কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য – অষ্টম পরিচ্ছেদ

অভিরূপ সরকার

অষ্টম পরিচ্ছেদ

আদিত্য ঠিক করেছিল ভোরবেলা বহরমপুর রওনা হয়ে সেই রাত্তিরেই ফিরে আসবে। ভোর ছটা পঞ্চাশে কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়ে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস, দশটা বারোয় বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে ঢুকে যায়। ওই ট্রেনটারই আবার পাঁচটা ষোলো মিনিটে বহরমপুর ছেড়ে নটা চল্লিশে কলকাতা স্টেশনে ফিরে আসার কথা। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলতে পারলে ফিরতি হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসটা অবশ্যই ধরা সম্ভব।

তবে ভোর ছটা পঞ্চাশে কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়ছে যে ট্রেন তাকে ধরতে গেলে ছটা দশ-পনেরোর মধ্যে কলকাতা স্টেশনে পৌঁছে যেতে হবে। সেটা, অন্তত আদিত্যর পক্ষে, মোটেই সোজা কাজ নয়। কলকাতা স্টেশনটা অদ্ভুত জায়গায়, সেখানে পৌঁছনোই এক ঝকমারি। সেখানে ছটা দশ-পনেরোর মধ্যে পৌঁছতে গেলে পাঁচটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে। আর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠার দরকার থাকলে টেনশনে সারা রাত্তিরই ঘুম হবে না।

এর ফলে যেটা হল, ছটা পঞ্চাশের গাড়িটা আদিত্য কোনওরকমে ধরে ফেলল বটে, কিন্তু সারা রাত্তিরের ঘুম চোখে জমে ছিল বলে জানলার ধারের সিটে বসে সেই যে ঝিমোতে শুরু করল, কৃষ্ণনগর স্টেশন আসার আগে সে ঝিমুনি কাটল না। গাড়ি কৃষ্ণনগর সিটি স্টেশনে থামতে এক কাপ চা খেল আদিত্য। সঙ্গে দুটো দিশি বিস্কুট। একটা ইংরেজি কাগজ কিনে কিছুক্ষণ খবরে চোখ বোলাল। তারপর ট্রেনটা চলতে শুরু করার পর শূন্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

কেয়ার জেঠুর বাড়ি পঞ্চাননতলা, বহরমপুর কোর্ট স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছতে গেলে আধঘন্টা লেগে যাবে। তার থেকে একটা টোটো ভাড়া করে নেওয়া ভাল, বিশেষ করে ভাড়ার টাকাটা যখন মক্কেলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া কেয়ার জেঠুর বাড়ি থেকে কোথায় যেতে হবে আদিত্য এখনও জানে না। তাই স্টেশনে নেমে একটা টোটো সে সারাদিনের জন্যে ভাড়া করে ফেলল। কেয়া বলে দিয়েছিল, বহরমপুর শহরে যেরকম ট্র্যাফিক জ্যাম হয় তাতে মোটর গাড়ির থেকে টোটো ভাড়া করাটাই সুবিধেজনক।

কেয়া বলেছিল, পঞ্চাননতলা পৌঁছে অমল বাগচির বাড়ি কোথায় বললেই লোকে দেখিয়ে দেবে। অমল বাগচি এক সময় ওকালতি পাস করে বহরমপুর কোর্টে প্র্যাক্টিস করতেন। তবে প্র্যাক্টিসটা নামে মাত্র, তাঁর আসল নেশা ছিল দেশ-সেবা। তখনকার শাসকদলের টিকিটে দাঁড়িয়ে বার কয়েক মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশনে জিতেও ছিলেন। সেসব অবশ্য অনেক দিন আগেকার কথা। এখন দেশের রাজনীতিটা আগাপাশতলা বদলে গেছে, এতটাই বদলে গেছে যে অমল বাগচি রাজনীতির মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারেন না। তাই রাজনীতিতে আর কোনও উৎসাহও পান না। তাঁর পুরোনো দলটাও বহুদিন হল আর নেই। ফলে আজকালকার ছেলে ছোকরারা কেউ তাঁর কাছে আসে না। তবু তাঁর নামটা এখনও স্থানীয় মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। হয়ত এই কারণে যে, অমল বাগচি আদ্যোপান্ত একজন সৎ মানুষ ছিলেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে যেমনটা আজকাল খুব বেশি দেখা যায় না।

পঞ্চাননতলার মোড়ে পৌঁছে অমল বাগচির নাম বলতেই চায়ের দোকানে আড্ডারত দুটি যুবক সামনের একটা গলি দেখিয়ে দিল। সেই গলিটা ধরে মিনিট তিনেক চলার পর একটা বাঁকের মুখে অমল বাগচির বাড়ি। লাল রঙের পুরোনো দোতলা বাড়ি। তার গা ঘেঁসে একটা নতুন পাঁচতলা বাড়ি উঠেছে। আদিত্য আন্দাজ করল, নতুন বাড়িটা যেখানে উঠেছে সেখানে এক সময় কেয়াদের অংশটা ছিল।

বাড়ির সামনে কয়েক ধাপ সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে রোয়াক, রোয়াক পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজা। বাড়ির প্ল্যানটা প্রাচীন যুগের, আজকের দিনে কেউ বাড়ির সামনে রোয়াক বানিয়ে জায়গা নষ্ট করে না। কেয়া নিশ্চয় বলে রেখেছিল হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে আদিত্য আসছে। না হলে একজন বৃদ্ধ পরিচারক তার জন্যে রোয়াকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে কেন?

‘আপনি ছোড়দির বন্ধু? কলকাতা থেকে আসছেন?’ বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

আদিত্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আগে তার টোটোর চালককে বলল, ‘আমি এখানে কিছুক্ষণ থাকব। বেরোনোর আগে আপনাকে ফোন করে ডেকে নেবখ’ন।’

সদর দরজাটা ভেজানো ছিল। সেটা হাতের ঠেলায় খুলে বৃদ্ধ আদিত্যকে ভেতরে আসতে বলল। ভেতরে ঢুকেই বসার ঘর। খুব বড় নয়। একটা ভ্যাপসা পুরোনো গন্ধ ঘরটাতে ভাসছে। একদিকে একটা পুরোনো আমলের ফরাশ ঢাকা তক্তপোশ। তার ওপর যে চাদরটা পাতা রয়েছে সেটা, অনুমান করা যায়, এক সময় সাদাই ছিল, এখন বয়সের ভারে ধূসর হয়ে গেছে। এছাড়া ঘরে আসবাব বলতে দু-টো চেয়ার, একটা টেবিল আর একটা মান্ধাতার আমলের দেরাজ। দেরাজের কাঠের পাল্লাগুলো বন্ধ, অতএব ভেতরে কী রয়েছে জানার উপায় নেই। ওপরে কয়েকটা কেষ্টনগরের পুতুল। গোটা তিনেক ফটোগ্রাফ। ফ্রেমে বাঁধানো ছুঁচের কাজ, তাতে লেখা ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’। বয়সের ভারে সকলেই মলিন হয়ে এসেছে। বসার ঘরটা খুব একটা ব্যবহার হয় না।

বৃদ্ধ পরিচারকটি বলল, ‘কত্তা চানে গেছেন। একটু বসতে হবে।’

চেয়ার দু-টো এতই পুরোনো যে বসতে ভরসা হয় না। আদিত্য ভেবেচিন্তে তক্তপোশের ওপরেই বসল।

আদিত্য বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। কেয়াকে ছোড়দি বলা হচ্ছে কেন? নিশ্চয় এই কারণে যে কেয়ার জ্যাঠামশায়ের দুই মেয়ে কেয়ার থেকে বড় এবং তারা যথাক্রমে বড়দি ও মেজদি। আগে একান্নবর্তী পরিবারে এই রকমই হতো। ঘরে বই-পত্তর বিশেষ নেই যে উলটে পালটে দেখবে। টেবিলের নিচের তলায় যেখানে ম্যাগাজিন রাখার জায়গা সেখানে একটা খবর কাগজ রয়েছে। আদিত্য হাতে নিয়ে দেখল সেটা বছর চারেকের পুরোনো। তাতে অবশ্য আদিত্যর ভালই হল। পুরোনো খবরের কাগজ পড়তে আদিত্যর বেশ ভালই লাগে।

‘অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। আসলে বয়েস হয়েছে তো, আজকাল তাড়াতাড়ি কিছু করতে পারি না। হলধর অনেক আগেই খবর দিয়েছে তুমি এসেছো।’

আদিত্য পুরোনো খবর কাগজটা পড়তে পড়তে আবার ঝিমোচ্ছিল, অমল বাগচির গলার আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। অমল বাগচিকে সে যতটা বৃদ্ধ কল্পনা করেছিল আসল মানুষটা ততটা বৃদ্ধ নন। মাথার চুল যদিও অধিকাংশই সাদা, দাঁড়ানোর ভঙ্গীটা এখনও ঋজু, শিরদাঁড়াটা একেবারে সোজা রয়েছে। বস্তুত, আদিত্যর মনে হল, বাড়ি, বাড়ির মালিক, আসবাবপত্র, পরিচারক সব কিছুর মধ্যে বাড়ির মালিকই সব থেকে তরুণ।

‘চল দুজনে আগে খেয়ে নিই। তারপর তোমার কথা শুনব।’

 খাবার প্রস্তাব আসবে আদিত্য মোটেই আশা করেনি। কেয়া তার সম্বন্ধে কী বলেছে কে জানে? সে ভদ্রতা দেখিয়ে একটু আপত্তি জানাল। তবে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করল না। সে ‘আপনাকে খুব অসুবিধেয় ফেললাম’ এইটুকু বলে অমল বাগচির পেছন পেছন বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। একতলায় কোণার দিকে খাবার ঘর। মাটিতে দুটি আসন পাতা। আসনের সামনে কাঁসার থালায় ভাত বাড়া হয়েছে। পাশে কাঁসার বাটিতে ডাল, মাছের ঝোল, পাঁঠার মাংস। একটা ছোট্ট বাটিতে ঘি। থালায় বাড়া ভাতের পাশে পটোল ভাজা, কুমড়ো ভাজা, এক টুকরো গন্ধরাজ লেবু, একটা তন্বী কাঁচা লঙ্কা। দেখে আদিত্যর মনটা ভাল হয়ে গেল। সে আসনে বসতে বসতে আবার বলল, ‘আপনাকে যে কী অসুবিধেয় ফেললাম।’

‘ফের যদি অসুবিধে অসুবিধে বল, মাথায় গাঁট্টা মারব।’ অমল বাগচি কপট ধমক লাগালেন। ‘তুমি অপুর বন্ধু আর অপু হল এই বাড়ির ছোট মেয়ে, আমাদের সব থেকে আদরের। তোমার অযত্ন হলে অপু আমাকে আস্ত রাখবে নাকি? তাছাড়া অপু আমাকে বার তিনেক ফোন করে বলেছে তোমার যেন খাতির-যত্ন হয়।’ অমল বাগচি হাসতে হাসতে আদিত্যর পাশে বসলেন।

‘আমি তো কিছুই ব্যবস্থা করতে পারিনি। অপু এত দেরি করে বলল। আগে বললে তোমাকে গঙ্গার ইলিশ খাওয়াতে পারতাম।’ বোঝাই যাচ্ছে অমল বাগচি কথা বলতে ভালবাসেন। খাওয়াতেও।

এর পরের পনের মিনিট আদিত্য চুপ করে খেয়ে গেল। কথা যা বলার অমল বাগচিই বলে গেলেন। তিনি জানালেন, আজ অনেকদিন পরে বাড়িতে মাংস রান্না হল। বামুনদিদি, যিনি সকালে রান্না করে চলে যান, আজ বেলায় এসে মাংস রান্না করেছেন। হলধর রান্না করতে জানে না। তবে চা-টা করতে পারে। আর রাত্তিরের রুটিটাও করে। তাছাড়া অবশ্য বাড়ির আর সব কাজ হলধরই করে।

‘আপনি কি মোটামুটি বাড়িতেই থাকেন?’ আদিত্য উঠতে উঠতে বলল।

‘আরে বোসো, বোসো। উঠছ কোথায়? মুরশিদাবাদে এসে আম খাবে না?’ অমল বাগচি আদিত্যর কথার উত্তর না দিয়ে বলে উঠলেন। ‘হলধর, এই হলধর। আম দে।’

তাঁর কথা শেষ হতে না হতে হলধর হাতে দুটি প্লেট নিয়ে হাজির। একটায় আম, অন্যটায় দুপিস বহরমপুরের বিখ্যাত ছানাবড়া। টেনিস বলের সাইজের।

‘আপনি খাবেন না?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘আমার হাই সুগার। আম, মিষ্টি কোনওটাই আর চলে না। এখন লোককে খাইয়ে যেটুকু আনন্দ পাই।’ আদিত্যর মনে হল অমল বাগচি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘এটা রানিপসন্দ আম। বাজারে কিনতে পাবে না। মুরশিদাবাদের হেরিটেজ আম এটা।’

খাবার পরে অমল বাগচি বললেন, ‘একটু বিশ্রাম করে নেবে নাকি? ওপরে সেই ব্যবস্থাও আছে। আমি আবার খাবার পরে আধঘণ্টা গড়িয়ে না নিলে পারি না।’

একে কাল রাত্তিরে ঘুম হয়নি, তার ওপর এই গুরুভোজন। আদিত্যর চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। সে দেখল ঘড়িতে একটা বেজেছে। আধঘণ্টা ঘুমিয়ে নেওয়াই যায়।

‘তোমার সঙ্গে অপুর কীভাবে জানাশোনা হল? তুমি কি অপুর সঙ্গে পড়তে? অপু আমাকে ফোন করে শুধু বলল, তুমি ওর খুব কাছের বন্ধু।’ অমল বাগচি জিজ্ঞেস করলেন।

আদিত্য ভেবেছিল আধঘণ্টার বেশি ঘুমোবে না। ঘুমটা প্রায় দেড় ঘণ্টা হয়ে গেছে। এখন তারা চা খাবে বলে দোতলার দালানে বেতের চেয়ারে বসে আছে।

‘তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে তোমাকে আর তুললাম না। নিশ্চয় খুব ক্লান্ত ছিলে।’

 ‘খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ আদিত্য লাজুক হেসে বলল। ‘আসলে ভোরবেলায় ট্রেন ধরতে হবে এই টেনশনে কাল রাত্তিরে একদম ঘুম হয়নি।’

হলধর চা নিয়ে এসেছে। ঘড়িতে তিনটে পাঁচ।

‘বললে না তো, অপুর সঙ্গে তোমার কীভাবে আলাপ?’ অমল বাগচি আবার জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমার সম্বন্ধে কেয়া কি কিছু বলেছে? বিশেষ করে আমার প্রফেশন সম্বন্ধে?’ আদিত্য সাবধানী গলায় বলল।

‘তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলেছে তুমি হাবিবুর রহমানের ছেলে ফিরদৌসের ব্যাপারে জানতে চাও। কেন জানতে চাও তাও বলেনি। ফিরদৌসের ব্যাপারটা আমরা খবর কাগজে পড়েছি। ভেরি স্যাড। ফিরদৌসের বাবা হাবিবুর আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল।’ অমল বাগচির মুখটা বেদনার্ত দেখাল।

আদিত্য কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘আমি পেশায় একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। ফিরদৌসের পিসি নুসরত বেগম আমার মক্কেল। তিনি ফিরদৌসের খুন হবার ব্যাপারটা আমাকে ইনভেস্টিগেট করতে বলেছেন।’

‘তুমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা?’ অমল বাগচির মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। ‘বেসরকারি গোয়েন্দা?’ ঠিক শুনেছেন কিনা যাচাই করার জন্যে তিনি কথাটা পুনরাবৃত্তি করলেন।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি ফিরদৌস রহমানের কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি। কেয়া আর আমি একদম এক বয়সী, তবে সহপাঠী নই। কেয়া স্কটিশে ফিজিক্স পড়ত, আমি প্রেসিডেন্সিতে অঙ্ক। আমাদের একজন কমন বন্ধু ছিল, চন্দ্রলেখা সেন। কিছুদিন আগে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি সেই কেসটা ইনভেস্টিগেট করেছিলাম। সেই সূত্রে কেয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হয়।’

‘চন্দ্রলেখা সেন অন্তর্ধান রহস্য? এটার কথা তো মিডিয়াতে বিরাট করে বেরিয়েছিল। তোমার নামও বেরিয়েছিল। এখন বুঝতে পারছি কেন তোমার নামটা প্রথম থেকেই আমার চেনা চেনা লাগছিল। তুমি তো বিখ্যাত লোক হে।’ অমল বাগচির গলায় মুগ্ধতা।

‘এই রকম বলবেন না জেঠু। আপনি যখন কেয়ার জেঠু আমারও জেঠু। আপনাকে মিথ্যে বলব না। সত্যি কথাটা হল, নানা কারণে বিএসসি পাশ করার পর আমার আর লেখাপড়া হয়নি। হরেক রকম কাজ করতে করতে পাকেচক্রে এই পেশায় এসে কোনওরকমে টিকে আছি। কেয়া সব জানে।’

‘তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?’

এর পরের পনের মিনিট আদিত্যকে তার পরিবারের ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি সব কিছু বিস্তারিতভাবে জানাতে হল। অমল বাগচি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিলেন। অমল বাগচির প্রশ্নের সামনে আদিত্য ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছিল। সে বড় জমিদার বংশের ছেলে, তার ঠাকুরদাদা প্রখ্যাত ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন, বাবা ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মস্ত পৃষ্ঠপোষক। অথচ এখন অবস্থা গতিকে মহাত্মা গান্ধী রোডের কাছে একটা মেসে তাকে থাকতে হয়, পেটের দায়ে তাকে গোয়েন্দাগিরি করতে হয় এসব কথা কবুল করতে তার ভাল লাগে না। তবে আদিত্য খেয়াল করছিল অমল বাগচির চরিত্রে একটা স্নিগ্ধতা আছে, ফলে তার সামনে এসব কথা বলতে যতটা খারাপ লাগার কথা আদিত্যর ততটা খারাপ লাগছিল না।

সাড়ে তিনটে বেজে গেল অথচ এখনও কাজের কথা শুরুই হল না। সোয়া পাঁচটার হাজারদুয়ারিটা মনে হচ্ছে না ধরা যাবে। আদিত্য একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আমি কি তাহলে এবার ফিরদৌস সম্পর্কে আমার প্রশ্নগুলো করতে পারি?’

‘বল, বল কী জানতে চাও।’

‘আমার একটাই প্রশ্ন। অল্প বয়েসে ফিরদৌস একটা চুরির মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত তার কোনও সাজা হয়নি। তার বাবা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। এই চুরির মামলাটা সম্বন্ধে আপনার জানা আছে কি?’

‘কেন জানি না, আমার মন বলছিল, তুমি এই প্রশ্নটাই করবে। তুমি ঠিকই বলেছ। ফিরদৌসের একটা গোপন ইতিহাস আছে যার কথা ওদের পরিবারের বাইরে খুব বেশি লোক জানে না। আমি জানি কারণ ফিরদৌসের বাবা আমার বিশেষ বন্ধু ছিল। ব্যাপারটা আমি তোমাকে সংক্ষেপে বলছি। ফিরদৌসের যখন পনেরো-ষোলো বছর বয়েস তখন পাড়ার একটি হিন্দু মেয়ের সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসা হয়। মেয়েটি ফিরদৌসেরই বয়সী, নাম জয়া, জয়া অধিকারী। এই সম্পর্কটা নিয়ে দুটি বাড়িতেই প্রবল আপত্তি ছিল, বিশেষ করে জয়াদের বাড়িতে। শোনা যায়, এই সময় বেশ কিছুদিন জয়াকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়। সে যাই হোক, এই পর্যন্ত ঘটনাটা পাবলিক নলেজ, পাড়া প্রতিবেশী সকলেরই জানা। বস্তুত সে সময় এটা নিয়ে স্থানীয় মহলে একটু হইচইও হয়েছিল। হবে নাই বা কেন? একে গল্পটা আঁসটে তার ওপর হাবিবুর রহমান বহরমপুরের নামকরা নেতা। ঘটনার পরের অংশটা অবশ্য ক্লাসিফায়েড।’

হলধর চায়ের খালি কাপগুলো নিতে ঘরে ঢুকেছে। বলল, ‘রাত্তিরে কটা রুটি করব?’

‘গোটা দশ-বারো করে রাখ।’ অমল বাগচি বললেন। তারপর আদিত্যর দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমি রাত্তিরে কটা রুটি খাও?’

‘রাত্তিরে? মানে আজ রাত্তিরেও আমি এখানে খাব?’ আদিত্য অপ্রতিভ, অপ্রস্তুত, অবাক।

‘শুধু খাবে তাই নয়, রাত্তিরে থাকবেও। তারপর কাল সকালের ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরবে। কেন বুঝিয়ে বলছি। এখান থেকে তোমাকে জয়ার কাছে যেতে হবে। সেখানে কথা শেষ করে স্টেশনে ফিরতে ফিরতে রাত্তির হয়ে যাবে। তখন আর ভাল কোনও ট্রেন নেই। অতএব তুমি জয়ার বাড়িতে কথা বলে সোজা আমার বাড়িতে ফিরছ। রাত্তিরে খাচ্ছ এবং থাকছ। বুঝতে পারলে?’

অমল বাগচি এমনভাবে কথাগুলো বললেন যেন এই ব্যবস্থাটা বহুদিন আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। আদিত্য আপত্তি করার কোনও সুযোগই পেল না। সে নিরীহভাবে বলল, ‘রাত্তিরে আমি তিনটে রুটি খাই।’

‘এবার ফিরদৌস-জয়া বৃত্তান্তের পরের অংশটা শোনো।’ অমল বাগচি আবার বলতে আরম্ভ করলেন। ‘ফিরদৌস আর জয়া ঠিক করল পালিয়ে গিয়ে বাড়ির অমতে বিয়ে করবে। আলাদা সংসার পাতবে। দুজনেরই তখন বছর কুড়ি বয়েস। মনে লাগামছাড়া প্রেম, তুলনায় সাধারণ বুদ্ধির প্রবল অভাব। তবে এটুকু তারা বুঝতে পেরেছিল যে আলাদা সংসার পাততে গেলে টাকা লাগবে। ফিরদৌস জয়াকে বলল, চিন্তা কোরো না, আমি টাকা জোগাড় করে ফেলব।

‘ফিরদৌসের বাবার কাছে সেই সময় পার্টির কিছু টাকা থাকত। পার্টির তো নানা রকম টুকিটাকি খরচ থাকে, ওই টাকাটা থেকে সেইসব খরচ করা হত। পার্টির বড় কর্তারা জানতেন, হাবিবুরের কাছে টাকা থাকা মানে ব্যাঙ্কে টাকা থাকার থেকেও নিরাপদ। হাবিবুরের ইন্টিগ্রিটি ছিল ইম্পিকেবল। ফিরদৌস সেই পার্টির টাকা থেকে পঁচাশি হাজার টাকা সরিয়ে ফেলল। ঠিক কীভাবে টাকাটা সরিয়েছিল, আমার জানা নেই। আমাদের গল্পের জন্যে জানার প্রয়োজনও আছে বলে মনে হয় না।’

‘তারপর?’ আদিত্য প্রখর মনযোগ দিয়ে অমল বাগচির কথা শুনছে।

‘তারপর আর খুব বেশি কিছু নেই। পালাতে গিয়ে ফিরদৌস-জয়া ধরা পড়ে গেল। জয়া অবশ্য জানত না ফিরদৌস তার বাবার টাকা চুরি করেছে। ফিরদৌস ও জয়া যে যার বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হল। টাকা চুরির ব্যাপারটা হাবিবুর অনেক মেহনত করে ধামাচাপা দিয়ে দিল। মেহনত করতে হল কারণ টাকাটা তো আর হাবিবুরের নিজের নয়, টাকাটা তার দলের। ফিরদৌসকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। সে সেখানে কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করবে। জয়ার যাবার কোনও জায়গা ছিল না। সে বহরমপুরেই রয়ে গেল। এর কিছুদিন পরে একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে হাবিবুর রহমানের মৃত্যু হয়। অনেকে বলে ছেলের নৈতিক অধঃপতন হাবিবুরের স্বাস্থ্যহানির প্রধান কারণ।’

আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে বলল, ‘আপনি যখন আমাকে জয়া অধিকারীর সঙ্গে দেখা করতে বলছেন তখন ধরে নিচ্ছি শেষ দিন অব্দি ফিরদৌসের সঙ্গে জয়ার যোগাযোগ ছিল।’

‘একেবারে ঠিক জায়গাটা ধরেছ। তুমি ভাল গোয়েন্দা বোঝা যাচ্ছে। আমার গল্পের শেষটা তাহলে বলি। ফিরদৌসের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর জয়া আর বিয়ে করেনি। বহরমপুরেই থাকে। একটা ইস্কুলে পড়ায়। ফিরদৌস অবশ্য বিয়ে-টিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ের পরেও সে জয়ার সঙ্গে একটা সম্পর্ক রেখে গেছে। এটা নৈতিক কিনা জানি না, কিন্তু যত বয়েস বাড়ছে তত মনে হয় নৈতিকতার বিচার একজন মানুষ করতে পারে না। একজনের কাছে যেটা অনৈতিক, অন্যজনের কাছে সেটা নৈতিক হতেই পারে। একটা সমাজের কাছে যা নৈতিক, অন্য কোনও সমাজ-ব্যবস্থায় সেটা হয়তো ঘোর অনৈতিক। যাক সেসব কথা, তোমাকে জয়ার সঙ্গে দেখা করতে বলছি কারণ খুন হবার আগে ফিরদৌস হয়তো জয়াকে কিছু বলেছিল যেটা তোমার কাজে লাগতে পারে।’

‘জয়া অধিকারী কত দূরে থাকেন?’

‘কুঞ্জঘাটা বাজার বলে একটা জায়গা আছে। এখান থেকে গাড়িতে যেতে অন্তত আধঘন্টা লাগবে, রাস্তায় জ্যাম থাকলে আরও বেশি। কুঞ্জঘাটা বাজার পেরিয়ে আরও খানিকটা গঙ্গার দিকে এগোলে জয়ার বাড়ি। ওখানে ও একাই থাকে। ওর ইস্কুল ছুটি হয় সাড়ে তিনটেতে। এতক্ষণে ও নিশ্চয় বাড়ি চলে এসেছে। ওকে বলা আছে তুমি আসবে। তুমি রওনা হয়ে যাও। আর হ্যাঁ, হলধর বলল তুমি একটা টোটো ভাড়া করেছ। তোমার ড্রাইভারকে ফোন করে ডাক। আমি ওকে ডিরেকশনটা বলে দিচ্ছি।’

‘আমি এখানে একাই থাকি। আমার বাবা-মা গত হয়েছেন। এক দাদা আছে, কলকাতায় থাকে। আমার সঙ্গে তার খুব যোগাযোগ নেই। ফিরদৌস আমার …… বন্ধু ছিল, …… নিকটতম বন্ধু।’ জয়া অধিকারী থামল। এরপর কী বলবে ভাবছে। তাকে দেখে মনে হয় তার ওপর দিয়ে সম্প্রতি একটা বিরাট ঝড় বয়ে গেছে। সেই ঝড়ের প্রভাব এখনও সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

আদিত্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জয়া অধিকারীকে দেখছিল। চাপা রঙ, ছোটখাটো শরীর, বড়-বড় মমতা-মাখা চোখ। কেউ সুন্দরী বলবে না। কিন্তু মুখে একটা দুঃখের লাবণ্য আছে। অনেক দুঃখকষ্ট পেরিয়ে এলে যে বিষণ্ণ সৌন্দর্য আপনা থেকে মুখে ফুটে ওঠে, সেই লাবণ্য।

‘আপনার সঙ্গে ফিরদৌসের কি নিয়মিত যোগাযোগ ছিল?’

‘ফোনে কথা হত।’ জয়া অধিকারী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নিচু করে বলল, ‘তাছাড়া মাসে অন্তত একবার ফিরদৌস এখানে আসত।’

‘শেষ কবে ফিরদৌস এখানে এসেছিল?’ আদিত্য মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল।

‘ঘটনাটা ঘটার দু-তিন দিন আগে ফিরদৌস আমার কাছে এসেছিল।’ জয়ার গলায় কান্না জমে উঠছে। একটু জিরিয়ে নিয়ে সে বলল, ‘আমি তারিখ মনে রাখতে পারি না।’

‘একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি। আপনার ইচ্ছে না হলে উত্তর দেবেন না। আর আমার প্রশ্নটা যদি আপনাকে কোনওভাবে আঘাত করে, আমি আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ আদিত্য সাবধানী গলায় বলল।

জয়া কোনও কথা বলল না। কিছুটা উদগ্রীব হয়ে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে রইল।

‘শেষ যেদিন ফিরদৌস এখানে এসেছিল, সে কি রাত্তিরটা এখানেই ছিল?’ আদিত্য আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল।

জয়া সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। বেশ কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর যেন খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে বলল, ‘আমার এখানে এলে ফিরদৌস সাধারণত রাত্তিরটা থেকে যেত। সেদিনও রাত্তিরটা থেকে গেছিল।’

আদিত্য ভাবছিল। জয়া অধিকারীর বাড়িটা একটেরে। আশেপাশে আর কোনও বাড়ি নেই। পাশেই গঙ্গা। আদিত্যর ড্রাইভার বলছিল, হাঁটাপথে বড়জোর তিন-চার মিনিট। ঘরে বসে আদিত্য নদীর হাওয়া টের পাচ্ছিল। সম্ভবত ইচ্ছে করেই জয়া অধিকারী লোকালয় থেকে একটু দূরে বাড়ি নিয়েছে। যাতে ফিরদৌসের সঙ্গে তার মেলামেশা নিয়ে আবার একটা স্থানীয় কথা চালাচালি শুরু না হয়।

‘ফিরদৌস খুন হবার পর পুলিশ কি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল?’

‘না, এখনও করেনি। হয়তো ফিরদৌসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথাটা তারা জানে না। আমিও আগ বাড়িয়ে কিছু জানাতে চাইনি। তবে পুলিশ যদি আমার কাছে এসে কিছু জানতে চায়, আমি যেটুকু জানি অবশ্যই জানাব। পুলিশের সঙ্গে তো সহযোগিতা করতেই হবে। আপনি কি পুলিশের লোক?’

‘না, না। আমি পুলিশের লোক নই। আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। ফিরদৌসের কেসটা প্রাইভেটলি ইনভেস্টিগেট করছি। ফিরদৌসের পিসি আমাকে নিয়োগ করেছেন। অমল বাগচি আপনাকে বলেননি?’

‘বলেছেন। অমলকাকা বললেন বলেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলাম। অমলকাকার কথা ফেলতে পারি না।’

‘আচ্ছা, শেষ যেদিন ফিরদৌস আপনার সঙ্গে দেখা করতে এল, ওর সঙ্গে কী কী লাগেজ ছিল আপনার মনে আছে?’

‘লাগেজ!’ জয়া অধিকারীকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। ‘ঠিক মনে নেই তো। বোধহয় একটাই ব্যাগ ছিল।’

‘কী রকম ব্যাগ? কত বড়?’

‘ঠিক মনে নেই। ছোট ব্যাগই হবে। আসলে ফিরদৌসের রাত্তিরে পরার জামাকাপড় তো এখানেই দু-তিন প্রস্ত থাকে। সাবান, টুথব্রাশ সবই এখানে আছে। তাই কিছুই আনতে হয় না।’

‘একটু কষ্ট করে মনে করুন না, ফিরদৌসের সঙ্গে কী রকম ব্যাগ ছিল। তদন্তের জন্যে এটা জানা আমার খুব দরকার।’

জয়া অধিকারী অনেকক্ষণ ধরে ভাবছে। আদিত্য কিছুক্ষণ জয়ার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর এদিক-ওদিক। টেবিলে চায়ের কাপ, আধ-খাওয়া চা, প্লেটে বিস্কুট। বাঁদিকের দেয়ালে পাশাপাশি তিনটে ছবি টাঙানো রয়েছে। জলরঙ। দেখে বোঝা যায় একই হাতে আঁকা। তিনটেই গঙ্গার ছবি।

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। মনে পড়েছে।’ জয়া অধিকারী হঠাৎ বলে উঠল। ‘ফিরদৌসের একটা ছোট চামড়ার ব্যাগ আছে। কাঁধে ঝোলানো যায়। ও ওটা নিয়েই এসেছিল। ওটা থেকে একটা পারফিউম বার করে ফিরদৌস আমাকে দিল। কলকাতা থেকে পারফিউমটা আমার জন্যে এনেছিল। তাই আমার মনে আছে। যতদূর মনে পড়ছে, ফিরদৌসের আর কোনও লাগেজ ছিল না।’

‘ফিরদৌস কি আপনাকে কিছু রাখতে দিয়ে গিয়েছিল? মানে, শেষ যখন সে এখানে এসেছিল?’

‘কই, না তো।’ উত্তরটা দেবার আগে জয়া অধিকারী কি একটু চমকে উঠেছিল?

‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব সুবিধে হল। আর একটা প্রশ্ন করব। এই বাড়িটা কি ভাড়া বাড়ি? নাকি আপনার নিজের?’

জয়া উত্তর দিতে ইতস্তত করছে। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘এটা ভাড়াবাড়ি নয়। বাড়িটা আমার নামে। পুরোনো বাড়ি কিনে সারিয়ে নিয়েছি। এটা কেনার সময় আমি কিছু টাকা দিয়েছিলাম। বেশির ভাগটাই কিন্তু ফিরদৌসের টাকা। বিশেষ করে বাড়ি সারানোটা পুরোটাই ওর টাকায় হয়েছিল। ও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়িটা সারিয়েছিল। না হলে আমি একা পারতাম না।’

‘আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।’ আদিত্য উঠে দাঁড়াল। ‘সাবধানে থাকবেন। আপনি একেবারে একা থাকেন তো, তার ওপর এই বাড়িটাও একেবারে আইসোলেটেড।’

‘আমাকে আর কে কী করবে? আমার তো কোনও শত্রুও নেই।’ জয়া নিস্পৃহ গলায় বলল।

‘ধরে নিন, ফিরদৌসের শত্রুরা আপনারও শত্রু। যে কারণে ফিরদৌস খুন হয়েছিল ওই একই কারণে আপনারও বিপদ হতে পারে। এর বেশি আর কিছু বলতে পারব না। তাই বলছিলাম সাবধানে থাকবেন। সাবধানের মার নেই।’

জয়া চুপ করে রইল। সে আদিত্যকে গাড়ি অব্দি এগিয়ে দিচ্ছিল।

‘আপনি বুঝি ছবি আঁকেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘আমি স্কুলের ড্রয়িং দিদিমণি। বড় ক্লাশে আঁকা শেখাই। ছোট ক্লাসের বাচ্চাদের অবশ্য সবই পড়াতে হয়। আমাদের ছোট স্কুল তো। টিচার কম, তাই কাজের চাপটা একটু বেশি।’

‘কোনও দরকার হলে আমাকে প্লিজ ফোন করবেন। আপনার নম্বরটা বলুন, আমি একটা মিসড কল দিচ্ছি।’ আদিত্য গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল।

পশ্চিম দিকের আকাশে খানিকটা আলো এখনও রয়ে গেছে। আদিত্যর মনে হল জয়া অধিকারী কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে।

‘চলুন একবার গঙ্গার ধারটা ঘুরে আসব। এত কাছে এসে গঙ্গাটা না দেখলে আফশোস থেকে যাবে।’ আদিত্য টোটোতে উঠে ড্রাইভারকে বলল।

নূপুর মণ্ডল একটা মেল পাঠিয়েছে। সঙ্গে একটা গুগল ড্রাইভের লিঙ্ক। মেল-এ লিখেছে, সুমনা ঘোষালের ইন্টারভিউ-এর অডিওটা পাঠালাম। ফাইলটা এত বড় হয়ে গেল যে গুগল ড্রাইভ দিয়ে পাঠাতে হচ্ছে। লিঙ্কটাতে ক্লিক করলেই অডিওটা পেয়ে যাবে। অডিওটা থেকে আমি ট্রান্সক্রিপশান করছি। এখনও কাজটা শেষ হয়নি। দু-এক দিনের মধ্যেই হয়ে যাবে। হলেই লেখাটা তোমাকে পাঠিয়ে দেব। তোমার তাড়াতাড়ি থাকতে পারে বলে অডিওটা আগেই পাঠিয়ে দিলাম। আমাদের কম্পানি একটা বড় কাজ পেয়েছে। সেই কাজটা নিয়ে আমরা তিনজনেই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সময় পেলেই ফোন করব।

বহরমপুর থেকে কলকাতা ফেরার পথে আদিত্য মেলটা মোবাইলে দেখেছিল। কিন্তু ট্রেনে বসে অডিওটা খোলার প্রশ্নই ওঠে না। বিকেলে মেসে ফিরে সে ঠিক করল এখন একটা কিংবা দরকার পড়লে দুটো দিন আপিস না গিয়ে ঘরে বসেই অডিওটা শুনবে।

সন্ধের ঝোঁকে বলরাম চা এনে দিয়েছে। এমন সময় সশরীরে বিমল এসে হাজির।

‘আপনার ফোনটা কিছুতেই পাচ্ছিলাম না স্যার। দুপুরে কতবার চেষ্টা করলাম। তাই নিজেই চলে এসেছি।’ বিমল জানাল।

‘ট্রেনে ছিলাম। তাই ফোনে পাওনি। মাঠের মধ্যে দিয়ে ট্রেন চললে সিগনাল পাওয়া যায় না।’

‘কোথায় গেছিলেন স্যার? আপনি তো সচরাচর কলকাতা ছেড়ে বেরুতে চান না।’

‘বহরমপুর গেছিলাম। কাল ভোরে গেলাম। আজ বিকেলে ফিরলাম। কচুরি খাবে? তুমি খেলে আমিও দুটো খেতে পারি।’

খাওয়ার ব্যাপারে বিমল মুখ ফুটে হ্যাঁ বলতে এখনও লজ্জা পায়। তবে খাওয়ার ইচ্ছে থাকলে চুপ করে থাকে। না বলে না।

আদিত্য বারান্দায় গিয়ে হাঁক পেড়ে ডাকল, ‘বলরাম, এই বলরাম।’

আধঘণ্টা পরে, যখন কচুরি-জিলিপি খাওয়া হয়ে গেছে, বলরাম আর এক প্রস্ত চা ঢেলে দিয়ে চলে গেছে, তখন ভাঁড়ে একটা চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘তারপর বল বিমলবাবু, কী খবর আনলে?’

‘খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি স্যার। যেটুকু জানতে পেরেছি, মনে হয়, সবই আপনার আগে থেকে জানা। তাও বলছি।’

‘তুমি যেটুকু জানতে পেরেছ আমাকে বল। আমি তার থেকে আমার যেটা দরকার বেছে নেব।’

‘বুটলেগার ক্লাবের সামনে তিন দিন চা-কফি বিক্রি করে মোটের ওপর কিছু জিনিস জানতে পেরেছি। আরও কয়েকটা দিন ওখানে থাকতে পারলে হয়তো আরও কিছু জানতে পারতাম। কিন্তু চতুর্থ দিন লোকাল মস্তানরা এসে আমাকে তুলে দিল। বলল, এখানে ব্যবসা করতে গেলে ওদের টাকা দিতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম কত টাকা। ওরা বলল, দশ হাজার। আমি বললাম অত টাকা আমি কোথায় পাব? ওরা বলল, তা হলে এখানে চা বিক্রি করার কথা ভুলে যা। আমি বললাম, হাজার পাঁচেকে হয় না? ওদের মধ্যে যেটা সর্দার গোছের সে আমার গালে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে বলল, আমরা দরাদরি করি না। আজ এখান থেকে ফোট। কাল যদি দশ হাজার জোগাড় করতে পারিস তাহলে আসবি। না হলে আসার দরকার নেই। আমি আর ও ধার মাড়াইনি।’

‘যাচ্চলে। বেমক্কা থাপ্পড় খেয়ে গেলে?’

‘কিছুই বৃথা যায় না স্যার। থাপ্পড় খাওয়াটাও বৃথা যায়নি। কেন যায়নি পরে বলছি। তার আগে প্রথম থেকে বলি কী কী জানতে পেরেছি।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেটাই বল।’

‘ড্রাইভার আর সিকিউরিটিদের থেকে জানতে পারলাম ওই বুটলেগার নাইট ক্লাবের ব্যাবসা এখন ভাল যাচ্ছে না। ওখানে একজন ম্যানেজার ম্যাডাম ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে পলি ম্যাডাম বলেও ডাকত। কিছুদিন আগে ওই পলি ম্যাডাম তাঁর রাজারহাটের ফ্ল্যাটে খুন হন। ডাকাতরা তাঁকে মেরে টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়। পলি ম্যাডাম ক্লাবটা খুব ভাল ম্যানেজ করতেন। উনি মারা যাবার পর ক্লাবটায় অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কাস্টমাররা বিরক্ত হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে।’

‘তা ওই ম্যাডামের জায়গায় অন্য কাউকে নেওয়া হয়নি?’

‘বোধহয় এখনও হয়নি। কেন হয়নি বলতে পারব না। তবে সবাই বলল, ক্লাবের মালিক পিটার অরোরার সঙ্গে ওই ম্যানেজার ম্যাডামের জোরদার ইস্ক চলছিল। রাজারহাটের ফ্ল্যাটটা মালিকই ম্যাডামকে ভাড়া করে দিয়েছিল। সেখানে মালিক ম্যাডামের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই রাত কাটাত।’

‘আর কিছু জানতে পারলে?’

‘হ্যাঁ স্যার। বলছি। আমাকে ওই থাপ্পড়টা মেরে তো মস্তানগুলো বাইক চেপে চলে গেল। আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালে হাত বুলোচ্ছি এমন সময় একটা সিকিউরিটি আমাকে বলল, এই মস্তানগুলো না খেতে পাওয়া কুত্তার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। না হলে তোমার গায়ে হাত তুলত না। তোমার কাছে টাকাও চাইত না। আমি বললাম, কেন? না খেতে পাওয়া কেন? সিকিউরিটি ছেলেটা ফিসফিস করে বলল, আগে এই নাইট ক্লাবের পেছনের দিকের একটা হলঘরে জুয়া খেলা হত। এই মস্তানগুলো সেই জুয়ার আড্ডাটা সামলাত। কেউ ঝামেলা করলে তাদের দু-চার ঘা দিয়ে বার করে দিত। কিন্তু কিছুদিন হল জুয়ার আড্ডাটা বন্ধ হয়ে রয়েছে। তাই মালিক মস্তানগুলোকেও বরখাস্ত করে দিয়েছে। আমি বললাম, জুয়ার আড্ডা বন্ধ হয়ে গেল কেন? সিকিউরিটি ছেলেটা বলল, সে আমি বলতে পারব না।’

আরও দু-চার কথার পর বিমল বিদায় নিল। ঘড়িতে সোয়া সাতটা বেজে গেছে। আদিত্য নূপুরের পাঠানো অডিওটা তার ল্যাপটপে ডাউনলোড করে নিল।

আমার ছোটবেলা কেটেছিল উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর মোড় থেকে বিডন স্ট্রিট ধরে চিৎপুরের দিকে হাঁটলে মিনার্ভা থিয়েটার আর রবীন্দ্র কাননের মাঝামাঝি একটা জায়গায় একটা দোতলা বাড়িতে আমরা থাকতাম। বাড়িটা মিনার্ভা থিয়েটারের ফুটপাতে। আমার মা সুনয়না দেবী মিনার্ভায় নিয়মিত অভিনয় করতেন। আমার বড় হওয়া নাটকের পরিবেশে। শিশু শিল্পী হিসেবে, আট বছর বয়েসে, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের আলিবাবা নাটকে স্টেজে প্রথম অভিনয় করি।

কেউ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। বলরাম। আদিত্য অডিওটায় পজ দিয়ে বলরামের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

‘ম্যানেজারবাবু পাঠাল। বলল, তোমার নাকি এ-মাসের মেস ভাড়া বাকি আছে। আমার হাতে দিয়ে দিতে বলল।’

‘ঠিক আছে। দিয়ে দিচ্ছি। একটু দাঁড়া।’

ভাগ্যিস আজই মেসে ঢোকার আগে এটিএম থেকে টাকা তুলেছিল আদিত্য। হোয়াট নট খুলে টাকা বার করে বলরামের হাতে দিয়ে বলল, ‘আমাকে আজ একটু তড়কা-রুটি এনে দিবি? আজ আর মেসের রান্না খেতে ইচ্ছে করছে না। আজ তো নিরামিষের দিন।’

‘আজ তড়কা-রুটি খেলে ঠকবে। ভানু ঠাকুর আজ ধোঁকার ডালনা বানিয়েছে। যা গন্ধ ছাড়ছিল না!’ বলরাম দাঁত বার করে হাসল।

‘হঠাৎ ধোঁকার ডালনা কেন? আগে তো কখনও করেনি।’

‘তুমি তো মেসের কোনও খবরই রাখ না। আজ দুপুরে ম্যানেজারবাবুর ছেলে এয়েচে না? তাই পেশাল খাওয়া।’

‘তাহলে তো এখন ক-টা দিন ভালমন্দ খাওয়া যাবে।’

‘সে গুড়ে বালি। ছেলে কী একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে এয়েচে। কাল দুপুরে পরীক্ষা দিয়েই দেশে ফিরে যাবে।’

‘যাগগে। ধোঁকার ডালনাই সই। থাক, আজ আর তড়কা রুটি আনতে হবে না।’

বলরাম চলে যেতে আদিত্য সুমনা ঘোষালের অডিও ইন্টারভিউটা আবার চালিয়ে দিল। সুমনা ঘোষাল তার ছেলেবেলার কথা বলছে, মায়ের কথা বলছে, তাদের স্ট্রাগল-এর কথা বলছে। শুনতে শুনতে আদিত্যর মনে হচ্ছিল নূপুর বেশ প্রফেশানালি ইন্টারভিউটা নিয়েছে। আদিত্য উঠে গিয়ে কেটলিতে চায়ের জল গরম করতে দিল। সিগারেট ধরাল। সুমনা ঘোষাল সিনেমায় তার প্রথম অভিনয়ের কথা বলছে। এটাও শিশু শিল্পী হিসেবে। নূপুর খুব কায়দা করে সুমনা ঘোষালকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করল। সুমনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে আরম্ভ করেছে। আদিত্য কান খাড়া করে শুনছে।

বাবাকে আমার ভালই মনে আছে। আমার বাবার নাম অজয় ঘোষাল। নাটকের ডিরেক্টর। কালীঘাটের মন্দিরে বাবার সঙ্গে মার বিয়ে হয়েছিল। আমার খুব ছোটবেলায় বাবা আমাদের সঙ্গে ওই বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে থাকত। সেই সময়টা আমার খুব ভাল কেটেছিল। পরে জানতে পারলাম বাবার আর একটা পরিবার আছে। তারা বালিগঞ্জে থাকে। একদিন বাবা আমাদের ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বালিগঞ্জে চলে গেল। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। খুব খারাপ লেগেছিল। রাতদিন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম। রাত্তিরে ঘুম ভেঙে যেত। টের পেতাম আমাদের সংসারে টাকা পয়সার টান দেখা দিয়েছে। চলে যাবার পর প্রথম প্রথম বাবা প্রত্যেক সপ্তাহে আসত। তারপর আসা কমিয়ে দিল। টাকা রোজগারের জন্যে মা যাত্রায় অভিনয় শুরু করল। এর জন্যে মাকে দূরে দূরে অভিনয় করতে যেতে হত। বাড়ি ফিরতে রাত্তির হত। অনেক রাত্তিরে ফিরতেই পারত না। আমাকে বাড়িতে একা থাকতে হত। টাকা বাঁচানোর জন্যে মা রাতদিনের লোকটাকেও ছাড়িয়ে দিয়েছিল।

ইতিমধ্যে আমি সিনেমায় আরও কাজ পেতে শুরু করেছি। শিশু থেকে কিশোরীর ভূমিকায়, কিশোরী থেকে তরুণী। ক্লাস এইটের পরে আর পড়াশোনা হল না। বিডন স্ট্রিট থেকে টালিগঞ্জে যাতায়াত করতে অসুবিধে হচ্ছিল। মা আর আমি মিলে টালিগঞ্জ অঞ্চলে একটা ফ্ল্যাট কিনলাম। ফ্ল্যাটটা খুব পয়া। হাসবেন না। ফিল্ম লাইনে আমরা অনেকেই পয়া-অপয়ায় খুব বিশ্বাস করি। সে যাই হোক, টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে উঠে যাবার কিছুদিন পরেই আমি পরপর কয়েকটা অফার পেলাম, তার মধ্যে একটা লিড রোলে। আরও কিছুদিনের মধ্যে আমার খানিকটা নাম হল। মা বলল, টালিগঞ্জের এই এঁদো ফ্ল্যাটটা আমার স্টেটাসের সঙ্গে বেমানান। আমি কিন্তু ওই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে কোত্থাও যেতে চাইছিলাম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মার পেড়াপেড়িতে নিউ আলিপুরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে উঠে যেতেই হল।

ফোন বাজছে। কেয়া। আদিত্য অডিওটা আবার পজে দিয়ে ফোনটা ধরল।

‘সেই কখন ফোন করে বললে ট্রেনে উঠছ, তারপর আর সাড়াশব্দ নেই। কখন ফিরলে?’ কেয়ার গলায় ঈষৎ উৎকণ্ঠা।

‘বিকেলে ফিরেছি। ভাবলাম তোমাকে ফোন করি, তারপর মনে হলো তুমি নিশ্চয় ক্লাস নিচ্ছ। তাই আর তোমাকে বিরক্ত করলাম না। রাত্তিরের দিকে ফোন করতাম।’

‘কেমন লাগল আমার জেঠুকে?’ কেয়ার গলায় আর উৎকণ্ঠা নেই।

‘চমৎকার মানুষ। আমাকে তো জামাই আদর করলেন।’ কথাটা বলেই আদিত্য ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘মানে, বলতে চাইছি, উনি খুবই আদর-যত্ন করেছেন। সব থেকে বড় কথা, ওঁর ব্যবহারটা ভীষণ আন্তরিক। কাল দুপুরে খাবার পর ওখানেই একটু ঘুমিয়ে নিলাম। কোনও অসুবিধে হয়নি।’

‘আমি জেঠুকে বলব জামাই খুশি হয়েছে।’ কেয়া মজা করার গলায় বলল। আসলে সে নিজেই খুব খুশি হয়েছে। ‘তোমার কাজ কিছু এগোল?’

‘চমৎকার কাজ এগিয়েছে। তবে মন বলছে আর একবার বহরমপুরে যেতে হবে।’

‘অবশ্যই আবার যেও। গেলে জেঠুর বাড়িতে নিশ্চয় যাবে। জেঠু খুব খুশি হবে।’

‘তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কবে দেখা হবে?’ আদিত্য খুব মৃদু গলায় বলল। কথাগুলো যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আদিত্যর ভেতর থেকে উঠে এসেছে।

‘কাল। বিকেল পাঁচটায় তোমাকে পাতিরামের স্টলের সামনে থেকে তুলে নেব। আজ মন দিয়ে কাজ কর। কেমন?’ যেন এই সিদ্ধান্তের ওপর আর কোনও কথা হতে পারে না এমন ভঙ্গীতে কথাগুলো বলে কেয়া ফোনটা কেটে দিল।

আদিত্য ফোন রেখে আবার অডিওটা চালিয়ে দিল। কেয়ার সঙ্গে কথা বলার পর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। সুমনা ঘোষাল তার কেরিয়ার নিয়ে কথা বলছে। কোন কোন ছবিতে অভিনয় করেছিল। কোনগুলো দর্শক নিয়েছিল, কোনগুলো নেয়নি। লম্বা ইন্টারভিউ। চলছে তো চলছেই। আদিত্য অর্ধেক শুনছে, অর্ধেক শুনছে না। আবার সিগারেট ধরাল। সুমনা তার মুম্বাই প্রবাসের কথা বলছে। তিন বছর সে সেখানে থেকে সিরিয়ালে কাজ করেছিল। আদিত্য এসব তথ্য জানে। ইন্টারভিউটা বেশ একঘেঁয়ে হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ, সম্ভবত একঘেঁয়েমিটা কাটানোর জন্যেই, নূপুর মণ্ডল জিজ্ঞেস করল, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কথা কিছু বলুন। আপনার তো একটি ছেলে আছে, তার কথা একটু বলবেন?

সুমনা : আমার ছেলেকে কেন টেনে আনছেন? তাকে এই ইন্টারভিউ থেকে বাদ দিন।

নূপুর : আপনি যদি বলেন অবশ্যই বাদ দেব। তবে কিনা আপনার জীবনের এই দিকটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা তীব্র কৌতূহল আছে। আমি খোলাখুলি বলছি, আপনার ছেলের পিতৃ-পরিচয় নিয়ে মিডিয়াতে নানারকম গল্প বেরিয়েছে। যেমন অনেকে লিখেছেন, প্রোডিউসার রোহিত ধামানি আপনার ছেলের বাবা। আবার অনেকে লিখেছেন, আশিসকুমার বলে যে নায়কের বিপরীতে প্রথম কয়েকটা ছবিতে আপনি অভিনয় করেছিলেন, তিনিই আপনার সন্তানের পিতা। কিছু মনে করবেন না, কেউ কেউ আবার অত্যন্ত আপত্তিজনক ইঙ্গিত দিয়েছে। বলেছে, আপনি নিজেই নাকি নিশ্চিত নন কে আপনার ছেলের বাবা। এগুলো সবই হয়তো বানানো গল্প। কিন্তু এই বানানো গল্পগুলো অকারণে আপনার চরিত্রহনন করেছে। আপনি নিজেই যদি ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেন, তাহলে আপনারই তো লাভ।

সুমনা : (উত্তেজিত গলায়) আমার লাভ-লোকসান দেখার ভার তো আপনাকে আমি দিইনি। ভাল করে শুনে রাখুন। আপনি যদি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো বাদ দিতে পারেন তা হলেই আমি আপনাকে ইন্টারভিউ দেব। না হলে নয়। এটা কি পরিষ্কার হল? আর আপনি ঠিক সেইটুকুই ছাপবেন যেটুকু আমি বলব। আপনি আগে আমাকে এই ইন্টারভিউ-এর একটা লিখিত কপি দেখিয়ে নেবেন। দেখে আমি তলায় সই করে দেব। আমি অনুমতি দিলে তবেই ছাপবেন। কোনও রকম চালাকি করবেন না। আপনাদের আমি ভালরকম চিনি।

নূপুর : (আত্মসমর্পণের গলায়) ম্যাডাম, আপনি যেমন বলবেন, আমি ঠিক তেমনভাবে আপনার ইন্টারভিউটা নেব। আপনি যদি আপনার ব্যক্তিগত জিনিসগুলো বাদ দিতে চান আমি অবশ্যই বাদ দিয়ে দেব। আপনি প্লিজ আমার ওপর রাগ করবেন না। আমি আসলে খুব বেশিদিন সাংবাদিকতা করছি না। বলতে গেলে এই ইন্টারভিউটাই আমার প্রথম বড় অ্যাসাইনমেন্ট। আমি যদি অভিজ্ঞতার অভাবে আপনাকে কোনওভাবে ভুল কিছু বলে থাকি আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিন। আমি তো আপনার থেকে কত ছোট। (নূপুরের গলাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছে)

অডিওটা চলছে, কিন্তু নূপুরের কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। সাবাস, নূপুর, সাবাস। আদিত্য মনে মনে তারিফ না করে পারল না। কিন্তু ইন্টারভিউটা এখানেই শেষ হয়ে গেল নাকি? না, না, শেষ হয়নি। ওই আবার সুমনার গলা শোনা যাচ্ছে।

সুমনা : (ঈষৎ অপ্রস্তুত গলায়) ঠিক আছে, ঠিক আছে। কান্নাকাটি করার কিছু নেই। আসলে কথাটা কী জান? আমার ছেলের যিনি বাবা তাঁর সঙ্গে আমার এখনও ভালই যোগাযোগ আছে। কিন্তু তিনি নিজে থেকে যতদিন না আমার ছেলের পিতৃত্ব স্বীকার করে নিচ্ছেন, আমি নিজে থেকে তাঁর ওপর কোনও চাপ সৃষ্টি করব না। এটা আমার একটা অভিমানের জায়গা। বলতে পার, একটা চরম অপমানের জায়গাও বটে। তাই এটা নিয়ে কোনও পাবলিক স্টেটমেন্ট দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই যে কথাগুলো তোমাকে বললাম এটা যেন কিছুতেই ছাপা না হয়।

আদিত্য ঘড়ি দেখল। ন-টা বাজে। বেশি দেরি করলে ধোঁকার ডালনা ফুরিয়ে যাবে। অডিওটা বন্ধ করে আদিত্য উঠে দাঁড়াল। বাকিটা পরে শুনলেও হবে।

সাবিনা অঝোরে কাঁদছে। তার পিসি-শাশুড়ি নুসরত তাকে সামলাতে পারছে না। আদিত্য বোকা-বোকা মুখ করে বসে আছে। এই সব অবস্থায় সে বুঝে উঠতে পারে না কী করবে।

এটা একটা হোটেলের ঘর। হোটেলটা পার্ক সার্কাস কানেক্টারের দোরগোড়ায়, চার নম্বর ব্রিজের নিচে। নতুন হোটেল, ঘরগুলোও বেশ বড়। আদিত্য একটা সোফায় বসেছে, সাবিনা রাইটিং টেবিলের সংলগ্ন চেয়ারে, নুসরত বসেছেন আর একটু দূরে, একটা চামড়া দিয়ে মোড়া আরাম কেদারায়। সোনালি বেডকভার ঢাকা দেওয়া দুটি সিঙ্গল খাট, সোফা এবং আরাম কেদারার মাঝখানে আড়াল তৈরি করেছে। চেয়ার-টেবিলটা সোফার দিকে।

নুসরত কথা বলছিলেন। ‘সাবিনাকে নিয়ে এক্ষুনি কলকাতায় আসার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কিছু টাকা পয়সার ক্লেম আছে যেগুলোর জন্যে সাবিনার সই দরকার। এল আই সি, কিছু কম্পানির স্টক, ফিক্সড ডিপোজিট। কাজগুলো হয়তো হালিশহরে বসেও করা যেত। তবে আমাদের এজেন্ট বলল, সাবিনা কলকাতায় এসে দু-একদিন থাকলে কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তাই সাবিনাকে নিয়ে চলে এলাম।’

‘ভাল করেছেন। আমিও এই সুযোগে সাবিনা ম্যাডামকে দু-একটা জিনিস জিজ্ঞেস করে নিতে পারব।’

‘আমি একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছি। যে হোটেলটায় এখন আমরা রয়েছি সেটাতে কিছুদিন আগে সাবিনাকে নিয়ে ফিরদৌস কয়েকদিন কাটিয়েছিল। আমি তো সেটা জানতাম না। জানলে কিছুতেই এই হোটেলে উঠতাম না। এখানে আসার পর থেকে সাবিনা একেবারে হিস্টিরিক হয়ে গেছে। ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে। যত বলছি, চল অন্য কোনও হোটেলে চলে যাই, তাও কিছুতেই যাবে না। বলছে, এখানে ফিরদৌসের স্মৃতি রয়েছে। কী যে মুশকিলে পড়েছি।’ নুসরতকে খানিকটা বিপন্ন দেখাল।

কলিং বেল বাজছে। আদিত্য উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখল রুম সার্ভিসের ছেলেটা চা নিয়ে এসেছে। টি-কোজি ঢাকা টি-পটে চা। শুধু আদিত্যর জন্যে। মহিলারা কেউ চা খাবেন না।

‘আমি ঢেলে দিচ্ছি।’ নুসরত তাঁর চেয়ার ছেড়ে ওঠবার উপক্রম করলেন।

‘না, না। আমি ঢেলে নেব। আপনাকে উঠতে হবে না।’ আদিত্য সন্ত্রস্ত হয়ে বলল। বলে সে নিজেই চা ঢালতে শুরু করল। ঢালতে ঢালতে তার মনে হল চা-টা আর একটু ভিজলে ভাল হত।

‘সাবিনা ম্যাডাম, আমি আপনাকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না। জাস্ট দু-তিনটে প্রশ্ন করব। কত তাড়াতাড়ি আমি আপনার স্বামীর হত্যাকারীকে খুঁজে বার করতে পারব সেটা অনেকটাই আপনার উত্তরের ওপর নির্ভর করবে।’ আদিত্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কুণ্ঠিতভাবে বলল।

সাবিনা উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে রইল। তার চোখ দিয়ে এখনও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আদিত্যর মনে হল, যে সাবিনাকে সে দেখেছিল তার তুলনায় এই সাবিনা অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখ দুটো বসে গেছে, গাল দুটো ভাঙা, উসকো খুসকো চুল। সেই পুরোনো সাবিনাকে চেনাই যায় না। আদিত্য ভাবছিল, সাবিনার মতো সব মেয়ে স্বামীদের সঙ্গে এতটা জড়িয়ে থাকে না। চকিতে তার জয়া অধিকারীর বেদনাক্লিষ্ট মুখটা মনে পড়ে গেল। ফিরদৌস রহমান, সন্দেহ নেই, তার প্রেয়সীদের আকর্ষণ করতে পারত।

‘আপনি ওকে প্রশ্ন করুন। ও উত্তর দেবে।’ নুসরত বললেন।

‘ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে যখন প্রথম কথা হয়েছিল, আপনি বলেছিলেন ফিরদৌস কোথায় আছে আপনি জানেন না। ফিরদৌসের কল লিস্ট থেকে এখন বোঝা যাচ্ছে সে যখন হোটেল সিতারায় লুকিয়ে ছিল তখন তার সঙ্গে আপনার নিয়মিত কথা হত। ফিরদৌস কি তখন আপনাকে বলেছিল কেন সে লুকিয়ে রয়েছে?’

সাবিনা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর প্রায় শোনা যায় না এমন একটা গলায় বলল, ‘ফিরদৌসের সঙ্গে আমার কথা হত এটা সত্যি। কিন্তু ফিরদৌস তখন কোথায় থাকত সেটা সে আমাকে কখনও বলেনি। আমি বহুবার জিজ্ঞেস করেছি। ফিরদৌস বলেছে, আমার এবং তোমার সেফটির জন্যেই তোমার জানার দরকার নেই আমি কোথায় আছি। ফুফাজি ভাবছেন আমি টাকা চুরি করে পালিয়ে গেছি। তাই তিনি আমাকে খুঁজছেন। খুঁজে পেলে কী করবেন আমি জানি না। হয়তো জানেই মেরে দেবেন। তুমি যদি জান আমি কোথায় লুকিয়ে আছি তা হলে চাপের মুখে তুমিই হয়তো সেটা ফুফাজিকে বলে দেবে। তার থেকে তোমার না জানাই ভাল আমি কোথায় আছি।’

‘টাকাটা আসলে কে নিয়েছে সে-বিষয়ে ফিরদৌস কী বলত?’

‘ফিরদৌস খুব জোর দিয়ে বলত টাকাটা বটুকবাবু চুরি করেছে। সে এই বিষয়ে প্রমাণ জোগাড় করছিল। চলে যাবার আগের দিনও তার সঙ্গে আমার কথা হয়। সে সেদিন বলেছিল সে যে নির্দোষ তার প্রমাণ সে প্রায় জোগাড় করে ফেলেছে।’

‘ফিরদৌসের সঙ্গে আর কী কী বিষয় নিয়ে আপনার কথা হত?

‘সাধারণ সাংসারিক কথা। মেয়েরা কেমন আছে? ফুফি কেমন আছে? আমি কেমন আছি? এইসব জিজ্ঞেস করত। বলত, একটু ধৈর্য ধর। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক হল না। কিছুই ঠিক হল না। আমার সব শেষ হয়ে গেল।’ বলতে বলতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সাবিনা খাতুন।

কথা বলার মতো অবস্থায় ফিরে আসতে সাবিনার খানিকটা সময় লেগে গেল। আদিত্য শান্তভাবে অপেক্ষা করছে।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সে বলল, ‘আপনাকে আর আমি বিরক্ত করব না। আমি চলে যাচ্ছি। যাবার আগে শুধু একটা শেষ প্রশ্ন। এমন কি কিছু আছে যেটা আপনার মনে হচ্ছে আমাকে বলা দরকার? যেটা নিয়ে ফিরদৌসের সঙ্গে আপনার সেই সময় কথা হয়েছিল, যেটা হয়তো খুবই সামান্য কিছু, কিন্তু স্বাভাবিকের বাইরে? আমি কি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি?’

সাবিনা মুখ তুলে তাকাল। বলল, আপনি ঠিক কি জানতে চাইছেন বুঝতে পারছি না। মিয়া-বিবির মধ্যে রোজ যেমন কথা হয় সেরকম কথাই তো হত। তবে একেবারে প্রথম দিকে একবার ফিরদৌস আমার কাছে একজনের ফোন নম্বর জানতে চেয়েছিল।’

‘কার ফোন নম্বর?’

‘জয়দেব বলে একটা ছেলের। সে কম্পিউটার সারাই করে। কলকাতায় থাকে। মনে হয়, ফিরদৌসের ল্যাপটপটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’

‘ফিরদৌসের কাছে জয়দেবের ফোন নম্বরটা ছিল না?’

‘দুটো নতুন মোবাইলের কোনওটাতেই ছিল না। হয়তো পুরোনো মোবাইলটাতে ছিল, কিন্তু সেই মোবাইলটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। খোলাই যায় না।’

‘তারপর?’

‘নম্বরটা শেষ পর্যন্ত আমার একটা পুরোনো অ্যাডড্রেস বইতে পাওয়া গেল। আমি অ্যাডড্রেস বই থেকে ফিরদৌসকে ফোন নম্বরটা জানিয়ে দিলাম।’

‘যদি খুব অসুবিধে না হয়, আমাকে জয়দেবের ফোন নম্বরটা জানাতে পারবেন?’

‘না, না। অসুবিধের কী আছে। অ্যাডড্রেস বইটা তো আমার ব্যাগেই আছে। আমি এক্ষুনি দেখে বলে দিচ্ছি।’

সাবিনা তার ব্যাগের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কোথায় গেল ব্যাগটা? সাবিনা উঠে গিয়ে ক্লজেটের পাল্লাটা সরাল। সাবিনার ব্যাগটা ওখানে আর একটা বড় নীল ব্যাগের ওপর রাখা রয়েছে। আদিত্য বড় নীল ব্যাগটার দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে।

‘ওই বড় নীল ব্যাগটা কি ফিরদৌসের?’ আদিত্য খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল।

‘কোন ব্যাগটা? ওই নীল ব্যাগটা? হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটা ফিরদৌসের। লাস্ট ক্রিসমাসে ওটা ফিরদৌস কুমুদিনী থেকে গিফট পেয়েছিল।’ সাবিনা স্বাভাবিক গলায় বলল। তারপর একটু থেমে বলল, ‘জয়দেবের ফোন নম্বরটা পেয়েছি। আপনি সেভ করে নিন।’

সাবিনাদের সঙ্গে কথা বলে রাস্তায় বেরিয়ে এসে আদিত্য খানিকক্ষণ ভাবল কোনদিকে যাবে। আসার সময় এসপ্ল্যানেডে ব্রেক জার্নি করে এসেছিল। তখন তাড়া ছিল বলে সামনে যা পেয়েছে উঠে পড়েছে। এখন আর ভিড় বাসে উঠতে ইচ্ছে করছে না। ট্র্যামে উঠলে কেমন হয়? আজকাল ট্র্যামের রুটগুলো অনেক বদলে গেছে। নতুন রুটগুলোর খবর আদিত্য রাখে না। আগে একটা কুড়ি নম্বর ট্র্যাম ছিল, চার নম্বর ব্রিজ থেকে একটু এগিয়ে আমির আলি এভিনিউ থেকে ধরা যেত। সেই ট্র্যামটা শেয়ালদা ফ্লাইওভারের ওপর থেকে বাঁদিকে বেঁকে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে হাওড়ার দিকে চলে যেত। সেটা পেলে আদিত্যর খুব সুবিধে হয়। আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে নামলে সেখান থেকে আদিত্যর মেস দু-মিনিটের হাঁটা পথ। কুড়ি নম্বর ট্র্যামের জন্য চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আদিত্য হাঁটতে হাঁটতে পার্ক সার্কাস ট্র্যাম ডিপোর সামনে দিয়ে আমির আলি এভিনিউতে এসে পড়ল।

মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর একটা ট্র্যাম এল বটে কিন্তু সেটার নম্বর ২৬/১৭। এরকম নম্বরের ট্র্যাম আদিত্য আগে দেখেনি। কন্ডাকটারকে জিজ্ঞেস করে জানল ট্র্যামটা শেয়ালদা ফ্লাইওভার দিয়ে সোজা মানিকতলার দিকে চলে যাবে। মানিকতলার মোড় থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে কাঁকুড়গাছি পেরিয়ে বিধাননগর তার অন্তিম গন্তব্য। ট্র্যামটা বেশ ফাঁকা। আদিত্য লাফ দিয়ে ট্র্যামে উঠে পড়ল।

জানলার ধারে সিট। অলস চোখে কলকাতা দর্শনের এমন সুযোগ আর হয় না। মল্লিকবাজার, এলিয়ট রোডের মোড়, নোনাপুকুর ডিপো পেরিয়ে গেল ট্র্যাম। এন্টালির বাজার আসবে আসবে। অনেক দিন এসব চত্ত্বরে ঘোরা হয়নি। আদিত্য উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তা দেখছিল। অবশ্য ওপর ওপর অলস চোখে রাস্তা দেখলেও আসলে কিন্তু আদিত্য গভীরভাবে চিন্তা করছিল। কুমুদিনীর রহস্যটা একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে। তবে এখনও দু-একটা অস্বচ্ছ জায়গা রয়েছে। সেগুলো ঘষে মেজে স্বচ্ছ করতে হবে।

এন্টালি মার্কেট পেরোনোর আগেই একটা ফোন এল। সোমেন মুখুটি।

‘কেমন আছেন? আপনার তদন্ত কেমন চলছে?’ আদিত্য ফোন তুলে জিজ্ঞেস করল।

‘ভাল আছি স্যার। তদন্তে খানিকটা এগিয়েছি, আবার কিছু কাজ বাকিও আছে। আপনাকে জানাব বলে ফোন করলাম। দু-মিনিট সময় হবে তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন। ট্র্যামে বসে আছি। ট্র্যামটা এখনও চলছে তবে একটু পরেই মনে হয় মৌলালির ট্র্যাফিক লাইটে আটকে যাবে। অতএব হাতে অনেক সময়। আপনি বলুন।’

‘কয়েকটা জিনিস বুঝতে পেরেছি। এটা এখন পরিষ্কার যে কুড়ি লক্ষ ডলার শিবেন মাইতি বলে কুমুদিনীর এজেন্ট আত্মসাৎ করেছে। ফিরদৌস, গোবিন্দ আর শিবেন এই তিনজন এজেন্ট মিলে টাকাটা সরিয়েছিল। শিবেন অন্য দু-জনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিজেই পুরো টাকাটা গাপ করেছে। খুন দুটো অবশ্য শিবেন নিজের হাতে করেনি, কোনও সুপারি কিলারকে দিয়ে করিয়েছে। আমি কুড়ি লক্ষ ডলারের ট্রেলটা মোটামুটি ধরতে পেরেছি। শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটে একটা দোকান আছে যারা হাওয়ালা বাজারে ডলার কেনাবেচা করে। আমি জানতে পেরেছি তাদের হাত দিয়েই ডলারটা বিক্রি হয়েছে। আমি দোকানের মালিককে এখনও অ্যারেস্ট করিনি কারণ ওকে ধরলে শিবেন সাবধান হয়ে যাবে। আসল কথা হল, শিবেনকে এখনও ধরতে পারিনি। সে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’

ট্র্যামটা সত্যিই মোলালির ট্র্যাফিক লাইটে আটকে গেছে।

‘আপনি অসাধ্য সাধন করেছেন। কোনও প্রশংসাই আপনার পক্ষে যথেষ্ট নয়।’ আদিত্য উচ্ছ্বসিত গলায় বলল। ‘আপনি কলকাতায় কবে আসছেন?’

‘আমি আর দিন দুয়েক পরে কলকাতায় ফিরছি। তার মধ্যে যদি শিবেন মাইতিকে ধরে ফেলতে পারি তো ভাল। না হলে আবার নর্থ বেঙ্গলে আসতে হবে।’

‘আমার সমস্ত শুভেচ্ছা আপনার সঙ্গে রইল। খুনি ধরা পড়ে গেলে আমার মাথার ওপর থেকেও একটা বিরাট বোঝা নেমে যাবে। মনেপ্রাণে প্রার্থনা করি আপনি খুব তাড়াতাড়ি সফল হয়ে ফিরে আসুন।’ আদিত্য যথাসম্ভব আন্তরিকভাবে বলল।

আরও আধঘণ্টা পরে আদিত্য যখন ট্র্যাম থেকে নেমে মেসের দিকে হাঁটছে তখন আবার একটা ফোন। এবার নূপুর মণ্ডল।

‘আদিত্যদা, ইন্টারভিউটা লিখে, সুমনা ঘোষালকে দিয়ে সই করিয়ে, তোমাকে একটা স্ক্যান কপি মেল করে দিয়েছি। অরিজিনালটা আমার কাছে আছে। তুমি চাইলে পাঠিয়ে দেব। সুমনা ঘোষাল যেগুলো বাদ দিতে বলেছিল সেগুলো কিন্তু এই লেখাটাতে নেই।’

‘ইন্টারভিউটা ভীষণ ভাল নিয়েছ। বোঝাই যাচ্ছে না এটা তোমার নেওয়া প্রথম ইন্টারভিউ। আমি কিন্তু এটা ছাপাবার ব্যবস্থা করছি।’

‘কোথায় ছাপাবে?’

‘সেটা তোমায় ভাবতে হবে না। আমার অনেক সাংবাদিক বন্ধু আছে। তাদের কাউকে বলব।’

‘ইন্টারভিউটা সত্যি সত্যি ছাপা হলে আমাকে একটু জানিও। আমি সুমনা ঘোষালকে একটা কপি পাঠিয়ে দেব। খুব খুশি হবে। কদিন ইন্টারভিউ নিয়ে ভদ্রমহিলার ওপর একটা মায়া পড়ে গেছে।’

‘তোমার কম্পানি কেমন চলছে?’

‘ভাল চলছে, আদিত্যদা। কাজের চাপ ক্রমশ বাড়ছে।’

‘তাহলে আর তোমাকে আমার কাজ করতে বলে বিব্রত করব না। তুমি ভাল করে তোমার নিজের কাজটা কর। ভাল থেক।’

আদিত্য মোবাইলটা বন্ধ করে দেখল সে তার মেসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।

‘চাকি বলছি স্যার। দু-মিনিট কথা বলা যাবে?’

‘নিশ্চয়, বলুন।’

‘আমি ওই কম্পিউটারগুলো দেখছিলাম, ওই যেগুলো কুমুদিনী থেকে সিজ করে আনা হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বুঝেছি। তা কিছু পেলেন?’

‘ওপর ওপর কুমুদিনীর ব্যবসা হল শেয়ার বাজারের দালালি। পাঁচটা কম্পিউটারে শেয়ার কেনাবেচার তথ্য রয়েছে। পার্টিদের নামও রয়েছে, মানে যাদের হয়ে কুমুদিনী শেয়ার কেনাবেচা করেছে। আমি সেই কেনাবেচাগুলো স্টাডি করছিলাম।’

‘বেশ। তারপর?’

‘দেখলাম মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বলে একটা কম্পানির হয়ে কুমুদিনী প্রচুর শেয়ার কেনাবেচা করেছে। অন্য পার্টিদের হয়ে ট্র্যাঞ্জ্যাকশনগুলো যেখানে হাজার বা দু-একটা ক্ষেত্রে বড় জোর লাখের অঙ্কে, সেখানে মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট-এর কেনাবেচাগুলো সব সময় কোটির অঙ্কে। নাম্বার অফ ট্র্যাঞ্জ্যাকশনও অনেক বেশি। ব্যাপারটা সন্দেহজনক লাগছে। তাই ভাবছি আজ দুপুরে মহাদেব কম্পানিতে একবার ইনভেস্টিগেশনে যাব। আপনি কি আমার সঙ্গে যেতে ইন্টারেস্টেড হবেন স্যার?’

‘অবশ্যই ইন্টারেস্টেড হব। অবশ্যই ইন্টারেস্টেড হব। আপনি কি যাবার পথে আমাকে আমার আপিস থেকে তুলে নিতে পারবেন?’

‘ঠিকানাটা স্যার এজরা স্ট্রিটের। যায়গাটা খুব ঘিঞ্জি। ওখানে গাড়ি নিয়ে যাবার থেকে হেঁটে যাওয়াই সুবিধে হবে স্যার।’

‘ঠিক আছে। আমিই তাহলে লালবাজারে চলে যাব। ওখান থেকে হেঁটে এজরা স্ট্রিট খুব বেশিক্ষণ লাগবে না। কখন যাব?’

‘আপনি দুপুর একটা নাগাদ আসতে পারবেন স্যার? মেন গেটে পৌঁছে আমাকে একটা ফোন করে দিলে আমি নিচে নেমে আসব। আপনাকে আর কষ্ট করে ওপরে উঠতে হবে না।’

‘ওকে। সেটাই তাহলে ঠিক রইল।’

ফোনটা রেখে আদিত্য সিগারেট ধরাল। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানি কি সেইসব প্রশ্নের কোনওটার উত্তর দিতে পারবে?

রাধাবাজারের ঘড়ি-পট্টি পেরিয়ে আদিত্যরা যখন এজরা স্ট্রিটের ইলেকট্রিকাল গুডস-এর চত্বরে পৌঁছল তখন প্রায় দেড়টা বাজে। ঠিকানাটা একটা পাঁচতলা আপিস-বাড়ির। ঢোকার মুখে দেয়ালে লেটারবক্সের আধিক্য দেখে মনে হল বাড়িটায় অন্তত শ’খানেক আপিস আছে। এই ই-মেল, এস এম এস-এর যুগে চিঠিপত্তর খুব বেশি আসে না। তাই লেটারবক্সগুলো চিঠি বহন করার পরিবর্তে সাইনবোর্ডের কাজ করছে। বাড়িতে ঢোকার মুখে দেয়ালটা ভেঙে গিয়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে। ঢুকলেই একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ নাকে আসে। পুরোনো চুন-সুরকির ওপর শ্যাওলা জমলে যেমন গন্ধ হয়। একজন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে গিয়েও চাকির ইউনিফর্মের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। তারপর দ্বিগুণ দ্রুততায় বেরিয়ে গেল রাস্তায়। সিঁড়ির হাতলটা এখনও নড়বড় করছে, লোকটা তাতে ভর দিয়ে নামছিল নিশ্চয়। এমন হাতলে ভর করে সিঁড়ি ভাঙতে ভরসা হয় না। এরকম একটা বাড়িতে যে কম্পানির আপিস তারা কোটি-কোটি টাকার ট্র্যাঞ্জাকশন করে কী করে?

লেটারবক্সের জঙ্গল থেকে মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানির নামটা খুঁজে পাওয়া বোধহয় মহাদেবেরও অসাধ্য। চাকি এবং আদিত্য সেই অসাধ্যসাধনে লিপ্ত হয়েছে। ধারে কাছে এখন আর কেউ নেই যাকে জিজ্ঞেস করা যাবে। সিঁড়ি দিয়েও কেউ ওঠানামা করছে না। মিনিট পাঁচেক গোরু-খোঁজা খোঁজার পর আদিত্য হাল ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ধরাল। আর প্রায় ঠিক তখনই চাকি, আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ বলার ভঙ্গীতে বলে উঠল, ‘এই যে, পেয়ে গেছি স্যার। একেবারে ধারের দিকে ছিল বলে চোখে পড়ছিল না।’

 মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানির আপিসটা সেকেন্ড ফ্লোর অর্থাৎ তিনতলায়। পুরোনো আমলের বাড়ি, তাই তিনতলাটা এখনকার বাড়ির পাঁচতলার সমান। আজকাল বেশি সিঁড়ি ভাঙতে গেলে আদিত্য বেশ হাঁপিয়ে ওঠে। আর তখনই তার সিগারেট ছাড়ার কথা মনে হয়। তারপর অবশ্য সব ভুলে যায়।

সিঁড়িটা নোংরা। কোনাগুলো পানের পিকে লাল হয়ে আছে। আরও ওপরে অসংখ্য পায়রার বাসা। তাদের বর্জ্য সিঁড়ির দেয়ালে, মেঝেতে, ঘুলঘুলির গায়ে জমে পাথর হয়ে রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আদিত্যর গা ঘিনঘিন করছিল।

 মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানির লেটারবক্সটা যেমন এক কোণে লুকোনো, তেমনি আপিসটাও। এবারেও সেটা চাকিই খুঁজে বার করল। আপিস বলতে সরু এক চিলতে ঘর। একটা অল্পবয়সী ছেলে একটা ল্যাপটপ খুলে কাজ করছিল, পুলিশ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল।

‘এটা মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কম্পানির অফিস?’ চাকি ধমকের সুরে প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। কী ব্যাপার স্যার?’ ছেলেটার গলাটা কাঁপছে।

ঘরে আরও দু-সেট চেয়ার-টেবিল রয়েছে। কোনওটাতেই লোক নেই। একটা টেবিলের ওপর কিছু কাগজপত্র, একটা ফাইল। অন্য টেবিলটার ওপরে একটা ডেস্কটপ। সেটা বন্ধ।

চাকি ছেলেটার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘এই চেয়ার-টেবিলগুলো ফাঁকা রয়েছে কেন? এখানে লোক নেই?’

‘একজন আজ আসেনি। আর একজন কাজে বেরিয়েছে। এক্ষুনি এসে পড়বে।’

‘এখানে কী কাজ হয়?’ এবার আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কাজ স্যার। অনেক ছোট ছোট কম্পানি আমাদের থ্রু দিয়ে ইমপোর্ট করে, এক্সপোর্টও করে। আমরা তাদের সাহায্য করি।’

‘কী ইমপোর্ট করে?’

‘নানা ধরনের জিনিস। যেমন ধরুন ইলেকট্রিকাল গুডস। এই যে এজরা স্ট্রিটে দেখছেন এত রকমের ইলেকট্রিকাল গ্যাজেট বিক্রি হচ্ছে এর অধিকাংশই চাইনিস। যারা এগুলো বিক্রি করছে তারা তো এই জিনিসগুলো চায়না থেকে ইমপোর্ট করছে। আমরা এইরকম কিছু ইমপোর্টারকে সাহায্য করি। অ্যাডভাইস দিই কোথা থেকে মাল কিনতে হবে, কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’ আদিত্যর সঙ্গে কথা বলে ছেলেটার ভয় যেন কেটে যাচ্ছে।

‘আর এক্সপোর্ট?’ এবার চাকির গলা।

‘ব্যাপারটা ওই একই রকম। ধরুন কেউ অ্যামেরিকায় ছোটখাটো চামড়ার জিনিস এক্সপোর্ট করবে। আমরা তাকে খদ্দেরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিই।’

‘এত কিছু আপনারা এইটুকু একটা আপিসে বসে করেন?’ চাকির প্রশ্ন।

‘আমাদের কাজের জন্যে খুব বেশি জায়গা লাগে না স্যার। একটা-দুটো কম্পিউটার আর ভাল ইন্টারনেট কানেকশান থাকলেই হয়।’

‘আপনাদের এই কম্পানির মালিক কোথায়? আপনি তো মনে হচ্ছে এখানে চাকরি করেন।’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ স্যার। আমরা তিনজন এখানে চাকরি করি। মালিক খুব বেশি এখানে আসে না। দরকার পড়লে আমাদের ডেকে পাঠায়। মালিকের আরেকটা অফিস আছে।’

‘মালিকের নাম আর অফিসের ঠিকানাটা বলুন। আর ফোন নাম্বারটা।’ চাকি ধমক লাগাল।

‘স্যার, মালিককে না জিজ্ঞেস করে নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার দিলে মালিক খুব রাগ করবে। আমার চাকরিটাও চলে যেতে পারে স্যার।’

চাকি কিছু বলল না। শুধু ঠান্ডা চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। সেই হিমশীতল দৃষ্টি দেখে ছেলেটা যা বোঝার বুঝে নিল। টেবিলের ওপর থেকে একটা চিরকুট নিয়ে একটা নাম আর ঠিকানা লিখল। তারপর পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখে দেখে ফোন নম্বরটাও লিখল।

‘আপনার নাম কী?’ চিরকুটটা পকেটে পুরতে পুরতে চাকি বলল।

‘সুপ্রতিম, স্যার। সুপ্রতিম জানা।’

‘শুনুন সুপ্রতিমবাবু। এই মহাদেব কম্পানির অফিসটা আমরা সিল করে দেব। আমি লালবাজারে ফোন করে আরও ফোর্স পাঠাতে বলছি। তারা এসে সিল করার কাজটা করবে। আপনাকে উইটনেস থাকতে হবে। আর আপনার মালিকের সঙ্গে আমরাই যোগাযোগ করে নেব।’

রাত্তিরে অমিতাভ-রত্নার বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল আদিত্যর। উইকএন্ড। রত্না অনেকবার করে রাত্তিরটা থেকে যেতে বলেছে। মহাদেব এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ঝামেলা চুকিয়ে সে যখন অমিতাভদের বাড়ি পৌঁছল তখন প্রায় আটটা বাজে। সদর দরজায় বেল বাজানোর আগেই বাইরে থেকে শুনতে পেল অমিতাভর বসার ঘরে অপরিচিত গলায় কে যেন কথা বলছে।

‘আয়, আয়। এত দেরি করলি কেন? আমরা তোকে বাদ দিয়েই চা খেয়ে নিলাম।’ অমিতাভ দরজা খুলে বলল।

আদিত্য দেখল বসার ঘরে অমিতাভ এবং রত্না ছাড়া আরও দুজন সোফায় পাশাপাশি বসে আছে। আদিত্যর মনে হল এরা স্বামী-স্ত্রী।

‘আলাপ করিয়ে দিই। ডাক্তার নীলাদ্রি দত্ত, আমার ইস্কুলের বন্ধু। আর নীলাদ্রির স্ত্রী ডাক্তার অনসূয়া দত্ত। আর এ হল আমার আর রত্নার কলেজের বন্ধু আদিত্য মজুমদার।’ অমিতাভ বসল। আদিত্য তখনও দাঁড়িয়ে।

‘আমি আদিত্যর জন্যে চা নিয়ে আসি। কিছু খাবি?’ শেষ কথাটা রত্না আদিত্যর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘না, এখন কিছু খাব না। আর চা করার ঝামেলায় না গিয়ে তুই বরং এক কাপ কফি খাওয়া। তোদের সেই কলম্বিয়ান কফি। ওটা তো ইন্সট্যান্ট কফি, তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।’ আদিত্য এবার বসে পড়ল। নীলাদ্রি নামটা তার মনে পড়েছে। সেই পেডিএট্রিশিয়ান যে বটুক সামন্তর ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে।

‘ক্লাস ফাইভ অব্দি নীলাদ্রি ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। পাশাপাশি বসতাম। টিফিনে একসঙ্গে খেলতাম। তারপর হঠাৎ বিচ্ছেদ। ক্লাস ফাইভের শেষ দিকে নীলাদ্রির বাবা বদলি হয়ে গেলেন। তুই কি ফাইভের অ্যানুয়ালটা দিয়েছিলি?’ অমিতাভ নীলাদ্রিকে জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ। অ্যানুয়ালটা দিয়েই চলে গিয়েছিলাম। তোর সঙ্গে দেখাও করে যেতে পারিনি। ভেবেছিলাম যাবার আগে তোর ঠিকানাটা নিয়ে নেব। সেটাও হয়ে ওঠেনি। বাবা মধ্যপ্রদেশের ভূপালে বদলি হয়ে গেলেন। সেখান থেকে পুনে। পুনে থেকে আবার কলকাতা। ফিরে এসে অন্য স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখান থেকেই হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলাম। তারপর আর জি কর থেকে মেডিকাল।’ নীলাদ্রি থামল।

নীলাদ্রির স্ত্রী অনসূয়া বলল, ‘আপনার সঙ্গে নীলাদ্রির যে আবার যোগাযোগ হল সেটাও আশ্চর্যভাবে। সারা সপ্তাহ আমরা দুজনেই খুব ব্যস্ত থাকি, দু-জনের প্রায় দেখাই হয় না। শুধু উইকএন্ডটা আমাদের নিজস্ব। সেই দিনটাও একটা উইকএন্ড ছিল। আমরা বাড়িতে বসে এক সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। এটা আমাদের কাছে বিরাট লাক্সারি। সাধারণ কথাবার্তাই বলছিলাম। সামনে টিভিটা খোলা ছিল। আমরা কেউই খুব একটা টিভি দেখি না। তাই, নেহাত ভাগ্যবশতই বলব, টিভিটা খোলা ছিল। কলকাতার হেরিটেজ বিল্ডিংগুলো নিয়ে একটা প্রোগ্রাম হচ্ছিল। কয়েকজন হিস্টোরিয়ান বিল্ডিংগুলোর হিস্ট্রি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। হঠাৎ নীলাদ্রি বলে উঠল, দ্যাখো, দ্যাখো। এই ভদ্রলোককে ঠিক আমার ছোটবেলার বন্ধু অমিতাভর মতো দেখতে।’

‘অমিতাভর চেহারাটা কিন্তু একদম পাল্টায়নি। ছোটবেলার সেই শুগার বেবি ভাবটা এখনও মুখে রয়ে গেছে। তাই আপনি চিনতে পারলেন।’ রত্না হাসতে হাসতে বলল।

‘সেটা ঠিক। কিন্তু সেদিন টিভির প্রোগ্রামটা তো শেষ হয়ে গেল, হিস্টোরিয়ানদের নামগুলো আমারা জানতে পারলাম না। বোধহয় গোড়াতেই বলে দিয়েছিল, আমরা খেয়াল করিনি। ভাগ্যক্রমে, ওই চ্যানেলের একটি রিপোর্টারের বাচ্চা আমার পেশেন্ট। তাকে ফোন করে কনফার্মড হলাম যে ওটা আমার ছোটবেলার বন্ধু অমিতাভ মিত্রই বটে। ওই রিপোর্টার ছেলেটিই অমিতাভর ফোন নম্বরটা জোগাড় করে দিল।’ নীলাদ্রি দত্ত থামল।

‘এত বছর পরে নীলাদ্রি যখন ফোন করল তখন প্রথমে বলল, আপনি কি অমিতাভ মিত্র? আমি হ্যাঁ বলতে ও বলল, আমাকে চিনতে পারছ? আমি নীলাদ্রি দত্ত, তোমার সঙ্গে পড়তাম। আমি যেই বললাম, অবশ্যই চিনতে পারছি, ও বলল, আমি এখন পিজিতে আছি। একদিন তোর সঙ্গে দেখা করতে পারলে খুব ভাল হয়। এত দ্রুত আপনি থেকে তুই-এর ট্রাঞ্জিশানটা খুব মজার।’ অমিতাভ বলল। তারপর একটু থেমে বলল, ‘নীলাদ্রি তুই তো বাচ্চাদের ডাক্তার। তুই কি ডাঃ সামন্ত বলে কাউকে চিনিস যিনি বাচ্চাদের ডাক্তার, বর্ধমান মেডিকাল কলেজে আছেন?’

‘ডাঃ শুভঙ্কর সামন্ত।’ আদিত্য এতক্ষণ বাদে মুখ খুলল।

নীলাদ্রি দত্ত একটু অবাক হয়ে আদিত্যর দিকে তাকাল। তারপর অমিতাভর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও, শুভঙ্কর। হ্যাঁ, তাকে চিনি বইকি। শুভঙ্কর আমার সব থেকে ভাল ছাত্র। বারো বছরের টিচিং কেরিয়ারে আমি যত ছাত্র পড়িয়েছি তার মধ্যে বেস্ট। কিন্তু তাকে তোর কেন দরকার? কাউকে দেখাতে হবে?’

‘দরকারটা আসলে আমার।’ আদিত্য যথাসম্ভব কাঁচুমাচু হয়ে বলল। ‘কারণটাও একটু অদ্ভুত। কাউকে দেখাব বলে ডাঃ সামন্তর সঙ্গে দেখা করতে চাইছি না। একটা খুন এবং টাকা চুরির মামলায় ডাঃ শুভঙ্কর সামন্তর বাবা সত্যজিৎ সামন্ত জড়িয়ে পড়েছেন। সেই সূত্রে ডাঃ সামন্তর সঙ্গে দেখা করতে চাইছি। অমিতাভ আপনাকে এখনও আমার আসল পরিচয়টা দেয়নি। তাই আমি নিজেই নিজের পরিচয়টা দিচ্ছি। আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। আমি সত্যজিৎ সামন্তর কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি।’

আগের তুলনায় আদিত্য এখন অনেক পোড়-খাওয়া হয়েছে। নিজের গোয়েন্দা পরিচয়টা দিতে সে আজকাল আর সংকোচ বোধ করে না। কিন্তু এক সঙ্গে এতগুলো তথ্যের চাপে ডাঃ নীলাদ্রি দত্ত যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। তার স্ত্রীর অবস্থাও অথৈবচ। সেই বিভ্রান্ত অবস্থা থেকে প্রথমে বেরিয়ে এসে ডাঃ অনসূয়া দত্ত বলল, ‘যাঃ কী বলছেন। বেসরকারি গোয়েন্দা আবার হয় নাকি?’

আদিত্য ভাবছিল বলবে, ‘নাই যদি হবে তা হলে হলো কী করে?’

কিন্তু এটা রসিকতার সময় নয়। তাই সে কাতরভাবে বলল, ‘বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, ওটাই আমার জীবিকা।’

 নীলাদ্রি দত্ত খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে। সে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে সাবধানি গলায় বলল, ‘আমাকে ঠিক কী করতে বলছেন?’

‘যদি শুভঙ্কর সামন্তর সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিতে পারেন তা হলে আমার খুব উপকার হয়। আর সত্যি কথা বলতে কি, আমার থেকেও বেশি উপকার হয় ডাঃ সামন্তের নিজের। আমার উপকারের কারণটা অবভিয়াস। ডাঃ সামন্তর সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমার তদন্তটা এগোতে পারবে। ডাঃ সামন্তর কেন উপকার হবে, বলছি। দেখুন, আজ না হোক তো কাল এই কেসটার সূত্রে পুলিশ ডাঃ সামন্তর কাছে পৌঁছে যাবেই। সেটা ওঁর রেপিউটেশনের পক্ষে ভাল হবে না। ডাঃ সামন্তর কাছে পুলিশ এসেছে এই খবরটা ডিসটর্টেড হয়ে নানা দিকে ছড়িয়ে যাবে। তার চেয়ে আমি যদি পুলিশের আগে পৌঁছতে পারি তাহলে কিছু ব্যাপারে আমি ওঁকে সাবধান করে দিতে পারব। হয়তো পুলিশকেও বোঝাতে পারব যে শুভঙ্কর সামন্তর সঙ্গে দেখা করে বিশেষ লাভ নেই। অমিতাভ জানে, পুলিশের সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্য আছে।’

অমিতাভ ঘাড় নাড়ল। নীলাদ্রি দত্ত ভাবছে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘দেখুন শুভঙ্কর আমার সব থেকে ভাল ছাত্র নিশ্চয়, কিন্তু মানুষ হিসেবে ও একটু ডিফিকাল্ট। কিছু ব্যাপারে ও হুইমসিকাল, আনস্ক্রুপুলাস, আনঅর্থডক্স, অসামাজিক। ওর স্বভাবটা রীতিমতো রুক্ষ। রুগির বাবা-মায়ের সঙ্গে ওর ব্যবহার নিয়ে অনেক কমপ্লেন আছে। নেহাত ডাক্তার হিসেবে আউটস্ট্যান্ডিং বলে লোকে ওর সমস্ত দোষ মেনে নেয়। আমি যত দূর জানি ওর বাবার সঙ্গে ওর এবং ওর মায়ের খুব একটা সম্পর্ক নেই। সম্ভবত ছোট থেকেই শুভঙ্কর মামারবাড়িতে মানুষ। ওর কথা শুনে মনে হয় নিজের বাবাকে ও ঘৃণা করে। এই অবস্থায় ও আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে কিনা জানি না।’

‘দেখুন, শুভঙ্করবাবু যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে না চান তা হলে তো কিছু করার নেই। সেক্ষেত্রে আমি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে যাব। আমার সঙ্গে পুলিশ থাকলে উনি দেখা করতে বাধ্য হবেন। কিন্তু আমি সে ভাবে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই না। আপনি যদি ওঁকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন তা হলে উনি হয়ত রাজি হয়ে যেতে পারেন।’

‘আমি ওকে বুঝিয়ে বলব। আসলে, যতই ওর দোষ থাকুক ওর প্রতি আমাদের, মানে অনসূয়ার আর আমার, একটা প্রচণ্ড দুর্বলতা আছে। আমরা চাই ওর ভাল হোক।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন