আবু সয়ীদ আইয়ুব
কড়ি ও কোমল-এর মুখবন্ধে রবীন্দ্রনাথ কেন বললেন যে ‘এই আমার প্রথম কবিতার বই যার মধ্যে বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং বহির্দৃষ্টিপ্রবণতা দেখা দিয়েছে,’ তা আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়। যে-বিপুল উদ্বেল অভিজ্ঞতার কথা “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে” ব্যক্ত হয়েছে এবং গদ্যেও যার বর্ণনা একাধিক জায়গায় পেয়েছি আমরা, সেই স্বপ্নভঙ্গের সময় থেকেই জগৎচরাচরের বৈচিত্র্য তাঁকে মুগ্ধ করেছে। প্রভাতসংগীত এবং ছবি ও গান-এর চেয়ে বহির্দৃষ্টিপ্রবণতা কড়ি ও কোমল-এ অধিকতর পরিস্ফুট বলে তো মনে হয় না। সন্ধ্যাসঙ্গীত-এ অবশ্য তিনি বড়ো বেশি আত্ম-নিমজ্জিত ছিলেন, একটি সাময়িক বিচ্ছেদের ব্যথাকে সযত্নে লালন করে যেন সেই দুঃখবিলাসেই ডুবে ছিলেন। অথচ একই সময়ে লেখা “অকারণ কষ্ট” নামক প্রবন্ধে দেখা যায় যে তিনি অহেতুকী দুঃখভোগীদের প্রতি কটাক্ষ করছেন। অবশ্য কাদম্বরী দেবী কবির জীবনে বাল্যকাল থেকে এত নিবিড় ও পরিব্যাপ্ত স্থান অধিকার করে ছিলেন যে তাঁর সাময়িক বিচ্ছেদের দুঃখকেও তিনি অহেতুকী না মনে করতে পারেন। তবে এ-কথাও ঠিক যে উনিশ শতকী বাইরনিক বিষাদ এবং জার্মান রোম্যান্টিকদের জাগতিক বেদনা তরুণ রবীন্দ্রনাথের মনের উপরেও ছায়া ফেলেছিল। এই কালোচিত প্রগাঢ় বিষাদ এবং বিষণ্ণ আত্মনিমগ্নতা থেকে নিষ্ক্রমণের কাব্য প্রভাতসংগীত। সন্ধ্যাসঙ্গীত-এ দুঃখের আসন ঢালাও করেই পাতা হয়েছিল, নইলে মাস দুয়েকের জন্য বউঠাকরুন (তা তিনি যত গভীর অন্তরবাসিনী মানসী-প্রতিমাই হোন না কেন) কোথাও বেড়াতে গেলে কি সে দুঃখের প্রকাশ এমন উদ্বেল ভাষায় সম্ভব:
চলে গেল, আর কিছু নাই কহিবার।
চলে গেল, আর কিছু নাই গাহিবার।
শুধু গাহিতেছে আর শুধু কাঁদিতেছে
দীনহীন হৃদয় আমার, শুধু বলিতেছে,
‘চলে গেল সকলেই চলে গেল গো,
বুক শুধু ভেঙে গেল, দ’লে গেল গো।’
বছর তিনেকের মধ্যে কিন্তু সে চিরতরেই চলে গেল। প্রিয়জনের স্বাভাবিক, অল্প বা দীর্ঘকালের কঠিন পীড়ার পর প্রত্যাশিত মৃত্যুর জন্য আমরা কতকটা প্রস্তুত থাকি, তার আঘাত সহ্য করবার শক্তি আগে থেকেই কিছুটা সঞ্চয় করা থাকে। আপতিক মৃত্যু অনেক বেশি মর্মান্তিক। ছাব্বিশ বছর বয়সে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা চব্বিশ বছরের রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যে কত বড়ো বজ্রাঘাত তা কোনো সাহিত্যানুরাগী বাঙালির অজানা নেই। এই বুকভাঙা শোকের ছায়া পড়েছে কড়ি ও কোমল-এ। তারই গভীর থেকে গভীরতর, কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষ, কখনো বা অনভিজ্ঞ পাঠকের দৃষ্টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারে এমনই সূক্ষ্ম প্রকাশ কড়ি ও কোমল থেকে একেবারে শেষ পর্বের কাব্য পর্যন্ত ছড়ানো রয়েছে। চিত্রার “সন্ধ্যা”, উৎসর্গ-এর “আলো নাই, দিন শেষ হল,” পূরবীর “শেষ অর্ঘ্য”, বীথিকার “কৈশোরিকা”, শ্যামলীর “মিল ভাঙা”, সানাই-এর “আসা-যাওয়া”— এমনি কত অবিস্মরণীয় কবিতাই এই শোককে এবং শোকমাত্রকে শাশ্বত মহিমায় উজ্জ্বল করে এঁকে দিয়েছে আমাদের চিত্তে।
কড়ি ও কোমল-এ এই বেদনা ও নৈরাশ্যের সঙ্গে অন্য একটি সুরও বেজে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথ যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, এখানে ‘প্রথম আমি সেই কথা বলেছি যা পরবর্তী আমার কাব্যের অন্তরে অন্তরে বার-বার প্রবাহিত হয়েছে—
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
কড়ি ও কোমল-এ দুটি বিপরীত ঠাটের রাগিণী একই সঙ্গে বেজে উঠেছে— জীবনের জয়গান এবং ‘মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি’— সে-কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনাবলীর সূচনায় বিশেষরূপে জানিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে দুটি সুরই আমরা রবীন্দ্রকাব্যের গোড়া থেকে শুনতে পাচ্ছি, কড়ি ও কোমল-এ কোনোটা প্রথম বেজে ওঠেনি। লক্ষ্য করবার বিষয় যে কালানুক্রমে প্রথম শোনা গেল দুঃখের সুর, তাঁর সর্বপ্রথম কাব্যগ্রন্থ সন্ধ্যাসঙ্গীত-এ। সুন্দর ভুবনকে সানন্দ উচ্ছ্বাসে গ্রহণ করার বার্তা ঘোষিত হলো দ্বিতীয় কবিতা-সংকলন প্রভাতসংগীত-এ, অর্থাৎ সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকার এল আগে, তার পরে প্রভাত হলো, গুহার আঁধারে দেখা দিল ‘পথহারা রবির কর’। এই দুটি কড়ি ও কোমল সুর কড়ি ও কোমল নামক একই কাব্যগ্রন্থে মিলিত হয়েছে— এই পর্যন্ত। দুঃখ ও মৃত্যুর উপলব্ধি কী ভাবে কবির মনে জীবনের প্রতি উচ্ছ্বাস এবং প্রকৃতি, মানুষ ও ঈশ্বরের প্রতি প্রবল অনুরাগকে প্রভাবিত করেছে, কেমন করে তাঁর জীবনদর্শনকে স্বপ্নালুতা ও ভাবাবেগপ্রবণতা থেকে মুক্ত করে ক্রমশ গভীর, কঠিন, আত্মসচেতন ও আত্মকৌতুকময় করেছে— সমগ্র রবীন্দ্র-কাব্যকে তার বিস্তারিত ইতিবৃত্ত ভাবা যেতে পারে।
কড়ি ও কোমল কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর প্রথম প্রকাশিত বই, এবং মাত্র দু-বছর পরে প্রকাশিত। এত বড়ো শোকের অভিঘাতে মন যদি তিক্ত হয়ে থাকত তবে এই কাব্যগ্রন্থেই তা সবচেয়ে দুর্নিবাররূপে দেখা দিত। অথচ তিক্ততা এখানে লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত, শোকের কবিতা থেকেও অনুপস্থিত। বরঞ্চ সুন্দর ভুবন এবং ভুবনবাসীদের প্রতি ভালোবাসার সুস্পষ্ট প্রকাশ এ-বইখানিকে স্মরণীয় করে রেখেছে আমাদের কাছে। তবু দু-এক জায়গায় একটু খটকা লাগে। ইন্দিরা দেবীকে একটি ছন্দে লেখা চিঠিতে কবি বলেছেন:
জেনো মা এ সুখে-দুঃখে আকুল সংসারে
মেটে না সকল তুচ্ছ আশ,
তা বলিয়া অভিমানে অনন্ত তাঁহারে
কোরো না, কোরো না অবিশ্বাস।
বারো-তেরো বছরের মেয়ের মনে যতই অভিমান জাগুক, তার ফলে সে নাস্তিক হয়ে উঠবে এমন সম্ভাবনার কথা ভাবা একটু বাড়াবাড়ি। শোকবিহ্বল তরুণ রবীন্দ্রনাথ পরোক্ষে নিজেকেই বোঝাচ্ছেন না তো যে জগতের উপর যতই অভিমান হোক, ‘অনন্ত তাঁহারে’ যেন অবিশ্বাস না করেন? অবিশ্বাসের অঙ্কুর কি মনের নিভৃত কোনো কোণে ছোটো দুটি পাতা মেলেছিল? যে-বিশ্বাস হারাবার আশঙ্কা এখানে অনুমান করা যায় তা কিন্তু তখনও আপ্ত; একান্ত স্বকীয় উপলব্ধিজাত ঈশ্বরচেতনা ঐ বয়সে রবীন্দ্রনাথের মনে পরিস্ফুট হয়নি। কড়ি ও কোমল-এর কবি নিশীথের অন্ধকারে সর্বশঙ্কাহরা উষার অরুণালোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন:
হায় হায় কোথা সে অখিলের জ্যোতি
চলিব সরল পথে অশঙ্কিত গতি।
হৃদয় ডেকে ওঠে কিন্তু সাড়া নেই ত্রিভুবনে :
কে শুনেছে শতকোটি হৃদয়ের ডাক
নিশীথিনী স্তব্ধ হয়ে রয়েছে অবাক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন