আশাপূর্ণা দেবী
কলকাতায় এসে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই বাপ্পার মনের মধ্যে যেন ভয়ঙ্কর একটা যন্ত্রণায় মোচড় পাক খেতে থাকে। কতদিন এই কলকাতাটাকে দেখেনি সে। এটা সে তার এতোখানি ভালোবাসার জায়গা ছিল, তা তো কোনোদিন খেয়াল করেনি।
অনুভূতিটা অদ্ভুত একটা বিপরীতধর্মী।
এক একবার মনে হচ্ছে, আশ্চর্য, সব ঠিক যেমন ছিলো তেমনই রয়েছে। বাপ্পা যে এদের সর্বদা দেখছিলো না, তা কারো মনে পড়ছে না, আবার হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে, সবকিছু বুঝি বদলে গেছে!
আচ্ছা কতদিন এইসব চেনা চেনা রাস্তাঘাট দোকান-টোকান দেখেনি বাপ্পা? হিসেব করে দেখতে চেষ্টা করলো। ধরতে হলে, সেই কোন একটা পচা গ্রাম থেকে মাথাটা ফাটিয়ে আসার পর থেকেই ধরতে হয়। হাসপাতালের সময়টা আর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গিয়ে ফেরারি আসামীর মতো আত্মগোপন পদ্ধতিতে কাটানোর সময়টা মিলিয়ে, হিসেব করে দেখলো, প্রায় আড়াই বছর।…
হঠাৎ একটা তুলনা মনে এলো বাপ্পার। কেউ যদি এতোগুলো দিন জেল খেটে এসে বাইরের চেনা জগতে পা ফেলে, পরিচিত গৃহে ফিরে আসে? তার কী এইরকম অনুভূতি হয়? লজ্জা, অস্বস্তি, নিজেকে গুটিয়ে রাখার ইচ্ছে।…এমন তুলনা মনে হলো বোধহয় নিজের মানসিক অবস্থায়। অথচ এখন হবার কথা নয়। বাপ্পা কী কোন গর্হিত কাজ করে ফেরার হয়েছিল? বাপ্পা তো শুধু—
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে ওঠে। ইস, সব ঠিক তেমনি। বাড়িখানা? সেও তো প্রায় একই। হয়তো আর একটু বিবর্ণ, হয়তো বা আর একটু জীর্ণ। সে এমন কিছু না। ধারে পাশে আরও যে সব বাড়ি রয়েছে, কেউই তো ঝকঝকে চকচকে নতুন নয়। এদের সঙ্গে খাপ খেয়ে গেছে বলেই ওই জীর্ণতা বিবর্ণতা তেমন চোখে ঠেকে না। কাজেই মনে হলো, বাপ্পা এতোদিন না থাকতেও, কোথাও বিশেষ কিছু রেখাপাত করেনি। তার মানে কারো জন্যেই কিছু আটকায় না।
আর আশ্চর্য, হঠাৎ ওই সত্যটুকু অনুভব করে বাপ্পা নামের চিরউদাসীন ছেলেটা যেন রীতিমত ক্ষুব্ধই হলো। আশ্চর্য অন্য ব্যাপারেও। অথচ বাড়ির পথে আসবার সময় বাপ্পা মা-বোনকে অবহিত করিয়ে দিতে দিতে এসেছে, তাকে দেখে যেন বাড়িতে কোনোরকম হৈচৈ শোরগোল না ওঠে। কেউ যেন না ‘তোর কী চেহারা হয়েছে রে—’ বলে ডুকরে ওঠে। আর সকলে মিলে যেন ‘অধিক যত্নের’ জ্বালায় তাকে ব্যস্ত না করে। তাহলে কিন্তু সে তক্ষুণি পালাবে। .
শুনে টুসকি বলেছিলো, এখন বাড়িতে থাকার মধ্যে তো বিছানায় শোওয়া বাবা, আর তিনতলায় বুড়োবুড়ি দুটো। তো আগেই তাহলে কেউ নেমে পড়ে, সাবধান করে দেওয়া হোক। ছোড়দা, তুই ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে পড়ে দরজা খুলিয়ে এই নিষেধাজ্ঞাটি জারি করে দিস। না হলে, বুড়ি নির্ঘাৎ নাতিকে দেখেই ‘আরে আমার বড় খোকা রে। অ্যাতোদিনে কেমন করে বুড়িরে ভুলে বসেছিলি দাদা—’ বলে কান্নায় উথলোবে।
তা সেইমতো কিছু করা হলো।
অতএব বাপ্পাকে দেখে তার বাপ ঠাকুর্দা ঠাকুমা কেউই ডুকরে উঠলেন না, উথলে উঠলেন না। খুবই সংযত ভঙ্গীতে স্বাগত জানালেন।
অথচ সেই জিনিসটার অভাবেই বাপ্পার নিজেকে একটা মূল্যহীন ফালতু মনে হলো। বাস্তবিকই যখন বাপ নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন, এবার শরীরটার দিকে একটু নজর দিলে ভালো হয়। সামনে একটা বড়ো কাজ আসছে। দায়িত্বটা তো তোমাদের ঘাড়েই পড়ছে এখন। আমার তো এই দেখেছো—টুসকির বিয়ের কথা বলছি।
তখন বাপ্পার মনে হলো, এই বাবারই না কী বাপ্পার আকস্মিক অন্তর্ধানে স্ট্রোক হয়েছিলো। …হুঁঃ। সম্পূর্ণ কাকতালীয়। সেটাই ভাঙিয়ে খাওয়া হয়েছে। সেন্টিমেন্ট সৃষ্টি করতে একটা জোরদার ব্যাপার পাওয়া গিয়েছিলো তো।
আবার যখন প্রথম দর্শনেই পিতামহ অতি সহজভাবেই, বলতে গেলে এখন অপ্রাসঙ্গিকই একটা কথা বলে উঠলেন, ‘ওদের যে কী খেয়াল চাপলো ট্রেন-এর বদলে ‘বাই কার’। আমার তো মনে হচ্ছে এতেই জার্নির কষ্টটা বেশী—’ আর পিতামহী (হয়তো অতিকষ্টেই) সহজ গলায় বললেন, ‘বনেবাদাড়ে ঘুরে রংটা অ্যাক্কেবারে খুইয়ে এয়েচে বড় খোকা’ তখন বাপ্পার মনে হলো, না এলেই বা কার এমন কী এসে যেতো?…মনে হচ্ছিলো যেন ভয়ানক কী একটা ঘটনা ঘটিয়ে চলেছিলো সে।
এই রকমই হয়। নিষেধের সঙ্গেও থাকে প্রত্যাশা। যেটা বাড়তি, যেটা বিশেষ।
.
তবে হ্যাঁ, ওই প্রত্যাশাটি পূরণ করে দিলেন পিসি সন্ধ্যাতারা…তিনি বাপ্পার প্রত্যাবর্তন সংবাদটি পাপিয়া বাহিত হয়ে জেনে ফেলা মাত্রই তদ্দণ্ডে চলে এলেন, বলতে কী শ্বশুর ঠাকুরের অশুখ সত্ত্বেও। অবশ্য সেই বিচক্ষণ ব্যক্তিটি নিজেই বললেন, মনটা ছটফট করছে বুঝতেই পারছি বড় বৌমা, তুমি এখনি একবার ঘুরে এসো। আমার জন্যে ভেবো না। সবাই রয়েছে। আর—একটু হেসে বললেন, মস্ত ভরসা ‘ডাক্তারবাবুই তো এসে গেছেন।
অতএব এ বাড়ির বড় বৌমা সন্ধ্যাতারা ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যেই ওবাড়ির টুনি’ হয়ে গিয়ে আসামীটার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে উঠলেন, বাপ্পারে, তোর মনপ্রাণ বলে কী কিছুই নেই বাবা?
প্রত্যাশার পূরণেই কী বাপ্পা সহজ হতে পারলো?
অথবা এই আবেগের ধাক্কায়? এটাই দরকার ছিলো তার অপরাধবোধের আড়ষ্টতা ঘোচাতে।…হ্যাঁ, এতোক্ষণ যেন বোকার মতো আড়ষ্ট হয়েই বেশী কথা না বলে চলে গিয়েছিলো স্নান সারতে।
এখন পিসির অভিযোগে হেসে বলে উঠতে পারলো, ‘মন’? সেটা ছিল কিনা, আদৌ আর সকলের থাকে কিনা জানা নেই, তবে ‘প্রাণ’টি ছিলো বৈকি পিসি। না হলে কী আর সশরীরে এসে দাঁড়াতে পারি?
আর সাহস পেয়ে এখন নয়নতারা বলে উঠলেন, তুই শুধোলি তাই। সাহস করে তো বলতেও পারি নাই, ‘পাষাণপ্রাণ ছেলে, এইটাই কী তোর ধর্মে হয়েছে?…একবার বাড়ির কারো কথা ভাবিস নাই?…তখন সত্যব্রতও বলেন একটু শান্তভাবে, সকলে যে কীভাবে কাটিয়েছি!
এখন আশেপাশে সবাই এসে জড়ো হয়েছে। কারণ সন্ধ্যাতারা তার অভ্যস্ত বাঁধভাঙা আবেগের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছে অন্যের পথের সামনের ঢিলপাটকেলের বাধাগুলো।
বাপ্পা বোনের দিকে তাকিয়ে একটু সরস গলায় বলে, খুব বেশী খারাপ ভাবেও যে ছিলে, তা তো মনে হচ্ছে না দাদু! বাড়িতে তো উৎসবের ঘটা পড়ে গেছে দেখছি।… আর তোমাকে দেখেও তো মনে হচ্ছে বেশ একটু ইয়াং হয়ে গেছো। শুনলাম আবার কোট প্যান্ট পরে কোর্টে যাওয়া আসা করছো।
সন্ধ্যাতারা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, সেটা মনপ্রাণের হাহাকার ঘোচাতেই বাবা!
অর্থাৎ প্রয়োজনের প্রশ্নটা তুলে আদিত্যকে লজ্জিত করতে চায় না।
তাহলে তো বলতে হবে, আমার দ্বারা একটা ভালো কাজই হয়েছে। কী বলো দিদা?
তা যা কইতে সাদ হয়, তাই ক ভাই।… তবে টুনিরে—তর পাপিয়ারে বড় একখান ‘পেরাইজ’ দেবার দরকার লাগছে। ওই মেয়েই তো আমার বড় খোকারে এনে ফেলাতে পারলো।
টুসকি মুচকি হেসে বলে, বড়ো একখান প্রাইজ তো তোমার হাতের মুঠোতেই মজুত দিদা। তবে মুঠোটা একটু শক্ত করো, যেন আবার ফসকে না পালায়।
নয়নতারা বলেন, আর অরে ফসকে পালাতে দিচ্ছি? বলে রাখছি, আবার পালালে, দিদাকে আত্মহত্যের পাপে পাপী করতে হবে। তো পেরাইজটার কতা কী কইলি, ঠিক বুঝলুম না!
টুসকি সেইভাবে বলে, বুঝবে কোথা থেকে? চিরকাল নীরেট মগজ। যে বোঝবার সে ঠিকই বুঝেছে।….
এই মহামুহূর্তে এসে পড়েন নীলুমামা। নিজস্ব ভঙ্গীতে হৈ হৈ করেই। তবু যেন কিছুটা সন্ত্রস্তভাবে। যেন বেশী লাগাম ছাড়া না হয়ে যায় বাবা।…তাছাড়া সরাসরি বাপ্পার সঙ্গে কথা না বলে, বলতে থাকেন অন্যদের উদ্দেশে।
কী মাসিমা, এইবার প্রাণে শান্তি পেলেন তো?…কী মেসোমশাই, কেমন লাগছে?…ওরে নীরু, তোর এখন দেখছি মণিকাঞ্চন যোগ এসেছে। ওদিকে জামাই আসছে, এদিকে উড়ো পাখি পুত্তুর এসে হাজির হয়েছে।….তোরা যতই বলিস—বিয়েতে সানাই ফানাই সেকেলে হয়ে গেছে, আমি কিন্তু এক সানাইশিল্পীর সঙ্গে বাৎচিৎ করে এসেছি। বিয়ের সকালে এসে পোঁ ধরবে। সানাই না হলে বিয়েবাড়ি মানায়?
এই তো—কও তো ছেলে!
নয়নতারা বলে ওঠেন, সাদে বলি, আমার নীলমাধব ছেলেখানা বুক-জুড়নো ছেলে। নীলুকে উনি নীলমাধব বলেন। এমন বুঝদার। আমার তো মনের মদ্যে কথাটা উথাল-পাথাল করছিলো, তো বলতে সাহস করি নাই।
কী আশ্চর্য! আপনার সাহসের অভাব কী জন্যে? আপনি বাড়ির হেড, আপনার নাতনীর বিয়ে—
নীহারিকা ঘর থেকে ডাক দেয়, নীলুদা, এই এ ঘরে একটু এসো তো। ইয়ের ফর্দটা একটু দেখে, হিসেবটা করে দিয়ে যাও তো।
নীলু এগিয়ে যেতেই নীহারিকা চাপা গলায় বলে, ওঃ নীলুদা, মোসাহেবীটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছো তো? তো আর কত তোল্লা দেবে?
নীলু একটু হেসে তেমনি গলার স্বর নামিয়ে বলে, দ্যাখ সামান্য দুটো কথায় যদি কাউকে একটু খুশী করা যায়, সেটুকু করতে অসুবিধে কী? তাছাড়া আইনত তো বাড়ির হেডই। নয়?
নীহারিকা অভিমানের গলায় বলে, সেই তো! তবে তুমি যে এতো আইনজ্ঞ তা জানা ছিলো না নীলুদা। তবে জেনো বুড়ো বয়সের ধর্ম হচ্ছে, একটু প্রশ্রয় পেলেই, ব্যবহারে ভারসাম্য বজায় রেখে উঠতে পারে না।
আচ্ছা, আচ্ছা…দেখি তোর কী ফর্স—
এ কথাটা উচ্চগ্রামে।
.
নীহারিকা বলেছিল, বুড়ো হলে লোকে ব্যবহারে ভারসাম্য রাখতে পারে না। কিন্তু বনছায়া কী বুড়ো? বনছায়া তো আহ্লাদের আতিশয্যে অনবরতই ব্যবহারে ভারসাম্য হারিয়ে বসছেন।
অরিন্দম অফিস থেকে ফেরামাত্রই শুভশ্রী ওরফে টিঙ্কু ঝঙ্কারের সুরে বলে ওঠে, ছেলের বিয়ে দিতে মা-টি আমার একেবারে আত্মহারা। কী বলেছেন জানো? জিতুর বিয়েতে—
অরিন্দম টাই খুলতে খুলতে বলে, এসেছিলেন না কি?
না না। আসবার খাটুনি কমিয়ে দিয়েছেন তালেবর ছেলে। ফোন এসে গেছে। আজই— পেয়েই আমার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কথা—
ফোন পেয়ে গেল?…অরিন্দম বলে ওঠে, ‘শালা’র এলেম আছে বটে।
টিঙ্কু তেমনি ঝঙ্কারের সুরেই বলে, তা থাকবে না কেন? ঘুষ দিতে পারলে সবাই এলেম দেখাতে পারে।
অরিন্দম হেসে ফেলে বলে, তোমার কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, দুটো ভাই-ই বোধহয় তোমার বৈমাত্রেয়। অথচ এটি তো একদম পিওর সহোদর।
থামো। সবসময় ঢং। মার বাড়াবাড়ির জ্বালাতেই! দেখছি তো চিরকাল। ছেলে হেঁটে গেলে বুকে বাজে।…
অরিন্দম স্বভাবগতভাবে উচ্চহাস্য করে বলে, তোমার মতে অবশ্য ওটা খুবই বাজে ব্যাপার? তা মায়ের স্বভাবটির যৎসামান্য পেলেও, আমার ছেলেটা একটু হেঁসেখেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতো!
কী? ওঃ। তোমার ছেলেকে আমি হাসতে খেলতে দিই না? হাঁফ ফেলতে দিই না? বটে!
আরে বাবা! তোমার সঙ্গে একটু ঠাট্টা করবারও জো নেই। করলেই একদম গাঁট্টা।… তো যাক, সদ্যলব্ধ ফোনে তোমার জননী বললেনটা কী?
বললেন? বললেন, আমি ভিন্ন আর কে আছে ওনার সাহায্য করতে, বড় বৌয়ের এসে থাকা তার পতিদেবতার ছুটিনির্ভর! অতএব আমাকে সপরিবারে, দিন পনেরোর মতো মায়ের কাছে গিয়ে থাকতে হবে।…যুক্তি অকাট্য। ছেলেমেয়ের পরীক্ষা হয়ে গিয়ে গরমের ছুটি পড়ে যাচ্ছে। আর তাঁর জামাই শাশুড়ির স্নেহছায়া থেকেই অনায়াসে অফিস যেতে পারবে। দরকার হলে শালাবাবু একটা গাড়ির ব্যবস্থাও করে দিতে পারে। গাড়ি বাড়ি কেনাবেচারই তো ব্যাবসা।
অরিন্দম ইত্যবসরে ধড়াচূড়া ছেড়ে বাড়ির সাজ করে ফেলেছে। এবং অভ্যাসগতভাবেই ঘরে বসবার মতো আসন থাকতেও বিছানায় বসে পড়েছে। শুনেই লাফিয়ে উঠে বলে, এ্যা? এই প্রস্তাব দিয়েছেন? মার্ভেলাস! এর থেকে আহ্লাদের ব্যাপার আর কী আছে?
এটা তোমার খুব মনের মতো হলো?
অফ কোর্স। কেন নয়? দিন পনেরো ধরে ভি. আই. পি.র পোস্ট, সংসারের ঝক্কি-ঝামেলা নেই। আধমাসের বাজারখরচ বাঁচছে, অথচ নিত্য চারবেলা ভালো মন্দ’। আহা। বলে দিয়েছো তো খুব রাজি!
দেখো, রাগিও না বলছি, ‘খুব রাজি’। পনেরো দিন ধরে শ্বশুরবাড়ি থাকতে যাবে?
এই দ্যাখো। দোষটা কী? তোমরা মেয়েরা সারাজীবন থাকতে পারো, আর আমরা দু-দশ দিন থাকতে পারবো না? এতোই অপদার্থ ভাবো?
লোকে গায়ে ধুলো দেবে।
ধুলো? কার গায়ে?
কার আবার? হ্যাংলা জামাইটারই গায়ে।
নো। প্রবলেম! স্ফটিক পাত্রে ধুলো লাগে না।…তুমি যে এতো এতো চটে যাচ্ছো কেন বুঝছি না। অন্য মেয়ে হলে তো আহ্লাদে নাচতো। তোমার প্রাণের দাদা বৌদিই বা কী করেন? মাসখানেকও থাকেন না শ্বশুরবাড়ি অথবা বাপের বাড়ি।
টিঙ্কু গোঁজ হয়ে বলে, সে আলাদা, ওরা বিদেশে থাকে। ছুটির সময় চলে আসবে না?
অরিন্দম এখন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, টিঙ্কু। তখন বলেছিলাম না মনে হয় দুটো ভাই-ই তোমার বৈমাত্রেয়। একটু ভুল বলেছিলাম। একটাই। শুধু একটু পাল্টে নেওয়া!
টিঙ্কু আরো গোঁজ হয়ে বলে, মার বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতার জন্যেই—আর যেন কারো ছেলের বিয়ে হয় না। যা করছে, বলার নয়। সব যদি শোনো—তত্ত্ব-টত্ত্ব নিয়ে যা করছেন-
থাক, সব শোনার এখন সময় নেই। সেটা গভীর রাত্রের প্রেমালাপের সময় শোনা যাবে। ছেলেমেয়ের মাস্টারমশাই বোধহয় উঠলেন। ওরা চলে আসছে। তো যাক, তোমার মার ফোন নম্বর পেয়েছো?
পাবো না কেন? আগেই তো শুনিয়েছেন। তো এক্ষুণি ফোন করতে বসবে না কি?
বাঃ। করবো না? এই দণ্ডে জানাতে হবে না, ‘মাদার, আপনার প্রস্তাবে দারুণ রাজি!’ কী জানি বাবা পরে যদি মন ঘুরে যায়। হা হা হা….
এমন হ্যাংলা জামাই বলেই-
অরিন্দম আরো একটু হেসে কৌতুকের গলায় বলে, আরে আসল ব্যাপারটা মনে নিচ্ছো না কেন? এ তো মাছের তেলেই মাছভাজা যাবে।
তার মানে?
মানে তো অতি সরল। হাজার হোক তোমার তো মাত্র একটা ভাইবৌ হচ্ছে? তাকে তো—ইয়ে, ভালোমতো একটু প্রেজেনটেশন দিতে হবে? তো আধমাসের সংসারখরচা বেঁচে গেলে তাতেই খানিকটা উসুল হয়ে যাবে।
টিঙ্কু জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে বলে, তোমার মতন এমন বেহেড ছোটলোকের সঙ্গে যে কী করে এতোদিন ঘর করছি তাই ভাবি।
অরিন্দম নিশ্চিতভাবে বলে, আমিও তো তাই ভাবি।
.
মনে মনে অবশ্য নিশ্চিন্ত থাকে, এখন থেকেই বৌ ভাঁজতে শুরু করেছে দিন পনেরো যাবৎ বিয়েবাড়িতে থাকতে হলে কী পরিমাণ শাড়ি নিতে হবে। স্বভাবটা তো জানা। যে কোনো ব্যাপারেই পাছে বর আপত্তি তোলে, আর তাকে খেলো হতে হয়, তাই নিজেই সে আগেভাগে শোরগোল তুলে নিজের অনিচ্ছে ঘোষণা করে। অতঃপর যেন দায়ে পড়েই করতে বাধ্য হচ্ছে, এইভাবে সেটা করে। ছুটিতে বেড়াতে যেতেও।
হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় অরিন্দমের, অমন সোজা সরল মহিলাটির কন্যেখানির মধ্যে এমন জটিলতা কেন?
এই ‘কেন’টা হয়তো চিরন্তন কালের পৃথিবীর সৃষ্টির একটা অজ্ঞাত রহস্য।
.
মায়ের আকুলতায় বিয়ের কাজকর্মের জন্যে মাঝখানে একবার কী একটা ছুটির সঙ্গে রবিবার জুড়ে যাওয়ায়, সুরজিৎ কর্মক্ষেত্র থেকে চলে এসেছিল। সেই কাজের ধুয়োতেই মায়ের কাছে এসে বলে ওঠে মা, বিয়ের নেমন্তন্নপত্রের কার্ডের নমুনা কী তুমি পছন্দ করবে?
বনছায়া বলে ওঠেন, ওমা। তুই এসে গেছিস, আমি আবার কী করতে? তুই যা বুঝবি।
ঠিক আছে। আজকাল দোকানে বাজারে দারুণ সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের কার্ড পাওয়া যায়। যাক, তোমার নামে ‘দেবী’ লেখা হবে না ‘সরকার’ লেখা হবে?
বনছায়া অবাক গলায় বলেন, আমার নামে? আমার নাম নিয়ে কী হবে?
বাঃ। বাবা নেই, চিঠি তো তোমার নামেই ছাপা হবে।
বনছায়া বলে ওঠেন, কী যে বলিস। একেবারে অনাছিষ্টি কথা। আমাদের তিন কুলে কখনো মেয়েমানুষের নামে বিয়ের চিঠি ছাপা হয় না’।…পুরুষের মধ্যে বংশে যে হেড থাকবে তার নামেই হয়। তা সে—তিন পুরুষের জ্ঞাতি, জ্যাঠা, কাকার নামেও হয়। আর তোদের তো নিজের কাকাই রয়েছে। তার নামেই হবে।
সুরজিৎ আকাশ থেকে পড়ে, ‘কাকা’।
এমনভাবে কথাটা উচ্চারণ করে, যেন একাট দুর্বোধ্য ভাষা শুনেছে।…তারপর উড়িয়ে দেওয়া সুরে বলে, কাকার নামে চিঠি। তুমিই যে একটা অদ্ভুত সৃষ্টিছাড়া কথা বললে মা! কাকাকে তুমি পাচ্ছো কোথায়? কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আদৌ আছেনই কিনা—
ষাট, ষাট। দুর্গা, দুর্গা। বনছায়া শিউরে উঠে বলেন, আছে বাবা! সেই আমেরিকাতেই আছে, তবে মাঝে মাঝে ঠিকানা বদল করে। এখানের ঠিকানা জেনে নিয়েছি।
সুরজিতের মুখ দেখে মনে হয়, ও যেন মঙ্গল গ্রহের কোনো বাসিন্দার কথা শুনছে। হতভম্বের মতোই বলে—
কাকার সঙ্গে যোগাযোগ আছে না কি? চিঠিপত্র চলে? তা সেটা তুমিই করো বোধহয়? লক্ষ্মণ দেবর।
বনছায়া বলেন, জিভুও ওই নিয়ে হাসে, আমায় ঠাট্টা করে। ঠিকানা-টিকানা তো ওকেই লিখে দিতে হয়। তো হ্যাঁরে, ন’নাসে হ’মাসে এক একবার যোগাযোগ করে খোঁজ নেব না? বাড়ির একটা আসল মানুষ তো!
সুরজিৎ বলে ওঠে, জিতু যে যখন তখন বলে ওঠে, ‘মা, তুমি নমস্য’ ঠিকই বলে। বলতে গেলে যে কাকার জন্যে বাবা–
বনছায়া সরল সাদাসিধে। বনছায়ার মন নির্মল। তবু বনছায়ার মনের মধ্যে যেন একটা প্রতিবাদ মুচড়ে উঠলো।…সে প্রতিবাদটাকে ভাষা দিলে এই দাঁড়ায়, হ্যাঁ, ভাইয়ের নিষ্ঠুরতায় আর দুর্ব্যবহারে তোদের বাবার মৃত্যুটা ত্বরান্বিত হয়েছিলো, কিন্তু তার অংশীদার কী তুইও ছিলি না বাবা?…বাড়িটা বিক্রী করে দেওয়ার জন্যে তাঁর ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিলো, সেটা তো তোমার সহায়তাতেই বেশী জোরদার হয়েছিলো…না, ওটা ভাষায় রূপায়িত হলো না। শুধু ভাবটুকু মনে ভেসে উঠল। তাই বনছায়া বিষণ্নভাবে বললেন, সে যার যা নিয়তি।…তবু জিতু একখানা বাড়ি করেছে আর সে বাড়ির নামটাও সেই তোদের ঠাকুমার নামেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে, এই আহ্লাদের কথাটুকু জানাব না?
সুরজিতের হঠাৎ মনে হয়, ওঃ। তাই! বাহাদুরিটা প্রকাশ করা! বিনয়ের ছলে অহমিকা। তবে সেটা সামলে নিয়ে বেজার গলায় বলে, শুনে তিনি কী আর আহ্লাদে অধীর হবেন? হয়তো মনে মনে হেসে ভাববেন, তুমি অহঙ্কার দেখাতেই—
বনছায়া আহত হন।
আস্তে বলেন, ওভাবে মানুষকে বিচার করতে নেই রে, সুরো।…অসময়ে মা-বাপহারা ছেলেটা তো শুনেছি চিরদিনই খামখেয়ালি, খাপছাড়া, একবগ্গা। ওর দাদাও মায়ায় পড়ে কোনো শাসন না করে বাড়িয়েছিলেন। আসলে মনটা নিচু নয়। শুনে আহ্লাদ করে চিঠি দিয়েছিলো। তবে যা করে, ইংরিজিতে। বাংলা লিখতে ভুলে গেছে নাকি কে জানে! জিতু পড়ে আমায় বুঝিয়ে দিলো।…যাক—চিঠি ওর নামেই ছাপা হবে বাবা! চিরকালই এমন হয়। দূরে ভিটেয় বসে থাকা দূর-সম্পর্কের জ্ঞাতির নামেও হয়।
তো এই পর্যন্ত তো হয়েছিলো একরকম।
কিন্তু ওই! আবেগের অতিশয্যে, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা বনছায়া সরকার যে তলে তলে আরো কী করে বসেছিলেন, তা কী তখন কেউ জেনেছিলো? না ভেবেছিলো?
.
তারক বলেছিলো, দিদির বিয়ের আগেই একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসি মাসিমা। নচেৎ বিয়েবাড়িতে আটকা পড়ে যাবো। ফিরে এসে দেখা করি নাই জানতে পারলে, বুড়ি কুরুক্ষেত্তর করবে।
নীহারিকা হাসল। তোর মা কী বুড়ি?
তা বৈ আর কী? ‘মা’ শব্দটাই বুড়িতুল্য, আমি তো এই সার বুঝি! কলকেতার মধ্যেই তো। একটা বেলার জন্যে যাচ্ছি।
নীহারিকা কী ভেবে বলে ওঠে, তো তাহলে আমার হয়ে মাকে বিয়েতে নেমন্তন্ন করে আয়। বলিস, আমি বিশেষ করে বলেছি! যতই হোক পুরোনো লোক তো।
আচ্ছা বলে দেখবো। বড় মানুষের বাড়ির দাসী হয়েছে। মায়ের এখন ফুরসৎ হয় কিনা দেখি। বড় মানুষের হাওয়া গায়ে লাগলেই মানুষের মেজাজ বদলে যায়।
টুসকি শুনতে পেয়ে হেসে উঠে বলে, তারক, তুমি বড়মানুষদের দু’চক্ষে দেখতে পারো না বোধহয় ওই বড়দাবাবুর সঙ্গে থেকে থেকে।
তা হতে পারে। তো তারক আবার ‘তুমি’ হতে গেল কোন্ অপরাধে? অ্যাঁ? ‘তুই’ না ডাকলে মনে হয় রেগে আছেন।
হেসে ওঠে টুসকি। তারপর গলা নামিয়ে বলে, আর কিছুতেই দাদাকে যেতে দিবি না। বুঝলি?
তারক কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে, আমি যেতে দেওয়া না দেওয়ার মালিক?
তুই সঙ্গে সঙ্গে তলপি বয়ে না গেলে, দাদার সাধ্য হবে একা কোথাও থাকতে?
তারক তার উঁচু দাঁতের পাটিটি বিকশিত করে বলে ওঠে, তা পারবে কিনা ভগবান জানে, তবে তারকের তো তেমন ক্ষেত্রে না গিয়ে বসে থাকবার সাধ্য নাই দিদি।
ও বাবা! এ যে একেবারে ভক্ত হনুমান। আমি তো ঠিক করেছি দাদাকে বিয়ে দিয়ে ছাড়বো।
তারক অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলে, তেমন ক্ষ্যামতা হলে বলতে হবে বাহাদুর।
‘বড়দাবাবু বিয়ে করবে’ এমন অধঃপতনের কথা ভাবতেই পারে না তারক। তারকের জীবনও তো তাহলে সেই তালে নিয়ন্ত্রিত হবে? তা হোক। তবে বড়দাবাবুর অমন বাউণ্ডুলে জীবনও অবশ্য আর চায় না-সে। কেন, বে-থা না করা লোকও কী শহরে ভদ্দরলোকের মতন থাকে না? এই তো কবে যেন কে বলেছিলো, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রেথম প্রেথম এই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীদের বে করার রেওয়াজ ছিলো না। তাই হওয়া উচিত। বৌ ছেলেপুলেই হচ্ছে কাজের বিঘ্ন। স্বার্থচিন্তার মূল। দেশের ভালো করতে চাও তো মঠ-মন্দিরের, সাধু-সন্নিসীদের মতো হও বাবা।
তারকের এই মনোভঙ্গী অবশ্য তারক কাউকে খুলে বলে না। তবে তাতেই সে ধারণাবদ্ধ!
.
টুসকি আবার বলে, হ্যাঁরে তারক, কাজলের সন্ধান জানিস?
আশ্চর্য! টুসকির কিনা মনে হচ্ছে, তার বিয়েতে কাজলকেও নেমন্তন্ন করতে পারলে ভালো হতো।
কাজল যদি পালিয়ে গিয়ে হারিয়ে যেতো, তার জন্যে ঘৃণার আর রাগের সঞ্চয় ছাড়া আর কিছু থাকতো না।…কিন্তু কাজল তার সুখী সম্পূর্ণ জীবনের ছবিটি দেখিয়ে গেছে!
সকল জীবনকে অবহেলা করতে বাধে মানুষের। তাকে সম্মান না দিয়ে পারে না। তা সে যতো তুচ্ছই হোক
তারক বললো, আমি আর কোথা থেকে সন্ধান জানবো দিদি? কোনখেনে বাস করা চলছিলো, সে তো দেখেই এসেছেন। তবে বলেন তো এখন খোঁজ করতে পারি। মনে হচ্ছে ‘গণেশ অপেরা’ না কী যেন নামটা ছিলো ওর কোম্পানীর। যাত্রাপাড়ায় খোঁজ করতে পারি। তবে এতোকাল টিকে আছে কিনা কে জানে!
টুসকি লজ্জা পায়।
তাড়াতাড়ি বলে, না রে বাবা, অতোকিছু করতে হবে না। এমনি বলছিলাম।
.
তারক মাতৃসন্নিধানে যেতে যেতে বাসে বসে ভাবে, পিসির বাড়ির ওই ডাক্তার মেয়েটাকে নিয়েই আমার একটু সন্দ। ওর লেগেই না বড়দাবাবু ফেঁসে বসে। মেয়েখানা যে দারুণ! যেমন রূপের আধার তেমন গুণের আধার।…বিয়েতে তো আসবে যাবেও। কী ঘটে বসে কে জানে! মুনি না মতিব্রম না কী যেন বলে।
.
তারকের ‘সন্দ’টা বোধহয় একেবারে অমূলক নয়।…সেদিন থেকেই বাপ্পা নামের সেই ছেলেটার মাথার মধ্যে থেকে যেন সেই কথাটা কিছুতেই বিদায় হচ্ছে না। অবিরাম পাক খেয়ে চলেছে। টুসকির সেই কথাটা।
‘প্রাইজ তো তোমার হাতের মধ্যেই দিদা।…প্রাইজ তো তোমার হাতের মধ্যেই—’
কী সেই প্রাইজ?
অনুক্তই তো ছিলো। তবু যেন শরীরী হয়ে উঠে বাপ্পাকে অস্থিরতায় ফেলে রেখেছে। ….এই মেয়েটা বাপ্পার চোখে চোখ পড়লেই অমন গভীর দৃষ্টিতে তাকায় কেন?
অগ্রাহ্য করে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না কেন?…একেবারে মর্মমূলে কেটে বসে থাকে কেন?
বাপ্পা কী আবার পালাবে?
কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে সেটা কী অতিশয় একটা অমানবিকতা হবে না….
নাঃ। সেটা-এ সংসারের সকলের ওপর ভীষণ একটা বিশ্বাসঘাতকতার মতোই হবে। …টুসকির বিয়েটা পর্যন্ত তাকে থাকতেই হবে।
.
টুসকির বিয়ে উপলক্ষেই হরদম আসছে পাপিয়া। কারণ সে ভিন্ন তার ‘বড়মা’ অচল। আর তার বড়মা’টি.তাঁর পূজনীয় শ্বশুরঠাকুরের শরীর খারাপের চিন্তায় নিশ্চিন্ত হয়ে মা ভাই-এর বাড়িতে থাকতেও পারছেন না। কেবলই যাওয়া আসা চলছে। তার মানে রোজ
একবার করে ধাক্কা।
তার ওই চলাচলের কাণ্ডারী তো ওই সর্বনেশে মেয়েটাই।…
বাপ্পাই বা বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে?
এখানে ওর ঠিক এখন কোনো ‘কাজের’ প্রশ্ন নেই। পার্টির সঙ্গে কতোদিন যেন প্রায় বিচ্ছিন্ন। বড় গোলমেলে সময় পড়ে গেছে বাপ্পার।
.
তারকের মা তার পুরোনো মনিবানীর আমন্ত্রণের মর্যাদা রক্ষায় সেই দিনই তারকের সঙ্গে চলে এলো দেখা করতে। অথবা ত্রুটি মার্জনীয়’র আবেদন জানাতে।
আর কপাল বৌদিদি ওই তারিখেই আবার এখনের মনি বাড়ির কাজ পড়ছে। আসার উপায় নাই। তাই একবার দেখা করতে এলুম। আপনাদের জন্যে এখনো মনটা কেমন করে। দেশ থেকে চলে এসে প্রেথম তো আপনাদের ঘরেই কাজে লেগেছিলুম।…তো মাসিমা কই? মাসিমা মেসোমশাই।…তারকের মুকে শুনলুম আচেন দুজনাই। আহা ভালো থাক। বড়ো ভালো মানুষ।
তারকের মার পরনে এখন আর সরু কালোপাড় কাপড় নয়, অনেকখানি চওড়া পাড় জরির দাঁতের সারি, ফুলপাড় ধনেখালি শাড়ি। গায়ে রঙিন ব্লাউস। হাতে দু’গাছা করে নকল সোনার চুড়ি, গলায় সেই জাতেরই বিছেহার। পায়ে চটি।
রোগা কালো দাঁত উঁচু তারকের মা-টির যে তার ছেলের থেকে বিশেষ তফাৎ ছিলো তা নয়, কিন্তু এখন ছেলের সঙ্গে মায়ের আকাশপাতাল তফাৎ। আকৃতিতে প্রকৃতিতে।
তারকের মায়ের কালো রঙে দিব্যি চেকনাই, শরীরে মেদবাহুল্যের রীতিমত প্রকাশ আর তারকের মায়ের ভঙ্গীতে যেন আভিজাত্যবোধের, আর বেশ একটু মদগর্বের ভাব। …চলনে বলনে ‘আমি একজন’ ভাবের ঘোষণা।
শুধু বড়লোকের বাড়ি বলেই নয়, বহু লোক সমাগমের বাড়ি বলেও। এবং সেই বড় মানুষের গিন্নীর বিশেষ পেয়ারের লোক বলেই সর্বদা তাঁর কাছে কাছে থাকার সুবিধেয় বুদ্ধি চতুরতা অনেক বেড়েছে। গিন্নীর কর্তাটি তো শুধু পয়সার বড় মানুষই নয়, ক্ষমতার বড় মানুষ যে। তার অনুভূতিই আলাদা। এতে নিজেকেও আর পাঁচজন ‘হেঁজিপেঁজি হারিপারির’ থেকে অনেক উঁচু জগতের লোক বলে মনে হয়।
তারকের মা হাতের ভ্যানিটি বটুয়া ব্যাগটি পাশে নামিয়ে রেখে চেয়ারে বসেই গল্প করতে থাকে। চেয়ারে বসবার আগে ইতস্তত মাত্র করেনি।
স্টীলের ছোট্ট কৌটোটি বটুয়া থেকে বার করে একটিপ জর্দা নিয়ে মুখে ফেলে তারকের মা বলে, এই! এই আবার এক বালাইয়ের বদভ্যেস হয়ে বসেছে, গিন্নীর খাতিরে। ‘খা না একটু, খেয়ে দেখ না একটু’ বলে বলে, হাতে ধরিয়ে দিয়ে—তো বলবো কী, এখন আবার ওনার থেকে আমার নেশাটি হয়ে গেছে বেশী। ওনার যদি বা দু-এক ঘণ্টা না হলে চলে, আমার মিনিটে মিনিটে চাই ….
নীহারিকা কী ওই চেয়ার আরোহিণীকে দেখে মনে মনে হাসে? তা তো মনে হচ্ছে না, বরং যেন বেশ একটু সমীহবোধই করে। বলে, আমার ভাগ্যে ঠিক সেইদিনই তোমার মনিবগিন্নীর বোনঝির বিয়ে লাগলো?
তারকের মা গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা, বে কী গো! সে তো বাচ্চা মেয়ে। ইস্কুলে পড়ে। জন্মোদিন। তারই ঘটা।
জন্মদিন। ও মা। তাতে আবার তোমার কী বাধা? ঘটা হলে তো ওরাই যাবে সেখানে নেমন্তন্ন খেতে। তোমাদের কী? বরং রান্নার ছুটি!
আ আমার কপাল। তবে আর বলছি কী!
তারকের মা আর এক টিপ জর্দা মুখে ফেলে বলে, ঘটাপটা তো সবই এ বাড়িতে। কর্তার খুব পেয়ারের শালী যে। ওদের যা কিছু সবই এ বাড়ি থেকেই। এই তো বছর— বছর মেয়ের এই ‘জন্মোদিন’। তাছাড়া মেয়ের মা-বাপের ‘বের দিন’। সেও খুব উৎসব। …..আদিখ্যেতা দেখে হাসবো না কাঁদবো! বুড়ো বয়সে সক্কলের সামনে ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে বেড়ানো। ফটো তোলা। আবার সত্যি বে’র মতন সবাই পেজেনটেশান আনছে। যতো দেখছি ততোই তাজ্জব বনছি।
গিন্নীর তো বোনঅন্ত প্রাণ, কর্তারও আদিখ্যেতার শেষ নাই। ও শালীর সুবাদেই ভায়েরাকেও কী তোল্লা দেওয়া গো বৌদি! ওনাদের পাটি কর্তাদের বলে কয়ে ভায়রার কী বোলবোলাও। গাড়ি বাড়ি বিজনেস করে দেওয়া। নিজেরা যেখেনে যাবে সেখেনেই সঙ্গে ওই শালী, ভায়রার গুষ্ঠি লেজুড়।…আগে এতোটা দেখিনি, যতো দিন যাচ্ছে ততো বাড়াবাড়ির মাত্রা বাড়ছে।…আসলে পয়সার বাড়বিদ্ধি ঘটলে যা হয়। এই চার-পাঁচ বছর কাজ করছি, এই ক’বছরের মধ্যে যেন আঙুল ফুলে কলাগাছ।…এবারের ভোটের পর থেকে তো আরো। …গিন্নী বলে, এর পরের ভোটে কর্তার মন্ত্রী হবার চান্স আছে। তখন তো তালে সোনায় সোহাগা।…তো সত্যি বলতে, আমায় যা মান্যি দেয়, তা বলবার নয়। সকল গল্প আমার সঙ্গে।… আসলে সেই যে ভোটের আগে আমাদের গেরামের ‘মা পাষাণকালীর’ ফুল এনে দিছলুম, আর কর্তা খুব বেশী ভোটে জিতেছিলো, সেই অবধি, ‘মা পাষাণকালী’র ওপর যতো ভক্তি, এই অধম তারকের মার ওপরও ততো ভালোবাসা।…বলেছে সামনের ভোটের সময় আবার ওই ফুল এনে দিতে হবে। জিৎ হলে, আমায় সোনার বিছেহার গড়িয়ে দেবে।…নিজেদের তো যাবার উপায় নাই, লোক জানাজানি হলে না কী খবরের কাগজে উঠে যাবে। লোকে হাসিঠাট্টা করবে। বলবে, অমুক ‘ন্যাতা’র পরিবার এই গাঁইয়াপনা করেছে। ন্যাতা হওয়ার জ্বালাও কম না বাবা! খপর-কাগজওয়ালারা না কী মুকিয়ে থাকে। হবে হ্যাঁ, মধু খেতে হলে হুলটিও খেতে হয়। হি হি। …
বিয়েতে আসতে পারবে না বলে নীহারিকা তারকের মাকে তোয়াজ করে চা-টা খাওয়ায়, যাত্রাকালে আরো একবার দুঃখ প্রকাশ করে, আসতে পারবে না বলে, এবং সিঁড়ি অবধি পৌঁছে দেয়।
.
বাপ্পা নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিলো।
টুসকি ঘরে এসে দেখলো, বইটা মুখের ওপর চাপা। উঠে আলোটা নেভায়নি আলস্য করে। তবে, ঘুমোচ্ছে এমন মনে হলো না।
এসেই বইটা আস্তে সরিয়ে বললো, দাদা, শুনলি?
বাপ্পা চোখ কুঁচকে বললো, কী শুনবো?
ওই যে তারকের মায়ের ভাষণ!
তারকের মা!
বাপ্পা বিরক্তির গলায় বলে, তারকের মার ভাষণ শোনবার জন্যে কান খাড়া করে বলেছিলাম বুঝি? রাবিশ!
টুসকির এখন সাহস বেড়ে গেছে অনেক। আজ বাদে কাল পরের ঘরে চলে যাবে।…. তাই সাহসে ভর করে বলে ওঠে, আহা, ওই ‘সানাইকণ্ঠী’ মহিলার কথা শোনবার জন্যে কী আর কান খাড়া করে থাকতে হয় রে? বরং শুনতে শুনতে মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। চার বছরের মধ্যে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’।… ভায়রা-ভাইয়ের অবধি বোলবোলাও। গাড়ি বাড়ি বিজনেস। নিজের একখানার ওপর আরো একখানা গাড়ি। এবার ভোটে নির্ঘাৎ মন্ত্রী হবে।
হবে তো তোর এতো আহ্লাদ কিসের?
আহ্লাদ? আহ্লন্দ কী রে? বরং দুঃখে প্রাণ ফেটে যাচ্ছে। কী মাকাল ফলের পিছনে ছুটে মরে নিজের জীবনটা বরবাদ দিলি তুই। ওই—তারকের মার মনিবকর্তার কাছেই তো যাওয়া আসা ছিলো তোর! ছিলো না?…তোদের সবাই আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেরে। শুধু তোর মতো দু-দশটা বোকাই বোধহয় এখনো সর্বহারার ভূমিকায় রয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গ থামাবি?
তা তুই রেগে গেলে থামাতেই হবে। তবে মনের দুঃখেই বলি রে। অন্ধকার পথে আলেয়াটাকে জ্যোতির্ময় আলো ভেবে তার পিছনে ছুটতে ছুটতে পুরো বয়েসটাই বৃথা ফুরিয়ে গেল।
বাপ্পা বিদ্রূপের গলায় বলে, ওঃ। তাহলে সার্থকটা হতো কিসে? আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে?
মোটেই তা বলছি না দাদা। বলছি ভ্রান্ত পথে এগোতে এগোতে অনেকখানি সময় বৃথা চলে গেল। এখন তো দেখছিস, মানে যদি এখনো অন্ধ না থাকিস, তোদের মতোদের চলার পথে আর কোনো সঙ্গী থাকছে না। জীবনের সবচেয়ে ক্ষতি কী হয়েছে জানিস? ‘মানুষের ভালো করবো’ সংকল্পে মানুষ শব্দটার অর্থই হারিয়ে ফেলেছিস তোরা!…মাঝখান থেকে পদ্ধতির ভ্রান্তিতে ভালোবাসতেই ভুলে গেছিস তোরা। শুধু পদ্ধতির মাধ্যমে কারো ভালো করা যায় না দাদা। সব আগে তাকে ভালোবাসতে হয়রে।…তো তোদের অভিধানে তো মায়া-মমতা-ভালোবাসা এইসব শব্দগুলো অবান্তর, বাতিল।…মানে তোদের মতো কট্টরদের। …..হিহি—যারা অতো শুচিবাইয়ের ধার ধারে না তারা শালীপতিকেও ভালোবেসে তার আখের গুছিয়ে দিতে পারে।
হুঁ। এতো সব কথা বুঝি তোর নতুন গুরুদেবের কাছে শিখেছিস?….
একটু ব্যঙ্গের গলায় কথাটা বলে বাপ্পা।
টুসকি জোর গলায় বলে ওঠে, মোটেই না। আমি তোদের মতো ‘গুরুভজা’ নই। বিদ্যেবুদ্ধির বালাই না থাকুক, নিজস্ব বোধবুদ্ধি তো আছে একটা।…আর তোর জন্যেই, এইসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে মরে চলেছি। এখন আবার সেই মেয়েটার জন্যে ঘামিয়ে মরছি।
বাপ্পার ভুরুটা আবার কুঁচকে ওঠে, মেয়েটা? মানে?
মানে? সেটুকু বোঝবার অনুভূতিটুকুও কী বজায় নেই রে দাদা? সত্যিই কী তোদের সাধন পদ্ধতিতে শুধু মগজ ধোলাইয়েরই প্রেসক্রিপশান নয়, হৃদয় ধোলাইয়ের প্রেসক্রিপশান থাকে? যে মেয়েটা তোর জন্যে মরছে, তাকে দেখতে পাস না?
.
সানাই বাজছে। এখন উৎসব-সন্ধ্যার প্রাণমাতানো সুর।
এই সানাই থেকেই যে আগামী সকালে ‘কন্যাবিদায়ের’ সেই চিরপরিচিত বুকমোচড়ানো করুণ সুরটি উঠবে, এখন সেটা মনে আসছে না।
এখন চারদিকে আলোর সমারোহ, সৌরভের সমারোহ, সুঘ্রাণেরও সমারোহ। সমারোহ, সুসজ্জিত নরনারী বালক-বালিকা শিশু-বৃদ্ধেরও। বাঙালী ঘরের মেয়ের বাপ হচ্ছে একদিনের রাজা। সারাজীবন টানাকষা করে কাটিয়ে আসারও এই একটি দিন, মেজাজে রাজার মেজাজ।
আদিত্য গাঙ্গুলী আর নীহারিকা গাঙ্গুলীর আবার বাড়তি একটা কারণ যোগ হয়েছে। মেয়ের বিয়েতে পাত্রপক্ষের যে শুধু চাহিদাই নেই তা নয় উল্টে করজোেড় মিনতি, অহেতুক বেশী কিছু দিতে বসবেন না।
কনের মায়ের কাছে বনছায়ার নম্র বিনয়ী ভাষণ, আপনার একটি মাত্র মেয়ে, আপনি আপনার সাধ শখ মেটাবেন, আমি বারণ করতে আসবো, সাহস করছি না ভাই, তবে এখন তো আত্মীয়জনই হয়ে গেছি, তাই বলছি, মেঘলার বাবার শরীর ভালো নয়, ওনাকে চাপ না দেওয়াই উচিত আমাদের, তাই নয় কী ভাই? আমার ওই খেয়ালি বাউণ্ডুলে ছেলেটা যে বিয়েয় রাজি হয়েছে, এই আহ্লাদে আমিই বেআন্দাজী অনেক কিছু কিনে জমিয়ে বসেছি। আবার তার ওপর—বাহুল্য হয়ে যাবে।…মেয়ে-জামাই, তাদের দেওয়াদিয়ি তো পালিয়ে যাচ্ছে না, পরে যখন যা-ইচ্ছে দিতে মন চাইলে দেবেন। এখন একসঙ্গে ঘাড়ে অনেক পড়ে গেলে অসুবিধে তো! এমনিতেই বরযাত্রীর সংখ্যা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে বলেই ছেলেটা আমায় খুব ঠাট্টা করছিলো। বলে কিনা, ‘নারদের নেমন্তন্ন’টি করে এক নিরীহ ভদ্রলোকের দেউড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে দায়টি সেরে নিচ্ছো কমন?
নীহারিকা অবশ্য তাতে ‘না না, সে কী? পঞ্চাশ-ষাটজন আবার বেশী কী’ বলে তাঁকে থামিয়েছেন। তবে ওই ‘কিছু দেবেন না’ শব্দটির প্রেরণাতেই উৎসবে অবস্থার অধিক আতিশয্য এসে গেছে।
তাছাড়া—বাপ্পা ফিরে আসার আহ্লাদটিও বুকে বল জোগাচ্ছে। আর বিয়ের সময় তো দেখা যাচ্ছে টুসকি শুধু একা নীহারিকারই নয়, সে তার ঠাকুমা-ঠাকুর্দারও। তার পিসিরও তার চির যোগীন নীলুমামারও।
আমন্ত্রিতদের জন্যে আসর বসানো হয়েছে কাছের ‘স্কুলমাঠটার’। যেখানে ছেলেরা খেলে। তবে এখন গ্রীষ্মের ছুটি, তাই মাঠটা সহজে মিলেছে।……
ডেকরেটারদের নিপুণ শিল্পকৃতি ‘তোরণ টার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে পাপিয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। জানে তাদের বাড়ির সব্বাই এসে গেছে, বড়মাকে লীডার করে। তারই একটু কাজ ছিলো, তাই এখন এলো বাবার সঙ্গে। অথচ বাবা গাড়ি থেকে নেমেই যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন।
পাপিয়ার ‘কারো সঙ্গে আসাটা শুনতে অবশ্য নতুন। তার সঙ্গেই রোজ আসা যাওয়া করছেন তার ‘বড়মা’ এ বাড়ির কন্যে টুনি। কিন্তু আজ পরিস্থিতি আলাদা। আজ পাপিয়ার অঙ্গে বিশেষ সাজপোশাক।
টুসকি বলে রেখেছিলো, এই তোমাকে কিন্তু আমার বিয়েতে ভীষণ সেজে আসতে হবে তা বলে রাখছি। না হলে—জন্মের আড়ি।
পাপিয়া যে সাজগোজে একেবারে নারাজ, বিয়েবাড়িতে ও সাদাসিধেভাবে যেতে চায়, তার বড়মার এই আক্ষেপ থেকেই টুসকির এই ঘোষণা।
পাপিয়া হেসে ফেলে বলেছিলো, ‘ভীষণ’ সাজতে হবে? ও বাবা। তো প্যাটার্নটি কী? তাড়কা? না পুতনা?
এই, বাজে বকবে না বলছি।
বলে টুসকি ওর হাত ধরে বলেছিলো, না ভাই, সত্যি, খুব সুন্দর করে সেজে আসবি আমার বিয়েতে।
বাঃ। তোমার বিয়েতে, তুমিই তো সাজবে। অন্যরা কী করেছে না করেছে সেটা দেখবারই কী সময় পাবে তুমি?
পাবো। পাবো!…সুন্দর জরিদার একটা লাল শাড়ি পরবি—আর-
লাল। সর্বনাশ! আমায় কাটলেও হবে না ভাই।
বাঃ! এখানে তো আর তুমি ‘ডাক্তারবাবু’ নও?
না হোক। লাল জামা, লাল শাড়ি আমি কক্ষণো পরি না বাবা!
টুসকি কৌতুকের হাসি হেসে বলেছিলো, কেন? একেবারে সেই মহামোক্ষম দিনটির জন্যে রিজার্ভ রেখে দিয়েছো? ঠিক আছে, তাহলে সবুজই সই। অথবা চকোলেট কালার। তবে সিল্ক আর জরিদার হওয়া চাই। তুই যা ফর্সা, যে-কোনো রংই গায়ে ঝলসে উঠবে।
হলদে সবুজ ওরাং ওটাং জাতীয় শাড়িই নেই আমার।
বলে হেসেছিলো পাপিয়া
টুসকি অবশ্য সেকথা গায়ে মাখেনি। বলেছিলো, দরকারের সময় ‘লোন’ নেওয়ার নিয়ম আছে। তোদের বাড়ি হাতড়ালে অমন দশ-কুড়িখানা পেয়ে যেতে পারিস। তোর কাকীদের দিদিদের বৌদির—লক্ষ্মীটি ভাই
ঠিক আছে, তোমার যখন এতোই সাধ। তবে সাধটার মর্ম বুঝছি না। আর ওই স্পেশাল শাড়ির সঙ্গে ‘সর্বালঙ্কার ভূষিতা’ও হতে হবে এমন সাধ নেই তো বাবা!
না না, সে তুই যা ভালো বুঝবি। তবে খোঁপায় একটা ফুলের মালা কম্পালসারি। ব্যস। নড়চড় চলবে না। যদি দেখি সেটার অভাব নিজের মালা বদলের মালাটাই নিয়ে জড়িয়ে দেব তা বলে রাখছি। একটা সীন ক্রিয়েট হোক এটা চাস না নিশ্চয়?
কখনো ‘তুমি’, কখনো ‘তুই’।
টুসকি যে দীর্ঘদিন ধরে পাপিয়াকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিনী ভেবে বিদ্বেষ চোখে দেখে এসেছে, সে সন্দেহের নিরসন ঘটায় টুসকির যেন এখন বিরূপতা গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের মনোভাব। তাই এতো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে তাকে। তা ছাড়া—এখন ভিতরে অন্য এক অভিসন্ধি।…দাদাটাকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিতে চায়।
কী সুন্দর লাবণ্যময়ী মেয়ে! মুখে যেন একটি দেবী দেবী ভাব। প্রকৃতিও আকৃতির মতোই সুন্দর। তাছাড়া— বিদ্যে’ বলতে গেলে একটি দুর্লভ রত্ন।…বোকা-বুদ্ধ দাদাটা অন্ধের মতো এ হেন রত্নটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কাঁটাবনে ঘুরে বেড়িয়ে জীবনটা বরবাদ দেবে?…মানুষের ভালো করতে চাস কর না বাবা। তার জন্যে—একটা মার্কামারা খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকতে হবে তার কী মানে আছে? যারা তোদের মতো বোকাদের বিরাট একখানা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে, শক্তিবৃদ্ধি করে নিজেদের আখেরটি ভালোমতো গুছিয়ে নিচ্ছে, এখনো তাদের কাছে বিশ্বস্ততার প্রশ্ন কেন? তাঁরা গজদন্তমিনারে উঠে গেছেন, আর তোরা এখনো কাঁটবনে পাক খাচ্ছিস।…বুঝতে পারছিস না সেই একদা ‘বিপ্লব’ নামের ধোঁকার ডালনার বালতিটি দেখিয়ে দেখিয়ে পরিবেশনের ভান করে তোদের আকৃষ্ট করেছেন। …পাপিয়ার মতো একাট ভালো মেয়েকে জীবনের সঙ্গিনী করতে পারলে, তোর মানুষের ভালো করার ব্রতটা ব্যাহত হবে না, বরং পূর্ণতাই পাবে। তায় আবার ও ডাক্তার। একজন সত্যিকার সেবাব্রতী ডাক্তারকে কাছে পাওয়া কী কম সৌভাগ্য আর সুবিধে!
অবিরত এইসব ভেবে চলেছে আজকাল মেখলা।
আসলে—বাপ্পার জীবন থেকেই তার মধ্যে এই ধরনের চিন্তা-ভাবনার উদ্ভব। এখন নিজে তার ঈপ্সিত জীবনটি পেতে চলেছে বলেই বুঝি ভিতরে এসেছে একটি দায়বদ্ধতা।…
দাদার জীবনটা সহজখাতে বইছে দেখলেই যেন স্বস্তি পায় টুসকি। ছোড়দা তো যা ভালো বুঝেছে করছে। তার জন্যে ভাবনাচিন্তার প্রশ্ন নেই। কিন্তু দাদার কথা আলাদা। পাপিয়ার হৃদয়ের খবরটি জানা পর্যন্তই টুসকির মধ্যে এই আকুলতা। যেন একটা অবোধ লোক পথে চলতে পথের ধারে পড়ে থাকা একটা পরম মূল্যবান বস্তুকে পায়ে ঠেলে চলে যাচ্ছে অন্যমনস্কভাবে, ছুটে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে তার দামটা কী!
এতএব আর কী?
চিরন্তন নারীহৃদয়ের গোপনতম রহস্য।
মোহিনী মায়া!
হ্যাঁ। চিরকালীন মেয়েমন জানে ওইখানেই তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। আজকের মেয়েরাও বিদ্যায়-বুদ্ধিতে দক্ষতায় কর্মকুশলতায় মেধায় প্রতিভায় যতোই স্বাক্ষর রেখে চলুক, ভিতরে ভিতরে কিন্তু শেষ আস্থাটি রাখে অনাদত্তকাল সেই ব্রহ্মাস্ত্রটির ওপর। জয় করে নেবার মোক্ষম হাতিয়ার।
কেনই বা নয়? সে কী জানে না—কার কাছে—’মুনিগণ ধ্যান ভাঙি, দেয় পদে তপস্যার ফল’।….
সে কি গুণের কাছে?
টুসকি নামের সেই চিরকালীন মেয়েমনের মেয়েটা ভেবে ঠিক করেছে, রোসো না, বেখেয়ালি বুদ্ধ দাদাটার মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিয়ে ছাড়ছি।
এদিকে টুসকির গোপন অস্ত্র পাপিয়া নামের সেই মেয়েটা, এই গরমের সময় অনভ্যস্ত সাজে সেজে এসে হঠাৎ বোকার মতো একা দাঁড়িয়ে পড়ে ঘেমে অস্থির।
কী মুশকিল। প্যান্ডেলের কোন্ দিকটা দিয়ে ঢুকতে হবে? বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভিতরে কাপড়ের ঘের দিয়ে ভাগ গোছের একটা হয়েছে। যার একদিকে শুধুই বসবার, অপর দিকে খেতে বসবার ব্যবস্থা।
হঠাৎ ঢুকে পড়ে যদি সাজানো টেবিলের সামনে গিয়ে পড়ে? এ মা। ছি ছি।…ফুলের আর পারফিউমের সৌরভ-সারটি আসছে কোনদিক থেকে আর কোনদিক থেকেই বা রসনাতৃপ্তিকর খাদ্যসম্ভারের সুঘ্রাণের, তা বোঝা যাচ্ছে না। সম্মিলিত সুগন্ধভার, ভিতরে ঘূর্ণমান পাখাগুলোয় বাহিত আর তাড়িত হওয়া বাতাসকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।….
নাঃ। বাবার যে এখন কোনদিকে কী কাজ পড়লো!
বিষণ্ণ মুখ পাপিয়া এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ সামনে তাকিয়ে প্রায় কেঁপে উঠলো। কী লজ্জা! কী লজ্জা! ওর সামনে এই সাজে!
কিন্তু যার জন্যে এই লজ্জা সে কী ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে তাকালো?
না! হঠাৎ অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। হয়তো মুহূর্ত মাত্ৰই।
তারপর বোধহয় অজ্ঞাতসারেই বলে উঠলো, আরে। দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে তো তোমায়!
.
আরে দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে তো তোমায়……
দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে তো তোমায়!… দারুণ সুন্দর…দারুণ সুন্দর…।
কথাটা কী পাপিয়ার কানের পর্দায় ধ্বনিত হলো? আর সোট প্রতিধ্বনিত হয়ে চললো!…..
নাকি পাপিয়ার মনের পর্দায়? সেখানেই ধ্বনিত হয়েছে, আর ধ্বনিত হয়ে চলেছে? ‘দারুণ! সুন্দর!! দারুণ সুন্দর। দারুণ…….
মা-ঠাকুমা-বোনের একান্ত নির্বেদে বাধ্য হয়েই আজ বাপ্পাকে বিয়েবাড়ির উপযুক্ত সাজে সাজতে হয়েছে। ফাইন কল্কাদার মুগার পাঞ্জাবি, আর আলিগড়ি পায়জামা। নিখুঁতভাবে কামানো নির্মল মুখ, চুলে পড়েছে চিরুনির স্পর্শ।…পাবনার সত্যব্রত উকিলের ডাকসাইটে চেহারার খানিকটা উত্তরাধিকারী তাঁর বড় নাতিটিকে এখন দেখাচ্ছে যেন রাহুমুক্ত শশী। বেশ কয়েকদিন বাড়ির মধ্যে বিশ্রামে থাকায় বাপ্পার চামড়ার ওপর স্থায়িভাবে পড়ে যাওয়া তামাটে কোটিংটাও যেন অনেকটাই বিলীন!…
ওই দীর্ঘোন্নত উজ্জ্বল মূর্তিটির দিকে চেয়ে, পাপিয়ার ভিতরও ওই শব্দটাই ধ্বনিত হতে চাইছিল, ‘দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়।’
তাই বুঝি পাপিয়ার বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো, ধ্বনিটা কানের পর্দায় ধাক্কা দিলো, না মনের পর্দায়! তবে সামলে নিতেও দেরী হলো না। বলে উঠলো, এদিকে অবস্থাটি নিদারুণ! উঃ। এই গরমে মানুষ এতে সাজতে পারে? এদিকে বিয়ের কনে ভয় দেখিয়ে রেখেছে দারুণ, একখানা সাজ না করে বিয়েবাড়িতে এলে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তাই অন্যের কাছে ধার-কর্জ করেও কাজ চালাতে হলো!
একসঙ্গে এতোগুলো কথা কী বলে পাপিয়া? অথবা বলতো কী এখন? যদি না ওই মুগ্ধ মন্তব্যের মুখে পড়তে হতো! লজ্জা ঢাকতেই কথার চাস!
বাপ্পা অবশ্য বলে ফেলে খেয়াল করেনি, এটা হচ্ছে মুগ্ধতার উচ্ছ্বাস!…তবে বুঝতে পারলো পাপিয়া লজ্জা পেয়েছে। না বোঝবারও কারণ নেই অবশ্য! পাপিয়ার দেহের সমস্তটুকু রক্তই যে তার মুখের চামড়ায় এসে আছড়ে পড়েছে।
তাই বাপ্পা মুখে আসা কথাটা বলতে পারলো না ‘আসলে ভীষণ মার্ভেলাস লাগছে কিন্তু, চুলের খোঁপা না কিসে ওই মোটা ফুলের মালাটায়।
বললো না। তার বদলে বললো, দেখো না আমার ওপরও ওই হুকুম চালানো হয়েছে! শুধু একবার মাত্র পরবার জন্যে মা এতোগুলো টাকা খরচা করে এইসব—
পাপিয়া এখন সহজভাবে বলে উঠতে পারলো, বাঃ! একদিনের জন্যে কেন? এ তো সবসময়ই পরে ছেলেরা।…আমাদের মেয়েদের শাড়ির মতো তো আর জরিটরি নেই। … কিন্তু বাবাকে দেখেছো বাপ্পাদা?
বাবাকে? মানে—তোমার? কেন অনেকক্ষণ আগেই তো মনে হলো পিসেমশাইরা— সবাই—
হ্যাঁ, আর সবাই তো বোধহয় সেই কখন! আমি আর বাবাই এখন—তো হঠাৎ যে কোনদিকে—আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না কোন্ দিক দিয়ে ঢুকবো!
বাপ্পার হঠাৎ এ কী দশা হলো?
বাপ্পার কেন আরো একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে? যেটা চিরকাল তার স্বভাবের বিপরীত। বাপ্পার দৃষ্টিটা যেন ওই লাবণ্যময়ী মেয়েটার লাবণ্যে আটকে গেছে।
তাই বাপ্পা বলে ওঠে, আমার অবস্থাও প্রায় তাই। শিলুটা তো হরদমই ঘুরছে, অথচ আমি—বাবাঃ। একটা বিয়েয় এতো ভয়ঙ্কর সব কাণ্ড!
পাপিয়া আস্তে একটু হেসে বললো, এক হিসেবে বিয়েটাও তো একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড! একটা মেয়েকে তার আজীবনের মাটি থেকে শিকড়সুদ্ধু উপড়ে নিয়ে অন্য মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ব্যবস্থা!
বাপ্পা তার সহজাত ভঙ্গীতে খপ করে বলে ওঠে, তবু তো মেয়েগুলো বিয়ের জন্যে মরে-
হ্যাঁ, এমনি দুমদাম একটা কথা বলে বসাও মূলত স্বল্পভাষী ছেলেটার চিরকেলে স্বভাব। …..ছেলেবেলায় ওর কথার ফলে নীহারিকাকে কী হঠাৎ হঠাৎ কম অপদস্থ হতে হয়েছে? অতিবাল্যেই অবশ্য ও অনায়াসে বলে বসতো, ‘হ্যাঁ, এখন তো বাবাকে বেশ ভক্তি হচ্ছে, আর যখন বাবা থাকেন না, তখন কেবল নিন্দে!’…বলে বসতো, ‘দিদার ওপর কথা বলছো যে? দিদা তোমার গুরুজন না? আর আমি একটু তোমার ওপর কথা বললেই যতো দোষ!’…আবার যখন তারকের মা এ বাড়িতে বাসনমাজুনি ছিল, তখন হয়তো তার কামাইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলে উঠতো, ‘তারকের মা, তোমার তো সত্যি জ্বর হয়েছিল? হয়নি? আর মা বলেন কিনা, জ্বর না হাতি! ইচ্ছে করে আসেনি।’
তা এতো বড়ো হয়েও স্বভাবটা নির্মূল হয়নি। তাই ফট করে বলে বসে, তবু তো মেয়েগুলো বিয়ের জন্যে মরে—
তবে এখন বলে অপ্রতিভ হয়ে যায় নিজেই! কারণ একজোড়া মর্মভেদী দৃষ্টি তার মুখের ওপর স্থির হয়ে গেছে তার কথায়।
মেয়েমাত্রই বিয়ের জন্যে মরে! তোমার বুঝি তাই ধারণা বাপ্পাদা?
বাপ্পা যেন কেঁপে ওঠে। এই মেয়েটার দৃষ্টিটা হঠাৎ হঠাৎ এমন গভীর আর স্থির হয়ে যায় কেন? মনে হয় কেন, ওই স্থির দৃষ্টির অন্তরালে সর্বদাই থাকে একটা ক্ষুব্ধ ভর্ৎসনা!
বাপ্পা অনায়াসেই অবজ্ঞার সুরে বলে উঠতে পারতো, তাছাড়া আবার কী? তাই তো দেখি!’ এমন বলাটাই তো তার স্বভাবে খাপ খেতো। কিন্তু বাপ্পা তখন আর তার স্বভাব অনুযায়ী কথা বলতে পারলো না। একজোড়া ক্ষুব্ধ চোখ কোনখানে যেন কেটে বসে গেছে। বসে রয়েছে।
বাপ্পা তাই তাড়াতাড়ি বললো, মানে সব্বাই কী আর? মানে—এই রে—আবার কারা এলো মনে হচ্ছে। গাড়ি দাঁড়ালো একটা।
বাপ্পা তার পরিত্রাতা গাড়িখানার দিকে এগিয়ে গেল।
অনেক আহ্লাদ অনেক বিষাদ, অনেক প্রাপ্তি অনেক হতাশা, অনেক উজ্জ্বল হাসি অনেক গোপন অশ্রুর বিচিত্র সুতোর টানাপোড়েনে বোনা তাঁর বহুদিন লালিত ‘উৎসব মুখর দিনগুলি পার করে বনছায়া সবেমাত্র যখন তাঁর স্বপ্নের ছাঁচে গড়ে ওঠা সংসারটিকে হাতের মধ্যে পেতে চলেছেন, যখন বাড়িতে শুধু বনছায়া আর তাঁর সদ্যবিবাহিত ছেলে-বৌ, ঠিক সেই মহামুহূর্তে সেই বোমাটি ফাটলো। যেটিকে বনছায়া নিতান্তই খেলার বল ভেবে নিশ্চিন্তে ফেলে রেখেছিলেন!
বোমাটার আপাত চেহারা নিরীহ একখানা চিঠি। যার আধারে দূর বিদেশের ডাকটিকিট আর ডাকের ছাপ! যেটা পেয়ে বনছায়া হেসে হেসে বলেছিলেন, ‘ওরে জিতু, দ্যাখ, ভাবি যে তোর কাকা বুঝি বাংলা লিখতে ভুলেই গেছে। ভোলেনি, তবে হাতের লেখাটি এখন দেখছি প্রায় সদ্য লিখতে শেখা ছোট ছেলের মতো। লাইন আঁকাবাঁকা, অক্ষরগুলো গোটা গোটা বড় বড় আর নানান সাইজের। বাংলা না লিখে লিখেই —
যুধাজিৎ একবার তাকিয়ে দেখে হেসে বলেছিল, ভাষাও তো প্রায় বালসুলভ।…তো তুমি কাকাকে তোমার ছেলের বিয়েতে আসতে বলেছিলে নাকি?
বনছায়া অপ্রতিভভাবে বলেন, সে কী আর সত্যি বলা? একটু তো বলতেই হয়। শুধু বিয়ের খবরটি দিয়ে, আর ‘তোমার নামে চিঠি ছাপতে দেওয়া হয়েছে’ বলেই দায়সারাটা জলো দেখায়? লিখেছিলাম ‘সেই যে দেশ ছাড়লে, সত্যিই একেবারে বিদেশী হয়ে গেলে। বিয়েতে যদি আসতে কতো আনন্দ হতো!”
যুধাজিৎ হেসে উঠে বলেছিল, সাধে বলি, জননী তুমি নমস্য! সেই কাকাকে! পারোও বা।
বনছায়া কুণ্ঠিত হাস্যে বলেছিলেন, তা যতোই হোক বাপু, আপনজন তো বটে।
ঠাট্টার হাসি হেসেছিল যুধাজিৎ, ‘আপনারা না। তা বটে। খুবই আপনজন! তবে আমার তো সে ভদ্রলোকের চেহারাখানাও আর এখন ভালো করে মনে পড়ে না। তোমার মনে আছে?
বনছায়া তখন লজ্জা ত্যাগ করে সজোরেই বলেছিলেন, কী যে বলিস! মনে থাকবে না? বিয়ে হয়ে যখন তোদের বাড়িতে এলাম তখন একমাত্র ওই ছেলেটাই তো ছিলো আমার সঙ্গী! তোর দাদা তো সর্বদা ঘ্যানঘেনে রুগ্ন একটা দু’বছরের মাত্র ছেলে! তাকে নিয়েও তো—থেমে গিয়েছিলেন বনছায়া।
কোনোভাবে যদি এমন প্রসঙ্গ এসে পড়ে, যাতে প্রকাশ পায় ‘বড় ছেলে’টি তাঁর আপন গর্ভজাত নয়, তাহলেই থেমে যান।
যুধাজিও সেটা বোঝে। তাই কথায় তেমন প্রসঙ্গ আনে না। বরং সবসময় ‘তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্তুরটি বলে উল্লেখ করে। এখন মাকে অপ্রতিভ হতে দেখে তাড়াতাড়ি হেসে উঠে বলে, বিয়ে হয়ে তুমি ‘আমাদের বাড়িতে’ এলে? হো-হো-হো! আমি তখন কোথায় মা?
তুই? তুই তো—বনছায়া একটু কৌতুকের হাসি হেসে বলেন, তখন ‘ইচ্ছে’ হয়ে.ছিলি মনের মাঝারে।… তা হলেও বাড়িটা তো তোদেরই বাড়ি। সরকার বাড়ি!
যুধাজিৎ চিঠিটায় আর একবার চোখ ফেলেছিল। সত্যি বলতে—ভাব-ভাষা দুটোই বালসুলভ।
‘…আপনি যে আমায় মনে রাখিয়াছেন, ইহাতে আমি যারপরনাই সুখী হইয়া আছি। আর পুত্রের বিবাহে আমি যাইলে খুশী হইতেন জানিয়া প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়াছি। আপনি একজন মহতী দেবী! আপনি আমার নমস্কার নিবেন। ক্ষমতা থাকিলে যাইতাম। অর্থ সামর্থ্য কোনো ক্ষমতাই নাই। ইতি—হতভাগ্য বিদ্যজিৎ।’
বনছায়া বলেছিলেন, চিঠিতে আবার ‘আপনি’ করে লিখতে গেছে কেন? ‘তুমি’ করেই তো বলতো।
যুধাজিৎ হেসে উঠে বলেছিল, এখন বোধহয় আপনি যে একজন ‘মহতী দেবী’ সেটা অনুভব করে।
ওই পর্যন্তই। চিঠিখানা মেয়েকে আর বড় ছেলেকে একটু দেখাবার ইচ্ছে হলেও, দেখাতে তেমন সাহস করেননি। হয়তো ওই থেকেই আবার নতুন করে কটুক্তি সমালোচনা হতে পারে লোকটার নামে। সুরজিৎ তো আবার নিজের সে সময়কার ব্যবহারের ব্যাপারটি ঢাকতে বেশী করেই ধিক্কার দিতে বসবে। যুধাজিৎও বলে বটে, তবে হেসে হেসে। ওদের মতো কাকা সম্বন্ধে মনে অতো বিদ্বেষ নেই ওর। মনে হয় আসলে ‘বিদ্বেষ’ জিনিসটাই তেমন নেই যুধাজিতের মধ্যে। হয়তো বা যেটুকু দেখা যায় সেটুকু সাময়িক! তা সে যে কোনো ক্ষেত্রে, যে কারো সম্পর্কে।
বনছায়ার প্রকৃতির কিছুটা পেয়েছে ছেলে যুধাজিৎই, মেয়ে শুভশ্রী নয়। মেয়ে যেন সর্বদাই সকলের প্রতি বিদ্বিষ্ট। ভারী আশ্চর্য লাগে বনছায়ার। ভগবান তো ওকে কোনো বিষয়েই বঞ্চিত করেননি, তবু কেন ভিতরে ভিতরে বিশ্বসংসারের প্রতি বিদ্বেষ বিরূপ ভাব। ‘মেয়ে আসছে’ বলে উৎফুল্ল হন, কিন্তু এলে যেন কাঁটা হয়ে থাকেন, কখন কী কারণে তার মেজাজ খচে যায়। নেহাৎ তুচ্ছ কারণেই যায়।
ওই চিঠিখানা তাই দেখাবো ভেবেও আর কাউকে দেখাতে যাননি বনছায়া। শুধু যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন। যত্নের কারণ নেহাৎই তুচ্ছ। এ যাবৎ বাংলায় কিছু লেখেনি লোকটা তাই! কিন্তু সেই নিশ্চিন্তে তুলে রাখা বস্তুটাই বোমা ফাটিয়ে বনছায়াকে হতভম্ব করে দিলো।
যুধাজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো ভয়ে ভয়ে বললেন, কী হবে তাহলে জিতু?
যুধাজিৎ কষ্টে আত্মসংবরণ করে বলে, কী আর হবে, পূজনীয় খুড়োমশাইকে সসম্মানে রিসিভ করে নিয়ে আসতে এখনি এয়ারপোর্টে ছুটতে হবে।
হাতের টেলিগ্রামখানায় আর একবার চোখ ফেলে বলে, যা দেখছি, তাতে তো এক্ষুণিই যাওয়া দরকার! প্লেন এসে পড়বার টাইম হয়ে গেছে।…তবে ভেবে পাচ্ছি না, অবস্থাটা কী দাঁড়াবে! বলে চলে যায়।
ছেলেকে এতো বিচলিত হতে আর কখনো দেখেননি বনছায়া।…তাই নিজেও ভীষণভাবে ভীত আর বিচলিত হচ্ছেন। বেচারী তিনি। কী করে ভাববেন, তাঁর সেই সামান্য সৌজন্যটুকুর ফলটি এমনভাবে তাঁর ওপর গদা হয়ে এসে পড়তে চাইবে!
দিল্লী থেকে প্রেরিত ওই গদাতুল্য দীর্ঘ টেলিগ্রামখানির সারাংশ এই, ‘জীবনযুদ্ধে পরাজিত আর বহুভাবে বহুজনের কাছে প্রতারিত হতভাগ্য ‘ডি. সরকার’ নামের লোকটা এখন আপন ভুলের জন্য একান্ত অনুতপ্ত, এবং তার পরিপ্রেক্ষিতেই নে এখন তার পরিত্যক্ত মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চায়। নানা ব্যাধিতে জীর্ণ জীবনের প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তাই সেই সংক্ষিপ্ত শেষটুকুকে নিয়ে চলে আসছে দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে—তার ‘শেষ আশ্রয়’ দেবীসদৃশ বৌদির কাছে।…অবস্থা—কপর্দকশূন্য। কোনোমতে ওয়াশিংটন থেকে দিল্লীতে এসে পৌঁছে, একটি পরিচিতজনের বাড়ি উঠে, তার কাছ থেকে দিল্লী থেকে কলকাতা আসার রাহাখরচটি ‘ভিক্ষা করে অমুক ফ্লাইটে যাত্রা করছে। বনছায়া দেবী যেন নিশ্চিতভাবে তাঁকে এয়ারপোর্ট থেকে উদ্ধার করে আনার ব্যবস্থা করেন। অন্যথায় তাঁকে পথে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে।’
.
সদ্য হাতে ধরা রঙিন পানপাত্রখানিকে কে যেন নির্মমভাবে হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হাত বাড়িয়েছে।
মেখলা তার মাত্র সাত দিন পাওয়া সুখের জীবনের দিকে তাকিয়ে সেই সুখদাতার মুখের দিকে তাকায়। আস্তে বলে, এয়ারপোর্টে যাচ্ছো? নিয়ে আসতে? এখানেই থাকবেন?
যুধাজিতের ভিতরেও কী ভয়ঙ্কর একটা আলোড়ন উঠছে না? তার মধ্যেও কী এমন একটি আর্তনাদ উঠছে না, ‘যাঃ। সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’। কী মধুরছন্দে কাটছিল এই দিন ক-টি? বনছায়া যেন হাওয়ায় ভাসছিলেন। মেখলার মুখে স্বপ্নের মদিরতা! সাটা দিন, না সাতটা মুহূর্ত?
আসলে বহিরাগতরা বিদায় নেওয়ার পরই, বনছায়ার বাসনাবদ্ধ ‘সংসারখানির’ চেহারাটি দেখতে পেতে শুরু করেছিলেন।
মেখলা ক্ষণে ক্ষণে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছে, বাবাঃ। এতো বড়ো বাড়িটায় মাত্র তিনজন! কোন জায়গাটা কখন উপভোগ করা হবে? সব জায়গাগুলোই তো ছবির মতো। তিনতলায় উঠে এলে আর নেনে যেতে ইচ্ছে করে না, আবার বাগানে গিয়ে বসলেও মনে হয় সেইখানেই পড়ে থাকি।….অথচ ওদিকে মার সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘরেও থাকতে ভালো লাগে!
যুধাজিৎ কৌতুক হাস্যে বলেছে, এতো সব ভালো লাগার মধ্যে থেকে কিন্তু এই হতভাগাটা বাদ পড়ছে।
তার উত্তরে মেখলা ভুরু তুলেছে, ‘হতভাগা’ মানে? নিজেকে তাহলে তুমি এখন থেকেই ‘হতভাগা’ ভাবতে শুরু করেছো? তার মানে—ভাগ্য তোমায় ঠকিয়েছে!
সর্বনাশ! ওই কথার এই মানে? সাংঘাতিক মহিলা! তোমার সঙ্গে কথা বলতে তো দেখি নিক্তি হাতে রাখতে হবে। আমি বাবা একটা আলাভোলা লোক, যখন যা মুখে আসে বলে ফেলি। ইস, ভাবনায় ফেলে দিলে তো!
অবশ্যই অতঃপর উপযুক্ত আচরণে ওই কপট ভাবনাটি দূর করে ফেলে বলেছে, ঠিক আছে মশাই, ওই ভালো। তোমায় আর নিক্তি ধরে মেপে কথা বলতে হবে না।
আমার মাকে কেমন লাগছে?
মেখলা চোখ তুলে বলেছে, সব কথা মুখে বলতে নেই। বাইরের বাতাস লেগে হালকা হয়ে যায়।
টুসকি!
এই আবার ওই নাম? কী বলেছি?
ওই নামটাই যে বেশী ভালো লাগে!
কেন? শুনি? ওটা কী একটা নাম? শুনলেই মনে হয় টুসকি মারলেই পাকা টম্যাটোর মতো গলে যাবো।
আরে ঠিক। কারেক্ট। সেইজন্যেই তো নামটা এতো ক্যাচি! কাছে এসে ডাকতে গেলেই গালে একটি টুসকি মারতে ইচ্ছে করে।
এই খবরদার।
কেন হে? কে দেখছে?
সেই তো মুশকিল। কেউ কোথাও থেকে দেখতে পাচ্ছে ভাবলে বোধহয় আলাদা একটা রোমাঞ্চ আসে। সত্যিই এতো বড়ো বাড়ি যেন মাত্র তিনজনের জন্যে ‘এনাফ’!
সর্বনাশ। এখুনি কী জনসংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা—
এই! অসভ্য। ইস। আঁ-আঁ-আঁ! রোসো, গুনে গুনে পাঁচটা কীল মারবো। পিঠ পাতো।
.
হ্যাঁ, এইভাবেই সাতটা দিন সাতটি মুহূর্ত! আলোয় উজ্জ্বল, বাতাসের মতো হালকা. …. হঠাৎ তার উপরে যেন পাথরের চাঁই এসে পড়লো। শকুনির ছায়া!…
কিন্তু কী আশ্চর্য! অনেকখানি বাড়তি জায়গার অগাধ পরিবেশে, বাড়তে আসছে তো একটা মাত্র মানুষ! তবে এমন হাঁফধরা ভাব আসছে কেন?
এই একই কথা ভাবছে সংসারের তিনটে মানুষ
সত্যি ভেবে এতো দমবন্ধ ভাব আসছে কেন? একটাই তো মানুষ বাড়ছে। তাও বীরদর্পে কোনো দাবির ভঙ্গীতে নিজেকে বিস্তার করতে নয়। দাবি-দাওয়াহীন একটা আশ্রয়প্রার্থী মাত্র।…কী আর করবে?
কী করবে? অনুভূতির গভীরে ধ্বনিত হয়, অনেক কিছুই করবে হয়তো। প্রথমেই তো তোমাদের এই সুখ ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজানো সংসারটির ছন্দ ভাঙবে।…তারপর কে জানে আর কী ভাঙবে!
বড় ভয় করছে মেখলার।
বড় ভাবনা হচ্ছে যুধাজিতের।
আর বড় বেশী ভয়-ভাবনা হচ্ছে বনছায়ার আপন অপরাধবোধে।
একেই তো চিরকালই বিদঘুটে স্বভাবের ছিল। স্বেচ্ছাচারী, আত্মকেন্দ্রিক, অন্যের সুবিধে-অসুবিধে সম্পর্কে সম্পূর্ণ চেতনাবিহীন। তাছাড়া এই দীর্ঘদিন কী ধরনের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে এসেছে তা কে জানে!…ওর বক্তব্যের ভাব শুনে তো মনে হয়েছে—এই বয়েসে জীবনের শেষদিন গোনবার কারণ নিজের প্রতি অত্যাচার অবহেলা আর ফ্রাস্ট্রেশান।
.
বেরোবার সময় যুধাজিৎ বললো, মা, তাহলে চলছি—অজানা সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে। জানি না কতোক্ষণে ফিরতে পারবো। প্লেনও তো হরদমই লেট করে।
বনছায়া বললেন, এসো বাবা। দুর্গা, দুর্গা। আহা, যেন বেশী ‘লেট’ হয়ে ভুগতে না হয় ঠাকুর।
যুধাজিৎ হেসে ওঠে, তোমার ঠাকুরটি বেশ বাধ্য ছেলে, তাই না মা? যখন যা বলো, তাই শোনেন!
বনছায়া ক্ষীণভাবে বলেন, এ সময় আর ঠাকুরকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করতে বসিসনে বাছা! দুর্গা বলে এগিয়ে পড়।
এগিয়ে তো পড়ছিই তবে ‘দুর্গা’ বলে বোধহয় নয়। তো তোমার লক্ষ্মণ দেবরের জন্যে খাবার-টাবারের কী ব্যবস্থা করেছো জানি না। তবে ভাবছি, সাদা জল কী চলে? না জলের বদলে বোতলবাহিনী। আবার সেই ব্যবস্থায় না ছুটতে হয়…
হাসির ভানটা দেখিয়ে চলে যায় বটে, তবে ভিতরে হাসির মেজাজ নেই। কী ভাবে অভ্যর্থনা করতে হবে সেই প্রায় অচেনা হয়ে যাওয়া মার ভাষায় ‘আপনজন’টিকে
‘বোতল’ সম্পৰ্কীয় উক্তিটি দিদির টেলিফোনে ঝঙ্কারের ফল! খবরটা টেলিফোনে শুনলো রিঙ্কু, আর সঙ্গে সঙ্গে কঠোরকণ্ঠে বলে উঠলো, মাকে একবার দে তো। দিই একবার আচ্ছা করে শুনিয়ে।
শুনিয়ে আর কী করবি? এখন তো আর কোনো প্রতিরোধের উপায় নেই।
তাই বলে, তাঁকে বাড়িতে এনে তুলবি? বোকামিরও একটা শেষ থাকে।
না তুলে?
টাকার মায়া যখন নেই, তখন একটা হোটেলে-টোটেলে নিয়ে গিয়ে তুললেই হতো! তোর জামাইবাবুও তো তাই বলছিলো। বলছিলো, কে জানে ব্রাদার ইন-ল’কে এবার বাড়িতে বোতল আমদানি করতে হবে কিনা। হয়তো জলের বদলে বিয়ারই চলে তাঁর। কই মাকে দে না একবার।
যুধাজিৎ বলেছিলো, থাক বাবা। একেই তো বেচারী নিজেই মরমে মরে আছেন। আর সেই যে কী বলে, ‘মরার ওপর খাঁড়া’। না কী, তাই কেন?
তা সে সময় অরিন্দম এসে ধরেছিলো। বলেছিলো ব্যাপারটা বেশ রিস্কই। ওনার যা হিস্ট্রী, তাতে মনে তো হয় না, এযাবৎ সাধুসন্তের মতো জীবন-যাপন করে এসেছেন। কীরকম প্রকৃতি কে জানে।
যুধাজিৎ বলেছিলো, সব কিছুর জন্যেই প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমি অবশ্য ভাবছিলাম কোনো হোটেলে একটা রুম নিয়ে, মানে তাতে হয়তো একটু স্বস্তি থাকতো।
যুধাজিৎ বলেছিলো, তা হয়তো থাকতো জামাইবাবু! তবে তাতে বনছায়া দেবীর সম্মানটি কী অটুট থাকতো? একটা ‘হতভাগ্য প্রাণী’ দেবীর মন্দিরে আশ্রয় পাবার আশায় ভূগোলকের ওপিঠ থেকে এপিঠে ছুটে আসছে—
অরিন্দম বলেছিলো, কারেক্ট।…তবে আর কি? ‘জয় মা কালী’ বলে ঝুলে পড়গে ব্রাদার।
.
তো তাই পড়েছে এখন যুধাজিৎ!
তবু এয়ারপোর্টে যাবার পথে—যেটা ওর বাড়ি থেকে সামান্যই দূর, ভাবতে ভাবতে চলে, টুসকির মুখটা কী হঠাৎ বড্ড বেশী ক্ষুণ্ণ আর বিস্ময়াহত দেখাচ্ছিলো? টুসকি কী মনে মনে এটা সহজে মেনে নিতে পারবে না? যদি না চায়? আশ্চর্য! কে জানতো এতোদিন নয় ততোদিন নয়, যুধাজিতের জীবনের এই পরমক্ষণে এমন একটা অদ্ভুত আকস্মিকতার ধাক্কা এসে তার জীবনের সাজানো খুঁটিগুলো এলোমেলো করে দেবে!
আবার ভাবতে চেষ্টা করলো, ব্যাপারটাকে এতো বড়ো করেই বা ধরছি কেন? ‘সামান্য বলে ধরলেই তো হয়। অনেক দিনের একজন নিকটাত্মীয় আসতে চেয়েছেন। এই তো। তাও নিজে থেকে পরিকল্পনা বা কোনো অভিসন্ধির বশে নয়, আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে। সে আমন্ত্রণ বাড়ির খোদ গৃহকর্ত্রীর। আহূত ব্যক্তিটি তো সৌজন্য হিসেবেই আসতে চাইতে পারেন।
আর আমাদেরই বা কী এতো? এতো বড়ো বাড়িতে বাড়তি একটা মাত্র মানুষকে জায়গা দেওয়া যাবে না? তাতে আর সংসারের ছন্দ ভাঙাভাঙির কী আছে? তাও ব্যক্তিটি মহিলা নয়, প্রৌঢ় এক পুরুষ! রুগ্ন অভাবগ্রস্ত? তাতেই বা কী? নিঃসম্পর্কীয় জনকে ও এমন ক্ষেত্রে সহানুভূতি দেখাতে হয়, আর এ তো একেবারে নিকটজন।
এও মনে হলো, সংসারক্ষেত্রে এমন ধরনের ঘটনা তো আকছার। হয়তো কোনো অভাবগ্রস্ত নিকট আত্মীয়ের আকস্মিক মৃত্যু ঘটলো! তাঁর পরিবারের বহন করার দায়িত্ব নিতে হয় না? শত অসুবিধেতেও নিতে হয়। সেক্ষেত্রে ‘সংসারের ছন্দ ভেঙে যাবে উদাসীন হয়ে গা ঝাড়া দিলে জীবনের ছন্দ’টি কী ঠিক থাকে?
কিছুদিন আগে হলেও এতো কথা ভাবতে বসতো না যুধাজিৎ। নিজের স্বপক্ষে এতো যুক্তি খাড়া করতে বসতো না। কারণ যুধাজিতের জীবনে তখন এমন কেউ এসে দেখা দেয়নি, কোনো ব্যাপারে যার মুখের চেহারাটি কেমন হয়ে উঠলো তাই বিশ্লেষণ করতে বসতে হতো।
মা। কেবলমাত্র ‘মা’ই ছিলো তার শেষ কথা।
এখন আবার দুটো পাল্লায় বাটখারা চাপিয়ে চাপিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। জীবনভোর! কী আশ্চর্যভাবে এসে যায় এই দায়বদ্ধতা।
.
কিন্তু সেই দায়বদ্ধতাটির দায় কী সকলের কাছে সমান হয়ে দেখা দেয়?
অনেকে তার ধারও ধারে না। এবং সেই মানসিকতা যে কেবলমাত্র পারিবারিক শিক্ষাদীক্ষা বা পরিবেশ-নির্ভর হয়, তাও নয়। না হলে—বেলেঘাটার শুভ্রাঙ্ক মুখুয্যের বড় নাতি শঙ্খ মুখার্জি ওরফে খোকা ওরফে ‘বাবু’ কী করে অনায়াসে অতি সহজে, একটি শক্ত গাঁথুনি বড়সড় যৌথ পরিবারের মধ্য থেকে নিজেকে খসিয়ে নিয়ে বৌ নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে পেরে উঠলো। যে নাকি সন্ধ্যাতারা নামের মহিলাটির গর্ভজাত।
যে সন্ধ্যাতারার জীবনসাধনাটি হচ্ছে আত্মবিলোপী সাধনা। যে নাকি অপরের কোনোরকম ক্ষোভ দুঃখ বেদনা অভিমানের কারণ হতে পারার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। সকলের সন্তুষ্টিবিধানই যার ধ্যানজ্ঞান। অথচ তার ছেলে শঙ্খ ওসবের তোয়াক্কা করেনি, বরং মা যখন সকাতরে ছেলের কাছে আবেদন জানাতে এসেছিলো, অন্তত বাবা যে ক-টা দিন আছেন এমন কাজ করিসনে বাবুসোনা।
বাবুসোনা তখন অনমনীয় তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছিলো, তোমার পূজনীয় শ্বশুরঠাকুরের হেলথ্ বেশ ভালোই আছে মা। তার ওপর তোমার সেবা-যত্ন ভক্তি। নিশ্চিন্ত থাকো, এখনো আরো দশ বিশ বছর দিব্যি টিঁকে থাকবেন। তো আমি ব্যাটা কেন ওনার মরণ টাকতে বসবো? আমার অভাবে তো আর ওঁর ভোগপুজোর কোনো অভাব হবে না।
আহত সন্ধ্যাতারা বলেছিলো, তোর কথাবার্তাগুলো এমন বাড়িছাড়া মতো হলো কী করে রে ‘বাবু’?
বাবু বলেছিলো, আশ্চর্যের কী আছে? মানুষ তো আর ছাঁচের পুতুল নয়।
ছেলেবেলা থেকেই অবশ্য ‘বাবু’ ঠাকুর্দার কাছে ‘খোকা’, একটু স্বার্থপর স্বতন্ত্রপ্রিয় একবগ্গা! তবে এতোটা বাকচাতুর্যে রপ্ত ছিল না। সেটা হয়েছে বোধহয় সঙ্গগুণে! তার প্রেমঘটিত বিয়ের বৌ যখন প্রথমেই এসে বলেছিলো, বাবাঃ! এই দম আটকানো বাড়িতে আমায় থাকতে হবে? অসম্ভব! কই কোনোদিন তো বলোনি তোমাদের এমন একখানা রাবণের গুষ্ঠীর সংসার! স্রেফ চেপে গেছলে।
বৌ সাজে-সজ্জায় অতি আধুনিক বটে। তো বাক্যবিন্যাসে পিতামহীর ধারা বহন করে।
শঙ্খের কন্ঠ থেকে অবশ্য তখন প্রতিবাদের শঙ্খনিনাদ ধ্বনিত হয়নি। মিনমিন করে বলেছিলো, তখন অতো কথা বলার কী অবকাশ হতো। তোমায় দেখলেই তো সব ভুলে মেরে দিয়ে কেবল—
থামো! ওসব ঢং-এর কথা রাখো। আমার এই সাকথা মাথায় ওপর পাহাড় নিয়ে থাকতে পারবো না! এ বাড়িতে কারো এক ইঞ্চি স্বাধীনতা আছে? স্বাতন্ত্র্যসুখ বলে কিছু আছে? নিজস্ব ভাবে থাকার ব্যবস্থা আছে? সবই তো দেখি সর্বক্ষণ ওই এক ইজিচেয়ারে পড়ে থাকা অনড় বুড়ো ভদ্দরলোকের ইচ্ছের তালে চলে।
এই মনোভঙ্গী প্রকাশ পেয়েছে, তার প্রতিক্ষণের আচারে আচরণে, চলনে বচনে। নববিবাহিতের রোমান্স তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি। আগে ‘প্রেম নিবেদনের’ উপযুক্ত জায়গার মালিক হও তবে ওসব করতে এসো। এই তার ঘোষণা।
তবু সন্ধ্যাতারার গর্ভজাত সন্তানের কণ্ঠ থেকে, কোনো একসময় মিউ মিউ করে উচ্চারিত হয়েছিলো, ঠাকুর্দা যে ক-টা দিন আছেন—ততোদিনই। তারপর কী আর—
বৌ কথা শেষ করবার আগেই সাফ জবাব দিয়েছিলো, তোমার ওই ঠাকুর্দাটি আরো দশ বছর থাকবেন না, তার গ্যারান্টি আছে? মানুষ একশো বছরও বাঁচতে পারে। তাও আবার সর্দার এতো ঠাকুরসেবা তুল্য তোয়াজি সেবা! বলেছিলো, জীবনটাকে উপভোগ করার সময়টিই যদি দম বন্ধ হয়ে গুড়ের নাগরীর মতো পড়ে থাকলুম, তো পরে বয়েস ফুরিয়ে গেলে স্বাধীনতা স্বাচ্ছন্দ্য পেলুম আর না পেলুম।…কিসের জন্যে জীবনের সেরা সময়টিই বিকিয়ে দেবো। নিরুপায়ের মতো? তোমার ঠাকুর্দার এই ‘রাজপ্রাসাদের’ আধখানা ঘরের মালিকানার আশায়? হ্যাৎ! এই বিরাট গুষ্ঠির ভাগে, এই আধখানা বৈ একখানা আস্ত ঘর জুটবে বলে মনে হয় তোমার? তবে জীবনটাকে বরবাদ দিয়ে ঠাকুর্দার ভিটের দুখানা নোনাধরা ইঁট কামড়ে বসে থাকতে হবে? দায় পড়েছে।…আমায় এই খাঁচা থেকে উদ্ধার করতে না পারো তো যেখানে ছিলাম, সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে এসো।
হ্যাঁ, এই রকমই ভাষা শঙ্খর বৌয়ের। জড়তাহীন, কঠোর, ধারালো। এর সামনে কী শঙ্ক মনে পড়িয়ে দিতে পারবে, যেখানে ছিল সেখান থেকে উদ্ধার করে আনার জন্যেও তো পাগল করে তুলেছিলে আমায়। তোমার সেই দিদি-জামাইবাবুর সংসারে যতোই বিলাসিতা আড়ম্বর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থাক, তোমার পোজিশানটি কী ছিলো? ঘাড়ে পড়া একটা দস্যি আইবুড়ো শালী। এই তো? তোমার জামাইবাবু যখন তখন হাসির ছলে বলতো না, ‘লোকের থাকে মাতৃদায়, পিতৃদায়, কন্যেদায়, এ হতভাগার হলো শালীদায়।’…বলতো, “নিশ্চিন্তে কলকূজন প্রেম গুঞ্জনের জন্যে নিজের কোর্ট নিয়ে গিয়ে ফেলো না হে বৎস!… কেন পরের গোয়ালে ফেলে রাখা?’
.
আর সেই শ্যালিকা ‘সঞ্চারিনী’ তখন সঞ্চারিনীলতার মতো ব্রেনে গড়িয়ে পড়লেও আড়ালে হতভাগা প্রেমিকটার ওপর তর্জনগর্জন করতো না? বলতো না, তুমি কী চাও একদিন গায়ে কেরোসিন ঢেলে নিজেকে নিকেশ করে দিই?’
এখনো এ বাড়ি ছাড়বার তাড়নাতেও সেই কথাই বলে। তবে তার সঙ্গে এই নতুন বাক্যবাণটিও জুড়ে দেয়, যার কানাকড়ির মুরোদ নেই তার আবার প্রেম করতে আসার শখ কেন?
অথচ এখানে ‘বাবুর বৌ’ নামক ভি. আই. পি. মহিলাটির জন্য আরাম আয়োজনের কোনো ত্রুটি ছিল না। তা হলে কী হবে? ওই স্বাধীনতা! সেখানেই যে ঘাটতি। নো হঠাৎ নিজে একটু একা বেরিয়ে কিছু কেনাকাটা করে এনে দেখলো, বাড়িতে ‘বৌ কোথায়’, ‘ধোঁ কোথায়’ রবে হুলিয়া বেরিয়ে গেছে।…
ইজিচেয়ারে আসীন বৃদ্ধটি বলেন কিনা, এ বাড়িতে ঠিক এরকম রেওয়াজ নেই নাতবৌমা! কেনাকাটার দরকার হলে বাড়ির বেটাছেলেদের বলবে। আর নয়তো খোকার সঙ্গে বেরি
রাগে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। আর তারপর যখন শাশুড়ি ঠাকুরণ।’ বলতে এসেছিলেন, ‘তো একটু আধটু বেরোতে দরকার পড়লে বাড়িতে কাউকে বলে দে হয় মা। বাড়িতে কী ভাবনাই পড়ে গেছলো।’…তখন কণ্ঠে সেই গরমটি ঢেলেছিলো, ভাবনার কী আছে? দিন দুপুরে চুরি হয়ে যাবো?
এই বৌকে আর কী বলতে যাবে সন্ধ্যাতারা? চোখের জলটাকে সামলাতে হবে না?
তা সেই প্রথমদিন শঙ্খও মৃদুকণ্ঠে বলেছিলো, একটু বলে গেলে আর ঝানেলা থাকে না।
কিছু বলেই বা যাবে কেন বৌ? সে কী নজরবন্দী আসামী? তাই নড়তে চড়তে ‘হুকুম’ নিতে হবে?…যে বাড়ির মেয়ে ডাক্তারী পড়ে (তখনো পড়ার স্টেজ চলছিলো) সে বাড়ির এমন সেকেলে গাঁইয়াপনা! তাজ্জব।…বাড়ির পুরুষরাও যখন কোথাও বেরোয়, বাড়িতে কাউকে বলে যায়?…সেলাম বাবা সাত সেলাম এই বাড়ির খুরে।…এ সেই তানের দেশ না কী? ‘নি-য়-ম!’ আমার দ্বারা হবে না ওসব।
অতএব পরবর্তী স্টেজে শঙ্খ-কণ্ঠেও নিনাদিত হতে শোনা গেল, সবাইতো এ বাড়ির মতো পৌরাণিক পদ্ধতিতে মানুষ হয় না মা। আমাদের এ বাড়ির রীতিনীতি এ যুগে ভাচল। উঠতে বসতে সবকিছুর পারমিশান নেওয়া ‘ওর’ পক্ষে অসম্ভব। বুড়ো ভদ্রলোকটিও তেমনি এক বদ অভ্যেস। সক্কলের সব ব্যাপারে নাক গলাতে আসা। বয়েস হয়েছে হরিনাম করুন না।
তা বলতে হয়, এতোটি বাকপটুতা ছিলো না শঙ্খর। সঙ্গগুণেই হয়েছিলো।
সে যাক। সে অধ্যায়ে যবনিকা পড়ে গেছে।
সন্ধ্যাতারা তার ছেলে বৌয়ের খাট পালঙ্কে শোভিত, যেগুলো সন্ধ্যাতারারই অবদান, ঘরটাকে দুবেলা ঝাড়ামোছা করায়, সন্ধ্যাবেলা সন্ধ্যা দেয়।
এসব জিনিস নিয়ে যায়নি কেন ছেলে বৌ?
সন্ধ্যাতারা তো কাতর অনুনয় করেছিলেন, না নিয়ে গেলে অসুবিধেয় পড়বে বলে। কিন্তু নিয়ে গিয়ে তুলবে কোথায়? আস্ত একখানা ফ্ল্যাট তো আর যোগাড় করে উঠতে পারেনি। আর যদিবা এক আধটা হাতছানি দিয়েছে, তো সে একেবারে নাগালের বাইরে। নত একটা কেষ্টবিষ্টু তো আর নয় শঙ্খ মুখার্জী? ভাররাভাইয়ের সুপারিশে যা হোক একটা চাকরি জুটেছে এই পর্যন্ত। বিদ্যেই বা কী? সাত তাড়াতাড়ি প্রেমে পড়ে তো গুবলেট হয়ে বসলো।
এখন আস্তানা হচ্ছে এক বন্ধুর তিনখানা ঘরের ফ্ল্যাটের একখানা। বন্ধুর বদান্যতায় অবশ্য নয়, রীতিমতো মূল্য ধরে। এবং তৎসত্ত্বেও শুনতে হয়েছিলো, অন্য কাউকে দিলে— মোটা টাকা সেলামী পেতো। তবে তার বদলে একটি শর্ত আরোপিত আছে, নোটিশ দিলে তিন মাসের মধ্যে উঠে যেতে হবে। বন্ধুর বক্তব্য তিন মাস এনাফ্। আগে লোকে পনেরো দিনের নোটিশ দিতো।
আর বন্ধুর বৌ হেসে গা পাতলা করে বলেছিলো, ভাড়া দিয়ে কিন্তু ‘ভাউচার টাউচার’ চাইতে বসবেন না মশাই। তাহলেই ‘ভাড়াটে বাড়িওলা’ আইনের প্যাঁচে পড়ে যেতে হবে আমাদের। আমার বাবা তো শুনে ভয় খেয়ে বললেন, ওরে বাবা—ভাড়াটে বসানো। ডেঞ্জারাস ব্যাপার। সেই যে কথায় বলে, ‘ছেলে মরবে তবু ঘুনসি ছিঁড়বে না’—এও প্রায় তাই। বাড়িওয়ালা ঝামেলায় বাড়ি বেচে চলে যাবে—তবু ভাড়াটে নড়বে না। আর মামা বললো, ভাড়া দেওয়াও যা, হিহি দানপত্র লিখে দেওয়াও তা। ধরে নে সদব্রাহ্মণকে বাড়ির একটু অংশ দান করে দিচ্ছিস।
অতএব এই শর্ত।
ভাড়াটে নয়। বন্ধু। বাড়ি খুঁজছে, যতোদিন না পায়, ততোদিনের জন্যে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তো আশ্রিতই যখন, তখন আবার ভাড়ার রসিদ কিসের?
টাকাটা যে বন্ধুর নিজেরই বিশেষ উপকারে লাগবে বলেই এই ‘আশ্রয়’ দেওয়ায়!ম্মতি, তা কী না বুঝেছে এরা? তবে উপায় কী? তবু একটা স্বাধীন জীবন পাওয়া গেল! উপভোগের কালটা হাতছাড়া হয়ে গেল না।
কমন বাথরুম?
তা আর কী করা যাবে?
রান্নাঘর নেই, শোবার ঘরের সামনের ব্যালকনিটাতেই কেরোসিন স্টোভে রাঁধতে হবে? তা আর কী করা? সবদিনই যে দুবেলা রাঁধবে সঞ্চারিণী, এমন কোনো কথা নেই। বাইরে কী খাদ্যবস্তুর অভাব আছে?
তবে রাত দশটার মধ্যে না ফিরলেই গেট-এ তালা পড়ে যায়। অনেক ডাকাডাকি করে সবিনয়ে আর্জি জানাতে হয়?
উপায় কী? যার বাড়ি, সে হচ্ছে দারুণ নিয়মী।
সকালে বেলা সাতটার আগে পাম্প খোলা হয় না? তাইতো দেখা যাচ্ছে। ওটাই বন্ধুর বাড়ির নিয়ম।
তা এ সব তো মেনে নিতেই হবে। বন্ধু যে রাজি হয়েছিল এই ঢের!
কত জনকেই তো বলা হয়েছিলো। কে রাজি হয়েছে? লজ্জার মাথা খেয়ে একবার বৌয়ের দিদিকেও বলে বসেছিলো শঙ্খ। কিন্তু দিদি সে প্রস্তাব একেবারে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। বললো, ভাড়া নেবো? তোমার কাছ থেকে? মাথাটা ঠিক আছে তো ভাই?
কিন্তু একেবারে আশ্রিত হয়ে তো আর থাকা যায় না!
তা তো নয়ই। অতএব অন্য পথ দেখো বাপু।
ভায়রাভাই বললো, ভাড়াটে বাড়িওলা সম্পর্কটা বড়ো খারাপ ভায়া। নিকটাত্মীয়ের মধ্যে ও সম্পর্ক পাতাতে না আসাই ভালো।
অর্থাৎ আশ্রয় না দিলেও বেশ একটু জ্ঞান দিলেন ওঁরা।
অতএব বেলেঘাটার শুভ্রাঙ্ক মুখার্জীর পৌত্র শঙ্খ মুখার্জী, নিরাশ্রয়ের ভূমিকায় সাত দরজায় ঢুঁ মেরে মেরে এই একখানি হৃদয়বান বন্ধুর সন্ধান পেয়ে কৃতকৃতার্থ হয়ে গেছে। মাইনের অধিকাংশই তার হাতে তুলে দিতে হচ্ছে বটে, তবু পায়ের তলায় মাটি, মাথার ওপর ছাত, এই কী সোজা প্রাপ্তি না কী?…এখান থেকে তো কোনো কিছুতেই কারো পারমিশান নিতে হয় না। আর সেজেগুজে দিদির ছেলের জন্যে চকোলেট আর জামাইবাবুর জন্যে তাঁর প্রিয় কড়াপাকের সন্দেশের বাক্স হাতে নিয়ে গিয়ে গা ভাসিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। আর যেখানে আছে, সেখানে যে কী সুখে আছে তা গল্প করা যায়।
বেলেঘাটার পথে অবশ্য একবারও উঁকি দেওয়া হয় না।
হয় না, তার কারণ একজনের নিতান্তই অনীহা, অপরজনের হয়তো বা অবচেতনে একটু অপরাধবোধের সুপ্ত কামড়। যদিও মনের মধ্যে অবিরত যুক্তিও খাড়া করে চলে, “কেন। এতো কী! লোকে এমন করে না?” অথচ—ও মুখো হতে যাবার সাহসও খুঁজে পায় না। যাকগে, সেই রাস্তাটা ভুলে গেলেই বা ক্ষতি কী!
এ বিশ্বভুবনে দিকে দিকে আরো কতো রাস্তা।
কিন্তু মুশকিল ওই শঙ্খর যে সব রাস্তার দিকে আগ্রহ তার বৌয়ের ঠিক সেই সব দিকেই অনীহা। তার মতে লোকের বাড়ি ‘বেড়াতে গিয়ে কী হবে? শহরে এতো দর্শনীয়র পসরা!
তবে মুশকিল এই, সেই সব দর্শনীয়দের জন্যে টিকিট কাটতে হয়।
বৌ ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে বলে, পয়সা খরচের ভয়ে হাত পা নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি বসে থাকতে হবে?…সারাদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়ে আসা, চিরদিনের আয়েসী মার্কা ক্লান্ত বাবুর যখন মনপ্রাণ চাইছে আরাম করে গা গড়িয়ে চা সিগারেট নিয়ে নিজেকে এলিয়ে দেবার, তখন সারাদিন বাড়ি বসে থেকে হাঁফিয়ে ওঠা সঞ্চারিণীর প্রাণ-মন উন্মুখ হয়ে থাকে বাইরে বেরিয়ে পড়ার।
বিপরীতমুখী এই দুই ইচ্ছার’ মধ্যে জয় অবশ্য প্রবল পক্ষেরই হয়! যদি সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি বসে গ্যাজাবে, তবে তো কাঠখড় পুড়িয়ে, বাড়ির আওতা থেকে টেনে বার করে আনা কেন ওই কুড়ের বেহদ্দটাকে।
অতএব কাচপোকার জয়যাত্রা পিছনে তেলাপোকাকে নিয়ে।
তবে শুধুই কী ওইটুকু? অন্যের ফ্ল্যাটের একখানা ঘরে পড়ে থাকা জীবন থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে না? আর সেই ঘটনাটি ঘটাবার জন্যে সারাক্ষণ চলবে না চাপা গর্জন?
না রাবণের গুষ্ঠীর বাইশ জোড়ার চোখের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে অবাধ ‘প্রেমগুঞ্জন আর কলকূজন’ কপালে জোটে না। জোটে ওই চাপা তর্জন গর্জন। এখানেই বা অবাধ কোথায় হে অকৃতী অধম পুরুষ? ঘাড়ের কাছে বন্ধুপত্নী। আর তাঁর কানও রীতিমতো তীক্ষ্ণ।
শঙ্খের কোনোদিন জানা ছিলো না, একজন পুরুষের বিয়ে করতে ‘আম্বা’ হবার আগে, প্রধান চিন্তা থাকা উচিত, সে তার স্ত্রীকে একটি ‘নিভৃত নির্জন’ আর আরামের উপকরণ সমৃদ্ধ ‘ঘর’ যোগাতে পারবে কিনা!
শঙ্খর দেখা আর জানার জগতে এ চিন্তার চাষ দেখেনি কখনো। অথচ ‘দেখেনি’ বলেই অবিরত ধিকৃত হতে থাকে।
এ হেন অবস্থায় কিনা হঠাৎ দেখা গেল বৌয়ের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে, আহারে অনিচ্ছা এবং আরো সব নানান উপসর্গ।
শঙ্খ মাথায় হাত দিয়ে বললে, সর্বনাশ! প্রিকশান নাওনি?
বৌ চাপা ক্রুদ্ধ গর্জনে বললো, বাজে কথা বলো না। সাবধানের যেমন মার নেই, তেমনি মারের’ও সাবধান নেই। দৈবাৎ উলটোপালটা ঘটে যাওয়ার ঘটনাও ঢের থাকে।
তাহলে? এখন উপায়? দিদির কাছে চলে যাবে?
বৌ তীব্র হলো, কী? দিদির কাছে? কেন? গলায় দিতে দড়ি জুটবে না?
কিন্তু এইভাবে—উপোস দিয়ে দিয়ে সংসারের কাজটাজ—
ন্যাকামি রাখো। কোন আমলে আছো? উপায় আবিষ্কার করতে বসলে ‘দিদির’ কাছে চলে যাবার। শহরের অলিতে গলিতে ‘উপায়’ ছড়ানো নেই।
ঠিক তো! অলিতে গতিতেই তো আজকাল উপায় ছড়ানো। যার নগ্ন নির্লজ্জ ভাষায় সোচ্চারে দুহাত বাড়িয়ে ডাকাডাকি করছে। বলছে, ‘এসো এসো এক ঘণ্টায় অসুবিধা মুক্ত হও।’
তেমন একখানা গলিঘুঁজি আবিষ্কার করতে অসুবিধা হলো না। অতএব—বেলেঘাটার শুভ্রাঙ্ক মুখার্জীর এতাবৎ কালের নির্মল বংশধারার ধারা-রক্ষকের ভূমিকা নিয়ে যে প্রাণটুকু পৃথিবীর আলো দেখবার ‘আম্বা’ নিয়ে চলে আসছিলো, তাকে সে আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে, অসহায়ভাবে ফিরে যেতে বাধ্য হতে হলো অথচ অভাগা হতভাগার ছিলো একটি আলোকোজ্জ্বল সম্ভাবনা। তার পৃথিবীর আলো দেখামাত্রই শাঁখ বাজতো, উলু পড়তো, বাড়িতে আহ্লাদের বান ডাকতো!…আর রাবণের গুষ্ঠীর তৃতীয় প্রজন্মের ধারক বাহকের ভূমিকা লাভের দৌলতে ‘মুখ-দেখানির’ অগাধ সম্ভারে ভরে উঠতো প্রাপ্যের ঝুলিটি। …’নামকরণের’ ধুয়োর ঘটায় উৎসব বসে যেতো পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে। ….
হতে পেলো না বেচারা সেই পরম ভাগ্যের অধিকারী হতে। তাকে একটা নামহীন আলোহীন অন্ধকার জগতে তলিয়ে যেতে হলো। সে বাঁচতে পেলো না।
তা উপায় কী? তার জনক-জননীকে তো বাঁচতে হবে! বাঁচার মতো বাঁচতে!
তোমায় ‘আহ্লাদ দিয়ে’ বাঁচাতে বসলে তাদের সাধ-আহ্লাদের বারোটা বেজে যাবে না? অতএব সরে পড়ো বাছা। অসময়ে ঝামেলা করতে এসো না।
তোমার জনক-জননীর যখন সুবিধে সুসময় আসবে, তখন তোমায় ডাক দেবে, ‘আয় আয় তু-তু! খেতে দেবো দুদু—’ তখন এসো।
ক্লিনিকের ডাক্তার নাকি মুখে হাল্কা হাসির প্রলেপ বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘ফার্স্ট চাইল্ড, তাহলে রেখেই দিন না। আসবার জন্যে বায়না করে বসেছে যখন
তো যার ফার্স্ট, সেই জননীই তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিলো, না না। এখন ঠিক সুবিধে নেই। ফরনাথিং খানিকটা প্রবলেম বাড়ানো
তবে আর কী করা? তারা তো মুক্তিদাতা রূপেই আসরে অবতীর্ণ আছে।
আর যারা বুদ্ধিমান তারা কেনই বা জীবনে প্রবলেম বাড়াবে, অসুবিধে বাড়াবে!
বায়না করে বসেছে বলেই, সে বায়না রাখতে হবে? এ যুগ এতো বোকা নয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন