৩. মানসী ও সোনার তরী

আবু সয়ীদ আইয়ুব

মানসীই রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্রথম কাব্যগ্রন্থ যাতে ‘কবির সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিল’। ভাবের কুয়াশা কেটে গেছে, ভাষার পেশী শক্ত হয়েছে, হৃদয়াবেগ ঈষৎ সংযত, প্রকাশে অতি-বিস্তার নেই— যদিও পরিণত বয়সের সংহতি এখনও অনাায়ত্ত। তিন বছর ধরে লেখা কবিতা এ-বইখানিতে স্থান পেয়েছে, তাই ভাববৈচিত্র্য এখানে অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের চেয়ে বেশি। মোটামুটি বলা যায় তিন প্রকার ভাবধারা বয়ে চলেছে তিন রকমের বিষয়কে অবলম্বন করে— প্রকৃতি, নারী ও স্বদেশ। প্রেমের কবিতাই মানসীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ, কিন্তু প্রথমোক্ত বিষয়বস্তুটিকে উপলক্ষ্য করে রচিত কবিতাগুচ্ছ— “নিষ্ঠুর সৃষ্টি”, “প্রকৃতির প্রতি”, “সিন্ধুতরঙ্গ”, “শূন্য গৃহে”, “জীবন-মধ্যাহ্ন” প্রভৃতি— এই বইকে অন্য দিক থেকে বিশিষ্টতা দান করেছে। এগুলি রবীন্দ্রকাব্যের ব্যতিক্রম¹ নয়, একটি স্বতন্ত্র ধারা। প্রভাতসংগীত থেকে, অর্থাৎ বলতে গেলে কাব্যরচনার সূত্রপাত থেকেই, এ-ধারার শুরু। এবং শেষ পর্বের কবিতায় তো এই ‘ব্যতিক্রম’ নিয়মকে সংখ্যায় না হলেও অনুভূতির প্রবলতায় ছাড়িয়ে গেছে প্রায়।

“নিষ্ঠুর সৃষ্টি” এবং “শূন্য গৃহে” একই ভাবের কবিতা, প্রকাশের রীতি ভিন্ন। প্রথম কবিতাটিতে সৃষ্টিকে বলেছেন খামখেয়ালী, উৎশৃঙ্খল :

মনে হয় সৃষ্টি বুঝি বাঁধা নাই নিয়মনিগড়ে
আনাগোনা মেলামেশা সবই অন্ধ দৈবের ঘটনা

আর দ্বিতীয় কবিতার নালিশ বিশ্বের লৌহকঠিন নির্মম নিয়মের বিরুদ্ধেই :

জীবন নির্ভরহারা ধুলায় লুটায়ে সারা
সেথাও কেন গো তব কঠিন নিয়ম।
… … …
সমস্ত মানবপ্রাণ বেদনায় কম্পমান
নিয়মের লৌহবক্ষে বাজিবে না ব্যথা!

কিন্তু দুটি কবিতার মূল বক্তব্য একই— সৃষ্টি নিষ্ঠুর, অসহায় মানুষের পক্ষে যন্ত্রণাই সার, প্রকৃতি বা প্রকৃতির স্রষ্টার বুকে দয়ামায়া সমবেদনার লেশমাত্র নেই। প্রথম কবিতাটির সবচেয়ে জোরালো উক্তি— ‘আপন গর্জনে বিশ্ব আপনারে করিছে বধির’— দ্বিতীয় কবিতাটিতেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে :

এ আর্তস্বরের কাছে রহিবে অটুট
চৌদিকের চিরনীরবতা?

“সিন্ধুতরঙ্গে”র নাস্তিকতা আরও বেদনা-বিক্ষুব্ধ। কবিতাটি এক নিদারুণ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে লেখা। বঙ্গোপসাগরে দুইখানি পুরী-তীর্থযাত্রী স্টিমার প্রবল ঝড়ে পড়ে ডুবে যাওয়াতে নারীপুরুষ, শিশুবৃদ্ধ বহু লোকের প্রাণনাশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথের মন যদি ‘তিক্ত’ হয়েই থাকে, তবে সাড়ে-সাত শ’ তীর্থযাত্রীর অসহায় মৃত্যু কি তার যথোপযুক্ত কারণ নয়? তাঁর সংবেদনশীল মনে এই দুর্ঘটনার অভিঘাত অত্যন্ত প্রবল হয়েছিল, সমস্ত ঐশী বিধিবিধানের বিরুদ্ধে তিনি যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। এমন স্পষ্ট ঈশ্বর-বিদ্রোহের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ইতিপূর্বে কখনো লেখেননি :

নাই তুমি, ভগবান,    নাই দয়া, নাই প্রাণ—
জড়ের বিলাস।

শেষ স্তবকে শুধরে নিয়ে বলছেন, দয়া যে একেবারে নেই তা নয়, যদি না থাকত তবে ‘এমন জড়ের কোলে’ নির্ভয়ে নিখিল মানব কেমন করে বাঁচত? দয়ামায়া অবশ্যই আছে, কিন্তু তার মাঝখানে ক্ষণে-ক্ষণে দৈবের দারুণ আঘাতও এসে পড়ে :

পাশাপাশি একঠাঁই      দয়া আছে, দয়া নাই—
বিষম সংশয়।
… … …
জড় দৈত্য শক্তি হানে, মিনতি নাহিক মানে—
প্রেম এসে কোলে টানে, দূর করে ভয়।
একি দুই দেবতার        দ্যুতখেলা অনিবার
ভাঙাগড়াময়?
চিরদিন অন্তহীন জয়পরাজয়?

কল্পিত শুভ ও অশুভ দুই দেবতার নিত্য সংগ্রামের উপমার দ্বারা যে-ট্র্যাজিক উপলব্ধিটি ব্যক্ত হয়েছে তা রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কাব্যে আরো লক্ষণীয়, যেমন লক্ষণীয় মধ্যবর্তী ভক্তিপর্বের কাব্যে তার তিরোভাব।

রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন মানসীর প্রেমের কবিতার মধ্যে ঈশ্বরের জন্ম-কথা লেখা আছে— ‘মানসীতে যাকে খাড়া করেছি সে মানসেই আছে— সে আর্টিস্টের হাতে রচিত ঈশ্বরের প্রথম অসম্পূর্ণ প্রতিমা। ক্রমে শেষ হবে কি?’ শেষ হবার ইতিহাস আমরা পাব নৈবেদ্য, উৎসর্গখেয়ায়। অসম্পূর্ণ প্রতিমাটিও ধীরে-ধীরে পর্যায়ক্রমে তৈরি হয়েছিল মানসীতে। ঐ বইখানির প্রেমের কবিতাগুলিতে অতৃপ্তি, বিষাদ ও নৈরাশ্যের ঘন ছায়া পড়েছে এটা কারও দৃষ্টি এড়াতে পারে না; সে-ছায়া সর্বপ্রথম লক্ষ্য করেন বিশ বছরের প্রমথ চৌধুরী, মানসী প্রকাশের অব্যবহিত পরেই। অতৃপ্তি ও বিষাদের ‘মূলটা কোনখানে’ প্রমথ চৌধুরীর পত্রোত্তরে এ-প্রশ্ন কবি নিজেই তুলে তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। উত্তরটা এইরূপ: ‘এক-একবার আমার মনে হয় আমার মধ্যে দুটো বিপরীত শক্তির দ্বন্দ্ব চলছে। একটা আমাকে সর্বদা বিশ্রাম এবং পরিসমাপ্তির দিকে টানছে, আর-একটা আমাকে কিছুতে বিশ্রাম করতে দিচ্ছে না। আমার ভারতবর্ষীয় শান্ত প্রকৃতিকে য়ুরোপের চাঞ্চল্য সর্বদা আঘাত করছে… একদিকে কর্মের প্রতি আসক্তি, আর-একদিকে চিন্তার প্রতি আকর্ষণ। সবশুদ্ধ জড়িয়ে একটা নিষ্ফলতা এবং ঔদাসীন্য।’ ভাবুক-সত্তা ও কর্মী-সত্তার অন্তর্বিরোধ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অবশ্যই ছিল, কখনো এক পক্ষের সাময়িক বা আপেক্ষিক প্রাধান্য দেখা যায়, কখনো অন্য পক্ষের; কোনো পক্ষই চূড়ান্ত পরাভব স্বীকার করেনি শেষ পর্যন্ত। এ দুই পরস্পরস্পর্ধী সত্তার স্বাক্ষর রবীন্দ্রকাব্যে ছড়ানো রয়েছে, তার পরিচয় আমরা পাবো “শ্রেয়োনীতি ও সাহিত্যনীতি” শীর্ষক অধ্যায়ে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বই যে মানসীর প্রেমের কবিতাগুলির নৈরাশ্য ও বিষাদের মূল কারণ তা আমার মনে হয় না। অন্য পথে সে-কারণের সন্ধান করতে হবে আমাদের।

কবি-প্রেমিক তাঁর প্রেয়সীতে দুটি গভীরতর সত্যের সন্ধান করছেন। প্রথমত, তিনি খুঁজছেন সমগ্র মানুষটিকে, অথবা আরো একটু বিশ্লেষণ করে বলা যায়, শারীরিক রূপলাবণ্যে অতৃপ্ত হয়ে তিনি খুঁজছেন শরীরের অন্তরালে যে-আধ্যাত্মিক সত্তা লুকানো আছে, যে-‘আত্মার রহস্য-শিখা’ কাঁপছে, তাকে। এ-সন্ধান, এ-ক্রন্দন, বৃথাই হবে তা তিনি জানেন। কিন্তু এই ব্যর্থতা কি কোনো নিরুদ্দেশ যাত্রার অনন্ত পথ খুলে দিতে পারবে? হয়তো পারবে। তার ক্ষীণ আভাস পাই আমরা “নিষ্ফল কামনা” নামক সুপরিচিত কবিতাটিতে— যদিও যে-ব্যর্থ সন্ধানের বেদনা কবি সেখানে প্রকাশ করতে চেয়েছেন তা কতকটা চাপা পড়ে গেছে উপদেশ বাণীর অযথা ভারে। দ্বিতীয়ত, কবি-প্রেমিক সন্ধান করছেন তাঁর প্রেয়সীর মধ্যে এমন এক পরিপূর্ণ সৌন্দর্য যা তার মানবিক সত্তাকে ছাপিয়ে বহুদূর প্রসারিত, দেশ-কালের সীমানাকেও যেন ছাড়িয়ে। বাস্তব প্রিয়া যেন মানসী প্রিয়ার অর্ধস্ফুট রেখাচিত্র। একটি সুন্দর শরীরের মধ্যে আত্মার কম্পমান দীপশিখা শুধু নয়, প্রেমিক খোঁজে একটি মূর্ত ব্যক্তি-স্বরূপের যবনিকার অন্তরালে যে-বিমূর্ত অখণ্ড অনন্ত সুন্দরের আভাস মাঝে-মাঝে তার চোখে ঝলকে ওঠে, তাকেই। এ-খোঁজার কোনো শেষ নেই, এ-যাত্রার কোনো পথ জানা নেই তার, তবু—

অকূল সাগর মাঝে চলেছে ভাসিয়া
জীবন-তরণী। ধীরে লাগিছে আসিয়া
তোমার বাতাস।

প্রেমিক তার মানুষী প্রিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গভীর ব্যথা ও অসম্ভব আশা বুকে ধারণ করে বেরিয়ে পড়ছে তার মানসীর সন্ধানে। ‘সংসারের খেলাঘরে’ যে-খণ্ডিতাকে ছেড়ে এল আর ‘সর্বপ্রান্ত দেশের’ও পরপারের যে-পূর্ণার দিকে সে ‘নিরুদ্দেশ-মাঝে’ ভেসে চলেছে, এ-দুজনের বিপরীতমুখী টানে তার বক্ষ বিদীর্ণ। মানসীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা “বিদায়ে” এই ব্যথার প্রকাশ আশ্চর্য সুন্দর। কবিতাটি অবশ্য মানুষী প্রিয়াকেই সম্বোধন করে লেখা, এবং আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, কবির মনে মানসীকে পাওয়ার ব্যাকুলতা যতখানি তার চেয়ে এই গৃহকর্মরতা রক্তমাংসের মানুষটিকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা অনেক বেশি গভীর:

অবশেষে যবে একদিন,
বহুদিন পরে, তোমার জগৎ-মাঝে
সন্ধ্যা দেখা দিবে— দীর্ঘ জীবনের কাজে
প্রমোদের কোলাহলে শ্রান্ত হবে প্রাণ,
মিলায়ে আসিবে ধীরে স্বপনসমান
চিররৌদ্রদগ্ধ এই কঠিন সংসার,
সেই দিন এইখানে আসিয়ো আবার।
এই তটপ্রান্তে ব’সে শ্রান্ত দু নয়ানে
চেয়ে দেখো ওই অস্ত-অচলের পানে
সন্ধ্যার তিমিরে, যেথা সাগরের কোলে
আকাশ মিশায়ে গেছে। দেখিবে তা হলে
আমার সে বিদায়ের শেষ চেয়ে-দেখা
এইখানে রেখে গেছে জ্যোতির্ময় রেখা।
সে অমর অশ্রুবিন্দু সন্ধ্যা-তারকার
বিষণ্ণ আকার ধরি উদিবে তোমার
নিদ্রাতুর আঁখি-পরে; সারা রাত্রি ধ’রে
তোমার সে জনহীন বিশ্রামশিয়রে
একাকী জাগিয়া রবে। হয়তো স্বপনে
ধীরে ধীরে এনে দেবে তোমার স্মরণে
জীবনের প্রভাতের দু-একটি কথা।
এক ধারে সাগরের চির চঞ্চলতা
তুলিবে অস্ফুট ধ্বনি— রহস্য অপার—
অন্য ধারে ঘুমাইবে সমস্ত সংসার।

মানসীর বিষাদ ও নৈরাশ্য সোনার তরীতে আরও ঘন হয়েছে। পূর্ববর্তী কাব্যগ্রন্থের বিষয়গুলির এখানে পুনরাবৃত্তি দেখা যায়, তবে মানুষের— সাধারণ মানুষের— আরও কাছাকাছি এসেছেন কবি। সেই সঙ্গে কিন্তু নিরুদ্দেশের জন্য মন আরও চঞ্চল ও ব্যাকুল। অবিরাম তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতোই ‘অলক্ষ্য সুদূর-তরে’ অজানা বেদনা ও প্রত্যাশা কবির হৃদয়কে এবং সমস্ত পৃথিবীর হৃদয়কে অশান্ত করে রেখেছে:

হে জলধি, বুঝিবে কি তুমি
আমার মানব ভাষা। জানো কি, তোমার ধরাভূমি
পীড়ায় পীড়িত আজি ফিরিতেছে এপাশ ওপাশ,
চক্ষে বহে অশ্রুধারা, ঘন ঘন বহে উষ্ণ শ্বাস।
নাহি জানে কী যে চায়, নাহি জানে কিসে ঘুচে তৃষা
আপনার মনোমাঝে আপনি সে হারায়েছে দিশা
বিকারের মরীচিকা-জালে।

(“সমুদ্রের প্রতি”)

আদি জননী সিন্ধুর কাছ থেকে যখন ব্যথিতা কন্যা বসুন্ধরা ‘সান্ত্বনার বাক্য অভিনব’ শুনতে চাইল, তখন কবি ভাবতে পারলেন না চিরপুরাতন বাক্য ‘ঘুমা, ঘুমা, ঘুমা’ ছাড়া আর কী বলা সিন্ধুর পক্ষে সম্ভব— নিরুপায় মাতা যেমন অত্যন্ত পীড়িত সন্তানকে কেবল ঘুম পাড়িয়ে শান্ত করতে চায়। এটি কবিতার দুর্বল উপসংহার নয়, কবি তখনও জানেন না দুঃখিনী বসুন্ধরাকে কোন্ ভাষায় সান্ত্বনা দেওয়া যায়। গীতাঞ্জলির ভগবান তখনও অনুপলব্ধ।

‘পীড়ায় পীড়িত… বিকারের মরীচিকা-জালে’ দিশাহারা ধরাভূমি থেকে পলায়নী-ভাবানুপ্রাণিত কবিতা “মানস-সুন্দরী”। খুব উঁচুদরের কবিতা না হলেও রবীন্দ্রমানসে ঈশ্বরচেতনার বিকাশ বুঝতে হলে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। যাঁকে সম্বোধন করে লেখা তিনি স্বয়ং কাব্যলক্ষ্মী, ‘আজন্ম-সাধন-ধন সুন্দরী আমার কবিতা’, কিন্তু ‘কবিতা’ অনিবার্যত, প্রায় অলক্ষ্যত, ইহলোকের এবং লোকোত্তর সৌন্দর্যের ও সুরসংগতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। মানস-সুন্দরী যদিও নারীরূপে, ‘প্রণয়-বিধুরা সীমন্তিনী’ রূপে কল্পিত, তবু প্রকৃতপক্ষে তা নিরাকার এবং নিঃসীম। তবে একে পরোৎকর্ষের (ইংরেজি পার্ফেকশান-এর) কল্পরূপ বললে ঠিক বলা হবে না, কারণ শ্রেয়ের আদর্শ এখানে স্পষ্টরূপে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কবি এখানে সেই সৌন্দর্যের পূর্ণতাকেই খুঁজছেন নারীর দেহমনের লীলায়, প্রকৃতির বর্ণগন্ধের বৈভবে যা অর্ধস্ফুট; মহত্ত্বের সে-পরমতার কথা ভাবছেন না বীরের কঠিন তপস্যায় ও মৃত্যুবরণে যা আংশিক অভিব্যক্ত।

সোনার তরীর সবচেয়ে প্রখ্যাত ও আলোচিত কবিতা যদিচ প্রথম কবিতাটিই, সবচেয়ে স্মরণীয় এবং আমার মতে সবচেয়ে রসোত্তীর্ণ কবিতা— “নিরুদ্দেশ যাত্রা”— স্থান পেয়েছে একেবারে শেষে। পরবর্তী মরমিয়া পর্বের— খেয়া-গীতাঞ্জলি পর্বের—ছোঁয়া লেগেছে এই কবিতায়, তবু ভক্তিরস এখনো অনুৎসারিত, ঈশ্বরের পদধ্বনি এখনো স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। যিনি এসেছেন তিনি মানস-সুন্দরীই, তবে তিনি খুব কাছে এসে পৌঁছেছেন এবং কবির সোনার তরীর হাল ধরে বসেছেন। “মানস-সুন্দরী” নামক কবিতাটিতে যদিও তাঁকে অতি মধুর অন্তরঙ্গ সম্বোধনে ডাকা হয়েছিল (‘প্রথম প্রেয়সী’ ‘সীমন্তিনী’ ইত্যাদি) তবু তিনি ছিলেন অনেক দূরে, অধরা, অমর্ত্যবাসিনী। আর “নিরুদ্দেশ যাত্রা”য় তিনি মুখোমুখি সমাসীনা, তবু তিনি ‘অপরিচিতা’, ‘বিদেশিনী’, কোনো কথা না বলে শুধু হাসেন, শুধু অঙ্গুলি দিয়ে দেখিয়ে দেন যে-দিকে ‘অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি’। রাত্রির ছায়ায় রহস্যের বাতাবরণ আরও নিবিড় হয়ে উঠছে, মনে হয় দুর্ভেদ্য অন্ধকারে সমুদ্রের মাঝখানে মস্ত কিছু ঘটবে, হয়তো সেই অপরিচিতা হাত বাড়িয়ে ‘পরশ’ করবেন; অবশ্য এমনও হতে পারে যে ঘনান্ধকারে তাঁর নীরব হাসিটুকুও অদৃশ্য হয়ে যাবে। যখন কিছুই দেখা যাবে না তখন অকূল সিন্ধুর উত্তাল তরঙ্গে সোনার তরী ডুবে যেতেও তো পারে? সে-আশঙ্কা কিন্তু কবিকে বিচলিত করছে না। যাত্রা নিরুদ্দেশ, কর্ণধার অপরিচয়ের রহস্যে ঢাকা, তবু তাঁর নৌকা সাগর পাড়ি দেবে, অনেক ঝড়-তুফান আলো-অন্ধকারের মাঝখান দিয়ে কোনো-এক অজানা তীরে গিয়ে ভিড়বে। সেই তীরে কি মহত্তর কোনো সত্তার সুস্পষ্ট পথচিহ্ন দেখিয়ে দেবেন মানস-সুন্দরী? আশা আছে বুকভরা, কিন্তু চারিদিকে

সংশয়ময় ঘন নীল নীর
কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন।

জগৎজোড়া কান্না এখনও তাঁর কানে বাজছে। এ-কান্নার কি কোনো শেষ আছে? অন্য একটি সনেটে সে-প্রশ্ন তুলেছেন কবি, উত্তর খুঁজে পাননি:

জানি না, কী হবে পরে, সবি অন্ধকার
আদি অস্ত এ সংসারে— নিখিল দুঃখের
অন্ত আছে কি না আছে, সুখ-বুভুক্ষের
মিটে কি না চির-আশা। (“গতি”)

বিশ্বব্যাপারের কল্যাণস্বরূপ কর্তায় যার দৃঢ় প্রত্যয়, যিনি জীবনের শুভত্ব বিষয়ে সর্বদা নিঃসংশয়, এই সনেটের রচয়িতা সে-রবীন্দ্রনাথ নন।

.

ফুটনোট

১. বুদ্ধদেব বসু— প্রবন্ধ-সংকলন (ভারবি), পৃ ৬ ‘His verse changed externally, as it had many times before, but neither in his attitude to life nor in the use of language did he outgrow himself.’-Buddhadeva Bose- Tagore, Portrait of a poet, (University of Bombay, 1962) p. 25

২. নাই, নাই, কিছু নাই শুধু অন্বেষণ—
নীলিমা লইতে চাই আকাশ ছানিয়া,
কাছে গেলে রূপ কোথা করে পলায়ন,
দেহ শুধু হাতে আসে— শ্রান্ত করে হিয়া। (“হৃদয়ের ধন”)

৩. প্রমথনাথ বিশী— রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ, ১ম খণ্ড পৃ ৭১

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন