আশাপূর্ণা দেবী
বাপ্পার কাছে যেটা বরাবর সবথেকে বিরক্তিকর, সেটাই এখন সহ্য করে যেতে হচ্ছে তাকে। বাড়িতে তবু একরকম চলছিলো। তাকে দেখতে আসার ছুতো করে আত্মীয়জন যারা ‘বেড়াতে’ আসতো তারা কমক্ষণই বাপ্পার বিছানার ধারে বসতো। তারা একবার দেখে, এবং বাপ্পার হাড়-মাথা জ্বলে যায় এমন দু’-চারটি প্রশ্ন এবং মন্তব্য করে ভিড়ে যেতো অন্যত্র। হয় নীহারিকার কাছে, নয় তিনতলায় বুড়োবুড়ির কাছে। পিসির বাড়ির দিকের লোকেরা এলে স্বভাবতই ওই ওপরতলায়। নীহারিকার দিকের এলে তার কাছে।
ছেলের তো আর ‘মরণবাঁচন’ কোনো অসুখ করেনি, কোথায় গিয়ে কী ভাবে যেন মাথায় একটু চোট খাইয়েছে। অতএব একটু ‘আহা উহু’ করে এবং চুপিচুপি ছেলের মতিবুদ্ধির একটু সমালোচনা করে, চা-জলখাবারে সঙ্গে আড্ডা চালিয়ে বিদায় গ্রহণ। সেটা ক্রমশ কমেও আসছিল। কিন্তু হাসপাতালে আসার পর আবার নতুন করে বিপত্তি বাড়লো। যারা দু-একবার বাড়িতে দেখে গেছে, তারাও আবার তার এই অবস্থা পরিবর্তনে হাসপাতালে দেখতে আসছে।…কী বিরক্তির এই ‘দেখতে আসা’।
বাপ্পার মনে হয়, এইসব আসাটা স্রেফ ‘কর্তব্য’ পালনের পরকাষ্ঠা দেখানো। আসতে হবে। হাতে করে কিছু খাবার বা ফল আনতে হবে, এসব নিয়ম! ‘তাসের দেশের’ মতোই ‘নিয়ম’। অসহ্য।
তার ওপর যেটা বেশী অসহ্য, সেটা রোগীর খাটের ধারে গেঁটিয়ে বসা! বাপ্পার ইচ্ছে করে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আপনারা যান তো। কেটে পড়ুন এবার। আপনাদের ‘সৌজন্য সামাজিকতা’ এসব সারা হয়েছে তো? আর কেন?
বলে উঠতে পারে না, এটাই অসুবিধে।
অতএব ‘হুঁ’ ‘না’ ছাড়া কোনো কিছুই বলে না। চোখ বুজে পড়ে থাকে। তাতে অবশ্য অপর পক্ষের যে কিছু এসে যায় তা নয়। তাঁরা এই ঘরে আরো অন্য রোগীর উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে অনায়াসে জোর তলবে নিজস্ব ঘরোয়া কথা চালিয়ে যান।
অবশ্য সময়টা সকলেরই ‘একরকম’ এই যা।
এসময় সব রোগীর বেড-এর ধারেই তাদের দর্শনার্থীরা। তারাও একই কাজ করে চলেছে। খুব খারাপ লাগে।
সময় পারের ‘ওয়ার্নিং বেলটা’ বাজলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বাপ্পা।…আর সেই সময়ই নীহারিকা অথবা আদিত্য অথবা টুসকি, আর নীলুমামা হলে তো কথাই নেই, যে যার নিজস্ব ভাষায় একবার সশব্দ আক্ষেপোক্তি করবেনই, ‘এই এক জেদ ছেলের। নার্সিংহোমে থাকবো না, হাসপাতালে থাকবো।’ নার্সিংহোমে তো বাবা ‘ভিজিটিং আওয়ার্সের এতো রেসট্রিকশান থাকে না’।
আশ্চর্য! বলা হয় বেশ জোরেই যাতে ঘরে আর যারা রয়েছে তাদের কানে যায়।… তার মানে তাদের বোঝানো হচ্ছে, এই ‘রাজপুত্তুর’টি তোমাদের মতো হাবিজাবিদের সঙ্গে থাকবার মতো সস্তা মাল নয়, কেবলমাত্র এই ছেলের অদ্ভুত এক জেদের জন্যেই।
বাপ্পা ভাবে কী অর্থহীন এই ফল্স প্রেস্টিজ! কোনো মানে হয়? এতে যেন ঘরের অন্যান্য রোগীর কাছে লজ্জায় মাথা কাটা যায় বাপ্পার।
যদিও কারুর সঙ্গেই যে কোনোদিন ‘ভাব জমাতে’ বসেনি। অন্যেরা যেমন নিজ নিজ খাট থেকেই গলা তুলে, অথবা চলাফেরায় সক্ষম রোগীরা নিজস্থান থেকে অন্যের কাছে এসে সেটা করে। বাপ্পা দেখতে পায়। তবু অচেনা হলেও লজ্জা করে। মনে হয় যেন গলা তুলে বলা হচ্ছে, এ তোমাদের ‘দরে’র নয়।
ওঃ কী বিপাকেই পড়া গছে! কবে যে সেই ‘অপারেশনটা’ হবে।
এতো টালবাহান এদের। নানাবিধ ‘পরীক্ষা’ তো আছেই, তার জন্যে সময় গেছে। তাছাড়া একটু না কি এনিমিয়া ধরা পড়েছে। অতএব ওষুধপত্র খেরে সেটা সামলে নাও আগে।
সে সম্পর্কেও মন্তব্য শুনতে হয়েছে, ‘এনিমিয়া আর হবে না? শরীরকে শরীর জ্ঞান না করে ‘রাজকার্য করা হয়েছে।’
বাপ্পার এইসব নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না। মনে মনেই বলে, নেহাৎই ফাঁদে পড়ে গেছি, তাই ওহে নীহারিকা দেবী, এতো সাহস বেড়ে গেছে তোমার। ওঃ একবার এই নিরুপায় অবস্থাটা কাটলে হয়!
এইরকম বিরক্ত চিত্তের সামনে হঠাৎ আবার একদিন পিসি!…সঙ্গে নিজেদের বাড়ির কাউকে দেখতে পেল না, যেটা সচরাচর ঘটেই। কারণ বাড়ির কেউ কেউ তো আসেই রোজ।
একা পিসিকে ঢুকতে দেখেই বাপ্পা মনের ঝাল ঝাড়তে বলে উঠলো, কী হে সন্ধ্যাতারা, তোমার ডিউটি দেওয়া আর শেষ হচ্ছে না? বাড়িতে তো বার দুই হয়ে গেছে বাবা! আবার কেন?
পিসিকে তারা ছেলেবেলা থেকে মজা করতে এভাবে নাম ধরে ডেকেই কথাটথা বলে।
পিসি হাসপাতালের খাট ছুঁলো না! সাবধানে সবকিছুর ছোঁওয়া বাঁচিয়ে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই মলিন-সলিল গলায় বললো, বাঃ! বাড়িতে দেখেছি বলে কর্তব্য শেষ? হাসপাতালে দেখতে আসবো না? মনটা কী যে ছটফট করছিল। অথচ কিছুতেই সুবিধে করতে পারছিলাম না। কার সঙ্গে বা আসি! সকলেরই এ সময় কাজ। তো এই মেয়েটা আমায় সাহস দিয়ে বললো, চলো বড়মা, আমি নিয়ে যাচ্ছি। তাই—
মেয়েটা।
বাপ্পা তাকিয়ে দেখলো দরজার কাছে পিসির বাড়ির সেই ‘পাপিয়া’ নামের মেয়েটা! পিসেমশাইয়ের ভাইয়ের মেয়ে। না কে যেন।
ছেলেবেলায় এই মেয়েটা বাপ্পার রীতিমতো ফ্যান ছিল।
‘বাপ্পাদার মতো ক্যারাম খেলুক দিকি কেউ?…বাপ্পাদার মতো ঘুড়ি ওড়াবার সাধ্য আছে কারুর?…বাপ্পাদা যা ‘ম্যাজিক’ দেখাতে পারে, দেখলে ‘তাক’ লেগে যায়।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
পিসিরা বেলেঘাটায় চলে যাবার পর অবশ্য তেমন যোগসূত্র প্রায় ছিন্ন।…আর বাপ্পারও মনের জগতে ‘পিসি মাসি মামা’ জাতীয়রা আর বিরাজিত থাকেননি। সেই মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেছে? মনে মনে স্বীকার না করে পারলো না বাপ্পা, দেখতেও খুব সুন্দর হয়ে গেছে দেখা যাচ্ছে।…একটু অপ্রতিভ হলো। পিসিকে যে হ্যানস্থার মতো কথা বলা হয়েছে ওর সামনে।
পাপিয়া কিন্তু খুব সপ্রতিভভাবে বলে উঠলো, এই দ্যাখোনা বাপ্পাদা, এদিকে শুচিবাইয়ের রাজা, হাসপাতালের সবকিছুই তো ওনার কাছে অচ্ছুৎ। অথচ ‘ছেলেটাকে হাসপাতালে যেতে হলো’ বলে কী ছটফট। যেন ত্রিভুবনে কাউকে হাসপাতালে যেতে হয় না। তাহলে হাসপাতালগুলো আছে কী করতে?
যাক! ‘আপনি’ বলবে না, ‘তুমি’ বলবে, বাপ্পার সে সমস্যার হাতে হাতেই সমাধান। পাপিয়া দিব্য স্বচ্ছন্দে ‘তুমি’ বললো। অতএব বাপ্পাও বললো, যাক, এতোদিনে তোমার মুখে একটা ন্যায্য কথা শুনতে পেলাম। সক্কলের তো ওই আক্ষেপ। ইস’! হাসপাতাল! হাসপাতালে পড়ে থাকতে হচ্ছে।’
পাপিয়া হেসে উঠে বললো, সে বোধহয় তুমি ভীষণ একটা মূল্যবান প্রাণী বলে।
‘প্রাণী!’ তবু ভালো! ‘জীব’ বলোনি এই ঢের। অবশ্য দুটো একই। কিন্তু মূল্যবানটা কিসে?
সে নিজেই হিসেব করো। আপনজনেরা যাকে একটিবার চক্ষে দেখতে পায় না, এতোই ব্যস্ত সে। তাকে লোকে মূল্যবান ভাববে না?
তুমি তো দেখছি অনেক কথা শিখেছো। আগে তো-
বাঃ। বেশ। চিরদিন সেই ব্রুকপরা ‘ভ্যাবলামার্কা’ মেয়েটাই থেকে যাবো না কি? যাক, তুমি কিন্তু আমার আগে ‘তুই’ বলতে বাপ্পাদা।
‘তুই’! বলতাম বুঝি?
বাঃ, মনে নেই? ভেবে দেখো।
আমার স্মৃতিশক্তিটা একটু দুর্বল।
পাপিয়া বলে, তা নয়। স্মৃতিশক্তিটাকে বাজে খরচে কাজে লাগাও না।
বাপ্পার হঠাৎ খেয়াল হয় সে আজ এখন অনেক কথা বলছে। আর এদের কথা শুনে ব্যাজার হচ্ছে না। আশ্চর্য তো। পাশের খাটের রোগীরা বাপ্পার গলার স্বর কোনোদিন ভালো করে শুনেছে কিনা সন্দেহ। অথচ আজ বাপ্পা গলা খুলেই কথা বলছে।
পিসি বলে উঠলো, এই হলো! মেয়ের স্বভাব প্রকাশ পেল। রুগি দেখতে এসেও তর্ক জুড়তে বসলো।…তুই আবার ‘ভ্যাবলা’ ছিলি কবে? অ্যাঁ। চিরদিনই তো কথার জাহাজ, তর্কের রাজা।
বড়মা। আবার তুমি সেই ভুল করছ? সব সময় আমি সব ব্যাপারে রাজা। রাজা। কিন্তু ওটা ব্যাকরণের ভুল বলি না?
পিসি হেসে ফেলে বলে, ব্যাকরণের ঠিক করতে গিয়ে কী তোকে ‘তর্কের রানী’ বলতে হবে? দ্যাখ না বাপ্পা। উঠতে বসতে আমার সঙ্গে ওই সব চালাবে।
বাপ্পার কিন্তু হঠাৎ মেজাজটা যেন বদলেই গেল। এতোজনের সামনে ‘ব্যক্তিগত কথা’ বলা দেখলে যে রাগটা হয় সেটা যেন হচ্ছে না। বরং কথা বলতে ভালোই লাগছে।
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে! এটা যেন বাপ্পার কাছে হঠাৎ একটা অনাস্বাদিত স্বাদ। মনের মধ্যে কেমন করে যে একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, তাদের যা ‘পথ’ তাতে ব্যক্তিগত কোনো কিছু ব্যাপারেই কিছু ‘ভালোলাগাটা’ অসঙ্গত। তাদের হতে হবে কঠোর কঠিন শুকনো। পৃথিবীতে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটানোর কর্মযজ্ঞের শরিক তারা। তাদের সাধারণের মতো হওয়া সাজে না।
তাই যে কোনো মুহূর্তে যদি কিছু ভালো লেগেছে তখনি সেটাকে সবলে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে বাপ্পা।
অথচ আজ সেটার জেরই টানতে ইচ্ছা করছে। সেই ইচ্ছেটাই প্রকাশ পায় তার প্রায় অনভ্যস্ত সরস একটি মন্তব্যে। বলে ওঠে, তা সন্ধ্যাতারা তোমাদের বাড়িটা তো বেশ সেকেলে প্যাটার্নের। এটিকে এখনো ‘অন্য বাড়িতে’ চালান করা হয়নি যে?
অন্য বাড়ি। হায় কপাল। উনি যে এখন ডাক্তারী পড়তে ঢুকেছেন। বিয়ে-টিয়ের নাম মুখে আনা চলবে না।
ডাক্তারী পড়ছে? তোমাদের বাড়ির মেয়ে?
আর ‘আমাদের বাড়ি’। পিসি কৃত্রিম আক্ষেপ দেখিয়ে বলে, সে সব এখন পাল্টে গেছে রে বাবা। এই মেয়ে তো হেসে হেসে সবসময় তোর পিসেকেই বলে, ‘আভি জমানা বদল হো গিয়া জ্যেঠু। ওর ধারণা ডাক্তারী শিখলে লোকের উপকার করতে পারবে।’
ধারণাটা ভুল নয়। তবে কাজে করাটাই আসল।
পিসি হৃষ্টচিত্তে বলে, তা ইে আহ্লাদীর সে গুণে ঘাট নেই। লোকের উপকার করতে পেলে আর—
আঃ। বড়মা। তোমার কী আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? তাই বাজে বাজে কথা বলতে বসছো?
.
বড়মার উত্তরের আগেই দরজার বাইরে করিডোরে কোনো দুজনকে কথা বলতে বলতে আসতে শোনা গেল। ‘কথা’ না বলে ‘কলধ্বনি’ বললেই ভালো হয়। তবে ধ্বনিটি সুপরিচিত। ঢুকে এলো শিলাদিত্য আর টুসকি।
শিলাদিত্য বলে উঠলো, আরে! ‘টুনু’ রানী যে? কতক্ষণ? বলে টুনু রানীর পার্শ্ববর্তিনীর দিকে একটু সস্মিত দৃষ্টিপাত করে।
আর টুসকি?
পিসির দিকে দৃকপাত মাত্র না করে ওই পার্শ্ববর্তিনীর দিকেই একটি তিক্ত জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে মনে মনে বলে ওঠে, এটি আবার এখানে এসেও জুটেছে।
.
সেই যুধাজিৎদের গৃহপ্রবেশের দিন থেকেই ওদের ওপর বিজাতীয় বিদ্বেষ এসে গেছে টুসকির। এমনকি চিরভালোবাসার পিসির ওপরই। যেন পিসির ষড়যন্ত্রেই টুসকির একটা নিজস্ব এলাকা বেদখল হয়ে গেছে।
এখন ভাবলো, এই মেয়েটি তো ছোড়দার মাথাটা একরকম ঘুরিয়েই রেখেছেন। টুসকির নিজস্ব এলাকায় হানা দিয়েছেন। আবার আমার দাদার দিকেও নজর ফেলতে এসেছেন দেখছি। এখানে তো কোনো সুবিধে হবার কথা নয়। তবু দাদার মুখের ভাবটা এমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কেন? দাদার গলার শব্দও বাইরে থেকে শোনা গেল যেন।…এটা তো সুলক্ষণ নয়। রীতিমতো দুর্লক্ষণই। যে দাদা নিজে থেকে কোনো কথাই বলে না, এবং কারো কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে যদি কিছু বলে, যেন নেহাৎই অনিচ্ছাসত্ত্বে, চাপাস্বরে, যেটুকু না বললেই নয়, সেইটুকুই।…অথচ এখন যেন—
নাঃ। এই মেয়েটি ভালোমতোই মোহিনী-মায়া জানে।…ইস্। যদি দাদাকেও অন্য রকম করে দেয়!
এই কল্পনাই টুসকির সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরায়।
গৃহপ্রবেশের আয়োজনে যুধাজিৎ তার মাকে আপ্লুত করে ফেলেছিল বটে, তবে সবাইকে যে পারেনি সেটা বলাই বাহুল্য।
দিদি জামাইবাবু ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিন রাত্তির বাস’-এর নিয়ম পালন করলেও, এবং সারাক্ষণ আদরের সাগরে ভাসলেও, আডালে আবডালে কেবলিই বলে চলেছিল, ‘বাড়াবাড়ি’, ‘দেখানেপণা’, ‘হঠাৎ নবাব হলে এই রকমই হয়’, ইত্যাদি এবং সহোদর ভাইয়ের বিরুদ্ধে এই সমালোচনা পেশ হচ্ছিল, সতাতো দাদা এবং বৌদির দরবারে। সুরজিৎও দুর্গাপুর থেকে এসে তার বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে গিয়েছে, থেকেছে, তার জন্যে নির্ধারিত এই দ্বিতীয় ‘মনোরমা ধামের’ পুরো তিনতলাটায়। এবং হেসে হেসে বলেছে, নিউ দিল্লীর মতো এটাকে ‘নিউ মনোরমা ধাম’ বলা হোক।….এবং একথাও বলেছে, ‘ওল্ড’ ধামটির থেকে অনেক খোলামেলা।
কিন্তু রিঙ্কু যে ফাঁক পেয়েই তার জন্যে নির্ধারিত তার মায়ের কোলের কাছের দোতলার অর্ধেকের অধিক অংশটি থেকে সরে পড়ে টুক করে তিনতলায় উঠে গেছে, সেই শুরু হয়েছে চাপা সুরের আলোচনা।
‘জানি না, হঠাৎ এতোখানি নবাবীর রসদ যোগাড় হলো কোথা থেকে? শুধু সরল সহজ ব্যবসায়! হুঁঃ। কেউ ঘাস খায় না, যে সেটা বিশ্বাস করবে।’
আমার তো দাদা ভয়ই করছে। শেষে না ফাঁসে!
রিঙ্কুর এই ভীতিবাক্যে বৌদি বঙ্কিম হাসি হেসে বলেছে, কেন? ছোট সাহেব তো সাফাই দিয়ে রেখেছেন, ‘খোদা যব দেতা, তব ছাপ্পর ফোঁড়কে দেতা।’…আমিও তো বলে ফেলেছিলাম, কিসের ব্যাবসা ধরেছো হে ছোটসাহেব, ‘সোনার বিস্কুট’ আমদানি রপ্তানির নাকি! তো ওই জবাবখানি জুটলো।
দাদা বললো, মার তো বেশ প্রশ্রয়ই রয়েছে দেখা যাচ্ছে। আহ্লাদের সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে একেবারে।… গৃহপ্রবেশ না, যেন বড়লোকের বাড়ির বিয়ে।…বিয়েবাড়ির মতো তিন দিন ধরে রাজকীয় ভোজ।
বৌদি হেসে ওঠে, কী যে বলো না। আজকাল আবার বিয়েবাড়িতেই দু’-পাঁচ দিন ‘ভোজ’ আছে না কি? স্রেফ একরাতের রোশনাই।…পরদিন সক্কালেই দেখবে প্যান্ডেলের বাঁশ খোলা হচ্ছে।…ছোটসাহেব দেখালেন বটে একখানা! চলতেই থাকে এইসব উক্তি।
যদিও এই তিনদিনব্যাপী রাজকীয় ভোজে আপত্তি দেখা যায়নি কারোরই।…শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও বনছায়ার নিজের ছোটবোনও, যে নাকি ওই তিন দিনেরই অতিথি ছিল সেও কেমন করে যেন এদের দলেই ভিড়ে গেছলো।…কারণ সকলেরই যে একই জ্বালা। এতো বাড়াবাড়ি! হঠাৎ এমন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে পড়া!
জামাইবাবু মারা যাবার পর থেকে দিদি বেচারী যে স্থানহারা মানহারা হয়ে কাটাচ্ছিল, দিদির দ্যাওর যে দিদির সঙ্গে যথেষ্ট শত্রুতা সেধে, বলতে গেলে জামাইবাবুর মৃত্যুরই কারণ হয়েছিল, এবং দিদির নিজের ছেলের অধিক করে মানুষ করা সতীনপোও যে দিদিকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল, এসব ঘটনায় সে খুবই মর্মাহত ছিল।…মাঝে মাঝেই রিকশা চেপে দিদির সেই দেড়খানা ঘরে বেড়াতে এসে হা-হুতাশ করেছে, এবং এ সান্ত্বনাও দিয়েছে, এদিন থাকবে না দিদি। জিতু একটু মাথা তুলতে পারলেই আবার সুদিন পাবে।… দুটো মা-ছেলে বৈ তো নয়।…
কিন্তু সেই জিতু যদি বলা-কওয়া নেই, হঠাৎ মাথাটা আকাশে তুলে বসে, তাহলে সেই সহানুভূতি আর সমবেদনার’ স্নিগ্ধতাটুকু টিকে থাকতে পারে?
এখনকার সকলেরই হিতৈষী চিন্তা ছেলেটা না হঠাৎ ফেঁসে যায়।”
যুধাজিতের ছোট মেসো এবং ভগ্নিপতি দুজনে একত্রে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে রায় দিয়েছেন ‘ব্ল্যাকমানি ছাড়া এ জিনিস হতেই পারে না।’
ভয় কী বনছায়ারও ছিল না? প্রথম থেকেই তো বুকের মধ্যে ছিল আতঙ্কের বাসা। কিন্তু ছেলের নিরুদ্বেগ আর সদাপ্রফুল্ল ভাব দেখে, সেই ভয়টা যেন ক্রমেই ফিকে হয়ে এসেছে।
যদিও তিনি কেবলই ছেলেকে বলেছেন, এতো কেন রে জিতু? এতো কেন?
জিতু মার পিঠ চাপড়ে বলেছে, তুমি তো জননী চিরকাল ‘এতো’র ভক্তই ছিলে!
তা হয়তো ছিলেনই সত্যি। কিন্তু তখন যে বুকে জোর ছিল! এখন সেই বুকটাই যে ফাঁকা হয়ে গেছে। তবু যখনই ভাবছেন, তাঁর জিতু ‘মায়ের মনোবেদনা’ দূর করতে, অসাধ্যসাধন করছে তখনই বুকটা ভরে উঠেছে।
.
আশা ছিল এই ভরা বুকের অনুভূতিটা নিয়ে আরো ক’দিন কাটাতে পাবেন। কিন্তু সপ্তাহ শেষেই মেয়ে জামাই বলে উঠলো, আর তো থাকা যাবে না। এদের স্কুল কামাই হচ্ছে।
অফিসটা অবশ্য কামাই হয়নি তার, কারণ এখান থেকেই সেটা চলছিল। কিন্তু ছেলেমেয়ের ব্যাপারে নাকি নানা খানা অসুবিধে। মাস্টার আসে। সে ফিরে যাচ্ছে। অথচ সাপ্তাহিক পরীক্ষা আসছে।
কিন্তু বড় ছেলে?
বনছায়া বললেন, সে কীরে সুরো, তুইও আজ চলে যাবি বলছিস্ যে? বলেছিলি না পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে আসছিস্?
তা সে হিসেব তো হাতেই। তোমার গৃহপ্রবেশের আগে চার-পাঁচটা দিন ওখানেই কাটলো। তখন তো আর তোমার এই নতুন বাড়িতে আসা চলতো না।
বনছায়া ঈষৎ আহত গলায় বলেন, ‘আমার বাড়ি’ বলছিস কেন বাবা? বাড়ি তো তোদেরই। তো মানছি বটে তখন তো আসা যেতো না। পাঁজিপুঁথির ব্যাপার। তা ওইখানেই তো হয়ে গেল। তখন ক’দিন ওখানে কাটাতে হলো যখন, বাকি ক’দিন এখানে থাকবি না?
ছেলে নির্লিপ্ত গলায় বলে, তাই কী হয়? ‘ওর’ মাও তো আশা করে বসে আছেন।
বনছায়া কী বলতে পারবেন, তো ‘সে আশা’ তো তাঁর এই ক’বছর খুবই মিটেছে বাবা। তোর মা বাস্তুহারা হয়ে দেড়খানা ঘরের মধ্যে মাথা গুঁজে পড়ে থেকেছে, একটা রাত তোদের থাকতে বলতে পারেনি। ‘তার’ মার তো আরও এতো আশা থাকার কথা নয়।’
না, বনছায়া কখনোই কাউকে ‘হক’ কথা শুনিয়ে দিতে জানেন না। বনছায়া তাই আরো নরম হয়ে বলেন, সে তো সত্যি রে, মায়ের প্রাণ বলে কথা। তবে বেয়ানকে আমি সেদিন বুঝিয়ে বলে রেখেছি।
ঠিক এই প্রসঙ্গে না হলেও বেয়ানের কাছে তিনি বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলেছিলেন, এবার তো ভাই তোমার মেয়ের নিজের বাড়ি হলো, মাঝে মধ্যে একটু আসবে-টাসবে। ওরা যখন ছুটিছাটায় আসবে, তখন তো এসে থাকবেই, না হলেও ওই দিদিটার কাছে আসবে, থাকবে। একা এতো বড় বাড়িটায় খাঁ খাঁ করে মরবো।
শুনে যে ‘বেয়ান’ আহ্লাদে বিগলিত হয়েছিলেন, এমন নয়। মেয়ের সতাতো দ্যাওরের বাড়ি হওয়াকে মেয়ের ‘নিজের বাড়ি’ হলো বলে আহ্লাদে ভাসবার মতো পাগল তিনি নন। …এই ‘বোকা-হাবা ন্যাকা-ধ্যাকা’ বেয়ানকে তিনি খুব একটা গণ্য কখনই করেন না। তবু যতদিন কেষ্ট-বিষ্টু একটা বেয়াই ছিল, ততদিন একরকম। তারপর তো আর কোনো প্রশ্নই ছিল না। জামাইয়ের সৎমাকে প্রাণের জন ভাবতে বসবেন না কি?
তবে সেদিন তার ওই বোকাটে কথার আর প্রতিবাদ করতে বসেননি। গা আলগা করে বলেছিলেন, সে তো ঠিক। তো এইবার ছোটছেলের বৌ আনুন!
এখন বনছায়া সেই কথার জের টেনে বলেন, বেয়ানকে বলে রেখেছি।
ছেলে একটু হেসে বললো, বেয়ানকে বলে রাখলেই তো সব হলো না। বেয়ানের মেয়ে তো মায়ের কাছে যাবার জন্যে অস্থির হচ্ছে। সেও তো বারো মাস দূরে থাকে।
বনছায়া চুপ করে গেলেন।
বনছায়া একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। অথচ বনছায়ার মেয়ে? মার কাছ থেকে চলে যাবার জন্যেই অস্থির হলো। বনছায়ার ভাগ্যটাই এইরকম। তিনি যতই মনপ্রাণ ঢেলে সবাইকে ভালোবাসতে চান না কেন, সেই সবাইরা সে ভালোবাসাকে যেন ধুলোবালির মতো হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চায়।
তবু বনছায়া তাঁর বড়ছেলের কাছে তাঁর মাতৃহৃদয়টিকে একবার মেলে না ধরে পারলেন না। হতাশ আক্ষেপের গলায় বললেন, তাহলে আর এতো বড় একখানা বাড়ি করে কী হলো?
বড়ছেলে অবহেলার গলায় বললো, কী হলো তা তুমিই জানো আর তোমার পুত্তুরই জানেন। এটা তো আর আশা করোনি, আমি চাকরি-বাকরি ছেড়ে, তোমার বাড়ি উসুল করতে এখানে বসে থাকবো?
বুদ্ধু বনছায়ার তো মনে থাকে না ছেলেটা তাঁর নিজের গর্ভের নয়। তাই আবারও মলিনভাবে বলেন, ভেবেছিলাম, ছুটি-টুটি হলেই চলে আসবি, ঘণ্টা কয়েকের তো মামলা। তাছাড়া তোর ছেলেমেয়ের লম্বা ছুটির সময় বৌমা তাদের নিয়ে এসে থাকবে, তুই শনিবারে শনিবারে আসবি। তোর তো এক্সপার্ট ‘কাজের লোক’ রয়েছে, অসুবিধে কিছু হবে না। তারপর রিটায়ারের পর—
সুরজিৎ তো এই মলিন ভাবটি দেখে একটু কর ণাবোধ করতেও পারতো। তাতে তো তার অর্থসামর্থ্য কিছুই লাগতো না, তবু সেটুকু করলো না। বরং হঠাৎ যেন ঝাঁজের গলায় বলে উঠলো, ওঃ। আমার রিটায়ারের কথা পর্যন্ত ভাবা হয়ে গেছে? ধন্য! ধন্য! তবে বরাবর এই আশ্চয্যি দেখি, সব সময় নিজের দিক থেকেই সব কিছু ভাবো। অপরেরও যে একটা দিক আছে, তা খেয়াল থাকে না।
বনছায়া হতভম্ব হয়ে গেলেন। সবসময় নিজের দিক থেকেই ভাবেন বনছায়া!
হতভম্ব হয়ে গেলেন বলেই বোধহয় আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে ছেলের কথাটাই পুনরুক্তি করেন।
সবসময় নিজের দিক থেকে ভাবি!
তা ছাড়া আর কী?…ছেলে জোরালো গলায় বললো।
সুরজিৎ যেন ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত হতে থাকা ভিতরের জ্বালাটাকে প্রকাশের একটা পথ পেয়ে বাঁচে। তাই নিষ্করুণ গলায় বলে উঠে, তাছাড়া আর কী? তোমার নাতি-নাতনী যে আর একটা গরীব বেচারীরও নাতি-নাতনী, তারও কিছু প্রত্যাশা থাকতে পারে, তা কী একবারও ভেবে দেখেছো?
‘আর একটা গরীব বেচারীর’ প্রতি মমতাবিধুর ওই মুখটার দিকে তাকিয়ে, বনছায়া বোধহয় তাকিয়েই থাকতেন, যদি সেই মুখটাই বনছায়ার চোখের সামনে থেকে সরে না যেতো।
এখন আর অভ্যাগত বহিরাগতরা কেউই নেই। সাজানো-গোছানো মস্ত একখানা তিনতলা বাড়ির পুরোটাই কারো পদপাতহীন নিঃশব্দ
বাড়ির সংলগ্ন খোলা জমিটা, যেখানে ক’দিন আগে প্যান্ডেল বাঁধা থাকায় সেটাকেও ‘বাড়িরই অংশ বলে মনে হচ্ছিল; সেটা এখন সকালের রোদে খাঁ খাঁ করে যেন শূন্যতাকে আরো জানান দিচ্ছে।
নীচের তলার যে দালানটা থেকে গোটা তিনেক সিঁড়ি নামলে ওই জমিটায় নামা যায়, সেই সিঁড়িটার একটা ধাপে বসেছিলেন বনছায়া অদ্ভুত একটা শূন্যদৃষ্টি মেলে। ক’দিন আগের উচ্ছ্বাস আনন্দ আর আড়ম্বরে স্মৃতিটা যেন স্বপ্নের মতো লাগছে।
এই বাড়িটায় এইভাবে একা বাস করতে হবে বনছায়াকে?
একা ছাড়া আর কী? জিতু তো সারাদিনই নিজের ধান্দায় ঘোরে। ক’টা দিন অতিথি অভ্যাগতদের খাতিরে তাকে তবু দু’দণ্ড চোখে দেখা যাচ্ছিল। আর কী যাবে?
এখন যুধাজিৎ স্নানের ঘরে ছিল।
বেরিয়ে মাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এসে মাতৃদর্শন।
বলে উঠতে যাচ্ছিল, কী? রান্নাঘর ছেড়ে মাঠে এসে সকালের হাওয়া খাচ্ছ? গুড়।
কিন্তু বলা হলো না।
বনছায়া ছেলেকে দেখেই বিনা ভূমিকায় সেই কথাটিই আবার একবার উচ্চারণ করলেন। যা সেদিন বড়ছেলের সামনে করেছিলেন। প্রায় হাহাকারের সুরেই বললেন, এতো বড় বাড়িটা তৈরী করে কী হলো জিতু?
জিতু কী আর মনে মনে এ প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না? ছিলই। তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, কী আবার হবে? উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া বনছায়া সরকারের পুনর্বাসন হলো।…এখন প্রেমসে এই পোড়া জমিটায় বাগান করো, ফুল ফোটাও। অথবা ইচ্ছে করো তো লাউ কুমড়ো ট্যাড়শ ফলাতেও পারো।
একা একা ওইসব করতে যাবো আমি?
বাঃ? একা কেন? সাহায্যকারী হিসেবে একটা মালি-টালি জুটিয়ে আনবো।
তোর কথা শুনলে হাসবো না কাঁদবো তা বুঝতে পারি না জিতু।
কী মুস্কিল! এই সামান্যটুকুও বুঝতে পারো না, কাঁদার থেকে হাসা অনেক ‘বেটার’ তাও জানো না।
কিন্তু আমার যে এই শূন্যপুরীখানার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বুক ঠেলে কান্নাই আসতে চায় রে জিতু!
যুধাজিৎ যে মায়ের হৃদয়বেদনা অনুভব করছে না তা নয়। কিন্তু তার করার কিছু নেই। যার নিজের মধ্যে ‘বাঁচার’ কোনো সম্বল নেই, অপরের দাক্ষিণ্যের ওপর জীবন-মরণ; তাকে আর কে বাঁচাতে পারবে?
তবে সেকথা তো আর বলা যায় না? তাই বলল, মাই গড। তুমি তোমার ‘মনোরমা ধাম’খানা হারিয়ে ফেলে পরম দুঃখের মধ্যে ছিলে, এখন আবার একটা ‘নিউ মনোরমা ধাম’ পেলে, অথচ তোমার কান্না পাচ্ছে!
আমি কী শুধু ইট-কাঠ-দালান-সিঁড়িই চেয়েছিলাম জিতু? ওই রকম ভূতের মতো একা একা ঘুরতে?
জিতু একটু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, আরো যা চেয়েছি, সেটা যোগানো আমার সাধ্যে নেই মা। কিন্তু ভেবে দ্যাখো এখন যদি তুমি তোমার সেই ‘ওল্ড মনোরমা ধামেই’ থাকতে, এ ছাড়া আর কী অবস্থা হতো? যারা ছিল তারা তো তোমায় পরিত্যাগ করে চলেই গিয়েছিল মা। তুমিই এই ভেবে বৃথা কষ্ট পেয়েছো। তারা বাড়িটার অভাবেই চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের মধ্যেকার ভালোবাসার অভাবটা অনুভব করোনি। তাই আবার বৃথা স্বপ্ন দেখেছো, আবার একখানা, ‘মনোরমা ধাম’ পেলেই আবার সবাইকে পাবে? তা হয় না মা!
বনছায়া অসহায়ভাবে বলেন, তা হলে আমি কী করবো জিতু? এই রকম হাঁ হাঁ করা মস্ত বাড়িখানা নিয়ে?
জিতু আরো গম্ভীরভাবে বলে, বাড়িখানাকে যদি তুমি লোক দিয়ে ভরাতে চাও মা, তোমার সে সাধ এখনি পূর্ণ হতে পারে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখো কতো লোক পাতার ঝুপড়ির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। তাদের ডেকে এনে থাকতে বললে কৃতার্থ হয়ে ছুটে আসবে। আর দু’বেলা তোমার চরণামৃত খাবে!—
বনছায়া রেগে উঠে বলেন, ও আমার সঙ্গে ঠাট্টা চালাচ্ছিস?
কী করবো বলো মা। তোমার সঙ্গে যে আর কিছুই চালানো যায় না গো আমার চিরবালিকা-মা!
বনছায়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, তুই কেবল আমার বোকামিটাই দেখিস। কষ্টটা দেখতে পাস না।
যুধাজিৎ এবার সত্যিকার একটু গম্ভীর হয়ে বলে, পাই না কী? পাচ্ছিলাম বলেই তো অনেকখানিটা চেষ্টা করলাম। কিন্তু—
বনছায়া এখন একটু অপ্রতিভ হয়ে যান। যেন নিজের ভুলটা বুঝতে পারেন। তাই তাড়াতাড়ি বলেন, সেকথা অস্বীকার করলে আমার মহাপাপ হবে বাবা। কিন্তু তোর মতো দরদ আর কারো আছে? এই যে তোর বৌদিদি। ‘মা মা’ প্রাণ করে এমন সাজানো-গোছানো আলো-হাওয়া বাড়িখানায় পাঁচটা দিন থাকলো না। চলে গেল সেই গোবিন্দ ঘোষাল লেনের বাড়িতে।…তো মাকে ভালোবাসে বলেই তো? কিন্তু আমার মেয়ে? কতো ‘মা মা’ করে? ক’ বার—
ধনছায়া হঠাৎ চুপ করে গেলেন। অর্থাৎ স্বরটা রুদ্ধ হয়ে এলো।
যুধাজিৎ এই আপন হৃদয়ের কাছে অসহায় অবোধ মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখে মনে মনে একটু নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর নিজস্ব দরাজ গলায় বলে উঠলো, আরে ও নিয়ে ‘ঘাবড়াও মাৎ’ জননী।…দেখো তোমার মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনীদের উইক এন্ডের’ গেস্ট করে ছাড়বো।…সপ্তাহে দেড়-দুটো দিন অন্তত তোমার বাড়ি সরগরম থাকবে।
এখন বনছায়ার একটু নিঃশ্বাস পড়লো। হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে একটু বোধহীনতা থাকলেও সত্যিই রামবোকা নন। একটু বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন, সে তুই নেমন্তন্ন করে গাড়ি পাঠিয়ে আনা নেওয়া করে হয়তো সেটা ঘটিয়ে তুলবি, কিন্তু নিজের প্রাণ থেকে কী ‘মা’ কে কতোদিন দেখিনি বলে আসে কী? অথচ বৌমা—আমার ভাগ্য।
‘ভাগ্য’ নয় মা, তোমার বুদ্ধি! তোমার প্রথম থেকেই চালে ভুল। চিরকাল দেখলাম, তোমার কাছে কেউ এলেই যেন কৃতার্থ, কেউ ডেকে কথা কইলে যেন বর্তে যাও। আর সর্বদাই যেন ভেবে বসে থাকো তোমার সবকিছুতেই খুব ত্রুটি হচ্ছে। যেন যত সব কর্তব্যকর্ম করবার কথা ছিল তোমার, তার কিছুই করে উঠতে পারছো না। কাজেই অপরাধের ভারেই নুয়ে আছো। এতে যা হবার তাই হয়েছে। অন্যেও ধরে নিয়েছে, তোমার একশো হাজার ত্রুটি। তুমি তোমার করণীয় কর্তব্যের কিছুই করে উঠতে পারছো না। আর তোমাকে ‘মানুষ’ বলে গণ্য করে ডেকে কথা কইলে, অথবা তোমার বাড়ি বেড়াতে এলে তোমায় কৃতার্থ করা হয়।…বলো ঠিক বলছি কিনা?
বনছায়া একটু হেসে ফেলে বলেন, কী যে বলিস।
ঠিকই বলছি মা। এই হয়। সর্বদাই তোমার ‘ভিক্ষুকের’ ভূমিকা, প্রার্থীর ভূমিকা। ‘প্রার্থীকে’ কী ‘ভিক্ষুককে’ কে আবার পুঁছতে যায়? অবশ্য সত্যিকার ‘সুভদ্র’ ব্যক্তিজনেদের কথা আলাদা। তেমন জনেরা ‘তোমাদের মতো জনেদের’ হৃদয়ের মহত্ত বোঝেন। কিন্তু সত্যিকার ‘সুভদ্র’ আর সংসারে ক’জন বলো?…বেশীর ভাগ জনই ওই অহঙ্কারীরই পূজারী।
অহঙ্কারীর পূজারী! বেশীর ভাগ জন? তোর কথার মাথামুণ্ডু বোঝা দায় বাবা!
তোমার পক্ষে তো দায় হবেই মা। কারণ তোমার নিজের তো আর মাথা অথবা মুণ্ডু বলতে তেমন কিছু নেই। তুমি ভাবো, সক্কলকে খুব ভালোবাসলেই সবাই ‘আপন’ হয়ে যায়। তা হয় না হে বনছায়া দেবী। ও ফর্মুলা জনগণের জন্যে নয়। ওই জনগণের ক’জন আর তোমার ওই অহেতুক ভালোবাসাকে ‘মহামূল্যবান’ ভেবে ধুয়ে জল খাবে?… কোনো দামই দেবে না। বরং তুমি তোমার ‘প্রাণের ভালোবাসাটিকে’ প্রকাশ করতে অহেতুক যতো উপহার দ্রব্য দেবে, অহেতুক নেমন্তন্ন করে করে খাওয়াবে—তারা একটা ‘কমপ্লেক্সে’ ভুগবে এবং ক্রমেই তোমার বিরোধীপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে।…কারণ ওগুলো তো সবাই করে না। অবচেতনে একটা নিজেকে ‘খাটো’ ভাবটা এসে যায়।…তাহলেই বোঝো। জীবনের প্রথম থেকেই চালে ভূল।…দেখবে যারা ডাঁটুস অহঙ্কারী, যারা কোনো মানুষকেই নিজের থেকে উঁচুদরের ভাবে না, ‘কর্তব্য’ শব্দটা নিয়ে মাথা ঘামায় না এবং অন্যের ‘ত্রুটি’ সম্পর্কে রীতিমতো সচেতন থাকে, তাদেরকেই লোকে সমীহ করে, তোয়াজ করে আর তাদের শিবেরই নাম লেখায়। তাই তোমার মায়ের পেটের বোন, তোমার নিজের পেটের মেয়ে, তারা ওই ‘পরের মেয়ে’ তোমার বৌমার শিবিরে গিয়ে ঢোকে!
জিতু!
বনছায়া হঠাৎ যেন আর্তনাদের গলায় বলে ওঠেন, এ কথা তুইও বুঝতে পেরেছিলি? সত্যিই আমি যেন টের পেতাম, সবাই যেন একদলে, আর আমিই যেন ‘একঘরে’। একটু আড়াল পেলেই কেমন যেন ফিসফিস কথা।…আর অথচ আমি তা সর্বদাই সকলের মন’ আর ‘মান’ রাখবার চেষ্টায় প্রাণপাত করেছি। তাই না এতো আহ্লাদের মধ্যেও মনের মধ্যেটায় যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকেছে।
বনছায়া ছেলের চোখ এড়িয়ে নিজের চোখটা মুছে ফেলবার চেষ্টা করে বলেন, ভেবেছিলাম ভগবান যদি আবার একটু দিন দিয়েছেন, তো আবার আগের মতো হই। চিরকালই তো একই স্বভাব। ‘তিনি’ও তো ওই নিয়ে তোর মতোই হাসতেন।…বলতেন, ‘যতই তুমি সকলের মন পাবার চেষ্টা করবে ততই তারা তাদের মনটিকে আকাশে তুলে বসে থাকবে।’ কিন্তু আমার যে ওইটাই স্বভাব। তার বিপরীত কাজ করতে গেলে নিজের মনের শান্তি নষ্ট হয়। …কোনো ব্যাপারে একটু ত্রুটি করে ফেললে, পাঁচ দিন ধরে মনের মধ্যে খচখচ্ করতে থাকে। ভাবতে থাকি আবার করে তাকে হাতের নাগালে পাবো, তাহলে ওটা মিটিয়ে নেব। উঁহু! বলো ওটা ‘মেক আপ’ করে নেবো।…হেসে ওঠে যুধাজিৎ, রেলগাড়িদের যেমন হয়, তো প্রথমটা ঢিমেতালে চলে ‘লেটে’ যাচ্ছে, শেষের দিকে প্রাণপণ দৌড় দিয়ে সেই পিছিয়ে পড়াটা মেক-আপ করে নেয়।
যুধাজিতের কাজ ছিল বিস্তর, তবু মায়ের প্রতি মমতার বশেই এতোক্ষণ কথা চালিয়ে চলেছে। তবে এটা ও না ভেবে পারছে না, এই যে এতোদিন যাবৎ সেই শীতলাতলার’ দেড়খানা ঘরের মধ্যে বন্দী ছিল মা, সেও তো নিঃসঙ্গই কেটেছে। কে তার সঙ্গী হতে এসেছে? আর যুধাজিৎ তো ক্রমেই নিজের ধান্ধায়—
হঠাৎ কী ভেবে বলে ওঠে, ভাবছি আজ আর এখন বেরোবো না। বিকেলের দিকে বেরোনো যাবে। অনেকদিন তোমার সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়া হচ্ছে না, আজ সেটাই হোক।
তা হচ্ছে না বটে। সেই দেড়খানা ঘরের সংসারের ছন্দটি, কিছুদিন ধরেই ব্যাহত।
বনছায়া বললেন, আমার সঙ্গে। ওমা! তাহলে তো নিরিমিষের জেদ ধরবি। তো আগে বলবি তো? ওদিকে তো কিছুই—
কেন? তোমার আজ অরন্ধন? না কী ‘উপোস ষষ্ঠি’?
আরে বাবা! তোর এই ঠিকে ঠাকুরটা তো এখনো রয়েছে। এ মাসের ক’টা দিন থাকবে বলেছিলি? তাই ওর দিকেই কুটনো বাটনার ব্যবস্থা চলছে। বাজার করেও আনছে ভালোই। তো আমি আর একা নিজের জন্যে কী এতো পাঁচখানা রাঁধতে বসবো?…বেলায় দুটো ভাতে ভাত করে নিই।
বাঃ। কী সুচারু ব্যবস্থা। এমন না হলে সুগৃহিণী! বৃথা অপচয়ের পথ বন্ধ।…মা! তোমার সেই ঠিকে ঠাকুরটিকে একটু ডাকো তো!
কেন, তাকে আবার এখন কী করবি? সে আমি যা হোক
তাকে এই দণ্ডে এই মাসের শেষ দিন পর্যন্ত হিসেব করে মাইনেপত্তর দিয়ে বিদায় দিয়ে দেবো।
ওমা! সে কী দোষ করলো?
না, না, সে কী দোষ করবে? সে তো ভালো ভালো বাজার করছে, ভালো ভালো রান্না করে দাদাবাবুকে খাওয়াচ্ছে। অতীব সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু তার উপস্থিতির ফলে তোমায় যদি রোজ ভাতে ভাত খেতে হয়, সেটা বরদাস্ত হবে না। তুমি আমাদের সেই পাখির খাঁচা বাড়িতে দুজনের জন্যে যেমন ‘ষোড়শোপচার’ না কী বলে করতে, তাই ভালো! তাতে তোমারও বেকারত্ব ঘুচবে। হা-হুতাশ করবার সময়টা একটু কমবে।
সেই ব্যবস্থাটা ছিল ওদের এই ক’বছরের কেবলমাত্র মাতাপুত্রের সংসারে। দু’দিকে রান্নার ঝামেলা করা চলবে না বনছায়ার। যা হবে একই সঙ্গে।
‘ছেলেটা নিরিমিষ খেয়ে খেয়ে রোগা হয়ে যাবে?’ ভাবো কী নিরামিষে যা সব ভালো ভালো আছে সে সবের নিয়মিত প্রয়োগ হলে ছেলে মুটিয়ে যাবে!
বনছায়া রেগে বলেছিলেন, তাই বলে তুই এই মা বুড়ির জন্যে কচুঘেঁচু খেয়ে থাকবি?
কচুঘেঁচু। মাই গড। কেন, তোমার ছানার ডালনা, ধোঁকার ডালনা, পটলের দোলমা, পোস্তর বড়া, মোচার ঘণ্ট, নারকেল ঝাল, এরা সব অচ্ছুৎ না কি? সাত্ত্বিক আহার। বলো তা একখানা ওই সাত্ত্বিক রান্নার মেনু দেওয়া রান্নার বই একটা কিনে দিই।
হয়েছে। আর বই নিতে হবে না। মার আরো ঢের জানা আছে। তাই বলে—তুই বারো মাস বিধবার মতন—কী যে বলিস!
মা গো! একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছো মা। শহরের রাস্তায় রাস্তায় ‘অমেধ্য বস্তুর’ সাপ্লাইয়ের কারখানা অগুনতি। ইচ্ছে হলেই অসাত্ত্বিক হতে পারা যাবে!
তা সেই ব্যবস্থাই চালু ছিল সেখানে।
দৈবাৎ দিদি-জামাইবাবুরা এলে অথবা দাদা-বৌদি কৃপাপরবশ হয়ে একদিন বনছায়ার কাছে খেলে, যুধাজিৎ বালো হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে অতিথি সৎকার করে মায়ের শান্তিবিধান করতো।
তো সেই ব্যবস্থাই এখানেও ফিরিয়ে আনা হোক! যদিও বাড়ির প্রতিটি তলাকেই ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ করার জন্যে সব তলাতেই ‘কিচেন’ ‘স্টোররুম’….যেটা বনছায়ার ওল্ড মনোরমা ধামে ছিল না। তেমন অনাসৃষ্টি ভাবনাও ছিল না।
তার একতলার রান্নাঘরে সিমেন্ট গাঁথা জোড়া উনুন, রাক্ষসের মতো কয়লা খেয়ে সারাদিন জ্বলে মরতো…সেখানে বিশ পঁচিশ বছরের পুরোনো মুরলী ঠাকুরের ছিল জমজমাটি কারবার!
বাটনাবাটুনি পদ্মর সঙ্গে পানদোক্তার আঁতাতটি ছিল জম্পেস।…বাসনমাজুনি গজগজ করতো, ‘পদ্ম সাতবার চা খায়’।
বনছায়া হেসে বলতেন, ‘খাক না বাবা! তাকে কী আর তোমাদের ‘বাবু’ ফেল মেরে যাবেন?’
বলতে গেলে পুরো একতলাটাই ছিল ‘ভৃত্যরাজ্য’!
সেই রমরমার ছবিই, বনছায়ার মনের জগতে হচ্ছে ‘সংসারের ছবি’।
বনছায়ার সেই শূন্যতার পূরণ-করা আর কার সাধ্য?
যুধাজিৎ একটা অদ্ভুত মমতায় চেষ্টা চালিয়ে গেলে কী হবে? আর বনছায়ার সময়ের শূন্যতা ভরাট সারা বছরেও না ফুরোতে পারে, এতো পশমের গোলা এনে এনে মজুত করলে কী হবে?
বনছায়া বললেন, তা বলে এক্ষুণি বেচারীকে মাইনে মিটিয়ে ভাগিয়ে দিতে হবে না বাবা! এ ক’টা দিন চারবেলা খাওয়াটাও ও বেচারীর হিসেবের মধ্যে ছিল। হঠাৎ তা থেকে বঞ্চিত করলে—
যুধাজিৎ দুটো হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে, জননী গো। ‘মা’ তো চিরনমস্যাই, কিন্তু বাড়তি আরো কিছু নমস্কার তোমার চরণে নিবেদন করছি।… তবে আরো একটা হিসেব করতে ভুলে যাচ্ছো। এই ক’দিনের ‘বাজার করা’ বাবদ ‘আয়টা’।… সেটাও তাহলে মাইনের সঙ্গে মিটিয়ে দেওয়া উচিত।…ঠিক আছে। এই মাসের এই সাত দিন তোমার যেমন চলছে চলুক। তারপর আমাদের পুরোনো ছাঁচে ফেরা যাবে।
বনছায়া হঠাৎ বেমক্কা ডুকরে উঠে বলে ওঠেন, এবাবে আর কতোদিন তুই মাকে আগলে আগলে জীবন কাটাবি জিতু? এবার একটা বৌ আন। তোরও কষ্ট ঘুচুক, আমার ও দুঃখ ঘুচুক।
বৌ! বৌ এনে— একটি বৌ এনে–
হা হা হা।
যুধাজিতের গলা খোলা হাসির শব্দে বামুনঠাকুর এবং বোধহয় ঘরমুছুনি মেয়েটাও চমকে ওঠে। এতো জোরে হাসি কিসের? কোনোদিন তো এতো এমন শোনা যায় না।
জিতু যেন কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, কী বললে মা? আর একবার বলো তো শুনি?… একটা বৌ এনে ফেললেই ‘আমারও কষ্ট ঘুচবে, তোমারও দুঃখ ঘুচবে’। মাগো! তোমার ‘নিজস্ব’ বলতে তো এই কানাকড়িটা আছে, সেটাও বেহুঁশ হয়ে বিলিয়ে দিতে চাও?
হঠাৎ কেঁদে ফেলার লজ্জার ওপর ছেলের ওই হাসির বহর। তার ওপর আবার ছেলের ওই কথাটি।…বনছায়া সেই ভিজে চোখেই রাগ দেখিয়ে বলেন, কেন বিলিয়ে দেওয়া কিসের? তুই কী আমার সেই রকম ছেলে?
যুধাজিৎ দুই হাত উল্টে বলে, কে ‘কী রকম’ তা কি আগে থেকে বোঝা যায় মা? তোমরাই তো বলো ‘এই বেড়ালই বনে গেলে বনবেড়াল হয়’।
সে যে বলে সে বলে। তুই কখনোই তেমন হবি না। এ আমি লিখে দিতে পারি।
মাগো! দোহাই তোমার। যেন ‘স্ট্যাম্প পেপারে’ লিখে বসতে চেও না।… জানো আমার একটা বন্ধুর দাদা, বিয়ের আগে ‘বাড়িটা’ যার ছিল প্রাণতুল্য।… সে এখন মা-বাপ ভাইবোনেদের সঙ্গে কথা বলে না। মানে বলতে সাহস পায় না, বৌ ওর দাদাকে এমন কজা করে রেখেছে।
অমন ছেলেকে আমি মানুষ বলি না।
বনছায়া ধিক্কারের আর তেমন ভাষা খুঁজে না পেয়ে এইটুকুই বলেন। যতই হোক একটা ‘ছেলে’ বলে কথা। বলতে তো আর পারেন না, অমন ছেলের গলায় দড়ি’।
তবে কথাটি উচ্চারিত হয়। তাঁরই ছেলে বলে ওঠে, এও বলতে পারতে ‘অমন ছেলের গলায় দড়ি’। কিন্তু সে লোকও করবেই বা কী? কব্জা করে রাখবার জন্যে যে একখানি মোক্ষম অস্ত্র শানিয়ে রেখে দিয়েছে বৌ। একটু কিছু বলতে গেলেই শাসায়, ‘দ্যাখো আমায় বেশী ঘাঁটাতে এসো না। একখানা ‘সুইসাইড নোট’ লিখে লালবাজারের ঠিকানায় পোস্ট করে দেবো। ব্যস, তারপরই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে বাড়িসুদ্ধু সকলের হাতে দড়ি পরিয়ে ছাড়বো।’… আর কিছু বলতে যাবে কেউ তাকে?
বনছায়া অবিশ্বাসের গলায় বলেন, এতোটা আবার হয় না কি!
হয় না? আছো কোথায় মা? আরো যে কত হয় তা জানো না তাই।… তুমি তো ভেবে ঠিক করে বসে আছো, বৌ এলে খুব করে ভালোবাসবো। তার যা ইচ্ছে করতে দেবো। তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবো না—কী ভাবোনি এসব?… ভাবোনি ভালোবেসে আর ভালো ব্যবহারের জোরে আপন করে নেবো? নিশ্চয় তাই ভেবে রেখেছো। কিন্তু জেনে রেখো মা, এ তোমাদের আমলের’যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ’-এর সরল অঙ্ক নয় যে সহজে কষে ফেলা যাবে। এ যুগের অঙ্ক বড় জটিল। অতো সহজে কষে ফেলা যায় না মা।
বনছায়া হতাশা আর রাগের গলায় বলেন, বিয়ে করার মতলব নেই, তাই এতো সব গল্প ফাঁদছিস। বলতে চাস সব মেয়েই ওইরকম দুষ্টু? ভালো মেয়ে নেই?
সর্বনাশ। অমন পাপকথা কখনো বলতে পারি? আসলে দুষ্টু মেয়ের থেকে ভালো মেয়ের সংখ্যাই বেশী মা!…তবে তোমার ভাগ্যে যেটি জুটবে সেটি কী হবে কে বলতে পারে?
বনছায়া আবার একটু হতাশ নিঃশ্বাস ফেলেন, তাহলে সেটাকে ‘আমার কপাল’ বলেই মেনে নিতে হবে।
বাঃ। বনছায়া দেবী, বেশ। শুধুই তোমার ‘কপাল’? এই হতভাগাটার কথা ভাবছো না?
বনছায়া বলেন, সে কথা কী আর ভাবি না বাবা? তবে এটাও তো ভাবতে হবে, ঠান্ডা লাগলে অসুখ করতে পারে ভেবে, ঘরের জানলা খুলবই না’, এমন বুদ্ধিই ঠিক কিনা! …
হ্যাঁ, দুঃখ-নিবারণের বোধহয় ওই একটাই দাওয়াই আছে। ‘কাপাল’ কে মেনে নেওয়া।
তা ‘মেনে’ আর মানিয়ে নিয়ে চলাই তো নারীজীবনের চিরকালীন ভূমিকা। তার এই ভূমিকাটি সুচারু ছন্দে পালন করে চলতে পারলেই, সমাজ সংসারে ছন্দভঙ্গ। সংসারের সমস্ত সুষমা লাবণ্য আনন্দ অন্তর্হিত!
গরীব হতভাগা নিরুপায়দেরও তো ওই একই গতি। ‘কপাল’কে মেনে নেওয়া। এই মেনে নেওয়ার শক্তিটি যুগিয়ে চলে ‘পূর্বজন্ম’ আর ‘পরজন্মের অলীক আশ্বাস।
তোমারই বা এতো দুঃখ কেন?”
‘কেন আর, পূর্বজন্মের ‘কর্মফল’।’
‘এতো সয়ে মরছ কেন?’
‘পরজন্মে শান্তি পাবার আশায়। ‘
অর্থাৎ একটা হচ্ছে ‘কপালের ফের’। আর অপরটি হচ্ছে পরবর্তী জীবনে ‘কপাল ফেরাবার’ সাধনা।
শেষ পর্যন্ত ওই ‘কপাল’।
তা বনছায়ার প্রকৃতির সঙ্গে একেবারে বিপরীত নীহারিকা নামের মহিলাটিও শেষমেষ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমার কপাল। আমার পূর্বজন্মের কর্মফল।’ বলেছে অবশ্য তুচ্ছ কারণেই।
তবু বলেছে। তুচ্ছ কারণেই বলেছে। কারণ তখনো জানতে পারেনি নীহারিকার ‘কপাল তার জন্যে কী উপহার তুলে রেখেছে।
নীহারিকা ভেবেছে, আমার কপাল। তাই তিন তিনটে সন্তানই আমার বিরোধী পক্ষ আমার বড়ছেলেটাকে—প্রায় যমে নেওয়ার মতোই অহেতুক ছিনিয়ে নিয়ে গেছে একটা অশুভ শক্তি। আমার ছোট ছেলেটা আমায় মনিষ্যি বলে গণ্যই করতে চায় না। যেন ‘করুণার’ চোখে তাকায়। আর আমার মেয়ে?… সে আমার হাত থেকেই সমস্ত সুযোগসুবিধে আদায় করে নেয়, অথচ আমায় ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে দেখে।
আর নিতান্ত ‘নিষ্পর’ বললেও হয় যে মানুষটা, যে আমায়ও একটু স্নেহের দৃষ্টিতে, মমতার দৃষ্টিতে দেখে তার ওপর আমার তিন ছেলেমেয়েরই যেন জাতক্রোধ। অথচ তিনজন তিন প্রকৃতির। শুধু ওই একটা জায়গায় কী অদ্ভুতভাবে মিল!
আমার কপাল!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন