কুমুদিনী বিত্ত নিগম রহস্য – সপ্তম পরিচ্ছেদ

অভিরূপ সরকার

সপ্তম পরিচ্ছেদ

কয়েকটা দিন শুয়ে-বসেই কেটে গেল। তার মানে যে আলস্যে কেটে গেল তা নয়। শুয়ে-বসে মানে এই কয়েকটা দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপিস ছাড়া আদিত্য আর কোথাও যায়নি। ঘরে শুয়ে কড়িকাঠ গুনতে গুনতে কিংবা আপিসে বসে জানলা দিয়ে বউবাজারের জনস্রোত দেখতে দেখতে সে অনবরত চিন্তা করে যাচ্ছিল। একটা গল্প চোখের সামনে ভেসে উঠেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। ভগবান যদি তাকে আর একটু মনঃসংযোগের ক্ষমতা দিতেন, আর একটু বুদ্ধি দিতেন, তা হলে ভেঙে যাওয়া টুকরোগুলো জুড়ে জুড়ে সে আরও তাড়াতাড়ি গল্পটা তৈরি করে ফেলতে পারত। এই কটা দিন সিগারেট খাওয়া খুব বেড়ে গেছে, বুকের বাঁ দিকে কখনও কখনও একটা চিনচিনে ব্যথা হয়, তবু আদিত্য সিগারেট কমাতে পারছে না। সে মনকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছে, কুমুদিনীর রহস্যটা ভেদ করে সে সিগারেট খাওয়া একেবারে ছেড়ে দেবে। সে যে কুমুদিনীর রহস্যটা ভেদ করতে পারবে এটা নিয়ে তার কোনও সংশয় নেই। কত তাড়াতাড়ি পারবে সেটাই প্রশ্ন। তার মন বলছে, যত দেরি হবে তত আরও প্রাণক্ষয় হবার সম্ভাবনা বাড়বে।

এইভাবে চার দিন কেটে যাবার পর সোমেন মুখুটির ফোন এল। আদিত্য তখন সবে আপিসে ঢুকেছে।

‘স্যার, ফিরদৌসের বিরুদ্ধে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রমাণ পাওয়া গেছে। আপনাকে না জানিয়ে পারছি না।’ সোমেনের গলায় চাপা উত্তেজনা।

‘আচ্ছা? কী প্রমাণ পেলেন?’ আদিত্য গলায় উৎসাহ এনে বলল।

‘ফিরদৌসকে যে দুজন বডিগার্ড হালিশহর থেকে কলকাতা যাবার পথে সঙ্গ দিয়েছিল তারা দুজনেই বলল রাস্তায় একবার তারা থামতে বাধ্য হয়েছিল।’

‘সহদেব আর জামিল একথা বলল?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই দুজন।’

‘তারপর?’

‘আমি দুজনকে আলাদা আলাদা করে জেরা করেছিলাম। দু-জনেই বলল, টাকা নিয়ে কলকাতা যাবার পথে ব্যারাকপুর পৌঁছনোর একটু আগে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ওপর রাস্তার একেবারে মাঝখানে একটা লরি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। লরিটা না সরলে ফিরদৌসদের গাড়িটার পক্ষে এগোনো সম্ভব ছিল না। লরির ড্রাইভার নেমে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিল, যদি কোনও সাহায্য পাওয়া যায়। যদি লরিটাকে ঠেলে রাস্তার এক পাশে করে দেওয়া যায় যাতে রাস্তার ওপর দিয়ে অন্য গাড়ি যাতায়াত করতে পারে। মাল বোঝাই লরি। পাঁচ-ছজন জোয়ান লোক মিলে না ঠেললে তাকে নড়ানো যেত না। তাই গাড়ি থেকে ড্রাইভার ছাড়াও সহদেব এবং জামিল দুজনেই নেমে পড়ে হাত লাগায়। ওরা তিনজন ছাড়াও লরির ড্রাইভার এবং দুজন খালাসি সব মিলিয়ে ছ-জন মিলে অতি কষ্টে লরিটাকে রাস্তার এক ধারে দাঁড় করায়। লরিটা সরাতে প্রায় পাঁচ মিনিট সময় লেগে যায়। এই সময়টা ফিরদৌস টাকার ব্যাগটা নিয়ে একেবারে একলা গাড়িতে বসেছিল।’

‘এই সময় কী ঘটেছিল বলে আপনার মনে হয়?’

‘আমার অনুমান, এই সময় ফিরদৌসের দলের কোনও লোক ধানখেতের দিক থেকে উঠে এসে ফিরদৌসের টাকার ব্যাগটা বদলে দিয়েছিল। কুড়ি লক্ষ ডলার ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে তার বদলে এক কোটি টাকার একটা ব্যাগ সে ফিরদৌসের পায়ের কাছে রেখে দিয়েছিল।

‘চমৎকার। চমৎকার।’ আদিত্য বলে উঠল।

 ‘মনে রাখতে হবে, ঠিক এক রকম দেখতে একটা নীল রঙের ব্যাগ ফিরদৌসেরও ছিল। সেটাতে পাঁচশো টাকার নোটে এক কোটি টাকা আগেই ভরা ছিল।’ সোমেনের গলায় উৎসাহ ঝরে পড়ছে।

‘একটা প্রশ্ন। বটুক সামন্ত কুড়ি কোটির বদলে এক কোটি টাকা পেয়ে আপত্তি করেনি কেন? সে তো কুড়ি কোটি টাকা বা কুড়ি লক্ষ ডলার এক্সপেক্ট করছিল।’

‘আমি জাহাঙ্গির খানকে খুব ভাল করে জেরা করেছি। জাহাঙ্গির বলেছে, তার সামনে বটুকবাবুর সেক্রেটারি শৌভিক নন্দকে ফোন করে ফিরদৌস বলেছিল, বটুকবাবুকে বলে দিতে সে কথা মতো টাকা নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে। কত টাকা নিয়ে যাচ্ছে বলেনি। সম্ভবত, ফিরদৌস তার আগের রাত্তিরে বটুকবাবুকে ফোন করে বলে রেখেছিল সে এক কোটি টাকা নিয়ে পৌঁছে যাবে।’

‘ব্রিলিয়ান্ট! অ্যাবসোলিউটলি ব্রিলিয়ান্ট!’ আদিত্য আবার বলে উঠল।

‘এই টাকা চুরির অ্যাঙ্গল থেকে দেখলে ফিরদৌসের খুনেরও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। টাকাটার জন্যেই ফিরদৌসকে ফিরদৌসের কোনও অ্যাসোসিয়েট খুন করেছিল। টাকাটা ফিরদৌসের কাছে ওই নীল ব্যাগটাতে ছিল যেটা আমরা ফিরদৌসের হোটেলের ঘরে পেয়েছি। টাকাটা নিয়ে খুনি ফাঁকা ব্যাগটা ফেলে রেখে চম্পট দেয়।’

‘আর গোবিন্দ রায়? সে কেন খুন হল?’

‘আমার মনে হয় গোবিন্দও ফিরদৌসের দলে ছিল। কিন্তু কোনও কারণে গোবিন্দ পুলিশকে সব কথা বলে দিতে চেয়েছিল। তাই তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

‘আপনার বিশেষ কাউকে সন্দেহ হয়? যে এই খুনগুলো করছে?’

‘শুধু সন্দেহ নয় আমার স্থির বিশ্বাস একজনই এই খুনের পেছনে আছে।’ সোমেনের গলাটা বেশ আত্মপ্রত্যয়ী শোনাল। ‘সে আর কেউ নয়, কুমুদিনীর তিন নম্বর এজেন্ট শিবেন মাইতি। পুলিশ এখনও তার কোনও হদিশ করতে পারেনি।’

‘আপনার অনুমান নির্ভুল হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। আপনি তো কেসটা চোদ্দো আনা সলভ করেই ফেলেছেন। কনগ্র্যাচুলেশনস।’ আদিত্যর গলাটা আন্তরিক শোনাল।

‘ছকটা মোটামুটি ধরতে পেরেছি। কুমুদিনীর তিনজন এজেন্ট মিলে প্ল্যান করে টাকাটা সরিয়েছিল। তার মধ্যে একজন, যার নাম শিবেন মাইতি, একটু লোভী হয়ে উঠে অন্য দুজনকে খুন করে পুরো টাকাটা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমার এখনও দুটো আসল কাজ বাকি। এক, শিবেন মাইতিকে ধরতে হবে। দুই, টাকাটার হদিশ করতে হবে। শিবেন মাইতির বাড়ি জলপাইগুড়িতে। কাছেই শিলিগুড়ি। সেখানে কোটি কোটি টাকার বেআইনি বিদেশি জিনিস কেনাবেচা হয়। ভুললে চলবে না টাকাটা মার্কিনি ডলারে ছিল। চোরাই পথে বড় রকমের ডলার খরচ করার পক্ষে শিলিগুড়ি আদর্শ জায়গা। তাই মনে হচ্ছে জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি অঞ্চলে হানা দিলে হয়তো আমার দুটো কাজই হয়ে যাবে। আমার ইনফর্মাররা আমাকে দুএকটা লিডও দিয়েছে। আজ রাত্তিরের ট্রেনে শিলিগুড়ি রওনা হচ্ছি। আশা করছি, আপনাদের আশীর্বাদে কেসটা শিগগিরই সলভ করে ফেলতে পারব।’

‘জাহাঙ্গির দলার কোথায় পেল, জিজ্ঞেস করছেন?’

‘করেছি। সে বলল, বাংলাদেশে বিড়ি এক্সপোর্ট করে পেয়েছে।’

‘আপনার দক্ষতায় আমি মুগ্ধ। আপনি তাড়াতাড়ি কার্যসিদ্ধি করে ফিরে আসুন, আমার এই কামনা রইল।’

ফোনটা রেখে দেবার পর আদিত্যর মনে হল সে যে বটুকবাবুর আপিসটা একবার দেখতে চায় সেটা সোমেনকে বলা হল না। আগে একবার বলেছিল, সোমেন নিশ্চয় ভুলে গেছে। তারপর মনে হল, এখন বলে খুব লাভ হত না। সোমেন রাত্তিরের ট্রেনে শিলিগুড়ি যাচ্ছে, নিশ্চয়ই এখন খুব তাড়ায় থাকবে। কাকে এ-ব্যাপারে বলা যায়? সব কিছু নিয়ে গৌতমকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না। ভাবতে ভাবতে আদিত্যর মনে হল, সুদর্শন শিকদারকে একবার বলে দেখলে হয়। আফটার অল, সেই তো কুমুদিনীর রেডটা লিড করেছিল। সুদর্শন শিকদারের ফোন নম্বরটা আদিত্যর মোবাইলে সেভ করা আছে।

একটু দ্বিধা নিয়ে সুদর্শন শিকদারের নম্বরটা লাগাল আদিত্য।

‘আমি আদিত্য মজুমদার বলছি। আমাকে মনে আছে? কুমুদিনী বিত্ত নিগম কেসটার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল?’ ওদিক থেকে ‘হ্যালো’ শুনে আদিত্য কুণ্ঠার সঙ্গে বলল।

আদিত্যকে চিনতে অন্তত আধ মিনিট সময় নিল সুদর্শন শিকদার। তারপর দায়সারাভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বলুন।’

‘বলছিলাম, আপনি কি এখনও কুমুদিনী কেসটার চার্জে আছেন? থাকলে আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করতাম।’

‘কাগজে কলমে আছি, আসলে নেই। আমার জায়গায় সোমেন মুখুটিকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে। তবে চিঠি লিখে নয়, অ্যাডিশানাল কমিশানার সাহেবের মুখের কথায় ব্যাপারটা হয়েছে। কিন্তু এটা তো আপনার না জানার কথা নয়। আমি তো শুনেছি, অ্যাডিশানাল কমিশানার সাহেব আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেই রদবদলটা করেছেন।’ সুদর্শন শিকদার তার ভেতরের তিক্ততাটা ঢাকার চেষ্টা করল না।

অভিযোগটা আদিত্যকে হজম করে নিতে হল। সুদর্শন শিকদারকে দেবার মতো উত্তর আদিত্যর কাছে নেই। সে একটু মিনমিন করে বলল, ‘কুমুদিনীর অফিসটা কি একবার দেখা যেতে পারে? আপনি কি তার একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?’

‘না পারি না। কুমুদিনীর ব্যাপারে কার্যত আমার আর কোনও অথরিটি নেই। আর তাছাড়া কানাঘুষোয় শুনছি, কুমুদিনীর কেসটা নাকি মুখুটি সলভ করে ফেলেছে। তাহলে আর ওদের অফিসটা দেখে আপনি কী করবেন? আমি এখন রাখছি। একটু ব্যস্ত আছি।’ সুদর্শন শিকদার বেশ রূঢ়ভাবে ফোনটা রেখে দিল।

সুদর্শন শিকদার মনে হয় চটেছে। নাকি চটে যাবার অভিনয় করছে? আসলে কি তার মনে গভীরতর কিছু আছে? ভেবে দেখতে হবে। ঈষৎ চিন্তান্বিতভাবে আদিত্য গৌতমের নম্বরটা লাগাল। সেই অগতির গতি গৌতম।

‘বল। খবর কি? ফোন-টোন করিস না কেন?’ গৌতমের গলায় উৎফুল্ল ভাব।

গৌতমের গলা শুনেই আদিত্যর মনমরা অবস্থাটা কিছুটা কেটে যাচ্ছে। গোবিন্দ রায় খুন হবার ঠিক পরে সেই যে গৌতমের সঙ্গে কথা হয়েছিল তারপর চার-পাঁচদিন আর যোগাযোগ করা হয়নি। সে বলল, ‘তোর গলায় এত ফুর্তি কেন রে? আবার প্রোমোশন পাচ্ছিস নাকি?’

‘আরে না, না। প্রমোশন-টোমোশন নয়। আমি হলাম গিয়ে সদা আনন্দময় পুরুষ। ফুর্তিতে থাকার জন্য আমার কোনও কারণ লাগে না। তোর মতো আঁতেল নাকি যে সর্বদা বিষণ্ণতায় ভুগব? যাক গে, বাজে কথা থাক। বল কী ব্যাপার।’

‘সোমেন মুখুটি তো বলছে কুমুদিনীর কেসটা মোটামুটি সলভ করে ফেলেছে।’

‘তাই তো বলছে। শুধু আসল লোকটাকে ধরা বাকি। সেই কাজটা সম্পন্ন করতে ও আজ রাত্তিরে শিলিগুড়ি যাচ্ছে। ওর গল্পটা কিন্তু আমার প্লজিবল মনে হচ্ছে। তোর কি মনে হয়?’

‘সোমেন মুখুটির গল্পটা সত্যি হতেও পারে। তবে আমার দু-একটা খটকা এখনও রয়ে গেছে। আমি অবশ্য সোমেনকে সেসব বলিনি। উৎসাহ নিয়ে ছেলেটা কাজ করছে, খটকার কথা বললে ডিমরালাইজড হয়ে যাবে। কিন্তু আমার নিজের বোঝার জন্যে খটকাগুলো দূর করা দরকার। আর এর জন্যে আমার দরকার একবার কুমুদিনীর আপিসটা ভাল করে দেখা। আমি তোকে আগেও বলেছিলাম, এখনও বলছি, আমাকে কুমুদিনীর আপিসটা দেখার একটা ব্যবস্থা করে দে।’

‘তুই এখনও কুমুদিনীর আপিসটা দেখিসনি? স্ট্রেঞ্জ! আমি কবে সোমেনকে বলেছিলাম তোকে কুমুদিনীর আপিসটা একবার ভাল করে দেখিয়ে দিতে।’

‘হয়ত কাজের চাপে ভুলে গেছে। তুই একটু দেখ না, অন্য কাউকে দিয়ে হয় কিনা।’

‘নো প্রবলেম। কাল দুপুরবেলাটা খালি রাখিস। আমি লালবাজার থেকে কাউকে তোর কাছে পাঠিয়ে দেব। সে তোকে কুমুদিনীর অফিসে নিয়ে যাবে।’

‘আর একটা কথা। তুই তো বলেছিলিস জাহাঙ্গির খানকে পুলিশ শিগগির অ্যারেস্ট করবে। সেটা এখনও করল না কেন?’

‘আমরা তো প্রথমে সেটাই করব ঠিক করেছিলাম। তারপর সোমেন বলল, স্যার ওকে অ্যারেস্ট না করে বরং ওর পেছনে লোক লাগিয়ে দেখি লোকটা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে। সেই মতো দুজন পুলিশের লোক, একজন জাহাঙ্গিরের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে, আর একজন বটুক সামন্তের ওপর। জাহাঙ্গিরকে অ্যারেস্ট না করার আরেকটা কারণ, অ্যারেস্ট করা হলে ও শিয়োরলি বটুক সামন্তের মতো বেল পেয়ে যেত। সেটাই যদি হয় তাহলে আর অ্যারেস্ট করে লাভ কী? তার থেকে ওকে ছেড়ে রেখে ফলো করা ভাল।’

‘বুঝলাম। ঠিক আছে। তুই তাহলে কাল দুপুরে কাউকে পাঠিয়ে দিস।’

‘ওক্কে।’

বিমলকে একটা ফোন করতে হবে। আদিত্য মোবাইলটা তুলে নিল। দুবার নম্বরটা লেগেই কেটে গেল। আজকাল লাইন পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। অনেক কষ্টে তৃতীয়বারের চেষ্টায় পাওয়া গেল নম্বরটা। লাইনে খুব ডিসটার্বেন্স।

‘শোনো, তোমার জন্যে একটা কাজ আছে। আজ বিকেলে একবার আসতে পারবে?’

‘কাজে যাবার পথে যাব স্যার। এই পাঁচটা নাগাদ? আপনি আপিসে থাকবেন, না বাড়িতে?’

‘আপিসেই থাকব। তুমি চলে এস।’

বিমল এল সোয়া পাঁচটায়। ঘামছে।

‘বলুন স্যার কী কাজ।’ বিমল চেয়ারে বসে বলল।

‘আরে, আগে ঠান্ডা হয়ে বোসো। খুব ঘেমে গেছ। পাখার তলায় বসে ঘামটা শুকোও। তোমার বাড়ির কী অবস্থা? আর কোনও ঝামেলা টামেলা হয়নি তো?’

‘না স্যার। আপাতত আর কোনও ঝামেলা নেই। ছেলেটা দিল্লিতেই আছে। কাজ করছে। ওর মাকেই বেশি ফোন করে। তবে আমার সঙ্গেও মাঝে মাঝে কথা হয়। গিন্নির শরীরটাও, বলতে নেই, ঠিকঠাক আছে। না, কোনও ঝামেলা নেই স্যার।’

‘খুব ভাল। দাঁড়াও একটু চা বলি। শ্যামল চা আনতে আনতে কাজের কথাটা সেরে ফেলতে পারব।’

এই আপিস বাড়ির সিকিউরিটি শ্যামল আজকাল একতলায় তার ঘরে চা বানায়। সেই চা কেটলিতে করে আপিসে আপিসে বিক্রি করে। আদিত্য অবশ্য নিজের চা কফি নিজেই বানিয়ে নেয়, কিন্তু আদিত্যর বানানো চা বিমলের চলবে না।

‘দুটো মশলা চা আমার ঘরে। একটু তাড়াতাড়ি।’ আদিত্য শ্যামলকে ফোন করে বলল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বিমলকে বলল, ‘কাজটা কী শোনো।’

বিমল চেয়ারের ওপর শিরদাঁড়া সোজা করে বসেছে। এটা তার মনঃসংযোগের প্রস্তুতি।

‘রাজারহাট নিউ টাউনে একটা নাইট ক্লাব আছে। নাম বুটলেগারস। ওপর ওপর নাইট ক্লাব অর্থাৎ অনেক রাত্তির অব্দি নাচগান, খানাপিনা হয়। কিন্তু এর ভেতরে একটা জুয়ার আড্ডা আছে। সেটা অবশ্য বেআইনি, তাই সকলের জন্যে নয়। তোমাকে সেখানে গিয়ে নাইট ক্লাব এবং তার মালিক সম্বন্ধে জানতে হবে। মালিকের নাম পিটার অরোরা। তার সম্বন্ধে যা যা জানতে পারবে আমাকে এসে জানাবে। সম্ভব হলে জুয়ার আড্ডাটার সম্বন্ধেও জানার চেষ্টা করবে। ওটা সম্বন্ধেও আমার জানা দরকার। এর জন্যে তোমাকে কয়েক দিন কাজ থেকে ছুটি নিতে হবে। তোমার তো নাইট ডিউটি?’

‘সে আমি ম্যানেজ করে নেব। সকালে যে ছেলেটা কাজ করে তার সঙ্গে বদলা বদলি করে নিতে পারব। কিন্তু নাইট ক্লাবে যাবার মতো আমার তো ভাল জামা-প্যান্ট নেই স্যার।’

‘আরে কী মুশকিল। আমি কী তোমাকে নাইটক্লাবের খদ্দের হয়ে যেতে বলছি? বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নাইট ক্লাবে নাচতে যায়। তাদের মধ্যে তোমাকে মানাবে কেন? তুমি তো নাচতেও পার না। শোনো, তুমি ওখানে যাবে কাজ খুঁজতে। যেমন কিছুদিন আগে স্টুডিও পাড়ায় গিয়েছিলে। ওখানে ফেরিওলা বা চা-ওলা সেজেও যেতে পার। বাবু-বিবিরা যারা নাইট ক্লাবে যায় তাদের ড্রাইভারদের অনেক রাত্তির অব্দি বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। সেই ড্রাইভারদের কাছে চা বিক্রি করতে পার। চা বানাতে পারবে তো?’

‘চা-ওলা সেজেই যাব স্যার। চা বানানোটা গিন্নির কাজ থেকে শিখে নেব। একটা কেটলি কিনতে হবে আর একটা উনুন। ও ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে স্যার।’

‘কিছু টাকা রাখ। খরচপাতি আছে। তোমার পারিশ্রমিকটা কাজ হয়ে গেলে পাবে।’

‘সে আপনি যখন খুশি দিন স্যার। ও নিয়ে আমার চিন্তা নেই। আমার চিন্তা আপনার কাজটা ঠিকমতো করে উঠতে পারব কিনা তাই নিয়ে।’

কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে। শ্যামল। চা নিয়ে এসেছে।

বিমল চলে যেতে না যেতে কেয়ার ফোন।

‘কয়েকজন কলিগের সঙ্গে বউবাজারে ঘড়ি কিনতে এসেছি। তুমি অফিসে আছ? তাহলে ফেরার পথে দেখা করে যাব।’

কেয়া আদিত্যর অফিসে আগে কয়েকবার এসেছে। জায়গাটা চেনে। আদিত্য বলল, ‘আমি এখনও অফিসেই আছি। বেরোবার তোড়জোড় করছিলাম। তাড়াতাড়ি চলে এস।’

‘কেনাকাটা হয়ে গেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।’

মিনিট পনেরো বাদে আবার কেয়ার ফোন এল। আদিত্য চুপ করে আপিসেই বসে আছে।

‘তোমার অফিসের মেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমি আর ওপরে উঠব না। তুমি নিচে নেমে এস।’

‘বউবাজারে ঘড়ি কিনতে এসেছিলে কেন? তোমার বাড়ির কাছে, শ্যামবাজারেই তো ভাল ঘড়ির দোকান আছে।’ আদিত্য নিচে নেমে জিজ্ঞেস করল।

‘একটা বড় দেয়াল ঘড়ি কেনার ছিল। সেটা দেখতে হবে পুরোনো আমলের ঘড়ির মতো, কিন্তু ভেতরের কলকব্জা হতে হবে একেবারে আধুনিক। কয়েকটা জাপানি কম্পানি এরকম ঘড়ি তৈরি করছে। কিন্তু সেগুলো শ্যামবাজারে পাওয়া যায় না।’

‘কার জন্যে কিনলে এরকম ঘড়ি?’

‘ও মা, সেটাই তো বলা হয়নি। আমাদের এক কলিগের পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকী। স্কুলের সবাই মিলে জব্বর গিফট দেওয়া হবে। তার মধ্যে এই ঘড়িটাও আছে।’

ওরা বউবাজার স্ট্রিট ধরে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ-এর দিকে হাঁটছিল।

‘আমার কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছে। এক্ষুনি কিছু একটা খেতে হবে।’ কেয়া অস্থিরভাবে বলল।

‘খিদে আমারও পেয়েছে। কচুরি খাবে? পুঁটিরামে? অনেক দিন পুঁটিরামে যাইনি।’ আদিত্য খানিক ব্যগ্রভাবে বলল।

‘পুঁটিরাম! সে তো অনেক দূর! এত খিদে নিয়ে অতটা হাঁটতে পারব না।’ কেয়া ঘোষণা করল।

‘এই অফিস টাইমে ট্যাক্সি কোথায় পাব? আর ট্র্যাম-বাসে তুমি তো চড়ই না। এইসব কারণেই বোধহয় সেদিন আমার পুলিশ বন্ধু গৌতম দাশগুপ্ত আমাকে একটা গাড়ি কিনতে বলছিল।’ আদিত্যর গলায় ঠাট্টা।’

‘বাজে কথা বোলো না। একে হাঁটতে পারছি না, তার ওপর যত বাজে কথা। তুমি কিনবে গাড়ি! তা হলেই হয়েছে!’ কেয়া খিঁচিয়ে উঠল।

আদিত্য দেখেছে শারীরিক কষ্ট কেয়া একদম সহ্য করতে পারে না। এমনিতে কেয়া খুবই শান্ত স্বভাবের মানুষ। কিন্তু শারীরিক কষ্টের উপক্রম হলেই তার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। আদিত্যর ভাগ্য যথেষ্টই ভাল বলতে হবে, চিত্তরঞ্জন এভিনিউ-এর মোড়ে পৌঁছে দেখল একটা হলদে ট্যাক্সি তার মিটারটা লাল শালু দিয়ে মুড়ে ট্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য ছুটে গিয়ে তাকে পাকড়াও করল।

‘কলেজ স্ট্রিট যাবেন?’ আদিত্য কাতর গলায় আর্জি জানাল।

‘দেখছেন না, মিটার খারাপ আছে।’

‘মিটারের দরকার নেই। আপনি বলুন না কত লাগবে।’

টাক্সিওলা একটা ভাল দাঁও মারল। অবশ্য আদিত্যর মনে হল দাঁওটা সেই মেরেছে। কেয়াকে নিয়ে আর হাঁটা যাচ্ছিল না। কলেজ স্ট্রিট আর সূর্য সেন স্ট্রিটের মোড়ে এসে আদিত্য ট্যাক্সিওলাকে ডানদিকে বেঁকতে বলল। দু-পা গেলেই পুঁটিরাম।

‘ওদিকে যাওয়া যাবে না। ওদিকটা ওয়ান ওয়ে। ঢুকলে ফেঁসে যাব। আমাকে মিটার সারাতে মহাত্মা গান্ধী রোডে যেতে হবে। আপনারা এখানেই নেমে পড়ুন।’ ট্যাক্সিওলা সাফ জানিয়ে দিল।

অগত্যা ওখানেই ছেড়ে দিতে হল ট্যাক্সিটা। ওইটুকু হাঁটতে অবশ্য কেয়ার আপত্তি নেই। ট্যাক্সি পাবার পর থেকেই কেয়ার মেজাজটা একটু একটু করে ভাল হচ্ছে। পুঁটিরাম পৌঁছে তাকে রীতিমতো খুশি-খুশি দেখাচ্ছিল।

‘কতদিন পরে পুঁটিরামে এলাম। সেই কলেজে পড়ার সময় মাঝে-মাঝে আসতাম। খুব একটা বদলায়নি কিন্তু।’ কেয়া স্মৃতিতাড়িত গলায় বলল।

অন্তত কচুরির স্ট্যান্ডার্ডটা একই রকম আছে। শুধু পরিবেশনের কায়দা বদলেছে। আগে টেবিলে বসে কচুরি-মিষ্টি অর্ডার দেওয়া যেত। যেমন সব দোকানে দেওয়া যায়। এখন আর সেই নিয়ম নেই। সেলফ-সারভিস চালু হয়েছে। কাউন্টার থেকে নিজেই খাবার নিয়েটেবিলে বসতে হবে। তবে তরকারি ফুরিয়ে গেলে টেবিলেই দ্বিতীয়বার দিয়ে যায়। তখন আর উঠতে হয় না। কচুরির পর বোঁদে খাওয়া হল। বোঁদেটা গরম এবং টাটকা।

‘এর পর কি কফি খাবে? নাকি প্যারাগনের সরবত?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘দুটোই খাব। প্রথমে সরবত। রোজ সিরাপ দিয়ে ঘোলের সরবত। তারপর কফি হাউসের ওপরতলায় বসে কোল্ড কফি।’ কেয়া উত্তেজনায় ফুটছে। পুঁটিরামের কচুরি খেয়ে তার মন একেবারে ভাল হয়ে গেছে।

আধঘণ্টা পরে কফি হাউসের দোতলায় বসে দু-জনে যখন বেয়ারার জন্যে অপেক্ষা করছে, আদিত্য বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা তোমাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করব করব করেও করা হয়নি। এখন হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে গেল।’

‘কী কথা?’

‘তোমার ডাক নাম অপু, কিন্তু ভাল নাম কেয়া। এরকম কেন হল? সাধারণত যাদের ডাক নাম অপু হয় তাদের ভাল নাম হয় অপর্ণা বা অপরাজিতা ধরনের কিছু। তোমার ক্ষেত্রে সেটা না হবার কি বিশেষ কোনও কারণ আছে?’

কেয়া মিটিমিটি হাসছে। কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে সে বলল, ‘আমার নামকরণ নিয়ে একটা লম্বা ইতিহাস আছে। বাবা ছিলেন স্কুল টিচার। বহরমপুরে একটা স্কুলে বাংলা পড়াতেন। বিভূতিভূষণের অন্ধ ভক্ত। আমি যখন মায়ের পেটে তখন কেন জানি না বাবা ধরেই নিয়েছিলেন ছেলে হবে। আর ছেলে হলে তার নাম রাখা হবে অপু। ছেলে তো হল না, কিন্তু অপু নামটা রয়ে গেল। তুমি ঠিক বলেছ। অপু যদি কারও ডাক নাম হয় তাহলে তার ভাল নাম অপর্ণা হবার চান্স খুব বেশি। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক হল, ভাল নাম হবে অপর্ণা। এইভাবে তিন বছর কাটল। তখনও ইস্কুলে ভর্তি হইনি। বাবা সাত-তাড়াতাড়ি ইস্কুলে ভর্তি করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন বড়পিসিরা আমাদের বাড়ি বেড়াতে এলেন। বড় পিসেমশাই সরকারি অফিসে বড় চাকরি করতেন। বদলির চাকরি। পুনে, সাজাহানপুর, কার্কি, জব্বলপুর এইসব ছিল তাঁর কাজের জায়গা। ফলে বড়পিসিদের সঙ্গে খুব বেশি দেখা হত না। বড়পিসি সেই প্রথম আমাকে দেখলেন। দেখে তো বেজায় খুশি। কিন্তু যেই শুনলেন আমার ভাল নাম অপর্ণা রাখা হয়েছে অমনি তাঁর মুখ ভার। অপর্ণা নামের মেয়েরা নাকি বিয়ে করে সুখী হয় না। তিনি তিনজন অপর্ণার কথা জানেন যাদের মধ্যে দু-জন অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছে, আর একজনের বিয়েই হয়নি। বড়পিসির আজ্ঞায় অপর্ণা নামটা পালটানো হল। আমাদের বাড়ির পেছনে কয়েকটা কেয়াঝোপ ছিল। তাই দেখে বড়পিসি আমার নাম রাখলেন কেতকী। বড়পিসি চলে যাবার পরে বাবা নামটাকে আর একটু ছোট আর আধুনিক করে নিলেন। আমার নাম হল কেয়া। কেতকী মানেই তো কেয়া। আর ওটাকে পালটানো হয়নি।’

বেয়ারা এসেছে। আদিত্য কালো কফি খাবে, কেয়া খাবে কোল্ড কফি উইথ ক্রিম। বেয়ারা অর্ডার নিয়ে চলে গেল। আদিত্য ভাবছে। ভাবতে ভাবতে বলল, আচ্ছা, ‘তোমার বাড়ি তো বহরমপুরে। তুমি হাবিবুর রহমান বলে কাউকে জান? এক সময় ওখানকার এম এল এ ছিলেন।’

‘নামটা চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ, এম এল এ-ই ছিলেন। বোধহয় অল্প বয়সে মারা যান। আমি তখন কলকাতায় চলে এসেছি। এর বেশি আর কিছু বলতে পারব না।’ কেয়ার গলাটা অনিশ্চিত শোনাল।

‘তুমি এমন কাউকে জান যে বলতে পারবে? মানে বহরমপুরের পুরোনো কোনও লোক যে হাবিবুর রহমানের পরিবারকে চিনত?’

কেয়া বেশ কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘আমাদের বহরমপুরের বাড়িতে আর কেউ নেই। বাড়ির আমাদের অংশটা বিক্রি হয়ে গেছে। যে অংশটা এখনও বিক্রি হয়নি সেখানে আমার এক জেঠু থাকেন। জেঠিমা গত হয়েছেন, দুই মেয়ের বিদেশে বিয়ে হয়েছে। জেঠু একাই থাকে। জেঠু বহরমপুরের পুরোনো বাসিন্দাদের অনেককেই চেনে। তুমি জেঠুর সঙ্গে কথা বলতে পার। কিন্তু তার আগে বলো হাবিবুর রহমান সম্বন্ধে কেন জানতে চাইছ?’

‘ঠিক হাবিবুর রহমান সম্বন্ধে জানতে চাইছি না। হাবিবুর রহমানের ছেলে ফিরদৌস রহমান সম্বন্ধে জানতে চাইছি। ফিরদৌস সম্প্রতি খুন হয়েছে। তার পিসি, মানে হাবিবুর রহমানের এক বোন, আমাকে খুনি ধরার কাজে নিযুক্ত করেছে। ফিরদৌস একটা বয়েস অব্দি বহরমপুরে ছিল। তার ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানতে চাইছি।’

‘তা হলে তোমাকে একদিন বহরমপুরে চলে যেতে হবে। আমি জেঠুকে বলে রাখব। জেঠু খুব মাই ডিয়ার লোক। বুড়ো মানুষ, কথা বলার লোক পায় না। তোমাকে পেলে খুব খুশি হয়ে বকবক করবে।’

 কেয়া কথা বলা থামিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। কী যেন ভাবছে। আদিত্য তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দ্যাখে নিচে রাস্তা দিয়ে জনস্রোত চলেছে। ঠেলা, রিকশা, রিকশা-ভ্যান বোঝাই করে শুধু বই আর বই। সবই ইস্কুলপাঠ্য পুস্তক। বোধহয় নতুন ক্লাশ সবে শুরু হয়েছে বা শিগগির হতে চলেছে। আদিত্য লক্ষ করেছে, এই সময় মফস্বলের ইস্কুলগুলো থেকে প্রচুর মানুষ কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে আসে। হিন্দু ইস্কুলের সামনে জটলা। কারা যেন তর্কাতর্কি করছে। কী নিয়ে তর্ক করছে, তিনতলা থেকে ভাল বোঝা যাচ্ছে না।

কেয়া হঠাৎ বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকাল। নরম গলায় বলল, ‘জেঠুই কিন্তু এখন আমার একমাত্র অভিভাবক।’

আদিত্য হাসল। অনেকক্ষণ কথা বলল না। তারপর বলল, ‘দেখো, আমাকে তোমার জেঠুর অপছন্দ হবে না।’

কেয়াকে খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে আদিত্যর।

কেয়াকে হস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আদিত্য সবে রাত্তিরের খাওয়া সেরে ঘরে ফিরে সিগারেট ধরিয়েছে, এমন সময় নূপুর মণ্ডলের ফোন।

‘আদিত্যদা, হোম ওয়ার্ক হয়ে গেছে। সুমনা ঘোষাল সম্বন্ধে এখন আমার মতো খুব কম লোকই জানে। তুমি বলেছিলে সুমনা ঘোষালের ফোন নম্বরটা জোগাড় করে দেবে। তারও আর দরকার নেই। আমি ফোন নম্বরটা পেয়ে গেছি।’

‘কোথা থেকে পেলে?’

‘সুমনা ঘোষালের একটা ওয়েবসাইট আছে। সেখানে যোগাযোগ করে সুমনা ঘোষালকে কাজের জন্য কনট্যাক্ট করা যায়। সুমনা ঘোষাল হয়ত এখনও টুকটাক সিনেমায় বা সিরিয়ালে অভিনয় করে। অন্তত আশা করে নতুন কোনও অফার আসবে। তাই ওয়েবসাইটটা চালু রেখেছে। ওই ওয়েবসাইটে সুমনা ঘোষালের ল্যান্ডফোন এবং মোবাইল নম্বর দুটোই আছে। আমি ‘অ্যাক্ট্রেসেস’ বলে আর একটা ওয়েবসাইট থেকে নম্বরগুলো ক্রস চেক করে নিয়েছি। এই দ্বিতীয় ওয়েবসাইটটায় বাঙালি অভিনেত্রী প্রায় সকলের ঠিকানা এবং ফোন নম্বর আছে। দু-একজন খুব বিখ্যাতকে বাদ দিয়ে। তো এখানে ভেটারেনদের লিস্টে সুমনা ঘোষালকে পেয়ে গেলাম।’

‘তুমি কি ভদ্রমহিলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছ?’

‘এখনও করিনি। ভাবলাম তোমার সঙ্গে কথা বলে নিয়ে করব।’

‘পত্রিকার কী নাম ঠিক করলে?’

‘বায়োস্কোপ। খুব সিমপ্ল নাম। ফাইন্যান্সার উত্তরবঙ্গের। উত্তরবঙ্গ, কারণ ওই অঞ্চলটা আমি চিনি। যদি মহিলা ফাইন্যান্সার সম্বন্ধে ডিটেল কিছু জানতে চান ঢপ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব।’

‘তোমার কম্পিউটার কন্সালটেন্সি কেমন চলছে?’

‘একটু স্লো। মনে হচ্ছে পিক আপ করতে সময় লাগবে। এক দিক থেকে ভালই। তোমার কাজটা করার জন্যে সময় বার করে নিতে অসুবিধে হবে না।’

‘ফ্ল্যাট আর আপিস গোছানো হয়ে গেছে?’

‘কোথায় আর হল? তোমার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে তো সুমনা ঘোষালকে নিয়েই রিসার্চ করে যাচ্ছি। আমার এক বন্ধু খুব হেল্প করেছে। বন্ধু বাগবাজারে থাকে। ওদের বাড়ির কাছে খুব পুরোনো একটা লাইব্রেরি আছে। সেখানে গিয়ে অনেক দিনের পুরোনো সিনেমা পত্রিকা পাওয়া গেল। সেগুলো থেকে সুমনা ঘোষাল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, যেগুলো ইন্টারনেট থেকে জানতে পারতাম না।’

‘বেশ বেশ। তা হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শুরু করে দাও। গুড নাইট।’

‘গুড নাইট, আদিত্যদা।’

বটুক সামন্তর অফিসটা পোদ্দার কোর্টের পাশে, আদিত্যর অফিস থেকে খুব দূরে নয়। অফিসটা ভাল করে পরীক্ষা করার জন্যে, গৌতম বলেছিল, কাউকে সঙ্গে দেবে। গৌতম কথা রেখেছে। সঙ্গে যাকে দিয়েছে সে আর কেউ নয়, আদিত্যর পূর্বপরিচিত সাব-ইন্সপেক্টার চাকি।

চাকি আদিত্যর জন্য কুমুদিনীর অফিসের সামনেই অপেক্ষা করছিল। আদিত্যকে দেখে বলল, ‘চাবিগুলো সব কটা নিয়ে এসেছি স্যার। মেন গেটের দুটো চাবি, ভেতরের ঘরের আরও চারটে। কয়েকটা আলমারির চাবিও আছে, কয়েকটা মনে হয় ড্রয়ারের চাবি। তবে কোন চাবিটা কোন আলমারির বা ড্রয়ারের সেটা লাগিয়ে লাগিয়ে দেখতে হবে। এছাড়াও কিছু চাবি আছে যেগুলো কীসের আমরা জানি না। বটুকবাবুকে অনেক প্রশ্ন করেও উত্তর পাওয়া যায়নি। ওর একটাই উত্তর—এগুলো কীসের চাবি উনি জানেন না।’

অফিসটা একটা পুরোনো বাড়ির দোতলায়। একতলায় কয়েকটা দোকান তার মধ্যে একটা নাম করা মোবাইল কম্পানির শোরুম-সার্ভিস—সেন্টার অনেকটা জায়গা নিয়ে রয়েছে। দোতলা থেকে পাঁচতলা অব্দি নানা ধরনের অফিস। লিফট আছে। তবে লিফটটা দোতলায় থামে না।

‘বটুকবাবু কেমন আছেন? ওর গতিবিধির ওপর আপনারা নজর রেখেছেন নিশ্চয়।’ আদিত্য সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল।

‘নজর তো রাখা হচ্ছে। কিন্তু লোকটা বাড়ি থেকেই বেরোচ্ছে না। টেলিফোন-মোবাইল দুটোই ট্যাপ করা আছে। সেখান থেকেও কিছু পাওয়া যায়নি। লোকটা স্যার, হয় একেবারে গোবেচারা আর না হয় গভীর জলের মাছ। বোধহয় দ্বিতীয়টা। আসলে কি স্যার, বটুক সামন্তকে আরও কিছুটা রগড়ালে হয়তো কিছু পাওয়া যেত। শিকদার সাহেব এই কাজটাই করছিলেন স্যার। কিন্তু, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, মুখুটি সাহেব তো বটুক সামন্তকে ছেড়ে ফিরদৌসকে নিয়ে পড়েছেন। মানে ফিরদৌসের খুনিকে নিয়ে।’

‘মুখুটি সাহেবের কী খবর?’

‘তেমন কিছু খবর আছে বলে শুনিনি স্যার।’

কথা বলতে বলতে ওরা দোতলায় পৌঁছে গিয়েছিল। কুমুদিনীর মূল প্রবেশ পথে কোলাপসিবল গেট টানা, তালা লাগানো। সেই তালা ছাড়াও দরজায় আর একটা গা-তালা। ভেতরে অন্ধকার। চাকি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ডটা খুঁজে কয়েকটা আলো জ্বালিয়ে দিল। আদিত্য দেখল একটা বড় ঘরের ভেতরে তারা দাঁড়িয়ে আছে। চেয়ার-টেবিলগুলো অবিন্যস্ত। মনে হয় পুলিশি তল্লাসির পরে আর গুছিয়ে রাখা হয়নি। চেয়ার-টেবিলের ওপর অব্যবহারের ধুলো জমেছে। আদিত্য নাকে রুমাল চাপা দিল। ধুলোতে তার ভীষণ অ্যালার্জি আছে। এক্ষুনি হাঁচি শুরু হয়ে যাবে।

চাকি তিনটে বড় বড় জানলা খুলে দিয়েছে। একদিকের জানলা দিয়ে টেরিটি বাজারের ভিড় ভর্তি রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকের জানলা দিয়ে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, চিৎপুরের ট্র্যাম।

‘বটুক সামন্ত কোন ঘরে বসে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘ওই কোণের ঘরটায় স্যার। দাঁড়ান, খুলে দিচ্ছি।’

বড় ঘরটার একদিকে ছোট্ট করিডোর। সেটার মুখে একটা বসার জায়গা। করিডোরের শেষে বটুকবাবুর কামরা।

‘এইখানে বটুক সামন্তর সেক্রেটারি শৌভিক নন্দ বসে।’ চাকি করিডোরে ঢোকার মুখে বসার জায়গাটা দেখিয়ে বলল।

বটুক সামন্তর ঘরটা বন্ধ। দরজায় ইয়েল লক। চাকি চাবির গোছা বার করে তিন-চারটে চাবি চেষ্টা করার পর একটা চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে গেল। কাঠের প্যানেল দিয়ে সাজানো ঘর। রিভলভিং চেয়ারের সামনে মস্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিল। এক পাশে সোফা সেট। সোফা সেটের উল্টোদিকের দেয়ালে একটা পেল্লায় সাইজের এল ই ডি টিভি স্ক্রিন। ফিরদৌস বলেছিল, সম্ভবত কোনও ছবির পেছনে বটুক সামন্তর লুকোনো একটা সেফ আছে। আদিত্য নজর করে দেখল, ঘরে তিনটে ছবি রয়েছে। একটা গান্ধী, একটা বিবেকানন্দ আর একজন আটপৌরে করে শাড়ি পরা মধ্যবয়স্কা মহিলা। আদিত্য আন্দাজ করল, ইনি বটুক সামন্তর মা কুমুদিনী সামন্ত, যাঁর নামে কোম্পানির নাম।

‘চাকি সাহেব, এই তিনটে ছবিকে একটু সরাতে হবে। আমিও হাত লাগাচ্ছি। তার আগে একটা সিগারেট খেয়ে নিই।’

আদিত্য সোফায় বসে সিগারেট ধরাল। প্যাকেটটা এগিয়ে দিল চাকির দিকে।

‘আমি স্মোক করি না স্যার।’ চাকি লাজুক গলায় বলল। ‘কিন্তু ছবি সরাবেন কেন?’

 ‘ফিরদৌস আমাকে বলেছিল, কোনও একটা ছবির পেছনে নাকি একটা সেফ আছে। সেখানে গোপন কিছু থাকতেও পারে। দাঁড়ান সিগারেটটা আগে খেয়ে নিই।’

‘আমি ততক্ষণ একটু চায়ের ব্যবস্থা করে আসি স্যার। একতলায় লিফটের সামনে একটা লোক চা নিয়ে বসে। দেখি যদি দিয়ে যায়।’

ঘরে একটাই জানলা। ‘জানলাটা কি খোলা যাবে?’ বলতে বলতে আদিত্য নিজে গিয়ে জানলাটা খুলে দিল। জানলার নিচে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট। জনস্রোত। আদিত্য আবার সোফায় এসে বসল।

বসে বসে আদিত্য এক মনে ভাবছিল। একটা জটিল ক্যানভাস, তার কিছু কিছু অংশ এখনও অস্পষ্ট। রেনেসাঁস-এর মাস্টাররা একটা বড় ছবি আঁকার সময় যেমন কিছু কিছু অংশ আবছা রাখতেন, পরে স্পষ্ট করে নিতেন, আদিত্যর ক্যানভাসটাও এখন সেই রকম। আবছা অংশগুলোকে ভরাট করতে হবে। হাতে অনেক কাজ। আদিত্য মনে মনে কাজগুলোর তালিকা তৈরি করল। বহরমপুর যেতে হবে। সাবিনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ‘নিউ এজ মুভিজ’-এর মালিক রোহিত ধামানির সঙ্গেও একবার কথা বলা দরকার। পল্লবী ভদ্র বলে যে মেয়েটি খুন হয়েছে, তার সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হবে। এ-ব্যাপারে পুলিশ যতটা জানে সেটা গৌতমকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।

চাকি কাজের ছেলে। চা-ওলাকে ধরে এনেছে। চা-ওলার হাতে কেটলি ও ভাঁড়। সে কিছুতেই চায়ের পয়সা নেবে না। ধমক-টমক দিয়ে তার হাতে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিতে পারল আদিত্য।

‘চমৎকার চা।’ আদিত্য ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বলল। ‘লোকটাকে ধরে আনার কৃতিত্বটা কিন্তু ষোলো আনা আপনার।’

‘আসবে না কেন স্যার। আমার ইউনিফর্মটা দেখে সুড়সুড় করে চলে এল।’ পুলিশকে সবাই চমকায়।

‘সেটা ওর চায়ের পয়সা নেবার অনিচ্ছে দেখেই বুঝলাম।’

ছবি তিনটে সরিয়ে ফেলতে খুব একটা খাটতে হল না। গান্ধী এবং বিবেকানন্দর ছবির পেছনে নিরেট সাদা দেয়াল। কুমুদিনী সামন্তর ছবির পিছনে ছোট একটা পর্দা। পর্দাটা সরাতেই একটা সেফ বেরিয়ে পড়ল। সেফটা তালাবন্ধ।

‘এই চাবির গোছাটার মধ্যেই হয়তোসেফের চাবিটা আছে স্যার।’ চাকির গলাটা উত্তেজনায় কাঁপছে।

চাকির ধারণা ঠিক। সেফের চাবি গোছার মধ্যেই ছিল। মিনিট দশেকের মধ্যে সেফটা খুলে ফেলা গেল। ভেতরে কিছু আলগা কাগজপত্র, একটা বাক্স, দুটো ফাইল, কিছু ক্যাশ টাকা। আলগা কাগজগুলো দরকারি কিনা বলা শক্ত। পুরোনো ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল, বাড়ি ভাড়ার রসিদ। বাক্সের মধ্যে তিনটে ব্যাঙ্কের চেকবই, পাশবই, টাকা জমা দেবার কাগজ। ফাইল দুটোর একটাতে বটুক সামন্তর গত আট-দশ বছরের ইনকাম ট্যাক্সের রিসিট যত্ন করে রাখা। অন্যটাতে কিছু ফিক্সড ডিপোজিটের সার্টিফিকেট, এল আই সি-র পলিসি, কম্পানির ডিবেঞ্চার ইত্যাদি সবই বটুক সামন্তর একার নামে। আদিত্য লক্ষ করল, সবকটা সার্টিফিকেটেই নমিনির নাম রয়েছে। প্রায় সবকটাতেই নমিনির নাম ডা. শুভঙ্কর সামন্ত। শুধু একটা পঁচিশ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের নমিনি রণপ্রিয় ঘোষাল। এছাড়া সেফের মধ্যে উনিশ হাজার আটশো টাকার আলগা ক্যাশ রয়েছে।

বটুক সামন্ত স্ত্রী বা রক্ষিতাকে কিছু দিয়ে যেতে চাইছে না। কিন্তু তাদের ছেলেদের নমিনি করে রেখেছে। এটা কি খুব স্বাভাবিক? আদিত্যর মনে হল, এটা নিয়ে আর একটু ভাবতে হবে। সে চাকিকে বলল, ‘এই কাগজগুলো যত্ন করে নিয়ে নিন। এর থেকে হয়তো বটুক সামন্তর আর্থিক অবস্থার কিছু হদিশ পাওয়া যাবে।’

আরও কিছুক্ষণ কুমুদিনীর অফিসে খোঁজাখুঁজি করে দুজনে যখন ফেরার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছে, আদিত্য তখনও চিন্তায় ডুবে আছে।

‘কী এত ভাবছেন স্যার। আমরা তো দারুণ জিনিস পেয়ে গেলাম। আগে এই সব কাগজপত্রের হদিশ তো কেউ পায়নি।’ চাকির গলা বেশ উৎফুল্ল শোনাল।

‘দেখুন, সামন্তর মতো ব্যবসাদারদের এক নম্বরী এবং দু-নম্বরী দু-রকমের কাগজপত্র থাকে। এই কাগজগুলো দেখে মনে হচ্ছে এগুলো সবই এক নম্বরী। এগুলো দিয়ে আপনি বটুক সামন্তকে ফাঁসাতে পারবেন না। একটা জিনিস দেখে আমি একটু অবাক হচ্ছি। আমি হিসেব করে দেখলাম, ফিক্সড ডিপোজিট, কম্পানির কাগজ, এল আই সি সব মিলিয়ে ওই আলমারিতে যা পাওয়া গেল তাতে মনে হচ্ছে বটুক সামন্তর মোট অ্যাসেট আশি-পঁচাশি লাখের বেশি হবে না। ক্যাশের পরিমাণটাও এমন কিছু বেশি নয়। এটা কি সম্ভব? বটুক সামন্তর বাড়ি আমি দেখেছি। তার দাম অন্তত ছ-সাত কোটি। বাড়ির ভেতর যে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল একটা হণ্ডা অ্যাকর্ড একটা বি এম ডাবলু তাদের মোট দাম কোটির কাছাকাছি। এই সব থেকে কী মনে হয় না বটুক সামন্তর বেআইনি কাগজপত্রও কিছু আছে? যার হদিশ আমরা এখনও পাইনি?’

কথা বলতে বলতে দুজনে বড় রাস্তায় চলে এসেছিল। চাকির গাড়িটা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।

‘আমি আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি স্যার। আসুন।’ চাকি গাড়ির দরজা খুলে বলল।

‘এক মিনিট দাঁড়ান তো।’ কিছু একটা জিনিস আদিত্যকে অস্বস্তি দিচ্ছিল। আদিত্য এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে সেটা কী। সে ওপর দিকে তাকাল। এখান থেকে কুমুদিনীর অফিসটা পরিষ্কার দেখা যায়। সন্দেহ নেই, এই দিকটাই বটুক সামন্তর অফিস। বটুক সামন্তর অফিসের জানলা দিয়ে রাস্তার এই অংশটাই আদিত্য দেখতে পেয়েছিল যেখানে সে এখন দাঁড়িয়ে আছে।

‘কী আশ্চর্য দেখুন, বটুক সামন্তর অফিসঘরের বাইরের দেয়ালে একটা উইন্ডো এসি লাগানো আছে।’ আদিত্য উত্তেজিত গলায় বলল।

‘সে তো থাকতেই পারে, এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে?’ আদিত্যর হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তনে চাকি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছে।

‘আশ্চর্য নয়? বটুক সামন্তর ঘরের ভেতরে তো কোনও উইন্ডো এসি ছিল না। দুদিকের দেয়ালে দুটো সপ্লিট এসি লাগানো ছিল। তাহলে বাইরে উইন্ডো এসির খোলসটা রয়েছে কেন?’

‘হয়তো উইন্ডো এসি আগে ছিল। মেশিনটা আর নেই। শুধু বাইরের খোলসটা রয়ে গেছে।’

‘সেটা হতে পারে, কিন্তু হবার সম্ভাবনা খুবই কম। ইন এনি কেস আমাদের একবার দেখতে হবে ব্যাপারটা কী। আসুন।’ কথাগুলো বলে আদিত্য চাকির জন্যে অপেক্ষা না করেই কুমুদিনীর আপিসের দিকে হাঁটা লাগাল।’

চাকি তার ভেতরের বিরক্তিটা মুখে প্রকাশ করে ফেলেছে। কিন্তু বিরক্তি লাগলেও উপায় নেই। আদিত্যর কথা তাকে শুনতেই হবে। আদিত্যর অবশ্য চাকির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার সময় নেই।

বটুক সামন্তর ঘরে ঢুকে আদিত্য আবার জানলাটা খুলে দিল। এই জানলা দিয়ে উঁকি মেরেই সে একটু আগে বাইরে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো উইন্ডো এসির বাক্সটা দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু তখন অতটা খেয়াল করেনি, তবে মনের ভেতরে একটা অস্বস্তি রয়ে গিয়েছিল। এবার জানলা দিয়ে উঁকি মেরে সে এসির বাক্সটার অবস্থানটা খুব ভাল করে দেখে নিল। এসিটা লাগানো থাকলে যেখান দিয়ে ঠান্ডা হাওয়াটা বেরোত ঠিক সেখানে বিরাট এল ই ডি টিভি স্ক্রিনটা লাগানো আছে। স্ক্রিনটা একটা ফ্রেমের সঙ্গে আটকানো। আদিত্য হাতের চাপ দিতেই স্ক্রিনটা ফ্রেমের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বাঁদিকে সরে গেল। এখন স্ক্রিনটা ফ্রেমের বাঁ দিকের কোনায় আটকানো রয়েছে। আর স্ক্রিনের পেছনে দেয়ালের বদলে দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট সেফের দরজা।

‘ফিরদৌস ঠিকই বলেছে। টিভিটাও তো একটা ছবি।’ আদিত্য বিড়বিড় করে বলল।

সমস্ত ব্যাপার দেখে চাকি একবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। সেফের গায়ে দু-টো চাবির গর্ত। তার হতভম্ভ ভাবটা কাটিয়ে এবার চাকি তার চাবির গোছা থেকে চাবি খোঁজার কাজে লেগে পড়ল। মিনিট পনেরো পরে যখন সে চাবি দিয়ে সেফটা খুলতে পারল তখন আদিত্য তার পেছনে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন সিগারেটে টান দিচ্ছে। সেফের ভেতরে কিছু দু-হাজার টাকার নোটের বান্ডিল। গুণে দেখা গেল মোট পঞ্চাশটা বান্ডিল। অর্থাৎ ঠিক এক কোটি টাকা!

 ‘সেফের পেছন দিকের বেশিরভাগ অংশটা আসলে বাইরে বেরোনো। সেটাকে ঢাকার জন্যে ওপরে উইন্ডো এসির খোলটা লাগানো ছিল। বাইরে থেকে দেখলে লোকে ভাববে এসি। আর ভেতরে সেফের মুখটা তো বিরাট টিভি স্ক্রিন দিয়ে ঢাকা।’ ঘণ্টা খানেক পরে আদিত্য গৌতমকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছিল।

‘এটা কিন্তু একটা ব্রেক থ্রু হল। আমরা এবার বটুক সামন্তকে চেপে ধরতে পারব। দেখা যাক ও কী করে এক কোটি টাকাটা এক্সপ্লেন করে।’ গৌতম তার চায়ের কাপে চুমুক লাগাল।

‘আমার কিন্তু অন্য একটা ইনফর্মেশন দরকার।’ আদিত্যও চায়ে চুমুক দিল। ‘তোর নিশ্চয় মনে আছে কিছুদিন আগে পল্লবী ভদ্র বলে একটি মেয়ে রাজারহাট নিউ টাউনে খুন হয়।’

‘তাকে ভোলার কোনও উপায় আছে নাকি? এখন অব্দি তো খুনি ধরা পড়েনি, তাই মিডিয়া রাতদিন আমাদের বাবা-মা তুলে খিস্তি করছে। এটা নিয়ে পলিটিকাল চাপও বাড়ছে। শিগগির কিছু একটা না করতে পারলে আমাদের সকলকে চাকরি-বাকরি ছেড়ে হিমালয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু, ওয়েট আ মিনিট। তুই হঠাৎ পল্লবী ভদ্রর কেসটাতে ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়লি কেন?’

‘কারণ আছে। বলছি। খুন হয়ে যাবার আগের দিন সন্ধেবেলা গোবিন্দ রায় আমাকে একটা দরকারি খবর দিয়েছিল। সেটা আমি তোর সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। গোবিন্দ বলেছিল, যেদিন কুমুদিনী রেড হয় তার আগের দিন বুটলেগার নাইট ক্লাবের মালিক পিটার অরোরা বটুক সামন্তর কাছ থেকে পাঁচশোর নোটে এক কোটি টাকা ক্যাশ নিয়েছিল। টাকাটা তার বেআইনি জুয়োর আড্ডাটা চালানোর জন্যে দরকার হয়েছিল। কথা হচ্ছে, টাকাটা গেল কোথায়? সেটা কি জুয়োর আড্ডায় কাজে লাগানো হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তা হলে টাকাটা পিটার অরোরার কাছে থাকার কথা। আমাদের মনে রাখতে হবে, পিটার অরোরা পল্লবীর সঙ্গে রাত্তির কাটাত। ফলে, এমন হতেই পারে, পিটার দিল্লি যাবার আগে টাকাটা পল্লবীর বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। যদি তাই হয়, তা হলে এই সম্ভবনাটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে ওই এক কোটি টাকার জন্যেই পল্লবী খুন হয়েছিল।’

গৌতম খুব মন দিয়ে আদিত্যর কথা শুনছিল। আদিত্যর কথা শেষ হয়ে যাবার পর সে খানিকক্ষণ চুপ করে ভাবল। তারপর বলল, ‘তুই যেটা বলছিস সেটা যদি ঘটে থাকে তা হলে আমাদের খোঁজ নিতে হবে কার কার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল যে ওই টাকাটা পল্লবীর বাড়িতে আছে।’

‘পিটার অরোরা যে টাকাটা নিচ্ছে সেটা গোবিন্দর মতো নিশ্চয় আরও কেউ কেউ লক্ষ করেছিল। বটুকের সেক্রেটারি শৌভিক নন্দও ব্যাপারটা জানত। ইন ফ্যাক্ট, শৌভিক নন্দর কাছ থেকেই গোবিন্দ পিটার অরোরার টাকা নেবার ব্যাপারটা জানে। কিন্তু টাকাটা পিটার তার বান্ধবী পল্লবীর বাড়িতে রেখেছিল, এটা জাস্ট একটা অনুমান। আচ্ছা, শৌভিক নন্দ কি এখনও তোদের কাস্টডিতে আছে?’

‘না। কুমুদিনী থেকে আমরা যাদের অ্যারেস্ট করেছিলাম তারা সকলেই বেলে ছাড়া পেয়ে গেছে। পুলিশ এখনও কারও বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করে উঠতে পারেনি। ফলে ওদের ছেড়ে দিতেই হত। তবে দরকার পড়লে এদের সকলকেই ইন্টারোগেশনের জন্যে আবার ডাকা যেতে পারে।’

‘ঠিক আছে, তোরা এই অ্যাঙ্গেলটা এক্সপ্লোর করে দ্যাখ। আমাকে শুধু পল্লবী ভদ্রর ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু বল।’

‘আসলে পল্লবী ভদ্রর খুনের ঘটনাটা বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের আওতায়। ওখানকার জয়েন্ট কমিশানার শার্দুল সিং কেসটা ইনভেস্টিগেট করছে। শার্দুল শুধু যে আমার ব্যাচমেট তাই নয়, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। কেসটার ব্যাপারে শার্দুল আমার সাহায্য চেয়েছে। তাই পল্লবী ভদ্রর সম্বন্ধে আমি খানিকটা জ্ঞান অর্জন করেছি।’

গৌতম টেবিলের ওপর রাখা বেলটা বাজাল। পরিচারক ঘরে ঢুকে সাড়া দেবার পর গৌতম তাকে বলল, ‘আর একবার চা দাও। আর সমীরবাবুকে আসতে বল।’

আদিত্য জানে, সমীরবাবু গৌতমের ব্যক্তিগত সচিব।

‘পল্লবী ভদ্রর ডোসিয়ারটা নিয়ে আসুন।’ সমীরবাবু ঘরে ঢুকতে গৌতম তাকে বলল।

একটু পরে পল্লবী ভদ্রর ফাইলটা থেকে চোখ তুলে গৌতম আদিত্যকে বলল, ‘পল্লবী ভদ্রর বাড়ি কলকাতায়, যাদবপুর ছাড়িয়ে একটা রিফিউজি কলোনিতে। ডাকনাম পলি। পরিচিতরা তাকে ওই নামেই ডাকে। পলির ঠাকুরদাদা দেশভাগের সময় উদ্বাস্তু হয়ে ওপার বাংলা থেকে চলে আসে। এখানে বাঘা যতীনের কাছে একটা মনিহারি দোকান খোলে। সেই দোকান এখন পলির দুই কাকা দেখাশোনা করে। পলির বাবা কিছুটা লেখাপড়া শিখেছিল। তার জোরে সে একটা সরকারি চাকরি পেয়ে যায়। ওই কলোনিতেই নিজে একটা বাড়ি করে পরিবারের থেকে আলাদা হয়ে যায়। পলির মা গৃহবধূ। পলিরা এক ভাই এক বোন। ভাই আর্মিতে চাকরি করে। বাবা-মা ভাই সকলেই বেঁচে আছে।

‘বয়ঃসন্ধি থেকেই পল্লবীর প্রচুর অ্যাডমায়ারার। প্রথমে যে কলোনিতে পলি বড় হয়েছে, সেখানে। পরে যে কলেজে সে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট পড়েছে সেখানে। কলেজ থেকে পাশ করে পলি কিছুদিন নয়ডার একটা হোটেলে চাকরি করেছিল। নয়ডার হোটেলের সহকর্মীরা পুলিশকে জানিয়েছে সেখানে একটি বাঙালি ছেলের সঙ্গে পলির সম্পর্ক হয়। ছেলেটি কলকাতার, নয়ডায় চাকরি করত। একটা সময় তারা বিয়েও করবে ভেবেছিল। তারপর ছেলেটি কলকাতায় চলে আসে। পলিকেও চলে আসতে বলে। ছেলেটি নাকি কলকাতায় পলির জন্যে একটা চাকরিও দেখে রেখেছিল। এর পরে আর ছেলেটির কোনও ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘পলির বাড়িতে কোনও সিসি টিভি ছিল? মানে, সেখানে কাউকে ঢুকতে বেরতে দেখা গেছে?’

‘না, সিসি টিভি ছিল না। বাড়িটা সবে হয়েছে। প্রোমোটার সিসি টিভি বসাব বসাব করে এখনও বসিয়ে উঠতে পারেনি। ঘটনার দিন সন্ধেবেলা সিকিউরিটির ছেলেটাও ছিল না। তার নাকি মা অসুস্থ বলে দেশের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। বাজে ফোন। ছেলেটা গিয়ে দেখে মা বহাল তবিয়তেই আছে। তবে সে যে সেই রাত্তিরে দেশের বাড়িতে ছিল তার একাধিক সাক্ষী আছে। সিকিউরিটি ছেলেটা বলছে পিটার অরোরা এবং দু-চারজন ফেরিওলা ছাড়া আর খুব বেশি লোক পলির ফ্ল্যাটে আসত না। শুধু একটি অল্পবয়সী ছেলে মাঝে মাঝে আসত, পলির সঙ্গে রাত্তির কাটাত। আমাদের ধারণা সে-ই পলির পুরোনো বয়ফ্রেন্ড।’

‘বুটলেগারের চাকরিটা পলি পেয়েছিল কী করে?’

‘ইন্টারভিউ দিয়ে। বুটলেগার খবর কাগজে চাকরি খালির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। পলি সেই বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লাই করেছিল। তার বাবা-মা আমাদের সেটাই বলেছে।’

‘পলি কেন নয়ডা থেকে ফিরে এল সে বিষয়ে তার বাবা-মা কিছু বলেছে?’

‘পলির বাবা-মা একটা অন্য গল্প বলছে। তারা বলছে, পলির নয়ডায় ভাল লাগছিল না তাই ফিরে এসেছিল। কোনও ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা পলির বাবা-মা জানে না। নয়ডা থেকে ফিরে এসে কিছুদিন পলি বাড়িতে বসে ছিল। তারপর ইন্টারভিঊ দিয়ে বুটলেগারের চাকরিটা পায়। এই চাকরিটা নেবার ব্যাপারে পলির বাবা-মার, বিশেষ করে বাবার খুব আপত্তি ছিল।’

‘বুটলেগার নাইটক্লাবে পলির কাজটা কী ছিল?’

‘ম্যানেজারের কাজ। নাইটক্লাবের সমস্ত কাজকর্মের ওপর সুপারভাইজ করার কাজ। তবে অ্যাকাউন্টস-এর দিকটা পলি দেখত না। তার দায়িত্ব ছিল জেনারেল হসপিটালিটি। গেস্টরা ঠিকমতো খাবার দাবার বা অন্যান্য ফেসিলিটিস পাচ্ছে কিনা বা তাদের অন্য কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা, এইসব দেখা। এই হসপিটালিটি নিয়েই তো পলি পড়াশোনা করেছিল।’

‘পিটার অরোরার সঙ্গে তার কবে থেকে ভাব হল?’

‘সঠিক সময়টা পুলিশ জানতে পারেনি। তবে এইটুকু জানা গেছে যে বুটলেগারে যোগ দেবার পর থেকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে পল্লবীর খিটিমিটি লেগে থাকত। কাজ সেরে তার ফিরতে রাত্তির দুটো-তিনটে হয়ে যেত। সেটা শুধু পল্লবীর বাবা-মা নয়, পাড়ার লোকেরাও ভাল চোখে দেখত না। ফলে কাজে যোগ দেবার মাস ছয়েক পরে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ওই সময় থেকেই পল্লবী রাজারহাটের ফ্ল্যাটটাতে থাকতে শুরু করে। ফ্ল্যাটটা তাকে পিটার অরোরাই ভাড়া করে দিয়েছিল। পুলিশকে পিটার বলেছে ফ্ল্যাটটা ছিল পল্লবীর কোয়ার্টার। তবে সেই কোয়ার্টারে যে পিটার নিজেও মাঝে মাঝে রাত কাটাত সেটা সে অস্বীকার করেনি।’

‘এই পিটার অরোরা সম্বন্ধে তোদের কী মত?’

‘দু-কান কাটা বদমাস। নেহাত খুনের সময়ে লোকটা দিল্লিতে ছিল বলে ওকে ফাঁসাতে পারছি না। তাছাড়া আপাতদৃষ্টিতে পল্লবীকে খুন করার মোটিভটাও লোকটার ছিল না।’

‘দিল্লিতে যে লোকটা ছিল তার সাক্ষী আছে নিশ্চয়।’

‘একটা নয়, অনেকগুলো সাক্ষী। লোকটা একটা বিয়ের পার্টি অ্যাটেণ্ড করতে দিল্লি গেছিল। রাত পর্যন্ত পার্টি করেছে। অনেকে তার সাক্ষী আছে। তারপর আরও কিছুদিন দিল্লিতে থেকে গিয়েছিল। তারও সাক্ষী আছে।’

‘পিটার অরোরার ফ্যামিলি নেই?’

‘বউ-এর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে ইউকে-তে। ছেলেটা মায়ের সঙ্গেই নিউ বালিগঞ্জে থাকে। এখনও বিয়ে করেনি।’

‘একটা জিনিস চেক করে আমায় বলতে পারবি? গোবিন্দ রায় আমাকে বলেছিল, কুমুদিনী রেড হবার আগের দিন পিটার অরোরা তার গ্যাম্বলিং জয়েন্ট-এর জন্য এক কোটি টাকা নিয়েছিল। এটা নিয়ে সে কী করেছে? খুব সম্ভবত টাকাটার কথা সে স্বীকার করবে না, কারণ টাকা এবং গ্যাম্বলিং জয়েন্ট দুটোই দুনম্বরী। তবু একবার জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে।’

‘ঠিক আছে। আমি জেনে তোকে জানিয়ে দেব।’

‘আমার আর একটা রিকোয়েস্ট আছে। দু-এক দিনের মধ্যে কয়েকটা জায়গায় গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। যাকে বলে ইন্টারোগেশন। আমি একা গেলে কেউ পাত্তাই দেবে না। তুই আমার সঙ্গে একটা পুলিশ দিতে পারবি?’

‘তুই চাকি ছেলেটাকে নিয়ে যা না। ও হয়তো মুখুটির মতো অতটা ব্রাইট নয়, কিন্তু খুব সিনসিয়ার। মুখুটি যে কবে নর্থ বেঙ্গল থেকে ফিরবে বুঝতে পারছি না।’

‘চাকিকে পেলে আমার খুব ভাল চলে যাবে। পুলিশের উর্দিপরা যে কেউ সঙ্গে থাকলেই চলত আর চাকিকে তো আমার বিশেষ করে পছন্দ। আজ বিকেলে একবার সিতারা হোটেলে যাব ভাবছিলাম। চাকিকে পাওয়া যাবে?’

‘আমি চেক করে এক্ষুনি বলে দিচ্ছি।’

‘আর একটা কথা। গোবিন্দ রায়ের মোবাইলের কলার লিস্টটা নিশ্চয় তোরা বার করবি। ওটা তৈরি হলে আমাকে একটু জানাস।’

সিতারা হোটেলের সামনে সন্ধেবেলায় খুব ভিড় থাকে। বলাই বাহুল্য, ভিড়টা সিতারা হোটেলে ঢোকার জন্যে নয়। হোটেলের মূল প্রবেশপথের দু-পাশে দুটো কাবাবের দোকান, ভিড়টা সেইখানে। দুটো দোকানের মধ্যে বেজায় কম্পিটিশন। কেউ কেউ বলে, কম্পিটিশনের কারণে দুটো দোকানই তাদের খাবারের মান বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ফলে খদ্দেররাও অত্যন্ত তৃপ্ত। আবার অন্য একদল বলে, দুটো দোকানের একই মালিক। কম্পিটিশনটা পুরোপুরি লোক দেখানো। সত্যিটা যাই হোক, বেশ কিছুদিন হল, দুটো দোকানের কাবাবের খ্যাতি সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছে।

আদিত্যর মনে হচ্ছে, এত দূর এসে এখানে কাবাব না খেলে নিজের প্রতি অন্যায় করা হবে। সে চাকিকে কাবাবের দোকানটা দেখিয়ে বলল, ‘কাজ শুরু করার আগে একটু টিপিন করে নিলে মন্দ হত না।’

গৌতম একটা পুলিশের জিপ ওদের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে। পুলিশের জিপের সুবিধে হল যেখানে সেখানে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। ওরা সেই সুযোগটা নিয়ে সিতারা হোটেলের ঠিক উল্টোদিকে জিপটাকে দাঁড় করিয়ে কাবাব খাচ্ছিল। অ্যাসর্টেড কাবাব, রেশমি, বোটি, টিক্কা, শামি, আর সনাতন শিক কাবাব। দোকানের ভেতরে বসার জায়গা নেই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাওয়া। আদিত্যর মনে হল, সে বহুদিন এত ভাল কাবাব খায়নি। হয়তো একটু খিদেও পেয়েছিল।

‘চাকি সাহেব, আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হয়নি।’ আদিত্য এক টুকরো রেশমি কাবাব মুখে চালান করে দিয়ে বলল।

‘আমার নাম স্যার সুব্রত চাকি। আমাকে সুব্রত বলবেন, আমি আপনার থেকে অনেক ছোট।’

আদিত্য চট করে কাউকে নাম ধরে ডাকতে পারে না। সে কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনার সার্ভিস কতদিন হল?’

‘আগামী সেপ্টেম্বরে তিন বছর পূর্ণ হবে স্যার।’

‘বাড়ি কত দূরে?’

‘মধ্যমগ্রামে বাবা বাড়ি করেছেন। আমরা দু-ভাই ওখানেই থাকি। দাদা ব্যাঙ্কে চাকরি করে। বাবা সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার্ড।’

সিতারা হোটেলের সেই বেয়ারাটি, যে সেই রাত্তিরে রিসেপশনে ছিল, কোনও কাজে হোটেলের বাইরে এসেছিল। সে ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। আদিত্যর মনে পড়ে গেল ওর নাম রহমান।

‘আপ লোগ অন্দর আয়েঙ্গে সাব?’ রহমান সসম্ভ্রমে বলল। তারপর ওদের খাওয়া শেষ হয়নি দেখে মৃদুস্বরে বলল, ‘বহুত বড়িয়াঁ কাবাব হ্যায় সাব। এয়সা কাবাব আপকো সারে কলকাত্তে মে কঁহি নেহি মিলেগা।’

‘ম্যানেজার সাহেব এসেছেন? সফিকুল সাহেব? ওর সঙ্গে আগে কথা বলব।’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘ম্যানেজার সাব অন্দর অফিস মে হ্যায়। ম্যায় উনকো যাকে বাতাউঁ কি আপ লোগ আয়ে হ্যাঁয়?’

‘ঠিক আছে। তুমি গিয়ে ম্যানেজারকে খবর দাও। আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’ চাকি পুলিশি গলায় বলল।

খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আদিত্য বিল মেটাচ্ছে দেখে চাকিও পকেটে হাত ঢুকিয়েছে। ‘একদম নয়, একদম নয়। এই কাবাব খাবার প্রস্তাবটা আমার ছিল।’ আদিত্য জোর গলায় বলল।

চাকি আর খুব বেশি জোরাজুরির মধ্যে গেল না। শুধু একটু কুণ্ঠিত গলায় বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।’

ম্যানেজার সফিকুল ইসলাম খবর পেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। ‘ভেতরে যাবেন তো স্যার?’ সে বিনীতভাবে বলল।

‘দু-একজনের সঙ্গে একটু কথা বলব। আপনার ঘরটা ব্যবহার করা যাবে?’ আদিত্য কেজো গলায় বলল।

‘নিশ্চয় যাবে স্যার। অবশ্যই যাবে। আপনারা চলুন আমার ঘরে গিয়ে বসবেন।’

ম্যানেজারের ঘরটা একতলাতেই। রিসেপশনের সামনে দিয়ে যেতে হয়। আদিত্য লক্ষ করল রিসেপশনে সেই রঞ্জিত বলে ছেলেটা বসে আছে। মনে হয় আদিত্যকে চিনতে পেরেছে। তাকে দেখে মলিন হাসল। দু-একজন বোর্ডার ইউনিফর্ম পরা চাকিকে দেখে ভুরু কোঁচকাচ্ছে।

সফিকুলের ঘরটা খুব বড় নয়। তার মধ্যেই একদিকে একটা সোফা সেট। সফিকুল আদিত্যদের সোফায় বসাল। বলল, ‘একটু চা খাবেন স্যার?’

চাকি আদিত্যর দিকে তাকিয়েছে। আদিত্যর মনে হল চাকির একটু চা খাবার ইচ্ছে। ‘চা একটু খেলে হয়। তবে আমারটা দুধ-চিনি ছাড়া।’ আদিত্য ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলল।

‘আমারটা কিন্তু দুধ, চিনি সব দিয়ে।’ চাকি তার পছন্দটা জানাতেই ম্যানেজার তার টেবিলের ওপরে রাখা বেলটা বাজাল। বলল, ‘প্রথমে কার সঙ্গে কথা বলবেন স্যার?’

‘প্রথমে সেই সিকিউরিটির সঙ্গে কথা বলব যে সেই রাত্তিরে গেটে ছিল। সে কি এখন এখানে আছে?’

‘ওর তো স্যার নাইট ডিউটি। এখনও বোধহয় এসে পৌঁছয়নি। অন্যদের সঙ্গে বরং আগে কথা বলে নিন। কথা বলতে বলতে ও এসে যাবে।’

‘তাহলে চারতলায় যে বেয়ারা সেই রাত্তিরে ডিউটি করেছিল তাকে ডাকুন।’

ইতিমধ্যে বেলের ডাকে সাড়া দিয়ে লাল কোট পরা একজন বেয়ারা ঘরে ঢুকেছে। ‘চারতলায় তোমাদের কে রাত্তিরে ডিউটি করে? রমেশ করে না?’ সফিকুল তাকে জিজ্ঞেস করল।

‘জি সাব। রমেশ করে চারতলায় আর কালীচরণ করে তিনতলায়।’

‘রমেশকে পাঠিয়ে দাও। রমেশ এসেছে তো?’

‘জি সাব।’

রমেশ নামধারী ব্যক্তিটি কৃষ্ণবর্ণ, খর্বকায়, বিশেষত্বহীন একজন নেই হয়ে থাকা মানুষ। চেহারা দেখে মনে হয় অবাঙালি, কিন্তু বাংলা বলে চমৎকার।

‘আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?’ সে সফিকুলের দিকে তাকিয়ে বলল।

‘তোমাকে আমরা ডেকেছিলাম। কিছুদিন আগে চারশো বারো নম্বর ঘরে যে খুনটা হয়ে গেছে সেই ব্যাপারে দু-একটা প্রশ্ন করব।’ চাকি গম্ভীর গলায় বলল।

রমেশকে খানিকটা উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে। সে আদিত্যদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছে।

‘তোমার পুরো নাম।’

‘রমেশ পাসোয়ান, সাব।’

‘কতদিন এই হোটেলে কাজ করছ?’

‘দশ বছর হয়ে গেছে, সাব।’

‘যে রাত্তিরে চারশো বারো নম্বর ঘরে খুনটা হয় সেই রাত্তিরে তুমি চারতলায় ডিউটি করেছিলে?’

‘হ্যাঁ, সাব।’

‘কতক্ষণ তোমার ডিউটি?’

‘বেলা বারোটা থেকে রাত্তির বারোটা, সাব।’

‘সেদিন রাত্তিরে তুমি কোনও সন্দেহজনক শব্দ শুনেছিলে?’

‘আমি তো সাব চারতলায় ছিলাম না। একতলায় বেয়ারাদের ঘরে ছিলাম। এটাই এখানকার নিয়ম। চারতলার ডিউটি ছিল মানে, চারতলা থেকে রুম সার্ভিসে কেউ কিছু চাইলে আমার দায়িত্ব ছিল সেই ঘরে জিনিসটা পৌঁছে দেওয়া।’

‘সেই রাত্তিরে চারশো বারো নম্বরে কিছু পৌঁছে দিয়েছিলে?’

‘চারশো বারো নম্বরের সাহেব তো খাবার জন্য ডাইনিং হলে নামতেন না। ঘরে খাবার আনিয়ে নিতেন। সেই রাত্তিরেও আমি ন-টা নাগাদ সাহেবের ঘরে ডিনার পৌঁছে দিয়েছিলাম। পৌনে দশটা নাগাদ সাহেবের ঘর থেকে এঁটো প্লেটগুলো নিয়ে এসেছিলাম।’

‘সাহেবকে তখন কেমন দেখেছিলে?’

‘অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। আমি যখন এঁটো প্লেটগুলো নিয়ে আসতে সাহেবের ঘরে ঢুকেছিলাম, সাহেব তখন টিভি দেখছিলেন।’

এতক্ষণ চাকিই প্রশ্ন করছিল। এবার সে আদিত্যর দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি এবার জিজ্ঞেস করুন স্যার।’

‘আচ্ছা রমেশ, চারশো বারো নম্বরের সাহেব যেদিন হোটেলে চেক ইন করলেন সেদিন কি তুমি ওঁর লাগেজগুলো ঘরে নিয়ে এসেছিলে?’

‘সাহেব বেলা বারোটার একটু পরে চেক ইন করেছিলেন। আমিই ওর লাগেজ বয়ে এনেছিলাম।’

‘কী কী লাগেজ সাহেবের সঙ্গে ছিল তোমার মনে আছে?’

‘এমনিতে মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু একটা কারণে মনে আছে। সাহেবের সঙ্গে একটা সুটকেস ছিল আর একটা ব্যাগ। আমি দুটোই নিতে যাচ্ছিলাম। সাহেব বললেন ব্যাগে যেন আমি হাত না লাগাই। ওটা সাহেব নিজেই নিলেন। ব্যাগটা মনে হয় বেশ ভারী ছিল। ব্যাগের ভারে সাহেব একদিকে ঝুঁকে যাচ্ছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন অত ভারী ব্যাগটা সাহেব নিজে নিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা আমার আশ্চর্য লেগেছিল বলে মনে আছে।’

‘বেশ, বেশ। তুমি তো চারতলায় ডিউটি করতে। সাহেবের ঘরে কখনও কোনও ভিজিটার আসতে দেখেছো?’

‘একজন ভিজিটর তো রোজই আসত। এসে অনেকক্ষণ থাকত। মনে হয় সে সাহেবের কোনও অ্যাসিস্টেন্ট হবে। সাহেব নিজে ঘর থেকে বেরোতেন না। মনে হয় ওই অ্যাসিস্টেন্ট ছেলেটা সাহেবের বাইরের কাজগুলো করে দিত। এছাড়া আর কাউকে চারতলায় দেখিনি। তিনতলায় সাহেব আরেকটা ঘর নেবার পর সেখানে নাকি কিছু ভিজিটার আসত। একথা কালীচরণ আমাকে বলেছে। পুলিশকেও বলেছে। কালীচরণ তিনতলায় ডিউটি করে। ও দেখেছে। আমি নিজের চোখে দেখিনি।’

‘হোটেলের কোনও গেস্টকে কখনও সাহেবের ঘরে আসতে দেখেছ?’

‘আপনি জিজ্ঞেস করতে এখন মনে পড়ছে সাব। তিনশো এক নম্বর ঘরের সাহেবকে একবার চারশো বারো নম্বরে দেখেছিলাম। ওরা দুজনে ড্রিঙ্ক করছিলেন। চারশো বারোর সাহেব আমাকে টাকা দিয়ে বললেন সামনের দোকান থেকে কাবাব নিয়ে এসো। আমি ওদের কাবাব এনে দিলাম। ওরা নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা করছিলেন। যেমন বন্ধুরা করে।’

‘ওই একদিনই কি তিনশো এক নম্বর ঘরের সাহেবকে চারশো বারো নম্বরে দেখেছিলে?’

‘ওই একদিনই দেখেছিলাম সাব।’

‘আচ্ছা রমেশ, চারশো বারো নম্বরের সাহেব কখনও বাইরে বেরোতেন?’

‘খুব একটা বেরোতেন না সাব। খাবার তো ঘরেই খেতেন। খুব মাঝে মাঝে একবার-দুবার বেরিয়েছেন। তার মধ্যে একবার ভোরবেলা বেরিয়ে গেলেন। রাত্তিরে ফেরেননি, বাইরে কোথাও ছিলেন। ডিনার খাননি। পরের দিন দুপুরে হোটেলে ফিরে আমাকে লাঞ্চ আনতে বললেন।’

‘সেটা ঠিক কবে তোমার মনে আছে?’

‘ঠিক মনে নেই সাব। সাহেব খুন হবার মোটামুটি তিন-চার দিন আগে হবে।’

‘আর আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। ঠিক আছে রমেশ, তুমি এখন আসতে পার।’

রমেশ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে আদিত্য ম্যানেজারকে বলল, ‘আপনি একটু দেখুন খুনের সময় তিনশো এক নম্বর ঘরে কে ছিলেন? তিনি এখনও সেখানে আছেন কিনা। আর না থাকলে কবে চেক আউট করেছেন।’

‘আমি এক্ষুনি দেখে বলে দিচ্ছি স্যার।’ ম্যানেজার তার টেবিলের পাশে রাখা কম্পিউটারে মন দিল। একটু পরে সে কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে বলল, ‘তিনশো এক-এর বোর্ডারের নাম এক্রামুল হক। ঠিকানা, বহরমপুর, মুরশিদাবাদ। পেশায় ব্যবসায়ী। আমাদের হোটেলে চেক ইন করেছিল ২০শে ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ ফিরদৌস রহমান চেক ইন করার চোদ্দো দিন পরে। চেক আউট করেছে ৬ই মার্চ, মানে ফিরদৌস রহমান খুন হবার দুদিন পরে।’

‘আপনি এক্রামুল হকের ডিটেলটার একটা প্রিন্ট আউট দেবেন? তাহলে চাকি সাহেব লোকটার খোঁজ-খবর নিতে পারবেন। আর হ্যাঁ, লোকটা একটা আইডেন্টিটি প্রূফ দিয়েছিল নিশ্চয়?’

‘হ্যাঁ। আধার কার্ডের জেরক্স দিয়েছিল।’

‘ওটারও একটা ফটোকপি দেবেন।’

‘নিশ্চয় স্যার।’

‘এবার দেখুন তো সেই সিকিউরিটির লোকটি এসেছে কিনা।’

 সিকিউরিটির লোকটি মধ্যবয়স্ক, স্বাস্থ্যবান ও স্বল্পভাষী। চাকি এবং আদিত্যর প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল তার নাম আবদুর রফিক। সে রোজ রাত আটটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা অব্দি ডিউটি করে। সে কখনও রাত্তিরে ঘুমোয় না, খুনের রাত্তিরেও ঘুমোয়নি। তাছাড়া খুনের রাত্তিরে ঘুমোনো সম্ভব ছিল না কারণ পাশের গলিতে সারা রাত্তির হোলির গান চলছিল। প্রচণ্ড হল্লা হচ্ছিল। হোলি শেষ হয়ে যাবার পর একমাস অব্দি এইরকম হল্লা চলে। অত হল্লা হলে কেউ ঘুমোতে পারে?

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রোহিত ধামানির অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। শেক্সপিয়ার সরণির ওপরে রোহিত ধামানির জুয়েলারি শপ, তারই দোতলায় অফিস। টেলিফোনে রোহিত ধামানি বলেছিল সে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে অফিস পৌঁছে যায়, আদিত্য যেন নটার মধ্যে চলে আসে। সে ব্যস্ত লোক, আদিত্যকে পনেরো-কুড়ি মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবে না। ঠিক দশটায় তার দোকান খুলে যায়, সাড়ে ন-টা থেকে কর্মচারীরা আসতে শুরু করে। অতএব সাড়ে ন-টার আগেই আদিত্যকে তার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে ফেলতে হবে। গৌতম নাক না গলালে রোহিত ধামানির অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াই যেত না।

রোহিত ধামানির প্রোডাকশান হাউস সম্বন্ধে আদিত্য আগেই কিছু তথ্য জোগাড় করেছিল, এবার ইন্টারনেট ঘেঁটে তার পারিবারিক ইতিহাসও কিছু জানতে পেরেছে। ধামানিরা তিন পুরুষ ধরে কলকাতার বাসিন্দা। রোহিত ধামানির ঠাকুরদাদা শ্যামদাস ধামানি সামান্য পুঁজি সম্বল করে রাজস্থান থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন, তারপর নিজের চেষ্টায় বউবাজারে একটা সোনা-রুপোর দোকান খুলেছিলেন। সেই ব্যবসাকে অনেকটা বাড়াতে পেরেছিলেন রোহিতের বাবা, গণেশ ধামানি। তিনি ছিলেন তাঁর বাবার একমাত্র ছেলে, তাই বাবার ব্যবসার ভাগ কাউকে দিতে হয়নি। থিয়েটার রোডের এই দোকানটা তাঁর আমলেই হয়েছিল। রোহিতও তার বাবার একমাত্র ছেলে, কাজেই এই দোকানটাকে সে পুরোপুরি নিজের মতো করে বড় করতে পেরেছে এবং তার ব্যবসাটাকে সে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিতে পেরেছে। এখন তার মূল ব্যবসা বিদেশ থেকে না-কাটা হিরে কিনে সেগুলো কেটে এবং পালিশ করে আবার বিদেশে বিক্রি করা। এর পাশাপাশি কলকাতার দোকানটা ছাড়াও শিলিগুড়ি, গৌহাটি এবং পাটনায় তার আরও তিনটে দোকান আছে। সিনেমা প্রোডাকশানেও তার অনেকদিন হয়ে গেল।

‘এই ‘ফেরারি’ সিনেমাটা প্রোডিউস করতে গিয়ে আমি একেবারে ফেঁসে গেছি। শুরুতে প্রজেক্টটা খুব অ্যামবিশাস ছিল। তারপর টাকা-পয়সা শর্ট পড়ে গেল। আমার কিছু বিজনেস ভেঞ্চার ব্যাড হয়ে গেল। বটুকবাবু কিছু ফিনান্স করবেন বলেছিলেন। তারও অসুবিধা হয়ে গেল। এখন কোনওরকমে প্রজেক্টটা শেষ করতে পারলে বেঁচে যাই।’ রোহিত ধামানি তার নতুন প্রোডাকশানের কথা বলছিল। তার বাংলাটা প্রায় বাঙালিদের মতো।

‘বটুকবাবু তো আগে আপনাদের কিছু ফিল্ম ফাইনান্স করেছেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘নিশ্চয় করেছেন। অনেকবার করেছেন। বটুকবাবুর সঙ্গে আমার বিশ বছরের বিজনেস রিলেশান। কিন্তু এবার উনি কী করে হেল্প করবেন? আপনাদের পুলিশ তো ওর ব্যবসার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।’ রোহিত ধামানি নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাল।

‘আমি কিন্তু পুলিশের লোক নই, মিস্টার ধামানি। তাছাড়া আমি তো প্রথমেই বলেছি বটুকবাবুর ব্যবসা নিয়ে আমার ইনভেস্টিগেশন নয়। বটুকবাবুর একজন এমপ্লয়ি, নাম ফিরদৌস রহমান, খুন হয়েছে। আমি সেটা ইনভেস্টিগেট করছি। আপনি কি ফিরদৌসকে চিনতেন?’

‘চিনতাম। ফিরদৌস বটুকবাবুর কাজ নিয়ে মাঝে মাঝে আসত। বটুকবাবু ওঁকে খুব বিশ্বাস করত। এর বেশি আর কিছু জানি না।’ রোহিত ধামানি আবার ঘড়ির দিকে তাকাল।

‘আচ্ছা, অন্য একটা প্রশ্ন করছি। সুমনা ঘোষালকে আপনি কতদিন চেনেন?’ আদিত্য ঘড়ি দেখার ইঙ্গিতটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রশ্ন করল।

রোহিত ধামানি এবার সত্যিই অবাক হয়েছে। সে অবাক হয়ে বলল, ‘সুমনা ঘোষালের সঙ্গে ফিরদৌসের কী কানেকশান আছে? এটা কেন জিজ্ঞেস করছেন?’

‘একটা রিমোট কানেকশন থাকতে পারে। দেখুন, সুমনা ঘোষালের সঙ্গে বটুকবাবুর কানেকশান আছে আর বটুকবাবুর সঙ্গে ফিরদৌসের। তাই জিজ্ঞেস করছি।’

‘ভাল বুঝলাম না। যাই হোক, সুমনাকে আমি অনেকদিন চিনি। ও অনেকবার আমার প্রোডাকশানে কাজ করেছে। শি অয়াজ আ গুড অ্যাকট্রেস, দো অফ দ্য ওল্ড টাইপ। ওরকম অ্যাক্টিং এখন আর চলে না।’

‘তাহলে আপনার সঙ্গে সুমনা ঘোষালের শুধুই একটা প্রোফেশানাল বিজনেস রিলেশান ছিল?’

রোহিত ধামানি রেগে উঠতে গিয়ে হেসে ফেলল। বলল, ‘আদিত্যবাবু আপনি কিন্তু মিশ্চিভিয়াস আছেন। দ্য হোল ওয়ার্ল নোজ যে এক সময় আমার সঙ্গে সুমনার একটা সম্পর্ক ছিল। ইন ফ্যাক্ট উই ইউসড লিভ টুগেদার। আমার একটা ফ্ল্যাটে সুমনা থাকত। তারপর নানা কারণে উই ব্রোক অফ।’

‘এখনও কি আপনার সঙ্গে সুমনা ঘোষালের যোগাযোগ আছে?’

‘দেখুন আদিত্যবাবু, উই ব্রোক অফ উইদাউট এনি বিটারনেস। তাই যোগাযোগ এখনও আছে।’

‘আপনিই তো ওর ছেলেকে চাকরি দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, দিয়েছি। আমার মনে হয়, একটা সময় আই হ্যাড ডাম্পড সুমনা। তাই একটা কিছু ওর জন্যে করতেই হত। আমারও তো একটা বিবেক আছে। তবে রনি টার্নড আউট টু বি আ ভেরি ফাইন ল্যাড অ্যান্ড আ সিন্সিয়ার ওয়ার্কার। আমার প্রোডাকশান হাউসে ও কিন্তু নিজের কাজ দেখিয়েই উন্নতি করেছে।’

রোহিত ধামানি উঠে দাঁড়াল। আদিত্য বুঝল এর পর আর কথাবার্তা চালানো যাবে না।

রোহিত ধামানির অফিস থেকে বেরিয়ে আদিত্য সবে রাস্তায় পা রেখেছে এমন সময় সে লক্ষ করল আর একটা দরজা দিয়ে রনি ঘোষাল বেরোচ্ছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। আদিত্যকে দেখে রনি এগিয়ে এল।

‘আরে আদিত্যবাবু যে। এখানে কাজে এসেছিলেন?’ আদিত্য রনির গলায় উষ্ণতা টের পেল।

‘আপনার বসের কাছ থেকে অতি কষ্টে একটা পনেরো মিনিটের ইন্টারভিউ আদায় করতে পেরেছিলাম। কার্যত দেখা গেল সাত-আট মিনিটেই ইন্টারভিউ শেষ। আপনাদের নিউ এজ মুভিজ-এর আপিসটাও কি এখানে?’

‘না, না। আমাদের আপিস টালিগঞ্জে। তবে অ্যাকাউন্টস-এর কাজ সব এখানে হয়। তাই মাঝে মাঝে এই আপিসটাতে আসতেই হয়।’

দুজনে শেক্সপিয়ার সরণি ধরে বিড়লা প্ল্যানেটরিয়ামের দিকে হাঁটছে। আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোনদিকে যাবেন?’

‘আমি মেট্রো ধরব। টালিগঞ্জে আমাদের অফিসে যাব। আপনি?’

‘আমিও মেট্রো ধরব। তবে উল্টোদিকে। বউবাজারে আমার আপিসে ফিরব।’

কিছুক্ষণ দুজনে নীরবে হাঁটল। অ্যাসটর হোটেলের উল্টোদিকে একটা চায়ের দোকান। ফুটপাথেরই দোকান কিন্তু বেজায় ভিড়। এখানকার মশলা চা নাকি এতই বিখ্যাত যে গাড়ি করে লোক এখানে চা খেতে আসে। রাস্তার ধারে সত্যিই অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য বলল, ‘চা খাবেন নাকি? সময় হবে?’

রনি ঘোষাল ঘড়ি দেখল। বলল, ‘আমাকে এগারোটার মধ্যে অফিসে পৌঁছতে হবে। একজন এসে বসে থাকবে। তবে চা একটা খাওয়াই যায়।’

‘আপনাদের ‘ফেরারি’ সিনেমার শুটিং কেমন চলছে?’ কিছুক্ষণ পরে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক লাগিয়ে আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘চলছে একরকম। তবে ছবির নাম বদলেছে। এখন ছবির নাম হয়েছে ‘মায়ের স্বপ্ন’। গল্পও বদলেছে। সব প্রোডাকশানেই টুকটাক ঝামেলা লেগে থাকে। এটাতেও আছে। তার ওপর এই ছবির যিনি নায়িকা সেই মধুশ্রী চ্যাটার্জীর মেজাজ তো সব সময় সপ্তমে চড়ে আছে। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে নেই। সব ঝামেলা এই প্রোডাকশান ম্যানেজারকেই সামলাতে হয়। নামেই প্রোডাকশান ম্যানেজার, আসলে গোমস্তার কাজ। এত অপমান মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।’ রনির গলাটা হঠাৎ খুব তিক্ত শোনাল।

‘রণপ্রিয়বাবু, চাকরি মানেই পরের দাসত্ব, আর দাসত্ব মানেই অপমান। আমিও নানারকম চাকরি করে দেখেছি। অপমান সব চাকরিতেই আছে। সেদিক থেকে আপনার সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা মিলে যাচ্ছে।’ আদিত্য বন্ধুত্বের গলায় বলল। ‘তাই তো আমি চাকরি ছেড়ে এখন স্বাধীন ব্যবসা করছি।’ আদিত্য মৃদু হাসল।

‘আপনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার মিল থাকলেও, আপনার সঙ্গে আমার অনেক তফাত আদিত্যবাবু। আপনি বনেদি ঘরের মানুষ, সমাজের ওপরের তলায় আপনার অনেক যোগাযোগ। আর আমি পিতৃ-পরিচয়হীন এক ব্যক্তি, যার মায়ের পরিচয়টাও বুক ফুলিয়ে বলার মতো কিছু নয়। তাই আমাকে একটু-আধটু অপমান সহ্য করে চাকরিটা চালিয়ে যেতেই হবে।’ রনি ঘোষাল দাঁতে দাঁত চেপে বলল।

আদিত্য মাথা নিচু করে রয়েছে। তার মনে হচ্ছে অনিচ্ছাকৃতভাবে সে রনি ঘোষালের মনের গভীরে আঘাত করে ফেলেছে। সে বলল, ‘আমি যদি ভুল করে আপনাকে আঘাত করে ফেলে থাকি তার জন্য ক্ষমা চাইছি।’

‘না, না। আপনি তেমন কিছুই বলেননি। এটা আমারই একটা ইনসিকিওরিটি বলতে পারেন। চলুন, পা চালানো যাক। আমার একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ রনি ঘোষাল স্বাভাবিক গলায় বলল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন