৫. ক্ষণিকা ও নৈবেদ্য

আবু সয়ীদ আইয়ুব

নিষ্ক্রমণের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ খুঁজে পেলেন রবীন্দ্রনাথ; একটি পথ ‘ক্ষণিকা’; অন্য পথে কালিদাসের কাল পেরিয়ে তিনি চলে গেলেন বৈদিক ভারতবর্ষে, তাঁর ‘নৈবেদ্য’-রচনার ফুলগুলি সেখান থেকেই তুলে আনা।

‘ক্ষণিকা’ আমার মতে প্রাক্-’গীতাঞ্জলি’ পর্বের সবচেয়ে সার্থক রচনা। গুরুতম ভাবের সঙ্গে লঘুতম ভঙ্গির মিতালি ঘটানো সম্ভব হয়েছে এ বইখানিতে। ছন্দ ক্ষিপ্র ও অনায়াস, ভাষা ঘরোয়া ও অন্তরঙ্গ, ভাবের গাম্ভীর্যকে প্রায়ই মৃদু পরিহাসের পাতলা আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। সব যেন হালকা এবং সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু এই সহজকে পাওয়ার জন্য বিশ বছরের কঠিন কাব্য-তপস্যার প্রয়োজন ছিল, চল্লিশ বছর বয়সের পরিণত মনের অপেক্ষা ছিল। পূর্বের বিষাদ কেটে গেছে, তার বদলে পাই উদাস প্রফুল্লতা; নৈরাশ্যের বিক্ষোভ যেখানে তীব্র ছিল সেখানে দেখি বৈরাগ্যের মৃদু প্রশান্তি। ক্ষণিকার কবি অত্যন্ত আটপৌরে, নিকট প্রতিবেশের প্রতি একান্ত মনোযোগী, রক্তমাংসের মানুষের সঙ্গে, পল্লি প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। জীবনদেবতার মহানুভূতি থেকে আমাদের মন সরে এসেছে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটিতে, মানসসুন্দরীর সন্ধান থেকে ফিরে এসেছি সেই সব রূপে-গুণে নিরতিশয় সামান্যাদের কাছে যাদের নাম রঞ্জনা কি কৃষ্ণকলি, যাদের নিয়ে কাব্য করতে গেলেও ভাষা আপনিই নিরলংকার হয়, ভাব নিরুচ্ছ্বাস। ‘ক্ষণিকা’র অধিকাংশ কবিতার সুর চড়া নয়, আবেগকম্প্র কণ্ঠে আবৃত্তি করার উপযুক্ত নয় মোটেই। সাহস করে এখানে বলে ফেলাই ভালো যে পূর্ববর্তী কাব্যগুলির অতি-রোম্যান্টিকতার চড়া সুর এবং অলংকার-বাহুল্য (“উর্বশী” কবিতাটি তার সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ) আমাকে ঈষৎ পীড়া দেয়। ব্যতিক্রম অবশ্য ছিল, কিন্তু সংখ্যায় এত কম যে চারিত্র্যলক্ষণ-বিচারে তাদের ভূমিকা প্রান্তবর্তীই। ক্ষণিকাতে প্রকাশভঙ্গির আশ্চর্য পরিমিতি মনের পূর্ণ পরিণতিরই সাক্ষ্য বহন করে। লোকেন পালিতকে লিখিত উৎসর্গপত্রটি স্মরণীয়:

আশা করি নিদেন পক্ষে
ছ’টা মাস কি এক বছরই
হবে তোমার বিজন-বাসে
সিগারেটের সহচরী।
কতকটা তার ধোঁয়ার সঙ্গে
স্বপ্নলোকে উড়ে যাবে—
কতকটা কি অগ্নিকণায়
ক্ষণে ক্ষণে দীপ্তি পাবে?
কতকটা বা ছাইয়ের সঙ্গে
আপনি খ’সে পড়বে ধুলোয়,
তার পরে সে ঝেঁটিয়ে নিয়ে
বিদায় কোরো ভাঙা কুলোয়।

এই ব্যঙ্গরসিক আত্মসমালোচক দৃষ্টিভঙ্গি কবিকে অনেকটা নিরাসক্ত ও সমাহিত মনের অধিকারী করেছে। সে-মন তাঁকে বলছে— শাশ্বতীর সন্ধানে ক্ষণিকাকে অবহেলা করো না; আকাশ বড়ো দূরে, মাটির দিকে তাকিয়ে দেখো, সামান্যের মধ্যেই সুন্দরকে দেখতে পাবে, নিখুঁত নয় সে, তবু সে বহন করে এনেছে পরমের আশীর্বাদ। আরও বলছে— জীবনে দুঃখ তো থাকবেই, কিন্তু তা নিয়ে জীবন ভরে এবং কাব্য ভরে বিক্ষোভ বিলাপ আর বিদ্রোহও থাকবে, এমন তো কোনো কথা নেই। দুঃখের সঙ্গে যেন নতুন একরকম বোঝাপড়া করে নিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন কবি। ঐ “বোঝাপড়া” নামধারী কবিতাটিতেই তার চমৎকার ভাষ্য পাওয়া যায়:

অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে,
মুহূর্তেকে পাঁজোরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে—
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গে
ঝগড়া করে মরতে হবে?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো।
এটা কিছু অপূর্ব নয়,
ঘটনা সামান্য খুবই—
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ-ডুবি।

এই কথাগুলো নিজেকে খুব সহজে, ন্যায়সংগত ভাবেই বলা চলে। কিন্তু আর-একজনের জাহাজ-ডুবি হবার উপক্রম যখন তখন তাকে এ-হেন উপদেশ বাণী শোনাতে গেলে একটু নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেওয়া হবে না কি? অপরকেও এমন কথা বলা যায় হয়তো— দুই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। এক— যাকে ইংরেজিতে আইরনিক মুড বলা হয় ইদানীং। বাংলায় কী বলব? এই আইরনির মোদ্দা কথাটা হচ্ছে: নিয়তি বা বিধাতার বিধানে জীবন মোটের উপর দুঃখের— আছে এবং থাকবে। দুঃখ এড়াবার জন্য হাত-পা ছুঁড়ে কোনো লাভ নেই, অন্যকেও দুঃখ থেকে বাঁচাবার চেষ্টা বিফলই হবে— তার দিক থেকে; তোমার দিক থেকে তাতে একটু চিত্তশুদ্ধি ঘটতেও পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলকেই দুঃখের সঙ্গে ঘর-সংসার করতে শিখতে হবে, দুঃখকে আহার-নিদ্রার মতোই অত্যন্ত সহজ, তুচ্ছ, নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসগুলির অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। দুঃখ পাওয়াটা যেমন জীবনেরই নামান্তর, তা নিয়ে বিলাপ করাটা তেমনি বোকামির।

দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণটি বিশুদ্ধ নান্দনিক। শ্রেয়োনীতির বিচারে অবশ্য নিজের দুঃখকে ছোটো করে দেখা এবং অবহেলার বিষয় জ্ঞান করা যদিচ প্রশংসনীয়, অপরের দুঃখের প্রতি অমনোযোগ বা তাকে ব্যঙ্গ-কৌতুকের রসায়নে হালকা করে তোলাটা নিন্দার্হ। কিন্তু দার্শনিকের মতো শিল্পীও সুখদুঃখমাত্রকে— তা সে নিজেরই হোক আর অন্যেরই হোক— সম্পূর্ণ নিরাসক্ত নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে গ্রহণ করবেন, জীবনের যাবতীয় ঘটনাকে, দারুণতম দুর্ঘটনাকেও, বেশ একটু দূর থেকে এবং রঙে রেখায় ধ্বনিতে বাণীতে প্রতিবিম্বিত করে দেখবেন। শ্রেয়োনীতিতে আত্মপর ভেদ রয়েছে; আমি নিজের শরীর পাত করে, প্রাণ বিপন্ন করে, হিমালয়ের উত্তুঙ্গ শিখরারোহণ করতে পারি; কিন্তু পরের বেলা আমার সে অধিকার আদৌ নেই। আত্মবলিদান মহৎ কর্ম, অন্যকে বলিদান মহাপাপ। সমদৃষ্টি শিল্পী ও জ্ঞানীর অন্বিষ্ট, কর্মীর পক্ষে বিপজ্জনক।

অবশ্য শ্রেয়োনীতিক এবং নান্দনিক মানুষ পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়, একই মানবসত্তার এ-পিঠ ও-পিঠ। কিন্তু এই দুটো পিঠকে স্বতন্ত্র করে বোঝবার প্রয়োজন আছে জীবনে। দুটো পিঠকে গুলিয়ে ফেলাটাই আধুনিক সাহিত্যের মৌল ভ্রান্তি। রবীন্দ্রনাথ কবি এবং দুর্লভ প্রতিভাসম্পন্ন কবি। সেই রবীন্দ্রনাথ আবার অক্লান্ত কর্মীও বটে, এবং শ্রেয়োনীতিক চেতনা তাঁর অত্যন্ত প্রখর। সুতরাং শ্রেয়োনীতির সঙ্গে নন্দনতত্ত্বের যদি কোনো বিরোধ থাকে— আমার মতে এক জায়গায় বিরোধ আছেই— তবে তা রবীন্দ্রনাথ যেমন করে অনুভব করবেন, আর কোনো কবির তেমন করে অনুভব করার কথা নয়।

.

মানসীর বিষাদ ও নৈরাশ্য থেকে নিষ্ক্রমণের দ্বিতীয় পথ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গেল প্রাচীন ভারতবর্ষে এবং উপনিষদের ব্রহ্মবাদে— শঙ্করবেদান্তের মায়াবাদে নয়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দ্বারা ব্যাখ্যাত ব্যক্তিস্বরূপিত ব্রহ্মের ব্রাহ্ম-সামাজিক ধারণায় ও উপাসনায়। তারই উজ্জ্বল স্বাক্ষর ‘নৈবেদ্য’। ‘পরম পূজ্যপাদ পিতৃদেবের শ্রীচরণকমলে উৎসর্গ’ করা এই কাব্যগ্রন্থখানি কাব্য হিসেবে উজ্জ্বল নয়, তবে রবীন্দ্রনাথের আস্তিক্য, আস্থা, আশাবাদ এবং ঈশ্বরের মঙ্গলময় বিধানের উপর দ্বিধাহীন নির্ভরতার প্রকাশ রূপে প্রণিধানযোগ্য। মানসী-যুগের অবসান সূচিত হয় পরপর এবং খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে রচিত দুই কাব্যগ্রন্থে— ‘ক্ষণিকা’ ও নৈবেদ্যতে। অথচ কী বিপরীত তাদের ভাষা ও রচনাভঙ্গি, ভাব ও হৃদয়াবেগ, এবং কাব্যিক মূল্য। ‘ক্ষণিকা’ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ দু-চারখানি কাব্যগ্রন্থে গণ্য হবার যোগ্য; ‘নৈবেদ্য’ নিকৃষ্টতমের তালিকায় স্থান পাবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রমথনাথ বিশী নৈবেদ্যকে বলেছেন ‘আইডিয়া-প্রধান কাব্য’। বড়ো বেশি আইডিয়া-প্রধান, এত বেশি যে আইডিয়া আইডিয়াই রয়ে গেছে, সনেটের ঠাস-বুনোন শিল্পরূপ ধারণ করেও (অল্প দু-চারটি ব্যতিরেকে) ঠিক কবিতা হয়ে ওঠেনি। আইডিয়া প্রধানত তিনটি। (১) স্বদেশপ্রেম— যে-স্বদেশের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছিল বৈদিক যুগে এবং সে-যুগের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি বলে আজ আমাদের আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক দৈন্যদশা। (২) ঈশ্বরে ভক্তি— যে-ঈশ্বরকে রবীন্দ্রনাথ এখনও একান্ত আপন অন্তরের উপলব্ধিতে পাননি, লাভ করেছেন উপনিষদ পাঠে, ব্রাহ্মসমাজের মানসিক আবহাওয়ায়, পূজনীয় পিতৃদেবের কাছে আবাল্য শিক্ষায়। এবং (৩) সর্বমানুষের মঙ্গলচিন্তা।

রবীন্দ্রজীবনীকার লিখছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরবোধের প্রেরণা হইতেছে ব্রাহ্মধর্ম-গ্রন্থোধৃত উপনিষদ।’ এ-কথা ‘খেয়া’ বা গীতাঞ্জলির ঈশ্বরবোধ সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু ‘নৈবেদ্য’-এর ক্ষেত্রে খুবই সত্য। তিনি আরও বলছেন, ‘নৈবেদ্যের অনেকগুলি কবিতা আদি ব্রাহ্মসমাজীয় ধর্মমতবাদের প্রভাবে আচ্ছন্ন।’ এই কারণে নৈবেদ্যতে একপ্রকার ঐতিহ্যনির্ভরতা ও স্বাজাত্যাভিমানী গণ্ডিবদ্ধতা এসে পড়েছে যা সৎকাব্যে বেমানান। অনেকে নৈবেদ্য’কেও ‘খেয়া’-’গীতাঞ্জলির সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসান, কারণ দুটোতেই ভক্তিরসের স্বাদ পাওয়া যায়; অথচ প্রথমোক্ত গ্রন্থের ভক্তি-কবিতার সঙ্গে পরবর্তী ভক্তি-কবিতার প্রেরণা, প্রকৃতি ও প্রকর্ষের ভেদ অপরিমেয়। নৈবেদ্যতে অনেক স্মরণীয় বাণী আছে, অনেক প্রয়োজনীয় ধর্মদেশনা আছে, কিন্তু সত্যিকার কবিতা কটি? একটি সনেটের প্রথম স্তবকে উপনিষদের বিখ্যাত শ্লোকটি (‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে…’) অনুবাদ করে দিয়ে ষটকে কবি বলছেন:

আরবার এ ভারতে কে দিবে গো আনি
সে মহা আনন্দমন্ত্র, সে উদাত্তবাণী
সঞ্জীবনী, স্বর্গে মর্ত্যে সেই মৃত্যুঞ্জয়
পরম ঘোষণা, সেই একান্ত নির্ভয়
অনন্ত অমৃতবার্তা।
রে মৃত ভারত,
শুধু সেই এক আছে, নাহি অন্য পথ।

এটা ধর্মোপদেশ, কবিতা নয়। ঈশ্বরানুভূতি যে কত সুন্দর কবিতার উপজীব্য হতে পারে তা রবীন্দ্রনাথ নিজেই পরবর্তী কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে দেখিয়ে দিলেন।

‘নৈবেদ্য’-এর ঈশ্বর কবির অন্তরতম অনুভূতিতে বিরাজমান সেই ‘পরানসখা বন্ধু’ নন, যিনি ঝড়ের রাতে অভিসারের জন্য গহন অন্ধকারে নদী পার হয়ে আসছেন। তিনি সর্বমানুষের ঈশ্বর, জনগণের ভাগ্য-বিধাতা, বিশ্বচরাচর যাঁর মঙ্গলময় ইচ্ছার অধীন। সমাজবোধ ও সর্বজনকল্যাণ-চিন্তা ‘নৈবেদ্য’ রচনাকালে রবীন্দ্রনাথের মনে অতিশয় সজাগ ছিল। অথচ ঠিক ঐ সময়ে—

শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে
অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিণী
ভয়ংকরী।

বক্সার বিদ্রোহ দমনে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের নিষ্ঠুরতা এবং বোয়ার যুদ্ধের নৃশংসতা কবিকে খুবই বিচলিত করেছিল। বিচলিত করেছিল কিন্তু ঐশী বিধানে তাঁর নিটোল আস্থায় ফাটল ধরাতে পারেনি। তিনি ধরে নিলেন যে, পশ্চিমী সভ্যতার শক্তিমদমত্ততা এবং সংকীর্ণ জাতিপ্রেমরূপ পাপ এই দুঃখের কারণ। সুতরাং দুঃখকে আমাদেরই পাপের শাস্তি বলে গ্রহণ করতে হবে। ‘স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে’ হবেই, কারণ—

একের স্পর্ধারে কভু নাহি দেয় স্থান
দীর্ঘকাল নিখিলের বিরাট বিধান।

বিশ্বপালককে সম্বোধন করে কবি বলছেন:

তোমার নিখিলপ্লাবী আনন্দ-আলোক
হয়তো লুকায়ে আছে পূর্বসিন্ধুতীরে
বহু ধৈর্যে নম্র স্তব্ধ দুঃখের তিমিরে
সর্বরিক্ত অশ্রুসিক্ত দৈন্যের দীক্ষায়
দীর্ঘকাল, ব্রাহ্ম মুহূর্তের প্রতীক্ষায়।

ব্যক্তির ও সমাজের জীবনে অনেক আঘাত-সংঘাত, যন্ত্রণা ও মৃত্যু তো আসবেই, তারি মাঝখানে ‘সংশয়াতীত প্রত্যয়’ স্থির রাখতে হবে মনের মধ্যে— ঈশ্বরের করুণা থেকে তো শেষ পর্যন্ত আমরা বঞ্চিত হব না। তবে মিছে কেন আমরা ত্রস্ত-চিত্ত দীন-আত্মা হয়ে ‘মরিতেছি শত লক্ষ ডরে’—

যেন মোরা পিতৃহারা ধাই পথে পথে
অনীশ্বর অরাজক ভয়ার্ত জগতে।

এই যুগপরম্পরাগত আপ্তবাক্যনির্ভর পরাশ্রয়ী ধর্মচিন্তা রবীন্দ্রনাথের মতো অনন্যসাধারণ সৃজনী প্রতিভাকে বেশি দিন তৃপ্তি দিতে পারে না; দেয়ও নি। আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘যেখানে আমি স্পষ্টত ধর্মব্যাখ্যা করেছি সেখানে আমি নিজের অন্তরতম কথা নাও বলতে পারি, সেখানে বাইরের শোনা কথা নিয়ে ব্যবহার করা অসম্ভব নয়। সাহিত্য-রচনায় লেখকের প্রকৃতি নিজের অগোচরে নিজের পরিচয় দেয়, সেটা তাই অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ।’ ‘নৈবেদ্য’ ধর্মব্যাখ্যা নয়, কবিতাই। তবু তাতে কবি নিজের ‘অন্তরতম কথা’ বলেছেন বলে তো মনে হয় না। এবং ‘বাইরের শোনা কথা’য় যে তাঁর ভক্তিরসপিপাসা মেটেনি তার সাক্ষ্য ‘নৈবেদ্য’-এরই শেষ দিককার দু-একটি সনেটে পাওয়া যায়। ৮৬ নম্বর সনেটে জানতে পারি:

দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি, অতি দীর্ঘকাল,
হে ইন্দ্ৰ, হৃদয়ে মম। দিক্‌চক্রবাল
ভয়ংকর শূন্য হেরি, নাই কোনোখানে
সরস সজল রেখা—

পরবর্তী সনেটেও সেই একই বেদনা ব্যক্ত হয়েছে:

আমার এ মানসের কানন কাঙাল
শীর্ণ শুষ্ক বাহু মেলি বহু দীর্ঘকাল
আছে ক্রুদ্ধ ঊর্ধ্ব-পানে চাহি।

অপেক্ষা খুব বেশি দিন করতে হয়নি, ঊর্ধ্ব আকাশে (অথবা অন্তরের গভীর তলে) পৌঁছল কবির প্রার্থনা। চার বৎসর পরে প্রকাশিত খেয়ায় আনন্দবার্তা বিঘোষিত হলো:

এক রজনীর বরষনে শুধু
কেমন করে
আমার ঘরের সরোবর আজি
উঠেছে ভরে।

‘খেয়া’ থেকে ‘গীতালি’ পর্যন্ত এই ভরা সরোবরের কবিতা।

.

১. “শ্রেয়োনীতি ও সাহিত্যনীতি” অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

২. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়— রবীন্দ্রজীবনী, ২য় খণ্ড, পৃ ১২ ও ১৩

৩. করো মোরে সম্মানিত নববীরবেশে,
দুরূহ কর্তব্যভারে, দুঃসহ কঠোর
বেদনায়; পরাইয়া দাও অঙ্গে মোর
ক্ষতচিহ্ন-অলংকার। ধন্য করো দাসে
সফল চেষ্টায় আর নিষ্ফল প্রয়াসে।
ভাবের ললিত ক্রোড়ে না রাখি নিলীন
কর্মক্ষেত্রে করি দাও সক্ষম স্বাধীন। (৪৭ সংখ্যক সনেট)

৪. রবীন্দ্র-রচনাবলী, দশম খণ্ড, পৃ ২০১।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন