে?’

‘ভট্টাচাজ্জি ডাক্তারের ওপর বীরুর খুব রাগ। এত রাগ কেন রে বীরু?’ আরেকজন আলোচনায় যোগ দিয়েছে।

এরপর কিছুক্ষণ ভট্টাচাজ্জি ডাক্তারের দোষগুণ নিয়ে প্রবল তর্কাতর্কি চলল। দোকানের অন্য চা-পায়ীরা সকলেই তর্কে যোগ দিয়েছে। আদিত্যর অস্তিত্ব তারা ভুলেই গেছে মনে হয়। তর্কের শব্দমাত্রা যখন একটু কমেছে এবং গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর পর সকলেই একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, তখন আদিত্য সুযোগ বুঝে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘এখানে কি একটা ছোটদের নার্সিং হোম হচ্ছে?’ প্রশ্নটা বিশেষ কারও উদ্দেশে নয়, যে উত্তর দেবে তার উদ্দেশে।

‘হচ্ছে তো। দেখলেন না সাইন বোর্ড? আপনি তো ডাঃ সামন্তর চেম্বারেই গিয়েছিলেন।’ কানু চা-ওলা বলল।

‘দেখলাম তো। দেখলাম, শুধু একতলাটা তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। তাই জিজ্ঞেস করছি।’

‘আমিও কিন্তু দেখছি নার্সিং হোম তৈরির কাজ একমাসের ওপর বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে।’ বীরু বিস্কুটে কামড় দিয়ে বলল।

‘এই সময় কাজটা এগিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। এর পর তো বৃষ্টি নেমে যাবে।’ কানু বিজ্ঞের মতো বলল।

শুভঙ্কর সামন্তর চেম্বারে ফিরে আসার পর আদিত্যকে আরও আধঘণ্টা বসে থাকতে হল। দিনের শেষ রুগিটি দেখে তাকে বকতে বকতে শুভঙ্কর নিজেই তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল। মাঝারি গড়ন, মাঝারি উচ্চতা, গায়ের রঙ ফরসার দিকে। মনে হয় শুভঙ্কর সামন্ত তার মায়ের রঙ পেয়েছে। তবে মুখাবয়বে বটুক সামন্তর ছাপ আছে।

শেষ রুগিটি একটি মেয়ে, বয়েস এক বছরের নিচে। আপাতত সে তার বাবার কোলে রয়েছে। পিছনে বাচ্চার মা। আদিত্য শুনতে পেল বাচ্চার মাকে শুভঙ্কর বলছে, ‘বলিহারি আপনাদের আদিখ্যেতা। বাচ্চার দাঁত উঠছে না বলে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। কখনও শুনেছেন, কোনও বাচ্চার দাঁত উঠলই না? আমি কোনও ওষুধ দেব না। দাঁত আপনা-আপনি উঠবে।’

বাচ্চার মা বোধহয় মিনমিন করে কিছু একটা বলতে গেল।

শুভঙ্কর আবার ধমক লাগাল, ‘বলছি তো ওষুধ দেব না। বাড়ি চলে যান।’ এবার গলা বেশ উঁচু পর্দায়।

বাবা-মা বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে যাবার পর শুভঙ্কর সামন্ত আদিত্যকে খেয়াল করল। তাকে বসে থাকতে দেখে রুক্ষভাবে বলল, ‘আপনি ধরে নিচ্ছি আদিত্য মজুমদার। আপনাকে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না। কাল খুব ভোরে আমাকে উঠতে হবে।’ তারপর আদিত্যকে শুনিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘যত্ত সব উটকো ঝামেলা।’

কথা বলতে বলতে শুভঙ্কর ডাক্তার একটু এগিয়ে গেছে। এগিয়ে গিয়ে রিসেপশনের মেয়েটিকে বলল, ‘তুমি বাড়ি চলে যাও। কাল কখন থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছ?’

‘বিকেল তিনটে থেকে স্যার। তাছাড়া কাল তো পোলিও খাওয়ানোর দিন।’

‘তুমি তাহলে আড়াইটের সময় এসে চেম্বার খুলো।’

মেয়েটি বেরিয়ে যাবার পর ফাঁকা ঘরে আদিত্য আর শুভঙ্কর সামন্ত।

‘বলুন। চটপট বলে ফেলুন কী বলবেন।’ শুভঙ্কর সামন্ত আদিত্যর সামনে এসে বসল।

‘আপনার সময় বেশি নেব না। সারাদিন কাজ করে আপনি নিশ্চয় খুব ক্লান্ত।’ আদিত্য বিনীতভাবে শুরু করতে যাচ্ছিল।

তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শুভঙ্কর সামন্ত বলে উঠল, ‘ওসব ফালতু শান্তিপুরী ভদ্রতা-টদ্রতাগুলো কাটান। চটপট বলে ফেলুন কী বলবেন।’

অপমানে আদিত্যর কানদুটো গরম হয়ে গিয়েছিল। তবু সে মাথা ঠান্ডা রেখে শান্তভাবে বলল, ‘আমার দুটো প্রশ্ন। এক, আপনার বাবা সত্যজিৎ সামন্তর সঙ্গে আপনার কতটা যোগাযোগ আছে? মানে, কত ফ্রিকোয়েন্টলি আপনার বাবার সঙ্গে আপনার দেখা হয়, এবং শেষ কবে তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল? দু-নম্বর প্রশ্ন, আপনি যে এই নার্সিং হোমটা বানাচ্ছেন সেটা কি আপনার বাবা ফাইনান্স করছেন?’

প্রশ্নগুলো শুনতে শুনতে শুভঙ্কর সামন্তর মুখের অভিব্যক্তিটা বদলে যাচ্ছিল। এবার সে গলা তুলে বলে উঠল, ‘আপনাকে আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেব আপনি ভাবলেন কী করে? আপনি কে যে আপনাকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে? আপনি কে, অ্যাঁ? কোন লাটের বাঁট? অনেক রাত্তির হয়ে গেছে। এবার আপনি কেটে পড়ুন। নাহলে আমার সিকিউরিটিকে ডেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেব। আমার সিকিউরিটি কিন্তু আমার মতো এত কথা বলে না। প্রথমেই হাত চালিয়ে দেয়। সো গেট লস্ট।’

আদিত্য যেখানে বসে ছিল, কিছুক্ষণ সেখানেই স্থিরভাবে বসে থেকে খুব ঠান্ডা চোখে শুভঙ্কর সামন্তর দিকে সে তাকিয়ে রইল। তাকে একটুও বিচলিত না দেখে শুভঙ্কর সামন্ত কিছুটা থমকে গেছে। তাছাড়া আদিত্যর চোখের দৃষ্টিতেও কিছু একটা ছিল যা শুভঙ্কর সামন্তকে চিন্তায় ফেলছিল।

‘আজ আমি যাচ্ছি।’ আদিত্য খুব থেমে থেমে বলল। ‘এর পরে পুলিশের সঙ্গে আসব। সেদিন কিন্তু অন্য ভাষায় কথা বলব। হয়ত সেই ভাষাটা আপনি আরও সহজে বুঝতে পারবেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। আপনার বাবা চোরাই কারবার করে গ্রেপ্তার হয়ে আপাতত জামিনে মুক্ত আছে। তার চোরা কারবারের টাকায় আপনি নার্সিং হোম করছেন। পুলিশ আপনাকে ছাড়বে না। কোমরে দড়ি পরিয়ে ধরে নিয়ে যাবে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছিলাম। আপনার দুর্ভাগ্য আপনি সেটা বুঝলেন না। যাই হোক আমার প্রশ্ন দুটোর উত্তর আমি খানিকটা পেয়ে গেলাম। বাকি উত্তরের জন্যে মনে হচ্ছে আবার খুব শিগগির আসতে হবে। নমস্কার।’ খুব ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে আদিত্য উঠে দাঁড়াল।

সাফারি সুট পরা বলিষ্ঠ একটা লোক ঘরে ঢুকেছে। শুভঙ্কর সামন্তর সিকিউরিটি। আদিত্য শরীরটাকে টানটান করে রেখে দরজার দিকে হাঁটছে। বলা যায় না, লোকটা আক্রমণ করতে পারে। শুভঙ্কর সামন্ত তার সিকিউরিটিকে কিছু একটা ইশারা করল। লোকটা আদিত্যকে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে আদিত্য একবার পেছন ফিরে শুভঙ্কর সামন্তর দিকে তাকাল। আদিত্যর মনে হল, শুভঙ্কর সামন্ত ভয় পেয়েছে। বেশ ভয় পেয়েছে।

মোবাইল বাজার শব্দে আদিত্যর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম চোখে দেখল ঘড়িতে বেলা পৌনে এগারোটা। গতকাল রাত্তিরে বর্ধমান থেকে ফিরতে প্রায় তিনটে বেজে গিয়েছিল, ঘুম আসতে আসতে চারটে। এমনিতে অত দেরি করে ফেরার কথা নয়। কিন্তু একে তো রাস্তায় ট্রাকদের কনভয়, তার ওপর ডিনার খাবার জন্য পথে থামতে হয়েছিল। হাইওয়ের ধারে ধাবার তেল-মশলাদার তড়কা-রুটি এবং তার সঙ্গে অনিয়মিত ঘুম, দুই মিলিয়ে, আদিত্য টের পেল, তার চোঁয়া ঢেঁকুর ভাঙছে।

মোবাইলে একটা অচেনা নম্বর বাজছে। আদিত্য ঘুম জড়ানো গলায় ‘হ্যালো’ বলতে ওপার থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল, ‘আমি কি আদিত্য মজুমদারের সঙ্গে কথা বলছি?’

গলার স্বরটা আদিত্যর সামান্য চেনা-চেনা লাগছে। সে বলল, ‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আমার নাম সুমনা ঘোষাল। একবার খুব অল্প সময়ের জন্যে আমার বন্ধু সত্যজিৎ সামন্তর ভাবানীপুরের বাড়িতে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আপনার কি মনে আছে?’ সেদিনের সেই ঔদ্ধত্যের ছিটেফোঁটাও সুমনা ঘোষালের গলায় আজ নেই।

‘আপনাকে আমার খুব ভালই মনে আছে। তাছাড়া ম্যাডাম, আপনি তো একজন সেলিব্রিটি। আপনাকে ভুলব কী করে?’ আদিত্য নিজের গলাটাকে যথাসম্ভব সরল রাখার চেষ্টা করল, পাছে সুমনা ঘোষাল মনে করে সে ঠাট্টা করছে।

‘আপনার সঙ্গে আমার খুব দরকার।’ সুমনার গলাটা আকুল শোনাল। ‘খুব বিপদে পড়ে আপনাকে ফোন করছি। কোথায় গেলে আপনার সঙ্গে গোপনে কথা বলা যেতে পারে?’

‘আপনি আমার অফিসে চলে আসতেই পারেন।’ আদিত্য সতর্কভাবে বলল। ‘তবে আপনাকে যদি কেউ চিনে ফেলে তাহলে ব্যাপারটা আর গোপন থাকবে না। সেক্ষেত্রে আপনার কথাগুলো যদি বটুকবাবুর সামনে বলা চলে তাহলে আমিই বরং বটুকবাবুর বাড়ি চলে যেতে পারি। কথা হচ্ছে, বটুকবাবুর সাক্ষাতে কথাগুলো বলা চলবে কি?’

‘খুব ভালই চলবে। বটুকই তো আপনাকে ফোন করতে বলল। ও সবটাই জানে। আপনি কখন আসতে পারবেন?’

‘ধরুন এই বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ। তবে একটা শর্ত। বটুকবাবুকে আমার কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। বটুকবাবু যেন আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন, এটুকু আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে। সেটা আপনি পারবেন তো?’

‘আপনার সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে বটুককে রাজি করাতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু সে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে কিনা সেটা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়।’

‘ঠিক আছে। আপনি বটুকবাবুর সঙ্গে আমার কথা বলিয়ে দিলেই হবে। আমি তাহলে সাড়ে চারটে নাগাদ চলে আসছি।’

কয়েকদিন হল দুর্দান্ত গরম পড়েছে। মেট্রোর ঠান্ডা ভূগর্ভ থেকে ওপরে উঠতেই আদিত্য টের পেল বিধাতা পুরুষ এই শহরে আর একটা হিট-ওয়েভ আমদানির পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছেন। সাধারণত কলকাতার গরমে যে প্যাচপ্যাচে ভাবটা থাকে এখন সেটাও নেই। তার বদলে এই বিকেল চারটেতেও সূর্যের শুষ্ক আগুন চারদিক জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। এই সময় জগুবাবুর বাজারের বাইরে একটু একটু করে তরিতরকারির দোকান বসে যায়। আজ এখনও বসেনি। নিশ্চয় গরমের কারণে। আদিত্য জগুবাবুর বাজারের পাশের রাস্তাটা ধরে পদ্মপুকুরের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

বলরাম মল্লিকের আদি মিষ্টির দোকানটা বাঁ হাতে রেখে আদিত্য খানিকটা এগিয়েছে এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। সোমেন মুখুটি ফোন করছে।

‘ফিরে এসেছেন? নাকি উত্তরবঙ্গ থেকে বলছেন?’ আদিত্য ফোনটা ধরে বলল।

‘গতকাল ভোরবেলা ফিরেছি। ফিরেই লালবাজার গেছিলাম। তারপর কাজে এমন আটকে পড়লাম যে সারাদিন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি।’

‘তা তো হবেই। এত দিন ছিলেন না। নিশ্চয় অনেক কাজ জমে গিয়েছিল।’

‘কিছু কাজ তো জমেই ছিল। কিন্তু সেটা কথা নয়। বলার কথা হল, অবশেষে সেই শিবেন মাইতিকে ধরতে পেরেছি। ব্যাটাচ্ছেলে শ্বশুরবাড়ির গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে বসেছিল। কোচবিহারের ইন্টিরিয়ারে। খুব দৌড় করিয়েছে। যাই হোক ওকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। একটা প্রাথমিক ইন্টারোগেশান হয়ে গেছে। আজ বিকেল থেকে আসল ইন্টারোগেশান শুরু করব। আপনি কি আসতে পারবেন?’

‘আজ বোধহয় আমার হয়ে উঠবে না। একটা অন্য কাজে যাচ্ছি। আপনি জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিন। আমি পরে আপনার কাছ থেকে জেনে নেব কী হল।’

‘ঠিক আছে। কিছু বার করতে পারলেই আমি আপনাকে জানাব।’ সোমেন মুখুটি ফোন রেখে দিল।

আদিত্যর মনে হল সে জিজ্ঞাসাবাদের সময় না থাকতে পারাতে সোমেন মুখুটি মনে মনে খুশিই হয়েছে। তাকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। এই কেসটা সে নিজের মতো করে একরকমভাবে তৈরি করছে। চিন্তাভাবনা, দৌড়দৌড়ি সব তার একার। তাই অন্য কাউকে সে তার কৃতিত্বের ভাগ দিতে চায় না। নেহাত গৌতমের মতো একজন খুব সিনিয়ার অফিসার নির্দেশ দিয়েছে বলে মুখুটি মাঝে মাঝে আদিত্যকে কেসটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করে রাখছে।

আদিত্য যখন বটুক সামন্তর বাড়ির সামনে পৌঁছল তখন সে প্রায় হাঁপাচ্ছে। প্রবল গরমে অতটা হাঁটার ফলে তার রীতিমতো অসুস্থ লাগছিল। লোহার গেট দিয়ে ঢুকে আদিত্য দেখল হণ্ডা অ্যাকর্ডটা ঠিক আগের দিনের মতো ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু গ্যারেজের ভেতরে বা বাইরে বড় বি এম ডাবলুটা কোথাও নেই।

মিনিট দশেক পরে বটুকবাবুর বসার ঘরে বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘এবার বলুন কী আপনার সমস্যা।’

কথাটা সুমনা ঘোষালের উদ্দেশে বলা হলেও তার উত্তর দিলেন বটুক সামন্ত।

‘মিতুল ওর সমস্যাটা বলার আগে আমি একটু বলে নিই। সমস্যাটা ওর ছেলে রনিকে নিয়ে। রনি একটা পুলিশি ঝামেলায় পড়তে পারে। আপনি বলেছিলেন আপনার সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক ভাল। তাই মনে হল এই ব্যাপারে আপনি হয়তো রনিকে একটু সাহায্য করতে পারেন। আপনার যা ন্যায্য পারিশ্রমিক সেটা আমরা অবশ্যই দেব।’ বটুকবাবু চুপ করলেন।

‘আগে সমস্যাটা শুনি। তারপর বলতে পারব সুমনা ম্যাডামের ছেলেকে আমি হেল্প করতে পারব কিনা। আর পারিশ্রমিক নেবার প্রশ্নটা তো উঠছেই না। রনি যদি কোনও অন্যায় করে থাকে তাহলে তো তাকে পুলিশ ধরবেই। সেক্ষেত্রে আমি যদি আমার ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে রনিকে ছাড়িয়ে আনি তাহলে তো সেটা ঘুষ নেওয়া হয়ে যাবে। আমি প্রথমেই বলে রাখি, আমি ঘুষ নিয়ে অন্যায় কাজ করি না।’ আদিত্যর গলাটা একটু উত্তেজিত শোনাল।

‘রনি কোনও অন্যায় কাজ করেনি। ওর মতো শান্ত ছেলের পক্ষে এমন কোনও অন্যায় করা সম্ভব নয় যাতে ওকে পুলিশে ধরতে পারে। ভাগ্য খারাপ বলে একটা বিশ্রী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে।’ সুমনা ঘোষাল তার সপ্তকে গলা তুলে বললেন।

‘ম্যাডাম, আপনি এত উত্তেজিত হবেন না। রনি যদি কোনও অন্যায় না করে থাকে তাহলে কেউ তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। পুলিশও নয়। কিন্তু সবার আগে পুরো ব্যাপারটা আমাকে বলুন।’

সুমনা ঘোষাল চুপ করে রইলেন। মনে হয় তিনি নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন। আদিত্যর মনে হল সুমনার চেহারায় একটা আশঙ্কার ছায়া পড়েছে। দু-ঢোঁক জল খেয়ে সুমনা ঘোষাল বলতে শুরু করলেন।

‘আমার ছেলে রনি, যার ভাল নাম রণপ্রিয়, স্কুল পাস করার পরে বি কম পড়েছিল। আজকাল তো শুধু বি কম পাশ করে চাকরি-বাকরি পাওয়া যায় না, তাই ওকে ব্যাঙ্গালোরে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট পড়ালাম। শুনেছিলাম এটা পাস করলে নাকি হোটেলে বা হাসপাতালে চাকরি পাওয়া যায়। চাকরি একটা পেয়েও গেল রনি। এখানে নয়। নয়ডার একটা নতুন হোটেলে। সেখান থেকেই ওর দুর্ভাগ্যের শুরু।’

সুমনা ঘোষাল থামল। আরও একঢোঁক জল খেল। তারপর আবার বলতে লাগল।

‘চাকরিটা রনির প্রথম থেকেই সুট করেনি। নতুন হোটেল, কর্মচারীর সংখ্যা কম, তাই উদয়াস্ত খাটতে হতো। ফিক্সড অফিস আওয়ার বলতে কিছু নেই। হোটেল সংলগ্ন স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে, যখন তখন কাজে ডাক পড়ে। অত পরিশ্রম করে রনির শরীরটা ভেঙে পড়তে শুরু করল। কিন্তু আসল সমস্যা সেটা নয়। যে হোটেলে রনি চাকরি করত সেখানে একটি বাঙালি মেয়েও কাজ করত। রনির সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসা হয়। সম্পর্কটা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এতটাই যে, ওরা ঠিক করল বিয়ে করবে। ওই হোটেলের চাকরিটা মেয়েটাও আর করে উঠতে পারছিল না। ওরা দুজনেই মনস্থ করল কলকাতায় ফিরে আসবে। চাকরি খুঁজবে। চাকরি পেলে বিয়ে।’

গল্পটা আদিত্যর চেনা লাগছিল। কোথায় যেন অন্যভাবে শুনেছে। সে বলল, ‘তারপর?’

‘আমি রনিকে কলকাতায় একটা চাকরি জোগাড় করে দিলাম। রোহিত ধামানি আমার অনেক দিনের পরিচিত। ওদের ব্যানারে আমি অনেকগুলো ছবি করেছি। ধামানি সাহেবকে বলতে উনি ওঁদের প্রোডাকশান ইউনিটেই রনির একটা চাকরি করে দিলেন। রনি এখনও সেখানেই আছে। ভাল কাজ দেখিয়ে উন্নতিও করেছে। প্রোডাকশান ম্যানেজার হয়েছে। বটুকের এক বন্ধুর কম্পানিতে মেয়েটিরও একটা চাকরি হয়ে গেল।’

‘মেয়েটির নাম কি পল্লবী ভদ্র?’

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন। হ্যাঁ, মেয়েটির নাম পল্লবী ভদ্র। কিন্তু আপনি বুঝলে কী করে?’ সুমনা ঘোষালকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত দেখাল।

‘আন্দাজ করলাম। বলতে পারেন এডুকেটেড গেস। আমাদের প্রফেশনে কিছুটা খোঁজ খবর তো রাখতেই হয় ম্যাডাম। তার ভিত্তিতে অনুমান করলাম। তবে আপনার ছেলে রনি ঘোষালই যে পল্লবী ভদ্রর প্রাক্তন প্রেমিক সে খবরটা আগে জানতাম না। সম্ভবত পুলিশও জানে না। আমি যতদূর জানি, কিছুদিন আগেও তারা পল্লবী ভদ্রর প্রাক্তন প্রেমিককে ট্রেস করার চেষ্টা করছিল।’

‘এইখানেই আমাদের সমস্যা। আপনি যখন এত খবর রাখেন তখন এটাও নিশ্চয় জানেন যে পল্লবীর সঙ্গে রনির সম্পর্কটা পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল। পল্লবী তার বসের সঙ্গে রাত কাটাত। ফলে রনির সঙ্গে পল্লবীর আর কোনও যোগাযোগই ছিল না। কিন্তু টেলিভিশনে যখন রনি দেখল পল্লবী খুন হয়েছে তখন সে আমাকে বলল যে সে পুলিশের কাছে গিয়ে পল্লবীর সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাটা জানিয়ে দেবে। আমি ওকে ভীষণভাবে বারণ করলাম। আমার মনে হলো এসব পুলিশি ঝামেলায় নিজের থেকে জড়িয়ে পড়ার কোনও মানেই হয় না। তারপর যত দিন গেছে, তত কেসটা নিয়ে হইচই বেড়েছে আর ততই রনির পক্ষে পুলিশের কাছে যাওয়াটা শক্ত হয়ে গেছে। দেরি করে পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ তো বলবেই এতদিন আসেননি কেন? এ-নিয়ে রোজ রাত্তিরে রনির সঙ্গে আমার তর্কাতর্কি হত। রনি পুলিশের কাছে যাবেই, আর আমিও যেতে দেব না। শেষে, আমাকে না বলে, গতকাল লালবাজারে গিয়ে রনি পল্লবীর সঙ্গে তার পুরোনো সম্পর্কের কথা বলে এসেছে। পুলিশ বড় করে ইন্টারোগেশনের জন্যে রনিকে আবার ডাকবে বলেছে। কেসটা হ্যান্ডেল করছেন ইন্সপেক্টার সোমেন মুখুটি। রনি আমাকে বলেছে, একে সঙ্গে নিয়েই আপনি ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন।’

‘আপনি আমাকে ঠিক কী করতে বলছেন?’

‘দেখুন আমার ছেলেকে আমার থেকে বেশি কেউ চেনে না। ও অত্যন্ত নিরীহ, ভিতু একজন মানুষ। হয়তো কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট। কিন্তু খুন করা দূরে থাক, কাউকে একটা চড় মারাও ওর পক্ষে অসম্ভব। মুশকিল হল, পুলিশ তো এখন বলতেই পারে ও প্রতিহিংসাবশত পল্লবীকে খুন করেছে। দেখুন, কিছুদিন হল আর একটি মেয়ের সঙ্গে ওর ভাব হয়েছে। হয়তো কিছুদিন পরে ওরা বিয়েও করবে। এই অবস্থায় রনি হঠাৎ পল্লবীকে খুন করতে যাবে কেন? ও তো পল্লবীকে ভুলেই গিয়েছিল। এই ব্যাপারটা আপনি পুলিশকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, প্লিজ?’

‘ঠিক আছে। আমি যতটুকু পারি সোমেন মুখুটিকে বুঝিয়ে বলব। তবে পুলিশের ব্যাপার তো। কতটা বোঝাতে পারব জানি না। এদের মাথায় একটা কিছু ঢুকে গেলে আর বেরতেই চায় না। যাই হোক, আমি চেষ্টা করব। আশা করি, খুনের দিন রাত্তিরবেলা রনি যে অন্য কোথাও ছিল সেটা সে প্রমাণ করতে পারবে।’

‘রনি বলছে খুনের রাত্তিরে ও বাড়িতেই ছিল। সন্ধ্যাদি, মানে ওর কাজের মাসি, যে ওকে ছোট থেকে মানুষ করেছে, সে সাক্ষী আছে।’

‘ঠিক আছে। দেখছি কী করা যায়।’ আদিত্য খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বটুকবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার কি আমি আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে পারি?’

‘আমি তাহলে চলে যাচ্ছি। তোমরা কথা বল।’ সুমনা ঘোষাল উঠে দাঁড়াল।

‘না, না। তুমি থাক।’ বটুক সামন্ত সুমনার হাত ধরে আবার বসিয়ে দিল।

আদিত্য দেখল খানিকটা উদগ্রীব হয়ে বটুক সামন্ত তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার তিনটে প্রশ্ন। ফিরদৌসের খুনের কেসটা সলভ করার ব্যাপারে পুলিশ আমার সাহায্য চেয়েছে। সেই কারণে প্রশ্নগুলো করছি। হয়ত পুলিশ অলরেডি আপনাকে প্রশ্নগুলো করেছে। সেক্ষেত্রেও কিন্তু আপনার উত্তরগুলো আর একবার কষ্ট করে আমাকে জানাতে অনুরোধ করব।’

বটুক সামন্ত কথা বলছে না। স্থির দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আছে।

‘আমার প্রথম প্রশ্ন মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানি নিয়ে। এরা আপনাদের মাধ্যমে কোটি-কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা করেছে। অথচ ওদের অফিসটা দেখে মনে হল না ওদের অত টাকা লেনদেন করার ক্ষমতা আছে। আপনার কখনও মনে হয়নি যে ওদের টাকাটা সৎ পথে আসে না?’

‘দেখুন এই ধরনের একটা প্রশ্ন পুলিশও আমাকে করেছিল। তাদের যেটা বলেছি আপনাকে আবার সেটা বলছি। আমার কম্পানি কুমুদিনী বিত্ত নিগম একটা শেয়ার ব্রোকার ফার্ম। মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট আমাদের সব থেকে বড় ক্লায়েন্ট। শেয়ার ব্রোকার হিসেবে আমরা কখনই জানতে চাইব না মহাদেব কম্পানির টাকাটা এক নম্বরি না দুনম্বরি। ওটা আমাদের এক্তিয়ারেই পড়ে না। পুলিশ সরাসরি ওদের জিজ্ঞেস করে দেখুক না ওদের টাকাটা কোথা থেকে আসছে?’ বটুকবাবুর আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়ছে।

‘ঠিক আছে। আমার পরের প্রশ্নে আসি। আপনি প্রথম দিন আমাকে বলেছিলেন আপনার ধারণা কুড়ি কোটি টাকাটা ফিরদৌসই সরিয়েছিল। তারপর হয়ত কেউ চোরের ওপর বাটপারি করেছে। তাই তো?’

‘একদমই তাই। আমি এখনও বিশ্বাস করি টাকাটা প্রথম ফিরদৌসই সরিয়েছিল।’

‘সেক্ষেত্রে আপনার কাছে জানতে চাইব বহরমপুরে ফিরদৌসের এক পুরোনো বান্ধবী আছে এটা কি আপনি জানেন? বান্ধবীর নাম জয়া অধিকারী। ইস্কুলে আঁকা শেখায়। কুঞ্জঘাটা বাজার পেরিয়ে গঙ্গার কাছে বাড়ি। আপনি চেনেন একে? ফিরদৌস হয়তো টাকাটা এর বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল, তাই জিজ্ঞেস করছি।’

আদিত্যর কথাগুলো শুনতে শুনতে বটুক সামন্তর মুখটা ক্রমশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর সে বলল, ‘ফিরদৌসের যে এরকম একজন বান্ধবী আছে আমি জানতামই না। পুলিশও জানত বলে মনে হয় না।’ বলতে বলতে বটুক সামন্ত নিজেকে সামলে নিল। ‘মানে, পুলিশ জানলে নিশ্চয় আমাকেও জিজ্ঞেস করত।’

‘আমি আর একটা প্রশ্ন আপনাকে করব।’ বটুক সামন্তকে একটু জিরোবার সময় দিয়ে আদিত্য বলল। ‘আপনার ছেলে ডাঃ শুভঙ্কর সামন্ত তার বাড়ির পাশে যে নার্সিং হোমটা করছে সেটা কি আপনার টাকায় করছে? নার্সিং হোমের নাম ‘কুমুদিনী শিশু চিকিৎসালয়’। আপনার কম্পানির সঙ্গে নামে মিল আছে। তাই এই প্রশ্নটা আপনাকে করছি।’

বটুক সামন্তর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। সে কেটে কেটে বলল, ‘ওই নার্সিং হোমটা অবশ্যই আমি আমার ছেলেকে করে দিচ্ছি। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কেন, তাহলে বলব, ওই আমার একমাত্র ওয়ারিশ। আমার যা কিছু আছে সব ওর প্রাপ্য। ওর প্রতি বাবার দায়িত্ব আমি পালন করিনি। তাই এখন সেই ভুল শুধরে নিচ্ছি। এটা নিয়ে আপনার কিছু বলার আছে?’

‘না, না। আমার কেন বলার থাকবে? আপনার টাকা আপনি যাকে খুশি দেবেন। এটা তো আপনার অধিকার। তবে কিনা যদি কখনও প্রমাণিত হয় আপনার টাকাটা আইনের পথে উপার্জন করা হয়নি, তাহলে কিন্তু শুভঙ্করবাবুও বিপদে পড়বেন।’

‘ বটুকের এইসব ব্যক্তিগত কথার মধ্যে আমি প্রথম থেকেই থাকতে চাইনি।’ সুমনা ঘোষাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল। ‘আমি ওপরে যাচ্ছি।’

‘না, না। আপনি থাকুন। আমার কথা বলা হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি।’ এবার আদিত্যও উঠে দাঁড়াল।

বাইরে এসে আদিত্য টের পেল সারাদিন পুড়িয়ে দেওয়া গরমের পর একটা ঠান্ডা হাওয়া ছেড়েছে। হয়তো ঝড় উঠবে। দৈবী করুণা। সত্যিই গরমে আর পারা যাচ্ছিল না।

মেট্রোতে ওঠার আগে আদিত্য বিমলকে ফোন করল। বলল, ‘এক্ষুনি ফোন করে বল তুমি কিছুদিন ডিউটিতে যেতে পারবে না। আর আমার মেসে একবার সাতটা নাগাদ আসতে হবে। খুব দরকারি কয়েকটা কাজ আছে।’

 বিমলের সঙ্গে কথা বলার পর গৌতমকে ফোন করে আদিত্য কিছুক্ষণ কথা বলল।

সোমেন মুখুটি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আদিত্য তার কাছে গিয়ে দ্যাখে সোমেনের মৃদু নাক ডাকছে। একটু আগে বিমলের সঙ্গে কথা বলার পর আদিত্য ঠিক করে রেখেছিল আটটা নাগাদ একবার লালবাজারে গিয়ে দেখবে শিবেন মাইতির ইন্টারোগেশন কতটা এগোল। রনি ঘোষালের ব্যাপারটাও তখন জেনে নেওয়া যাবে। সোমেনকে ফোন করতে সে বলল চলে আসুন।

তারপর গৌতমের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।

মনে হয় গত কয়েকদিন সোমেনের খুব খাটনি গেছে। তার ওপর এই ইন্টারোগেশন। এখন খুব ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে দেখলে যে কারও মায়া লাগবে। আদিত্য খুব মৃদু স্বরে ডাকল, ‘সোমেনবাবু, ও সোমেনবাবু।’

আদিত্যর গলা শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল সোমেন মুখুটি। একটু লজ্জা পেল। ঘুমের ঘোরে তার ডানদিকের গাল বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়েছে।

‘এত টায়ার্ড ছিলাম, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।’ সোমেন রুমাল দিয়ে মুখ মুছে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বলল। ‘আসলে শিবেন মাইতিকে এতক্ষণ জেরা করছিলাম। খুব ধকল গেছে। ওরও, আমারও। ব্যাটাচ্ছেলে সব দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। একটু থার্ড ডিগ্রি দিতে হল। কিন্তু এছাড়া উপায় ছিল না। এখন শুধু ওকে ইণ্টারোগেট করার স্টেটমেন্টটা তৈরি করে ওকে চার্জশিট দিতে হবে। ততদিন ব্যাটা জেলে থাকুক।’ সোমেনের মুখে একটা ক্লান্ত পরিতৃপ্তির হাসি দেখতে পেল আদিত্য।

‘তাহলে তো কেসটা সলভডই হয়ে গেল। আপনি যেরকম ভেবেছিলেন সেরকমই দাঁড়াল তাহলে?’ আদিত্য নিরীহ গলায় প্রশ্ন করল।

‘তাই তো মনে হচ্ছে। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ওপর কুড়ি লক্ষ ডলার ফিরদৌসের গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে সরে যায়। কিছুদিনের জন্য সেটা সিতারা হোটেলে ফিরদোসের কাছে ছিল। পরে ফিরদৌসকে খুন করে গোবিন্দ এবং শিবেন টাকাটা সরিয়ে ফেলে। শুধু খালি ব্যাগটা সিতারা হোটেলে ফেলে রেখে যায়। তারপর গোবিন্দকে খুন করে শিবেন টাকাটা হাতিয়ে নর্থ বেঙ্গল পালায়। ডলারগুলো বাইরে পাচার করে দেয়। শিবেন সবটাই স্বীকার করেছে। ডলার পাচারের ট্রেলটা খানিকটা ধরতে পেরেছি, যদিও টাকাটা এখনও উদ্ধার করতে পারিনি।’

‘শিবেন মাইতির সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘আসলে জেরার পর শিবেন সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। আমার মনে হয় সেখান থেকে দু-একদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে। আমি তখন আপনাকে খবর দেব, কেমন?’

‘ঠিক আছে। আমি না হয় দু-চারদিন পরেই শিবেনের সঙ্গে কথা বলব। কেসটা তো সলভড হয়েই গেছে। আসলে, আমি আর একটা অন্য কারণে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এলাম। শুনলাম, পল্লবী ভদ্রর মার্ডার কেসের ব্যাপারে রনি ঘোষাল বলে একটি ছেলে আপনার কাছে কিছু স্বীকারোক্তি করেছে। রনি ঘোষালের মা বলছেন, তাঁর ছেলে নির্দোষ। ব্যাপারটা আপনার কীরকম মনে হচ্ছে?’

‘ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে আমারও প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে ছেলেটি নির্দোষ। শুধু পুলিশি ঝামেলা এড়াতে এতদিন চুপ করে ছিল। তবে খুনের কেস তো। পুলিশ খুব সহজে ওকে ছাড়বে না। বিশেষ করে সল্ট লেকের পুলিশ, যারা মেন ইনভেস্টিগেশনটা করছে। মনে হয়, সল্ট লেকের পুলিশ শিগগির ওকে ডেকে পাঠাবে। দেখা যাক কী হয়।’

‘রনির মা খুব বিচলিত হয়ে পড়েছেন। আমি কি তাঁকে বলব তাঁর ছেলের কোনও ভয় নেই?’

‘এক্ষুনি কিছু বলবেন না। সল্ট লেকের পুলিশ কীভাবে জিনিসটা হ্যান্ডেল করে আগে দেখে নিই।’

সোমেন মুখুটির সঙ্গে কথা বলে আদিত্য যখন উঠে পড়ল তখন প্রায় নটা বাজে। গৌতম বলেছিল, সে রাত্তির অব্দি অফিসে থাকবে। আদিত্যর জন্যে অপেক্ষা করবে। মুখুটির সঙ্গে কথা বলে আদিত্য যেন সোজা তার ঘরে চলে আসে।

করিডোরটা ফাঁকা, শুধু গৌতমের ঘরের সামনে একজন প্লেন ড্রেসের অ্যাটেনডেন্ট বসে আছে। আদিত্য নিজের নাম বলতে সসম্ভ্রমে ভেতরে নিয়ে গেল।

‘আয়, আয়। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে ডিনার এসে যাচ্ছে। ডিনার খাবি তো?’

‘তুই খাওয়ালে অবশ্যই খাব। সত্যি বলতে কী বেশ খিদে পেয়ে গেছে। কোথা থেকে ডিনার আনতে দিয়েছিস?’

‘রয়েল থেকে। সিমপ্ল খাবার। রুমালি রুটি, চাঁপ আর ফিরনি।’

‘চিকেন না মাটন?’

‘আরে মাটন, মাটন। চিকেন খেতে যাব কোন দুঃখে? বাড়িতে চিকেন খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে গেছে। কিন্তু মালিনী কিছুতেই বাড়িতে মাটন ঢোকাবে না। মাটন খেলেই নাকি সঙ্গে সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।’

মিনিট দশেকের মধ্যে খাবার হাজির। কিঞ্চিৎ গুরুভোজন হয়ে গেল। খাবার শেষ করে আদিত্য কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘এখানে বারান্দা-টারান্দা কিছু আছে? খাবার পরে একটা সিগারেট তো না খেলেই নয়।’

‘বারান্দা অব্দি যাবার দরকার নেই। এখন এখানে কেউ আছে বলে মনে হয় না। তুই এখানেই ধরা। শুধু জানলাটা খুলে দে। আর আমাকেও একটা সিগারেট দে।’

‘তুই ছেড়ে দিয়েছিলি না?’ আদিত্য প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করতে করতে বলল।

‘রোজই তো ছেড়ে দিই। পরের সিগারেটটা খাওয়া অব্দি ছেড়ে দিই।’ গৌতম হাসল।

কথাটা কে যেন একটা বলেছিল। মার্ক টোয়েন নাকি অন্য কেউ? আদিত্যর ঠিক মনে পড়ল না।

এর পরের এক-দেড় ঘণ্টা গৌতমের সঙ্গে কথাবার্তা চলল। গৌতম যখন আদিত্যকে মেসের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে তখন রাত্তির সাড়ে এগারোটা। কাল অনেক কাজ। জাল গুটিয়ে আসছে।

কলকাতা থেকে বহরমপুর গাড়িতে যেতে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়। তার থেকে ভোরের হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসটা ধরাই সুবিধেজনক। ঘুমোতে ঘুমোতে চলে যাওয়া যাবে। আদিত্যর খুব তাড়াতাড়ি বহরমপুর পৌঁছনো দরকার। তার মন বলছে, কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্যের যবনিকাপাত খুব শিগগির ঘটতে চলেছে। কিন্তু ঠিক কবে সেটা ঘটবে আদিত্য এখনও জানে না। তবে সে নিশ্চিত এই যবনিকাপাতের শুরুটা বহরমপুরে হতে চলেছে। এই ব্যাপারে তাকে গৌতম ও বিমলের কাছ থেকে কিছু সিগনালের অপেক্ষায় থাকতে হবে। আর সিগনাল পাবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে রঙ্গমঞ্চে নেমে পড়তে হবে। যেহেতু তার মনে হচ্ছে এবারের রঙ্গমঞ্চটা বহরমপুরে, তাই সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করাই ভাল। নাটকের কুশীলবদের সম্বন্ধে তার ধারণা এখন মোটামুটি পরিষ্কার।

এগারোটায় বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে পৌঁছে গেল ট্রেনটা। মোটামুটি ঘটনাবিহীন ভ্রমণ। অবশ্য ঘটনা ঘটলেও আদিত্যর টের পাওয়ার কথা নয়। ট্রেন শেয়ালদা ছাড়ার পর থেকেই সে একটানা ঘুমিয়েছে। এমনকি চা খেতেও ওঠেনি। ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাসটা সে বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। বহরমপুর স্টেশনে পৌঁছে ঘুমটা নিজের থেকেই ভেঙে গেল। স্টেশনের বাইরে এসে আদিত্য দেখল সেই আগের বারের ছেলেটি টোটো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্যর সঙ্গে অবশ্য কাল রাত্তিরেই তার কথা হয়ে গিয়েছিল।

একটা হোটেলে ঘর ঠিক করা আছে। গৌতমই ঠিক করে দিয়েছে। গৌতমের পিএ ট্রেনের টিকিটের সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের ভাউচারটাও মেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। হোটেলটা ভালই। গঙ্গার ধারে। একতলায় রেস্টোরেন্ট। আদিত্যর ঘরটা তিনতলায়। তার ওপরে মনে হয় আরও দুটো তলা আছে। আদিত্য ঘরে ব্যাগটা রেখে চা খাবার মতলবে নেমে এসে রেস্টোরেন্টে ঢুকে দেখল এর মধ্যেই লাঞ্চ শুরু হয়ে গেছে। মেরুন রঙের উর্দিপরা বেয়ারা সবিনয়ে জানাল আবার সেই তিনটের পরে রেস্টোরেন্টে চা পাওয়া যাবে। তবে আদিত্য যদি সত্যিই এখন চা খেতে চায় তাহলে ঘর থেকে ফোন করে রুম সার্ভিসে চা আনিয়ে নিতে পারে। রুম সার্ভিসের ফোন নম্বর ঘরেই পাওয়া যাবে।

আদিত্য রেস্টরেন্ট থেকে বেরিয়ে রিসেপশানের সামনে দাঁড়াল। সে ঠিক করতে পারছিল না ঘরে ফিরে রুম সার্ভিসে চা আনিয়ে নেবে নাকি হোটেল থেকে বেরিয়ে দু-পা হেঁটে গিয়ে দেখবে রাস্তায় চায়ের দোকান-টোকান কিছু আছে কিনা। আদিত্য হঠাৎ খেয়াল করল রিসেপশানের মেয়েটি তার খাতাপত্রের থেকে চোখ তুলে আদিত্যর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘বহরমপুরের আশেপাশে সাইট সিয়িং-এর কোনও গাইড বা লিটরেচার পাওয়া যাবে?’ আদিত্য মেয়েটির জিজ্ঞাসু দৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য জিজ্ঞেস করল।

‘যাবে।’ আদিত্যর হাতে ব্রোশিয়োর জাতীয় কিছু কাগজ তুলে দিল মেয়েটি।

‘আচ্ছা, কুঞ্জুঘাটা বাজার বলে এখানে একটা জায়গা আছে না?’

‘আছে।’ আদিত্য বুঝল রিসেপশানের মেয়েটি অতীব স্বল্পভাষী।

‘এখান থেকে কতদূর?’

‘হাঁটলে মিনিট দশেক।’

‘হোটেল থেকে বেরিয়ে কোন দিকে হাঁটব?’

‘হোটেল থেকে বেরিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম সরণী ধরে উত্তর দিকে যাবেন। মানে, হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে। মিনিট ছ-সাত হাঁটার পর ডান দিকে ঢুকতে হবে। রাস্তায় জিজ্ঞেস করলেই লোকে বলে দেবে।’ মেয়েটি মাথা নিচু করে আবার খাতাপত্রে মন দিল। তার ভাব দেখে মনে হল অনেকটা কথা তার খরচ হয়ে গেছে। আর কথা খরচ করতে সে রাজি নয়।

‘ধন্যবাদ।’ আদিত্য লিফটের দিকে হাঁটা লাগাল। সে ঠিক করে নিয়েছে রুম সার্ভিসে চা আনিয়ে খাবে। যা রোদ্দুর তাতে এখন বাইরে বেরোলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।

ঘরে গিয়ে প্রথমে খুব ভাল করে চান করল আদিত্য। চান করার পর বেশ খিদে পেয়ে গেল তার। এখন আর চা খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নিচে যেতেও ইচ্ছে করছে না। সে রুম সার্ভিসে লাঞ্চ অর্ডার দিল ভাত, ডাল, আলুভাজা, চিকেন কারি।

গৌতম কিছু দরকারি কথা মেসেজ করে জানিয়েছে। মিটিং-এ আছে তাই ফোন করতে পারছে না। খেতে খেতে আদিত্য খুব মন দিয়ে গৌতমের মেসেজটা পড়ল। তারপর খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ট্রে সমেত এঁটো প্লেট-ডিসগুলো ঘরের বাইরে বার করে রাখল। তার আবার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে কেউ বেল বাজিয়ে বিরক্ত করুক সে চায় না।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ঘুমিয়েছিল, মোবাইল বাজার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। বিমল ফোন করছে।

‘স্যার, আমি কেয়া বাগচি ম্যাডাম আর রত্নাবলী মিত্র ম্যাডামের বাড়িতে কাল রাত্তিরেই মিষ্টি পৌঁছে দিয়েছি। দুজন ম্যাডামের সঙ্গেই দেখা হয়েছে। বলেছি, আপনি মিষ্টি পাঠিয়েছেন। আর বলেছি, আপনি কলকাতার বাইরে গেছেন বলে নিজে আসতে পারলেন না। আর, আমরাও বাড়ির সকলে মিষ্টি খেয়েছি। অপূর্ব মিষ্টি স্যার। বিশেষ করে ওই সীতাভোগটা।’

‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু তোমাকে যে আসল কাজটা দিয়েছিলাম, সেটা কিছু এগিয়েছে?’

‘একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছি স্যার। আপনি যাঁর কথা বলেছিলেন তাঁর সঙ্গে সেই ভোরবেলা থেকে এঁটুলি পোকার মতো লেগে আছি। তিনি এখন লিন্ডসে স্ট্রিটে একটা হোটেলে এসেছেন। নাম হোটেল ক্রসরোড। ভেতরে ঢুকেছেন। আমি বাইরে রাস্তার চায়ের দোকানে বসে আপনাকে ফোন করছি।’

‘কেমন হোটেল?’

‘মাঝারি ধরনের হোটেল স্যার। প্রচুর সাহেব মেম আসে।’

‘আর কিছু লক্ষ করলে?’

‘সকালে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরলেন। তারপর সিঙ্গুরের কাছে একটা বাড়ির সামনে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামলেন। তখন ওঁর হাতে একটা ব্রিফকেস ছিল। আধঘণ্টা বাড়ির ভেতরে কাটিয়ে যখন আবার গাড়িতে এসে উঠলেন তখন ব্রিফকেসটা আর ওঁর হাতে ছিল না।’

‘এটা কখন ঘটল? মানে কটা নাগাদ?’

‘এই ধরুন সকাল আটটা নাগাদ।’

‘তারপর?’

‘তারপর উনি বাড়ি ফিরে এলেন। দুপুর বারোটা নাগাদ আবার বেরিয়ে এই হোটেলে এলেন।’

‘ঠিক আছে। তুমি নজর রেখে যাও। আর সিঙ্গুরের বাড়িটা চিনতে পারবে তো?’

‘নিশ্চয় পারব স্যার।’

আদিত্য ফোন কেটে দিয়ে দেখল রত্না মেসেজ করেছে ‘দারুণ মিষ্টি। উইকএন্ডে আসতে পারবি?’

আদিত্যর মনে হচ্ছে যা ঘটার আজ রাত্তিরেই ঘটে যাবে। হয়তো একটু বেশি রাত্তিরে। গৌতমের পাঠানো মেসেজে একটা ফোন নম্বর ছিল। আদিত্য নম্বরটা ডায়াল করল। ওদিক থেকে ‘হ্যালো’ কথাটা ভেসে আসার পর সে বলল, ‘আমি কি ইন্সপেক্টার ওয়াসিম মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলছি?’

‘ওয়াসিম মণ্ডল বলছি। আপনি কে বলছেন?’

‘আমি আদিত্য মজুমদার বলছি। লালবাজারের মেসেজ পেয়েছেন তো?’

‘হ্যাঁ পেয়েছি। আমরা ফোর্স নিয়ে রেডি। সকাল থেকে দুজন আর্মড পুলিশ প্লেন ড্রেসে বাড়ির বাইরে পাহারায় আছে। আপনি এখন কোথায়?’

‘আমি বহরমপুরে পৌঁছে গেছি। একটা হোটেলে আছি। গঙ্গার ধারে হোটেল। নাম হোটেল ভাগীরথী। আমার হোটেল থেকে জয়া অধিকারীর বাড়ি গাড়িতে কয়েক মিনিট। জয়া অধিকারী সাধারণত পাঁচটা নাগাদ বাড়ি ফেরেন। আমি তার পরে পরেই ওখানে পৌঁছে যাব। আমার সঙ্গে ওঁর কথা হয়ে গেছে।’

‘আমি তাহলে ফোর্স নিয়ে কখন পৌঁছব?’

‘আমার মনে হয়, রাত্তির নটার আগে কিছু ঘটবে না। আপনি সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছে গেলেই হবে।’

‘ঠিক আছে। তাহলে তখন দেখা হবে। নমস্কার।’

 ফোনটা কেটে দিয়ে আদিত্য একটা মেসেজ করল। মেসেজটা পাঠাতে না পাঠাতেই কেয়ার ফোন।

‘ব্যাপারটা কী? যার তার হাত দিয়ে মিষ্টি পাঠিয়ে নিজে উধাও হয়ে গেলে। কোথায় যাচ্ছ, কবে ফিরছ কিচ্ছু বলার দরকার নেই?’

কেয়া রেগে গেছে। সাধারণত এত রাগে না। ‘আমি তোমার বাড়ির খুব কাছে রয়েছি।’ আদিত্য মিনমিনে গলায় বলল।

‘আমার বাড়ির কাছে? কোথায়? শ্যামবাজারে?’

কেয়া যেন ধরেই নিয়েছে শ্যামবাজার ছাড়া কারও কোনও যাবার জায়গা থাকতেই পারে না।

‘না, না। সে বাড়ি নয়। তোমার আসল বাড়ি। আমি এখন বহরমপুরে।’

‘বহরমপুরে!’ কেয়া যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না আদিত্য হঠাৎ বহরমপুর চলে যেতে পারে। তার রাগটা এখন বিস্ময়ে বদলে গেছে।

কয়েক সেকেন্ড পরে কথাটা হজম হবার পর কেয়া বলল, ‘আমাকে বললে না কেন? জেঠুকে বলে রাখতাম। জেঠু খুব খুশি হত। আগের বার তুমি যখন গিয়েছিলে, জেঠু তোমার খুব প্রশংসা করছিল।’

‘আরে না না। এবার খুব দরকারি একটা কাজে এসেছি। হঠাৎ চলে আসতে হল, তাই তোমাকে বলে আসতে পারলাম না। এদিকে মিষ্টিগুলো রেখে দিলে খারাপ হয়ে যাবে। আমার তো ফ্রিজও নেই। তাই বিমলের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।’

‘ফিরবে কবে?’

‘মনে হচ্ছে আজ রাত্তিরেই কাজটা হয়ে যাবে। তাহলে কাল ফিরে আসব।’

‘ফিরে এসেই ফোন করবে কিন্তু।’

আদিত্য প্যান্ট-জামা পরে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। একটু পরেই বেরতে হবে। পাঁচটা বাজতে অবশ্য দেরি আছে। পথে না হয় কোথাও চা খেয়ে নেওয়া যাবে। তাতেও কিছুটা সময় যাবে। রোদ্দুরটা একটু কমেছে। আদিত্য জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আকাশের এক দিকে মেঘ জমছে।

কেউ ঘরের কলিং বেলটা বাজাচ্ছে। বেয়ারা এঁটো বাসন নিতে ফিরে এল নাকি? কিন্তু তা কী করে হবে? এঁটো বাসনপত্র তো দরজার বাইরেই রাখা আছে। আদিত্য খুব সন্তর্পণে দরজা অব্দি গিয়ে কী-হোল দিয়ে দেখল অচেনা একটা লোক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য খানিকক্ষণ খুব নিবিষ্ট মনে লোকটাকে লক্ষ করল। লোকটাকে একটু অসহিষ্ণু মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই দুবার বেল বাজাল সে। সামান্য শব্দ পেয়ে লিফটের দিকে তাকাল। বোধহয় কেউ আসছে কিনা বোঝার জন্যে। আদিত্য তার গলাটাকে ঘুম জড়িত করে বলল, ‘কেএএএ?’

লোকটা বাইরে থেকে বলল, ‘থানা থেকে আসছি। একটা চিঠি আছে।’

‘একটু দাঁড়ান। খুলছি।’ আদিত্যর গলাটা যেন এখনও ঘুমে জড়িয়ে আছে।

আদিত্য কী-হোল দিয়ে লোকটাকে লক্ষ করে যাচ্ছে। লোকটার হাতে কোনও চিঠি দেখা যাচ্ছে না। হয়ত চিঠিটা পকেটে আছে। লোকটা বারবার প্যান্টের পকেটে হাত দিচ্ছে। আদিত্য এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে এই লোকটা থানা থেকে আসছে না। যতই প্লেনড্রেসে থাকুক, পুলিশ দেখলে আদিত্য ঠিক বুঝতে পারে।

হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এল আদিত্য। আদিত্যকে হঠাৎ বেরিয়ে আসতে দেখে লোকটা হকচকিয়ে গেছে। বেরিয়ে এসে আদিত্য বলল, ‘কোথায় চিঠি?’

লোকটা সম্ভবত চিঠিটা বার করার জন্যে প্যান্টের পাশ পকেটে হাত ঢোকাল। এই পকেটটাতেই সে বারবার হাত ঢোকাচ্ছিল। সে যখন পকেট থেকে হাতটা ধীরে ধীরে বার করে আনছে আদিত্য দেখতে পেল তার হাতের মধ্যে একটা ছোট্ট অটোমেটিক পিস্তল রয়েছে। সেটা এতই ছোট যে প্রায় তালুর ভেতরে এঁটে যায়।

আদিত্য খানিকটা তৈরি ছিল। সে লোকটার পিস্তল সুদ্ধু হাতটা লক্ষ করে লাথি চালাল। বোধহয় বন্দুক বার করার সময় লোকটা তার মাথাটাকে একটু নামিয়েছিল তাই লাথিটা লক্ষভ্রষ্ট হয়ে লোকটার চিবুকে গিয়ে লাগল। কারণ যাই হোক, লাথিটা সপাটে লোকটার চিবুকে লাগার ফলে সে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ল। কিন্তু আদিত্য লক্ষ করল অটোমেটিকটা এখনও তার হাতে ধরা আছে। আদিত্য এঁকেবেঁকে সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগাল। সিঁড়ি অব্দি পৌঁছনোর আগেই আদিত্য টের পেল লোকটা দু-বার গুলি চালিয়েছে। বন্দুকে নিশ্চয় সাইলেন্সার লাগানো আছে, তেমন শব্দ হল না। একটা গুলি সিঁড়ির হাতলে এসে লাগল, আর একটা সিঁড়ি সংলগ্ন জানলার কাঁচে। কাঁচটা সশব্দে ভেঙে পড়ল। লোকটা দৌড়তে দৌড়তে সিঁড়ির দিকে আসছে। আদিত্য চেষ্টা করছে কত তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে দোতলায় লুকিয়ে পড়া যায়। আদিত্য সিঁড়ির মাঝপথে, লোকটা প্রায় সিঁড়ির মুখে পৌঁছে গেছে, বন্দুক তুলে আদিত্যর দিকে স্থির নিশানা করছে, এবার আর সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে চায় না, এমন সময় পরপর দুটো গুলির আওয়াজ শুনতে পেল আদিত্য। এবারের আওয়াজটা চারতলা থেকে এসেছে। দুটো গুলিই লোকটার গায়ে লেগেছে। লোকটা তিনতলার সিঁড়ির মুখে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হাতের অটোমেটিকটা দূরে ছিটকে গেছে।

চারতলার সিঁড়ি দিয়ে রিভলভর হাতে একজন নেমে আসছে। আদিত্য তাকে চেনে। পুলিশ ইন্সপেক্টার সুদর্শন শিকদার।

‘ভাগ্যিস সময় মতো আমাকে মেসেজ করে দিয়েছিলেন। না হলে পৌঁছতেই পারতাম না।’ শিকদার তার সার্ভিস রিভলভরটা হোলস্টারে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল।

‘আপনি সময় মতো না এলে আমার আজ এখানেই ইতি হয়ে যেত।’ আদিত্য তখনও হাঁপাচ্ছে।

লোকটি মারা গিয়েছিল। একটা গুলি তার হাতে লেগেছে, আর একটা ঘাড়ে। দ্বিতীয় গুলিটাই মৃত্যু ঘটিয়েছে। একটু পরে খবর পেয়ে ওয়াসিম মণ্ডল তাঁর দলবল নিয়ে এসে পৌঁছল। সে এবং তার দলের কয়েকজন মৃত লোকটিকে দেখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলেছে। লোকটা মুরশিদাবাদ জেলার একজন কুখ্যাত সুপারি কিলার। পুলিশ অনেকগুলো কেস-এ একে খুঁজছিল।

পুলিশ যখন ডেডবডি গাড়িতে তুলছে তখন আস্তে আস্তে আদিত্যর মাথাটা আবার কাজ করতে শুরু করেছে। সে হঠাৎ উপলব্ধি করল জয়া অধিকারী ভীষণ বিপদের মধ্যে আছে। কথাটা ভেবেই তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। সে শিকদার এবং ওয়াসিম মণ্ডলকে বলল, ‘আমাদের এই মুহূর্তে জয়া অধিকারীর বাড়ি পৌঁছনো দরকার।’

‘এক্ষুনি পৌঁছতে হবে? তবে আপনি যে বললেন রাত ন-টার আগে সেখানে কিছু ঘটবে না?’ ওয়াসিম মণ্ডল বেশ অবাক হয়েছে।

‘আমি ভুল করেছিলাম। সম্পূর্ণ ভুল করেছিলাম। এবং এই ভুলের জন্য যদি জয়া অধিকারীর কিছু একটা হয়ে যায় আমি নিজেকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারব না।’ আদিত্যর গলার আওয়াজটা উত্তেজনায় কাঁপছিল।

শিকদার এবং ওয়াসিম মণ্ডল তখনও বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে।

আদিত্য বলল, ‘আমি একদম নিশ্চিত যে আমার ওপর আক্রমণের দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক, আমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছি বলে আমাকে খতম করে দেওয়া। আর দুই, পুলিশের নজর আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সেই ফাঁকে জয়া অধিকারীর বাড়িতে হামলা করা। জয়া অধিকারীর ওপর এদের আলাদা করে কোনও রাগ নেই। এদের আসল উদ্দেশ্য জয়া অধিকারীর বাড়িতে যে জিনিসটা লুকোনো আছে, যেটা ফিরদৌস ওখানে লুকিয়ে রেখে গেছে, সেটি হস্তগত করা। বোধহয় জয়া অধিকারী জানে জিনিসটা ঠিক কোথায় লুকোনো আছে। তাই তার ওপর অত্যাচার হতে পারে। প্লিজ তাড়াতাড়ি চলুন।’

জয়া অধিকারীর বাড়ি যতটা তাড়াতাড়ি পৌঁছোনো যাবে মনে হয়েছিল ততটা তাড়াতাড়ি পৌঁছনো গেল না। একে মোটরের রাস্তাটা ঘুরপথে, তার ওপর বাজারের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। গাড়িতে না গিয়ে হেঁটে চলে গেলে বোধহয় এর থেকে তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যেত।

জয়া অধিকারীর বাড়ির রাস্তাটা অবশ্য সেই রকমই নির্জন। কাছে গিয়ে দেখা গেল বাড়ির সদর দরজাটা হাট করে খোলা। ঢুকেই বসার ঘর। সেটা আদিত্য যেমন দেখে গিয়েছিল ঠিক তেমনই রয়েছে। আরও ভেতরে ঢুকে একটা শোবার ঘর। ঘরের জানলাগুলো বন্ধ। সমস্ত আসবাব ঠিকঠাক রয়েছে। শুধু আলমারির পাল্লা দুটো হাট করে খোলা। আলমারির ড্রয়ারটাও খোলা। বুঝতে অসুবিধে হয় না, ড্রয়ারের মধ্যে কিছু একটা ছিল যেটা নিয়ে আততায়ী চম্পট দিয়েছে।

আর বিছানার ওপরে রক্তাক্ত, অচৈতন্য অবস্থায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে জয়া অধিকারী। তার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। ঠোঁট ফেটে গেছে। কপালের একদিক দিয়েও রক্ত ঝরছে।

আদিত্য জয়া অধিকারীর একটা হাত তুলে নিয়ে পালসটা অনুভব করার চেষ্টা করল। তারপর উজ্জ্বল মুখে বলল, ‘দেহে এখনও প্রাণ আছে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যেতে পারে।’

আধঘণ্টা পরে যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে জয়া অধিকারীকে নিয়ে চলে গেছে তখন ওয়াসিম মণ্ডল বলল, ‘একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। যে বা যারা এসেছিল তারা কোন দিক দিয়ে এল? বাড়ির সামনে তো সারাদিন পুলিশের পাহারা ছিল।’

‘আমার বিশ্বাস একজনই এসেছিল। সে এসেছিল গঙ্গা পেরিয়ে, ফেরিঘাট হয়ে। এই বাড়িতে সে পেছন দিক দিয়ে ঢুকেছিল। তাই পুলিশ তাকে দেখতে পায়নি। বাড়িতে ঢুকে সে জয়ার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। যে মুহূর্তে জয়া বাড়িতে ঢোকে সেই মুহূর্তে সে জয়াকে তুলে নিয়ে শোবার ঘরে যায়। ফিরদৌসের রেখে যাওয়া জিনিসটা কোথায় আছে জানার জন্যে সে জয়ার ওপর অত্যাচার শুরু করে। জয়া খুব বেশি অত্যাচার সহ্য করতে পারেনি। তাড়াতাড়ি বলে দিয়েছে জিনিসটা কোথায় আছে। একদিক থেকে ভালই হয়েছে। খুব বেশিক্ষণ অত্যাচার সহ্য করতে হলে জয়া অধিকারী মরেই যেত।’ কথাগুলো বলে আদিত্য সিগারেট ধরাল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন