সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক – ১৬

আশাপূর্ণা দেবী

।। ষোল।।

তারকের মা কপালে হাত দিয়ে বলে উঠল—তুই যে আমায় তাজ্জব করে দিলি রে তারক। অ্যা। বড় খোকা আমাদের ঘরে গে রয়েচে?

তারক গলা নামিয়ে বলে, আস্তে বাবা আস্তে। তো এখনো পর্যন্ত তো রয়েচে, আর ক’দিন আটকে রাখতে পারবো, ভগবানই জানে। মাথার ঘা তো সেরে গেছে দেখা যাচ্ছে

আহা! ভগবান ভালো রাখুক। তো সারলো কিসে? ডাক্তার দেখালি?

দূর কোথায় ডাক্তার? জ্যাঠা জবরদস্তি করল কী একটা শেকড়বাকড় ছ্যাঁচা রস নিয়ে, তো বড়দাবাবু হেসে বলল, আচ্ছা দাও! দেখি মৃত্যুটা কোনদিক দিয়ে আসে।…তো জ্যাঠা বলল, মিত্যু হতে যাবে কেন? এ তো কোবরেজি গাছড়া। আমাদের গা-গঞ্জে ক’জনা আর সামান্যর জন্যে ডাক্তার বদ্যি করতে পারে বাবু? এইসব দিয়েই দিন চালানো। তো সত্যি বলতে সেরেও তো গেল। বড়দাবাবু বলল, ভালোই হলো রে তারক আমার একটা শিক্ষা হলো। ভাবছি আর শহরে বাজারে নয়, অনেক দূরে চলে যাবো। গরীব-দুঃখী আদিবাসী-টাসীদের সঙ্গে মিশে দেশটাকে ভালো করে চেনা করবো। তো হয়তো এইভাবেই কতকিছু শিখতে পারব, জানতে পারব!’

তা হ্যাঁরে তারক, খোকার মতলবটা কী? আর ঘরে ফিরবে না?

কী জানি? এখন তো তাই মনে হচ্ছে।

আর তুই?

আমার আর নতুন কী? মুনিব যেখানে, নফর সেখানে!

কী?

হঠাৎ ফস করে যেন আগুনের মতো জ্বলে ওঠে তারকের মা, এ তো আচ্চা জুলুম। মুনিবের পায়ে দাসখৎ নিকে দিয়েচিস না কি?

তারকও উষ্ণ হয়। বলে, কোথায় কী লিকে দিয়েচি, সেকথা থাক। জুলুম’ বলছিস ক্যানো? বড়দা আমায় জুলুম করে সঙ্গে নে এসেচে? আমি বলে হত্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে তাকে বার করিচি!

তো ওই মানুষ যদি চেরজম্মো বাউণ্ডুলে হয়ে বেড়ায় তুইও তাই বেড়াবি?

তারক দু’হাত উল্টে নিরুপায়ের ভঙ্গি করে বলে, অগত্যে।

তারকের মা আরো রেগে গিয়ে বলে, ক্যানো? তুই তার ‘বে করা পরিবার’? তাই রণে বনে অরণ্যে তার সাতে গাঁটছড়া বেঁদে ঘুরতে হবে?

মার এই রাগ দেখে আর তুলনা শুনে তারক হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর বলে, এ তো আবার আর এক মজার কথা বললি মা! এখনকার কালে কী আর ‘বে করা পরিবারই’ তাই থাকে? ‘ভালো লাগলো রইলুম, ভাল্‌না লাগলো ছাড়লুম’ এই তো ধারা এখোন।

তারপর একটু আস্তে বলে, বড়দাবাবু একখানা মহোৎ মানুষ মা। উনার সেবা করতে গেলেও তারক হতভাগা মানুষ গৎরে যাবে। তবে মদিগতি বুঝি না। মাঝেমদ্যে ভয় হয় সাধু সন্নিসি হয়ে যাবে না তো?

তারকের মা পরিতাপের গলায় বলে, কি জানি। প্রেথম থেকে মা-বাপ শক্ত হাতে রাশ টানেনি বলেই এমনটা হয়ে পড়েচে রে তারক। সময়ে জোর করে বে থা দিলে বদলে যেতো!

নদের নিমাইয়ের তো বে হয়েছিল গো মা। হয় নাই? আর সেই বুদ্ধদেবের? ও কোনো কাজের কথা না তবে আসলে কী হয়েচে জানিস? যাদেরকে বিশ্বাস করে জীবনটাকে বিকিয়ে বসেছিল, হঠাৎ যেন দেকতে পেয়ে গেচে তাদের মদ্যে সব ভ্যাজালের কারবার! তার সাক্ষী এই তোর মুনিব! ভোটে জিতে বাবুর এখনো কী নম্বা চওড়া দেকচিস তো? নবাব না বাদশা, এই ভাব। আর এই হতভাগা ছেলেগুনান? মা হাতে করে একখানা সন্দেশ দিতে এলে খেতোনি। বলতো, ওসব বড়মানুষদের জন্যি। পুজোয় একটা ভালো পোশাকও নিতো না। ‘দেশের লোক’ গরীব। আমাদেরও গরীবী চালে থাকা দরকার।’ অথচো ওদিকে—

তারকের মা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তা দেকচি বটে। বাবুয়ানার শেষ নাই। অ্যাখোন আবার গিন্নীর জন্যে আলাদা একখান গাড়ি, ইচ্চে মতন বেড়াবে বলে।

তাহলেই বোঝ। যাক, এখনি চলি। নেহাৎ একবার তোর সঙ্গে দেকা না করে গেলে হাঁপিয়ে মরবি—তাই!

তারকের মা হঠাৎ ছেলের কাঁধটা প্রায় খামচে ধরে বলে ওঠে, তারক রে, তুই এই অভাগা মুখ্যু মায়ের মুখ্যু ছেলে, তবু তোর ভেতরে এই বিবেচনা রয়েচে, আর বড়খোকা বিদ্বান, বুদ্ধিমান হয়ে বাপ-মায়ের প্রাণটা বিবেচনা করচে না? বাপ যে ছেলে নিরুদ্দিশ হয়ে গেছে শুনে মরতে পড়েচে, খবর তো তোরই কাচে?

তারক একটু অসহায়ভাবে বলে, বিদ্বান পণ্ডিতদের মন বোধহয় শক্ত! কড়া হুকুম, যেন উনি কোথায় আচে ফাঁস না করি।

তুই চুপিচাপি একটা খবর দিয়ে দে না বাবা? তাতে তোর পুণ্যি বৈ পাপ হবে না! অন্ততো ছেলেটা বেঁচে আচে, ভালো আচে জানতে পারলেও—

হঠাৎ চোখটা আঁচলে মুছে বলে, অনেকদিন ওদের নেমক খেয়েছিলুম রে তারক, এখনো ওদের তরে প্রাণটা কাঁদে!

তারক আস্তে বলে, আচ্চা দেকি?

সেই প্রতিশ্রুতির ফলশ্রুতিতেই সেই পোস্টকার্ড! তাও তারক বুদ্ধি করে তাদের গাঁ থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে চিঠিটা অন্য গ্রাম থেকে পোস্ট করেছিল। যদিও অতো কষ্ট না করলেও চলতো।

গমনোদ্যত তারককে মা আবার আটকায়, তা হ্যাঁরে, আমাদের মতন ঘরে বড়খোকা খায় কী?

কী আবার? জ্যেঠি যা রাঁধে। আমাদের মতনই মোটা চালের ভাত, আস্ত কলাইয়ের ডাল, আবোড় জাবোড় চচ্চড়ি। আমি তো সে জিনিস মুখে তুলতে পারিনে। ওই কুচোকাচা যা মাচ আনে জ্যাঠা পুকুরে গামচা ছ্যাঁকা দিয়ে, তাই দিয়েই–তো বড়দাবাবু আমার কুচো মাচও খেতে পারে না। তো জ্যেঠির সেই ঢঙিনী ভাইঝিটা মাঝেমধ্যে কলকেতার বাজার থেকে বাঁদাকপি নিয়ে আসে। বড় আলু নে আসে! বলে, “মুনিবরা তাকে খেতে দেচে।’ আমি বিশ্বাস করি না।

এই মরেচে। তার আবার অ্যাতে দরদ ক্যানো?

তারক অবজ্ঞাভরে বলে, ঢঙিনীদের যা স্বভাব। বয়েসের পুরুষ বেটাছেলে দেকলেই মন উসখুশ করে।

দেকিস বাবা সাবধান।

তারক আর একবার হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, মা রে, যে আদিখ্যেতায় নন্দীভৃঙ্গীকে কাৎ করতে পারল না তাতে মহাদেব কাৎ হবে?

তারকের মা চিন্তিত আর সন্দিগ্ধ গলায় বলে, তাও জগতে ঘটে রে তারক। নন্দীভৃঙ্গী তো পাকা পক্কান্ন। সব বোজে। কে কী চীজ চেনে। ভোলানাত মহাদেব যে সরল সিদে।

দূর। ওসব চিন্তে ছাড়। বললুম শীগগিরই চলে যাচ্ছি।

কোতায় যাবি বাবা তারক?

এখনো তো মনস্থির করে নাই। কখনো বলে বাঁকড়ো পুরুলিয়ার দিকে চলে যাবে, কখনো বলে সুন্দরবনের দিকে যাবে।

অ তারক। তাহলে আমি তোর খপর পাবো কী করে বাপ?

তারক আশ্বাসের গলায় বলে, পৃথিবীর বাইরে চলে না গেলে, যে করে হোক খবর একটা করবই তোর। নিশ্চিন্দি থাকিস।

.

এখন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে হয় না তারকের মাকে, আর কথার মাঝখানে কেউ ছুটে এসে বাধা দেয় না, ‘অ আমার কপাল। বামুনদি তুমি এখানে? ওদিকে বাড়ি তোলপাড় হচ্ছে তোমার তরে।’

এখন তারকের মা ছেলে এসে খুঁজছে শুনলে, গিন্নীর কাছে ছাড়পত্র নিয়ে বেরিয়ে এসে হয়তো কোনো পার্কের বেঞ্চিতে এসে বসে, নয়তো পুরোনো চেনা মুড়িওয়ালি দিদির দাওয়ায় এসে বসে।

এখন তারকের মা-র পদমর্যাদা অনেক বেড়ে গেছে। রান্নাঘরের ভারপ্রাপ্ত বটে এখনো, তবে দাসদাসীমহলে প্রায় ‘বড়বাবুর পোস্ট। এবং যেহেতু রাধুনী তাই ‘বামুনদি’ নামটিও কায়েম হয়ে গেছে।

সুযোগ পেলেই মনি বাড়ির সমালোচনা করে তারকের মা, তবে এ বাড়ি যে সহজে ছাড়বে, এমন মনে হয় না। এখানে আরাম আয়েস আধিপত্য! বলতে গেলে গিন্নীর “খাসদাসী’র সম্মান। গিন্নী এখন তাঁর নিজস্ব গাড়িতে করে যখনই যেখানে যান দক্ষিণেশ্বর কী ‘চিতেশ্বরীতলা’, গণৎকারের অফিসে কী ‘ভরের কালীবাড়িতে’…তারকের মা তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী। খবরটি পাঁচ কান করবে না সেটা নিশ্চিত। পাঁচ কান হলে নাকি বাবুর মানমর্যাদা কমে যাবে।

তো বিশ্বাসী তারকের মা প্রতিটি ব্যাপারেই।

ঘরের বাক্স আলমারীর চাবিও নাকি গিন্নী অনায়াসে তারকের মার হেফাজতে রাখতে দেন। তাছাড়া—এখন আর তারকের মাকে মাসে মাসে দেশে গিয়ে মরণাপন্ন’ মাকে দেখতে হয় না। সময় বুঝে ‘মা একদিন মরেছে।’

অতএব মনিব গিন্নী তারকের মায়ের ওপর আরো সন্তুষ্ট।

মাকে কতদিন আর জীইয়ে রাখা যায়? তাছাড়া দরকারও ফুরিয়েছে, জমিজমা নিয়ে ভাসুরের সঙ্গে ভাগভিন্ন হওয়ার কাজটা মিটেছে। তাছাড়া আর এখন নতুন করে জমিজমা গরুবাছুর কেনার উৎসাহ নেই তারকের মায়ের। ছেলেই যদি দেশে এসে বাস না করে, সে আর কীজন্যে ভূতের জঞ্জাল বয়ে বেড়াবে? শেষতক্ সবই ওই জা-ভাসুরের ভোগেই লাগবে।

তারকের মা নিজেকেও জরিপ করে দেখেছে। ছেলের বিয়ে দিয়ে একটা মানুষের মতো মানুষ হয়ে সংসার করার বাসনায় যদি ছাই পড়ে, নিজে যে সে শেষ জীবনের একা বসে দেশ ভিটেয় পড়ে থাকতে পারবে, এমন মনে হয় না। সেও তো বলতে গেলে ‘আজন্ম’ কলকাতায় কাটাল। ‘স্বপ্ন’ যদি সফল না হয়, তাহলে এইভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দেবে, ব্যস।

এখন তো দিব্যি সুখেই আছে।

আদর্শের বিরোধ?

তারক তার মায়ের মনিবকে ছেদ্দার চোখে দেখে না? সে আর কী করা যাবে? তবু দাঁড়িপাল্লার অন্যদিকটাও তো দেখতে হবে? আরাম, আয়েস, প্রতিপত্তি, আধিপত্য, ক্ষমতা— এসবের মোহ কি সোজা নাকি? বলে মহা মহা বিদ্বান পণ্ডিত আদর্শবাদীরাই এসবের মোহে আদর্শে জলাঞ্জলি দিয়ে লোকচক্ষে হাস্যাস্পদ হয়েও সেইসব আঁকড়ে বসে আছেন, তো তুচ্ছ এক পরান মণ্ডলের বিধবা আর তারক মণ্ডলের মা মানদা মণ্ডল।

.

মায়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু এগিয়ে তারক ভারী দ্বিধায় পড়ে। এক্ষুণি ফিরে যাবে? একবার খোঁজ নিয়ে যাবে না বাবু কেমন রইলেন? আদৌ রইলেন কিনা? যে অবস্থা শুনে গেছে তাতে তো সে ভয়ও রয়েছে। আশ্চর্য বড়দাবাবু সে চিন্তার দিক দিয়ে যায় না। ওনার একমাত্র চিন্তা কেউ যেন না ওনার খোঁজ পায়। আবার না বাড়ির খপ্পরে পড়ে যেতে হয়।

তারক দু’একবার বলেছে, ‘কে জানে বাবু কেমন রইল।’ বড়দাবাবু অনায়াসে বলেছে, ‘সব ঠিক আছে বাবা, সব ঠিক আছে। ভাবনা করতে বসতে হবে না।’

দোমনা ভাব নিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশে যাবার জন্যেই দরকার মতো বাসের জন্যে দাঁড়ায়, আর হঠাৎ যেন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে।

সেই বাসস্ট্যান্ডেই দাঁড়িয়ে একজন।

তারক বলে, তুই? এখানে? আরে বাবা!

সেকথা আমিও তোমায় শুদোতে পারি। তুমি এখেনে!

হুঁ। তো মাথায় তো দেখছি খুব সিঁদুর লেবড়েছিল! বে-টা হলো কবে?

রাজারাজড়ার ঘরের বে’ তো নয় তারকদা যে, রাজ্যির লোক টের পাবে!

কালীঘাটে গিয়ে লেবড়ে এসেছিস বোধহয়

যা বলো!

তো এখন আছিস কোথায়? আর খেটে খাস বলে তো মনে হচ্ছে না। কী মার কাটারি সাজ মাইরী! তাজ্জব বনে যাচ্চি।

‘খেটে খাই না” তা বলতে পারব না তারকদা। তবে হ্যাঁ ‘ঝি, রাঁধুনী’ খাটা নয়। যাত্রা দলের আধা হিরোইনের পার্ট প্লে করতে হয়।

অ্যাঁ। বলিস কী? যাত্রাদলের হিরোইন?

হিরোইন তো বলি নাই তারকদা, বলিচি আধা হিরোইন।

আরে বাসরে বাস। সেটাই কম নাকি? এরপর কেপাসিটি দেখাতে পারলে হিরোইন হতে কতক্ষণ? বাবুদের বাড়ি থেকে চুরিচামারি করে পালিয়ে গিয়ে এমন একখানা দাঁও পেলি কোথা থেকে রে? অ্যাঁ?

চুরিচামারি মানে? ভালো হবে না বলছি তারকদা।

না হলে না হবে। তারক হক কথা না বলে ছাড়ে না। তো মাথায় সিঁদুর লেপে দিয়ে আবার যাত্রাদলে ঢুকিয়ে নিলো, এমন একখানা কাপ্তেন জোটালি কী করে রে কাজলবালা?

অ্যাই তারকদা, এখন আর ‘কাজলবালা’ নয়, এখন নতুন নাম ‘বিজলীরানী’।

আরে সাবাস! একবারে ‘বিজলী’! হা হা হা। কে দিল রে নামটা?

কে আবার। যার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলুম সেই দিলো। যাত্রার দলের চাকরী তো! ওই লোভ দেখিয়ে দেখিয়েই তো—

অ। বুঝেছি। এদিকে বাবুদের আমার ওপর কী সন্দ। বলে, তুই নিশ্চয় কাজলকে নিয়ে ভেগেছিস! ‘গলায় দিতে দড়ি জুটবে না’ তারকের তাই কাজলকে নিয়ে ভাগবে।

ওঃ। খুব যে অহঙ্কার। বলি তুমি তো এমন অছেদ্দা করছ, মাসিমা তো মাথায় করে নাচলো। দিদিমণি পর্যন্ত—

কী? মাসিমা মাথায় করে নাচল, কোন্ মাসিমা?

কেন, টুসকি দিদির মা।

ওবাড়িতে গেছলি তুই?

কেন যাব না? দু’জনায় গিয়ে পেন্নাম করে এলুম। এক হাঁড়ি রসগোল্লা নে গেলুম। কত আহ্লাদ করল মাসি।

তারক অগ্রাহ্যের গলায় বলে, এনতার গুলতাপ্পি মেরে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে।

ওঃ। গুলতাপ্পি! তাহলে তাই। বলে কাজল একটু ঠিকরে সরে যায়।

অতঃপর মানভঞ্জনের পালা।

সত্যিমিথ্যেটা তো যাচাই করতে হবে। একেবারে ডাহা মিথ্যে কী আর হবে? একেবারে রসগোল্লার হাঁড়ি পর্যন্ত আমদানি করবে?

তারক তাই এগিয়ে গিয়ে বলে, আরে বাস। সেই মহারানী মার্কা মেজাজ়টি তো ঠিক আছে দেখছি। বে থা হয়ে কমেনি। বলি তোর নিয়ে যাওয়া রসগোল্লার হাঁড়ি মাসিমা নিল?

কেন নেবে না? বরং কত বলল, এতো খরচা করতে গেলি কেন? সবাই তোমার মতন অহঙ্কারী নয় তারকদা, বুঝলে? তুমি চিরকাল জেনে এসেছ গরীব-দুঃখী কেলে কুচ্ছি কাজলকে ঘেন্না করতে হয়! সবাই তা ভাবে না। এই তো অধিকারীমশাই বললো, রঙের জন্যে কিছু এসে যায় না, পেন্টের গুণে বিজুলি হানবে। মুখের কাটুনি ভালো আছে। চোকে বাহার আচে।… নিয়ে নিল। করচি তো প্লে।

হঠাৎ একুট মুচকি হেসে বলে, তুমি তো চোর ছ্যাঁচোড় অনেক কিছু বললে গো তারকদা, মাসিমা কী খাতির করল যদি দেখতে। টুসকিদিদিও। আমার বরকে পেলেটে করে মিষ্টি খাওয়ালো। তাপর গে আমি অব্যেসের বসে মাটিতে বসতে যাচ্ছিলুম, তাড়াতাড়ি বলল, আহা হা সিল্কের শাড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে, সোফায়েই বোস বাবা!

অ্যাঁ!

তবে আর বলচি কী?

কাজলের চোখেমুখে এখন সত্যিই বিজলী ছিটকোয়, আমারেও তো মাসিমা নিজে হাতে করে পেয়ালা করে চা খাবার ধরে দিল। বলল, তুই পাঁপর ভাজা ভালোবাসিস, তাই ভাজলাম দু’খানা। মা মেয়ে উভয়েই ছাড়তেই চায় না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কেবল যাত্রাদলের বিত্তান্ত বিবরণ শুনতে চায়। টুসকিদি তো আবার হেসে হেসে বলল, তো তেমন ভালো পালাটালা হলে আমাদের ‘পাশ’ দিস কাজল!

তারক একটু বঙ্কিম হাসি হেসে বলে, সংসারে তলে সবই সম্ভব। অ্যাঁ!

কাজল গর্বিত কণ্ঠে বলে, দিন এলেই সম্ভব হয় তারকদা। আমার বে-তে কিছু দিতে পায়নি বলে টুসকিদির একখানা নতুন কেনা সিল্কের শাড়ি, বাড়ির ডামাডোলে পরা হয়নি, সেখানা জোর করে গছিয়ে দিল।…আমিও তেমনি ওস্তাদ বলে ফেললাম, এই মুখপুড়ি কাজল তো তার বে’র ‘উপহার’ না বলেই চেয়ে নে গেছল গো দিদি। আবার কেন দিয়ে লজ্জায় ফেলা। তো শুনে ওনারাই যেন লজ্জায় লাল। য্যাঃ! কী যে বলিস। ভারী তো দু’খানা পুরোনো শাড়ি বেলাউস। তো বে’ করতে যাচ্ছিস জানলে আমরা নিজেরাই ভালো করে দেওয়াথোওয়া করতুম।…ঠাকুমা আবার আমায় ‘মাছ খাস’ বলে কুড়িটা টাকা দিল। যেন সত্যিই কেউ আপনজন শ্বশুরবাড়ি থেকে এয়েচে। মেসোমশাই পর্যন্তো—

বলেই কাজল হঠাৎ প্রায় কেঁদে ফেলে বলে ওঠে, য্যাখন পেন্নাম করতে ঘরে ঢুকলুম, হাত তুলে আশীর্ব্বাদ মতন করে ‘থাক থাক’ বলে বলল, ‘কী গো কাজলকে কিছু খেতে দিয়েছ? শ্বশুরবাড়ি থেকে এলো।’

তারক হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, সবই ওই সিঁদুরটার গুণ, বুঝলি কাজল? ওটা না দেখলে তোকে কেউ এতো পূজ্যি করতো না।…তো মেসোমশাইকে তাহলে দেকলি?

দেকলুম। দেকে তো সুখ হলো না। বিছানায় পড়ে আচে।

তবু তো ‘আচে’ রে। শুনে, বাঁচলুম। ভেবে মরছিলুম, আচে কী নাই!

দুগ্‌গা। দুগ্‌গা। থাকবে না কেন?

এইমাত্তর পৃথিবীতে পড়লি নাকি রে কাজল? মানুষ মরে না? সেদিন যে অবস্থা দেখে গেছলাম—

হঠাৎ কাজল উদ্দীপ্ত গলায় বলে ওঠে, তবে এও বলি তারকদা, গরীব দুঃখী কাজল অভাবে পড়ে দু’খানা পুরাতন শাড়ি বেলাউস হাতিয়ে নে গেচলো বলে, তারে চোর ছ্যাঁচোড় অনেক কিছুই তো বললে? আর নিজে কী?

নিজে কী? তার মানে?

মানেটা নিজেই বুঝে দ্যাখো। এতোকাল ওনাদের কম নেমক তো খাও নাই, কিন্তুক নেমকহারামিতে কিছু কসুর করেচো? সংসারের একখানা সারের সার দামী মাল সরিয়ে এনে কেটে পড় নাই?

তারক কপাল কুঁচকে বলে, হঠাৎ এ আবার কী আবোলতাবোল বকতে শুরু করলি?

আবোলতাবোল কিসে? বড়দাবাবুর সাথে ষড়যন্তর করে তুমি তেনাকে নিয়ে একথা সটকান দাওনি?

কী? ষড়যন্ত্র করে? বলি কে বলেচে তারক অগ্নিশর্মা হয়ে বলে, অ্যাঁ? কে বলেচে?

স্পষ্ট করে কী আর বলেচে?

তবে কাজল তো আর বোকাহাবা নয়। ভাব দেকেই সব বুঝে নেয়। মাসিমার কথায় বুজলুম। বড়দাও হাসপাতাল থেকে হাওয়া হয়ে গেল, আর তুমিও না-বলা-না-কয়া, হঠাৎ‍ হাওয়া হয়ে গেলে, এতে মানুষ কী বুজবে?

তারক এখনো ক্রুদ্ধ গলায় বলে, কী আর বুঝবে? তারক ওই সাড়ে ছ’ফুট লম্বা লোকটাকে চুরি করে ভেগেছে।

‘চুরি করে’ তো বলে নাই। ভাব দেখে মনে হলো যেন সেই রকম সন্দ। দুটো মানুষ একই সঙ্গে হাওয়া হয়ে গেল।

তারক রাগে ফেটে পড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কোনদিক থেকে যেন একটা তেধ্যাড়াঙ্গে মতো লোক হনহনিয়ে এসে বলে, তুমি এখেনে? তোমারে না করে গেলুম ওই পানের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।

কাজল ঝঙ্কার দিয়ে বলে, গাছ পাতর নাকি? যে একটু নড়াচড়া করবে না? চেনা মানুষকে দেকলুম।….এই আমার সেই তারকা।

ওঃ। নমস্কার বলে লোকটা হাতদুটো জোড় করে একটা নমস্কারের ভঙ্গী করে পা চালাতে শুরু করে।

কাজলও তার পিছু পিছু দৌড় দিতে দিতে বলে, বাবাঃ। কী রাগ। আর নিজে যে ‘একটু আসচি’ বলে সাত ঘণ্টা দেরি করা হলো। তারকদা চিনে রাখো এই আমার হাজব্যান্ড’!

দৌড় মারে সেই দ্রুতগামীর কাছাকাছি পৌঁছতে।

.

কাজল রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া তারকের কাছে হেসে হেসে আর অহঙ্কারী অহঙ্কারীভাবে যে গল্প করে গেল, সে গল্প কিন্তু অতিরিক্ত নয়। সত্যি সত্যিই ‘কাজল’ নামের সেই বেইমান ‘বিশ্বাসঘাতক’ মেয়েটা যখন চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দিয়ে অতি অবলীলায় জমকালো সাজসজ্জা করে তার বরকে সঙ্গে নিয়ে পুরোনো মনিব বাড়িতে দেখা করতে এলো, অথবা বলা যায় ‘বর’কে দেখাতে এলো, তখন সেই দাগা খাওয়া মনি বাড়ি তাকে ‘দূর ছাই’ করার বদলে, যেন দেখে আহ্লাদে আটখানা হলো!

হয়তো এইরকমই হয়। যে প্রাণীটা একদা নিতান্ত তুচ্ছর ভূমিকায় করুণার পাত্র হয়ে থেকে গেছে, কাটিয়ে গেছে শাসিত হয়ে এবং ছেঁড়া বিছানায় শুয়ে আর চট-ওঠা কলাই-করা থালায় ভাত খেয়ে, সে যদি হঠাৎ অনেকখানিটা উঁচুতে উঠে গিয়ে আত্মবিশ্বাসের আলোয় মুখ মেজে অকুণ্ঠিতভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তার ‘অন্যায়’ বা অপরাধটা আর মনে আসে না, বরং সমীহর সঙ্গে নিজেদের মধ্যেই যেন একটা কুণ্ঠিত ভাব আসে। সে কুণ্ঠার ধরনটা অনেকটা এইরকম—ইস। একে আমরা কী হ্যানস্থার চোখেই দেখতাম! ছি ছি!’

অবশ্য এরকম ক্ষেত্রে হয়তো কখনো কখনো একদম বিপরীত মানসিকতাও দেখা যায়। দীনহীন জন যদি ‘বেশ একজন’ হয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়, তার সম্পর্কে অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিটা বেশী করে প্রকাশ করে জানিয়ে দিতে ‘এঃ খুব যে একখানা ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়ে এসে অহঙ্কার দেখাচ্ছিস্, আসলে তুই ‘কী’ তা কী আমরা ভুলে গেছি না কি? সেই তো রোঁয়া-ওঠা দাঁড়কাকটা তুই’।

হয়তো এদের মধ্যে কিছুটা ঈর্ষার ভাবও থাকে। সেই ঈর্ষার বশে কিছুতেই ওই চুড়ো উঠে যাওয়া লোকটারও অতীতটাকে ভুলতে রাজি হয় না।…ওঃ। ভারী একখানা গাড়ি চড়ে বেড়িয়ে বাহার দিচ্ছিস। বলি, কী ছিলি তা জানি না? নিজের চক্ষেই তোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্য লোকের গাড়ি ধুতে দেখেছি।’

‘দেখেছি’। অতএব কিছুতেই তোর সেই গাড়ি ধোওয়া মূর্তিটাকে মন থেকে সরাব না।

তা গাড়ি ধোওয়ার চাকর থেকে নিজেই গাড়িবান হওয়ার দৃশ্যটি বিরল হলেও, একেবারে অসম্ভব নয়। বিশেষ করে এ যুগে! কেবলমাত্র লোটাকম্বল সম্বল করে বৃহৎ বিশাল মরুভূমির পথ পার হয়ে—’সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলার’ দেশে এসে পড়ে, কোটিপতি হওয়ার দৃষ্টান্ত অবশ্য সব যুগেই ছিল, আছেও। কিন্তু—সে তো খেটেপিটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে।

এ যুগে খাটাপেটা না করেও হয়ে যায় দেখতে পাওয়া যায়। শুধু বুঝেসুঝে একখানা মুরুব্বি ধরতে পারলেই হলো। মুরুব্বির জোরেই সর্বদাই দেখা যায়, আজ যে গাড়ি ধুচ্ছে, কাল সে গাড়ি চড়ছে।

বেশী ক্ষেত্রেই কিন্তু জনসাধারণরা, ওই অতীত মূর্তিটিতেই বিগলিত হয়, সমীহে গদগদ হয়।

আদিত্য গাঙ্গুলীর বৌ মেয়ে মনে মনে নিজেদের সম্পর্কে খুব একখানা ‘বিশেষ’ ধারণা পোষণ করলেও, আসলে তারা ওই সাধারণের দলেই। তাই টুসকি দরজা খুলে কাজলকে দেখে—তুই আবার কোন লজ্জায়?’ না বলে, চেঁচিয়ে ওঠে, মা! দ্যাখো কে এসেছে।

আর সেই মা’ও কে এসেছে দেখে, বেজার মুখে তুমি হঠাৎ কী মনে করে?’ বলে অবজ্ঞার বদলে বিগলিত হয়ে বলেন, ওমা! কাজল। তুই! আরে বাবা! বিয়ে হয়ে গেছে দেখছি যে।

অতঃপর তো আবার তখনি জানা হয়ে গেল, শুধু ‘বিয়ে হয়েই’ কাজলের মহিমা শেষ হয়নি। কাজল আর এক উচ্চতর মহিমান্বিত লোকের বাসিন্দা হয়ে বসেছে।

কাজল একটা যাত্রাদলের নায়িকার ভূমিকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

নিজেই সেই ঘাটতিটুকুকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে, না গো মাসিমা, অ্যাখনো পুরোপুরি হেরোয়িন করেনি, অ্যাখন সাইট হেরোয়িন, তবে চান্স আছে। আমার অ্যাক্টো নাকি পোপাইটারের খুব পছন্দ।

টুসকি হেসে উঠে সংশোধন করে দিয়ে বলে, হেরোয়িন নয় বাবা, ‘হিরোইন’।

কাজল অম্লান বদনে বলে, তোমাদের ‘বোনাইও’ ওইরকম ভুল ধরে দিদি। তো আমি বলি, যাকগে যার নাম ভাজা চাল তার নামই মুড়ি। লোকে বুঝতে পারলেই হলো।

তারপর কাজল বর্ণিত আদরযত্ন ছাড়াও আরো কিছুর চাষ হতে থাকে তখন কাজল আর তার পুরোনো মনিবগিন্নী ও কন্যার মধ্যে। চাষটা এই—এক পক্ষের অবিরত কৌতূহল প্রশ্ন, আর অপর পক্ষের ঈষৎ মদগর্বভাবে সেই সব প্রশ্নের উত্তরদান।

টুসকি অনায়াসেই নিজ অভিজ্ঞতার দৈন্য স্বীকার করে বলে, সিনেমা থিয়েটারের নায়ক-নায়িকাদের ভেতরের কথা তবু অনেক জানা রে কাজল, সর্বত্রই বেরোচ্ছে। তবে তোদের যাত্রার লাইনের ব্যাপার তেমন কিছু জানা ছিল না। বাবাঃ। এতো সব ঝামেলা পার হয়ে তবে যাত্রাদলের রানী? হি হি। তা রানী হবি! তোর চেহারাখানা তো মারকাটারি। রংটাই যা হি হি ভুসোকালির মতো।

সে ‘হি হি’-তে অবশ্য কাজলও যোগ দেয়। বলে, ও দিদি! মেকআপ-এর গুণে ভূসোকালিকেও মেম বানিয়ে ছাড়ে। যা পেণ্ট লাগায়, তাজ্জব বনে যেতে হয়।

অতঃপর তাজ্জব বনে যাবার মতো বেশ কিছু গল্প করে কাজল। মোহিত হয়ে শোনে ‘দিদি’ আর তার মা।

আশ্চর্য বৈকি। নয়নতারাই না হয় এদের ভাষায় চিরকেলে হ্যাবলা-ক্যাবলা, আপন প্রেস্টিজ রেখে কথা বলতে জানেন না। কাজেই তিনি যদি কাজলকে দেখে পুরোনো কথা বিস্মৃতি হয়ে হাস্যবদনে বলে ওঠেন, ‘অ কাজল, তর বরখানি তো দেখছি তর থেকে অনেকখানি গোরা। বেশ! বেশ! ত শ্বশুরঘরে আর কে কে আছে?’ সেটা বিস্ময়ের নয়।

কিন্তু অতিমাত্রায় প্রেস্টিজজ্ঞানসম্পন্না নীহারিকা? আবার তার থেকেও আশ্চর্য, কাঠখোট্টা মার্কা আদিত্য গাঙ্গুলী। যে নাকি এখন অ-শক্ত হয়ে বিছানায় পড়ে! সেও কী করে বলে, থাক থাক, প্রণাম করতে হবে না। তা হ্যাঁরে টুসকি, কাজলকে চা-টা কিছু খেতে দিয়েছিস?

মানুষের হৃদয়রহস্য বোঝা ভার। কই আদিত্যর তো মনে পড়ল না, ওই পাজি লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটার কারণেই তাঁকে একদা থানায় ছুটতে হয়েছিল, এবং না হক খানিকটা অপদস্থ হতে হয়েছিল।

অবশ্য অপদস্থবোধটা শিলাদিত্যরই বেশী হয়েছিল। শিলাদিত্য এ সময়ে বাড়িতে থাকলে কী হতো বলা যায় না।

কিন্তু বাড়িতে সে আর থাকে কতটুকু? ক্রমশই তো ডুমুরের ফুল হয়ে উঠছে। শুধু হঠাৎ ভালোমত একটা চাকরী জোটাতে পেরেছে বলেই কী? তা চাকরী তো নটা পাঁচটা!

বাকি সময়টা? কী করে সে আটটার আগেই সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ে? আর কী বা করে রাত সাড়ে নটা-দশটা অবধি? জিগ্যেস করলেই রোজ অফিসে একটা করে বাড়তি কাজের ছুতো দেখায়। অথবা রাস্তায় যানজট ইত্যাদি।

নীহারিকা রেগে রেগে বলে, দুপুরের ‘লাঞ্চ’ তো অফিসের ক্যান্টিনে সারিস! রাত্তিরের ‘ডিনার টাও তাহলে এবার থেকে সেখানেই সারিস!

শিলাদিত্য অবলীলায় বলে, তো তোমাদের যদি আমার জন্যে বসে থাকতে খুব বেশী

অসুবিধে হয়, তাই হয়তো করতে হবে শেষ পর্যন্ত!

এরপর আর কী বলার থাকে? কেঁদে ফেলা ছাড়া?

নীহারিকার মনের দোসর বলে কেউ নেই।

মেয়েও আজকাল ‘একটা কিছু করা দরকার’ বলে চাকরীর চেষ্টায় হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ ঠিক যে কোন্ ধরনের কাজের যোগ্যতা আছে তার তা নিজেও বোঝে না। গান একটু শিখছিল বটে, কিন্তু সেটা এমন কিছু নয় যে, খুব বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও একটু তালিম দিতে পারে। নেহাৎ সাদাসিধে বি. এ. পাশ! স্কুলেও কাজ মিলবার আশা নেই। প্রাইমারি স্কুলে চেষ্টা করতে গেলেও বলে, বি. টি-টা করে নিন না আগে! বি. টি-টা পাশ করা ছাড়া কোনো স্কুলের দরজায় মাথা গলানো যাবে না।

তবে কিনা, সেটা হলেই কী এমন পরমার্থ লাভ হয়ে যাবে? হাজার হাজার বি. এ. বি. টি. বেকারের তালিকা বাড়িয়ে চলছে না?

মান-সম্মান খুইয়ে টুসকি এক একদিন ছোড়দাকে পাকড়াও করে জেরা করে, আচ্ছা ছোড়দা, তুই বা একটা সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হয়ে অমন মারকাটারি একখানা চাকরী জুটিরে ফেললি কি করে?

‘মারকাটারি’ আবার কে বলতে এলো তোকে?

তোর আচার-আচরণেই মালুম। ‘টাই’ পরে অফিস যাস। অফিস ক্যান্টিনে খানদানি খাওয়া! মেজাজও তো ক্রমেই খানদানি হয়ে উঠছে।

বেশী বাজে বকিস না। থাপ্পড় খাবি।

তার জন্যে গাল পেতেই আছি। তো আমায় একটা কিছু জুটিয়ে দে না বাবা।

হুঁঃ। বেড়ালের ভাগ্যে একটা শিকে ছিঁড়েছে বলেই, ব্যাটা বেড়ালটা সর্বশক্তিমান হয়ে গেছে না কি? সর্বদাই তো আতঙ্ক, আবার না কোথাও ‘দড়ি ছিঁড়ে বসে। সরকারি চাকরী নয় যে একবার ঢুকে পড়তে পারলে যাবজ্জীবেৎ! সে তুমি ভবিল তছরূপের দায়েই পড়ো, আর যে কোনো প্রকার কেলেঙ্কারির ফাঁসেই ফেঁসে যাও, ঠিক জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে। বে-সরকারি ব্যাপার! সর্বদাই হারাই হারাই।

টুসকি বলে ওঠে, সে কীরে? কেন? তোদের ইউনিয়ন নেই? যার নাম গঙ্কাদার! যে এইসব কর্মজীবীদের রক্ষা করতে হাল ধরেই থাকে।

শিলাদিত্য আর একটু ব্যঙ্গের গলায় বলে, হুঁ, খুব কথা শিখেছিস।…থাকিস তো ঘরের মধ্যে বসে, শিখিস কার কাছে?

সর্বদা ঘরের মধ্যে বসে থাকি, এ খবরটি সাপ্লাই করল কে শুনি? নিজে তো ডুমুরের ফুল! কতক্ষণ দেখিস কাকে?…আমি এখন হন্যে হয়ে যে কোনো একটা চাকরী খুঁজে বেড়াচ্ছি তা খবর রাখিস?

না, এতোটা রাখি না। তবে এটাই জিজ্ঞাস্য, এতো বেশী দরকারটাই বা কী? আদিত্য গাঙ্গুলী তো দুর্ভাগ্য ভাতা’র অনুদান মিলিয়ে পেনসনটি মন্দ পাচ্ছেন না। নীহারিকা গাঙ্গুলীর নিজস্ব হাতখরচ-টরচের একটি সোর্স তো আছেই চিরটাকাল। তার উপর বৃদ্ধ গাঙ্গুলী তো আবার নতুন করে ইয়াং হয়ে রুজিরোজগারের ধান্ধায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, তো শুনি মন্দ আয় করেন না। তাছাড়া—এই অভাগা শিলাদিত্য গাঙ্গুলীরও সংসারে যৎসামান্য কিছু কনট্রিবিউশন রয়েছে—আর কত চাই?

টুসকি ঝঙ্কার দিয়ে বলে, ওঃ। ‘আর কত চাই!’ ওঃ! বাজারদরের বাড়বৃদ্ধির হিসেব রাখিস না? তো বলি—শিলাদিত্য গাঙ্গুলীর যৎসামান্য কন্ট্রিবিউশানই বা কেন হে? তার তো আয়ের সবটাই মায়ের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এখন এই সংসারটার ভার নেওয়াটা তো তোরই কর্তব্য!

তাই না কি?

শিলাদিত্য তিক্ত ব্যঙ্গের মুখটা কুঁচকে বলে, দুঃখিত। আপনার মতো কর্তব্যজ্ঞান শিলাদিত্য গাঙ্গুলীর নেই ম্যাডাম। আর কর্তব্যজ্ঞানের দায়ে নিজেকে বিকিয়ে দেবার মতো নির্বোধও নয় সে!

টুসকি অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, আশ্চর্য! তুই কী দারুণভাবে বদলে গেছিস ছোড়দা!

ছোড়দা তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, তা বদলানোই তো স্বাভাবিক। বদলানোই তো জীবনের ধর্ম। দায়িত্ব-কর্তব্য। যতসব ফসিল কথা। তাই যদি হয়, তো কেন হে মেখলা দেবী, এই ব্যাটা কী চোরদায়ে ধরা পড়েছে? প্রথম এবং প্রধান দায়িত্বটি আইনত যাঁর সেই মহানুভব ব্যক্তিটি তো দিব্যি একখানি মহান ব্রতের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে কেটে পড়ে বসে আছেন! তাঁর বিষয় তো কিছু বলা হয় না?

টুসকি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, তুই কী আজকাল ড্রিক্-ফিক্ করতে শুরু করেছিস ছোড়দা? কথাবার্তার ধরনটা তো ভালো দেখছি না।

ওঃ। বটে? ড্রিঙ্ক করনেওয়ালাদের ধরনধারণ জানা হয়ে গেছে না কি?

তোর সঙ্গে আর কথা কইতেও ইচ্ছে হচ্ছে না ছোড়দা। ভাবতে পারছি না, এতো বদলে যেতে পারে মানুষ।

শিলাদিত্য সেই তিক্ত হাসি হেসে বলে, মানুষই তো বদলায়। গরু-গাধা বাঘ-ভাল্লুক এদের বদল ঘটে না। এরা আদি ও অকৃত্রিম। তুই কী ভাবছিস তুই কিছু বদলাসনি? নিজে বুঝতে পারা যায় না এই না! বলে শুয়ে পড়ে শিলাদিত্য।

শুচ্ছিস যে? খাবি না?

নাঃ। মাকে বলে দিয়েছি। বেডসুইচটা টিপে ঘর অন্ধকার করে দেয়।

টুসকি সেই অন্ধকারটার দিকে তাকিয়ে থাকে কেমন একটা আচ্ছন্নের মতো। সেই ছোড়দা। সত্যিই কী সবাই এতো বদলায়।

‘সবাই’ হয়তো নয়। তবে বেশীরভাগই বৈকি। বিশেষ করে এই যুগে। এ যুগ যেন প্রতি মুহূর্তে নিজেকে ভেঙে ভেঙে রূপান্তর ঘটিয়ে চলছে। তাই বড় বেশী বদলে যাচ্ছে পৃথিবী! আকাশ পাতাল বদল। অবিশ্বাস্যভাবে, অভাবিতভাবে।

তবু ওরই মধ্যে আবার কেউ কেউ আপন চরিত্রে অবিচল থেকে যায়। তারা নির্ভেজাল অপরিবর্তনীয় কোনো ধাতুতে গড়া। বেলেঘাটার মুখুয্যেবাড়ির গৃহিণী সন্ধ্যাতারা যেমন, নিজে ছেলের বৌয়ের শাশুড়ি হয়ে গিয়েও এখনো এপাড়া থেকে ওপাড়া—একদিনের জন্যে বাপের বাড়ি আসতে হলেও বুড়ো শ্বশুরের কাছে গিয়ে আবেদন জানায়, ‘বাবা! আজ একটু নলিন সরকার স্ট্রীটে যাব? দাদাকে অনেকদিন দেখতে যাওয়া হয়নি।’

গিন্নীবিহীন সংসারে তো বিয়ে হয়ে অবধিই গৃহিণীর পোস্টটা পেয়ে বসে আছে সন্ধ্যাতার, তবু সেই পোস্টের অধিকারটিই কখনো প্রয়োগ করে না সে। যদিও সেই পোস্টের দায়টা পুইয়ে আসছে চিরকাল। তবু এই তার স্বভাব। চেষ্টাকৃত নয়। স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ। গুরুজনকে সমীহ করতে হয়, এই চিরাচরিত অভ্যাসের বোধ। অথচ সন্ধ্যাতারার সবে বিয়ে হয়ে আসা পুত্রবধূটি? এখনি তো সে—

কিন্তু তার কথা থাক। সন্ধ্যাতারার কথা হচ্ছে তাই হোক।

এই আবেদনের ‘না মঞ্জুর’ হবার কোনো প্রশ্ন অবশ্য নেই। কারণ সন্ধ্যাতারাও এমন অবুঝ নয় যে, অঙ্কটঙ্ক না কষেই, আবেদনপত্র হাতে এনে দাঁড়াবে। সংসারের স্থির অবস্থা দেখলে তবেই এমন ইচ্ছে প্রকাশ।

অতএব সেই সন্ধ্যায় সন্ধ্যাতারা ওপাড়ায় গিয়ে ‘টুনি’ হয়ে বসল তার রোগশয্যাশায়ী দাদার পাশে।

আদিত্যর অবশ্য আহ্বানও নেই, বিসর্জনও নেই। যদিও বোনকে দেখে খুশী একটু না হলো তা নয়, তবে তার প্রকাশটা খুবই শান্ত নিরুত্তাপ।

‘কীরে টুনি? হঠাৎ এ বাড়ির কথাটা মনে পড়ল যে? তো রাতটা থাকবি তো? সেই বুড়ো ভদ্রলোক আবার ‘মা মা’ করে হেদোবেন না তো?”

এইটুকুই সম্ভাষণ!

নীহারিকা অবশ্য সৌজন্যের ত্রুটি রাখল না। এবং তার ছেলেটা আর মেয়েটা যে সবসময় বাইরে থাকে, কাজের লোক নেই ইত্যাদি সে সব তাড়াতাড়ি জানিয়ে দিলেন।

কিন্তু সত্যিকার আহ্লাদে বিগলিত হলেন সত্যব্রত। সত্যব্রত আশা করেননি বাড়ি ফিরে তাঁর উদ্বেল হৃদয়ের ভারটি নামানোর জন্যে একটু ঠাঁই পাবেন। দালান পার হতে হতে ভয়ে ভয়ে ছেলের দরজার দিকে তাকালেই আহ্লাদে বুকটা ভরে গেল। ভয়ে ভয়েই তো তাকান। সেখানে যে এক অদ্ভুত শীতলতা বিরাজ করে।

.

হ্যাঁ, আজ সত্যব্রত বন বেশী উদ্বেলিত। মাঝে মাঝে একটু-আধটু উদ্বেলতা বহন করে আনেন না তা নয়, ভাবেন বাড়ি গিয়ে গল্প করবো, কিন্তু বাড়িতে ঔদাসীন্যের হিমশীতল স্পর্শে সেটা জুড়িয়ে যায়। ছেলে-বৌ নাতি-নাতনী কেউই সত্যব্রতর কথা বলার ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দেয় না। হয়তো বলে, ‘এই ব্যাপার! তা এতে আর অবাক হবার কী আছে?”

শেষমেশ অবশ্য নয়নতারা!

কিন্তু ওদের কাছেও যে বলতে ইচ্ছে হয়।

আজ টুনিকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেলেন। তাও আবার আদিত্যর ঘরে! এবং আদিত্য যেন বোনের সঙ্গে কিছু কথাই কইছে।

সত্যব্রত আজ অকুণ্ঠিত চিত্তে ছেলের ঘরের মধ্যে ঢুকে এলেন। বলে উঠলেন, টুনি এসেছিস? ভালো ভালো। খুব ভালো। আজ ওখানে যা একখানা দারুণ ঘটনা ঘটেছে রে শুনলে অবাক হয়ে যাবি।

টুনি তাড়াতাড়ি সরে এসে বাবাকে প্রণাম করে বলে ওঠে, উঃ বাবা! তোমায় এই স্যুট-ট্যুট পরে কী ভালো দেখাচ্ছে গো। সেই আগেকার মতন। তাই না দাদা?

দাদার দিক থেকে অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।

সত্যব্রতর যেন ভয় হয় এই সুন্দর সুখময় মহামুহূর্তটি এক্ষুণি বুঝি উপে যাবে, তাই তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, অনেক কিছু আগেকার মতো দেখলে ভালো লাগে তাই না? আর যদি অনেক আগেকার কাউকে দেখতে পাওয়া যায়? কেমন লাগে বল? আজ এমন একজনের সঙ্গে দেখা হলো রে—একেবারে অভাবিত। আচ্ছা বল তো—নাঃ। তুই আর কী করে মনে করবি, তুই তো চলে এসেছিলি নেহাৎ ছোটবেলায়।…আদিত্য, আমাদের সেই পাবনার হর্ষ ডাক্তারকে তোর মনে আছে? হর্ষবাবু ডাক্তার? আমাদের বাড়ির কাছাকাছিই থাকতেন। রোগা কালো! তোর তো মনে পড়া উচিত। কত ওষুধ খেয়েছিস তুই তাঁর। রেগে রেগে বলতিস, ‘বিচ্ছিরি ওষুধ। তেতো পচা। হর্ষবাবু ডাক্তার নিজে খান না।’

হেসে ওঠেন জোরে।

টুনিও তার সঙ্গে।

নয়নতারা নেয়ের সঙ্গে প্রথম সম্ভাষণটি সেরে সন্ধেপুজোটি সারতে গিয়েছিলেন, হঠাৎ যেন চমকে যান। হাসি? না আর কিছু? না না, হাসিই তো। কতদিন এমন গলা খুলে হাসেননি সত্যব্রত! তাও আবার ছেলের ঘরে বসে।

আর পুজোর আসনে বসে থাকা যায়?

তাড়াতাড়ি প্রণাম সেরে নেমে এলেন।

আর সত্যব্রত তাঁকে দেখেই বলে উঠলেন, এই তো আসল মানুষ এসে গেছেন। আচ্ছা, তোমার হর্ষবাবু ডাক্তারকে মনে আছে?

নয়নতারা সঙ্গে সঙ্গে গালে হাত দেন, শোনো কথা। হর্ববাবু ডাক্তারকে মনে থাকবে না? কেন? কী হইছে তাঁর?

তাঁর আবার কী হবে? তাঁর কী আর কিছু হওয়াহয়ির কাল আছে? তিনি তো নেই। আজ হঠাৎ তাঁর ছেলের সঙ্গে দেখা।… ‘দেখা’ মানে আমি অতো খেয়াল করিনি। সেই ছেলেই এগিয়ে এসে ফট করে প্রণাম করে বলে উঠল, ‘গাঙ্গুলী কাকা, আমায় চিনতে পারছেন?’… সত্যি বলতে আমি প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারিনি। সে নিজেই আবার বলে উঠল, ‘আমি হরষিত! আপনাদের হর্ষবাবু ডাক্তারের বড় ছেলে। সেই পাবনার—’

তখন আর চিনতে বাকি থাকে? বলতে কি পাঁচজনের চোখের সামনেই প্রায় জড়িয়ে ধরি আর কী! আর লজ্জাও করল, ‘আমি তোমায় চিনতে পারিনি, আর তুমি আমায় — তুমি আর তখন কতটুকু ছিলে? অ্যাঁ?’ তা আদিত্যর থেকে ক’বছরের বড়ই হবে। নেহাৎ ছোট ছিল না। অনেক ইতিহাস, অনেক কাহিনি। একদিন আসবে বলেছে! ভয়ে ভয়ে বলছে, কাকিমা আছেন তো? মানে ভালো আছেন তো? একদিন প্রণাম করে আসবো।’ আসলে আমিও একটু ঠাট্টা করে ফেললাম। বললাম, ‘কেন হে? আমায় দেখে কি ‘বউ মরা হতভাগা’ বলে মনে হচ্ছে?”

…কোর্টে ক্লার্কের কাজ করে। বাপের মতই রোগা কালো! বলল বটে, ‘অনেক কথা বলবার আছে কাকা, বাড়ি গিয়ে বলবো।’ তবু ওই বার লাইব্রেরীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই একঘণ্টা কথা। অনেকেই আসছে যাচ্ছে, তাকাচ্ছে, আমার সে খেয়ালই নেই।…খুব দুঃখের ইতিহাস, বুঝলে?

নয়নতারা বলে ওঠেন, ত দেশবিভাগ হওয়ার পর কার আর সুখের ইতিহাস রইছে? অ্যাঁ? সবারই তো দুঃখের ইতিহাস। বলে, কতো কতো বেঘোরে মিত্যু! কতো কতো লাঞ্ছনা অপমান—

সত্যব্রত বলেন, হ্যাঁ, সে সব তো আছেই। সে তো অবর্ণনীয়। তবে এর ব্যাপার আবার অন্য। আপনজনের কাছ থেকে ধাক্কা খাওয়া।… আমরা তো বাড়ির ছেড়ে চলে এলাম, বাবার সেই মুহুরি রশিদ মণ্ডল দ্যাখাশোনা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল—

আদিত্য বলে ওঠে, তা আর আশ্বাস দেবে না কেন? মনে তো জানছে পিছন ফিরলেই কলাটি। সব তার হয়ে যাবে।

তা অবশ্য ঠিক নয় রে আদিত্য। ব্যাপারটা যে চিরদিনের মতো, একথা তখন কেউ ভাবেনি। সবাই ভেবেছিল, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ক্রমশই আশা ফুরোতে লাগল। তা ওই রশিদই শেষ পর্যন্ত খুব ভালো ব্যবহার করেছিল। আমাদেরকে নৌকোয় তুলে দেওয়া পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে ছিল। সে সময় সেই সাহায্যটুকুই ছিল পরম মূল্যবান। তবে আমাদের হর্ষ ডাক্তারের ছেলে হরষিতের আলাদা ব্যাপার। ওরা দুই ভাই, তো হরষিত নাকি বরাবর হাঁপানি রুগী বলে বিয়ে করেনি। ওর ছোট ভাই মনসিজের মস্ত সংসার, ছেলেমেয়ে মিলিয়ে সাত-আটটা। তাছাড়া বৌ, আবার বৌয়ের একটা বিধবা বোন। তো—দেশে একটু গোলমাল বাধতেই ওরা কলকাতায় চলে এসেছিল বৌয়েরই বাপের বাড়ির দিকের কার বাড়িতে।…তারপর জানিস, দাদাকে লিখল, পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ওর মামাশ্বশুরের চেনা এক মুসলমান ভদ্রলোক, ব্যাবসা-ট্যাবসা কিছু করেন, তিনি তাঁর বাড়ির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের কোনো হিন্দুর বাড়ি বিনিময় করতে চান, অতএব যদি তাদের বাড়িটা নিয়ে কথা হয়।… তো তাই হলো, এই হরষিতও তো তখন দেখছে, নাঃ, আর থাকা চলছে না! সবাই একে একে চলে যাচ্ছে। তো বাড়ির দলিল-টলিল কাগজপত্র ভাইকে সব পাঠিয়ে দিল। ডাক্তারের সেই অতো বড় বাড়ি, আমবাগান, দুটো মেছো পুকুর, সবকিছু পেয়ে যাবে পার্ক সার্কাসের ভদ্রলোক। তা তিনি সত্যিই ভদ্রলোক, ভালোভাবেই লেখাপড়া করিয়ে ওসব বদলাবদলি করিয়েছিলেন। ওঁর বাড়িও মস্ত। আর খাস কলকাতায়।…তো বেচারা হরষিত জানে, বুদ্ধিমান ভাই যা করছে ঠিকঠাক করছে। কিন্তু ভাইটি যে কত বেশী বুদ্ধিমান তা তখনো টের পায়নি। পাবনা ছেড়ে চলে এসে কলকাতায় পার্ক সার্কাসের বাড়িতে এসে দাঁড়াতেই ভাই সোজা জানিয়ে দিল, এখানে একসঙ্গে থাকা পোযাবে না। তার শ্বশুরবাড়ির বিস্তর আত্মীয় রয়েছে তার সঙ্গে।

আমার থাকা চলবে না?

হরষিত অবাক হয়ে বলল, আমার তো সংসার নেই, একটা মানুষ। একখানা ঘরে থাকবো বৈ তো নয়।…না, তাতেও অনেক অসুবিধে। বাড়তি একটা মানুষের হ্যাঁপা সামলাতে পারবে না তার বৌ!…তখন হরষিত তো রেগে উঠতেই পারে? বল্? রেগে বলল, তো বাড়ির অর্ধেকটা তো আমার। আমি নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নেব। অর্ধেকটা আমায় ছেড়ে দে।…তা শুনলে বিশ্বাস করবি নিজের সহোদর ভাই অনায়াসে দাদার নাকের ওপর দলিল ফেলে দিয়ে দেখাল। দাদার নামগন্ধ নেই সেখানে। পাবনার ডাক্তার হর্ষ সমাদ্দারের বাড়িবাগান ইত্যাদি সব তাঁর ছেলে মনসিজ সমাদ্দারের। কাজেই বিনিময় সূত্রে কলকাতার পার্ক সার্কাসের মনসুর আলির তিনতলা বাড়িটি সম্পূর্ণ তার।

হরষিত নাকি কেঁদে ফেলে বলেছিল, আমি বিশ্বাস করে সব তোকে ভার দিয়েছিলাম। সেই বিশ্বাসের বদলে তুই আমায় এতোখানি ঠকালি?…তো ভাই নাকি হেসে বলেছিল, ‘এ দুনিয়ায় বোকারা চিরকালই ঠকে।’ ভাবতে পারিস?

আদিত্য অবজ্ঞার ভঙ্গীতে বলে, এ আবার ভাবতে না পারার কী আছে? তুমি ওকালতি করো, জানো না ভাই ভাইকে ঠকায়, কাকা জ্যাঠা ভাইপোকে খুন করে সম্পত্তি গ্রাস করে। তোমার পক্ষে অবাক হওয়াটা অ্যাবসার্ড।

সত্যব্রত ব্যথিতভাবে বলেন, তা জানি। শুধু ওইটুকু কেন? আরো কত কত ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী আমরা, আইন-আদালতের লোকেরা। তবু—কী জানিস, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আমাদের পাবনার লোক। একেবারের চেনাজানা লোক! হর্ষ ডাক্তারের মতো একজন ভালো লোকের ছেলে! সে এমন কাজ করল!

বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ, বয়স্ক মানুষ ওকালতি করে বুড়ো হয়ে যাওয়া সত্যব্রত গাঙ্গুলীর এইরকম একটা অদ্ভূত ভাবপ্রবণতায় আচ্ছন্ন হয়ে এমন বোকার মতো কথা বলা আশ্চর্য বৈকি!

আদিত্য বলে, বাবা তো কোর্ট থেকে ফিরেই গল্পে জমে গেল দেখছি। চা-টা খাবে না?

তার মানে ওয়ার্নিং বেল।

অতঃপর এ ঘর থেকে সরে পড়ো সবাই।

অবিরত একা একা থাকার ফলে লোকসঙ্গ তার কাছে ভারী লাগে। একসঙ্গে মা-বাবা-বোন এবং অধৈর্যের মূর্তি বৌ। ওরও যে এইরকম বোকাটে উচ্ছ্বাস ভালো লাগছে না তা বোঝা যাচ্ছে।

কোন কালের চেনা একটা পুরোনো জনের ছেলের সঙ্গে দেখা হওয়া যে একখানা দারুণ ঘটনা’ এটা ওদের কাছে হাস্যকর। কিন্তু সত্যব্রত মনে মনে স্মৃতি রোমন্থন করে চলেন, বাবাকে কী শ্রদ্ধা সমীহ করতেন হর্ষ ডাক্তার। তাছাড়া সে আমলে তো আবার ‘ব্রাহ্মণ’ বলে আলাদা একটা মর্যাদা দেওয়া ছিল। ছেলেবেলা থেকে দেখেছি পাড়ার সব মহিলা এসে কী কী সব ব্রত পুজো উপলক্ষে মাকে, যাকে বলে সম্বর্ধনা সম্মান জানিয়ে যেতেন। তারপর ছেলেমেয়ের বিয়েটিয়ে বা কোনো কারণে ‘শুভকাজ’ না কিসে মায়ের ডাক পড়তো। লোকে দেবীর মতো ভক্তি দেখাতো। মা তো ছিলেন শুচিবাইয়ের রাজা! সারাক্ষণই ভিজে শাড়ি পরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু ওইসব বিশেষ দিনে মা যখন চওড়া লালপাড় গরদ শাড়ি পরে সিঁদুরটিপ-ফিপ পরে দাঁড়াতেন, সত্যিই দেবীর মতো দেখাতো। গায়ের রং তো ছিল শঙ্খশুভ্র! শেষ জীবন অবধিই ছিল। সে তো নিশ্চয় তোদের মনে আছে, অ্যাঁ? তবে কিনা সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে সিঁদুরটিপ, পায়ে আলতা, আর চওড়া লালপাড় শাড়ি—এসবে যে মহিমা মহিমা ভাব দেখাতো, তেমন তো আর থান-ধুতি মোড়া চেহারায় খোলে না। তা সে যতই রূপটুপ থাক! কী বলিস? নয়?

কাকে বলছেন?

আর কাকে, হঠাৎ পরম ভাগ্যে পেয়ে যাওয়া টুনিকে।

একসঙ্গে এতোগুলো কথা বলছেন সত্যব্রত, এটাই তো এক আশ্চর্য ঘটনা! তায় আবার এ ধরনের ভাবপ্রবণ কথা! টুনির তো মনেই পড়ে না বাবাকে এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলতে কবে কতদিন আগে দেখেছে!

হ্যাঁ, ‘ঠাকুমা’ নামের সেই ‘শঙ্খশুভ্র’ মহিলাটিকে মনে পড়ে টুনির, তবে সেটা অনেকটা ভীতিমণ্ডিত! বিকৃতমস্তিষ্ক সেই মহিলা তো রাতদিন অকথ্য গালাগালি করতেন, যার প্রধান টার্গেট হচ্ছেন নয়নতারা। নয়নতারার কুমন্ত্রণাতেই যে তাঁর ছেলে মাকে দেশ থেকে নিয়ে এসে একটা খাঁচায় ভরে রেখে অযথা যন্ত্রণা দিচ্ছে, এটাই ছিল তাঁর গালমন্দর প্রতিপাদ্য বিষয়!

হ্যাঁ, এইটুকু স্মৃতিই সেই মহিলা সম্পর্কে।

.

টুনি দেখছে তার বাবার স্মৃতিতে ধরা আছে ‘একটি দেবী দেবীমূর্তি’।

সত্যব্রত অবশ্যই একটু ব্যতিক্রম। নইলে ক’জনের আর এমন মনে থাকে? বুড়োবুড়ি অবস্থাদের সবাই ধরে নেন যেন চিরদিন এই অবস্থাই দেখছে তাদের। তারা অ-শক্ত অক্ষম অপটু বুদ্ধিহীন।

ছেলেরা ভুলে যায় বাবা নামের ওই বাতিকগ্রস্ত বুড়ো লোকটাই একদিন এই পৃথিবীর মাটিতে তাদের মতোই মটমটিয়ে হেঁটে বেড়াতো। আর হয়তো তার ক্যাপাসিটির জোরেই ছেলেদের এই ঘরবাড়ি সাজানো সংসার। হ্যাঁ, ভুলে যায়। একদম ভুলে যায়। বৌয়ের কর্মদক্ষতায় বিগলিত আর সদা-সন্ত্রস্ত পতিকুল মনে রাখে না আজকের যুগের সংসার চালনার বহুবিধ সুবিধাযন্ত্র, আর দুটো একটা কাজের লোকের সাহায্যের খুঁটিতে ভর করে বৌয়ের এই গুণপনার মহিমা। তাও তো হয়তো একটি কী দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে! অথচ মা? মায়ের আমলে সে সংসার যাত্রা নির্বাহে এতো রকম সুবিধে ছিল না। হয়তো সামান্য একটা বাসনমাজুনি রেখেই চালিয়েছে মা। এবং মানুষ করে তুলেছে সাত-আটটা ছেলেমেয়েকে, কে ভাবতে বসে সে কথা? মায়ের যৌবনকালের কর্মময়ী হাস্যময়ী উজ্জ্বল মূর্তিটি মনে রাখবার দায় কে বহন করছে? মা চিরকালই এইরকম ঘ্যানঘেনে রোগগ্রস্ত অক্ষম অপটু বুড়ি। যে নাকি তার অতি কনিষ্ঠ বৌয়ের ওপর নিজের অভিজ্ঞতার বাহাদুরি চাপাতে আসে। বৌ ঠিকমত নিয়মপালার মধ্যে চলছে কিনা তার খবরদারি করতে বসে বৌকে খাপ্‌পা করে তোলে। মাকে তাই অনায়াসেই বলা যায়, ‘যা বোঝো না, তাই নিয়ে কথা বলতে আসো কেন? সব ব্যাপারে নাক গলাতে আসো কেন? যে মানুষটা খেটে মারা যাচ্ছে, অকারণ তাকে ব্যস্ত করে তার মেজাজ খারাপ করে দিতে যাও কেন?’

বাবা চিরদিনই অবুঝ একবগগা বাতিকগ্রস্ত বুড়ো, আর মা চিরদিনই ন্যাতা-জোবড়া অকর্মা সংসারজ্ঞানহীন বুড়ি। ব্যাস।…অন্তত বুড়ো মা-বাপের জীবদ্দশাকালে এর বেশী আর কিছু মনে পড়ে না ছেলেদের।

হয়তো তাঁরা মরে যাবার পর কদাচ কখনো—খুব স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ছেলে মা বাপের ‘জীবনদৃপ্ত’ দীপ্ত জীবনের দিনের চেহারাটি মনে রাখে।

আর মা যদি খেটেও থাকে, তো সেটা বোকামির বশে। সেই সব এলোপাথাড়ি খাটুনির কোনো মানে হয় না। কাজেই তার কোনো মূল্যও নেই।

বার্ধক্যগ্রস্তদের ঝুলি ভরে ওঠে এই অভিজ্ঞতায়।

কিন্তু সত্যব্রত তাঁর পাগলী মায়েরও দেবীমূর্তিটি সযত্নে মনের মধ্যে লালন করে এসেছেন তাহলে।

মনে রাখার ক্ষমতাটি বোধহয় সত্যব্রতর একটু বেশীই। সেই স্মৃতির সমুদ্রটি কোথায় যেন থিতিয়ে ছিল, হঠাৎ সামান্য একটা বাতাসের ধাক্কায় উত্তাল হয়ে উঠছে সে সমুদ্র।

ভাগ্যিস ‘টুনি’ আজ তার শ্বশুরের কাছে আবেদন জানিয়েছিল, ‘আজ একবার নলিন সরকার ষ্ট্রীটে যাবো বাবা?”

টুনি আজ তার আসল বাবার কাছে এসে পড়ে, বাবার এই নতুন রূপটি দেখে হাঁ করে তাকিয়ে দেখে। সেই তার চিরদিনের মিতভাষী বাবা। একসঙ্গে এতো কথা বলছেন!

ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন আর বলে চলেছেন, এখন সব ঘটা করে ‘সংহতি’ আর ‘সম্প্রীতি’র বুলি কপচাচ্ছে। যেন ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারপর খুঁটি সামলাতে আসা! লক্ষ্মীর ঘটটি আগলাতে আসা! দেশভাগের সর্বনেশে আগুন জ্বালিয়ে অখণ্ড ভারতটাকে খণ্ড খণ্ড করে দিয়ে, বলে কিনা, আগে নাকি জাতপাতের বাড়াবাড়ি ছিল, তাতেই ভেতরে ভেতরে ভাঙন ধরেছে। আমি ওকথা মানি না। এখন জাতপাতের বিচার উঠে গেছে। কোথায় গেছে? এখন আর জল চল অচল’ শব্দটা নেই, এই তো? দরকারে পড়ে যে কোনো জনের হাতে ভাত খাচ্ছো, এই তো? বলি, তাদেরকে তোমরা সমশ্রেণি ভাবতে পারছো? ‘আপনজন’ ভাবতে পারছো? আমরা সকলের হাতের ভাত জল খেতাম না! ঠিক কথা! খুব খারাপ ব্যবস্থাই। তবু ভালো করে ভেবে দেখলে, তার সঙ্গে ‘হাইজিনের’ একটা সম্পর্কও ছিল। সকল শ্রেণির পরিচ্ছন্নতাবোধ সমান নয়। তবু—যাদের হাতে খাওয়া নিষেধ ছিল, তাদের আপনজন’ ভাবতে কোনো অসুবিধে ছিল না আমাদের। আবদুল চাচা, বাহার চাচা, সইদা ফুফু বেগমদাদি, এদেরকে আমরা একান্ত আপনজন বলেই মনে করতাম। তাঁদের সঙ্গে খ্যাওয়া-মাখা ছিল না বলে ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি ছিল না। তোমার মনে আছে টুনির মা, আবদুল চাচাকে আমরা কী মান্যভক্তি করতাম? বাবাও ‘আবদুল ভাই’ ভিন্ন কথা বলতেন না। কিন্তু ওই, অভ্যাসগত নিয়মে একটু ছুঁই ছুঁই ভাব ছিল। সেটা নেহাৎই অভ্যাসমতই। বহিরঙ্গে। তো তাঁরাই কি তার জন্যে কিছু অসম্মানবোধ করতেন? মোটেই না। এঁদেরও তো এটা মজ্জাগতভাবে জানা! মুহুরি চাচা, একতলায় বাইরের বারান্দায় একটা নির্দিষ্ট চেয়ার থাকতো তাঁর জন্যে, এসে বসতেন। বাড়ির মধ্যে থেকে তাঁর জন্যে মিষ্টি আসতো, মুড়ি আসতো, গেলাস ভর্তি সদ্য জ্বাল দেওয়া গরম দুধ আসতো। তিনি সে সবের সদ্ব্যবহার করে বলতেন, ‘আঃ। প্রাণডা য্যান জুড়াই গ্যালো। দাদার থনে আইলে সক্কলকার প্রাণ জুড়ায়। তো এই বাসনগুলান কোথায় থুইয়া যামু?’ বাবা বলতেন, থাক থাক। ও নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। ওখানেই দেয়ালধারে থাক।…আবার আবদুল চাচা? তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন। মান্যগণ্য বিদ্বান মানুষ। বাবার সঙ্গে কেজো কথা কইতেই আসতেন, তবু মাঝে মাঝেই গানের সুর ভাঁজতেন, দুই এক কলি গানও গাইতেন। মাকে বলতেন ‘বৌঠান’। তো হেসে হেসে বলতেন, ‘বৌঠানরে কখনো চক্ষে দেখবার সৌভাগ্য হলোনা, শব্দভেদী বাণের মতন ছানাচিনির সুবাদে চেনা…’

ছানাচিনি! মানে? টুনি অবাক হয়।

ওই তো! ওইভাবেই মজা করে কথা বলতেন। আসলে তাঁর খুব প্রিয় খাদ্য ছিল, বাড়ির গরুর দুধের সদ্য সদ্য ঘরে কাটানো গরম ছানা আর চিনি। জানা ছিল বলেই তিনি এলেই তাঁর জন্যে ওই ব্যবস্থা। যদিও করতেন আমার পিসিই। মায়ের তো সর্বদাই সময় অভাব। তবে নির্দেশটি দিতেন মা-ই। তো শুনে হাসবি, ঘরের গরুর খাঁটি দুধের পুরো একটি সেরের ছানা বানিয়ে আবদুল চাচার জন্যে চলে আসতো ভেতর থেকে। আসতো ভারী আর মস্তবড় একটা রুপোর বাটিতে। তার সঙ্গে রুপোর চামচ। জল দেওয়া হতো রুপোর গেলাসে।…

…আবদুল চাচা পরিতোষ করে সেই ছানার তালটি ফিনিস করে, জলটি খেয়ে গেলাস নামিয়ে রেখে গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে বলতেন, বৌঠান আমাদের ভারী সেয়ানা মেয়ে কী বলেন দাদা? সোনারুপায় তো ছুঁত লাগে না, তাই রুপোর বাটিতে ছানাচিনি, রুপোর গ্লাসে পানি! মেহমানের মান্যটাও করা হইল, আবার গিরস্থর বাসনের জাতিটাও বজায় রইল।

বাবার সঙ্গে খুব কাছাকাছি বয়সের সহকর্মী বন্ধু। বাবা বলতেন, তুমি এতো ফাজিল আবদুল। তো শব্দভেদী বাণ তো তুমিই ছুঁড়ে যাও, কই সাড়া পাও কখনো?

‘আরে বলেন কী দাদা? এই একতাল ছানাচিনি? বাণের বদলে কামানের গোলার তুল্য ছুটে আসে।’…তারপর সে কী হা হা হাসি। তেমন হাসিই তার জীবনে শুনতে পাই না। আকাশভেদ করা হাসি।…

রাত্রে টুনি মায়ের কোল ঘেঁষে শোয়।

বিছানা দেখে টুসকি খুব হেসে গেছে, পিসিকে ‘খুকুমণি’ বলে। শিলাদিত্যও অপেক্ষাকৃত সহজভাবে পিসির সঙ্গে কথা বলেছে। বাড়িতে আজকাল যেটা দেখা যাচ্ছে না আর। সেই সর্বদা কৌতুক করে কথা বলার অভ্যাসটাই যেন বদলে গেছে তার। আজ একটু পুরোনো অভ্যাসে কথা বলল!

তা এতেও তো অপমান অভিমান আসে নীহারিকার। অন্যের কাছে তোমরা সবাই ভালো, আর আমার কাছেই কাঠ কাঠ! কেন? আমায় এমন হ্যানস্থা কেন?

হয়তো নীহারিকা মনস্তত্ত্বের অতি গভীরে ডুবতে জানে না বলেই এই ‘কেন’র উত্তর খুঁজে পায় না। ছেলেমেয়েরা শৈশবে তেমন বুঝতে না পারলেও একটু বড় হলেই মায়ের ‘প্রেমিকা’ মূর্তিটি একদম দু’চক্ষের বিষ দেখে।

তা নীলুর মধ্যে মাত্র একটু ক্ষ্যামা ঘেন্না করুণা আর সহৃদয় মমতার ভাব থাকলেও নীহারিকার মধ্যেকার ভাবটি তো প্রেমিকারই। ছেলেমেয়ের চোখে যেদিন থেকে ধরা পড়েছে, নীলুমামা এসে দাঁড়ালেই মায়ের চোখেমুখে আলো জ্বলে ওঠে, সেদিন থেকেই বিরূপতার সঞ্চার। দুটো মানুষেরর প্রতিই!

এমন হয়। বৈধ অবৈধতার প্রশ্ন তো দূরের কথা, অনেক ছেলেমেয়ের বাবার সম্পর্কে মায়ের বিগলিত ভাব দেখলেও বিদ্বেষ ভাব আসে। টুসকির ছেলেবেলায় তার ক্লাসের একটা মেয়ে বলেছিল, তোর বাবা যখন অফিস থেকে ফেরে তোর মা কী করে রে? টুসকি অবাক হয়ে বলেছিল, কী আবার করবে? চা-টা তৈরী করতে লাগে।

আর আহ্লাদে গদগদ হয়ে গলে পড়ে না?

এ মা? সে আবার কী?

আমার মা এইরকম। দেখলে মাথায় রাগ উঠে যায়। একে তো বাবা ফেরবার একঘণ্টা আগে থেকে হাঁ করে বারন্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে, আমি ডাকাডাকি করলেও আসবে না। তার ওপর আবার যেই না বাবাকে আসতে দেখবে, ছুটতে ছুটতে নীচে নেমে গিয়ে দরজা খুলে ধরবে। যেন এক মিনিট কড়া নাড়লে ক্ষয়ে যাবে বাবা। বাবাও তেমনি, আমার কথা কানেই নেবে না। আজেবাজে করে উত্তর দেবে, আর মার কথা হাঁ করে শুনবে। তখন দুজনের কী আহ্লাদ। মুখে যেন আলো জ্বলে!

কত বয়েস তখন টুসকির? বড়জোর বছর সাত-আট। সেই মেয়েটাও তাই। সে অবশ্য তার প্রথম সন্তান, একটাই সন্তান। টুসকির ওপরে দুই দাদা। কারো মুখে আলো জ্বলার দৃশ্য অনুধাবন করতে টুসকির একটু সময় লেগেছিল। এবং করে পর্যন্তই বিদ্বিষ্ট হতে শুরু করেছিল।

আসলে সন্তান তার মাকে শুধু মাতৃমূর্তিতেই দেখতে চায়। ব্যতিক্রম ঘটলেই বিরক্তি আসে তার। তবে টুনির মতো মেয়েদের কথা আলাদা। সে তার মা-বাবাতে চিরবিগলিত। নিতান্ত ছেলেবেলায় বলতো, আমার বাবার মতন সোন্দর পৃথিবীতে নেই। বাবা সাহেবদের থেকেও সোন্দর। আজ এই বুড়ো বয়েসেও মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে বলে, বাবাকে দেখে আজ এতো ভালো লাগল মা! একদিন বাবাকে এমন প্রাণ খুলে কথা বলতে শুনিনি।

মা হেসে বলল, কানের দুয়োর বন্ধ হয়ে গিয়ে প্রাণের দুয়োরেও পাতর চাপা পড়েছিল।…

তারপর একটু করুণ হাসি হেসে বলে, পাবনার মানুষকে দেখে আজ একেবারে ভেতরটা উথলে উঠেছে রে। অখনো সবখান প্রাণ সেই পাবনায়।

নিজেও খানিকক্ষণ সেই পাবনারই স্মৃতিচারণ করে হঠাৎ বলে ওঠেন, ত পুরোনো কথা থাক। নতুন কথা হোক। তোর ছেলেটা তো দুম করে নিজে নিজে একখান বে করে বসে, খুব খেল দ্যাখাল। ত, বৌ কেমন হলো তাই ক।

টুনি একটু চুপ করে থেকে বলে, কেমন আর? এখনকার মতোই। আমাদের কালের মতো কী আর হবে?

নয়নতারা একটু হাসেন, তুই তো চিরদিনের চাপাধাতের! খুলে কী আর বলবি? ত যাক, ভালো সংসারে পড়েছে, শিক্ষেদীক্ষে হয়ে যাবে!

অন্ধকার ঘর। কেউ কারো মুখের চেহারা দেখতে পায় না। তবে এখন চাপা মেয়ে টুনির একটু হাসি শোনা যায়। চাপা হাসিই। সেই হাসির সঙ্গে খাদে নামানো গলায় বলে, হলেই ভালো। ঠাকুরের কাছে সর্বদা সেই প্রার্থনা। তবে একটা আগুনের ফুলকি ছিটকে এসে পড়ে একটা পাড়া ভস্মীভূত করে ফেলতে পারে মা! হঠাৎ যেটা ছিটকে এসে পড়েছে, সেটা ঢিল না আগুনের ফুলকি, সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছি।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকেন নয়নতারা।

তারপর আস্তে মেয়ের গায়ে একটি হাত রেখে বলেন, তরে আমি চিরটাকাল বোকাসোকা ভালোমানুষ ভেবে আসি টুনি। তর মদ্যে যে এতো চিন্তার খ্যালা হয় তা কখনো ভাবি না।

টুনি আস্তে বললে, আমিও জানতাম না মা। এখন ভাবতে ভাবতে কত রকম কথা মাথায় এসে যায়।…তবে বড় ভাবনা হয় মা, বড় ভাবনা হয়, এতোদিনের সুখের সংসারটা— একটা বৌ হতে—

থেমে যায়।

তারপর গলার স্বর ফিরে পেয়ে বলে, তোমার কাছেই বলছি, আর কারো কাছে তো বলার নয়, আমায় মান্য করুক না করুক ক্ষতি নেই, কিন্তু খুড়শাশুড়িদের যে ডোন্টো কেয়ার করে, এতেই তো বুক কাঁপে। তাছাড়া—তোমার জামাইকেও—

আবার থামে। যেন চিরদিনের চাপা স্বভাবের দরজাটা খুলে পড়তে পড়তেও, আটকে যেতে চাইছে। তবু রাত্রির অন্ধকারে, জগতের একান্ত আপনজনের কাছে বুঝি সেটা শেষ পর্যন্ত খুলেই পড়ে। নতুন বৌয়ের বেপরোয়া ব্যবহার, লজ্জাহীনতা সংসারের অন্য সদস্যদের গ্রাহ্যের মধ্যে না আনা এবং গৃহকর্তাকে অনায়াসে বুড়ো ভদ্দরলোক বলে উল্লেখ করা! বলে, উনিই নাতির দোষ ঢেকে মেনে নিয়ে বলেছিলেন, মুখ ছোঁড়াটা’ দুম করে ‘লেখাপড়া’র বিয়ে করতে বসল কেন? আমায় জানালে আমিই যথারীতি ব্যবস্থা করতাম। আজকাল তো এমন বামুন উদ্দুরের বিয়ে কতই হচ্ছে।’…শেষ পর্যন্ত ঘটা করে বৌভাতও দিলেন দেখলে? ঠিক তখনি দাদার বাড়াবাড়ি অসুখ। তোমাদের তো যাওয়াই হলো না।…তো আমার শ্বশুরমশাই তো নাতবৌ বলে খুব কাছে টানতে চান, কেমন যেন ছিটকে চলে আসে। দিব্যি অন্যদের শুনিয়ে বলে, বাবাঃ। খুব বেঁচে গেছি। পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি। যা বকবকানি শুরু হয়েছিল। বড়োদের এই এক রোগ। কেবল পুরোনো কথার পাঁচালি গাইবে।…আবার বলে, বাবাঃ। কে জানতো এতোবড় একখানা রাবণের গুষ্টিতে এসে পড়তে হবে। প্রাণ হাঁপিয়ে আসে।

নয়নতারা এখন একটু কঠিন গলায় বলেন, তর ছেলে কিছু কর না? বৌরে সুশিক্ষা দেয় না।

ছেলে?

সন্ধ্যাতারা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, সে বলবে? সে তো সর্বদা ভয়ে কাঁটা।

ভয়ে কাঁটা? কিসের এতো ভয়? অ্যাঁ?

ওই তো কে বলে! ভয়ে যেন চোর হয়ে থাকে। বাড়িতেও—খুড়িদের কাছে বোনেদের কাছে মুখ ভুলতে পারে না, আবার বৌয়ের ভয়েও তটস্থ।…বৌ যখন ইচ্ছে সেজেগুজে বেরিয়ে যায়। ‘কোথায় যাচ্ছো’ বললে রেগে আগুন হয়। বলে, ‘চোরদায়ের আসামী নাকি যে উঠতে বসতে জবাবদিহি করতে হবে?’

নয়নতারা এখন হতভম্ব হয়ে বলেন, কী কইছিস টুনি? তর ব্যাটাটা কোথা থেকে এই অবতারকে ঘরে নিয়ে এলো!

টুনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তার নিয়তিই গছিয়ে দিয়েছে। ছেলেটার অবস্থা দেখলেও দুঃখ হয় মা!

নয়নতারাও একটা পরিতাপের নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, আমারও এমন কপাল হলো। সেই অবধি আদিত্য বিছানায়। বাপ্পাটারও খোঁজ নাই। তারক পালাল। সাহস করে যে একদিন নাতি-নাতিবৌ রে ডাকবো, তা হচ্ছে না। বৌমার সামনে বলতেই ভয় লাগে। নচেৎ একদিন কাছে এনে দেখতাম, কেমন তার মতিবুদ্ধি। বুঝ দিলে বুঝ মানে কিনা!

টুনি একটু হাসে, এরা তোমাদের হিসেবের খাতায় ধরে না মা। বুঝ মানাবে তুমি? হুঁঃ ওসব কিছু ভাবি না। শুধু ঠাকুরকে ডাকি যদি মতিবুদ্ধি ভালো করে দ্যান।

নয়নতারা বলেন, ত আমাদের ঠাকুরই ভরসা। নিজে হাতে তো করণের কিছু নাই। ত এই ভাবি, ঠাকুর ক্যান মানুষের মুতিবুদ্ধি বালো করে দ্যান না? এই যে বিশ্বরাজ্য জুড়ে মারামারি হানাহানি, এই যে আস্ত দেশখান কেটে দুখান করা, এসবই তো মানুষের দুর্মতির ফল। তবে? সক্কলে সক্কলকে এট্টু ভালোবাসল, এট্টু সয়ে-বয়ে নিল, তালেই তো চুকে গ্যালো ল্যাঠা। তাই না? ক’ টুনি? আগে মানুষ অ্যাতো ছিলেছিঁড়া ধনুকের মতো ছিল না। তোদের ছেলেকালেও ত দেখছস

এই সময় হঠাৎ পাশের ঘর থেকে সত্যব্রতর গম্ভীর অথচ স্নেহকোমল কণ্ঠের স্বর ভেসে আসে, অ টুনি। মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে যে রাত কাবার করে আনলি। এবার ঘুমিয়ে পড়।

অন্ধকারেই জিভ কেটে চুপ করে যায় দুটি প্রাণী। ইস। তাদের কথার শব্দে সত্যব্রতর ঘুম আসছে না! ছি ছি।

আসলে যে আজ সত্যব্রতর নিজেরই ঠান্ডা মাথায় ঘুমিয়ে পড়ার প্রশ্ন নেই তা এরা জানবে কী করে? সত্যব্রত ভেবে চলেছেন, হর্ষ ডাক্তারের বড় ছেলে ওই হরষিত সমাদ্দার বলেছে একদিন আসবে। তার অপেক্ষায় না থেকে একদিন যদি বাড়িতে ডাকি?

কিন্তু নিজের মধ্যে তো সে জোর নেই। বাড়িতে ডাকলে, যে মানুষটাকে যত্নআত্তির ভার নিতে হবে, সে যে একান্তই প্রতিকূল মনোভাব দেখাবে, তাতে তো সন্দেহমাত্র নেই।

আদিত্য হয়তো বলে বসবে, ভারী তো এক কোর্টের কেরানী! কবে তার বাপের সঙ্গে চেনা ছিল বলে তাকে নিয়ে এতো মাতামাতি কিসের? আর তার বৌ?

সেইদিনই হয়তো তার দারুণ মাথা ধরবে?

সংসারের কূট কচালের মধ্যে না থাকলেও সাধারণ অভিজ্ঞতায় এসব জানা সত্যব্রতর। ইস! তারক কাজল দু-দুটো কাজের লোক হাওয়া হয়ে গেল। বর্তমান অর্থসঙ্কটের কালে হয়তো এটা শাপে বর। দু-দুটো মানুষকে পোষা। তবু থাকলে ঠিকই কুলিয়ে যেতো, এটাও ঠিক। তাই হয়। ওরা থাকলে তবু সত্যব্রত একটু পৃষ্ঠবল পেতেন। সে সুখ গেছে। এখন সব বিষয়ে আদিত্যর বৌয়ের মুখাপেক্ষী! বাইরের কোনো লোক এলে সাহস করে তার জন্যে এক কাপ চায়ের আবেদন করতেও ভরসা পান না সত্যব্রত। মনের মধ্যে ইচ্ছের কাঁটাটা বিধতে থাকলেও, তার সামনে খুব অন্যমনস্কের ভাবে থাকতে হয়, যেন বাড়িতে অতিথি এলে তার আপ্যায়ন করতে হয় এটা সত্যব্রতর মাথায় নেই। পাবনার গাঙ্গুলী বাড়ির সত্যব্রত গাঙ্গুলী। যাঁদের বাড়িতে পথচলতি লোকও বাড়ির সামনে একটু দাঁড়ালে তাকে ডেকে ‘জলপানি’ দেওয়া হতো।

কী সেই জলপানি?

তা ‘রাজার জন্যে রানী, কানার জন্যে কানি’। নেহাৎ অচেনা অভাগাদের জন্যে বস্তা বস্তা মুড়ি তো মজুত থাকেই, তার সঙ্গে ভেলিগুড়, তালপাটালি, নারকেল নাড়ু। আর তেমন অতিথি হলে? দুধের সাগর তো মজুত থাকেই। গোয়ালে গোয়ালভর্তি দুধেলা গাই! এক গেলাস গরম দুধ ও দুটো বাতাসা বরাদ্দ তাদের জন্যে! কে কেমন লোক, কাকে কী দিতে হবে, সেসব ছিল পিসির নখদর্পণে। আর কাকিমারা ছিলেন তার খিদমদগার

সত্যব্রতর প্রায় আধপাগলী মাকে কেউ কাজের ক্ষেত্রে হিসেবের তালিকায় ধরতো না। কিন্তু তাঁর প্রাপ্য মর্যাদাটুকু পুরোমাত্রায় দেওয়া হতো তাঁকে। পিসি সকল কাজে একবার জিগ্যেস না করে ছাড়তেন না, ‘অ বড়বৌ! এখন কও তো কারে কী দেওয়া হবে? কার ঘরে নিমন্তন্ন যাবে?’ এমনি সব প্রশ্ন

তিনি অবশ্য ঝেড়ে জবাব দিতেন, ‘শোনো কথা? তোমার চে আমি বেশী বুঝি ঠাকুরঝি?’

সৌজন্য আর সম্মান রক্ষার দায় আর এ যুগ বহন করতে রাজি হয় না।

হর্ষ ডাক্তারের ছেলে এলে তাকে যে পরিমাণ আদর-আপ্যায়ন করা উচিত, তার সিকিও কী পেরে উঠবেন সত্যব্রত? পুরুষ জাতটা সংসারক্ষেত্রের এই জটিলতার কাছে বড় অসহায়।

কিন্তু নয়নতারা?

তিনি কী এতোই অক্ষম? তিনি পারবেন না হালটা ধরতে? না, তেমন কিছু অক্ষম তিনি নন, এখনো দশ বিশটা লোককে রান্না করে খাইয়ে দিতে পারেন। কিন্তু—তাঁকে নৌকোর হালটা হাতে দিতে রাজি হচ্ছে কে? নৌকোর বর্তমান মালিক? নাঃ। রান্নাঘরের ধারেকাচে শাশুড়িকে আসতে দেয় না নীহারিকা।

যদি নয়নতারা সসঙ্কোচ বলেন, একা খেটে সারা হচ্ছো বৌমা, আমারে কিছু কাজ দাও না? যেমন পারি করি!

বৌমা অজান্তেই বলেন, আপনাকে আবার কী ভার দেবো? এক হেঁশেলে দুজনা! এতে আমার সুবিধের থেকে অসুবিধেই বেশী!

তবে?

কে আর তার অসুবিধে ঘটাতে যাবে?

কিন্তু চিন্তায় ফেলেছে পাবনার হর্ষ ডাক্তারের ভাগ্যবিড়ম্বিত বড় ছেলেটা। হরষিত সমাদ্দার।

দোকান থেকে কিনে আনা দৈ-মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে যতোটা যা হতে পারে, অথবা কতটা কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে নিজেই রাত কাবার করে আনেন।

পাবনার হর্ষ ডাক্তারের ছেলে। সত্যব্রতর কলকাতার বাড়িতে আসবে। ভাবা যাচ্ছে না!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন