অভিরূপ সরকার
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
গোবিন্দ রায় এল না। আদিত্য তার আপিসে বসে আছে তো বসেই আছে। এগারোটা বেজে গেল, সাড়ে এগারোটা বেজে গেল, এক সময় বারোটাও বেজে গেল। সাড়ে বারোটার সময় আদিত্য গোবিন্দ রায়ের নম্বরে ফোন করল। নম্বরটা সে কাল সেভ করে রেখেছিল। ফোন সুইচ অফ। লোকটার বিপদ হল নাকি?
পৌনে একটা নাগাদ একটা ফোন এল। পুলিশ ইন্সপেক্টার সোমেন মুখুটি ফোন করেছে।
‘কেমন আছেন স্যার?’
‘ভাল আছি। আপনার তদন্ত কেমন এগোচ্ছে?’
‘দু-একটা লিড পেয়েছি। সেইজন্যেই আপনাকে ফোন করলাম। ফিরদৌসের দু-টো ফোন, দু-টো নম্বর। দু-টো নম্বরই আমাদের আই টি ডিপার্টমেন্টকে দিলাম। ওরা বলে দিয়েছে খুন হবার আগের এক সপ্তাহ কার কার সঙ্গে ফিরদৌসের ফোনে কথা হয়েছিল। সেই ফোনগুলো কার কার নামে রেজিস্টার্ড সেটাও জানা গেছে। আপনি কি লিস্টটা একবার দেখবেন?’
‘অবশ্যই দেখব। ওটা কি মেলে পাঠানো সম্ভব হবে? আমার মেল আইডিটা টেক্সট করে দিচ্ছি।’
‘পাঠিয়ে দেব স্যার। আপনি ওটা ভাল করে স্টাডি করুন।’
‘আর কিছু পেলেন?’
‘আমরা জানার চেষ্টা করছিলাম কুড়ি লক্ষ ইউ এস ডলার কলকাতার হাওয়ালা বাজারে কোথাও ভাঙানো হয়েছে কিনা। সেরকম কিছু ট্রেস করতে পারিনি। হয়তো এখনও টাকাটা ভাঙানো হয়নি।’
‘ল্যাপটপটা দেখেছিলেন?’
‘ল্যাপটপে কিচ্ছু নেই। থাকার মধ্যে অনেকগুলো সিনেমা ডাউনলোড করা আছে। আর কিছু হিন্দি সিনেমার গান। ফিরদৌস মনে হয় খুব সিনেমা দেখত। বিশেষ করে সে যখন সিতারা হোটেলে লুকিয়ে রয়েছে, সারাদিন হাতে কাজ নেই।’
‘আর কিছু?’
‘আপনার মনে আছে একটা ফাঁকা নীল রঙের ব্যাগ ফিরদৌসের ঘরে পাওয়া গিয়েছিল? খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম গত বড়দিনের সময় ওইরকম কয়েকটা ব্যাগ কুমুদিনী কম্পানি কয়েকজনকে গিফট করেছিল। ফিরদৌসও পেয়েছিল একটা। তাছাড়া কম্পানির ক্লায়েন্ট হিসেবে জাহাঙ্গির খানও একই রকম দেখতে একটা ব্যাগ পেয়েছিল। আমি জাহাঙ্গির খানের বডিগার্ড সহদেবকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি জাহাঙ্গিরের নীল ব্যাগটা করেই সেদিন ফিরদৌস কুড়ি লক্ষ ইউ এস ডলার নিয়ে রওনা হয়েছিল। জামিলও একই কথা বলল। জামিল আর সহদেব তো ফিরদৌসের সঙ্গেই ছিল।’
‘ঠিক বলেছেন। ফিরদৌস বলেছিল ব্যাগের টাকাগুলো বটুক সামন্তকে দেবার পর সে ফাঁকা ব্যাগটা সহদেবকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। ব্যাগটা নিয়ে সহদেব আর জামিল হালিশহর ফিরে গিয়েছিল। জাহাঙ্গিরের কম্পানিতে ব্যাগটা এখনও টাকা বয়ে নিয়ে যাবার কাজে ব্যবহার করা হয়। কম্পানির ম্যানেজার তারক দাস যেদিন প্রথম সহদেবকে নিয়ে আমার কাছে আসে, সেদিন তার হাতে ব্যাগটা ছিল। তারক দাস আমাকে বলেছিল কিছু পেমেন্ট কলকাতা থেকে তার নেবার ছিল। সেগুলো নিয়ে সে ব্যাগে রেখেছে। তাই বডিগার্ড হিসেবে সহদেব তার সঙ্গে রয়েছে। ফিরদৌসের ব্যাগটা দেখে ওই ব্যাগটার কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফিরদৌসের ঘরে ঠিক ওই রকম আর একটা ব্যাগ কেন থাকবে বুঝতে পারছিলাম না। আপনার কথা শুনে এখন বুঝতে পারছি ফিরদৌসও একই রকম দেখতে একটা ব্যাগ কম্পানি থেকে পেয়েছিল।’
‘আমি কিন্তু একটা অন্য কথা ভাবছিলাম স্যার।’
আদিত্যর মনে হল, সোমেন মুখুটি দরকারি কিছু একটা বলার জন্য নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। আদিত্য তাকে উৎসাহিত করার জন্য বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন।’
‘আমি ভাবছিলাম স্যার, এমন কি হতে পারে ফিরদৌস তার নিজের ব্যাগে এক কোটি টাকা নিয়ে গাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল? পরে সুবিধে মতো সে কুড়ি লক্ষ ডলারের ব্যাগটার সঙ্গে এক কোটি টাকার ব্যাগটা বদলা বদলি করে দেয়। এবং বটুক সামন্তকে এক কোটির ব্যাগটা দিয়ে আসে। হয়তো বটুক সামন্তকে সে আগেই বলে রেখেছিল এক কোটি টাকা নিয়ে সে যাচ্ছে?’
‘এক্সেলেন্ট, সোমেনবাবু। এক্সেলেন্ট। আপনি যেটা বললেন সেটা খুবই সম্ভব। তবে আপনার থিয়োরিটা সাবস্ট্যানশিয়েট করার জন্য আর একটু প্রমাণ লাগবে।’
‘আমি তো প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্যে লেগে রয়েছি স্যার। যদি কিছু পাই আপনাকে জানাব।’
‘আচ্ছা, আপনি কি বটুক সামন্তর অফিসটা একবার দেখতে যাবেন? গেলে আমাকে একবার নিয়ে যাবেন প্লিজ।’
‘নিশ্চয় নিয়ে যাব স্যার। অ্যাডিশানাল কমিশানার আমাকে বলেছেন আপনি যেতে চান। আমি কাল পরশুর মধ্যে একদিন যাব। আপনাকে জানাব কবে যাচ্ছি। আজ বিকেলে অবশ্য আর একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। এই কুমুদিনীর ব্যাপারেই। আপনার যদি হাতে সময় থাকে আমার সঙ্গে আসবেন?’
‘কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন?’
‘রণপ্রিয় ঘোষাল। সবাই বলে রনি ঘোষাল। নিউ এজ মুভিস-এর প্রোডাকশান ম্যানেজার। ওই রোহিত ধামানির কম্পনিটা যারা কুমুদিনীর কাছ থেকে কুড়ি কোটি টাকা ধার চেয়েছিল। রোহিত ধামানি বিদেশে। তাই ওদের ম্যানেজারটাকে ধরলাম। সে যদি কিছু বলতে পারে। অনেক ধানাই পানাই করে সে আজ বিকেল সাড়ে চারটেতে সময় দিয়েছে। আপনি যাবেন?’
‘অবশ্যই যাব। আমি সোয়া চারটের মধ্যে লালবাজারে পৌঁছে যাচ্ছি। ওখান থেকে এক সঙ্গে রওনা হওয়া যাবে।’
‘ঠিক আছে স্যার। আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।’
রনি ঘোষালের বাড়ি টালিগঞ্জে। টালিগঞ্জের আনোয়ার শা রোড থেকে দক্ষিণ দিকে একটা গলি ঢুকে গেছে, তার মধ্যে। চারতলা বাড়ি, এক-একটা তলায় তিনটে করে ফ্ল্যাট। সাধারণ মধ্যবিত্তদের ফ্ল্যাট যেমন হয়। গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢোকার মুখে লেটার বক্স, ইলেকট্রিকের মিটার। এক কোণে ময়াল সাপের মতো পাকানো আলগা কেবল টিভির তার ডাঁই করে রাখা। কয়েকটা সাইকেলের সঙ্গে একটা স্কুটারও দাঁড় করানো রয়েছে। রনি ঘোষালের ফ্ল্যাটটা চারতলায়। লিফট নেই। সিঁড়িটা সরু। হতশ্রী। বোঝাই যায়, প্রত্যেক তলায় তিনটে করে ফ্ল্যাট বার করতে গিয়ে সিঁড়ির পরিসরে টান পড়েছে।
চারতলায় উঠতে গিয়ে আদিত্য ঈষৎ হাঁপিয়ে উঠছিল। সিগারেট। সোমেন মুখুটি কিন্তু বেশ ফিট। বেল বাজাতে মধ্যবয়স্কা পরিচারিকা দরজা খুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
‘আমরা লালবাজার থেকে এসেছি। রনি ঘোষাল এখানে থাকেন?’ সোমেন মুখুটি পুলিশি গলায় বলল।
‘দাদাবাবু চানে গেছেন। আমাকে বলেছেন আপনাদের বসাতে।’
আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। পৌনে পাঁচটা বাজে। এই অবেলায় কেউ চানে যায়?
পরিচারিকা বোধহয় আদিত্যর মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে। আদিত্যদের বাড়ির ভেতর নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘একটু আগে দাদাবাবু কাজ থেকে ফিরেছে। খাওয়া-দাওয়া কিচ্ছু হয়নি। এই চান করতে গেল।’
ভেতরে ঢুকেই একটা অগোছাল বসার ঘর। বেতের সোফা সেট। সোফার কোণে ধুলো জমেছে। সেন্টার টেবিলের ওপর ডাঁই করা পুরোনো খবর কাগজ, ম্যাগাজিন, ইংরেজি পেপারব্যাক। এক দিকে খাবার টেবিল। একটা ক্যাবিনেট কাম বুক কেস বসার জায়গা থেকে খাবার টেবিলটাকে খানিকটা আড়াল করে তাকে আংশিক আবরু দিয়েছে। সোফার ওপর বসতে বসতে আদিত্য লক্ষ করল খাবার টেবিলের ওপর রনি ঘোষালের মধ্যাহ্ন ভোজন ঢাকা দেওয়া রয়েছে।
আদিত্য বুক কেসের বইগুলোর ওপর চোখ বোলাচ্ছিল। বইগুলো সেভাবে সাজানো নেই। ইংরেজি বেস্ট-সেলারের পাশে মোটা অ্যাকাউন্টেন্সির বই। গীতবিতান। শারদীয় বাংলা সিনেমা পত্রিকা। সোমেন মুখুটি টেবিলের ওপর থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে পাতা ওল্টাচ্ছে।
ওরা কেউই টের পায়নি কখন রনি ঘোষাল নিঃশব্দে শোবার ঘর থেকে বসার ঘরে এসে ঢুকেছে। ‘আপনাদের বসিয়ে রাখার জন্য সত্যিই খুব লজ্জিত। সকালে কাজে এমন আটকে গেলাম, ফিরতে খুব দেরি হয়ে গেল।’ রনি ঘোষালের গলাটা আন্তরিক শোনাল। গলার আওয়াজটা বেশ গমগমে।
আদিত্য দেখল বছর তিরিশের এক যুবক। তার মাথার চুল ভেজা, বোঝা যায় সদ্য স্নান সেরে এসেছে। পরনে পাজামা, গাঢ় নীল ফতুয়া-পাঞ্জাবি। শ্যামলা গায়ের রঙ, লম্বা হাড়ালো শরীর। তার মুখের আদলে সুমনা ঘোষালের মুখাবয়বের স্পষ্ট ছাপ আছে। রনি ঘোষাল মাতৃমুখী সন্তান।
‘ইনি ইন্সপেক্টর সোমেন মুখুটি। লালবাজার থেকে এসেছেন। আমি ওঁর সঙ্গে এসেছি। আমার নাম আদিত্য মজুমদার। পেশায় আমি একজন’
‘আমি আপনার কথা জানি আদিত্যবাবু। আপনি কে আমাকে বলতে হবে না। আপনি যে কুমুদিনীর কেসটা ইনভেস্টিগেট করছেন সেটাও আমার মা আমাকে বলেছে। আর ইন্সপেক্টার মুখুটির সঙ্গে আমার তো ফোনেই কয়েকবার কথা হয়েছে। আপনারা বসুন। চা খান। আমাকে যদি অনুমতি দেন আমি তাহলে খুব তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিতে পারি। সেই সকাল থেকে ঘুরছি। কিচ্ছু খাওয়া হয়নি।’ রনি ঘোষালের শেষের কথাগুলো খুব কুণ্ঠিত শোনাল।
সোমেন মুখুটি কিছু বলার আগেই আদিত্য দরাজ গলায় বলল, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনি খেয়ে নিন। আমরা বসছি।’
রনি ঘোষাল খেতে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চা এসে গেছে। নিশ্চয় এর প্রস্তুতিপর্ব আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।
‘সন্ধ্যাদি, ভাত তুলে নাও। এই অবেলায় এত ভাত খেলে শরীর ঢিসঢিস করবে।’
‘কিচ্ছু ঢিসঢিস করবে না। ওই কটা তো ভাত। খেয়ে নাও।’ অন্তরাল থেকে সন্ধ্যাদির গলা শোনা গেল।
‘তাড়াতাড়ি তুলে নাও। নইলে খাওয়া শুরু করতে পারছি না। এঁরা বসে আছেন। তাড়াতাড়ি করো।’
‘খাবার গরম আছে তো? তুমি চান করতে ঢোকার সময় গরম করেছি।’ সন্ধ্যাদি ভাত তুলতে এসে জিজ্ঞেস করল।
আদিত্য লুকিয়ে টেবিলের ওপর দৃষ্টি দেবার লোভ সামলাতে পারল না। দেখল, প্লেটে ভাতের সঙ্গে দুটি বেগুন ভাজা, আলুভাতের ওপর কাঁচা লঙ্কা গাঁথা। পাশে একটা বাটিতে ডাল, আর একটাতে পুরুষ্টু কাতলার পেটি একটা ডুমো করে কাটা আলুকে সঙ্গে নিয়ে কালচে ঝোলের ভেতর থেকে উঁকি মারছে। মন্দ কী? আদিত্য ভাবল, তার নিজের এত ভাল খাওয়া জোটে না।
কিছু পরে যখন রনি খাওয়া শেষ করে আদিত্যদের সঙ্গে এসে বসেছে, সোমেন মুখুটি জিজ্ঞেস করল, ‘আজ সকালে কোথায় গিয়েছিলেন?’
‘একটা লোকেশনের খোঁজে। কাকদ্বীপের কাছে। শুটিং-এর ডেট ঠিক হয়ে গেছে অথচ লোকেশন ঠিক হয়নি। বহু কষ্টে হিরো-হিরোইনের ডেট পাওয়া গেছে। লোকেশন পাচ্ছি না বলে সেটা যদি পিছিয়ে দিতে হয়, তাহলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। তাছাড়া প্রোডাকশানেরও বড় ক্ষতি।’
‘লোকেশন ঠিক হল?’ সোমেন মুখুটিই প্রশ্ন করছে।
‘মোটামুটি ঠিক হয়েছে। আসলে গঙ্গার ধারে একটা ডান্স সিকোয়েন্স তোলা হবে। ডিরেক্টর লোকেশনটা দেখবেন, কোরিওগ্রাফার দেখবেন। তাঁরা অ্যাপ্রূভ করলে তবে ফাইনাল হবে। আমার অবশ্য মনে হয় লোকেশনটা বেশ ভাল, অ্যাপ্রূভ হয়ে যাবে।’
‘এটা কি আপনাদের সেই ফেরারি বলে ছবিটার শুটিং?’ এবার আদিত্য প্রশ্ন করল।
‘বাঃ। আপনি তো অনেক খবর রাখেন। হ্যাঁ, এটা সেই ছবিটাই।’
‘এই ছবিটার শুটিং বিদেশে হবার কথা ছিল না? আলাস্কা না কোথায় যেন?’
‘হ্যাঁ। আলাস্কার টনগ্যাস ন্যাশানাল ফরেস্ট-এ। প্রডিউসারের টাকা নেই বলে সেই প্ল্যানটা বাতিল করা হয়েছে। ফলে ছবির গল্পটাও পালটে দিতে হয়েছে। গল্প পালটালে বোধহয় ছবির নামটাও বদলাতে হবে। অবশ্য এর আগে ছবির একটা পার্ট ইয়োরোপে শুটিং হয়ে গেছে।’
‘ফেরারি নাম আর থাকবে না?’ আদিত্য নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘গল্প বদলে গেলে কী করে আর থাকবে? ফেরারির দু-টো মানে ছিল। একটা হল ফেরারি গাড়ি। আর একটা ফেরারি মানে ফিউজিটিভ। প্রথমে ভাবা হয়েছিল ছবিটাতে দু-টো মানেই অ্যাপ্লিকেবল হবে। হিরো ফেরারি গাড়ি চেপে আলাস্কার জঙ্গলে ফেরারি হয়ে যাবে। হাসবেন না, আদিত্যবাবু। আমাদের দর্শকরা এসব খুব খায়। তাছাড়া অল্প খরচে আলাস্কা দেখার সুযোগও কেউ ছাড়ত না। এখন পয়সার অভাবে সব ঘেঁটে গেল।’
‘হঠাৎ পয়সার অভাব ঘটল কেন?’ সোমেন মুখুটি প্রশ্ন করল।
‘দেখুন আমি তো সবটা জানি না। আমি এই কম্পানিতে চাকরি করি মাত্র। তবে যেটুকু শুনেছি বলতে পারি।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি সেইটুকুই বলুন না।’ আদিত্য ব্যগ্রভাবে বলল।
‘জানেন তো আমাদের কম্পানির মালিক ধামানি সাহেবের আসল ব্যবসা হিরের। আনকাট হিরে কিনে উনি দেশে সেটা কাটিয়ে অ্যামস্টারড্যাম-এর হিরের বাজারে বিক্রি করেন। শুনেছি কোনও কারণে সেই ব্যবসায় ওঁর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তাই তিনি এখন সিনেমায় টাকা ঢালতে পারছেন না।’
‘আচ্ছা, কুমুদিনীর কাছ থেকে আপনাদের কুড়ি কোটি টাকা ধার নেবার কথা ছিল না?’ সোমেন মুখুটি সরাসরি রনির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
রনি কিছুক্ষণ উত্তর দিল না। তারপর খানিকটা দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, ‘দেখুন, এই ধার-টার নেবার ব্যাপারগুলো হাই লেভেল পলিসি ডিসিশান। এগুলো আমাদের কম্পানির বড় কর্তা ধামানি সাহেব ঠিক করেন। আমি এসব ব্যাপারে কী করে জানব?’
‘আপনি এ-ব্যাপারে কিছু শোনেননি?’ সোমেন মুখুটি আবার জিজ্ঞেস করল।
‘কিছু ভাসা ভাসা গুজব শুনেছিলাম।’
‘কী শুনেছিলেন?’
‘শুনেছিলাম, আলাস্কায় শুটিং হলে অনেক টাকার দরকার পড়বে। তখন কিছু টাকা কুমুদিনী থেকে ধার নেওয়া হবে।’
‘কুমুদিনীর থেকে ধার নিয়ে তো এখনও আলাস্কায় শুটিং হতে পারে।’ আদিত্য মন্তব্য করল।
‘না আদিত্যবাবু। পুরোটা ধার নিয়ে একটা এত বড় প্রোডাকশান চলতে পারে না। কিছু টাকা প্রোডিউসারকে ঢালতেই হয়। প্রোডিউসার নিজে কিছু ইনভেস্ট না করলে ফাইন্যান্সারই বা টাকা ধার দেবে কেন?’
‘আপনাদের কম্পানির মালিক রোহিত ধামানি এখন কোথায়?’ সোমেন মুখুটি জিজ্ঞেস করল।
‘শুনেছি ব্যবসা সামলানোর জন্যে ইয়োরোপের কোথাও আছেন। আমি ঠিক বলতে পারব না।’
‘আচ্ছা, এমন কি হতে পারে, কুমুদিনীর কাছ থেকে কুড়ি কোটি ধার নিয়ে ধামানি সাহেব সেই টাকাটা ব্যবসা পুনরুদ্ধারের কাজে লাগিয়েছেন? অর্থাৎ টাকাটা ধামানি সাহেব কুমুদিনীর কাছ থেকে পেয়ে গেছেন?’ সোমেন জেরা করে যাচ্ছে।
‘এটাও আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ওই যে বললাম, এসব হাই লেভেলের ডিসিশান। আমি নেহাতই চুনোপুঁটি। তাছাড়া ধামানি সাহেব তাঁর হিরের ব্যবসার জন্য যদি টাকা ধার করেন সেটা আমি কী করে জানব? হিরের ব্যবসাটা তো অন্য একটা কম্পানির নামে।’
‘আর একটা প্রশ্ন। যদি ধামানি সাহেব ফেরারি ছবির জন্যে কুমুদিনীর কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন, তাহলে কি সেটা ডলারে নিতেন?’
‘ডলারে?’ রনি ঘোষালকে কিছুটা হতভম্ভ দেখাচ্ছে। ‘ডলারে কেন?’
‘কারণ অ্যামেরিকায় গিয়ে আপনাদের তো ডলারই খরচ করতে হত।’
রনি ঘোষাল কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘বলতে পারব না। এই ফাইন্যান্সিয়াল অ্যারেঞ্জমেন্টগুলো সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই নেই। আমি শুধু প্রোডাকশানের দিকটা দেখি।’
‘আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই। আদিত্যবাবু, আপনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন?’ সোমেন মুখুটি সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসল।
‘কিছুদিন আগে স্টুডিও পাড়ায় গুজব রটেছিল যে আপনি কাউকে কিছু না বলে বেপাত্তা হয়ে গেছেন আর সেই জন্যে ‘ফেরারি’ ছবির শুটিং বন্ধ রয়েছে। গুজবটা কি সত্যি?’ আদিত্য খানিকটা আক্রমণের ভঙ্গীতে প্রশ্নটা করল।
প্রশ্নটা শুনে রনি ঘোষাল একটু থতমত খেয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘দেখুন, ‘ফেরারি’ ছবির শুটিং কিছুদিন বন্ধ ছিল এটা সত্যি। কিন্তু সেটা আমি কাউকে কিছু না বলে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলাম বলে নয়। শুটিং বন্ধ ছিল টাকার অভাবে। আমি যখন দেখলাম শুটিং হচ্ছে না তখন বসকে বলে কিছুদিন ছুটি নিয়েছিলাম। দিল্লিতে আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজ ছিল। যে হোটেলে আমি আগে কাজ করতাম সেখানে কিছু টাকা-পয়সা পাওনা ছিল। সেই টাকা উদ্ধার করতে আমি ছুটি নিয়ে কয়েক দিনের জন্য দিল্লি গিয়েছিলাম।’ রনি ঘোষাল উত্তর শেষ করে পরবর্তী প্রশ্নের জন্যে আদিত্যর দিকে তাকাল।
আদিত্য বলল, ‘আমার দু-একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন আছে। উত্তর দিতে ইচ্ছে না করলে দেবেন না।’
রনি ঘোষালের মুখে সামান্য চিন্তার ছায়া পড়েছে।
‘এই বাড়িটা কি আপনার নিজের? নাকি ভাড়া?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘এই বাড়িটা আমার মা সুমনা ঘোষালের। মা নিজে এখানে থাকে না। আমাকে থাকতে দিয়েছে।’
‘আপনার মা কবে কিনেছিলেন এই বাড়িটা?’
‘অনেক দিন আগে। বোধহয় আমার জন্মের বছর সাত-আট আগে। মা তখনও অভিনেত্রী হিসেবে ততটা নাম করতে পারেনি। টালিগঞ্জের কাছে একটা বাসস্থানের দরকার হয়ে পড়েছিল। তখন মা অল্প দামে এই বাড়িটা কেনে। বোধহয় দিদিমারও কিছু টাকা ছিল।’
‘আপনার মা এই বাড়িতে কতদিন বসবাস করেছেন?’
‘খুব অল্প দিন। এই বাড়িতে উঠে আসার কিছুদিনের মধ্যেই মার সাকসেস শুরু হয়। এই বাড়িতে থাকাটা মার স্টেটাসের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। মা নিউ আলিপুরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে উঠে যায়।’
‘আপনার ছোটবেলাটা কোথায় কেটেছিল?’
‘খুব ছোটবেলায় মার সঙ্গে থাকতাম। তারপর হস্টেলে হস্টেলে বড় হয়েছি।’
‘এই বাড়িটায় আপনি কবে থেকে আছেন?’
‘কলেজ জীবন অব্দি হস্টেলে থেকেছি। বি কম পাশ করার পর মা এম বি এ পড়াল। কলকাতায় নয়, ব্যাঙ্গালোরে। তারপর কিছুদিন নয়ডায় চাকরি করলাম। মাইনে ভাল নয়, তার ওপর প্রচণ্ড খাটনি। আর পেরে উঠছিলাম না। মার সঙ্গে ধামানি সাহেবের বহুদিনের পরিচয়। ধামানি সাহেবকে বলে মা নিউ এজ মুভিজ-এ একটা চাকরি জোগাড় করে দিল। তখন থেকেই এই বাড়িতে আছি। বাড়িটা বহুদিন ফাঁকা পড়েছিল। এখানে প্রায় ছবছর হতে চলল আমার।’
‘মা আর দিদিমা ছাড়া আপনার আর কোনও আত্মীয় নেই?’
রনি ঘোষালের চোয়াল শক্ত হল। মুখে কাঠিন্যের ছায়া পড়ল। সে থেমে থেমে বলল, ‘আপনি যদি আমার পিতৃ-পরিচয় জানতে চান সেটা আমি আপনাকে জানাতে পারব না। কারণ আমি নিজেই সেটা জানি না। এ-ব্যাপারে মাকে অনেক জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পাইনি। মা ছাড়া আমার আর কোনও আত্মীয় নেই। দিদিমা বহুদিন হল মারা গেছে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রনি ঘোষাল ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘আপনাদের যদি প্রশ্ন করা হয়ে গিয়ে থাকে, দয়া করে আমাকে এবার অব্যাহতি দিন। সারাদিন খুব পরিশ্রম গেছে। একটু বিশ্রাম নিতে চাই।’
‘আমার প্রশ্ন যদি কোনওভাবে আপনাকে আঘাত করে থাকে আমি ক্ষমা চাইছি। আমি কিন্তু সত্যিই অত কিছু ভেবে প্রশ্নটা করিনি।’ সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে আদিত্য বলল।
রনি ঘোষালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আদিত্য খেয়াল করল সে ল্যাপটপটা আপিসে ফেলে এসেছে। তার মানে একবার আপিস হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সামনের গেটটা বন্ধ করে শ্যামল বাড়ি চলে গেলে মুশকিল। পেছনে একটা দরজা আছে। সেটা সাধারণত বন্ধ থাকে। আদিত্যর কাছে সেই দরজার একটা চাবি আছে বটে কিন্তু চাবিটা আপিসেই রয়ে গেছে। শ্যামলের অবশ্য সন্ধে আটটা অব্দি ডিউটি করার কথা। তার আগে আদিত্য নিশ্চয় পৌঁছে যাবে। কিন্তু শ্যামল মাঝে মাঝে আটটার অনেক আগেই কেটে পড়ে। আদিত্য শ্যামলকে ফোন করে বলল সে আটটার মধ্যে আপিসে পৌঁছচ্ছে। শ্যামল যেন তার আগে গেট বন্ধ করে চলে না যায়। সাবধানের মার নেই।
সাড়ে সাতটা নাগাদ আদিত্য চাবি খুলে তার আপিসে ঢুকতে যাবে হঠাৎ তার নজরে এল এক কোনায় একজন লোক চাদর দিয়ে মুখের অনেকটা ঢেকে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। লোকটা আদিত্যকে দেখে উঠে দাঁড়াল। আদিত্য তার দিকে তাকাতে সে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি গোবিন্দ, কুমুদিনীর গোবিন্দ রায়। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।’
‘আপনার তো সকাল এগারোটায় আসার কথা ছিল। আমি সাড়ে বারোটা অব্দি আপনার জন্য অপেক্ষা করলাম। সকালে এলেন না কেন?’
‘ভেতরে গিয়ে বলছি। আপনি অফিসের দরজাটা তাড়াতাড়ি খুলুন প্লিজ।’ বলতে বলতে লোকটা সিঁড়ির দিকে তাকাল। কেউ উঠে আসছে কিনা দেখার জন্যে। আদিত্যর মনে হল লোকটা ভয় পেয়েছে।
‘আসুন।’ আদিত্য দরজা খুলে আপিসের ভেতরে ঢুকল। পেছন পেছন লোকটা।
‘বসুন।’ ঘরের আলো জ্বালিয়ে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে আদিত্য বলল। ‘এবার বলুন কী ব্যাপার।’
লোকটা চেয়ারে বসেছে। আদিত্য আগে খেয়াল করেনি, লোকটার পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক ছিল। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা আজকাল যেমন পিঠে ব্যাগ নেয়। লোকটা তার ব্যাগটাকে পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। এতক্ষণ পরে আদিত্য লোকটাকে ভাল করে দেখার সুযোগ পেয়েছে। তামাটে রঙ, তোবড়ানো গাল, পাকানো চেহারা। গালে দু-তিন দিনের না কামানো দাড়ি। চোখে ধূর্ত সতর্কতার সঙ্গে কিঞ্চিৎ উদ্বেগ মিশেছে।
আদিত্য সিগারেটের প্যাকেট বার করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিল। লোকটার সিগারেটটা ধরিয়ে দিয়ে নিজেও একটা ধরাল। আদিত্য চাইছে লোকটা নিজের থেকে কথা বলতে শুরু করুক।
লোকটার মধ্যমা ও তর্জনীর মধ্যে ধরা সিগারেটটা সামান্য কাঁপছে। খানিকক্ষণ নীরবে ধূমপান করার পর লোকটা বলল, ‘এক গ্লাস জল হবে?’
আদিত্য উঠে গিয়ে বোতল থেকে এক গ্লাস জল ভরে লোকটাকে দিতেই সে ঢকঢক করে এক ঢোঁকে জলটা খেয়ে ফেলল। আর ঠিক তখনই দরজায় খটখট শব্দ। লোকটা চমকে উঠেছে। কাতর গলায় বলল, ‘একটু দেখে খুলবেন, প্লিজ।’
আদিত্য দরজা খুলে দেখে শ্যামল। ‘আমি তাহলে বাড়ি যাচ্ছি? সামনের গেটটা বন্ধ করে দিলাম। আপনি পেছনের গেটটা দিয়ে বেরিয়ে দরজাটা টেনে দেবেন।’
গোবিন্দ রায়ের দিকে শ্যামলের নজর পড়ল। ‘দেখা হয়েছে তাহলে?’ সে গোবিন্দ রায়ের দিকে তাকিয়ে বলল। তারপর শ্যামলকে বলল, ‘এই ভদ্রলোক আপনার খোঁজ করছিলেন। তার একটু আগে আপনি ফোন করে বললেন আপনি আসছেন তাই একে দাঁড়াতে বললাম।’ কথাগুলো বলে শ্যামল চলে গেল।
আদিত্য চেয়ারে ফিরে এসে গোবিন্দ রায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার বলতে শুরু করুন। রাত্তির হয়ে যাচ্ছে।’
‘ঠিক কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। আমি খুব ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছি। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় ফিরদৌসের যে অবস্থা হয়েছে, আমারও সেটা হতে পারে।’
‘মানে আপনি ভয় পাচ্ছেন কেউ আপনাকে খুন করতে পারে?’ আদিত্য সরাসরি জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। ঠিক যেভাবে ফিরদৌস খুন হয়েছে।’
‘ফিরদৌস কেন খুন হল? আপনাকেই বা কেউ খুন করতে চাইবে কেন?’
‘ফিরদৌস যে কারণে খুন হয়েছে, আমার ভয় আমিও হয়তো সেই কারণেই খুন হব।’
‘কারণটা কী?’
‘কারণটা আমি এখানে বসে আপনাকে বলতে পারব না।’
‘যদি না বলতে পারেন তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?’
‘আপনার কাছে একটা কারণেই এসেছি, আদিত্যবাবু। আমি জানি পুলিশের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা খুব ভাল। আপনি বলে দিলে পুলিশ আমাকে প্রোটেকশন দিতে পারে। আমার অনেক কিছু বলার আছে। পুলিশ যদি আমাকে প্রোটেকশন দেয় তাহলে আমি পুলিশকে সব বলব।’
ব্যাপারটা আদিত্যর বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল। সে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি যদি পুলিশকে সব কথা বলতে চান তাহলে তো সরাসরি পুলিশের কাছেই যেতে পারেন। আমি এর মধ্যে আসছি কোথায়?’
‘আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। দেখুন পুলিশের মধ্যে অনেক ঘুণ আছে। কুমুদিনীতে এত বছর কাজ করতে করতে এটা আমি জেনে গেছি। আমি যদি নিজে সরাসরি পুলিশের কাছে যাই তাহলে হয়তো আমি যেটা পুলিশকে বলব সেটা ঠিক জায়গায় পৌঁছবেই না। উলটে আমারই প্রাণ সংশয় হবে। তাই আপনার মাধ্যমে আমি একেবারে পুলিশের ওপরমহলে পৌঁছতে চাইছি। সকলেই জানে অ্যাডিশানাল কমিশানার গৌতম দাশগুপ্ত আপনার বন্ধু। এটাও সকলে জানে যে অ্যাডিশানাল কমিশানার সাহেবের সততা নিয়ে কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত। তাই আমি আপনার কাছে এসেছি। খুন হয়ে যাবার কয়েক ঘণ্টা আগে ফিরদৌস আমাকে ফোন করেছিল। ও খুব জোর দিয়ে আপনার কথা বলেছিল। আপনার ফোন নম্বরটাও ওর কাছ থেকে পেয়েছি।’
গোবিন্দ রায় থামল। সম্মতির আশায় আদিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘আপনাকে হ্যাঁ-না বলার আগে কয়েকটা প্রশ্ন করব। প্রথম কথা, সুদর্শন শিকদার বলে যে ইন্সপেক্টার কুমুদিনীর কেসটা দেখছিলেন, তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন অন্য একজন পুলিশ অফিসার কেসটা ইনভেস্টিগেট করছেন। এই রদবদলটা গৌতমের নির্দেশেই হয়েছে। আপনি কি এটা জানেন?’
‘না আমি এটা জানতাম না। এটা খুব ভাল হল।’ গোবিন্দ রায়ের মুখটা খানিকটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
‘তাহলেও কি আপনি সরাসরি পুলিশের কাছে যেতে ভয় পাবেন?’
গোবিন্দ রায় কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘যে ইনফর্মেশনটা আমি দিতে চাই সেটা খুবই গোপনীয়। যদি একেবারে খোদ বড়কর্তাকে খবরটা দিতে পারি তাহলেই ভাল হয়। একটা ফোকর বন্ধ হয়েছে বলে পুলিশের মধ্যে সব ফাঁক-ফোকর বন্ধ হয়ে গেছে এমন তো নয়।’
‘ঠিক আছে। বুঝতে পারলাম। আচ্ছা, আপনি যে ইনফর্মেশনটা দিতে চান সেটার সঙ্গে কি ওই কুড়ি লক্ষ ইউ এস ডলারের কোনও সম্পর্ক আছে?’
গোবিন্দ রায় খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘আছে। গভীর সম্পর্ক আছে। কিন্তু তার থেকে বেশি আমি এখন বলতে পারব না।’
‘একটা জিনিস বলুন। বটুক সামন্ত বলছে, ফিরদৌস ওকে এক কোটি টাকা পৌঁছে দিয়েছিল। কুড়ি লক্ষ ডলার নয়। আবার ফিরদৌস বলছে এক কোটি টাকা নয়, পুরো কুড়ি লক্ষ ডলারই ও বটুক সামন্তর হাতে তুলে দিয়েছে। কে সত্যি বলছে, আপনার মনে হয়?’
গোবিন্দ রায় আবার অনেকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘কে সত্যি বলছে আমি বলতে পারব না। ফিরদৌস আমাকে বলেছিল সে কুড়ি লক্ষ ডলারই পৌঁছে দিয়ে এসেছে। সেটা সত্যি কিনা আমি জানি না। তবে কুমুদিনীতে এক কোটি টাকা এসেছিল। কে এনেছিল বলতে পারব না। কিন্তু টাকাটা কোথায় গেছে সেটা আন্দাজ করতে পারি।’
‘এক কোটি টাকা কোথায় গেছে সেটা বলতে কি আপনার অসুবিধে আছে?’
‘স্বাভাবিক অবস্থায় বলতাম না। কিন্তু এখন আপনার কথার উত্তর না দিলে আপনিও আমার অনুরোধ রাখবেন না। তাই আমি যতটুকু জানি, বলছি। আমার তারিখ মনে থাকে না। তবে ঘটনাটা ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে ঘটেছিল। কুমুদিনীর কাজে আমাকে অনেক সময় নর্থ বেঙ্গলে ঘুরতে হয়। সেদিন আমি কলকাতায় এসেছিলাম। অফিসে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। আমি বটুকবাবুর সঙ্গে কথা বলছি এমন সময় বটুকবাবুর সেক্রেটারি শৌভিক নন্দ ঘরে ঢুকে বলল, পিটার অরোরা এসেছে। বলে রাখি, পিটার অরোরার নাইটক্লাবে কুমুদিনীর কিছু ইনভেস্টমেন্ট আছে। পিটারকে ঘরে ঢুকতে দেখে বটুকবাবু আমাকে বলল, তুমি একটু বাইরে গিয়ে বোসো। আমি পিটারের সঙ্গে কথাটা সেরে নিয়ে তোমাকে ডাকছি। পিটারের হাতে একটা নীল ব্যাগ ছিল।’
‘নীল ব্যাগ? কী রকম নীল ব্যাগ?’
‘বড় নীল ব্যাগ। ওই রকম অনেকগুলো ব্যাগ গত বড়দিনে কম্পানি কিনেছিল। ক্লায়েন্টদের গিফট দিয়েছিল। আমরাও কেউ কেউ পেয়েছিলাম। পিটারও নিশ্চয় গিফট হিসেবে কুমুদিনীর কাছ থেকে ব্যাগটা পেয়েছিল।’
‘ব্যাগটা কি খালি ছিল? না ভর্তি?’
‘জানি না। চেন টানা ছিল।’
‘তারপর কী হল বলুন। আপনি বাইরে গিয়ে কোথায় বসলেন?’
‘কুমুদিনীর আপিসে আমার একটা বসার জায়গা আছে। কিন্তু আমি সেখানে না বসে শৌভিকের সামনের চেয়ারটাতে বসলাম। কয়েক দিন কলকাতায় ছিলাম না। ভাবলাম, শৌভিকের কাছ থেকে কলকাতার খবরাখবর জানা যাবে।’
‘তারপর?’
‘একথা সেকথার পর শৌভিককে জিজ্ঞেস করলাম পিটার অরোরা কী করতে এসেছে? শৌভিক বলল, জান তো পিটার ওর নাইট ক্লাবের ভেতরে একটা ইল্লিগাল গ্যাম্বলিং জয়েন্ট চালায়। আমি বললাম, সে তো অনেক দিন ধরেই চালাচ্ছে। শৌভিক বলল, সেখানে এতদিন চাকতি দিয়ে জুয়ো খেলা হতো। রোজ ক্লাব খোলার পর টাকা দিয়ে চাকতি কেনো, তাই দিয়ে জুয়ো খেল, তারপর ক্লাব বন্ধ হবার সময় যে চাকতিগুলো সঙ্গে রয়েছে সেগুলো কাউন্টারে ভাঙিয়ে নাও। এই ছিল সিস্টেম। কিছুদিন আগে তাই নিয়ে গোলমাল হয়েছে। কিছু লোক নাকি জাল চাকতি, মানে যেটা পিটারের ক্লাবের নয়, সেসব ভাঙাবার চেষ্টা করেছিল। সেই থেকে জুয়ো খেলা বন্ধ। শুনলাম, আবার নাকি গ্যাম্বলিং শুরু হবে। তবে এবার চাকতি দিয়ে নয়। নগদ টাকা দিয়ে। বটুকবাবু পিটারকে পাঁচশোর নোটে এক কোটি টাকা জোগাড় করে দিচ্ছেন। আমার মনে হয় সেটা নিতেই পিটার এসেছে। দেখলে না হাতে বড় ব্যাগ। একটু পরে দেখলাম ব্যাগ নিয়ে পিটার বেরিয়ে গেল। ব্যাগের ভারে একদিকে ঝুঁকে হাঁটছে।’
‘যখন পিটার ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল তখন কি ঝুঁকে হাঁটছিল?’
‘না তখন সোজাই হাঁটছিল।’
‘তার মানে তখন ব্যাগটা ফাঁকাই ছিল।’
‘তখন অত ভেবে দেখিনি। এখন তো তাই মনে হচ্ছে।’
‘অন্য একটা প্রশ্ন। আপনি সকালে এলেন না কেন?’
‘আমি ঠিক সময়েই এসে যেতাম। আপনাদের গেট দিয়ে ঢোকার আগে উল্টো ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে নজর রাখছিলাম। লক্ষ করলাম একজন পুলিশের খোচড় গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকতে গেলেই ধরবে। আমি আস্তে আস্তে ফিরে গেলাম। ভাবলাম, পুলিশ জানল কী করে ঠিক এগারোটা নাগাদ আমি এখানে আসব? তারপর একটু ভাবতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। পুলিশ নিশ্চয় ফিরদৌসের কলার লিস্ট চেক করে আমার নম্বরটা পেয়েছে। নম্বরটা পুলিশ ট্যাপ করেছে। আপনার সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হয়েছে সবই পুলিশ জানে। তাই আমাকে ধরার জন্য লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমি আমার মোবাইলটা সঙ্গে সঙ্গে অফ করে দিলাম।’
আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে আটটা বেজে গেছে। সে আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘ঠিক আছে গোবিন্দবাবু। আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার কথা অ্যাডিশানাল কমিশানার সাহেবকে বলব। আশা করছি তিনি আপনার সঙ্গে শিগগির দেখা করবেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?’
‘আমি শেয়ালদা স্টেশনের উল্টোদিকে একটা হোটেলে আছি। আমার হোটেলের ঘরের ফোন নম্বরটা এই কাগজে লেখা আছে।’ গোবিন্দ রায় পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করে আদিত্যর দিকে এগিয়ে দিল। ‘আমি সারাদিন হোটেলেই থাকব। আপনার ফোনের অপেক্ষায়।’
‘একটা খবর আপনি নিশ্চয় জানেন।’ আদিত্য গোবিন্দ রায়কে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল। ‘পল্লবী ভদ্র বলে যে মেয়েটি পিটার অরোরার নাইটক্লাবে কাজ করত সে খুন হয়েছে। তার বাড়িতে ডাকাতিও হয়েছে। আপনি মেয়েটিকে চিনতেন?’
গোবিন্দ রায় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার মুখে নানারকম অভিব্যক্তি খেলে যাচ্ছে আতঙ্ক, বিস্ময়, সন্দেহ, অবিশ্বাস। প্রায় মিনিট খানেক পরে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে সে বলল, ‘পল্লবী ভদ্রকে আমি ভালই চিনতাম। তার বয়ফ্রেন্ডকেও চিনতাম। দু-জনে মাঝে মাঝে কুমুদিনীর আপিসে আসত। পরে বোধহয় ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তখন পল্লবী একাই পিটারের কাগজপত্র নিয়ে কুমুদিনীর আপিসে আসত। পিটার মেয়েটাকে খুব বিশ্বাস করত। কিন্তু সে খুন হয়েছে! কী করে হল? আর আমি খবরটাই জানতাম না!’ গোবিন্দ নিজের মনেই বিড়বিড় করছে।
‘আপনি টিভি দেখেন না? টিভিতে খবরটা তো বারবার দেখিয়েছে।’
‘আমি গত এক সপ্তাহ টিভি দেখিনি। যেখানে এই এক সপ্তাহ লুকিয়ে ছিলাম সেখানে টিভি ছিল না। কবে এটা হল?’
‘খুন এবং ডাকাতির ঘটনাটা ঘটেছে বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু বাড়িতে আর কেউ ছিল না বলে অনেক পরে ব্যাপারটা পুলিশ জানতে পেরেছে।’
‘কেউ ধরা পড়েছে?’
‘আমি যতদূর জানি এখন অব্দি কেউ ধরা পড়েনি।’
কথা বলতে বলতে দুজন বাড়ির পেছন দিকের দরজায় পৌঁছে গিয়েছিল। গোবিন্দ রায়কে এখনও খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।
‘চললাম। আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।’ রাস্তায় নেমে গোবিন্দ রায় বলল। তারপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বউবাজার স্ট্রিটের ভিড়ে মিলিয়ে গেল সে।
বাড়ি পৌঁছে আদিত্য গৌতমকে ফোন করেছিল। তার মনে হচ্ছিল গোবিন্দ রায়ের ব্যাপারটা ফেলে রাখা ঠিক হবে না। ফোন করতে গৌতম জানাল সে মুম্বাইতে। একদিনের জন্য কনফারেন্স করতে গেছে। আগামীকাল ভোরের ফ্লাইটে ফিরবে। গৌতম বলল, আগামীকাল বিকেল চারটের আগে সে গোবিন্দ রায়কে সময় দিতে পারছে না। চারটের সময় আদিত্য যেন গোবিন্দ রায়কে নিয়ে লালবাজারে চলে আসে। সেই রাত্তিরেই গোবিন্দর হোটেলের নম্বরে ফোন করে গৌতমের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট-এর ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছিল আদিত্য। গোবিন্দ বলেছে সে নিজেই পৌনে চারটা নাগাদ লালবাজারের মেন গেটে চলে আসবে।
পরের দিন বেলা এগারোটা নাগাদ আদিত্য সবে আপিসে পৌঁছে কেটলিতে কফির জল বসিয়েছে এমন সময় দরজায় প্রবল করাঘাত। নক নক নয়, দুম দুম করে কেউ দরজায় ঘা দিচ্ছে। আদিত্য দরজা খুলে অবাক। নূপুর মণ্ডল!
‘আদিত্যদা! তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে না জানিয়ে চলে এলাম! ভাল করিনি?’ নূপুর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে।
‘খুব ভাল করেছ। এবার ঠাণ্ডা হয়ে বোসো। কফি খাবে তো?’
‘তুমি বানালে নিশ্চয় খাব।’
নূপুরকে দেখে আদিত্যরও খুব ভাল লাগছে। চন্দ্রলেখা অন্তর্ধান-এর কেসটার সময় নূপুর তাকে খুব সাহায্য করেছিল। তারপর চাকরি নিয়ে নূপুর ব্যাঙ্গালোর চলে গেল। আদিত্যর সঙ্গে যোগাযোগটাও কমে এল। মেয়েটার ওপর আদিত্যর খুব মায়া পড়ে গিয়েছিল।
নূপুর আরও রোগা হয়েছে। তার রঙটা এমনিতেই চাপা, যেন আর একটু পুড়েছে।
‘রোগা হয়ে গেছ কেন? ব্যাঙ্গালোরে খাবার পাও না?’ আদিত্য কাপে কফির জল ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করল।
‘যে রাঁধুনিটাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম সে অনেক দিন হল পালিয়ে এসেছে। এখন একটা কন্নড় বউ রান্না করে। যেটা রান্না করে সেটা মুখে দেওয়া যায় না। যেমনি ঝাল, তেমনি টক। অফিসেও খুব খাটনি। সব মিলিয়ে ওখানে আর পোষাচ্ছিল না। তাই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরে এলাম।’
কথাটা বলে নূপুর মিটিমিটি হাসছে। মুখে একটা ‘কেমন দিলুম?’ ভাব। আদিত্যর আধ মিনিট লাগল খবরটা হজম করতে। হতভম্ব অবস্থাটা কাটিয়ে উঠে আদিত্য বলল, ‘চাকরি ছেড়ে চলে এলে? এখানে কিছু পেয়েছ?’
‘আর পরের গোলামি করব না আদিত্যদা। আমার দুজন ব্যাঙ্গালোরের রুম মেট আর আমি মিলে একটা কম্পানি খুলেছি। কনসাল্টেন্সি ফার্ম। নাম দিয়েছি ই-কিয়োর। ব্যাঙ্গালোরে বসেই দু-তিনটে কাজের বরাত পেয়েছি। সেক্টর ফাইভে একটা স্পেস ভাড়া করেছি। ওটাই আমাদের আপিস। ভাব কী আমাকে?’ নূপুর হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা ভিজিটিং কার্ড আদিত্যকে দিল।
‘কলকাতায় থাকছ কোথায়?’
‘বাগুইআটিতে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। তিনটে শোবার ঘর আছে। একটা বসার ঘর। তিনজনেই ওখানে থাকব। আমার বন্ধুরা দুজনেই আমার মতো মফস্বলের মেয়ে। একজনের বাড়ি মেদিনীপুর টাউনে। আর একজন মালদার। সেদিক থেকে আমাদের খুব মিল হয়েছে। এখন ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারলে হয়।’
‘বেশ, বেশ। খুব ভাল কথা। তবে জানো তো, ব্যবসা দাঁড় করাতে গেলে প্রথম দিকে খুব খাটতে হয়। তার জন্যে প্রস্তুত থেকো।’
‘খাটতে আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে কিনা আগে কাজ আসুক তার পরে তো খাটব। এখন যে কটা কাজ এসেছে সেগুলো আমার বন্ধুরাই সামলে দিচ্ছে। ওরা আমার সিনিয়ার, কাজের অভিজ্ঞতাও বেশি। তাই প্রথম কাজগুলো ওরাই করছে। তাতে কম্পানির সুনাম হবে।’
‘তাহলে তুমি এখন কী করছ? বাড়িতে বসে আরাম করছ?’
‘না, না। আরাম করব কী? ঘুরে ঘুরে কাজ জোগাড় করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া অফিসটা সাজানোর দায়িত্বও আমার। ফ্ল্যাটটাও।’
‘তাহলে তো তুমি এখন খুবই ব্যস্ত। আমি ভাবছিলাম, তোমার হাতে তেমন কোনও কাজ না থাকলে আমার একটা কাজ তোমাকে করে দিতে বলব। চন্দ্রার ব্যাপারটায় তুমি আমায় খুব সাহায্য করেছিলে।’ আদিত্য হালকা করে একটা প্রস্তাব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে।
‘আদিত্যদা, তুমি যদি আমাকে একটা চাকরি দাও তাহলে সব কাজ ছেড়ে আমি তোমার কাজটা করব। তোমার কাজে যে থ্রিল আছে, রুটিন কন্সাল্টিং-এর কাজে তার ছিটেফোঁটাও নেই। তুমি শুধু বল আমায় কী করতে হবে।’ নূপুরকে রীতিমতো উত্তেজিত দেখাচ্ছে।
‘দেখো নূপুর, তোমাকে পাকাপাকি কাজ দেবার ক্ষমতা আমার সত্যিই নেই। থাকলে তোমার মতো চালাক-চতুর মেয়েকে আমি কখনই ছাড়তাম না। আসল কথা হল, আমার নিজেরই রোজগারের ঠিক নেই। আমি কী করে একজনকে পাকাপাকিভাবে সহকারি হিসেবে রাখব? আমি ভাবছিলাম, যেহেতু তুমি এখন ফ্রিলান্স কন্সাল্টিং-এর কাজ করছ, তাই দরকার মতো আমিও তোমার সার্ভিসটা মাঝে মধ্যে পেতে পারি কিনা। অবশ্য আমি তোমার কাছ থেকে যে সার্ভিসটা চাইব সেটা, বলাই বাহুল্য, রুটিন কন্সাল্টিং নয়।’ আদিত্যর গলাটা কিছুটা রক্ষণাত্মক শোনাল।
নূপুর মাথা নিচু করে তার নিজের আঙুলগুলো নিয়ে খেলছে। আদিত্য জানে, তার মানে সে গভীরভাবে চিন্তা করছে। একটু পরে সে বলল, ‘তোমার কাজটা কতদিনের? কত ঘণ্টা লাগবে কাজটা করতে?’
‘কাজটা আর কিছু নয়। একজন অতীত দিনের অভিনেত্রীকে একটা সিনেমা পত্রিকার সাংবাদিক সেজে ইন্টারভিউ করতে হবে। অভিনেত্রীটি এখন রিটায়ার্ড। ধর, একটু লম্বা ইন্টারভিউ। এই ঘণ্টা দুয়েকের। তার আগে অবশ্য মহিলাটির সম্বন্ধে ভাল করে রিসার্চ করে নিতে হবে। সবার আগে, ইন্টারভিউ দেবার ব্যাপারে মহিলাকে রাজি করাতে হবে। পারবে করতে?’
‘এ আর এমন কী কাজ? নিশ্চয় পারব।’
‘কাজটা ওপর ওপর সহজই মনে হয়। কিন্তু আসলে ততটা সহজ নয়। ভদ্রমহিলার একটা গোলমেলে অতীত আছে। ইন্টারভিউ করতে করতে সেই অতীতটাকে টেনে বার করতে হবে। ভদ্রমহিলা খুব সহজে ওপেন আপ করবেন বলে মনে হয় না। এটা করানোর জন্যে তোমাকে একটু বুদ্ধি খরচ করে ভদ্রমহিলার মনস্তত্ত্বটাকে কাজে লাগাতে হবে। আমার মনে হয় তোমার সেই বুদ্ধিটা আছে। আমি ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে যতটুকু জানতে পেরেছি তোমাকে বলে দেব। অবশ্য তার কতটা সত্যি আর কতটা সিনেমা পত্রিকাগুলোর গসিপ আমি বলতে পারব না।’
‘কাজটা আমার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। আমি কাজটা করব। আমার এখন অন্য কাজের যা চাপ তাতে কাজটা করতে অসুবিধে হবে না। কাকে ইন্টারভিউ করতে হবে?’ নূপুরের গলায় উৎসাহ উপচে পড়ছে।
‘দাঁড়াও। তোমাকে কাজটা দেবার আগে আমার নিয়োগকর্তার কাছ থেকে একটা পারমিশান নিয়ে নিই। আফটার অল, তোমার পারিশ্রমিকটা তো তিনিই দেবেন।’ আদিত্য মোবাইলে নুসরতের নম্বরটা লাগাল।
‘নমস্কার আদিত্যবাবু। আপনার কাজ কেমন এগোচ্ছে?’ ওদিক থেকে শোনা গেল।
‘কাজ খানিকটা এগিয়েছে ম্যাডাম। তবে কিছু জট এখনও ছাড়াতে হবে। সাবিনা ম্যাডামের সঙ্গে কবে কথা বলা যাবে?’
‘সাবিনার সঙ্গে এখনই কথা বলা যেতে পারত। কিন্তু সমস্যা হল সাবিনা এখনও হালিশহরেই আছে। হালিশহরে এসে আমার স্বামীর চোখ এড়িয়ে সাবিনার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়। আপনি আর দু-তিন দিন অপেক্ষা করুন। সাবিনা কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় যাবে। তখন ওর সঙ্গে কথা বলাটা অনেক সেফ।’
আদিত্য খুব দ্রুত চিন্তা করছিল। জাহাঙ্গির খানকে তাহলে পুলিশ এখনও অ্যারেস্ট করেনি। গৌতম যে বলেছিল, পুলিশ শিগগিরই জাহাঙ্গিরকে অ্যারেস্ট করবে? ব্যাপারটা খোঁজ নিতে হবে। সে মুখে বলল, ‘ম্যাডাম, তদন্তের জন্যে আমার দুজন অ্যাসিস্টেন্ট লাগবে। পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা এক্সট্রা খরচ হবে। আপনার অ্যাপ্রূভাল চাই। পরে আপনাকে ডিটেলে হিসেব দেব।’
‘কোনও অসুবিধে নেই। আপনি অ্যাসিস্টেন্ট নিয়ে নিন।’
‘আমি জানতাম আপনি আপত্তি করবেন না। থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। সাবিনা কলকাতায় এলে আমাকে প্লিজ জানাবেন। ওর সঙ্গে কথা বলাটা খুব দরকার।’
আদিত্য ফোন রাখতেই নূপুর বলল, ‘আমি ছাড়া তোমার আরও অ্যাসিস্টেন্ট আছে নাকি, আদিত্যদা?’
‘আছে তো। বিমলকে তুমি বোধহয় দেখেছ। তাকে অন্য একটা কাজের ভার দিতে হবে।’
‘বিমল? ও হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে বিমল। কোথায় যেন সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে। খুব হুঁশিয়ার ছেলে। যাগগে, তুমি আমার কাজটা এবার বল।’
‘বসো বলছি। আর একটু কফি খাবে?’
‘না আদিত্যদা, আমি অতবার চা-কফি খেতে পারি না। তুমি খাও।’
আদিত্য আবার কফি বানাল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘তুমি বাংলা সিনেমা দেখ?’
‘না আদিত্যদা। আমি বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি কোনও সিনেমাই দেখি না। টানা দু-তিন ঘণ্টা সিনেমা হলে বসে থাকতে আমার খুব বোর লাগে। তার থেকে বরং মল বা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অনেক ইন্টারেস্টিং। কত অদ্ভুত অদ্ভুত মানুষ দেখা যায়।’
‘সিনেমা যখন দেখ না তখন তোমাকে একেবারে স্ক্র্যাচ থেকে শুরু করতে হবে। একদিক থেকে ভালই হল। ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে তোমার কোনও পূর্বনির্দিষ্ট ধারণা থাকবে না। যাকে ইন্টারভিউ করতে হবে তার নাম সুমনা ঘোষাল। যৌবনে দু-একটা ছবিতে হিরোইন হয়েছিলেন, তেমন সুবিধে করতে পারেননি। তারপর থেকে ক্যারেকটার আর্টিস্ট। কিছুদিন মুম্বাইতে থেকে হিন্দি সিরিয়াল করেছেন। কলকাতাতেও কিছু সিরিয়াল করেছেন। তবে আজকাল আর তেমন সুযোগ পান না। সুমনা ঘোষালের মা সুনয়নাও পেশাদার মঞ্চের অভিনেত্রী ছিলেন। তুমি তোমার ইন্টারভিউটা সুমনার মায়ের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করতে পার। সুমনার পিতৃ-পরিচয় ঈষৎ ঘোলাটে। মা-ই সুমনাকে বড় করেছেন। তাই মায়ের ব্যাপারে সুমনার একটা দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। সুমনার নিজের একটা ছেলে আছে। সেই ছেলেটির বাবার পরিচয় সুমনা প্রকাশ করে না। এই বিষয়ে যদি আর কিছু জানতে পার খুব ভাল হয়। আমি সুমনা সম্বন্ধে যেটুকু নোট করেছি তোমাকে স্ক্যান করে পাঠিয়ে দেব। তাছাড়াও তুমি দেখো আর কী তথ্য জোগাড় করতে পার। খুব ওয়েল-প্রিপেয়ার্ড হয়ে ইন্টারভিউটা নিতে যাবে। তোমাকে যেন অ্যামেচার বলে সন্দেহ না করে।’
‘আমি কোন পত্রিকার তরফ থেকে ইন্টারভিউটা নিতে যাব?’
‘নতুন কোনও পত্রিকা। যেটা এখনও বেরোয়নি। যেটার প্রথম ইসুতেই সুমনা ঘোষালের ইন্টারভিউটা বেরোবে। পত্রিকার একটা ভাল দেখে নাম ঠিক করে আমাকে জানিও। আমি দেখছি সুমনা ঘোষালের ফোন নম্বরটা জোগাড় করতে পারি কিনা।’
‘আমার কিন্তু একটু জানা দরকার কেন এই সুমনা ঘোষালের ব্যাপারে তুমি এত ইন্টারেস্টেড। নাহলে আমি ঠিক কী করছি বুঝতেই পারব না।’
‘একদম ঠিক কথা। আমি তোমাকে পুরো কেসটা খুলে বলছি। তোমার হাতে সময় আছে তো?’
আদিত্যর সঙ্গে কথা বলে নূপুর যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে। ফোনটা এল তার ঘণ্টা খানেক পরে। আদিত্য তখন লাঞ্চ শেষ করে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে।
‘আমি সাব ইন্সপেক্টার চাকি বলছি স্যার। আমাকে মনে আছে। সেদিন আপনাকে সিতারা হোটেলে নিয়ে গেলাম।’
‘খুব মনে আছে। বলুন কী ব্যাপার।’
‘সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়েছে স্যার। শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলে গোবিন্দ রায় বলে একজন খুন হয়েছে। মুখুটি স্যার বললেন, কুমুদিনীর গোবিন্দ রায়, আপনাকে বললেই আপনি বুঝতে পারবেন। মুখুটি স্যার ঘটনাস্থলে রওনা হয়ে গেছেন। আমাকে বলেছেন আপনাকে তুলে নিয়ে যেতে। আপনি এখন কোথায় আছেন স্যার?’
আদিত্য সত্যিই কথা বলতে পারছিল না। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার হল। কেউ তার কাছে আশ্রয় চাইল, স্বীকারোক্তি করল, অথচ আদিত্য তাকে বাঁচাতে পারল না। নিজেকে ঘেন্না করতে ইচ্ছে করছে। এই প্রফেশনে থাকার যোগ্যতা তার আছে কি?
চাকি বোধহয় ভাবছে ফোনটা কেটে গেল। সে ওপার থেকে ‘হ্যালো, হ্যালো’ করছে।
আদিত্য খুব কষ্ট করে বলল, ‘আমি আমার অফিসে আছি। বউবাজারের ওপর, বিনানি ম্যানশনে আমার অফিস। সেন্ট্রাল এভিনিউ বউবাজার স্ট্রিট মোড় থেকে দু-তিন মিনিট। বউবাজার তো ওয়ান-ওয়ে। আপনাকে সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর দিক থেকেই আসতে হবে। ওদিক থেকে এলে অফিসটা আপনার ডানদিকে পড়বে। আমি নিচে নেমে দাঁড়াচ্ছি। আপনি চলে আসুন।’
বৃষ্টির পরে অসম্ভব গরম পড়েছে। শুধু গরম নয়, তার সঙ্গে আর্দ্রতা। আদিত্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘেমে যাচ্ছিল। গলাটা শুকিয়ে আসছে। আদিত্য পাশের পানের দোকান থেকে একটা ঠান্ডা জলের বোতল কিনল। এক ঢোঁকে পুরো বোতলের জলটা খেয়ে শরীরটা ভারী লাগছিল। অথচ গলাটা আবার শুকিয়ে আসছে। আদিত্যর মনে হল, গরমের জন্যে নয়, গোবিন্দ রায়ের খুনের খবরটা পাবার পর থেকে তার ভেতরে যে তোলপাড়টা চলেছে, এটা তারই ফল। তবু সে আরেক বোতল জল কিনে রাখল। দোকানিকে পয়সা দিতে দিতে দেখল একটা পুলিশের জিপ রাস্তার ডান পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আদিত্য হাত তুলে তার উপস্থিতি জানাল।
হোটেলটা বড় রাস্তার ওপরে, শেয়ালদা ফ্লাইওভারের দক্ষিণ দিকে। প্রাচী সিনেমার ফুটপাথ ধরে মৌলালি মোড়ের উদ্দেশে খানিকটা এগিয়ে গেলে ডানহাতে ক্রিক রো বলে রাস্তাটা যেখান থেকে শুরু হয়েছে, হোটেলটা প্রায় সেখানে। হোটেলের নাম ক্রিক ভিউ। রাস্তার নামে হোটেলের নাম। যদিও রাস্তাটা একটা ক্রিক বা ছোট নদীর মতো এঁকেবেঁকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার অব্দি চলে গেছে, দৃষ্টির মধ্যে খাল, বিল, জলাশয়, নদী, নালা কিছুই নেই। অর্থাৎ ক্রিক ভিউ মানে ক্রিক রো নামক রাস্তাটার দৃশ্য। কেউ চাইলে হোটেলের জানলা থেকে প্রাণ ভরে ক্রিক রো-র কর্মব্যস্ত পূর্ব প্রান্তটা দেখতে পারে।
আসলে কিন্তু ক্রিক রো নামটার সঙ্গে একটা ছোট্ট নদীর ইতিহাস সত্যি সত্যিই জড়িয়ে আছে। আঠেরো শতকেও এই অঞ্চলে একটা ছোট নদী ছিল। সেই সময় সল্ট লেক উপনগরীর লবণ হ্রদ বিস্তৃত ছিল শেয়ালদা-বউবাজারের মোড় অব্দি। সন্দেহ নেই, শেয়ালদা বা শিয়ালদহ-র দহ কথাটা লবণ হ্রদ থেকেই এসেছে। ছোট নদীটা শেয়ালদা-বউবাজার অঞ্চলের লবণ হ্রদ থেকে পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করে ভাগীরথী নদী অব্দি বয়ে যেত। সাহেবদের পুরোনো ম্যাপে এর উল্লেখ আছে। আন্দাজ করা যায়, সেই নদীটা থেকেই ক্রিক রো নামের উৎপত্তি। নদীটা নাব্য ছিল। একটা সময় যখন পুরোনো কলকাতা নিয়ে আদিত্যর খুব উৎসাহ হয়েছিল তখন সে পড়েছিল, ১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দের প্রবল ঝড়ে এই নদীতে অনেক নৌকোর সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গা থেকে নোঙর ছিঁড়ে ছিটকে আসা একটা জাহাজও ডুবে যায়। অনেকে মনে করেন, সেই ঝড়ের ফলে নদীটাতে যেসব আবর্জনা জমেছিল সেগুলোই আস্তে আস্তে নদীর নাব্যতাটাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। কালের নিয়মে নদীটা মজে যাবার পর তার ওপর দিয়ে কলকাতা শহর তার শরীর বিছিয়ে দিয়েছে।
ক্রিক ভিউ হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে আদিত্যর অনেক দিন আগে পড়া এইসব পুরোনো ইতিহাস মনে পড়ে যাচ্ছিল। হোটেলের সামনে পুলিশ পাহারা। কিছু কর্মহীন কৌতূহলী মানুষ রাস্তায় ভিড় করে হোটেলের ভেতর উঁকি মারছে। চাকিকে দেখে কর্মরত কনস্টেবলটি সেলাম করে পথ ছেড়ে দিল। কনস্টেবলটিকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল চারতলার যে ঘরে খুনটা হয়েছে ইন্সপেক্টর মুখুটি সেখানে রয়েছেন। আদিত্যর মনে পড়ে গেল, ফিরদৌসও আর একটা হোটেলের চারতলাতেই খুন হয়েছিল। এটা অবশ্য সমাপতন হতেই পারে।
হোটেলটা সম্পন্ন মধ্যবিত্তদের জন্যে। লিফট আছে, একতলায় রিসেপশনের চেহারাটাও চটকদার, উল্টোদিকের ডাইনিং হলটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, যুগের নিয়ম অনুযায়ী আলো-আঁধারি। আদিত্য অনুমান করল, কাজে-কর্মে যারা শেয়ালদা স্টেশন হয়ে কলকাতায় আসে, তারাই ক্রিক ভিউ-এর মূল খদ্দের। সম্ভবত এদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী। আবার দূরবর্তী জেলা কিংবা রাজ্য থেকে কলকাতায় বেড়াতে আসা দু-চারটে দলও আদিত্যর চোখে পড়ল। তারা ডাইনিং হলে খেতে বসেছে। হোটেলে যে এতবড় একটা কাণ্ড ঘটে গেছে তারা জানে বলে মনে হল না।
লিফটে উঠে চারতলার কোণার দিকে একটা ঘরে ঘটনাটা ঘটেছে। ঘরটা খুব বড় নয়। আদিত্য ঘরে ঢুকে দেখল, একটা খাট, দেয়ালের সঙ্গে লাগানো ড্রেসিং টেবিল, একটা ডেস্ক ও চেয়ার, দেয়ালে লাগানো এসি মেশিন। মেশিনটা চলছে। ঘরটা নিশ্চয় হোটেলের পেছন দিকে। ঘরে একটাই জানলা। সেটা খোলা রয়েছে। জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায় না, কেবল পাশের বাড়ির একটা উঠোন চোখে পড়ে। উঠোনটা ফাঁকা।
মৃতদেহটা মেঝেতে, কার্পেটের ওপর শোয়ানো ছিল। মৃতের মুখে যন্ত্রণার কোনও ছাপ নেই। শুধু তার বুকের বাঁ দিকে গেরুয়া হাফ-হাতা পাঞ্জাবির ওপর এক ধাবড়া রক্ত। শরীরে আর কোথাও ক্ষতের চিহ্ন নেই। বোঝা যায়, একটাই গুলি মৃতের বুকের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে হার্টটাকে ফুটো করে দিয়েছে এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু হয়েছে তার। খুনি পেশাদার, গোবিন্দ রায়কে মারার জন্য তাকে একটার বেশি গুলি খরচ করতে হয়নি।
পুলিশের ফটোগ্রাফার ছবি তোলার তোড়জোড় করছিল। তার পেছনে সোমেন মুখুটি চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
‘আসুন স্যার। কেসটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।’ সোমেন মুখুটি আদিত্যকে দেখে বলল।
‘মৃতদেহটা কে আবিষ্কার করল?’
‘হাউসকিপিং-এর লোক। দুপুরবেলা গোবিন্দ রায়ের ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রথমে সে নক করে। কোনও উত্তর না পেয়ে ধরে নেয় ঘরে কেউ নেই। তখন সে নিজের স্মার্টকার্ড দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢোকে। ঢুকে দ্যাখে গোবিন্দ রায় জানলার কাছে মরে পড়ে আছে।’
‘কখন ঘটনাটা ঘটেছে কিছু আন্দাজ পেয়েছেন?’
‘পুলিশের ডাক্তারবাবু এসেছিলেন। একটু আগে চলে গেলেন। উনি বললেন, রাফলি ঘন্টা চারেক আগে খুনটা হয়েছে। তার মানে ধরুন এই সাড়ে দশটা এগারোটা নাগাদ।’
‘অর্থাৎ দিন-দুপুরে খুন। কেউ কি গুলির কোনও শব্দ শুনেছে?’
‘হোটেলের কর্মচারীরা কেউই কিছু শুনেছে বলে মনে করতে পারছে না। এমনিতেই এই জায়গাটায় খুব হট্টগোল। তাছাড়া ঘরটাও একটেরে। আশেপাশের ঘরগুলোতেও এখন কেউ নেই। তার ওপর খুনি হয়তো তার বন্দুকে সাইলেন্সার বা সাপ্রেসার ব্যবহার করেছিল। তাতে গুলির শব্দটা খানিকটা কমে যাবার কথা।’
‘হুঁ। রিসেপশনে এসে কেউ কি গোবিন্দ রায়ের খোঁজ করেছিল?’ আদিত্য চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল।
‘আমি রিসেপশনের মেয়েটিকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিলাম। না। কেউই গোবিন্দ রায়ের খোঁজ করেনি। তবে মেয়েটি বলল, সকালের ভিড়ের মধ্যে কেউ রিসেপশনের সামনে দিয়ে গিয়ে লিফটে উঠে চারতলায় গোবিন্দ রায়ের ঘরে পৌঁছে গেলে সে টের পাবে না। ওই সময়ে বহু বাইরের লোক রিসেপশনের উল্টোদিকের রেস্টোরেন্টটাতে খেতে আসে, তাই রিসেপশনের জায়গাটায় খুব ভিড় হয়।’
‘কিন্তু তার মানে খুনি আগে থেকেই জানত গোবিন্দ রায় কোন ঘরে রয়েছে। কে তাকে জানাল? গোবিন্দ নিজে ছাড়া আর কে জানাবে?’ আদিত্য বিড়বিড় করে বলল।
‘তাহলে কি স্যার ধরে নেব খুনি গোবিন্দ রায়ের চেনা লোক? গোবিন্দ রায় নিজেই তাকে দরজা খুলে নিজের ঘরে ঢুকিয়েছে?’ সোমেন মুখুটি প্রশ্ন করল।
‘সেই রকমই তো মনে হচ্ছে। ফিরদৌসের ক্ষেত্রেও মনে হয় তাই হয়েছিল।’ আদিত্য কিছুটা অন্যমনস্কভাবে বলল।
পুলিশের ফটোগ্রাফার নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি নিচ্ছে। আদিত্য বলল, ‘আপনারা কি হোটেলের অন্য বোর্ডারদের জানিয়েছেন এখানে একটা খুন হয়ে গেছে?’
‘এখনও জানাইনি। ফিরদৌসের বার তো পুরো তলাটাই সিল করে দিয়েছিলাম। কোনও লাভ হয়নি। তাই এবার ধীরেসুস্থে এগোচ্ছি।’
আদিত্য ঘরের চারদিকটা বারবার তাকিয়ে দেখছিল। কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি আছে, সে ধরতে পারছে না। হঠাৎ অসঙ্গতিটা সে বুঝতে পারল। সে সোমেন মুখুটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা যখন এই ঘরে ঢুকলেন তখন কি ঘরটা ঠিক এই রকমই ছিল?’
সোমেন বোধহয় প্রশ্নটার গুরুত্বটা ঠিক ধরতে পারেনি। সে একটু দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, ‘এই রকমই তো ছিল। শুধু মৃতদেহটা জানলার সামনে পড়েছিল, আমরা সেটাকে সরিয়ে এনে বিছানার পাশে রেখেছি।’
‘তার মানে আপনারা ঘরে ঢুকে দেখলেন জানলাটা খোলা?’
‘তাই তো দেখলাম।’ আদিত্যর চিন্তাটা কোনদিকে এগোচ্ছে সোমেন মুখুটি এখনও ধরতে পারেনি।
‘একই সঙ্গে দেখলেন এসিটা চলছে। তাই তো?’
‘হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম।’ সোমেন মুখুটি একটু থতমত খেয়ে গেছে। যেন এবার ভাসা ভাসা বুঝতে পারছে আদিত্যর অস্বস্তিটা কোথায়।
‘এই গরমে এসি চালানোটা স্বাভাবিক। কিন্তু এসি চালিয়েও গোবিন্দ রায় জানলাটা খুলে রেখেছিল। এটা আপনাদের অস্বাভাবিক মনে হল না?’
‘আপনি বলতে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনি কীভাবে এটার ব্যাখ্যা করছেন?’ সোমেন কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গীতে বলল।
আদিত্য চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর ধীরে ধীরে জানলাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, খুনি দরজা দিয়ে নয়, এই জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। নাহলে খোলা এসির সঙ্গে খোলা জানলাটা কিছুতেই মেলাতে পারছি না।’
‘কিন্তু গোবিন্দ রায় নিশ্চয় খুনি ঢুকবে বলে জানলাটা খুলে রাখেনি? জানলাটা খোলা ছিল কেন?’ সোমেন প্রশ্ন করল।
‘জানলাটা বন্ধই ছিল। আমার ধারণা, খুনি বাইরের প্যারাপেট দিয়ে জানলার কাছে এসে একটা পাতলা লোহার স্কেল বা ওই ধরনের কিছু ঢুকিয়ে বাইরে থেকে জানলাটা খুলে ফেলেছিল। গাড়ি চোরেরা যেমন করে গাড়ির লক খোলে। সম্ভবত গোবিন্দ রায় তখন তাকে দেখতে পায়, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুনি জানলার বাইরে থেকে তাকে গুলি করে। গোবিন্দ পড়ে যাবার পর জানলা দিয়ে খুনি ঘরের ভেতরে ঢোকে। নাহলে জানলাটা এতটা খোলা থাকত না। এই সব কিছু সম্ভব হয়েছিল কারণ এই ঘরটা হোটেলের পেছন দিকে। এই দিকটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না।’
‘খুনি ঘরে ঢুকল কেন? খুন করার পর প্যারাপেট দিয়েই তো পালিয়ে যেতে পারত।’
‘আমার বিশ্বাস গোবিন্দ রায়ের কাছে এমন একটা কিছু ছিল যেটা নেবার জন্য খুনিকে ঘরে ঢুকতে হয়েছিল। বস্তুত ওই জিনিসটা পাবার জন্যেই খুনি গোবিন্দকে খুন করেছে। জিনিসটা সম্ভবত একটা কালো রঙের ব্যাকপ্যাকে ছিল। একটা কালো ব্যাকপ্যাক ঘরে পাওয়া গেছে কি?’
‘কালো ব্যাকপ্যাক? কই না তো। গোবিন্দর লাগেজ বলতে শুধু এই সুটকেসটা পাওয়া গেছে।’ আয়নার নিচে রাখা একটা লাল সুটকেসের দিকে সোমেন আঙুল তুলে দেখাল। ‘কিন্তু গোবিন্দ রায়ের একটা কালো ব্যাকপ্যাক ছিল আপনি জানলেন কী করে?’
‘নিজের চোখে আমি ব্যাকপ্যাকটা দেখেছি। গতকাল সন্ধেবেলা গোবিন্দ রায় যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তখন ব্যাকপ্যাকটা তার সঙ্গে ছিল।’
‘গতকাল সন্ধেবেলা গোবিন্দ রায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল!’ সোমেন মুখুটি হতভম্ভ হয়ে গেছে।
‘হ্যাঁ। পুলিশকে তার কিছু একটা জানানোর ছিল। বলল, কথাটা গোপনীয়। কিন্তু সেই গোপন কথাটা সে আমাকে বলতে চায়নি। আমার কাছে এসেছিল যাতে পুলিশের অ্যাডিশানাল কমিশানারের সঙ্গে আমি তার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে পারি। সে জানত গৌতম দাশগুপ্তর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে। কথাটা সে সরাসরি গৌতমকেই বলতে চেয়েছিল। আজ বিকেল চারটের সময় গৌতমের কাছে গোবিন্দ রায়কে নিয়ে যাবার কথা।’
সোমেন মুখুটি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। আদিত্যর কথাগুলো সে হজম করার চেষ্টা করছে। দীর্ঘ নীরবতার পর সে বলল, ‘আপনার সঙ্গে যখন গোবিন্দ দেখা করতে এসেছিল তখন তার সঙ্গে একটা ব্যাকপ্যাক ছিল?’
‘ছিল। আমার ঘরে বসে ব্যাগটা সে নিজের পায়ের কাছে নামিয়ে রেখেছিল। আমার সঙ্গে যখন গোবিন্দ রায় দেখা করতে এসেছিল তখন তার চোখে আমি মৃত্যুভয় দেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, সে যেন কোনও অদৃশ্য আততায়ীর হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা করার আগে কিছুদিন সে প্রত্যন্ত কোনও জায়গায় লুকিয়েও ছিল। এখন কথা হচ্ছে, মানুষ যখন লুকিয়ে থাকছে বা পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখন সে চেষ্টা করবে যথাসম্ভব ঝাড়া হাত পা থাকার। অকারণে একটা ব্যাগ নিয়ে সে ঘুরতে চাইবে না। পালিয়ে বেড়ানোর অবস্থাতেও যখন ওই ব্যাগটাকে গোবিন্দ রায় কাছ ছাড়া করেনি, তখন ধরে নিতে হবে ব্যাগটায় মহা মূল্যবান কিছু ছিল। আর এখন যেহেতু দেখা যাচ্ছে ব্যাগটা উধাও হয়ে গেছে, এটা মনে করা স্বাভাবিক যে ওই ব্যাগটার জন্যেই গোবিন্দ রায় খুন হয়েছে। গোবিন্দ রায়কে খুন করে খুনি ব্যাগটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে।’
সোমেন মুখুটি কথা বলছে না। খুব গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। পুলিশের ফটোগ্রাফার আরও কিছু ছবি তুলে বিদায় নিল। ঘরে আদিত্য এবং সোমেন ছাড়া আর একজন পুলিশ অফিসার।
আদিত্য বলল, ‘মনে হচ্ছে, প্যারাপেটের ওপর দাঁড়িয়ে, জানলাটা অল্প ফাঁক করে খুনি গোবিন্দ রায়কে গুলি করেছিল। তারপর জানলা খুলে সে ঘরের ভেতরে ঢুকেছিল। কালো ব্যাকপ্যাকটা হাতিয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল। তার মানে খুনি যে শুধু গোবিন্দ রায়ের ঘরের নম্বরটাই জানত তাই নয়, গোবিন্দর ঘরে যে মহা মূল্যবান জিনিসটা আছে তার খবরও রাখত। শুধু যাবার সময় তাড়াহুড়োতে সে জানলাটা খোলা রেখে যায়।’
‘এমন কি হতে পারে ব্যাকপ্যাকে উধাও হয়ে যাওয়া কুড়ি লক্ষ ডলার ছিল?’ সোমেন জিজ্ঞেস করল।
‘কিছুটা থাকতে পারে, পুরোটা নয়। কুড়ি হাজার একশ ডলারের নোট ওইটুকু একটা ব্যাকপ্যাকে আঁটবে না। কুড়ি হাজার একশ ডলারের নোট আঁটাতে গেলে একটা বড় ব্যাগ দরকার। যেরকম ব্যাগ আমরা ফিরদৌসের হোটেলের ঘরে পেয়েছিলাম। তাছাড়া কুড়ি হাজার একশ ডলার নোটের ভার পিঠে নিয়ে হাঁটতে গেলে একটা মানুষকে যতটা ঝুঁকে হাঁটতে হবে, গতকাল সন্ধেবেলা গোবিন্দ রায়কে সে রকম ভাবে হাঁটতে দেখিনি। সে নিশ্চয় টাকাগুলো হোটেলে রেখে পিঠে শূন্য ব্যাগ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। চলুন একটু বাইরে গিয়ে দেখি খুনি কোনখান দিয়ে প্যারাপেটে নেমেছিল।’ আদিত্য দরজার উদ্দেশে হাঁটা লাগাল।
‘একটা খুনের জায়গায় বাড়তি ব্যাগ। থাকার দরকার ছিল না কিন্তু আছে। আর একটা খুনের জায়গায় একটা ব্যাকপ্যাক থাকার কথা কিন্তু নেই।’ আদিত্য হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল।
করিডোরটা খুব বড় নয়। এক প্রান্তে গোবিন্দ রায়ের ঘর। তার দুদিকে দুটো অতিথি-কক্ষ যেগুলো সোমেন মুখুটির কথা অনুযায়ী ফাঁকা রয়েছে। তারপর একটা ঘর যার দরজার ওপর লেখা, ‘স্টোররুম’। স্টোররুমের দরজাটা খোলা রয়েছে।
‘এই দরজাটা কি সব সময় খোলা থাকে?’ আদিত্য সোমেনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি ঠিক বলতে পারব না স্যার। বরং এখানকার কোনও স্টাফকে জিজ্ঞেস করা যাক।’
সোমেনের সঙ্গী পুলিশ অফিসারটি নিচে গিয়ে এক শীর্ণকায়, মাঝবয়সী ভদ্রলোককে ধরে আনল।
‘নমস্কার স্যার। আমি হাউসকিপিং সুপারভাইজার শশীকান্ত সরকার। আপনাদের কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?’ শীর্ণকায় ভদ্রলোক সোমেন মুখুটির দিকে তাকিয়ে দুহাত জড়ো করে নমস্কার করলেন।
‘এই স্টোররুমের দরজাটা কি সব সময় খোলা থাকে?’ সোমেন মুখুটির গলায় পুলিশি ধমক।
‘চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে না স্যার। সকাল ছটায় সুইপার এসে দরজা খুলে ঘরটা পরিষ্কার করে। তখন থেকে ওটা খোলাই থাকে। তারপর রাত্তির আটটায় সিকিউরিটি এসে স্টোররুমটা বন্ধ করে দিয়ে যায়। সারা রাত্তির ওটা বন্ধই থাকে।’
‘কারা ঢোকে এই স্টোররুমে? আদিত্য প্রশ্ন করল।
‘মেনলি হাউসকিপিং স্টাফরা ঢোকে। এই ঘরে কাচা চাদর-তোয়ালে, কম্বল, বালিশ এইসব থাকে। গেস্টদের বাথরুমে রাখার সাবান-শ্যাম্পুও থাকে। এখান থেকে জিনিসপত্র কার্ট-এ তুলে হাউসকিপিং স্টাফরা গেস্টরুমগুলো ক্লিন করে। চাদর-তোয়ালে বদলে দেয়, সাবান-শ্যাম্পু রিপ্লেস করে দেয়। আসুন না, ভেতরটা দেখবেন।’
শশীকান্ত সরকারের সঙ্গে সকলেই স্টোররুমের ভেতরে ঢুকল। এক দিকে সারি সারি র্যাকে চাদর-তোয়ালে, কম্বল, বালিশ ইত্যাদি সাজানো রয়েছে। অন্য দিকে সাবান-শ্যাম্পু-চিরুনি-টুথপেস্ট। ঘরে একটাই জানলা। জানলাটা খোলা রয়েছে। গোবিন্দ রায়ের ঘরের জানলার মতো এই জানলাতেও কোনও গরাদ নেই।
‘শশীকান্তবাবু, এই জানলাটা কি সব সময় খোলা থাকে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘না তো। বরং সব সময়েই জানলাটা বন্ধ রাখা হয়। এটা কে খুলল বুঝতে পারছি না।’ শশীকান্ত সরকারকে খানিকটা উদভ্রান্ত দেখাল।
আদিত্য জানলার কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকাল। জানলা দিয়ে বাইরে নামলেই প্যারাপেট। যে কেউ প্যারাপেট দিয়ে হাঁটতে পারবে না। কিন্তু একজন পেশাদার খুনি অনায়াসে জানলা দিয়ে নেমে প্যারাপেট ধরে হেঁটে গোবিন্দ রায়ের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।
আদিত্য ঘরের ভেতর দৃষ্টি দিয়ে বলল, ‘সোমেনবাবু দেখে যান। কীভাবে এই জানলা দিয়ে নেমে খুনি গোবিন্দ রায়ের ঘরের জানলা অব্দি পৌঁছে গিয়েছিল।’
একটু পরে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসার সময় আদিত্য সোমেন মুখুটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি সিতারা হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজগুলো দেখবার সময় পেয়েছিলেন?’
‘সত্যি বলতে কি ফুটেজগুলো এখনও ভাল করে দেখার সময় পাইনি স্যার। এটা আমার একটা ল্যাপ্স হয়ে গেছে। ভেরি সরি। আমি ফুটেজগুলো দেখে নিয়েই আপনাকে জানাব।’
‘না, না। ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনার এত কাজ। তার মধ্যে একটা দু-টো মিস হয়ে যেতেই তো পারে। আপনি ফুটেজটা দেখে নিয়ে আমাকে জানালেই হবে।’ আদিত্য ঈষৎ কুণ্ঠিতভাবে বলল।
তারপর আদিত্য একটু থেমে বলল, ‘এই ক্রিক ভিউ হোটেল থেকেও সম্ভবত একটা সিসি ফুটেজ আপনি পাবেন। আমার মনে হয়, দুটো ফুটেজকে মিলিয়ে দেখলে হয়ত দরকারি কোনও তথ্য পাওয়া যেতেও পারে।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন