সংযোজনা : গীতাঞ্জলি বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত সমস্যা

আবু সয়ীদ আইয়ুব

“We read fine things, but never feel them to the full
until we have gone the same steps as the author.” —Keats (Letters)

গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি (যা ভাবের গভীর ঐক্যে একই কাব্যগ্রন্থ, তার তিন খণ্ডের তিনটে স্বতন্ত্র নাম আলোচনার পক্ষে অসুবিধাজনক; অতঃপর বর্তমান লেখাতে সাধারণভাবে গীতাঞ্জলি বলতে গীতাখ্য তিনখানা বই-ই বোঝাবে) স্পষ্টতই ঈশ্বরপ্রেমের কবিতা বা গান। এর অধিকাংশ গান শুনে আমি মুগ্ধ হই, এমনকি সুর বাদ দিয়ে শুধু কবিতারূপে পাঠ করলেও আমার মন গভীরভাবে সাড়া দেয়। প্রেমের অভিজ্ঞতা আমার নেই, এমন কথা বলব না। কিন্তু ঈশ্বর-বিষয়ক যে-কোনো প্রকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি বঞ্চিত। শব্দ (authority) প্রমাণ হিসেবে আমার কাছে একেবারে অগ্রাহ্য, শুধু অগ্রাহ্য নয়, অশ্রদ্ধেয়। এবং দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তার পথে-বিপথে যত এগিয়েছি, ঈশ্বরে বিশ্বাস আমার ততই ক্ষীণ হয়েছে; অবশেষে আজ প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে পৌঁছে বাল্যকালের পরম আশ্রয়দাতা, পরম কল্যাণময়, অনন্ত শক্তিধর, সকল দুঃখতাপহর কোনো বিশ্ববিধানকর্তাকে তো আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ যে ব্যক্তিস্বরূপ ঈশ্বরকে গ্রহণ করতে আমার মনের প্রতিটি কক্ষে প্রবল প্রতিরোধ জানায়, সেই ঈশ্বর-প্রেমে আদ্যোপান্ত অনুরঞ্জিত কাব্যে ___ হৃদয়ে স্থান দিতে একটুও বাধে না।

কেন বাধে না, এ-প্রশ্ন আমাকে তরুণ বয়স থেকে ভাবিয়েছে। একটু ব্যক্তিগত ইতিহাস বলি এখানে। গীতাঞ্জলি আমি প্রথম পাঠ করি উর্দু ভাষায়—তখনো বাংলা পড়তে বা বলতে শিখিনি। ইংরেজি গীতাঞ্জলির চমৎকার অনুবাদ করেছিলেন নেয়াজ ফতহপুরী; যতদূর জানি ঐ অনুবাদ থেকেই উর্দু গদ্য-কবিতার (নসর-শায়েরীর) সূত্রপাত। ‘কহ্‌কাশান’ নামক মাসিকের পাদ-পূরণ-রূপে ব্যবহৃত এই গদ্য-কবিতাগুলি পড়তে পড়তে চোখে জল আসত যে অতিশয় আনাড়ি কিন্তু নিঃসন্দেহে আন্তরিক পাঠকের, তার বয়স তেরো, সে তখন মনেপ্রাণে ঈশ্বরে বিশ্বাসী, পরকালের ভয়ে পুণ্যকর্মে যত্নশীল, পাপবোধে ঈষৎ পীড়িত। বছর তিনেক পর অপেক্ষাকৃত পরিণত রুচি ও বুদ্ধি নিয়ে ইংরেজি গীতাঞ্জলি পড়লাম। পড়ে আরও মুগ্ধ হলাম, কতবার যে আবেগকম্প কণ্ঠে আবৃত্তি করলাম তার ইয়ত্তা নেই। স্মরণ-শক্তি নিতান্ত ভোঁতা না হলে আজও তার অধিকাংশ কবিতা মুখস্থ থাকত। কিন্তু ততদিনে আমি বার্ট্রান্ড রাসেল প্রভৃতির পাঁচ-সাতখানা গণপাঠ্য দার্শনিক পুস্তক হস্তগত করে হয়ে উঠেছি ঘোরতর নাস্তিক, এমনকি নাস্তিক্যপ্রচারের মিশনারি উৎসাহ নিয়ে বড়োদের সঙ্গে তর্ক করতে সর্বদা উদ্যত! সহিষ্ণুরা সক্ষোভে ক্ষমা করেছিলেন; অসহিষ্ণুদের কাছে প্রচণ্ড ধমক খেয়েছিলাম যতবার, ধর্মবিশ্বাসের অসারতা বিষয়ে আমার প্রত্যয় ততবার নতুন ক’রে বল পেয়েছিল।

ইংরেজি গীতাঞ্জলি পাঠ করে একটি সংকল্প এবং একটি প্রশ্ন মনে দানা বাঁধল। সংকল্পটি মূল বাংলা ভাষায় গীতাঞ্জলি পড়বার। সুতরাং বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় আর মিন্ সাহেবের ইংরেজি ভাষায় লিখিত বাংলা ব্যাকরণ জোগাড় করে লেগে গেলাম সেই ভাষার চর্চায় যে-ভাষা আজ আমার মাতৃভাষার চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়। প্রশ্নটি হলো—যে-ঈশ্বরকে আমি কায়মনোবাক্যে অলীক বলে জানি, সেই ঈশ্বরভাবে ভরপুর কাব্যে মন কেন সাড়া দেয়? আমি পেশাদারী নিস্তাপ সাহিত্যিক বিচার বা ঐতিহাসিক মূল্যায়নের কথা বলছি না যার দৌলতে আমরা দুর্লঙ্ঘতম মানসিক ও হার্দিক ব্যবধান অনায়াসে পার হয়ে দূরতম যুগ, সংস্কৃতি ও মেজাজের শিল্পসৃষ্টি সম্বন্ধে পণ্ডিতী রায়দান করে থাকি। আমি বলছি কাব্যের সেই সংরক্ত আবেদনের কথা যাতে সমস্ত মন-প্রাণ মুচড়ে ওঠে। প্রশ্নের কোনো উত্তর পাইনি সেদিন; আজও তার উত্তর খুঁজছি। কিছুক্ষণের জন্য পাঠককেও সেই খোঁজার শরিক করে নিতে চাই।

একটি উত্তর সহজেই মনে আসে। গীতাঞ্জলিতে তো ঈশ্বর-বিষয়ক কোনো মত, তত্ত্ব বা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হচ্ছে না, ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে একজন কবির একটি বা একাধিক অনুভূতি মাত্র ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই কবি এবং পাঠকের মধ্যে মত-বিশ্বাসের পার্থক্য যত গভীর ও মৌলিক হোক অনুভূতির প্রকাশ যদি সুন্দর হয়ে থাকে তবে যে-কোনো সহৃদয় পাঠকের মন তাতে সাড়া দিতে পারবে না কেন? অনুভূতির প্রকাশ অবশ্য সার্থক হওয়া চাই। মা যখন পুত্রশোকে কাঁদে তখন সে-ও তার তীব্র বেদনা প্রকাশ করে। তবু তা কবিতা নয়, কারণ মায়ের হৃদয়াবেগ নিঃসন্দিগ্ধরূপে ব্যক্ত হয় বটে কিন্তু সুস্পষ্টরূপে হয় না; মা নিজেই নিজের অনুভূতির রূপরেখা, বর্ণালি ও গভীরতা ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারে না। কবি পারেন। দ্বিতীয়ত, কবি কলাকৌশল দ্বারা তাঁর অনুভূতির সত্যরূপ পাঠকের চিত্তে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম। শোকার্ত মায়ের কান্না শ্রোতার মনে যে-অনুভূতি জাগায় তা শোক-জাতীয় কিছু নয়, একেবারে ভিন্ন পর্যায়ের অনুভূতি—করুণা বা দরদ। মোটকথা সুস্পষ্ট অনুভূতির সুদক্ষ প্রকাশই কবিতা। অন্য সব প্রশ্ন এখানে অবান্তর।

কিন্তু অনুভূতি-বহির্ভূত আর সব প্রশ্নই কি অবান্তর? আমরা ভুলে যাই যে আমাদের অনুভূতিগুলি একান্ত নিরালম্ব স্বাশ্রয়ী স্বয়ংসম্পূর্ণ মনোব্যাপার নয়। এরা বাস্তব জগতের কোনো অবস্থার বা ঘটনার (অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ, নিকটস্থ বা দূরবর্তী) উপলব্ধি নামক একটি পূর্ণাঙ্গ মানসিক প্রতিক্রিয়ার প্রত্যঙ্গ-বিশেষ; প্রত্যঙ্গ না বলে বলা উচিত তারই অনুরঞ্জন কিংবা অনুরণন। কাজেই কবিকে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করার জন্যে অনুভূতির বাহ্য উৎস বিষয়েও পাঠককে প্রয়োজনমতো অবহিত করতে হয়। কবি তাঁর হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করেন উতলা মায়ের মতো হাত-পা ছুঁড়ে বা উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করে নয়, বাস্তব বা বাস্তব প্রতিম কোনো-কিছুর যথোপযুক্ত বর্ণনার মাধ্যমেই। ‘অবজেকটিভ কোরেলেটিভ’-এর কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, আমি তারই কথা বলছি এখানে।

কবিতায় প্রকাশিত অনুভূতি নিরালম্ব নয়, বিষয়-নির্ভর—এটা অস্বীকার করবার জো নেই। কিন্তু সে-বিষয় বাস্তবিক না হয়ে কাল্পনিক হলেও কবিকর্ম বেশ সুষ্ঠুভাবেই এগুতে পারে। আর কাব্যানুভূতির অধিষ্ঠান যদি কল্পলোকেই হয় তবে তাতে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সে-বিশ্বাসের সঙ্গে পাঠকের বিশ্বাসের ভেদাভেদ নিয়ে তো কোনো সমস্যা উঠতে পারে না। তা কিন্তু নয়। এখানে অনুভূতি-প্রকাশের বাহ্য প্রতীক এবং অনুভূতির বাহ্য বিষয়—এ-দুটিকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। প্রথমটি কাল্পনিক হতে কোনো বাধা নেই। প্রেমভাব-প্রকাশের অবজেকটিভ কোরেলেটিভ হতে পারে কোনো কাল্পনিক গভীর বন বা সুরম্য অট্টালিকা। কিন্তু প্রেমাস্পদ রক্তমাংসের মানুষ ছাড়া আর কী হতে পারে? যে-কবি কখনো সত্যিকার প্রেমে পড়েননি, শুধু প্রেমের কবিতা বা উপন্যাস পড়েই প্রেমের কথা জেনেছেন এবং সে-বিষয়ে একটি কাল্পনিক ভাবাবেগ গড়ে তুলেছেন, প্রেমরস কি তাঁর কাব্যে সত্য হয়ে উঠতে পারে? এবং যে-পাঠক প্রেমের অভিজ্ঞতা থেকে একেবারেই বঞ্চিত, তার পক্ষে কি প্রেমের কবিতার সম্যক রসোপলব্ধি সম্ভব? অর্থাৎ রোম্যান্টিক প্রেম যার কল্পনাতেই আছে, হৃদয়ে অনুপস্থিত এবং প্রতিরুদ্ধ, সে কি কীটস্, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ইয়েট্স কিংবা রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতাপাঠে অধিকারী? তেমনি এ-প্রশ্নও কি ওঠে না যে, ভক্তিভাব যার মনে স্থান পায়নি, উপরন্তু সে-জাতীয় কোনো ভাবাবেগ জাগবার অনুকূল মনই যার তৈরি নেই, সে কি গীতাঞ্জলির মতো ভক্তি-কাব্যপাঠে অধিকারী?

কোনো কলাকৈবল্যবাদী তবু তর্ক করতে পারেন, প্রেমই হোক আর ভক্তিই হোক, বিদগ্ধ এবং সহৃদয় পাঠক কাব্যের সেই ভাবকে সম্যক আত্মসাৎ করে তাতে বিহ্বল হতে যাবেন কেন? এমনকি কবি নিজেও তো সেই ভাবের ঘোরে কাব্য লেখেন না। আমাদের আলংকারিকদের ভাষায় কবিকর্মে ভাব পরিণত হয় রসে, অর্থাৎ যা ছিল মনকে আন্দোলিত করে, আপ্লুত করে, তা এক বিশুদ্ধ, শান্ত, নৈর্ব্যক্তিক, অলৌকিক রূপ ধারণ করে কবিতায়—এমন যে তাকে ‘আমার’ও বলা যায় না, ‘পরের’ও বলা যায় না (পরস্য ন পরস্যেতি, মমেতি ন মমেতি চ)। সেই রসও আবার সহৃদয় পাঠক অন্তরে ঠিক গ্রহণ বা ধারণ করেন না, তার আস্বাদমাত্র সম্ভোগ করেন, অর্থাৎ তাকে যেন জিভের উপর রেখে একটু চেখে দেখেন মাত্র। অতএব কাব্যে প্রকাশিত হৃদয়ানুভূতির সঙ্গে যদি-বা কোনো বাস্তব বিষয়ের উপলব্ধি এবং কোনো জাগতিক কিংবা সামাজিক সত্যে বিশ্বাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে, আর সেই অনুভূতি যখন রূপান্তরিত হয় রসে এবং ঐ রস যখন কোনো পরিশীলিত পাঠকের নিরুত্তাপ সম্ভোগমাত্রের বস্তু হয়, তখন কবির মনে যে-গভীরতর উপলব্ধি ও বিশ্বাসের পরিমণ্ডল তাকে বেষ্টন করেছিল তা অগ্রাহ্য ঠেকলেও তাঁর বিশুদ্ধ রসানুভূতি ক্ষুণ্ন হতে যাবে কেন?

এ-মতে আমার মন অনেকটা সায় দেয়, বেশ কিছু কাল সম্পূর্ণ সায় দিত। সম্প্রতি একটু খটকা লাগে। আলংকারিকদের মত নাট্যকাব্যকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে তার বিচার করা যাক। ওথেলোর ঈর্ষা, ইয়াগোর অসূয়া, লেডি ম্যাকবেথের দুর্ধর্ষ অভীপ্সা—এই ভাবগুলিকে নাটকে আমরা বস্তুতপক্ষে অনুভব করি না, আস্বাদন করি মাত্র; নাটক দেখার সময়ে যদি সত্যি সত্যি ঐসব ভাবে বিলোড়িত হয়ে পড়ি তবে রসসম্ভোগে বিঘ্ন ঘটে এবং আমরা উপযুক্ত দর্শক নই একথা প্রমাণিত হয়। কিন্তু প্রাচীন আলংকারিকরা নাটকে অভিব্যক্ত এই ভিন্ন ভিন্ন ভাবসমষ্টি এবং তাদের রসরূপের প্রতি যতটা মনোযোগী ছিলেন, সে পরিমাণে দৃষ্টি দেননি নাটকের সামগ্রিক ঐক্যরূপের দিকে। শৃঙ্গার, বীর, করুণ, ভয়ানকাদি নবরস নাটকে ব্যবহৃত উপকরণ, এর কয়েকটি বা সব-কটির যথাযথ সন্নিবেশে নাটক রচিত হয়, কিন্তু কোনো একটিকে সমগ্র নাটকের মূল রস বলা যায় না (সব-কটিকে বা কয়েকটির সমষ্টিকে তো নয়ই)।

অনেকে শান্তরসের পক্ষ থেকে এই দাবি তুলেছেন। এক হিসেবে এ-দাবি যথার্থই। জীবনের চাঞ্চল্য ও বিক্ষোভের তুলনায় আর্টের অভিজ্ঞতা প্রশান্ত বইকি। যত ভয়ানক বা মর্মন্তুদ দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হোক রঙ্গমঞ্চে, আমরা তা প্রত্যক্ষ করি (বলা উচিত সম্ভোগ করি) প্রশান্ত চিত্তে। প্রেক্ষাগৃহে যেসব মহিলা ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে শুরু করেন বা কণ্ঠস্বর তারায় চড়িয়ে চিৎকার-শব্দে ছাদ ফাটাবার উপক্রম করেন, তাঁরা নাট্যরস সম্ভোগের উপযুক্ত মানসিক পরিণতি লাভ করেননি। শোনা যায় নীলদর্পণ দেখতে দেখতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নাকি দৃশ্যবিশেষে এতদূর উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছিলেন তাঁকে চটি জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। ঘটনাটা যদি সত্য হয় তবে বিদ্যাসাগরের চারিত্র্যগুণ সম্বন্ধে আমাদের শ্রদ্ধা বাড়ে, কিন্তু তিনি সুরসিক দ্রষ্টা ছিলেন কি না সে-বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হয়। যা-ই হোক, যে-শান্তরস নবরসের একটি রস এবং অন্য আটটির সমপর্যায়ভুক্ত, আর যে-শান্তরস সমগ্র নাটকের মূলরস—দুয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট।

তবু শান্তরসকে (মনে হয় অ্যারিস্টটলের ক্যাথারসিস তত্ত্বের ইঙ্গিতও এর দিকেই) আমি নাটকের মূলরস বলব না, মূলরসের সর্বপ্রধান গুণ বলেই গণ্য করব। নাট্যকার এবং মহৎ শিল্পী মাত্রেই মানুষকে, সমাজকে, পৃথিবীকে এবং সমগ্র বিশ্বজগৎকে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষণ করেন, সে-নিরীক্ষণের সঙ্গে তাঁর নিবিড় হৃদয়াবেগ জড়িত থাকে। আবেগপূর্ণ নিরীক্ষাকে উপলব্ধি বলা যেতে পারে। নাট্যকারের এই উপলব্ধিটি নাট্য-রচনায় যে রূপান্তর গ্রহণ করে তাকেই ঐ নাটকের মূলরস বলা সংগত। তা অবশ্যই শান্ত হবে, কিন্তু শান্ত বললেই তার যথোপযুক্ত পরিচয় দেওয়া হয় না। নাটকের অন্তর্ভুক্ত এবং উপকরণরূপে ব্যবহৃত বিভিন্ন গৌণ ‘রস’গুলিকে যে-ভাবে আমরা আস্বাদন করি, সমগ্র নাটকের মূল উপলব্ধি এবং তার রসরূপ সেইভাবে শুধু চেখে দেখবার জিনিস নয়, তার আবেদন নিবিড়তর, অন্তরের গভীরে সে পৌঁছয় এবং বাসা বাঁধে।

কলাকৈবল্যবাদীদের আমি প্রশ্ন করব: নাটকের মূল উপলব্ধির আলয় যে-জাগতিক নিরীক্ষা, তার সঙ্গে আমাদের স্বকীয় জাগতিক নিরীক্ষার বিরোধ যদি মৌলিক হয় তবে কি ঐ নাটকের সম্যক রসসম্ভোগ অব্যাহত থাকবে? সাহিত্য-বিশেষজ্ঞের সুশীতল সাধুবাদের পক্ষে অবশ্য কবি ও তাঁর পাঠকের মধ্যে হার্দ্যবিচ্ছেদ মস্ত বাধা নয় জানি, কিন্তু আমি বলছি সেই রসগ্রহণের কথা যাতে অন্তঃকরণের প্রতিটি তার ঝংকার দিয়ে ওঠে। তেমন করে সাড়া দেওয়ার কথা ভাবলে কি টি. এস. এলিয়ট-এর মতো আমরাও মানতে বাধ্য নই যে তত্ত্বের এবং তর্কের খাতিরে যা-ই বলি, কাব্যরসসম্ভোগ আমাদের মৌল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বারা কতকটা প্রভাবিত হয়ই।

শেক্সপীয়র যে-মহান দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন মানুষকে এবং জগৎকে তাঁর প্রধান ট্র্যাজেডিগুলিতে, তার সঙ্গে আমরা নিবিড় আত্মীয়তা বোধ করি। না করলেও আমরা শেক্সপীয়রিয়ান ট্র্যাজেডির রচনাকৌশলের প্রশংসা করতাম। কিন্তু হৃদয়ের এত গভীরে তাকে স্থান দিতে পারতাম না, ট্র্যাজেডিকারের মহত্ত্ব-বিষয়ে এমন নিঃসংশয় হতে পারতাম না। কবির দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির আনুপূর্বিক মিল থাকবে এমন কথা অবশ্য আমি বলছি না। কিন্তু আমার মতে সম্যক রসগ্রহণের ন্যূনতম শর্ত এই যে কবির সম্পূর্ণ উপলব্ধি—শুধু তাঁর অনুভূতির দিকটা নয়, তাঁর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিও—পাঠকের দ্বারা গৃহীত না হোক অন্তত তার কাছে গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধেয় ঠেকবে। যদি কবির সঙ্গে পাঠকের দৃষ্টিভেদ এতই মৌলিক হয় যে পাঠক কবির দৃষ্টিকে কেবল অগ্রাহ্য নয়, অসত্য বা অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করে, তবে সেক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে হার্দ্যসংযোগের এমন কোনো প্রণালী খুঁজে পাওয়া যাবে না যার ___ বইতে পারে।

এলিয়ট যদিও দান্তে প্রসঙ্গে জোর গলায় বলেছিলেন, ‘কবির মতবিশ্বাসের সঙ্গে পাঠকের মতবিশ্বাস এক না হলে রসসম্ভোগের ব্যাঘাত ঘটবে একথা আমি সরাসরি অস্বীকার করি’ তবু শেলি ও কীসের আলোচনায় তাঁকে ভিন্ন সুরে কথা বলতে হয়েছে। তার কারণ শেলির অনেক কবিতাই তাঁর ভালো লাগত না এবং আত্মবিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, ‘শেলির মতামত আমি অপছন্দ করি বলে তাঁর কাব্যসম্ভোগে বাধা পাই; শেলির কতকগুলি মত আমার এতই বাজে (‘puerile’) মনে হয় যে, যেসব কবিতায় ঐ মতের ছায়া পড়েছে তাতে আমি কোনো রসই খুঁজে পাই না।’ ফলে তাঁর পূর্বোক্ত সরাসরি অস্বীকৃতিকে একটু সংস্কৃত করে অনেকখানি মোলায়েম করে এলিয়ট শেষ অবধি যে-ফর্মুলায় পৌঁছলেন তা আমি মেনে নিতে প্রস্তুত:

‘When the doctrine, theory, belief, or “view of life” presented in a poem is one which the mind of the reader can accept as coherent, mature, and founded on the facts of experience, it interposes no obstacle to the reader’s enjoyment, whether it be one that he accept or deny, approve or deprecate.’

‘When’ কথাটার উপর আমি কিন্তু জোর দিতে চাই এবং যে-তিনটি বিশেষণের দ্বারা কাব্যব্যক্ত ‘অবিঘ্নকারী’ মতবিশ্বাসকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে সেগুলির উপর। এতগুলি সদ্গুণবিশিষ্ট যে-মত তা আমার আপন না হলেও, খুব অনাত্মীয় নয়, অপাঙ্‌ক্তেয় তো নয়ই।

ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয় যদি প্রশ্নটাকে বিশ্বনিরীক্ষা বা ধর্মবিশ্বাসের মৌলিক বিরোধ থেকে মূল্যবোধের, __ নীতিবোধের, সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে আসা হয়। ফ্যাশিস্ট মার্কা উচ্চণ্ড স্বাজাত্যদন্ত ও পরজাতিবিদ্বেষের দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চাঙ্গের নাটক, কবিতা বা উপন্যাস লেখা হয়েছে কিনা জানি না। আদৌ সম্ভব কিনা এমন সন্দেহ যদি কেউ প্রকাশ করেন তবে বলব যে তিনি গোড়াতেই মেনে নিচ্ছেন সাহিত্যে মতবিশ্বাসের কথাটা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। তাই আপাতত ধরে নেওয়া যাক যে সত্যাসত্য শুভাশুভ যে-কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উঁচু দরের সাহিত্য রচনা সম্ভব অর্থাৎ সেই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যা উঁচু দরের বলে গণ্য হবার যোগ্য। কিন্তু আমাদের মতো মনে-প্রাণে ফ্যাশিস্টবিরোধী যারা—যাদের কাছে ঐ বিশিষ্ট মনোভঙ্গি ও হৃদয়ভাব শুধু অনধিগম্য নয়, রীতিমতো অবজ্ঞেয়, তাদের পক্ষে ফ্যাশিস্ট সাহিত্যের রসসম্ভোগের চেষ্টা কি পদে পদে ব্যাহত হবে না? অবশ্য আমরা কোনো ফ্যাশিস্ট নাটকের প্লটের ঘনসন্নিবদ্ধতা, চরিত্রাঙ্কণের সূক্ষ্মরেখতা, ভাষার অনবদ্যতা, ছন্দের অপূর্বতা, চিত্রকল্পের উজ্জ্বলতা, ইত্যাদি বিষয়ে অনেক শীতল প্রশংসাবারি বর্ষণ করতে পারি; কিন্তু তাকেই কি বলে রসগ্রহণ? পেশাদারী প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েও আমাদের সমস্ত অন্তরাত্মা বিমুখ থাকবে। কারণ ফ্যাশিস্ট লেখক এবং ফ্যাশিস্ট-বিরোধী পাঠকের মধ্যে ব্যবধান অসেতুবন্ধা।

এ তো গেল নাট্যকাব্যের কথা। গীতিকবিতার ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে কবির সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গির কোনো-একটা দিক কিংবা জগৎ ও জীবন বিষয়ে তাঁর কোনো পূর্ণ উপলব্ধি পরিস্ফুট হবার সম্ভাবনা কম। তেমন প্রকাশ ঘটে অনেকগুলি কবিতার মাধ্যমেই। সে-সমস্ত কবিতা একই কাব্যগ্রন্থে সংগৃহীত থাকতে পারে, বা একাধিক কাব্যগ্রন্থে ছড়ানো। অনেক সময়ে সমগ্র কাব্যসংকলন না পড়লে আমরা কবির মনের নাগাল পাই না। রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ মেজাজ ও উপলব্ধি ব্যক্ত হয়েছে গীতাখ্য তিনখানি কাব্যগ্রন্থে, উৎসর্গে এবং তৎপূর্ববর্তী নৈবেদ্য-র ও অব্যবহিত পরবর্তী বলাকার কয়েকটি কবিতায়। এই পর্বকে ভক্তিপর্ব বলা যেতে পারে, এর আগে বা পরে আমরা ঠিক ভক্তিরসের স্বাদ পাই না[৪]— খুব অল্পসংখ্যক কয়েকটি ব্যতিক্রম ধর্তব্য নয়।

গীতিকবিতা প্রায় সব সময়েই উত্তম পুরুষে লেখা হয়, কিন্তু এই উত্তম পুরুষটি যে সর্বদা কবি নিজেই হবেন এমন কোনো কথা নেই। “The Love Song of Alfred J. Prufrock” বা “Portrait of a Lady”র উত্তম পুরুষ স্পষ্টত এলিয়ট নন, মানসীর “নারীর উক্তি”, “পুরুষের উক্তি”, “বন্ধু”, এবং শিশু কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতারই উত্তম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ নন। প্রথম দুটি তো ক্ষুদ্র নাটিকাই, প্রুফ্রক এবং অন্য কবিতাটির তরুণ প্রণয়ী (যাদের মুখ দিয়ে কবিতা দুটি বলানো হয়েছে স্বগতোক্তির আকারে) দুই নাটিকার দুজন নায়ক। “নারীর উক্তি”, “বন্ধু”, এবং শিশু-র কবিতাগুলি ঠিক নাটিকা না হলেও নাট্যধর্মী। এসব ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীর অনুভূতি কবির অনুভূতি নয়, কবি পাঠকের সামনে এই অনুভূতিগুলির চিত্র এঁকেছেন মাত্র। এই চিত্রের অন্তরালে কবির নিজের যে উপলব্ধিটি উহা রয়েছে তা যদি পাঠকের মর্মে না পৌঁছে থাকে তবে বলতেই হবে হয় কবির লেখা নয় পাঠকের পড়া ব্যর্থ হয়েছে। যে-কথাটার উপর আমি জোর দিতে চাই সেটা এই যে এ-জাতীয় নাট্যধর্মী লিরিকে পাত্রপাত্রীর অনুভূতি আর কবির অনুভূতি বা উপলব্ধি বেশ একটু পৃথক, এবং প্রথমটি দ্বিতীয়টির উপজীব্য। পাঠকও কবিতার দুই স্তরের অনুভূতিকে ভিন্নভাবে গ্রহণ করেন। প্রুফ্রক এবং বধূর অনুভূতির আমরা দ্রষ্টা বা আস্বাদকমাত্র, কিন্তু তদন্তরালবর্তী কবির নিজস্ব অনুভূতি আমাদের অন্তরের গভীরতর স্তরে প্রবেশ করে; তার সঙ্গে যদি অনেক পরিমাণে তাদাত্ম্য (আইডেন্টিটি) স্থাপিত না হয় তা হলে কবিতার সম্যক রসগ্রহণ সম্ভব হয় না।

কিন্তু বেশির ভাগ গীতিকবিতার উত্তম পুরুষ কবি স্বয়ং, তাঁর কল্পিত কোনো ভিন্ন-হৃদয় চরিত্র নয়। অর্থাৎ পূর্বোক্ত দুই স্তরের অনুভূতি সেখানে এক হয়ে গেছে, কবিতায় অভিব্যক্ত অনুভূতি প্রত্যক্ষভাবে স্বয়ং কবির অনুভূতি। অবশ্য কাব্যের অনুভূতিমাত্রই জীবনের অনুভূতি থেকে একটু ভিন্ন পর্যায়ের—অপেক্ষাকৃত সাধারণীকৃত এবং নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু এই নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতিটি কবিরই, কাজেই পাঠক যদি তাকে নিজ অন্তরের গভীরতম কক্ষে জায়গা না দিয়ে তাকে প্রেক্ষাগৃহের আসন থেকে দেখেন, তবে তিনি একটি গীতিকবিতাকে অবলম্বন করে স্বতন্ত্র নাটক রচনা করতেও পারেন, কিন্তু ঐ গীতিকবিতার মর্মে প্রবেশ করতে পেরেছেন কিনা সে-বিষয়ে সন্দেহ থেকে যাবে। অনেক নাস্তিক (শুধু ঈশ্বরে অবিশ্বাসী অর্থেই নয়, জীবনবিমুখ এবং বিশ্ববিতৃষ্ণ অর্থে নাস্তিক) এবং রবীন্দ্রমানসে বীতশ্রদ্ধ সমালোচক যখন গীতাঞ্জলির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন তখন সে-প্রশংসায় অন্তরের সাড়া যতটা থাকে তার চেয়ে হয়তো অনেক বেশি থাকে কৃতবিদ্য সূক্ষ্মদর্শী মূল্যবিচার, বিশেষত কলাকৌশলগত গুণগ্রাহিতা। আমার অনেক সময় মনে হয়েছে এঁরা গীতাঞ্জলির কবিতাগুলিকেও নাট্যকাব্য রূপে গ্রহণ করেন, কবিতার ভক্তিভাব যেন কবির নিজস্ব অনুভূতি নয়, কবিবর্ণিত একটি ভক্ত হৃদয়ের চিত্রণ মাত্র। সুতরাং পাঠকও নাটকোচিত দূরত্ব রক্ষা করেই তার রসসম্ভোগ করবেন, যেমন করে তিনি দূর থেকে সম্ভোগ করেন ওথেলোর ঈর্ষা বা ইয়াগোর অসূয়া। কিন্তু তাই যদি হতো, তবে এই ভক্ত হৃদয়ের অভিব্যঞ্জনায় গীতিনাট্যকারের স্বকীয় একটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গিও ফুটে উঠত—ব্যঙ্গের, করুণার বা ট্র্যাজিক চেতনার। সহজেই অনুমান করা যায় যে, কোনো আধুনিক কবি যদি কখনো গীতাঞ্জলির ভাব নিয়ে কাব্যরচনা করেন, তবে তার পেছনে এমনতর ব্যঙ্গের, করুণার, সকৌতুক বিস্ময়ের বা ট্র্যাজেডির সুর প্রচ্ছন্ন থাকবে—প্রচ্ছন্ন থাকবে এমন কোনো ইঙ্গিত যে এ ‘মৌল নাস্তি’র অনন্ত অমার মাঝখানে বসে যে-মানুষের হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্ত প্রেম জেগে ওঠে স্রষ্টা বা তাঁর সৃষ্টির প্রতি, কত আত্ম-প্রতারক, অর্বাচীন বা মধ্য-ভিক্টোরীয় তার অন্ধ ভাবাবেগ!

কিন্তু গীতাঞ্জলির রবীন্দ্রনাথ কাব্যবর্ণিত ভক্ত হৃদয়কে দূর থেকে সকৌতুকে বা সকরুণায় অবলোকন করছেন না, সে ভক্ত হৃদয় রবীন্দ্রনাথেরই। পাঠক যদি গীতাঞ্জলির কবির সঙ্গে এই নাটকীয় দূরত্ব রক্ষা করে চলেন তবে আমি বলব গীতাঞ্জলির সুর তাঁর মর্মস্তলে পৌঁছয়নি। শিশু কাব্যগ্রন্থে শিশুমনের প্রকাশের প্রতি পাঠকের যে-প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক, গীতাঞ্জলিতে ভক্ত-হৃদয়ের অভিব্যক্তির প্রতি সেই একই নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া অসংগত। ‘ঐ দেখ মা আকাশ ছেয়ে/মিলিয়ে এল আলো’ এবং ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে/আঁধার করে আসে’, কিংবা ‘আমার যেতে ইচ্ছে করে/নদীটির ঐ পারে’ এবং ‘আমি চঞ্চল হে/আমি সুদূরের পিয়াসী’—কবিতাদ্বয় পাশাপাশি পড়লে আমার বক্তব্য আরও স্পষ্ট হবে। প্রথমত, শিশু থেকে উদ্ধৃত কবিতা দুটিতে যে ভাবদ্বৈত আছে, গীতাঞ্জলি ও উৎসর্গের কবিতায় তা অবর্তমান। দ্বিতীয়ত, শিশুর কবিতা পড়বার সময়ে আমরা কবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে শিশুমনের সকৌতুক পরিচয় লাভ করি, কিন্তু গীতাঞ্জলি পাঠকালে আমরা কবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাঁরই মনের বেদনা ও ব্যাকুলতা অনুভব করি। শিশুর সুখদুঃখ আমাদের পক্ষে ঠিক অনুভব করা সম্ভব নয়, আমরা তার সহৃদয় দর্শকমাত্র। অপর পক্ষে, গীতাঞ্জলির বেদনা আমাদের প্রত্যক্ষীভূত নয়, অনুভূত। এই সমানুভবতার প্রয়োজন আছে গীতাঞ্জলির মতো কাব্যের পূর্ণ রসসম্ভোগের জন্য।

কাজেই প্রশ্ন থেকে যায় কেমন করে অভক্ত পাঠক, ব্যক্তিস্বরূপ ঈশ্বরে অবিশ্বাসী পাঠক, গীতাঞ্জলির কবির সঙ্গে সেই তাদাত্ম্য অনুভব করবেন যার অবর্তমানে এ-ধরনের গীতিকবিতার সম্যক রসোপলব্ধি সম্ভব নয়। প্রথিতযশাদের মধ্যে নাম করতে পারি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, গেল দশ বছরের বুদ্ধদেব বসু এবং শিবনারায়ণ রায়ের। এঁদের মনে কখনো এ-সমস্যা জেগেছিল কি না, এবং জেগে থাকলে তাঁরা কীভাবে তার নিরাকরণ করেছিলেন, ঠিক বলতে পারি না। আমার নিজের চোখে সমস্যাটি যে-রূপ ধারণ করেছে তার কিছু পরিচয় দিলাম। কোন্ পথে আমি সমাধান খুঁজেছি এবার সে-বিষয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করব।

.

তার আগে দুটো কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। প্রথমত, পূর্বোক্ত শ্রদ্ধেয় সাহিত্যকর্মীদের মন গীতাঞ্জলির রবীন্দ্রনাথ থেকে যতটা দূরে অবস্থিত বলে আমার বিশ্বাস, আমার নিজের মন ততটা দূরে নয়, কাজেই যে গিরিদরী আমাকে লঙ্ঘন করতে হলো তা ততটা দুর্লঙ্ঘ ছিল না। স্রষ্টা, বিধাতা এবং ত্রাণকর্তা ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করা যদিচ আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবু আমি কোনো অর্থেই জড়বাদী নই। মানুষের সমগ্র সত্তা শারীরবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের ছকে কোনো দিন ধরা দেবে—একথা আমি এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারি না। এমনকি, আমার বিশ্বাস জড়জগতের একটা চিত্রমাত্র পদার্থবিজ্ঞানে অনুরেখনীয় ও অনুধাবনীয়। অর্থাৎ যদিচ বিজ্ঞান আমার চোখে অতীব শ্রদ্ধেয় ও প্রণিধানযোগ্য, তবু আমি ভুলতে পারি না যে, অনেকান্ত বিশ্বজগতের একটা অন্ত বা দিক মাত্র বিজ্ঞানের বিষয়ীভূত, বাকিটা ধরাছোঁয়ার বাইরে, অপার গভীর রহস্যে ঢাকা। উপরন্তু মানবেতিহাসে আমি একটি মন্থর, যদিচ উত্থান-পতন-বন্ধুর, অগ্রগতির আভাস দেখতে পাই। এবং লক্ষ কোটি বৎসর পর নাক্ষত্র-জগতের অবধারিত তাপমৃত্যুর ফলে মনুষ্যজাতির নিদারুণ বিনাশ ঘটবেই এ-দুশ্চিন্তা আমার ঈষৎ ক্ষীণ আশাবাদকে সমূহ আচ্ছন্ন করে না, কারণ আমি ‘ওয়াইৎ-সেকর’-কে অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞানের এমনতর বহুদূরপাল্লার ভবিষ্যৎ-বাণীকে (তথা অতীত-বাণীকে) সন্দেহের চোখে দেখি।

এতৎসত্ত্বেও এবং এটাই আমার দ্বিতীয় স্বীকৃতি—গীতাঞ্জলির সব কবিতা আমার মনে সাড়া জাগায় না! যেগুলিকে বলা যেতে পারে শুদ্ধা ভক্তির কবিতা (যথা, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে’, ‘একটি নমস্কারে প্রভু’, ‘তোমায় আমার প্রভু করে রাখি’, ‘আর আমায় আমি নিজের শিরে বইব না’ ইত্যাদি), সুরের দিক থেকে কয়েকটি তার ভালো লাগলেও, ভাবের দিক থেকে আমাকে স্পর্শ করে না। উচ্চাঙ্গের কাব্যকৌশল এমনকি সুরের কৌশলও কোনো ব্যক্তি-স্বরূপিত সত্তার প্রতি আমার মনে কোনো প্রকারের দাসভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম নয়। এই বিশেষ মানসমুকুলটি ফুটিয়ে তুলবার মতো সার আমার মনের মাটিতে অনুপস্থিত। তবে সুখের কথা এই যে এ-ধরনের প্রভু-ভৃত্য-সম্পর্ক-নির্ভর ভক্তিগীতির সংখ্যা সমগ্র গীতাঞ্জলির গানের সংখ্যার অনুপাতে অত্যল্পই।

গীতাঞ্জলিতে বহু সংখ্যক রোম্যান্টিক প্রেমের এবং প্রকৃতি-অনুরাগের গান আছে যাতে ভক্তির ছোঁয়া লেগেছে, অনেক সময়ে খুব আলগোছেই লেগেছে। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি: ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়’, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’, ‘আরো আঘাত সইবে আমার’, ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না’, ‘ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো’, ‘আমারে দিই তোমার হাতে’—এগুলিকে নিছক প্রেমের গান মনে করলেও খুব ভুল করা হয় না। অন্য দিককার উদাহরণ: ‘আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে’, ‘আজি বারি ঝরে ঝর ঝর’, ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে’, ‘এসো হে এসো, সজল ঘন বাদল বরিষনে’—এগুলিকে তেমনি নিছক প্রকৃতির গান মনে করলে ভুল করা হয় না। ভুল করা হবে না বটে, তবে এই উভয় শ্রেণীর গানের মধ্যে ভক্তিভাবের আমেজ না দেখতে পেলে তার সম্পূর্ণ মূল্য অনাবিষ্কৃত থেকে যাবে।

কিন্তু গুণ এবং মাত্রা উভয় নিরিখে গীতাঞ্জলির মূল সম্পদ হচ্ছে সেইসব গান যাতে ভক্তি এবং প্রেমের কিংবা ভক্তি এবং প্রকৃতি-অনুরাগের কিংবা তিনটেরই সংগম ঘটেছে। উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই—’মেঘের পরে মেঘ জমেছে’, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’, ‘পথ চেয়ে যে কেটে গেল কত দিনে রাতে’, ‘ও আমার মন যখন জাগলি না রে’, ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’ প্রভৃতি বহু সংখ্যক গান আমাদের খুবই পরিচিত; গীতাঞ্জলি বলতে এইসব গানের কলিই সর্বাগ্রে মনে আসে।

দুটি কথা লক্ষ্য করবার মতো। প্রথমত, প্রেমের অথবা প্রকৃতি-অনুরাগের মধ্যেই ভক্তিভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এসব গানে। দ্বিতীয়ত, ভক্তি শব্দের প্রয়োগ এখানে তার সুনির্দিষ্ট সুপরিচিত অর্থে নয়, তার চেয়ে একটু ছড়ানো বা ঢিলেঢালা অর্থে। কারণ এসব গানে প্রিয়া বা প্রকৃতির সীমিত সত্তায় যে-অধরা, ধাবমান ছায়ার মতো মুহুর্তে সচকিত করে দূরে-পালিয়ে-যাওয়া সত্তার আভাস রয়েছে তাকে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসসম্মত, শাস্ত্রনির্দিষ্ট অর্থে ভগবান বলা একটু শক্ত। সেই আভাসিত সত্তার জন্য আকুতি আছে, আনন্দ ও বেদনা আছে, ভরসা ও নৈরাশ্য আছে, বিস্ময় ও রহস্যবোধ আছে, এবং এইসব ভাবপুঞ্জ ঐহিক প্রিয়া ও প্রকৃতির জন্য যতটা স্বাভাবিক তাকে মাত্রায় ও গুণে ছাড়িয়ে গেছে, তবু এগুলির মিলিত সম্ভার যে-ভাবাবেগ সমুৎপন্ন করে তাকে আভিধানিক অর্থে ভক্তি বলতে বাধে।

বাধাটা আরও পরিষ্কার হবে যদি এগুলির সঙ্গে আমরা তুলনা করি গীতাঞ্জলির অন্তর্ভুক্ত খাঁটি ভক্তিভাবের গানের। সেখানে ভক্তি নির্দিষ্ট অর্থে ভক্তিই, আর পাত্র চলিত অর্থে ভগবানই। আগেই বলেছি এই শেষোক্ত গানের সম্যক রসগ্রহণে আমি অনধিকারী। বাকি গানের বেলা এই অনধিকারের বাধা নেই, কারণ সেক্ষেত্রে প্রেমের ও প্রকৃতি-অনুরাগের পূর্বসঞ্চিত অভিজ্ঞতা জমি তৈরি করে রেখেছে। প্রেমের বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপলব্ধি যখন আমাদের মনে খুব নিবিড় এবং প্রবল ভাবে জাগে তখন আমরা বোধ করি প্রিয়ার সম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তা ঐ সীমাটুকুর মধ্যে ধরা দেয়নি যে-সীমা শারীরবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস টেনে রেখেছে প্রেমেতর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায়-চেনা মানুষের চারিদিকে; সেই মানুষকে যখন আমরা প্রেমের মধ্যে গ্রহণ করি তখন সে যেন এক অসীম রহস্যময় লোকোত্তর সত্তায় মিশে যায় বা তার রক্ত-মাংসের প্রতীক হয়ে আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রবল অনুভূতিও (বিশেষত ঐ সৌন্দর্য যদি সেই পর্যায়ভুক্ত হয় ইংরেজিতে যাকে সাব্লাইম বলে) আমাদের এক রহস্যঘন অনন্তলোকের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

খেয়া এবং গীতাখ্য তিনখানি কাব্যে অধিকাংশ কবিতার লগ্ন হয় গোধূলি নয় গভীর অন্ধকার রাত্রি, স্থান নির্জন নদীতীর কিংবা উন্মুক্ত প্রান্তর। ঐ সময়ে অমন স্থানে এক অবর্ণনীয় অপার রহস্যের আবছায়া অনুভূতি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনকেও দ্রবীভূত করে, কবির মনকে যে অভিভূত করবে তা আর বিচিত্র কী। তখন মনে হয় আমরা যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি, যেখানকার প্রত্যেকটি দৃশ্য একটি কম্পমান যবনিকা—যদি হঠাৎ সরে যায় সে যবনিকা (কখনো সরে যাবে না তা অবশ্য জানি) তবে আমরা এমন এক সত্তার মুখোমুখি হব যা ধারণার অতীত, কিন্তু অনুভূতির অগম্য নয়। এ-অনুভূতিকেও মিস্টিক বলা যায়, যদিও ধর্মাত্মা সাধকদের তপস্যালব্ধ তূরীয় অবস্থার কোনো অভিজ্ঞতার সমপর্যায়ভুক্ত নয় সে অনুভূতি। উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্রে—নাস্তিক পাত্রেও—এ-ধরনের অনুভূতি আপনিই জাগে এবং ক্ষণকালের মধ্যে আপনিই মিলিয়ে যায়। সে-’মুগ্ধক্ষণ’ কেটে গেলে আবার নদীকে নিতান্তই জলস্রোত এবং পাহাড়কে নিছক শিলাখণ্ডই বোধ হয়।

প্রেম ও প্রকৃতির মধ্যে এই যে অধরার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত, তাকেই আরও ইঙ্গিতময় ও প্রত্যক্ষগোচর করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই গীতাঞ্জলির শ্রেষ্ঠ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গানগুলিতে আমি একেবারে অপরিচিত অনভিজ্ঞাত অনধিগম্য ভাবের ব্যঞ্জনা পাই না; প্রিয়া ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে যা আগেই পেয়েছি তারই উন্নীততর, সূক্ষ্মতর, পূর্ণতর এবং সর্বোপরি স্পষ্টতর (নান্দনিক অর্থে স্পষ্টতর) রূপ দেখে মুগ্ধ হই। গীতাঞ্জলি পড়বার সময়ে সবিস্ময়ে অনুভব করি আমরা যেন দুই জগতের মধ্যবর্তী সীমান্তরেখা ধরে হাঁটছি, একটু এদিকে সরলে পড়ে মর্ত্যলোকের মাটিতে, একটু ওদিকে সরলে বাতাসে পাই অমৃতলোকের গন্ধ।

নোবেল পুরস্কার-প্রাপ্ত ইংরেজি গীতাঞ্জলির কল্যাণে পশ্চিমের এবং এদেশের অবাঙালি পাঠকেরা রবীন্দ্রনাথকে মোটের উপর ভক্তিরসের কবি বলেই জানেন; অর্থাৎ অত্যন্ত আংশিকরূপেই জানেন। ভক্তিরস তাঁর একটি বিশেষ পর্বের (কালের দিক থেকে দশ-বারো বৎসরের) মধ্যে সীমাবদ্ধ। বারো বৎসর অবশ্য খুব অল্পকাল নয়, তবে যিনি ষাট বৎসরের অধিককাল কাব্যসাধনা করেছেন তাঁর কবি-পরমায়ুর ক্ষুদ্র অংশ তো বটেই। কিন্তু ঐ সময়ের কবিতাও যে বিশুদ্ধ ও অনন্যাশ্রয়ী-ভাবে ভক্তিরসের কবিতা নয় সেটা আরও একটু বিশদ করে একটু অন্য দিক থেকে বলা হয়তো বাহুল্য হবে না।

ভক্তের মন একান্তভাবে ঈশ্বরে তন্ময়, নিজেকে নিয়ে ব্যাপৃত থাকার কথা নয় তার। ভক্তিরস বাৎসল্যরসের মতোই একতরফা; মা যেমন শিশুর কাছে, ভক্ত তেমনি ভগবানের কাছে নিজেকে নিঃশেষে কেবল ঢেলে দিতেই চায়, প্রতিদানের কোনো প্রত্যাশা রাখে না, দাবি তো নয়ই। কিন্তু গীতাঞ্জলির কবি আত্মবিস্মৃত মোটেই নন, গীতাঞ্জলির ভাবজগতে দান যেমন অকৃপণ, প্রতি-দানের দাবিও তেমনি অকুণ্ঠ, আত্মবিসর্জন এবং আত্মস্ফুরণ দুটি বিপরীত ভাবের ব্যঞ্জনা একাধারে বিধৃত। একদিকে যেমন শুনি—

আমার যে সব দিতে হবে, সে তো আমি জানি।

অন্যদিকে তেমনি জানতে পারি—

তোমার      এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ ঝরবে
আমার       প্রাণে নইলে সে কি কোথাও ধরবে?

একদিকে যেমন—

আরো প্রেমে, আরো প্রেমে
মোর আমি ডুবে যাক নেমে

অন্যদিকে তেমনি—

আমার      প্রাণের মাঝে যেমন করে
নাচে তোমার প্রাণ
আমার      প্রেমে তেমনি তোমার প্রেমের
বহুক না তুফান।

একদিকে—

আমারে দিই তোমার হাতে
নূতন করে নূতন প্রাতে।

অন্যদিকে—

যদি আমায় তুমি বাঁচাও তবে
তোমার নিখিল ভুবন ধন্য হবে।

এই দ্বিতীয় সুরটি কবীরের দোহার মতো বিশুদ্ধ ভক্তিকাব্যে স্বভাবতই শোনা যায় না, কারণ এ-সুরটি প্রেমের, ভক্তির নয়। প্রেমিক সর্বদাই প্রতিদান চায়, না পেলে তার প্রেম ব্যর্থ, আত্ম-নিবেদন বৃথা। প্রেমাস্পদের জন্য যত উচ্ছ্বাস, উদ্বেগ, উদ্বেলতা থাক, আত্মবিস্মৃত নয় প্রেমিক। কবীরের কাব্য ভক্তির প্রকাশে উজ্জ্বল কিন্তু প্রেমের লক্ষণে দীন একথা মানতেই হবে। কবীরের সঙ্গে তুলনার বিশেষ গুরুত্ব আছে যেহেতু রবীন্দ্রনাথ নিজেই কবীরকে তাঁর পূর্বসূরীরূপে পাশ্চাত্ত্য এবং সেই সূত্রে এ-দেশীয় পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। ‘ইংরেজী গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হলে যখন পাশ্চাত্ত্য একদল ধর্মব্যবসায়ী বলতে প্রবৃত্ত হলেন, এইসব কথা খ্রীষ্টধর্মেরই প্রভাবে লেখা এবং আমাদের দেশের বহু লোক সেই কথা আরও জোরে প্রতিধ্বনিত করতে প্রবৃত্ত হলেন… তখন আমাকে বাধ্য হয়ে কবীরের অনুবাদ করে দেখাতে হলো এই জাতীয় ভাব ইংরেজ আমলের পূর্বে এই দেশে ছিল, কবীরের মধ্যে ছিল।’

অথচ এমনি কপাল যে ঐ অনুবাদ পড়ে ইয়েট্স প্রমুখ কয়েকজন বিদগ্ধ পশ্চিমী পাঠকের মনে হয়েছিল এ-অনুবাদ না ছাপলেই ভালো করতেন রবীন্দ্রনাথ, কেননা তাঁর কাব্যিক অর্থাৎ ঈষৎ জোলো ভক্তিরস কবীরের খাঁটি গাঢ় ভক্তিরসের তুলনায় একটু পানসে ঠেকে। এঁরা লক্ষ্য করলেন না যে, কবীর শুধু খাঁটি ভক্ত নন, মূলত ভক্তই, কবিতা তাঁর পক্ষে গৌণ কর্ম, কবি না হলেও তাঁর ভক্তিরস বিন্দুমাত্র খণ্ডিত হতো না। অপর পক্ষে, রবীন্দ্রনাথ খাঁটি কবি এবং মূলত কবিই, ভক্তি তাঁর কাব্যসৃষ্টির উপাদান এবং একমাত্র উপাদান নয়, ভক্ত না হলেও তিনি উঁচু দরের কবি হতেন, কিন্তু কবিতায় প্রকাশের সার্থকতা না পেলে তাঁর ভক্তিরস অচিরে শুকিয়ে যেত। দ্বিতীয়ত, কবীরের দোঁহা বিশুদ্ধ ভক্তিরই প্রকাশ, তাতে প্রেমিক-প্রেমিকার সেই ভাবগত আদান-প্রদান নেই যা গীতাঞ্জলির ভক্তিকাব্যকে অন্য এক স্তরে নিয়ে গেছে। কবীরের ভক্তিরসের সঙ্গে যা মিশেছে তা প্রেম নয়, বিশুদ্ধ দার্শনিক ব্যাখ্যান এবং ধর্মদেশনা: ‘The creature is in Brahma and the Brahma is in the creature, they are ever distinct yet ever united’ (রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ)—এই ধরনের পক্তির অপ্রতুলতা নেই তাঁর কাব্যে। দু-এক জায়গায় স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমাস্পদের প্রতীক থাকা সত্ত্বেও (এ-প্রতীকের ব্যঞ্জনাশক্তি খুবই দুর্বল সেখানে) সর্বত্র যা প্রকাশ পেয়েছে তা কেবল এক পক্ষের আকুতি এবং আত্ম-নিবেদন—সেটাই ভক্তির ধর্ম। অপর পক্ষ যে পরমেশ্বর, তিনি কেমন করে ব্যাকুল হবেন কারও জন্য? গীতাঞ্জলির ভগবান কিন্তু আপনাতে আপনি পরিপূর্ণ নন (‘আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে’), তিনি বিরহী (‘আমার মিলন লাগি তুমি/আসছ কবে থেকে’, ‘তুমি পার হয়ে এসেছ মরু/নাই যে সেথায় ছায়াতরু’); তিনি চোখের জলও ফেলেন:

সন্ধ্যা হল, একলা আছি বলে
এই-যে চোখে অশ্রু পড়ে গলে
ওগো বন্ধু, বলো দেখি
শুধু কেবল আমার এ কি।
এর সাথে যে তোমার অশ্রু দোলে।

এমনতর বিরহ-ব্যাকুল মিলন-তৃষ্ণার্ত ত্রিভুবনেশ্বরের চিত্রকল্প কবীরের রচনায় আশা করা যায় না, ভাবাই যায় না।

এ-সবই পাওয়া যাবে অবশ্য বৈষ্ণব পদাবলীতে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন, গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতায় ‘প্রেমভক্তি-আত্ম-নিবেদন-মিশ্রিত বৈষ্ণবীয় ভঙ্গির আমেজ লাগিয়াছে।’ প্রেমের ধারা যে বৈষ্ণব পদাবলী থেকে রবীন্দ্রনাথে এসেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির তুল্য সংরক্ত, প্রাণস্পন্দিত ও প্রকাশোজ্জ্বল প্রেমের কবিতা যে-কোনো সাহিত্যে দুর্লভ, এবং রবীন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকে তার নিবিড় আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। সন্দেহ উপস্থিত হয় অন্য দিক দিয়ে। বৈষ্ণব কাব্যের যে-পদগুলির সঙ্গে আমরা অত্যন্ত পরিচিত এবং যার কাব্যিক উৎকর্ষ সর্বসম্মত, তাতে প্রায়ই প্রেমের লক্ষণ কি ভক্তির লক্ষণকে ছাড়িয়ে যায়নি? অনেক সময়ে মনে হয় যেন ভক্তির ছদ্মবেশে নিরতিশয় মানবিক প্রেমই অভিব্যক্ত; ছদ্মবেশটাও যে সর্বত্র ধারণ করা হয়েছে তা নয়। বিদ্যাপতি সম্পর্কে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন—‘বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ ব্রজের রাধা বা বাসুদেবনন্দন কৃষ্ণ বলিয়া একেবারেই ঠাহর হয় না। সর্বদেশের ও সর্বকালের প্রেমিক-প্রেমিকার রূপটিই রাধাকৃষ্ণের প্রণয়দর্পণে প্রতিফলিত দেখিতে পাই’—তা কি চণ্ডিদাস, গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাসের শ্রেষ্ঠ পদাবলী সম্বন্ধেও বলা যায় না? এটাও ভাববার কথা যে, রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর গীতাঞ্জলি পর্বের কাব্যের সঙ্গে পদাবলী সাহিত্যের একাত্মতা বোধ করেননি, নইলে ‘পাশ্চাত্য ধর্ম-ব্যবসায়ীদের’ ভুল শোধরাবার জন্য কেবল কবীরের দোঁহার ইংরেজি তর্জমা করেই ক্ষান্ত হতেন না, অন্তত কয়েকটি বৈষ্ণব পদের অনুবাদও সংযোজিত করে নিজের এ-দেশীয় পূর্বসূরীদের পরিচয় পূর্ণতর করতেন।

প্রকৃতপ্রস্তাবে কবীরও খেয়া-গীতাঞ্জলি রচয়িতার পূর্বসূরী ছিলেন না। রবীন্দ্র-প্রতিভার বিকাশে ভারতীয় ভাবধারার ও সৃষ্টিকর্মের পূর্বাপরতা যতখানি লক্ষণীয়, অপূর্বতা তার চেয়ে ঢের বেশী। তবে অপূর্বতা তাঁর ভুঁইফোড় ছিল না, দেশের মাটির মধ্যে বহুদূরবিস্তৃত এবং শক্ত তার শিকড়।

.

১. “The only way of expressing emotion in the form of art is by finding an ‘objective correlative’; in other words, a set of objects, a situation, a chain of events which shall be the formula of that particular emotion; such that when the external facts, are given, the emotion is immediately evoked.”

—T. S. Eliot : Essay on “Hamlet and his problems”

২. ‘অভিনব যদিও কাব্যার্থকে রস বলিয়া বলিয়াছেন এবং কাব্যের একান্ত তাৎপর্য রসের মধ্যেই ইহা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করিয়াছেন, তথাপি এই রসের মধ্য দিয়া সমগ্র বিশ্বের যে একটি অন্তর্দৃষ্টি ফুটিয়া ওঠে এবং কবি যে তাঁহার কাব্যের ভিতর দিয়া বিশ্বভুবনের সত্যকে নিত্য নবোন্মেষিণী বুদ্ধির দ্বারা রসসিক্ত করিয়া প্রকাশ করিয়া ভগবৎ-প্রাপ্তির ন্যায় চরমানন্দ লাভ করেন, তাহা তিনি মুক্তকণ্ঠে বলিয়া গিয়াছেন।’

—সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত—কাব্যবিচার, পৃ ১৩৪

৩. ‘I can only conclude that I cannot, in practice, wholly separate my poetic appreciation from my personal beliefs.’

—T. S. Eliot : Dante, p. 54

৪. ‘রবীন্দ্রনাথের পূর্বেকার ধর্ম সংগীতগুলি প্রচলিত ধর্মোপাসনার ভাব অবলম্বন করিয়াই রচিত। তখন কবির স্বকীয় কোনো অধ্যাত্ম অনুভূতি জাগে নাই—তিনি আপনার অভিজ্ঞতাকে আপন বাণীরূপে প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন নাই।’

—অজিতকুমার চক্রবর্তী, কাব্যপরিক্রমা, পৃ ১১০

৫. এই অধ্যায়টি “দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর বুদ্ধদেব বসুর ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ দ্বিতীয় বার পাঠ করে লক্ষ্য করলাম যে আমার সমস্যার কাছ ঘেঁষে তিনি নিম্নপ্রকার উক্তি করেছেন:

রবীন্দ্রনাথের সে-সব কবিতাই আমাদের পক্ষে সবচেয়ে হৃদয়- গ্রাহী, যেগুলি সবচেয়ে কম স্পষ্ট ও নিশ্চিত। তাঁর প্রতিভার এই বিশেষ চরিত্রলক্ষণটি বেরিয়ে আসে তাঁর ব্রহ্মসংগীতের সঙ্গে ‘গীতাঞ্জলি’র তুলনা করলে। ‘পদপ্রান্তে রাথ সেবকে, / শাস্তিসদন সাধনধন দেবদেব হে’ : যদি ‘গীতবিতান’-এ মুদ্রিত না থাকতো তাহ’লে এই ঈশ্বরবিশ্বাসী উত্তম-ভাবসম্পন্ন গানটিকে রবীন্দ্রনাথের রচনা ব’লে বিশ্বাস করা সহজ হ’তো না; উপরন্তু, এক ‘দুঃখতাপবিঘ্নতরণ শোকশান্ত- স্নিগ্ধচরণ’ ঈশ্বরকে রবীন্দ্রনাথের হাত থেকেও গ্রহণ করতে আমাদের কারো কারো আপত্তি হ’তে পারে। কিন্তু ‘আলোয় আলোকময় কর হে / এলে আমার আলো’— এই কবিতাটিতে ‘আলো’ বলতে কী বোঝাচ্ছে তা অস্পষ্ট ব’লেই অনাস্থার অপনোদন ঘটে, আমরা তৎক্ষণাৎ অতি সহজে কবির কাছে আত্মসমর্পণ করি। (পৃ ৮১-৮২)

কিন্তু গীতাঞ্জলির অনেক কবিতার ব্যঞ্জনা বুদ্ধদেব-উদ্ধৃত কবিতার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট ; ভগবানকে সেখানে ‘আলো’-র মতো শব্দের আড়ালে রাখা হয় নি, ‘প্রভু’, ‘নাথ’, ‘রাজার রাজা’ ইত্যাদি সম্বোধনে তাঁকে চিনতে আমাদের একটুও দেরি হয় না। গীতাঞ্জলির প্রথম কবিতাটিই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ; প্রথম ছয়টি কবিতাই উদাহরণরূপে পেশ করা যায় । এই কবিতাগুলি কি বুদ্ধদেবের কাছে ‘হৃদয়গ্রাহী’ ঠেকে না? যদি না ঠেকে তবে কি সেখানে ভগবানের অনাবরণ উপস্থিতিই তার কারণ, অন্তত অন্যতম কারণ ? তিনি কি মানেন যে কবি ও পাঠকের মধ্যে বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গির মৌল বিরোধ কাব্যরসসম্ভোগের অন্তরায় হতে পারে? তাঁর কাছ থেকে এ-প্রসঙ্গের আরও বিশদ আলোচনা পেলে আমি ( এবং আমার মতো অনেক পাঠক ) উপকৃত বোধ করব ৷

৬. শশিভূষণ দাশগুপ্ত— উপনিষদের পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ, পৃ ১৯৭

৭. চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়— বিদ্যাপতি, চণ্ডিদাস ও অন্যান্য মহাজন পদকর্তা, কবিপরিচয়

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন