সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক – ২৪

আশাপূর্ণা দেবী

।। চব্বিশ।।

বাবা টেলিফোন করে আমায় যেতে বলেছেন? আজকালের মধ্যেই?

চিরকেলে ভয়তরাসে সন্ধ্যাতারার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। উদ্বেগের আর আবেগের গলায় বলে, কেন বল তো ছোটোবাবু?

সমবয়সী ছোট দ্যাওর অরুণাঙ্ককে সন্ধ্যাতারা ঠাকুরপো বলে না, বলে ‘ছোটোবাবু’। একদা নতুন বিয়ে হয়ে এসে এই সমবয়সী ছেলেটাই ছিলো তার খেলুড়িতুল্য। যদিও তখনকার দিনে বিরাট যৌথ সংসারে বৌদের সম্পর্কে ‘খেলা’ কথাটা ওঠার প্রশ্ন ছিলো না। এদের তো দাপুটে পিসশাশুড়ির ভয়ে ভাইপো-বৌরা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতো! তবে সন্ধ্যাতারা তখন নতুন বৌ, আর নেহাৎ ভালোমানুষ হাবাগোবা এবং কর্মে অপটুত্বের নিদর্শনে হাস্যকর। তাই ওকে সেই জাঁদরেল মহিলাটিও ক্ষমাঘেন্না করে শানে শিথিল ছিলেন। তাই ছোটোখটো সংসার থেকে আসা মেয়েটা একটু সুযোগ পেলেই, বৃহৎ বাড়ির কোনো একখানে লুডোর ছকখানা পেতে চুপিচুপি ডাকতে আসতো, ‘এই ছোটোবাবু, লুডো খেলবে? এসো না ভাই একটু।’

তবে ব্যাচিলার বড় জ্যাঠশ্বশুর দরাজ স্বভাব মৃগাঙ্কমোহনেরও এই ছেলেমানুষ বৌটার প্রতি একটু বেশীমাত্রায় মমতার প্রশ্রয় ছিলো। কাজেই সে খেলায় তেমন বাধা আসতো না। মৃগাঙ্কমোহনের এবং তাঁর বালবিধবা পিঠোপিঠি দিদি নিরুপমার নেতৃত্বে পাঁচ ভাইয়ের ‘ষষ্ঠির কৃপায় সমৃদ্ধ’ সংসারটি তো ছিলো জনারণ্যতুল্য। ….

বাপ্পাদিত্য শিলাদিত্য শৈশবের স্মৃতি প্রসঙ্গে বলে, ‘উঃ! ছেলেবেলায় পিসির বাড়িটায় বেড়াতে গেলে, কী ভালোই যে লাগতো! সবসময়ই যেন বিয়েবাড়ি। আর ছাদটা? যেন মাঠ। ফুটবল খেলা যেত।

তা খেলতোও। সে বাড়িতে ছেলেপুলে তো ছিলো অগুনতি। মৃগাঙ্কমোহনই না হয় অকৃতদার, তবে বাকি চার ভাই শশাঙ্ক, বরঙ্ক, উতঙ্ক এবং শুভ্রাঙ্ক তো কৃতদার। কাজেই শাখাপ্রশাখায় ঘন অরণ্য।

সন্ধ্যাতারা প্রথম প্রথম দেখে হাঁপিয়ে উঠতো।

কিন্তু সে বাড়ি কী বেলেঘাটার এই বাড়িটা?

নাঃ, সে তো মানিকতলায় সেই চকমিলোনো বিরাট তিনতলা বাড়িখানা। যার ছাদের আলসেয় পরীপুতুল বসানো ছিলো। মৃগাঙ্কমোহনের মৃত্যুর পর সেখানে ভাঙন ধরালো, এবং সেই বৃহৎ বৃক্ষের শাখা-প্রশাখারা কী ভাবেই যে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে…হারিয়ে গেল! একদা যারা প্রতিক্ষণ একই বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছে, একই হাঁড়ির অন্নে বর্ধিত হয়েছে, ক্রমশ তাদের মধ্যে বৎসরান্তে একবারও দেখা হয়েছে কিনা সন্দেহ।

বছরে একবার ‘বিজয়া দশমীর কৃত্য’র দায় সারতে বিজয়া কাবার হয়ে যাবার হয়তো এক-দু-মাস পরেও কোলাকুলির প্রহসনটা বজায় রেখেছিলো। ক্রমশ সেটাতেও কখন একসময় ছেদ পড়েছে।

মৃগাঙ্কর সর্বকনিষ্ঠ ভাই শুভ্রাঙ্ক যেমন তখন এই বেলেঘাটার বাড়ি কিনে নতুন সংসারের পত্তন করেছিলেন, তেমনি অন্য ভাইরাও তো দিকে দিকে নিজভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সামাজিক অঙ্কশাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে তাদের পরবর্তীরা এখন পরস্পরের ‘দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি’তে পরিণত হয়েছে।

শুভ্রাঙ্কর সংসারেও তো তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বড় বড় ফাটল দেখা যাচ্ছে। এখানেও সেই একই খেলার পূর্বাভাস উঁকি মারছে।

তবে রান্নাঘরের গোটা চারেক ব্রাঞ্চ খোলা হয়েছে বলেই যে পরস্পরের মধ্যে ‘কথা বন্ধ’ অথবা তিক্ততা বিরক্তি তীব্রতা দেখা গিয়েছে, ঠিক তেমনও নয়। শুধু যেখানে একটা নিশ্চিন্ত নিকটত্বের স্বাদ ছিলো, সেখানে বাঁধন ঢিলে হয়ে দূরত্বের ভাব। আর সকলের মধ্যেই যেন একটু লজ্জিত লজ্জিত ভাব। অন্তত পুরুষদের মধ্যে। আর সত্যি বলতে— যেন ‘বড়গিন্নী’ সন্ধ্যাতারার কাছেই।

তাই মনে হলো কথা বলার একটা সুযোগ পেয়ে ‘ছোটোবাবু’ অরুণাঙ্ক যেন খুশীই হয়েছে। সন্ধ্যাতারার কাছে এসে বললো, ‘এই দ্যাখো বড়বৌদি, এক খবর। তোমার বাবা তোমায় একবার তোমাদের নলিন সরকার ষ্ট্রীটে যেতে বললেন।’

এ বাড়ির টেলিফোনটার মালিক ওই অরুণাঙ্কই। বড় চাকরি করে! অফিস থেকেই পাইয়ে দিয়েছে। অফিস যাতায়াতের জন্যে গাড়িও পেয়েছে একটা।

আর এই সব পাওয়া-পায়ির পর থেকেই ওই অরুণাঙ্কর বৌয়ের মধ্যেই প্রথম রান্নাঘরের ব্রাঞ্চ খোলার তাগিদ উঁকি মেরেছিলো। তো সে কথা যাক, একান্নে থাকার সময় খেতে বসে সকলের সঙ্গে সকলের একবার দেখা হওয়ার যোগাযোগ থাকে এবং সেই যোগাযোগের কালে সন্ধ্যাতারার ভূমিকা থাকে প্রধান। মানে ‘থাকতো’। বাড়ির সকলের ‘খাওয়া’টি ভালো হলো কী হলো না, এটাই তো ছিলো সন্ধ্যাতারার ধ্যানজ্ঞান। এখন সন্ধ্যাতারার মনের মধ্যে বড় শূন্যতা। সে নিজে ভাবে, ‘বাবা চলে যাওয়াতেই এমন হয়েছে। সবসময় তাঁকে নিয়েই থাকতুম।’…আসলে কিন্তু সেটাই সব নয়। সবাইকে ঘিরেই যে সন্ধ্যাতারার জীবন আবর্তিত হয়েছে।

.

সন্ধ্যাতারার উদ্বিগ্ন প্রশ্নে ‘ছোটোবাবু’ বলে, ‘কারণ’ কিছু বললেন না। আমি তো ‘বললাম তোমায় ডেকে দিই।…তো তাড়াতাড়ি বললেন, “না না, তার দরকার নেই। বলে দিও যদি পারে তো যেন আজ কী কাল একবার আসে।’

আবার এও বললেন, ‘তেমন কোনো অসুবিধে থাকলে দরকার নেই।’…তো এই তো এখন সকাল। ইচ্ছে করলে আজই চলে যেতে পারো। তোমার কাণ্ডারীটি তো বাড়িতেই রয়েছে মনে হচ্ছে।

কাণ্ডারী মানে পাপিয়া।

পাপিয়াই যে স্বেচ্ছায় তার বড়মার দায়িত্বটি নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, এটা সকলেরই জানা। পাপিয়ার মা অর্থাৎ মেজগিন্নী অবশ্য ক্রমশ আর সেটা তেমন মধুর চোখে দেখেন না। তবে একদম কৃতী হয়ে যাওয়া স্বাধীন মেয়েটাকে বলাই বা যায় কী! একমাত্র চিন্তা তার একটা বিয়ে হয়ে যাওয়া। তো সে আশায় ছাই দিয়ে মেয়ে বলে কিনা, ‘সকলকেই যে ‘বিয়ে আর ঘরসংসার করা’র ছাঁচে ঢালাই হতে হবে তার কী মানে আছে?’

এতএব সেই মেয়ে যদি বাড়ির মধ্যে স্পেশাল একজনের কাণ্ডারী হয়, নিজের মা-বাপের থেকে সেই ‘অন্য একজন’কে অধিক ভালোবাসে তাতেই বা কী বলার আছে? করবার তো কিছু নেই।

কাজেই সন্ধ্যাতারার কাণ্ডারীর কাছে এসে টেলিফোন বৃত্তান্ত পেশ করা।

সে বললো, হয়েছে তো? এবার বাবার কাছে লজ্জায় মাথাটি কাটা গেল তো?…বলি না, বেচারী বুড়োমানুষটাকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত! সকলের সম্পর্কে এতো কর্তব্যজ্ঞান তোমার, অথচ—ওনার বেলায়—

আচ্ছা পাপিয়াই বা নিজেকে অপর পক্ষের উকিলের ভূমিকায় দাঁড় করায় কেন? পাপিয়া কী সেই গাঙ্গুলীবাড়িটার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে?

সন্ধ্যাতারা বিমনাভাবে বলে, আমার যাওয়া মানেই তো তোর কাজ বাড়ানো। আর তো কাউকে সঙ্গে পাবার মতো দেখি না।

আমাদের কাজ বাড়ানোর ভয়ে তুমি—অ্যাঁ? ভীষণ চটাচটি হয়ে যাবে কিন্তু বড়মা! কথা ফিরিয়ে নাও। চটপট। এ কথা বরদাস্ত করতে রাজি ন‍ই।

আচ্ছা বাবা। ফিরিয়ে নিলাম। তো চল তবে বড়মাকে ঘাড়ে করে।

চটপট রেডি হয়ে নাও। এই এক্ষুণি বেরোতে যাচ্ছিলাম।

এক্ষুণি? রেডি হয়ে নেবো?

একদম এই দণ্ডে!

কিন্তু তোর জ্যেঠুকে না খাইয়ে—

জ্যেঠুকে খাইয়ে? তবেই হয়েছে। তাহলে আজ আর হবার কোনো আশা নেই।… আমার তো ডিউটি রয়েছে।…ঠিক আছে, সেটা আমি ম্যানেজ করে ফেলছি।

বলেই গলা তুলে বলে ওঠে, বাড়ির মহিলারা! একটু কান পেতে শুনুন! বাড়ির হেড্ তাঁর বুড়োবাবাকে একটু দেখতে যাচ্ছেন। বাবা ডেকেছেন। এখন আপনারা যে পারবেন ওই ‘হেড্‌’-এর ‘হেড’টিকে একটু খেতে টেতে দেবেন।…চলছি। আমার দাঁড়াবার সময় নেই

পাপিয়ার মা কাছে এসে বলে, কথাবার্তার কী ছিরি হচ্ছে তোর আজকাল?

পাপিয়া স্থির গলায় বলে, বাড়ির যেমন ছিরি হয়েছে, আজকাল তার উপযুক্তই কথা হবে, এতে আর আশ্চর্য কী মা? তবে ভেবে পাই না হঠাৎ ‘লজ্জা’ জিনিসটা বাড়ি থেকে উপে গেল কী করে?…বড়মা। ওয়ান, টু, থ্রী।…ভীষণ তাড়া।…

.

সত্যব্রত একটু কুণ্ঠিত হাসি হেসে বলেন, ইস! ফোন পেয়েই ‘পত্রপাঠমাত্র’ চলে এসেছিস? কী মুশকিল।

পাপিয়া তাঁকে প্রণাম করে বলে ওঠে, মুশকিল? আপনার যদি মুশকিল মনে হয় দাদু তো বলুন। আবার পত্রপাঠ ফিরিয়ে নিয়ে যাই আমাদের বাড়ির বৌটিকে।…তার একটা মানমর্যাদা আছে তো?

সত্যব্রত কতোদিন পরে যেন একটু প্রাণ খুলে হাসেন। বলেন; তোর এই মেয়েটা তো আচ্ছা টুনি। উকিলজব্দ করা মেয়ে। কথা ফেরত নিচ্ছি বাপু। আসলে এক্ষুণি এসে পড়তে পারবে, তেমন প্রত্যাশা তো ছিলো না। তাই দেখে আহ্লাদের চোটে উলটোপালটা বলে বসেছি।

আচ্ছা এখন মেয়ের সঙ্গে ‘সোজা’ কথা-টথা শুরু করুন। আমাকে এক্ষুণি বিদায় নিতে হচ্ছে।…সন্ধের পর আসছি বড়মা। দাদু, চলি।

.

সত্যব্রত বলেন, আজই চলে যাবি?

সন্ধ্যাতারা আঁচলে চোখ মুছে বলে, যেতে কী ইচ্ছে করে বাবা? তবে ওদিকে আপনার জামাইয়ের জন্যেই। শরীর তো ভালো না।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। নিশ্চয় যাবি। সেটাই আসল কর্তব্য।

ডেকেছিলেন কেন বাবা?…বাপের পায়ের কাছে বসে পড়ে সন্ধ্যাতারা।

সত্যব্রত আবারও তেমনি কুণ্ঠিত হাসি হাসেন—আরে ও এমন কিছু না। মানে একরকম পাগলামিই। আসলে যাচ্ছি তো মাত্র দুদিনের জন্যেই। তবু হঠাৎ মনে হলো, ‘ভাবছি তো দুদিন। কিন্তু যদি আরো বেশীদিন হয়ে যায়। যদি আদৌ না ফিরি। মেয়েটাকে একবার দেখে যাব না?’

সন্ধ্যাতারা অবাক হয়ে বলে, কোথায় যাবার কথা বলছেন বাবা?

এই দ্যাখো। বলিনি বুঝি? কী ভুলো কাণ্ড! যাচ্ছি—কোথায় জানিস? পাবনায়.

পাবনায়!

সন্ধ্যাতার ও নীলুর মতোই হতচকিত হয়ে বলে, পাবনায়। সেখানে সহজে যাওয়া যায়?

আরে! সহজ হয়ে গেছে বলেই তো—এখন তো আর যাওয়া নিষিদ্ধ নয়। নিয়মমাফিক

একটা পাসপোর্ট করিয়ে নিলেই—

কিন্তু সেখানে আর এখন আপনার কে আছে বাবা?

আবারও নীলুর মতোই প্রশ্ন করে টুনি।

আর উত্তরটাও তার মতোই দেন সত্যব্রত, কে আছে? কী জানি! তবে তার আকাশ-বাতাশ, জল-মাটি, ঘাস-পাতা, এরা তো আছে। তাই ভাবছি কী জানিস টুনি, গিয়ে পড়লে সেই তারা যদি না ছাড়ে, আটকে ফেলে! তাহলে তো ফেরা হবে না। থেকেই যেতে হবে।

থেকেই যেতে হবে? সেইখানেই থেকে যাবেন? আমাদের সবাইকে ফেলে?

টুনি টুনির উপযুক্তই ডুকরে ওঠে।

সত্যব্রত ঈষৎ গভীরভাবে বলেন, সবাইকে ফেলে? হ্যাঁ, শুনে তোদের কষ্ট হতে পারে। কিন্তু সবাইকে ফেলে চলে যাওয়াই তো এই জগৎসংসারে নিয়ম রে টুনি। সে যাওয়াটা কী আটকানো যাবে। আটকানো কী গেল?

.

নীহারিকা বললো, দেখ এখন বাবার এই পাগলামি! তুমি এসেছো, যদি বলেকয়ে বোঝাতে পারো। প্রথমটা তো বলেছিলেন, দিন দুয়েকের জন্যে একবার ঘুরে আসি। দেখি পাবনাটা সেই পাবনার কতোটুকু কী রেখে দিয়েছে। কিন্তু ভাবে-ভঙ্গীতে মনে হচ্ছে ইচ্ছেটা অন্য।

সন্ধ্যাতারা মলিন হয়। আমি বুঝিয়ে সুজিয়ে বাবার মত বদলে দেবো? কী যে বলো বৌদি! আমার কী সাধ্য?

কিন্তু ব্যাপারটা অন্য পাঁচজনের কাছে কীরকম দেখাবে সেটা কেউ খেয়াল করছে না। লোকে তো ভাববে-শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর ছেলের বৌ বুড়ো শ্বশুরকে অযত্ন অবহেলা করে সংসার থেকে বিতাড়িত করেছে।

সন্ধ্যাতারা থতমত খায়, কী যে বলো বৌদি। এইসব আবার ভাবতে যাবে লোকে?

এইরকমই তো ভাবে লোকে। জানো না?

যারা ভাবে তাদের কথা ছেড়ে দাও। তবে বাবা সেখানে থেকে যাবেন, তাই কী আর সত্যি হতে পারে? এখন মনপ্রাণ খারাপ, একটু ঝোঁকের মাথায় ওইসব অসম্ভব ভাবনা ভাবছেন। এতো বছর পরে কী আর ওঁদের সেই পাবনা সেইরকমই আছে? আর থাকবেনই বা কোথায় কীভাবে? দেখবে কে? অবস্থা দেখে ঠিকই ফিরে আসবেন তোমার নীলুদার সঙ্গেই।

নীহারিকা বলে, এলেই ভালো। তবে কিনা এই গাঙ্গুলীবাড়িরই ঝাড়টি তো একগুঁয়ের রাজা! শত অসুবিধে সত্ত্বেও হয়তো জেদ বজায় রাখতে থেকে যাবেন। ঝাড়ের একখানি বাঁশকে তো দেখেছি হাড়ে হাড়ে।

সন্ধ্যাতারা আস্তে বলে, বাপ্পার কথা বলছো?

তাছাড়া?

ও কি সত্যিই আবার চলে যাবে?

জানি না। ও জানে আর ওর বিবেক জানে।…রাতটা থেকে যাবে তো টুনি?

অর্থাৎ নিজেই নিজের তোলা প্রসঙ্গয় ফুলস্টপ মেরে দেয় নীহারিকা।

টুনি ইতস্তত করে বলে, পাপিয়া বলেছে, সন্ধেয় ও আসবে। রাতে থাকলে, ওকে আবার কাল সকালে আসতে হয়। তাছাড়া—বাবা তো কালই কখন যেন বেরোবেন বললেন।

অর্থাৎ টুনিও সরাসরি ‘নাঃ। রাত্তিরে থাকা চলবে না’ না বলে ঘুরিয়ে কথা বলে! শিখে যাচ্ছে ক্রমশ।

.

আদিত্য টুনি ঘরে ঢুকতেই বলে ওঠে, বাবার প্যাঁচটি একবার দেখলি তো টুনি? প্যাঁচ।

প্যাঁচ মানে?

প্যাঁচ মানে প্যাঁচ। তা ছাড়া আবার কী? এতোকাল পরে কিনা হঠাৎ পাবনার জন্যে ভালোবাসা উথলে উঠলো! কেন? কী জন্যে? অ্যাঁ, কী জন্যে? মানে বুঝি না কিছু?

এর আর মানে কী দাদা?

টুনি হতাশ গলায় বলে।

আদিত্য হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের চোখটা রগড়ে বলে, মনে হচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া এই সংসারখানা ভদ্রলোকের বাসের অযোগ্য। অথচ আসলে লোকটা পারফেক্ট ভদ্রলোক।…তাই সরে পড়ছে। তা নইলে বুড়ো বয়সে স্ত্রীবিয়োগ হলে কে অনার সংসার ত্যাগ করে?…

হঠাৎ সুর পাল্টে বলে, হবে না কেন? হবেই তো। লক্ষ্মীছাড়া ছেলে আর মহারানী বৌমার সংসারে দুজনে যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন, তাতে এখন এই একা হয়ে যাওয়ায় এই ডিসিসান নেওয়াই স্বাভাবিক।

আচ্ছা দাদা, পাগলের মতো কী যা তা বলছো? কী আবার দুঃখে জীবন কেটেছে ওঁদের? তবে তোমাদের ছেলেটা একটু দুঃখ দিয়েছে বটে। সে তার আদর্শের নেশার ঝোঁকে আসলে বাবার এখন মনপ্রাণ খারাপ, তাই প্রাণ ছটফট করছে—

সবাই তোর মতন এতো সোজা হিসেবের কারবারি হতে পারলে সংসারটা স্বর্গ হয়ে উঠতো রে টুনি। তা তো হচ্ছে না।…কষ্ট দুঃখু? ওসব কোনো ব্যাপারই নয় টুনি। আসল প্রশ্ন হচ্ছে ‘সম্মান’। ‘সম্মানহীন’ জীবন হচ্ছে মৃত্যুতুল্য! বুঝলি? এই যে লক্ষ্মীছাড়া আদিত্য গাঙ্গুলী। ওই মহামহিম পাবনার গাঙ্গুলীবাড়ির রক্ত যার মধ্যেও বইছে, সে জানে সেটা। সারাজীবন হাড়ে হাড়ে সেই মৃত্যু অনুভব করে আসছে। কিন্তু তার জন্যে কোনো ‘পাবনা’ নেই। তাই তার আশ্রয় এই বিছানা… বুঝলি?

তোমার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না দাদা।

ও তুই বুঝবি না। বোঝবার ক্ষমতাই নেই।

বলেই হঠাৎ শুয়ে পড়ে দেওয়ালমুখো হয়ে

টুনি একটুক্ষণ বোকার মতো বসে থেকে বলে, বাপ্পা তো এখনো এখানেই আছে শুনলাম। তো কই দেখতে পাচ্ছি না তো।

দেখতে পাবে? তাঁকে? ওইসব ভয়ানক কাজের লোকদের কী সহজে দর্শন মেলে রে টুনি? পাবি। সারাদিন থাকলে একবার হয়তো দেখতে পাবি। দয়া করে বাড়ির অন্নটুকু গ্রহণ করেন।…আর তেমনি হয়েছে ওই পাজী রাস্কেল তারকটা!

হঠাৎ আবার উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে আদিত্য। বলে, ওর জন্যেই এতো বাড় বেড়েছে বাবুর।…বাপ মরো মরো শুনেও একবার দেখতে আসে না, সেই ছেলে করবে দেশোদ্ধার। হুঁঃ! ভেতরে মমতা না থাকলে আর দেশোদ্ধার করতে হয় না।

টুনি বলে, আমি বোকাহাবা মানুষ, অতো সব বুঝি না দাদা, তবে আমার ওই পাপিয়া বলে, সেকালের পরাধীন দেশের ‘দেশোদ্ধার’ আর একালের ‘দেশোদ্ধার’–এ আকাশ পাতাল তফাৎ বড়মা। একালে এই দেশের কাজে নাকি দেশের মানুষের জন্যে অতো মায়া-মমতা-ভালবাসার দরকার হয় না। এসব অন্য ছাঁচের ব্যবস্থা। বরং মায়া-মমতা মানুষ-মনুষ্যত্ব ধর্ম-অধর্ম পাপ-পুণ্যি, এইসবকে ‘বাজে’ জিনিস ভেবে উড়িয়ে দিয়ে কাজ করতে হয়।… মাথায় ঢোকে না বাবা! মানুষ কী গরু-মোষ ছাগল-ভেড়া যে শুধু তাদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা করলেই চলবে? আর কিছুর দরকার নেই। মায়া-মমতা, মনের উন্নতি —

আরে দূর। আছিস কোথায়? ওসব হচ্ছে বাজে সেন্টিমেন্ট। ওসব সাফ করে ফেলে মানুষগুলোকে যন্ত্র করে তুলে চাবি ঘুরিয়ে কাজ চালানোই হচ্ছে ওদের দেশোদ্ধারের রীতিনীতি। বললাম তো ও তুই বুঝবি না। তবে তোদের ওই মেয়েটা বড় খাসা মেয়ে, বুঝলি? ওই তোর পাপিয়া। অমন একখানা মেয়ে বাড়িতে থাকলে—

বলেই থেমে গিয়ে অন্য সুরে বলে, এসে চা-টা পেয়েছিস?

এ মা। তা আবার পাইনি! সে তো আসতে মাত্রই বৌদি—কতো যত্ন করে—

ওঃ। কতো যত্ন করে দেখে যায়। ভালো অ্যাকটিং দেখাও একটা ভাগ্য!…দেখ না শ্বশুর বুড়ো বাড়ি ছাড়বার সময় কতো যত্ন করে খাওয়াবে। রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করে চলেছে আজীবন।…আমার কপালগুণে আবার এই নাটকের অন্য পার্টনারটি, একদম আগমার্কা অনেস্ট। সেটাই আমাকে হাত-পা বেঁধে রেখে দিয়েছে সারাজীবন।…খুব অসুবিধে বুঝলি! একটা পাথরের বিগ্রহের সঙ্গে তো আর লড়াই করা যায় না। লোকটা ভিলেন হলে কতো সুবিধে হতো!

সন্ধ্যাতারা শঙ্কিত হয়।

মনে মনে ঠিক করে ফেলে, দাদার মাথাটা বেশ একটু গোলমেলে হয়ে গেছে। না হলে এমন সব মানে ছাড়া কথা বলছে কেন? হায় ভগবান। এ আবার কী করছো? নাঃ। দাদার কথাগুলোর—কোনো মানে নেই।

.

তা জগতে মানে ছাড়া কাজ যে কতোই ঘটে! তা নইলে পাপিয়া মুখার্জি নামের জুনিয়ার ডাক্তার ওই মেয়েটা কেন তার কর্তব্যকর্মের মধ্যে বারে বারে ঘড়ি দেখে, কখন আন্দাজ তার বড়মাকে আনতে যাওয়া শোভন হবে। এর কী মানে?

অথচ আবার এসে পড়ে শোভন অশোভনতা প্রশ্ন ভুলে, বেপরোয়া ঘণ্টা খানেকের বেশী সময় নীচের তলার ঘরটায় বসে থাকে। এরই বা কী মানে?

দরজাটা খুলে দিতে হয়েছিলো বাপ্পাকেই। কারণ তারক দু’দিনের জন্যে দেশে গেছে।

কিন্তু দরজা খোলা পাওয়ার পর পাপিয়া নীচের তলায় বসবার ঘরটারতেই বসে পড়েছিলো কেন? ওর তো ওর সেই বড়মার উদ্দেশেই পাশের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যাবার কথা!

কিন্তু ভিতরে যদি অন্য এক ‘কথার সমুদ্র’ তোলপাড় করে ওঠে, ন্যায্য নিয়মবদ্ধ কথারা কী সেখানে ঠাঁই পেতে পারে?

বাপ্পা বলে উঠলো, কী? বড়মাকে নিয়ে যেতে বুঝি?

তা ছাড়া আর কী?

এর পর তো বাপ্পার আর কোনো কথা বলার কথা নয়। কিন্তু বাপ্পাও অপ্রয়োজনীয় কথার বীজ পুঁতে বসলো। বললো, বাড়ির লোকটিকে বুঝি একরাতের জন্যেও পরের বাড়িতে ফেলে রাখা যায় না?

পাপিয়া হঠাৎ বিনা আমন্ত্রণে সোফায় বসে পড়ে বলে উঠলো, তা আসবার জন্যে একটা দৃশ্যমান কারণের দরকারও তো থাকে।

বাপ্পা ওর এই নির্ভীক উজ্জ্বল দীঘল চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে যেন একটু কেঁপে ওঠে। তবে সেটা সামলে নিতে দেরী হয় না। বলে, দরকার কী সত্যিই আছে?

কারো কারো কাছে থাকতেও পারে। সকলের ‘দরকার’ এক পথে চলে না।

বাপ্পাও সামনের সোফাটায় বসে পড়ে। হয়তো অবচেতনায়, অন্যমনস্কভাবে। বসে পড়ে বলে, অবস্থাটা আমার পক্ষে খুব কিন্তু স্বস্তির নয়। বেশ অস্বস্তির।…আমি তো বেতালা বিদঘুটে কাঠখোট্টা মানুষ। আমার কাছে কারুর কোনো প্রত্যাশা-ফ্রত্যাশা নেই বাবা।

তোমার কাছে কেউ কিছু প্রত্যাশা করছে, বলেছে তোমায়?

পাপিয়া তেমনি সোজাসুজি তাকিয়ে থাকে।

বাপ্পার চেহারায় এখন আবার আগের ঔজ্জ্বল্য, আগের লাবণ্য। বাপ্পার দিকে তাকালে কোনো তরুণী মেয়ের মধ্যে আকর্ষণ সঞ্চয় না হয়ে উপায় নেই। তাছাড়া এ মেয়ে তো কবেই মনে মনে সমর্পিত হয়ে বসে আছে।

বাপ্পা ফট করে বলে ওঠে, তাহলে বারবার আসার আর দেখা করার দরকারটা কী?

বললাম তো সেটা আমার নিজের ব্যাপার…

আমার এতে—মানে আমি এতে—একটা অস্বস্তি ফীল করি।

কেন বলো তো বাপ্পাদা?

পাপিয়া একটু কৌতুকচাপা গলায় বলে, কতোজনই তো বাড়িতে আসে। ইহসংসারে এতো লোক থাকতে, আমার মতো একটা তুচ্ছ মানুষ এলে অস্বস্তির কী আছে?

বাপ্পা উঠে দাঁড়ায়, দু-পা হাঁটাচলা করে নেয়।

তারপর বলে ওঠে, ‘তুচ্ছ’ যে নও তা নিজেই খুব ভালো জানো।

মোটেই জানি না। চিরকালই নিজেকে খুব তুচ্ছ বলেই ভেবে থাকি। তা নইলে এমন হ্যাংলা স্বভাব হয়?

আশ্চর্য। পাপিয়াই বা এমন বদলে যাচ্ছে কী করে? এমন সাহসী আর বেপরোয়া কথাই বা শিখছে কোন্ ফাঁকে? বরাবর পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকা পাড়ার সেই ছেলেটা, সহপাঠীও, সেই শৌভনিক! সে কি পাপিয়ার বাক্যরচনা প্রণালীর শিক্ষাগুরু? তার তো এইরকমই কথাবার্তা।

এই ক’দিন আগে শৌভনিকের বিয়ে হয়ে গেল। নেমন্তন্নর চিঠিটা দিতে এসে বলেছিলো, আর কতোদিন হ্যাংলার মতো মগডালের ফলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বয়েসটা পার করে দেওয়া যায় বল? হাতের নাগালের একটা ডাল ধরেই ঝুলে পড়া গেল। যা হাতে এসে যায়। টক, তেতো যা জোটে।

পাপিয়া বলেছিলো, বাঁচলাম বাবা! একটা অস্বস্তি দূর হলো।

অস্বস্তির বালাই ছিলো কিছু নাকি?

তা মনিষ্যির প্রাণ তো বটেই। একেবারে ইটকাঠ তো নই!

ও দারি ছাড়। ইটকাঠের ওপর আরো একটা জিনিস আছে, তার নাম পাথর।

এই শৌভনিক, শুনতে ভালো দেখাচ্ছে বলে বানিয়ে বানিয়ে কতকগুলো বাজে কথা বলিস না তো। বৌকে বলে দিয়ে আসবো।

হ্যাঁ। তুই না হলে আর এতো খাটুনি স্বীকার করাতে যাবে কে? তবে বলে এলেও কিছু হবে না। বৌ জানে।

চমৎকার। এক পাড়ায় বাস। নতুন বৌয়ের কাছে এই বেচারীকে এমন ‘দাগী আসামী’ মার্কা করে চিনিয়ে দেবার মানে?

এই ‘প্রাণ’টা যে একটা দাগা-খাওয়া প্রাণ সে খবরটা জানিয়ে দিয়ে একটু সিমপ্যাথি পাওয়ার আশায় আর কী!

ওঃ। কী বুদ্ধি। সিমপ্যাথি পাবার উপায় একখানা আবিষ্কার করেছিস বটে!

পাবো না?

মাথা খারাপ।

কেন? এই অভাগাকে ‘আহা বেচারী’ ভেবে যদি মায়াদয়া করে তার ‘ত্রুটিটা একটু মেনে নেয়।

থাম। বেশী বকিস না! ‘ত্রুটি’। ‘ত্রুটি’টা হতে দিবি নাকি? দু’দিন বাদেই তো দেখা যাবে প্রেমের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিস!

বলছিস? আহা! তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। আর ‘ঈশ্বর’ নামের যদি কেউ কোথাও থাকে তার কাছে প্রার্থনা করি—যেন তুই চটপট আমার এই লালকালিতে লেখা ‘পত্তর টার একটা রিটার্ন দিতে আসিস!

চলে গিয়েছিলো হাসতে হাসতে। তবু কোথায় যেন একটু বেদনার মোচড় ছিলো।

কিন্তু পাপিয়া কী করবে? পাপিয়া যে নিজেই সেই অভাগা সহপাঠীটির ভাষায় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে।

নিজেকে ‘তুচ্ছ’ না ভাবলে কী আর এমন হ্যাংলা স্বভাব হয়?

তুমি এসে এখানেই বসে থাকলে? বাড়ির মধ্যে যাবে না?

যদি নাই যাই?

তাহলে আমাকেই চলে যেতে হয়।

তাই বুঝি? তাহলে বিদেয় হই—বলে পাপিয়া উঠে দাঁড়ায়।

এখন বাপ্পা অপ্রতিভভাবে বলে, তা বলে এক্ষুণি চলে যেতে বলিনি।

বিদেয় হও—বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত বলছো?

কী আশ্চর্য! তুমি যে কেন আমার অস্বস্তিটা বুঝতে পারছো না।

পাপিয়া শান্ত গলায় বলে, বুঝতে পারছি। আর পারছি বলেই উঠে যাচ্ছি।

আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে যেতে মনে মনে বলে, শৌভনিক রে। তোর ‘পত্তরে’র রিটার্ন পাবার আশা ছাড়। তারপর আবারও সেইভাবে বলে, হয়তো সেটাই ঠিক। ওই লোকটা বিয়েটিয়ে করে বোকাটে একটা ঘরসংসারী জীব হয়ে গেছে, এ দৃশ্যটাও তো ঠিক মনে এঁকে ফেলতে পারা যায় না।

.

কিন্তু নিজের ভবিষ্যতের ছবিটাই কী কখনো কোনো সময় এঁকে ফেলতে চেষ্টা করেছে পাপিয়া?

না। পাপিয়ার কাছে এই ‘নিজে’ বলে কোনো শব্দই কী ছিলো কখনো? পাপিয়ার ধ্যানজ্ঞান লক্ষ্য ছিলো তাকে একটা ‘আস্ত মানুষ’ হয়ে উঠতে হবে। মানুষের সেবা করবার শক্তি অর্জন করতে হবে। আর সেই সেবা করবার ইচ্ছে থেকেই বেছে নিয়েছিলো শিক্ষার এই লাইনটা। ডাক্তারি! ডাক্তার হলে সে সুযোগ সহজে হাতের কাছে এসে যায়।

সেই লক্ষ্যেই তো অগ্রসর হচ্ছিলো?

হঠাৎ কেন শান্ত অরণ্যে ঝড় উঠলো? কেন সেই ঝড়ে সব ওলোটপালোট হয়ে গেল? সেই ওলোটপালোটের মধ্যেই না হঠাৎ নিজের ‘নিজে টাকে আবিষ্কার করে বসলো পাপিয়া। …দেখে অবাক হয়ে গেল কোন শৈশব বাল্য থেকে অজান্তে নিজেকে বিকিয়ে রেখে বসে আছে পাপিয়া! অথচ নিজেরই জানা ছিলো না। সেই ছেলেবেলায় আকর্ষণের মানে জানতো না, ভালোলাগার কারণ বুঝতো না। শুধু ছিলো তারা।

.

পাপিয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবার পর ভয়ানক একটা অস্থিরতা বোধ করল বাপ্পা! যেন কোথায় কী একটা ভেঙেচুরে গেল। অথচ অনুভবে আসছে না সেটা কী? সত্যিই কী ছিলো কোথাও কিছু?

হঠাৎ খুব একটা রাগ এলো বাপ্পার নিজের বাড়ির ওপর।…যেন সবাই মিলে বাপ্পাকে একটা ফাঁদে ফেলে দিয়ে মজা দেখছে।

কী দরকার ছিলো আদিত্য গাঙ্গুলী নামের লোকটার এমন গা ছেড়ে বিছানায় পড়ে থাকবার? এটা যেন লোকটার অপরকে জব্দ করার একটা ফন্দি।…কী দরকার ছিলো নয়নতারা গাঙ্গুলীর এমন আচমকা সরে যাওয়ার? বাপ্পার উপস্থিতির মধ্যে? পালিয়ে গেলে কী এভাবে আটকে পড়তো হতো?…আর কী দরকার ছিলো এই সময়ই সত্যব্রত গাঙ্গুলীর ‘পাবনা-প্রেম’ জেগে ওঠবার?

আর সবথেকে রাগ হতে থাকলো শিলাদিত্যর ওপর।

তুই তো বেশ যা ইচ্ছে করে দায়িত্বমুক্ত হয়ে পার পেয়ে গেলি। যতো দায় দাদার। কেন?

এ প্রশ্নে আদিত্য বলেছে, ওর কথা তুলে লাভ কী? ‘অমানুষের’ কাছে আবার কার কী প্রত্যাশা? তবে তুমিও যদি ‘অমানুষের’ লিস্টে নাম রাখতে চাও, বলবার কিছু নেই!

এ কী ভয়ানক অবস্থায় পড়া! কেন সবাই তাকে বেঁধে মারবে। আর বাপ্পাকে নিরুপায় হয়ে সেই মারটা খেতে হবে পড়ে পড়ে? বাপ্পা ভেতরে বাইরে যতো অসহায়তা বোধ করে ততো রেগে উঠতে থাকে।…আর হঠাৎ কখন মনে মনে বলতে শুরু করে, ‘এতো সব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে তুমি কেন আবার অদ্ভুত একটা ঝঞ্ঝাটের মূর্তি নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালে বল তো? আমার স্বভাবটাই উল্টেপাল্টে যেতে বসেছে। আমি কিছুতেই আমার এই অস্বস্তিটাকে ঝেড়ে ফেলে উড়িয়ে দিতে পারছি না। অথচ আগে সবকিছুই তা পেরেছি।…আবার ভাবে আসল কথা—এখানে আমার কোনো কাজ নেই, তাই এমন অসহায়তা অনুভব করছি। না না! এ চলতে পারে না। এ হতে দেওয়া যায় না। আবার আমায় কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।…আমায় চলে যেতে হবে।

পুরলিয়ার সেই আদিবাসী লোকগুলোর মুখ মনে পড়ে যায় বাপ্পার। বাপ্পা তাদের ‘সাক্ষর’ করে তুলতে চেষ্টা করছিলো। তাদের মধ্যে চেতনা এনে দেবার ভাষা আয়ত্ত করছিলো। তারা বাপ্পাকে ভালোবেসেছিলো, বিশ্বাস করেছিলো।

বাপ্পাদিত্য গাঙ্গুলী! তুমি কী সেই সরল লোকগুলোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? তা হতে পারে না!

.

এই, এই, গাড়িটাকে একটু থামাও না—চটপট।

খ্যাঁচ্ করে গাড়িটাকে থামিয়ে যুধাজিৎ ঘাড় ফিরিয়ে বলে, কী হলো?

আরে কতোখানি এগিয়েই এসে গেলাম। মেখলা বলে ওঠে, ওই যে ফুটপাতের ওপারে ওই দোকানটার সামনে একজনকে দেখতে পাচ্ছো, একটা হাত ব্যান্ডেজ করা গলায় ঝোলানো, কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট পরা। আঃ! কোন দিকে তাকাচ্ছো? ওই স্টেশনারি দোকানটার সামনে! তাকাও না—দেখতে পাচ্ছো না?

যুধাজিৎ বলে, হুঁঃ। পাচ্ছি। তো ওকে তোমার দরকার?

ভীষণ দরকার। কিছুতেই ফসকানো চলবে না।

কী ব্যাপার? প্রাক্তন প্রেমিক নাকি?

আঃ। অসভ্যতা কোরো না তো। আমি এগোচ্ছি। তুমি এসো।

মেখলা নেমে পড়ে ডান হাতখানা উঁচু করে এগোতে থাকে কোনো একটা কিছু নাম ধরে ডাকতে ডাকতে। রাস্তার বহুবিধ শব্দে সেই ডাক-এর মর্মোদ্ধার করতে পারে না যুধাজিৎ! তবে না পারলেও বুঝতে পারে লোকটাকে মেখলার সত্যিই ‘ভীষণ দরকার’। তা না হলে রাস্তার মাঝখানে একটা একহাত ভাঙা লোকের বাকি হাতখানা বেপরোয়া চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসে!

.

নলিন সরকার ষ্ট্রীট থেকে বেলেঘাটায় মুখুজ্যেবাড়ির দরজা পর্যন্ত সারাক্ষণ সন্ধ্যাতারা চোখ মুছেছে, নাক মুছেছে, আর মাঝে মাঝে একটা কথাই উচ্চারণ করেছে, ‘বাবা আর ফিরেছেন!’

আপন হৃদয়ভারে ভারাক্রান্ত সঙ্গী মেয়েটা তখন বলে উঠছে বটে, ‘ওকথা কেন ভাবছো বড়মা? সেখানে থাকা সম্ভব হবে এমন মনে হচ্ছে তোমার?’

সন্ধ্যাতারার চোখের জল আরো উপছে উঠেছে, ‘বাবাকে তুই চিনিস না পাপিয়া। বাবার কাছে ‘অসম্ভব’ বলে কিছু নেই।’

অন্যসময় হলে পাপিয়া তার চিরঅবোধ বড়মাকে নানা কথায় ভুলিয়ে চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করতো, কিন্তু এখন নিজের মধ্যেই জোরের অভাব। তাই আলগা আলগাভাবে এক একবার বলছে, ‘তুমিই’ তো বলো আগে থেকে ‘অশুভ’ চিন্তা করতে নেই। তবে নিজেই তা করছো কেন বল তো?

আবার উথলে উঠছে সন্ধ্যাতারা, আমি যে দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছিরে পাপিয়া। বাবা আর ফিরবেন না।

দিব্যচক্ষে? তোমার তাহলে দিব্যদৃষ্টি আছে বল?

অবস্থায় পড়ে আসে সে দৃষ্টি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বাবা শত অসুবিধেতেও পাবনাতেই থেকে যাবেন!

পাপিয়া তেমনি নির্লিপ্ত গলায় বলে, তাহলে ধরে নিতে হবে সেই থাকাটা ওঁর কাছে সুখের হবে!

তা তো হবে। কিন্তু আমাদের?

আবার অশ্রুধারা দুর্বার।

পাপিয়াও যেন হঠাৎ কেমন নির্বিকার।

কাঁদতে দিচ্ছে সন্ধ্যাতারাকে। চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে।

বাড়ির কাছাকাছি আসবার আগে বলে, এবার নিজেকে একটু সামলাও বড়মা। এভাবে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ঢুকলে জ্যেঠু আপসেট হয়ে যাবেন! তাছাড়া অন্য সবাইও তো—

অন্য সবাই। জ্যেঠু! তাই তো, কী মুশকিল।

সন্ধ্যাতারা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে। সফলও হয়।

কিন্তু আবার একটা ভয়ানক বেসামাল হয়ে পড়বার অবস্থা ঘটবে তা কী স্বপ্নেও ভেবেছিল সন্ধ্যাতারা? অথবা তার পাহারাদার পাপিয়া মুখার্জি?

ট্যাক্সিটা মোড় ঘুরতেই পাপিয়া অবাক গলায় বলে, বাড়ির সামনে মেখলাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে!

হ্যাঁ, রাস্তায় ধরে ফেলা হাতভাঙা লোকটাকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে শেষ পর্যন্ত গাড়ির মধ্যে ভরে ফেলে, সে গাড়িকে এই বাড়িটার সামনে এনে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো টুসকি!

তবে খুব সহজে কী?

‘কালো প্যান্ট সাদা শার্ট’ গলায় একটা হাত-ঝোলানো লোকটা বাকি হাতখানা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা কী কম করেছিলো?

কিন্তু পেরে ওঠেনি।

যুধাজিৎ বলেছিলো, বৃথা চেষ্টা করবেন না দাদা। মহিলাটি যে কী ডেঞ্জারাস জাঁদরেল, সে ধারণা নেই আপনার। তাছাড়া দেখছেন তো এই দেড় মিনিটেই আশেপাশে লোক জমতে শুরু করছে। করবে না? একদম হিন্দি সিনেমার একখানা ঘোরালো ‘সিন’। চেঁচিয়ে লোক জড়ো করে পুলিশ ডাকতে তো পারবেন না।

দৃশ্যটা অবলোকন করে শেষ পর্যন্ত গাড়িতে উঠেই পড়তে হয়েছিলো গলায় হাত-ঝোলানোকে। বলেছিলো, এই হাতটা যে বড়ই বেকায়দায় ফেলেছে, তা না হলে—তারপর মুখ ফিরিয়ে বলেছিলো—একখানা গাড়িবান বর বাগিয়ে তোর খুব উন্নতি হয়েছে দেখছি।

যুধাজিৎ বলেছিলো, দেখলেন তো? বলিনি দারুণ ডেঞ্জারাস মহিলা।

গাড়িটা চলছে।

কালো প্যান্ট সাদা শার্ট ব্যস্ত গলায় বলে ওঠে, ও মশাই, কোন্‌দিকে চলছেন?

ঠিক দিকেই।

দিকটা ঠিক করবে কে? থামুন! এই সামনের মোড়ে আমায় নামিয়ে দিন।

সম্ভব নয়।

সম্ভব নয় মানে?

মানে দেখছেনই তো হুকুমের চাকর। হুকুম না পেলে—

বাজে কথা রাখুন। গাড়ি থামান। না হলে-

মেখলা একটু হেসে বলে, না হলে কী করবে? ‘আমায় কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে-বলে চেঁচাবে?

তোর মতলবটা কী?

ধরতে পারছো না?

ধরতে পারলেই কী ভেবেছিস ধরা দিতে যাবো?

মেখলা জোরের সঙ্গে বলে, কেন নয়? ধরে যখন ফেলেছি, ঠিক জায়গায় জমা দিয়ে তবে আর কাজ।

বাজে কথা রাখ। গাড়ি থামাতে বল। হুকুমের চাকরটি তো আবার মালকিনের হুকুম ভিন্ন কিছু করবেন না। বল, আমায় নামতে হবে।

মেখলা এখন হঠাৎ সুর বদলে কাতর গলায় বলে, আচ্ছা তোমাদের মনে কী মায়াদয়া বলে কিছুই নেই? মা-বাপ ভাই বোন অন্যসব আপনজন কেউ কিছু না? সবার উপরে ‘প্রেমই সত্য’ তাহার উপরে নাই? আমার মায়ের পেটের দাদাটির হচ্ছে পার্টিপ্রেম, আর তোমার হচ্ছে পত্নীপ্রেম। অবস্থা একই

পত্নীপ্রেম?

গলায় হাত-ঝোলানো কালো প্যান্ট সাদা শার্ট হঠাৎ বেমক্কা একটা জোর হাসি হেসে বলে ওঠে, কী বললি? পত্নীপ্রেম? হা হা। মাথা নেই তার মাথাব্যথা!

মেখলা চমকে উঠে বলে, ‘নেই’ মানে?

নেই মানে নেই! আর কোনো কথা নেই।

মেখলা একটু থমমত খেয়ে যায়! একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর দ্বিধা জড়ানো গলায় আস্তে বলে, তাহলে তো যেতেই পারো-

যেতেই পারি? সেখানে এই ‘নিখিন্নে’ মুখটা দেখাতে যেতেই পারি? চোখের চামড়া বলে একটা জিনিস নেই? যার জন্যে এই এতোদিন—

হঠাৎ থেমে যায়। একখানা হাত তুলেই মুখ ঢাকে।

যুধাজিৎ গাড়ির গতিটা একটু কমিয়ে আনতে আনতে স্থির শান্ত গলায় বলে, সেখানে ওটা কোনো প্রবলেমই নয়।

না না। দোহাই আপনার। আমায় ছেড়ে দিন।

আর কোথায় ছেড়ে দেব? এসেই তো গেছি। দিলে বাড়ির মধ্যেই ছেড়ে দিতে হবে। তাই দেওয়া হবে।

.

টুসকিদের গাড়ি? চিনতে পারছিস তুই?

ওমা। চিনবো না? মানুষ চেনাই শক্ত বড়মা। আর সবই সহজে চেনা যায়।

এই দার্শনিক উক্তিটি করে ট্যাক্সিভাড়া মেটানোয় মন দেয় পাপিয়া। ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে যায় সন্ধ্যাতারা। সহজেই ঢোকে। দরজা খোলাই ছিলো।

ঢুকে এসে সামনের ঘরের দরজা থেকেই সাড়া নেয় সন্ধ্যাতারা। গাড়িতে কে এসেছে রে?…..আর তারপর ঘরের দরজার মধ্যে পা ফেলার পর? হঠাৎ প্রায় আর্তনাদের মতো একটা শব্দ ঘরের বাতাসে আছড়ে পড়ে যেন দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা মেরে ছড়িয়ে পড়ে— ‘কে? কে? অ্যা—খোকন। তুই! কী হয়েছে তোর? কী দেখাতে এলি আমায়?’

.

বনছায়ার অনেকগুলো উদ্বিগ্ন প্রশ্নে যুধাজিৎ অবহেলাভরে বলে, এমন কিছুই হয়নি গো মা। শুধু আমার ওই শালাবাবুটি একটা রিকশাগাড়ির হ্যান্ডেলে ধাক্কা খেয়ে নিজের একখানি হ্যান্ড জখম করে বসেছেন।…তাই বললাম তোমার বৌমাকে, তোমার খোকনদা হাতখানাকে ভাঙলেন ভাঙলেন, কিনা রিকশার ধাক্কায়? ছিঃ, একখানা জম্পেস কিছু জুটলো না? লরী ট্রাক মোটরগাড়ি, নিদেনপক্ষে– মোটরবাইক, অটোও—তা নয় রিকশার হ্যান্ডেল! মানসম্মান বলে কিছু থাকলো?

বনছায়া ষাট ষাট করে বলেন, কী যে বলিস!…ট্রাক লরী! মোটরগাড়ি! দুর্গ, দুর্গা। ভগবান অল্পের ওপর দিয়ে ফাঁড়া কাটিয়ে দিয়েছেন। যা সব দস্যি দস্যি গাড়ির নাম করলি, তাই হলেই বুঝি ভালো হতো? তাতে আরো কতো বড়ো বিপদ হতে পারতো তা ভাব? তোদের এ যুগের ‘মানসম্মানের’ মাপকাঠিকে বলিহারী! ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ হতে হলে—বড় গাড়ি না হলে মানসম্মান থাকবে না? এমন কথা সাতজন্মে শুনিনি বাবা।

যুধাজিৎ বলে ওঠে, কেন শুনবে না গো মা। চিরকাল কথা নেই, ‘মারি তো গণ্ডার। লুঠি তো ভাণ্ডার!’ ‘বড়র’ প্রতিই তো সম্মান লোকের।

সে সম্মান কী ‘মাপে বড়র’ প্রতি?

তা ‘বড় মাপের’টি আর সর্বদা জুটছে কই? তাই ‘বড় মাপের মানুষ’ খোঁজার দিকে যেতে জানে না লোকে! মাপে বড় জিনিসের দিকে ঝোঁকে।

সবসময় তোর তত্ত্বকথা। তো কই বৌমা, এসো, ভালো করে সব শুনি তোমার কাছে ঘটনাটি। জিতুর তো খাপছাড়া খাপছাড়া কথা। আহা! বড়ো একটি ভালো কাজ করেছ আজ মা! মায়ের বাছাকে মায়ের কাছে ধরে এনে দিতে পেরেছো। তোমার পিসির খাঁ খাঁ করা শূন্য প্রাণখানা ভরলো, জুড়লো। একই শহরের মধ্যে থেকে ছেলেটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন না মানুষটা! ভাবা যায়? আর ছেলেকেও বলিহারী দিই। কী পাষাণপ্ৰাণ গো!

যুধাজিৎ হেসে হেসে বলে, তোমার ছেলের মতো এমন ‘কাদার প্রাণ’ আর ক-টা খুঁজে পাবে মা? দিকে দিকে তাকিয়ে দেখ? সব প্রাষাণপ্রাণ!

তা সে তো একশোবার। ভগবানের অশেষ কৃপা আমার ওপর। তাই তোর মতো ছেলে পেয়েছি।

দেখলে? দেখলে মেখলা? ‘গুড্‌বয় হয়ে’ মরলাম ব্যাটা আমি। আর ক্রেডিটটা জুটলো মহাত্মা ভগবানের!

সেটাই নিয়ম। কিন্তু মা, আসছি আপনার কাছে। তবে তার আগে কাকার সঙ্গে দেখা করে আসি। এতোক্ষণ ছিলাম না। বার কয়েক নাকী খোঁজ করেছেন!

বনছায়া ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে একটি তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, মেয়েটার গুণের তুলনা হয় না। মনে মনে ভয় ছিলো, তোর কাকাকে স্বচক্ষে দেখতে পারবে কিনা। যতই হোক একটু খামখেয়ালি বিদঘুটে মতো তো?

একটু?

আহা, না হয় অনেকটুকুই। তো সে ভয়ও তো থাকতে দেয়নি বৌমা। কী রকম আপন করে নিয়েছে মানুষটাকে। ভালোবাসা! ভালোবাসাই পারে পরকে আপন করতে, ‘অসহ্য’কে সহ্য করাতে!…আবার সেইটুকুর বিহনেই—আপনকে পর করায়

কারেক্ট। সেইটুকুর বিহনেই ল্যাংড়া গাছে আমড়া ফলায়। যেমন ‘শ্রীমতী বনছায়া দেবী’ নামের ল্যাংড়া আমের গাছটিতে শ্রীমতী শুভশ্রী দেবীরূপ আমড়ার ফলন!

আঃ। দিদিকে অতো ঠাট্টা করিস কেন বল তো?

ঠাট্টা? পিওর সত্য। জামাইবাবু হেন মহাপুরুষটার ভাগ্যে কিনা ওই টক আমড়া।… কথাটা বলেই যুধাজিৎ একটু হাসে। বলে, তবে আমড়া আছে ল্যাংড়া ফলার দৃষ্টান্তও যে নেই তা নয় মা!…গলাটা একটু নামিয়ে বলে, সে দৃষ্টান্ত তোমার ঘরেই মজুত।…যাক গে, নাম করে বলাটা ঠিক নয়। যতই হোক মাননীয়া গুরুজন তো।

বনছায়া সরল তবে অবোধ নন। তাই কথাটা ধরতে দেরী হয় না। আর তাই আস্তে বলেন, দোষ দেওয়া যায় রে। তার ভেতরেও তো অনেক জ্বালা।…তো ছাড় ও কথা। কই বৌমা এলো না?

জ্বালাবিহীন হৃদয় বনছায়া যে কী করে অন্যের ‘জ্বালা’টা বুঝে পেলেন, এটাই আশ্চর্য! আরো আশ্চর্য, সেই জ্বালার প্রতি সহানুভূতির ‘অনুভূতি’।

যুধাজিৎ সর্বদা দেখা এই আশ্চর্যের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়েও, স্বভাবসিদ্ধভাবে বলে ওঠে, বৌমা তিনি বোধহয় তাঁর ‘ফ্রেণ্ড’ কাকাশ্বশুরের কাছে, তাঁর হতভাগ্য হাতভাঙা দাদার দুর্দশা-কাহিনিটি শোনাতে বসে গেছেন। এক পোড়-খাওযা ভ্রান্ত পথিকের কাছে, আর এক সদ্য পোড়া ভ্রান্ত পথিকের কাহিনি! দুজনের জীবনের হিস্ট্রীতে একটা সাদৃশ্য আছে। করুণ করুণ দুঃখময়।

.

তা কাহিনিটি সত্যিই বড় করুণ।

‘ভালোভাবে থাকতে চাই, বাঁচার মতো করে বাঁচতে চাই।’ এই শ্লোগানটি মনে গেঁথে, বেলেঘাটার মুখুয্যেবাড়ির বড় নাতি স্বর্ণাঙ্ক মুখার্জির মুখুয্যেবাড়িখানাকেই ত্যাগ করে চলে যাওয়ার ভ্রান্ত বুদ্ধি তাকে যে পথে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলো তা ক্রমশই মৃত্যুর পথ। কারণ তার পথসঙ্গিনীটি ভালোভাবে বাঁচতে হবে—এই মন্ত্রটাকেই আরো জোরে আঁকড়ে ধরে নিজের পথ দেখতে বসেছিলো।……

বুঝে ফেলেছিলো ‘নৌকো’ বাঁধতে হলে বড় গাছে বাঁধাই বুদ্ধির কাজ।

ফলশ্রুতি ডিভোর্স।

এবং পরবর্তী ঘটনা, বাড়িওয়ালার বড়লোক শালার ছেলেটিকে বেছে নেওয়া!

ভুক্তভোগী কাকাশ্বশুর বলে ওঠেন সেম! সেম ঘটনা!…হয়তো পৃথিবীর সব ধ্বংসের ইতিহাসেই থাকে একই ঘটনা। লোভ আর বিশ্বাসঘাতকতা!

.

ওদিকে সন্ধ্যাতারা তখন ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে উঠছে, ‘এই ভাঙাহাতে, তুই এক হাতে— এক হাতেও রেঁধে খেয়েছিস?…রাস্তার দোকানের ডালরুটি খেয়ে খেয়ে রাত কাটিয়েছিল? …মাংস পরোটার পয়সা জোটেনি বলে ডালরুটি!…ওরে খোকন, শুনে শুনে যে আমার কপাল চাপড়ে মরতে ইচ্ছে করছে।…ওরে নিষ্ঠুর নির্মায়িক ছেলে, একবার তোর মায়ের মুখটা মনে পড়েনি?…মনে পড়েনি এ সংসারে তোর সব বজায় আছে!

সেইটাই অনুভবে আসেনি মা! মনে হয়েছিলো, কী আর থাকবে? সবকিছুই তো নিজের হাতে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে এসেছি।

তুই সবাইকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছিস বলেই কী তোকে সবাই ছুঁড়ে ফেলে দেবে খোকন? এতো ভুলবুদ্ধি কেন?

ভুল তো গোড়া থেকেই মা!

তবু মনেপ্রাণে তো বুঝিসনি বাবা সেকথা। একবারও তো ভাবিসনি ‘আমার যদি কেউ না থাকে, তবু মা আছে।’ ওই গুণের সাগর মেয়েটা যাই তোকে দেখে ফেলে ধরে নিয়ে এলো তাই না আবার তোকে ফিরে পেলাম বাবা! তা না হলে–হয়তো তোর মার কাঁদতে কাঁদতেই জীবন অবসান হতো! আশ্চয্যি, এই শহরের মধ্যে রয়েও তুই হারিয়ে বসে রইলি। রাতদিন মাথা খুঁড়েছি, কেউ তোকে খুঁজে আনতে পারলো না!

যার উপর অভিমানভরা কটাক্ষপাত সেই ‘কেউ’টার ‘প্রতীক’, সদ্যপ্রয়াত শুভ্রাঙ্ক মুখুয্যের অপরাধী বড়ছেলেটি আস্তে বলেন, একটা অ্যাডাল্ট মানুষ যদি ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, কে তাকে খুঁজে বার করে এনে দিতে পারে? পারে শুধু দৈব।…সেটাই ঘটেছে। ওসব ‘কে, কী বৃত্তান্ত, কী হলে কী হতে পারতো, আর কী না হলে কী হতো না’ এসব মিথ্যে আলোচনায় লাভ নেই। ওসব ছেড়ে ছেলেটার শরীরটা যাতে সারে, তার চেষ্টা করো দিকি। কী চেহারা হয়েছে! চিনতে পারা যায় না।

সত্যিই তাই। ‘স্বর্ণাঙ্ক’ নামের অধিকারী ছেলেটার যা চেহারা দাঁড়িয়েছে তাতে চিনতে পারা শক্ত। তবু মেখলা চিনতে পেরেছিলো। এবং সেই পাবার সূত্রেই না পলাতক আসামীর এই নাটকীয় প্রত্যাবর্তন!

.

চেহারা দেখে বাড়ির অন্য সদস্যরা আড়ালে ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ বলে হাসাহাসি করলেও, ওপরে আহ্লাদে আদরে বিগলিত ভাবই দেখাচ্ছেন!

সন্ধ্যাতারা বলে, খোকন! তোর সাতবেলা এঘরে ওঘরে নেমন্তন্নর চাপে মায়ের ঘরে আর খাওয়াই হচ্ছে না।

প্রথমটায় অবাক হয়েছিলো খোকন, ‘এঘরে ওঘরে, তোমার ঘরে’ এসবের মানেটা কী মা?

খোকনের হাঁপানী রুগী বাবা শান্ত গলায় বলেছিলেন, থাকতে থাকতেই মানে বুঝতে পারবি বাবা!

তা অবশ্য পারে খোকন। ক্রমেই পেরে যায়।

আর অবাক কথা, এই একদা যে ঠাসবুনুনি অখণ্ড সংসারের চেহারাখানা তার চিত্তে বিরূপতাই এনে দিয়েছে, মনে হয়েছে ‘ভেড়ার গোয়াল’! মনে হয়েছে কতকগুলো বোধহীন সৌন্দর্যজ্ঞানহীন কাদার তালের মতো মানুষের সমষ্টিমাত্র, আর মনে হয়েছে ‘এভাবে বাঁচার কোনো অর্থ হয় না—’ সংসারের সেই পরিচিত চেহারাখানা না দেখতে পেয়ে ভিতরে ভিতরে একটা গভীর শূন্যতাবোধ করছে ছেলেটা। যেন তার কিছুদিনের অনুপস্থিতির অবকাশে, কী একটা বড় জিনিস হারিয়ে গেছে।

এ বাড়ির সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অথচ ‘খোকন’ নামধারী ছেলেটা হঠাৎ হঠাৎ যেন নিজেকেই এর জন্যে দায়ী করে।…’আমার ওভাবে চলে যাওয়াই হয়তো কারণ! হয়তো ওই ঘটনাটাই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছে। একাত্মতার যে ভাবটি অভ্যাসগতভাবে ধারাবাহিক ধারায় বহে আসছিলো, সেখানে আমার এই অন্যায় অসঙ্গত অসভ্য ব্যবহার ঘূর্ণীস্রোত বইয়েছে।

ঠিক এই ভাষায় না ভাবতে পারলেও এইরকম একটা অপরাধবোধের ভার সঞ্চিত হয়েছে এ বাড়ির স্বর্ণাঙ্ক নামের ছেলেটার মধ্যে।…আমিই সব বেঠিক করে দিয়েছি।…অথচ নিজের জীবনটাকেও বেঠিক করে বলেছি, তচনচ করে ফেলেছি। এখানে এসে সেই পুরনো ছবিখানা ফিরে পেলেই কী আমি আমার পুরনো ‘আমি টাকে ফিরে পেতাম?…সেই সদ্য

‘আমি’টাকে নিঃশঙ্ক হাওয়ায় ভাসা আদরের দুলাল জীবনটা! পেতাম না। আমার এই ভাঙাচোরা দাগটা কী মুছে যেতো?

নাঃ। একটা আস্ত জিনিস ভেঙে গেলে, আর কিছুতেই আগের চেহারা ফিরে পায় না।

খোকন টের পায় মা আবার তার জীবনটাকে গড়ে তোলবার স্বপ্ন দেখছে। খোকন কী সেই স্বপ্নের অংশীদার হতে যাবে?…..

তা হয়তো হতে পারে। মেরুদণ্ডহীন ছেলেটা আবার একটা কাউকে অবলম্বন করতে চাইবে। কিন্তু সন্ধ্যাতারার স্বপ্নছবিটি কী তাতে রূপ নিয়ে গড়ে উঠতে পারে?

তা পারার নয়।

ভাঙাপড়ার খেলারও যে একটি অবিচ্ছিন্ন ধারা আছে; তাই আবারও একদিন দেখা যাবে বেলেঘাটার এই মুখুয্যেবাড়িটার মধ্যে যারা অনেকদিন ধরে এক ছাতের তলায় মাথা রেখে বাস করছিলো, তারা বাসাভাঙা পাখির মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে চলে গেছে এই ছাতের তলাটাকে পরিত্যাগ করে। যেমন একসময় এদেরই আগের পুরুষ পুরনো বাসা ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছিলো সেই মানিকতলার চকমিলোনো বাড়িটা থেকে। …বৃহৎ বৃক্ষের শাখা-প্রশাখারা ছড়িয়ে পড়ে, কেউ আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আবার মাটিতে ঝুরি নামিয়ে নামিয়ে প্রতিষ্ঠিত চেহারা নিয়ে দীপ্যমান হবে। কেউ হয়তো ঝড়ে ভেঙে ধুলোয় মাটিতে মিলিয়ে যাবে।

শাখা-প্রশাখারা ক্রমশ আর কেউ কাউকে চিনতে পারবে না। খেয়ালও করবে না একদা একদিন তাদের মূল কাণ্ডটি একই ছিলো।…

আবার দূরকালে কেউ একদিন তার শিকড়ের খোঁজে অস্থির চেষ্টায় ঘুরে বেড়াবে।… তার মনে হবে শিকড়টাকে জানা হচ্ছে সবথেকে জরুরি। যেন সেইখানেই রয়েছে তার অস্তিত্বের স্বীকৃতি।

.

অভাবিত ঘটনাচক্রের দুরন্ত ঝড়ে শিকড় উপরে বহুদূরে ছুটে এসে পড়া পাবনার উকিল-পাড়ার সত্যব্রত উকিল কি একচল্লিশ বছর পরে আবার তাঁর সেই শিকড়ের মাটিতে গিয়ে পড়ে, তাঁর সেই অস্তিত্বের স্বীকৃতিটি খুঁজে পেয়ে গেলেন? দেখলেন তাঁর কিছুই হারায়নি।….সেই তাঁর আকাশ বাতাস মাটি গাছপালারা তাঁকে চিনতে পেরে উল্লসিত হয়ে বলে উঠলো, ‘সে কী? চলে যাবে কী বলো? থাকো। থাকো!’

.

নীহারিকা বিপন্ন গলায় বললো, বাবা সেই তাঁর কী যেন ডাক্তারের ছেলে পেন্টু না ঘন্টুর ভরসায় সেখানে রয়ে গেলেন? বলছো কী নীলুদা? তুমি শুনলে সে কথা? জোর করলে না?

নীলু একটু হেসে বলেন, তুই চিরদিনই ছেলেমানুষ থেকে গেলি নীরু। আমি জোর করবার কে?

আদিত্য বলে ওঠে, অতো বেশী উত্তেজিত হবার ভান দেখাচ্ছো কেন বলতো? ধরা পড়ে যাবে যে?

তোমার এ কথার অর্থ?

চিরটাকাল আমার কথা শুনে এলে অথচ আজ পর্যন্ত তার অর্থটা বুঝে ফেলবার বুদ্ধিটা জন্মালো না? আশ্চর্য তো। বাবার ডিসিসানে ভালোই তো হলো। ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মারলো!…ওহে নীহারিকা দেবী, তুমি কী ভেবেছিলে, পাবনার সত্যব্রত গাঙ্গুলী পাবনায় গিয়ে পড়ে, আবার তোমার এইখানে ফিরে আসবে?

ওঃ। তুমি তাহলে জানতে আর ফিরে আসবেন না।

অফ কোর্স। জানতামই তো।

অথচ যেতে দিয়েছিলে? বাধা দাওনি!

বাধা দেবো? কেন বাধা দেবো? যে মানুষটা প্রাণপণ চেষ্টায় ‘চিরআকাঙ্ক্ষিত স্বর্গে’র কাছে পৌঁছে গেছে, তাকে আবার টেনে আস্তাকুঁড়ে নামিয়ে আনার জন্যে?

কী? এখানটা আস্তাকুঁড়?

আমার তো তাই ধারণা।

তবু নিজে এখানেই পড়েও তো আছো।

উপায় কী? আমার তো আর দ্বিতীয় কোনো জায়গা নেই। তাই পড়ে মার খেয়ে চলেছি সারাজীবন।

তুমি! তুমি সারাজীবন পড়ে মার খেয়েছো? ওঃ। ইচ্ছে করে পঙ্গু সেজে বিছানায় গা ঢেলে, রাজাই আরামে চালাচ্ছো, কোথা থেকে তার রসদ আসছে, তা না দেখবার জন্যে বেহুশের ভান করে দিব্যি মজা মারছো—আর তবু বলছো কিনা—বলছো কিনা…এখানটা এখানটা—নীহারিকা হাঁপাতে থাকে। আস্তাকুঁড়। চিরকাল তুমি আমায় অপমান করে এসেছো। কেন? কেন? আমি এর শোধ নেবো। এক্ষুণি নেবো জব্দ করে যাবো তোমায়—

ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নীহারিকা। কিন্তু সিঁড়ির মুখেই একটা বাক্কা খায় বাপ্পার সঙ্গে। বাপ্পা ধরে না ফেললে হয়তো পড়েই যেতো।

কী ব্যাপার? এ ভাবে যাচ্ছো কোথায়?

কোথায় যাচ্ছি? মরতে! মরতে যাচ্ছি। ছেড়ে দে আমায়। সরে যা আমার সামনে থেকে। গাড়ির চাকার তলায় গিয়ে পড়বো আমি-

বাপ্পা কিন্তু স্থির গম্ভীরভাবে বলে, সেটা বরং পরে ধীরেসুস্থে যেও। এখন এক্ষুণি একটা নার্সিংহোমে যেতে হবে।

বাপ্পার কণ্ঠে যেন একটা অমোঘ স্বর।

নার্সিংহোমে! হঠাৎ বুকটা কেঁপে ওঠে নীহারিকার। বাকি দুই সন্তানের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অস্ফুট স্বরে একটা কিছু প্রশ্ন করে। হয়তো সেই প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন? কী হয়েছে?

বাপ্পা সেইভাবেই যেন একটা ধাতব কণ্ঠে বলে, শিলু একজন লোককে পাঠিয়েছে তোমায় জানাতে—ওর স্ত্রীকে নার্সিংহোমে দেওয়া হয়েছিলো, ইয়ে বোধহয় বাচ্চাটাচ্চা হতে, হঠাৎ অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়ে—

কী? কী বলছিস? থেমে গেলি কেন? কার অবস্থা খারাপ?

ওর স্ত্রীর। বোধহয়—বোধহয় এতোক্ষণে—

আবারও চুপ করে যায়।

কিন্তু আর বলবার কী আছে?

যা বোঝবার তা তো বোঝাই হয়ে গেছে।

তার মানে পরম দুঃখের সময় মাকেই প্রথম মনে পড়ে গেছে নীহারিকার ছেলের। যেন অনুভব করেছে—সেখানেই আশ্বাস আর আশ্রয়।

কিন্তু নীহারিকা! তুমি কী? অ্যাঁ? কী তুমি? এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে, তোমার মধ্যে এমন একটা পুলকের ভাব ফুটে উঠতে চাইছে কেন?

কী আশ্চর্য! তোমার ছেলেটা কতখানি হারিয়ে ফেললো, সে কথা মনে পড়লো না তোমার? তুমি কী পেয়ে গেলে সেই হিসেবটাই বড়ো হয়ে উঠলো?

নীহারিকা যখন পৌঁছলো, শিলাদিত্যর শাশুড়ি তখন সেই নার্সিংহোমেই আছড়া-আছড়ি করে চলেছেন, ওরে আমি কী কাজ করলাম। কী কাজ করলাম! কেন আমি সর্বনেশে ডাক্তারদের কথা শুনলাম।…খুকুর যে আমার চিরদিন ছুরিতে বড় ভয়। ও যে আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, ‘মা ভীষণ ভয় করছে! ভীষণ ভয় করছে—’ তবু আমি তাকে ছুরির নীচে সঁপে দিয়ে গেলাম! ওরা আমার খুকুকে কেটেকুটে মেরে ফেললো!

উন্মাদিনীর মতো সেই আছড়া-আছড়ি। এলোপাথাড়ি বিলাপ!

এ যুগে শিক্ষিত আর বিত্তবানেদের ঘরে কেউ ‘সিজিরিয়ান’ শিশু ভিন্ন অন্য কিছু ভাবতেই পারে না। কারণ অন্য কিছুটা—ইচ্ছে নেহাৎই সেকেলে গ্রাম্যতা। যে আসছে, সে যেন বিনাযুদ্ধে আসতে পায়, যুদ্ধক্লান্ত না হয়। কাজেই এখানেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। ভাগ্যের পরিহাস। শিশুটা বিনাযুদ্ধে বিনা আয়াসে পৃথিবীর আলো দেখবার সুযোগ পেয়ে যাবার পরক্ষণেই তার জননীর চোখের আলোটি মুছে গেল চিরতরে।

যে দুটো প্ৰাণ অনেকগুলো দিন ধরে একই আহার আর একই শ্বাসপ্রশ্বাসে বৰ্ধিত হচ্ছিলো, তাদের মধ্যে একজন অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর জগতে এসে পড়লো, অপরজন আচমকা আলোর জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়ে তলিয়ে গেল অজানা অন্ধকারে।

.

সেই হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার প্রবল ধাক্কায় বেসামাল তার মা, লোকলজ্জা বিস্মরণ হয়ে, সভ্যতার শর্ত অবহেলা করে আর্তনাদ করে চলেছেন, ওরে খুকু, তোকে হারিয়ে ফেলে শূন্য প্রাণে কোন্ মুখে ফিরে যাবো আমি! আমাকেও তোমরা ওর সঙ্গে চিতায় দিয়ে এসো— গো!

শোকের বিলাপ এমন একটা ব্যাপার যে সহজে থামতে চায় না। কথার পিঠে আরো কথা এসে যায়।….

দুজন নার্স মহিলাকে বুঝিয়ে-বাঝিয়ে নিবৃত্ত করতে চেষ্টায় বিফল হয়ে প্রায় ধমক দিয়ে চলে গেছে। বোধহয় বাড়ির লোককে বলতে গেছে নিয়ে যাবার জন্যে।…এই সময় একজন আয়া কী ভেবে—এই ঘটনার নায়ক সদ্যোজাত শিশুটাকে তোয়ালে মুড়ে পুঁটুলি পাকিয়ে কাছে নিয়ে এসে বলে, শুনুন! একে দেখুন। এর দিকে তাকান। একে নিয়েই আপনার খাঁ খাঁ করা মন আবার ঠিক হয়ে যাবে।

এ সান্ত্বনায় অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে।

উন্মত্ত শোকে কাণ্ডজ্ঞানহীন মহিলা নতুন করে চীৎকার করে ওঠেন, কী? ওই কালশত্ৰুটাকে আমি বুকে করে ঘরে নিয়ে যাবো? নিয়ে যাও ওকে আমার সামনে থেকে। ওই সর্বনেশে রাক্ষসটার মুখ দেখতে চাই না আমি! ও যম। সাক্ষাৎ যম! ও জন্মমাত্রই আমার সোনার পুতুলটাকে গ্রাস করে ফেললো! ছোঁব না ওকে আমি।…সরিয়ে নিয়ে যাও।

আত্মহারা শোকের বিকার হয়তো এইরকম এলোমেলো কথা বলায়, পরবর্তীকালের কথা ভুলিয়ে দেয়।…এই হাহাকারই হয়তো ক্ষণপরেই প্রশমিত হয়ে যেতো, ওই তোয়ালেমোড়া পুঁটুলিটাকেই ‘ওরে আমার খুকুর স্মৃতি—’ বলে বুকে তুলে নিয়ে হৃদয়ের শূন্যতা ভরাতে চেষ্টা করতো, ওকেই ‘নয়নের মণি, প্রাণের পুতুল’ করে আঁকড়ে থাকতো। কিন্তু সেই ‘ক্ষণটি’ আর এলো না। বিহ্বল শোকের অসতর্কতার অবসরে ‘বল ততক্ষণে অপরের কোর্টে চলে গেছে।’

নীহারিকা এই দুরন্ত নাটকের দৃশ্যের মাঝখানে এসে পড়ে, প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো, আস্তে এগিয়ে এলো। অতঃপর—স্থিরস্বরে—ঠিক আছে। গাঙ্গুলীবাড়ির ছেলে গাঙ্গুলীবাড়িতেই মানুষ হতে চলুক—’ বলে সেই তোয়ালেমোড়া পরম ঐশ্বর্যের পুঁটুলিটাকে কোলে জড়িয়ে ধরে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো! কী প্রবলভাবে জিতে যাওয়া। শোকাহত নারী যদি অমন এলোমেলো না হতেন, শ্রীহরি আর কী সাহস হতো কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়বার? বলে ওঠবার ঠিক আছে, গাঙ্গুলীবাড়ির বংশধর সেই বাড়িতে মানুষ হতে চলুক’।

এরপর—ওই অপর পদবির পরিবারের পক্ষ থেকে সেই ঐশ্বর্যের অধিকারের কোনো দাবি উঠলে কী সে দাবি গ্রাহ্য হবে? আইনের কাছে? সমাজ-সংসারের কাছে?

অথচ পরিস্থিতি তো অন্য হবারই কথা।

নীহারিকার তো অনধিকারিণীর ভূমিকায় শিশুটাকে একবার মাত্র চোখে দেখেই নিঃশ্বাস ফেলে চলে আসবার কথা। নীহারিকার ছেলেরই কী সাহস হতো ‘বংশের ছেলে’ বলে দাবি করে নিজের মার কোলে তুলে দেবার?…ওই ছেলেটার জন্যেই চিরভীতিকর ওই মহিলাটির কাছে আত্মোৎসর্গ করে পড়ে থাকতে হতো। থাকতে হতো কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে।

অদ্ভুত একটা মোহের আর স্বার্থের জালে আটকা পড়ে গিয়ে আপন কেন্দ্ৰচ্যুত হয়ে যাওয়া ছেলেটা এখন সভয়ে সেই ‘জাল টার দিকে তাকিয়ে দেখে। ভাবে কী অদ্ভুত! ওর মধ্যে আটকা পড়ে থেকেছিলাম আমি এতোদিন? হারিয়ে যাওয়া নিজেকে যেন খুঁজে পেয়ে যায় ছেলেটা। তাই তার একান্ত নিজস্ব ওই প্রাণকণিকাটুকুকে নীহারিকার কোলে চেপে গাড়িতে উঠতে দেখে নিশ্চিন্ততার নিঃশ্বাস ফেলে।

.

কে বলতে পারে ওই অতি ক্ষীণপ্রাণ কণিকাটুকুই ভবিষ্যতে একদিন এই স্রোত শুকিয়ে যাওয়া বালুনদীতুল্য গাঙ্গুলীপরিবারে আবার প্রাণের জোয়ার এনে দেবে কিনা। এক থেকেই তো একশো হয়।

এমন তো হয়ও। বৃহৎ বৃক্ষটার কাণ্ডখানায় কুড়ুল পড়লেও—হয়তো পাখিতে ঠোকরানো, মাটিতে পড়ে যাওয়া একটা ভাঙাচোরা ফলের বীজটুকু থেকে জন্ম নেওয়া একটু চারাগাছ ভবিষ্যতে মহীরুহ হয়ে ওঠে। আবার সমৃদ্ধ করে তোলে সেই ভূমি।

.

কিন্তু এ বাড়ির আর একটা ছেলে? সেই হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসা ছেলেটা? ফিরে এসে আবার হৃতসৌন্দর্য ফিরে পেয়ে সুকান্তি হয়ে ওঠা ছেলেটা! সে তো তার পরিবারের মধ্যেই ছিলো। তার ভাইয়ের ওই শোকের সময়! তার মায়ের এক পরম প্রাপ্তির সময়!

নাঃ, সে ছেলেটাকে আর তার পরিবারের পরিবেশে দেখা যায় না।…এখন দেখা যাচ্ছে…সেই তার একদার রুক্ষ মলিন ধূলি-ধূসরিত পরিবেশে। সেই গায়ে অদ্ভুত একটা ঢোলা জামা, পায়জামা, মাথায় রোদ বাঁচাতে শোলা হ্যাট। তাকে ঘিরে সেই কতকগুলো দেহাতি আদিবাসীর ভিড়।…তার সেবায় নিয়োজিত সেই তারকা!

তাহলে কী বলতে হবে, জলের মাছ আবার জলে ফিরে এসে বেঁচে গেছে?

কিন্তু তাই কী? যে ছেলেটা আবার এই পরিবেশে ফিরে এসেছে, সে কী আগের সেই তাজা টগবগে উদোমাদা ছেলেটা? নাঃ। এ যেন সেই ‘সন্ন্যাসী আবার ধীরে, পূর্বপথে যায় ফিরে, খুঁজিতে নূতন করে হারানো রতন/সে শকতি নাহি আর, নুয়ে পড়ে দেহভার, অন্তর লুটায় ছিন্নতরুর মতন।

একদা যে উজ্জ্বল আদর্শের লক্ষ্যে ছুটে চলেছিলো, সেই আদর্শের আলো ক্রমশ আলেয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।…আর অজানিতে কখন একটুক্ষণের জন্য যে পরশ পাথরের স্পর্শ পেয়েছিলো, অসতর্কে তাও গেছে হারিয়ে। এখন শুধু আবার মরুবালুর উপর দিয়ে হেঁটে চলা! চলা ছাড়া গতি নেই।

চলে আসার আগে টুসকি অবাক আর আবেগে বলেছিলো, আবার তুই আমাদের কাছ ছেড়ে সেই জঙ্গলে চলে যাচ্ছিস দাদা?

‘দাদা’ বলেছিলো, “তা এখন আর যেতে বাধা কী? শিলুই যখন বাড়িতে এসে গেছে!’

টুসকি খুব কড়া গলায় বলেছিলো, তার মানে সেই চিরকেলে কথা! কারো সর্বনাশ, কারো পৌষ মাস! ছোড়দা বেচারীর বৌটা মরে গেল—আর তুই সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে—

বাপ্পা একটু অসহায় গলায় বলেছিলো, কিন্তু ওর দুর্ভাগ্যের জন্যে তো আর আমি দায়ী নই। তবে হ্যাঁ, ওই বাচ্চাটাকে আমার ‘পরিত্রাতা’ ত্রাণকর্তা বলে মনে হয়েছে। আমি ওর কী নাম দিয়েছি জানিস—

জানি। যীশু!

জানিস? খুব সুন্দর নাম নয়?

সুন্দর কিন্তু নতুন কিছু না। এখন কলকাতার ফুটপাথেও ও নাম খুঁজে পাওয়া যায়।

কোনো কিছুই চিরকাল নতুন থাকে না। তবু সুন্দর চিরদিনই সুন্দর।

হুঁ। তুই আজকাল অনেক কথা শিখেছিস দাদা। আগে এতো জানতিস না। কিন্তু তুই একটা স্কুলে মাস্টারী ধরেছিলি না?

ধরেছিলাম বটে।

সেটার কী হবে?

বাপ্পা হেসে উঠেছিলো, এটা আবার একটা প্রশ্ন? আমি জায়গা খালি করে চলে গেলে, আর একজন বেশী যোগ্য লোক এসে বসে পড়বে সেখানে!

টুসকি বলে উঠেছিলো, কতো সহজেই হিসেবটা কষে ফেললি রে দাদা। কিন্তু জীবনের সব হিসেবই কী ওইভাবে কষে ফেলা যায়? যেখানে তুই ছিলি, তুই জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেই যোগ্যতর ব্যক্তি সেখানে বসে পড়তে পারে?

বাপ্পা বলে উঠেছিলো, আঃ। ‘বিদায়ভোজ’ বলে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে, এতো গোলমেলে কথা জুড়লি কেন বল তো? কী খেতে দিবি দে! পেটের মধ্যে ইঞ্জিন চলছে।

বাজে কথা বলে, কথা ঘোরাসনে দাদা। আরও যে কোথাও কিছু দায়িত্ব ছিলো তোর, সেটা ভেবে দেখেছিস?

বাপ্পা হঠাৎ অদ্ভুত একটা তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, আমি আবার কে একটা লোক বাবা, যে আমার কারো প্রতি দায়িত্ব! কোথায় আকাশে উড়তে যাওয়া এক মহামান্যজন, আর কোথায় জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়া একটা হতভাগা প্ৰাণী!

টুসকি যেন চমকে ওঠে! টুসকি এই গলার স্বরে তার বাবার স্বর শুনতে পায়। আহত অভিমানে তিক্তস্বাদ একটি স্বর। যা আদিত্য গাঙ্গুলীর অভ্যস্ত স্বর।

দাদার গলার হঠাৎ এ স্বর এলো কী করে?….

টুসকি জানে না এলো কী করে। কিন্তু সেই স্বরের অধিকারী নিজেই কী জানে?

তবু এসে গেছে। হয়তো রক্তের ঋণ! যে ঋণ অলক্ষিতে পাওনা আদায় করে নেয় এ কথা বাপ্পা নামের ছেলেটা নিজে জানে না।

তবে সে শুধু জানে প্রতিনিয়ত একটা অস্বস্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পুরো একটা রাত বিনিদ্র কাটিয়ে যেদিন সকালে উঠে স্থির করে ফেললো, সোজাসুজি গিয়ে বলে উঠবে, তুমি আমায় কী জব্দতেই ফেলেছো। আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছো। আর পারা যাচ্ছে না-

ঠিক সেইদিনই—হ্যাঁ সেইদিনই সক্কালবেলাই—তার রাতের ঘুমের বিঘ্নকারিণী এসে বসে পড়ে বলেছিলো, এই চিরহ্যাংলা মেয়েটা তোমায় অস্বস্তি আর জ্বালাতনের হাত থেকে রেহাই দিয়ে বিদেয় হয়ে যাচ্ছে বাপ্পাদা। শুধু শেষ হ্যাংলামি—দেশ ছেড়ে চলে যাবার সময় তুমি আমায় ‘সী-অফ’ করতে যেও। যাত্রাকালে মুখটা একবার দেখে যাবো!

বাপ্পা বিচলিত হলো। বাপ্পা হতভম্ব হলো।

বললো, দেশ ছেড়ে চলে যাবার সময় মানে? কোথায় যাচ্ছো?

পাপিয়া হাতের ব্যাগ থেকে দু-একটা কাগজপত্র বার করে আস্তে ওর সামনে নামিয়ে রাখলো।

কাগজগুলোয় একটু চোখ ফেলেই ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হলো না।

‘ডক্টর মিস পি মুখার্জি তাঁর অধীত বিদ্যার উপর উচ্চতর শিক্ষা আহরণের জন্য বিদেশ যাত্রা করছেন। যাত্রার সহায় একটি ভালো স্কলারশিপ!

দেখে বাপ্পাদিত্য গাঙ্গুলী নামের শুধু বি. এ. পাশ ছেলেটার টানটান হয়ে থাকা মনে হঠাৎ মনে হয়েছিলো কেউ তার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলে। ঝনঝনিয়ে উঠেছিলো স্নায়ুশিরা। আর সেই টানটান সুরেই বলে উঠেছিলো, ওঃ আকাশে উড়ে সাগর পার হতে যাবার সময় একটা দীনহীন লোকের ঊর্ধ্বমুখে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা বুঝি খুবই জরুরি?

কী?

চমকানিটা সুস্পষ্ট!

বিস্ময়াহত দুটো চোখ কেমন বোকার মতো তাকিয়ে দেখেছিলো এই অকারণ রূঢ়তার দিকে।

চোখ দুটোয় যেন নিঃশঙ্ক একটা পাখির আচমকা বাণ খাওয়ার বিস্ময়-বেদনার মর্মান্তিক অভিব্যক্তি।

কিন্তু সেই চোখ দেখেও নিজেকে সামলে নিতে পারেনি বাপ্পা। কেউ কোনো অপমান করেনি, তবু তীব্র একটা অপমানের জ্বালা! যেন করেছে কেউ তাকে খুব একটা অপমান

সেই জ্বালার দাহ ফুটে উঠেছিলো তার স্বরে, ‘সী-অফ্’। ওসব শৌখিন ব্যাপার আমার পক্ষে সম্ভব হবে না! আমি কী এখানে বসে থাকছি, তখনো?

বড্ডো বেশী ভালো মেয়েটা আর কোনো কথা বলেনি। নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলো! আর তাকায়ওনি। চলে গিয়েছিলো চোখ নিচু করে।

সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখেই আদিত্য গাঙ্গুলীর ছেলে বাপ্পাদিত্য গাঙ্গুলী এদিকে চলে এসে অকারণ তীব্রতায় ডাক দিয়ে বলে উঠেছিলো, তারক! আর কতোকাল এখানে বসে থাকা হবে?

তারক বড়ো নিশ্চিন্ত ছিলো বড়দাদাবাবুকে নিয়মিত একাট স্কুলে মাস্টারী করতে যেতে দেখে। তাহলে নৌকোখানা নোঙর বেঁধেছে। এখন হতচকিত হয়ে বলে, আর থাকা হবে না?

তোমাকে কেউ যাবার জন্যে অনুরোধ করছে না। ইচ্ছে না হলে যাবার দরকার নেই আমার তাতে কিছু এসে যাবে না।

বলেছিলো। অনায়াসেই বলেছিলো।

আর মা যখন ডুকরে উঠে বলেছিলো, আবারও তুই সেই চলে যাবার কথা তুলছিস বাপ্পা?

তখনও ঠিক তেমনি অনায়াস অবহেলায় বলেছিলো, বাঃ, আর এখন যাওয়ায় অসুবিধেটা কী? শিলু তো থাকছে?

‘অসুবিধেটা’ই কী সব রে?

তা সেটাই তো প্ৰধান।

.

নিষ্ঠুর হবারও একাট নেশা আছে। ঘরে বাইরে। তাই সমাজে সংসারে রাজ্যে রাষ্ট্রে এমন অকারণ নিষ্ঠুরতার চাষ। শান্তি স্বস্তি সুখ স্থিতি’, এগুলো জুটলেই সে ওই নেশায় মেতে উঠে ভাঙচুর করতে বসে। কখনো শান্তির ইতিহাস’ রচনা করতে দেয় না।

আসলে মানুষ জাতটা একটা আজব জীব। বলা হয় বটে, সে নাকি কেবল সুখের সন্ধানে ফেরে, ‘সুখের পিপাসাতেই হন্যে হয়ে বেড়ায়’, কিন্তু দেখা যায়, ঠিক তার বিপরীতটাই। সে নিজের হাতে নিজের সুখের ঘরে আগুন লাগায়, শান্তির কুঁড়েয় ‘বাড়ি’ মেরে ভেঙে তচনচ করে।…কেন করে তা সে নিজেই জানে না।

আসলে হয়তো এই আজব প্রাণীটার ‘সুখ’ জিনিসটা সয় না।…এই ‘সত্য’টাই বোধকরি তার সকল ‘ভাঙনের’ অন্তর্নিহিত ইতিহাস। সুখের উপকরণ এনে এনে জড়ো করে, আবার তাকে ভেঙেচুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। আর সেই সঙ্গে ভাঙে নিজেকেও।…

ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকে। অথচ মজা এই, মনে ভাবে, ‘এটাই হচ্ছে ‘বড় হবার সাধনা। সাধনা—বড় হবার, বিস্তৃত হবার, নিজেকে বিস্তার করবার। তাই অবিরত নিজেকে ঘিরে বৃত্ত রচনা করতে করতে, সেই বৃত্তবলয়ের চাপে সঙ্কুচিত হতে হতে হারিয়ে ফেলে খোলা আকাশের স্বাদ।…’

***

অধ্যায় ২৪ / ২৪

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন