সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক – ৭

আশাপূর্ণা দেবী

।। সাত।।

বেশী মাইনের লোভে পুরোনো মনিব-বাড়ি ছেড়ে এক বড়মানুষের বাড়িতে কাজে ঢুকে তারকের মা বেশ একটু মুস্কিলে পড়ে গেছে। এ বাড়ির ভারী কড়াকড়ি। বাজার দোকান দুধ র‍্যাশন ইত্যাদির জন্যে আলাদা লোক আছে এদের। অতএব রাঁধুনীর পথে বেরোতে পাবার কোনো যুক্তি নেই, অথচ পাড়াবেড়ানি স্বভাবের তারকের মার চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দীদশায় থাকতে প্রাণ আইঢাই করে।

তারকের সঙ্গেও তাই দেখাসাক্ষাৎ প্রায় দুর্লভ হয়ে গেছে। ছেলেকেই বলে রেখেছে বটে, আমার তো এখন পর্দানসীন অবস্থা ঘটেছে রে তারক, একটু বেরোতে চাইলেই, ‘ক্যানো কী বিতান্ত, কোতায় যাবে, কখোন আসবে’ এই সব সাত সতেরো হুজ্জুতি জেরা। আবার গিন্নীর থেকে গিন্নীর বেধবা বুনঝিটি বেশী দড়। সে বলে, ‘তো তুমিই বা ছেলেকে দেখতে হুটহুট যাবে কেন গো? জোয়ান ছেলে—সে আসতে পারে না মাকে দেখতে? তার মনিব-বাড়ি থেকে বুঝি অবসর পায় না? তো তুইই যাস বাবা এক একবার। বেশীদিন না দেকলে প্রাণ ক্যামন করে।

কিন্তু ছেলে সভয়ে মাথা নাড়ে, না বাবা, আমাকেও ওদের দেউড়িতে মাথা গলাতে হলে নানান কৈফেৎ দিতে হয়। কতবার দেখেছে, তবু বলবে—’কে তোমার মা? নাম কী? কতদিন এখেনে কাজ করছে?’ এইসব। তার ওপর আবার গেটে লেখা—কুকুর হইতে সাবধান।’ ওরেব্বাস! তারপর? ঢুকতে গেলে তেড়ে এসে ঘ্যাক করে একখান কামড় বসিয়ে দিক, আর কী!

সে কথায় তারকের মা হি হি করে হেসে বলেছিল, ওই ‘নেকাই’ আচে। কুকুর কোতা? বলে, স্বয়ং বাড়ির গিন্নীর কুকুরে যা ভয়। যে বাড়িতে কুকুর পোষা আচে, সে বাড়িতে নাকি বেড়াতে যায় না। এখেনে কুকুর নাই।

তারক চোখ কুঁচকে বলে, বললেই হলো? বাইরে থেকে আকাশ ফাটানো ‘ঘেউ ঘেউ’ শোনা যায়।

হি হি, সেও ফক্কিকারি রে তারক! কুকুরের গাঁকগাঁকানি ‘টেপ’ না কী যেন করে ‘কেসেটে’ ভরে রেকে দেচে, মধ্যে মধ্যে সেটাকে চালিয়ে দ্যায়?

কী আশ্চয্য! এর কারণ?

কারণ? শুদিয়েছিলুম ঘরমুচুনি মেয়েটা হেমলতাকে, বলে কি বাড়িতে কুকুর থাকাটা নাকি বড়নোকী ফেসান। না থাকলি মান থাকেনি। তাই এই কৌশল। বলে, গেটে ওই যে ‘সাবধানের’ কতা নিকে রেকেচে, ওতে মান-মর্যাদা রক্ষে হয়েছে।

মনিব-বাড়ির মান রক্ষার এই ‘মান’ দেখে সেদিন মায়ে ছেলেয় খুব হেসেছিল। তবু তারক আসতে তেমন গা করে না। বলে, এলেই বা কী? সেই তো বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলে চলে যাওয়া। তোর আগের মনিব-বাড়ির মতন কী? যে গিন্নী বলবে ‘ও তারকের মা, ছেলে এয়েছে, একটু চা পানি খাইয়ে দাও। ঘরে কী আছে না আছে দ্যাখো না!’ ‘দিদমা’ বলে নমস্কার করলে ‘থাক থাক’ বলে কতো কথা শুধোতো। কতোদিন নিজেই হাতে করে এটা ওটা খেতে দিয়েছে। তোর সঙ্গে বসে দু’ঘণ্টা গপপো করলেও কিছু বলেনি।

তারকের মা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তা সত্যি, গিন্নীর মনটি খুব ভালো ছেলো। নজরও উঁচু। বলতো, ‘আহা, ‘ছেলে’ বলে কতা। তোমার কাজটা বরং একটু পরেই হবে।’ তা বাদ খাওয়া-দাওয়ায় নিজেদের সঙ্গে কোনো তফাৎ করতোনি। নিজেরাও কিচু নিত্যদিন পোলোয়া কালিয়া খাচ্ছে না, যা হতো তা সবারই এক। আবার যেদিন জামাই কুটুম আসবে বলে ভালোমন্দ কিছু হতো, আমারেও তা দিতো। এখানে অন্য বেবোস্তা। একগাদা নোকজন, তাদের জন্যে মোটা বেবোস্তা।

সে বাড়ির কাজটা ছেড়ে ঠিক করিসনি মা।

তারকের মা দুঃখের গলায় বলে, ত্যাখোন ঠিক বুঝতে পারি নাই রে। ওখেনে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সকল কাজের দায়িত্বো, আর মাইনা মোটে একশোটি ট্যাকা! আর এখেনে, তো শুধু রান্নাই। রান্না বিনে আর বিশেষ কিছু না। অছতো মাইনা দুশোর ওপর আরো দশ। বলেচে পুজোর পরে আরো বাড়িয়ে দেবে। ওই নোবে পড়েই। দেশে ভোর নেগে এটু জমি-জিরেত করতে মন, নগদ ট্যাকাটার তো দরকার!

দেশের জমি-জিরেত! হবেটা কী শুনি? কে থাকতে যাবে সেখানে?

আহা! ভবিষ্যতে যাবি না?

তারকের মা স্বপ্নভরা গলায় বলে, চেরটাকাল পরের বাড়ি নকরগিরি করবি? বে থা করে আপন দেশে সোমসার পেতে দশের অ্যাকজন হবি না? আমি নাতিপুতি নে আদর-গোবর করব না? তুইও ট্যাকা জমা, আমিও ট্যাকা জমাই, উভয়ের চেষ্টায় হবেই এসব। তারক মায়ের স্বপ্নসৌধটিকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলে, ওই আহ্লাদেই থাক। তোর তারক বে-ই করবে না।

ষাট! ষাট! শোনো কতা! বে’ করবিনি কী? তোর বাপের তুই অ্যাক সন্তান না? তা মানুষটা তো অকালে চলে গ্যাচে, তো তার নামখানা মুচে যাবে? বন্‌শো থাকবেনি?

কী একখান রাজা-মহারাজার বংশো রে? তাই সে বংশো থাকা না থাকার চিন্তা! আমি বাবা বে-টে করে পায়ে বেড়ি পরছিনে। বড়দাবাবু বলে, ‘মহা আহাম্মুকেরাই বে করে।’

তারকের মা ছিটকে ওঠে, তোর ওই বড়দাবাবুটিই তোর মাতাটা খেয়েচে, নিজে যেমন বাউগুলেপনা করে বেড়ায়, ইচ্ছে সবাই তাই হোক। তো ওবাড়ির কর্তার তো আরো ছেলে রয়েচে, বড় না করুক, ছোটো ছেলে বে-থা করে সোমসারি হবে। আমার কী হবে তাই ক? তারক হেসে হেসে বলে, তো তোমারই বা মোটে একটা ক্যানো? জ্যেঠির মতো সাতটা নয় ক্যানো?

তারকের মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, এতোদিনে এই কতা কইলি? সাতটা ক্যানো নাই জানিস না। তোরে ছ মাসেরটি নে বেধবা হই নাই?

হাসি-তামাসা হঠাৎ স্যাঁতসেঁতে হয়ে আসাতেই তারক তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ওই হলো চোখে অমনি নোনাপানি। এতে তোকে মানায় না মা। খাণ্ডারণী মূর্তিটাই তোর বেশ জুৎসই!

মা হেসে ফেলে বলে, বটে না কি রে? পরে ভবিষ্যতে আবার বলবি তো, ‘মা কী খাণ্ডারণী! আমার বৌটারে কী টাইশে রাকে!

ওই তো। ওই ভয়েই তো বে করায় মন নেই। মায়ে-ছেলেয় বেশ আছি। আবার মাঝখানে একটা পাথর এনে বসিয়ে সুখটা কী?

মা বিগলিত হাস্যে বলে, সুখটা কী সেটা পরে বুঝবি।

আমার বুঝে কাজ নাই। এ দিব্যি আচি।

তারকের মা যে ছেলের এই ঘোষণায় মনে মনে বেশ পুলকিত না হয় তা নয়, তবে সংসারবাসনাও যে বড় প্রবল বাসনা। তাই বলে, তা বললি তো হবেনি। সারা জেবনটা তো ব্রিথাই গেল, তোর মায়ের শেষ জেবনে একটু মানুষের মতন হবোনি? আর মায়েছেলেয় বেশ আছি আর কই? তুই একখানে দাসত্বো করচিস, আমি একখানে দাসত্বো করচি। মাসে দুদিন দ্যাকা হয় কি না হয়।

তারক একটু গম্ভীর হাসি হেসে বলে, দাসত্বো আর এ জগতে কে না করছে মা? হাইকোটের জজও করছে, পুলিশের বড়কত্তাও করছে, মন্ত্রীরাও করছে। লোকের দোরে ধর্না পেড়ে পেড়ে ভোট ভিক্ষে করে মরছে। আবার মন্ত্রী হয়েও সদাই ভয় কখন না জানি এই সুখের গদিটি থেকে ঠেলে ফেলে দেয়।

‘ভোট’ শুনেই তারকের মা বলে ওঠে, ওরে তারক, আমাদের এবাড়ির কর্তাও বোধহয় এবার ভোট সাধতে নামছে।

তারক চমকে ওঠে, কে বলল?

তারকের মা ঝুনো হাসি হাসে, বাঁদীবান্দাদের কী আর কেউ ধরে করে কিছু বলে রে বাপ? কতা হাওয়ায় ওড়ে, বাতাসে ভাসে, ধরে ফেলতি হয়। যদিও গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর, কতাবাত্রা, তবে দেকতে তো পাওয়া যাচ্ছে বৈঠকখানা ঘরে রাতদিন নানান লোকের আসা যাওয়া, আর কর্তার শালা সমুন্দি ভায়রাভাইয়ের হরঘড়ি এসে খানাপিনা, রাতদুপুর অবদি আলোচনা। খাওয়ার টেবিলে বসে য্যাতো শলা-পরামর্শ। আমরা সামনে এসে গেলেই, কতা কয় ঠারেঠারে, ইনজিরিতে। তৎসত্বেও ধরি ফেলতি পারা যায়।

তারক গলা নামিয়ে বলে, ‘ভোটে’ নামার পরামর্শ তা বুঝলি কী করে? বিজনেসের বেপার হতে পারে।

তারকের মা নিশ্চিন্ত গলায় বলে, না রে বাপু না। ও আমি হাওয়ায় হাওয়ায় ধরি ফেলিচি। দুদিন গেলেই দেকতে পাবি।

তারকের আরো গলা নামে, ‘ছি পি এম’, না অন্য কিছু? তা কিছু ধরতে পেরেছিস? সেটা বুজিনি

তারক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে, ঠিক আচে। আমায় যা বললি বললি, আর কাউকে বলিস না মা।

আবার কাকে বলতে যাব? আর আমার আছেটা কে?

না, মানে দেশে-টেশে তো যাস?

আর দেশ!

তারকের মা একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, বড়মানষের বাড়ি কাজে ঢুকেও সে পতেও কাঁটা পড়েছে রে তারক। আগের মতন, যখন তখন হুটহাট ‘দেশে’ চলে যাবার উপায় নাই। একদম কড়াকড়ি। মাসে একবেলার জন্যি। সকালে গিয়ে রাতে ফেরা। তো সেও বুদ্ধি কৌশলে আদায়!

তা বুদ্ধি কৌশলই বৈকি। কাজে নিয়োগের কালে মনিব গিন্নীর নানাবিধ জেরার সময় এ প্রশ্নটিও ছিলো, ‘দেশে’ যাওয়া-টাওয়ার বালাই নেই তো? বলছো তো একটা মাত্তর ছেলে, তাও এই কলকাতাতেই থাকে।

তখন তারকের মা তৎক্ষণাৎ তার এককুড়ি বছর আগে মরে যাওয়া মাকে চিতাশয্যা থেকে তুলে এনে রোগশয্যায় শুইয়ে বলে উঠেছিল, মাস পয়লা একটিবারের জন্যি তো যেতিই হবে মাসিমা! বুড়ো মা-টা আজ পাঁচ-সাত বচর বেছনায় পড়ে, আমার মুক চেয়েই আচে। তার জন্যিই আরো পরের দোরে খাটা। মাইনাটা পেলিই তারে দে আসতি যেতি হবে।

ফি মাসে? মনিব-গিন্নী শিউরে উঠে বলেন, বল কী গো?

কী করবো মাসিমা? আমার পত চেয়ে পড়ে থাকে। ওই ট্যাকা কটাই ভরসা।

কেন? তোমার ভাইটাই নেই?

তারকের মা উদাস দার্শনিক গলায় বলেছিল, ‘নাই’ বলে অকল্যেণ করবোনি মাসিমা, তবে কতা হচ্ছে—আচে গরু না বয় হাল, তার দুঃখু চেরকাল’।

এই আপ্ত বাক্যটুকু থেকেই অনেক ইতিহাস প্রচারিত হয়।

তত্রাচ গৃহিণী জেরা করে জেনে নিয়েছিলেন, দেশে যেতে আসতে কতোটি সময় লাগে, একদিনের মধ্যে গিয়ে ফিরে আসা যায় কিনা।

তা সে প্রশ্নের সখেদ উত্তর, তা যাবে না কেন? গ্রামের এতো বৌ-ঝি নিত্যদিন ডেলি প্যাসেঞ্জারী করে শহরে এসে তিন-চার বাড়ি কাজ সামলে আবার সন্ধের মধ্যে ঘরে ফিরছে না? তবে কিনা—শয্যোশায়ী। মায়ের কাছে গিয়ে, তক্ষুণি উল্টোপাক খেয়ে চলে আসায় মায়ের প্রাণটি কেমন করবে, সেই চিন্তা। একটা রাত অন্ততো না থাকলে—

কিন্তু সে চিন্তাকে আমল দেননি গিন্নী। বলেছিলেন, ‘তা আর কী হবে বাপু! মাকে এটুকু বুঝতে হবে। প্রতিমাসেই যখন যেতে হচ্ছে—! না না, রাতে থাকা-টাকা চলবে না। ভোরের সময়টি সামলাবে কে? আমি তোমায় পয়লা তারিখেই মাইনে দিয়ে দেব, তুমি দোসরা সকালে ভোরের সময়ের চা-জলখাবারটি সামাল দিয়ে বেরিয়ে পড়বে, সন্ধের মধ্যে ফিরে আসবে। নেহাৎ মায়ের কথা বললে তাই! নইলে—আগের লোককে তো ওই দেশে গিয়ে দেরী করার জন্যেই বাদ দিতে হলো।’

তাহলে বলতে হবে কিনা তারকের মার কৌশলের ফলশ্রুতি ওই ‘মাসে একবার’ দেশে যাবার ছাড়পত্র। মাতৃভক্তির পুরস্কারই বলা যায়।

ওই একদিনের সফর। তবে এতে দেশে মান-মর্যাদা বেড়ে গেছে। ভাবো—তারকের মা এমন জব্বর বড়মানুষের বাড়িতে ঢুকেছে যাদের পান থেকে চুন খসাবার জো নেই, অথচ সেই হেন বাড়িতেও তারকের মা বিহনে ভুবন অন্ধকার’! তার মানে—মানুষটা এমন মস্ত দামী হয়ে উঠেছে।

দেশের নাম অবশ্য ‘তারকের মা’ নয়, নাম পরাণের বৌ। বহুকাল মৃত পরাণ মণ্ডলের পরিচয়বাহী এই নামটিই দেশে এখনো চালু। কিন্তু তার নিজস্ব কোনো নাম নেই? আছে হয়তো, কে তার খোঁজ করছে? পরিচয়টাই তো আসল।

তা এদের বাড়ি কাজে ঢোকার পর থেকে সাজে-সজ্জাতেও বেশ একটু দামী দামী ভাব এসে গেছে তারকের মার। এরা চায় ‘সর্বদা ভব্যিযুক্ত’ হয়ে থাকুক কাজের লোকজন বিশেষ করে রান্নার লোক। বাইরের অতিথি-অভ্যাগতদের সামনে বেরোতে হবে যাকে। কারণ চায়ের ভারটিও রান্নার লোকেরই।

অতএব এখন ‘পরাণের বৌ’ যখন দেশে যায়, তার পরনে ধবধবে শাড়ি ব্লাউজ, পরিচ্ছন্ন চাদর, ছিমছাম চটি, আর রঙিন চটের থলির (আগে যেটাকেই শৌখিন ভাবতো তারকের মা) বদলে, কাধে ঝোলানো ঈষৎ পুরোনো হলেও শ্রীনিকেতনী ঝোলা। অতএব সম্ভ্রম সমীহ খাতির তো অধিক জুটবেই।

‘পরাণের বৌ’ এসেছে শুনলেই ভাসুর নড়েচড়ে বসে, জমিজমার হিসেবপত্রগুলো দেখে নেয়। আর বড়জা তাড়াতাড়ি এসে বলে, আমার কাচেই দুটো ভাত খাবি—বুঝলি?

যদিও পরাণের বৌ বলে, সকালের ‘ব্রেকফাস্টটি’ এতোই ভারিভুরি হয়ে গেছে যে এবেলা না খেলেও চলবে। তবু ওই জায়ের কাছেই খায়।

ছেলের কাছে তারকের মা হেসে হেসে তার ‘দু’ পাঁচ বছর বিছানায় পড়ে থাকা’ মা’কে দেখতে আসার আর মাইনের সব টাকাটি মাতৃসেবার ব্যয় করার গপপোটি করে বলে, এতে কিন্তু আমি মিচে কতা কওয়ার দোষ নিই না। যার সঙ্গে যেমন। গরীব বলে, তোমার ঘরে খাটতে এয়েচে বটে, তা বলে সে মাজে মদ্যে ছুটি পাবে না? বাবুরা আপিসে ছুটি পায় না? তো—ওই অ্যাকবেলার সময়ের মদ্যেই তোর জ্যেটার সঙ্গে শলা-পরামর্শো! কী জানি কেন তোর জ্যেটিও আজকাল বেশ সদয়।

সেই জ্যেঠির অন্তর্নিহিত স্বপ্নটুকু এখনো জানা নেই বলেই তারকের মা ওই সদয়তাকে ‘হৃদয়বাই’ ভাবে!

তারক হেসে বলে, ‘মরা মায়ের’ নাম ভাঙিয়ে খাচ্ছে! দিদমা একদিন ভূত হয়ে এসে তোমার ঘাড়ে চাপবে!

তারকের মা উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বাড়ির মধ্যে থেকে আর এক কাজকরুনী প্রায় ছুটে বেরিয়ে এসে গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে, ওমা! তুমি অ্যাখনো এখেনে? দুলো তো ঠিক বলেছে। এদিকে মাসিমা তোমারে হন্যে হয়ে খুঁজছে। এক গুচ্ছির লোক এসেছে, চায়ের জল চাপাতে হবে। এসো ঝাঁ করে। নইলে রক্ষে থাকবে না।

চলে যায় তেমনি ছুটে।

তারকের মাও সে তৎপরতা দেখায়। তবে যাবার আগে একবার মুখটা বেজার করে বলে, এই অ্যাক বাড়ি বাবা! সর্বোদা গাদাগুচ্ছির নোক। আচ্ছা তারক—চলি রে—। আবার তাড়াতাড়ি আসিস বাবা!

তারক মার ব্যস্ত প্রস্থানের ভঙ্গীটির দিকে তাকিয়ে একটু আশ্চর্য হয়। লোকে তো বলে, ‘স্বভাব যায় না মলে’, তো মায়ের স্বভাবটা এমন বদলালো কী করে? মা তো কখনো এমন মনিবভয়ে ভীত ছিল না? এক কথার বদলে দশ কথা শুনিয়ে দেওয়াই তো মায়ের চিরকেলে স্বভাব।

তারক কী করে বুঝবে, তার মাও সেই একটি ‘স্বপ্নে’র পিছনে এগোবার বাসনায় দাঁতে দাঁত চেপে স্বভাবকে দমন করে চলেছে।

ছেলে উঠে চলে যাবার পরও বনছায়া কেমন নিথর হয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ছেলে যে খবরটি পরিবেশন করে গেল, সেটি ঠিক পরিপাক করে উঠতে পারছেন না। দুটো প্রবল অনুভূতি যেন পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে বনছায়াকে যাচাই করবার জন্যে।

টাকা চাই। অনেক টাকা। তা তার আসবার পথটি যেমন হোক!’ ছেলের এই মতবাদকে কিছুতেই নিশ্চিন্তে গ্রহণ করা যাচ্ছে না, আবার দুর্বার একটি লোভানির হাতছানি ও দুর্বল করে ফেলছে।

বনছায়ার আবার নিজস্ব একখানা বাড়ি হবে। ভালো বাড়ি। সত্যিকার মর্যাদাসম্পন্ন বাড়ি। সেই বাড়ির নামকরণের অধিকারও থাকছে বনছায়ার! এই সংকীর্ণ গর্তটুকুর মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়ে আবার বনছায়া তাঁর আগের জীবনের গৌরবময় পরিবেশে ফিরে যেতে পাবেন? বনছায়া আবার একটা মানুষের মতো মানুষ হয়ে সংসার করবেন! হারিয়ে যাওয়া জীবনটাকে আবার ফিরে পাবেন! এই অবিশ্বাস্য সত্য হয়ে উঠে বনছায়াকে ডাক দিচ্ছে। এ কী কম লোভ? এই লোভের ডাক একটা প্রবল শক্তিতে বনছায়ার মূল পর্যন্ত ঝাঁকিয়ে নাড়িয়ে উপড়ে ফেলে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কী মোহময় মনোরম সেই ভেসে যাওয়া! কিন্তু সেই ‘যাওয়াটা’র হাতে কী নিজেকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব?

আরও একটা বিপরীত শক্তিও যে ভিতর থেকে জোরালো গলায় বলে উঠছে, “না না। এ ঠিক নয়। এ শুভকারী নয়! এ অন্যায়। এ পথ ভ্রান্ত পথ। সন্তানকে ভ্রান্ত পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাই তো মাতৃধর্ম!

দুটো বিপরীত অনুভূতি যেন পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘বনছায়া’ নামের মানুষটাকে যাচাই করতে চাইছে।

বনছায়া! তুমি কি লোভের হাতে আত্মসমর্পণ করবে? না কি তুমি তোমার সন্তানকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করবে?…ফেরানো যাবে না? সে শিশু নয়, বালক নয়, একটা পরিণত মানুষ। সেও এখন প্রচণ্ড এক লোভের তাড়নায় দুরন্ত গতিতে ছুটতে চাইছে। তাকে নিবৃত্ত করা সহজ নয়। সহজ নয়? তাহলে বনছায়া। কঠিন পথই ধরো। কঠিন হও। তুমি তাকে বলো ‘তোর ওই ভুল পথে ফলানো ফসল আমি আমার গোলায় তুলতে রাজি নই। অন্যায় পথে আসা লক্ষ্মী তো শুভ নয়, সত্যকার লক্ষ্মী নয়, সে অশুভ সে অলক্ষ্মীরই নামান্তর।… ‘বনছায়া! তুমি যদি শক্ত হয়ে প্রতিরোধ করতে পারো তাহলেই ছোটা বন্ধ করে থেমে যাবে তোমার ছেলে।’

বনছায়ার মধ্যে দু’জন কথা বলে চলেছে।… কিন্তু ছেলেটা তো কেবলমাত্র তার মায়ের সুখশান্তি চায়। আর সেই চাওয়ার পিছনেই ছুটবে। ছুটছে তার মায়ের হৃদয়বেদনার লাঘব করতে, তার তো আপাতত এ ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নেই। তুমি তাকে ঠেলে সরিয়ে দিলে, ‘তোর দেওয়া ওই অশুভ সুখে আমার দরকার নেই’ বলে মুখ ফেরালে সে যে বড্ড বেশী আহত হবে। ভেঙে পড়বে। ছেলেটা যে দারুণ অভিমানীও। কাকা অকারণ শাস্তি দিয়েছে, বাবা ভাইয়ের কথা বেদবাক্য মনে করে ছেলেকে তিরস্কার করেছে, কখনো প্রতিবাদে ফেটে পড়েনি, অথবা আত্মপক্ষও সমর্থন করতে চেষ্টা করেনি। শুধু লাল লাল মুখ করে নিথর হয়ে বসে থেকেছে। সেই অভিমানী ছেলেকে যদি আমি—

বনছায়া! তুমি জানো না, তুমি তোমার ওই ভাবপ্রবণতাকে সামলাতে না পারলে, তোমার সন্তানের ক্ষতিই হবে। ‘টাকা’ বড় ভয়ানক জিনিস বনছায়া! একবার ওর স্বাদ পেলে আর নিবৃত্তি ঘটে না।

…কিন্তু এও তো সত্যি, পুরুষ জাতটার ওই টাকার পিছনে ছোটার মূলে কেবলমাত্র আপন ভোগবাসনা চরিতার্থতার স্পৃহাই কাজ করে না, নেহাৎই কিছু দুরাচারী দুশ্চরিত্র ভোগবাসনামত্ত বিলাসীজন ব্যতীত। পুরুষহৃদয়ের পূজা আর নৈবেদ্যর উপচার সাজানো তো নারী জাতটাকেই ঘিরে। সে নারীর উপস্থিতি তার কাছে নানা রূপে নানা রঙে। হতে পারে সে নারী জায়া প্রিয়া জননী—ভগিনী কন্যা প্রণয়িনী যে কোনো কেউ। অথবা নিঃসম্পৰ্কীয়ই কেউ, তবু তার সন্তুষ্টিসাধনই থাকে সেই পুরুষচিত্তের ধ্যানজ্ঞান লক্ষ্য!

অথবা হয়তো শুধু সন্তুষ্টিবিধানই নয়, প্রেরণার উৎস চমক দেওয়াও। নিজেকে বিকশিত করা, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলা!

দুর্বোধ্য নারীহৃদয় কিসে সুখী হয়, সে রহস্যটি জানা নেই বলেই পুরুষ আপ্রাণ চেষ্টায় উপচার সাজিয়ে সাজিয়ে তার মন জয় করতে চেষ্টা করে।

অপরপক্ষে আবার নারীর অন্তহীন চাহিদাও পুরুষ জাতটাকে ছুটিয়ে মারে বৈ কি! নারীহৃদয়ে বস্তুর মোহ বড় সর্বনেশে মোহ, সর্বনেশে মোহ প্রতিষ্ঠার। অতএব আরো চাই, আরো—আরো!

কশাহত পশুর মতোই তখন সেই চাহিদাতাড়িত পুরুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে। মুছে যায় তার নীতি দুর্নীতির আদর্শ, তার নিজস্ব মনোভঙ্গী! তার নিজস্ব জীবনচর্যার ছক্‌।…শেষ সত্য একটিই পুরুষের প্রেরণার উৎসে একটি নারীর উপস্থিতি থাকেই।

অতএব।

অতএব সেই নারীজাতটা যদি লোভের কাছে আত্মসমর্পণ না করে বলে উঠতে পারতো, ‘এতোয় আমার দরকার নেই!’… যদি বলে উঠতে পারতো, ‘যে ঐশ্বর্য অসততার পথে নীতিবিসর্জনকারী অশুভর পথে আসতে চায়, সে ঐশ্বর্য আমি চাই না’ তাহলে যে জগতের অনেক দুর্নীতির ভার কমে যেতো, তাতে সন্দেহ নাস্তি!

কোনো একজন প্রিয় নারীর প্রসন্ন দৃষ্টির আলোয় উদ্ভাসিত হতে না পারলে পুরুষের সব ‘অর্থই’ তো অর্থহীন!

কিন্তু কোথায় সেই শক্তিময়ী নারী? যে আপন হৃদয়ের চাহিদার ভারেই ভারাক্রান্ত নয়? কোথায় সেই শুভবুদ্ধির আলোয় আলোকিত নারীহৃদয়, যে হৃদয় পুরুষহৃদয়ের অর্থ প্রত্যাখ্যান করে বলে উঠতে পারে ‘যে ন্যহম অমৃতস্যামি —

নারীচিত্ত আপনার বাসনার জালেই বন্দী। সীতারাই রামচন্দ্রদের সোনার হরিণের পিছনে ছোটায়। যদি বা তেমন নাও হয়, তবু তার অসহায় বন্দীত্ব মমতার কাছে। প্রিয়জনকে আহত করার ক্ষমতা তার নেই।

পুরুষ নারীর অভিমান ভাঙাতে ‘দেহি পদপল্লব মুদারম্’ বলেই কাজে হাসিল করে ফেলে। আর নারী তার আপন সত্তাটাকেই ভেঙে টুকরো করে বসে পুরুষের অভিমান ভাঙাতে।

শক্ত হবার শক্তি কোথায়?

জায়া প্রিয়া জননী ভগিনী কন্যা যে রূপেই হোক আপন দুর্বলতার কাছেই সে অসহায়!

এই যে বনছায়া।

যখন যুধাজিৎ মার সব ভয়-ভাবনা নস্যাৎ করে দিয়ে বলে গেল, ‘ফালতু চিন্তাটিন্তাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, তোমার গৃহপ্রবেশে কাকে কাকে ডাকবে, তার লিস্টটা বানাতে থাকো তো বসে বসে, শেষে আবার না কাউকে ভুলে গিয়ে আপশোস হয়—’ তখন তো কিছুতেই তেমন করে সেই ‘ফালতু’ চিন্তাটি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না!…তিনি তো ভাবতে থাকলে না না! কিছুতেই আমি ওভাবে গা ভাসিয়ে দেব না! আমায় ভালো করে জানতে হবে, বুঝতে হবে যুধাজিতের এই হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠার মূল উৎসটি কী?

বলে গেল বটে, ‘একটা বিষয় নিশ্চিন্ত থাকো মা, তোমার ছেলে অন্তত জালজালিয়াতি, চুরিডাকাতি, চোরাকারবার, মেয়েপাচার, অন্যের অনিষ্টসাধন, অপরকে পীড়ন—এই সব করে বেড়াচ্ছে না। তার মধ্যে ‘আদর্শবাদের’ পরাকাষ্ঠা না থাকুক, নীচতা নোংরামি নেই।’ তবু বনছায়া ভেবেছেন, তা হোক, আমার শক্ত হতে হবে। যদি দেখি ওর কোনো কুপরামর্শদাতা জুটে ওকে ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছে, আমায় বলতেই হবে, ‘তোর বাড়ি নিয়ে তুই থাকগে যা বাবা, আমি এই এখানেই বেশ আছি, বেশ থাকবো, আমার আর ‘নতুন গৃহপ্রবেশে’ দরকার নেই।’

তথাপি কখন কোন ফাঁকে, কোন অসতর্কতার পথ বেয়ে বনছায়া আচ্ছন্নের মতো এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন একটি কলকল্লোলে মুখরিত আনন্দোজ্জ্বল উৎসব মঞ্চে

বনছায়ার চিরপরিচিত প্রিয় প্রিয় সব মুখেরা উল্লসিত হাস্যে বনছায়ার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। বনছায়া তাদের স্নেহে আদরে ভালোবাসায় অভ্যর্থনা করে ডেকে নিয়ে আসছেন চাকচিক্যময় এক নতুন পরিবেশের মধ্যে। নতুন রঙের গন্ধে ম ম’, তার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হচ্ছে ফুল আর ধূপের গন্ধ … সেই নতুন বাড়ির প্রবেশপথে আলপনা, কলাগাছের চারা, মঙ্গল কলস, আম্রপল্লবের সার।

চোখের আড়ালে কোথায় যেন বৃহৎ যজ্ঞের উপযুক্ত রান্নাবান্না হচ্ছে, বাতাসে ভেসে আসছে তার মনমাতানো সুগন্ধ-ভার।… কোনো একখানে পুজোর আয়োজন। আর বনছায়া এই সবকিছুর মধ্যমণি হয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন, উচ্ছাসহীন প্রসন্নতায়। ……

আর সকলের বিস্ময়মিশ্রিত কৌতূহল প্রশ্নের উত্তরে অলৌকিক এক আলোয় ভরা মুখে উত্তর দিচ্ছেন, ‘হ্যাঁ, ওই পুরোনো নামই রাখা হয়েছে নতুন বাড়ির। তাতে কী? আমিও তো পুরোনো।

এই উৎসব মঞ্চের মাঝখানে এসে পড়ে কী আর ফিরে যাওয়া যাচ্ছে?… অজস্র ছবির টুকরো পরপর ভেসে ভেসে উঠছে।…

‘কী আশ্চর্য! তোমার জিতু কী করে এতোখানি হয়ে উঠলো?…. না বাবা, তাক লাগিয়ে দিলো বটে।… কে জানতো ওর মাথায় এমন একখানা প্ল্যান ঘুরছিল?’

কই কারো মুখে তো ধিক্কারের ছারা দেখা যাচ্ছে না।

ঈর্ষা? তা হয়তো কোথাও কোথাও ছায়া ফেলেছে। কারণ সেই ফেলাটা খুব বেশী স্বাভাবিক। তবে সে ছায়া গোপনে রাখতে হয়, তাই বনছায়া তাদের বহিরঙ্গের আলোর আভামাখা মুখই দেখতে পাচ্ছেন। তাই বনছায়া তাদের মধ্যেই কাউকে কাউকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাড়িটা দেখাতে দেখাতে বলে চলেছেন, এই তিনতলাটা পুরোটাই তোদের জন্যে। যখন মাঝে মাঝে ছুটিতে আসবি তখন তো থাকবিই, তবে রিটায়ার করে যখন পাকাপাকি কলকাতায় এসে বসবি সেই বুঝে সব রকম ব্যবস্থাই করা আছে।… কী বললি? ‘খোলামেলা তিনতলাটা সবটা তোদের কেন?’ কী বলছিস রে পাগল ছেলে? জানিস না ‘জ্যেষ্ঠের শ্রেষ্ঠ ভাগ! … অগ্রজের অগ্রাধিকার।’ আর ও পাগলটা তো বলেছে, ‘পুরো একতলাটা ওর কব্জায় থাকবে। ও ওর অফিসঘর বুকে করে সেখানেই পড়ে থাকবে।’

আবার আর একজনকে বলছেন, ‘এই দোতলাটা তোর আর আমার বুঝলি? তো আমার আর কতটুকু কী দরকার বাছা, কোণের দিকের ওই ঘরটায় শোবো থাকবো, আর তার লাগোয়া ছোট বক্সরুমটাকে ঠাকুরঘর করে নেব। তো পুজোয় তো কতই মন। পাঁচ মিনিটেই ছটফট। হি হি, তোরাই আমার ঠাকুর দেবতা।…বাঃ, তা বললে চলছে না। এখন আর অতো সংসারের দোহাই পাড়া শুনবো না। জামাইকে বলে রাখছি—জায়গার অভাবে এতোদিন তোদের একটা রাত থাকতে বলতে পারিনি, ভগবান যদি মুখ তুলে চেয়েছেন।

আপাত আচ্ছন্নের ভঙ্গী কিন্তু অদেখা একটা কোথায় যেন ঝলসে বেড়াচ্ছেন বনছায়া সেই একদার বনছায়ার মতো।…এই বনছায়া একখানা অদৃশ্য কাগজে অদৃশ্য কালিতে লিখে চলেছেন লম্বা একখানা চিঠি… আচ্ছা মশাই, আপন দেশটাকে এতো ভুলে বসে আছো কী করে বলো তো? একবারও দেখতে ইচ্ছে করে না? আমি তো তোমাদের দেখবার জন্য হেদিয়ে মরি। চিঠিপত্রও দাও না খবরও জানি না। কদাচ কোনো বিদেশ প্রত্যাগতর মুখে ভাসা ভাসা কিছু খবর জোটে, সেটা ঠিক না বেঠিক কে জানে। সত্যি একবার এসো না ভাই? তোমার ভাইপো আবার একখানা মনোরমা ধাম’ বানিয়েছে তা জানো? অন্তত এই নামের অনারেও একবার আসা উচিত। নয় কী?”

কাগজের ওপর তো কালির দাগ পড়ছে না, তাই দ্বিতীয়বার চোখ বুলোনোর প্রশ্ন নেই। …শুধু লিখে চলা।

এই বনছায়া স্বামীর মৃত্যু, পারিবারিক বিপর্যয়, ছোট্ট একটু মাথা গুঁজে পড়ে থাকা আশ্রয়ের মধ্যে কোনোমতে দিন কাটাতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি আঘাতে আঘাতে যেন বরফের মতো জমাট হয়ে গিয়েছিলেন, হঠাৎ কোথা থেকে এক ঝলক সূর্যকিরণ এসে পড়ে বরফ গলাতে শুরু করছে।…’বাড়ি’ মানে ‘জীবন’!

কিন্তু জিনিসটা কী সকলের কাছেই সত্যি এতোখানি? নাকি মনের গড়ন হিসেবে? হয়তো তাই। বনছায়া অনেককে নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন, অনেকের মধ্যে নিজেকে বিকশিত করে তুলেই যেন ‘নিজেকে’ খুঁজে পান। তাই হয়তো বনছায়ার কাছে বাড়িটাই ‘জীবন’। সেটা হারিয়ে ফেলে মৃতকল্প হয়ে পড়েছিলেন, আবার ফিরে পাওয়ার আশ্বাসে জীবনের স্বাদ অনুভব করছেন।

কিন্তু এ তো অসতর্ক আচ্ছন্ন বনছায়া।

সজাগ সতর্ক বনছায়া মনে মনে ঠিক করছেন, ছেলের সঙ্গে একবার মোকাবিলার দরকার। বলবেন গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্নর লিস্ট করতে বসতে আমার দায় পড়েছে। আগে ভালো করে শুনি গৃহটা জুটছে কি ভাবে?

.

চায়ের পেয়ালায় তুফান উঠলো!

অবশ্য নয়নতারার মনের মধ্যে যে এ তুফানের আশঙ্কা একেবারেই ছিল না তা নয়, তবে এতোটা আশঙ্কা করেননি।

টুনু চলে যাবার পর নয়নতারা ছেলের বৌয়ের মুখের দিকে তাকালেন, সেখানে তাপ উত্তাপ কিছু ধরতে পারলেন না। সব সময় যা করেন তাই করলেন, নিজের মান খুইয়ে, পোজিশান খুইয়ে বলে উঠলেন, খুকেনের ভাগনাটি বড় খাসা ছেলে। দেখে নাতজামাই করতে মন লাগছে। তাই না বৌমা? তুমি কী বলো?

বৌ একবার স্থির চোখে তাকিয়ে বরফঠান্ডা গলায় বললো, বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার মন আপনার হতে পারে, আমার হয় না।

অ মা। বামন আবার কী? ক্যানো আমার নাতনী কী ফ্যালনা না কি? খুকেনের ঘরের লোক। আমি তো মন করছি চুপিচাপি অ্যাকবার বলে দেখবো।

বৌ আরো ঠান্ডা গলায় বললো, গাল বাড়িয়ে চড় খেতে সাধ হয় দেখবেন তাই। তবে কনে ওর ঠিক হয়ে আছে অনেক আগে থেকে।

কনে ঠিক হয়ে আছে, এবং অনেকদিন আগে থেকে। আর সেটি নয়নতারার নাতনীর মায়ের জানা হয়ে গেছে। অর্থাৎ ‘গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়াটা’ ইতিপূর্বে হয়ে গেছে একজনের। দমে গেলেন একটু। টুনির ভাগনাকে বেশ একটু সমারোহময় আপ্যায়ন করা দেখে মনটি বেশ হৃষ্ট ছিল। অপ্রতিভ হয়ে গেলেন। আর কথা না চালিয়ে চলে এলেন স্বামীর কাছে। …তবে তাঁর সঙ্গে মৃদু গুঞ্জনে আলাপচারিতার তো উপায় নেই এইটার যা দুঃখ। এ নিয়ে এখন কিছু কথা চালানো যাবে না। তবে আশা দিয়ে গেছে ছেলেটা, এই যা ভরসা।

একটু মজাদার কথাবার্তাও আছে ছেলেটার। বলে গেল, আর কোনো প্রবলেম থাকবে না দিদিমা! দাদু কানে যত্তরটি লাগিয়ে আয়েস করে বসে থাকবেন, আপনার ‘ফিসফাস’ কথাটিও কান থেকে প্রাণে ভরে নিতে পারবেন।

মামীর মা, অতএব দিদিমা।

মামী চাপা গলায় বললো, এই ফাজিল ছেলে, বাবা রয়েছেন না?

ছেলেটা মুচকি হেসে বললো, এখনো তো কানে ‘যন্তর’ বসেনি। পরে সাবধান হওয়া যাবে।

নয়নতারা তিনতলায় উঠে এসে দেখলেন, সত্যব্রত ছাদের বাগানে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছাদ ভর্তি হরেক ফুল ফুটিয়েছেন নয়নতারা টবে মাটি ভরে ভরে। এমনকি সংসারের বাতিল বালতি ডেকচি হাঁড়িকড়াতেও মাটি ফেলে ফেলে। গাঁদাফুলে একটা কোণ সোনায় রাঙা হয়ে উঠেছে। আর একদিকে টগর দোপাটি নয়নতারার ঝাড়।

রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন সত্যব্রত, নয়নতারাকে দেখে একটু হেসে বলে উঠলেন, আমার যে দেখছি ঘরেও ‘নয়নতারা’, বাইরেও ‘নয়নতারা’।

কথাটা অনুধাবন করতে একটু সময় লাগলো, তারপর হেসে ফেলে, এ মানুষটা দেখছি কোনোকালে বুড়া হবে না!

সত্যব্রত একটু হাসলেন, তুমি তো পাল্লা ঠিক রাখছো, তাহলেই হবে।

নয়নতারা একটু নিশ্বাস ফেললেন, মেয়েলোকের বুড়া না হইলেও ‘বুড়া’ সাজতে হয়। বয়েস হইছে আর বুড়া হইছে না এটা সংসারজন ভালো চোক্ষে দেখে না।

সত্যব্রত একটু গভীর গলায় বললেন, তা জানি। কিন্তু কেন যে

কথা শেষ হলো না, হঠাৎ আদিত্য এসে সামনে দাঁড়ালো! ঘরে দেখতে না পেয়েই ছাতে বেরিয়ে এসেছে। তিনতলায় উঠে আসা আদিত্যর পক্ষে দৈবাতের ঘটনা, আজকের আসার পিছনে অবশ্যই আজকের ঘটনার ইতিহাস বিদ্যমান। কী জানি, ছেলে ঘটনাটাকে কোন আলোয় নিয়েছে।

বেশীক্ষণ ভাবতে হলো না।

আদিত্য দাঁড়িয়ে পড়েই একটু শ্লেষের গলায় বললো ওঃ! দুজনে বাগানে বেড়ানো হচ্ছে। দেখে তো মনে হচ্ছে না, খুব অসুবিধের অবস্থা।

এখন আকাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। এক কোণ থেকে রাস্তার আলো পড়ায় মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। সে আলোয় মুখের চেহারা ঠিক বোঝা যায় না। তাই শব্দজগৎহীন সত্যব্ৰত শুধু চুপ করে চেয়ে থাকলেন। নয়নতারা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, অ মা! অসুবিধার আবার কী আছে! তরা কী আমাদের কোনো অসুবিদা রাখছস। ত’ আজ তর অ্যাতো দেরী? টুনিটা এয়েছিলো, ‘দাদার সাথে দেখা হলো না’ কয়ে আফশোস করে চলে গ্যালো। এট্টাদিন থাকার তো জো নাই। আজই না কী শ্বশুরঠাকুরের হাপানি বৃদ্ধি।

ছেলের সামনে একসঙ্গে এতোগুলো কথা বলা স্বভাব নয় নয়নতারার, এখন যে বললেন সেটা বোধহয় নার্ভাসনেস সামলাতে।

পুত্র স্থিরভাবে শেষ পর্যন্ত সবটি শুনে একটু তিক্ত হাসি হেসে শ্লেষের গলায় বললো, দাদার সঙ্গে দেখা না হওয়ার আফশোসটা কিসের? সরাসরি হাতে করে দাদার গালে চড়টা বসিয়ে দেওয়া হলো না বলে?

নয়নতারা থতমত খেয়ে বললেন, কী বলছস্?

যা বলছি, খুবই বুঝতে পেরেছো। তবে তোমার বড়লোক মেয়েটি কী ভেবেছেন, পয়সা থাকলেই অন্যকে অপমান করবার রাইট্ জন্মায়?

অপমান? কে কারে অপমান করলো খোকা। বুঝছি না তো।

না, বুঝছি না? নিজেকে যতো বোকা-হাবা দেখাও, ততো বোকা তো নও তুমি!

এ কথাটা মোক্ষম সত্যি বৈকি। সকলের সব মনস্তত্ত্ব পড়ে ফেলেও অবোধের ভূমিকাতেই তো থাকেন নয়নতারা। তবু এখন আন্তরিক ব্যাকুলভাবেই বলেন, তর মা চিরকেলে বোকা-হাবাই রে খোকা। শুধো এই মানুষটারে। সত্যিই বুঝছি না, কিসে কার অপমান হইছে।

কার অপমান বুঝতে পারছো না? তোমার খুকেন আমার মুখের ওপর একখানি থাপ্পড় কষিয়ে যায়নি?

আ ছি ছি। এ তুই কী বলছস্ বাবা? তোর বোনটা কী তেমন মেয়ে? “দাদা’ বলে কতো ভক্তি ভালোবাসা।

রাখো। আগে তাই ভাবতাম। ক্রমেই বুঝছি সবই দ্যাখানো।

বোকা হাবা অবোধ নয়নতারা মনে মনে বলেন, তা বুঝবি বৈকি। ক্রমেই ‘সদগুরুর কৃপায় দিব্যদৃষ্টিটা খুলছে যে। তবু আবার নয়নতারা সত্যিই সরলও। তাই বলে ওঠেন, তো আমিও ভেবেছিলুম, তর সঙ্গে পরামর্শ না করে হুট করে ভাগনাটিকে আনা ওর ঠিক হয় নাই। কিন্তু—

থামো থামো!

গর্জে ওঠে আদিত্য, আমার সঙ্গে পরামর্শ! মায়েমেয়ের তলে তলে পরামর্শ চলেছে বুঝি না কিছু?

সত্যব্রত এগিয়ে এসে বলেন, হলোটা কী?

কিছু না। তুমি ঘরে যাও তো—

তাঁকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দিয়েই নয়নতারা বলেন, আমার সাথে আবার কিসের পরামর্শ? আমার সাথে ওর দ্যাকাটা হয় কখন?

ওঃ। দেখা না হলে হয় না, কেমন? তোমরা নিরক্ষর? বলি, আমার সংসারে নাক গলাতে আসে ও কোন সাহসে?

এখন নয়নতারা আস্তে বলেন, তোর সংসারে নাক গলাতে আসবে কেন খোকা? বাপের অসুবিদার অবস্থার চিন্তাতেই—

ওঃ। খুব দুরবস্থায় আছো তোমরা কেমন? সব ঠিকঠাক থাকে? বয়েস হলে লোকের চোখে ছানি পড়ে না? বাতে ধরে না? নানানখানা রোগে ধরে না? কানে খাটো হয় না? বাবার তো তবু হেলথ্টি যথেষ্ট ভালো। ওই সামান্য একটু অসুবিধের জন্যে তোমার মেয়ে একেবারে দরদে গলে গিয়ে প্রতিকার করতে ছুটে এসেছেন? ওঃ! দাদাকে টেক্কা দেওয়া। শুনতে চাই কোন সাহসে ও ববার ওই ‘কানের যন্তর টা নিজে কিনে দেবে বলেছে? এতো আসপদ্দা কিসের?

স্বর উত্তরোত্তর চড়তে থাকে, এই হতভাগ্য আদিত্য গাঙ্গুলীর যদি চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতে সামর্থ্যে না কুলোর, স্ত্রীর গহনা বিক্রী করেও দেবে। কুটুমবাড়ির টাকায় বাপের চিকিৎসা করাবে কিসের জন্যে?

স্ত্রীর গহনা বিক্রী! এসব অপয়া অলক্ষণা কথা তুই বলছস্ কী করে খোকা? নয়নতারা একটু স্থির গলাতেই বলেন এখন, এমোন উল্টাপাল্টা ভাবনা করছস্ ক্যানো? মানুষটা কী উয়ারও বাপ না? ও সন্তান না? এটুকু করতে ইচ্ছা হতে পারে না?

ইচ্ছে। রাখো! এ হচ্ছে স্রেফ টেক্কা দেওয়া! ‘দ্যাখো তোমার বাবার জন্যে কিছু করলে না, আমি করছি।’ তার মানে কুটুমবাড়ির লোকের সামনে আদিত্য গাঙ্গুলীর মুখে চুনকালি তবে আমিও আদিত্য গাঙ্গুলী! পরের টাকায় বাপের চিকিৎসা করাতে দেব না।

নয়নতারা একটু উত্তেজিত হন, খালি খালি পরের টাকা পরের টাকা কইছিস ক্যান? খুকেন তোদের কাছে যদি পর হয়, তার মা-বাপের কাছে ত না। ওর মা-বাপের জন্যি ও কিছু খরচা করতে পারে না? ও কুটুম্ব?

উপার্জনটা ওর নয় মা! সেটা কুটুম্বরই!

নয়নতারার স্বর গাঢ় হয়, মেয়েছেলে আবার কে কবে উপার্জন করেছে খোকা? এখোনই নয় তার চল হয়েছে। তাই বা কয়জনা করছে? স্বামীর উপার্জনের টাকাই তার নিজস্ব—

ওঃ। তাই বুঝি তুমি এখন ঠিক করছো ছেলের ভাত আর খাবে না, আবার স্বামীকে উপার্জনে লাগিয়ে দেবে?…

আদিত্যর কণ্ঠস্বরে শ্লেষ আর তিক্তত। ঝরে পড়ে।

এসব কী কথা! তর কী আজ মাথা নারাপ হইছে বাপ?

আকাশ থেকে পড়ছ যে? ক্যানো তোমার মেয়ের মস্ত ডাক্তার ভাগনেটি বলে যায়নি, ওনার থেকে অনেক সিনিয়ররাও এখনো কোর্টে প্র্যাকটিশ করছে। আর উনি কানে সেই একখান ‘হিয়ার এন্ড্’ লাগিয়েই আবার কাজে নেমে পড়তে পারেন। বলেনি— দাদুর এমন হেলথ্ সামান্য একটু গ্রাহ্যের অভাবে বাড়ি বসে গেছেন!’ বলেনি?

নয়নতারা অবাক হলো। বলেছিল সত্যি, কিন্তু যখন বলেছিল তখন তো সেখানে আর কেউ ছিল না। তবে—’একথা আবার কখন বললো?’ বলে অস্বীকার তো করতে পারেন না! তাই বললেন, বলেছে বলেই যেন তিনি এখন আবার কোর্টে ছুটতে যাচ্ছেন।

যাচ্ছেন কী না যাচ্ছেন, তোমরাই জানো। তবে তোমার মেয়েটিকে সাফ বলে দিও, আমায় যেন টাকা দেখাতে না আসে।

পরিমণ্ডল বেশ উত্তপ্তই হয়ে উঠছিল, হঠাৎ একটি হিমেল হাওয়ার ঝাপটা এসে পড়লো। সিঁড়ির সামনে থেকে বরফে শান দেওয়া একটি ধারালো ছুরির মতো স্বর উচ্চকিত হলো, এতো সাফ কথার কী আছে? তোমারই বা এতে মানের হানি কিসের? মা-বাপ তোমার একার? ওর নয়?

এ আবার কী!

হঠাৎ ভূতের মুখে রামনাম! যেন ধাঁধা লাগার মতো।

শ্রোতা দু’জনের কেউই এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না।

একজন ভাবলো, এর মানে? এরকমটার তো কথা ছিল না।…অপরজন ভাবলো, কী হলো। যা ভাবছিলাম তা তো ঠিক নয়। মনে তো হচ্ছিল, ‘নিদের্শনামা’ নিয়ে এসে সেটাই আওড়ানো হচ্ছিল। সেই রকমই তো হয় বেশীর ভাগ। এটা কেমন উল্টোপাল্টা লাগছে। তবু তিনি প্রায় বিগলিত আর একটু তোয়াজ গলাতেই বলে ওঠেন, তাই কও তো বৌমা তুমি বুঝমান মেয়ে, ভাই নেয্য কথাটা বুঝছো। আমি ত এই এগাটারে সেই কথাটাই বুঝাতে চাইছি—ত মানছে না। তুমি অরে বুঝাও তো এট্টু—

ততক্ষণে নেয্য বুদ্ধিসম্পন্না ঘরের মধ্যে এসে পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে দেখে একটি অগ্রাহ্যের মুখভঙ্গী করেন।

অতঃপর সেই ভঙ্গীর সঙ্গে একটু শ্লেষ মিশিয়ে বলে ওঠেন, আমি? আমরা বোঝাবো ওই লোককে? যা একখানি পুত্তুর তৈরী করে রেখেছেন। আমার ঠাকুর্দা এলেও পারবে না। তবে আমারও এই কথা, বাপের বিষয়-সম্পত্তির বেলায় যদি ছেলে আর মেয়ের মধ্যে সমান সমান চুলচেরা ভাগ তো—দায়-দায়িত্বর বেলাতেই বা তা হয় না কেন?

আর একবার চমক!

এটা তো ঠিক ধাঁধার মতো নয়। স্রেফ ছুরির মতই।

দু’জনেই প্রায় বিভ্রান্ত। আদিত্য এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। বাড়ি ঢুকে টুনিঘটিত ঘটনাটি সাড়ম্বর ভাষ্যে শোনামাত্রই তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। মনে হয়েছি টুনির এই সর্দারি করতে আসা আদিত্যর পক্ষে রীতিমত অপমান।… আর নয়নতারা? তিনিও কথার মোড় এদিকে ঘুরে যাবে একমুহূর্ত আগেও ঠিক বুঝতে পারেননি। বরং ভেবেছিলেন, বৌ তাহলে একটা হক্ কথাই কইতে এসেছে।

আদিত্য চমকটা একটু সামলে নিয়ে ভাসা ভাসা গলায় বলে, এর মধ্যে আবার এসব কথা কেন?

বৌ তিক্ত গলায় বলে, বলিয়ে ছাড়লে, বলতেই হয়। …বোন যদি জন্মজীবনে বাপের জন্যে একটু কিছু করেই, তোমার এতো লজ্জা পাবার কী আছে? তুমি বারো মাস মা-বাপের সমগ্র ভারটি বইছো না? আইন যখন বলছে ‘মেয়ে আর ছেলে সমান’ তখন দায়িত্ব-কর্তব্যও সমান হওয়া উচিত। আমার বুদ্ধি তো এই কথাই বলে। তাছাড়া—মেয়ে যদি ভেবে থাকে, তার মা-বাপের উচিতমত যত্ন-আত্তি হচ্ছে না, তাতে তার প্রাণ কাঁদতে পারে। সুব্যবস্থা করতে ইচ্ছে হতে পারে। তোমার বাধা দেবার কী রাইট্ আছে?

সত্যব্রত মা-ছেলের কথার মধ্যে দু-একবার ‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে?” বলে জানবার জন্যে ঈষৎ ব্যাকুল হচ্ছিলেন, কেউ তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা না করায় আস্তে আস্তে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন। এখন শুধু ত্রিমুখী ধারা।

আদিত্য ভেবে পাচ্ছে না, এখন তার কী বলা মানায়। অথচ কিছু বলাও দরকার। তাই হঠাৎ বলে ওঠে, আমার একটা মানসম্মান আছে। টুনি হঠাৎ ওপর-পড়া হয়ে এসে এভাবে—

হ্যাঁ, ‘হঠাৎই’ আশ্চর্য! সাতজন্মে তো একবার মা-বাপকে দেখতে আসতেও দেখা যায় না। হঠাৎই বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়তে দেখা যাচ্ছে।

নয়নতারা একবার নিথর নয়নে তাকিয়ে দেখেন।

পরক্ষণেই তাঁর পক্ষে একটি অসমসাহসিক কাণ্ড করে বসেন নয়নতারা। অসমসাহসিকই, কারণ সংসারের শান্তি বজায় রাখার চেষ্টায় চেষ্টায় নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখতে রাখতে আর ‘অবোধ’ সেজে থাকতে থাকতে নয়নতারার মধ্যে ‘সাহসের’ প্রকাশ কোনো সময়ই দেখা যায় না। শুধু এখনই বা কেন, বলতে গেলে চিরকালই। পাবনার সেই বধূ নয়নতারা গাঙ্গুলী কি কখনো সাহস করে কারো মুখের ওপর কোনো ‘স্পষ্ট’ কথা বলে উঠতে পারতেন? অশান্তি আর সংঘর্ষকে বড় ভয় নয়নতারার। তাই আধপাগল শাশুড়ির পাগল জনোচিত নির্দেশও মেনে চলতেন, পাছে গোলমাল চেঁচামেচি হয়। সর্বোপরি পাছে সত্যব্ৰত আহত হন।

আর এখন কার সংসারে? সে তো সর্বদাই একটি অদ্ভূত ভূমিকায় থাকেন। মান-অভিমান রাগ-বিরক্তি কোনো কিছুই প্রকাশ পায় না তাঁর মধ্যে থেকে, কারণ তিনি বোকাসোকা, কে কী বললো তার মানে ধরে ফেলতে পারেন না। ভূমিকাটি এক হিসেবে মোটমুটি নিরাপদ। কিন্তু নয়নতারা আজ এখন হঠাৎ সেই ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে বলে উঠলেন, দাঁড়াও বৌমা, শুনে যাও।

কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা

নীহারিকা থমকালো।

নয়নতারা শান্ত কঠিন গলায় বললেন, ‘আইনকানুন চুলচেরা ভাগের’ কথা যখন তুলছোই বৌমা, ত কয়ে রাখছি—ওই উকিল মনিষ্যিটি অনেক আগেই তার ব্যবস্থা করে রাখছে। বসতবাটিতে ‘ভেন্নগোত্তর’ এসে ভাগীদার হয়ে বসবে, এটা তাঁর বরাবরের না পছন্দ, তাই পাকাপাকি লেখাপড়া করে এই বাড়ি পুত্র-পুত্রবধূর নামে উইল করে রাখছে। সে উইলে সাক্ষীনামায় সই করিয়ে রাখছে ‘খুকেন’ আর জামাইকে যাতে ভবিষ্যতে কেউ তোমাদের কিছু দূষতে না পারে। কথাটা অখন থেকে প্রচার করার কথা না, তবু এক্ষেত্রে বলাটা দরকার ভেবে বললাম। ঠাকুরের দয়ায় খুকেনের কোনো অভাব নাই, এ বাড়ির ‘ভাগ’ নিয়ে দাবিদার হতে আসবে না সে। নিশ্চিন্তে থাকো তোমরা!

দু’জোড়া নিথর পাথর চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে দালান থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকে যান নয়নতারা।

তার মানে আদিত্যর কিছু হোক না হোক, ‘মুখের ওপর একখানা থাপ্পড়’ আজ আদিত্যর বৌয়ের কপালেই ছিল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন