আবু সয়ীদ আইয়ুব
কালের দিক থেকে বলাকা গীতাঞ্জলি পর্বের অব্যবহিত পরে, কতকটা সমসাময়িকও বটে। বলাকার কবিতা লেখা যখন আরম্ভ হয়ে গেছে, গীতালির গান লেখা তখনো শেষ হয় নি। অথচ ভাবের দিক থেকে ব্যবধান অনেকখানি। বলাকা-ছন্দের নতুনত্ব শুধু ছন্দ নিয়ে পরীক্ষার ফল নয়, নতুন প্রাণের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল নতুন কলেবরের। কাব্যের আঙ্গিক-বদল সব সময়ে হার্দ্য পরিবর্তনের তাগিদেই যে ঘটে তা নয়—এমনকি রবীন্দ্রকাব্যেও না। উদাহরণত, পুনশ্চ-এর গদ্যকবিতা ভাবের বিচারে খুব অভিনব নয়। শেষ পর্ব নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রকাব্যের এক নতুন পর্ব, কিন্তু সে নূতনত্বের স্বাক্ষর পরিশেষ-এর নিয়মানুগ ছন্দেই সুস্পষ্ট, গদ্যকবিতায় তা নূতনতর হয়ে ওঠে নি। রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায় অবশ্য ছিল সুদূরপ্রসারী: ‘অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেকদূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস, এবং সেই দিকে লক্ষ্য রেখে এই গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি।’ শেষ দশকের কবিতায় কাব্যের অধিকারকে তিনি অনেক দূর প্রসারিত করেছিলেন নিশ্চয়ই, তবে তা ছন্দ ভাঙার অপেক্ষা রাখে নি। বলাকা কাব্যে কিন্তু নতুন কালের করাঘাতে ছন্দের মুক্তি ও ভাবের উন্মোচন একই সঙ্গে ঘটে।
গীতাঞ্জলিতে কাল তার গতিধর্ম হারিয়ে এক নিস্তরঙ্গ নিঃশব্দ অকূল সরোবরে পরিণত হয়েছিল। বলাকাতে পশ্চিমী গতিবেগের যৌবনোচিত চাঞ্চল্য দেখা যায়, এবং সাম্প্রতিক কালের বিক্ষোভ। আমরা অবিরাম শব্দ শুনি পাড়-ভেঙে-চলা স্রোতস্বিনীর। ৮ সংখ্যক কবিতায় কবি স্বয়ং এই উপমা ব্যবহার করেছেন; নাম-কবিতাটিতে কালের উদ্দামতা আরও মনোগ্রাহী চিত্রকল্পে অভিব্যক্ত।
প্রসঙ্গত, লক্ষ্য করবার বিষয় যে কালচেতনা কর্মচেতনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ভক্তি কালাতীত ব্যাপার, এমনকি তাতে ইহকাল-পরকালের ভেদ পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, কর্মব্রতী মানুষের একটি চোখ থাকে উপস্থিত কালের উপর নিবদ্ধ, আর একটি চোখ প্রসারিত হয় অনাগত কিন্তু ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে। সে চায় অবস্থার পরিবর্তন—কখনো সংস্কারের পথে, কখনো বা বিপ্লবের। কাজেই কালের গতিশীলতা সে ভুলতে পারে না।
গীতাঞ্জলির কবি ছিলেন সমাজ থেকে বেশ একটু দূরে, আপন পরান-সখার সঙ্গে একান্তে আসীন, বা এক তরীতে কূলহারা কিন্তু প্রশান্ত—কানে-কানে গান শোনানো যায় এতটা প্রশান্ত—সমুদ্রের মাঝখানে ভেসে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। বলাকার কবি সারা পৃথিবীর দুঃখ ও পাপের ভারে নিপীড়িত। আমরা জানি প্রথম মহাযুদ্ধের প্রকাশ্য ধ্বংসলীলা আরম্ভ হবার কিছু পূর্বেই মানবজাতির কোনো অজ্ঞাত মহাবিনাশ আসন্ন জেনে তাঁর মন কী-রকম ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। যখন যুদ্ধ বাধল, ‘মৃত্যুর গর্জন’ কবির কানে এসে পৌঁছল, তখন তা শুধু বেদনাদগ্ধই করল না তাঁকে, কর্মেও উদ্বুদ্ধ করল। মানসী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কবির সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিল’; বলাকা সম্বন্ধে লিখতে পারতেন, ‘কবির সঙ্গে যেন একজন কর্মী এসে যোগ দিল’। এই কর্মীপুরুষকে আমরা আগের কোনো কোনো কাব্যেও দেখেছি, বিশেষত নৈবেদ্যতে। কিন্তু এতখানি সমাজ-সচেতন, অমঙ্গলপীড়িত, দেশ-বিদেশের দুঃখ ও পাপ বিষয়ে কর্তব্যভারগ্রস্ত কর্মীপুরুষের অস্তিত্ব ইতিপূর্বে অনুদ্ঘাটিত ছিল। গীতাঞ্জলিতে যিনি সহজ মনে বলতে পেরেছিলেন—
কথার পাকে কাজের ঘোরে
তলিয়ে রাখে কে আর মোরে
তাঁর স্মরণের বরণমালা
গাঁথি বসে গোপন কোণে,–
বলাকায় এসে তাঁর মনে পড়ল বিধাতা তাঁর উপর কেবল বাঁশি বাজাবার দায়িত্ব অর্পণ করেন নি। অকস্মাৎ যেন ভাবের ঘোর কেটে গেল, মাটির দিকে চেয়ে দেখলেন—’তোমার শঙ্খ ধুলায় প’ড়ে আছে’। পূর্ববর্তী ভক্তিপর্বের তদগত আত্মনিমজ্জিত ভাবটাকে লক্ষ্য ক’রেই বোধ হয় বললেন:
চলেছিলেম পূজার ঘরে
সাজিয়ে ফুলের অর্ঘ্য।
খুঁজি সারাদিনের পরে
কোথায় শান্তি-স্বর্গ।
এবার আমার হৃদয়ক্ষত
ভেবেছিলেম হবে গত
ধুয়ে মলিন চিহ্ন যত
হব নিষ্কলঙ্ক।
পথে দেখি ধুলায় নত
তোমার মহাশঙ্খ।
অতএব শান্তি-স্বর্গ খোঁজা আর হ’ল না, পূজার ঘরে কুলুপ লাগিয়ে বেরিয়ে আসতে হ’ল আঘাত-সংঘাত-মুখর জনসমাজে। এই কবিতার গদ্য-ব্যাখ্যায় কবি বলছেন, ‘সে সময়ে পূজাকেই একমাত্র কর্তব্য ব’লে মনে হয়েছিল। কিন্তু অন্তরে একটা দাবী এল, হঠাৎ মনে হ’ল মানুষকে আহ্বান করবার শঙ্খ তো বাজাতে হবে, বিশ্ববিধাতার নামে মানুষকে ছোটো গণ্ডি থেকে বড়ো রাস্তায় তো ডাকতে হবে।’
‘এবার যে ঐ এল সর্বনেশে গো/ বেদনায় যে বাণ ডেকেছে’ কিংবা ‘এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে / পরাও রণসজ্জা’ যখন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন (৫ই ও ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১), তখন সর্বনাশা মহাযুদ্ধ এসে পৌঁছয় নি, তবে বিপুল সমারোহে ও বিকট দম্ভে আটঘাট বাঁধা হচ্ছিল ভিয়েনায়, বের্লিনে, পীটার্সবার্গে, প্যারিসে, লণ্ডনে; প্রস্তুতি-পর্ব প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। যুদ্ধের খবর পেয়ে লিখলেন বলাকার ৫ সংখ্যক কবিতা। লক্ষণীয় যে এত বড় সর্বনাশের খবর পেয়ে যে-কথাটা প্রথমে তাঁর মনে এল সেটা এই নয় যে সর্বশক্তিমান মঙ্গলময়ের বিধানে এমন দুঃসহ দুঃখ কোটি কোটি মানুষকে সইতে হবে কেন? মনে এল—
মত্ত সাগর দিল পাড়ি গহন রাত্রিকালে
ঐ যে আমার নেয়ে।
ঝড় বয়েছে, ঝড়ের হাওয়া লাগিয়ে দিয়ে পালে
আসছে তরী বেয়ে।
যত ভয়ানক হোক, যত কোটি মানুষই ডুবে মরুক, তবু কবির সন্দেহ নেই যে তাঁর নেয়ে, মানবেতিহাসের নেয়ে, কালসাগর পাড়ি দিয়ে আসছেন: প্রশ্ন শুধু এই—কোন্ সম্পদ নিয়ে আসছেন তিনি এবং কোন্ ভাগ্যবান দেশের জন্য:
নাহি জানি পূর্ণ ক’রে কোন রতনের বোঝা
আসছে তরী বেয়ে।
… … … … …
কার গলাতে নবীন প্রাতে পরিয়ে দেবে হার
নবীন আমার নেয়ে।
—আশ্চর্য প্রশ্ন এবং আশ্চর্য এর মূলীভূত প্রত্যয় (‘যুদ্ধের সমুদ্র পার হয়ে নাবিক আসছেন’)। কিন্তু প্রত্যয়ান্তরের সূচনা ও বলাকাতেই পরিলক্ষ্য।
মহাযুদ্ধের অভিঘাত অনেক বেশি স্পষ্ট ও তীব্র হয়ে উঠেছে বছর খানেক পরে লেখা ৩৭ সংখ্যক কবিতায়:
দূর হতে কি শুনিস মৃত্যুর গর্জন, ওরে দীন,
ওরে উদাসীন,
ওই ক্রন্দনের কল্লোল,
লক্ষ বক্ষ হতে মুক্ত রক্তের কল্লোল।
বহ্নিবন্যা-তরঙ্গের বেগ,
বিষশ্বাস-ঝটিকার মেঘ,
ভূতল গগন
মূর্ছিত বিহ্বল-করা মরণে মরণে আলিঙ্গন;
মহাযুদ্ধের বীভৎসতা এই ‘উদাসীন’ কবির চিত্তে নতুন চেতনার উদ্রেক করল, বিশ্ববিধান ও বিধানকর্তা সম্বন্ধে তাঁর এতদিনকার কুসুমাস্তীর্ণ বিশ্বাস-ভূমি ধীরে ধীরে প্রশ্ন-কণ্টকিত হয়ে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন পুরানো সত্যের পুঁজি ফুরিয়ে এসেছে, গীতাঞ্জলির যে-বন্দরে এতকাল তাঁর ভাবের তরী অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল সেখান থেকে নোঙর তুলতে হবে, এই বিষশ্বাস ঝটিকার মাঝখানে তরী বেয়ে চলতে হবে তাঁকে।
বন্দরের বন্ধনকাল এবারের মতো হল শেষ,
পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা
আর চলিবে না।
বঞ্চনা বাড়িয়া ওঠে, ফুরায় সত্যের যত পুঁজি,
কাণ্ডারী ডাকিছে তাই বুঝি—
‘তুফানের মাঝখানে
নূতন সমুদ্রতীরপানে
দিতে হবে পাড়ি।’
কিন্তু যে-নতুন মানসভূমির দিকে তরী চলেছে তার ভূ-প্রকৃতি, তার তটরেখা, এমনকি তার সঠিক অবস্থান সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথের মনে কোনো ধারণা ছিল না তখন। শুধু জানতেন:
অজানা সমুদ্রতীর, অজানা সে-দেশ—
সেথাকার লাগি
উঠিয়াছে জাগি
ঝটিকার কণ্ঠে কণ্ঠে শূন্যে শূন্যে প্রচণ্ড আহ্বান।
কবিতার স্তবকে স্তবকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত একটি সক্ষোভ এবং সাগ্রহ আওয়াজ—‘বন্দরের কাল হল শেষ’।
এই পর্যন্ত কবিতাটি সুন্দর; এরপর থেকে তার কাব্যপ্রাণ কতকটা চাপা প’ড়ে গেছে তত্ত্বকথা আর উপদেশবাণীর ভারে। নৈবেদ্যে উল্লিখিত বোয়ার যুদ্ধের চেয়ে এই বিশ্বযুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের মনের আরও অনেক গভীরে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু এবারেও অন্তত প্রথম দফায় তিনি সমস্ত ব্যাপারটাকে পশ্চিমের কয়েকটি বলদৃপ্ত রাষ্ট্রের উৎকট স্বাজাত্যভিমান ও হিংস্র সাম্রাজ্যলিপ্সা এবং সেই মহাপাপের প্রচণ্ড শাস্তি রূপেই দেখেছিলেন। কিন্তু এ-দেখা একপেশে; সমাজ-সংস্কারকের পক্ষে হয়তো স্বাভাবিক, কবির পক্ষে ক্ষতিকর। আগেই বলেছি, গীতাঞ্জলিতে যিনি ছিলেন নিছক প্রেমভক্তিরসের কবি, বলাকায় তিনি মানুষকে কঠিন কর্তব্যের পথে আহ্বান করার শঙ্খ হাতে তুলে নিলেন। তবে এ-কথা ভুললে চলবে না যে কর্মপ্রেরণা কোনো কবির, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের মতো কবির—যিনি আধুনিক ও বৈদিক উভয় অর্থে কবি—মূল প্রেরণা হতে পারে না। তাই মহাযুদ্ধের প্রতি তাঁর মানসিক প্রতিক্রিয়া ধর্মনীতির গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রইল না বেশিদিন, কবির সংবেদনী চিত্ত ধর্মোপদেষ্টার নীতিবাক্যকে ছাপিয়ে উঠল।
দুঃখ-কষ্টের দুই প্রকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় প্রাচীন ধর্মমতে। এদেশীয় ব্যাখ্যা হ’ল—মানুষের দুঃখ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ন্যায়সংগত এবং জাগতিক নিয়মানুগ, ইহজন্মের বা পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল। কর্মভোগ সমাপ্ত হলে এবং এ-জন্মের পাপ-পুণ্যের খতিয়ানে পুণ্যের পাল্লাটা ভারী থাকলে পরজন্মে উন্নতি এবং সুখলাভ অবধারিত। সেমিটিক ধর্মের শিক্ষা অন্যপ্রকার। মানুষের পার্থিব পরমায়ু তার অনন্ত জীবনের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশমাত্র। ঐহিক দুঃখ-কষ্টের কষ্টিপাথরে যাচাই করা হয় ঈশ্বরে বিশ্বাস আর ধর্মে মতি তার খাঁটি এবং টেকসই কি না। যদি পরীক্ষায় সে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয় তবে ইহজীবনে না হোক পরকালে অক্ষয় আনন্দের দ্বারা তার স্বল্পকালীন ঐহিক যন্ত্রণার বহুগুণীকৃত ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে। আর যদি পরীক্ষায় তার আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক অযোগ্যতা প্রতিপন্ন হয় তবে ঐহিক এবং পারত্রিক সমূহ দুর্ভোগ আছে তার কপালে। অবশেষে যথাবিহিত নরক-যন্ত্রণার পর তার পাপক্ষালন হবে, সে গৃহীত হবে ঈশ্বরের অপার করুণায় প্রেমে।
মানুষের ঐহিক দুঃখভোগের এসব প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও সাফাই রবীন্দ্রনাথের যুক্তিনির্ভর মন গ্রহণ করতে পারে নি। পারে নি বলে তার এক অভিনব স্বকীয় ব্যাখ্যা তৈরি করলেন তিনি। ঐ সময়ে শান্তিনিকেতন মন্দিরে প্রদত্ত একটি অভিভাষণ ‘পাপের মার্জনা’য় তার মূল কথাটা পাওয়া যাবে। এই যুদ্ধ যে-অসহ্য দুঃখ-কষ্ট বহন ক’রে নিয়ে আসছে ‘তার সমস্ত বেদনা কোনখানে গিয়ে লাগছে? কত পিতামাতা তাদের একমাত্র ধনকে হারাচ্ছে, কত স্ত্রী স্বামীকে হারাচ্ছে।’ অগণ্য নিরীহ মানুষের উপর এমন নিষ্ঠুর আঘাত কেন? – দুঃসাহসিক প্রশ্ন, কিন্তু সহজেই তার সমাধান খুঁজে পেলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন: ‘যেখানে পাপ সেখানে কেন শাস্তি হয় না। সমস্ত বিশ্বে কেন পাপের বেদনা কম্পিত হয়ে ওঠে? কিন্তু, এই কথা জেনো যে, মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। সেইজন্য পিতার পাপ পুত্রকে বহন করতে হয়, বন্ধুর পাপের জন্য বন্ধুকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, প্রবলের উৎপীড়ন দুর্বলকে সহ্য করতে হয়।’
তথ্যের দিক থেকে কথাগুলি নির্ভুল। পিতার ব্যভিচারের ফলে পুত্র সিফিলিস রোগে অন্ধ হয়, রাজা বা রাষ্ট্রপতি দুর্নীতি-পরায়ণ হলে প্রজাবর্গের কপালে অশেষ যন্ত্রণা থাকে, নাৎসীদের জঘন্য জাতিবিদ্বেষের ফলে ষাট লক্ষ নিরপরাধ ইহুদী প্রাণ হারায়। এমনটা হয়ে থাকে, কিন্তু এমনটাই কি হওয়া উচিত? এই সব নির্দোষ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে কি আমাদের বিবেক পীড়িত হয় না, ন্যায়নীতিবোধ বিদ্রোহ ক’রে ওঠে না? পাপ যে করবে তার গায়ে আঁচড়টি লাগবে না, আর যে নিষ্পাপ সেই পাপের মার খেয়ে মরবে—এ প্রকৃতির অন্ধ নিয়ম হতে পারে, বিধাতার মঙ্গলবিধান হতেই পারে না। কোনো পিতা যদি জ্যেষ্ঠ পুত্রের অপরাধের শাস্তি দেয় কনিষ্ঠ পুত্রকে প্রহার ক’রে যেহেতু তাকেই হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে, তা হলে আমরা বলবই—অত্যন্ত অন্যায়ভাবে এই শাস্তি দেওয়া হ’ল। আমাদের পরম পিতা যদি প্রবলের পাপের শাস্তি দুর্বলকে দেন, তবে কি বলব না তিনি ততোধিক অন্যায় করেছেন? রবীন্দ্রনাথ এই ব’লে তার সমর্থন করতে পারেন না যে ‘অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তরে হৃদয়ে হৃদয়ে মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।’
একটি জীবদেহে যেমন বহুকোটি জীবকোষ তাদের স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে এক বৃহত্তর যৌগিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হয়ে যায়, কোনো মনুষ্যসমাজের অন্তর্ভুক্ত বহু লক্ষ মানুষ তেমন ক’রে তাদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে সমাজদেহের
অঙ্গপ্রত্যঙ্গমাত্র হয়ে যায় না। সমাজসেবার উদ্দেশ্যও ব্যক্তির আত্মস্ফুরণ, আত্মবিলোপ নয়; ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যেই মানুষের মনুষ্যত্ব মৌমাছিতন্ত্রে নয়। চরিত্রনীতির ক্ষেত্রে এই মানবিক বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব সর্বাধিক। পাপ-পুণ্য, অপরাধ-শাস্তি একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। মনুষ্যসমাজ পাপচিন্তা ও পাপাচরণ করে না, এক বা একাধিক ব্যক্তিই করে। পাপ যারা করে আর শাস্তি যারা পায় তারা যদি ভিন্ন হয়, তবে তা বিশ্ববিধানের ত্রুটি। কার্যকারণ শৃঙ্খলা তাতে অটুট থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মনীতি থাকে না।
রবীন্দ্রনাথ এসব কথা তখন ভাবেন নি, বরঞ্চ পদ্যের আবেগ-পূর্ণ ভাষায় ব্যক্তির পাপ ও শাস্তিকে সমাজের পাপ ও শাস্তির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে এক ক’রে দেখিয়েছেন:
হে নির্ভীক, দুঃখ-অভিহত।
ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি। মাথা করো নত।
এ আমার এ তোমার পাপ।
বিধাতার বক্ষে এই তাপ
বহু যুগ হতে জমি’ বায়ুকোণে আজিকে ঘনায়।
পৃথিবীর এক স্থানে তাপবৃদ্ধির ফলে ঝড় ওঠার সঙ্গে সমাজের এক স্থানে পাপ জ’মে ওঠার ফলে সামাজিক ঝড়ের তুলনা বলাকার অন্য একটি কবিতার গদ্য-ব্যাখ্যায় সবিস্তারে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বায়ুমণ্ডলের কোনো-এক অংশ যদি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে তা হলে অনেকক্ষণ তার কোনো ফল দেখা দেয় না। তার পরে হঠাৎ এক সময়ে ভীষণ ঝড় ওঠে, হাজার হাজার ক্রোশ জুড়ে বনপ্রান্তর লোকালয় সব ছারখার ক’রে দেয়। তেমনি সমাজের কোনো-এক অংশে পাপ জমতে জমতে যখন একটা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন বিধাতার শাস্তি নেমে আসে ভয়ংকর রূপে, অনেক সময় মহাযুদ্ধ রূপেই। কিছুকাল পরে পাপক্ষালন হলে, সমাজ শুদ্ধ হলে, শাস্তির মেয়াদ ফুরোয়, আবার আসে শাস্তি, স্বস্তি, আশীর্বাদ।
কবিজনোচিত সুন্দর উপমা, কিন্তু উপমামাত্র। পাপ ও তজ্জনিত দুঃখের এই ধরনের সরল কাব্যিক ব্যাখ্যায় একটা চারিত্র্যনৈতিক ফাঁকি আছে, সেটা রবীন্দ্রনাথের সুষ্ঠু সুষম বিচার-শক্তির কাছে ধরা না প’ড়ে পারে না। বছর পনেরো পর যখন বিহারের নিদারুণ ভূমিকম্পকে গান্ধীজী অস্পৃশ্যতা-পাপের ভগবৎকৃত শাস্তি ব’লে ঘোষণা করলেন তখন রবীন্দ্রনাথই প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর একটা বড়ো যুক্তি ছিল যে—এ পাপের প্রধান পাপী তো সেই উচ্চবর্ণ হিন্দুরাই, অথচ তাদের মধ্যে অনেকেই পাকা দালান-কোঠায় বাস করত ব’লে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। অপর পক্ষে, অচ্ছুৎরা বেশির ভাগই বাস করত মাটির ঘরে, তাদেরই সর্বনাশ হ’ল। অর্থাৎ পাপের মার যারা খেয়েছিল, শাস্তির মারও পড়ল তাদেরই পিঠে। মহাযুদ্ধের বেলাও তাই ঘটেছিল। যে-অল্পসংখ্যক ক্ষমতামদমত্তদের সাম্রাজ্যলিপ্সা ও ধনলোলুপতা ঐ যুদ্ধ বাধিয়ে তুলল, তারা তো দিব্যি বহাল তবিয়তে রইল; উপরন্তু, দুই হাতে মুনাফা লুটল। আর তাদেরই দুষ্কৃতির ফলস্বরূপ লক্ষ লক্ষ নিরীহ সাধারণ মানুষ নিহত হ’ল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারাল, সব দিক দিয়ে সর্বস্বান্ত হ’ল।
প্রচলিত বা তাঁর স্বকীয় ধর্মতত্ত্ব যা-ই বলুক, কবির সংবেদনী ও ব্যথিত হৃদয় উপলব্ধি করল যে, কোনো ধর্মোপদেশ বা নীতি-বাক্যের দ্বারা এতগুলো মানুষের এত বড়ো দুঃখ-দুর্দশাকে ঢাকা যায় না। ‘য়ুরোপের দত্ত ও লোভ সর্বজাতির কল্যাণযাত্রার পথ রুদ্ধ ক’রে জগদ্দল পাথরের মতো সবার বুকের উপর চেপে থাকবে—এটা কখনো বিধাতার অভিপ্রায় হতে পারে না।’—এ-কথা যেমন ভাবুক রবীন্দ্রনাথ হৃদয়ঙ্গম করলেন, তেমনি কবির
সংক্ষুব্ধ হৃদয়ে এ-কথাও স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, ‘উপরিতলের রাজনীতিওয়ালাদের ক্ষমতার কাড়াকাড়ি’র পরিণামে য়ুরোপের তথা সারা দুনিয়ার নিম্নতলের কোটি কোটি নিরীহ অসহায় মানুষের সর্বনাশ ঘটুক—এটাও বিধাতার অভিপ্রায় হতে পারে না।
অথচ সর্বনাশ তো ঘটল। এ এক নতুন উপলব্ধি। বস্তুত এত বিরাট, এত ভয়াবহ, এত দুর্বিষহ ও দুর্বোধ্য আকারে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ ও পাপের চেহারা ইতিপূর্বে কখনো দেখেন নি, কল্পনার চক্ষেও না। এর ফলে তাঁর ধর্মচিন্তা, জীবনবোধ, হৃদয়ানুভূতির বর্ণালি, কাব্যরচনার ধারা—সবই বদলে গেল। একটু তলিয়ে দেখলে এই নতুন কবির পরিচয় বলাকাতেও আমরা পেতে পারি; তবে তার অব্যর্থ স্বাক্ষর শেষ পর্বের (অর্থাৎ পরিশেষ ও তৎপরবর্তী) কাব্যেই পরিলক্ষ্য।
পূর্বে উদ্ধৃত ৩৭ সংখ্যক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যদিচ ‘নিখিলের হাহাকার’ শুনেও তরী বেয়ে চলেছেন ‘চিত্তে নিয়ে আশা অন্তহীন’, দুঃখ ও পাপের ‘অভ্রভেদী বিরাট স্বরূপ’-এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘তোরে নাহি করি ভয়’, বলছেন, ‘শান্তি সত্য, শিব সত্য, সত্য সেই চিরন্তন এক’; কিন্তু স্পষ্টতই বিশ্বাসের ইমারত ঠিক আগের মতো মজবুত নয় আর, সংশয়ের ফাটল এবং সে-ফাটলকে পলেস্তারা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা দেখা যায়। কবি যেন নিজের সঙ্গে তর্ক করছেন, নিজেকে আশ্বাস দিয়ে বলছেন, ‘দেবতার অমর মহিমা’ সাময়িকভাবে ঝাপসা হয়েছে মাত্র, মহাযুদ্ধের ঘন কুয়াটিকা কেটে গেলে আবার পূর্ণ জ্যোতিতে ভাস্বর হবে। বলছেন, কিন্তু আশ্বাসবাক্যে অন্য এক ইঙ্গিত ধরা পড়ে, ধরা পড়ে ‘মানুষের ধর্ম’-রচয়িতার মানবিক ধর্মমতের পূর্বাভাস।
বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা?
স্বর্গ কি হবে না কেনা?
বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না
এত ঋণ?
রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন?
নিদারুণ দুঃখরাতে
মৃত্যুঘাতে
মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্ত্যসীমা
তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?
কবিতার উপান্ত্য প্রশ্নের প্রত্যাশিত উত্তর অবশ্যই ‘হ্যাঁ’, কিন্তু কবিতাটি প্রশ্নেই শেষ হয়। এবং উহা উত্তরের পিছনে আরও কিছু উহ্য থাকে। মানুষ অযুত নিযুত বৎসর ধ’রে দুঃসহ দুঃখ ভোগ ক’রে দুঃসাধ্য জ্ঞানে কর্মে ও প্রেমে আপন মর্ত্যসীমা (জৈবধর্মের সীমা) ‘চূর্ণ’ করতে পারে যদি, তবেই দেবতার অমর মহিমা দেখা দেবে, নতুবা নয়। তার মানে এই নয় কি যে, দেবতার অমর মহিমা এখনো পর্যন্ত অপূর্ণ বা অনভিব্যক্ত? দেবত্বের পূর্ণ বিকাশ মনুষ্যত্বেরই পূর্ণ বিকাশের উপর নির্ভরশীল ও শর্তাধীন? এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় সেই স্থান যেখানে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করবেন—ভগবান বলতে মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না।
যুক্তিতর্কের দ্বারা নিজের সন্দেহভঞ্জন করা এবং একটি শর্তযুক্ত বাক্যে সেই তর্কের সমাপ্তি ১৯ সংখ্যক কবিতায় আরও স্পষ্ট। জীবনানুরাগের সঙ্গে মৃত্যুচেতনার দ্বন্দ্বই এই কবিতার মূল বিষয়।
তবুও মরিতে হবে এও সত্য জানি।
মোর বাণী
একদিন এ-বাতাসে ফুটিবে না,
মোর আঁখি এ আলোকে লুটিবে না,
মোর হিয়া ছুটিবে না
অরুণের উদ্দীপ্ত আহ্বানে
মোর কানে কানে
রজনী কহে না তার রহস্যবারতা,
শেষ করে যেতে হবে শেষ দৃষ্টি, মোর শেষ কথা।
নিজের মৃত্যুকে এমন একান্ত নঞর্থক চেহারায় দেখা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে একটু অপ্রত্যাশিত বইকি। ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’—সেই বাল্যরচনার সময় থেকে কত মধুর সম্ভাষণেই তিনি ডেকেছেন মরণকে।
অত চুপি চুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।
অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও,
ওগো একি প্রণয়েরি ধরন।
সেই রবীন্দ্রনাথ আজ প্রণয়ী রূপে নয়, জীবনের পরিপূর্ণতা রূপে নয়, মরণকে দেখছেন জীবনের পরিপন্থী রূপে। বলাকার ঐ কবিতার গদ্য-ব্যাখ্যায় বলছেন, ‘এমন করে যে জগতকে চাচ্ছি, আর এমন করে যে জগতকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি এই দুটো যদি সমান সত্য হয়েও দুটো contradictory হয় তবে জগতে এই ভয়ানক অসামঞ্জস্যের ভার, এই প্রবঞ্চনা, থেকে যেত; তবে তার সৌন্দর্যের মধ্যে ক্রুরতার চিহ্ন দেখতাম। কিন্তু তা তো কোথাও দেখি না। তবে এ দুই সত্যের মিল কোথায়?’ এর উত্তর কবিতায় নেই। দুটি অসমঞ্জস অথচ অনস্বীকার্য সত্য কোথায় কেমন ক’রে কাঁটায় কাঁটায় মিলেছে তার বিবরণ কবিতায় থাকার কথা নয়। কিন্তু মিলেছে কি? যেখানেই হোক, যেমন ভাবেই হোক, সম্পূর্ণ মিলেছে—সে-প্রত্যয়ও তো এই কবিতায় দানা বাঁধতে পারে নি। বরঞ্চ কবিতা শেষ হয় একটি দুর্বল অনুমানে, দর্শনের পরিভাষায় অর্থাপত্তিতে:
এ দুয়ের মাঝে তবু কোনোখানে আছে কোনো মিল;
নহিলে নিখিল
এতবড়ো নিদারুণ প্রবঞ্চনা
হাসিমুখে এতকাল কিছুতে বহিতে পারিত না।
সব তার আলো
কীটে-কাটা পুষ্পসম এতদিনে হয়ে যেত কালো।
উহ্য প্রতিজ্ঞা—নিখিলের সব আলো কালো হয়ে যায় নি, অর্থাৎ বিশ্বপ্রকৃতি সুন্দর; অতএব মিল আছে কোনোখানে। কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষের সৌভাগ্যের যথোপযুক্ত প্রমাণ নয়। দুর্বল হোক, সবল হোক, কবিতা যখন যুক্তিতে এসে ঠেকে তখন বুঝতে হবে কবির উপলব্ধির কোনো পর্বে ভাটা পড়েছে।
তবু সমগ্র কবিতাটি দুর্বল নয়। তার কারণ কবিতার আপাত বক্তব্যের অন্তরালে রয়েছে তার গভীরতর ব্যঞ্জনা। আপাতত মনে হয় রবীন্দ্রনাথ যেন পাটিগণিতের অঙ্ক মেলাবার মতো ক’রে দেখিয়ে দিতে চান জীবন ও মৃত্যু পরস্পর-বিরোধী নয়, কোথাও নিশ্চয়ই মিলেছে তারা। কিন্তু কবিতার গূঢ় ব্যঞ্জনা তা নয়। ব্যঞ্জনা—ঐ বিরোধের ভয়াবহতা, এবং কোনো পূর্ণ সামঞ্জস্যের জন্য কবির আকুলতা ও উৎকণ্ঠা। এই ব্যঞ্জনাই কবিতাটিকে রসোত্তীর্ণ করেছে।
বলাকার আর-একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়। ‘এই সব দারুণ নীচতা ও ভণ্ডামির অন্তরালেও শিব সক্রিয় আছেন’—এ-বিশ্বাস তাঁর অটুট রইল, কিন্তু এই লীলাময় দেবতার সঙ্গে নৈবেদ্য-গীতাঞ্জলির প্রেমকরুণাময় ভগবানের তফাত অনেক। ১১ সংখ্যক কবিতায় এই দেবতাকে কখনো ‘হে মোর সুন্দর’ ব’লে সম্বোধন করা হচ্ছে, কখনো ‘হে রুদ্র আমার’ ব’লে; তাঁর স্বভাবে ভয়ংকর কঠোরতা ও জননী-সুলভ কোমলতা সমমাত্রায় বিদ্যমান। উপরন্তু এই লীলাময়ের বিচারালয় থেকে মানুষের ‘উগ্রতা ‘পরে’ কখন যে ‘জননীর স্নেহ-অশ্রু’র মতো তাঁর বিচার ঝরবে, কখন আবার ‘গর্জমান বজ্রাগ্নি-শিখা’র মতো, তা ঠাহর করা আমাদের মানুষী বিচারবুদ্ধি ও ন্যায়বোধের সাধ্যাতীত। বরঞ্চ আমাদের জ্ঞানবুদ্ধিমতো আমরা যখন জননীর স্নেহ প্রত্যাশা করি তাঁর কাছ থেকে, ঠিক তখনই বজ্রাগ্নি ঝরে; আর যেখানে মনে হয় দেবতার কঠোরতম শাস্তি সমুপযুক্ত সেখানেই তাঁর করুণা নেমে আসে।
তাদের আঘাত যবে প্রেমের সর্বাঙ্গে বাজে,
সহিতে সে পারি না যে;
অশ্রু-আঁখি
তোমারে কাদিয়া ডাকি,
খড়্গ ধরো, প্রেমিক আমার,
করো গো বিচার।
তার পরে দেখি এ কী,
কোথা তব বিচার-আগার।
জননীর স্নেহ-অশ্রু ঝরে
তাদের উগ্রতা-’পরে;
পক্ষান্তরে যারা মূঢ়, যারা কোনো দুর্বল মুহূর্তে প্রলুব্ধ হয়ে ‘সিঁধ কেটে করে চুরি তোমার ভাণ্ডার’, তারা আপন পাপের ভারে আপনিই ভেঙে পড়ছে। তাদের হয়ে কবি কেঁদে বলেন, ‘এদের মার্জনা করো, হে রুদ্র আমার’। কিন্তু রুদ্রের এ কী অদ্ভুত বিচার—
মার্জনা তোমার
গর্জমান বজ্রাগ্নিশিখায়,
সূর্যাস্তের প্রলয়লিখায়
রক্তের বর্ষণে,
অকস্মাৎ সংঘাতের ঘর্ষণে ঘর্ষণে।
দুঃখ ও দুঃখের দেবতা বিষয়ে সম্পূর্ণ নতুন উপলব্ধির ফলে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হ’ল সেই ভক্তিরসধারা যা নৈবেদ্য থেকে গীতালি পর্যন্ত উচ্ছল ছিল। শুভ ও সুন্দরের দিকে পিঠ ফেরালেন না রবীন্দ্রনাথ; বরঞ্চ শুভ ও সুন্দরের চেতনা তাঁর মনে আরও গভীর ও সুপরিণত হ’ল। তবে তাঁর চরম মূল্যবোধের স্থানাঙ্কদ্বয় (co−ordinates) গেল পালটে। এই নতুন কো-ওর্ডিনেট ফ্রেম্ সম্বন্ধে অবহিত না হলে রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কাব্যের রসগ্রহণ ব্যাহত হবে। এই পর্বে বিবৃতির প্রাধান্য যতটুকু ঘটেছে তা এইজন্য যে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বুঝতে চাইছেন, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া ক’রে নিতে চাইছেন; তাঁর বিশ্বনিরীক্ষায় যে-একটা বিপ্লব ঘ’টে গেছে সেটা মানতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে, সেটাকে ক্রমবিবর্তন ব’লেই দেখতে এবং দেখাতে চেষ্টা করছেন। পুরানো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নতুন রবীন্দ্রনাথের বোঝাপড়া কিন্তু শেষ অবধি খণ্ডিতই রয়ে গেল। সেই আংশিক ব্যর্থতা শেষ পর্বের কাব্যকে অভূতপূর্ব সার্থকতা দান করেছে। বোঝাপড়া সন্তোষজনক হলে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতেন দার্শনিক, কবিকর্ম হ’ত তাঁর পক্ষে গৌণকর্ম। রবীন্দ্রনাথের দর্শন শ্রদ্ধেয়, কিন্তু আরও অনেক ঊর্ধ্বে তাঁর দার্শনিক অপূর্ণতা- ও অতৃপ্তি- সম্ভূত গীতিকাব্যের স্থান।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন