সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক – ১৭

আশাপূর্ণা দেবী

।। সতেরো ।।

পুরুলিয়া জেলার একটি গ্রাম। নাম ‘আরসা’। আপাত অর্থহীন অসংখ্য নামের মধ্যে একটি নাম। তবে নেহাৎ গণ্ডগ্রাম নয়, গ্রামের নামে থানা আছে, ডাকঘর আছে, এবং একটি হাইস্কুল ও একটি প্রাইমারি স্কুলও আছে। অর্থাৎ সরকারি খাতা-কলমে আছে এসব। এমনকি একটা সরকারি হাসপাতালও নাকি আছে!

তবে কতটা কী কার্যকরী আছে, সেটা অনুমানসাপেক্ষ।

স্কুল আছে বলেই যে নিয়মিত পঠন-পাঠনও আছে, এমন মনে করার হেতু নেই। কারণ স্কুলের মাস্টারমশাইদের ক্লাস নিতে আসার থেকে অনেক সব জরুরি কাজ থাকে। আর হাসপাতালে ডাক্তার নার্স বা ওষুধপত্র থাকাটা যে আবশ্যিক, এটা কর্তৃপক্ষের খেয়ালে না থাকায়, নেহাৎই চালাঘরতুল্য সেই হাসপাতালটিকে রোগী ছাড়া এ, ও, সে কিছু লোকজন আছে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী’ এই গালভরা বিশেষণটির অধিকারী নকুল জমাদার তার স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, মুরগী, ছাগল, শুয়োর ইত্যাদি নিয়ে সুখে ঘরসংসার করছে।

এই ‘আরসা’ গ্রামেরই একপ্রান্তে সরকারি উদ্যোগের কর্মসূচির অন্তর্গত একটি উদ্যোগে সদ্য পাশ করে বেরোনো ডাক্তারদের একটি সেবাশিক্ষণ শিবির খোলা হয়েছে।

খাতায়-কলমে ‘বাধ্যতামূলক’ না হলেও ওই সদ্য পাশ করে বেরোনো জনা কয়েক ডাক্তারকে আসতেই হয়েছে। সরকারি কর্মসূচির’ রূপায়ণের একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণিত দৃশ্যও তো থাকা দরকার।

এঁদের শিবিরের একটি ভব্যিযুক্ত নামকরণও হয়েছে ‘পরিষেবা’! সেই নামটি কঞ্চির ফ্রেমে বাঁধা দরমার টুকরোর ওপর কাগজ মেরে লিখে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুলবাড়ির গেটে। কারণ ওই স্কুলবাড়িতে স্থাপিত হয়েছে এই শিবির।

যদিও স্কুল সারা বছরই প্রায় ফাকা ফাকাই থাকে। তবে আপাতত এখন গ্রীষ্মের বন্ধের দরুন আইনসঙ্গতই ফাকা। ডাক্তার এবং তাঁদের অনুষঙ্গে আসা জনা আটেকের এই দলটির স্কুল বাড়ির,মধ্যে হেসে খেলেই জায়গা হবার কথা। কারণ স্থানীয় এক কৃতী ব্যক্তির মায়ের নামে উৎসর্গীকৃত এই ভবতারিণী স্মৃতি বিদ্যালয় টির আয়তন মোটামুটি ভালোই। এবং পারিপার্শ্বিক অন্য অনেক কিছুর মতো দীনহীন চেহারার নয়।

কিন্তু ওই দলটি এসে পৌঁছনোর পরই স্থান থাকতেও স্থান সংকুলানের সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কারণ ‘রিসেপশন কমিটি’ ওনাদের ট্রেন থেকে নামানোর সময়ই সভয়ে লক্ষ্য করেছিলেন, এই সদ্য পাশ করা বেরোনো তরুণ ডাক্তারদের মধ্যে একটি তরুণীও বিদ্যমান।

ব্যাপারতো তাহলে গুরুচরণ!

ওই গণ্ডা দুই ছোঁড়ার সঙ্গে (মনে মনে কী না বলা যায়?) একটা সুন্দরী তরুণী! ডাক্তার মিস মুখার্জি অবশ্য তাঁর হালকা তনুখানির মতোই একটু হালকা হাসির হাওয়া ছড়িয়ে, ‘না না। তাতে আমার কিছু অসুবিদে হবে না’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অভ্যর্থনা সমিতির একটা দায়িত্ববোধ নেই? আর এই ‘আরসা’ গ্রামে ‘সমাজরক্ষক সম্প্রদায়ের’ ধুলো-গুঁড়োও কি কিছু অবশিষ্ট নেই?

অতএব স্কুলের হেডমাস্টারমশাই গোপীমোহন পাড়ুই প্রস্তাব দিলেন, ওনার থাকার ব্যবস্থা আমার বাড়িতে হবে।

শুনে মিস মুখার্জি যে খুব একটা পুলকিত হলেন, তা অবশ্যই নয়। তিনি ‘ব্যর্থ’ হবে বুঝেও আর একবার চেষ্টা চালালেন, মিছিমিছি আবার আপনার বাড়ির সকলকে বিব্রত করা। সত্যিই আমার এখানে কোনো অসুবিধে হবে না। এরা সকলেই তো আমার পরিচিত।

কিন্তু সে-কথা কখনো ঢেঁকে?

গোপীমোহন সবেগে মাথা নেড়ে বলেন, আমার বাড়ির লোকের অসুবিধের প্রশ্ন ওঠেই না। আপনাকে সেবা করতে পেয়ে সবাই ধন্য হয়ে যাবে।

যদিও উচ্চারণে জেলাসুলভ কিছু ‘টান’ আছে, তবে গোপীমোহনের ভাষাভঙ্গী পরিষ্কার।

মিস মুখার্জি মনে মনে ভাবলেন, আপনাদের অসুবিধে না হলেও, আমার নিজের তো বিলক্ষণ অসুবিধে বোধ হচ্ছে। এভাবে দলছুট হয়ে থাকায় একত্রে আসার যে আনন্দময় পরিবেশটুকু পেয়ে যাবার কথা, সেটি তো ঘুচল!

এমনিতে—এই ‘পরিষেবা’র দলে নাম লিখতে প্রায় বাধ্য হওয়ায় মনে মনে সকলেই বেজার। কারণ স্থানটা পুরুলিয়া জেলা, আর কালটা গ্রীষ্মকাল।

গরমকালে পুরুলিয়ার জলকষ্ট তো সর্বজনবিদিত। নাকি মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। খাল-বিল, ডোবা-পুকুর, পাতকুয়া সবকিছুই তো জলশূন্য হয়ে ওঠে, এমনকী সরকারি অনুদানে নির্মিত গভীর নলকূপগুলিতেও আর সহজে জল উঠতে চায় না।

অবশ্য নলকূপগুলি যথার্থই ‘গভীর’ কিনা সে বিষয়ে স্থানীয় বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের গভীর সন্দেহ আছে। অবশ্যই অথবা নিশ্চয়ই গ্রামোন্নয়নের কর্মকাণ্ডের বিধি অনুযায়ীই হয়েছে এসব। সে বিধিতে ‘গভীর’ হবার কথা নয়।

যাক ওসব কূটকচালে কথা!

গরমকালে পুরুলিয়ার মতো জায়গায় নেহাৎই ব্যাগার খাটতে আসতে বাধ্য হওয়া উৎসাহজনক না হবারই কথা। তবু একটা ‘বন্ধুদল’ এ বয়েসে আহ্লাদের। মিস মুখার্জির ক্ষেত্রে তাতেও বাদ সাধলেন পাড়ুইমশাই।

পাড়ুইমশাইয়ের বাড়ির একটা বাগাল যখন মিস মুখার্জির ব্যাগ বেডিং মাথায় চাপিয়ে বিকশিত দন্তে বলে উঠল, “চলেন দিদিমণি! টুখানি পথ মাত্তর!’

তখন তোটক বোস গলা নামিয়ে হাসি চেপে বলল, যান মিস মুখার্জি, ‘জ্যাঠামশায়ে’র হেফাজতে নিরাপদ গোয়ালে গিয়ে আশ্রয় নিন গে!

বিভাগ রায় বলল, যা বলেছিস। এখানে নখী দত্তী শৃঙ্গীদের মধ্যে ফেলে রেখে যাওয়া? উঃ। সর্বনাশ! সত্যি! এই গার্জেন টাইপের লোকগুলো দেখি সর্বত্রই বিরাজিত। দেখুন গে ওনার গিন্নীটি আবার কী টাইপের!

বাগাল বা রাখাল ছোকরা চলতে চলতে পিছু ফিরে দাঁড়ায়।

অগত্যাই মিস মুখার্জিকে চলতে শুরু করতে হয়।

বেলা বেশ চড়ে উঠেছে। সৌখিন ফোল্ডিং ছাতার কর্ম নয় এই তাত থেকে রক্ষা করতে! পথটা টুক্‌মাত্তর’ এই যা ভরসা! ছেলেটা অবশ্য মহানন্দেই মাথায় বোঝা চাপিয়ে চলেছে। এই ‘সোন্দর দিদমণিটা যে দলবিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের সম্পত্তি হয়ে গেল, এতে ছোকরা রীতিমত খুশি।

ম্যাস্টোরবাবুর বাড়িতেই তো তার স্থিতি।

তোটক এবং বিভাস গোপীমোহনের গিন্নী সম্পর্কে যে সন্দেহবাণী ব্যক্ত করেছিল, সেটা অমূলক। ভদ্রলোক অকৃতদার। যৌবনকালে নানা রাজনৈতিক আবর্তে পাক খেয়ে জেলটেলও যেন খেটেছেন, কাজেই বিয়ে করে ঘরসংসারী হবার ফুরসত হয়নি। তবে পরবর্তী জীবনে বহুবিধ প্রলোভন সত্ত্বেও ‘বড় গাছে’ নৌকো বাঁধতে যাননি। নিজস্ব একটা আদর্শের মতবাদে স্থির থেকে এই স্কুলটি এবং ছোটভাই ভাইবৌদের সংসারটির ভালোমন্দ নিয়েই কাটিয়ে যাচ্ছেন। কাঁচাপাকা কদমছাঁট চুল মাথা, রোগা লম্বা শুকনো শুকনো চেহারাটা দেখে বয়েস বোঝা শক্ত। ষাটের নীচেও হতে পারে. পঁয়ষট্টির ওপরেও হতে পারে। যদি ‘পঞ্চাশ’ বলে বসে, তাতেও হেসে ওঠা চলবে না।

তা বয়েস যাই হোক, বাড়িতে সংসারের হেড়। এবং স্কুলে হেডমাস্টার, এই পদমর্যাদাই তাঁর সকলের প্রতিই একটা অভিভাবকসুলভ মনোভাব গড়ে তুলেছে।

বর্তমানে গ্রাম পঞ্চায়েত ইত্যাদি নানা জটিলতার মধ্যে স্কুলটার ইচ্ছেমতন উন্নতি করতে না পাওয়ায় ভদ্রলোক নিতান্তই ক্ষুব্ধ। মাস্টাররা কেউই যথাসময়ে স্কুলে আসা অথবা ‘প্রতিদিন আসা’ কে দরকারি বলে মনে করেন না, এবং হেডমাস্টারকে তোয়াক্কাও করেন না। ভিতরে ভিতরে যে হেডমাস্টারকে কোনোমতে বিতাড়নের ষড়যন্ত্র চলছে, তাও গোপীমোহনের অবিদিত নয়। তবে, পায়ের তলায় একটু শক্ত মাটি, গোপীমোহন এই ভবতারিণী স্মৃতি বিদ্যালয়ের’ প্রতিষ্ঠাতার ভ্রাতুষ্পুত্র, এবং স্কুল পরিচালনার ভারও তাঁর উপর অনেকটা ন্যস্ত করা আছে ‘কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম’ হিসেবে।

তবে শেষরক্ষা হবার আশা কম। কারণ, তলে তলে নৌকোর তলায় ফুটো করে চলার ফলে নৌকোয় জল উঠছে বিস্তর। ছেঁচে ছেঁচে আর কত ফেলা যায়?… একদিন ভরাডুবি হবেই।

এখন তো গ্রামেগঞ্জে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই চলছে যত কূটকচালে রাজনীতি। নিরক্ষররা সাক্ষর হয়ে উঠুক’, এমন বুদ্ধিহীন ইচ্ছা পোষণ করেন না শাসকদল। গোয়ালারা কী চায় তাদের খাটালের গরু-মোষগুলো চৈতন্যলাভ করুক? তাঁরা চান প্রাণীগুলো পর্যন্ত খোল-ভূষিমাখা বিচিলির জাবনা নিয়ে নির্লিপ্ত চিত্তে চক্ষু মুদে জাবর কেটে চলুক, আর দুগ্ধ দোহনকালে ওই বাড়তি খোল-ভূষির প্রতিফলন ফলাক। ব্যস!

তবে সেই পোষা প্রাণীগুলো অন্যত্র বা যত্রতত্র তচনচ করে বেড়াক, প্রশ্রয় দিতে হবে বৈকি! ওরাই তো খুঁটি। আর ‘খুঁটির জোরেই তো মেড়া লড়ে’।

রাখাল ছেলেটার কথা বেঠিক নয়, একটু হেঁটেই গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাওয়া গেল। আর পৌঁছেই ডাক্তার মিস মুখার্জির আর একবার মনটা নতুন করে দমে গেল। এই একটা অজানা অচেনা গেরস্থ লোকের অন্দরে ঢুকে পড়ে থেকে যেতে হবে তাঁকে?

নিজে অবশ্য তিনি সংসারী গেরস্থ ঘরেরই মেয়ে। কিন্তু নিজের বাড়ি, আর বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে অপরের বাড়ি।

তবে কার্যত তাকে ঠিক অন্দরে ঢুকে যাওয়ার অবস্থায় পড়তে হলো না। গোপীমোহনের বাড়ির সদর অংশেই তার থাকার ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলেছেন গোপীমোহন। তাই ওদের সঙ্গে কথা কয়েই আগে আগে চলে এসে ওই রাখাল ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

বাড়িটার আয়তন নেহাৎ কম নয়, ছড়ানো-ছিটোনো বেশ খানিকটা জমির মাঝখানেই বাড়ি। তবে কেবলমাত্র সামনেই একখানি ‘দালানকোঠা’। ভিতরে এল শেপ্‌-এ সারি সারি বেশ কয়েকখানা ঘর থাকলেও তার মাথাটা অ্যাসবেস্টাসের। তবে দেওয়াল পাকা। মেজেয় বিলিতি মাটির প্রলেপও আছে।

সামনের এক টানা রোয়াকের ওপর টানা লম্বা ঘরখানার অর্ধাংশ পাড়ুইমশাইয়ের বৈঠকখানা। এবং বাকি অর্ধাংশ একটা কাঠের পার্টিশন দিয়ে ঘিরে শয়নঘর।

স্ত্রী-পুত্রের বালাই নেই, অন্দরে ভাদ্রবৌদের কলকল্লোল, কাজেই এই ব্যবস্থাটিই তাঁর বরাবরের। এই শোবার ঘরটিই তিনি ‘মেয়ে ডাক্তারবাবু’র জন্যে ছেড়ে দিচ্ছেন। খুব তাড়াতাড়ির মধ্যেই সুব্যবস্থা করে ফেলেছেন পাড়ুইমশাই।

মেয়ে ডাক্তারবাবু এসে দেখলেন, পার্টিশান ঘেঁষে একটি সরু চৌকির ওপর সদ্য পাটভাঙা একখানা ফেমাস বাঁকুড়ার চাদর। দুটো মাথার বালিশে ফর্সা ওয়াড় পরানো জানলার ধারে একটি ছোট টেবিল আর চেয়ার। কোণে একটি টুলের ওপর মাটির কলসীতে খাবার জল!

কিন্তু তিনি দেখার আগেই তো মাথা থেকে মোটগুলো নামিয়ে ছেলেটা যতটা সম্ভব দম্ভবিকশিত করে বলে উঠল, উব্বাস। মেয়ে ডাক্তারবাবুকে রাখা করাতে ম্যাস্টোরবাবুর ঘরটো যে এক্কেবারে উল্টা করা হয়েছে দেকচি! ইখানকার জিনিস উত্থান, উত্থানকার জিনিস ইখান। কী ফার্সা বেছনা!

ছেলেটার কথাটা সত্যি। মাস্টারবাবুর চৌকিটা ছিল জানলার ধারে, যাতে গায়ে একটু হাওয়া আসে। টেবিল-চেয়ারটা ছিল পার্টিশানের গায়ে। কিন্তু একতলার ঘর। ‘মেয়েছেলেকে’ জানলার ধারে শুতে দেওয়া শ্রেয় মনে করেননি ‘ম্যাস্টোরবাবু’। এবং নিজের সর্বস্ব ছেড়ে দিয়ে উদ্বাস্তু বনে যেতে হলেও, এই ব্যবস্থাই ন্যায্য মনে করেছেন। বাড়ির মধ্যে সর্বদা চ্যা ভ্যাঁ! মেয়েদের গজালি। ডাক্তার মেয়ের অসুবিধে। আবার বাড়ির মধ্যেও এরকম একটা উচ্চমানের জীবকে ঢুকিয়ে দিলে অন্দরের স্বস্তি ঘুচবে।

অর্থাৎ ডাক্তার মিস মুখার্জিকে বেশ খানিকটা সুবিধে উপহার দিতে, গোপীমোহন নিজে অনেকখানি অসুবিধে কিনলেন।

যাক। যার যা নিয়তি।

কিন্তু মেয়ে ডাক্তারবাবু মনে মনে যতই অস্বস্তিবোধ করুন, মোট বয়ে আনা ছেলেটাকে একটু বখশিস দেওয়া উচিত বিবেচনায় তার সঙ্গে আলাপ জমাতে বলেন, এই ছেলে! তোমার নাম কী?

‘তোমার!’

ওকে আবার কে কবে ‘তুই’ ছাড়া ‘তুমি’ বলেছে?

ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, উব্বাস। ‘পদ’র কী মান্যি গো। বলি পদ আবার ‘তুমি’ হলো কবে? না না! কানে বাজল। ‘তুই’! তুই।

অগত্যাই প্রশ্নকারিণী হেসে ফেলে বলে, বেশ, না হয় তাই হলো। তো নামটা কী?

ওই তো বলা করলাম ‘পদ’।

পদ! শুধু ‘পদ’! এ আবার একটা নাম হয় না কী?

হওয়ালেই হয়।

পদ তাচ্ছিল্যভরে বলে, মা-বাপ তো ‘নিরাপদ’ নাম রাখা করেছিল। তো তারা হডুম-দুড়ুম মরে গেলে, অতো বড়োটা বলা করার কার দায়? ‘পদ’ই ঢের। তো আপুনার নামটা কী শুনি? তা’লে সেই নামে দিদিমণি বলি বটেক! কাঁহাতক ‘বিটিছ্যালা ডাক্তারবাবু’ “বিটিছ্যালা ডাক্তারবাবু’ বলা করা যায়?

‘বিটিছ্যালা ডাক্তারবাবু’। এটা আবার কী ভাষা!

শুনে তো তাজ্জব। তাঁর আড়ালে যে এই নামের চাষ চলেছে, সেটা তাঁর জানার কথা নয়। তাই কষ্টে হাসি চাপতে চাপতে বলে ফেলেন, কী বললি? কী ডাক্তারবাবু?

ক্যানো? বিটিছ্যালা ডাক্তারবাবু!

এই নামে ডাকবি আমায়?

পদ অবশ্য এতে দমল না। জোর গলায় বলে উঠল, তো পদর ‘প্রোমটা কী হলো বটেক? আপুনি বিটিছ্যালা না?

তা বটে। তা নই বলা চলে না।…হাসি চাপতে রীতিমত চেষ্টা করতে হয়।

তালে? আর ডাক্তারবাবু না?

হ্যাঁ, তাও তো বটে! ডাক্তার যখন তখন অবশ্যই ‘বাবু! তো সত্যি আমাকেই বা অতো বড় নামে ডাকতে তোর কী দায়? বলবি পাপিয়াদি।

টুক থামা করো বটে।

কী নামটো বুললে?

পাপিয়া। পাপিয়াদি বলবি।

পা-পিয়া! ওই নাম তুমার?

এবার আপনি ছেড়ে ‘তুমি’।

পাপিয়া হেসে বলে, কেন নামটা তোর পছন্দ নয়?

উচ্ছ্বাস। পদোর পছোন্দো! পদ একটা মনিষ্যি? তা নামটা তো তুমার ভালো রাখা করা হয়েছিলো বটে! উটা অ্যাকটা মিঠে সুর পাকির নাম বটে!

বাঃ। তবে তো তুই সবই জানিস। আচ্ছা বেশ, এদিকে আয়। এই নে একটু মিষ্টি কিনে খাস।

পাপিয়া তার হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে দেয়।

সত্যি বলতে প্রথমটা দু’টাকাই দিতে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো দু’টাকায় কী বা হয়। ভারি মায়া লাগছে ছেলেটাকে দেখে। রোগা হাড়সার চেহারা। পরনে কেবলমাত্র একটু ছেঁড়া ময়লা গামছা মালকোঁচা করে পরা। সর্বাঙ্গ ধূলিধূসরিত। মাথার চুলগুলোয় তেল পড়ে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও হাস্যবদন, তবু দেখে ভারি মায়া লাগছে।

হ্যাঁ, বেলেঘাটার মুখুয্যে বাড়ির (যে বাড়ির হাড়মজ্জা মায়ামমতার নির্যাসে টইটুম্বুর) মেয়ে পাপিয়া এই সদ্য পাশ করা ডাক্তারদের দলে এসে হাজির হয়েছে।

বাড়িতে ওকে অনুরোধ করেছিল, “বাবা! এই গরমে পুরুলিয়া! তুই চেষ্টা চরিত্র করে দ্যাখ্ না, যদি যাওয়াটা আটকানো যায়।’

বিশেষ করে জ্যাঠা-জ্যেঠিই এই অনুরোধে জপিয়েছে।

কিন্তু ও মেয়ে যে গোড়া থেকেই নিজমনে তার বিপরীত চেষ্টা করেছে। সব আগেই ‘ইচ্ছুক’দের তালিকায় নাম বসিয়ে রেখেছে। মেয়ে তাই হেসে বলেছিল, ‘আচ্ছা দেখি চেষ্টা করে সরকারকে বলে-কয়ে ক্যাম্পটা যদি দার্জিলিঙে করানো যায়! কী বলো? তাহলে আর তোমাদের কোনো চিন্তা থাকবে না।’

তারপর অবশ্য একটু ছোটখাটো বক্তৃতাও দিয়েছিল, ডাক্তারি পড়ার আদর্শ আর উদ্দেশ্যটি কী! সেই উদ্দেশ্য আর আদর্শের সঙ্গে আরাম খোঁজার চেষ্টা চলে কিনা।

তা যাক্, মায়া তো হলো। কিন্তু ছেলেটা যে ওই পাঁচ টাকার নোটটা হাতে পাওয়া মাত্রই স্রেফ সাপের ছোবল খাওয়ার মতোই শিউরে উঠে নোটখানা ঝপ করে আবার দাতার হাতে ফেলে দিয়ে বলে উঠল, উব্বাস! এটো কী বটেক? লিয্যস করে দেখা করে দিবেক তো?

কী মুস্কিল। দেখেই তো দিলাম। বললাম যে মিষ্টি কিনে খাবি।

ওঃ, পদ আক্কোস? অতোগুলান মিষ্টি খাবেক?

আরে দূর! এতে আবার তোর কতোগুলান হবে? নে না বাবা!

বলে আবার নোটটা ওর হাতে চালান করতে চেষ্টা করে।

কিন্তু পদ অমনমীয়।

পদকে কী ডাক্তারদিদি মারা পড়াতে চায়? রাখবে কোথায় অতো টাকা?

বাঃ, রাখবি কেন? খাবি তো!

খাবে! ওটা পাঁচ টাকার নোট না?

পদ তার জীবনে এমন অবাস্তব কথা কখনো শোনেনি। ডাক্তারদিদির মাথাটা খারাপ! দিদি বরং তাকে একটা পঞ্চাশ নয়া দিক। যেটা না কী ন্যায্য হবে।

ডাক্তারদিদি বলে ওঠে, পঞ্চাশ পয়সা? তাতে কী হবে শুনি? দোকানী তাহলে তোকে শুধু একখানা শালপাতা দেবে।

হ্যাৎ!

পদ জোর গলায় বলে, উতে পাঁচটো জিলুপি তো হবে বটেক।

বাঃ, জিলিপি খাবি কেন? রসগোল্লা খাবি। আমি ভালেবেসে দিচ্ছি, নে না।

পদ কিন্তু অটল অনমনীয়।

পদর হাতে নোট। পদ দোকানে গিয়ে রসগোল্লা খেতে চাইবে? দোকানী তাহলে তাকে কান ধরে ম্যাস্টোরবাবুর কাছে ধরে নিয়ে এসে ‘বকা খাওয়াবে না’? বলবে না নির্ঘাৎ এটা চুরি করেছে পদ!

পাপিয়া সেই ভীতকাতর নিরুপায় মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে।

সত্যি! কী দুঃখী ছেলেটা! কেউ কিছু দিলেও ভয়ে নেবার সাহস নেই। অথচ ওর সমস্ত অবয়বের মধ্যে একটাই মাত্র ছাপ! বঞ্চিত হতভাগ্য। বিশ্ব জুড়ে নাকি ‘শিশু শ্রমিক’ নিয়ে মাথাব্যথা চলছে, শিশু শ্রমিকবিরোধী আন্দোলন চলছে। অথচ এই রকম লক্ষ লক্ষ শিশু নিদারুণ অসহায়তা আর বঞ্চনার মধ্যে হাড়পেষা শ্রম করে চলেছে।

ছেলেটা নাকি এই মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির গরুর রাখাল। ওই রোগা লিকলিকে দুখানা হাত আর কাঠির মতো দুটো পা ছাড়া যেটা চোখে প্রকট হয়ে ওঠে, সেটা ওর খসখনে শুকনো জিরজিরে চামড়ায় ঢাকা পাঁজরগুলো। ডাক্তারের চোখ ছাড়াই যাদের সহজে গুনে ফেলা যায়। কী করে সামলায় গরুদের?

পাপিয়া হতাশ গলায় বলে, নিবি না?

পদ ওই মলিন হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখে বোধহয় করুণাপরবশ হয়েই বলে, ‘তবে নয় অ্যাটা গোটা ট্যাকাই দাও।’

তাতেই রফা!

সঙ্গে ছিল কী ভাগ্যিস কটা ‘কয়েন’!

চকচকে গোল টাকাটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে পদ। মুখটা চকচকে হয়ে ওঠে। তারপর সেটাকে তার গামছার কৌপিনের ট্যাকে ভালোমতো পাক দিয়ে সুরক্ষিত করে ইশারায় জানায়, কেউ দেখে ফেললে পদর নিস্তার নেই।

পাপিয়ার আবার একটা গভীর নিঃশ্বাস পড়ে। সংসারী মানুষরা এমন হৃদয়হীন কেন?

কিন্তু গোপীমোহন মাস্টার কী লোকটা খারাপ? না কী হৃদয়হীন?

মোটেই তা নয়। বরং তাঁর বাড়িতে রাখাল-বাগাল, দু-একটা মুনিষ এবং বাসনমাজুনি খড়কাটুনি গোবরকুড়ুনিরা অন্য যে কোনো বাড়ির থেকে সুখে থাকে। তুলনামূলকভাবে বেশী পায়। গোপীমোহনের কঠিন আদেশে বাড়ির মেয়েরাও এদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কৃপণতা করতে সাহস পায় না। কেউ যদি বৃহৎ গামলার এক গামলা ভাতও পেটে চালান করে ফেলে আবার বলে, টুকুন ভাত গো জননী।’ তখন রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে গেলেও টুকুন ভাতটি তাদের খালি হয়ে যাওয়া পাতে ফের ঢালতেই হয়। টুকুন’ মানে তো অন্তত এক কাঁসি।

সকালের জলপানিতেও এ বাড়িতে ঢালাও মুড়ি আর ঢালাও ঢেলা গুড়। একধামা মুড়ি নিয়ে যখন বসে, দেখে বিশ্বাস হয় না অতো মুড়ি খাওয়া সম্ভব। কিন্তু জলের ছাট দিয়ে দিয়ে ভিজিয়ে সেই বিরাট মুড়ির সম্ভার যখন তারা থাবা থাবা করে চিমড়ে পেটের মধ্যে চালান করে ফেলে, সে দৃশ্য দেখতে অনভ্যস্ত দর্শকের চোখ কপালে উঠে যায়।

এমন ঢালাও খাওয়া আর কোনো বাড়িতে রাখাল-টাখালদের জোটে না। কাজেই পদ ভালই আছে।

কিন্তু যাদের অনভ্যস্ত চোখ? তাদের চোখে ধরা পড়ে কী অপরিসীম বঞ্চনা আর দুঃখের সঙ্গে কাটে এইসব হতভাগ্যদের জীবন।

গোপীমোহনের ভাদ্রবৌরা ভাসুরের ভয়ে ওই বাগাল ছোঁড়ার পেটপূর্তি হয়ে আশা মেটা পর্যন্ত ভাত-মুড়ি দিতে বাধ্য হয় বটে, মনে মনে বেজার হয় বিলক্ষণ! এবং সেই বিরক্তিটা ওই ছেলেটার ওপর পড়ে বলেই, উঠতে বসতে চলতে ফিরতে বকুনি খেতে হয় তাকে।

পাপিয়া ছেলেটার কাছে জানতে চেষ্টা করছিল, স্নানটানের ব্যাপারটার ব্যবস্থা কী! অপরের বাড়ির মধ্যে এসে বাস করতে ঢুকলে ওইটাই তো সবথেকে অস্বস্তিকর সমস্যা। দলের সঙ্গে স্কুলবাড়িতে অবশ্যই এই অস্বস্তিটা হতো না। হয়তো ‘মেয়ে’ বলে একটু বাড়তি সমস্যা দেখা দিত। তো সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু একটা ব্যবস্থাই দেখা যেত। আবার মেয়ে বলেই একটু বাড়তি সুযোগও পেত! কিন্তু এখানে এখন কী করা? কোনো মহিলাকে তো দেখা যাচ্ছে না।

পাপিয়া ভিতরের দরজার দিকে চোখ ফেলল। দরজাটায় একটা ‘পর্দা’ নামক বস্তু ঝোলানো আছে বটে তবে বাতাসে উড়ে উড়ে ভিতরের দৃশ্যটি প্রকাশ করছে মাঝে মাঝে কিন্তু সেখানে শুধু খানিকটা ঘাসচাচা মেটে উঠোন, আর একটি তুলসীমঞ্চের একাংশ নজরে পড়ছে মাত্র। আর কিছু না। কেউ কোথাও নেই

পাপিয়া গলা নামিয়ে বলল, এ বাড়িতে ‘মেয়ে-বৌ’ কেউ নেই?

পদ একটু অনুধাবন করে একগাল হেসে গলা নামিয়েই জানাল, বৌ? ম্যাস্টোরবাবু তো বিহাই করেনি।

তাহলে? বাড়ির মধ্যে আছে কে?

থাকবে তো নিশ্চয়। তুলসীতলা যখন আছে, তখন সেখানে প্রদীপ দেবার লোকও নিশ্চয় আছে।

পদ দুটো আঙুল দু’বার দেখিয়ে ইশারায় জানাল, ম্যাস্টোরবাবুর দুটো ভাই আর সেই দুজনের দুটো বৌ আছে। তারপর দুহাতের পাতা ছড়িয়ে জানালো, ওই দুজনের সাকুল্যে দশটা ‘ছানা’ আছে।

পাপিয়াও চোখের ইশারায় জিগ্যেস করল, কই তারা?

মুকাভিনয়ের ধরনেই উত্তর প্রত্যুত্তর, তারা ‘ডাক্তারবাবু’র ভয়ে ‘ভিতর’ দিকে লুকিয়ে আছে।

ভয়! ভয় কেন?

ভয় হবে না? ম্যাস্টোরবাবু এসে বলে যায়নি ডাক্তারবাবুর সামনে কেউ যেন গোলমাল না করে।

পাপিয়া হতাশভাবে বলে, কিন্তু আমার তো এখন চানের দরকার।

এর উত্তর জানা নেই পদর। অতএব পদর সেই মূক-এর ভূমিকা।

সবাই কোথায় চান করে?

ওঃ। সে তো পুষ্কর্ণীতে। তো এখন তো সে পুষ্কর্ণী হাজামজা শুকা।

পদ আর কিছু বলার আগেই হাতের ছাতাটা মুড়তে মুড়তে গোপীমোহন ব্যস্ত-সমস্তভাবে ঢুকে আসেন। এবং খুবই লজ্জিতভাবে তাড়াতাড়ি কৈফিয়ৎ দেন মূল ব্যাচকে ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁর এতোক্ষণ লাগল।…মিস মুখার্জির ওপর খুবই অবিচার হয়ে যাচ্ছে। ইস্! নাওয়া-খাওয়ার কত দেরি হয়ে গেল!

তারপরই পদর দিকে চোখ পড়তে ধমকের সুরে বলে ওঠেন, এখনো এখানে? মাঠের গরুগুলোকে দেখছে কে?

পদর ভীত মুখের দিকে চেয়ে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ও যাচ্ছিল। আমি গল্প করে ওর দেরি করিয়ে দিয়েছি মাস্টারমশাই।

মাস্টারমশাই একটু হাসি কোঁচকানো মুখে বলেন, গপপোর যুগ্যি লোক পেয়েছেন বটে!

কী করবো? আর তো কাউকে দেখছি না।

ইঃ। ভেরি সরি। পদ, তুই তোর কাজে যা। ছাড়া গরু দেখলেই কে কখন একটাকে ধরে ‘পণ্ডে’ দেবে।……

‘পণ্ডে’ দেওয়া একটা রাখাল-চলিত ভাষা।

সুযোগ পেলেই পরের গরুকে ধরে ‘বেওয়ারিশ গরু-মোষের’ থানায় জমা দিয়ে আসা একধরনের প্রতিবেশীসুলভ শত্রুতা। বলে আসবে ‘আমার বাগান মুড়োচ্ছিল। আমার উঠোনে ঢুকে এসেছিল।’

পদ ছুট মারে। ট্যাকে হাতটা শক্তভাবে রেখে।

পাড়ুইমশাই ভিতর বাড়িতে ঢুকে যান। পরক্ষণেই একটা বছর আষ্টেকের মেয়ে একটা ছোট কাঁসার বাটিতে একটু সরষের তেল আর একখানা নতুন গামছা নিয়ে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে স্বয়ং পাড়ুইমশাইও। মেয়েটার পরনে একটা ফ্রক, চুলটায় আঁটিসুটি করে বেণী বাঁধা। নাকে নোলক।

তেল গামছা।

পাপিয়া হেসে ফেলে বলে, এসব লাগবে না। আমার সঙ্গেই আছে! শুধু জলটা কোথায় দেখিয়ে দিলেই—

নিশ্চয়। নিশ্চয়। আসুন এদিকে—

বলে গোপীমোহন তাকে ভিতর বাড়ির উঠোনে নামিয়ে এনে পাশের দিকে বাঁশ আর দর্মায় তৈরী একটা ‘ঘের’-এর সামনে নিয়ে আসেন। এইটি তাঁর নিজস্ব স্নানঘর। যেটাকে তিনি বোধহয় রাজকীয়ই ভাবেন।

তার দরজা থেকেই দেখা যাচ্ছে, মরচেপড়া একটা জলের ড্রাম ও একটা মগ।

পাপিয়ার গলা শুকিয়ে আসে। ক্ষীণভাবে বলে, জল আছে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আছে বৈকি। বলে রেখে গেছি জল রাখতে।

তারপর ঢোক গিলে বলেন, তবে এ সময় তো এখানে বিশেষ জলকষ্ট! যেদিন যেমন জোটে। পুকুরটুকুর তো সব শুকনো। আমার বাড়ির পাতকুয়াটি আমার পিতার আমলের, প্রাচীন এবং গভীর! তাই জল বেশী শুকোয় না। তবে অনেক নীচেয় নেমে যায়। আপনার কষ্ট হবে। কী আর করবেন? কষ্ট করতেই তো সরকার আপনাদের এখানে পাঠিয়েছেন!

উচ্চারণে জেলাজনিত ‘টান’ থাকলেও কথাবার্তা বেশ টানটান মাস্টারবাবুর।

পাপিয়ার একবার ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করে, ‘বাকিদের কী হলো?’ কিন্তু লজ্জা করল। বিনা, প্রশ্নেই পাড়ুইমশাই অনুক্ত প্রশ্নের উত্তরটি দিলেন, ‘ওনাদের অবশ্য সব ঠিক আছে স্কুল বাড়িতে ডিপ টিপকল, পাকা পায়খানা, চানের ঘর সবই আছে। আবাসিক ধাঁচে বানানো হয়েছিল তো বাড়িটা।’

ওঃ, ওনাদের সবই আছে। বেচারী পাপিয়াই মেয়ে হয়ে চোরদায়ে ধরা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসি এলো, মেয়ে? না ‘বিটিছ্যালে’। কিন্তু ‘মেয়ে’ হওয়ার অসুবিধেটি যে কতটি, সেটা বোধহয় আজই প্রথম এতো বেশী অনুভব করে পাপিয়া। মনে মনে ভাবে, আমি যে দলছাড়া হয়ে থাকতে জোরালো আপত্তি করতে পারলাম না, সেও তো মেয়ে বলেই? তাতে আমার নির্লজ্জতা প্রকাশ পেত। কিন্তু মানুষের কী শুধু চান করার জলটুকু পেলেই চলে?

না, তা চলে না, সেটা বিচক্ষণ মাস্টারমশাইও জানেন। তাই তিনি, ওই বাথরুমের পিছনে আরো একটা ‘ঘের’ দেখিয়ে দেন, ইটের গাঁথুনি। তার মানে আরো রাজকীয়।

বহুকষ্টে পাপিয়ার কণ্ঠ থেকে স্বর বেরোয়, এখানে কী ‘সার্ভিস সিস্টেম’?

সার্ভিস সিস্টেম!

গোপীমোহন একটু থমকালেন। তারপর সামলে নিয়ে বলে ওঠেন, ইয়ে, নাঃ। মানে সার্ভিসের লোক কোথা? তেমন লোক মেলে না। ইয়ে, মানে—ইটালিয়ান টাইলসের দেওয়াল, শাওয়ার গিজার বেসিন বাথটব, একাধারে গরম জল ঠান্ডা জলের কল। হয়তো বা কারো কারো বাথরুমেও ফ্যানের হাওয়ার স্থানীয় সকলেই মাঠটাকেই প্রেফারেন্স দেয়। কী করবে? অবস্থা কোথায়? ইয়ে, মানে—প্রথম দিন আপনার একটু অসুবিধা হবে। স্কুলবাড়িতেও তো ওই একই বেবস্থা! নিন নিন চান করে নিন! আহারে বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে।

খুবই সহৃদয় কণ্ঠ।

আহার। সে চিন্তা তো আসছে না।

পাপিয়া তার শাড়ি-জামা-তেল-সাবান ইত্যাদি নিয়ে ফাঁসির আসামীর বন্যভূমিতে যাবার মনোভঙ্গি নিয়ে সেই ‘ঘের’এর মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর তখনি তার মনে হয়, এইটাই আমাদের আসল দেশ। আমাদের গর্ব আর অহঙ্কারের পাদপীঠ, আমাদের ‘রাজ্য’।

রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ এইভাবেই জীবন-যাপন করে। মুষ্টিমেয় কিছু ভাগ্যবান জন, মহোৎসাহে রাজ্যের অগ্রগতির হিসেব দেয়, আর নিজেদের সরু চালুনিতে ছাঁকা শহুরে জীবনটিকেই ‘এটাই দেশের অবস্থা’ ভেবে পরম শান্তিবোধ করে।

আর নেতারা? মন্ত্রীরা? তাঁদের কথা তো বাদই দাও।

তাঁদের ‘ওয়েস্টার্ন স্টাইলের’ স্নানের ঘরে মোজাইক টাইলসের মেজে, ব্যবস্থা, এমনকি টি. ভি. সেটও। হয়তো আরো কিছু!

এই ‘জনগণে’র নেতা তাঁরা। এদের ভোটে তাঁদের ‘গদি’ শক্ত থাকে।

নতুন কিছুই নয় অবশ্য। এ ব্যবস্থা আদিঅন্তকালই পৃথিবীতে আছে।…চিরকালই কথা আছে, ‘রাজার প্রজার এক হয় না!… পায়ে মাথায় সমান হয় না।’

তবে হঠাৎই একদিন মানুষ একটা আশ্চর্য নতুন কথা শুনেছিল, এবং এখনো শুনে চলেছে। সে কথা হচ্ছে, ‘এই চিরকেলে পচা পুরোনো ব্যবস্থা থাকবে না। এ ব্যবস্থা চুরমার করে ফেলা হবে। ‘পায়ে মাথায় এক করা হবে’।…হ্যাঁ, বটবৃক্ষ থেকে বেগুন গাছটি পর্যন্ত সমান সাইজের হয়ে যাবে। এর নাম সাম্যবাদ। দুনিয়ার মজদুর এক হয়ে লড়ে তামাম দুনিয়াকে এক ছাঁচে ঢালাই করে ফেলবে। ‘ফেলবে’ কেন, ফেলছে। কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে অনেক দিনই। চলে চলেছে সে হোম-যজ্ঞি বৃহৎ বৃহৎ দেশে। তবে কারো চোখের সামনে নয়। সবকিছুই লোকচক্ষুর অন্তরালে। লৌহ যবনিকা স্থাপিত। সেই যবনিকার অন্তরালে চলেছে যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার কাজ। সমস্ত পৃথিবীর সামনে অন্ধকার দুর্বোধ্য, যবনিকা কম্পমান। কবে উন্মোচিত হবে সেই যবনিকা! কী দেখবে! কী দেখব!

কী দেখল সেটা পরবর্তী ইতিহাস।

আমাদের এই অভাগা রাজ্যে সেই যজ্ঞ-হোমের ভস্মটাকাটুকু এসে পৌঁছেছিল বৈকি। তাতে কত আশার বাণী শোনানো হয়েছে তাবৎ জনকে। ‘কেউ আর পা থাকবে না রে। সবাই মাথা হয়ে যাবে।’

তো সেই শিক্ষাটুকু নিয়েছে বৈকি কিছু কিছু জন। যারা যুগ-যুগান্তর ধরে ‘পা’য়ের অমর্যাদায় কাটিয়ে এসেছিল তারাই মাথায় চড়ে বসেছে। কিন্তু আগের ‘মাথা’রা? তারা নেমে এসে সমান হয়েছে? পাগল না কী? তাদের জন্যে আরো উচ্চ আকাশ নেই?

অনেক কিছু ভেবে চলেছিল পাপিয়া, তার এই নবলব্ধ অভিজ্ঞতার তীক্ষ্ণ কামড়ের মধ্যে। প্রথমটা হতাশভাবে দাঁড়িয়ে ভেবেছে, কী করে কী করবে! একসময় নিজেই পাপিয়া আবার অবাক হয়ে দেখল স্নান নামক ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলে পাটভাঙা শাড়ি-জামা পরে দিব্যি মানুষের চেহারাটি নিয়ে লোকসমাজে দেখা দিতে সক্ষম হয়েছে।

.

সন্ধের মুখে দলের সঙ্গে যোগযোগ ঘটল। ঘটাতে তো হবেই। কাল সকাল থেকেই তো কর্মসূচী অনুযায়ী অভিযানে বেরোতে হবে।….

তবে আপাতত দেখা গেল এরা দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে! সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। মিস মুখার্জিকে দেখে সমস্বরে হৈ হৈ করে উঠল, এই যে ম্যাডাম! এসে গেছেন। আপনার জন্যেই সবকিছু আটকে রয়েছে।

সবাই এরা পরিচিত বন্ধুজন। তবে শৌভূনিক হচ্ছে পাপিয়াদের পাড়ার ছেলে। ‘তুই-তোকারির’ সম্পর্ক

পাপিয়া তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলল, আমার জন্যে সব আটকে রয়েছে? কোনটা? খাওয়া-দাওয়া নাকি? দিব্যি তো আড্ডা চলছে।

আহা। কাজের ব্যাপারটার তো আলোচনা মুলতুবি রয়েছে।

অনেক ধন্যবাদ। একটু বসতে পারি কী?

চৌকিতে বসে থাকা ওরা একটু সরে সরে জায়গা বার করে বলে উঠল, ‘জ্যেঠু’ অ্যালাউ করবেন তো একাসনে বসতে?

আঃ! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে না কী, তাই করবেন না।

শৌভনিক বলে ওঠে, কেন? উল্টো গাইছিস কেন? তোর তো স্পেশাল খাতির! গোয়ালে না রেখে অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়ে তোয়াজ। তা জ্যাঠামশাইয়ের খবরদারিতে কাটল কেমন?

আর বলিস না। রীতিমতো একটি এক্সপিরিয়েন্স। শুনবি দুঃখের কথা! বাড়ির মহিলারা কেউ ‘ডাক্তারবাবু’কে মুখ দর্শালেন না। একটা নাবালিকা আর একটা বালক যোগাযোগের সেতু। তবে ভাতের থালাটা অবশ্য বয়ে নিয়ে এলেন এক মহিলা আবক্ষ অবগুণ্ঠন টেনে। বাইরের দিকে যে ঘরে থাকতে দিয়েছে, সেই ঘরেই এনে হাজির!…যখন প্রতিবাদ করে উঠলাম, এ কী! এখানে কেন? আপনাদের সঙ্গে বসিগে চলুন। তখন মাস্টারমশাই সবিনয়ে জানালেন, ওনাদের তো ভুঁয়ে পিঁড়ি পেতে বসে খাওয়া অভ্যাস। কিন্তু ডাক্তারবাবুকে তো তা দেওয়া যায় না। তাই স্পেশাল ব্যবস্থা। একটা বড় টুলের ওপর থালা বসিয়ে দিয়ে গেল পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে।

তোকে ‘ডাক্তারবাবু’ বলছে?

বাঃ। বলবে না? পয়সাকড়ি খরচা করে খেটেখুটে ডাক্তার হইনি আমি? তার একটা মান্য নেই!

হো হো করে হেসে ওঠে সকলে।

তাই বলে দেখে মহিলারা ঘোমটা দেবেন?

দিলেন তো! তবে একটি বালিকা লেগে পড়ে বসে থেকে সমানে জিগ্যেস করে চলল, আর কিছু লাগবে? আর কিছু লাগবে?

হুঁ, তা আমাদের তো এখানে—থাক সে কথা। তোর ভাগ্যে অতিথি সৎকারটা ভালই জুটেছে তাহলে!

তা বলতে পারিস। প্রায় ‘সৎকারের’ অবস্থায় এনে ফেলার যোগাড়। বললে বিশ্বাস করবি সাত-আট রকম তরকারি, সবই প্রায় একই চেহারার, প্রত্যেকটার ওজন অন্তত হাফ কিলো করে! বাটি ভর্তি ভর্তি। তার সঙ্গে ইয়া বাটির এক বাটি দুধ!

অ্যাঁ, এই বাজারে? তাহলেই বলুন ঠিক বলেছি কিনা? স্পেশাল খাতির।

আমার বদলে কেউ গিয়ে এই স্পেশালটা ভোগ করুনগে না। সেই গামলার সাইজের একবাটি দুধকে খাওয়াবার জন্যে কী ঝুলোঝুলি। ‘বাড়ির গরুর’ দুধ। নাকি অতীব সুস্বাদু! আমাদের কলকাতায় দুধের এমন স্বাদ মিলবে না।

তোটক বলে, সবই সত্যি। তবে এখানের এখন যা আবহাওয়া দেখছি গরুরা কী দুধ দিচ্ছে? মাঠে তো ঘাস নেই।

কী জানি। একদিনেই তো অস্থির লাগছে। আবার আসবার সময় প্রশ্ন, রাত্রে ডাক্তারবাবুর ভোগের আয়োজনটা কী হবে?

শৌভনিক লাফিয়ে ওঠার ভঙ্গীতে বলে, তাই না কী? আমাদের তো স্রেফ ‘ভাত’ দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের সেবায় যাদের যাদের নিয়োগ করা হয়েছে, তারা না কী রুটি বানাতে জানে না। তুই কী বললি?

বলবো আবার কী? বেলা তিনটের সময় যা আহার হয়েছে তার জের চলবে কাল সকাল অবধি।…তবে মনে হয় না, রুটি নামক বস্তুটি এখানে তেমন চালু! আমি প্রথমটায় মেয়েটিকে বলেছিলাম, তোমরা যা খাও তাই। তা উত্তরে জানলাম, বালখিল্যদের নাকি রাত্রের আহার শুধু মুড়ি।…আর বয়স্করা একমেবাদ্বিতীয়ং ওই ভাতই।…আসলে গ্রামের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই রে। কত জায়গায় কত রকম। আমাদের যেন বদ্ধমূল ধারণা কলকাতাটাই, অথবা গ্রেটার কলকাতাও বলা যায়। আমাদের পুরো রাজ্যটা। মানে ওটাই পুরো ‘পশ্চিমবঙ্গ’! একবার সন্ধানী দৃষ্টি চালালেই ধরা পড়ে যাবে— কিন্তু থাক ওসব ফালতু কথা, কাজের কথাটা হোক এবার।

.

কাজের কথাটথা হয়েছিল বৈকি!

সরকারি কর্মসূচি অনুযায়ী অভিযানের ছকটি ঠিক করাও হয়েছিল। কিন্তু কাজ?

কী ভাবে? তা ‘ভাবটা’ এই—

গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রতিটি মানুষকে স্বাস্থ্য-সচেতন করে তোলা। অপরিষ্কার জল ফুটিয়ে খাওয়ার নির্দেশ! গর্ভবতী অবস্থায় কী কী পালনীয়। শিশুর জন্মের পর নির্দিষ্ট সময় হাসপাতালে গিয়ে ‘ইনজেকশন’ খাইয়ে আসার বিশেষ প্রেরণা।

এছাড়া হঠাৎ আক্রমণকারী কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে, রোগীকে যতসম্ভব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে এসে অন্তত—আউটডোরে দেখাতে নিয়ে আসা। এবং বাড়ির সবাই নিজেরা কীভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তার নির্দেশিকা দেওয়া।

হ্যাঁ, এই ধরনের অনেক কিছুই সূচি রয়েছে এদের কাজের জন্য!

তবে সে সূচিকে রূপায়ণ করা?

সাধ্য নাকি?

যেখানে খাবার জলই দুষ্প্রাপ্য, হয়তো মাইল মাইল রাস্তা হেঁটে সেই খাবার জল সংগ্রহ করে আনতেই ছাতি ফাটে, সেখানে জল ফুটিয়ে খাবার মতো বিলাসিতা? তা বিলাসিতাই বৈকি। অন্য একদিকেও। যাদের দুটো চাল ফুটিয়ে ভাত সেদ্ধ করবার মতো জ্বালানি জোটে না, তারা জল ফুটিয়ে খাবার কথাটা পাগুলে কথা বলে মনে করবে না?

শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ‘পোলিও’ প্রতিষেধক খাইয়ে আসবে? কোন্ হাসপাতালে গিয়ে? যেখানে ডাক্তারের চিহ্নমাত্র নেই, ‘ওষুধটা স্বপ্নবিলাস মাত্র, এবং নামকাওয়াস্তে যে ক-টা বেড আছে, সেখানে রোগীর বদলে জমাদারের স্ত্রী-পুত্র, সন্তান-সন্ততি বসতি করে, সেই হাসপাতালে?

আউটডোর!

তা নামটা ঝোলানো আছে বটে, দর্শাঘেরা বারান্দায় একটা কেঠো চেয়ার-টেবিল আর একখানা টানা লম্বা বেঞ্চের সামনে। নামই আছে, নামের মাহাত্ম্য বিকাশের চিহ্ন নেই। চেয়ারখানায় না কি–প্রায়শই ওই জমাদারের বুড়ো হয়ে যাওয়া পোষা কুকুরটা স্রেফ কুকুরকুণ্ডলী হয়েই শুয়ে থেকে ঝিমোয়, আর বেঞ্চটায়—জমাদারগিন্নী সময় পেলেই বছর দশেকের মেয়েটাকে টেনে এনে বসিয়ে তার মাথার উকুন বাছে। এইটাই বোধহয় তার সবচেয়ে প্রিয় অবসর বিনোদন।

কিন্তু এসব তো নেপথ্য দৃশ্য! কাগজে কলমে, সরকারি খাতায় পূর্বতন রিপোর্টে তো সবই আছে। সেইভাবেই রিপোর্ট তৈরি করতে পারলেই বখেড়া ঢুকে যায়।

‘ডক্টরস্ ক্যাম্পের’ দ্যাভালের ভারপ্রাপ্ত নগেন সোরেন। বেয়াড়া এই ডাক্তার চারটের অভিযোগ ক্ষুব্দ এবং বিরক্ত হয়ে বলে, আমি কী করবো? আমার কী করবার আছে?… আপনাদের যা বলবার ‘অঞ্চল প্রধানকে’ বলুনগে না।

‘অঞ্চল প্ৰধান!

কই তিনি?

তিনি! তিনি কী এই অভাগা নগেনের মতো এইসব ছেঁড়া কাজ করতে আসবেন? অভিযোগ জানাতে হলে তাঁর কাছে গিয়ে জানাতে হবে। সেই কাছটা? সে তো ঝালদার কাছে। বিরাট বাগান, মস্ত বাড়ি। তিনি কি আরসায় পড়ে থাকবার লোক? তবে অভিযোগটা মশাই কী এমন গুরুতর? হাসপাতালে ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, ব্যান্ডেজের তুলো নেই, ইনজেকশনের ছুঁচ নেই, বেড়-এ রোগী থাকার মতো অবস্থা নেই, এসব কী খুব একটা নতুন কথা? গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে দেখে আসুনগে না। বরং এদিককার মধ্যে এই ‘আরসা’ গ্রামটাই অনেকের থেকে ভালো। আপনাদের শহরে-নগরেই কী এর থেকে খুব ভালো?

জলাভাব? সে তো প্রকৃতির অভিশাপ।

কিন্তু গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের নথিভুক্ত এ অঞ্চলের সেই পাঁচটা নলকূপ কোথায়? একটা ‘গভীর’ আর চারটে অগভীর। বিশ্বব্যাঙ্কের মঞ্জুরীকৃত টাকায় বিগত মার্চের মধ্যেই যেগুলোর কাজ শেষ হয়েছিল?

নাঃ। এবার রাগ নয়, হাস্যের পালা নগেন সোরেনের।

টিপকল। পাঁচটা।

দপ্তরের হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে বলেই, তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে? সাকুল্যে তিনটে টিপকলের মালপত্তর এসেছিল, একটা ‘গভীরে’র আর দুটো ‘অগভীরের’। তো গভীর জলের মাছ অঞ্চল প্রধান ওই ‘গভীরটা’ নিজের উঠোনে বসিয়ে নিয়েছেন। এখনো জল উঠছে! তবে আরো খরা হলে কী হবে বলা যায় না!

বাকি দুটোর মধ্যে একটা অকেজো হয়ে পড়ে আছে, ‘ঘাড়’ ‘হাতল’ লোপাট হয়ে। বাকিটায় জল একটুক একটুক ওঠে বটে, তো সে জলে নাকি দারুণ ক্ষার। খাওয়া যায় না।

ব্যবস্থার দোষ দিচ্ছেন বটে টাটকা তাজা ‘ডাক্তারবাবুরা’। বলি জলে ক্ষার, সেটাও কী কর্তাদের দোষ? সবকিছুতেই গরমেন্টের সমালোচনা করা, আর নেতাদের দোষ দেওয়া, এটা এখন একটা ব্যাধিতে দাঁড়িয়ে গেছে লোকের। এই নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটি বক্তৃতাও দিয়ে ফেলে নগেন।

লোকটা তাদের তদারকিতে আছে। তাই বেশী চটায় না কেউ তাকে। লোকটাকে কারুরই ভালো লাগে না।

বিভাস বলে, আমাদের এই ‘দ্যাখালের’ খাতে যতটি ‘ব্যয়’ ধরা হয়েছে বা হবে, তার কতটি এই মাননীয় নগেন মহাশয়ের পকেটে ঢুকে যাবে বলে মনে হয় তোদের? বেশ ভালো অঙ্কের একটি কী বলে ব্যয়বরাদ্দ হয়েছে নিশ্চয়!

তোটক হাসে। বলে, ‘সকল পক্ষী মৎস্যভক্ষি’, ‘মাছরাঙাই কলঙ্কিনী।’ …শুধু নগেন মহাশয় কেন? ধাপে ধাপে অনেক পকেটেই যাবে কিছু কিছু। আহা। এটা ভেবেও কিন্তু এক এক সময় প্রাণে বেশ বেদনা অনুভব করি! ভাগে ভাগে ভাগ করতে করতে কার ভাগে আর কতটুকু পড়ে?

তা বটে। সমস্ত বিভাগেই তো একটা ‘চেন’-এর কারবার। উঁচুতলা থেকে নেহাৎ নিচুতলা পর্যন্ত সবাই সেই ‘চেন’-এ আটকা পড়ে আছে।

পাপিয়া হতাশ গলায় বলে, সত্যি ভাবলে এতো খারাপ লাগে! যেখানে যতটা বরাদ্দ, তার সবটাই যদি যারা সত্যি পাবার তারা সবটা পেত! তাহলে—

সবটা! হায় অবোধ বালিকা।

শৌভনিক বলে, অর্ধেকটাও যদি পেত, কৃতার্থ হয়ে যেত! টি. বি. হসপিটালের পেশেন্টদের ‘মিল’ থেকে কীভাবে ভাগবাটোয়ারা হয়, শুনেছিলি তো?

আচ্ছা শৌভনিক, মানুষ এতো লোভী কেন বল্ তো?

পাপিয়ার এই সত্যিকার বেদনার্ত হতাশ প্রশ্নে কিন্তু বাকিরা সশব্দে হেসে ওঠে।

মিস মুখার্জি! আপনি এতো ইনোসেন্ট কেন বলুন তো?

কাজ করতে এসেছে। অথচ না আছে কাজের পরিবেশ, না আছে কাজের উপযুক্ত উপকরণ। সংশ্লিষ্ট জনেদের সহযোগিতাহীনতাও লক্ষণীয়।

পাপিয়া বিরক্তভাবে বলে, আচ্ছা, আমরা কী এখানে কোনো বিয়ের বরযাত্রী হয়ে এসেছি নাকি? আমাদের থাকা-খাওয়ার যাতে কোনো অসুবিধে না হয়, কেবল সেই ব্যবস্থাই দেখছি। চল্ শৌভনিক, একটু এমনি বেড়িয়ে আসা যাক। এসে পর্যন্ত তো এই একটা জায়গাতেই পাক খাওয়া হচ্ছে। খুব ভিতরের দিকে, নেহাৎ গণ্ডগ্রামের মধ্যে কোথাও চলে গিয়ে—

বাকি তিনজন, এবং ওদের সঙ্গে আমাদের মধ্যে ক’জনের দলের সুকুমার আর অনীশ বলে ওঠে, ওঃ বাবা, যা কঠিন পথ ওখানকার! চড়াই উৎরাই। তাছাড়া রোদ চড়া হয়ে উঠল বলে—

তাবলে এইভাবে বসে বসে! কোনো মানে হয় না। এই শৌভনিক, তুই তো সেই কবে যেন পদব্রজে বঙ্গদর্শন না কিসে নাম লিখিয়েছিলি!

হুঁঃ। ক্লাস নাইনে, ওই নামই লিখিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল?

হয়নি তা জানি। ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ জ্বরে পড়ে গিয়েছিলি। তা যাকগে, সেই অসমাপ্ত ব্রতটা সমাপ্ত করবি চল্।

শৌভনিক দুষ্ট হেসে বলে, শুধু দুজনে? তাও অজানা পথে? যদি জ্যেঠুর হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়?

আঃ। বেশী বাজে কথা বলবি না। একেই তো আমায় হারেমে ঢুকিয়ে ফেলে জীবন মহানিশা করে তুলেছেন ভদ্রলোক। তার ওপর অতি যত্নর বাড়াবাড়ি! তাছাড়া—

পাপিয়া উদাস উদাস গলায় বলে, চোখের সামনে একটা প্রতিকারের উপায়হীন অন্যায় অবিচার দেখা যে কী কষ্ট! সেই ছোট ছেলেটার কথা বলেছিলাম মনে আছে? ইস, ওই রোগা হাড়জিরজিরে ছেলেটাকে দিয়ে যে কী অমানুষিক খাটায়! কুয়ার জল কোন্ গভীরে চলে গেছে, ওই ছেলেটাকে দিয়ে সেই জল টেনে তোলায়। ভাবতে পারিস?

অভাবিতও নয়। শহরেই কী দেখছি না অহরহ।

জানি। কিন্তু ছেলেটা এমন অদ্ভুত, ওই কষ্টের মধ্যেও সর্বদা দাঁত বার করেই আছে।

তার মানে কষ্টের বোধ নেই।

কী জানি কী! হয়তো তাই। একদিন হেসে হেসে বলেছিলাম, তোকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। গেলে আমাদের বাড়ির সব্বাই খুব ভালবাসবে দেখিস। যাবি তো বল্? শুনে না হেসে গড়িয়ে পড়ল। বলে, ধ্যেৎ!

হ্যাঁ, সত্যিই একদিন বলেছিল পাপিয়া সেকথা।

পদ বলেছিল, ধ্যেৎ।

কেন? কেমন রেলগাড়ি চড়বি। কলকাতা দেখবি।

পদ অবলীলায় বলেছিল, আর উই গরুগুলনকে কে দেখা করবে? অ্যাঁ? ম্যাস্টোরবাবু? হি হি।

বাঃ। এখানে কী আর কোনো লোক নেই গরু চরাতে?

আছে তো কী? গরুগুলান ওদের চেনা-জানা? পদকে না দেখলে উয়াদের পেটে খড়-

ভূষি ঢুকবে?

আর তারপরেই বলেছিল, ধুস। ‘আরসা’ ছেড়ে কোথাও থাকা করা যায়?

তখনি অবশ্য মনে হয়েছিল পাপিয়ার, তা ঠিক।। সেটা বনের পাখিকে খাঁচায় ভরে আদর করার মতোই হবে ওর পক্ষে। কিন্তু ওর খাটুনিটা দেখলে ভীষণ মন খারাপ লাগে। অথচ ওই মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সকলেই শুধু নয়, তিনি স্বয়ংও দিব্যি নির্বিকারভাবেই সেই ব্যবস্থা দেখেন, এবং একটু ত্রুটি হলেই ধমক দিতেও কসুর করেন না। তবে হ্যাঁ, বড়জোর কখনো বলেন, খিদে লেগেছে? তালে কিছু খেয়ে নে। তাতেই কৃতার্থ পদ!

কত অল্পে সন্তুষ্ট এরা!

.

পাপিয়া বলল, কেউ না যাও, আমি একাই চললাম।

তারপর? রাস্তা হারিয়ে গেলে? তোকে তো কেউ বলতে আসবে না, পথিক, তুমি কী পথ হারাইয়াছো?

দ্যাখ্ শৌভনিক, মনে রাখিস তুই এখন একজন ‘ডাক্তারবাবু’। এখনো এতো ছ্যাবলামার্কা থাকা চলে না। পথ হারালে, সবাই মিলে খুঁজতে বেরোবি। তবু কিছুটা হাঁটা হবে। ভাবনা নেই বাবা। বেশী দূর যাব না। বলে পাপিয়া এমনিই একটু এগোয়।

কিন্তু শৌভনিক সঙ্গে সঙ্গে আসে। বলে, বনেজঙ্গলে গিয়ে পড়ে যদি বাঘের পেটে চলে যাস, ফিরে গিয়ে মাসিমা-মেসোমশাইকে কী জবাব দেব?

ওঃ। বাঘের মুখ থেকে বাঁচাবি আমায়? অ্যাতো বাহাদুর!

তোটক একটু অর্থপূর্ণ হেসে বলে, বাঁচাতে না পারুক, একসঙ্গে মরতে তো পারবেন! ওদের দুজনকে নিয়ে এরা রীতিমতোই হাসি-কৌতুক করে! এবং ভাবে, বাল্যপ্রেম দানা বাঁধছে।

কিন্তু পাপিয়া? সে কী অন্যত্র বাঁধা পড়ে নেই?

কিন্তু আজ পাপিয়াকে এমন জোর করে ঠেলে পথে বার করল কে? সে কী তার ভাগ্য? না নিয়তি?

তাই এলোমেলো খানিকটা ঘুরে শৌভনিক যখন বলে ওঠে, অনেক বেড়ানো হয়েছে, এবার ফেরা যাক। ঠিক তখনি পাপিয়া হঠাৎ এবড়ো-খেবড়ো উঁচু-নিচু রাস্তায় প্রায় ছুটতেই থাকে। আর অভীষ্ট জায়গায় পৌঁছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, তুমি! এখানে!

তুমি! এখানে!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন