আশাপূর্ণা দেবী
প্রশ্ন নয়, যেন রুক্ষ বালিয়াড়ির ওপর হঠাৎ আছড়ে এসে পড়া ঝড়ের সমুদ্রের একটা উদ্বেল ঢেউ। সেই ঝড়টা বিস্ময়ের ক্ষোভের উত্তেজনার, হয়তো বা ধিক্কারেরও, আর তার সঙ্গে অপ্রত্যাশিত একটা আনন্দের।
যাকে প্রশ্ন করা হলো, তার মধ্যেও কী এই হঠাৎ আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ধাক্কায় একটা ঝড় উঠল না? বিচিত্র রসাস্বাদিত অনুভূতির ঝড়! তবু সে তার চিরস্বভাব মতো ভিতরের উদ্বেল ঢেউকে কন্ট্রোলে রেখে অনুত্তেজিত গলায় বলল, এ প্রশ্নটা অবশ্য আমিও তোমায় করতে পারি!
আমাকে? আমার মধ্যে তো তোমার মতো কোনো রহস্য নেই! আমি তো—
সংক্ষেপে নিজের এখানে আসার কারণটা বিবৃত করে পাপিয়া আরো ক্ষুব্ধ উত্তেজিত স্বরে বলে, কিন্তু তুমি কী বাপ্পাদা? তোমার ব্যাপারটা কী? কী সাংঘাতিক ছেলে তুমি!
বাপ্পা সেইভাবেই বলে, সে পরিচয় তো অনেকদিন আগেই পাওয়া হয়ে গেছে!
সে একরকম! তবু তো বাড়িতে থেকে টেকে—কিন্তু এটা কী? এর কোনো মানে আছে? আশ্চর্য! এভাবে নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হয়ে চলে এসে—বাড়ির লোকেদের কথা একবারও মনে পড়ল না বাপ্পাদা? মনে হলো না তোমার এই অদ্ভুত খেয়ালের ফলে কী অবস্থা ঘটবে তাদের!
বাপ্পা এ ধিক্কারেও অবিচলিত ভাব বজায় রেখে বলে, আমার সম্বন্ধে অতো প্রশ্ন নেই। এই পাষণ্ড পামর ছেলেটাকে তাঁরা অনেকদিন আগেই খরচের খাতায় লিখে রেখেছেন।
সহজে উত্তেজিত হবার মেয়ে নয় পাপিয়া, হয়তো বা আদী উত্তেজিত হবার নয়, কিন্তু এখন এই অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎ অভাবিত একটা হারানো জনের দেখা পেয়ে গিয়ে পাপিয়া যেন তার স্বভাবের বাইরে এসে পড়েছে।
উত্তেজনায় পাপিয়ার ঠোঁট কাঁপছে, হাত-পা কাঁপছে, হাতের তালু ভীষণভাবে ঘামছে। পাপিয়া ওই অদ্ভুত সাজে সজ্জিত লোকটার দিকে তাকিয়ে আরো বিচলিত হচ্ছে।
এই সেই বাপ্পাদা!
ইদানীং অনেক অনিয়ম বেনিয়ম আর শরীরের ওপর অত্যাচারের ফলে তার সেই রাজকীয় চেহারাটার বারোটা বেজে গেছে অনেকদিন। তারকের মায়ের ভাষায়, ‘সায়েবের মতো রং তাঁবার মতো হয়ে গেছে যে গো।—’ তবু তার সেই দীর্ঘোন্নত গঠনভঙ্গী, আর ধারালো কাটানো মুখের ছাঁচে পাবনার সত্যব্রত গাঙ্গুলীর যে সাদৃশ্যটুকু বজায় ছিলো, তার থেকেই শনাক্তকরণ। দূরে থেকেও।
হয়তো আশেপাশে ভিড় করে থাকা একদল দেহাতি মানুষদের মধ্যে মাথাটা অনেকখানি উঁচু বলেই, দূরে থেকেও মুখ দেখা গেছে। ওই অদ্ভুত সাজ সত্ত্বেও।
তা অদ্ভুত বৈকি! বাপ্পার পরনে একটা ডোরাকাটা পায়জামা, গায়ে একটা ছাইরঙা মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি, পায়ে একটা বিধ্বস্ত বিবর্ণ চপ্পল, যেটার নাকি একদার নাম ছিলো ‘কাবুলী’!
আর বাপ্পার মাথায় ছিলো একটা খেজুরপাতায় বানানো ‘হ্যাট’। হ্যাঁ, এরা ‘হ্যাঁটই’ বলে। তবে গবেষণা করলে বোঝা যায়, এটা হচ্ছে এদের চিরকালীন ‘টোকার’ একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। টোকার অসুবিধে হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে, কিন্তু একে একটি বন্ধনডোর দিয়ে চিবুকের নীচের আটকানোর ব্যবস্থা আছে। বোধকরি সেই কারণেই ওর ওই নাম-গৌরব
বাপ্পার একরাশ রুক্ষ চুল মাথা ছাড়িয়ে ঘাড়ে নেমে আসতে চাইছে, আর গালভর্তি দাড়ি জানান দিচ্ছে—এখানে দাড়ি কামানোর মতো বিলাসিতার অভ্যাসটা বজায় রাখেনি বাপ্পা।
দাড়ির প্রথম আবির্ভাবের কিছুদিন পর বাপ্পা একবার চেষ্টিত হয়েছিল দাড়ি রাখতে, শখে বা নিত্য ঝঞ্ঝাটের দায় এড়াতে কিনা কে জানে! কিন্তু নিজের অস্বস্তিতেই সে ইচ্ছেটা বাতিল করেছিলো। বলেছিলো, নাঃ। পোষাবে না। মুখটাকে ক্লীয়ার করে মোছা যায় না।
কিন্তু এখন বাপ্পার গালভর্তি দাড়ি।
তবু পাপিয়া দূর থেকে দেখেও চিনে ফেলে শৌভনিককে একেবারে ভুলে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এসেছে। এবং এখনো সেই ভুলে যাওয়াটাই রয়েছে। পাপিয়ার মনেও পড়ছে না বেশ কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে শৌভনিক তাকে অবলোকন করে চলেছে।
কিন্তু শুধু কী ওইটুকুই ভুলে বসেছে পাপিয়া? পাপিয়া তো এও ভুলে গেছে, বাপ্পার সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্র কতটুকু, আর সেইটুকুর জোরে কতটা পর্যন্ত যাওয়া চলে। কোনখান পর্যন্ত টানা আছে তার অধিকারের সীমারেখা!
ভুলে গেছে বলেই পাপিয়া রুদ্ধস্বরকে জোর করে ক্রুদ্ধ’য় পরিণত করে বলে ওঠে, ওই বলে গা ঝাড়া দিতে চাইছো বাপ্পাদা? তুমি কী ইট-পাথর না লোহা-লক্কড়?
বাপ্পা পাপিয়ার ওই ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ উত্তেজিত মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয় বৈকি। এই ভঙ্গি এই স্বর অবশ্যই নীহারিকাকে মানাতো, হয়তো টুসকিকেও, কিন্তু পিসির বাড়ির এই মেয়েটা? ও কেন?
ছেলেবেলায় চঞ্চল অস্থির বাক্যবাগীশ যাই-থাকুক, বড় হয়ে তো অতি শান্ত নম্র স্থির একখানা মেয়ের রূপেই দেখা গেছে। তবে হ্যাঁ, বাপ্পার মাথা ফাটার সময় নার্সিংহোমে যে ক’দিন পিসির সঙ্গে এসেছে কিংবা ঠিক বলা হয়, পিসিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, তখন যেন মেয়েটার চাহনির মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ একটা গভীর অতলস্পর্শতা দেখে একটু আশ্চর্য হয়েছে। এ চাহনি যেন অন্য এক লোকের।
এমনকি পিসির সঙ্গে কথা কইতে কইতে ও যেন অনুভব করেছে, একজোড়া গভীর কালো অতলস্পর্শী চোখ বাপ্পার মুখের ওপর স্থির হয়ে রয়েছে।
চাহনিরও একটা অনুভূতি আছে বৈকি! স্পর্শানুভূতির থেকে খুব কম নয়।
তবে তখন বাপ্পা ওই অপ্রয়োজনীয় চিন্তাটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল। ভেবেছিল, হঠাৎ বড় হয়ে উঠলেই বোধহয় মেয়েদের চোখের চাওয়ার ভঙ্গিটঙ্গিগুলো বদলে যায়।
কিন্তু এখন? এখন তো হঠাৎ বড় হয়ে ওঠার ব্যাপার নয়।
এখন তাই বাপ্পাকে ওই দৃষ্টিটা যেন অস্বস্তিতে ফেলে। বাপ্পা অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, হয়তো তাই। মাও যখন তখন এই কথাটা বলতো বটে!
তারপরই তাড়াতাড়ি বলে, কিন্তু এই রোদের মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে—
পাপিয়া এখন স্থির গলায় বলে, নিজেকে তো ইট-পাথর লোহা-লক্কড়ের সমগোত্র বলেই স্বীকার করলে বাপ্পাদা। তাহলে আর এ চিন্তা কেন? রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিছুতেই এসে যাবে না আমার। আমি শুধু জানতে চাই, খুনী আসামীর মতো এভাবে পালিয়ে এসে লুকিয়ে থাকার মানেটা কী?
আমি তো বরাবরই মানহীন কাজই করে আসছি বাবা!
পাপিয়া সেই নিজের অধিকারটা ভুলে যাওয়া অবস্থাতেই প্রায় ধমক দেওয়ার সুরে বলে, থামো! কথার প্যাঁচ মেরে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা কোরো না। জানো তোমার জন্যে তোমাদের বাড়ির কী অবস্থা! তুমি হাসপাতাল থেকে হারিয়ে গেছ এই খবরটা শুনে তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে—
বাবা!
বাপ্পা যেন বিহ্বল হয়। বাবার আবার তার সম্পর্কে এতোটা সেন্টিমেন্ট ছিলো কবে! যদি মায়ের কথাটা বলতো তাও বোঝা যেত। কিন্তু পাপিয়া নামের ওই স্বভাবছাড়া উত্তেজিত হয়ে ওঠা মেয়েটা কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল কেন?
বাপ্পার বুকের মধ্যেটা যেন আচমকা ঠান্ডা মেরে গেল। ভাই শুধু ভাবশূন্য গলায় উচ্চারণ করল, “বাবা”!
পাপিয়াও অবশ্য হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে আসা কণ্ঠকে আবার মুক্ত করে আস্তে বলে, বেশ কিছুদিন ইনসেনটিভ কেয়ারে থাকতে হয়েছিল। এখনো প্রায় বেডরিডন অবস্থায়। সংসার চালাবার জন্যে তোমার দাদুকে এখন আবার নতুন করে কোর্টে বেরোতে হচ্ছে। সবের মূলে তোমার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ বাপ্পাদা! অবশ্য বলতে পারো আমি এতো কথা শোনাবার কে? আমার কী রাইট আছে?
কিন্তু—
বাপ্পা হঠাৎ একটু সরে এসে গভীর গলায় বলে, ছিঃ পাপিয়া।
পাপিয়া! এই নামটা ধরে সেই ছেলেবেলার পর আর কোনোদিন ডেকেছে বাপ্পা?
বাপ্পার নিজের কানেই যেন কেমন অদ্ভুত লাগল। আর যে শুনল? তার মধ্যে এক প্রবল আলোড়ন ওঠে। সেই আবেগের ভার তারও নিজের কাছে নতুন।
অথচ পরিবেশটি আবেগের পক্ষে একদম হাস্যকর। মাথার ওপর প্রখর রোদ (শৌখিন ছাতায় অথবা খেজুর পাতার হ্যাটে কতটা রক্ষা হয়?), আশেপাশে তৃণশূন্য রুক্ষ পাথুরে ভূমি! অদূরে একদল দেহাতি লোক তাদের শিক্ষাদাতা গুরুকে আচমকা এক রমণী কেড়ে নেওয়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করে দাঁড়িয়ে থেকে, ক্রমে সবাই উবু হয়ে বসে পড়েছে।
ওদিকে শৌভনিকও অবলোকন করতে করতে ক্রমশ কেমন একটা সন্দেহে পৌঁছে গিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করবে কিনা পাপিয়ার কী দেরি হবে?
এমনি মহামুহূর্তে কোন দিক থেকে যেন নাটকের আর এক নট এসে হাজির হয়ে বলে ওঠে, পাপিয়া দিদিমণি! আপনি!
.
ফেরার সময় শৌভনিক বলে, ওই অদ্ভুতদর্শন ব্যক্তিটির সঙ্গে যেরকম মশগুল হয়ে গিছলি, আমি তো ভাবলাম কিরেই যাই। তুই বোধহয় আর ফিরতে পারবি না।
গেলেই পারতিস। তোকে তো আমার বডিগার্ড হয়ে আসতে বলেনি কেউ। এমন বোকার মতো কথা বলিস! ওকে তুই দেখিসনি কখনো?
জীবনেও না!
জীবনেও না? খোকনদার মামাতো ভাই না? বলতে গেলে আমাদেরও। আগে তো কত এসেছে আমাদের বাড়িতে। ইদানীং অবশ্য পার্টি-ফার্টিতে মিশে অনেক ইতিহাস সৃষ্টি করে, হসপিটাল থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলো। ওদের বাড়ির অবস্থা—মানে বড়মার বাপের বাড়ির অবস্থাটা ভেবে দ্যাখ। এতোদিন পরে হঠাৎ দেখতে পেয়ে ভাবছিলাম তো ধরে টেনেই নিয়ে এসে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিইগো।
বড় বেশী কথা বলে ফেলল না পাপিয়া?
এখন কী এতো কথা কইবার মতো অবস্থা ছিলো ওর?
ছিলো না। আর ছিলো না বলেই বুঝি স্বভাববিরুদ্ধভাবেই এতো কথার চাষ চালিয়ে চলেছে। ভয় হচ্ছে স্তব্ধ থাকলেই বুঝি বাইরে থেকে পাপিয়ার মনের মধ্যেকার তুমুল আলোড়নটা দেখতে পাওয়া যাবে। অতএব কথাই ভালো। কথাই আবরণ! কথাই আত্মরক্ষার অস্ত্র। অতি সহজ ভঙ্গির তড়বড়িয়ে কথা বলে অপর ব্যক্তির সন্দেহ সন্দেহ ভাবটাকে উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে!
শৌভনিক এখন বলল, ও! তোর বড়মার সেই পার্টিপ্রেমী ভাইপোটি? নিরুদ্দেশের খবরটা যেন শুনেছিলাম মনে হচ্ছে। যাক। ঝটপট খবরটা তাদের কাছে পৌঁছে দে। তা নিরুদ্দেশ হওয়ার উদ্দেশ্যটা কী? কোনো খুনখারাপির ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েননি তো মহাশয়।
আঃ, শৌভনিক। ছোটলোকের মতো কথা বলিস না।
আরে ব্বাস। খুব টেনশনে রয়েছিস মনে হচ্ছে।
আছিই তো। ভাব তো, যদি আমি ওদের বাড়িতে খবর দিয়ে বলি এখানে রয়েছে, আর তাঁরা ছুটে আসেন। আর সেই অবকাশে মহাশয় ব্যক্তিটি আবার উড়ে পালান!
তা এতো ওড়াউড়ির রহস্যটা কী?
অন্য কিছুই না, বাড়ির লোক পাছে আটকায়। ওর নিজস্ব জীবনদর্শনে বাধা পড়ে।
হ্যাঁ, সারা পথটাই কথা বলতে বলতে এসেছে পাপিয়া।
সে কী শুধুই শৌভনিকের সন্দেহ নিরসনের জন্য? নাকি ঠিক এই মুহূর্তে নিজের মনের মুখোমুখি হতেও সাহস হচ্ছে না বলে?
বাপ্পা নামের ওই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে পাপিয়ার মধ্যে যে সমুদ্র উথলে উঠবে এমন কথা কী আর কল্পনাতেও ছিল? পাপিয়া তো শুধু ওই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া বাবদ, তার পরম ভালোবাসার ‘বড়মা’র মনোকষ্ট আর তাঁর বাপের বাড়ির দুঃখ-বেদনার কথা ভেবেই সর্বদা ওই পালানো লোকটার ফিরে আসার প্রার্থনা করেছে ঈশ্বরের কাছে। এর বেশী কিছু, এমন ধারণা পাপিয়ার নিজের মধ্যে তো ছিলো না।
অথচ! অথচ ওকে দেখামাত্র যেন পাপিয়ার মধ্যে সপ্তসিন্ধু উথলে উঠল। কথায় আছে, মনের অগোচর পাপ নেই।’ তা একে যদি পাপ বলো তো পাপ।
পাপিয়ার তো বাপ্পাকে দেখামাত্রই ‘বাপ্পাদা’ বলে তার ওপর আছড়ে পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল। পাপিয়া এখন সেই ভয়ঙ্কর ইচ্ছেটার কথা ভেবে অবাক হচ্ছে, ভয় পাচ্ছে।
.
পরবর্তী অবস্থা অবশ্য অন্যরকম।
পাপিয়া যখন বলে উঠেছিলো, তারক! তুমি! তুমি বাপ্পাদার সঙ্গে?…এবং তারক অবলীলায় উত্তর দিয়েছিল, তা রামচন্দ্র যেখেনে, হনুমানও সেখেনে—তখন পাপিয়া তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠেছিলো, তোমরা দুজনেই সমান নিষ্ঠুর আর বিশ্বাসঘাতক।
আর তারপর বাপ্পার সঙ্গে তর্ক চালিয়েছিলো তেমনি তীক্ষ্ণস্বরে, আর বিদ্রূপের ভঙ্গিতে।
কিন্তু সেটা কোথায়?
সেই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?
নাঃ, তা নয় অবশ্য।
বসবার জায়গা জুটেছিলো। সময়ও।
তাহলে কী পাপিয়ার একান্ত অনুরোধ রেখেছিলো বাপ্পা নামের ওই নির্মায়িক ছেলেটা? দেখা করেছিলো সেই হেডমাস্টার গোপীমোহন পাড়ুইয়ের বাড়িতে গিয়ে?
তা বলে তা নয়।
বাপ্পা সেই ছেলে না কি?
অথচ বাপ্পার মধ্যেও হঠাৎ খুব একটা অস্থিরতা এসেছিলো পাপিয়াকে দেখে। খুব আকুলতা এসেছিলো, এই কথা ভেবে পাপিয়াকে বসতে বলার কেনো জায়গা নেই সেখানে। তার মানে দু’চারটে বাক্য বিনিময়ের পরই চোখের সামনে থেকে অন্তর্হিত হয়ে যাবেও। বলল, ‘আর দু-দিন পরেই তল্পি গোটাতে হবে।’ তাহলে আর কখন দেখা হবে?
কিন্তু যখন পাপিয়া তারককে দেখে, ওদের অনেক কথা শুনিয়ে দিয়ে বলেছিলো, একটু মানুষের মতো ব্যবহার কোরো বাপ্পাদা। আমার আস্তানার ঠিকানাটা জেনে নাও। কাল নিশ্চয় করে যেতে হবে। না না। ভয় পেও না, ‘খেতে হবে’ এমন কথা বলছি না, শুধু যেও। অনেক খবর দেবার আছে বাপ্পাদা। অনেক কথা জানাবার আছে।
তখনই বাপ্পা স্থির করে ফেলেছিলো, নাঃ। যাওয়া-টাওয়া নয়।
যাওয়া নিজের ওপর একটা কঠোরতার আবরণ দিয়ে নিজেকে আর সকলের থেকে অন্যরকম ভাবতে অভ্যস্ত হয়, তাদের মধ্যে সর্বদাই ভয়, ওই বুঝি শিথিল হয়ে গেল সেই কঠোর আবরণ।
অতএব মনের মধ্যে একটু কোমলতা উঁকি মারলেই চটপট সাবধান হতে চেষ্টা করে সে। বাড়িতেও তো—মায়ের সঙ্গে অমন মমতাশূন্য ব্যবহার করতো কেন বাপ্পা?…বাবার সঙ্গে অতো নির্লিপ্ত আচরণ। আর টুসকি? মমতায় পড়ে তাকে একটু প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেই সামলে নিত নিজেকে। তক্ষুণি কঠিন ভাব দেখাতো!
এখনো তাই হলো।
মনটা যখন একান্তভাবে সেই ঠিকানায় পৌঁছে যেতে চাইল, তক্ষুণি ঠিক করে ফেলল, নাঃ! ‘হৃদয়’ নামক বস্তুটাকে কঠোর করতে হবে।
কিন্তু পাপিয়ার তো কঠোরতার সাধনা নয়
পাপিয়ার সাধনা এখন শুধু নিজেকে সামলানোর। তাই পাপিয়া পরদিন সকালটা কোনোমতে অপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়েছিলো তারকের দেখিয়ে দেওয়া তাদের দুজনের সেই আস্তানাটার উদ্দেশে। রামচন্দ্র আর হনুমানের যেখানে অবস্থান, সেটা প্ৰায় হনুমানজনোচিতই …পাবনার গাঙ্গুলীবাড়ির ছেলের নয়।
দেহাতিদের যেমন কুঁড়েঘর থাকে, তেমনি একখানা কুঁড়েঘর। মাটির দেওয়াল, খেজুরপাতা না তালপাতা পানপাতা কিসের যেন ছাউনি। তর্ তারকের ‘গৃহিণীপনায়’ তার মধ্যে পরিপাটি এবং রান্নাবান্নারও ব্যবস্থা!
বাপ্পা জানে না কোথা থেকে খাবার জল নিয়ে এসে মাটির কলসীতে ভরে ঠান্ডা রাখে তারক। এবং আহারের আয়োজনটাই বা কীভাবে হয়!
আচ্ছা তারক। এই খাওয়া-দাওয়াটা কীভাবে চলছে বল তো? আমি তো ভেবে পাই না!
রামচন্দ্রের প্রশ্নে হনুমান অবজ্ঞায় ঠোঁট উল্টে বলে, খাওয়া-দাওয়া। হ্যাৎ! দু’বেলা দুটো করে চাল সেদ্ধ করা। তাও চালের কী ছিরি। আর তরকারির মধ্যে শুধু কুমড়ো আর ধুঁধুল। দেখলে ঘেন্না করে। হাতে করে ধরে দিতে লজ্জায় মাথা কাটা যায়। থাক বাবা, কেটে ফেলিস না। তাহলেই গেছি। তবু দু’বেলা ওই চালই বা আসে কোথা থেকে?
তা আসে। হনুমান ছাড়াও আরো ভক্ত আছে বৈকি রামচন্দ্রের। কাঠ বেড়ালীটাও। তাদের পরম ভক্তিতে নিবেদন করা নৈবেদ্যতেই চলে যাচ্ছে এখানে এসে পর্যন্ত।
কেমন করেই যে এমন ঘটনাটা ঘটে গেছে!
এই দেহাতি বস্তিতে বাপ্পা প্রায় ভগবানের পোস্টটা পেয়ে গেছে। তাদের ভালোবাসার দানও তো এই কুঁড়ে।
.
রুদ্ধ একটা অভিমান ভিতরে ভরে রেখেও পাপিয়া সাবলীলভাবে জোর গলায় বলে উঠল, খুব তো গেলে বাপ্পাদা। সকাল থেকে হাঁ করে বসে থেকে—
তারক জল আনতে যাচ্ছিল, পাপিয়াকে দেখেই থমকে বলে উঠল, হলো তো! দেখলেন তো বড়দাবাবু? তারক বলে নাই, না যাওয়াটা খারাপ দেখাবে বড়দাবাবু। পাপিয়াদি অতো করে বলে গ্যালো। কলকাতায় ফিরে গিয়ে তো উনি তোমার কথা প্রকাশ করে দেবেনই, তবে আর একটু ভদ্দরতা করতে দোষ কী? যাক, বসেন পাপিয়াদি। জলটা নিয়ে আসি।
পাপিয়া চারিদিক তাকিয়ে বলেছিলো, এই ঘর!
বাপ্পা তার অভদ্রতা সম্পর্কে সমস্ত অভিযোগটি হাস্যবদনে হজম করেই হাসিমুখে বলেছিলো, কেন খারাপটাই বা কী? আমাদের শহর কলকাতায়ও তো সকলের ভাগ্যে এমন একটা ঘর জোটে না। ফুটপাথে পড়ে থেকে ‘স্টোনম্যানের’ শিকার হতে হয়।
বাপ্পাদা। কথামালার গল্প সকলেরই পড়া আছে। খলের ছলের অভাব হয় না। যারা ফুটপাথে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়ে স্টোনম্যানের শিকার হয় তারা তাদের প্রাসাদ ছেড়ে এসে ফুটপাথে শুতে আসে না। অভাবে পড়েই পড়ে থাকে। কিন্তু তুমি?
হ্যাঁ। পাপিয়া অবশ্যই তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করছে। পাপিয়া বাপ্পাকে এভাবে অভিযুক্ত করতে পারে, এমন সম্পর্ক নয়। কিন্তু গঙ্গায় যখন জোয়ার আসে, নদীতে যখন বান ডাকে, সে কী ভাবতে বসে সে তার সীমা লঙ্ঘন করছে?
করে না।
তাই পাপিয়াও তা করছে না। তাই সে রুষ্ট ক্ষুব্ধ মুখে চোখের মধ্যে আগুন আর জল দুটোর সঞ্চয় রেখেই বলে চলেছে, কিন্তু তুমি? তুমি কী জন্যে? কী রাজকার্য করছো তুমি এই পাতার কুঁড়েয় লুকিয়ে বসে থেকে?
বাপ্পাও একটু চড়ে ওঠে, লুকিয়ে আবার কী? আমি কী ফেরারি আসামী যে লুকিয়ে?
আচরণটা তো ফেরারি আসামীর মতোই বাপ্পাদা। লোকে তো তেমন সন্দেহ করতে শুরু করছেও। তো এখানে কী ব্রত? মহান একটা ব্রত না নিলে তো কেউ এতোখানি কৃচ্ছ্রসাধন করতে পারে না। এই শান্ত নিরীহ অবোধ আর সুখী প্রাণীগুলোর মধ্যে বুঝি বিপ্লবের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলছো? তাদের শান্তি আর সুখটুকু কেড়ে নিতে চাইছো?
আর কেউ হলে, অন্তত নিজের বোন হলে বাপ্পা নিশ্চয় তাকে একটা কঠোর নির্মম অবহেলার কথা বলে, এক মিনিটে থামিয়ে দিত, কিন্তু এ তো তা নয়। এ পরের বাড়ির মেয়ে।
আর? আর এর মোমে গড়া মসৃণশুভ্র মুখটা এখন বাড়তি রক্তোচ্ছ্বাসে লাল লাল, এর বরাবরের শান্ত আয়ত দুটো চোখে এমন একই সঙ্গে জল আর আগুন।
তাই বাপ্পা নিজেকে সংরবণ করে ব্যঙ্গের সুরে বলে, সুখ! শাস্তি! তা অবোধেরাও একরকম সুখ শান্তিতে থাকে বটে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকলেও শান্তিতে থাকে।
বেশ তো, তাই যদি হয়, থাক না সেই ঘুমন্ত শান্তিতেই। তোমার হাতে কে এই ভুবনের ভার’ দিয়ে রেখেছে বাপ্পাদা? তোমাদেরও তো একসময় বিপ্লবের বাণী শুনিয়ে, নতুন জগৎ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়ে দেখিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে ছন্নছাড়া করে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু তারপর? এই এক যুগের এক্সপিরিয়েন্সে ভেবে দেখেছো কোনোদিন, তারপর কী পেলে?
যারা সবসময় টাকা আনা পাইয়ের হিসেব কষে দেখে—’কী দিলাম, আর তার বদলে কী পেলাম’ তাদের সঙ্গে সকলের মত নাও মিলতে পারে।
ইঙ্গিতটা অপমানজনক।
তাই লাল লাল মুখটা আরো লাল হয়ে ওঠে, সে হিসেব কষার কথা হয়তো মনে আসতো না বাপ্পাদা, যদি না চোখের ওপর দেখতে হতো ‘কুমির কুমির’ খেলা করতে, অবোধ দলটাকে জলে নামিয়ে কুমিরের মুখে ছেড়ে দিয়ে, বুদ্ধিমানেরা নিরাপদ দূরত্বে সরে এসে, নিজেদের জন্যে পাথরের দুর্গ বানিয়ে বসে আমীরী চাল চালতো! বাপ্পাদা। তোমাদের না স্লোগান ছিলো, ‘বড়লোকের চামড়া ছাড়িয়ে গরীবের জুতো বানানো হবে।’…চোরাকারবারী কালোবাজারী আর ঘুষখোরদের ‘শেষের সেদিন’ দেখিয়ে দেবে। নেহাৎ ছোট ছিলাম না তখন। কানে এসেছে বৈকি। আর এখনো বোধহয় কৌটো বাজানোর শব্দটা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কী অবস্থা দেখছো তোমার নেতাদের? জনদরদী গরীবের বন্ধু সর্বহারাদের নেতাদের?
কেউ কেউ আদর্শচ্যুত হয়, সবাইকেই তাই হতে হবে?
হয়তো তা হবে না। কিন্তু আসলে, যদি দেখা যায় সেই আদর্শের ভেতরটা স্রেফ ফাঁপা? গদির মোহ সব আদর্শ আর তত্ত্বকে জলাঞ্জলি পাঠিয়ে দিয়েছে। তাহলে?
তাহলে যে যার নিজের মতবাদে বিশ্বাসী থাকতে পারে।
তার মানে, যে উটপাখির মতবাদে বিশ্বাসী। পাপিয়া যেন হাঁপিয়ে গেছে। যেমন হাঁপিয়ে যায় লোকে পাহাড়ি পথে চড়াই ভাঙতে হলে।
পাপিয়া কী হঠাৎ অসতর্কে একটা পাহাড়ি পথে এগিয়ে এসেছে? এখন দেখছে সামনে ‘চড়াই’। দেখছে যখন, তখন সেই চড়াই তো ভাঙতেই হবে তাকে। তাই পাপিয়া বলে ওঠে, তার মানে যে উটপাখির মতবাদে বিশ্বাসী! কিন্তু বাপ্পাদা, সবাই তো সে মতবাদে বিশ্বাসী নয়। তারা চড়া রোদে আলোটা দেখতে পায়। তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করতে রাজি হয় না। সবাইকে শোনানো হয়েছিলো, এ বিপ্লবে সবাই সমান মর্যাদায় বাঁচতে পাবে। রাজ্য থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। অভাগা জনগণকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে আনা হবে। বঞ্চিত শোষিত শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ দেখতে বাধ্য করতে হবে মালিককে। এমনি আরো কত কত আশ্বাসের কথা। কিন্তু বাপ্পাদা! তুমিই বলো, রাজ্যের প্রজারা এই এক যুগ ধরে ক্রমশ কী দেখছে? বলো বলতেই হবে তোমায়, যা দেখছো তা কি এইসব প্রমিসের’ সঙ্গে ঠিকঠাক মিলেছে?…সবাই সমান মর্যাদায় বাঁচতে পারার নমুনা হচ্ছে? নেতাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স এতো বেশী বেড়ে যাচ্ছে যে, আর দেশের ব্যাঙ্কে কুলোচ্ছে না। তাই বিদেশী ব্যাঙ্কের শরণ নিতে হচ্ছে অনেক লুকোচুরির কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু পরীক্ষার্থীরা? যে তিমিরে সেই তিমিরেই। তবে যারা নেতাদের হাত শক্ত করবার কাজে লাগবে, তাদের কথা আলাদা। তারা ক্ষমতা আর অর্থের অহঙ্কারে রাজ্যে ‘জগাই মাধাইয়ের ভূমিকা নিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা যত খারাপ কাজই করে চলুক, কোনো শাস্তি নেই। পুলিশ পর্যন্ত তাদের ভয় পায়। কারণ তারা নেতাদের ছাতার তলায় আছে। আর পুলিশ? তারাও তো—
কথার মাঝখানে বাপ্পা তার ভারী ভারী গম্ভীর গলাতেও একটু ব্যঙ্গের ছুরির ধার মিশিয়ে বলে ওঠে, শুনলাম তো এতোদিন পড়াশুনো নিয়েই ছিলে। ডাক্তারি পাশ করেও বেরিয়েছো। তো বাংলা খবরের কাগজগুলো এতো মুখস্থ করবার সময় পেয়েছো কখন?
বাপ্পাদা!
পাপিয়া আহতভাবে বলে, তোমার কাছ থেকে অন্তত এরকম কথা শোনবার আশা করিনি। এসব অভিযোগ শুধু ‘খবরের কাগজের’? তোমাদের নিজেদের দৃষ্টিশক্তি বিচারবুদ্ধি কিছুই নেই? নাকি তোমাদের সেই ‘ব্রেন ওয়াশের’ পদ্ধতির ফল? না হলে এমন চোখ বুজে ‘হরিনাম’ করে চলার অভ্যাস জন্মায়?…তোমার ওপর বরাবর—
পাপিয়া হঠাৎ থেমে যায়।
তারপর গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলে, দেখতে পাও না দেশে এ রাজ্যে নিরক্ষরতার সংখ্যাই বাড়বৃদ্ধির পথে। নতুন নতুন কলকারখানা খোলা তো দূরের কথা, গাদা-গাদা কারখানা লকআউট হয়ে পড়ে থাকার ফলে বহু শ্রমিকদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! অভাবে অনাহারে আত্মহত্যা করছে। আর নেতারা কোটিপতি শিল্পপতিদের সঙ্গে, মানে যাদের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে গরীবের জুতো বানানোর স্লোগান দেওয়া হতো, তাদের সঙ্গে পাঁচতারা হোটেলে লাঞ্চ খাচ্ছেন, ডিনার খাচ্ছেন আর কনটেসা গাড়ি চড়ে বেড়াচ্ছেন। এগুলোর কিছুই চোখে পড়ে না তোমাদের বাপ্পাদা? চোখে পড়ে না নেতাদের বিলাসিতার আর আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা? তোমাদের সেই আগেকার নেতারা ভাবতে পারতেন, এতো বিলাসিতা, এতো আড়ম্বরের কথা? ভাবতে পারতেন, নেতারা এমনভাবে গুছিয়ে নেবেন, যাতে সাত প্রজন্ম বসে খেতে পারবে! নেতাদের আত্মীয়জনেরা রাতারাতি লাখপতি কোটিপতি হয়ে যাবে! আর—রাজ্যের মানুষদের সত্যিকার ভালো করবার চিন্তা না করে শুধু ‘পাইয়ে’ দেওয়া আর ‘খাইয়ে’ দেওয়ার পথে, দলে টেনে রাখার পথটাই শ্রেয় হবে! এসবই খবরের কাগজের কথা মুখস্থ করা? নিজেদের মধ্যে কোনো চিন্তাভাবনা থাকে না কারুর? বাপ্পাদা! তোমরা আরামকে হারাম করে, আপনজনেদের সঙ্গে মায়ামমতা ভালোবাসার সম্পর্ক ছিন্ন করে কোন্ লক্ষ্যে পৌঁছতে যাচ্ছো, তোমরাই জানো! তোমাদের নেতা কর্তারা তো বেশ স্ত্রীপুত্র পরিবার শালা-শালী নাতি-নাতনী নিয়ে জমজমাটি সংসার করতে অস্বস্তি পাচ্ছেন না! এঁদের সম্পর্কে তোমাদের এখনো মোহভঙ্গ হয়নি বাপ্পাদা?
বাপ্পা প্রশ্নকারিণীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। হঠাৎ এই মেয়েটা এতো সাহসী হয়ে উঠল কখন? এতো সাহস যে বাপ্পাকে এ হেন প্রশ্ন করে বসে? আর কেউ হলে অবশ্যই বাপ্পা একটা তাচ্ছিল্যসূচক কড়া উত্তরে তাকে নস্যাৎ করে দিত। কিন্তু এখন ঠিক তেমনটা ইচ্ছে হলো না। দীর্ঘদিন পরে একটা আত্মীয় সম্পর্কিত মেয়েকে দেখেই কী কঠোর চিত্ত আদর্শবাদীর এই কোমলতাটুকু? তাছাড়া—শুধুই তো আত্মীয় ঘরের একটা মেয়ে মাত্র নয়। বিদূষী মেয়ে এবং ফুলের মতো দেখতে মেয়ে। পাপিয়াকে দেখলে বোঝবার উপায় নেই, ও এতোটা পথ পার হয়ে এসেছে। মনে হয় সবে স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছে বুঝি।
বাপ্পা তাই শুধু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, ওইসব ফালতু কথা রেখে অন্য কথা বলবার থাকে তো বলো।
অন্য কথা?
হ্যাঁ। তোমার নিজের কথাই বলো না। কী রকম কাজকর্ম করলে—কোথায় কী রকম লোকজন দেখলে—
কী রকম কাজকর্ম করলাম।
পাপিয়া একটু হেসে বলে ওঠে, সর্বত্রই তো একই ইতিহাস বাপ্পাদা! ‘দোয়াত আছে কালি নাই।’
মানে?
মানে? মানে স্কুল আছে মাস্টার নেই, হসপিটাল আছে ওষুধ নেই। আউটডোর আছে, পেশেন্ট দেখতে ডাক্তার নেই। অতি দৈন্যদশাগ্রস্ত যে ক-টা বেড আছে হসপিটালে সেখানে জমাদার সাহেবের ফ্যামিলি বাস করেন, উইথ তাঁর পোষা জন্তুজানোয়ার। যেমন, মুরগী ছাগল শুয়োর কাজেই বেড-এ পেশেন্ট নেই। এটা কিন্তু খবরের কাগজ পড়া খবর নয় বাপ্পাদা। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ।
বাপ্পা একটু রেগে গিয়ে বলে, অনেক জায়গায় গ্রাম পঞ্চায়েতে অঞ্চল সমিতিতে এই রকম কতকগুলো বাজে লোক ঢুকে এসে—
রাজ্যের যেখানে যা কিছু কর্মযজ্ঞের ব্যবস্থা রয়েছে সর্বত্রই ওইরকম বাজে ভিড় বাপ্পাদা! কাজের পরিবেশ কোথাও নেই। শুনলাম ঝালদা না কোথায় যেন অঞ্চল প্রধানের বিরাট সম্পত্তি, বাড়ি-বাগান, তাছাড়া কিছু ব্যাবসাপত্র। এখানেও বেশ কিছু রয়েছে আর গ্রামের জন্যে বরাদ্দ ডিপ টিউবওয়েলটি তাঁর বাড়িতেই বসানো হয়েছে।
বাপ্পা রীতিমতো অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। এই মেয়েটা কী আর কোনো কথা বলবে না? বাপ্পাকে অ্যাটাক করতেই এসেছে? তারকটাই বা এতো দেরি করছে কেন? তৃতীয় ব্যক্তি থাকলে আলাপ-আলোচনার অনেক সুবিধে হয়।
হঠাৎ আঘাত দেওয়ার মনোভঙ্গীতে ব্যঙ্গে বলে ওঠে বাপ্পা, অনেকের এমন অভ্যাস আছে, যারা ভালো কিছু দেখতে পায় না, শুধু খারাপগুলোই দেখতে পায়।
কিন্তু পাপিয়া?
মোটেই আহতের ভঙ্গি নেই তার। এই তীব্র মন্তব্যের পর হেসে বলে ওঠে, ওঃ। বলছো ‘মক্ষিকারণমিচ্ছক্তি’! তাই হবে হয়তো! আচ্ছা বাপ্পাদা, একটা অন্য কথাই জিগ্যেস করি-একবারও তো কই তুমি তোমার বাড়ির খবর জানতে চাইলে না?
বাপ্পা চেষ্টা করেই হয়তো নিরাসক্ত গলায় বলে, বাড়ির খবর তো তুমি নিজে থেকেই জানালে।
শুধু ওইটুকু জানালেই হবে? তার বেশী কিছু না? তোমার একটা ছোট ভাই আছে, একটা ছোট বোন আছে, নেহাৎ ভালোমানুষ বুড়োমানুষ দাদু-দিদা আছেন, যাঁরা রাতদিন তোমার জন্যে চোখের জল ফেলছেন, তাঁদের কথা একটুও জানতে ইচ্ছে হলো না?
এতো বেশী ইচ্ছের অধীন হলে জীবনে কোনো কাজ করা যায় না।
ঠিক। খুব ঠিক। কিন্তু সেই ‘কাজটা সঠিক কিনা সেটা তো একটু ভেবে দেখা উচিত। মানবসেবাব্রত নাও, খুব ভালো। দুঃখী গরীব নিরুপায় নিরাশ্রয়দের জন্যে কাজ করো, নিশ্চয়ই সেটা মহৎ ব্রত। কিন্তু তুমি যে পথ বেছে এগিয়েছিলে, সেই প্রথমটাই যে কাঁটাবনে গিয়ে হারিয়ে থেছে বাপ্পাদা। এই যে এতোদিন ধরে তোমরা যাদের নিয়ে কাজ করলে, তাদের চিরকালীন সরল গ্রাম্য মনের মধ্যে দুর্নীতির শিক্ষা আর ঔদ্ধত্যের শিক্ষা ছাড়া আর কী শিক্ষা দিতে পেরেছো? আবারও এখন নিজের জীবন ক্ষয় করে এই ‘বন্য’দের-শিক্ষা দিতে এসেছো! বেশ আছে এরা নিজেদের কুসংস্কার সুসংস্কার, ভালোমন্দ, গাঁও বুড়োর উপদেশ আর. জড়িবুটির বিশ্বাস নিয়ে। ওদের এই চিরকালীন সন্তোষের মনটা, এমনকি ভালোবাসার মনটাও কেড়ে নিয়ে কী দিতে পারবে? কোন সত্য বিশ্বাস মানুষ ক্রমশই ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছে। আর তোমাদের মতনরা? ভাবছে ‘ভালোবাসা’ জিনিসটা স্রেফ একটা দুর্বলতা। ওটাকে জীবন থেকে নির্বাসন দাও। কিন্তু জীবন তো একটাই বাপ্পাদা। সেই ভালোবাসাশূন্য জীবনটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া কী সহজ?
বাপ্পাদের সাধনার মূলমন্ত্রটিই তো ছিলো স্নেহ-প্রেম-মমতা-মাধুর্য চিরন্তন সংস্কার চিরকালীন মূল্যবোধ আর ঈশ্বর-বিশ্বাস নামক বোকাটে জিনিসটাকে জীবন থেকে নির্বাসন দিয়ে সৈনিকের জীবন!
বাপ্পা সেই মূলমন্ত্রটিই হয়তো এখনো আঁকড়ে ধরে আছে, চোখের সামনে অনেক পটপরিবর্তন দেখেও! হয়তো সে পরিবর্তন তাকেও নাড়া দিয়েছিলো। তাই অন্যত্র সরে এসে আবার নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আত্মনিয়োগ করতে চাইছে।
হাজার হাজার মাইল দূর থেকে চলে আসা ধর্মযাজকরাও তো আপন অভ্যস্ত সভ্য জীবনযাত্রার আকাশ-পাতাল জীবনে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলেন আপন ধমৰ্মত প্রচারকল্পে।
কিন্তু ‘ধর্মমত’ আর ‘রাজনৈতিক মত’ এ দুটোয় তফাৎ আছে বৈকি! একটা মত প্রচার করে থাকে সহিষ্ণুতার শিক্ষা, আর অপরটায় থাকে অসহিষ্ণুতার দীক্ষা।
বাপ্পা তো সেই দীক্ষাতেই দীক্ষিত।
বাপ্পাও তো ছেলেবেলায় কত সুন্দর ভালোবাসা-ভরা প্রাণ ছেলে ছিলো। সেই মমতা ভালোবাসার ফলশ্রুতিতেই তো ‘তারক’ নামের ছেলেটা চিরদিনের মতো নিজেকে ‘বড়বাবুর’ কাছে বিকিয়ে দিয়ে রেখেছে।
তা শুধু—এইখানটাতেই বোধহয় বাপ্পার ‘দীক্ষা জনিত শিক্ষাটা তেমন কাজে লাগেনি তা ব্যতীত আর সব ক্ষেত্রেই বাপ্পা সেই দীক্ষাকে কাজে লাগিয়েছে।
বাপ্পা তালে আর কতক্ষণ পিসির বাড়ির ওই মেয়েটার বাচালতা সহ্য করবে?
বাপ্পা অতএব শক্ত গলায় বলে ওঠে, আচ্ছা তোমার সঙ্গে তো আমার এমন কিছু চেনাজানা নেই, হঠাৎ আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে বসার কী দরকার পড়ল?
গলাটা শক্তই, তবে কথাগুলো বাপ্পার পক্ষে যতটা সম্ভব মোলায়েমই করেছে বলতে হবে।
এ প্রশ্নে পাপিয়া হঠাৎ খুব শান্ত আর স্থির হয়ে গেল। এবং প্রশ্নকারীর চোখের দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলল, যদি বলি ‘আছে দরকার’!
সর্বনাশ। এ আবার কী কথা!
না না। এসব বলতে দেওয়া চলে না। বাপ্পা প্রায় ছটফটিয়ে ওঠে। আর সেই ছটফটে গলায় বলে ওঠে, না না! যতোসব অ্যাবসার্ড কথা! আমার ব্যাপারে কারো কোনো দরকার থাকতে পারে না। আশ্চর্য! কোনো মানে হয় না।
তা আশ্চর্যই বৈকি। কোনো মানে না হবারই কথা। পাপিয়া এই হঠাৎ দেখা হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত নিজেই কি জানতো ওই দীর্ণশীর্ণ রং জ্বলে-যাওয়া রুক্ষ শুকনো চেহারার লোকটাকে নিয়ে মাথাব্যথার’ দরকার আছে তাঁর? অথচ দেখে পর্যন্তই ভিতর থেকে উথলে উঠছে সেই দরকারটা।
পাপিয়া যেন এখন ভাবতেই পারছে না, একে এখানে এই পরিবেশে আর এই অবস্থায় ফেলে রেখে কালই ফিরে যাওয়া সম্ভব!
হ্যাঁ, ঠিক হয়ে গেছে আগামীকালই। যে দিনটা হাতে থেকে যাচ্ছিল, সেই দিনটাকে কাজে লাগাতে চাইছে, ওই অভিযাত্রী দল। একদিনের জন্যে রাঁচী বেড়িয়ে আসা স্থির করে ফেলেছে ভোটক বিভাস শৌভনিকরা।
নাঃ। পাপিয়া যাবে না। পাপিয়া তো ওদের দলের মধ্যে নেইও। পাপিয়া তো গোপীমোহনের হেফাজতে। পাপিয়া কোনো ছুতো করে বেড়ানোটা অ্যাভয়েড করবে।
কিন্তু তাতেই বা কী? তার পরের দিন?
পাপিয়া নিজের মনের মধ্যেটা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে। পাপিয়া কী এতোদিন ঘুমিয়ে ছিলো?
যোগাযোগও বটে।
তারক ঠিক এই সময়ই জল আনতে গেল। আর গেল তো গেলই।
পাপিয়া যতোই তর্কের জাল বুনে সময়টাকে ঠেলে দেবার চেষ্টা করে চলুক, পাপিয়ার মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে, রক্তস্রোতের মধ্যে বেজে চলেছে ঘুঙুরের ধ্বনি!
তবু সামলে চলছিলো। কিন্তু ওই জোরালো নির্দেশটা! না না, আমার ব্যাপারে কারো কোনো ‘দরকার’ থাকতে পারে না।
.
রাতের আকাশ থেকে ঝড়ে পড়া শিশিরকণারা জমে থাকে গাছের পাতায় পাতায়, ঘাসের আগায় আগায়, ছোটো ছোটো মুক্তোবিন্দুর মতো, সকালে রোদের তাপে শুকিয়ে ওঠার আগেই হঠাৎ কোনো সময় একটা হাওয়ার ধাক্কায় ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে।
ঝরে পড়ল পাতার কানায় কানায় জমে থাকা সেই শিশিরকণারা।
‘রোদের তাপের’ চেষ্টাতেই এতোক্ষণ চালিয়ে চলেছিলো লড়াকুর ভূমিকা!
সব গুবলেট হয়ে গেল!
আর ভয়ানকভাবে অপ্রস্তুত হয়ে গেল দুজনেই। যার গালের ওপর ঝরে পড়ল সেই মুক্তোবিন্দু ক’টি, সে তো হবেই। কিন্তু তার দর্শকটি? সেও বোধকরি তার থেকেও বেশী। তবু মান বজায় রাখার ব্যর্থ চেষ্টাটা করতে হবে বৈকি। তাই মুখটাকে হঠাৎ অন্যদিকে ফেরায় পাপিয়া!
আর সেই শিশিরবিন্দুগুলো ঝরে পড়ার দর্শকটি? সেও ভয়ানকভাবে বিচলিত হওয়া অবস্থাকে সামাল দিতে চট করে দাঁড়িয়ে উঠে কুঁড়েঘরের ‘দরজা’ নামক জায়গাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে, ‘তারকটা করছে কী? কত দেরি করছে!’
তা ভয়ঙ্কর মুহূর্তটাকে সামাল দেওয়া গিয়েছিলো।
দুজনেরই মনোবলটা যথেষ্ট বেশী বলতে হবে। তাই তারক এসে দাঁড়াতেই পাপিয়া বলে ওঠে, কী তারকদা, এতো দেরি? আমার তো ভাবনা হচ্ছিল, জল আনতে গিয়ে জলে ডুবে গেলে না কী?
ঘর্মাক্ত তারক মাটির কলসীটাকে সাবধানে ‘বিড়ের’ ওপর বসিয়ে বলে ওঠে, হায়রে কপাল। ডুবে মরার মতো জল থাকলে কী আর মুখ্যু তারটা এতোদিনে সে পথটা নিয়ে রেহাই পাবার চেষ্টা না করতো?…জল না ‘সোনা’। ওই কলসীটুকু ভরতেই হুঁঃ। তো এমন অভাগার মতোন হাল যে, আপনাকে একটু চা বানিয়ে খেতে দেবো তারও উপায় নেই। চায়ের মুখ দেখি নাই কতকাল।
পাপিয়া হঠাৎ যেন চমকে যায়।
তার চোখের সামনে যেন একটা অজানা জগতের দরজা খুলে যায়। কেবলমাত্র প্রভুভক্তির শক্তিতে এই নিরক্ষর গ্রাম্য লোকটা এই ক্লেশ বহন করে চলেছে। করে চলেছে এই কৃচ্ছ্রসাধন।
ওর প্রভুও হয়তো তাই। একটা জোরালো শক্তির বশেই শুধু। তার শক্তিটা হচ্ছে আত্মপ্রেমের শক্তি। নিজের কাছে ও নিজের যে ভাবমূর্তিটি গড়ে রেখেছে, তা থেকে বিচ্যুত হবার মনোবল নেই ওর।
.
তৃতীয় ব্যক্তি।
তৃতীয় ব্যক্তিও একটি বিশেষ ব্যাপার। সময় বিশেষে তেমনি পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। আপাতত তৃতীয় ব্যক্তি ওই ‘তারক’, যে নাকি ভৃত্যমাত্র, যে এদের ত্রাণ করল।
কীভাবে যেন এই প্রায়ান্ধকার কুঁড়ে ঘরটার মধ্যে যে অভাবিত ভয়ের ভার জমাট হয়ে উঠেছিল, সেই ভারটা কোথায় উড়ে গেল।
এদের মনে হলো, ঘরটা হঠাৎ আলোয় আলো হয়ে গেছে।
কলসীটা নামিয়ে রাখার পর তারক তার পিঠে ফেলা গামছার কোণে বেঁধে আনা দুটো ডিম গিঁট খুলে বার করে নামিয়ে বলে উঠল, এই হাভাতে গাঁয়ে তো আর একটা মিষ্টিও জুটবে না। তো না করতে পাবেন না পাপিয়াদি, এই ডিম দুটো সেদ্ধ করছি, আপনাকে খেতে হবে।
আকাশ থেকে পড়ার মতো কথা।
এখন এই ডিম দুটো খেতে হবে? কী যা তা বলছো তারকদা? পাগল না কী?
তারক আত্মস্থভাবে এককোণে সরে গিয়ে দু’চারটে কাঠিকুটি জ্বেলে ফেলতে ফেলতে গম্ভীর গলায় বলে, না খেলে তারক মনে খুব বেদনা পাবে।
কী মুস্কিল! এই ভরদুপুরে—
ওইটুকুনই সাহস তারকের। তেমন সাহস থাকলে বলতো, দুটো ভাত খেতে হবে এই সঙ্গে। তো সে সাহস নাই!
পাপিয়া হঠাৎ বেশ কৌতুক অনুভব করে তারকের ভাবভঙ্গিতে। তাই হালকা গলায় বলে ওঠে, তা তাতেই বা এতো সাহসের অভাব কেন?
তারক উনুনে জ্বালটা ঠেলে দিয়ে তার প্রভুর দিকে একটি দৃষ্টি হেনে বলে, পরে গঞ্জনা খাওয়ার ভয়ে। নির্ঘাৎ শুনতে হবে, ওই মোটা মোটা লাল চালের ভাত তুই কুটুমবাড়ির মেয়ের সামনে বার করলি কোন্ লজ্জায়? তার মানে হাটে হাঁড়িভাঙা তো! কী খেয়ে উনি দিনযাপন করছেন, একজনা তার সাক্ষী হয়ে যাবে তো!
তারক, তোর কথাবার্তা আজকাল খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এতোই যদি সব খারাপ তো · যা না বাবা ওই কুটুমবাড়ির মেয়ের সঙ্গে। আমি ঠিক চালিয়ে নিতে পারবো।
তা আর পারবে না কেন? ওই ভূতগুলোর ঘরে আশ্রয় নিতে যাবে। তবে বেশীদিন ওদের সাথে মিশলে নিয্যস ‘হাঁড়িয়া’ ধরবে তুমি। ওদের মতন হতে হবে তো! এই নিন, ধরেন।
একটা কাঁচা শালপাতার ওপর ধরে দেয় ডিম সেদ্ধ দুটো। পাশে শুধু একটু নুন।
তারক আর একবার বলে, মরিচগুঁড়ো ব্যতীত ডিম সেদ্ধ খেয়েছেন কখনো? দেখুন! তার আবার শালপাতে।
দেখেছি। কিন্তু দুটো? অসম্ভব। একটা তোমার জন্যে রাখো।
দুটো আবার এতো কী বেশী?
খুব বেশী। তোলো একটা।
ঠিক আছে। তো রাখারাখিতে কাজ নাই। বলে তারক আর একটু পাতা ছিঁড়ে একটা ডিমকেই খুন্তির কোণ দিয়ে দু ভাগ করে একটা বাপ্পার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, খেয়ে নাও। রাখলেই তো পিঁপড়ে
ভীষণ অস্বস্তিবোধ করে বাপ্পা। বলে, আঃ। আমায় আবার কী? তুই খা না!
হঠাৎ তারককে খুব হিংসে করতে ইচ্ছে করে পাপিয়ার।
একা খাবে তারক?
আঃ। কী এক জিনিস! তোর যতো—
ঠিক আছে, তারকও খাবে না। পিঁপড়েরাই খাক।
বাপ্পা অগত্যা পাতাটা হাতে তুলে নিয়ে বোধহয় লজ্জা অস্বস্তি কাটাতেই বলে, দেখছো তো পাপিয়া, কী সাংঘাতিক জব্দর মধ্যে থাকতে হয় আমার। সত্যি সত্যিই তুমি ওটাকে নিয়ে যাও।
পাপিয়া! আর একবার সেই অনুভূতি! দেহমন সব কিছুর মধ্যে একটা উত্তাল প্রবাহ। তা হোক। তবু মান বজায় রেখেই চলতে হবে।
কী তারকদা? যাবে না কি?
গেলে আপনার সঙ্গ ধরতে হবে না কি? যেদিন ইচ্ছা জাগবে, যেদিকে চক্ষু যায় চলে যাবে তারক।
তোর ওই ‘ইচ্ছেটা’ জাগলে আমি বাঁচি।
হ্যাঁ। তাহলে সাপের পাঁচ পা দেখার সুবিধে হয়। হাড় ক’খানা আছে এখনো, সে ক’খানাও যাবে, এই আর কী!
ও তারকদা, তোমার মায়ের খবর কী?
মায়ের খবর? অতি উত্তম। বড়মানুষ নেতার বাড়িতে চাকরি। গিন্নীর নেকনজরে পড়ে গিয়ে মনি বাড়ির ভাঁড়ারে গিন্নীর হয়ে বসে তোয়াজেই আছে। মায়ের তুকতাকে কর্তা ভোটে জিতেছে, তাই মায়ের খুব খাতির।
তুকতাক!
ওই হলো আর কী, দৈব ওষুধ। মাদুলী! তো উনিও পার্টি করে। তবে বড়দাবাবুর মতন তো অবোধ না। বিচক্ষণ বেক্তি। দুধও খায়, তামাকও খায়। মা বড় গাছেই নৌকো বেঁধেছে। আর এই তারককে সংসারী করবার আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে, দেশের জমিজমাটুকুন জ্যাঠার কাছে বেচে, তারকের হিস্যেটা বুঝিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কেঁদেকেটে বলে গেছে, ‘তারক রে—মরে গেলে যেন তোর হাতের আগুনটুকুন পাই।’
তারকের বলার ভঙ্গিতে এরা হেসে ওঠে।
আর তারকের প্রভু পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, এই রোদের মধ্যে যেতে তোমার খুব কষ্ট হবে।
পাপিয়া। তোমার কী মনে হচ্ছে? বরফ গলতে শুরু করেছে? নাকি করুণা? ভিক্ষুককে একমুষ্টি ভিক্ষা দেওয়া?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন