সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক – ৩

আশাপূর্ণা দেবী

।। তিন ।।

টুক টুক টুক।

জানলার কপাটে তিনটি বিশেষ ভঙ্গির টোকা পড়ে। পরিচিতই অবশ্য। বলতে গেলে সাঙ্কেতিকও বলা যায়, এ ব্যবস্থা নীহারিকার। তিনিই ছেলেকে বলে রেখেছেন, কী তোর রাজকার্য ভগবান জানেন। তবে যদি কোনোদিন ফিরতে বেশি রাত হবার চান্স থাকে সেদিন বলে রাখিস। আমি এনাদের বলে রাখবো, ‘আজ ও মিটিং করতে কলকাতার বাইরে যেতে পারে। হয়তো রাতে ফিরতে পারবে না।’… নাহলে বাড়িসুদ্ধ সবাই রাত দুপুর অবধি না খেয়ে জেগে বসে থাকবে আর হাজার কথা কইবে। জানিস তো তোর বাপকে। আবার ‘চাঁদের ওপর চুড়ো’ মা-বাপ্! তাঁরাও তো কম জ্বালাল না। মিনিটে মিনিটে খোঁজ নেওয়া চলবে। ‘অ বৌমা ‘বাপু’ আলো? অ বৌমা ‘বাপু’ বলে গেছে? এতো রাত অবধি কী করছে?’ অসহ্য লাগে বাবা! এগারোটা সাড়ে এগারোটা পার হয়ে গেলে আর কড়া নাড়া দিবি না। চুপিচুপি জানলা থেকে তারককে ডেকে দোর খুলিয়ে নিবি।…রাতটা নীচের তলায় বসবার ঘরেই শুয়ে পড়বি। লম্বা সোফাটা আছে। তাছাড়া একখানা ক্যাম্পখাটও তো রয়েছে? তারককে বলবি, খুলে পেতে দিতে। তারকের কাছেই তোর খাবারটা টিফিন কৌটোয় করে দিয়ে রাখবো, খাবার জলও থাকবে। তোকে নিয়ে যে আমার কী জ্বালা তা কী বুঝবি?

বাপ্পাদিত্য বলেছে, তোমায় তো বলি বাবা, আমায় ছেড়ে দাও, আমি পার্টি অফিসেই পড়ে থাকি। হোলটাইমার ক্যাডারদের সে সুবিধে আছে।

নীহারিকা এমন কথায় কেঁদে ফেলে। বলে, বলতে তোর মুখে আটকালো না বাপু? তোকে ছেড়ে দেব?

কী আছে? তোমাদের তো আর একটি সোনার চাঁদ ছেলে রয়েছে বাবা? আহ্লাদিপুতুল মেয়েও রয়েছে একখানা। আমার মতো একটা উড়নচণ্ডে হতভাগা থাকলো, আর না থাকলো।

বলিসনি বাবা অমন কথা!

তোমাদের এই স্যাঁতসেঁতে মাতৃস্নেহই দেশটাকে জখম করে রেখেছে।

মা মরে গেলে বুঝবি, এই স্যাঁতসেঁতে মাতৃস্নেহটা কী!

চমৎকার। হঠাৎ মরতেই বা যাবে কেন? কত বয়েস হলো?

মরার আবার হঠাৎ কী? মরার কী বয়স আছে?

সে তো আমিও যে কোন মুহূর্তে মরতে পারি। বরং আমারই চান্স বেশী।

ষাট! ষাট! এমন যা-তা কথা মুখে অনিস। দ্যাখ, তোর এই পার্টির কাজ করার ইচ্ছেয় আমি তোর বাবার সঙ্গে কী কম লড়ালড়ি করেছি। সমানেই করে চলেছি। উনি তো কিছুতেই মেনে নিতে চান না।

আশ্চর্য! কী যে সব বুঝি না। প্রত্যেকটা মানুষ একই ছাঁচে ঢালাই হবে? ভালো ছেলে হয়ে লেখাপড়া শিখবে, চাকরিবাকরি করবে। বিয়ে করবে ঘরে সংসার আর বংশবৃদ্ধি করবে। তারপর একদিন অক্কা পাবে। আর কোনো ছাঁচের কথা ভাবতেও পারা যায় না?

আমি তো বাপু তোকে বিয়ে করতেও বলি না, সংসার করতেও বলিনি। শুধু বলি বাড়িতে থাকবি। সারাদিন যতই টো টো করে বেড়াস, বাড়িতে দুবেলা দুটো খাবি, আর রাতটায় ঘরের বিছানায় শুবি। এই তো।

তোমার মনে হচ্ছে ‘এই তো’। ওইটিই দারুণ আটক, বুঝলে? কখন কোথায় গিয়ে পড়তে হয়। সর্বদা মাথায় রাখতে হয়, ‘বাড়ি গিয়ে খেতে হবে, মা বসে আছে’।

তা মার জন্যে এটুকু কষ্ট করবি। কী আর করা!

মনে মনে ভাবে নীহারিকা, আমার হয়েছে ভালো। লোকেদের মোদো মাতাল স্বভাব চরিত্র খারাপ ছেলে রাত করে বাড়ি ফিরলে মায়ের যে জ্বালা, আমারও দেখি তার থেকে কম কিছু না। কত মিছে কথার চাষ করতে হয়।…আরো জ্বালা ওই ‘ওনাদের’ জন্যে। ‘ছেলে কোন্ দলে মিশছে, তাদের কী রীতিনীতি, বিপদের ঝুঁকি আছে কিনা’ এই সবকিছু খোঁজ নেওয়া চাই। কেনরে বাবা, তোমাদের এতো কী মাথাব্যথা? উনি আবার ‘উকিলবাবু’ হওয়ার ফলে অনেক কিছুর নাড়ি নক্ষত্র জানেন তো।…উঃ আমার জীবনটা যে কী মহানিশা। যে মানুষটার হাতে পড়েছি, সে তো কোনোদিনই আমার জ্বালা বুঝল না।

হায় নীহারিকা! এ সংসারে কে কার জ্বালা বোঝে? সকলেই ভাবে একমাত্র তারই যত ‘জ্বালা’।

.

এই যে তারক, সেও এখন ওই জানলায় টোকা পড়াতেই নিয়মমাফিক একটা ফলস কাশি কেসে জানান দিল ‘জেগেছি, শুনতে পেয়েছি’। তবু কী আর একবারও না ভেবে পারল, এই এক জ্বালা হয়েছে আমার। ঘুমিয়ে স্বস্তি নাই।

তবে বড়দা সম্পর্কে ওর বেশী বিরুদ্ধে কিছু ভাবতে পারে না তারক। বড়দা সম্পর্কে তার আলাদা একটা ভালোবাসা আছে। বড়দা তার কাছে ‘ফ্যান’-এর কাছে হিরোর মতো। একদা তো ‘ভক্ত হনুমানের’ ভূমিকাতেই থাকতো।

সেই ‘একদা’ যখন তারকের পাঁচ বাড়ি বাসন মেজে বেড়ানো মা এই পীলে পেটা হাড্ডিসার দাঁত বার করা ছেলেটাকে এ বাড়িতে এনে বাড়ির গিন্নীর কাছে ধরে দিয়ে বলেছিল, এটারে আপনি আপনার ঘরে একটু ঠাঁই দ্যাও মাসিমা। আমি ঘরে থাকি না, বস্তির যত ধাড়িধাড়ি বজ্জাত ছেলের সঙ্গে মিশে পথে বেরিয়ে হুডুদ্দুম খেলা খেলতে যায়। আজ আরটু হলে গাড়িচাপা পড়ে প্রাণটা যাচ্ছিল। তোমার বাড়িতে কাজে ভর্তি করে ন্যাও আমি নিশ্চিন্দি থাকবো। দিনভোর থাকবে, রাতে এসে ঘরে নে যাব। আবার ভোরবেলা বাসন ধুতে আসবার সময় সাথে নে আসব। পাঁচটা টাকা মাইনে দিলেই হবে।

তখন সেই তারকের মার সেই ‘মাসিমা’ অর্থাৎ বাড়ির ‘গিন্নী’ ছিলেন অবশ্য নয়নতারা। তিনিই তখন চৌকস হয়ে সংসার করছেন। রান্নাঘরে রাঁধুনী ঢোকেনি তখনো। বাসনমাজুনী ঘরমুছুনিদের কাছে নীহারিকা তখন বৌদিদি।

নয়নতারা অবাক হয়ে বলেছিলেন, এ কী কাজ করবে রে?

তা এখন হাতনুড়ফুৎ ফাইফরমাসটা তো খাটতে পারবে। ক্রমশ আরো শিখবে। কীরে তারক পারবি নে?

তারক বত্রিশ পাটি দাঁত মেলে দিয়ে ঘাড় কাৎ করেছিল।…তখন তারক কী করে তাকিয়ে দেখছিল, প্রায় তারই বয়সী বড়দাবাবুকে।…অবশ্য সে ভাবেনি, তারই বয়সী। আকৃতিতে অনেকটাই বড়। আর পরে দেখতে প্রকৃতিতে যে কত বড় তার ঠিকই নেই। তবে তখন সে দেখছিল, কী ফরসা রে বাবা। যেন সায়েবদের ছানা।…কই ছোড়দাটা তো অত না।

আসলে বাপ্পাদিত্য তার আকৃতিটি পেয়েছিল অবিকল দাদুর মতো। মুখ, চোখ, গড়ন, রঙ!

‘ওঁরা যে কেন আমার ছেলের ব্যাপারে নাক গলাতে আসেন!’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করলেও ‘প্রকৃতির’ রহস্যপ্রিয়তায় নীহারিকার গর্ভজাত পুত্র, ওই পাবনার সত্যব্রত উকিলের মতো রূপ নিয়ে উদিত হয়ে বসে থাকে।

তারক অবশ্য তখনো সেই সত্যব্ৰত উকিলকে দেখেনি। তিনি তো তখন পুরোদমে কোর্ট কাছারি করছেন। পরে দেখে বলেছিল, আপনিও তোমার ঠাকুদ্দার মতন উকিল হবে, তাই না বড়দা?

বড়দা বলেছিল, দুর! উকিল হতে আমার বয়ে গেছে, আমি এরোপ্লেনের ড্রাইভার হবো। বোঁ করে আকাশে উঠে গিয়ে বাঁই বাঁই পাক খাবো। আর দেখব সব্বাই নীচেয়

হিরো তখন বছর আষ্টেকের, ফ্যান বছর সাত। তা তখন থেকেই বড়দা তারকের ত্রাণকর্তা।

বাপ্পা এসে হাঁক পাড়ে, ঠাকুমা তারককে এবার ছাড়ো তো। আমার নাটাইয়ে সুতো জড়িয়ে দেবে।…ঠাকুমা তারককে ছাতে নিয়ে যাচ্ছি, আমার ঘুড়ির ধরতাই দেবে। খবরদার ডাকাডাকি করবে না।…ঠামা ওই রোগা পটকা তারককে এতো খাটাও কেন বল তো? লজ্জা করে না? মায়া হয় না?

ঠাকুমা গালে হাত দিয়ে বলেন, শোনো কথা। তর তারককে কত খাটাচ্ছি? অ্যাঁ! আহা! ছাত থেকে গাদা গাদা শুকনো কাপড়জামা তুলে নিয়ে আসে না? বাড়ির যত বিছানা ঝাড়ে না? জুতো বুরুশ করে না? ওর বুঝি কষ্ট হয় না?

ত অরে কী আমি অর ঘর থে টেনে আনে মজুর খাটুনি খাটাচ্ছি? অর মা কাজকাম করবে বলে লাগিয়ে গেছে না?

ওর মা তোমারই মতন! ইস আমার থেকে ছোট একটা ছেলে—আমাকে যদি অন্য লোকের বাড়ি গিয়ে কাজ করতে হতো?

ঠাকুমা বলতেন, হরি! হরি! অ বৌমা! কী কথা কয় গো তোমার ছাওয়াল? …..তো বাপুরে তুই তো দেখিস নাই। আমাগোর পাবনার ওইটু ছেলেই বাগাল ছিলো।

বাগাল? বাগাল মানে?

বাগাল। মানে গোরু চরানোর কম।…ওইটু অ্যাকটা পটকা ছেলেই দশবারোটা গোরুকে গোয়ালঘর থে বার করে নে মাঠ চরাতে যেতো…তো—

হেসে উঠতেন নয়নতারা। কোঁচড়ে যা জলপান নে যেতো তা একটা জোয়ান মানুষে খেয়ে উঠতে পারবে না।

তোমার খালি সব কথায়—আমাদের পাবনায়। আমাদের পাবনায়। পাবনা যদি এতো ভালো, তো চলে এসেছিলে ক্যানো? অ্যাঁ। নাতির তীব্র প্রশ্ন।

ঠাকুমার দীর্ণ উত্তর, চলে এসেছি কী আর সাধে রে দাদা? ঘাড় ধাক্কিয়ে বিদেয় করে দেচে!

উঃ! অমনি তোমার কান্না পেয়ে গেল। ‘পাবনা’র কথা হলেই কান্না। তো এখানে তো আর গোরু নেই, আর তারকও রাখাল না বাগাল কী যেন নয় তো, ওকে এখন ছাড়ো তো! ও আমার গুলতি বানিয়ে দেবে।

তো দিকগে না। অমি কী তর তারকরে ধরে রেখেছি?…তারক তর একবারে ‘প্রাণ’। হাসতেন নয়নতারা।

কিন্তু নীহারিকা ছেলের এই তারক-প্রীতিটি দু’চক্ষের বিষ দেখতো। ‘বাবু’দের ছেলে আবার বাসনমাজুনির ছেলের সঙ্গে এতো খেলবে কী?

কিন্তু ছেলেকে যদি বলে, খেলতে ইচ্ছে হয়, নিজের ভাইয়ের সঙ্গে খ্যাল না বাবা! যদিও ‘নিজের ভাইটি’ তখন মাত্র পাঁচ বছরের।

বাপ্পা অবজ্ঞা ভরে উত্তর দেয়, আহা। ‘নিজের ভাই’। ওই শিলুটা আবার খেলার কী জানে? আর ও আমার কোনো কথা শোনে?

‘শোনে না’ বললে অবশ্য শিলাদিত্যর প্রতি অন্যায় দোষারোপ হবে। আসলে সে দাদার প্রোগ্রামসমূহ বোঝেই না।…তাছাড়া তারকের তুল্য বশংবদ আর কে হবে? যে খেলা ভালো লাগছে না, সে খেলায় আটকে থাকবে, নিজের ভাই বলে? হ্যাৎ। অতএব তারক!

তা তার সঙ্গে আবার ঠাকুমার মদত। ছানাপোনার কী আর জাত গোত্তর গেয়ান থাকে বৌমা? ছেলের বন্ধু ছেলে?…

তবে আর কী। নীহারিকার ছেলে তারকের গলা ধরে বন্ধুত্ব করে বেড়াক।…তারকেরও সাহসের কমতি নেই। ‘বড়দা বড়দা’ করে কী গায়ে পড়া ভাব। কমতি থাকবেই বা কেন? বাবুর ছেলেরা যা খাবে, বাসনমাজুনির ছেলেও তাই খাবে। …এ নাকি গিন্নীর ‘পাবনাই’ প্যাটার্ন। মুড়িমিছরির কে দর! আমার ছেলেরা জলখাবারে পরোটা, আলুচচ্চড়ি, রসগোল্লা খাচ্ছে, তারকও তাই খাচ্ছে। …অসহ্য। শুধু খরচ বলেই নয়, এতে যেন প্রেষ্টিজেরও হানি।

অন্তত নীহারিকার তাই মত। ঘরে এসে ঝাল ঝাড়ে নীহারিকা। আমার মা বলেন, —অপচয়ে কুবেরের ভাণ্ডারও শূন্য হয়ে যায়।’

কিন্তু তখনো খরচের টাকা আসে উকিল কর্তার পকেট থেকে। তাই সেই অপচয় নিবারণের প্রকল্পটি তৈরি হয়ে ওঠেনি। …পরে হলো। যখন উকিলের পকেট শূন্য হয়ে গেল। অপচয় নিবারণের অনেক পথ আবিষ্কার হলো। আশ্চর্য! তবু তারক নামের সেই ছেলেটা এই বাড়িতেই রয়ে গেছে। এখন আবার নীহারিকার ছা তারক! জো তারক! কারণ বোঝে সে, তারক ব্যতীত তার সংসার অচল হয়ে উঠবে। তারক যে কোন ফাঁকে ঠাকুমার রান্নাঘরের দরজায় বসে থেকে রান্নাটা এতখানি শিখে ফেলেছিল, তা কে জানতো! এখন তারকই সেখানের ভারপ্রাপ্ত অফিসার। নীহারিকা তাকে তোয়াজ করে চলে।

‘কাজল’ হচ্ছে খিদমদগারিনী।

তথাপি নীহারিকার মনে হয়, নিজে সে খেটে খেটে সারা হয়ে গেল। আসলে সর্বদাই যে মনে হয় সংসারটা তার অহেতুক ভারী! ‘অহেতুক ভার’ বড় বেশি ভার। তার উপর আবার বড় ছেলেকে নিয়ে সমস্যা।

কিন্তু ছেলেমেয়ে দুইই বড় হয়ে উঠলে ক্রমেই যে সমস্যা হয়ে ওঠে, সে জ্ঞানটা নীহারিকার এখনো আসেনি। নীহারিকা তাই এখন বড়ছেলের ব্যাপারে আপাত সমস্যার সমাধান করে তারকের সাহায্যে। তার সঙ্গে গোপন সমঝোতায়। ভাবে অন্য দুটোকে নিয়ে তো কোনো ভাবনা নেই। ওই বাপুটাই!

.

দরজাটা খুলে দিয়ে তারক নিঃশব্দে পাশ হয়ে সরে দাঁড়াল। বাপ্পাও ঢুকে এলো নিঃশব্দে। তারপর ভিতরে ঢুকে এল। নীচের তলাটা সবই তারকের দখলে।

সিঁড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর আর কেউ নীচে নামে না। অতএব তারক বড়দার জন্যে ক্যাম্প খাট পেতে শয্যা রচনা করেই রেখেছে—বসবার ঘরের একাংশেই।

তারকের রাজশয্যা পূর্বেকার রান্নাঘরে। যেখানে দেয়ালের একধারে ইট সিমেন্টে গাঁথা একজোড়া উনুন পাতা আছে। কয়লার উনুন।

নয়নতারার আমলে এই নীচের তলাতেই ছিল রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, খাবার ঘর। নীহারিকা সব ব্যবস্থাই দোতলায় উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে। অত কে খাটে? তাছাড়া রান্না তো গ্যাসের উনুনে, ঝুলকালি হবার ভয় নেই।

বসবার ঘরেরই একটা ছোট টেবিলে তারক বড়দার ‘খাবার’ সম্বলিত টিফিন কৌটোটাও রেখেছে।

বাপ্পা একটু হেসে ইশারায় প্রশ্ন করলো, সবাই ঘুমিয়েছে?

তারকও ইশারায় জানালো, ঘুমিয়েছে কিনা জানিনা তবে শুয়েছে। বাপ্পা নীচের তলারই স্নানের ঘরে ঢুকে গেল।

তারকের ব্যবস্থাপনায় শুকনো তোয়ালে ফ্রেশ জামা-পায়জামারও অভাব হলো না তার বড়দার।

বাপ্পা হেসে সেগুলো নিয়ে বললো, তুই যদি কারো বৌ হতিস তারক, তাহলে খুব ভালো বৌ হতিস।

তারক কৃতার্থমন্যের মতো একটু হাসে। দাঁত উঁচু তারকের এই হাসিটা সেই ছেলেবেলার মতো দেখতে লাগে। একদা যখন সেই ঘুড়িতে ভালো ধরতাই দিয়ে প্রশংসা পেয়ে কৃতার্থ হাসি হাসতো, এখনো প্রায় সেইরকমই। অথচ বাড়ির আর সকলের মতে তারকের হাবভাব চালচলন যেন রাজ্যপালের পুষ্যিপুত্তুরের’ মতো। তারক একখানি নবাব খাঞ্জা খাঁ।

বড়দার সামনে অন্য তারক। খেয়ে এসেছেন নাকি?

খেয়ে? আরে, যেখানে গিয়ে পড়েছিলাম সেখানে ‘খাওয়ার’ কথাই ওঠে না।… আছে নাকি কিছু?

থাকবে না? আসুন

হৃষ্টচিত্তে খাবারটা গুছিয়ে প্লেটে সাজিয়ে দেয় তারক।

বাপ্পাও প্লেটটা টেনে নিয়ে দেখে শুনে একটু হৃষ্টচিত্তেই বলে, রাত্তির একটার সময় পরোটা, চিংড়ি ফুলকপির ডালনা, বেগুন ভাজা, আলুর দম! ম্যাজিক ম্যাজিক লাগছে রে!

তারপরই একটু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, একসঙ্গে আর যারা যারা গিয়েছিলাম, তাদের ভাগ্যে কী জুটলো কে জানে!

সে নিয়ে মাথা ঘামিও না। যার ভাগ্যে যা লেখা থাকে তাই জোটে।…তো কোথায় গেছলেন গো বড়দা?

সে কাছাকাছি একটা গ্রামে। জগৎবল্লভপুরে।

কী হলো সেখানে? মিটিং?

তা তো হলোই। তাছাড়াও কিছু। যা হয়েছে সেটা আপাতত প্ৰকাশিতব্য নয়।

বাপ্পার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করার সাহস তার মা-বাপের হয় না। ভাইয়ের তো বাদই দাও। বোন টুসকি অবশ্য কখনো সে দুঃসাহস করে। দাদার মেজাজ ভালো থাকলে কিছু কিছু উত্তর পায়, মেজাজ ভালো না থাকলে শীতলতার কাঠিন্যে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। কিন্তু তারকের?

তারক হচ্ছে অবোধের দুঃসাহস। তাই তারক বলে, আচ্ছা বড়দা এই যে আপনি রাত নাই, দিন নাই প্রাণপাত খাটছো, তাতে কাদের কী ভালো হচ্ছে?

খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, তবু বাপ্পা বসে থেকেই একটু সোজা হয়ে বলে, এ কথা তো রোজ একবার করে জিগ্যেস করিস।

রোজ আপনারে পাচ্ছি বুঝি? তা সত্ত্বেও বলি, জিগ্যেসই করি, সদুত্তর তেমন পাই কই? আপনাদের এতটা খাটুনির বিনিময়ে কার কী লাভ হচ্ছে, সেটাই তো ধন্ধ রয়ে যায়।

বললে তুই বুঝতে পারবি?

তো বড়দা, আপনাদের কাজ তো রাজ্যির যতো নিরোক্ষার মুখ্যা গরীবদের নিয়েই। তাদেরকে বোঝাতে হলে, সেই মতোই বলতে হয়। হয় না? …এদিকে কতজনা কত রকম বলে—শুনে—

চট করে চেহারা বদলে যায়।

বাপ্পা শক্ত হয়ে বসে। শক্ত গলায় বলে, কে কী বলে? কী শুনিস?

আহা বাড়ির লোক কী আর বলে? শুনি যত সব হাটে-বাজারে পথে-ঘাটে। দেশসুদ্ধু লোকই তো এখন ‘পলিটিক্স’ হয়ে গেছে। তাই নিয়েই কথা বলে। ফড়ে থেকে রিকশাওলারা পর্যন্ত খেটে খাওয়া জনেরাই বেশী বলে। শুনে শুনে—

বাপ্পা এখন একটু শিথিল ভঙ্গিতে বলে, বলেটা কী?

ওই তো বলে, গরীবের আর ছাই হচ্ছে। গরীব চেরকাল যে অন্ধোকারেই, সেই অন্ধোকারেই। ভালোটালো যা হচ্ছে, তা নেতাদের। আর—

তারক একটু ঢোক গেলে।

ও। আর কী বলে?

শুনলে আপনি রেগে যাবেন হয়তো।

আরে বাবা, আমি তো আর নেতা নই? আমিও তো খেটে খাওয়া জনেদের একজন। ইয়ে বলে, একদা আগে নেতারা সব গরীবী চালে থাকতো, কৌটো বাজিয়ে বাজিয়ে পয়সা তুলে পার্টি ফান্ডে জমা দিয়ে কোনোমতে দিন চালাতো। তখন বাবুয়ানা বিলাসিতাকে পাপ বলতো। বলতো—আমরা গরীব, গরীবের জন্যে লড়তে নেবেছি। তা এখন তো সব উল্টোপাল্টা কাণ্ড হয়ে চলেছে। নেতাদের হালচাল আকাশপাতাল বদলে গেছে।

বাপ্পা স্থির গলায় বলে, এসব তোদের ওই হাটে-বাজারের লোকেরা বলে?

বলেই তো বড়দা। বেশির ভাগ জনই বলে। বলে, এখন যতসব পেটমোটা বিজিনেসম্যানরা পার্টি ফান্ডে এনতার মোটা মোটা চাঁদা দিয়ে নেতাদেরকে কিনে নিয়েছে। নেতারা এখন পয়সার মুখ দেখে ইষ্টমন্তর ভুলে গিয়ে নবাব বাদশার চালে চলছে।

বলতে বলতে তারক উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, মিথ্যেও তো বলে না বড়দা। বলে, অগ্রে রাইটাসে যারা রাজত্ব করতো তেনাদের আড়ম্বর বাবুয়ানার ব্যবস্থা দেখে নতুন কর্তারা কতো টিটকিরি দিয়েছে। …আর এখন সেই তারা নিজেরাই হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা শুধু বাহারের জন্যে ঢালছে। অথোচো বস্তির লোকেদের যে নরককুণ্ডু সেই নরককুণ্ডু। আর নেতাদের বিরাট বিরাট অট্টালিকা হচ্ছে। দু’পাঁচখানা গাড়ি হচ্ছে। তাদের আত্মজনরা পর্যন্ত ফুলে কলাগাছ হচ্ছে—

বড়দা গম্ভীরভাবে বলে, ওরা সব শোনা কথা বলে বুঝলি? খবরের কাগজে বানিয়ে বানিয়ে যত সব মিছে কথা বলে, তাই শুনে শুনে—

তারকও হঠাৎ বেশ শক্ত হয়ে বলে, এটা আপনি কী বলছেন বড়দা? আপনার মতন জ্ঞানীগুণীর মুখে এ কথা কী সাজে? লোকের শুধু কানই আছে? চোখ নাই।

ও। আমায় খুব জ্ঞানীগুণী ঠাওরেছিস বুঝি?

আমার কাছে তাই।

তারক ঈষৎ গাঢ় স্বরে বলে, লোকে চোখে দেখে না? … নেতারা এখন সব ঠাণ্ডিগাড়ির মধ্যে বসে ভেঁপু বাজিয়ে রাস্তা কাঁপিয়ে ভিন্ন চলে না।…সবাই এক একখানি ক্ষুদে নবাব …এই যে বন্যেয় দেশ ভেসে যায়!—অনেকদিন আগেকার নেতারা নাকি নিজের শান্তি চেপে-ডোঙা চেপে-নৌকো চেপে তাদের দুঃখদুর্দশা দেখতে গেছে, কাছে বসে শুনেছে তাদের কথা। আর এখন? এখন নেতারা ‘হেলিকেপ্‌টারে’ চেপে আকাশ থেকে পরিদর্শন করছেন। এসব তো আর বানানো কথা না? সবাই তো চোখেই দেখছে।

বড়দা আরো গম্ভীর হয়ে গিয়ে উঠে পড়ে বলে, তখন পরিস্থিতি অন্য ছিল। ওসব শালতি ডোঙা সম্ভব ছিল। এখন পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে।

তারক একটা হাই তুলে বলে, তো সেই কথাই বলাবলি করে সবাই। নেতাদের অবস্থা আকাশ-পাতাল বদল হয়ে গেছে। গরীবের যা ছিল তাই আছে।…ওই নিয়ে তো একদিন নতুন বাজারে বেদম মারপিট হয়ে গেল। এক দল বলছে, নেতাদের এতো টাকা আসে কোথা থেকে? সবাই দুর্নীতি করছে। আর এক দল তাই শুনে এই মার সেই মার। তারপর একখানা রক্তারক্তি কাণ্ড। …আর পুলিশের যা স্বভাব, সব মিটে গেলে, দুটো ফালতু লোককে ‘হ্যাট হ্যাট’ করে তুলে নিয়ে চলে গেল। তো আচ্ছা বড়দা–

বড়দা গম্ভীরতর হয়ে বলে, এবার থাম তারক। বেদম ঘুম পাচ্ছে।

তারক ত্রস্তচিত্তে সরে আসে।

বাপ্পাদিত্য নামের ছেলেটা ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে তার ক্যাম্প খাটের বিছানায়। ঘুম পাচ্ছে বললেও অনেকক্ষণ ঘুম আসে না। মনে মনে প্রাণপণে মন্ত্র জপার মতো বলতে থাকে, আমাদের প্রথম শর্তই হচ্ছে প্রশ্নহীন আনুগত্য। প্রশ্নহীন আনুগত্য! …

কিন্তু আশেপাশে সামনের দেওয়ালে যদি তীক্ষ্ণ তীব্র সব প্রশ্নরা দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে থাকে? …কী করে তাদের সেই দাঁতদের ভেঙে উড়িয়ে দেওয়া যাবে? …এদিকে—আরো তীব্র প্রশ্ন উঠবে না, কেন? কেন? কেন? কেন এই আদর্শচ্যুতি?…কেন আমাদের মতো নিঃশঙ্কচিত্ত ছেলের দল দলে দলে যে আলোকরশ্মির আকর্ষণে ছুটে এসেছিল, তাদের চোখের সামনে থেকে সে আলো মুছে ফেলা হচ্ছে? কেন তাদেরকে একটা দিশেহারা অবস্থায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে?

হাটে-বাজারে পথে-ঘাটে যেসব কথা উচ্চারিত হতে থাকে, সে সমস্তই কি ভিত্তিহীন ‘মিথ্যা কথা’ মাত্র? …এখন কী সেই দিশেহারা দলটাকে ঠেলে নিয়ে যাবে তোমরা এমন এক কিনারায়, যেখান থেকে তাদের সহজেই ঠেলে ফেলে দেওয়া যাবে একটা অনিশ্চিত গহ্বরে? যেখানে পড়ে থাকতে থাকতে তারা নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আর ক্ষতবিক্ষত হতে হতে কোনো এক সময় স্রোতে ভেসে যাবে। …

তখন অবশ্য আর তারা ‘ছেলে’ থাকবে না, হয়ে পড়বে এক একটা জীবনে ব্যর্থ আধবুড়ো লোক। যাদের জীবনে তখন জীবিকা অর্জনের চেষ্টা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য থাকবে না।…

আর—আর যদি কেউ নিজের সঙ্গে লড়াইয়ে না নামে? তাদের জন্যে অবশ্যই জুটবে আরাম, আয়েস, নিশ্চিত অন্নের প্রতিশ্রুতি, নিশ্চিত আশ্রয়ের আশ্বাস।…

বাপ্পা নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলো, হয়তো বেশিরভাগ লোকই এই ‘শেষের পথের’ সামিল হবে। …এক স্বপ্নময় মায়াগোলকের পিছনে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একসময় যদি দেখা যায়, সেটা সাবানের ফানুস হয়ে গেছে, তাহলে আর কিসের প্রেরণায় খাড়া থাকতে পারা যাবে? আরাম আয়েস সুবিধা, ইচ্ছাপূরণের যথেচ্ছ সুখ, ক্ষমতা, এসবের আকর্ষণ কী সোজা? কে ধার ধারবে তখন ওটা ‘সুনীতি’ আঁর ওটা ‘দুর্নীতি’ বলে। …ভাবতে ভাবতে অস্থির হলো, আবার শেষ পর্যন্ত একসময় ঘুমিয়েও পড়লো।

সারাটা দিনের ক্লান্তি তো কাজ করবেই। …অস্নাত অভুক্ত অবস্থায় একটা সংঘর্ষের মোকাবিলা করতে করতে কোথা দিয়ে দিনটা গড়িয়ে রাতে এসে পৌঁছে গেছলো! টের পেয়েছে ফেরার সময়।

তারক নামের মুখ্যু ওই ছেলেটাও অনেকক্ষণ না ঘুমিয়ে ভাবতে থাকে, কে জানে কী করে বেড়ায় বড়দা! সেই সায়েরের মতন রংটা জ্বলে পুড়ে, একদম তাঁবা হয়ে গেছে। চুলগুলো যেন কাকের বাসা, হাতে পায়ে খড়ি ওঠা। …ছোটদা তো রঙে বড়দার ধারেকাছে ছিল না, তবু কেমন চেকনাই। বড়দার জন্যেই যে কেন প্রাণটা কাঁদে, ওনার জন্যেই এখানে পড়ে থাকা।…

তারকের মা এখন আর পাঁচবাড়ি বাসন মেজে বেড়ায় না, গেরস্থবাড়িতে খাওয়া-পরার কাজে লেগে মোটামুটি ভালই আছে। এ যুগে তো আর গেরস্থর রান্নাঘরে ঢুকে পড়বার জন্যে ‘জাতপাত জলচল’ এইসব কূটকচালে প্রশ্নর মুখোমুখি হতে হয় না। অতএব সহজেই কাজ জোটে।

তারকের মা স্বল্প দেখে, এই যে এখন মাইনের টাকাটি সব জমে যাচ্ছে, এক পয়সাও খরচা হচ্ছে না, পান দোক্তার খরচটি পর্যন্ত মালিকের, এই টাকাটা নিয়ে তাদের লক্ষ্মীকান্তপুরে জ্ঞাতিদের সঙ্গে যে ধানজমিটুকু আছে, তার সঙ্গে এক লপ্তে আর একটু জমি কিনে, একখানা ঘর তুলে গুছিয়ে ‘গেরস্থ’ হয়ে বসবে। শেষজীবনে ‘মানুষ’ পরিচয়ের মধ্যে থাকবে। … ছেলের বিয়ে দিয়ে শাওরীর’ পোস্ট পাবে, নাতি-নাতনীকে কোলেপিঠে করবে।

তা স্বপ্ন আর কে না দেখে?

মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরাই যে দেখে না, তাই বা কে বলতে পারে? …হয়তো কখনো কখনো শুকনো রুক্ষ অঞ্চলের পাখিরা কোনো অজানা দ্বীপের ফলভারাবনত সমারোহময় সবুজের স্বল্প দেখে। হয়তো খরা দুর্ভিক্ষে জর্জরিত ভূমির গরুরা স্বপ্ন দেখে আদিগন্তু তৃণাচ্ছাদিত ভূমির। তারকের মা তো মানুষ। স্বপ্ন দেখার তো রাইটই আছে তার।

জমির ধান্ধায় মাঝে মাঝেই দু’একবেলা ছুটি নিয়ে গ্রামে এসে ঢোকে, জমির খোঁজখাঁজ করে। এখানের ঘরগেরস্থী মেয়েদের তুলনায় তার সাজেসজ্জায় চলনেবলনে রীতিমতো শহুরে আভিজাত্যের ছাপ আছে। যার সঙ্গে দেখা হয়, তার কাছ থেকে সমীহই পায়।… একদা যে সদ্যবিধবা বৌটা, একটা নিতান্ত শিশুপুত্রকে নিয়ে পেটের দায়ে কাজের চেষ্টায় গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় এক জ্ঞাতি সম্পর্কে ননদাইয়ের সহায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, সেই ‘ছোট্ট’ কথাটা এখন আর কেউ মনে রাখেনি। এখন যে পরাণের বৌ শহরে চাকরি করে টাকা পয়সা জমিয়ে গ্রামে আসছে জমি কিনে ঘর তুলবে বলে, কনের খোঁজ করছে ছেলের বিয়ে দেবে বলে, এতে তার মানমর্যাদাটি অনেকখানি বেড়ে গেছে।

জ্ঞাতি ভাসুর বলে, তা পরাণের বৌ যদি নেয়, আমি সুবিদে দরে জমির সন্ধান দিতি পারি। তবে এতোদিন কলকেতার বাবুর বাড়ি থাকা তারক কী গাঁয়ে এসে চাষাবাদের কাজ করতে পারবে?

ভাসুরের বৌ বলে, চাষবাস না পারুক। গাঁয়েও তো এখন কত কাজ পেতেছে ছেলেপুেলে। … কতো সব ‘পোকল্প’ হয়েচে, তা বাদ পঞ্চায়েতিতে কতো কাজ পাচ্ছে। দ্যাকো না, এই সিদিন মণ্ডলদের যে ছেলেডা ট্যানা পরে ঘুরেচে আর চুরি করে অপরের পুকুরে ম্যাচ ধরেচে, এখনো তার পরনে শার্ট পেল্টুন, গলায় ‘উমাল’। হাতে হাতঘড়ি। তারক তেমন কাজও পেয়ে যেতি পারে।

অতঃপর সেও স্বপ্ন দেখে তার গলায় পড়ে থাকা মা-বাপ মরা বোনঝিটাকে তারকের ঘাড়ে গছাতে পারে কিনা।

এই দেখনের অঞ্চলের বেটাছেলেদের সঙ্গে শহরের যতটা না যোগসূত্র, মেয়েছেলেদের তার থেকে অনেক বেশী। এখান থেকে অনেক মেয়েমানুষই ডেলি প্যাসেঞ্জারী করে। ভোরের ট্রেনে চাপে, শহরে গিয়ে নেমে পড়ে, এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সারাটা দিন বাসনমাজুনি কাপড়কাচুনির ভূমিকা পালন করে আবার পড়ন্ত বেলার ট্রেনে ফিরে আপন সংসারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারাদিনে ঘোরাফেরার মধ্যে হয়তো তিন চার বাড়ি থেকে জোটা চা রুটি। সেই কাকভোরে যা দুটো পান্তা খেয়ে বেরোয় তাতেই পিত্তি রক্ষে। সংসারে যে বুড়িটুড়ি একটা থাকে, শাশুড়ি পিসশাশুড়ি মা মাসি, তাদের দৌলতেই স্বামী সন্তান সময়ে দুটো ভাতজল পায়। এই বৌ মেয়েরা নগদ টাকা রোজগার করে বলে পুরুষের তুল্য মান্য না পাক, ব্যবহারটা পায়। বাড়ি ফিরলে, কেউ মুখনাড়া দিতে আসে না ‘এতোক্ষণ বাইরে কাটিয়ে এলি?’ বলে।

ডেলি প্যাসেঞ্জারী করে বলে যে এরা ট্রেনের ভাড়া গোনে, এমন ভাববার কোনো কারণ নেই। ওরা অনায়াসেই বলে, টেরেন ভাড়া দিতে গেলে কী আর আমাদের পোষায় বৌদিদি? তালে পেটে কী খাবো?

ট্রেন কোম্পানী কিছু বলে না?

কোম্পানী তো আর টেরেনে বসে নেই বৌদিদি? যারা থাকে তারা তো আমাদের চেনা জানা। আমাদের আবস্তা জানে, বোঝে।

শহরে আসা যাওয়া করতে করতেই এদের চোখ কান ভালো মতোই ফোটে এবং সেখানের চাহিদাটিও বোঝে। তাই এরা এদের মেয়েগুলো একটু মাথাঝাড়া দিলেই সঙ্গে করে শহরে নিয়ে এসে বাবুদের বাড়িতে ‘কাজের মেয়ে’ রূপে ভর্তি করে দেয়।

এখন কাজের মেয়ের যে দারুর চাহিদা। আজকের আধুনিক সংসারজীবন, ‘সুখী পরিবার ছোট পরিবার’রা কেবলমাত্র একটি ‘কাজের মেয়ের’ বৃত্তে ভর করেই বিকশিত হয়ে থাকে। আর কাউকে প্রয়োজন হয় না তাদের। সেই মেয়েই একাধারে সর্বার্থসাধিকা। তাকে বিহনে গৃহিনীর চোখে সর্ষেফুল।

সেই গৃহিণীটির নিজের চাকরি বজায় রাখা সম্ভব হয় একমাত্র ওই একটি তরুণী কাজের মেয়ের ভরসাতেই। মেয়েটা সংসারের যাবতীয় কাজ করবে, সারাদিন বাড়ি পাহারা দেবে, ছোট বাচ্চাকে সামলাবে, অপেক্ষাকৃত বড় হলে তাকে স্কুলে ‘আনা যানা’ করবে, এবং এলে নাওয়াবে খাওয়াবে ঘুম পাড়াবে।

এর বিনিময়ে অবশ্যই মনিবানী মহিলা রীতিমতো তোয়াজের পথ ধরেন। অর্থাৎ গ্রামের সেই চাষীবাসী বাবার মেয়েটাকে আধুনিক জীবন আর বাবুয়ানায় রপ্ত করে তোলেন। মনিবানীর প্রসাদী শাড়ি ব্লাউসে সে বাড়ির মেয়ের চেহারায় ঘুরে বেড়ায়, এবং শত কাজের মধ্যেও ক্রমশই শতরূপে বিকশিত হয়ে ওঠে। …বাবুর মেয়ে বা বৌদিদির মতো টাইট করে শাড়ি পরতে শেখে, শাওয়ার খুলে চান করতে শেখে, নিজের জামাশাড়ি সাবানে কেচে নেবার বদলে লন্ড্রীতে আর্জেন্ট কাচিয়ে আনতে শেখে, টিভি-র ছবি দেখাদেখি ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে শেখে, হিন্দি সিনেমার নায়িকার মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে গা মোচড় দিয়ে কথা বলতে শেখে, বাসি রুটি অথবা পান্তা ভাত দেখলে শিউরে উঠতে শেখে, এবং চুল নিয়ে এলিয়ে ছড়িয়ে কায়দা করতে শেখে, শেখে আরো অনেক কিছুই। তবে যেটা শেখাতে চাইলেও শিখতে চায় না সেটা হচ্ছে লেখাপড়া। সে পথে একটু আধটু হাঁটাতে চেষ্টা করলেও তার দিক দিয়ে হাঁটতে চায় না। কিন্তু তাতে কী? অক্ষর পরিচয় না হয়েও কেবলমাত্র টি ভি-র দৌলতেই তো তার বিশ্বপরিচয় ঘটে যায়।

সে গ্যাস স্টোভ জ্বালাতে শেখে, প্রেসার কুকার ব্যবহার করতে শেখে এবং শেখার পরিধি বাড়াতে বাড়াতে মনিবানীকে একেবারে একান্ত নির্ভরশীল করে তোলে।

এহেন সময়ই হঠাৎ একদিন বিনা নোটিশে গ্রাম থেকে মা কী বাবা এসে, ‘মেয়ের বে দেব’ বলে নিয়ে চলে যায়।

মনিবানী চোখে অন্ধকার দেখেন, মনে মনে গালি-গালাজ করেন এবং আবার কেঁদে ককিয়ে একটা কাজের মেয়ে যোগাড় করে নেন। হয়তো ফ্রক পরা একটা মেয়ে। তা হোক -তার ওপরই ঘরবাড়ি সমগ্র সংসারের এবং হয়তো বাচ্চারও দায়িত্ব দিয়ে রেখে স্বামী-স্ত্রী অফিসে বেরিয়ে যান।

এই হচ্ছে আজকের সমাজের কাজের মেয়ের ভূমিকা।

কিন্তু সেই অতি শহুরে হয়ে ওঠা মেয়েগুলোর আবার পানাপুকুরে গা ডোবাতে আর পান্তা খেতে গিয়ে কী অবস্থা হয়, সে ইতিহাস অজ্ঞাত।

হয়তো কেউ কেউ অজ্ঞাত অন্ধকারে চিরতরেই হারিয়ে যায়। তবে অধিকাংশই হয়তো বছর কয়েক পরে আবার পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়ায়। হয়তো দেখা যায় ইতিমধ্যেই কয়েকটি শাবকের জননী হয়ে পড়ছে, এবং সেগুলোকে যথারীতি ঘরে কোনো বুড়ির জিম্বায় রেখে, ডেলি প্যাসেঞ্জারী করতে বেরিয়ে পড়েছে। হয়তো শুধু বাবুদের বাড়ির কাজই নয়, চাল চালানোর কারবারও রপ্ত করে ফেলে রোজগারের ক্ষেত্রে একটা নতুন মাত্রা যোগ করে ফেলেছে। লক্ষ্মীকান্তপুর, বারুইপুর, সোনারপুর, ক্যানিং—এই সব নিয়ে তাদের কর্মক্ষেত্রের এলাকা বিস্তৃত।

তারকের মায়ের জ্ঞাতি জায়ের ওইরকম একটি বোনঝি গড়িয়া অঞ্চলে কোনো বৌদিদির গোকুলে বাড়ছে। তাকে নিয়েই চটপট স্বপ্ন দেখে ফেলে তারকের জ্যেঠি।

জীবন যার যেমনই হোক, ‘স্বপ্ন’ দেখার কামাই নেই কারুর। যে যার আপন পরিবেশ পরিধির মধ্যেই স্বপ্ন দেখে, কেউ বা সে পরিধি ছাড়িয়ে অসম্ভবের স্বপ্ন দেখে। যাদের এখনো ভবিষ্যৎটা হাতে আছে তারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, যাদের সে জিনিসটা হাত থেকে গড়িয়ে পড়ে গেছে, অতএব তারা সেই হারিয়ে যাওয়া অতীতের অরণ্যে আপন অস্তিত্বটির খুঁজে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে।

পাবনার গাঙ্গুলীবাড়ির বৌ নয়নতারা চল্লিশ বছর পরেও ফিরে ফিরে সেই গাঙ্গুলীবাড়িটার এখানে সেখানে দালানে বারান্দায়, বিশাল রান্নাশালার কাছাকাছি ঘুরে ফিরে আপন অস্তিত্বটুকু খুঁজে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে।

তা এমন স্বপ্ন একদা নয়নতারার শাশুড়ি বিন্দুবাসিনীও দেখতেন। ধ্যানব্রত উকিলের পরমাসুন্দরী পরিবার, শাঁখের মতো শাদা গায়ের রং, মুখের চাটুনি নিখুঁত। চাঁচাছোলা গড়ন। মেঘের মতো একঢাল চুল ছিল, সিঁদুর-মোছার পরোয়ানা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই কেশপাশকে মুড়িয়ে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

আর বেশবাসের মধ্যে সর্বদা একখানা ভিজে থান। যখন তখন পুকুরে নেমে নেমে একবার করে মাথাটা চুবিয়ে আসার পক্ষে ওই সাজটিই আদর্শ। তাছাড়া বিন্দুবাসিনী ‘শুদ্ধবস্ত্রে’-র শুদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। অনায়াসেই চিরাচরিত ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলতেন, ‘রিশম পশোম’ আবার ‘শুদ্ধ’ হয় কোন গুণে? অ্যাট্টা তো ‘পোকা-মাকড়ের’ লালা থিক্যা, অব অ্যাট্রা পশুলোম থিক্যা? ছ্যা ছ্যা। আমি অরে শুদ্ধ কই না! সুতাই হচ্ছে আসল শুদ্ধ। গাছের ফুল থিক্যা বানায়।

তবে তার শুদ্ধতাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সহজে কোনো কিছুর স্পর্শদোষ ঘটে যায়। … ধ্যানব্রতর জীবৎকালেই তাঁর সুন্দরী স্ত্রীর হাতে পায়ে হাজা, আর সর্বদা ভিজে কাপড়। তবে তখন কাপড়টা থাকতো প্রধানত লাল পাড়ের, আর ভিজে চুলের রাশি থাকতো মাথায় ঝুঁটি বাঁধা। … স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল শুধু বকাবকির সূত্রে।

ওই সিক্তবসনা সুন্দরীকে একবার দেখতে পেলেই ধ্যানব্রত তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলতেন, এটিকে অখনো পাগলা গারোদে ভরতে পাঠানো হচ্ছে না ক্যারে? যাঃ যাঃ অখনি অরে গারদে ভরি আয়!

আর সে প্রশ্ন শুনতে পেলেই বিন্দুবাসিনীও দাঁতে দাঁত চেপে বলতেন, অই। আলেন উকিল সাহেব। … সাহেবের গুণের মদ্যি শুধু কটুবাক্যি। কে অরে অন্দরে সেঁদোতে সাদে? ঠাকুরঝি অরে কয়ে দ্যাও পুরুষ ছেলেকে বৈটকখানাতেই শোবা পায়

তা সেসব পাট চুকে গেছল আগেই।

নয়নতারার মনে পড়ে পাবনার বাড়ি ছেড়ে চলে আসবার প্রস্তাবে বিন্দুবাসিনীর কী প্রতিরোধ। …

সময় হয়ে গেছে, বাইরে গাড়ি প্রস্তুত, আর বিন্দুবাসিনী নিজস্ব পেটেন্ট পোশাকে ঠাকুরঘরের দরজাটা আঁকড়ে ধরে তীব্র আপত্তি জানাচ্ছেন, তরা যা। তরা যা। তদের বয়েস আচে, বাঁচনের সাদ আচে, তরা ‘ছানাপোনা’ আর পেরাণ নিয়ে পালা। আমারে বাঁচনের সাদ নাই। আমার কর্তার এই ভিটাটায় পড়ে থিক্যা মরতে দে। বলি ভিটে ফেলে, মা লক্ষ্মীরে ফেলে পেরাণ বাঁচাতে চলে গ্যালে, সেহানে গিয়ে কর্তারে জবাবটা কী দেবো? অ্যাঁ?

এর সদুত্তর অবশ্য জোটেনি বিন্দুবাসিনীর। নিরুপায় হয়ে চলে আসতেই হয়েছিল। তদবধি তাঁর কাজই ছিল, ছেলেকে ধিক্কার আর ছেলের বৌকে গলাগালি। ওই সর্বনাশী মেয়েমানুষটাই যে শাশুড়িকে জব্দ করবার জন্যেই ভ্যাড়া বনে যাওয়া সোয়ামীকে দিয়ে এই চাল চেলেছে, তাতে তাঁর সন্দেহ ছিল না।

তিনি তাঁর ছেলেকে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে বিঁধে বিঁধে মন্তব্য করতেন, আর আমাগো সেহানে ঢুকতি দিবে না! হঃ। আমারে পোলাপান পাইছস্? তাই তর এই কতা পেত্যয় করবো? মগের মুলুক নাকি? দ্যাগে খন, যে যার ঠাঁই ফিরা আইচে। শুদু তুই পরিবারের মন্ত্রনায় আমারে এহানে বন্দী বানিয়ে রাখছস্। এহানে এট্টু এ্যাকটু খাঁচার মদ্যি চান। পেরাণটা হাঁপিয়ে মরে সত্য। মায়ের দুঃখটা বোঝস না হতভাগা ছাওয়াল?

আবার কখনো কখনো মিনতি করেছেন, তরে হাত ধরে কই বাপ, দুটাদিন কাচারি কামাই করে আমারে সেহেনে রাইখ্যা আয়। সেহেনে আমি বেশ থাকবো। পড়শী-প্রতিবেশী রইচে না? তারা আমারে ভালোবাসে।

পড়শী প্রতিবেশীরা যে আর কেউই নেই সেখানে একথা শেষ পর্যন্ত বোঝাতে পারা যায়নি বিন্দুবাসিনী গাঙ্গুলীকে। শুধু ছেলের আলস্য, আর বৌয়ের কুপরামর্শর ফল তাঁর এই যমযন্ত্রণা। কখনো কখনো আবার চিল চেঁচানো চেঁচাতেন, বৌ অ বৌ (হ্যাঁ শুধু ‘বৌ’। কদাচ বৌমা নয়।) বলি, সেই বড়বড় বগি থালগুলা কোথায় নুকিয়ে রেখেছিস অ্যাঁ, সত্যরে আমার ওই অ্যাত্তোটুকুন থালে ভাত দিচিস? বৌ! অ বৌ কানের মদ্যে সীসা ঢালচস না কি? শুনতি পাস না? বলি তামা পিতলের ঘট-কলসগুলা কোতায় বিসজ্জোন দিচিস? অ্যাঁ লোহার টবে জল? ও জলের চানে ‘শুদ্ধ হয়?’ ক্যান? বড় ভাঁড়ারের সাঙায়, বিরোদ বিরোদ সব কলস তোলা নাই? তাই পাড়চস না ক্যান? বাপের ঘরে চালান করবি বুঝি? মতলোব বুজেছি।

অনুক্ষণ অভিযোগ আর অসন্তোষ। অহরহ আক্ষেপ আর ক্রন্দন। আর গালমন্দ শাপশাপান্ত।

নয়নতারা ভাবেন, অথচ আমি মুখ বুজে সে সব সহ্য করেছি। সেই মানুষকেই খোসামোদ করে আর ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়েছি। কোনোদিন বলে উঠতে পারা যায়নি, “এতো সহ্য করা যায় না।’

না পারা যায়নি। নিশ্চিত জানতেন—সেটুকুও সত্যব্রত মেনে নিতে পারবেন না। নিশ্চয় বলবেন, মার মানসিক অবস্থাটা অনুভব করতে চেষ্টা করো।

যেন নয়নতারার মধ্যে কোনো মানসিক অবস্থার বৈপরীত্য ঘটেনি।

খুবই স্নেহশীল স্বামী। কিন্তু মায়ের সম্পর্কে এতটুকু কিছু অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে ফেললে একদম কঠোর কঠিন।

এখনো—মায়ের মৃত্যুর এই দীর্ঘদিন পরেও, কী সাবধানেই কথা বলতে হয় নয়নতারাকে—সেই অবুঝ আধপাগল কটুভাষিনী এবং স্নেহমমতাবর্জিত সম্পর্কে। মনে হয় যেন সত্যব্রতর একটি ক্ষতস্থানে আঘাত লেগে যাবে।

গুরু ইষ্ট ঈশ্বর এসবের অনেক ঊর্ধ্বে মা।

আর—নয়নতারার পুত্র?

নিশ্বাস ফেলে ভাবেন, ত্রুটি আমারই। আমিই পারিনি আমার সন্তানের উপর সেই প্রভাব ফেলতে। আমার সন্তান মানুষ করার পদ্ধতিতে নিশ্চয় ভুল ছিল। আবার মাঝে মাঝে একটি অদ্ভুত ধারণাও মনের মধ্যে কাজ করে। হয়তো এভাবে কেন্দ্রচ্যুত হয়ে চলে আসতে না হলে, একই ধারায় গড়ে উঠতো নয়নতারার ছেলেও। শিকড় ছিঁড়ে চলে আসার ফলেই হয়তো—

অতএব—সেই ‘শিকড়ের’ গোড়াটা হাতড়ে বেড়ান নয়নতারা। কল্পনা করতে থাকেন, সেখানে সেই বৃহৎ পরিবারের মধ্যে ধারাবাহিক নিয়মে গড়ে উঠছে আদিত্য। হয়ে উঠছে বাপের মতই শান্ত, ভদ্র, মাতৃভক্ত।

কল্পনার সুতো ছিঁড়ে যায়। নিশ্বাস ফেলে ফিরে আসেন বর্তমানের বাস্তবতায়।

তবে নিজের জন্য যতটা নয়, বেশী দুঃখ হয় সত্যব্রতর জন্যই। কী মানী মানুষটা, কীভাবে নীরবে সমস্ত অবস্থাকে মেনে নিয়ে স্থির আছেন। ভগবানও তেমনি। শরীরের একটা ছোট্ট যন্ত্রকে কমজোরি করে দিয়ে কর্মজীবনটা শেষ করে দিলেন। অনায়াসেই এখনো প্র্যাকটিস করতে পারতেন। ঊনসত্তর বছর বয়েস হলেও স্বাস্থ্য এখনো যথেষ্ট মজবুত। বরং ছেলে আদিত্যরই এই বয়সে নানানখানা।

মাঝেমাঝে মনে হয়, সত্যব্রতর এই বয়সেও এমন মজবুত স্বাস্থ্য, বলিষ্ঠ চেহারা, এটাও যেন সংসারের চোখে সত্যব্রতর একটা বাড়তি স্বার্থপরতা অথবা চক্ষুলজ্জাহীনতা।

তাই ওরা যেন জোর করেই বাবাকে বুড়োর পোস্টে বসিয়ে ছাড়ে।

বাবার রাতের খাবারটা সাততাড়াতাড়ি তিনতলায় তুলিয়ে দেয়, এবং দিনের খাবার সময় বারবার বলে, বাবার তরকারিতে বেশী ঝাল-মশলা দেওয়া হয়নি তো?

সত্যব্রত অবশ্য নিজেই যথেষ্ট নিয়মী। এবং ‘নিয়মটি’ বড় সুন্দর ছন্দে আবর্তিত হতো, যতদিন পর্যন্ত কর্মজীবনে যুক্ত ছিলেন। তবে শান্তচিত্ত মানুষ। নয়নতারা যদি স্বামীর এই কর্মবিরতিতে আক্ষেপ করেন, একটু হেসে বলেন, কী আশ্চর্য! এখনো তোমার এই নিয়ে দুঃখ? ধরো যদি সরকারি চাকরি হতো? কবেই তো দারুব্রহ্ম জগন্নাথ হয়ে বসে থাকতে হতো।…

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন