আশাপূর্ণা দেবী
টাইটা খুলতে খুলতেই অরিন্দম বলে উঠলো, ‘ব্রাদার’ বেশ চালু হয়ে গেছেন মনে হচ্ছে।
রিঙ্কু এতোক্ষণ কেমন গুম হয়ে বসেছিল। যুধাজিৎ যেন ওকে একটা থাপ্পড় বসিয়ে গেছে। ভাই বাড়ি করছে, বাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া মায়ের আবার বাস্তুভিটে হচ্ছে, এটা তো আহ্লাদেরই কথা।…কিন্তু অনাহ্লাদের কারণ মা, ভাই দু’জনায় যেন রিঙ্কুকে বহিরাগতজনের কোঠায় ফেলে নেমন্তন্নে ডাকছে। এটা অবমাননার।
ভিতপুজো থেকে প্ল্যান বানানোটি পর্যন্ত সব-এর মধ্যেই তো রিঙ্কুর উপস্থিতির অধিকার থাকবার কথা। এটা কী হলো? বরের কাছে মুখ থাকলো, না মান থাকলো? থাকলো না। তাই রিঙ্কুকেই বরের শিবিরেই চলে যেতে হলো। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠতে হলো, তাই দেখছি। হঠাৎ ছাপ্পর ফুঁড়ে একখানা বাড়ি নেমে এলো বাবুর হাতে। শুধু বাড়ি নয়, তার সঙ্গে গাড়িও।
অরিন্দমের প্রথম বাক্যটিতেই শ্লেষ ছিল। এখন আবার তাতে ঝাঁজ যুক্ত হলো। বললো, বোঝা যাচ্ছে ‘বাঁ-হাতের’ কারবারটি ভালোই চলছে।
ওর আবার ডান বাঁ কী?…রিঙ্কুর কণ্ঠেও ঝাঁজ। ও কী চাকরি করে? বলে বলো যে ‘দু’হাতে লুঠছে।
তা তাই মনে হলো। গলার স্বরই পাল্টে গেছে যেন, বাবুর ফোনেই বোঝা গেল দিব্যি চাল্লুশ গলা! উড়ছেন ভালোই।
আশ্চর্য! আজকেই তোমার অফিসে যতো কাজ পড়লো। তুমি থাকলে ঠিক ধরে ফেলতে কোন্ সূত্রে এমন রাতারাতি বড়লোক হয়ে উঠলো তোমার শালা।
অরিন্দম ধড়াচূড়া ছেড়ে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে গুছিয়ে বেতের সোফাটায় বসে পড়ে বললো, এর আবার সূত্র। এ যুগে এখন এ শহরের হাওয়ায় বাতাসে টাকা ওড়াউড়ি করছে, বাগিয়ে ধরে ফেলতে পারলেই হলো।
রিঙ্কু এখন আবার অন্য শিবিরে, অথবা নিজস্ব একক শিবিরে চলে এলো। বললো, তা এতোই যদি জানো তো, সেই ওড়াউড়ির দিকে তাক করছো না কেন? সেই মাসমাইনের ভরসাটিকেই আঁকড়ে বসে থেকে জাবর কেটে চলেছো কেন?
অরিন্দম বললো, এ হাড়ে আর কিছু হবে না। অফিসে যদি কোন পার্টি এক প্যাকেট সিগারেট উপহার দিতে আসে, রিফিউজ করতে হয়, বুঝলে?
রিঙ্কু তার বরের এই মহিমা ভালোই জানে! তবে রিঙ্কু একে “মহত্ত্ব’ বলে গণ্য করে না। বলে ‘ভীরুতা’! ‘কাপুরুষতা’! ‘সাহসের অভাব’! তাই রেগে রেগে বলে উঠলো, তোমার আবার বেশী বেশী! এক প্যাকেট সিগারেট উপহার নেওয়াও কী ঘুষ খাওয়া।
অফিসশাস্ত্রে তাই বলে! কে বলতে পারে ওই সিগারেটের প্যাকেটটি ‘জালপাতা যন্ত্ৰ’ কিনা! ওই থেকেই অফিসারদের অনেস্টির পরীক্ষা হয়ে থাকে কিনা। ও রিস্কের মধ্যে যেতে আছে?
রাতদিন মৌখিক ঝগড়া চালালেও—পতিপ্রেমে অন্ধ রিঙ্কু অর্থাৎ শুভশ্রী বলে উঠতে পারলো না, ‘ও! তাহলে ‘রিস্কের’ ভয়েই তোমাদের ‘অনেস্টি’? সত্যিকার সততাবোধে নয়!’…. বলতে পারতো, বলবার স্কোপ ছিল। কিন্তু অন্য সকলের ব্যাপারে শুভশ্রী যতোই কেননা চড়াৎ করে মুখের মতো জবাব দিয়ে বসতে পারে, বরের ব্যাপারে ততোটা নয়। বরের ব্যাপারে সত্যিই একটু অন্ধপ্রেম আছে তার। যা সচরাচর ঘরসংসারী মহিলাকুলের মধ্যে দেখা যায় না। বরের কাছে মা-ভাইয়ের সমালোচনাতেও তৎপর শুভশ্রী।
তবে এক্ষেত্রে ‘যুগলমিলন’ বা দু’জনার মধ্যে আঁতাতের আর একটি কার্যকারণ সম্পর্কও আছে। অরিন্দম ও তার নিজের পরিবার অর্থাৎ দাদা-বৌদি, ভাই-ভাইবৌদের সম্পর্কে আদৌ স্পর্শকাতর নয়। শুভশ্রী যখন তাদের কথা উঠলে, তাদেরকে কচুকাটা করে ছাড়ে, অরিন্দম গায়ে মাখে না। কখনো বা বলে, দুনিয়াটা দেখে যাও মিসেস! মাথা গরম করে নয়, কৌতুকের চক্ষে!
তো এখনও সে তার শালার নৈতিক অধঃপতনের প্রমাণ পেয়েও তেমন ঘৃণা বা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখলো না তাকে, বেশ মেজাজি কৌতুকের দৃষ্টিতেই দেখলো। অর্থাৎ আসলে সে ওই নীতি-দুর্নীতি সম্পর্কে খুব বেশী সিরিয়াস নয়। যে যা করছে করুকগে! আমার কী? আমি বাবা কোনো রিস্ক-টিক্স নিতে চাই না। গা বাঁচিয়ে চলে স্বস্তিতে থাকতে চাই। ব্যস।
অতএব চা খেতে খেতে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গলা খুলে গল্প শুরু করে দিল। এইবার তাহলে তোমরা মায়ের সঙ্গে মার্কেটিঙে বেরিয়ে পড়ো, নেমন্তন্ন যাবার পোশাক কিনতে। হুঁ-হুঁ বাবা, নতুন বাড়িতে নতুন পোশাক চাই। নইলে ‘ছোটমামা’ হয়তো ঢুকতেই দেবে না।
বিলটু আর মিলটু একযোগে বলে ওঠে, য্যাঃ
জিগ্যেস কর তোদের মাকে! মা এখনি মনে মনে সকলের নতুন পোশাকের রং গড়ন কায়দাকরণ আর বাজেটের হিসেব কষতে বসে গেছে কিনা।
মেয়ে পল্লবিনী অপভ্রংশে পলি, ভাইদের থেকে বড়, বর্তমানে ক্লাস নাইনের ছাত্রী, বলে ওঠে, আচ্ছা বাপী, সবসময় তুমি মাকে এতো ঠাট্টা করো কেন বলো তো?
বাপী দরাজ গলায় হেসে ওঠে, ঠাট্টার সম্পর্ক বলে।
বাঃ। মা’র সঙ্গে তোমার ঠাট্টার সম্পর্ক?
নয়? ভেবে দ্যাখ জগতের সেরা ঠাট্টার সম্পর্কটি কী? শালা, সম্বন্ধী, বড়কুটুম্ব, ব্রাদার-ইন-ল। আরো কতো আদরের নাম তার। তো তারই বোন তো? তবে?
শুভশ্রী নিজের চা-টা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে এসে বলে, কী নিয়ে এতো হাসাহাসি?
অরিন্দম মেয়ের সঙ্গে চোখে চোখে ইশারায় নিরীহ ভাব ফুটিয়ে বলে, তেমন কিছু না। বলছিলাম তোদের ছোটমামার হঠাৎ একখানা লম্বা ল্যাজ গজিয়ে গেছে। হা হা হা!
দরাজ হাসি, তবু কোথায় যেন প্রচ্ছন্ন রয়েছে ঈষৎ ঈর্ষার হুল।
.
তা যুধাজিতের বন্ধুর মনের মধ্যেও কী তেমন একটু ঈর্ষা ঈর্ষা ভাব প্রচ্ছন্ন নেই? যখন করজোড়ে বিনীত আবেদনে শিলাদিত্যর বাড়িতে এসে তাদের ‘বাড়িসুদ্ধ সকলকে’ যুধাজিতের গরীবের কুঁড়েয় প্রথম প্রবেশের শরিক হবার জন্যে নেমন্তন্ন করতে এলো!
এই তো সেদিন, ক’দিনেরই বা কথা, লোকটা কেবল কতকগুলো রংচটা ছালওঠা ভাঙা ঝড়ঝড়ে গাড়ি নিয়ে কারবার চালাচ্ছিল। হঠাৎ এমন অবস্থা ফিরে গেল যে, নতুন পাড়ায় তিনতলা বাড়ি। এবং সে বাড়ির গৃহপ্রবেশ উৎসবে ঢালাও নেমন্তন্ন করে বেড়ানো!
বললো, কী হে! কী ব্যাপার! আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ-ট্রদীপ পেয়ে গেলে না কী?
যুধাজিৎ বললো, বাজে বকিস না। সে জিনিস পেলে কী আর মাটিতে পা দিয়ে হাঁটতাম? দেখতিস শূন্যে ভাসছি। তারপর বললো, মাসিমাকে কিন্তু নিজে বলে যেতে চাই। বাড়ির মধ্যে একটু প্রবেশাধিকার পেতে পারি?
শিলাদিত্য বললো, কথায় খুব চালু হয়েছিস দেখছি। আয়।
নীহারিকা ছেলেটিকে দেখে এবং তার বিনয় বচনে যথেষ্টই মুগ্ধ হলো। আর তারপর তার রাতারাতি সাফল্যের ইতিহাস শুনে ও আরো মোহিত। কিন্তু কী জ্বালা! পদবী কিনা সরকার! দুস!…নীহারিকা অবশ্য অত সব মানামানির ধার ধারে না কিন্তু মাথার ওপর যে কট্টরের ঝাঁক! বরটি তো আছেনই, তাঁর মা-বাপটিকেও তো এসব ক্ষেত্রে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে যদি মেয়ে ভাব-ভালোবাসা করে বসে তো আলাদা কথা!
আচ্ছা, এই ছেলেটা শিলুকে খুঁজতে মাঝে মাঝে আসে না? সেরকম কিছু আঁচ কি মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়? কি জানি। লক্ষ্য রাখতে হবে। এই তো যাচ্ছিই তো ওদের ওখানে, অবিশ্যিই টুসকিকে নিয়ে যেতে হবে; তখন ভাবভঙ্গি দেখতে হবে।
যুধাজিৎ বললো, আচ্ছা মাসিমা, শিলাদিত্যর দাদু-দিদা আছেন না?
নীহারিকা শঙ্কিত হয়। এই সেরেছে, আবার তাঁদের কাছে গিয়েও নেমন্তন্ন জানাবে না কী? তাড়াতাড়ি বললো, হ্যাঁ, আছেন! তিনতলায় থাকেন! মানে খুব বুড়ো তো! সিঁড়ি ওঠানামা করতে পারেন না। ওখানেই ওনাদের সব ব্যবস্থা করা আছে।
খুব বুড়ো হয়ে গেছেন?
তা আর বলতে।
ওঃ। তাহলে আর-
এই সময় মেখলা ট্রের ওপর চা নিয়ে এলো। সঙ্গে এক প্লেট বড়া ভাজা।
নীহারিকা বললো, তোমার রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম এইমাত্র একথালা ভেজে রেখে এসেছো। কিছু হাতিয়ে আনলাম। চায়ের সঙ্গে ‘টা’ হিসেবে।
মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো। যা আশা করছিলাম, তার পূর্বাভাস না কী? হঠাৎ এতো ফ্রী! তবু বলে উঠলো, আচ্ছা, এই বাজে জিনিসটা কী বলে নিয়ে এলি? স্রেফ্ ডালের বড়া।
ততক্ষণে যুধাজিৎ সেই বাজে জিনিসের দুটো মুখে ফেলে আবেশের ভান করে বলে ওঠে, মাসিমা, আপনার রান্নাঘরে সর্বদা এরকম সব বাজে জিনিস মজুত থাকে? তাহলে হয়তো হঠাৎ হঠাৎ সেখানে বর্গির হাঙ্গামা ঘটতে পারে! আঃ, মার্ভেলাস! এই শিলাদিত্য, এইবেলা নিয়ে নে দুটো। এক্ষুনি প্লেট ফর্সা হয়ে যাবে।
শিলাদিত্য বললো, শুনলি তো ‘একথালা’ থেকে যৎসামান্য হাতানো হয়েছে।
ওঃ। তাহলে নির্ভয়ে সব ক-টি ফিনিশ করে ফেলতে পারি? টুসকি দেবী, আপনার হাতানো বিদ্যার জন্য ধন্যবাদ।
নীহারিকা একবার মেয়ের, একবার ছেলের আর একবার ছেলের বন্ধুর দিকে তাকায়। মনে মনে বলে, ব্যাপার তো অনেকখানি এগিয়েই গেছে বলে মনে হচ্ছে। কবে হলো? … আচ্ছা তবে কেন সেদিন টুনির ভাগ্নেটাকে দেখে মেয়ে অমন উথলোনো উথলোনো চোখে তাকাচ্ছিল। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। না কী, আসলে ভেতরে কিছুই না, বয়েসের কারসাজি! একটা এ বয়েসের ছেলে দেখলেই একটা উথলোনো ভাব আসে।…অবশ্য দেখতে শুনতে একটু ভালো হলেই। তা টুনির ভাগ্নের মতো রূপের কান্তি না হলেও, এ ছেলেটার চেহারাও ফ্যালনা নয়।…লম্বা ছাঁদ মুখচোখ তো কুঁদেকাটা, রংটাই যা একটু—তা বেটাছেলের আবার রং।
মনে মনে মুহূর্তেই বোম্বে মেল চলে।…
আবার মনটা দমে যায়। যদি সত্যি তেমন কিছু হয়ও। সেটা হয়তো সমস্যাই ঘটাবে। আশ্চর্য। ছেলেটা ছাই সরকার হতে গেল কেন? ব্যানার্জি মুখার্জি চ্যাটার্জি, এসবের একটা হতে পারলো না!
আর একটু বাক্যব্যয় করে যুধাজিৎ উঠলো। যাবার সময় আবার বললো, মেসোমশাইও যেন নিশ্চয় যান। দাদু-দিদার তাহলে যাওয়া সম্ভব নয়?
শিলাদিত্য বললো, দূর। অসম্ভব। তা তুই এমনভাবে আকুলতা করছিস, যেন তোর বিয়ের ঘটার নেমন্তন্ন!
যুধাজিৎ হেসে উঠলো। বিয়ের ঘটা? বলির পাঁঠা কী নিজে নেমন্তন্ন করে বেড়ায়?….আচ্ছা চলি। শিলাদিত্য, কোথাও বেরোবার আছে না কি? থাকে তো চলে আয় আমার সঙ্গে।
শিলাদিত্য বললো, থাকলেও দু’জনের পথ এক নাও হতে পারে।
ওটা কোনো ব্যাপার নয়। যে কোনো পথকেই নিজের পথ করে নেওয়া যায়।
তা বটে, তেল যখন অফুরন্ত।
যুধাজিৎ হেসে উঠে বলে, নজর দিসনে ভাই, নজর দিসনে। বহুকষ্টে সবে একটু তৈলাক্ত হচ্ছি। আসলে কী জানিস? চিত্ত তো সেই চিরদিনের মধ্যবিত্ত! একা একখানা গাড়ি নিয়ে চলেছি, এটা যেন বড় গায়ে লাগে। মনে হয় অপচয়। বাজে খরচ।
বুঝলাম। তাহলে আর অস্বস্তির কিছু নেই। তুমি বরাবর ওইরকম ‘মধ্যবিত্তই’ থাকো মানিক
উঠে পড়ে গাড়িতে।
.
ক’দিন ধরে তোড়জোড় চলে মা এবং মেয়েতে।
কী ধরনের সাজ করে যাওয়া উচিত! বিয়েবাড়ি নয়, খুব জমকালো কিছু মানাবে না, তাছাড়া সকালবেলার ব্যাপার। সাদামাঠার মধ্যে বেশ রুচিসম্পন্ন কিছু পরা দরকার! শাড়ি, গহনা সবকিছুই। মেয়ের সঙ্গে এক্ষেত্রে যেন সখীত্ব!
তবু নীহারিকা মাঝেমাঝেই মেয়ের দিকে তাকায় আর ভাবে, লাটাইয়ের সুতো ছাড়া উচিত, না এখন থেকেই টাইট দেওয়া উচিত! ও ছেলে পাত্র হিসেবে নীহারিকাদের কাছে যথেষ্ট, কিন্তু সেই জাতপাত। তিনতলার বুড়োবুড়ির কথা ধর্তব্য না করলেও, এই দোতলাতেই যে অকালবৃদ্ধটি রয়েছেন, তাঁর শরীরেও যে সেই পাবনার জমিদারবাড়িরই রক্ত। অকারণ ‘অহমিকা’।
প্রথম দিন শুনেই আদিত্য বলে উঠছিল, ‘বাড়িসুদ্ধ সবাই যাবেন’ বলেছে বলেই হ্যাংলার মতো সত্যি সবাইকে যেতে হবে? মাথা খারাপ। যার বন্ধু সে যাক। ব্যস!
কী আশ্চর্য। অতো করে বলে গেল। তুমি না যাও আমি যাবো! ‘মাসিমা মাসিমা’ করে কীভাবে বললো যদি শুনতে।
‘মাসিমা মাসিমা’। তবে আর কী, তুমি অমনি গলে গেলে। প্রেস্টিজ জ্ঞান বলে যদি কিছু থাকে! ঠিক আছে, তুমিও যেও তাহলে ছেলের সঙ্গে নতুন গজানো বোনপোর বাড়ি। ঠিক এইরকম ক্ষেত্রে ঝগড়া বিদ্রোহের ক্ষমতা আসে না। এখানে নিজের দিকের বাটখারাটা নেহাৎই হালকা। তাই নীহারিকা মেয়ের নাম মুখে না এনে বলে ওঠে, তোমারই বা গেলে কী হয়? রবিবার পড়ছে তো।
আমার? আমি যাবো? মাথা-ফাতা খারাপ হয়ে গেল না কী? বাজে বোকো না।
এই মহামুহূর্তে নীহারিকা কিছুতেই আর টুসকির কথা তুলতে সাহস পায় না। ভাবে, দেখা যাক কীভাবে ম্যানেজ করা যায়। আসলে বেশীর ভাগ সময়ই তো লোকটাকে ‘থো’ করে নীহারিকা জিতে যায়। কিন্তু এক একটা জায়গায় যেন তার অস্ত্রশস্ত্র হারিয়ে যায়। সেটা যায়, যখন লোকটার মধ্যে সেই পাবনার জমিদারবংশের রক্তধারার প্রবাহধ্বনি শুনতে পায় নীহারিকা
কিন্তু শুধু নিজে ছেলের সঙ্গে যাবো কোন মুখে? টুসকিটাকেই যদি সঙ্গে না নিতে পারলাম। ভাবতে থাকে। এক কাজ করলে হয়, শিলাদিত্যকে দিয়ে যদি বাপের কাছে আর্জি করানো যায়। যদি বলানো যায় সবাই না গেলে বড্ড বেশী আহত হবে। এমনকি ‘দাদু-দিদা’র পর্যন্ত খোঁজ করেছে! নিদেনপক্ষে টুসকিটাও চলুক মা’র সঙ্গে।
শুনে শিলাদিত্য বললো, সেরেছে। আমায় বাঘের খাঁচার মধ্যে ভরে দিতে চাও?
আহা! বড় তো ভয় করিস!
সেটা তুমিও করো না জননী। কিন্তু এক এক জায়গায়—ও বাবা! যেখানে তুমি পশ্চাদপসরণ করছো, সেখানে আমি? অভিযানে বোঝাই যাচ্ছে টুসকি বাদ!
মা বিমনাভাবে বলে, মেয়েটা ক’দিন ধরে আহ্লাদ করছে। বলছে, ‘গৃহপ্রবেশের’ উৎসবটা যে কী জিনিস, দেখিনি বাবা কখনো। বেশ দেখা হবে।।
এর বেশী আর কী বলা যায়?
যেটা বলা হলো না, সেটা অবশ্য বুঝে ফেলে ছেলে। বলে, বুঝলাম তো—কিন্তু—
কিন্তু ভাগ্যবানের বোঝা বোধহয় এ যাত্রা ভগবানই বইলেন!
একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো। ঠিক সামনের ওই রবিবারটায় আদিত্যরও হঠাৎ একটা নেমন্তন্ন জুটে গেল। অফিসের এক সহকর্মীর ছেলের পৈতে, যেতেই হবে। ভদ্রলোক অফিসসুদ্ধ সক্কলকে ডেকেছেন এবং যাতায়াতের সুবিধার জন্য একখানা প্রাইভেট বাসকে ভাড়া করে মজুত রাখছেন।…
পরপর তিন মেয়ের কোলে এই ছেলে। তাই তার পৈতেয় রীতিমতো সমারোহর ব্যবস্থা।
যেতে হবে কোথায়? না চন্দননগরে। তার মানে সারাদিনের মতো।
অতএব বাড়ির কর্তা আর টের পাচ্ছেন না, সংসার সদস্যদের মধ্যে কে কে ওই গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্নয় গেল। এরাই তো আগে ফিরবে। আদিত্য অবশ্যই পরে।
মনের মধ্যে হাঁফফেলা ভাব। তবু নীহারিকা কথা বাড়িয়ে ব্যাপারটা আরো সহজ করতে চেষ্টা করে। বলে, সব্বাইয়েরই কোনো না কোনো কারণে বাড়িতে সমারোহর আয়োজন হয়। এই একটি বাড়িতেই শুধু তার ব্যতিক্রম।
আদিত্য বলে, ছেলেদের পৈতে দেবার অধিকার থাকলে পাবনার সত্যব্রত গাঙ্গুলী কি সে ব্যবস্থা না করে ছাড়তেন? এখন ছেলেমেয়ের বিয়ে ছাড়া—
হুঁ। বিয়ে। প্রথম নম্বরেরটিই তো চোখে সর্ষেফুল দেখাচ্ছেন। দু নম্বরেরটি তো এখনো পড়ুয়া। আর মেয়ের বিয়ে! সে কবে হবে তা জানি না। মেয়েকে খাঁচায় পুরে রাখবার ইচ্ছেটি ছাড়া আর কোনো ইচ্ছে তো দেখি না।
আদিত্য ব্যঙ্গের গলায় বলে, তোমার মেয়ে খাঁচায় পোরা আছে? বাঃ। বেড়ে!
নেই সে তুমি সেভাবে পেরে ওঠোনি বলে। তবে আজকালকার মেয়েরা যে কী করে বেড়ায় আর না বেড়ায় তা তোমার ধারণাও নেই।
আদিত্য আর কথা বাড়ায় না। উঠে যায়। শুধু বলে যায়, তোমার তো আছে, তাতেই তোমার মেয়ের কাজ চলে যাবে।
আশ্চর্য। এ সংসারে প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের প্রতিপক্ষ। কিন্তু তিনতলার বাসিন্দা ওই বুড়োবুড়িরা? গোছানো কথায় বলতে গেলে বলা যায়, যেন ‘একে অপরের পরিপূরক’। কিসে কী হয়?
যাক, তখনকার মতো যবনিকা।
.
অতঃপর সেই ‘সামনের রবিবার’ দিন আদিত্য সক্কালবেলাই বেরিয়ে পড়ে। কারণ বেলা আটটার সময়, বন্ধুর সেই ভাঙাচরা বাসটি অফিসের সামনে অপেক্ষা করবে। ওখান থেকেই সবাই একযোগে যাত্ৰা।
আদিত্য বেরিয়ে যেতেই নীহারিকা ছেলের দিকে তাকিয়ে একটু বিজয়গৌরবের হাসি হেসে বলে, শিলু, দেখলি?
কী দেখলাম?
যা দেখলি, তা আর বলে বোঝাতে হবে কেন? চোখেই তো তা দেখলি। এ হচ্ছে আমার ইচ্ছাশক্তির জোর, বুঝলে বাপ! ভাগ্যক্রমে এই সময় ‘বড়দাবাবু মেদিনীপুরে গ্যাছে’ বলে নিজে ক’দিন ছুটি নিয়ে দেশে গেছে, তাই নিশ্চিন্দি। নইলে—ওটা যা ধুরন্ধর। ওর চোখে ধুলো দেওয়া খুব শক্ত। তিনতলা ওলাদের’ তবু যা হোক কিছু করে বোঝানো যায়।
শ্বশুর-শাশুড়ি সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে তিনতলা ওলারাই বলে। বরের সামনে সামলে চলে।
শিলাদিত্য বললো, দাদা মেদিনীপুরে গেছে কবে?
এই তো পরশু।
আশ্চর্য! বাড়ির মধ্যে থেকে জানতেই পারি না।
ও কী আর ‘বাড়ির ছেলে’ থাকছে রে? ক্রমেই পার্টির ছেলে হয়ে যাচ্ছে। আমার কপাল! তা এ দুঃখু আর বুঝছে কে?
বলে তিনতলায় উঠে যায়।
নয়নতারা বার্তাবৃত্তান্ত শুনে বলেন, ত খোকা তো ঠিকই কইছে। বয়েসের মেয়্যা। অনাত্মীয় বাড়ি যাওনে কাম কী?…অরে আমাগোর এখেনে থুয়ে যাও। অ্যাখোন তো অর দাদুর কানের তালাচাবি খুলে গ্যাছে। কানে কলকব্জা বসেছে। দাদা-নাতনীতে গপ্পো আড্ডা হবে।
নীহারিকা ‘ইনোসেন্ট’ গলায় বলে, আমিও তো তাই ভেবে রেখেছিলুম, তো মেয়ে যে এদিকে নাকি আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে কলেজের কোন বন্ধুর বাড়ি গিয়ে একসঙ্গে পড়াশুনো করবে। সামনে পরীক্ষা আসছে তো?
অ না। তাই বুঝি? ত সে বন্দুর বাড়ি কনে? দূর না কি?
না না। কাছেই। আমরা যাবার সময় নামিয়ে দিয়ে চলে যাবো, ফেরার সময় নিয়ে আসবো। পথেই পড়বে।
অ। ত মেয়ের খাওন-দাঙন? কাজলরে করে দ্যাও যেন দ্যাখভাল করে খাওয়ায়।
মাকড়সা আপন লালা থেকে সুতো ছাড়ে, আর ছাড়তে ছাড়তে জাল রচনা করে চলে।
তদ্দণ্ডে অনেকখানি সুতো তৈরী হয়ে গেছে। সেও আবার এক ফ্যাচাং। বন্ধু নাকি খুব করে বলে রেখেছে, দু’জনে একসঙ্গে খাবে। নেমন্তন্ন বলে কিছু না, নিজেরা যা ডালভাত খাবে ভাই।…তো যাক। আপনারা কিন্তু ঠিক সময় খেয়ে নেবেন। তারকটা তো নেই। কাজলকে বলে যাচ্ছি ভালো করে।
সত্যব্রত এসে দাঁড়ান, বলেন, তাহলে দেখছি বৌমা তোমাদের তিন যাত্রায় তিন ব্যবস্থা। আদিত্যর উপনয়নের নেমন্তন্ন, তোমার আর শিলুর গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন, আর তোমার মেয়ের পড়াশুনো করবার নেমন্তন্ন! তো আমাদের নেমন্তন্নটা তাহলে কাজলের কাছে? হাসেন একটু।
কথা শুনতে পাওয়ার উপায় হওয়া পর্যন্ত সত্যব্রত একটু ফ্রী হয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে আসেন।
নীহারিকা বলে, খুব ইচ্ছে ছিল, আপনাদের জন্যে নিজে হাতে একটু বেঁধে রেখে যাবো। কিন্তু এমন তাড়াহুড়ো হয়ে গেল!
কিসের ‘তাড়াহুড়ো’ সে প্রশ্ন আর কে করছে? করে না বলেই হয়তো এরকম অনর্গল কথা বানাতে পারে নীহারিকা…টুসকি বলে, ‘কথাশিল্পী’। বলে তুমি যে কেন লেখিকা হলে না মা? দেদার গল্প উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতে।
মা বলে, তোদের এই সংসারে এসে আমার যে সবই হলো! গানের গলাও তো ছিল। কিছু না। স্রেফ গোয়ালে বসে জাবর কাটা
নীহারিকার কথা মানেই অভিযোগ।
তো আপাতত, সে আজ আপন ইচ্ছাশক্তির মহিমায় ডগমগ করতে করতেই সাজাগোজা করে নেয়। যে গল্পটি শাশুড়িকে বলে এলো, কাজলকেও সেইটিই বলে। দিদি বন্ধুর বাড়ি থাকবে, ওখানেই খাবে।
কাজল বললো, তো বন্ধুর জন্মোদিন বুঝি? তাই এতো সাজ?
নীহারিকা তৎক্ষণাৎ তার শিল্পকর্মটি ফলায়। বলে, বাব্বাঃ। ধরতেও বা পারিস। তবে বন্ধুর জন্মদিন নয়, সেটা বলে বসলে ভবিষ্যতে আবার কোনদিন কী হিসেবের গোলমাল হয়ে যায়। হয়তো বলে বসবে, “ওমা এই যে সেদিনকে বন্ধুর জন্মোদিন হলো।’ অবশ্য ‘বন্ধু’ টুসকির যে মাত্র একটা তা নয়। তবু সাবধানের মার নেই। তাই বলে, বন্ধুর বোনের জন্মদিন। অনেকে আসবে-টাসবে।
সাজগোজ? সাজগোজের এখন আছে কী? গহনাবর্জিত জগৎ।
.
ওদের যাত্রাকালে নয়নতারা নেমে এসে বলেন, অ বৌমা, যজ্ঞিবাড়ি যাচ্ছো ত গায়ে তেমন গহনা নাই ক্যান? তোলা গহনা তো দু-অ্যাক খানও পরবে?
সে খেদ যে নীহারিকারও নেই তা নয়। তাই চির প্রতিপক্ষ শাশুড়ির কাছেই আক্ষেপ জানিয়ে বসে, পরা যাবে আর কী করে? সবই তো ব্যাঙ্কের ভল্টে রাখা আছে। আজ আবার রবিবার, ব্যাঙ্ক বন্ধ।
নয়নতারা বেজায় গলায় বলেন, এই অ্যাখোন এক ফেসান হয়েছে। গহনাগুলান ব্যাঙ্কে ভরে রেখে আসবে। ব্যাঙ্কে টাকাই রাখে লোকে, গহনা রাখা অগ্রে কখনো শুনি নাই। …যজ্ঞিবাড়ি যাবে ন্যাড়া-বঁচা। আজ নয় রবিবার, দু’দিন আগে এনে রাখতে হয় তো?
নীহারিকা তেতো গলায় বলে, সেকথা বলবেন আপনার ছেলেকে। সদাই ভয় বাড়িতে ডাকাত পড়বে। তাই একটুকরো সোনা ঘরে রাখার জো নেই। এই নেহাৎ গায়ে যেটুকু আছে-
নয়নতারা ক্ষুণ্নস্বরে বলেন, পাবনার গাঙ্গুলীবাড়ির বৌ যজ্ঞিবাড়ি যাচ্ছে, ন্যাড়া-বঁচা।
তা উপায় কী?
নয়নতারা নিজের যা কিছু সোনাদানা আনতে পেরেছিলেন তা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, বৌ-মুখ দেখেছিলেন। এখন তিনি মনে মনে ভাবেন, আহা, আমার সেই দশ-বারো ভরির শঙ্খমালা হারটা যদি থাকতো, বৌমারে কইতুম, বৌমা গলায় পরে নাও।
তা যাক, এ যুগে নকলেও কাজ চলে। আগের সেই উন্নাসিক যুগ আর নেই, যে ‘গিল্টি’, ‘নকল’, ‘ঝুটো? ছিঃ বলে লোকে নাক কোঁচকাবে।
টুসকি একটা নকল মুক্তোর সেট পরলো। সরু একহালি একটা মালা, কানে দুটো ঝুমকো, আর অনামিকায় একটা মুক্তো বসানো আংটি। আংটির সোনাটা অবশ্যই ‘গিল্টি’ করা। তা দেখতে ভারি সুন্দর ছিমছাম।
.
অনেক আয়োজন অনেক উত্তেজনা, অনেক উৎকণ্ঠা, অনেক মিথ্যার জাল বোনাবুনি! তবু কী রোমাঞ্চ! টুসকির মনে হতে থাকে, যেন তার জীবনে কি এক পরম লগ্নের আভাস দেখা দিয়েছে।… কে ভেবেছিল এই উচ্ছ্বাসের পরিসমাপ্তি এমন হবে!
প্রথম দিকটি তো শুরু হয়েছিল গানের সুরের মতো, কবিতার ছন্দের মতো। সেই যজ্ঞিবাড়ি থেকে গাড়ি এসে দরজায় দাঁড়িয়েছিল নীচেতে। আর সঙ্গে যুধাজিতের দু’লাইন চিঠি—’মাসিমা, নিজে যেতে পারলাম না, সেজন্য দুঃখিত। অনুগ্রহ করে এর সঙ্গে সকলে চলে আসবেন নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে।’
গাড়িটা অবশ্য যুধাজিতের নয়, এবং এ ব্যবস্থাটিও কেবলমাত্র ‘মাসিমা স্পেশাল’ নয়। অচেনা রাস্তা, আনকোরা নতুন পাড়া, ঠিকানারও ‘মা-বাপ নেই’, পাছে নিমন্ত্রিতদের শুধু ঠিকানা দেখে রাস্তা চিনতে অসুবিধে হয়, তাই যুধাজিৎ গাড়ি-সারাইয়ের গ্যারাজ থেকে খানতিনেক গাড়িকে ভাড়া করে এইভাবে নিজে হাতে চিঠি দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এ বাড়িতে দিয়েছে, দিয়েছে তার নিজের দিদির বাড়িতে এবং দাদার শ্বশুরবাড়িতে (তারা তো দু’দিন আগে দুর্গাপুর থেকে এসে সেখানেই উঠে রয়েছে।)… তা ছাড়াও এক দূরসম্পর্কের পিসি এবং মাসিও আছে যুধাজিতের এবং আরো কেউ কেউ শহরের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। …সকলের জন্যেই সুব্যবস্থা।
যুধাজিতের আপ্রাণ চেষ্টা মায়ের ইচ্ছাপূরণ। তার নিমন্ত্রণ তালিকায় মায়ের নিজস্ব সংযোজনও আছে বেশ কিছু।…তা এসব নীহারিকার আন্দাজে নেই। তাই ভারি উৎফুল্ল, এই গাড়ি পাঠানোটা ‘মাসিমা স্পেশাল’ ভেবে। এবং তার সঙ্গে একটি অন্তর্নিহিত কাৰ্যকারণের যোগ কল্পনা করে।
গাড়িতে ওঠার আগে ছেলের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে নীহারিকা, সত্যিকার ভদ্রছেলে বটে একখানা। ভেবে দ্যাখ তো, তোর বাবার হুকুম মেনে যদি শুধু তুই যেতিস নেমন্তন্ন রক্ষে করতে, কেমন দেখাতো? ভাবা যায় না।
তা চলমান গাড়ির মধ্যে সেই ভাবা যায় না-র রেশ তো চলছিল, গিয়ে বাড়ির সামনে নেমে পড়েও মনে হলো, বাবা! এ যে ভাবা যায় না!
বিয়েবাড়ির মতো করেই উৎসব বাড়ি সাজিয়েছে যুধাজিৎ। সামনে ডেকরেটারদের তৈরী বিচিত্র সুন্দর তোরণ, লাল শালুকের ওপরে সাদা ফুল দিয়ে লেখা ‘সুস্বাগতম’।…তোরণের দু’পাশে মঙ্গল কলস। ভিতরে ঢুকে সামনের চত্বরে আলপনা আঁকা।
বিভোর হয়ে এগোতে থাকে টুসকি।…বাড়ির গায়ে একধারে মস্ত প্যাণ্ডেল। তার মধ্য থেকে রান্নার সৌরভ ভেসে আসছে। আহারের আয়োজন বোধহয় সেখানেই।… নতুন পাড়া, ধারেকাছে খোলা জমি পেয়েছে অনেকটা।
প্যাণ্ডেলের সামনে এখানে ওখানে খানকয়েক খানকয়েক করে চেয়ার পাতা, তাতে কিছু সুসজ্জিত নারী-পুরুষের সমাবেশ।
দরজার সামনে একটি মেয়ে সকলের গায়ে গোলাপজল ‘স্প্রে’ করছে আর একটা করে গোলাপের ‘বোকে’ হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য কোনোটাই নতুন নয়, অজানাও নয়। এমন দেখা আছে ঢের, তবে সেসব তো ঘটাপটার বিয়েবাড়িতে হতে দেখেছে টুসকি। এরকম অনুষ্ঠানেও এতো?
তবে সবই অপরিচিত মুখ। উৎসুক দৃষ্টি একটি পরিচিত মুখ খুঁজতে থাকে। কিন্তু চট করে পায় না। এগিয়ে আসে আর একটি অপরিচিত মুখ। তবু দেখেই মনে হয় যেন পরিচিত। যেন কোথায় দেখা, কোথায় দেখা।…
সাদা ধবধবে গরদের ব্লাউজ আর সাদা ধবধবে সরু ভোমরাপাড় দুধে গরদ পরা যে হালকা গড়নের শান্তশ্রীমণ্ডিত মহিলাটি কাছে এসে দাঁড়ালেন, দেখামাত্রই বুঝতে অসুবিধে হলো না তিনিই যুধাজিতের মা। মুখের ছাঁচে আদল আছে।
মহিলা শিলাদিত্যর দিকে এগিয়ে এসে বলে ওঠেন, খুব যদি ভুল না করে থাকি, তুমি নিশ্চয় শিলাদিত্য। আগে দেখেছি। সেই স্কুল-কলেজে পড়ার সময়। তাই না? আর ইনি নিশ্চয় মা আর বোন। ঠিক তো? কই তোমার বাবা এলেন না?
শিলাদিত্য নিচু হয়ে প্রণাম করে বলে, না। মুস্কিল হয়েছে বাবাকেও আবার আজ চন্দননগরে একটা নেমন্তন্নয় যেতে হয়েছে।
আঃ। বাবার এই ঘটনাটা তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। নচেৎ তাকেও এখন মায়ের মতো কথা বানাতে হতো।
তাই বুঝি? এসো। কী নাম তোমার গো? মেখলা না? শুনেছি জিতুর মুখে। জিতুটা কোথায় দেখি।…আচ্ছা এসো, ভেতরে চলে এসো, আসুন ভাই। আপনার নামটি কিন্তু জানি না।
টুসকির মনে হয়, কী মার্জিত! কী ভদ্ৰ! কী সুন্দর কথাবার্তা! এমন সৌজন্যশীলা মা, তাই ছেলের মধ্যেও অতো সৌজন্যবোধ।
এগিয়ে যায় পায়ে পায়ে।
ওই যে–
মহিলা অদূরবর্তী একটি গ্রুপের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ওই যে জিতু। আপনাদেরই কে যেন আত্মীয় হন, ওঁদের সঙ্গে কথা বলছে। জিতুকে ভীষণ ভালোবাসেন। ওঁরা আগেই এসে গেছেন।
সেই ওঁরা’র দিকে তাকিয়ে বিদ্যুতাহতের মতো শক্ত হয়ে যায় মেখলা। পিসি, পিসির জা, আর তার মেয়ে ‘পাপিয়া’। তার সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলছে যুধাজিৎ। ওদের হাতে এক এক পাত্র আইসক্রীম। হয়তো সেইটা নিয়েই বাক্যজাল।
ট্রের ওপর বেশ কিছু আইসক্রীমের পাত্র বসিয়ে কেটারারের নামাঙ্কিত উর্দিপরা লোক এসে দাঁড়ায় শিলাদিত্যদের কাছে। তিনজনের হাতে তুলে নেয় তিন পাত্র। তার মানে, এটাই আসামাত্রই অভ্যর্থনার আয়োজন। কিন্তু তিনজনের একজন নিজেই তো আইসক্রীম বনে গেছে।… পিসির ওই দ্যাওরঝিটাকে এখানে দেখবে, দুঃস্বপ্নেও ভেবেছে টুসকি?
অথচ ওরা সদলবলে এসেছে। আগে এসে হাজির হয়েছে। বেলেঘাটা থেকে দূরত্ব কিছুটা কম বলে কী?… কিন্তু পথের দূরত্ব তো একটা পরিমাপ নয়। কখন কোন্ ফাকে ওরা দূরত্ব ঘুচিয়ে যুধাজিৎ নামের একান্তই টুসকির সম্পত্তিটিকে বাগিয়ে ধরে ফেলেছে!
পা থেকে মাথা পর্যন্ত যে একটা আগুনের শিখা দাপাদাপি করতে থাকে মেখলার মধ্যে! কী বিশ্বাসঘাতকতা! কী বিশ্বাসঘাতকতা!…ওই লোকটাকে খুব ভদ্র আর মার্জিত ভাবছিল টুসকি।…ছোটোলোক। একের নম্বরের ছোটোলোক।
টুসকির সমস্ত চেতনা জুড়ে ওই দুটো শব্দই ধ্বনিত হতে থাকে, ‘বিশ্বাসঘাতক! ছোটোলাক।’
তা নীহারিকাও যে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে তার ননদের বাড়ির গুষ্ঠিকে এখানে দেখে বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছে, তা অবশ্যই নয়।…কী আশ্চর্য! ওরা কেন? ওরা কে? ওদের সঙ্গে এতো ভাব হলো কখন? আমাদের মূল্যের পারাটা যে অনেক নেমে যাচ্ছে!
শিলাদিত্যও তাই-ই ভাবছিল। তবে তার ভাবনাটা সোচ্চার। কী পিসি, কী ব্যাপার? তুমি? এদের সঙ্গে এতো চেনাজানা হলো কবে? তাজ্জব বনে যাচ্ছি যে। কী ‘পাপিয়া’! কতক্ষণ এসেছো?
পাপিয়া কিছু বলার আগে পিসি বলে ওঠে, আর বলিস না। সক্কালবেলাই গাড়ি গিয়ে হাজির। সঙ্গে চিঠি।… ‘পিসিমা, কষ্ট করে একটু আগে আগে চলে আসুন। গাড়িটা আবার দিকবিদিকে ছুটবে।… কী সোনার চাঁদ ছেলে বাবা তোর বন্ধু। একদিনে সবাইকে আপন করে নিতে পারে।
যুধাজিৎ আড়ে আড়ে টুসকির দিকে তাকিয়ে চোখোচোখি হবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পিসির দিকেই তাকিয়ে বলে, সে বিদ্যেটি আপনাদের থেকে বেশী আর কারো আছে না কি?
তারপর?
মা ছেলে মেয়ে তিনজনের কেউই ওদের এই অনধিকার প্রবেশকে প্রসন্ন মনে গ্রহণ করতে পারেনি। এ যেন অন্যায়ভাবে তাদের জিনিস ছিনিয়ে নেওয়া।… তবে—তিনজনের মধ্যে মাত্রাভেদ ছিল অবশ্যই।
টুসকি যে কীভাবে অতোক্ষণ বসেছিল, তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। খেতে অবশ্য আদৌ পারেনি। দারুণ মাথা ধরলে’ কী করে খাবে?….বসেছিল এই ঢের।
যুধাজিৎ দুচারবারই চেষ্টা করেছে, হঠাৎ আপনার কী হলো? এরকম ‘মাথা ধরার’ অভ্যাস আছে না কি? কী ওষুধ খান? বলে বলে কিন্তু কাজ হলো না। টুসকি নিজেই বুঝতে পারছে না, তার সমস্ত মন এতোটা বিজাতীয় বিরাগে বিস্বাদ হয়ে উঠলো কেন?
‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে ভাবছি কেন?…নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিতে পারে না টুসকি। মনকেও আয়ত্ত করতে পারে না। কষ্টে সময়টা কাটিয়ে কোনোমতে বোদা বিস্বাদ মন নিয়ে বাড়ি ফেরে।
নীহারিকারও মুখ কালিবর্ণ! শিলাদিত্য অবশ্য বেগতিক দেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসিঠাট্টা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতো বড় কর্মযজ্ঞের নায়কের তো তাদের নিয়েই বসে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। কাজেই ছেঁড়া তার আর জোড়া দেওয়া গেল না।
কিন্তু কাল্পনিক এক বিশ্বাসঘাতকতাতেই এতো শিথিল হয়ে গিয়েছিল যারা, তারা কী স্বপ্নেও ভেবেছিল সত্যিকার এক অবিশ্বাস্য বিশ্বাসঘাতকতার নমুনা তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
.
বাড়ি ফিরে দরজায় কড়ানাড়া দিল শিলাদিত্যই। হ্যাঁ, এ বাড়িতে, শুধু এ বাড়িতেই বা কেন, এ পাড়ার অনেক বাড়িতেই এখনো সাবেকি চালে সদর দরজায় কড়ানাড়া দিয়ে জানান দিতে হয় কেউ এসেছে।
দরজা খুলে দিলেন নয়নতারা।
শিলাদিত্য অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার। তুমি?
নয়নতারা বললেন, কী জানি দ, তদের কাজলেরে তো সেই কখোন থেকে দেখছি না। ডাকেও সাড়া নেই।
ছিটকে বলে আসে নীহারিকা, ‘কখোন’ থেকে মানে? কখোন থেকে?
ওই তো তমরাও বার হলে, আর আমাগোর তাড়া লাগাতে ধরলো, দাদু খেয়ে ন্যাও, ঠাকুমা খেয়ে ন্যাও। ভাত ঠান্ডা হয়ে যাবে।…তা খাওয়ালো তোয়াজ যত্ন করে। তারপরে যে কনে গ্যালো! সাড়াশব্দ কিছু নাই।
শিলাদিত্য চড়া গলায় বলে, ‘কনে’ আর যাবেন? নিজেও গরম ভাত সেঁটে ঘুম মারছেন কোথাও। বেওয়ারিশ বাড়িটি পেয়েছেন।
কিন্তু কোথায় ঘুম মারবে?
রক্তমুখী হয়ে তল্লাশ করে নীহারিকা। টুসকিও বিদ্যুতাহত ভাব ত্যাগ করে তদন্তে লেগে যায়। এবং চটপটই আবিষ্কার হয়, শুধু যে কাজলই নেই তা নয়। কাজলের জামাকাপড়, পাউডার, স্নো, আয়না, চিরুনি ইত্যাদি যাবতীয় সম্পত্তিও নেই। এবং মহাজনের পথ অনুসরণ করতেই বোধহয় টুসকির ঘরের আলনায় যে সব সুন্দর শৌখিন শাড়ি-ব্লাউসগুলি দোদুল্যমান ছিল—তারাও উধাও।
টুসকির রুদ্ধ কণ্ঠ থেকে এখন মুহুর্মুহু ধ্বনিত হতে থাকে, মা! আমার লাল চটিজোড়াটাও নেই। মা! ‘স্বয়ম্ভর’ থেকে কেনা আমার নতুন সাইড ব্যাগটাও নেই! মা।… আমার আস্ত বোরোলীনটাও নেই!… আমার নেলপালিশটাও—
তার মানে একখানা অখণ্ড অবসরের সুযোগ পেয়ে কাজল তার বেশ কিছুদিনের জীবনযাত্রার পাথেয় সংগ্রহ করে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে!
শিলাদিত্য হাঁক পাড়ে, আলমারিগুলো খুলে দেখেছিস? সেসবও ফর্সা হয়ে গেছে কিনা!
না। আলমারি অটুটই আছে। চাবি কোথা পাবে? সে তো নীহারিকার সঙ্গে হাতব্যাগে ছিল।
তা ভাঙতেও পারতো! মনে হচ্ছে পেছনে গ্যাং আছে।
অতঃপর চলতে থাকলো আরো কী কী করতে পারতো কাজল, এবং আরো কী কী করেছে, তার তল্লাশ!
কী অবিশ্বাস্য! কী অবিশ্বাস্য! কাজল এই কাজ করলো!… কিন্তু ব্যাপারটা তো এইখানে থেমে থাকছে না। আদিত্য নামের রগচটা লোকটি যখন এসে প্রশ্ন করবে, বাড়িটা এমন ‘বেওয়ারিশ’ হলো কী করে? টুসকি কোথায় ছিল?
নীহারিকা হঠাৎ তিনতলার ‘ওনাদের’ আক্রমণ করে বসে। আপনাদেরও বলিহারী যাই। দিনদুপুরে জলজ্যান্ত একটা মানুষ এতো কাণ্ড করে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল, আর আপনারা টেরটি মাত্র পেলেন না? আশ্চর্য!
নয়নতারা আত্মপক্ষ সমর্থনের কাতর চেষ্টা করেন। বলেন, আমি ক্যামোন কইরে জানবো বৌমা? আমার মনের মধ্যে ছন্দঅংশে সন্দেহ থাকলি তো নজর রাখবো? কাজল আজ কত বছর আছে। তমাগোর মেয়্যার মতো, আলমারি বাক্স খুলে গোছায়, তমাগোর ভাঁড়ার নাড়ে, তারে করবো সন্দেহ?…
কিন্তু গেল কোথা দিয়ে? বাইরের দরজাটা তো ভিতর থেকে খিল-ছিটকিনি সবই লাগনো রয়েছে দেখা গেল।
অনুসন্ধানে ধরা পড়লো পাশের গলির দিকের জমাদার আসার ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তবে মনিবের সঙ্গে নেমকহারামি করেনি। রাত্রে রান্নাঘরে লাগাবার পটপটে তালাটা সেই দরজায় লাগিয়ে দিয়ে গেছে।… বাইরের চোর-ছ্যাঁচোড় যাতে চট করে ঢুকে পড়তে না পারে।
শিলাদিত্য কিছুক্ষণ গোয়েন্দার স্টাইলে আরো তদন্ত করতে করতে হঠাৎ গলা নামিয়ে বলে উঠলো, তারকবাবুর হঠাৎ ছুটিতে ‘দেশে’ যাওয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তো?
তারকের সঙ্গে সম্পর্ক?
নীহারিকা বলে ওঠে, কী যে বলিস! দুটোতে তো সাপে নেউলে।
শিলাদিত্য একটু রহস্যময় দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকায়। যার অর্থ, ওইটাই চালাকি। অপরকে বোকা বানাবার আবরণ। নির্ঘাৎ এই তারকটার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে—দ্যাখো এখন তারকবাবুর ঘরে তাঁর সম্পত্তির কী আছে আর কী নেই এবং এ বাড়ির কিছু হাতিয়ে নিয়ে গেছেন কিনা।
দেখা গেল তারকের সর্বস্বই রয়েছে। খুব সম্ভব শুধু সবথেকে ভালো শার্ট প্যান্ট দুটো নিয়ে চলে গেছে।
টুসকি গলা নামিয়ে বললো। ছোড়দা! এটাও চালাকি নয় তো? বোকা বানাবার জন্য আর একটা ধাপ্পা। ভারী তো সম্পত্তি ওর। জামাকাপড় আছে বটে অনেকগুলো, তো তার বদলে কারো কিছু হাতিয়েছে কিনা কে জানে! দাদার সর্বস্বই তো ওই তারকের হাতে। … সে জায়গায় তারকের একটা চিনমোড়া আর্শি, দুটো চিরুনি, একখানা ময়লা গামছা দু’খানা তোয়ালে। আর বাবুর পরম শখের প্রাণতুল্য ট্র্যানজিস্টারটা।
দুই ভাইবোনের গোপন বৈঠকে প্রায় ঠিকই হয়ে গেল, তারকের হঠাৎ দেশে যাওয়াটার সঙ্গে কাজলের অন্তর্ধানের সম্পর্ক গভীর! নিবিড়!
.
নিজস্ব হিসেবে দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেললেও, আদিত্যর সামনে সে সন্দেহের কথা ব্যক্ত করতে পারে না। আদিত্যর সামনে সেই নিচু কথাটা মুখ দিয়ে বার করবে কী করে?
এ খবরে আদিত্য প্রথমটা প্রচণ্ড চেঁচামেচি করে উঠলো। তার আজ সারাটা দিন ভারি আহ্লাদে কেটেছে। অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে সুখের স্বাদই আলাদা। তছাড়া নিমন্ত্রণকর্তা বন্ধু আর একটি আকর্ষণীয় প্রমোদ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, একটা পুকুর ঠিক করে রেখেছিলেন মাছ ধরবার জন্যে। এ একটা লোভনীয় ব্যাপার।
সারাদিনের বেশ একটু ভালো লাগার আমেজ (যা নাকি এখনকার জীবনে প্রায় দুর্লভ) নিয়ে বাড়ি ফিরে কিনা এই দুঃসংবাদ। এ তো আর সংসারের একটা করিৎকর্মা ‘কাজের মেয়ের’ হঠাৎ কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া নয়! এ যে মাথায় বাজ হানা।
ওর বাপ যখন এসে জিগ্যেস করবে, বাবু, আপনাদের হেফাজত থেকে আমার জোয়ান বয়সী মেয়েটা হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেল কী করে, তার জবাব দিন। কী জবাব দেবে আদিত্য গাঙ্গুলী নামের অহঙ্কারী মানুষটা!
তারপর মনে পড়লো, ওর বাপের তো আসার খুব ঠিক নেই। মেয়ের মাইনেটা হাতিয়ে নিয়ে যেতে মাসে একবার আসে বটে তবে খুব নির্দিষ্ট কোনো তারিখে নয়। মনে হচ্ছে এই কিছুদিন আগে যেন একবার এসেছিল।
অতঃপর থানা পুলিশের গাড্ডায় পড়তেই হবে।
উৎকণ্ঠা সকলেরই।
সত্যব্রতও আজ ছেলে ফেরার পর নীচে নেমে এসেছেন। বললেন, শিলুকে সঙ্গে নিয়ে একটা ডায়েরি করে এসো। ওটা তাড়াতাড়ি না করলে আবার আইনের অনেক প্যাচে পড়ে যেতে হয়।
শিলাদিত্য দারুণ অস্বস্তির সঙ্গে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, একজন গেলে হয় না?
সত্যব্রত বলেন, ‘হয় না’ তা নয়। বাড়িতে যদি দু’জন না থাকে। তবে তুমি একটা ইয়াং ছেলে, এ ধরনের বেল-এ তোমার একা পেলে বেশী হ্যারাস করবে। সেটাই তো স্বভাব ওদের।
শিলাদিত্য চমকে ওঠে, আমায় একা পেলে? আমি একা যাবো? মাই গড। বলছি শুধু বাবা গেলে হয় না?
সত্যব্রত একটু গম্ভীর হাসি হাসেন, তাই বা না হবে কেন? তবে গোলমেলে কাজে সাবালক হয়ে ওঠা ছেলেদের তো বাপের সঙ্গে যাওয়াই উচিত।…আমার যাওয়াটা যদি তোমরা অ্যালাউ করো তো আমিও যেতে পারি। তবে তাতে আবার ট্যাক্সিভাড়া লেগে যাবে। অনেকদিন বাসে-ট্রামে চড়িনি, একটু ভীতি এসে গেছে।
আদিত্য বেজার গলায় বললো, আপনাকে কে যেতে বলছে? আমি একাই যাবো!… টুসকি, তোর মার কাছ থেকে ভালো করে জেনে আয় তো তোদের ওই কাজলের দেশের বাড়ির ঠিকানা কী, বাপের নাম কী, বাপ কী করে।
টুসকিকে আর জিগ্যেস করতে হলো না। তার আগেই আকাশ থেকে পড়লো নীহারিকা।
আমি? আমি ওসবের কী জানি? গ্রামের নামটা ‘পৈলেনহাট’ না কী যেন অদ্ভুত একটা বলতো! আর বাপ চাষবাস করে এইটুকু জানি।
বাপের নাম? ‘সেটুকুও জানো না? এই এতোদিন আছে এখানে।
আশ্চর্য! আমারই যেন যতো দায়। ‘বাপ’ না বাপ! কেলে কুচ্ছিৎ ভোঁদড়ের মতো একটা লোক আসতো এক আধবার দেখেছি। কাজলবালা তদব্যস্ত হয়ে বাপকে চা খাবার খাওয়াতে যেতো, দেখে হেসেছি, এর বেশী কে জানতে গেছে?
আদিত্য আবার চেঁচায়। বলে, জানা উচিত ছিল। এগুলো বাড়ির গিন্নীর জানার কথা।
নীহারিকা স্থান-কাল-পাত্র বিস্মরণ হয়। নীহারিকা তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের গলায় বলে ওঠে, ‘বাড়ির গিন্নী।’ ওঃ। গিন্নীই বটে! বলি গিন্নীর পোস্টটা পেল কখন এই নীহারিকা গাঙ্গুলী? বরং বলো ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। আমি বলবো, এসব বাড়ির পুরুষদের জেনে রাখা উচিত।…তো সে উচিতজ্ঞান কার আছে? সাধের পাসিখানি, ঠিকই ঠিক সময় বৈতরণী পার হয়ে যাচ্ছে।…এতেই নিশ্চিন্দি।
আদিত্য আর একটা ক্ষিপ্ত উত্তর দেয়। তার পিঠে নীহারিকা আবার!… পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে দু’জনে যেন সম্মুখ সমরে নেমে পড়ে।
সত্যব্রত আর কথা বলেন না। নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান।
সেদিকে লক্ষ্যমাত্র না করে দু’জনে চালাতেই থাকে। আর টুসকি সেই অবকাশে ভাবে যাক বাবা, গোলেমালে বাবা যে সেই মোক্ষম প্রশ্নটি করে বসেনি, সেটাই রক্ষে।
টুসকি কোথায় ছিল?
টুসকি?
বন্ধুর বাড়ি?
কোন বন্ধু? কোথায় থাকে সে? আজই হঠাৎ বন্ধুর বাড়ি যাওয়াটা এতো কী জরুরি ছিল?
আজ টুসকির বড় দুঃখের দিন।
তারপর—যেই ভাবছে—সকালে উঠে দেখা যাবে তারক নেই, কাজল নেই, তখন? কী চেহারা হবে সংসারের? এবং মায়ের?
টুসকির বুকের ওপর একখানা পাথরের চাঁই চেপে বসে। তারপর আস্তে আস্তে ভাবতে থাকে—
আচ্ছা, ছোড়দা যা সন্দেহ করছে, সেটাই কী সত্যি সম্ভব?…ভগবান জানে।…অসম্ভব বলে কিছু নেই জগতে। দেখছি তো। না হলে, আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে যুধাজিতের বাড়িতে গিয়ে দেখতে হয় সেখানে পিসির গুষ্ঠিবর্গ! পাপিয়ার সঙ্গে হেসে হেসে আইসক্রীম খাচ্ছে।
.
কিছুক্ষণ উষ্ণ বাক্য বিনিময়ের পর আদিত্য কর্তব্যকর্মের তাগিদে বাধ্য হয়ে বেরিয়ে যায়।…জীবনে কখনো জানেনি, থানায় গিয়ে ‘ডায়েরি’ করে আসাটা কী ব্যাপার? কাকে বলতে হয়? কীভাবে কথা পাড়তে হয়?…বাড়িতে চোর পড়ে চুরিচামারি করে গেলে পাড়ার লোককে ডেকে ডেকে বলা যায়, পরামর্শ করা যায়, কিন্তু এ যে এক অতি অস্বস্তিকর ব্যাপার।…শোনামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার মনের মধ্যে সন্দেহের কুয়াশা জমে উঠবে।…
হঠাৎ মান খুইয়ে টুসকিকে ডেকে বললো, যা দাদুকে জিগ্যেস করে আয়। বাড়ির চাকরটা হঠাৎ দু’তিন দিন আগে দেশে যাবো বলে চলে গেছে, এটা কী থানায় জানাবো?
.
খানিক পরে যখন বেরিয়ে পড়েছে আদিত্য নামের রগচটা অথচ ভেতরে ভীতু লোকটা, দেখলো ছেলে আসছে সঙ্গে সঙ্গে।
নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন